হাবশায় মুসলমানদের ১ম হিজরত, রাসুলুল্লাহ ﷺ কর্তৃক আকাবার প্রথম ও দ্বিতীয় বাইয়াত/শপথ গ্রহন, মদিনায় হিজরতের নির্দেশ – প্রেক্ষাপট ও পরিবেশ পরিস্থিতি
بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیۡمِ
الحمد لله و الصلاة و السلام على رسوله محمد و على أله و أمّته
>>> মূল সূচিপত্র (index) থেকে এ পেজের পূর্ববর্তী বা পরবর্তী আলোচনা পড়তে [এখানে ক্লিক করুন]
পূর্ব আলোচনার পর…
নবুওতের ৫ম বছরে রাসুলুল্লাহ ﷺ কর্তৃক মক্কা’র মুসলমানদেরকে হাবশা’য় হিজরতের অনুমতি
….এধারার এক পার্যয়ে যখন মক্কার মুসলমানদের উপরে মুশরেকদের জুলুম নির্যাতন এতটা চরম মাত্রায় গিয়ে পৌঁছলো যে, দ্বীন ইসলাম নিয়ে মক্কায় জীবনযাপন করাটা মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত অনিরাপদ ও অসহনীয় পর্যায়ে গিয়ে ঠেঁকলো, তখন আল্লাহ তাআলা’র পক্ষ থেকে হিজরতের অনুমতি দেয়া হলে রাসুলুল্লাহ ﷺ মজলুম ও নির্যাতিত নিপীড়িত মুসলমানদেরকে মক্কা থেকে হিজরত করে অন্যত্র নিরাপদ কোথাও চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন। এ নির্দেশ ছিল আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পক্ষ থেকে ফরয নির্দেশ। যুহরী রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, ওরওয়া রহ. বর্ণনা করেন- فَلَمَّا كَثُرَ الْمُسْلِمُونَ ، وَظَهَرَ الْإِيمَانُ فَتَحَدَّثَ بِهِ الْمُشْرِكُونَ مِنْ كُفَّارِ قُرَيْشٍ بِمَنْ آمَنَ مِنْ قَبَائِلِهِمْ يُعَذِّبُونَهُمْ وَيَسْجِنُونَهُمْ ، وَأَرَادُوا فِتْنَتَهُمْ عَنْ دِينَهُمْ قَالَ : فَبَلَغَنَا أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لِلَّذِينَ آمَنُوا بِهِ : تَفَرَّقُوا فِي الْأَرْضِ قَالُوا : فَأَيْنَ نَذْهَبُ يَا رَسُولَ اللَّهِ ؟ قَالَ : هَاهُنَا وَأَشَارَ بِيَدِهِ إِلَى أَرْضِ الْحَبَشَةِ وَكَانَتْ أَحَبُّ الْأَرْضِ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُهَاجَرُ قِبَلَهَا فَهَاجَرَ نَاسٌ ذُو عَدَدٍ مِنْهُمْ مَنْ هَاجَرَ بِأَهْلِهِ ، وَمِنْهُمْ مَنْ هَاجَرَ بِنَفْسِهِ حَتَّى قَدِمُوا أَرْضَ الْحَبَشَةِ . اخرجه عبد الرزاق في مصنفه : ٥/٣٨٤ رقم ٩٧٤٣، اسناده مرسل – “(মক্কায়) যখন মুসলমানরা সংখ্যায় অনেক হয়ে গেল এবং (লোকসম্মুখে তাদের) ইমান প্রকাশ পেতে থাকলো, তখন কুরায়েশ কাফেরদের মধ্যে মুশরেকরা -তাদের কবিলাহ গুলোর মধ্য থেকে যাঁরা (রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর উপরে) ইমান আনছিলো- তাঁদের ব্যাপারে তারা আলোচনা করলো (যে, এই পরিস্থিতিকে কিভাবে সামাল দেয়া যায়)। (সে সময় মূলত:) তারা মুসলমানদেরকে (দমানোর জন্য নানান কায়দায়) নির্যাতন চালাতো ও শিকলে বেঁধে রাখতো। ওদের উদ্দেশ্য ছিল, মুসলমানদেরকে দ্বীনের ব্যাপারে ফিতনায় নিপতিত করা, (যাতে তারা দ্বীন ইসলামকে ছেড়ে দেয়)’। তিনি বলেন: ‘আমাদের কাছে খবর পৌছেছে যে, যারা (সে সময় মক্কায়) রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর প্রতি ইমান এনেছিলেন, তিঁনি তাদেরকে বললেন: ‘তোমরা (এখান থেকে হিজরাত করে) পৃথিবীর বিভিন্ন (নিরাপদ) স্থানে চলে যাও’। তারা জিজ্ঞেস করলেন: ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমরা যাবোটা কোথায়’? তিনি বললেন: ‘ওই দিকে’ -একথা বলে তিনি তাঁর হাত দিয়ে হাবশাহ’র দিকে ইশারা করলেন’। বস্তুত: (সে সময়) রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে ওটাই ছিল হিজরত করার সবথেকে পছন্দস্ই (নিরাপদ) ভূমি। ফলে তাদের মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক ব্যাক্তি হিজরত করেন, যাদের মধ্যে কেউ কেউ তার পরিবার সহ হিজরত করেন, আবার কেউ কেউ হিজরত করেন একাই। এভাবে এক সময় তাঁরা হাবশাহ’য় গিয়ে পৌছেন”। [আল-মুসান্নাফ, ইমাম আব্দুর রাজ্জাক– ৫/৩৮৪ আছার ৯৭৪৩; উয়ূনুল আছার, ইবনু সায়্যিদিন নাস- ১/১১৫; মাজমাউয যাওয়ায়ীদ, হাইছামী- ৮/৩৯]
ফলে নবুওতের ৫ম বৎসরের রজব মাসে সাহাবাগণের প্রায় পনের-ষোল জনের একটি জামাআত গোপনে হাবশা’য় (আবিসিনিয়ায়, বর্তমান ইথিওপিয়া’য়) হিজরতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। এখবর জানাজানি হয়ে গেলে মক্কার মুশরেকরা মুসলমানদের উপরে নজরদারী ও জুলুম অত্যাচারের মাত্রা আরো বারিয়ে দেয়। যে কারণে আরো প্রায় এক’শ জনের মতো মুসলমান মক্কা থেকে হিজরত করে হাবশায় যেতে সমর্থ হন। যেসকল মুসলমান হাবশায় হিজরত করেছিলেন, তাঁরা সে দেশের খৃষ্টান সম্রাটের অধীনে কিছু দিন নিরাপত্তার সাথে বসবাস করছিলেন বটে, কিন্তু মক্কার মুশরেকরা মাসলমানদের না মক্কা ত্যাগের বিষয়টিকে মেনে নিতে পারছিল, আর না তাদের হাবশায় নিরাপদে নিশ্চিন্তে থাকার বিষয়টিকে তারা সহ্য করতে পারছিলো। ফলে মক্কার গণ্যমান্য লোকদের একটি দল সুদূর সফর করে গেল হাবশাহ’য়, যাতে সেখানে অবস্থানরত সকল মুসলমানকে পূণরায় মক্কায় ফিরিয়ে আনতে পারে। সেখানে উপস্থিত হয়ে দলটি হাবশাহ’র তৎকালীন সম্রাট নাজ্জাশী’র কাছে তার রাজ্যে আশ্রয় নেয়া মুসলমানদেরকে মক্কায় পূণরায় ফিরিয়ে নেয়ার জন্য অবেদন করলো। কিন্তু মুসলমানরা নাজ্জাশী’কে বুঝাতে সমর্থ হয় যে, ইতিপূর্বে মক্কায় তাদের উপরে মুশরেকরা কেনো কী পরিমাণ জুলুম নির্যাতন করেছে এবং কেনো তারা মক্কায় ফিরে যেতে চান না, বরং হাবশায় নিরাপত্তার সাথে বসবাসের সুযোগ চান। নাজ্জাশী সব শুনে এবং মুসলমানদের অবস্থা উপলব্ধি করতে পেরে মুশরেক দলটির আবেদন নাকোচ করে দেন এবং মুসলমানদেরকে নিরাপত্তার সাথে তার রাজ্যে বসবাসের সুযোগ করে দেন। ফলে মুশরেকরা সেবারের মতো নিরাশ হয়ে মক্কায় ফিরে আসে। [মাজমাউয যাওয়ায়ীদ, হাইছামী- ৬/৩০; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইবনে কাছির- ৩/৭৫]
মুশরকেদের জুলুমের মুখে মুসলমানদের মধ্যে যারা হাবশায় হিজরত করার তারা তো হাবশায় হিজরত করলেন, তবে মুসলমানদের মধ্যে কেউ কেউ এমনও ছিলেন যারা এই পরিকল্পনা নিয়ে মক্কায় থেকে গেলেন যে, সম্ভব হলে তারা মুশরেকদের জুলুমের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিবেন, কিংবা সুযোগ বুঝে জালেম মুশরেকদেরকে গোপনে গোপনে কৌশলে গুপ্ত হত্যা করবেন ইত্যাদি। তখন তাদের এজাতীয় অমুলক চিন্তা পরিহার করার ইংগীত দিয়ে এবং অচিরেই তাঁদেরকে মক্কার মুশরেকদের জুুলুম ও অন্যায় অত্যাচার থেকে (পর্যায়েক্রমে) রক্ষা করার আগাম সুসংবাদ সহকারে নিম্নের (সুরা হজ্জের ৩৮ নং) এই আয়াতটি নাজিল হয়। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-
إِنَّ اللَّهَ يُدَافِعُ عَنِ الَّذِينَ آمَنُوا ۗ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ خَوَّانٍ كَفُورٍ
“যারা ইমান এনেছে, নিশ্চই আল্লাহ (তাআলা) -তাদেরকে (কাফেরদের জুলুম অত্যাচার ও অনিষ্টতা থেকে) দিফা (রক্ষা) করবেন। নিশ্চই -(যারা আল্লাহ’র দেয়া আমানতকে শয়তানের রাস্তায়) খিয়ানতে-অভ্যস্ত (এবং আল্লাহ’র নিয়ামতকে অস্বীকারকারী) অকৃতজ্ঞ -(এমন) কাউকেই আল্লাহ (তাআলা) ভালোবাসেন না”। [সূরা হজ্জ ৩৮]
বস্তুত: এই আয়াতের মাধ্যমে এই সুসংবাদবহ ইংগীত দান করা হয়েছিল যে, “ওই দিন বেশি দূরে নয়, যখন আল্লাহ’র ফজল ও সাহায্য আসবে, ফলে মক্কার মুশরেকদের জুলুম ও অন্যায় অত্যাচারের উপরে মুখবুঝে সবর (ধৈর্যধারন) করার দিনে শেষ হয়ে আসবে, মুসলমানরা দল বেঁধে মক্কা থেকে অন্য কোনো নিরাপদ অঞ্চলে (মদিনায়) হিজরত করবে, সেখানে রাষ্ট্রক্ষমতা ও যুদ্ধশক্তি দান করা হবে, ফলে একসময় মুসলমানদের হাতেই এসব কাফের-মুশরকেরা পরাস্ত ও প্রতিহত হবে, অবশেষে মুসলমানরাই কাফের মুশরেকদের উপরে বিজয়ী হয়ে জমিনে প্রবল ও পরাক্রান্ত হয়ে উঠবে। এভাবেই আল্লাহ তাআলা মুমিনগণকে কাফের-মুশরেকদের হাত থেকে রক্ষা করবেন”। [তাফসীরে বাহরুল উলূম, ইমাম আবুল লাইস সমরকন্দি- ২/৪৬১; আল-বাসিত্ব, ইমাম ওয়াহিদী- ১৫/৪২১; আল-জামে’ লি আহকামিল কুরআন, ইমাম কুরতুবী- ১২/৬৭; ছফওয়াতুত তাাসীর, মুহাম্মাদ আলী সাবুনী- ২/২৬৭; তাফসীরুল ওয়াসিত, ওয়াহবাহ যুহাইলী- ২/১৬৫০; জাহরাতুত তাফাসীর, আবু জাহরাহ- ৯/৪৯৯১]
ইকরিমাহ রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রা. বর্ণনা করেন- أَنَّ عَبْدَ الرَّحْمَنِ بْنَ عَوْفٍ ، وَأَصْحَابًا ، لَهُ أَتَوَا النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِمَكَّةَ فَقَالُوا : يَا نَبِيَّ اللَّهِ ، إِنَّا كُنَّا فِي عَزٍّ وَنَحْنُ مُشْرِكُونَ ، فَلَمَّا آمَنَّا صِرْنَا أَذِلَّةً ، فَقَالَ : إِنِّي أُمِرْتُ بِالْعَفْوِ ، فَلَا تُقَاتِلُوا الْقَوْمَ . رواه النسائي في السنن الكبرى , كتاب التفسير , قوله تعالى : ألم تر إلى الذين قيل لهم كفوا أيديكم : ١٠/٦٨ رقم ١١٠٤٧، و في السنن الصغرى , كتاب الجهاد , باب وجوب الجهاد : ٣/٦ رقم ٣٠٨٦ ، قال مقبل بن هادي الوادعي في الجامع الصحيح مما ليس في الصحيحين : ٥/٤٦٠ : هذا حديث صحيح رجاله رجال الصحيح، و قال الألباني في صحيح النسائي : رقم: ٣٠٨٦ : إسناده صحيح ، و الحاكم في المستدرك على الصحيحين , كتاب الجهاد : ٢/٣٨٢ رقم ٢٤٢٤ و قال: هذا حديث صحيح على شرط البخاري و لم يخرجاه و وافقه الذهبي، و قال كمال بسيوني زغلول الناشر في تحقيقه علي أسباب نزول القرآن : ١/١٦٧: إسناده صحيح – “(একবার) মক্কায় (থাকাবস্থায়) আব্দুর রহমান বিন আউফ তার কিছু সঙ্গিসাথি সহ নবী ﷺ-এর কাছে এসে বললেন: ‘আল্লাহ’র নবী! আমরা (জাহেলিয়াতের জামানায়) মুশরিক অবস্থায় ইজ্জত সম্মানের সাথে ছিলাম। আর আমরা যখন (থেকে আপনার উপরে) ইমান এনেছি তখন (থেকেই এসব কাফের মুশরেকদের হাতে) জিল্লত-অপদস্ততার শিকার হয়ে পড়েছি, (আমরা আর তাদের হাতে মার খেতে থাকবো? আমরা কেনো তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিচ্ছি না?)’। তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন: ‘আমাকে ক্ষমা করে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কাজেই (আল্লাহ’র পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট হুকুম না আসা পর্যন্ত) তোমরা (তোমাদের) কওমের সাথে কিতাল (সশস্ত্র যুদ্ধ) করো না”। [সুনানুল কুবরা, ইমাম নাসায়ী- ১০/৬৮ হাদিস ১১০৪৭; সুনানুস সুগরা, ইমাম নাসায়ী- ৬/৩ হাদিস ৩০৮৬; মুসতাদরাকে হাকিম- ২/৩৮৩ হাদিস ২৪২৪; সুনানুল কুবরা, ইমাম বাইহাকী- ৯/১৯ হাদিস ১৭৭৪১; জামেউল বয়ান, ইমাম তাবারী- ৫/২৩৪]
উপরের আয়াত ও এই হাদিসটি থেকে বোঝা যায়, তখনও পর্যন্ত মক্কার মুসলমানদের জন্য আল্লাহ তরফ থেকে সশস্ত্র জিহাদের কোনো অনুমতি আসেনি। তখনকার জন্য মক্কার মুসলমানদের বড় জিহাদ ছিল, মক্কার কাফের মুশরিকদের কাছে ইসলামের দাওয়াত ও আল্লাহ’র বানী পৌছে দেয়া এবং এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যে বিপদ আসে তার উপরে সবর (ধৈর্যধারণ) করা এবং কাফেরদের অন্যায় জুলুম অত্যাচারগুলোকে আল্লাহ’র ওয়াস্তে ক্ষমা করতে থাকা। যেমন আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-
فَلَا تُطِعِ الْكَافِرِينَ وَجَاهِدْهُم بِهِ جِهَادًا كَبِيرًا
“সুতরাং, (হে নবী মুহাম্মাদ!) তুমি কাফেরদের অনুগত্য করো না এবং তাদের সাথে এ(ই কুরআনে)র দ্বারা জিহাদ করো -বিশাল (এক) জিহাদ”। [সূরা ফুরকান ৫২]
قُل لِّلَّذِينَ آمَنُوا يَغْفِرُوا لِلَّذِينَ لَا يَرْجُونَ أَيَّامَ اللَّهِ لِيَجْزِيَ قَوْمًا بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ
“(হে নবী!) যারা ইমান এনেছে তুমি (তাদেরকে) বলে দাও, তারা (যেন) ওদেরকে ক্ষমা করে দেয় যারা আল্লাহ’র (পরকালে প্রতিশ্রুত) দিনগুলোর আকাঙ্খা রাখে না। (এটা এজন্য), যাতে তিঁনি প্রত্যেক গোষ্ঠিকে তাদের কৃতকর্মের প্রতিফল দিতে পারেন”। [সূরা জাশিয়াহ ১৪]
নবুওতের ৬ষ্ঠ থেকে ১১ তম বছর পর্যন্ত – কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা
এ ব্যার্থতার পর এই জালেম মুশরিকরা মক্কায় বিদ্যমান মুসলমানদের উপরে অত্যাচার নির্যাতনের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়। বিশেষ করে মক্কার কুরাইশী নেতা ও গণ্যমান্য ব্যাক্তিদের মধ্যে -ইসলামে শুরুর দিকে আবু বকর সিদ্দিক রা ও ওসমান বিন আফফান রা, তার কিছু কাল পর বিশেষ করে হযরত হামযা রা. এবং তারও পরে (নবুওতের ৬ষ্ঠ বছরে) হযরত ওমর রা. প্রমুখ একে একে ইসলাম গ্রহন করতে থাকায় এবং দিনকে দিন মুসলমানদের সংখ্যা অচিন্তনীয় ভাবে বাড়ে চলতে থাকায় মক্কার কাফের সর্দার’দের টনক ভাল করেই নড়েচড়ে ওঠে। তারা বেশ ভালো করেই উপলব্ধি করতে থাকে যে, এবারে ইসলাম এবং মুসলমানদেরকে গোড়া থেকে উপড়ে ফেলা ছাড়া তাদের ‘বাপদাদা পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্যমাখা (শিরকী) দ্বীন’ রক্ষা করাই অনতিদূরে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। এজন্য মক্কার বিভিন্ন গোত্রের প্রভাবশালী সর্দার, নেতা ও গণ্যমান্যরা একত্রে সিদ্ধান্ত নেয় যে, মুসলমানরা তাদের দ্বীন ইসলাম থেকে পূণরায় তাদের পূর্বপুরুষদের ধর্মে ফিরে না আসা পর্যন্ত তাদের সকলকে সম্ভাব্য সর্বদিক দিয়ে বয়কট করা হবে, তাদের সাথে মক্কার কেউ দেখাসাক্ষাত করতে পারবে না, তাদেরকে কোনো রকম খাবার পানীয়ও সরবরাহ করতে পারবে না ইত্যাদি। এই সিদ্ধান্ত নেয়ার পর তারা ‘নবুওতের ৭ম বৎসরের মুহাররম মাস’ থেকে মক্কায় অবস্থানরত মুসলমানদেরকে সামাজিক ভাবে বয়কট করে “শে’বে আবু তালেব” এলাকায় অবরুদ্ধ জীবনযাপনে বাধ্য করে রাখে। সেসময় কষ্টের মাত্রা এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেঁকেছিল যে, মুসলমানদের কেউ কেউ দুই-তিন দিন পর মুখে কিছু দেয়ার সুযোগ পেতো, এমনকি তারা বাবলা গাছের পাতা খেয়ে কোনো মতে জীবন ধারণের চেষ্টা করেছেন, ক্ষুধার যন্ত্রনায় বাচ্চাদের ক্রন্দনের রোল পড়ে যেতো। কেউ কেউ খুবই গোপনে গোপনে তাদের কারোর কারোর কাছে খাবার দাবার সরবরাহ করতো, ওগুলোই যে যতটুকু পারতো খেয়ে কোনো রকমে জীবন বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করতো। এধারা সুদীর্ঘ তিন বছরের মতো চলার পর তথা নবুওতের ৯ম বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই মুসলমানরা ওই বয়কট থেকে মুক্তি লাভ করে। এছরেই হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা. হাবশা’য় হিজরতের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন, কিন্তু পথিমধ্যে কারা গোত্রের সর্দার ইবনুদ দাগুনার সাথে সাক্ষাত হলে সে তাঁর হিজরতের ইচ্ছার কারণ জানতে পেরে তাঁকে নিজের নিরাপত্তা দিয়ে মক্কায় ফিরিয়ে আনে।
“শে’বে আবু তালেব”-এর ৩ বছরের শ্বাসরুদ্ধ অবরুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি লাভের পর ‘নবুওতের ১০ম বৎসরের’- প্রথম থেকেই মুসলমানদের উপরে কাফেরদের নজরদারী আরো বেড়ে যায়, যাতে আর নতুন কেউ ইসলাম কবুল করতে না পারে এবং যাতে পুরাতন মুসলমানরাও কোনঠাসা হয়ে থাকে। কিন্তু মুসলমারা যতটা সম্ভব নিজেদের ইসলামকে গোপনে গোপনে মেনে চলা এবং গোপনে গোপনে দ্বীনের প্রচার প্রসারের কাজ চালাতে থাকে। কিন্তু কোনো না কোনো ভাবে এইসবক বিষয় আর গোপন হয়ে থাকে না, বরং ঠিকই তা কাফের সর্দারদের কানে যেতে থাকে। তখন কাফেররা উপলব্ধি করতে থাকে যে, এত জুলুম নির্যাতন চালানোর পরও ইসলাম ও মুসলমানদের প্রসারের গতি কোনো ভাবে রুদ্ধ করাতো দূরের কথা, বরং দিনকে দিন মুসলমানদের সংখ্যা শঙ্কাজনক ভাবে বেড়েই চলেছে, পাছে না তাদের নিজেদের সর্দারগীরী ও বাপ-দাদা-পূর্বপুরুষদের ধর্মই মক্কায় হুমকির মুখে পড়ে!!!
এরপর ‘নবুওতের ১০ম বৎসরের রমজান অথবা শাওয়াল মাস’-এর মধ্যেই রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর চাচা আবু ত্বালেব মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর আগে মক্কার নেতৃস্থানীয় কুরায়েশরা যখন তার মুমূর্য় অবস্থঅর খবর পেলো, তখন তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করলো যে, হামযা ইবনু আব্দিল মুত্তালিব এবং ওমর ইবনুল খাত্তাব-এর মতো লোকও ইসলাম কবুল করে ফেলেছে, এদিকে ইসলামও বেশ ছড়িয়ে পড়েছে, এটাই শেষ সুযোগ যে, আবু তালেবকে বলে কয়ে মুহাম্মাদ ﷺ এবং তাদের মাঝে যা নিয়ে মক্কায় দ্বন্দ্ব তৈরী হয়েছে তার অবসান করা হোক। কারণ কুরায়েশরা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিল যে, সেদিনটি বেশি দূরে নয়, যখন মুসলমানরা মক্কার উপরে চড়াও হয়ে আসবে। এজন্য তারা শেষ বারের মতো আবারো দল বেঁধে আবু তালেবের সাথে সাক্ষাত করলো এবং বললো: وَ قَدْ حَضَرَكَ مَا تَرَى وَتَخَوَّفْنَا عَلَيْكَ وَ قَدْ عَلِمْتَ الَّذِي بَيْنَنَا وَبَيْنَ ابْنِ أَخِيكَ فَادْعُهُ فخذ له مِنَّا و خذ لنا منه لِيَكُفَّ عَنَّا وَ نَكُفّ عَنْهُ، وَ لِيَدَعَنَا وَ دِينَنَا وَ لِنَدَعَهُ وَ دِينَهُ – “আপনি দেখছেন আপনি এখন অন্তিম মুহূর্তে; (কখন আপনার জীবন চলে যায় -এ নিয়ে) আমরাও আপনার ব্যাপারে শংকিত। আর আপনি তো অবগত আছেন যে, আমাদের এবং আপনার ভাতিজার মধ্যে কী চলছে। সুতরাং, (এটাই ভালো হয় যে), আপনি আমাদের থেকে (কিছু শর্ত ও অঙ্ঘিকার নিয়ে) তাকে দিন এবং তার থেকে (কিছু শর্ত ও অঙ্ঘিকার নিয়ে) আমাদেরকে দিন, যাতে সেও আমাদের (বিষয়াদি) থেকে বিরত থাকে এবং আমরাও তার (বিষয়াদি) থেকে বিরত থাকি, যাতে গ্রহন করুক ”। আবু তালেব যখন রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে কুরায়েশদের এসব দাবী বিবেচনা করার জন্য বললেন, তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন- نعم ، كلمة واحدة تعطونيها تملكون بها العرب ، وتدين لكم بها العجم – “বেশ, আপনারা (শুধু) একটিমাত্র কথাকে আমার থেকে গ্রহন করুন, এতে আপনারা গোট আরবের মালিক হয়ে যাবেন এবং এর কারণে অনারবরাও আপনাদের করতলগত হয়ে যাবে”। তখন আবু জাহল আশা নিয়ে বললো: نَعَمْ وَأَبِيكَ وَعَشْرَ كَلَمَّاتٍ – “বেশ তো, তোমার পিতার কসম, (এমন হলে তো এটি কথা কেনো) দশটি কথা (বলতে পারো, বেটা)”। রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন- تقولون : لا إله إلا الله ، وتخلعون ما تعبدون من دونه – “(তাহলে) আপনারা বলুন: আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ (উপাস্য) নেই, আর (এর সাথে সাথে) আপনারা আল্লাহ’কে বাদ দিয়ে যাদের ইবাদত (পূজা-অর্চনা) করেন সেগুলোকে পরিত্যাগ করুন”। একথা শুনে তারা (ব্যাঙ্গার্থে) হাত তালি দিয়ে বলে ওঠে- أَتُرِيدُ أَنْ تَجْعَلَ الْآلِهَةَ إِلَهًا وَاحِدًا؟! إِنَّ أَمْرَكَ لَعَجَبٌ – “হে মুহাম্মাদ! (আজও) তুমি চাচ্ছো যে, তুমি (আমাদের অনেক) উপাস্য(দেব-দেবী)দেরকে (শুধুমাত্র) একজন উপাস্যে পরিণত করবে। তোমার এ কাজ সত্যই আশ্চর্যের, (দেখছি, এখনো তুমি তোমার পূর্বের দাবী ছাড়ছো না)”। তারপর তারা একে অপরকে একথা বলে সে স্থান ত্যাগ করে যে- إِنَّهُ وَاللَّهِ مَا هَذَا الرَّجُلُ بِمُعْطِيكُمْ شَيْئًا مِمَّا تُرِيدُونَ، فَانْطَلِقُوا وَامْضُوا عَلَى دِينِ آبَائِكُمْ حَتَّى يَحْكُمَ اللَّهُ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُ – “আল্লাহ’র কসম! তোমরা যা চাও, তার কিছুই দেয়ার মতো পাত্র সে মোটেও নয়। সুতরাং, তোমরা এখান থেকে চলো। তোমরা তোমাদের বাপ-দাদা-পূর্বপুরুষদের দ্বীন-ধর্মের উপরেই চলতে থাকো, যাবৎ না আল্লাহ -আমাদের ও তার মাঝে ফয়সালা করে দেন”। [সিরাতে ইবনে হিশাম- ১/৪১৮; আত-ত্বাবাকাত, ইবনে সা’দ- ১/১৫৮; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ইবনে হাছির- ৩/১২৩] একই বছর আবু তালেবের মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন পর রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর স্ত্রী খাদিজাহ বিনতে খাওয়াইলীদ রা. মৃত্যুবরন করেন।
চাচা আবু তালেব এবং স্ত্রী খাদিজা রা. দুজনই দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়ার পর রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর বংশীয় গোত্রিয় কিংভা আত্বীয়তার দিক থেকে এমন আর কেউই অবশিষ্ট রইলো না, যার সামাজিক প্রভাবের কারণে মক্কায় রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর জান মাল কুরায়েশদের থেকে নিরাপদ থাকতে পারতো। একজন সাপোর্টকারী যাও ছিলেন তাঁর হাশেমী কুরায়েশী চাচা আব্বাস বিন আব্দিল মুত্তালীব, তিনিও ছিলেন রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর সম-সয়সী যুবক, যিনি কারায়েশ নেতৃস্থানীয় মোড়লদের সামনে কোনো রকম প্রভাব সৃষ্টি করার মতো ক্ষমতা রাখতেন না। ফলে রাসুলুল্লাহ ﷺ মক্কায় এখন সম্পূর্ণ একা ও অ-নিরাপদ হয়ে গেলেন। ফলে মক্কার মুশরেক নেতৃস্থানীয়রা এবারে যুৎসই মওকা হাতে পেয়ে গেল রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে তাঁর আনিত দ্বীন ইসলাম সহ সমূলে উৎপাটন করে ফেলার। রাসুলুল্লাহ ﷺ খুব ভালো করেই তাঁর এই অনিরাপত্তার বিষয়টি বুঝতে পারছিলেন, এজন্য তিঁনি কিছুদিন পর্যন্ত গৃহের মধ্যেই বেশির ভাগ সময় আবদ্ধ হয়ে থাকতেন; বেশি একটা বাইরে বের হতেন না এবং বাইরে বের হলেও কুরায়েশ নেতাদের নজরে না পড়ার মতো অবস্থায় থাকতে চেষ্টা করতেন। একথা জনতে পেরে তাঁর চাচা আবু লাহাব এসে তাঁকে বলে: يَا مُحَمَّدُ امْضِ لِمَا أَرَدْتَ وَمَا كُنْتَ صَانِعًا إِذْ كَانَ أَبُو طَالِبٍ حَيًّا فَاصْنَعْهُ. لا وَاللاتِ لا يُوصَلُ إِلَيْكَ حَتَّى أَمُوتَ – “হে মুহাম্মাদ! আবু তালেব যখন বেঁচে ছিল, তখন তুমি যে উদ্দেশ্যে (পা বাড়াতে, এবার সেই উদ্দেশ্যে) পা বাড়াও (দেখি), আর তখন যা করতে এখন সেটা করো (দেখি)। লা’ত-এর কসম, কক্ষোনো নয়, আমি বেঁচে থাকতে তোমার ভাগ্যে তা জুটবে না”। [আত-ত্বাবাকাত, ইবনে সা’দ- ১/১৬৪] এরপর এভাবেই বেশ কিছু একা একা অনিরাপত্তার সাথে দিন কেটে গেলো।
এরপর ‘নবুওতের ১০ম বৎসরের শাওয়াল মাস’-এর একদিন বাকি থাকতেই রাসুলুল্লাহ ﷺ কেবলমাত্র যায়েদ বিন হারেসাহ রা.-কে সঙ্গে নিয়ে একাই ত্বায়েফ সফর করেন -এই আশায় যে, তারা হয় তো দ্বীন ইসলাম কবুল করবে এবং তাঁকে তাদের মাঝে নিরাপত্তা দিয়ে মক্কার কুরায়েশদের হাত থেকে রক্ষা করবে ও দ্বীনের সাহায্য করবে। তিঁনি সেখানে ১০ দিনের মতো ছিলেন। কিন্তু হল তাঁর আশার সম্পূর্ণ বিপরীত। ত্বায়েফ-এ বসবাসকারী ‘নবু সাকীফ’ গোত্রের নেতৃস্থানীয়রা রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কথা শুনে তাঁকে মুখের উপরে অপমান করে তাঁর আহবান সরাসরি প্রত্যাক্ষান করলো এবং তাদের শহর থেকে তাঁকে বের হয়ে যেতে বললো। রাসুলুল্লাহ ﷺ উঠে চলে যাবার সময় তাদেরকে বললেন, তারা যেন তাঁর এ উদ্দেশ্যে এখানে আগমনের কথাটি লোকদের থেকে গোপন রাখে। কিন্তু তারা রাসুলুল্লাহ ﷺ-এ কথাতো রাখলোই না, উল্টো তাঁর পিছনে লোকজন, দাস-দাসী ও ছেলেপুলেকে লেলিয়ে দিলো, যারা হৈচৈ করে রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে পিছু থেকে তাড়া করছিল, আর তাঁকে এলোপাথাড়ি ইটপাটকেল ও পাথড় কড়ি নিক্ষেপ করছিল, যার কারণে তার পা দুখানি ক্ষতবিক্ষত হয়ে রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়, আর যায়েদ বিন হারেসাহ রা. নিজ শরীর দিয়ে রাসুলুল্লাহ ﷺকে বাঁচাতে গিয়ে তার মাথা ও শরীর ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত হয়ে যায়। তাঁরা দুজনে কোনো রকমে একটি খেজুর বাগানে আশ্রয় নেন, যেটা ছিল মক্কার উৎবাহ ও শাইবাহ’র বাগান। তাঁরা ব্যাথা বেদনা ও ক্লান্তিতে জর্জরিত হয়ে পড়ায় কিচুক্ষন সেখানে বিশ্রাম নেন। এসময় উৎবাহ ও শাইবাহ এদৃশ্য দূর থেকে লক্ষ্য করছিল, তারা কিছুটা দয়াপরবশ হয়ে তাদের বাগানের দেখাশুনাকারী আদ্দাসের মাধ্যমে কিছু খেজুরও রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে পাঠিয়েছিলেন। এরপর তাঁরা দুজন মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। ফেরার পথে তারা ‘নাখলাহ’ নামক স্থানে কয়েকদিন অবস্থান করেন এবং সখোনেই এক রাতে নামাযে তেলাওয়াত রত অবস্থায় ৭জন জ্বীন তাঁর তিলাওয়াত শুনে মুগ্ধ হয়ে নিজেদের জাতীর কাছে গিয়ে খবর দেয়ার ঘটনা ঘটে, যার ইংগীত সুরা জ্বিন-এর ২৯-৩২ নং আয়াতে রয়েছে।
ত্বায়েফের এ ঘটনার পর রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর জন্য মক্কায় ঢোকাটা আরো বেশি অ-নিরাপদ হয়ে যায়। কারণ –হয় এতক্ষনে কুরায়েশরা এখবর জেনে ফেলেছে অথবা অচিরেই জেনে ফেলবে যে, “তাদের দুশমন মুহাম্মাদ (ﷺ) তাদেরই বিরুদ্ধে লোক দাঁড় করানোর জন্য ত্বায়েফে গিয়েছিল”; এমতাবস্থায় তিঁনি মক্কায় প্রবেশ করলে তো কুরায়েশরা তাঁকে জানেই খেয়ে ফেলবে। যায়েদ বিন হারেসাহ রা. বললেন: كَيْفَ تَدْخُلُ عَلَيْهِمْ. يَعْنِي قُرَيْشًا. وَهُمْ أَخْرَجُوكَ؟ – “(ইয়া রাসুলাল্লাহ! এখন কুরায়েশ কাছে কেমনে যাবেন; তারাই তো আপনাকে (মক্কা থেকে) বের করে দিয়েছে”। এজন্য রাসুলুল্লাহ ﷺ যখন মক্কার নিকটবর্তী হলেন, তখন প্রথমেই মক্কায় না ঢুকে আগে উরাইক্বাত্ব নামক এক লোককে পাঠিয়ে আখনাস ইবনে শুরায়েক নামক এক ব্যাক্তির কাছে নিরাপত্তা-আশ্রয় চাইলেন, কিন্তু সে এই বলে এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলো যে- إِنَّ حَلِيفَ قُرَيْشٍ لَا يُجِيرُ عَلَى صَمِيمِهَا – “(আমরা) কুরায়েশদের (মিত্র; তাদের) সাথে (আমরা) চুক্তিবদ্ধ। (কাজেই) তাদের (মাঝে দ্বন্দ্ব ও বিরোধ সৃষ্টিকারী) মূল-হোতা’র জন্য (আমাদের কাছে) কোনো আশ্রয় নেই”। এখানে আশ্রয় না পেয়ে রাসুলুল্লাহ ﷺ উরাইক্বাত্ব’কে পাঠান সুহাইল বিন আমর নামক এক ব্যাক্তির কাছে নিরাপত্তা-আশ্রয় চেয়ে। সেও এই বলে এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে যে- إِنَّ بَنِي عَامِرِ بْنِ لُؤَيٍّ لَا تُجِيرُ عَلَى بَنِي كَعْبِ بْنِ لُؤَيٍّ – “(আমরা) বনু আমের বিন লুওয়াই (-এর বংশধর, আর সে) তার বিরোধীপক্ষ বনু কা’ব বিন লুওয়াই-কে আশ্রয় দেয় না”। এখানেও আশ্রয় না পেয়ে রাসুলুল্লাহ ﷺ নিরাপত্তা-আশ্রয় চেয়ে প্রস্তাব পাঠান (খুযাআ গোত্রের) মুতঈম বিন আদী’র কাছে। মুতঈম বিন আদী তাঁকে নিরাপত্তা-আশ্রয় দিতে রাজি হলেন, ফলে রাসুলুল্লাহ ﷺ তার কাছে গিয়ে সেই রাতটি তার ওখানে থাকলেন। পরের দিন সকালে মুতঈম বিন আদী তার ৬/৭জন ছেলে এবং তার কওমের লোকদেরকে উদ্দেশ্য করে ঘোষনা দিলেন: تَلَبَّسُوا السِّلاحَ وَكُونُوا عِنْدَ أَرْكَانِ الْبَيْتِ فَإِنِّي قَدْ أَجَرْتُ مُحَمَّدًا – “তোমরা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বায়তুল্লাহ’র চার ধারে অবস্থান নাও, আমি মুহাম্মাদকে নিরাপত্তা-আশ্রয় দিয়েছি”। এরপর তারা রাসুলুল্লাহ ﷺ ও যায়েদ রা.-কে সঙ্গে নিয়ে সোজা মসজিদে-হারামে প্রবেশ করলেন এবং উচ্চ স্বরে বললেন: يَا مَعْشَرَ قُرَيْشٍ إِنِّي قَدْ أَجَرْتُ مُحَمَّدًا فَلا يَهْجُهُ أَحَدٌ مِنْكُمْ – “হে কুরায়েশগণ ! মুহাম্মাদকে আমি নিরাপত্তা-আশ্রয় দিয়েছি। সুতরাং, তোমদের কেউ যেন তাঁর ক্ষতি না করে”। এরপ মুতঈম নিজেই রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে তাওয়াফ করতে বলেন। এরই মধ্যে একসময় আবু সুফিয়ান সেখানে এসে মুতঈমকে জিজ্ঞেস করলো- أمجير أو تَابِعٌ – “(সত্য সত্য বলেন) আপনি কি (মুহাম্মাদের) আশ্রয়দাতা, নাকি (তাঁর) অনুসারী(দের একজন হয়ে গেছেন)”? মুতঈম বলেন-لَا بَلْ مُجِيرٌ – “(আমি ওনার অনুসারী কেউ) না, বরং (শুধুমাত্র) আশ্রয়দাতা”। তখন আবু সুফিয়ান তাকে বললো- إِذًا لَا تُخْفَرُ – “তাহলে আপনাকে লাঞ্চিত-অপমানিত করা হবে না”। এরপর মুতঈম বিন আদী তার ছেলেদেরকে নিয়ে চলে যায়। [আত-ত্বাবাকাত, ইমাম ইবনে সা’দ- ১/১৬৫; মাজাগীয়ে আল-উমারী : আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ইবনে কাছির- ৩/১৩৭] রাসুলুল্লাহ ﷺ মদিনায় হিজরতের কিছুদিন পর মুতঈল ইন্তেকাল করেন। বদর যুদ্ধের দিন যুদ্ধ-বন্দীদের সম্পর্কে বলেছিলেন- لَوْ كَانَ الْمُطْعِمُ بْنُ عَدِيٍّ حَيًّا ثُمَّ سألني في هؤلاء النقباء لَوَهَبْتُهُمْ لَهُ . رواه البخاري في صحيحه , كتاب فرض الخمس , باب ما من النبي صلى الله عليه وسلم على الأسارى من غير أن يخمس : ٤/٩١ رقم ٣١٣٩ – “(আজ) যদি মুুতঈম বিন আদী বেঁচে থাকতো, আর এইসব নকীবদের ব্যাপারে আমার কাছে (মুক্তির) আবেদন করতো, তাহলে তার খাতিরে আমি অবশ্যই এদেরকে ছেড়ে দিতাম”। [সহিহ বুখারী- ৪/৯১ হাদিস ৩১৩৯]
রাসুলুল্লাহ ﷺ আপাতত তো মুতঈমের নিরাপত্তা-আশ্রয়ে মক্কায় থেকে গেলেন সত্য, কিন্তু ত্বায়েফের ঘটনা কুরায়েশদের কানে যাওয়ার পর থেকে তিঁনি তাদের ভিষন ভাবে তাদের রোশানলে পড়ে গেলেন। পরিবেশ বিবেচনা করে রাসুলুল্লাহ ﷺ বুঝতে পারছিলেন যে, মুতঈমের এই নিরপত্তার বাঁধ কুরায়েশদের অগ্নীচক্ষুর তাপের সামনে বেশিদিন টিকবার নয়, তাই তাঁর প্রয়োজন ছিল এমন একটি নিরাপত্তা-আশ্রয়ের, যেখানে তিঁনি অন্তত: বুক টান করে বেঁচে থাকতে পারবেন তাঁর মিশনকে মূল লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এসময় আল্লাহ তাআলা রাসুলুল্লাহ ﷺকে নির্দেশ দিলেন, তিঁনি যেন আরব গোত্রগুলোর কাছে নিজকে পেশ করেন -এই মর্মে যে, তারা তাঁকে তাঁর ও তাঁর আনিত দ্বীনের হিফাজত ও প্রচার প্রসারের জন্য কুরায়েশদের মুকাবেলায় তাঁকে নিরাপত্তা আশ্রয় দিতে পারবে কিনা। রাসুলুল্লাহ ﷺ এই নির্দেশ পাওয়ার পর (ত্বায়েফের ঘটনার মাত্র দু মাস পর) তথা ‘নবুওতের ১০ম বৎসরের জ্বিলহজ্জ মাসে হজ্জের উদ্দেশ্যে দূরদূরান্ত থেকে আগত আরবদের বিভিন্ন সমাবেশে গিয়ে তাদের কাছে দ্বীন ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন এবং নিজকে তাদের নিরাপত্তা-আশ্রয়ে নেয়ার জন্য আবেদন জানাতে থাকেন। ইকরিমাহ রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বর্ণনা করেন- حَدَّثَنِي عَلِيُّ بْنُ أَبِي طَالِبٍ مِنْ فِيهِ، قَالَ: «لَمَّا أَمَرَ اللهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى رَسُولَهُ صَلَّى الله عليه وآله وَسَلَّمَ أَنْ يَعْرِضَ نَفْسَهُ عَلَى قَبَائِلِ الْعَرَبِ، خَرَجَ وَأَنَا مَعَهُ، وَأَبُو بَكْرٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ، فَدُفِعْنَا إِلَى مَجْلِسٍ مِنْ مَجَالِسِ الْعَرَبِ …. رواه البيهقي في دلائل النبوة , باب عرض النبي صلى الله عليه وآله وسلم نفسه على قبائل العرب وما لحقه من الأذى في تبليغه رسالة ربه – عز وجل : ٢/٤٢٢، و أبو نعيم في “دلائل النبوة” : ١/٢٨٢ رقم ٢١٤، قال الحافظ في الفتح” : ٧/٢٥٩ : وقد أخرج الحاكم وأبو نعيم والبيهقي في ” الدلائل ” بإسناد حسن عن ابن عباس ” حدثني علي بن أبي طالب. – “আলী বিন আবি তালেব আমার কাছে বর্ণনা করেছেন যে, ‘আল্লাহ তাবারাক ওয়া তাআলা যখন তাঁর রাসুল ﷺকে নির্দেশ দিলেন যে, তিঁনি যেন আরব গোত্রগুলের সামনে (নিরাপত্তা-আশ্রয় চেয়ে) নিজকে পেশ করেন, তখন তিঁনি বের হয়ে পড়লেন, আর তাঁর সাথে ছিলাম আমি এবং আবু বকর রা.। তখন আমরা আরবদের এক মজলিস থেকে অন্য মজলিসে গেলাম……”। [দালাইলুন নুবুওয়াহ, ইমাম বাইহাকী- ২/৪২২; দালাইলুন নুবুওয়াহ, ইমাম আবু নুআইম- ১/২৮২ হাদিস ২১৪; তারিখে দিশাশক, ইবনে আসাকীর- ১৭/২৯৩; সিরাতুন নাবাউইয়াহ, ইমাম ইবনে হিব্বান- ১/৯৩; ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার- ৭/২৫৯] এ সময় আরবের কোনো গোত্র রাসুলুল্লাহ ﷺকে কুরায়েশদের মুকাবেলায় নিরাপত্তা-আশ্রয় দেয়ার সাহস করেনি। তবে মদিনা থেকে আগত খাযরাজ গোত্রের কিছু মুশরেক ব্যাক্তি সেখানে ইসলাম কবুল করেন। এরপর এ বছরই আরো কিছু যুবক মদিনা থেকে এসে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর হাতে ইসলাম কবুল করে পূণরায় মদিনায় ফিরে যান।
এরপর (অধিক গ্রহনযোগ্য মতানুসারে) নবুওতের ১১তম বছরে রজব মাসে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর মি’রাজ রজনীর ঘটনা ঘটে, আর এসময়ই মুসলমানদের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করা হয়। এ বছরেরই হজ্জের মৌসুমে মদিনার ৬ জন ব্যাক্তি ইসলাম কবুল করেন এবং মদিনায় ফিরে গিয়ে সেখানে প্রতিটি ঘরে ঘরে মজলিশে মজলিশে ব্যাপক ভাবে ইসলামের দাওয়াত পৌছাতে থাকেন।
নবুওতের ১২ তম বছর: আনসারগণের আক্বাবাহ’র ১ম বায়াত এবং মদিনায় জুমআহ’র জামাত কায়েম
এরপর নবুওতের ১২তম বছরে হজ্জের সময় মক্কার মিনা’র নিকটস্থ আক্বাবাহ’র কাছে মদিনা থেকে আগত ১২ জন ব্যাক্তি (যাদের মধ্যে ৫ জন গত বছরে হজ্জের সময় ইসলাম কবুল করেছিলেন তাঁরা এসে) রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর হাতে বায়াত হন, (যেটাকে ‘আক্বাবাহ’র ১ম বায়াত বলে অবিহিত করা হয়ে থাকে)। আবু আব্দিল্লাহ আব্দির রহমান বিন উসাইলাহ আস-সুনাবিহী রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, উবাদাহ বিন সামিত রা. বর্ণনা করেছেন– كُنْتُ فِيمَنْ حَضَرَ الْعَقَبَةَ الْأُولَى وَ كُنَّا اثْنَيْ عَشَرَ رَجُلًا فَبَايَعْنَا رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى بَيْعَةِ النِّسَاءِ وَ ذَلِكَ قَبْلَ أَنْ يُفْتَرَضَ الْحَرْبُ عَلَى أَنْ لَا نُشْرِكَ بِاللَّهِ شَيْئًا ….. . رواه الإمام احمد في مسنده , باقي مسند الأنصار , حديث عبادة بن الصامت رضي الله عنه : ٥/٣١٦ رقم ٢٢٧٥٢، قال شعيب الأرنؤوط : حديث صحيح و هذا إسناد حسن من أجل محمد بن إسحاق، قال محمد الصوياني في الصحيح من أحاديث السيرة النبوية : ص ١٠٧: سنده صحيح – “(মদিনার আনসারগণের মধ্যে) যারা ১ম আক্বাবাহ’য় উপস্থিত ছিলেন, (সেদিন) আমিও ছিলাম তাদের মধ্যে একজন। আর (সেদিন) আমরা ছিলাম (মোট) বার জন ব্যাক্তি। তখন আমরা রাসুলুল্লাহ ﷺ -এর কাছে (ঠিক সেই অঙ্ঘিকার সহকারে) বায়াত করেছিলাম, (যে সকল অঙ্ঘিকার সহকারে রাসুলুল্লাহ ﷺ) -নারীদের (থেকে) বায়াত (নিতেন সেই বায়াত)-এর উপরে, (যার ইংগীত কুরআনের সুরা মুমতাহ্বিনাহ’র ১২ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে)। আর এটা হয়েছিল জিহাদ ফরয হবার আগে। (সেদিন আমরা বায়াত করেছিলাম এই মর্মে যে) আমরা আল্লাহ’র সাথে কোনো কিছুকে শরিক করবো না,…..”। [মুসনাদে আহমদ- ৫/৩২৩ হাদিস ২২২৪৭, ২২/]
যুহরী রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, আবু ইদ্রিস আয়েজুল্লাহ বনি আব্দুল্লাহ রহ. বর্ণনা করেন- أَنَّ عُبَادَةَ بْنَ الصَّامِتِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ وَكَانَ شَهِدَ بَدْرًا وَهُوَ أَحَدُ النُّقَبَاءِ لَيْلَةَ العَقَبَةِ: أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ، وَحَوْلَهُ عِصَابَةٌ مِنْ أَصْحَابِهِ: «بَايِعُونِي عَلَى أَنْ لاَ تُشْرِكُوا بِاللَّهِ شَيْئًا، وَلاَ تَسْرِقُوا، وَلاَ تَزْنُوا، وَلاَ تَقْتُلُوا أَوْلاَدَكُمْ ، وَلاَ تَأْتُوا بِبُهْتَانٍ تَفْتَرُونَهُ بَيْنَ أَيْدِيكُمْ وَأَرْجُلِكُمْ، وَلاَ تَعْصُوا فِي مَعْرُوفٍ، فَمَنْ وَفَى مِنْكُمْ فَأَجْرُهُ عَلَى اللَّهِ، وَمَنْ أَصَابَ مِنْ ذَلِكَ شَيْئًا فَعُوقِبَ فِي الدُّنْيَا فَهُوَ كَفَّارَةٌ لَهُ، وَمَنْ أَصَابَ مِنْ ذَلِكَ شَيْئًا ثُمَّ سَتَرَهُ اللَّهُ فَهُوَ إِلَى اللَّهِ، إِنْ شَاءَ عَفَا عَنْهُ وَإِنْ شَاءَ عَاقَبَهُ» فَبَايَعْنَاهُ عَلَى ذَلِكَ . رواه البخاري في صحيحه , كتاب الإيمان , باب: علامة الإيمان حب الأنصار : ١/١٢ رقم ١٨ – “উবাদাহ বিন ছামিত -যিনি বদরে(র যুদ্ধে) শরিক ছিলেন এবং যিনি (২য়) আক্বাবার রাতের (মনোনীত) নক্বিবগণের মধ্যে একজন ছিলেন -(তিনি বর্ণনা করেন), রাসুলুল্লাহ ﷺ তাঁর পাশে কয়েকজন সাহাবীর উপস্থিতিতে (১ম আক্বাবাহ’র রাতে আমাদের থেকে বায়াত নেয়ার জন্য) বললেন: بَايِعُونِي عَلَى أَنْ لاَ تُشْرِكُوا بِاللَّهِ شَيْئًا، وَلاَ تَسْرِقُوا، وَلاَ تَزْنُوا، وَلاَ تَقْتُلُوا أَوْلاَدَكُمْ ، وَلاَ تَأْتُوا بِبُهْتَانٍ تَفْتَرُونَهُ بَيْنَ أَيْدِيكُمْ وَأَرْجُلِكُمْ، وَلاَ تَعْصُوا فِي مَعْرُوفٍ – ‘তোমরা আমার কাছে (এই ওয়াদাবদ্ধ হয়ে) বায়াত করো যে, তোমরা আল্লাহ’র সাথে কোনো কিছুকে শরিক করবে না, তোমরা চুরি করবে না, তোমরা জিনা-ব্যাভিচার করবে না, তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে না, তোমরা তোমাদের হাত ও পা-এর মাঝে (বিদ্যমান কোনো কিছুকে কেন্দ্র করে) কাউকে মিথ্যা অপবাদে দুষ্ট করবে না এবং কোনো সৎকাজে (আল্লাহ’র) নাফরমানী করবে না’। তোমাদের মধ্যে যে ব্যাক্তি (এসব বিষয়ের ওয়াদা) পূরণ করবে, তার পুরষ্কার আল্লাহর উপরে ন্যাস্ত। আর যে ব্যাক্তি ওগুলোর মধ্যে কোনো কিছুতে লিপ্ত হয়ে পৃথিবীতে শাস্তি পাবে, তার জন্য সেটা হবে কাফফারাহ স্বরূপ। আর যে ব্যাক্তি ওগুলোর মধ্যে কোনো কিছুতে লিপ্ত হবে, তারপর আল্লাহ সেটাকে (তাঁর সৃষ্টি থেকে) ঢেকে রাখবেন, সে আল্লাহ’র (ইচ্ছার) কাছে সোপর্দ। তিঁনি চাইলে তাকে মাফ করে দিতে পারেন, আবার তিঁনি চাইলে তাকে শাস্তিও দিতে পারেন’। (সেদিন) আমারা তাঁর কাছে এসবের উপরে বায়াত করেছিলেন”। [সহিহ বুখারী- ১/১২ হাদিস ১৮; সহিহ মুসলীম- ৩/১৩৩৩ হাদিস ১৭০৯; মুসনাদে আহমদ- ৫/৩২৩]
এই ১২ জন সাহাবী বায়াত সম্পন্ন করে যখন মদিনায় ফিরতে ইচ্ছে করেন, তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ তাঁদের সাথে মক্কার আব্দুল্লাহ ইবনে মাকতুম রা. এবং মুসআব ইবনে উমায়ের রা.-কে মদিনায় পাঠান, যাতে তাঁরা মেদিনার মুসলমানদেরক কুরআন ও শরয়ী আহকাম শিক্ষা দিতে পারেন। এরপর তাঁরা মদিনায় ফিরে গিয়ে সেখানকার অধিবাসীদের মাঝে ব্যাপক ভাবে ইসলামের দাওয়াত পৌছাতে থাকেন, ফলে বহু নারী পুরুষ ইসলাম কবুল করেন। মুসআব ইবনে উমায়ের রা. মদিনায় নামাযের জামাআতের ইমামতী করতেন। তাঁরই দাওয়াতে সারা দিয়ে মদিনার আওস গোত্রের সর্দার সা’দ বিন মুয়ায ইসলাম কবুল করেন, আবার একই দিনে সা’দ বিন মুয়ায রা.-এর দাওয়াতে তাঁর গোত্রের সকল নারী পুরুষ ইসলাম কবুল করেন, (শুধু আমর বিন সাবিত সেদিন ইসলাম গ্রহন করা থেকে বিরত থাকেন, পরে উহূদ যুদ্ধের দিন ইসলাম কবুল করেন)।
এ বছরেই আবু উমামা আসআদ বিন যুরারাহ রা. মদিনার মুসলশানদেরকে নিয়ে ‘হাযমুন নাবীত’ এলাকার ‘নাকিউল খাজমাত’ নামক স্থানে শুক্রবার দিন ‘জুমআহ’র নামাযের জামাআত’ কায়েম করেন। [তালখিসুল হাবির, ইবনে হাজার- ৪/৫১৭] মদিনার ইহূদী ও খৃষ্টানদের সাপ্তাহিক ধর্মীয় ‘সমাবেশ দিবস’ নির্ধারিত ছিল; ইহূদীরা শনিবার এবং খৃষ্টানরা শনিবার এ দিবস পালন করতো। এজন্য মদিনার মুসলমানরাও ধারনা করলো যে, তাদের এমন একটি দিন থাকা দরকার যেদিন সকল মুসলমান একত্রিত হয়ে ইবাদত বন্দেগী করবে। পরে তারা শুক্রবারকে জুমআহ (সমাবেশ)-এর দিন হিসেবে নির্ধারণ করে নেন। পরে আল্লাহ তাআলা মক্কায় তাঁর রাসুল ﷺ-এর উপরে সুরা জুমআহ’র ৯ নং আয়াত নাজিল করে সাপ্তাহিক শুত্রবারকে মুসলমানদের জুমআর দিন হিসেবে কবুল করেন। কিন্তু মুশরেকদের জুলুম অত্যাচারে জর্জরিত অনিরাপদ মক্কায় তো আর এ আয়াতের উপরে আমল আমল করা সম্ভব ছিল না, এজন্য রাসুলুল্লাহ ﷺ মদিনায় অবস্থানরত মুহাজির সাহাবী মুসআব বিন উমায়ের রা.-কে নির্দেশ দেন, তিঁনি যেন মদিনার মুসলমানদেরকে নিয়ে প্রতি শুক্রবার দুপুর বেলা দু রাকাআত জুমআর নামায আদায় করেন। মুসআব বিন উমায়ের রা. এ নির্দেশ পালনার্থে মুসলমানদেরকে নিয়ে জুমআহ কায়েশ করতে থাকেন।
উবাইদুল্লাহ রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন- –أذَّنَ النَّبِيُّ ﷺ الجُمُعَةَ قَبْلَ أنْ يُهاجِرَ، ولَمْ يَسْتَطِعْ أنْ يُجَمِّعَ بِمَكَّةَ، فَكَتَبَ إلى مُصْعَبِ بْنِ عُمَيْرٍ: «أمّا بَعْدُ، فانْظُرِ اليَوْمَ الَّذِي تَجْهَرُ فِيهِ اليَهُودُ بِالزَّبُورِ فاجْمَعُوا نِساءَكم وأبْناءَكُمْ، فَإذا مالَ النَّهارُ عَنْ شَطْرِهِ عِنْدَ الزَّوالِ مِن يَوْمِ الجُمُعَةِ فَتَقَرَّبُوا إلى اللَّهِ بِرَكْعَتَيْنِ» قالَ: فَهو أوَّلُ مَن جَمَّعَ، حَتّى قَدِمَ النَّبِيُّ ﷺ – المَدِينَةَ فَجَمَّعَ عِنْدَ الزَّوالِ مِنَ الظَّهْرِ» . رواه الدارقطنى كما قال ناصر الدين الألباني في إرواء الغليل في تخريج أحاديث منار السبيل : ٣/٦٨ رقم ٦٠١ : وروى الدارقطنى من طريق المغيرة بن عبد الرحمن عن مالك عن الزهرى عن عبيد الله عن ابن عباس قال: ….. سكت عليه الحافظ , ولم أره فى سنن الدارقطنى فالظاهر أنه فى غيره من كتبه و إسناده حسن – “(জুমআহ’র নির্দেশ সম্বলীত আয়াত নাজিল হলে) নবীজী ﷺ (মদিনায়) হিজরত করার আগেই (তিঁনি মদিনার মুসলমানদেরকে) জুমআহ’র (নামায আদায়ের) অনুমতি দেন। (কারণ) তখন (মুশরেকদের অত্যাচারের শংকায়) মক্কায় (মুসলমনাদেরকে নিয়ে) জুমআহ(র নামায আদায় করা) তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফলে তিঁনি (মদিনায় অবস্থানকারী তাঁর মুহাজির সাহাবী) মুসআব ইবনে উমায়েরকে (এই মর্মে) পত্র লিখে পাঠান: ‘অত:পর সমাচার এই যে, তুমি দেখতে পাবে, (মদিনার) ইহূদীরা (তাদের কিতাব তাওরাত সংলগ্ন অংশ) ‘জাবুর’ নিয়ে (সপ্তাহের একটি নির্দিষ্ট) দিনে একত্রিত হয়। সুতরাং, তোমরাও তোমাদের নারী এবং তোমাদের সন্তানরা (সহ প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার দিন ইবাদতের জন্য) একত্রিত হও। জুমআহ’র দিন দ্বিপ্রহরের সময় দিনটি যখন অর্ধেকের বেশি ঢলে (চলে) যাবে, তখন তোমরা দুই রাকায়াত (নামায)-এর মাধ্যমে আল্লাহ’র নৈকট্য লাভ করো’। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন: ‘(আল্লাহ ও তাঁর রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর আদেশ পালন স্বরূপ) তিনিই সর্বপ্রথম (মদিনার মুসলমানদেরকে) জুমআহ কায়েম করেছিলেন। পরে নবীজী ﷺ মদিনায় (হিজরত করে) আসেন, তারপর তিঁনি জোহরের ওয়াক্তে দ্বিপ্রহরের সময় জুমআহ কায়েম করতেন”। [দ্বাবাকুতনী : আদ-দুররুল মানসুর, ইমাম সুয়ূতী- ৬/২১৮]
আবু বকর ইবনু আব্দির রহমান রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, আবু মাসউদ রা. বলেন- أَوَّلُ مَنْ قَدِمَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ الْمَدِينَةَ مُصْعَبُ بْنُ عُمَيْرٍ وَهُوَ أَوَّلُ مَنْ جَمَعَ بِهَا يَوْمَ الْجُمُعَةِ جَمَعَهُمْ قَبْلَ أَنْ يَقْدَمَ رَسُولُ اللَّهِ – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ – فَصَلَّى بِهِ . رواه الطبراني في المعجم الكبير: ١١/٣٩٤ رقم ١٦٩٠، و في المعجم الأوسط : ٤/٣٧٦ رقم ٢٦٩٤، و الطحاوي في أحكام القرآن الكريم : ١/١٥٦ رقم ٢٤٤، و قال الهيثمى في مجمع الزوائد : ٢/١٧٦ رقم ٣٠٧٦ : رواه الطبراني في الأوسط والكبير وفيه صالح بن أبي الأخضر وفيه كلام – “মুহাজিরদের মধ্যে সর্বপ্রথম যিনি মদিনায় আসেন তিঁনি হলেন মুসআব বিন উমায়ের। (রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর উপরে জুমআর হুকুম নাজিল হওয়ার পর) তিনিই (ছিলেন) সে ব্যাপারে প্রথম ব্যাক্তি, যিনি (রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর নির্দেশ শোনানোর জন্য) জুমআহ’র দিন লোকজনকে একত্র করেছিলেন। রাসুলুল্লাহ ﷺ (মদিনায় হিজরত করে) আসার আগেই তাঁরা (জুমআর নামাযের জন্য একত্র হয়ে) মুসআব বিন উমায়েরের সাথে নামায আদায় করেছিলেন”। [আল-মু’জামুল কাবীর, ইমাম ত্বাবরাণী- ১১/৩৯৪ হাদিস ১৬৯০; আল-মু’জামুল আউসাত, ইমাম ত্বাবরাণী- ৪/৩৭৬ হাদিস ২৬৯৪; আহকামুল কুরআন, ইমাম তাহাবী- ১/১৫৬ হাদিস ২৪৪; মাজমাউয যাওয়ায়ীদ, হাইছামী- ২/১৭৬ হাদিস ৩০৭৬]
এভাবে নবুওতের ১১তম, ১২ তম এবং ১৩ তম বছরে’র মধ্যে মদিনার ঘরে ঘরে ইসলাম কবুলের ধারা অব্যাহত থাকে এবং সেখানে দিনকে দিন মুসলমানদের সংখ্যা বাড়তেই থাকে। এক পর্যায়ে মদিনা ভূমিটি মুসলমানদের জন্য একটি ‘দারুল আমান’ (নিরাপদ বাসস্থান)-এ পরিণত হয়ে যায়।
ফায়দা: মদিনা তখনও পর্যন্ত ‘দারুল ইসলাম’ (ইসলামী রাষ্ট্র/ইসলামের রাজনৈতিক শাসন ভূমি) -তে পরিণত হয়নি, কেননা তখন পর্যন্ত মদিনার মুসলমানদের উপরে তাদের রাজনৈতিক আমীর বা দল-প্রধান (বিশ্বনবী মুহাম্মাদ মুস্তফা ﷺ) আগমন করেন নি এবং তারা তাদের রাজনৈতিক আমীরের শাসনাধীন ভূমির আওতাভূক্ত হয়ে ইসলামী শাসনব্যবস্থা ভোগ করতে পারেননি।
নবুওতের ১৩ তম বছর: আনসারগণের আক্বাবাহ’র ২য় বায়াত; মদিনায় ইসলাম ও রাসুলুল্লাহ ﷺকে রক্ষায় দিফায়ী (আত্বরক্ষা মূলক) জিহাদের ওয়াদা
এ সময় মদিনার মুসলমানগণ এক পরামর্শ সভায় এই বিষয়বস্তু পেশ করেন যে, “রাসুলুল্লাহ ﷺ আর কতদিন এভাবে মক্কায় ভীত-সংকিত ও অনিরাপদ অবস্থায় এখানে ওখানে দ্বীনের বাণী নিয়ে ঘুরে বেড়াবেন, বরং এখন তাঁকে আমাদের মাঝে মদিনায় আনা যায় কিনা, যাতে তিঁনি এখানে আমাদের বেষ্টনীর মাঝে থেকে আরো নিরাপত্তার সাথে দ্বীন ইসলামের প্রচার ও প্রসারের কাজ আঞ্জাম দিতে পারেন”। এ পরামর্শের পর সিদ্ধান্ত হয় তাঁরা এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর সাথে সাক্ষাতের জন্য মক্কায় যাবেন। অবশেষে সিদ্ধান্ত মতো, নবুওতের ১৩ তম বছরের হজ্জের মৌসুমে মদিনার আওস ও খাযরাজ গোত্রের মুশরেকদের অনেকেই যখন মক্কায় হজ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়, তখন তাদের সাথে মুসলমানদের প্রায় ৭০ জনের একটি জামাআতও মক্কায় আসেন। পরে কয়েকজন গোপনে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর সাথে সাক্ষাত করলে তখন এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, ১২-ই যুল-হজ্জ তারিখ মধ্য-রাতে তারা সকলে গোপনে মিনা’র নিকটস্থ আক্বাবাহ’য় এসে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর হাতে বায়াত হবেন। কথা মতো ১২-ই যুল-হজ্জ তারিখ মধ্য-রাতে তাঁরা সকলে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর হাতে বায়াত হন। বায়াত গ্রহনের সময় রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর চাচা আব্বাস ইবনু আব্দিল মুত্তালীব সাথে তাঁর হাত ধরে ছিলেন। ১২-ই যুল-হজ্জ তারিখের উক্ত বায়াত’কেই ‘আক্বাবাহ’র ২য় বায়াত’ বলে অবিহিত করা হয়ে থাকে।
আবু যুবায়ের রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, যাবের বিন আব্দু্ল্লাহ রা. বর্ণনা করেছেন- مَكَثَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِمَكَّةَ عَشْرَ سِنِينَ ، يَتْبَعُ النَّاسَ فِي مَنَازِلِهِمْ بعُكَاظٍ وَمَجَنَّةَ ، وَفِي الْمَوَاسِمِ بِمِنًى ، يَقُولُ : ” مَنْ يُؤْوِينِي ؟ مَنْ يَنْصُرُنِي حَتَّى أُبَلِّغَ رِسَالَةَ رَبِّي ، وَلَهُ الْجَنَّةُ ” ؟ حَتَّى إِنَّ الرَّجُلَ لَيَخْرُجُ مِنَ الْيَمَنِ ، أَوْ مِنْ مِصْرَ – كَذَا قَالَ – فَيَأْتِيهِ قَوْمُهُ ، فَيَقُولُونَ : احْذَرْ غُلَامَ قُرَيْشٍ ، لَا يَفْتِنُكَ ، وَيَمْشِي بَيْنَ رِجَالِهِمْ ، وَهُمْ يُشِيرُونَ إِلَيْهِ بِالْأَصَابِعِ ، حَتَّى بَعَثَنَا اللَّهُ لَهُ مِنْ يَثْرِبَ ، فَآوَيْنَاهُ ، وَصَدَّقْنَاهُ ، فَيَخْرُجُ الرَّجُلُ مِنَّا فَيُؤْمِنُ بِهِ ، وَيُقْرِئُهُ الْقُرْآنَ ، فَيَنْقَلِبُ إِلَى أَهْلِهِ فَيُسْلِمُونَ بِإِسْلَامِهِ ، حَتَّى لَمْ يَبْقَ دَارٌ مِنْ دُورِ الْأَنْصَارِ إِلَّا وَفِيهَا رَهْطٌ مِنَ الْمُسْلِمِينَ ، يُظْهِرُونَ الْإِسْلَامَ ، ثُمَّ ائْتَمَرُوا جَمِيعًا ، فَقُلْنَا : حَتَّى مَتَى نَتْرُكُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُطْرَدُ فِي جِبَالِ مَكَّةَ وَيَخَافُ ؟ فَرَحَلَ إِلَيْهِ مِنَّا سَبْعُونَ رَجُلًا حَتَّى قَدِمُوا عَلَيْهِ فِي الْمَوْسِمِ ، فَوَاعَدْنَاهُ شِعْبَ الْعَقَبَةِ ، فَاجْتَمَعْنَا عِنْدَهُ مِنْ رَجُلٍ وَرَجُلَيْنِ حَتَّى تَوَافَيْنَا ، فَقُلْنَا : يَا رَسُولَ اللَّهِ ، علَامَ نُبَايِعُكَ ، قَالَ : ” تُبَايِعُونِي عَلَى السَّمْعِ وَالطَّاعَةِ فِي النَّشَاطِ وَالْكَسَلِ ، وَالنَّفَقَةِ فِي الْعُسْرِ وَالْيُسْرِ ، وَعَلَى الْأَمْرِ بِالْمَعْرُوفِ ، وَالنَّهْيِ عَنِ الْمُنْكَرِ ، وَأَنْ تَقُولُوا فِي اللَّهِ ، لَا تَخَافُونَ فِي اللَّهِ لَوْمَةَ لَائِمٍ ، وَعَلَى أَنْ تَنْصُرُونِي ، فَتَمْنَعُونِي إِذَا قَدِمْتُ عَلَيْكُمْ مِمَّا تَمْنَعُونَ مِنْهُ أَنْفُسَكُمْ ، وَأَزْوَاجَكُمْ ، وَأَبْنَاءَكُمْ ، وَلَكُمُ الْجَنَّةُ ” ، قَالَ : فَقُمْنَا إِلَيْهِ فَبَايَعْنَاهُ ، وَأَخَذَ بِيَدِهِ أَسْعَدُ بْنُ زُرَارَةَ ، وَهُوَ مِنْ أَصْغَرِهِمْ ، فَقَالَ : رُوَيْدًا يَا أَهْلَ يَثْرِبَ ، فَإِنَّا لَمْ نَضْرِبْ أَكْبَادَ الْإِبِلِ إِلَّا وَنَحْنُ نَعْلَمُ أَنَّهُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، وَإِنَّ إِخْرَاجَهُ الْيَوْمَ مُفَارَقَةُ الْعَرَبِ كَافَّةً ، وَقَتْلُ خِيَارِكُمْ ، وَأَنَّ تَعَضَّكُمُ السُّيُوفُ ، فَإِمَّا أَنْتُمْ قَوْمٌ تَصْبِرُونَ عَلَى ذَلِكَ ، وَأَجْرُكُمْ عَلَى اللَّهِ ، وَإِمَّا أَنْتُمْ قَوْمٌ تَخَافُونَ مِنْ أَنْفُسِكُمْ جَبِينَةً ، فَبَيِّنُوا ذَلِكَ ، فَهُوَ أَعْذَرَ لَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ ، قَالُوا : أَمِطْ عَنَّا يَا أَسْعَدُ ، فَوَاللَّهِ لَا نَدَعُ هَذِهِ الْبَيْعَةَ أَبَدًا ، وَلَا نَسْلُبُهَا أَبَدًا ، قَالَ : فَقُمْنَا إِلَيْهِ فَبَايَعْنَاهُ ، فَأَخَذَ عَلَيْنَا ، وَشَرَطَ ، وَيُعْطِينَا عَلَى ذَلِكَ الْجَنَّةَ . رواه أحمد في مسنده , مسانيد المكثرين , تتمة مسند جابر بن عبد الله رضي الله تعالى عنهما : ، و قال ابن كثير في البداية والنهاية : ٣/١٦٠ : و هذا إسناد جيد على شرط مسلم، و صححه الألباني على شرط مسلم في السلسلة الصحيحة : ١/١٣٤ رقم ٦٤ – “(নবুওত লাভের পর) রাসুলুল্লাহ ﷺ (প্রায়) দশটি বছর মক্কায় (মুশরেকদের সাথে) অবস্থান করলেন। (তিঁনি যখন বুঝতে পারলেন যে, মুশরেকরা বাহ্যত: দ্বীন ইসলাম গ্রহন করার পক্ষে আর নেই, বরং নিরাপত্তাহীনতা নানান উপকরণ দিয়ে মক্কাকে তাঁর ও মুসলমানদের জন্য সঙ্কীর্ণ ও শ্বাসরুদ্ধকর বানিয়ে দেয়া হচ্ছে, তখন থেকে) তিঁনি (প্রত্যেক হজ্জের মৌসুমে) উকাজ, মাযান্নাহ এবং মিনা’র জনসমাবেশে(র মতো) বিভিন্ন মঞ্জিলে মঞ্জিলে গিয়ে লোকসমাবেশে বলে থাকেন: مَنْ يُؤْوِينِي ؟ مَنْ يَنْصُرُنِي حَتَّى أُبَلِّغَ رِسَالَةَ رَبِّي ، وَلَهُ الْجَنَّةُ – ‘(তোমাদের মধ্যে) কে (আছে, যে) আমাকে (নিরাপদ) আশ্রয় দিবে? কে (আছে, যে) আমাকে (আল্লাহ’র দ্বীনের ব্যাপারে) সাহায্য করবে, যাতে আমি আমার রব (আল্লাহ)’র (দেয়া) রিসালাত(-এর বাণী লোকদের কাছে ব্যাপক ভাবে) পৌছিয়ে দিতে পারি? আর (যে একাজ করবে) তার জন্য (পরকালে থাকবে) বেহেশত’। এমনকি (এমনও ঘটতো যে), ইয়ামেন বা মিসর থেকেও কোনো ব্যাক্তি আসতো, (তখনও) তিঁনি (তাদেরকে) এমন কথাই বলতেন, (তখন দেখা যেতো যে), তাঁর কওম ওই ব্যাক্তির কাছে গিয়ে বলতো: ‘(মুহাম্মাদ নামের অমুক) কুরায়েশী যবকটি থেকে তুমি সতর্ক থেকো; সে যেন তোমাকে বিভ্রান্ত করতে না পারে’। রাসুলুল্লাহ ﷺ (যখন) তাদের মাঝ দিয়ে হেটে যেতেন, (তখন) তারা তাঁর দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করেতা (যে, ‘এই যে এই ব্যাক্তির কথা বলেছিলাম, এর থেকে বেঁচে থেকো)’। অবশেষে আল্লাহ (তাআলা) ইয়াসরিব (মদিনা)থেকে আমাদেরকে তাঁর কাছে পাঠান। বস্তুত: (গোটা আরব আজমের মধ্যে) আমরা (ইয়াসরিব বাসীরাই ছিলাম প্রথম জামাআত, যাঁরা) তাঁ(র রিসালাত)কে সত্তায়নও করেছিলাম, আবার তাঁকে (নিরাপদ) আশ্রয়স্থল দিয়েছিলাম। (যা হোক, শুরুর দিকে এমন হত যে), আমাদের মধ্যে থেকে কোনো ব্যাক্তি (সময়ে সুযোগে মক্কার উদ্দেশ্যে) বের হত এবং (সেখানে গিয়ে) রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর উপরে ইমান আনতো, (তারপর) তাকে কুরআন পড়ানো হতো (এবং দ্বীনী আহকাম শিক্ষা দেয়া হত। পরে) সে তার পরিবারের কাছে ফিরে এলে তারাও তার ইসলামের (সৌন্দর্যের) দ্বারা (অনুপ্রানিত হয়ে) ইসলাম কবুল করে নিতো। এমনকি (এভাবে একসময়) আনসারদের এমন কোনো ঘরবাড়ি বাকি রইলো না, যেখানে মুসলমানদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যা বিদ্যমান পাওয়া না গেল। (ফলে) তারা ইসলামকে প্রকাশ্যে মানতে থাকলেন। এরপর (একদিন) তারা সকলে মিলে পরামর্শ করলো। আমরা বললাম: ‘আর কতদিন আমরা রাসুলুল্লাহ ﷺকে (এভাবে) দূরে ফেলে রাখবো, আর তিঁনি (মুশরেকদের) ভয়ে-শংকায় মক্কার পাহাড়ে পাহাড়ে পড়ে থাকবেন’। পরে (সিদ্ধান্ত মতো) আমাদের (প্রায়) সত্তরজন ব্যাক্তি তাঁর (সাথে সাক্ষাতের) উদ্দেশ্যে (মক্কার দিকে) রওয়ানা হলাম। অবশেষে তারা হজ্জের সময় তাঁর সাথে সাক্ষাত করলেন, (এবং প্রাথমিক কথাবার্তা হবার) পরে আমরা তাঁর সাথে (দ্বীন ইসলামের ব্যাপারে বিস্তারিত কথাবার্তা ও আদেশ নিষেধ এবং পরবর্তী পদক্ষেপ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনার জন্য পূণরায়) ‘শি’বে-আক্বাবাহ’-তে সাক্ষাতের ওয়াদা করলাম। পরে আমরা (সময় মতো) একজন দুজন করে (আক্বাবাহ-তে) গিয়ে তাঁর কাছে সমবেত হতে লাগলাম, এভাবে একসময় আমরা সবাই (সেখানে) উপস্থিত হলাম। আমরা বললাম: ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! কোন্ বিষয়ের উপরে আমরা আপনার কাছে বায়াত করবো’? রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন: تُبَايِعُونِي عَلَى السَّمْعِ وَالطَّاعَةِ فِي النَّشَاطِ وَالْكَسَلِ ، وَالنَّفَقَةِ فِي الْعُسْرِ وَالْيُسْرِ ، وَعَلَى الْأَمْرِ بِالْمَعْرُوفِ ، وَالنَّهْيِ عَنِ الْمُنْكَرِ ، وَأَنْ تَقُولُوا فِي اللَّهِ ، لَا تَخَافُونَ فِي اللَّهِ لَوْمَةَ لَائِمٍ ، وَعَلَى أَنْ تَنْصُرُونِي ، فَتَمْنَعُونِي إِذَا قَدِمْتُ عَلَيْكُمْ مِمَّا تَمْنَعُونَ مِنْهُ أَنْفُسَكُمْ ، وَأَزْوَاجَكُمْ ، وَأَبْنَاءَكُمْ ، وَلَكُمُ الْجَنَّةُ – ‘তোমরা আমার কাছে (এ ওয়াদার উপরে) বায়াত করো যে, (তোমরা তোমাদের) সু-সময়ে ও দু:সময়ে (উভয় অবস্থাতেই আমার কথা) শুনবে এবং (বিনা বাক্যে আমার) অনুগত্য করবে, অভাবে ও স্বচ্ছলতায় (উভয় অবস্থাতেই দ্বীনের চাহিদা সৃষ্টি হলে তোমাদের সাধ্য মতো আল্লাহ’র পথে) ব্যায় করবে। এমনি ভাবে (তোমরা আমার কাছে এ ওয়াদার উপরেও বায়াত করো) যে, (মানুষকে আল্লাহ’র নির্দেশিত) মা’রুফ (নেক কাজ)-এর আদশে করবে এবং (তাদেরকে) মুনকার (হারাম ও নাজায়েয বিষয়) থেকে নিষেধ করবে, আর তোমরা আল্লাহ’র পক্ষে কথা বলবে এবং আল্লাহ’র পক্ষে (অবস্থান নিতে গিয়ে) তোমরা কোনো ভৎসনাকারীর ভৎসনাকে ভয় করবে না। এমনি ভাবে (তোমরা আমার কাছে এ ওয়াদার উপরেও বায়াত করো) যে, তোমরা আমাকে (আল্লাহ’র দ্বীনের কাজে) সাহায্য করবে, আমি (মদিনায়) তোমাদের কাছে গেলে পর তোমরা আমাকে সেইসব বিষয় থেকে (সাধ্য মতো) নিরাপত্তা দিবে যেসকল বিষয় থেকে তোমরা নিরাপত্তা দিয়ে থাকো -তোমাদের নিজেদেরকে, তোমাদের স্ত্রীদেরকে এবং তোমাদের সন্তানসন্ততিদেরকে। আর (এ ওয়াদা পূরণের প্রতিফল হিসেবে) তোমাদের জন্য থাকবে (পরকালে) বেহেশত’। যাবের রা. বলেন: ‘(রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কথা শেষ হলে) তখন আমরা তাঁর কাছে বায়াত করার জন্য দাঁড়ালাম। কিন্তু তখন (আবু উমামা) আসআদ বিন যুরারাহ -যে তাদের মধ্যে সব থেকে কনিষ্ট ছিল- সে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর হাত ধরে বললো: ‘হে ইয়াসরিব (মদিনা)বাসী! একটু দাঁড়াও। তাঁকে আল্লাহ’র রাসুল ﷺ হিসেবে জেনে নেয়ার পরই আমরা (সুদূর মদিনা থেকে) আমাদের উট হাকিয়ে (এতদূর মক্কায় তাঁর সাক্ষাত করতে) এসেছি। (তবে বায়াত করার আগে একথা ভালো করে বুঝে নাও যে), নিশ্চই আজ রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে (মক্কা থেকে) বের করা(র পরিণতি হবে) -(আমাদের থেকে) গোটা আরবের বিচ্ছিন্নতা, (কারণ যে আরবরা আজ রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর বিরুদ্ধে নেমেছে, তাঁকে আশ্রয় দেয়ার কারণে কাল সেই আরবরাই তোমাদের বিরুদ্ধেও নামবে)। আর (এর ফলে) তোমাদের (বিরোধীদের হাতে তোমাদের) বড়বড় ব্যাক্তিরা খুন হবে এবং তোমারা হবে (তোমাদের বিরোধী শক্তিদের) তরবারী গুলোর লোকমা। সুতরাং, (চিন্তা করে দেখো) তোমরা যদি এমন গোষ্ঠি হও যে, ওসব (বিপদ আপদ)-এর উপরে তোমরা সবর করতে পারবে, তাহলে তোমাদের পুরষ্কার রয়েছে আল্লাহ’র দায়িত্বে, অপরদিকে তোমরা যদি এমন গোষ্ঠি হয়ে থাকো যে, (দায়িত্ব আদায়ের সময়) তোমরা ভীরুতা বসত: (সেদিন বিরুদ্ধবাদীদের বিরোধীতায়) ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে যাবে (এবং রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর সাথে কৃত ওয়াদা পূরণ করতে পারবে না), তাহলে সেটাও পরিষ্কার করে বলে দাও, তাহলে (হয়তো) সেটা আল্লাহ’র কাছে তোমাদের জন্য ওজর হিসেবে (কবুল হবে)’। (একথা শুনে) তারা বললেন: ‘আমাদের সামন থেকে সরে যাও, হে আসআদ’! আমরা -এই বায়াতকে না কখনো অপূর্ণ রাখবো, আর না কোনো দিন তা ভঙ্গ করবো’। যাবের রা. বলেন: ‘পরে আমরা (সকলে) রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে এগিয়ে গিয়ে বায়াত করলাম, তিঁনি (আমাদেরকে বায়াত করলেন, আর সাথে) আমাদের উপরে কিছু শর্ত আরোপ করলেন। আর এর পরিপ্রেক্ষিতে আমাদেরকে বেহেশত(-এর ওয়াদা) দেয়া হল”। [মুসনাদে আহমদ- হাদিস ; মুসনাদে বাযযার, হাদিস ১৭৫৬; মুসতাদরাকে হাকিম- ২/৬২৪; সুনানুল কুবরা, ইমাম বাইহাকী- ৯/৯ হাদিস ১৭১৭৮; দালাইলুন নুবুওয়াহ, ইমাম বাইহাকী- ২/৪১৩]
ফায়দা (১) উপরের মুসনাদে আহমদের হাদিসে ৭০ জনের কথা বলা আছে। অন্যান্য হাদিস ও ঐতিহাসিক রেওয়াত থেকে জানা যায় যে, দুজন নারী সাহাবীয়া সহ মোট ৭৫ জন মুসলমান মদিনা থেকে এসেছিলেন। যারা সে কালের আরবদের ভাষার ধরন সম্পর্কে অবগত তারা জানেন যে, আরবরা তাদের সাধারণ কথাবার্তায় প্রায়সই কোনো বড় সংখ্যার খুচরা হিসাব ছেড়ে দিয়ে মোটা হিসাবটি উপস্থাপন করে কথা বলতে অভ্যস্ত ছিল। সম্ভবত: এজন্যই যাবের বিন আব্দুল্লাহ রা. ৭৫ সংখ্যা থেকে খুচরা ৫ জনের হিসাব না বলে মোটের উপরে হিসাবটি বলতে গিয়ে ৭০ জনের কথা বলেছেন। তাছাড়া বিভিন্ন রেওয়ায়েথ থেকে এও জানা যায় যে, ওই ৭৫ জনের মধ্যে অনেকেই রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর সাথে সাক্ষাতের আগে তাদের সাথে আগত মদিনার মুশরেকদের কারোর কারোর কাছে ইসলামের দাওয়াত পেশ করলে তারাও মুসলমান হয়ে যায়। তাঁরাও নিশ্চয় সেদিন ওই ৭৫ জনের সাথে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর হাতে বায়াত হয়েছিলেন। এ হিসেবে সেদিনের বায়াতকারীর সংখ্যা ৭৫ থেকে আরো অনেক বেশিই হবেন। ইমাম ইবনুল যাওজী রহ. -সেদিন বায়াত হওয়া প্রায় ৯০ জন আনসারী সাহাবীর নাম উল্লেখ করেছেন। [তালকীহ, ইমাম ইবনুল জাওযী- ১/২১৫]
(২) মদিনার আনসারগণের ‘আক্বাবাহ’র ১ম বায়াত’টি ছিল মূলত: একজন মুসলমান হিসেবে উল্লেখীত বড় বড় গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার উপরে ওয়াদাবদ্ধ হওয়া। কিন্তু ‘আক্বাবাহ’র ২য় বায়াত’টি ছিল আদপে এই কথার উপরে ওয়াদাবদ্ধ হওয়া যে- ‘রাসুলুল্লাহ ﷺ যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনার মুসলমানদের কাছে যাবেন, তখন থেকে মদিনার মুসলমানদের উপরে অপরিহার্য হবে রাসুলুল্লাহ ﷺকে মদিনার সীমার ভিতরে দ্বীনের জন্য রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর জান মাল ও ইজ্জতের যথাসাধ্য পূর্ণ নিরাপত্তা দেয়া -চাই এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রয়োজনে তাদের নিজেদের জীবন ও ধ্বনসম্পদও বিলিয়ে দিতে হোক না কেনো’। এজন্য ‘আক্বাবাহ’র ২য় বায়াত’টি ছিল মূলত: দ্বীন ইসলাম ও রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে দুশমনদের হাত থেকে রক্ষার জন্য পরিষ্কার একটি ‘দিফায়ী (আত্মরক্ষামূলক) যুদ্ধ’র ওয়াদা। যেমন, ওয়ালিদ বিন উবাদাহ রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছ যে, উবাদাহ বিন ছামিত রা. বলেন- بَايَعْنَا رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَيْعَةَ الْحَرْبِ …. رواه الإمام احمد في مسنده , تتمة مسند الأنصار , حديث عبادة بن الصامت : ٣٧/٣٧٣ رقم ٢٢٧٠٠، قال شعيب الأرنؤوط :حديث صحيح، وهذا إسناد حسن من أجل محمد بن إسحاق – “(আক্বাবাহ’র দ্বিতীয় বাইয়াতের সময়) রাসুলুল্লাহ ﷺ (মূলত:) আমাদের থেকে হরব (যুদ্ধ)’র বাইয়াত নিয়েছিলেন”। [মুসনাদে আহমদ– ৩৭/৩৭৩ হাদিস ২২৭০০; মুসনাদে বাযযার, হাদিস ২৭০০; আল-ইজতিযকার, ইমাম ইবনু আব্দিল বার- ৫/১৪ হাদিস ৯২৯] ইমাম হাফিজ ইবনে হাজার আল-আসকালানী (মৃ: ৮৫২ হি:) রহ. বলেন- وهذه الرواية تدل على أن هذه البيعة هي بيعة الحرب ، وأن بيعة النساء كانت في العقبة الأولى قبل أن تفرض الحرب – “এই বর্ণনাটি একথার দলিল যে, (আক্বাবাহ’র) এই (দ্বিতীয়) বাইয়াতটি ছিল হরব (যুদ্ধ)-এর জন্য বায়াত। আর আকাবাহ’র ১ম (বাইয়াত, যেটাকে সুরা মুমতাহ্বিনাহ’র ১২ নং আয়াতে বর্ণিত নারীদের বাইয়াতের অনুরূপ বাইয়াত হওয়ার কারণে) নারীদের বাইয়াত (বলা হয়ে থাকে) সেটা সম্পন্ন হয়েছিল (এই আক্বাবাহ’র ২য় বাইয়াতে আনসারদের জন্য এভাবে) যুদ্ধ ফরয হওয়ার আগে”। [ফাতহুল বারী, ইমাম ইবনে হাজার- ১/৬১]
মুসনাদে আহমদ-এর হাদিসে কা’ব বিন মালেক রা. থেকে একটি রেওয়ায়েত আছে, যার মধ্যে আছে যে, বায়াত সম্পন্ন হবার আগে আবু হাইছাম ইবনে তায়হান রা. বললেন- يَا رَسُولَ اللهِ، إِنَّ بَيْنَنَا وَبَيْنَ الرِّجَالِ حِبَالًا، وَإِنَّا قَاطِعُوهَا – يَعْنِي الْعُهُودَ – فَهَلْ عَسَيْتَ إِنْ نَحْنُ فَعَلْنَا ذَلِكَ، ثُمَّ أَظْهَرَكَ اللهُ أَنْ تَرْجِعَ إِلَى قَوْمِكَ، وَتَدَعَنَا؟ – “ইয়া রাসুলাল্লাহ! (ইয়াসরীব/মদিনা-এ) আমাদের এবং (স্থানীয়) ইহূদী লোকদের মাঝে একটি মৈত্রিচুক্তি আছে, আর (আজকে আপনি যেসব শর্তের উপরে আমাদের থেকে বায়াত নিতে যাচ্ছেন, তাতে পরোক্ষ ভাবে) আমরা নির্ঘাত সে(ই মৈত্রিচুক্তি)টিকে কর্তন করে ফেলবো। (এখন) যদি আমরা (বায়াতের মাধ্যমে) সেটা (কর্তন) করে ফেলি, তারপর আল্লাহ যদি (ভবিষ্যতে) আপনাকে (মক্কার মুশরেকদের উপরে) বিজয় দান করেন, তখন কি আপনার এমন করার সম্ভাবনা আছে যে, আমাদেরকে (ইয়াসরীব-এ) ফেলে রেখে আপনি আপনার কওমের কাছে ফিরে যাবেন”? জবাবে রাসুলুল্লাহ ﷺ মুচকি হেসে বললেন- بَلِ الدَّمَ الدَّمَ، وَالْهَدْمَ الْهَدْمَ أَنَا مِنْكُمْ، وَأَنْتُمْ مِنِّي أُحَارِبُ مَنْ حَارَبْتُمْ، وَأُسَالِمُ مَنْ سَالَمْتُمْ – “বরং (আমার) জীবন (আর তোমাদের মদিনাবাসী আনসার মুসলমানদের) জীবন এবং (আমার) ধ্বংস (আর তোমাদের মদিনাবাসী আনসারদের) ধ্বংস (মূলত: একই শরীরের মতো আষ্টেপিষ্টে গাঁথা থাকবে -আমরন)। (শুনে রাখো), আমি (যেমন আমরন) তোমাদের মধ্যেকার (একজন হয়ে থাকবো, তেমনি) তোমরা(ও) আমার (হয়ে থাকবে)। তোমরা যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে আমিও তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো এবং তোমরা যাদের সাথে সন্ধি করবে আমিও তাদের সাথে সন্ধি করবো”। এরপর রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন- أَخْرِجُوا إِلَيَّ مِنْكُمْ اثْنَيْ عَشَرَ نَقِيبًا يَكُونُونَ عَلَى قَوْمِهِمْ – “তোমরা তোমাদের মধ্য থেকে (এমন) বার জনকে নকীব নির্বাচন করে আমাকে দাও, যারা তাদের কওমের উপরে (দায়িত্বশীল হিসেবে থাকবে)”। ফলে তারা আউস গোত্র থেকে ৩ জনকে এবং খাযরাজ গোত্র থেকে ৭ জনকে (এই মোট ১২ জনকে) নকীব নির্বাচন করে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর সামনে পেশ করলেন। এরপর কথাবার্তার একপর্যায়ে আব্বাস বিন উবাদাহ বিন নাদ্বলাহ রা. বললেন- وَالَّذِي بَعَثَكَ بِالْحَقِّ لَئِنْ شِئْتَ لَنَمِيلَنَّ عَلَى أَهْلِ مِنًى غَدًا بِأَسْيَافِنَا – “(ইয়া রাসুলাল্লাহ!) ওই সত্ত্বার কসম যিঁনি আপনাকে সত্য সহকারে পাঠিয়েছেন, আপনি যদি চান তাহলে আগামিকাল আমরা মিনা’য় অবস্থানকারীদের উপরে আমাদের তরবারীর সাহায্যে আক্রমন চালাতে পারি’। রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন- لَمْ أُؤمَرْ بِذَلِكَ . رواه أحمد بن حنبل في مسنده , مسند المكيين بقية حديث كعب بن مالك الأنصاري : ٢٥/٨٩ رقم ١٥٧٩٨، قال شعيب الأرنؤوط : حديث قوي و هذا إسناد حسن – “আমাকে (এখনো পর্যন্ত) এব্যাপের নির্দেশ দেয়া হয়নি। (সুতরাং, তোমরা এমন কিছুই করতে যাবে না)”। [মুসনাদে আহমদ– ২৫/৮৯ হাদিস ১৫৭৯৮; দালাউলুন নুবুওয়াহ, ইমাম বাইহাকী- ২/৪৪৪]
ফায়দা: (১) এই হাদিসে বর্ণিত আব্বাস বিন উবাদাহ বিন নাদ্বলাহ রা.-এর কথা- وَالَّذِي بَعَثَكَ بِالْحَقِّ لَئِنْ شِئْتَ لَنَمِيلَنَّ عَلَى أَهْلِ مِنًى غَدًا بِأَسْيَافِنَا – “(ইয়া রাসুলাল্লাহ!) ওই সত্ত্বার কসম যিঁনি আপনাকে সত্য সহকারে পাঠিয়েছেন, আপনি যদি চান তাহলে আগামিকাল আমরা মিনা’য় অবস্থানকারীদের উপরে আমাদের তরবারীর সাহায্যে আক্রমন চালাতে পারি’, এবং তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কথা- لَمْ أُؤمَرْ بِذَلِكَ – “আমাকে (এখনো পর্যন্ত) এব্যাপের নির্দেশ দেয়া হয়নি। (সুতরাং, তোমরা এমন কিছুই করতে যাবে না)”-এটা একথার দলিল যে, ‘আক্বাবাহ’র ২য় বাইয়াত’ সম্পন্ন হল কিন্তু তখনো পর্যন্তও আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের কারো জন্যই দ্বীনের দুশমনদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়া তথা সশস্ত্র জিহাদ করার অনুমতি নাজিল করেন নি। (২) ‘আক্বাবাহ’র ২য় বাইয়াত’-এর সময় মদিনার মুসলমানগণ রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে যে যুদ্ধের বাইয়াত করেছিলেন, সেটা উক্ত বাইয়াতের দিন থেকেই মদিনাবাসী মুসলমানদের উপরে কার্যকর হবার জন্য ছিল নয়, বরং ভবিষ্যতে রাসুলুল্লাহ ﷺ যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় তাদের কাছে যাবেন, তখন থেকে এ ওয়াদা কার্যকর হবার জন্য।
‘আক্বাবাহ’র ২য় বায়াত’ সম্পন্ন হবার পর রাসুলুল্লাহ ﷺ যখন সকলকে নিজ নিজ তাবুতে ফিরে যেতে বললেন তখন সকলে ফিরে গেলেন। ভোর হবার আগেই তারা মক্কা থেকে মদিনার উদ্দেশ্যে প্রস্থান করেন। সকাল হতেই মক্কার মুশরেকদের কানে এ খবর পৌছে গেল, ফলে মুশরেকদের কেউ কেউ মদিনার দিকে গমনকারী মুসলমানদের পিছু ধাওয়া করার জন্য রওনা হল, কিন্তু ততক্ষনে ওইসকল মুসলমানগণ তাদের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ায় সেবারের মতো তাদেরকে আর ধরা সম্ভব হল না। তারা শুধুমাত্র সা’দ ইবনে উবাদাহ রা.-কে ধরতে সমর্থ হয় এবং তাকে বেদম প্রহার করে। পরে যুবায়েল ইবনে মুতইম এসে তাকে মুশরেকদের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান।
নবুওতের ১৩ তম বছর: মক্কার থেকে রাসুলুল্লাহ ﷺ ও মুসলমানদের মদিনায় হিজরত
বলাই বাহুল্য, এ অবস্থার পর মক্কায় মুসলমানদের জীবন অনেক ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়, এরই মধ্যে রাসুলুল্লাহ ﷺ আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মদিনায় হিজরতের ইশারা পেয়ে মক্কা’র মুসলমানদেরকে মদিনায় হিজরত করার অনুমতি দেন। উরওয়াহ বিন যুবায়ের-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, আয়েশা সিদ্দিকা রা. বর্ণনা করেছেন-فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ” قَدْ أُرِيتُ دَارَ هِجْرَتِكُمْ ، رَأَيْتُ سَبْخَةً ذَاتَ نَخْلٍ بَيْنَ لاَبَتَيْنِ ” ، وَهُمَا الحَرَّتَانِ ، فَهَاجَرَ مَنْ هَاجَرَ قِبَلَ المَدِينَةِ حِينَ ذَكَرَ ذَلِكَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، وَرَجَعَ إِلَى المَدِينَةِ بَعْضُ مَنْ كَانَ هَاجَرَ إِلَى أَرْضِ الحَبَشَةِ ، وَتَجَهَّزَ أَبُو بَكْرٍ مُهَاجِرًا ، فَقَالَ لَهُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ” عَلَى رِسْلِكَ ، فَإِنِّي أَرْجُو أَنْ يُؤْذَنَ لِي ” ، قَالَ أَبُو بَكْرٍ : هَلْ تَرْجُو ذَلِكَ بِأَبِي أَنْتَ ؟ قَالَ : ” نَعَمْ ” ، فَحَبَسَ أَبُو بَكْرٍ نَفْسَهُ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِيَصْحَبَهُ ، وَعَلَفَ رَاحِلَتَيْنِ كَانَتَا عِنْدَهُ وَرَقَ السَّمُرِ أَرْبَعَةَ أَشْهُرٍ . رواه البخاري في صحيحه , كتاب الكفالة , باب جوار أبي بكر في عهد النبي صلى الله عليه وسلم وعقده : ٢/٨٠٤ رقم ٢٠٧٦ – “(মদিনায় হিজরতের আগে) রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করলেন: ‘আমাকে (স্বপ্নে ওহীর মাধ্যমে) তোমাদের হিজরতের আবাস্থল দেখানো হয়েছে। আমি দেখলাম, দুই পাহাড়ি প্রান্তরের মধ্যভাগে – আর ওই দুটি হল দু-হাররা- (এর মধ্যভাগে) অবস্থিত খেজুর গাছে ভরা একটি লবনাক্ত জলা-ভূমি’। রাসুলুল্লাহ ﷺ-এ একথা শোনার পরে, যারা মদিনার দিকে হিজরত করার (তারা মদিনার দিকে) হিজরত করলেন, আর কিছুলোক যারা হাবশাহ’র দিকে হিজরত করছিল (তারা এখবর শুনতে পেয়ে) মদিনার দিকে ফিরে গেলেন। (আমার পিতা) আবু বকরও (মদিনায়) হিজরতের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ তাকে বললেন: ‘আপনি (এখনই) যাওয়া থেকে বিরত থাকুন, আমার (মনের) দৃঢ় বাসনা, (অচিরে) আমাকেও (মদিনায় হিজরতের) অনুমতি দেয়া হোক’। আবু বকর রা. বললেন: ‘আপনার জন্য আমার পিতা উৎসর্গীত হোন, আপনিও এর বাসনা করছেন’! রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন: ‘হ্যাঁ’। ফলে আবু বকর রা. রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর (সফর)সঙ্গী হবার জন্য (তার হাবশায় হিজরত করা থেকে) বিরত থাকলেন, এবং তার কাছে যে দুটি সওয়ারী ছিল, তিনি চার মাস পর্যন্ত ওগুলোকে সামর গাছের পাতা খাওয়ালেন”।[সহিহ বুখারী- ২/৮০৪ হাদিস ২০৭৬]
হিজরতের অনুমতি পাওয়ার পর মক্কার মুসলমানগণ একে একে যে যখন যেভাবে সুযোগ পেয়েছেন, তিনিই মদিনায় হিজরত করে চলে যেতে থাকেন। মদিনার পানে হিজরতের এধারা চলতেই থাকে। মক্কার অবস্থা তখন এমন হয় যে, কিছু সংখ্যক মুসলমান কাফেরদের কবজায় আটোক অবস্থায় বা কড়া নজরদারিতে থাকে এবং রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে শুধুমাত্র আবু বকর সিদ্দিক রা. এবং আলী বিন আবি ত্বালেব রা.-ই রয়ে যান। কাফেররা যখন দেখতে পেল যে, মুসলমানরা গোপনে গোপনে মক্কা ছেড়ে মদিনায় গিয়ে বিরাট এক জামাআতে পরিণত হচ্ছে এবং এভাবে তাদের সংখ্যা বাড়তে দিলে একসময় মদিনার মুসলমানরাই মক্কার উপরে প্রভাব বিস্তার করে ফেলবে, তখন বিশেষ করে কুরায়েশ নেতারা মক্কার ‘দারুন নাদওয়া’তে একত্রিত হয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, ‘যেহেতু মুহাম্মাদ (ﷺ)ও এখানে তার রয়ে যাওয়া কয়েকজন সাথিকে সঙ্গে নিয়ে যে কোনো সুযোগে মদিনায় হিজরত করে চলে যেতে পারে, তাই এটাই সুবর্ণ সুযোগ যে, খোদ্ মুহাম্মাদ (ﷺ)-কেই হত্যা করে ফেলা হোক, এতে করে ইসলামের শিকড়ই উপড়ে যাবে। আরো সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, মক্কার সকল গোত্রের একজন করে প্রতিনিধি একেত্রে মিলে তাকে হত্যা করবে, যাতে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর কুরাইশী গোত্র ‘বনী আব্দে মানাফ’ কখনো এর প্রতিশোধ নিতে চাইলে এতগুলো গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কোনো সাহস কখনো না দেখাতে পারে। সিদ্ধান্ত হয়, ওই রাত্রেই মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে হত্যা করা হবে। আল্লাহ তাআলা একথা রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে ওহীর মাধ্যমে জানিয়ে দেন। ফলে তিঁনি ওই দিনই দুপুরে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা.-কে নিয়ে মদিনায় হিজরত করার পরিকল্পনা নকশা ঠিক করেন।
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-
وَ إِذْ يَمْكُرُ بِكَ الَّذِينَ كَفَرُوا لِيُثْبِتُوكَ أَوْ يَقْتُلُوكَ أَوْ يُخْرِجُوكَ ۚ وَيَمْكُرُونَ وَيَمْكُرُ اللَّهُ ۖ وَاللَّهُ خَيْرُ الْمَاكِرِينَ
“আর (হে নবী! স্মরণ করো) যখন কাফেররা তোমাকে -(হয়) বন্দিকরা, নাহয় কতল করা অথবা (দেশ থেকে) তোমাকে বের করে দেয়ার উদ্দেশ্যে তোমার বিরুদ্ধে ষঢ়যন্ত্র করছিল। তারা (তোমার বিরুদ্ধে বদ) কৌশল আঁটছিল, আর (এদিকে) আল্লাহ কৌশল করছিলেন (তোমাকে তাদের ষঢ়যন্ত্র থেকে নিরাপদ রাখার)। আর আল্লাহ হলেন কৌশলকারীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ (কৌশলকারী)”। [সূরা আনফাল ৩০]
আল্লাহ তাআলা’র পক্ষ থেকে ওহী সূত্রে বিশ্বনবী মুহাম্মাদ মুস্তফা ﷺ-এর কাছে কাফেরদের এসব চক্রান্ত ও ষঢ়যন্ত্রের খবর এবং ওই রাতেই মক্কা ছেড়ে মদিনার পানে হিজরত করে চলে যাওয়ার নির্দেশ আসার পর, নবীজি ﷺ ওই রাতেই নিজের ঘরে চাচাতো ভাই হযরত আলী বিন আবি ত্বালেব রা.-কে অভয় দিয়ে এবং কিছু আমানত তাঁর প্রাপকদের কাছে পৌছে দেয়ার জন্য তাকে দায়িত্ব দিয়ে হিজরতের নিয়তে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নেন। এসময় মুশরেকরা তাদের পরিকল্পনা মতো ওই রাতেই রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর বাড়ির চারি দিক ঘিরে রাখে, কিন্তু আল্লাহ তাআলা নিজ কুদরতে রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে কাফেরদের চোখ ও কবজা থেকে বাঁচিয়ে নেন, ফলে রাসুলুল্লাহ ﷺ কাফেরদের চোখে ধুলো দিয়ে সোজা তাঁর প্রিয় সাহাবী হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর বাড়িতে গিয়ে তাকে সহ ওই রাতেই মদিনায় হিজরতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
ইকরিমাহ রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বর্ণনা করেছেন-أُنْزِلَ عَلَى رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ ابْنُ أَرْبَعِينَ، فَمَكَثَ ثَلَاثَ عَشْرَةَ سَنَةً، ثُمَّ أُمِرَ بِالْهِجْرَةِ، فَهَاجَرَ إِلَى الْمَدِينَةِ . رواه البخاري في صحيحه , كتاب مناقب الأنصار , باب مبعث النبي صلى الله عليه وسلم : ٥/٤٥ رقم ٣٨٥١ – “রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর যখন চল্লিশ বছর বয়স, তখন তাঁর উপরে (নবুওতের সুসংবাদ সহকারে ওহী) নাজিল হয়। এরপর তিঁনি (মক্কায়) বাস করেন (প্রায়) তের বছর, এরপর (আল্লাহ তাআলার তরফ থেকে) তাঁকে হিজরতের নির্দেশ দেয়া হয়, ফলে তিঁনি মদিনায় হিজরত করেন”। [সহিহ বুখারী- ৫/৪৫ হাদিস ৩৮৫১]
আবু সালামাহ রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, আব্দুল্লাহ বিন আদী বিন হামরা আয-যুহরী রা. বর্ণনা করেছেন- رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَاقِفًا عَلَى الْحَزْوَرَةِ فَقَالَ وَاللَّهِ إِنَّكِ لَخَيْرُ أَرْضِ اللَّهِ وَأَحَبُّ أَرْضِ اللَّهِ إِلَى اللَّهِ وَلَوْلَا أَنِّي أُخْرِجْتُ مِنْكِ مَا خَرَجْتُ . رواه الترمذيُّ في سننه , أبواب المناقب عن رسول الله صلى الله عليه وسلم , باب في فضل مكة : ٦/٢٠٧ رقم ٣٩٢٥، و صححه الألباني في صحيح الترمذي – “আমি দেখলাম, রাসুলুল্লাহ ﷺ (মক্কা বাজারের) হাজওয়ারাহ’য় দাঁড়ান অবস্থায় (মক্কা নগরীকে উদ্দেশ্য করে) বলছেন- “আল্লাহ’র কসম! (হে মক্কা নগরী) নিশ্চই তুমি হলে আল্লাহ’র (সৃষ্ট পৃথিবীর) সর্বোত্তম ভূমি এবং আল্লাহ’র নিকট (তুমি) আল্লাহ’র সব থেকে প্রিয় ভূমি। তোমার থেকে আমাকে যদি বের করে দেয়া না হত, তাহলে আমি (তোমার বুক থেকে) বের হতাম না”। [জামে তিরমিযী– ৬/২০৭ হাদিস ৩৯২৫; সুনানে ইবনে মাজাহ- ২/১০৩৭ হাদিস ৩১০৮; মুসনাদে আহমদ– ৪/৩০৫ হাদিস ১৮২৪১; সুনানে দারেমী– ২/৩১১ হাদিস ২৫১০; সহিহ ইবনে হিব্বান- ৯/২৩ হাদিস ৩৭০৯; মুসতাদরাকে হাকেম- ১/৬৬১ হাদিস ১৭৮৭]
আবু জ্ববইয়ান রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বর্ণনা করেছেন- كان رسول الله – صلى الله عليه وسلم – بمكة، ثم أمر بالهجرة، وأنزل عليه: {وَقُلْ رَبِّ أَدْخِلْنِي مُدْخَلَ صِدْقٍ وَأَخْرِجْنِي مُخْرَجَ صِدْقٍ وَاجْعَلْ لِي مِنْ لَدُنْكَ سُلْطَانًا نَصِيرًا . رواه أحمد في مسنده , مسند عبد الله بن العباس بن عبد المطلب عن النبي صلى الله عليه وسلم , بداية مسند عبد الله بن العباس: ١/٢٢٣ رقم ١٩٤٩، قال محمد الصوياني في السيرة النبوية كما جاءت في الأحاديث الصحيحة : ١/٢٥١ : إسناده حسن، قال شعيب الأرنؤوط في تعليقه علي المسند لأحمد بن حنبل : إسناده ضعيف – “রাসুলুল্লাহ ﷺ মক্কায় (বসবাস রত) ছিলেন (প্রায় তের বছর), তারপর তাঁকে হিজরতের নির্দেশ দেয়া হয় এবং (হিজরতের আগে) তাঁর উপরে নাজিল হয় (সুরা ইসরা/বনী ইসরাঈল-এর ৮০ নম্বর এই আয়াতটি)- وَقُلْ رَبِّ أَدْخِلْنِي مُدْخَلَ صِدْقٍ وَأَخْرِجْنِي مُخْرَجَ صِدْقٍ وَاجْعَلْ لِي مِنْ لَدُنْكَ سُلْطَانًا نَصِيرًا – “(হে নবী) তুমি বলে: ‘হে (আমার) রব (প্রভু পরওয়ারদেগার)! আমাকে (যে এলাকায় প্রবেশ করান না কেনো, আমাকে সর্বদা) সত্য সহকারে প্রবেশকারী রূপে প্রবেশ করান এবং আমাকে (যে এলাকা থেকে বের করান না কেনো, আমাকে সর্বদা) সত্য সহকারে প্রস্থানকারী রূপে বের করান, আর আমার জন্য সুলত্বান (ক্ষমতা-শক্তি ও দলিল-প্রমাণ)কে আপনার পক্ষ থেকে (বিশেষ) সাহায্যকারী বানিয়ে দিন”। [মুসনাদে আহমদ– ১/২২৩ হাদিস ১৯৪৯; জামে তিরমিযী- ৫/২০৭ হাদিস ৩১৩৯; মুসতাদরাকে হাকেম- ৩/৫৩৫ হাদিস ৪৩১৮; সুনানুল কুবরা, ইমাম বাইহাকী- ৯/৯ হাদিস ১৭১৭৯; জামেউল বায়ান, ইমাম তাবারী– ১৫/১৮৫ হাদিস ১৭০৭৭]
রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর মক্কা থেকে হিজরতের এই ঘটনাটি ঘটে ‘আক্বাবাহ’র শেষ বাইয়াত’-এর প্রায় তিন মাস পরে; তথা নবুওতের ১৪ তম বছরে, (অগ্রাধিকারযোগ্য মতানুসারে) দিনটি ছিল আরবী তারিখ হিসেবে ‘সফর’ মাসের ২৭ তারিখ বৃহ:ষ্পতিবার দিবাগত শুক্রবার রাত (মোতাবেক ১০-ই সেপ্টেম্বর ৬২২ ইং)।
[[[এই পেজের বর্ণিত তথ্য ও তাহ্বক্বীক আরো বিস্তারিত ভাবে জানতে দেখুন: আস-সিয়ার ওয়াল মাগাজী, ইমাম ইবনে ইসহাক- ১/১৭৪-২৯৭; সিরাতে ইবনে হিশাম- ১/৩২১-৪৮৫; আনসাবুল আশরাফ, ইমাম বালাযুরী- ১/১৯৮-২৬১; আত-ত্ববাক্বাত, ইবনে সা’দ- ১/১৫৯-১৭৫; তারিখুল রুসুল ওয়াল মুলুক, ইমাম তাবারী- ২/২৯৮-৩৯২; আস-সিরাতুন নাববিয়্যাহ, ইমাম ইবনে হিব্বান- ১/৯৩-১৩৭; আদ-দুরার ফি ইখতিছারিল মাগাজী ওয়াস সিয়ার, ইমাম ইবনু আব্দিল বার- ১/৪৮-৮০; আর-রাউজুল উনুফ, ইমাম সুহাইলী- ৩/১২০-৪/১৮১; উয়ূনুল আছার, ইবনু সাইয়্যেদুন নাস- ১/১৩৫-২০৯; তারিখুল ইসলাম, ইমাম যাহাবী- ১/১৮৩-২/৩১; আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইবনে কাসির- ৩/৬৬-১৯৫; মাজমাউয যাওয়ায়ীদ, হাইছামী- ৬/৩৬০; ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার- ৭/১৮৩; উসদুল গাবাহ- ৪/৪০৯; আল ইসাবাহ- ১/৯১; খাসায়েসুল কুবরা, ইমাম সুয়ূতী- ১/১৮৫; শারহু মাওয়াহিবিল লাদুনিয়্যাহ, যুরকানী- ১/৫০৩-২/১৪৩; রাসুলে রহমত, মওলানা আবুল কালাম আযাদ- ১৫৯-১৯৭ পৃষ্ঠা (ইঃফাঃ); সিরাতুল মুস্তফা, মওলানা ইদ্রিস কান্দালভী- ১/২৪১-৩৯৯; খাতামুন নাবিয়্যীন, মুহাম্মাদ আবু জাহরাহ- ১/৩৬০-৪৫৭; সহিহ সিরাতিন নাবাউইয়্যাহ, ইব্রাহিম আলী- ১/৭৩-১১৯]]]
>>> মূল সূচিপত্র (index) থেকে এ পেজের পূর্ববর্তী বা পরবর্তী আলোচনা পড়তে [এখানে ক্লিক করুন]