আল্লাহ’র নাজিলকৃত ইসলামী শরিয়াহ আইন vs ধর্মনিরপেক্ষ কুফরী আইন

আল্লাহ’র নাজিলকৃত ইসলামী শরিয়াহ আইন vs ধর্মনিরপেক্ষ কুফরী আইন ও প্রকাশ্য আল্লাহদ্রোহিতা

بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیۡمِ

الحمد لله و الصلاة و السلام على رسوله محمد و على أله و أمّته

اَللّٰهُمَّ صَلِّ عَليٰ مُحَمَّدٍ النبي الأمي عَدَدَ خَلْقِك وَ رِضَا نَفْسِك وَزِنَةَ عَرْشِك وَ مِدَادَ كَلِمَاتِك، صَلِّ عَليه صَلاَةً كَامِلَةً دَائِمَةً كَمَا يَنْبَغِي أَنْ يُصَلَّى عَلَيهِ وَ سَلِّمْ تَسلِيمَاً بِقَدرِ عَظَمَةِ ذَاتِكَ فِى كُلِّ وَقتٍ وَ حِين، صلاة تكون لك رضاء و له جزاء، صلاة لا غاية لها ولا منتهى ولا انقضاء باقية ببقائك الى يوم الدين ، و اعطه الوسيلة و الفضيلة و المقام المحمود الذي وعدته، و اجزه عنا ما هو اهله، و على اله وأصحابه و أزواجه و ذريته و أهل بيته و سلم تسليما مثل ذلك، اَللّٰهُمَّ اجمعني معه في الفردوس و جنة المأوى، اَللّٰهُمَّ صَلِّ عَليٰ مُحَمَّدٍ صَلوٰةً تُنَجِّيْنَا بِهَا مِنْ جَمِيْعِ الْأَهْوَالِ وَاْلآفَاتِ وَتَقْضِيْ لَنَا بِهَا مِنْ جَمِيْعِ الْحَاجَاتِ وَتُطَهِّرُنَا بِهَا مِنْ جَمِيْعِ السَّيِّاٰتِ وَتَرْفَعُنَا بِهَا عِنْدَكَ اَعْليٰ الدَّرَجَاتِ وَتُبَلِّغُنَا بِهَا اَقْصىٰ الْغَايَاتِ مِنْ جَمِيْعِ الْخَيْرَاتِ فِي الْحَيَاتِ وَبَعْدَ الْمَمَاتِ – اِنَّكَ عَليٰ كُلِّ شَيْئٍ قَدِيْرٍ بِرَحْمَتِكَ يَا اَرْحَمَ الرَّاحِمِيْنَ


>>> মূল সূচিপত্র (index) থেকে এ পেজের পূর্ববর্তী বা পরবর্তী আলোচনা পড়তে [এখানে ক্লিক করুন] 


পূর্ব আলোচনার পর………….

এর ঠিক পূর্বের পৃষ্ঠায় যখন একথা প্রমাণিত হল যে, ‘আল্লাহ তাআলাই হলেন তাঁর সৃষ্ট বান্দাদের জন্য আইন ও বিধিবিধান  (শরীয়ত) দেয়ার একচ্ছত্র মালিক প্রভু, অপরদিকে যারা আল্লাহ’র নাজিলকৃত আইন কানুন বাদ দিয়ে নিজেরা নিজেদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা নির্ভর আইন রচনায় বিশ্বাসী, তারা মূলত: আইন দানের ক্ষেত্রে আল্লাহ’র প্রকাশ্য প্রতিদ্বন্দ্বীতার আসনে সমাসীন হবার দাবীদার, প্রকাশ্য আল্লাহদ্রোহি এবং আল্লাহকে উক্ত মর্যাদা দানকে প্রকাশ্য অস্বীকারকারী (কাফের)’, তখন এ বিষয়টিও বিস্তারিত ভাবে পাঠকের সামনে আসা জরুরী যে, ‘তাহলে আল্লাহ তাআলার নাজিলকৃত শরীয়ত (বিধি বিধান) কী, যা মেনে চলার নির্দেশ তিঁনি দিয়েছেন’? এতে করে ইসলামী শরীয়ত বনাম মানবরচিত ধর্মনিরপেক্ষ আইন -এর উৎসের একটি তুলনামূলক দিক পাঠকের সামনে পরিষ্কার হয়ে যাবে।

 দ্বীন ইসলাম ও শরিয়াহ

 আল্লাহ তাআলা  এরশাদ করেন-

 إِنَّ الدِّينَ عِندَ اللَّهِ الْإِسْلَامُ
“নিশ্চই ইসলামই হল আল্লাহ’র কাছে (একমাত্র গ্রহনযোগ্য ও মনোনীত) দ্বীন (ধর্মবিশ্বাস/মতবাদ/মতাদর্শ/ism)”। [সূরা আল ইমরান ১৯]
 
  وَمَن يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَن يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ
“আর যে ব্যাক্তি (দ্বীন) ইসলাম ছাড়া অন্য কিছুকে (তার) দ্বীন (ধর্মবিশ্বাস/মতবাদ/মতাদর্শ/ism) হিসেবে গ্রহন করবে, সেটা তার থেকে মোটেও কবুল করে নেয়া হবে না। আর আখেরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রস্তদের একজন”। [সূরা আল ইমরান ৮৫]
 
  ثُمَّ جَعَلْنَاكَ عَلَىٰ شَرِيعَةٍ مِنَ الْأَمْرِ فَاتَّبِعْهَا وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَ الَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ
“অতঃপর (হে নবী মুহাম্মাদ!) আমি তোমাকে (আমার) আল-আমর (আল-দ্বীন)-এর মধ্য থেকে একটি শরীয়াহ’র উপর স্থাপন করেছি। অতএব তুমি তার অনুসরণ করে চলো এবং যারা (এই ইসলামী শরীয়ত সম্পর্কে) জানে না তুমি তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না”। [সূরা জাসিয়া ১৮]
 
 اتَّبِعْ مَا أُوحِيَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ 
“(হে নবী মুহাম্মাদ!) তোমার রবের পক্ষ থেকে তোমার কাছে যে ওহী আসে তুমি সেটারই অনুগত্য-অনুসরণ করে চলো’।[সূরা আনআম ১০৬]
 
  اتَّبِعُوا مَا أُنزِلَ إِلَيْكُم مِّن رَّبِّكُمْ وَلَا تَتَّبِعُوا مِن دُونِهِ أَوْلِيَاءَ 
“(হে মুমিনগণ!) তোমাদের রবের পক্ষ থেকে (নবী মুহাম্মাদের উপর) তোমাদের জন্য (শরীয়ত হিসেবে) যা নাজিল করা হয়েছে, তোমরা তার অনুগত্য করে চলো। আর তাঁকে বাদ দিয়ে (অন্য কোনো) অভিভাবকের  অনুগত্য-অনুসরণ করো না”। [সূরা আ’রাফ ৩]

উপরের এসকল আয়াত থেকে সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয়-

(১) আল্লাহ তাআলা তাঁর সর্বোশেষ নবী ও রাসুল মুহাম্মাদ ﷺ-কে নবুওত দানের পর তাঁর শেষ জীবন পর্যন্ত যে ইসলামী শরীয়তের উপর রেখেছেন, তাঁর অনুসারী বলে দাবীদার মুসলমানদের জন্য শুধু সেই শরীয়তের অনুগত্য-অনুসরণ করা মুসলমানদের জন্য ফরয (obligatory)। 
 
(২) ইসলামী শরীয়তের সাথে সাংঘর্ষিক বা বিরোধী যে কারো উদ্ভাবীত বা আমদানীকৃত যে কোনো বিশ্বাস, আদর্শ, মতবাদ-মতাদর্শ বা ism এবং বিধি-নিষেধের অনুগত্য-অনুসরণ করা মুসলীম উম্মাহ’র জন্য সম্পূর্ণ হারাম।  
 
এখন জানা প্রয়োজন, ‘ইসলামী শরিয়াহ কী’ এবং ‘ইসলামী শরীয়তের উৎস কী কী’? 

 ইসলামী শরিয়াহ কী?

ইসলামী শরীয়ত (شريعة) বলতে আল্লাহ তাআলা’র নাজিলকৃত ওইসকল আদেশ নিষেধ ও অনুমতিকে বুঝায় যা তিঁনি তাঁর সর্বশেষ নবী ও রাসুল মুহাম্মাদ -এর উপর ওহী সূত্রে নাজিল করেছেন এবং মুহাম্মাদ সেই নাজিলকৃত ওহীসমূহকে যেভাবে মানা শিখিয়ে গেছেন। অন্যকথায়, ইসলামী শরীয়ত হল – আল্লাহ তাআলার’র হুকুম (যা ওহী সুত্রে কুরআন আকারে নাজিল হয়েছে) এবং মুহাম্মাদ -এর শরয়ী ব্যাখ্যা (যা তাঁর উপর সুন্নাহ বা আদর্শ হিসেবে ওহী সুত্রে নাজিল হয়েছে) -এই দুইয়ের সামষ্টিক রূপ। 
 
 رَبَّنَا وَابْعَثْ فِيهِمْ رَسُولًا مِّنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُزَكِّيهِمْ
‘‘(স্মরণ করো, যখন নবী ইব্রাহিম ও তাঁর পুত্র নবী ইসলাঈল দোয়া করেছিল এই বলে যে,) হে আমাদের রব (প্রতিপালক প্রভু)! আপনি তাদের মাঝে তাদেরই মধ্য থেকে এমন একজন রাসুল প্রেরন করুন, যেঁ তাদের কাছে আপনার আয়াত সমূহ তেলাওয়াত করবে এবং তাদেরকে শিক্ষা দিবে আল-কিতাব (কুরআন) ও হিকমাহ্ (সুন্নাহ) আর তাদেরকে (শিরক ও কুফর থেকে) পবিত্র করবে”[সূরা বাকারাহ ১২৯
 
হযরত হাসান আল-বাসরী রহ. الكتاب (আল-কিতাব)-এর ব্যাখ্যায় বলেছেন- القرآن (আল-কুরআন)”। হযরত ইবনে যায়েদ, ইয়াহইয়া বিন আবি কাছির, মুক্বাতিল বিন হাইয়্যান, আবু মালেক রহ. প্রমুখ থেকেও এরকম তাফসীর বর্ণিত হয়েছে। [তাফসীরে ইমাম ইবনু আবি হাতীম- ১/২৩৬ আছার ১২৫৯, ১/৯৭৯ আছার ৫৪৭৫; জামেউল বায়ান, ইমাম ত্বাবারী- ৩/৮৭ আছার ২০৭৭, ২০৮০; আদ্দুররুল মানসুর, ইমাম সুয়ূতী- ১/১৩৯]
 
হযরত ক্বাতাদাহ রহ. আয়াতে বর্ণিত الحكمة (আল-হিকমাহ)-এর ব্যাখ্যায় বলেছেন- السنة – “ (রাসুলুল্লাহ -এর) সুন্নাহ”। [জামেউল বায়ান, ইমাম ত্বাবারী- ৩/৮৭ আছার ২০৭৮] হযরত হাসান আল-বাসরী রহ.  الحكمة (আল-হিকমাহ)-এর ব্যাখ্যায় বলেছেন- الحكمة حكمة السنة – “ আল-হিকমাহ হল (রাসুলুল্লাহ -এর) সুন্নাহ’র হিকমাত”। হযরত ইয়াহইয়া বিন আবি কাছির, মুক্বাতিল বিন হাইয়্যান, আবু মালেক রহ. প্রমুখ থেকেও এরকম তাফসীর বর্ণিত হয়েছে [তাফসীরে ইমাম ইবনু আবি হাতীম- ১/২৩৬ আছার ১২৬২] হযরত মুজাহিদ রহ. বলেছেন- فَهْمَ الْقُرْآنِ – “কুরআনের বুঝ”। [মাআলিমুত তানজিল, ইমাম বগভী- ১/১৫২]
 
হযরত ইবনে যায়েদ বিন আসলাম রহ. الحكمة (আল-হিকমাহ)-এর ব্যাখ্যায় বলেছেন- الحكمة الدين الذي لا يعرفونه إلا به ﷺ، يعلمهم إياه – “(এখানে) ‘হিকমাহ’ অর্থ সেই দ্বীন (ইসলাম, সেই শরীয়ত) যা নবী ছাড়া অন্য কেউ তাদের কাছে পরিচয় দান করতে পারতো না, যা কেবল তিঁনিই তাদের শিখিয়েছিলেন”। [জামেউল বায়ান, ইমাম ত্বাবারী- ৩/৮৭ আছার ২০৮০] হযরত ইবনে কুতাইবাহ রহ. বলেছেন- هِيَ الْعِلْمُ وَالْعَمَلُ، وَلَا يَكُونُ الرَّجُلُ حَكِيمًا حَتَّى يَجْمَعَهُمَا، وَقِيلَ: هِيَ السُّنَّةُ – “(আল-হিকমাহ) -এটা হল (ইসলামী শরীয়ত সম্পর্কিত) ইলম (জ্ঞান) এবং আমল (তথা প্রয়োগ বিধি -এ দু’য়ের সমষ্টিক রূপ)। এই দুটি বিষয় কোনো ব্যাক্তির মধ্যে একত্রিত হওয়া ছাড়া সে (কখনোই একজন) হাকিম (হিকমাহ ওয়ালা/শরীয়তের তত্ত্বজ্ঞানী) হতে পারে না। আর এই (দুটি বিষয়ের সামষ্টিক বাস্তব রূপ) হল (রাসুলুল্লাহ -এর) সুন্নাহ”। [মাআলিমুত তানজিল, ইমাম বগভী- ১/১৫২]
 
ইমাম শাওকানী রহ. এই আয়াতে الحكمة (আল-হিকমাহ)-এর ব্যাখ্যায় বলেছেন- والمُرادُ بِالحِكْمَةِ: المَعْرِفَةُ بِالدِّينِ والفِقْهُ في التَّأْوِيلِ والفَهْمُ لِلشَّرِيعَةِ – “(এখানে) ‘আল-হিকমাহ’ দ্বারা উদ্দেশ্য হল: দ্বীন (ইসলাম)-এর স্বরূপ পরিচিতি, (কুরআনের) ব্যাখ্যার নিগুর তত্ত্বজ্ঞান এবং (ইসলামী) শরীয়তের বুঝ”। [ফাতহুল কাদীর, শাওকানী- ১/১৪৪]
 
হযরত মাকহুল রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেন-  آتانِي اللَّهُ القُرْآنَ ومِنَ الحِكْمَةِ مَثِّلِيهِ – “আল্লাহ (তাআলা) আমাকে কুরআন দিয়েছেন এবং (সাথে আরো দিয়েছেন) তারই অনুরূপ আল-হিকমাহ” [মারাসিল, ইমাম আবু দাউদ- ২/১০৩; আদ্দুররুল মানসুর, ইমাম সুয়ূতী- ১/১৩৯]
آتَانِيَ اللَّهُ الْقُرْآنَ ، وَمِنَ الْحِكْمَةِ مِثْلَيْهِ . رواه أبو داود في مراسيل , باب في البدع : رقم
 
“إني لا أحل إلا ما أحل الله في كتابه ولا أحرم إلا ما حرم الله في كتابه
 
وَ أَنزَلَ اللَّهُ عَلَيْكَ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ
‘‘আর (হে নবী মুহাম্মাদ!আল্লাহ তোমার কাছে নাজিল করেছেন আল-কিতাব (কুরআন) এবং হিকমাহ্ (সুন্নাহ)”[সূরা নিসা ১১৩] 
 
وَ ٱذْكُرْنَ مَا يُتْلَىٰ فِى بُيُوتِكُنَّ مِنْ ءَايَٰتِ ٱللَّهِ وَٱلْحِكْمَةِ ۚ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ لَطِيفًا خَبِيرًا
 
وَاذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ وَمَا أَنزَلَ عَلَيْكُم مِّنَ الْكِتَابِ وَالْحِكْمَةِ يَعِظُكُم بِهِ
“তোমরা তোমাদের উপর আল্লাহ’র অনুগ্রহের কথা স্মরণ করো এবং (স্মরণ করো) আল-কিতাব (কুরআন) ও হিকমাহ (সুন্নাহ) হতে তোমাদের উপর যা নাজিল করেছেন, যা দিয়ে তোমাদেরকে উপদেশ দান করা হয়”[সূরা বাকারাহ ২৩১]
 
 
 
هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَ الْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُبِينٍ
‘‘তিঁনি (সেই সত্ত্বা) যিঁনি (আরবের) উম্মি(নিরক্ষর)দের মধ্যে তাদেরই একজনকে রাসুল হিসেবে পাঠিয়েছেন, (যে রাসুল) তাদের কাছে তাঁর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে শোনান, তাদেরকে পবিত্র করেন এবং তাদেরকে আল-কিতাবআল-হিকমাহ শিক্ষা দেন। আর ইতিপূর্বে তারা ছিল অবশ্যই পরিষ্কার পথভ্রষ্ঠয় লিপ্ত”।[সূরা আল-জুমআহ ২] 
 
 لَقَدْ مَنَّ اللَّهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولًا مِّنْ أَنفُسِهِمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَ الْحِكْمَةَ وَإِن كَانُوا مِن قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ –
  “বস্তুতঃ আল্লাহ মুমিনদের উপর অনুগ্রহ করেছিলেন, যখন তিঁনি তাদের মাঝে তাদেরই মধ্য থেকে (একজনকে) রাসুল (হিসেবে) পাঠালেন, যিনি তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করে শোনান ও তাদেরকে পবিত্র করেন এবং শিক্ষা দেন তাদেরকে আল-কিতাব (কুরআন) ও হিকমাহ্ (সুন্নাহ)। আর ইতিপূর্বে তারা ছিল অবশ্যই পরিষ্কার পথভ্রষ্ঠয় লিপ্ত”। [সূরা আল-ইমরান ১৬৪]
 
উপরোক্ত আয়াতগুলোতে দু’টি শব্দ এসছে- الْكِتَابَ (আল-কিতাব) এবং الْحِكْمَةُ (আল-হিকমাহ)
 
الْكِتَابَ (আল-কিতাব)– বলতে ‘আল-কুরআন’ উদ্দেশ্য -এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
 
الْحِكْمَةُ (আল-হিকমাহ) অর্থ- নবী মুহাম্মাদ -এর সুন্নাহ (বানী ও কর্মসমষ্টি), যা আল্লাহ তাআলা হযরত জিবরীল আ.-এর মাধ্যমে মুহাম্মাদ -এর উপর শরীয়ত হিসেবে কুরআনের পাশাপাশি অতিরক্তি নাজিল করেছেন, যার দ্বারা মুমিন ব্যাক্তি দ্বীনের সহীহ পরিচয় লাভ করে এবং কুরআন তার কাছে কি চায় কিভাবে চায় -তা উপলব্ধি করতে পারে, হক্ব ও বাতিল চিনতে পারে, হেদায়েতের উপর চলতে পারে।। [বিস্তারিত জানতে দেখুন: তাফসীরে তাবারী, আছার ৮১৭৭ ; তাফসীরে কাবীর, ইমাম রাজি- ৭/৭৩; তাফসীরে ইবনে কাসির; আল-মাওয়াফিকাত, শাতেবী- ৪/১৪; মাজমুঊল ফাতাওয়া, ইবনে তাইমিয়্যাহ- ১৯/৪৬; তাফসিরুস সাহীহ- ১/৩৪৮] 
 
ইমাম শাফেয়ী (মৃ: ২০৪ হি:) রহ. বলেন- ذكر الله الكتاب ، وهو القُرَآن ، وذكر الحِكْمَة ، فسمعتُ مَنْ أرْضى من أهل العلم بالقُرَآن يقول : الحكمة سنة رسول الله ؛ لأن القُرَآن ذُكر وأُتْبِعَتْه الحكمة ، وذكرَ الله منَّه على خَلْقه بتعليمهم الكتاب والحكمة ، فلم يَجُزْ – والله أعلم – أن يقال الحكمة هاهنا إلا سنةُ رسول الله . وذلك أنها مقرونة مع كتاب الله ، وأن الله افترض طاعة رسوله ، وحتَّم على الناس اتباع أمره ، فلا يجوز أن يقال لقول : فرضٌ ، إلا لكتاب الله ، ثم سنة رسوله – “আল্লাহ তাআলা الكتاب (আল-কিতাব)-এর কথা উল্লেখ করেছেন, আর তা হল আল-কুরআন। তিনি এরপর الحِكْمَة (আল-হিকমাহ)-র কথাও উল্লেখ করেছেন। আমি আমার দেশের ওলামায়ে কেরামগণ থেকে শুনেছি, কুরআন যে এখানে الحِكْمَة (আল-হিকমাহ)-র কথাও উল্লেখ করেছে তার অর্থ হল سنة رسول الله –‘রাসুলুল্লাহ -এর সুন্নাহ’কারণ, (এসকল আয়াতে) আল- কুরঅনের কথা বলা হয়েছে এবং তার অনুগামী হিসেবে বলা হয়েছে الحِكْمَة (আল-হিকমাহ)-র কথা। আল্লাহ তাআলা উল্লেখ করেছেন যে, তিনি তাঁর সৃষ্টি (মানুষের)কে আল-কিতাব ও আল-হিকমাহ শিক্ষা দেয়ার মাধ্যমে তাদের উপর অনুগ্রহ করেছন। তাই আল-হিকমাহ বলতে এখানে রাসুলুল্লাহ -এর সুন্নাহ ছাড়া অন্য কোনো অর্থের কথা বলা সঠিক হতে পারে না। আল্লাহ’ই অধিক জানেন। বস্তুতঃ আল্লাহ’র কিতাবের সাথে আল-হিকমাহ (নবীর সুন্নাহ) আষ্টেপিষ্টে জড়িত। আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসুলের অনুগত্য করতে বলেছেন এবং মানুষের জন্য রাসুলের নির্দেশের অনুগত্য করাতে বাধ্যবাধক করে দিয়েছেন। কাজেই কেবলমাত্র আল্লাহ’র কিতাব (আল-কুরআন) মানা ফরয, তারপর তাঁর রাসুলের সুন্নাহ -একথা বলা জায়েয নেই। (কারণ কুরআন ও সুন্নাহ দুটিই ওহী সূত্রে নাজিলকৃত এবং ইসলামী শরীয়ত হল এ দুই-এর সমহ্নিত রূপ)”। [আর-রিসালাহ, ইমাম শাফেয়ী- ১/৭৮]
 
ইমাম ইবনে রজব হাম্বলী (মৃ: ৭৯৫ হি:) রহ. বলেছেন- من قال الحكمة : السنة ، فقوله الحق ؛ لأن السنة تفسر القرآن ، وتبين معانيه ، وتحض على اتباعه…انتهى – “যারা বলেন الحِكْمَة (আল-হিকমাহ) অর্থ সুন্নাহ, তাদের কথা সঠিক। কারণ সুন্নাহ হল কুরআনের তাফসীর (ব্যাখ্যা), যা কুরআনের অর্থ ও মর্মকে খুলে খুলে বর্ণনা করে এবং তার অনুসরণের সোপান হিসেবে কাজ করে”। [লাত্বায়েফুল মাআরিফ, ইবনে রজব- ৮৪ পৃ:]
 
ইমাম ইবনুল বাত্ত্বাল (মৃ: ৪৪৯ হি:) রহ. এই হাদিসের وَمِثْلَهُ مَعَهُ –এবং এর সাথে এরই মতো (আরেকটি) জিনেস (ওহী সূত্রেই দেয়া হয়েছে)’-এর ব্যাখ্যায় বলেছেন- قال أهل العلم : أراد بذلك السنة التي أوتي…انتهى – আলেমগণ বলেছেন, এর দ্বারা (রাসুলুল্লাহ’র) সুন্নাহ উদ্দেশ্য………।  তিনি আরা বলেন- كان جبريل ينزل عليه بالسنن كما يأتيه بالقرآن، ولذلك قال صلى الله عليه وسلم : – أوتيت الكتاب ومثله معه – يعنى : من السنن…. انتهى  হযরত জিবরীল আ. যেমন তাঁর কাছে কুরআন নিয়ে আসতেন, তেমনিভাবে তিনি তাঁর উপর সুন্নাহ’ নিয়েও নাজিল হতেন। আর এজন্যই রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেন- أوتيت الكتاب ومثله معه – আমাকে (ওহী যোগে)  ‘আল-কিতাব’ দেয়া হয়েছে এবং এর সাথে এরই মতো (আরেকটি) জিনেস (ওহী সূত্রেই দেয়া হয়েছে)’। অর্থাৎ সুন্নাহ…………….। [শারহুল বুখারী, ইবনুল বাত্তাল-১৯/৪৭৩]
 
 এখানে আমারা দেখতে পেলাম, আল্লাহ তাআলা তাঁর সর্বশেস নবী মুহাম্মাদ -এর উপর ওহীসূত্রে দু’টি জিনিস নাজিল করেছেন: (১) আল-কিতাব (আল-কুরআন) এবং আল-হিকমাহ (সুন্নাহ), যা ইসলামী শরীয়তের মূল উৎস। ثُمَّ جَعَلْنَاكَ عَلَىٰ شَرِيعَةٍ مِنَ الْأَمْرِ فَاتَّبِعْهَا وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَ الَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ – ‘অতঃপর (হে নবী মুহাম্মাদ!) আমি তোমাকে (আমার) নির্দেশিত একটি শরীয়তের উপর স্থাপন করেছি। অতএব তুমি তার অনুসরণ করে চলো এবং যারা (এই শরীয়ত সম্পর্কে) জানে না তুমি তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না’। [সূরা জাসিয়া ১৮]
 

 ইসলামী শরীয়াহ প্রয়োগের পরিধি ও ক্ষেত্রসীমা

 এখন প্রশ্ন হল, ইসলামী শরীয়ত মানুষের জীবনের কোন কোন ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এর জবাব হল, জীবনের সকল ক্ষেত্রে -চাই তা ব্যাক্তি বা পরিবারিক জীবন হোক কিংবা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন। গোটা কুরআন এবং সুন্নাহ এর জ্বলন্ত সাক্ষ্য। বলা বাহুল্য, কুরআন-সুন্নাহ’র সবকিছু এখানে পাঠকের সামনে তুলে ধরা সম্ভব নয়। আমি শুধু একটি আয়াত এখানে উল্লেখ করছি। হেদায়েত পাওয়া ইচ্ছে যার আছে, তার জন্য একটি আয়াতই যথেষ্ট হতে পারে।  
 
قُلْ إِنَّ صَلاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ * لا شَرِيكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ
 ‘(হে নবী মুহাম্মাদ!) তুমি বলো, নিশ্চই আমার সালাত, আমার নসক, আমার জীবন এবং আমার মৃত্যু বিশ্বজাহানের রব আল্লাহ’র জন্য (উৎসর্গীত)। তাঁর কোনো শরীক নেই। আর এব্যাপারেই আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং আমি (আল্লাহ’র কাছে আত্বসমর্পনকারী) মুসলীমদের মধ্যে প্রথম (মুসলীম বা আত্বসমর্পনকারী)। [সূরা আনআম ১৬২,১৬৩]
 
এই আয়াতে আল্লাহ’র কাছে আত্বসমর্পনকারী মুসলমানদের গোটা জীবন ও মৃত্যুকে শুধুমাত্র আল্লাহ’র জন্য উৎসর্গ করতে বলা হয়েছে। বলা বাহুল্য, আল্লাহ’র যখন যে হুকুম যেভাবে পালন করার নির্দেশ তিনি দেন, সেইভাবে তা পালনের মাধ্যমে তাঁর হুকুমের কাছে নিজের মন ও কর্মজীবনকে কায়মনোবাক্যে সপে দেয়াই হল তাঁর জন্য নিজকে উৎসর্গ করা। আল্লাহ’র হুকুমই দ্বীন, আল্লাহ’র হুকুমই শরীয়ত। মুহাম্মাদ -এর উপর নাজিলকৃত সুন্নাহ এজন্য শরীয়তের অংশ যেহেতু তা আল্লাহ’রই নাজিলকৃত হুকুম। পূর্ববর্তী নবী রাসুলগণের উপর নাজিল হওয়া কিতাব ও সুন্নাহ’গুলো এজন্য ইসলামী শরীয়তের অংশ নয় যেহেতু সেগুলো মানসুখ (রহিত) ও বাতিল হওয়া আল্লাহ’রই হুকুম। বিষয়টি একদম পরিষ্কার। যেখানে পূর্ববর্তী নবী রাসুলগণের উপর নাজিল হওয়া কিতাব ও সুন্নাহ’গুলোর সবই মানসুখ (রহিত) ও বাতিল এবং তা মানা উম্মাতে মুহাম্মাদীর জন্য হারাম, সেখানে যে সকল ইসলামী শরীয়তবিরোধী আইন-কানুন মানুষ পার্লামেন্টে কিংবা পার্লামেন্টের বাইরে তৈরী করে তা মানা মুসলমানদের জন্য আরো মারাত্মক হারাম
 

ইসলামী শরিয়াহ (বিধিবিধান) চয়নের মানদন্ড : কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস

এখন যেহেতু মুসলমানদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে -চাই তা ব্যাক্তি-জীবন, পারিবারিক-জীবন, সমাজ জীবন বা রাষ্ট্রীয় জীবনই হোক না কেনো – ইসলামী শরীয়ত মানা ফরয এবং ইসলামী শরীয়ত বিরোধী অন্য যে কোনো শরীয়ত বা বিধিবিধান মানা হারাম, তাই তাদেরকে  এসবের যে কোনো ক্ষেত্রে-তো কুরআন ও সুন্নাহ‘য় বিদ্যমান শরয়ী বিধিবিধানগুলো মেনে চলতে হবে; তার বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। কিন্তু যেসকল বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহ’য় পরিষ্কার করে জবাব দেয়া নেই,  অথবা জবাব বিদ্যমান রয়েছে কিন্তু তার একাধিক অর্থ ও মর্মের সম্ভাবনা রয়েছে সে সকল ক্ষেত্রে খোদ্ কুরআন ও সুন্নাহ ‘তেই আরো দুটি শরয়ী মানদন্ডের কথা বলা হয়েছে, যার একটি হল ‘কিয়াস’ এবং অপরটি হল ইজমা। তবে এই দুইটি শরয়ী মানদন্ড তখনই গ্রহনযোগ্য বলে অবিহিত করা হয়েছে, যখন তার মূল ভিত্তি হবে কুরআন ও সুন্নাহ অথবা তাতে বিদ্যমান উসূল ও ইশারা-ইংগীতের আলোকে। 

এই হিসেবে ইসলামী শরীয়তের মানদন্ড হল ৪টি-

(১) কুরআন

(২) সুন্নাহ (নবী মুহাম্মাদ সা.-এর বাণী ও কর্মসমষ্টি)

(৩) ইজমা (আহলে হক্ব আলেমগণের ঐকমত)

(৪) কিয়াস (শরয়ী ইজতেহাদী অনুমান)

 নিম্নে এসম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা পেশ করা হল।  

(১) আল-কুরআন

আল্লাহ তাআলার কালাম আল-কুরআন হল ইসলামী শরীয়তের প্রধান উৎস ও শরয়ী মানদন্ড। আল্লাহ’র কালামকে রদ করার কোনো হক্ব কোনো সৃষ্টির নেই। সুতরাং, তিনি তার সৃষ্টির জন্য কোনো কিছু যা হালাল করেছেন তা হারাম করার কারো হক্ব নেই, এবং তিনি যা হারাম করেছেন তা হালাল করার কারো হক্ব নেই।  এ সম্পর্কিত সকল আয়াত ও তার ব্যাখ্যা পেশ করা এখানে সম্ভব নয়, নমুনা স্বরূপ কয়েকটি মাত্র আয়াতে কারিমা উল্লেখ করছি। হেদায়েত পাওয়ার ইচ্ছা থাকলে একটিমাত্র আয়াতই যথেষ্ট। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-
 
كِتَابٌ أَنزَلْنَاهُ إِلَيْكَ لِتُخْرِجَ النَّاسَ مِنْ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ بِإِذْنِ رَبِّهِمْ إِلَى صِرَاطِ الْعَزِيزِ الْحَمِيدِ
“(হে নবী মুহাম্মাদ! এই) আল-কিতাব (কুরআন)কে আমরা তোঁমার প্রতি নাজিল করেছি যাতে তুমি মানুষকে জুলুমাত (অন্ধকারসমূহ) থেকে বের করে নিয়ে আল-নূর (হেদায়েতের আলো)’র দিকে নিয়ে যেতে পারো –তাদের রবের অনুমতিক্রমে, (নিয়ে যেতে পারো) মহাপরাক্রমশালী মহাপ্রশংসীতের পথের দিকে’। [সূর ইবরাহিম ১-২]
 
إِنَّا أَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِتَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ بِمَا أَرَاكَ اللَّهُ ۚ وَلَا تَكُنْ لِلْخَائِنِينَ خَصِيمًا
“(হে নবী মুহাম্মাদ!) আমি তোঁমার প্রতি সত্য সহকারে আল-কিতাব (কুরআন) নাজিল করেছি যাতে তুঁমি মানুষের মাঝে (সৃষ্ট বিবাদ বিসম্বাদের) বিচার-ফয়সালা ওইভাবে করতে পারো, যেভাবে আল্লাহ তোমাকে দেখিয়ে দিয়েছেন। আর তুঁমি (বিশ্বাসঘাতক) খিয়ানতকারীদের পক্ষ নিয়ে (আমার বিপক্ষে) বিতর্ককারী হয়ে বসো না”।  [সূর নিসা ১০৫]
 
قُل أَرَأَيتُم مَا أَنزَلَ اللهُ لَكُم مِن رِزقٍ فَجَعَلتُم مِنهُ حَرَاماً وَحَلالاً  قُل آلله أَذنَ لَكُم أَم عَلَى اللهِ تَفتَرُونَ 
 “(হে নবী তুঁমি ওদেরকে) বলে দাও: ‘তোমরা কি চিন্তা করে দেখেছো, যে রিজেককে আল্লাহ তোমাদের জন্য নাজিল করেছেন, তোমরা (সেই আল্লাহ’র অনুমতি ছাড়াই নিজেদের ইচ্ছে মতো) কোনোটিকে হালাল আর কোনোটিকে হারাম বানিয়ে নিয়েছো। (তাদেরকে) জিজ্ঞেস করুন, আল্লাহ কি তোমাদেরকে এর অনুমতি দিয়েছেন, নাকি তোমরা আল্লাহ’র উপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করছো”? [সূরা ইউনুস ৫৯]
 
 إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ ۚ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ ۚ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ 
‘হুকুম (চলে ও চলবে) শুধুমাত্র আল্লাহ’র। তিনি হুকুম করেছেন, তোমরা (জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই) তাঁকে ছাড়া অন্য আর কারোরই ইবাদত (উপাসনা ও গোলামী) করবে না (অন্য কারো আজ্ঞাবহ হবে না)। (ভাল করে জেনে রেখো) এটাই হলদ্বীনই-কাইয়্যেম’ (প্রতিষ্ঠিত দ্বীন)। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই তা জানে না। [সূরা ইউসূফ ৪০]
 
أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوا لَهُمْ مِنَ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَنْ بِهِ اللَّهُ وَلَوْلَا كَلِمَةُ الْفَصْلِ لَقُضِيَ بَيْنَهُمْ وَإِنَّ الظَّالِمِينَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ
‘তাদের জন্য এমনসব শরীকরা আছে নাকি, যারা তাদের জন্য দ্বীন  (-এর অংশ) হিসেবে (এমন) শরীয়ত (বিধিবিধান) রচনা করে দিয়েছে, যা করার কোনো অনুমতি আল্লাহ দেননি? আর যদি একটি কথা নির্দিষ্ট হয়ে না থাকতো, তাহলে তাদের মাঝে ফয়সালা হয়ে যেত। আর নিশ্চই যারা জালেম তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ আযাব’। [সূরা শুরা ২১]
 
أَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُونَ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ حُكْمًا لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ 
 ‘তবে কি তারা জাহেলীয়াতের বিধান কামনা করছে? আর দৃঢ় বিশ্বাসীদের জন্য আল্লাহ’র চাইতে উৎকৃষ্ট বিধানদাতা আর কে আছে। [সুরা মায়েদা ৫০]
 
এসকল আয়াতে কারিমাসমূহ দ্বারা পরিষ্কার প্রমাণিত হয়, আল্লাহ’র কালাম, আল্লাহ’র হুকুমসমূহ যা কুরআনে ব্যাক্ত হয়েছে, তা ইসলামী শরীয়তের উৎস ও মানদন্ড। এব্যাপারে উম্মাহ’র ইজমা রয়েছে যে, যে ব্যাক্তি কুরআনকে শরীয়তের উৎস মানেনা সে কাফের।
 

(২) সুন্নাহ

আল্লাহ তাআলা’র সর্বশেষ রাসুল বিশ্বনবী মুহাম্মাদ .-এর সুন্নাহ (বাণী, কর্মসমষ্টি ও আদর্শ) হল ইসলামী শরীয়তের দ্বিতীয় উৎস ও শরয়ী মানদন্ড -যেহেতু খোদ শরীয়তদাতা আল্লাহ তাআলাই ‘সুন্নাহ’কে শরীয়তের উৎস হিসেবে মানার হুকুম দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন- 
 
 قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ ۗ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ –  قُلْ أَطِيعُوا اللَّهَ وَ الرَّسُولَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّ اللَّهَ لا يُحِبُّ الْكَافِرِينَ
 “(হে নবী, তুঁমি তাদের) বলে দাও: তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও, তাহলে আমার অনুগত্য করে চলো, (তাহলে) আল্লাহও তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহসমূহকে তিঁনি ক্ষমা করে দিবেন। আল আল্লাহ হলেন গাফুরুর রাহিম। (হে নবী, তুঁমি তাদেরকে আরো) বলে দাও: ‘তোমরা (তোমাদের প্রভু) আল্লাহ’র ও (তাঁর) রাসুলের অনুগত্য করো।  আর তোমরা যদি (আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের অনুগত্যতা থেকে) মুখ ঘুরিয়ে নাও, তাহলে (জেনে রেখো, তোমাদের প্রভু) আল্লাহ (এমন) কাফেরদেরকে ভালোবাসেন না, (বাসবেনও না)”। [সূরা আল ইমরান ৩১, ৩২]
 
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ  وَ رَسُولَهُ وَلَا تَوَلَّوْا عَنْهُ وَأَنْتُم تَسْمَعُونَ
 “হে ইমানদারগণ! তোমরা অনুগত্য করো আল্লাহ’র ও তাঁর রাসুলের। আর তোমরা (আল্লাহ বা তাঁর রাসুলের কোনো নির্দেশ) শোনার পরও তা থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিও না”। [সূরা আনফাল ২০]
 
ইমাম শাতেবী (মৃ: ৭৯০ হি:) রহ. এ জাতীয় আয়াত সমূহের ব্যাখ্যায় বলেন- وسائر ما قُرِنَ فيه طاعة الرسول بطاعة الله فهو دال على أنَّ طاعةَ الله ما أمر به ونهى عنه في كتابه، وطاعةَ الرسول ما أمر به ونهى عنه ممَّا جاء به ممَّا ليس في القرآن، إذْ لو كان في القرآن لكان من طاعةِ الله  “হযরত জিবরীল আ. যেমন তাঁর কাছে কুরআন নিয়ে আসতেন, তেমনিভাবে তিনি তাঁর উপর সুন্নাহ’ নিয়েও নাজিল হতেন” [আল-মুওয়াফিক্বাত, ইমাম শাতেবী- ৪/৩১৪]
 
مَّن يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللَّهَ ۖ وَ مَن تَوَلَّىٰ فَمَا أَرْسَلْنَاكَ عَلَيْهِمْ حَفِيظًا
 “যে ব্যাক্তি রাসুলের অনুগত্য করলো, সে মূলত: আল্লাহ’র অনুগত্য করলো। আর যে ব্যাক্তি (রাসুলের অনুগত্যতা থেকে) মুখ ফিরিয়ে নিলো, সে ক্ষেত্রে (হে রাসুল) আমরা তোমাকে তাদের (কর্মকান্ডের) উপরে তত্ত্বাবধায়ক করে পাঠাইনি”। [সূরা নিসা ৮০]
 
আবু হুরায়রাহ রা. থেকে সহিহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেছেন- مَنْ أَطَاعَنِي فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ، وَمَنْ يَعْصِنِي فَقَدْ عَصَى اللهَ، وَمَنْ يُطِعِ الْأَمِيرَ فَقَدْ أَطَاعَنِي، وَمَنْ يَعْصِ الْأَمِيرَ فَقَدْ عَصَانِي . صحيح مسلم, كتاب الإمارة , باب وجوب طاعة الأمراء في غير معصية وتحريمها في المعصية: ٣/١٤٦٦ رقم ١٨٣٥  – ‘যে আমার অনুগত্য করলো, সে মূলত: (আমাকে মানা সম্পর্কিত আল্লাহ তাআলার নির্দেশ পালনের মাধ্যমে প্রকারন্তে) আল্লাহ’র অনুগত্য করলো। আর যে আমার অবাধ্য হল, সে মূলত: (আমাকে মানা সম্পর্কিত আল্লাহ তাআলার নির্দেশের অবাধ্য হওয়ার মাধ্যমে প্রকারন্তে) আল্লাহ’র অবাধ্য হল। আর যে আমীর -এর অনুগত্য করলো, সে মূলত: (আমীর’কে মানা সম্পর্কিত আমার নির্দেশ পালনের মাধ্যমে প্রকারন্তে) আমার অনুগত্য করলো। আর যে আমীরের অবাধ্য হল, সে মূলত: (আমীর’কে মানা সম্পর্কিত আমার নির্দেশের অবাধ্য হওয়ার মাধ্যমে প্রকারন্তে) আমার অবাধ্য হল’। [সহিহ মুসলীম- ৩/১৪৬৬ হাদিস ১৮৩৫; সুনানে নাসায়ী, হাদিস ৪১৯৩, ৫৫১০; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস ২৮৫৯; মুসনাদে আহমদ- ২/২৫৩ হাদিস ৭৩৮৬, ২/২৮০ হাদিস ৭৬০০; মুসনাদে আবু আউয়ানাহ- ৪/৪০১ হাদিস ৭০৯০-৭০৯৬; শুআবুল ইমান, বাইহাকী- ৯/৪০৯, হাদিস ৬৯৬৪]
 
 وَمَا آَتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا 
“আর (আমার সর্বোশেষ নবী ও) রাসুল (মুহাম্মাদ) তোমাদের কাছে (আমার পক্ষ থেকে) যা কিছু নিয়ে আসে সেটাকে তোমরা আঁকড়িয়ে ধরো এবং সেঁ তোমাদেরকে যা কিছু থেকে নিষেধ করে সেটা তোমরা পরিত্যাগ করো”। [সূরা হাশর ৭]
 
وَمَن يَعۡصِ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ وَيَتَعَدَّ حُدُودَهُۥ يُدۡخِلۡهُ نَارًا خَٰلِدٗا فِيهَا وَلَهُۥ عَذَابٞ مُّهِينٞ 
“আর যে ব্যাক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের অবাধ্যচারন (বিরুদ্ধাচারণ) করবে এবং তাঁর (নির্দেশাবলির) হুদুদ (সীমা সমূহ) লঙ্ঘন করবে, তিঁনি তাকে (দোযখের) আগুনে প্রবেশ করাবেন, তার মধ্যে সে চিরস্থায়ী ভাবে থাকবে, আর তার জন্য থাকবে অপমানকর আযাব”। [সূরা নিসা ১৪]
 
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَ أُولِي الْأَمْرِمِنكُمْ  ۖ   فَإِن تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ۚ ذَٰلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا
“হে ইমানদারগণ! তোমরা অনুগত্য করো আল্লাহ’র এবং অনুগত্য করো রাসুলের, এবং (অনুগত্য করো) তোমাদের (মুসলমানদের) মধ্যকার উলুল-আমর’-এর। সুতরাং তোমরা যদি কোনো বিষয়ে বিবাদে লিপ্ত হয়ে পরো, তাহলে যদি আল্লাহ ও কেয়ামতের দিবসের প্রতি তোমাদের ইমান থেকে থাকে, তাহলে বিষয়টি আল্লাহ ও (তাঁর) রাসুলের (ফয়সালার) কাছে সোপর্দ করো। এই (নির্দেশনাটি তোমাদের জন্য) কল্যানকর এবং (এটাই হচ্ছে এবিষয়ক) সর্বোত্তম ব্যাখ্যা”[সূরা নিসা ৫৯]
 
ইমাম শাতেবী (মৃ: ৭৯০ হি:) রহ. এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন-  والرد إلى الله هو الرد إلى الكتاب، والرد إلى الرسول هو الرد إلى سُنَّته بعد موته  “(এই আয়াতে বর্ণিত নির্দেশ মতে -কোনো বিবাদমান বিষয়রে ফয়সালা পাওয়ার জন্য বিষয়টিকে) আল্লাহ’র কাছে সোপর্দ করার অর্থ হল (আল্লাহ’র দেয়া সংবিধান) আল-কিতাব (কুরআন)-এর কাছে সোপর্দ করা এবং রাসুলের কাছে সোপর্দ করার অর্থ হল (তাঁর জীবনকালে তাঁরই কাছে সোপর্দ করা, আর তাঁর) মৃত্যুর পর তাঁর সুন্নাহ’র কাছে সোপর্দ করা, (যাতে কুরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক সংশ্লিষ্ট বিষয়ের মিমাংসা পাওয়া সম্ভব হয়)” [আল-মুওয়াফিক্বাত, ইমাম শাতেবী- ৪/৩১৪]
 
ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম আল-জাওযীয়্যা (মৃ:  হি:) রহ. এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন- أمر تعالى بطاعته وطاعة رسوله، وأعاد الفعل إعلاماً بأن طاعة الرسول تجب استقلالاً من غير عرض ما أمر به على الكتاب، بل إذا أمر وجبت طاعته مطلقاً، سواء كان ما أمر به في الكتاب أو لم يكن فيه، فإنه أُتِىَ الكتاب ومثله معه  “আল্লাহ তাআলা (এখানে মুসলমানদেরকে) তাঁর অনুগত্য করার এবং (সাথে) তাঁর রাসুলের(ও অনুগত্য করার) হুকুম করেছেন। আর এই আমলটির কথা (কুরআনে) উল্লেখ করা হয়েছে বারবার। এটা এজন্য যে, আল-কিতাব (কুরআন)-এ যা কিছুর নির্দেশ দেয়া হয়েছে, রাসুলের আনুগত্যকে তা থেকে একটি স্বতন্ত্র অপরিহার্য কর্তব্য বলে অবিহিত করা হয়েছে। বরং, যখনই নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তখন স্বতন্ত্র ভাবেই রাসুলের আনুগত্য করতে বলা হয়েছে -চাই তিঁনি যা নির্দেশ দিয়েছেন সেটা আল-কিতাব (কুরআন)-এ থাকুক চাই তাতে না থাকুক। কারণ, তাঁর কাছে আল-কিতাব (কুরআন) নাজিল হয়েছে এবং তার সাথে তারই অনুরূপ বিষয়ও দেয়া হয়েছে” [ই’লামুল মুওয়াক্কিয়ীন, ইবনুল কাইয়্যেম- ১/৪৮]
 
وَ أَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ 
“আর (হে নবী মুহাম্মাদ), আমরা তোঁমার প্রতি আল-যিকর (স্মারকলিপি/আল-কুরআন) নাজিল করেছি, যাতে তুঁমি মানুষের কাছে তা খুলেখুলে বর্ণনা করে দিতে পারো, যা তাদের জন্য নাজিল করা হয়েছে এবং (যাতে) তারা (আল্লাহ’র নাজিলকৃত বার্তা নিয়ে) চিন্তাভাবনা করে”। [সূরা নাহল ৪৪]
 
মিকদাম বিন মা’দীকারিব রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেছেন- ‏ أَلاَ إِنِّي أُوتِيتُ الْكِتَابَ وَمِثْلَهُ مَعَهُ أَلاَ يُوشِكُ رَجُلٌ شَبْعَانُ عَلَى أَرِيكَتِهِ يَقُولُ عَلَيْكُمْ بِهَذَا الْقُرْآنِ فَمَا وَجَدْتُمْ فِيهِ مِنْ حَلاَلٍ فَأَحِلُّوهُ وَمَا وَجَدْتُمْ فِيهِ مِنْ حَرَامٍ فَحَرِّمُوهُ أَلاَ لاَ يَحِلُّ لَكُمْ لَحْمُ الْحِمَارِ الأَهْلِيِّ وَلاَ كُلُّ ذِي نَابٍ مِنَ السَّبُعِ وَلاَ لُقَطَةُ مُعَاهِدٍ إِلاَّ أَنْ يَسْتَغْنِيَ عَنْهَا صَاحِبُهَا وَمَنْ نَزَلَ بِقَوْمٍ فَعَلَيْهِمْ أَنْ يَقْرُوهُ فَإِنْ لَمْ يَقْرُوهُ فَلَهُ أَنْ يُعْقِبَهُمْ بِمِثْلِ قِرَاهُ . رواه أبو داود في سننه , كتاب السنة , باب في لزوم السنة : ٤/٢٠٠ رقم ٤٦٠٤، و قال ت الأرنؤوط : ٧/١٥ : إسناده صحيح، و صححه الألباني في صحيح أبي داود খুব ভাল করে শুনে রাখো, আমাকে (ওহী সূত্রে) আল-কিতাব (কুরআন) দেয়া হয়েছে এবং এর সাথে (আরো দেয়া হয়েছে) অনুরূপ (ওহী)। খুব ভাল করে শুনে রাখো, অচিরেই (এমন হবে যে), উদরপূর্ণ লোক তার আরাম-কেদারায় ঠেস দেয়াবস্থায় বলবে: ‘তোমাদের উপরে (শুধুমাত্র) এই কুরআন’ই (মানা) আবশ্যক। যে হালাল(-এর কথা) তোমরা এর মধ্যে পাবে, (শুধুমাত্র) সেটাকেই হালাল বলে গণ্য করবে এবং যে হারাম(-এর কথা) তোমরা এর মধ্যে পাবে, (শুধুমাত্র) সেটাকেই তোমরা হারাম বলে গণ্য করবে’। (খবরদার! খবরদার! খুব ভাল করে শুনে রাখো, আল্লাহ’র রাসুল যা হারাম করেন সেটা আল্লাহ কর্তৃক কোনো কিছু হারাম করার মতোই হুুকুম রাখে। কারণ আল্লাহ’র রাসুল শরীয়তের কোনো কিছুই ওহীর ইঙ্গিত ছাড়া নিজ থেকে হালাল বা হারাম করেন না)। জেনে রেখো, তোমাদের জন্য গৃহপালিত গাধার গোশত হালাল নয়, (একই ভাবে হালাল) নয় প্রত্যেক হিংস্র জানোয়ার, কোনো মুআহিদ-এর লুক্বত্বাহ সংশ্লিষ্ট মালিক কর্তৃক তা পরিত্যাক্ত হওয়া ছাড়া (হালাল) নয়। আর আর যে ব্যাক্তি কোনো কওমের কাছে যায়, তখন তাদের কর্তব্য হবে তার মেহমানদারী করা    ”[সুনানে আবু দাউদ- ৪/২০০ হাদিস ৪৬০৪; মুসনাদে আহমদ– ৪/১৩১ হাদিস ১৬৭২২]
 
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ ۗ وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُبِينًا
‘আর আল্লাহ ও তাঁর রাসুল যখন কোনো বিষয়ে কোনো ফয়সালা দিয়ে দেন, তখন কোনো মুমিন পুরুষ ও মুমিনা নারীর জন্য তাদের নিজেদের বিষয়গুলোতে (ভিন্ন ফয়সালা দানের) কোনো এখতিয়ার থাকে না। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে অমান্য করলো, সে মূলতঃ সুস্পষ্ট পথভ্রষ্ঠতায় নিমজ্জিত হয়ে গেল’। [সূরা আহযাব ৩৬]

فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا 
  “আপনার রবের শপথ, কক্ষোনো নয়! যতক্ষন পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের মাঝে সৃষ্ট বিবাদ-বিসম্বাদগুলোর জন্য (হে নবী মুহাম্মাদ!) তোমাকে বিচারক না মানবে, অতঃপর তুমি যে ফয়সালা করে দিয়েছ সে ব্যপারে (যতক্ষন পর্যন্ত) তাদের মনে দ্বিধামুক্ততা অনুভূত না হবে এবং (যতক্ষন পর্যন্ত) তারা (তোমার ফয়সালাকে) ঐকান্তিকভাবে গ্রহন করে না নিবে, ততক্ষন পর্যন্ত তারা (মূলতঃ তোমার উপর) ইমানআনায়নকারী (বিবেচিতই হবার) নয়, (বরং বিবেচিত হবে সন্দেহপোষনকারী মোনাফেক বেইমান হিসেবে)”। [সুরা নিসা ৬৫]
 
ইমাম ইবনে কাছির (মৃ: ৪৪৯ হি:) রহ. এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন- يُقْسِم تعالى بنفسه الكريمة المُقدَّسة أنه لا يؤمن أحد حتى يُحَكِّمَ الرَّسولَ صلى الله عليه وسلم في جميع الأمور، فما حَكَم به فهو الحقُّ الذي يجب الانقياد له باطناً وظاهراً، ولهذا قال: ﴿ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا ﴾ أي: إذا حكَّموك يطيعونك في بواطنهم فلا يجدون في أنفسهم حرجاً مما حكمت به، وينقادون له في الظَّاهر والباطن، فيُسَلِّمون لذلك تسليماً كلِّيًّا من غير ممانعةٍ، ولا مدافعةٍ، ولا منازعة  “হযরত জিবরীল আ. যেমন তাঁর কাছে কুরআন নিয়ে আসতেন, তেমনিভাবে তিনি তাঁর উপর সুন্নাহ’ নিয়েও নাজিল হতেন” [তাফসীরে ইবনে কাছির- ১/৫২১]
 
আবু হুরায়রাহ রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেছেন- كُلُّ أُمَّتِي يَدْخُلُونَ الجَنَّةَ إِلَّا مَنْ أَبَى، قَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ، وَمَنْ يَأْبَى؟ قَالَ: مَنْ أَطَاعَنِي دَخَلَ الجَنَّةَ ، وَمَنْ عَصَانِي فَقَدْ أَبَى . رواه البخاري في الصحيح , كتاب الاعتصام بالكتاب والسنة , باب الاقتداء بسنن رسول الله صلى الله عليه وسلم : ٩/٩٢ رقم ٧٢٨٠ “আমার সকল উম্মত জান্নাতে প্রবেশ করবে; শুধু (সে বাদে) যে (আমার থেকে) মুখ ফিরিয়ে নিবে’। লোকেরা জিজ্ঞেস করলো: ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! কে (আপনার থেকে) মুখ ফিরিয়ে নেয়’? তিঁনি বললেন: ‘যে (মুসলীম) আমার অনুগত্য করবে, সে জান্নাতে যাবে, আর যে (মুসলীম) আমার অবাধ্য হবে, সেই মূলত: (আমার থেকে) মুখ ফিরিয়ে নিলো[সহিহ বুখারী- ৯/৯২ হাদিস ৭২৮০]
 
হুযাইফাহ রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেছেন-أَنَّ الأَمَانَةَ نَزَلَتْ مِنَ السَّمَاءِ فِي جَذْرِ قُلُوبِ الرِّجَالِ، وَنَزَلَ القُرْآنُ فَقَرَءُوا القُرْآنَ، وَعَلِمُوا مِنَ السُّنَّةِ» . رواه البخاري في الصحيح , كتاب الاعتصام بالكتاب والسنة , باب الاقتداء بسنن رسول الله صلى الله عليه وسلم : ٩/٩٢ رقم ٧٢٧٦ “নিশ্চই আল-আমানাত আসমান থেকে লোকদের অন্তরের অন্তস্থলে নাজিল হয়েছে। আর কুরআন নাজিল হওয়ার পর তারা কুরআন পাঠ করেছে এবং (কুরআনের আলোকে আমার) সুন্নাহ সম্পর্কে জানতে পেরেছে[সহিহ বুখারী– ৯/৯২ হাদিস ৭২৭৬]
 
https://tafsir.app/ibn-alqayyim/53/3
 
https://islamqa.info/ar/answers/77243/%D8%A7%D9%84%D8%B3%D9%86%D8%A9-%D8%A7%D9%84%D9%86%D8%A8%D9%88%D9%8A%D8%A9-%D8%A7%D9%84%D8%B5%D8%AD%D9%8A%D8%AD%D8%A9-%D9%88%D8%AD%D9%8A-%D9%85%D9%86-%D8%A7%D9%84%D9%84%D9%87
 
https://www.alukah.net/sharia/0/136490/%D8%A3%D9%88%D8%AA%D9%8A%D8%AA-%D8%A7%D9%84%D9%83%D8%AA%D8%A7%D8%A8-%D9%88%D9%85%D8%AB%D9%84%D9%87-%D9%85%D8%B9%D9%87/
 
https://al-maktaba.org/book/32986/360
 
https://www.alukah.net/sharia/0/136490/%D8%A3%D9%88%D8%AA%D9%8A%D8%AA-%D8%A7%D9%84%D9%83%D8%AA%D8%A7%D8%A8-%D9%88%D9%85%D8%AB%D9%84%D9%87-%D9%85%D8%B9%D9%87/
এসকল আয়াতে কারিমাসমূহ দ্বারা পরিষ্কার প্রমাণিত হয়-
 
(ক) মুহাম্মাদ -এর সুন্নাহ (বাণী ও কর্মসমষ্টি) হল ইসলামী শরীয়তের দ্বিতীয় উৎস ও শরয়ী মানদন্ড।
 
(খ) রাসুলুল্লাহ -এর সুন্নাহ হল শরয়ী হুজ্জত (দলিল), যা দ্বীন ইসলামের একটি জরুরী (অত্যাবশ্যক) অংগ। সুতরাং, রাসুলুল্লাহ -এর সুন্নাহ (আদর্শ)কে শরীয়তের হুজ্জত (দলীল) বলে বিশ্বাস করা ইমানের অন্যতম পূর্বশর্ত
 
(গ) মানুষের জন্য শুধু কুরআনই যদি যথেষ্ঠ হতো, তাহলে আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাবের সাথে সাথে তাঁর রাসুল মুহাম্মাদ সা.-এর নসিহত, আদেশ ও নিষেধগুলোকে মেনে চলতে বলতেন না। এর কারণ হল, মুহাম্মাদ সা.-এর বাণী ও কর্মসমষ্টি হল কুরআনের ব্যাখ্যা। অর্থাৎ, কুরআন কি চায় এবং তা কিভাবে চায় -তার ব্যাখ্যা হল মুহাম্মাদ সা.-এর বাণী ও তাঁর কর্মজীবন। ‍সুতরাং, তাঁকে বাদ দিয়ে কুরঅান বোঝা ও মানার পথে বিশ্বাসী হওয়া ও এমন মতবাদ গ্রহন করা পরিষ্কার গোমরাহী ছাড়া আর কিছু নয়। উদাহরণস্বরূপ: কুরআনে ইমান, কুফর, নিফাক, নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত, জিহাদ, খিলাফত, বিচার ইত্যাদি সম্পর্কিত নির্দেশ এসেছে, কিন্তু তা কিভাবে পালন করতে হবে তার বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়নি; তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে রাসুলুল্লাহ সা.-এর সুন্নাহ’য় (বাণী ও কর্মসমষ্টিতে)। 

কাজেই, এমনটা হতে পারে না যে, একদিকে আল্লাহ তাআলা নিজেই নির্দেশ দিবেন যে– وَمَا آَتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا‘আর (আমার) রাসুল (মুহাম্মাদ) তোমাদের কাছে যাকিছু (নির্দেশনা) এনেছে তা আঁকড়িয়ে ধরো এবং তোমাদেরকে যা কিছু করতে নিষেধ করে তা পরিত্যাগ করো’। [সূরা হাশর ৭] -আবার তিনি মুহাম্মাদ সা. কী কী নসিহত, আদেশ ও নিষেধ করেছেন তা পর্যাপ্ত মাত্রায় সংরক্ষনের ব্যবস্থা না করেই মুসলমানদেরকে শূন্যে ছেড়ে দিবেন?! জি হ্যা, তিনি মুসলমানদেরকে শূন্যে ছেড়ে দেন নি। তিনি নিজেই কুরআনের হিফাজতের দায়িত্ব নিয়েছেন, সাথে সাথে কুরআনের অর্থ, মর্ম ও ব্যাখ্যারও, যা কিয়ামত পর্যন্ত মুসলমানদের ইসলামী শরীয়ত অনুসারে জীবন অতিবাহিত করার জন্য যথেষ্ঠ হবে। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন– إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ‘নিশ্চই আমিই (সেই সত্ত্বা, যিনি) আল-যিকর নাজিল করেছি এবং আমিই তার হিয়াজতকারী। [সূরা হিজর ৯]  এখানে الذِّكْر (আল-যিকর) বলতে আল্লাহ’র কিতাব ‘আল-কুরআন’ উদ্দেশ্য। [বিস্তারিত: তাফসীরে ত্বাবারী-১৭/৬৮; তাফসীরে ইবনে কাছির-৪/৫২৭; তাফসীরে কুরতুবী-৭/১৬৩] আর কুরআন বলতে আল্লাহ’র শুধু বাণীসমষ্টিই নয়, তার অর্থ, মর্ম ও উদ্দেশ্যও অন্তর্ভূক্ত। অর্থাৎ, যে উদ্দেশ্যে কুরআন নাজিল হয়েছে সেই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য যতটুকু অর্থ, মর্ম ও ব্যাখ্যা জানা দরকার তা সংরক্ষন করাও উপরোক্ত আয়াতে ইংগিত করা হয়েছে। এজন্য, নির্দ্বিধায় বলা যায়, দ্বীন ইসলামের উপর চলার জন্য আল-কুরআনের পাশাপাশি মুহাম্মাদ সা.-এর সুন্নাহ (আদর্শ) যথেষ্ট মাত্রায়  হিফাজত রয়েছে- (১) তাঁর যুগ থেকে চলে আসা নির্ভরযোগ্য মুসলীম উম্মাহ’র মধ্যে পরম্পরা আমলের চর্চার মাধ্যমে, (২) হাদিস আকারে, যেখানে তাঁর বাণী ও কর্মসমষ্টি বর্ণিত হয়েছে। 


(ঘ) নবী মুহাম্মাদ -এর যে কোনো প্রমাণিত সিদ্ধান্ত ও বিচার-ফয়সালা বিনাদ্বিধায় মেনে নেয়া ইমানের পূর্বশর্ত ও ফরয দায়িত্ব। যে ব্যাক্তি তাঁর বিচার-ফয়সালা বিনাদ্বিধায় মেনে নেয় না, সে তাঁর রিসালাতের উপর ইমানই আনেনি। 
 
(ঙ) যে ব্যাক্তি রাসুলুল্লাহ -এর সুন্নাহ (আদর্শ)কে হুজ্জত হিসেবে মানতে ইনকার ও অস্বীকার করে, সে দ্বীন ইসলামের একটি জরুরী (অত্যাবশ্যক) বিষয়কে শরীয়তের অংশ হিসেবে মানতে ইনকার ও অস্বীকার করার আকীদা পোষন করায়  সন্দেহাতীতভাবে একজন পথভ্রষ্ঠ কাফের/মুরতাদ [আল আওয়াসেম ওয়াল কাওয়াসেম-২/২৭৪]
 
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-
 
إِنَّ الَّذِينَ يَكْفُرُونَ بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ وَيُرِيدُونَ أَن يُفَرِّقُوا بَيْنَ اللَّهِ وَرُسُلِهِ وَيَقُولُونَ نُؤْمِنُ بِبَعْضٍ وَنَكْفُرُ بِبَعْضٍ وَيُرِيدُونَ أَن يَتَّخِذُوا بَيْنَ ذَٰلِكَ سَبِيلًا – أُولَٰئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ حَقًّا ۚ وَأَعْتَدْنَا لِلْكَافِرِينَ عَذَابًا مُّهِينًا – وَالَّذِينَ آمَنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ وَلَمْ يُفَرِّقُوا بَيْنَ أَحَدٍ مِّنْهُمْ أُولَٰئِكَ سَوْفَ يُؤْتِيهِمْ أُجُورَهُمْ ۗ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَّحِيمًا 
‘নিশ্চই যারা কুফরী করে আল্লাহ’র সাথে ও তাঁর রাসুলের সাথে এবং কামনা করে যাতে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের মাঝে (স্থাপিত শরয়ী সম্পর্কের মধ্যে) পার্থক্য সৃষ্টি করা যায় এবং বলে আমরা কারো প্রতি ইমান আনছি আর কারো সাথে কুফরী করছি এবং কামনা করে এর মাঝ থেকে (তৃতীয় একটি) পথ অবলম্বন করতে, তারাই হল খাঁটি কাফের। আর আমি কাফেরদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছি লাঞ্চনাদায়ক আযাব। আর যারা ইমান আনে আল্লাহ’র প্রতি এবং তাঁর রাসুলের প্রতি এবং তাঁদের মধ্যে কারোরও মাঝে (স্থাপিত শরয়ী সম্পর্কের মধ্যে) পার্থক্য সৃষ্টি করে না (বরং আল্লাহ’র হুকুমও মানে নবীকেও মানে), তাদেকে তিনি অতি শিঘ্রই দিবেন তাদের পুরুষ্কার। আর আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল ও রহমকারী’। [সূরা নিসা ১৫০-১৫২] 
 
কিন্তু এই শেষ জামানায় একটি পথভ্রষ্ঠ ফেরকাহ’র অাবির্ভাব হয়েছে, যারা বলে তাদের জন্য শুধু কুরআনই যথেষ্ট, আর এদিকে মুসলীম উম্মাহ’র কাছে রাসুলুল্লাহ সা.-এর যেসকল হাদিসসমূহ নির্ভরযোগ্যসূত্রে সংরক্ষিত আছে তা আগাগোড়া অস্বীকার করে। তারা ‘আহলে কুরআন’ নামে পরিচিত। এজাতীয় লোকদের দিকে ইঙ্গিত করে আবু রাফে’ রা.-এর সূত্রে এক হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেন-  لَا أُلْفِيَنَّ أَحَدَكُمْ مُتَّكِئًا عَلَى أَرِيكَتِهِ يَأْتِيهِ الْأَمْرُ مِنْ أَمْرِي مِمَّا أَمَرْتُ بِهِ أَوْ نَهَيْتُ عَنْهُ فَيَقُولُ لَا نَدْرِي مَا وَجَدْنَا فِي كِتَابِ اللَّهِ اتَّبَعْنَاهُ . رواه أبو داود في سننه , كتاب السنة , باب في لزوم السنة : ٤/٢٠٠ رقم ٤٦٠٥، و قال ت الأرنؤوط : ٧/١٥ : إسناده صحيح، و صححه الألباني في صحيح أبي داود– “তোমাদের কারোর সাথে যেন এমন ভাবে সাক্ষাত না ঘটে যে, সে তার আরাম-কেদারায় হেলান দিয়ে (আরামে বসে) আছে, (এমতাবস্থায়) আমি নির্দেশ দিয়েছি বা কিছু করতে নিষেধ করেছি – এমন  নির্দেশ সমূহের মধ্যে কোনো নির্দেশ তার কাছে চলে আসে, আর সে বলে: ‘আমরা (দ্বীন ও শরীয়ত মানার প্রশ্নে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর হাদিস মানতে হবে মর্মে কিছু) জানিনা। আমরা(তো শুধুমাত্র) আল্লাহ’র কিতাবে যা পাবো, মানবো (কেবল) সেটাকেই”। [সুনানে আবু দাউদ- ৪/২০০ হাদিস ৪৬০৫; সুনানে তিরমিযী- ৫/৩৭ হাদিস ২৬৬৩; সুনানে ইবনে মাজাহ- ১/৬ হাদিস ১৩; মুসনাদে আহমদ- ৮/৬; সুনানুল কুবরা, ইমাম বাইহাকী- ৭/১২১ হাদিস ১৩৪৪১]

মিকদাম বিন মা’দীকারিব রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেছেন- أَلَا هَلْ عَسَى رَجُلٌ يَبْلُغُهُ الحَدِيثُ عَنِّي وَهُوَ مُتَّكِئٌ عَلَى أَرِيكَتِهِ، فَيَقُولُ: بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ كِتَابُ اللَّهِ، فَمَا وَجَدْنَا فِيهِ حَلَالًا اسْتَحْلَلْنَاهُ. وَمَا وَجَدْنَا فِيهِ حَرَامًا حَرَّمْنَاهُ، وَإِنَّ مَا حَرَّمَ رَسُولُ اللَّهِ كَمَا حَرَّمَ اللَّهُ . رواه الترمذي في سننه , أبواب العلم , باب ما نهي عنه أن يقال عند حديث النبي صلى الله عليه وسلم : ٥/٣٤ رقم ٢٦٦٤، و صححه الألباني في صحيح الترمذي و في السلسلة الصحيحة : رقم ٢٨٧٠ – “খুব ভাল করে শুনে রাখো, (অচিরেই এমন ধরনের উদরপূর্ণ) ব্যাক্তির (আবির্ভাবের) সম্ভাবনা রয়েছে, যার কাছে (তার এমন হালতে) আমার পক্ষ থেকে (নির্ভরযোগ্য সূত্রে কোনো) হাদিস গিয়ে পৌছবে যে, সে (তখন) তার আরাম-কেদারায় হেলান দেয়াবস্থায় থাকবে, তারপর সে (আমার হাদিসটি শুনে) বলবে: ‘আমাদের ও তোমাদের মাঝে আল্লাহ’র কিতাব (আল-কুরআন) রয়েছে, (সেটাই আমাদের জন্য যথেষ্ঠ)। কাজেই, আমরা তার মধ্যে যাকিছু হালাল হিসেবে পাবো, আমরা (কেবল) সেটাকেই (আমাদের জন্য) হালাল হিসেবে গণ্য করবো এবং আমরা তার মধ্যে যাকিছু হারাম হিসেবে পাবো, আমরা (কেবল) সেটাকেই (আমাদের জন্য) হারাম হিসেবে গণ্য করবো’। (কিন্তু খুব ভাল করে শুনে রাখো), নিশ্চই আল্লাহ’র রাসুল যাকিছু হারাম করেন, সেটাও আল্লাহ কর্তৃক (কোনো কিছু) হারাম করার মতোই (হুকুম রাখে, কারণ আল্লাহ’র রাসুল শরীয়তের কোনো কিছুই ওহীর ইঙ্গিত ছাড়া নিজ থেকে হালাল বা হারাম করেন না)”[সুনানে তিরমিযী- ৫/৩৮ হাদিস ২৬৬৪; সুনানে ইবনে মাজাহ- ১/৬ হাদিস ১২; মুসনাদে আহমদ– ৪/১৩১ হাদিস ১৬৭২২; সুনানুল কুবরা, ইমাম বাইহাকী- ৭/১২১ হাদিস ১৩৪৪২]

এই শেষ জামানায় এক পথভ্রষ্ঠ ফেরকাহ’র আবির্ভাব হয়েছে, যারা বলে তাদের জন্য শুধু কুরআনই যথেষ্ট, আর এদিকে মুসলীম উম্মাহ’র কাছে রাসুলুল্লাহ সা.-এর যেসকল হাদিসসমূহ নির্ভরযোগ্যসূত্রে সংরক্ষিত আছে তা আগাগোড়া অস্বীকার করে। তারা ‘আহলে কুরআন’ নামে পরিচিত, যাদেকে ‘মুনকেরুল হাদিস’ (হাদিস অস্বীকারকারী) বা ‘মুনকেরুস সুন্নাহ’ (সুন্নাহ অস্বীকারকারী)ও বলা হয়ে থাকে। এই ভবিষ্যৎ বাণী পূর্ণ হয়েছে।

হাদীস অস্বীকার করার এক সুবিধা হল কুরআনের ইচ্ছে মতো ব্যাখ্যা করে তার প্রকৃত অর্থ ও তাৎপর্যকে দুমড়ে-মুঁচড়ে রাখা যায় এবং ইসলামের বিরুদ্ধে বিভিন্নভাবে যুৎসই মতো ব্যবহার করে স্বেচ্ছাচারী জীবন কাটানোর পথ পাওয়া যায়। আজকালকার লিবারাল ঘরানার লোকেরা এই ফাঁদের বেশি শিকার হয়ে থাকে।  الله اعلم

(دَعُونِي مَا تَرَكْتُكُمْ، إِنَّمَا هَلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ بِسُؤَالِهِمْ وَاخْتِلاَفِهِمْ عَلَى أَنْبِيَائِهِمْ، فَإِذَا نَهَيْتُكُمْ عَنْ شَيْءٍ فَاجْتَنِبُوهُ، وَإِذَا أَمَرْتُكُمْ بِأَمْرٍ فَأْتُوا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ) رواه البخاري، (6 /2658)، (ح6858).

يُوشِكُ بِأَحَدِكُمْ أَنْ يَقُولُ: هَذَا كِتَابُ اللَّهِ، مَا كَانَ فِيهِ مِنْ حَلاَلٍ أَحْلَلْنَاهُ وَمَا كَانَ فِيهِ مِنْ حَرَامٍ حَرَّمْنَاهُ، أَلاَ مَنْ بَلَغَهُ عَنِّي حَدِيثٌ فَكَذَّبَ بِهِ، فَقَدْ كَذَّبَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَالَّذِي حَدَّثَهُ . رواه الطبراني في ” الأوسط ” عن جابر، وأورده ابن عبد البر في ” جامع بيان العلم : ٢/١٨٩

https://www.alukah.net/sharia/0/129808/%D8%AD%D8%AC%D9%8A%D8%A9-%D8%A7%D9%84%D8%B3%D9%86%D8%A9-%D8%A7%D9%84%D9%86%D8%A8%D9%88%D9%8A%D8%A9/#_ftnref21

قُلْ أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ فَإِنْ تَوَلَّوا فَإِنَّمَا عَلَيْهِ مَا حُمِّلَ وَعَلَيْكُمْ مَا حُمِّلْتُمْ وَإِنْ تُطِيعُوهُ تَهْتَدُوا وَمَا عَلَى الرَّسُولِ إِلَّا الْبَلاغُ الْمُبِينُ [النور:54] و

 

من عمل عملاً ليس عليه أمرنا فهو رد

https://ketabonline.com/ar/books/106826/read?part=1&page=1&index=3810123


>>> মূল সূচিপত্র (index) থেকে এ পেজের পূর্ববর্তী বা পরবর্তী আলোচনা পড়তে [এখানে ক্লিক করুন]