ইসলামী খিলাফত ও খলিফা / সুলতান / আমীর / ওলী – কুরআন কারিমের আয়াত

ইসলামী খিলাফত ও খলিফা / সুলতান / আমীর / ওলী সম্পর্কে কুরআন কারিমের আয়াত সমূহ

 

بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیۡمِ

الحمد لله و الصلاة و السلام على رسوله محمد و على أله و أمّته

 

[উল্লেখ্য, এখানে উল্লেখিত আয়াত সমূহ ও অনুবাদ’কে কোনো বিজ্ঞ মুহাক্কেক আলেমের পরামর্শ ব্যাতীত কারো কাছে বর্ণনা করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিচ্ছি, যাতে আমার অযোগ্যতার কারণে এখানে কোনো উল্লেখযোগ্য ভুল হয়ে থাকলে তা সংশোধন করে নেয়ার আগেই মানব সমাজে ছড়িয়ে না যায়। এগুলো পড়ুন ইলম অর্জনের জন্য এবং যোগ্য আলেম থেকে তা বুঝিয়ে নিন। আর কোনো যোগ্য চোখে উল্লেখযোগ্য ভুল ধরা পড়লে তা আমাকে অবগত করুন।]

আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-

وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَائِكَةِ إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً ۖ قَالُوا أَتَجْعَلُ فِيهَا مَن يُفْسِدُ فِيهَا وَيَسْفِكُ الدِّمَاءَ وَنَحْنُ نُسَبِّحُ بِحَمْدِكَ وَنُقَدِّسُ لَكَ ۖ قَالَ إِنِّي أَعْلَمُ مَا لَا تَعْلَمُونَ
 
‘আর যখন তোমার রব ফেরেশতাদেরকে বললেন: নিশ্চই আমি পৃথিবীতে (আমার) খলিফাহ্ (প্রতিনিধি) সৃষ্টি করবো। (তখন) তারা বললো: আপনি কি সেখানে (তাদেরকে) সৃষ্টি করবেন, যারা তাতে ফ্যাসাদ বাঁধাবে এবং (একে অপরের) রক্ত ঝড়াবে। আর (তাদেরকে সৃষ্টি করার কি দরকার?) আমরা (ফেরেশতারাই-তো) আপনার প্রশংসা সহকারে তাসবিহ করছি এবং আপনার পবিত্রতা বয়ান করছি। (তখন তোমার রব) বললেন: নিশ্চই আমি যা জানি তোমরা তা জানো না’ [সূরা বাকারাহ ৩০]

হযরত আদম আ. যে পৃথিবীতে আল্লাহ তাআলা’র প্রথম মানব খলিফা (স্থলাভিষিক্ত-প্রতিনিধি) -এ ব্যাপারে সকল নির্ভরযোগ্য মুফাসসিরিনে কেরাম একমত। তবে তিনিই শেষ মানব খলিফা নন। বরং আল্লাহ’র দ্বীন ও শরীয়ত কায়েম রাখার জন্য তাঁর বংশধরদের মধ্য থেকে যাঁরা নবী ও রাসুল হিসেবে পৃথিবীতে এসেছেন এবং তাঁদের উম্মতদের মধ্যে মুমিন অনুসারীগণ সকলে আল্লাহ তাআলা’র খলিফা (স্থলাভিষিক্ত-প্রতিনিধি), যারা আল্লাহ তাআলার হুকুম আহক্বাম পৃথিবীতে কায়েম করার জন্য নিয়োজিত’। [তাফসিরে ইবনে কাসির- ১/১০৯; উযওয়াউল বয়ান, শানক্বিতী- ১/১১৯]

ইমাম আবুল হাসান আলী বিন মুহাম্মাদ মাওয়ার্দি রহ. (মৃ: ৪৫০ হি:) এখানে إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً নিশ্চই আমি পৃথিবীতে (আমার) খলিফাহ্ (প্রতিনিধি) সৃষ্টি করবো -এর ব্যাখ্যায় লিখেছেন : و في خِلافَةِ آدَمَ وذُرِّيَّتِهِ ثَلاثَةُ أقاوِيلَ: أحَدُها: أنَّهُ كانَ في الأرْضِ الجِنُّ، فَأفْسَدُوا فِيها، سَفَكُوا الدِّماءَ، فَأُهْلِكُوا، فَجُعِلَ آدَمُ وذُرِّيَّتُهُ بَدَلَهُمْ، وهَذا قَوْلُ ابْنِ عَبّاسٍ. و الثّانِي: أنَّهُ أرادَ قَوْمًا يَخْلُفُ بَعْضُهم بَعْضًا مِن ولَدِ آدَمَ، الَّذِينَ يَخْلُفُونَ أباهم آدَمَ في إقامَةِ الحَقِّ وعِمارَةِ الأرْضِ، وهَذا قَوْلُ الحَسَنِ البَصْرِيِّ. و الثّالِثُ: أنَّهُ أرادَ: جاعِلٌ في الأرْضِ خَلِيفَةً يَخْلُفُنِي في الحُكْمِ بَيْنَ خَلْقِي، وهو آدَمُ، ومَن قامَ مَقامَهُ مِن ولَدِهِ، وهَذا قَوْلُ ابْنِ مَسْعُودٍ. – ‘আদম ও তাঁর বংশধর’রা (পৃথিবীতে) খলিফা হওয়ার অর্থ সম্পর্কে তিনটি বক্তব্য রয়েছে। (১) একসময় পৃথিবীতে জ্বিনরা বসবাস করতো। পরে তারা সেখানে ফ্যাসাদ বাঁধায় এবং (একে অন্যের) রক্ত ঝড়ায়। ফলে তাদেরকে (আল্লাহ’র হুকুমে) ধ্বংস করে দেয়া হয়। এরপর তাদের স্থলে আদম ও তাঁর বংশধর’দেরকে (পৃথিবীর খলিফা) বানানো হয়। একথা বলেছেন ইবনে আব্বাস রা.। (২) আল্লাহ তাআলা ইচ্ছে করলেন, তিনি আদম সন্তানদের মধ্য থেকে কতকের পর কতককে (পৃথিবীতে) আনবেন, যারা (দ্বীনে) আল-হক্ব (তথা আল্লাহ’র সত্য দ্বীন)কে কায়েম রাখবে এবং (সে অনুযায়ী) পৃথিবীকে গড়ে তোলার ব্যাপারে (আল্লাহ’র) প্রতিনিধিত্ব করবে। এ কথা বলেছেন হাসান বসরী রহ.। (৩) আল্লাহ তাআলা ইচ্ছে করলেন, তিনি পৃথিবীতে (তাঁর) খলিফা পাঠাবেন, যে তাঁর সৃষ্টির মাঝে তাঁর দেয়া হুকুম-আহকাম (কায়েমের) ব্যাপারে প্রতিনিধিত্ব করবে। আর তিনি হলেন আদম আ. এবং তার বংশধরদের মধ্যে (তারা) যারা (এ দায়িত্ব পালনার্থে) তার স্থালাভিষিক্ত হবেন। একথা বলেছেন ইবনে মাসউদ রা.’। [আন-নুক্বাত ওয়াল উইয়ূন, মাওয়ার্দি– ১/৯৬ ]

ইমাম মানসুর বিন মুহাম্মাদ সামআনী রহ. (মৃ: ৪৮৯ হি:) إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً নিশ্চই আমি পৃথিবীতে (আমার) খলিফাহ্ (প্রতিনিধি) সৃষ্টি করবো -এর ব্যাখ্যায় বলেছেন : وَاخْتلفُوا فِي أَنه لما سمى خَليفَة؟ مِنْهُم من قَالَ : لِأَنَّهُ خَليفَة الْجِنّ؛ فَإِن الله تَعَالَى لما خلق الأَرْض أسكنها الْجِنّ، وَلما خلق السَّمَاء أسكنها الْمَلَائِكَة، ثمَّ لما خلق آدم أزعج الْجِنّ إِلَى أَطْرَاف الأَرْض؛ فَهُوَ الْخَلِيفَة الْجِنّ فِي الأَرْض. وَ قيل: إِنَّمَا سَمَّاهُ خَليفَة؛ لِأَنَّهُ يخلفه غَيره. فَيكون الْخَلِيفَة بِمَعْنى أَنه يخلف غَيره. وَيكون الْخَلِيفَة أَنه يخلفه غَيره. وَقيل: إِنَّمَا سمى خَليفَة لِأَنَّهُ خَليفَة الله فِي الأَرْض؛ لإِقَامَة أَحْكَامه، وتنفيذ قضاياه، وَهَذَا هُوَ الْأَصَح – ‘আদম আ.-কে কেনো খলিফা বলা হয়েছে -এ ব্যাপারে (মুহাক্কিক মুফাসসিরগণের) দৃষ্টিভঙ্গিতে পার্থক্য রয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন: এর কারণ, তিনি জ্বিন জাতির (ধ্বংসের পর তাদের) স্থলাভিষিক্ত (হয়ে পৃথিবীতে এসেছেন)। আল্লাহ তাআলা যখন পৃথিবী সৃষ্টি করে তাতে জ্বিনদেরকে বসবাস করতে দিলেন এবং আসমান সৃষ্টি করে তাতে ফেরেশতাদেরকে থাকার জন্য দিলেন, এরপর তিনি আদম আ.কে সৃষ্টি করে (পৃথিবীতে পাঠালেন আর) জ্বিনরা পৃথিবীর বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল। এভাবে তিনি হলে পৃথিবীতে জ্বিনদের স্থলাভিষিক্ত। আবার বলা হয়েছে, তাকে এজন্য খলিফা নামে ডাকা হয়েছে, কারণ তাকে অন্য কারো স্থলে স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ, তিনি এই অর্থে খলিফা হলেন যে, তিনি অন্য কারো পরে এসেছেন; তিনি খলিফা হলেন, কারণ তিনি অন্য কারো স্থলে স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। এও বলা হয়েছে যে, তাকে এজন্য খলিফা নামে ডাকা হয়েছে, কারণ তিনি পৃথিবীতে আল্লাহ’র হুকুম-আহকাম কায়েম করা এবং তাঁর বিধানকে বাস্তবায়ন করার জন্য (নিযুক্ত) খলিফা (স্থলাভিষিক্ত প্রতিনিধি)। আর এই ব্যাখ্যাটিই অধিক বিশুদ্ধ’। [তাফসিরে সামআনী– -১/৪১]

ইমাম জাওযী রহ. (মৃ: ৫৯৭ হি:) إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً নিশ্চই আমি পৃথিবীতে (আমার) খলিফাহ্ (প্রতিনিধি) সৃষ্টি করবো -এর ব্যাখ্যায় বলেছেন : وفي مَعْنى خِلافَةِ آَدَمَ قَوْلانِ. أحَدُهُما: أنَّهُ خَلِيفَةٌ عَنِ اللَّهِ تَعالى في إقامَةِ شَرْعِهِ، ودَلائِلِ تَوْحِيدِهِ، والحُكْمِ في خَلْقِهِ، وهَذا قَوْلُ ابْنِ مَسْعُودٍ ومُجاهِدٍ. و الثّانِي: أنَّهُ خَلَفُ مَن سَلَفَ في الأرْضِ قَبْلَهُ، وهَذا قَوْلُ ابْنِ عَبّاسٍ والحَسَنِ – ‘আদম আ.-এর খলিফা হওয়া সম্পর্কে দুইটি বক্তব্য রয়েছে: (এক) তিনি হলেন আল্লাহ তাআলা’র পক্ষ থেকে তাঁর শরীয়ত, তাঁর একত্ববাদের প্রমাণাদি ও তাঁর সৃষ্টির মধ্যে (তাঁর) হুকুম আহকাম কায়েম রাখার জন্য (নিযুক্ত) খলিফা (স্থলাভিষিক্ত প্রতিনিধি); এ কথা বলেছেন ইবনে মাসউদ রা. এবং মুজাহিদ রহ.। (দুই) তিনি তার পূর্বে যারা ছিল তাদের পরিবর্তে (তাদের স্থলাভিষিক্ত হয়ে) পৃথিবীতে এসেছেন। এ কথা বলেছেন ইবনে আব্বাস রা. এবং হাসান রহ.’। [যাদুল মাসির, ইমাম জাওযী- ১/৬০]

ইমাম আবু মুহাম্মাদ বগভী রহ. (মৃ: ৫১৬ হি:) এখানে إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً নিশ্চই আমি পৃথিবীতে (আমার) খলিফাহ্ (প্রতিনিধি) সৃষ্টি করবো -এর ব্যাখ্যায় বলেছেন : والمراد بالخليفة هاهنا آدم سماه خليفة لأنه خلف الجن أي جاء بعدهم وقيل لأنه يخلفه غيره والصحيح أنه خليفة الله في أرضه لإقامة أحكامه وتنفيذ وصاياه – ‘এখানে খলিফা (স্থলাভিষিক্ত প্রতিনিধি) কথাটি দ্বারা (প্রধানত) উদ্দেশ্য (মানুষের আদি পিতা নবী) আদম (আ.)। তাঁকে খলিফা বলা হয়েছে, কারণ তিনি জ্বিনদের পরিবর্তে এসেছেন, অর্থাৎ তিনি তাদের পর (তাদের স্থলাভিষিক্ত হয়ে পৃথিবীতে) এসেছেন। (তাঁকে খলিফা) বলা হয়েছে, কারণ, তাঁকে অন্য কারো স্থলে স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে। সঠিক কথা হল, তিনি হলেন পৃথিবীতে আল্লাহ’র হুকুম-আহক্বাম কায়েম ও তাঁর উপদেশাবলি বাস্তবায়নের জন্য (পৃথিবীতে প্রেরিত) আল্লাহ’র খলিফাহ (স্থলাভিষিক্ত-প্রতিনিধি স্বরূপ)’। [মাআলিমুত তানযিল, ইমাম বগভী– ১/৭৯]

ইমাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুর রহমান ইযিয়ী রহ. (মৃ: ৯০৫ হি:) এখানে إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً নিশ্চই আমি পৃথিবীতে (আমার) খলিফাহ্ (প্রতিনিধি) সৃষ্টি করবো -এর ব্যাখ্যায় বলেছেন : يعني آدم هو خليفة الله في أرضه ينفذ قضاء الله وأحكامه أو المراد من الخليفة البدل، أي: من الجن والملائكة فإنهما كانا سكان الأرض حينئذ أو المراد قوم يخلف بعضهم بعضًا قرنًا بعد قرن كقوله تعالى: وهو الذي جعلكم خلائف الأرض – ‘এর অর্থ হচ্ছে: আদম আ. হলেন আল্লাহ’র পৃথিবীতে আল্লাহ’র (প্রতিনিধি স্বরূপ নিযুক্ত একজন) খলিফা, যিনি আল্লাহ’র হুকুম-আহকাম ও বিধান বাস্তবায়ন করবেন। কিংবা খলিফা দ্বারা এখানে পরিবর্তন উদ্দেশ্য, অর্থাৎ জ্বিন ও ফেরেশতা (দের পরিবর্তে আদম জাতিকে পৃথিবীতে খলিফা/স্থলাভিষিক্ত-প্রতিনিধি বানানো হয়েছে)। বস্তুতঃ কোনো এক সময় তারা উভয়ে (এই) পৃথিবীতে বাস করতো, (যার মধ্যে জ্বিন জাতি আল্লাহ’র নাফরমানী ও ফিতনা-ফ্যাসাদ করায় তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়া হয়)। অথবা এর দ্বারা উদ্দেশ্য (আদমের বংশধর) মানব গোষ্ঠি, যারা এক জামানার পর আরেক জামানায় (বিভিন্ন ঘটনার পরিক্রমায়) একটি গোষ্ঠির স্থলাভিষিক্ত হয়ে আরেকটি গোষ্ঠি (পৃথিবীতে) আসতে থাকবে। যেমন আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন: وَهُوَ الَّذِي جَعَلَكُمْ خَلَائِفَ الْأَرْضِ – ‘আর তিনি (আল্লাহ) যিনি (পূর্বের জাতিগুলোর পর) তোমাদেরকে পৃথিবীর খলিফা (স্থলাভিষিক্ত প্রতিনিধি) বানিয়েছেন…..’[জামেউল বয়ান, ইমাম ইযিয়ী]

ইমাম ইবনে জারীর তাবারী রহ. (মৃ: ৩১০ হি:) নিজ সনদে বর্ণনা করেছেন যে, ইবনে আব্বাস রা., ইবনে মাসউদ রা. সহ রাসুলুল্লাহ সা.-এর বহু সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে যেأن الله جل ثناؤه قال للملائكة : ” إني جاعل في الأرض خليفة ” قالوا : ربنا وما يكون ذلك الخليفة ؟ قال : يكون له ذرية يفسدون في الأرض ويتحاسدون ويقتل بعضهم بعضا . فكان تأويل الآية على هذه الرواية التي ذكرناها عن ابن مسعود وابن عباس : إني جاعل في الأرض خليفة مني يخلفني في الحكم بين خلقي . وذلك الخليفة هو آدم ومن قام مقامه في طاعة الله والحكم بالعدل بين خلقه – ‘আল্লাহ তাআলা ফেরেশতা দেরকে বললেন: إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً নিশ্চই আমি পৃথিবীতে (আমার) খলিফাহ্ (প্রতিনিধি) বানাবো। তখন ফেরেশতা জিজ্ঞেস করলো: হে আমাদের রব! সেই খলিফা কে হবে? আল্লাহ বললেন: (আদম হবে আমার প্রথম খলিফা/স্থলাভিষিক্ত-প্রতিনিধি। তবে) তার বংশধর হবে, যারা জমিনে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করবে, পরষ্পরকে ঘৃনা করবে এবং একে অন্যকে কতল করবে’।…..ইবনে মাসউদ ও ইবনে আব্বাস রা.-এর সূত্রে আলোচ্য আয়াত নিয়ে বর্ণিত এই রেওয়াতটি দীর্ঘ। (তাতে একথাও আছে যে, ইবনে মাসউদ ও ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন) : নিশ্চই আমি পৃথিবীতে আমার এমন খলিফাহ্ (স্থলাভিষিক্ত-প্রতিনিধি) বানাবো। । [তাফসিরে তাবারী– ১/৪৫২, আছার ৬০৫; তাফসিরে ইবনে কাসির– ১/৭৫]

সিদ্দিক হাসান খান রহ. (মৃ: ১৩০৭ হি:) লিখেছেন- والصحيح أنه إنما سمي خليفة لأنه خليفة الله في أرضه لإقامة حدوده وتنفيذ قضاياه – ‘সঠিক কথা হল, তাঁকে শুধুমাত্র এজন্য খলিফা বলা হয়েছে, কারণ তিনি হলেন আল্লাহ’র জিমিনে আল্লাহ’র হুকুম-আহক্বাম কায়েম করা ও তাঁর নির্দেশ বাস্তবায়নের জন্য (প্রেরিত) আল্লাহ’র খলিফাহ (স্থলাভিষিক্ত প্রতিনিধি)’। [ফাতহুল বয়ান– ১/৯৩]

আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-

وَهُوَ الَّذِي جَعَلَكُمْ خَلَائِفَ الْأَرْضِ وَرَفَعَ بَعْضَكُمْ فَوْقَ بَعْضٍ دَرَجَاتٍ لِّيَبْلُوَكُمْ فِي مَا آتَاكُمْ ۗ إِنَّ رَبَّكَ سَرِيعُ الْعِقَابِ وَإِنَّهُ لَغَفُورٌ رَّحِيمٌ

‘আর তিনি (আল্লাহ) যিনি (পূর্বের জাতিগুলোর পর) তোমাদেরকে পৃথিবীর খলিফা (স্থলাভিষিক্ত প্রতিনিধি) বানিয়েছেন এবং তোমাদের কতককে কতকের উপরে উচ্চ মরতবা দিয়েছেন; উদ্দেশ্য তোমাদেরকে যা কিছু দিয়েছেন সে ব্যাপারে তোমাদেরকে যাচাই করে নেয়া’। [সূরা আনআম ১৬৫]
 
আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে সহিহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ সা. এরশাদ করেছেন: إِنَّ الدُّنْيَا حُلْوَةٌ خَضِرَةٌ، وَإِنَّ اللهَ مُسْتَخْلِفُكُمْ فِيهَا، فَيَنْظُرُ كَيْفَ تَعْمَلُونَ، فَاتَّقُوا الدُّنْيَا وَاتَّقُوا النِّسَاءَ، فَإِنَّ أَوَّلَ فِتْنَةِ بَنِي إِسْرَائِيلَ كَانَتْ فِي النِّسَاءِ . رواه مسلم, كتاب الرقاق, باب أكثر أهل الجنة الفقراء وأكثر أهل النار النساء وبيان الفتنة بالنساء: رقم ٢٧٤٢ – ‘নিশ্চই পৃথিবীটা হল মিষ্টি ফল (-এর মতো)। আর আল্লাহ তোমাদেরকে সেখানে খলিফা (স্থলাভিষিক্ত প্রতিনিধি) বানিয়েছেন। সুতরাং, তিনি দেখবেন তোমরা (তাঁর নির্দেশ ও বিধান অনুযায়ী) কেমন আমল করো। তোমরা সতর্ক হয়ে থেকো পৃথিবী (-র ধোকা) থেকে এবং সতর্ক থেকো নারী (-র মায়া, আকর্ষন ও ধোকা) থেকে। বস্তুতঃ বনী ইসরাঈলের প্রথম ফিতনা ছিল নারী’র মধ্যে (যা তাদেরকে ক্রমে ক্রমে গ্রাস করে ফেলে এবং একসময় আল্লাহ’র পথ থেকে ভ্রষ্ঠ বানিয়ে দেয়)’। [সহিহ মুসলীম, হাদিস ২৭৪২]
 

আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-

وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِي ارْتَضَىٰ لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُم مِّن بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا ۚ يَعْبُدُونَنِي لَا يُشْرِكُونَ بِي شَيْئًا ۚ وَمَن كَفَرَ بَعْدَ ذَٰلِكَ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ

‘আল্লাহ ওয়াদা করেছেন, যারা তোমাদের মধ্য থেকে (ইমানের দাবী অনুযায়ী) ইমান আনবে এবং (কুরআন-সুন্নাহ মাফিক) নেক কাজ করবে, তিনি অবশ্য-অবশ্যই তাদেরকে জমিনে খলিফা বানাবেন, যেমনি ভাবে তিনি- তাদের পূর্বে যারা ছিল তাদেরকে খলিফা বানিয়েছিলেন এবং অবশ্য-অবশ্যই তাদের জন্য তাদের (ওই) দ্বীনকে (জমিনের বুকে) সুদৃঢ় করে দিবেন, যে (দ্বীন)টিকে তিনি তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং অবশ্য-অবশ্যই তাদের (উপর বয়ে যাওয়া নিরাপত্তাহীনতা জনিত) ভীতি’র পর (সেই পরিবেশকে) তাদের নিরাপত্তা দ্বারা বদলিয়ে দিবেন’। (তখন) তারা আমার ইবাদত করবে এবং আমার সাথে কোনো কিছুকে শরিক করবে না। (এই অবস্থা যতদিন চলবে, ততদিন আমার ওয়াদা বহাল থাকবে)। কিন্তু এর পর যারা কুফরী করবে (ও অকৃতজ্ঞ হবে), বস্তুত: ওরাই -ওরাই হল ফাসেক গোষ্ঠি। [সূরা নূর ৫৫]

ইমাম ইবনু আবি হাতিম রহ. (মৃ: ৩২৭ হি:) এই আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে নিজ সনদে বর্ণনা করেছেন – (১) সুদ্দী রহ. বলেছেন: هُمْ أَصْحَابُ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اسْتَخْلَفَهُمْ فِي الْأَرْضِ – তারা হলেন মুহাম্মাদ সা.-এর সাহাবীগণ, যাঁদেরকে (ওয়াদা অনুযায়ী পরবর্তীতে আরব ও অনারবী) জমিনে খলিফা বানানো হয়েছিল(২) আব্দুর রহমান বিন আব্দুল হামিদ আল-মিসরী রহ. বলেছেন: أَرَى وِلَايَةَ أَبِي بَكْرٍ وَعُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا – আমার মতে, (এখানে) আবু রকর রা. এবং ওমর রা.-এর শাসন/খিলাফত (সম্পর্কে বলা হয়েছে) (৩) আবু আলিয়া রহ. বলেছেন: انَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَصْحَابُهُ بِمَكَّةَ نَحْوًا مِنْ عَشْرِ سِنِينَ يَدْعُونَ إِلَى اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ وَحْدَهُ وَعِبَادَتِهِ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ سِرًّا وَهُمْ خَائِفُونَ لَا يُؤْمَرُونَ بِالْقِتَالِ حَتَّى أُمِرُوا بَعْدَ الْهِجْرَةِ إِلَى الْمَدِينَةِ، فَقَدِمُوا الْمَدِينَةَ فَأَمَرَهُمُ اللَّهُ بِالْقِتَالِ وَكَانُوا بِهَا خَائِفِينَ يُمْسُونَ فِي السِّلَاحِ، وَيُصْبِحُونَ فِي السِّلَاحِ، فَغَبَرُوا بِذَلِكَ مَا شَاءَ اللَّهُ، ثُمَّ إِنَّ رَجُلًا مِنْ أَصْحَابِهِ قَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ أَبَدَ الدَّهْرِ نَحْنُ خَائِفُونَ هَكَذَا، مَا يَأْتِي عَلَيْنَا يَوْمٌ نَأْمَنُ فِيهِ وَنَضَعُ فِيهِ السِّلَاحَ؟ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ” لَنْ تَغْبُرُوا إِلَّا يَسِيرًا حَتَّى يَجْلِسَ الرَّجُلُ مِنْكُمْ فِي الْمَلَأِ الْعَظِيمِ مُحْتَبِيًا لَيْسَتْ فِيهِ حَدِيدَةٌ، فَأَنْزَلَ اللَّهُ {وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِي ارْتَضَى لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُمْ مِنْ بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا} إِلَى آخِرِ الْآيَةِ فَأَظْهَرَ اللَّهُ جَلَّ وَعَزَّ نَبِيَّهُ عَلَى جَزِيرَةِ الْعَرَبِ فَأَمِنُوا وَوَضَعُوا السِّلَاحَ، ثُمَّ إِنَّ اللَّهَ قَبَضَ نَبِيَّهُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَكَانُوا كَذَلِكَ آمِنَيْنِ فِي إِمَارَةِ أَبِي بَكْرٍ وَعُمَرَ، وَعُثْمَانَ حَتَّى وَقَعُوا فِيمَا وَقَعُوا وَكَفَرُوا بِالنِّعْمَةِ فَأَدْخَلَ اللَّهُ عَلَيْهِمُ الْخَوْفَ الَّذِي كَانَ رُفِعَ عَنْهُمْ، وَاتَّخَذُوا الْحَجَزَةَ، وَالشُّرَطَ وَغَيَّرُوا فَغَيَّرَ مَا بِهِمْ – । (৪) মুকাতিল বিন হাইয়্যান রহ. বলেছেন: فَقَدْ فَعَلَ اللَّهُ بِهِمْ ذَلِكَ وَبِمَنْ كَانَ بَعْدَهُمْ حَتَّى هَذِهِ الْأُمَّةِ، فَمَكَّنَ لَهُمْ فِي الْأَرْضِ، وَأَبْدَلَهُمْ أَمْنًا بَعْدَ خَوْفِهِمْ، وَبَسَطَ لَهُمْ فِي الرِّزْقِ، وَنَصَرَهُمْ عَلَى الْأَعْدَاءِ، فَقَدْ أَنْجَزَ اللَّهُ مَوْعِدَهُ وَبَقِيَ دَيْنُ اللَّهِ فِي رِقَابِهِمْ – বস্তুতঃ (ইতিপূর্বেও যারা খাঁটি মুমিন মুসলমান ছিলেন) আল্লাহ তাআলা তাঁদের সাথে এমনটাই করেছিলেন এবং তাঁদের পরে যারা (বনী ইসরাঈলের মধ্যে ইমান ও আমলে খাঁটি মুমিন মুসলমানিত্বের পরিচয় দিয়ে)ছিলেন (তাদের সাথেও এমনিভাবেই তাঁর ওয়াদার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন)। শেষ পর্যন্ত (সর্বশেষ নবী ও রাসুল মুহাম্মাদ সা.-এর) এই উম্মাত (এসেছে)। পরে তাদেরকে জমিনের বুকে খিলাফত দেয়া হয়েছে, তাদের ভয়-ভীতিকে নিরাপত্তায় বদলিয়ে দেয়া হয়েছে, তাদের রিজেকে স্বচ্ছলতা দেয়া হয়েছে, তাদের দুশমনদের বিপক্ষে তাদেরকে সাহায্য করা হয়েছে। বস্তুত: আল্লাহ তাআলা তাঁর ওয়াদাকে সম্পূর্ণরূপে পূরণ করে দিয়েছেন। আর আল্লাহ’র দ্বীন তাদের গলায় (অলঙ্কার হিসেবে) অবশিষ্ট রয়ে গেছে। (৫) বিশিষ্ট তাবেয়ী কা’ব আহবার রহ. বলেছেন- هُمُ اثْنَا عَشَرَ، فَإِذَا كَانَ عِنْدَ انْقِضَائِهِمْ فَيُجْعَلُ مَكَانَ اثْنَيْ عَشَرَ اثْنَا عَشَرَ مِثْلُهُمْ وَكَذَلِكَ وَعَدَ اللَّهُ هَذِهِ الْأُمَّةَ فَقَرَأَ: { وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ} وَ كَذَلِكَ فَعَلَ بِبَنِي إِسْرَائِيلَ – তারা হলেন বার জন (আল্লাহ’র প্রিয় বান্দা)। যখন তাদের সময় ঘনিয়ে আসে, তখন ওই বার জনের মতো অন্য বার জন তাদের স্থানে স্থান করে নেয়। এভাবে চলতে থাকে। আল্লাহ তাআলা এই উম্মতের ব্যাপারেও এই ওয়াদা করেছেন। (শেষ নবী ও রাসুল মুহাম্মাদ সা.-এর উম্মতের মধ্যেও বার জন এমন মুসলীম হবেন, যাঁদের হাতে মুমূর্ষ দ্বীন পূণরায় জমিনের বুকে সতেজ হয়ে উঠবে)। তারপর তিনি তেলাওয়াত করলেন: وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ –‘আল্লাহ ওয়াদা করেছেন, যারা তোমাদের মধ্য থেকে (ইমানের দাবী অনুযায়ী) ইমান আনবে এবং (কুরআন-সুন্নাহ মাফিক) নেক কাজ করবে, তিনি অবশ্য-অবশ্যই তাদেরকে জমিনে খলিফা বানাবেন, যেমনি ভাবে তিনি- তাদের পূর্বে যারা ছিল তাদেরকে খলিফা বানিয়েছিলেন। আর বনী ইসরাঈলের সাথেও এমনটাই করা হয়েছিল। [তাফসীরে ইবনু আবী হাতিম- ১/২৬২৭-২৬২৯ আছার ১৪৭৬৩, ১৪৭৬৪, ১৪৭৬৯, ১৪৭৭১, ১৪৭৭৩]

ইমাম ইবনে জারীর তাবারী রহ. (মৃ: ৩১০ হি:) বলেছেন: এখানে وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ -‘নেক কাজ করবে’অর্থ وأطاعوا الله ورسوله فيما أمراه ونهياه – তারা (জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে) অনুগত্য করবে আল্লাহ’র ও তাঁর রাসুলের – যে বিষয়ে তাঁরা আদেশ করেছেন বা নিষেধ করেছেন। আরلَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ তিনি অবশ্য-অবশ্যই তাদেরকে জমিনে খলিফা বানাবেন’-এর অর্থ : ليورثنهم الله أرض المشركين من العرب والعجم، فيجعلهم ملوكها وساستها – আল্লাহ তাআলা অবশ্য-অবশ্যই তাদেরকে আরবের মুশরেকদের স্থলে এবং অনারবেও -পৃথিবীর (ব্যাপক এলাকা জুড়ে) ওয়ারিস বানাবেন এবং তাদেরকে (সেখানে) শাসনক্ষমতা ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব দিবেন। আর كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ – ‘যেমনি ভাবে তিনি- তাদের পূর্বে যারা ছিল তাদেরকে খলিফা বানিয়েছিলেন’ অর্থ: كما فعل من قبلهم ذلك ببني إسرائيل ، إذ أهلك الجبابرة بالشأم ، وجعلهم ملوكها وسكانها – যেমনিটা করেছিলেন তাদের পূর্বে বনী ইসরাঈলদের সাথে, যখন শাম-এর জাবাবিরাহ (জালেমানাহ শাসন ব্যবস্থা)কে ধ্বংস করে দিয়ে (তদস্থলে) তাদেরকে শাসক বানানো হয়েছিল ও (তাদের জন্য নিরাপত্তা বেষ্টিত) আবাসস্থলের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। [তাফসীরে তাবারী – ১৮/২১১]

ইমাম আবু বকর মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান আল-আযুরী রহ. (মৃ: ৩২০ হি:) লিখেছেন- اعلموا ، رحمنا الله وإياكم أن خلافة أبي بكر، وعمرَ، وعثمانَ، وعليٍّ رضي الله عنهم بيانها في كتاب الله عز وجل وفي سنة رسول الله صلى الله عليه وسلم، وبيان من قول أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم، وبيان من قول التابعين لهم بإحسان . ولا ينبغي لمسلم عَقَلَ عن الله عز وجل أن يشك في هذا . فأما دليل القرآن: فإن الله عز وجل قال: وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِي ارْتَضَى لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُمْ مِنْ بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا يَعْبُدُونَنِي لَا يُشْرِكُونَ بِي شَيْئًا . فقد واللهِ، أنجز اللهُ الكريمُ لهم ما وعدهم به، جعلهم الخلفاء من بعد رسول الله صلى الله عليه وسلم ومكنهم في البلاد، وفتحوا الفتوح، وغنموا الأموال، وسبوا ذراري الكفار، وأسلم في خلافتهم خلقٌ كثيرٌ، وقاتلوا مَن ارتدَّ عن الإسلام حتى أجلوهم، ورجع بعضهم، كذلك فعل أبو بكر الصديق – رضي الله عنه -، فكان سيفُه فيهم سيفَ حقٍّ إلى أن تقوم الساعة، وكذلك الخليفة الرابع وهو علي بن أبي طالب – رضي الله عنه – كان سيفه في الخوارج سيف حق إلى أن تقوم الساعة، فأعز الله الكريم دينه بخلافتهم، وأذلوا الأعداء، وظهر أمر الله، ولو كره المشركون، وسنوا للمسلمين السنن الشريفة، وكانوا بركة على جميع أمة محمد – صلى الله عليه وسلم من أهل السنة والجماعة . الشريعة للإمام الآجُرِّيِّ : ص٤٣٨، ط/ دار الحديث – জেনো রাখো -আল্লাহ তাআলা আমাদের ও তোমাদের উপর রহম করুন- আবু বকর (সিদ্দিক) রা., ওমর (ফারূক) রা., ওসমান রা. এবং আলী রা. -এর খিলাফতের বয়ান (খোদ্) আল্লাহ’র কিতাব (কুরআন)-এ হয়েছে, রয়েছে রাসুলুল্লাহ সা.-এর হাদিসেও। এর বয়ান রয়েছে রাসুলুল্লাহ সা.-এর সাহাবীগণের (অনেকের) বর্ণনাতে, রয়েছে তাবেয়ী’গণের বর্ণনাতেও। কোনো মুসলমানের জন্যেই এটা উচিৎ নয় যে, সে আল্লাহ তাআলার ব্যাপারে বিবেক খাঁটিয়ে সন্দেহ-সংশয়ে নিপতিত হবে। এক্ষেত্রে কুরআনের দলিল হল, আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন: وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِي ارْتَضَىٰ لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُم مِّن بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا ۚ يَعْبُدُونَنِي لَا يُشْرِكُونَ بِي شَيْئًا‘আল্লাহ ওয়াদা করেছেন, যারা তোমাদের মধ্য থেকে (ইমানের দাবী অনুযায়ী) ইমান আনবে এবং (কুরআন-সুন্নাহ মাফিক) নেক কাজ করবে, তিনি অবশ্য-অবশ্যই তাদেরকে জমিনে খলিফা বানাবেন, যেমনি ভাবে তিনি- তাদের পূর্বে যারা ছিল তাদেরকে খলিফা বানিয়েছিলেন এবং অবশ্য-অবশ্যই তাদের জন্য তাদের (ওই) দ্বীনকে (জমিনের বুকে) সুদৃঢ় করে দিবেন, যে (দ্বীন)টিকে তিনি তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং অবশ্য-অবশ্যই তাদের (উপর বয়ে যাওয়া নিরাপত্তাহীনতা জনিত) ভীতি’র পর (সেই পরিবেশকে) তাদের নিরাপত্তা দ্বারা বদলিয়ে দিবেন’। (তখন) তারা আমার ইবাদত করবে এবং আমার সাথে কোনো কিছুকে শরিক করবে না’। আল্লাহ’র কসম, তিঁনি তাদেরকে যা যা দেয়ার ওয়াদা করেছিলেন তার সবই দিয়েছে পরিপূর্ণরূপে। তিনি তাদেরকে রাসুলুল্লাহ সা.-এর পর (জমিনের বুকে) খলিফা বানিয়েছেন, তাদেরকে বিভিন্ন অঞ্চলের কতৃত্ব দিয়েছে, দিকে দিকে বিজীত করেছেন, গণীমতের সম্পদে আপ্লুত করেছেন, কাফেরদেরকে শক্ত হাতে বন্দি করেছেন, তাঁদের খিলাফতের জামানা গুলোতে বহু লোক ইসলাম গ্রহন করেছে, তারা মুরতাদদেরকে কতল করেছেন -সেটা বিলম্ব হলেও, তাদের মধ্যে কেউ কেউ (দ্বীন ইসলামের ভিতরে) ফিরেও এসেছে। এমনটা করেছিলেন আবু বকর সিদ্দিক। তাদের মাঝে তাঁর তরবারী ছিল হক্কের তরবারী যাবৎ না কিয়ামত আসে। আল্লাহ তাআলা তাঁদের খিলাফতের মাধ্যমে দ্বীন (ইসলাম)কে সম্মানিত করেছেন, দুশমনদেরকে লাঞ্চিত করেছেন, আল্লাহ’র দ্বীনকে প্রবল হয়েছে -যদিও মুশরেকরা তাতে অসন্তুষ্ট হয়েছে। তাঁরা মুসলমানদের জন্য পবিত্র সুন্নাহ জারি করেছেন। বস্তুতঃ গোটা উম্মতে-মুহাম্মাদী ও আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ তাঁদের বরকতে ধন্য হয়েছে’ । [আশ-শারইয়াহ, ইমাম আযুরী: ৪৩৮ পৃ:]

ইমাম আবু মুহাম্মাদ বগভী রহ. (মৃ: ৫১৬ হি:) লিখেছেন- এখানে لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ – ‘তিনি অবশ্য-অবশ্যই তাদেরকে (জমিনের বুকে) খলিফা বানাবেন’ – এর অর্থ: ليورثنهم أرض الكفار من العرب والعجم ، فيجعلهم ملوكها وساستها وسكانها – ‘তাদেরকে আরব ও আজম (অনারব) কাফেরদের  ভূমির ওয়ারিস বানাবেন, শাসক বানাবেন, রাজনৈতিক কর্তৃত্ব দিবেন, (নিরাপদ) বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দিবেন’। আর كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ – ‘যেমনি ভাবে তিনি- তাদের পূর্বে যারা ছিল তাদেরকে খলিফা বানিয়েছিলেন’ -এর অর্থ: بني إسرائيل حيث أهلك الجبابرة بمصر والشام وأورثهم أرضهم وديارهم – ‘এর অর্থ: বনী ইসরাঈল। তাদের সময়ে মিশর ও শাম-এর জাবাবিরাহ (জালেমানাহ) শাসন ব্যবস্থা’কে ধ্বংস করে (তদস্থলে) তাদেরকে ওসব এলাকাসমূহের ওয়ারিস রানানো হয়েছিল। আর وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِي ارْتَضَىٰ لَهُمْ অবশ্য-অবশ্যই তাদের জন্য তাদের (ওই) দ্বীনকে (জমিনের বুকে) সুদৃঢ় করে দিবেন, যে (দ্বীন)টিকে তিনি তাদের জন্য পছন্দ করেছেন’ অর্থ: قال ابن عباس : يوسع لهم في البلاد حتى يملكوها ويظهر دينهم على سائر الأديان – ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন: তিনি তাদেরকে প্রসস্থ অঞ্চল জুড়ে শাসন-কর্তৃত্ব দিবেন এবং তাদের দ্বীন (ইসলাম)কে (পৃথিবীর বুকে বিদ্যমান) বাকি সব দ্বীন (ধর্ম ও মতবাদ)-এর উপর প্রবল করে দিবেন’। [মাআলিমুত তানযিল, ইমাম বগভী- ৩/৩৫৪] তারপর লিখেছেন: و في الآية دلالة على خلافة الصديق وإمامة الخلفاء الراشدين – এই আয়াতেটি  খিলাফতে (আবু বকর) সিদ্দিক এবং খুলাফায়ে রাশেদীনের শাসন ব্যাবস্থার ব্যাপারে একটি (বিশেষ) দলিল (যে, তাঁদের জামানায় আল্লাহ’র এই ওয়াদাটি সত্য প্রমাণিত হয়েছে)’। [মাআলিমুত তানযিল, ইমাম বগভী- ৩/৩৫৪]

ইমাম মাহমুদ জামাখশারী রহ. (মৃ: ৫৩৮ হি:) লিখেছেন- الخطاب لرسول الله صلى الله عليه وسلم ولمن معه. ومنكم: للبيان، كالتي في آخر سورة الفتح: وعدهم الله أن ينصر الإسلام على الكفر، ويورّثهم الأرض، ويجعلهم فيها خلفاء، كما فعل ببني إسرائيل، حين أورثهم مصر والشام بعد إهلاك الجبابرة، وأن يمكن الدين المرتضى وهو دين الإسلام. وتمكينه: تثبيته وتوطيده، وأن يؤمن سربهم ويزيل عنهم الخوف الذي كانوا عليه، وذلك – এই আয়াতে রাসুলুল্লাহ সা. ও তাঁর সাহাবীগণ’কে উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে।…আল্লাহ তাআলা তাঁদের সাথে ওয়াদা করেছেন যে, (অচিরেই) কাফের’দের বিপরীতে ইসলামকে সাহায্য করা হবে এবং তাঁদেরকে জমিনের ওয়ারিস বানানো হবে এবং বানানো হবে (জমিনের) খলিফা, যেমনটা করা হয়েছিল বনী-ইসরাঈলদের সাথে, যেখানে তাদেরকে (ফেরআউনের) জাবাবিরাহ (তথা জালেমানাহ শাসন কাল)-এর ধ্বংসের পর মিশর ও শাম-এর ওয়ারিস বানানো হয়েছিল। (আল্লাহ তাআলা এখানে এও ওয়াদা করেছেন) যে, তিনি তাঁদের (সেই) দ্বীন’কে (জমিনের বুকে) প্রতিষ্ঠিত করে দিবেন, (যে দ্বীনটির উপর তিনি) সন্তুষ্ট, তথা দ্বীন-ইসলাম, তিনি ইসলামকে (নিরাপত্তার মজবুত বেষ্টনির ভিতরে) স্থান করে দিবেন, (বিশেষ সময়ের জন্য জমিনে) তাকে পোক্তভাবে সুদৃঢ় করে গেড়ে দিবেন (যেটাকে ইসলামের দুশমনরা উপড়াতে পারবে না)। (আল্লাহ তাআলা আরো ওয়াদা করেছেন) যে, তিনি তাদের ছিদ্রকে নিরাপত্তা বেষ্টিত করে দিবেন এবং তারা (এ শক্রুদের পক্ষ থেকে যাবৎ জান মাল নিয়ে) যে ভয়-ভীতির মধ্যে ছিল তিনি তাদের থেকে থেকে সেই ভয়-ভীতির তুলে নিবেন..’। [তাফসিরে কাশশাফ, জামাখশারী- ৩/৭৩]

ইমাম ফখুরুদ্দিন রাজী রহ. (মৃ: ৬১৫ হি:) লিখেছেন- فقد وعد الله الذين آمنوا منكم وعملوا الصالحات أي الذين جمعوا بين الإيمان والعمل الصالح أن يستخلفهم في الأرض فيجعلهم الخلفاء والغالبين والمالكين كما استخلف عليها من قبلهم في زمن داود وسليمان عليهما السلام وغيرهما، وأنه يمكن لهم دينهم وتمكينه ذلك هو أن يؤيدهم بالنصرة والإعزاز ويبدلهم من بعد خوفهم من العدو أمناً – ‘বস্তুতঃ وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ -‘আল্লাহ ওয়াদা করেছেন, যারা তোমাদের মধ্য থেকে (ইমানের দাবী অনুযায়ী) ইমান আনবে এবং (কুরআন-সুন্নাহ মাফিক) নেক কাজ করবে-(এখানে তাদের কথা বলা হচ্ছে) যারা (তাদের জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে) ইমান ও নেক আমলের মাঝে (কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী) সম্মন্ধ জুড়ে নিয়েছে। বলা হচ্ছে যে, আল্লাহ তাআলা তাদেরকে জমিনে খলিফা বানাবেন, (দ্বীনের দুশমনদের বিরুদ্ধে) তাদেরকে প্রবল ও ক্ষমতাধর শাসক বনিয়ে দিবেন, যেমনি করে বানিয়েছিলেন তাদের পূর্বে (নবী) দাউদ ও (নবী) সুলাইমান আ. প্রমূখের জামানায়, তাদের দ্বীন (ইসলাম)কে (জমিনের বুকে) প্রতিষ্ঠিত করে দিবেন, তাদেরকে (নিরাপত্তার মজবুত বেষ্টনির ভিতরে) স্থান করে দিবেন, তাদের প্রতি সাহায্য ও মহব্বতের হাত বাড়িয়ে দিবেন এবং (ইসলামের) শত্রুদের পক্ষ থেকে (জান ও মালের নিরাপত্তাহীনতার যে ) ভয় ও আশংকা (রয়েছে, সেই অবস্থা)কে নিরাপত্তা দ্বারা বদলিয়ে দিবেন’।… [তাফসিরে কাবীর, ইমাম রাজী- ২৪/২৪]

ইমাম ইবনে কাসির রহ. (মৃ: ৭৭৪ হি:) লিখেছেন- هذا وعد من الله لرسوله صلى الله عليه وسلم . بأنه سيجعل أمته خلفاء الأرض ، أي : أئمة الناس والولاة عليهم ، وبهم تصلح البلاد ، وتخضع لهم العباد ، وليبدلن بعد خوفهم من الناس أمنا وحكما فيهم ، وقد فعل تبارك وتعالى ذلك . وله الحمد والمنة ، فإنه لم يمت رسول الله صلى الله عليه وسلم حتى فتح الله عليه مكة وخيبر والبحرين ، وسائر جزيرة العرب وأرض اليمن بكمالها . وأخذ الجزية من مجوس هجر ، ومن بعض أطراف الشام ، وهاداه هرقل ملك الروم وصاحب مصر والإسكندرية – وهو المقوقس – وملوك عمان والنجاشي ملك الحبشة ، الذي تملك بعد أصحمة ، رحمه الله وأكرمه . ثم لما مات رسول الله صلى الله عليه وسلم واختار الله له ما عنده من الكرامة ، قام بالأمر بعده خليفته أبو بكر الصديق ، فلم شعث ما وهى عند موته ، عليه الصلاة والسلام وأطد جزيرة العرب ومهدها ، وبعث الجيوش الإسلامية إلى بلاد فارس صحبة خالد بن الوليد ، رضي الله عنه ، ففتحوا طرفا منها ، وقتلوا خلقا من أهلها . وجيشا آخر صحبة أبي عبيدة ، رضي الله عنه ، ومن معه من الأمراء إلى أرض الشام ، وثالثا صحبة عمرو بن العاص ، رضي الله عنه ، إلى بلاد مصر ، ففتح الله للجيش الشامي في أيامه بصرى ودمشق ومخاليفهما من بلاد حوران وما والاها ، وتوفاه الله عز وجل ، واختار له ما عنده من الكرامة . ومن على الإسلام وأهله بأن ألهم الصديق أن استخلف عمر الفاروق ، فقام في الأمر بعده قياما تاما ، لم يدر الفلك بعد الأنبياء [ عليهم السلام ] على مثله ، في قوة سيرته وكمال عدله . وتم في أيامه فتح البلاد الشامية بكمالها ، وديار مصر إلى آخرها ، وأكثر إقليم فارس ، وكسر كسرى وأهانه غاية الهوان ، وتقهقر إلى أقصى مملكته ، وقصر قيصر ، وانتزع يده عن بلاد الشام فانحاز إلى قسطنطينة ، وأنفق أموالهما في سبيل الله ، كما أخبر بذلك ووعد به رسول الله ، عليه من ربه أتم سلام وأزكى صلاة . ثم لما كانت الدولة العثمانية ، امتدت المماليك الإسلامية إلى أقصى مشارق الأرض ومغاربها ، ففتحتبلاد المغرب إلى أقصى ما هنالك : الأندلس ، وقبرص ، وبلاد القيروان ، وبلاد سبتة مما يلي البحر المحيط ، ومن ناحية المشرق إلى أقصى بلاد الصين ، وقتل كسرى ، وباد ملكه بالكلية . وفتحت مدائن العراق ، وخراسان ، والأهواز ، وقتل المسلمون من الترك مقتلة عظيمة جدا ، وخذل الله ملكهم الأعظم خاقان ، وجبي الخراج من المشارق والمغارب إلى حضرة أمير المؤمنين عثمان بن عفان ، رضي الله عنه . وذلك ببركة تلاوته ودراسته وجمعه الأمة على حفظ القرآن; ولهذا ثبت في الصحيح عن رسول الله صلى الله عليه وسلم أنه قال : ” إن الله زوى لي الأرض ، فرأيت مشارقها ومغاربها ، وسيبلغ ملك أمتي ما زوي لي منها ” فها نحن نتقلب فيما وعدنا الله ورسوله ، وصدق الله ورسوله ، فنسأل الله الإيمان به ، وبرسوله – আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসুল সা.-এর কাছে এই ওয়াদা করেছেন যে, তিনি তাঁর উম্মত (-এর মধ্যে খাঁটি ইমানদার মুসলীম জামাআত)’কে জমিনের (বুকে) খলিফা বানাবেন, অর্থাৎ মানুষের ইমাম (দিশারী/কান্ডারী) এবং তাদের উপর (কর্তৃত্বকারী) শাসক বানাবেন, তাদের দ্বারা বিভিন্ন এলাকার (নৈতিক ও আধ্যত্বীক) সংশোধন করাবেন, (তাঁর অন্যান্য অকৃতজ্ঞ) বান্দারা তাঁদের অনুগত হয়ে যাবে, তাঁরা (সদা সর্বদা ইসলাম বিরোধী) মানুষের পক্ষ থেকে (জান ও মালের যে নিরাপত্তাহীনতার) ভয় ও আশংকাবোধ করতেন সেই অবস্থার বদলে তাদেরকে (নিজেস্ব আলয়ের মজবুত) নিরাপত্তা দেয়া হবে এবং (দেয়া হবে) ওদের মাঝে (চালানোর মতো) শাসনক্ষমতা। বস্তুতঃ আল্লাহ তাবারাক ওয়া তাআলা (তাঁর পবিত্র ওয়াদা মাফিক) তা করেছেন। সকল প্রশংসা আল্লাহ’র প্রাপ্য; এটা তাঁরই করুনা। দেখুন, রাসুলুল্লাহ সা.-এর ইন্তেকালের কিছুকাল আগেই আল্লাহ তাআলা তাঁকে মক্কার বিজয়, খায়বর, বাহরাঈন, বৃহত্তর আরব উপকুল, গোটা ইয়ামেন দান করেন। তিনি যিযিয়া উসূল করেন হাযরের মাজুস এবং শামের কিছু এলাকা থেকে। রোমান সম্রাট হিরকল (হিরাক্লিয়াস), মিশর ও ইসকান্দ্রিয়া’র অধিপতি মাকুকাস তাঁর কাছে উপহার সামগ্রী পাঠায়। আর আম্মানের শাসক এবং হাবশা’র শাসক নাজ্জাসী -যিনি আসহামাহ’র পর শাসক হন -তারাও (রাসুলুল্লাহ সা.-কে সম্মান করেন)। আল্লাহ তাআলা নাজ্জাসীর উপর রহম করুন এবং তাকে সম্মানীত করুন।

এরপর রাসুলুল্লাহ সা.-এর ইন্তেকাল হলে আল্লাহ তাআলা তাঁর জন্য যে মর্যাদা নিজের কাছে রেখেছেন তা তাঁকে দান করেন। এরপর খলিফা আবু বকর সিদ্দিক রা. (রাসুলুল্লাহ সা.-এর রেখে যাওয়া) একই কাজ নিয়ে দাঁড়ান। বস্তুতঃ রাসুলুল্লাহ সা.-এর ইন্তেকালের সময় (দ্বীনের) যে বিষয়টি (যে অবস্থায় ছিল, তাতে) তিনি শিথীলতা/বিশৃঙ্খলা আনতে দেননি, তিনি বৃহত্তর আরব উপকুল’কে শক্তিশালী করেছিলেন, করেছিলেন সুগঠিত। তিনি খালিদ বিন ওয়ালীদের নেতৃত্বে পারস্য ভুমিতে ইসলামী সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন এবং পারস্যের একাংশ বিজয় লাভ করে। সেখানকার অধিবাসীদের মধ্যে (যারা ইসলামের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের) কতককে কতল করা হয়। এমনিভাবে তিনি আবু উবাইদাহ রা.-এর নেতৃত্বে কয়েকজন আমীর সমেত আরেকটি সৈন্যবাহিনী শাম-এ প্রেরন করেন। আমর বিন আস রা.-এর নেতৃত্বে তৃতীয় আরেকটি সৈন্যবাহিনী প্রেরন করেন মিশরে। পরে আল্লাহ তাআলা শামে প্রেরিত সৈন্যবাহিনীকে তাঁর আমলেই বুসরা, দামেশক, তাদের বিপরীত পার্শ্বে অবস্থিত হাওরান এবং আশে পাশের কিছু অঞ্চলের উপর বিজয় দান করেন। এরপর আল্লাহ তাআলা তাঁকে মৃত্যুর স্বাদ আসাদন করান এবং তাঁর জন্য যে মর্যাদা নিজের কাছে রেখেছেন তা তাঁকে দান করেন, সাথে এই অনুগ্রহ করেন যে, আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর অন্তরে ওমর ফারুক রা.-কে পরবর্তী খলিফা বানানোর কথাটি ঢেলে দেন। ফলে তাঁর (ইন্তেকালের) পর ওমর ফারুক রা. (খিলাফতের) কাজ নিয়ে পূর্ণদমে দাঁড়িয়ে যান। আম্বীয়ায়ে কেরাম আ.-এর পর তাঁর মতো সুগঠিত চরিত্র ও ইনসাফে পরিপূর্ণ কোনো (মানব)জাহাজ (আজ পর্যন্ত এ ধরায়) জন্মগ্রহন করেনি। তাঁরই আমলে গোটা শাম অঞ্চল, মিশরের মাথা থেকে অন্ত পর্যন্ত এলাকা, পারস্যের বেশিরভাগ অঞ্চল বিজীত হয়। কিসরা সম্রাজ্য একেবারে খানখান হয়ে যেতে থাকে, হয় (ইসলামের পতাকাতলে) পদদলীত এবং তার সাম্রাজ্য পিছাতে পিছাতে একেবারে দেয়ালে গিয়ে ঠেঁকে। (এভাবে একসময়) তিনি কায়সার’কে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং তার হাত থেকে শাম’কে ছিনিয়ে আনেন। এরপর তিনি কুসতুনতুনিয়ার দিকে মনোযোগী হন এবং (বিজীত) রোম ও পারস্যের ধ্বনসম্পদ আল্লাহ’র পথে ব্যায় করেন। এই সংবাদই দেয়া হয়েছে (আলোচ্য আয়াতে), আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসুল সা.-এর সাথে এই ওয়াদাই করেছিলেন। রাসুল সা.-এর উপর তাঁর রবের পরিপূর্ণ সালাম ও দরূদ নাজিল হোক।

এরপর যখন উসমানী রা.-এর খিলাফত কাল এলো, তখন ইসলামী রাজ্যের সীমানা পূর্ব ও পশ্চিমের শেষ প্রান্তে গিয়ে ঠেঁকলো। আন্দুলুস (স্পেন), কাবরুস, কায়রাওয়ান অঞ্চল এবং বাহরুল মুহিত (আটলান্টিক মহাসাগর) -এর পার্শ্বস্থ সাবতাহ সীমাঞ্চল -এই পশ্চিমাঞ্চলগুলোর শেষ পর্যন্ত (ইসলামী খিলাফতের) করতলগত হল। আর পূর্ব দিকে (খিলাফতের সীমানা) গিয়ে ঠেঁকলো বৃহত্তর চীন পর্যন্ত। কিসরা’কে হত্যা করা হল ও তার গোটা রাজ্যকে বিলুপ্ত করে দেয়া হল। ইরাকের মাদায়েন, খুরাসান, আহওয়ায বিজীত হল। এপর মুসলীম বাহিনী তুর্কীদের সাথে এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধে অবতরন করলো। আল্লাহ তাআলা তুর্কীদের রাষ্ট্রপ্রধান খাক্বান’কে (মুসলমানদের হাতে) পরাভূত করলেন। আমীরুল মু’মিনীন উসমান বিন আফফান রা.-এর কাছে পূর্ব ও পশ্চিম (-এর সকল অঞ্চল) থেকে খারায (ভূমি-কর) উসূল করে নিয়ে আসা হতে লাগলো। এসব হয়েছে তাঁর (অধীনস্থ এলাকাগুলোতে কুরআন) তিলাওয়াত, (কালামুল্লাহ’র) শিক্ষা ব্যবস্থা চালু এবং উম্মতকে কুরআন সংরক্ষনের ব্যাপারে একত্র করার বরকতে। আর এসব কথা রাসুলুল্লাহ সা. থেকে সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত, যেখানে তিনি বলেছেন: إِنَّ اللَّهَ زَوَى لِيَ الْأَرْضَ ، فَرَأَيْتُ مَشَارِقَهَا وَمَغَارِبَهَا ، وَسَيَبْلُغُ مُلْكُ أُمَّتِي مَا زُوِيَ لِيَ مِنْهَا আল্লাহ তাআলা আমার জন্য পৃথিবীকে সংকুচিত করে দিয়েছিলেন। ফলে আমি তার পূর্ব ও পশ্চিম (দিগন্ত পর্যন্ত বহুদূর) দেখতে পেলাম। আর (সুসংবাদ গ্রহন করো,) আমার জন্য যতটুকু অংশ সংকুচিত করা হয়েছিল, শিঘ্রই আমার উম্মতের রাজ্য সেই পর্যন্ত গিয়ে ঠেঁকবে। এই হল আমাদের (মুসলীম উম্মাহ’র পূর্বসূরীগণের দ্বারা আনীত ইসলামী) বিপ্লব যার ওয়াদা করেছিলেন আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সা.। আল্লাহ তাআলা সত্য বলেছেন এবং সত্য বলেছেন তাঁর রাসুলও।…[তাফসীরে ইবনে কাসির– ৬/৮৮, ৮৯]

আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-

إِنَّ اللَّهَ يُدَافِعُ عَنِ الَّذِينَ آمَنُوا ۗ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ خَوَّانٍ كَفُورٍ. أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوا ۚ وَإِنَّ اللَّهَ عَلَىٰ نَصْرِهِمْ لَقَدِيرٌ. الَّذِينَ أُخْرِجُوا مِن دِيَارِهِم بِغَيْرِ حَقٍّ إِلَّا أَن يَقُولُوا رَبُّنَا اللَّهُ ۗ وَلَوْلَا دَفْعُ اللَّهِ النَّاسَ بَعْضَهُم بِبَعْضٍ لَّهُدِّمَتْ صَوَامِعُ وَبِيَعٌ وَصَلَوَاتٌ وَمَسَاجِدُ يُذْكَرُ فِيهَا اسْمُ اللَّهِ كَثِيرًا ۗ وَلَيَنصُرَنَّ اللَّهُ مَن يَنصُرُهُ ۗ إِنَّ اللَّهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ . الَّذِينَ إِن مَّكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنكَرِ ۗ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُورِ

‘নিশ্চই যারা ইমান এনেছে -আল্লাহ তাদের তরফ হতে (জালেম কাফেরদেরকে) প্রতিহত করবেন। নিশ্চই আল্লাহ কোনো খেয়ানতবাজ অকৃতজ্ঞ’কে ভালবাসেন না। ওই সকল লোকদেরকে (কিতাল/সমরযুদ্ধ) করার অনুমতি দেয়া হল (যাদের বিরুদ্ধে) যুদ্ধ করা হচ্ছে -তা এজন্য যে তারা নির্যাতিত (অত্যাচারীত, মজলুম)। আর নিশ্চই আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করতে অবশ্যই সক্ষম। যাদেরকে অন্যায্য ভাবে তাদের ঘরবাড়ি থেকে বেড় করে দেয়া হয়েছে, (কাফেরদের চোখে তাদের একটাই অপরাধ ছিল, আর সেটা হল) তারা শুধু বলতো: আল্লাহ আমাদের রব (প্রভু; তাঁকে ছাড়া আর কাউকে আমরা রব হিসেবে গ্রহন করি না, তাই তাঁকে ছাড়া আর কারো বিধান মানি না)। আর আল্লাহ যদি (বিভিন্ন জামানায়) মানুষের একদলকে অপরদল দ্বারা প্রতিহত না করতে থাকতেন, তাহলে উপাসনালয়, গীর্জা ও মসজিদসমূহ -যেগুলোতে প্রচুর পরিমানে আল্লাহ’র নাম স্মরণ করা হয় -তা অবশ্যই চুরমার করে দেয়া হত। আর আল্লাহ (ওয়াদা করছেন যে, তিনি) অবশ্য-অবশ্যই তাদেরকে সাহায্য করবেন, যারা তাঁকে (তাঁর দ্বীন কায়েমে) সাহায্য করে। (এটা মনে করো না যে, আল্লাহ তোমাদের কারো সাহায্যের মুখাপেক্ষি)। নিশ্চই আল্লাহ মহা-শক্তিমান মহা-পরাক্রমশালী (তিনি নিজেই সর্বেসর্বা)। (তারা হল আমার সেই সকল মুমিন বান্দা) যাদেরকে -আমরা যদি জমিনে (অন্যের উপর) ক্ষমতাসীন করি, তাহলে তারা নামায কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, ভাল কাজের নির্দেশ দেয় এবং মন্দ কাজ থেকে (মানুষকে) বিরত করে। আর সকল কিছুর (চুড়ান্ত) পরিণতি আল্লাহ’র হাতে’। [সূরা হজ্জ ৩৮-৪১]
 
ইবনে কাসির রহ. সিয়াহ্ব আল-কুন্দী’র সূত্রে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন- سمعت عمر بن عبد العزيز يخطب وهو يقول :الذين إن مكناهم في الأرض … الآية ، ثم قال : إلا أنها ليست على الوالي وحده ، ولكنها على الوالي والمولى عليه ، ألا أنبئكم بما لكم على الوالي من ذلكم ، وبما للوالي عليكم منه؟ إن لكم على الوالي من ذلكم أن يؤاخذكم بحقوق الله عليكم ، وأن يأخذ لبعضكم من بعض ، وأن يهديكم للتي هي أقوم ما استطاع ، وإن عليكم من ذلك الطاعة غير المبزوزة ولا المستكرهة ، ولا المخالف سرها علانيتها . تفسير ابن كثير ٥/٤٣٤ – আমি (একদিন খলিফায়ে রাশেদ) ওমর বিন আব্দুল আযীয’কে খুৎবা দিতে শুনলাম, তিনি الَّذِينَ إِن مَّكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ (তারা হল আমার সেই সকল মুমিন বান্দা) যাদেরকে -আমরা যদি জমিনে (অন্যের উপর) ক্ষমতাসীন করি….. (-এই আয়াতটি তেলাওয়াত করে) বললেন: এখানে শুধু ওলী/শাসকের একার দায়িত্বের কথা বলা হচ্ছে না, বরং এখানে শাসক ও (তার অধীনস্থ) শাসিত (নাগরীক) -উভয়ের কথা বলা হচ্ছে। ওহে! আমি কি তোমাদেরকে জানাবো না যে, শাসকের উপর তোমাদের কী হক্ব রয়েছে এবং তোমাদের উপর শাসকের কী হক্ব রয়েছে? শাসকের উপর তোমাদের যে হক্ব রয়েছে, সেটা হল, তোমাদের উপর আল্লাহ’র যেসব হক্ব রয়েছে (তাতে ক্রটি দেখলে) তিনি তোমাদের থেকে তা আদায় করবেন, তোমাদের একজনের (হক্ব) অপরজনের থেকে আদায় করে দিবেন এবং সাধ্য মতো তোমাদেরকে হেদায়েতের পথে পরিচালিত করবেন। আর তোমাদের উপর (শাসকের) যেটা (হক্ব) রয়েছে, সেটা হল, (তোমরা তার) অনুগত্য (করবে) -বঞ্চনার সময়, অপছন্দ অবস্থায়, প্রকাশ্যে ও গোপনে’। [তাফসীরে ইবনে কাসির- ৫/৪৩৪]
 
শানক্বিতী রহ. বলেছেন- دليل على أنه لا وعدَ من الله بالنصر إلا مع إقامة الصلاة ، وإيتاء الزكاة ، والأمر بالمعروف ، والنهي عن المنكر ، فالذين يمكِّن الله لهم في الأرض ، ويجعل الكلمة فيها والسلطان لهم ، ومع ذلك لا يقيمون الصلاة ، ولا يؤتون الزكاة ، ولا يأمرون بالمعروف ، ولا ينهون عن المنكر : فليس لهم وعدٌ من الله بالنصر ؛ لأنهم ليسوا من حزبه ، ولا من أوليائه الذين وعدهم بالنصر ، بل هم حزب الشيطان وأولياؤه ، فلو طلبوا النصر من الله بناء على أنه وعدهم إياه : فمثلهم كمثل الأجير الذي يمتنع من عمل ما أجر عليه ، ثم يطلب الأجرة ، ومَن هذا شأنه : فلا عقل له ……وهذه الآيات تدل على صحة خلافة الخلفاء الراشدين ؛ لأن الله نصرهم على أعدائهم ؛ لأنهم نصروه ، فأقاموا الصلاة ، وآتوا الزكاة ، وأمروا بالمعروف ، ونهوا عن المنكر ، وقد مكَّن لهم ، واستخلفهم في الأرض ، كما قال : وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ . والحق : أن الآيات المذكورة تشمل أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم ، وكل من قام بنصرة دين الله على الوجه الأكمل ، والعلم عند الله تعالى . أضواء البيان: ٥/٢٧٢[আযওয়াউল বায়ান, শানক্বিতী- ৫/২৭২]
 

আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-

أَمْ لَهُمْ نَصِيبٌ مِّنَ الْمُلْكِ فَإِذًا لَّا يُؤْتُونَ النَّاسَ نَقِيرًا . أَمْ يَحْسُدُونَ النَّاسَ عَلَىٰ مَا آتَاهُمُ اللَّهُ مِن فَضْلِهِ ۖ فَقَدْ آتَيْنَا آلَ إِبْرَاهِيمَ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَآتَيْنَاهُم مُّلْكًا عَظِيمًا

‘(হে নবী! এই যে পথভ্রষ্ঠ ইহূদীগুলোকে দেখছো,) তাদের জন্য মুলক (রাজ্যক্ষমতা’র কোনো অংশ আছে কি? (না নেই। তারা অভিশপ্ত হয়ে বিক্ষিপ্ত ভাবে কখনো এখানে কখনো ওখানে ঠাঁই নিয়ে জীবন যাপন করছে। তাদের যদি নিজেস্ব রাজ্যক্ষমতা থাকতো) তাহলে তারা (অ-ইহূদী) মানুষকে (তা থেকে) এক কপর্দকও দিতো না। (তবে) কি -আল্লাহ তাঁর অনুগ্রহ থেকে (আরবের) লোকদেরকে (নবী ইব্রাহিমের ছেলে ইসমাঈলের বংশ থেকে প্রথম বারের মতো তার সুযোগ্য বংশীয় উত্তরসূরী নবী মুহাম্মাদের উপর নবুওত স্বরূপ) যা দিয়েছেন, তার উপর তারা হিংসা পোষন করছে (এই জন্য যে, সেঁ নবী ইব্রাহিমের অন্য ছেলে ও তাদের প্রিয় নবী ইসহাকের সন্তান নবী ইয়াকুব/ইসরাঈল -এর বংশীয় উত্তরসূরীদের মধ্যে থেকে কেউ নয়)? অথচ (ইতিপূর্বে) আমরা ইব্রাহীমের (ইসহাকী) বংশধরকে কিতাব ও হিকমাহ দান করেছিলাম এবং তাদেরকে দিয়েছিলাম বিশাল এক মুলক (রাজ্যক্ষমতা)। (ইসমাঈলের বংশে শুধু একজন মাত্র নবী মুহাম্মাদ’কে দিলাম, তাতেই তাদের এত হিংসা!!!)[সূরা নিসা ৫৪]
 

আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-

وَيَسْأَلُونَكَ عَن ذِي الْقَرْنَيْنِ ۖ قُلْ سَأَتْلُو عَلَيْكُم مِّنْهُ ذِكْرًا. إِنَّا مَكَّنَّا لَهُ فِي الْأَرْضِ وَآتَيْنَاهُ مِن كُلِّ شَيْءٍ سَبَبًا

‘(হে নবী!) তারা তোমার কাছে ‘যুল-কারনাইন’ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। (তাদেরকে বলো,) আমি তোমাদের সামনে তার ব্যাপারে (কিছু) বর্ণনা তেলাওয়াত করছি। নিশ্চই আমরা তাকে জমিনে ক্ষমতাসীন করেছিলাম  এবং তাকে দিয়েছিলাম সকল প্রকারের (প্রয়োজনীয়) উপকরণ’। [সূরা কাহফ ৮৩, ৮৪]
 

আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-

فَهَزَمُوهُم بِإِذْنِ اللَّهِ وَقَتَلَ دَاوُودُ جَالُوتَ وَآتَاهُ اللَّهُ الْمُلْكَ وَالْحِكْمَةَ وَعَلَّمَهُ مِمَّا يَشَاءُ ۗ وَلَوْلَا دَفْعُ اللَّهِ النَّاسَ بَعْضَهُم بِبَعْضٍ لَّفَسَدَتِ الْأَرْضُ وَلَٰكِنَّ اللَّهَ ذُو فَضْلٍ عَلَى الْعَالَمِينَ

‘তখন আল্লাহ’র ইচ্ছায় তারা (যুদ্ধ ক্ষেত্রে) ওদেরকে পরাজিত করে দিল এবং (নবী) দাউদ (তার দুশমন) জালুতকে কতল করলো। আর আল্লাহ তাকে দিয়েছিলেন মুলক (রাজ্যক্ষমতা) ও হিকমাহ এবং তাকে যা ইচ্ছা শিখিয়েছিলেন। আর আল্লাহ যদি (বিভিন্ন জামানায়) মানুষের একদলকে অপরদল দ্বারা প্রতিহত না করতে থাকতেন, তাহলে (একটি ক্ষমতালোভী উদ্ধত্ব্যবাদী গোষ্ঠি) পৃথিবীকে অবশ্যই বিশৃঙ্খল/ফ্যাসাদময় বানিয়ে দিতো। কিন্তু আল্লাহ হলেন বিশ্ববাসীর উপর অনুগ্রহকারী’। [সূরা বাকারাহ ২৫১]
 

আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-

يَا دَاوُودُ إِنَّا جَعَلْنَاكَ خَلِيفَةً فِي الْأَرْضِ فَاحْكُم بَيْنَ النَّاسِ بِالْحَقِّ وَلَا تَتَّبِعِ الْهَوَىٰ فَيُضِلَّكَ عَن سَبِيلِ اللَّهِ ۚ إِنَّ الَّذِينَ يَضِلُّونَ عَن سَبِيلِ اللَّهِ لَهُمْ عَذَابٌ شَدِيدٌ بِمَا نَسُوا يَوْمَ الْحِسَابِ

‘হে দাউদ! নিশ্চই আমরা তোমাকে জমিনে খলিফা বনিয়েছি। সুতরাং, তুমি মানুষজনের মাঝে (তোমার প্রতি আমার নাজিলকৃত শরীয়ত অনুযায়ী) হক্ব সহকারে (ইনসাফের সাথে) বিচার-ফয়সালা করো এবং কুপ্রবৃত্তির অনুগামী হয়ো না। তাহলে তা তোমাকে আল্লাহ’র পথ থেকে ভ্রষ্ঠ করে দিবে। নিশ্চই যারা আল্লাহ’র পথ থেকে ভ্রষ্ঠ হয়ে যায়, তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ আযাব -তা এজন্য যে তারা হিসাবের দিনকে ভুলে গিয়েছিল’। [সূরা সা’দ ২৬]
 
ইমাম ইবনে জারীর তাবারী রহ. (মৃ: ৩১০ হি:) নিজ সনদে সুদ্দি রহ. থেকে উপরোক্ত আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে বর্ণনা করেছেন যে, এখানে يَا دَاوُودُ إِنَّا جَعَلْنَاكَ خَلِيفَةً فِي الْأَرْضِ -‘নিশ্চই আমরা তোমাকে জমিনে খলিফা বনিয়েছি’ –এর অর্থ হল: ملَّكه في الأرض‘(আল্লাহ তআলা) তাঁকে জমিনে শাসনকর্তৃত্ব দিয়েছিলেন’। এরপর তাবারী রহ. নিজে আয়াতের অর্থ করেছেন এভাবে: يا داود إنا استخلفناك في الأرض من بعد من كان قبلك من رسلنا حكما ببن أهلها – ‘হে দাউদ! তোমার আগে আমি আমার রাসুলদের মধ্যে থেকে যাদেরকে তাদের নিজ নিজ অধিবাসীদের উপর হাকেম (শাসক) বানিয়ে পাঠিয়েছিলাম, (এখন) আমি তোমাকে তাদের (পরবর্তী একজন স্থলাভিষিক্ত) খলিফা বানালাম (যাতে তুমি আমার নাজিলকৃত শরীয়ত অনুযায়ী তোমার নাগরীকদের উপর শাসন চালাতে পারো)’। [তাফসিরে তাবারী- ২৩/১৮০]
 
ইমাম মাহমুদ জামাখশারী রহ. (মৃ: ৫৩৮ হি:) এখানে يَا دَاوُودُ إِنَّا جَعَلْنَاكَ خَلِيفَةً فِي الْأَرْضِ -‘নিশ্চই আমরা তোমাকে জমিনে খলিফা বনিয়েছি’ -এর অর্থ করেছেন : استخلفناك على الملك في الأرض ، كمن يستخلفه بعض السلاطين على بعض البلاد ويملكه عليها – ‘(হে দাউদ!) নিশ্চই আমি তোমাকে পৃথিবীর একটি রাজ্যের খলিফা বানিয়েছি, যেমনি ভাবে (ইতিপূর্বে) কতক শাসককে কোনো কোনো ভূমির খলিফা বানিয়ে তথাকার (নাগরীকদের) উপর কর্তৃত্বক্ষমতা দেয়া হয়েছিল’। আর فَاحْكُم بَيْنَ النَّاسِ بِالْحَقِّ – সুতরাং, তুমি মানুষজনের মাঝে হক্ব সহকারে বিচার-ফয়সালা করো’ -এর অর্থ করেছেন: بحكم الله تعالى إذ كنت خليفته – ‘তুমি যখন তাঁর খলিফা হয়ে গেছো, তখন (স্বভাবতই তোমার উপর ফরয হল) আল্লাহ  তাআলা’র বিধান দিয়ে (তাদেরকে শাসন করা এবং তাদের মাঝে ইনসাফের সাথে বিচার-ফয়সালা করা)’[তাফসিরে কাশশাফ, ইমাম জামাখশারী- ৩/৩৭১]
 
ইমাম ফখুরুদ্দিন রাজী রহ. (মৃ: ৬১৫ হি:) এখানে يَا دَاوُودُ إِنَّا جَعَلْنَاكَ خَلِيفَةً فِي الْأَرْضِ -‘হে দাউদ! নিশ্চই আমরা তোমাকে জমিনে খলিফা বনিয়েছি’ –এর অর্থ করেছেন: إنا جعلناك مالكاً للناس ونافذ الحكم فيهم فبهذا التأويل يسمى خليفة ، ومنه يقال خلفاء الله في أرضه ، وحاصله أن خليفة الرجل يكون نافذ الحكم في رعيته وحقيقة الخلافة ممتنعة في حق الله ، فلما امتنعت الحقيقة جعلت اللفظة مفيدة اللزوم في تلك الحقيقة وهو نفاذ الحكم – ‘নিশ্চই আমি তোমাকে (একটি রাজ্যের) জনগণের শাসক বানিয়েছি ও (বানিয়েছি) তাদের মাঝে (আমার) বিধান-কার্যকরকারী (স্বরূপ)’। বস্তুতঃ এই মর্মার্থের সাথেই (নবী দাউদ আ.-কে) খলিফা নামে সম্মোধন করা হয়েছে। তাঁকে বলা হয়েছে, তিনি হলেন আল্লাহ’র জমিনে আল্লাহ’র খলিফা। আর মূলতঃ খলিফা হলেন এমন ব্যাক্তি যিনি তার অধীনস্তদের মাঝে (আল্লাহ’র) বিধান চালু/প্রয়োগ করতে পারেন। আর খিলাফতের মূল বৈশিষ্টই হল, আল্লাহ’র (দ্বীনী) হক্বের রক্ষনাবেক্ষন। যখন (খিলাফতের) মূল বৈশিষ্টের রক্ষনাবেক্ষন করা হবে, তখনই (খলিফা) কথাটির সার্থকতা প্রকাশ পাবে, উপকারী সাব্যস্থ হবে। আর এই মূল বৈশিষ্টের (সার্থকতার) জন্য অপরিহার্য হল (আল্লাহ’র) হুকুম-আহকাম’কে (মানুষের মাঝে) চালু/প্রয়োগ করা’।… [তাফসিরে কাবীর, ইমাম রাজী- ১৩/১৮৪]
 
ইমাম কুরতুবী রহ. (মৃ: ৬২৭ হি:) এখানে إِنَّا جَعَلْنَاكَ خَلِيفَةً فِي الْأَرْضِনিশ্চই আমরা তোমাকে জমিনে খলিফা বনিয়েছি -এর অর্থ করেছেন: ملكناك لتأمر بالمعروف وتنهى عن المنكر ، فتخلف من كان قبلك من الأنبياء والأئمة الصالحين – ‘আমি তোমাকে শাসক বানিয়েছি এজন্য যে, তুমি (তোমার নাগরীকদেরকে আমার নাজিলকৃত বিধান অনুযায়ী) ভাল’র নির্দেশ দিবে এবং মন্দ থেকে নিষেধ করবে। বস্তুতঃ তোমার পূর্বেও নবীগণ এবং নেককার ইমামদের (নেতা/শাসকদের) মধ্য থেকে (কাউকে কাউকে জামিনের বিভিন্ন এলাকার) খলিফা বানানো হয়েছিল’…। আর فَاحْكُم بَيْنَ النَّاسِ بِالْحَقِّসুতরাং, তুমি মানুষজনের মাঝে হক্ব সহকারে বিচার-ফয়সালা করো-এর ব্যাখ্যায় কুরআনের কয়েকটি আয়াত উল্লেখ করেছেন, যার অর্থ ও উদ্দেশ্য একই, যেমন: وقوله : وأن احكم بينهم بما أنزل الله وقوله تعالى : لتحكم بين الناس بما أراك الله وقوله تعالى – ‘আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন: ‘তুমি তাদের মাঝে হুকুম জারি করো/বিচার-ফয়সালা করো তা দিয়ে যা আল্লাহ (তোমার প্রতি ওহী সূত্রে) নাজিল করেছেন’। আল্লাহ তাআলা আরো এরশাদ করেন: ‘এজন্য যে, যাতে তুমি ওইভাবে হুকুম জারি করতে পারো/বিচার করতে পারো যেভাবে আল্লাহ তোমাকে দেখিয়ে দিয়েছেন’…..’। আর وَلَا تَتَّبِعِ الْهَوَىٰ এবং তুমি কুপ্রবৃত্তির অনুগামী হয়ো না’ -এর অর্থ করেছেন: لا تقتد بهواك المخالف لأمر الله – ‘তুমি আল্লাহ’র নির্দেশ/বিধানের বিপরীতে নিজের প্রবৃত্তিকে মান্য করবে না’…। [তাফসিরে কুরতুবী- ১৫/১৮৯]
 
ইমাম বাইযাভী রহ. (মৃ: ৬৮৫ হি:) এখানে إِنَّا جَعَلْنَاكَ خَلِيفَةً فِي الْأَرْضِনিশ্চই আমরা তোমাকে জমিনে খলিফা বনিয়েছি -এর অর্থ করেছেন: اسْتَخْلَفْناكَ عَلى المُلْكِ فِيها، أوْ جَعَلْناكَ خَلِيفَةً مِمَّنْ قَبْلَكَ مِنَ الأنْبِياءِ القائِمِينَ بِالحَقِّ – আমরা তোমাকে রাষ্ট্রের খলিফা নিযুক্ত করেছি, বা তোমাকে আমরা তোমার পূর্বের হক্বের উপর প্রতিষ্ঠিত আম্বীয়াগণের খলিফা/স্থলাভিষিক্ত বানিয়েছি’[আনওয়ারুত তানজিল, ইমাম বাইযাভী- ৫/৪৩]
 
ইমাম ইবনে কাসির রহ. (মৃ: ৭৭৪ হি:) লিখেছেন: هذه وصية من الله عز وجل لولاة الأمور أن يحكموا بين الناس بالحق المنزل من عنده تبارك وتعالى ولا يعدلوا عنه فيضلوا عن سبيله – এই (আয়াতটি) আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে শাসকের প্রতি উপদেশ, তারা যেন আল্লাহ তাআলার (নিযুক্ত খলিফা/প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর স্থলে তাঁর) হয়ে মানুষের মাঝে ইনসাফের সাথে শাসন চালায়/বিচার-ফয়সালা করে এবং বে-ইনসাফী না করে। অন্যথায় তারা তাঁর পথ থেকে ভ্রষ্ঠ/বিপথগামী হয়ে যাবে’[তাফসিরে ইবনে কাসির- ৭/৬২]
 
ইমাম বদরুদ্দিন আইনী রহ. (মৃ: ৮৫৫ হি:) এখানে يَا دَاوُودُ إِنَّا جَعَلْنَاكَ خَلِيفَةً -‘নিশ্চই আমরা তোমাকে খলিফা বনিয়েছি’ -এর অর্থ করেছেন: صيرناك خلفا عمن كان قبلك – ‘তোমার পূর্বে যাঁরা (নবী ও রাসুল) ছিলেন, তোমাকে আমরা তাঁদের খলিফা/স্থালাভিষিক্ত করেছি’। এবং فِي الْأَرْضِ -‘জমিনে’ -এর অর্থ করেছেন: على المُلك من الأرض كمن يستخلفه بعض السلاطين على بعض البلاد ويملكه عليها – ‘পৃথিবীর একটি রাষ্ট্রের উপর (খলিফা স্বরূপ ক্ষমতাসীন করেছি), যেমনি ভাবে (তোমার পূর্বে) কতক শাসককে কোনো কোনো ভূমির খলিফা বানিয়ে তথাকার (নাগরীকদের) উপর কর্তৃত্বক্ষমতা দেয়া হয়েছিল’[উমদাতুল ক্বারী, আইনী- ২৪/২৪০]
 
ইমাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুর রহমান ইযিয়ী রহ. (মৃ: ৯০৫ হি:) এখানে إِنَّا جَعَلْنَاكَ خَلِيفَةً فِي الْأَرْضِনিশ্চই আমরা তোমাকে জমিনে খলিফা বনিয়েছি -এর অর্থ করেছেন: استخلفناك على الملك أو خليفة ممن قبلك من الأنبياء – আমরা তোমাকে রাষ্ট্রের খলিফা নিযুক্ত করেছি, বা তোমাকে আমরা তোমার পূর্বের আম্বীয়াগণের খলিফা/স্থলাভিষিক্ত বানিয়েছি’। আর فَاحْكُم بَيْنَ النَّاسِ بِالْحَقِّ – সুতরাং, তুমি মানুষজনের মাঝে হক্ব সহকারে বিচার-ফয়সালা করো’ -এর অর্থ করেছেন: الذي هو حكم الله تعالى – ‘আল্লাহ তাআলা যে বিধান দিয়েছেন (তা দিয়ে ইনসাফের সাথে শাসন চালাও ও বিচার-ফয়সালা করো)’[জামেউল বয়ান, ইমাম ইযিয়ী- ৩/৪৭৪]
 
ইমাম আবুল লাইস নসর বিন মুহাম্মাদ সমরকন্দি রহ. (মৃ: ৩৭৩ হি:) এখানে إِنَّا جَعَلْنَاكَ خَلِيفَةً فِي الْأَرْضِনিশ্চই আমরা তোমাকে জমিনে খলিফা বনিয়েছি -এর অর্থ করেছেন- يعني: أكرمناك بالنبوة، وجعلناك خليفة، والخليفة الذي يقوم مقام الذي قبله، فقام مقام الخلفاء الذين قبله، وكان قبله النبوة في سبط، والملك في سبط آخر، فأعطاهما الله تعالى لداود – ‘আমরা তোমাকে নবুওত দিয়ে সম্মানীত করেছি এবং তোমাকে খলিফা বানিয়েছি’। আর খলিফা হলেন তিনি যিনি তার পূর্বের জনের স্থলে স্থলাভিষিক্ত হন। এভাবেই খলিফাগণ (একের পর এক) তাদের পূর্বের জনের স্থলে স্থলাভিষিক্ত হতে থাকেন। আর নবী দাউদ আ.-এর পূর্বপুরুষদের মধ্যে যেমন নবুওত ছিল, তেমনি অন্য দিকে শাসন-ক্ষমতাও ছিল। আল্লাহ তাআলা হযরত দাউদ আ.-কে (নবুওত ও শাসন-ক্ষমতা) দুটোই দিয়েছেন (দু’ধারারই স্থলাভিষিক্ত করেছেন)। [তাফসিরে সমরকন্দি– ৩/১৩৪ ]
 
মাহমুদ আলুসী রহ. (মৃ: ১২৮০ হি:) এখানে يَا دَاوُودُ إِنَّا جَعَلْنَاكَ خَلِيفَةً فِي الْأَرْضِ -‘হে দাউদ! নিশ্চই আমরা তোমাকে জমিনে খলিফা বনিয়েছি’-এর অর্থ করেছেন: اسْتَخْلَفْناكَ عَلى المُلْكِ فِيها، والحُكْمِ فِيما بَيْنَ أهْلِها، أوْ جَعَلْناكَ خَلِيفَةً مِمَّنْ قَبْلَكَ مِنَ الأنْبِياءِ القائِمِينَ بِالحَقِّ – আমরা তোমাকে রাষ্ট্রের নাগরীকদের খলিফা ও হাকেম নিযুক্ত করেছি, বা তোমাকে আমরা তোমার পূর্বের হক্বের উপর প্রতিষ্ঠিত আম্বীয়াগণের খলিফা/স্থলাভিষিক্ত বানিয়েছি’। আর فَاحْكُم بَيْنَ النَّاسِ بِالْحَقِّ ‘সুতরাং, তুমি মানুষজনের মাঝে হক্ব সহকারে বিচার-ফয়সালা করো’ -এর অর্থ করেছেন: الَّذِي شَرَعَهُ اللَّهُ تَعالى لَكَ – আল্লাহ তাআলা তোমাকে যে শরীয়ত দিয়েছেন (তা দিয়ে তাদেরকে শাসন করো এবং তাদের মাঝে ইনসাফের সাথে বিচার-ফয়সালা করো) [রুহুল মাআনী, আলুসী- ২৩/১৮৬]
 
কাযী শওকানী রহ. (মৃ: ১২৫০ হি:) এখানে يَا دَاوُودُ إِنَّا جَعَلْنَاكَ خَلِيفَةً فِي الْأَرْضِ -‘নিশ্চই আমরা তোমাকে জমিনে খলিফা বনিয়েছি’ -এর অর্থ করেছেন : اسْتَخْلَفْناكَ عَلى الأرْضِ لِمَن قَبْلَكَ مِنَ الأنْبِياءِ لِتَأْمُرَ بِالمَعْرُوفِ وتَنْهى عَنِ المُنْكَرِ – ‘(হে দাউদ!) আমরা তোমাকে পৃথিবীতে পূর্ববর্তী আম্বীয়াগণের খলিফা/স্থলাভিষিক্ত বানিয়েছি, এজন্য যে, তুমি (তোমার অধীন্ত মানুষজনকে আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান অনুযায়ী) ভাল’র নির্দেশ দিবে এবং (আল্লাহর নিষেধকৃত) মন্দ হতে বিরত রাখবে’। আর فَاحْكُم بَيْنَ النَّاسِ بِالْحَقِّ – সুতরাং, তুমি মানুষজনের মাঝে হক্ব সহকারে বিচার-ফয়সালা করো’ -এর অর্থ করেছেন: بِالعَدْلِ الَّذِي هو حُكْمُ اللَّهِ بَيْنَ عِبادِهِ – ‘আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য যে বিধান দিয়েছেন (তুমি) তা দিয়ে (তাদেরকে শাসন করো এবং তাদের মাঝে) ইনসাফের সাথে (বিচার-ফয়সালা করো)’[ফাতহুল ক্বাদির, শাওকানী- ৩/৪২৯]
 
ড. নসর বিন আলী আয়েয হাসান রহ. লিখেছেন- و هذه الآية فيها ارشاد و تعليم من الباري جل و علا لعباده المؤمنين انه لا بد من خليفة يقوم بالحكم بما انزل الله بين عباده لتصلح به البلاد العباد – ‘আল্লাহ তাআলা এই আয়াতের মধ্যে তাঁর মুমিন বান্দাদেরকে এই কথার তা’লিম দিয়েছেন যে, খলিফার বিশেষ কর্তব্য হবে নগর ও নাগরীকদের (দ্বীন-দুনিয়ার) ইসলাহ/সংশোধনের জন্য আল্লাহ’র নাজিলকৃত বিধান নিয়ে তাঁর বান্দাদের সামনে দাঁড়ানো’[আকীদাতু আহলিস সুন্নাহ ফি সাহাবাতিল কিরাম: পৃ: ৫০৮]
 
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-

إِنَّ فِرْعَوْنَ عَلَا فِي الْأَرْضِ وَجَعَلَ أَهْلَهَا شِيَعًا يَسْتَضْعِفُ طَائِفَةً مِّنْهُمْ يُذَبِّحُ أَبْنَاءَهُمْ وَيَسْتَحْيِي نِسَاءَهُمْ ۚ إِنَّهُ كَانَ مِنَ الْمُفْسِدِينَ . وَنُرِيدُ أَن نَّمُنَّ عَلَى الَّذِينَ اسْتُضْعِفُوا فِي الْأَرْضِ وَنَجْعَلَهُمْ أَئِمَّةً وَنَجْعَلَهُمُ الْوَارِثِينَ . وَنُمَكِّنَ لَهُمْ فِي الْأَرْضِ وَنُرِيَ فِرْعَوْنَ وَهَامَانَ وَجُنُودَهُمَا مِنْهُم مَّا كَانُوا يَحْذَرُونَ

‘নিশ্চই ফেরআউন (তার রাজ্যের) জমিনে (যত্রতত্র) ঔদ্ধত্যকারী (এক প্রভাবশালী জালেম শাসক) ছিল এবং সে (তার ক্ষমতা ও দাপটকে টিকিয়ে রাখার জন্য) সেখানকার অধিবাসীদেরকে (বিভিন্ন) দলে (বিভক্ত) করে রেখেছিল (যাতে তারা এক জোট হয়ে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শক্তি অর্জন করতে না পারে)। সে তাদের একটি অংশকে (অন্যায়-অত্যাচার দ্বারা) দূর্বল করে রাখতো, তাদের ছেলে সন্তানদেরকে জবেহ করতো এবং তাদের নারীদেরকে জীবিত রাখতো। নিশ্চই সে ছিল (জমিনে) ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারীদের একজন। আর আমরা চাইলাম, জমিনে যাদেরকে দূর্বল করে রাখা হয়েছিল আমরা তাদের উপর নেয়ামত দান করবো, (ফেরআউনের স্থলে) তাদেরকে (অন্যদের উপর) ইমাম বানাবো, তাদেরকে (সেই জমিন ও তদস্থ ধ্বনসম্পদের পরবর্তী ওয়ারীস) উত্তরাধিকার বানাবো, তাদেরকে জমিনে ক্ষমতাসীন করবো (কর্তৃত্ব দিবো), এবং ফেরআউন, হামান ও তাদের উভয়ের সৈন্যদেরকে তা দেখিয়ে দিবো, যে ব্যাপারে আশংকা তারা করতো’। [সূরা ক্বাসাস ২-৬]
 

আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-

وَلَقَدْ أَهْلَكْنَا الْقُرُونَ مِن قَبْلِكُمْ لَمَّا ظَلَمُوا ۙ وَجَاءَتْهُمْ رُسُلُهُم بِالْبَيِّنَاتِ وَمَا كَانُوا لِيُؤْمِنُوا ۚ كَذَٰلِكَ نَجْزِي الْقَوْمَ الْمُجْرِمِينَ . ثُمَّ جَعَلْنَاكُمْ خَلَائِفَ فِي الْأَرْضِ مِن بَعْدِهِمْ لِنَنظُرَ كَيْفَ تَعْمَلُونَ

‘আর মূলতঃ আমরা তোমাদের পূর্বের জাতিগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছি যখন তারা জুলুম করেছিল। তাদের কাছে তাদের রাসূলগণ এসেছিল সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ সহকারে, কিন্তু তারা ইমান আনেনি। এভাবেই আমরা অপরাধী গোষ্ঠিকে প্রতিফল দিয়ে থাকি। পরবর্তীতে আমরা তাদের পর তোমাদেরকে জমিনে (তাদের) স্থলাভিষিক্ত বানালাম, যেন আমরা দেখে নিতে পারি যে, তোমরা কিরকম আমল করো’। [সূরা ইউনুস ১৩, ১৪]
 

আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-

آمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَأَنفِقُوا مِمَّا جَعَلَكُم مُّسْتَخْلَفِينَ فِيهِ ۖ فَالَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ وَأَنفَقُوا لَهُمْ أَجْرٌ كَبِيرٌ

‘তোমরা ইমান আনো আল্লাহ’র প্রতি ও তাঁর রাসুলের প্রতি এবং তোমরা (আল্লাহ’র দেখানো পথে) ব্যায় করো তা থেকে, যার মধ্যে তোমাদেরকে মালিক-প্রতিনিধি বানিয়েছেন। সুতরাং, তোমাদের মধ্যে যারা ইমান আনবে এবং (আল্লাহ’র দেখানো পথে) ব্যায় করবে, তাদের জন্য রয়েছে বিরাট প্রতিদান’। [সূরা হাদিদ ৭]
 

আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-

فَإِن تَوَلَّوْا فَقَدْ أَبْلَغْتُكُم مَّا أُرْسِلْتُ بِهِ إِلَيْكُمْ ۚ وَيَسْتَخْلِفُ رَبِّي قَوْمًا غَيْرَكُمْ وَلَا تَضُرُّونَهُ شَيْئًا ۚ

‘(নবী হূদ তাঁর জাতিকে বললো:) সুতরাং তোমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নাও, তাহলে (জেনে রেখো), মূলতঃ আমি যে পয়গাম সহকারে তোমাদের কাছে প্রেরিত হয়েছি, আমি (সেটা) তোমাদেরকে পৌছে দিয়েছি। আর (একটু অপেক্ষা করো!) আমার রব তোমাদের স্থলে অন্য জাতিকে (তাঁর প্রতিনিধি) খলিফা বানাতে যাচ্ছেন। আর তোমরা তাঁর কোনো ক্ষতিই করতে পারবে না’। [সূরা হূদ ৫৭]
 

আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-

وَلَقَدْ كَتَبْنَا فِي الزَّبُورِ مِن بَعْدِ الذِّكْرِ أَنَّ الْأَرْضَ يَرِثُهَا عِبَادِيَ الصَّالِحُونَ

‘আর আমরা (নবী দাউদের উপরে নাজিলকৃত) যাবুর কিতাবে উপদেশ দানের পর (একথা) লিখে দিয়েছিলাম যে, (যুগে যুগে আমার) সালেহ-নেককার বান্দারাই হবে (এই) পৃথিবীর (উপযুক্ত খলিফা ও) ওয়ারিছ (উত্তরাধিকার)’। [সূরা আম্বিয়া ১০৫]
 

আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-

وَقَالَ الْمَلَأُ مِن قَوْمِ فِرْعَوْنَ أَتَذَرُ مُوسَىٰ وَقَوْمَهُ لِيُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَيَذَرَكَ وَآلِهَتَكَ ۚ قَالَ سَنُقَتِّلُ أَبْنَاءَهُمْ وَنَسْتَحْيِي نِسَاءَهُمْ وَإِنَّا فَوْقَهُمْ قَاهِرُونَ . قَالَ مُوسَىٰ لِقَوْمِهِ اسْتَعِينُوا بِاللَّهِ وَاصْبِرُوا ۖ إِنَّ الْأَرْضَ لِلَّهِ يُورِثُهَا مَن يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ ۖ وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ . قَالُوا أُوذِينَا مِن قَبْلِ أَن تَأْتِيَنَا وَمِن بَعْدِ مَا جِئْتَنَا ۚ قَالَ عَسَىٰ رَبُّكُمْ أَن يُهْلِكَ عَدُوَّكُمْ وَيَسْتَخْلِفَكُمْ فِي الْأَرْضِ فَيَنظُرَ كَيْفَ تَعْمَلُونَ . وَلَقَدْ أَخَذْنَا آلَ فِرْعَوْنَ بِالسِّنِينَ وَنَقْصٍ مِّنَ الثَّمَرَاتِ لَعَلَّهُمْ يَذَّكَّرُونَ

‘ফিরাউনের জাতির মধ্য থেকে (কোনো কোনো) নেতা/মাতব্ব বললো, আপনি কি মুসা ও তার (পক্ষের) লোকজনকে (থামাবেন না? তাদেরকে কি মিশরের) জমিনে (একটা) ফ্যাসাদ সৃষ্টির জন্য (উন্মুক্ত) ছেড়ে দিয়ে রাখবেন, আর (এদিকে তারা) আপনাকে ও আপনার উপাস্যদেরকে পরিত্যাগ করে চলবে?! (এমনটা কি মেনে নেয়া যায়’? এতে) সে বললো, আমরা অবশ্যই তাদের ছেলে-সন্তানগুলোকে মেড়ে ফেলবো এবং তাদের মেয়ে-সন্তানগুলোকে (না মেড়ে) জীবিত রেখে দিবো। নিশ্চই আমরা তাদের উপরে প্রবল-পরাক্রমশালী; (তারা দূর্বল)। মুসা তাঁর জাতিকে বললো, (ফেরাউন ও তার জাতির অুনষ্টতা থেকে) তোমরা আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও এবং সবর করো। নিশ্চই ভূমি আল্লাহ’র। তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে থেকে যাকে ইচ্ছা তার ওয়ারিছ (উত্তরাধিকার) বানান। আর (উত্তম) পরিণাম মুত্তাকী-পরহেজগারদের জন্য। তারা বললো, (হে মুসা!) তুমি আমাদের কাছে আসার আগেও আমরা (ফিরাউনের দ্বারা) নির্যাতিত হয়েছি, (এখন) আমাদের কাছে তোমার আগমনের পরও আমরা নির্যাতিত হচ্ছি। (লাভটা হল কি? এর শেষ কখন হবে?)। সে বললো, শ্রীঘ্রই তোমাদের রব তোমাদের দুশমনদেরকে ধ্বংস করে দিবেন এবং (তাদের স্থানে) তোমাদেরকে জমিনে স্থলাভিষিক্ত করবেন। তারপর তিনি দেখবেন তোমরা কেমন কাজ করো’। বস্তুত: আমরা ফিরাউনের লোকদেরকে দূর্ভিক্ষ ও ফলনের ক্ষয়ক্ষতি দিয়ে পাকড়াও করেছিলাম, যাতে তারা উপদেশ গ্রহন করে’। [সূরা আ’রাফ ১২৭-১৩০]