ইসলামে নারী বিচারক (কাজী) নাজায়েয vs ধর্মনিরপেক্ষতার শরীয়ত বিরোধীতা

ইসলামী শরীয়তে মুসলমানদের উপরে নারী বিচারক (কাজী) নাজায়েয vs ধর্মনিরপেক্ষতার শরীয়ত বিরোধীতা ও পথভ্রষ্ঠতা


>>> মূল সূচিপত্র (index) থেকে এ পেজের পূর্ববর্তী বা পরবর্তী আলোচনা পড়তে [এখানে ক্লিক করুন] 


 
পূর্ব আলোচনার পর…
 

(খ) বিচারক (কাজী) হবেন একজন পুরুষ

কুরআন-সুন্নাহর সুস্পষ্ট দলিলাদির ভিত্তিতে এব্যাপারে পূর্বাপর সকল মুহাক্কেক ওলামায়ে কেরামের ইজমা রয়েছে যে, মুসলমানদের উপরে শরয়ী কাজী (বিচারক) নিযুক্ত হওয়ার একটি অন্যতম শর্ত হল  পুরুষ  হওয়া, এবং কোনো নারীর জন্য এ পদ গ্রহন করা কিংবা মুসলমানদের দ্বারা তাকে এ পদে অধিষ্ঠিত করানো দুটোই সমভাবে নাজায়েয

এব্যাপারে বিস্তারিত জানার আগে প্রত্যেক মুসলমানের একথাটি তার মস্তিষ্কে গেঁথে নেয়া জুরুরী যে, বিচারক (কাজী) পদটি গ্রহন করা এবং ইসলামী শরীয়ত মোতাবেক বিচারকার্য সম্পাদন করাটা – অহংকার বা ফুটানী প্রদর্শনের ক্ষেত্র নয় মোটেও, বরং এটা নবুওতের পর সব থেকে বড় ও অতীব ভারী এমন এক আমানত, যার প্রতিটি পদক্ষেপে খেয়ানত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, যার পরিণতিতে দুনিয়া ও আখেরাতে লজ্জা ও জিল্লতীর সম্ভাব্যতাই অধিক।

আবু হুরায়রাহ রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেছেন- مَنْ وَلِيَ القَضَاءَ، أَوْ جُعِلَ قَاضِيًا بَيْنَ النَّاسِ فَقَدْ ذُبِحَ بِغَيْرِ سِكِّينٍ . رواه الترمذي في سننه , كتاب الأحكام عن رسول الله صلى الله عليه وسلم , باب ما جاء عن رسول الله صلى الله عليه وسلم في القاضي : ٣/٦١٥ رقم ١٣٢٥ و قال : هذا حديث حسن غريب من هذا الوجه وقد روي أيضا من غير هذا الوجه عن أبي هريرة عن النبي صلى الله عليه وسلم، من جعل قاضياً بين الناس فقد ذبح بغير سكين . رواه أبو داود في سننه, كتاب الاقضية: ٢/٢٩٨ رقم ٣٥٧١، ٣٥٧٢ ، و ابن ماجه في سننه: ٢/٧٧٤ رقم ٢٣٠٨، و الامام احمد في مسنده: ٢/٣٦٥ رقم ٨٧٦٢ و قال شعيب الأرنؤوط : إسناده حسن، و صححه الالبانى    – “যে ব্যাক্তি কাজী (বিচারক)-এর দায়িত্ব নিলো, অথবা যাকে মানুষজনের মাঝে কাজী (বিচারক) বানানো হল, সে মূলতঃ ছুরি ছাড়াই জবেহ হয়ে গেল” [সুনানে তিরমিজী– ৩/৬১৫ হাদিস ১৩২৫; সুনানে আবু দাউদ- ২/২৯৮ হাদিস ৩৫৭১, ৩৫৭২;  সুনানে ইবনে মাজাহ- ২/৭৭৪ হাদিস ২৩০৮; মুসনাদে আহমদ- ২/৩৬৫ হাদিস ৮৭৬২]

হযরত আয়েশা রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেছেন- يُؤْتَى بِالْقَاضِي الْعَدْلِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ، فَيَلْقَى مِنْ شِدَّةِ الْحِسَابِ مَا يَتَمَنَّى أَنَّهُ لَمْ يَقْضِ بَيْنَ اثْنَيْنِ فِي تَمْرَةٍ قَطُّ . أخرجه الطيالسي في مسنده , أحاديث النساء , الأفراد عن عائشة : ٣/١٣٢ رقم ١٦٥٠، و ابن حبان : ١١/٤٣٩ رقم ٥٠٥٥ ; و أحمد في مسنده: ٦/٧٥، و الطبراني في الأوسط: ٢٧٨١، والبيهقي في سننه الكبرى: ١٠/٩٨، ضعفه الالبانى في السلسلة الضعيفة: ١١٤٢ –কিয়ামতের দিন একজন ন্যায়পরায়ন কাজী (বিচারক)’কে নিয়ে আসা হবে। তখন সে এত কঠিন হিসাব দানে নিপতিত হবে যে, সে কামনা করতে থাকবে, (কতই না ভাল হতো) যদি সে (দুনিয়ার জীবনে) দু’ব্যাক্তির মাঝে কোনো ব্যাপারেও বিচার করে না দিতো” ! [মুসনাদে আবু দাউদ তায়ালিসী- ৩/১৩২ হাদিস ১৬৫০; সহিহ ইবনে হিব্বান- ১১/৪৩৯ হাদিস ৫০৫৫; মুসনাদে আহমদ- ৬/৭৫; মু’জামুল আউসাত, তাবরাণী- ২৭৮১; সুনানুল কুবরা, বাইহাকী- ১০/৯৮; তারিখুল কাবীর, ইমাম বুখারী- ৪/২৮২ হাদিস ২৮১৬] 

সাথে একথাও মস্তিষ্কে গেঁথে নেয়া জুরুরী যে, আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনের  বহু স্থানে ‘তাকওয়া’র প্রশ্নে পুরুষ ও নারী‘র মাঝে কোনো পার্থক্য করেননি, বরং তাদের দুজন-এর মধ্যে যে-ই আল্লাহ তাআলার অধিক অনুগত হবে ও তাঁকে ভয় করে চলবে, সে-ই আখেরাতে আল্লাহ তাআলা’র অধিক নৈকট্য লাভ করবে -চাই সে পুরুষ হোক বা নারী। যেমন, আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন– مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَىٰ وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَاةً طَيِّبَةً ۖ وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُمْ بِأَحْسَنِ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ -“যে ব্যাক্তিই মুমিন থাকা অবস্থায় নেক কাজ করবে -চাই সে পুরুষ হোক বা নারী, তাকে আমরা অবশ্যই হায়াতে তৈয়্যেবা’র জীবন যাপন করাবো এবং তারা যেসকল উৎকৃষ্ট কাজ করবে সে অনুযায়ী তাদেরকে আমরা অবশ্যই পুরুষ্কারে পুরষ্কৃত করবো”[সুরা নাহল ৯৭] উদাহরণ হিসেবে বলা যায় হযরত ঈসা আ.-এর সম্মানিত মাতা হযরত মারিয়াম রা. একজন নারী হয়েও আল্লাহর যে নৈকট্য লোভ করেছেন, আপনি-আমি পুরুষ হয়েও কি সেই নৈকট্যেল ধারের কাছেও যেতে পারবো? এথেকে বোঝা গেল, নিছক পুরুষ বা নারী হওয়াতে লাভ/ক্ষতির কিছু নেই, লাভ/ক্ষতি নির্ভর করবে ‘তাকওয়া’র উপরে। কিন্তু দুনিয়ার মানব জীবনকে সুষ্ঠু ও সুন্দর করে গড়ে তোলা ও আল্লাহ’র দ্বীন অনুয়ায়ী চলার জন্য আল্লাহ তাআলা তাঁর মহাজ্ঞান ও হিকমতের আলোকে পুরুষদের কাঁধে এমন কিছু বিশেষ দায়িত্ব বেশি চাপিয়ে দিয়েছেন, যেসকল দায়িত্বের বোঝা থেকে তিনি নারীদেরকে পরিত্রান দিয়েছেন। এদিকে ইশারা করেই আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেনوَلِلرِّجَالِ عَلَيْهِنَّ دَرَجَةٌ – ‘আর (দায়িত্বের প্রশ্নে) নারীদের উপর পুরুষের জন্য (নির্ধারিত রয়েছে) একটি (অতিরিক্ত দরজা) স্তর’ [সুরা বাকারাহ ২২৮] তিঁনি আরো এরশাদ করেনالرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ بِمَا فَضَّلَ اللَّهُ بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ وَبِمَا أَنْفَقُوا مِنْ أَمْوَالِهِمْ – ‘পুরুষ ব্যাক্তি নারী’র উপর কাউআম (ওলী ও অভিভাবক)। এটা এজন্য যে, আল্লাহ তাদের কতককে কতকের উপর মর্যাদা দিয়েছেন এবং এজন্য যে, তারা (পুরুষরা আল্লাহ’র পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত যে, নারীদের ভরনপোষনের জন্য তারা উপার্জনকৃত) অর্থকড়ির মধ্য থেকে ব্যায় করবে’[সুরা নিসা ৩৪] 

নিঃসন্দেহে, রাসুলল্লাহ -এর হাদিস ও সুন্নাহ হল কুরআন কারিমের ব্যাখ্যা। এক্ষেত্রে সহিহ বুখারী’র নিম্নোক্ত এই মাশহুর হাদিসটি মূলতঃ উপরোক্ত সুরা বাকারাহ’র ২২৮ নং আয়াত এবং সুরা নিসার ৩৪ নং আয়াতেরই ব্যাখ্যা। হাসান রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, (সাহাবী) আবু বকরাহ রা. বর্ণনা করেন–  لَمَّا بَلَغَ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَنَّ أَهْلَ فَارِسَ قَدْ مَلَّكُوا عَلَيْهِمْ بِنْتَ كِسْرَى قَالَ : لَنْ يُفْلِحَ قَوْمٌ وَلَّوْا أَمْرَهُمُ امْرَأَةً . رواه البخاري في الصحيح , كتاب المغازي , باب كتاب النبي صلى الله عليه وسلم إلى كسرى وقيصر: رقم ٤١٦٣ রাসুলুল্লাহ -এর কাছে যখন এই খবর পৌছলো যে, পারস্যবাসীরা তাদের উপর কিসরার কন্যাকে রাষ্ট্রপ্রধান বানিয়ে রেখেছে, তখন তিঁনি এরশাদ করলেন-‘ওই জাতি কক্ষোনই সফলতা অর্জন করতে পারবে না, যে জাতি কোনো নারীকে তাদের বিষয় গুলোর ওলী (অভিভাবক) বানিয়ে দেয়”। [সহীহ বুখারী– ৪/১৬১০ হাদীস ৪১৬৩; মুসনাদে আহমাদ- ৫/৪৩, ৪৭, ৫১; জামে’ তিরমিজী- ৪/৫২৮, হাদিস ২২৬২; সুনানে নাসায়ী-৮/২২৭, হাদিস ৫৩৮৮; মুসনাদে বাযযার, হাদিস ৩৬৮৫; আল মুস্তাদরাকে হাকিম- ৩/১১৯]

হাদিসটিতে দেখা যায়, রাসুলুল্লাহ-কে – পারস্যের মতো একটি কাফের অধ্যুসিত রাষ্ট্রের একজন কাফের নারী-রাষ্ট্রপ্রধান সম্পর্কে সংবাদ দেয়া হয়েছিল, কিন্তু তিঁনি অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত কথায় একটি মূলনীতি বলে দিয়েছেন, আর সেটা হল, কোনো নারীকে রাষ্ট্রের যে কোনো স্তরের ওলী (অভিভাবক) পর্যায়ের কোনো পদে বসিয়ে দিলে তার ক্ষেত্রেই উপরোক্ত হাদিসে বর্ণিত ধমকীটি প্রযোগ্য হবে – চাই সে কোনো কাফের নারী হোক বা মুসলীম নারী হোক, চাই সে রাষ্ট্রপ্রধান পর্যায়ের ওলী (অভিভাবক) হোক বা তার নিচের কোনো পদের ওলী (অভিভাবক) হোক। যেমন, জমহুর মুহাক্কিক মুহাদ্দিসীন ও ফুকাহায়ে কেরাম বলেছেন যে, উপরোক্ত হাদিসে বর্ণিত وَلَّوْا أَمْرَهُمُ امْرَأَةً – ‘কোনো নারীকে তাদের বিষয়গুলোর ওলী (অভিভাবক) বানিয়ে দেয়’ -এই বাক্যের মধ্যে امرهم ( তাদের বিষয়গুলো)কথাটি  عام  (আম/ব্যাপক অর্থবোধক)। অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা দ্বীন-দুনিয়ার যে যে ব্যাপারে ওলী (অভিভাবক) হওয়ার দায়িত্ব পুরুষের উপরে চাপিয়ে দিয়েছেন, তার সব কয়টি ক্ষেত্রেই হাদিসের এই ধমকী প্রযোজ্য এবং ওর সবগুলোর ক্ষেত্রেই নারীকে ওলী (অভিভাবক) বানানো নাজায়েয ও গুনাহ’র কাজ। যেমন, ইমাম হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী (মৃ: ৮৫২ হি:) রহ. লিখেছেন- قال الخطابي : في الحديث أن المرأة لا تلي الإمارة ولا القضاء ، وفيه أنها لا تزوج نفسها ، ولا تلي العقد على غيرها – “(ইমাম) খাত্তাবী বলেন- ‘হাদিসটিতে (এই মাসআলা অন্তর্ভূক্ত) রয়েছে যে, নারী -না রাষ্ট্রের ওলী (অভিভাবক) হতে পারবে, আর না পারবে বিচারকার্যের (ওলী/অভিভাবক হতে)। এই হাদিসে (এ মাসআলাও অন্তর্ভূক্ত) রয়েছে যে, নারী(’র মধ্যে ওলী/অভিভাবক হওয়ার শরয়ী যোগ্যতা বিদ্যমান না থাকায় সে) না (পুরুষের মতো নিজেই নিজের ওলী হয়ে নিজেই) নিজকে বিয়ে দিতে পারে, আর না সে- অন্য কারোর (বিয়ের) আক্বদ (সম্পন্ন করা)র ওলী (অভিভাবক) হতে পার[ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার- ৭/৭৩৪]

ইমাম মুহাম্মাদ শাওকানী (মৃ: ১২৫৫ হি:) রহ. লিখেছেনفيه دليل على أن المرأة ليست من أهل الولايات، ولا يحل لقوم توليتها؛ لأن تجنب الأمر الموجب لعدم الفلاح واجب – “এই হাদিসটি একথারই দলিল যে,  নারী (শরীয়তের দৃষ্টিতে) ‘ওলী’ হওয়ার উপযোগী ব্যাক্তিদের মধ্যে গণ্য নয়। কোনো জাতি বা গোষ্ঠির জন্যও একাজ হালাল নয় যে, তারা কোনো নারীকে তাদের ওলী (অভিভাবক) বানিয়ে নিবে। [নাইলুল আওতার, শাওকানী- ৩/১৩৭] আর নিঃসন্দেহে কাজী (বিচারক) হলেন একজন উলুল-আমর এবং মুসলমানদের উপর নিয়গকৃত একজন বড় মাপের ওলী (অভিভাবক)। সুতরাং কোনো নারীকে কাজী (বিচারক) বানানোও  নাজায়েয

আর আমরা উপরে বলে এসেছি যে, বিচারক (কাজী)’র মূল দায়িত্বটা মূলত: খলিফা’রই, যা তিঁনি যেমন নিজেও সম্পাদন করতে পারেন, তেমনি কাজের সুবিধার্থে অন্য যোগ্য কোনো মুসলমানকেও বিচারক (কাজী) হিসেবে নিয়োগ দিতে পারেন, যিনি খলিফার প্রতিনিধি হিসেবে বিচারকার্য আঞ্জাম দিবেন। [বিদায়াতুল মুজতাহীদ, ইবনে রুশদ- ২/৩৮৪; শারহু আদাবিল কাজী, ইবনে মাজাহ- ১/১২৯; তাবসিরাতুল হুক্কাম, ইবনে ফারহুন- ১/২১;  রাদ্দুল মুহতার, ইবনে আবিদীন- ৫/৩৬৮, ৪০৯; নিযামুল কাজা- ১/৩৩] সুতারং, কোনো নারীর জন্যখলিফা হওয়া নাজায়েয হলে তার জন্য মুসলমানদের উপরে বিচারক (কাজী) নিযুক্ত হওয়াও নাজায়েয হবে। কারণ, মূলে যিনি খলিফা, আসলে তিনিই বিচারক (কাজী) হওয়ার প্রধান হক্বদার এবং তিনিই হলেন রাষ্ট্রের সকল নাগরীকের উপর নিয়োগকৃত সবচাইতে বড় ওলী (অভিভাবক)।। হাদিসেও শাসককে ‘ওলী (অভিভাবক)’ শব্দযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।

যেমন, হযরত আওফ বিন মালেক রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেন- خِيَارُ أَئِمَّتِكُمْ الَّذِينَ تُحِبُّونَهُمْ وَيُحِبُّونَكُمْ، وَيُصَلُّونَ عَلَيْكُمْ وَتُصَلُّونَ عَلَيْهِمْ، وَشِرَارُ أَئِمَّتِكُمْ الَّذِينَ تُبْغِضُونَهُمْ وَيُبْغِضُونَكُمْ، وَتَلْعَنُونَهُمْ وَيَلْعَنُونَكُمْ ” قِيلَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ أَفَلَا نُنَابِذُهُمْ بِالسَّيْفِ ؟ فَقَالَ:” لَا مَا أَقَامُوا فِيكُمْ الصَّلَاةَ، وَإِذَا رَأَيْتُمْ مِنْ وُلَاتِكُمْ شَيْئًا تَكْرَهُونَهُ، فَاكْرَهُوا عَمَلَهُ، وَلَا تَنْزِعُوا يَدًا مِنْ طَاعَةٍ. رواه مسلم, كتاب الإمارة, باب خيار الأئمة وشرارهم: رقم ١٨٥٥ -‘তোমাদের ওই ইমাম (খলিফা/আমীর)গণই উত্তম, যাদেরকে তোমরা ভালবাসো এবং তারাও তোমাদেরকে ভালবাসে, তারা তোমাদের জন্য দোয়া করে এবং তোমরাও তাদের জন্য দোয়া করো। আর তোমাদের ওই ইমাম (রাষ্ট্রপ্রধান)গণই নিকৃষ্ট যাদেরকে তোমারা ঘৃনা করো এবং তারাও তোমাদেরকে ঘৃনা করে, তোমরা তাদেরকে অভিশাপ দেও, তারাও তোমাদেরকে অভিশাপ দেয়। বলা হল: ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমরা কি তাদের বিরুদ্ধে তরবারী নিয়ে বিদ্রোহ করবো না? তিনি বললেন: না, যাবৎ তারা তোমাদের মাঝে নামায আদায় করে। আর তোমরা যখন তোমাদের (রাষ্ট্রের) ওলী’দের (অভিভাবক’দের/শাসক’দের মাঝে এমন) কিছু দেখতে পাও যা তোমরা অপছন্দ করো, তখন তোমরা তাদের ওই কাজটিকে অপছন্দ করবে, কিন্তু (তাদের) অনুগত্য থেকে (তোমাদের) হাত’কে সরিয়ে নিবে না’। [সহিহ মুসলীম – ৬/২৪ হাদিস ১৮৫৫; সুনানে দারেমী, হাদিস ২৮৩৫; মু’জামুল কাবীর, তাবরাণী- ১৮/৬২]  সুতরাং, কোনো নারীকে কোনো নিম্ন স্তরের ওলী (অভিভাবক) বানানোই যেখানে জায়েয নেই, সেখানে তো নারীকে রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান বানানো আরো শক্তনাজায়েয কাজ হবে।

ইমাম আবু বকর ইবনুল আরাবী (মৃ: ৫৪৩ হি:) রহ লিখেছেন– هذا نص في أن المرأة لا تكون خليفة ولا خلاف فيه – এই হাদিসটি একথার দলিল যে, কোনো নারী খলিফা হতে পারবে না। আর (আহলে হ্বক ওলামায়ে কেরাম থেকে) এর বিপরীত কোনো মত নেই”[আহকামুল কুরআন, ইবনুল আরাবী- ৩/৪৮৪] সুতরাং, এ দৃষ্টিকোণ থেকেও কোনো নারীকে কাজী (বিচারক) বানানোও  নাজায়েয প্রমাণিত হয়।

নারীকে কাজী (বিচারক) বানানো যে নাজায়েয ও গুনাহ’র কাজ তার সপক্ষে কেবল উপরোক্ত হাদিসটিই দলিল -বিষয়টি এমন নয়। বরং এছাড়া আরো বহু দলিল রয়েছে, যার সবগুলো ব্যাখ্যা সহ উল্লেখ করা এই ক্ষুদ্র পরিসরে মোটেও সম্ভব নয়, কারণ তাতে পাঠকের মনোযোগ আমাদের মূল আলোচনা থেকে অন্যত্র সরে যেতে পারে। (আল্লাহ’র তৌফিক হলে পৃথক ভাবে  দলিল ও ব্যাখ্যা সহ এব্যাপারে আলোচনা পেশ করার ইচ্ছা রইলো)। এখানে শুধু কয়েকটি পয়েন্ট নিয়ে অতি সংক্ষেপে কিছু আলোচনা করেই ক্ষ্যান্ত হচ্ছি।

(১)  ইসলামে, বিচারক (কাজী)’র মূল দায়িত্বটা মূলত: খলিফা’রই, যা তিঁনি যেমন নিজেও সম্পাদন করতে পারেন, তেমনি কাজের সুবিধার্থে অন্য যোগ্য কোনো মুসলমানকেও বিচারক (কাজী) পদে নিয়োগ দিতে পারেন, যিনি খলিফার প্রতিনিধি হিসেবে বিচারকার্য আঞ্জাম দিবেন। [বিদায়াতুল মুজতাহীদ, ইবনে রুশদ- ২/৩৮৪; শারহু আদাবিল কাজী, ইবনে মাজাহ- ১/১২৯; তাবসিরাতুল হুক্কাম, ইবনে ফারহুন- ১/২১;  রাদ্দুল মুহতার, ইবনে আবিদীন- ৫/৩৬৮, ৪০৯; নিযামুল কাজা- ১/৩৩] রাসুলুল্লাহ ﷺ এবং খুলাফায়ে রাশেদীন (আবু বকর সিদ্দিক রা., ওমর ফারুক রা., ওসমান গণী রা., আলী বিন আবি ত্বালেব রা., ওমর বিন আব্দুল আজিজ রহ. প্রমুখ) নিজেরা খলিফা হিসেবে অপরাপর দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি মুসলমানদের মাঝে বিচার ফয়সালাও করে দিতেন, আবার কাজের সুবিধার্থে অন্য যোগ্য মুসলমানকেও বিচার ফয়সালার দায়িত্ব ন্যাস্ত করতেন। হাদিস ও তারিখের কিতাবে এর ভুরীভুরী নমুনা আছে যার সবগুলো এখানে উল্লেখ করা সম্বব নয়। এখানে শুধু নমুনা স্বরূপ কিছু আয়াত ও হাদিস পেশ করছি।

আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন

فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا 
“আপনার রবের শপথ, কক্ষোনো নয়! যতক্ষন পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের মাঝে সৃষ্ট বিবাদ-বিসম্বাদগুলোর জন্য (হে নবী মুহাম্মাদ!) তোমাকে বিচারক না মানবে, অতঃপর তুমি যে ফয়সালা করে দিয়েছ সে ব্যপারে (যতক্ষন পর্যন্ত) তাদের মনে দ্বিধামুক্ততা অনুভূত না হবে এবং (যতক্ষন পর্যন্ত) তারা (তোমার ফয়সালাকে) ঐকান্তিকভাবে গ্রহন করে না নিবে, ততক্ষন পর্যন্ত তারা (মূলতঃ তোমার উপর) ইমানআনায়নকারী (বিবেচিতই হবার) নয়, (বরং বিবেচিত হবে সন্দেহপোষনকারী মোনাফেক বেইমান হিসেবে)”।[সুরা নিসা ৬৫]
 
এটি একটি মাদানি আয়াত, মদিনায় ইসলামী খিলাফত কায়েম হবার পর নবী মুহাম্মাদ ﷺ যখন মুসলমানদের খলিফা, তখন ঘটনার এক পর্যায়ে আল্লাহ তাআলা এই আয়াত নাজিল করে জানিয়ে দিচ্ছেন যে, নিজকে মুসলীম দাবীদারদের মধ্যে যারা রাসুলুল্লাহ মুহাম্মাদ ﷺ-এর যে কোনো বিচার ফয়সালাকে মন থেকে সন্তষ্টচিত্বে মেনে না নিবে, ততক্ষন পর্যন্ত তাদের ইমানী দাবী বাতিল, কারণ তারা মুসলমান নামের মুনাফেক।
 
হানাশ রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, আলী রা. এরশাদ করেছেন-  بَعَثَنِي رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَى الْيَمَنِ قَاضِيًا، فَقُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ تُرْسِلُنِي وَأَنَا حَدِيثُ السِّنِّ، وَلَا عِلْمَ لِي بِالْقَضَاءِ، فَقَالَ: إِنَّ اللَّهَ سَيَهْدِي قَلْبَكَ، وَيُثَبِّتُ لِسَانَكَ، فَإِذَا جَلَسَ بَيْنَ يَدَيْكَ الْخَصْمَانِ، فَلَا تَقْضِيَنَّ حَتَّى تَسْمَعَ مِنَ الْآخَرِ، كَمَا سَمِعْتَ مِنَ الْأَوَّلِ، فَإِنَّهُ أَحْرَى أَنْ يَتَبَيَّنَ لَكَ الْقَضَاءُ، قَالَ: «فَمَا زِلْتُ قَاضِيًا، أَوْ مَا شَكَكْتُ فِي قَضَاءٍ بَعْدُ . أخرجه أبو داود في سننه , كتاب الأقضية , باب كيف القضاء: ٣/٣٠١ رقم ٣٥٨٢، و الترمذي في سننه : رقم ١٣٣١ و حسنه، و النسائي في الكبرى : رقم ٨٣٦٥ ،  و صححه الألباني في إرواء الغليل : رقم ٢٥٠٠ রাসুলুল্লাহ ﷺ  আমাকে ইয়ামেনে কাজী (বিচারক) হিসেবে পাঠিয়েছিলেন। তখন আমি তাঁকে বললাম: ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনি আমাকে (ইয়ামেনে কাজী’র দায়িত্ব দিয়ে) পাঠাচ্ছেন, অথচ আমি একজন নব্যবয়সী (যুবক), আর বিচারের জন্য আমার (বিস্তর) ইলমও নেই, (আমি কি এত বড় দায়িত্ব সামলাতে পারবো?)! এতে তিঁনি বললেন: ‘আল্লাহ (তাআলা) অচিরেই তোমার অন্তরে হেদায়েত দান করবেন এবং তোমার বজানকে (হক্বের উপরে) দৃঢ় করে দিবেন। সুতরাং, তুমি যখন তোমার সামনে উপস্থিত দুই পক্ষের সামনে (বিচারের জন্য) বসবে, তখন (এক পক্ষের শুনানী নিয়েই) ফয়সালা দিয়ে বসবেনা, যাবৎ না তুমি অপর (পক্ষের কাছ) থেকে (বিস্তারিত) কথা শোনো, যেমনি ভাবে তুমি প্রথম (পক্ষের কাছ) থেকে কথা শুনে নিয়েছো। নিশ্চয় এটা বিচারকে তোমার কাছে সুস্পষ্ট করে তোলার ক্ষেত্রে অধিক কার্যকর (পন্থা বাব্যবস্ত) হবে’। আলী রা. বলেন: ‘এরপর থেকে আর আমার (কখনো) বিচারে ভুল হয়নি বা কোনো বিচারে আমার সন্দেহ জন্মায়নি”। [সুনাআবু দাউদ- ৩/৩০১ হাদিস ৩৫৮২; সুনানুল কুবরা, ইমাম নাসায়ী, হাদিস ৮৩৬৫; সুনানে তিরমিযী, হাদিস ১৩৩১; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস২৩১০; মুসনাদে আহমদ, হাদিস ১২৮১; সুনানুল কুবরা, ইমাম বাইহাকী- ১০/২৩৬ হাদিস ২০৪৮৭
 
হযরত আবু হুরায়রাহ রা. থেকে সহিহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেছেন- سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمْ اللَّهُ فِي ظِلِّهِ يَوْمَ لا ظِلَّ إِلا ظِلُّهُ : الإِمَامُ الْعَادِلُ …. أخرجه البخاري في صحيحه : ٢/١٤٣ رقم ٦٦٠ و ١٣٢٣ و ٦٨٠٦ ; و مسلم صحيحه : ٧/١٦٩ برقم ١٧١٢; النسائي في سننه: رقم ٥٣٩٥; الترمذي في سننه: رقم ٢٣٩١ – ‘সাত (প্রকারের ব্যাক্তি রয়েছে), যাদেরকে আল্লাহ তাআলা এমন এক দিনে তাঁর (রহমতের) ছায়ার ভিতরে ছায়াচ্ছন্ন রাখবেন, যে দিন তাঁর (রহমতের) ছায়া ব্যতীত কোনো ছায়া থাকবে না। (তাদের একজন হল) الإِمَامُ الْعَادِل – ‘ইনসাফগার-ন্যায়পরায়ন ইমাম (খলিফা/শাসক)’…..’। [সহিহ বুখারী- ২/১৪৩ হাদিস ৬৬০, ১৩২৩, ৬৮০৬ মুসলীম-৭/১৬৯ হাদিস ১৭১২; সুনানে নাসায়ী, হাদিস ৫৩৯৫; সুনানে তিরমিযী, হাদিস ২৩৯১] আর কাউকে ইনসাফগার খলিফা-তো তখনই বলা হবে, যখন তিনি শাসন ও বিচার ফয়সালা দুটোই ইনসাফের সাথে পালন করবেন। আর জনগণকে শাসন করার প্রতিটি পদক্ষেপেই তো খলিফাকে কোনো না কোনো বিষয়ে ফয়সালা করে দিতে হয়।  
 
ইসলামী শরীয়তে যে কাজী (বিচারক) হওয়ার জন্য পুরুষ হওয়া শর্ত, তা সহিহ হাদিস দ্বারাও প্রমাণিত। যেমন, বুরাইদা রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেনالْقُضَاةُ ثَلَاثَةٌ: وَاحِدٌ فِي الْجَنَّةِ، وَ اثْنَانِ فِي النَّارِ، فَأَمَّا الَّذِي فِي الْجَنَّةِ فَرَجُلٌ عَرَفَ الْحَقَّ فَقَضَى بِهِ، وَ رَجُلٌ عَرَفَ الْحَقَّ فَجَارَ فِي الْحُكْمِ، فَهُوَ فِي النَّارِ، وَ رَجُلٌ قَضَى لِلنَّاسِ عَلَى جَهْلٍ فَهُوَ فِي النَّارِ . رواه أبو داود في سننه , كتاب الأقضية، باب: في القاضي يخطئ : ٣/٢٩٩ رقم ٣٥٧٣ و قال: وهذا أصح شيء فيه, و صححه الألباني في إرواء الغليل; و الترمذى في سننه : رقم ١٣٢٢، و ابن ماجة في سننه : رقم ٢٣١٥، و الطبراني في المعجم الكبير: ٢/٥، و الحاكم في المستدرك: ٤/٩١ ، و قال: حديث صحيح الإسناد ولم يخرجاه، وله شاهد بإسناد صحيح على شرط مسلم و وافقه الذهبي. قال الهيثمي: رجاله ثقات; -“(ইসলামী শরীয়তে মুসলমান) কাজী (বিচারক) তিন প্রকারের (হতে পারে)। (কেয়ামতের দিন এদের মধ্যে) এক (প্রকার বিচারক) জান্নাতে যাবে, আর (বাকি) দুই (প্রকারের বিচারক) যাবে জাহান্নামে। যে (বিচারক)টি জান্নাতে যাবে সে এমন পুরুষ ব্যাক্তি যে (কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক দ্বীনে) হক্ব’কে বুঝেছে তারপর সে অনুযায়ী বিচার করেছে। আর (বাকি দুইজনের একজন হল এমন) পুরুষ ব্যাক্তি যে হক্ব’কে বুঝেছে কিন্তু অবিচার করেছে, সুতরাং সে যাবে জাহান্নামে। (আরেকজন হল এমন) পুরুষ ব্যাক্তি যে (তার) মুর্খতার উপর ভিত্তি করে লোকজনের বিচার করেছে; তাই সেও যাবে জাহান্নামে”। [সুনানে আবু দাউদ- ৩/২৯৯ হাদিস ৩৫৭৩, সুনানে তিরমিজী, হাদিস ১৩২২; সুনানে ইবনে মাজা, হাদিস ২৩১৫, আল-মুজামুল কাবীর, ইমাম তাবরানী- ২/৫; মুসতাদরাকে হাকীম- ৪/৯১; শারহুস সুন্নাহ, ইমাম বগভী- ১০/৯৪; সুনানে বাইহাকী- ১০/১১৬]

এই রেওয়ায়েতে পরিষ্কার বলা হয়েছে, ইসলামী শরীয়ত মোতাবেক বিচার করা বা না-করা’র প্রশ্নে মুসলমানদের মধ্য থেকে কাজী (বিচারক) তিন প্রকারের হতে পারে, যাদের সকলেই رجل (পুরুষ ব্যাক্তি)। এই হাদিসে-তো কোনো নারীকে কাজী (বিচারক) হিসেবে কল্পনার মধ্যে আনা হয়নি!। সুতারং, মুসলমানদের রাষ্ট্রপ্রধান (খলিফা/আমীর/সুলতান/ইমাম) হওয়ার জন্য ‘পুরুষ’ হওয়া যেমন অন্যতম একটি পূর্ব শর্ত, তেমনি কাজী (বিচারক) হওয়ার জন্যও ‘পুরুষ’ হওয়া অন্যতম একটি পূর্ব শর্ত। বিষয়টি একদম পরিষ্কার। [নাইলুল আউতার, শাওকানী- ৮/৬১৮] 

(২)  ইসলামী শরীয়তের মাসআলাহ’টি কে না জানে যে, মুসলমানদের বিয়ের আক্বদ্ শুদ্ধ হওয়ার জন্য ‘ওলী’ (অভিভাবক) শামিল হওয়া একটি অন্যতম পূর্ব শর্ত। সহিহ হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেন– لا نكاح إلا بولي -‘ওলী ছাড়া বিয়ে হয় না’। [সুনানে তিরমিজী, হাদিস ১১০১; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ২০৮৫; মুসনাদে আহমাদ-৪/৪১৩; সহীহ ইবনে হিব্বান-৯/৩৮৬] আবার বহু হাদিস একথার দলিল যে, পুরুষ ব্যাক্তি তার নিজের বিয়েতে নিজেই ‘বিয়ের ওলী (অভিবাবক)’ হতে পারে-তো বটেই, এর সাথে সাথে সে অন্য কোনো নারী বা পুরুষ উভয়ের বিয়ের অলী (অভিভাবক)ও হতে পারে, কিন্তু কোনো নারী কারোরই বিয়ের ওলী (অভিভাবক) হতে পারবে না – না নিজের, না অন্যের। যেমন এক হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেন– لا تزوج المرأة المرأة، ولا تزوج المرأة نفسها – “(ইসলামে) কোনো নারী অন্য কোনো নারীকে বিয়ে দিতে পারে না এবং কোনো নারী নিজেও নিজের বিয়ে দিতে পারে না”। [সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস ১৮৮২] এ থেকে প্রমাণিত হল, ‘ বিয়ের ‘ওলী (অভিভাবক)’ হওয়ার জন্য  পুরুষহওয়া অন্যতম একটি পূর্ব শর্ত । [আল-মুগণী, ইবনে কুদামাহ- ৭/৩৩৭] সুতরাং, যেখানে বিয়ের মতো একটি পারিবারিক ব্যাপারেও নারীকে শরয়ী ওলী (অভিভাবক) বানানো জায়েয রাখা হয়নি, সেখানে দালালাতুন্নাস হিসেবে নারীকে রাষ্ট্রের মতো এত বিরাট ব্যাপারে মুসলমানদের এত উচ্চপর্যায়ের বড় ওলী (অভিভাবক) বানানো যে আরো শক্ত নাজায়েয গোনাহ’র কাজ হবে – তা সহজেই অনুমেয়। কারণ, যেমনটা উপরে বলে এসেছি যে, একে-তো কাজী (বিচারক) হওয়ার মূল দায়িত্ব খলিফার’ই, তদুপরি খলিফার প্রতিনিধি হিসেবে যে কাজী (বিচারক) মুসলমানদের বিচারকার্য সম্পাদনের দায়িত্ব পালন করে থাকেন সেই কাজী (বিচারক) খলিফারও বিচার করতে পারে ইসলামী শরীয়তে। সুতরাং, ইসলামী শরীয়তে কাজী (বিচারক)-এর পদটি যেনতেন ওলী’র পদ নয়; বরং,  রাষ্ট্রের অতীব উচ্চ পর্যায়ের ওলী (অভিবাবকত্ব)’র পদ। আর এটা নিছক অনুমান বা কিয়াস করে বলা হচ্ছে না। কারণ, যে নারীর বিয়ের ক্ষেত্রে তার নিকট-আত্বীয়ের মধ্যে কোনো ওলী (অভিভাবক) পাওয়া যায় না, তার বিয়ের আক্বদ্ শুদ্ধ হওয়ার জন্য খোদ্ রাসুলুল্লাহ -ই মুসলমানদের খলিফা বা রাষ্ট্রপ্রধানকেই তার ওলী (অভিভাবক) হওয়ার দায়িত্ব দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেন– فالسلطان ولي من لا ولي له -‘সেক্ষেত্রে যার কোনো ওলী (অভিভাবক) নেই, সুলতানই হবে তার ওলী (অভিভাবক)’। [সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ২০৮৩; সহীহ ইবনে হিব্বান-৩/৩৮৬; মুজামে আউসাত, ইমাম ত্বাবরাণী-৪/২৮২; মুসনাদে আহমাদ-১/২৫০; মুসনাদে আবু ইয়া’লা-৮/১৯১; সুনানে দ্বারাকুতনী-৩/২২৫; সুনানে বাইহাকী- ৭/১২৫]

এই হাদিস থেকেও প্রমাণিত হল, নারী নিজের বা অন্যের -কারোর বিয়ের ওলী হতে পারে না বলেই সেই দায়িত্ব রাষ্ট্রের সুলতান (রাষ্ট্রপ্রধান/খলিফা/আমীর)-এর হাতে দেয়া হয়েছে। আর বলাই বাহুল্য, একজন খলিফার পক্ষে এটা কখনই সম্ভব নয় যে, তিনি রাষ্ট্রের অপরাপর গুরুত্বপূর্ণ কাজকারবার বাদ দিয়ে, দেশে স্থানে স্থানে ঘুরে যেসকল ওলীহীন-নারী’র বিয়ে আটকে আছে তাদের ওলী হয়ে বিয়ে পড়িয়ে দেয়ার কাজ করে বেড়াবেন। সুতরাং, এক্ষেত্রে হাদিসে ‘সুলতান (খলিফা)’ কথাটির মধ্যে তার নিযুক্ত সকল ‘মুসলীম পুরুষ প্রতিনিধি’গণ, যারা দেশে বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবেন –যেমন: উযীর (মন্ত্রী), কোনো অঞ্চলের আমীর/আমেল (গভর্ণর/প্রশাসক/চেয়ারম্যান/মেয়র/কাউন্সিলর), হাকেম (শাসক/বিচারক), কাজী (বিচারপতি/বিচারক) প্রমুখ– তারাও অন্তর্ভূক্ত রয়েছেন। এজন্য, ওলীহীন-নারী’র বিয়ের ওলী যেমন রাষ্ট্রের সুলতান (খলিফা) হতে পারবেন, তেমনি দেশে চড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তার অনুমদিত প্রতিনিধিরাও ওলী হতে পারবেন। যেমন, ইমাম ইবনে কুদামাহ আল-মাকদেসী (মৃ: ৪৫৮ হি:) রহ. লিখেছেন: لا نعلم خلافا بين أهل العلم ، في أن للسلطان ولاية تزويج المرأة عند عدم أوليائها  …….و الأصل فيه قول النبي صلى الله عليه وسلم { : فالسلطان ولي من لا ولي له…….و السلطان هاهنا هو الإمام أو الحاكم ، أو من فوضا إليه ذلك  – “যে নারীর ওলী (অভিভাবক) নেই সেই নারীর বিয়ের ওলী হবেন সুলতান (খলিফা/ইমাম/আমিরুল মুনিনীন) –এ ব্যাপারে আহলে ইলমগণের মাঝে কোনো মতভিন্নতা আছে মর্মে আমাদের জানা নেই।…. এই মাসআলার ক্ষেত্রে মূল সূত্র হল, নবী ﷺ-এর হাদিস- فالسلطان ولي من لا ولي له -‘সেক্ষেত্রে যার কোনো ওলী (অভিভাবক) নেই, সুলতানই হবে তার ওলী (অভিভাবক)’।………আর এক্ষেত্রে সুলতান হলে ইমাম (খলিফা/আমিরুল মু’মিনীন), কিংবা হাকেম (শাসক/বিচারক) অথবা এ কাজের দায়িত্ব যাকে দেয়া হবে তিনি”। [আল-মুগনী, ইবনে কুদামাহ- ৭/১২, ১৩] সুতারং, মুসলমানদের রাষ্ট্রপ্রধান (খলিফা/আমীর/সুলতান/ইমাম) হওয়ার জন্য ‘পুরুষ’ হওয়া যেমন অন্যতম একটি পূর্ব শর্ত, তেমনি কাজী (বিচারক) হওয়ার জন্যও ‘পুরুষ’ হওয়া অন্যতম একটি পূর্ব শর্ত। বিষয়টি একদম পরিষ্কার। 

(৩) দ্বীন ইসলামে নারীদের থেকে পুরুষদের এমন কিছু অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, যে দায়িত্ব পালনের দায়িত্ব থেকে নারীরা মুক্ত। অর্থাৎ, এগুলো এমন সব দায়দায়িত্ব, যে ক্ষেত্রে কোনো মুসলিম নারী তা আদায় না করলে কিয়ামতের দিন তাকে সে ব্যাপারে জিজ্ঞেসও করা হবে না যে -‘তুমি ওটা কেনো করো নি’। কিন্তু মুসলিম পুরুষদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে – ‘তুমি ওটা কোনো করো নি’। যেমন, একটি সহিহ হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেন- أَلا كُلُّكُمْ رَاعٍ وَ كُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ فَالْأَمِيرُ الَّذِي عَلَى النَّاسِ رَاعٍ وَ هُوَ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ وَ الرَّجُلُ رَاعٍ عَلَى أَهْلِ بَيْتِهِ وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْهُمْ وَ الْمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ عَلَى بَيْتِ بَعْلِهَا وَ وَلَدِهِ وَ هِيَ مَسْئُولَةٌ عَنْهُمْ . رواه الإمام مسلم في صحيحه , كتاب الإمارة » باب فضيلة الإمام العادل وعقوبة الجائر والحث على الرفق بالرعية والنهي عن إدخال المشقة عليهم : رقم ١٨٢٩ – “খুব ভাল করে শোন! তোমদের সকলেই খবরদারীকারী। প্রত্যেককেই তার খবরদারী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। সুতরাং আমীর (খলিফা/রাষ্ট্রপ্রধান/শাসক) হল জনগণের উপর খবরদারীকারী এবং তাকে তার খবরদারী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। এমনিভাবে পুরুষ হল তার গৃহের লোকজন (তথা পরিবার)-এর উপর খবরদারীকারী এবং তাকে তার খবরদারী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। আর নারী হল তার স্বামী ও স্বামীর সন্তানদের উপর খবরদারীকারী এবং তাকে তার খবরদারী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে”। [সহিহ মুসলীম– ৩/৪৬০ হাদিস ১৮২৯; সহিহ বুখারী, হাদিস ৭১৩৮; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ২৯২৮; সুনানে তিরমিযী, হাদিস ১৭০৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস ৫১৬৭]

এই হাদিস একথার পরিষ্কার দলিল যে, আল্লাহ’র শরীয়তে পুরুষই তার গৃহের কর্তা, আর তার স্ত্রী সহ পরিবারের অপরাপর লোকজন তার অধিনস্ত, এবং সে দুনিয়ার জীবনে তাদেরকে আল্লাহ তাআলার হুকুম অনুসারে পরিচালনা করেছে কি না সে ব্যাপারে সে কিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসিত হবে। এ থেকে একথাও প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ’র শরীয়তে নারীকে তার স্বামীর গৃহের কর্তা হবার মতো দায়িত্বটুকু পর্যন্ত সোপর্দ করা হয়নি, বরং এক্ষেত্রে তার উপরে অর্পিত দায়িত্ব হল, স্বামীর হক্ব আদায় করা এবং স্বামীর সন্তানদের দেখভাল করা, পরিচর্যা করা, তাদের দ্বীন শিক্ষা দান ও সুচরিত্র গঠনে সাধ্য মতো অবদান রাখা, আর এই অর্পিত দায়িত্বটুকু সেঠিক মতো  আদায় করেছে কিনা – সে ব্যাপারেই সে কিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসিত হবে।

দেখুন, নারীকে যেখানে স্বামীর গৃহের ভিতরের কর্তা হওয়ার দায়িত্বটুকু পর্যন্ত শরীয়ত দেয় নি, সেখানে গৃহের বাহিরের পরপুরুষে ভরা সমাজ বা রাষ্ট্র পর্যায়ে হাকেম/কাজী (বিচারক) হওয়ার দায়িত শরীয়ত নারীকে কি করে দিতে পারে? 

(৪)  পর্দা সম্পর্কিত সম্ভাব্য সকল আয়াত ও হাদিসসমূহ একত্রিত করে পর্যালোচনা করে দেখলে যে বিষয়টি পরিষ্কার দৃষ্টিগোচর হয় -তা এই যে, নারীকে এমন লাবনীয় ও আকর্ষনীয় পাত্র হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে যে, ইসলাম তাকে শরীয়তের যে কোনো বিধান মানার ক্ষেত্রে পরপুরুষদের থেকে যথাসম্ভব নিরাপদ দূরত্বে থাকার ব্যাবস্থা করতে চেয়েছে এবং কোনো বাস্তব প্রয়োজন ছাড়া লোকজনের সাধারণ সমাবেশে তার আসাকেও কোনো অবস্থাতেই পছন্দ করা হয় নি। যেমন- 

আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-

يَا نِسَاءَ النَّبِيِّ لَسْتُنَّ كَأَحَدٍ مِّنَ النِّسَاءِ ۚ إِنِ اتَّقَيْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ وَقُلْنَ قَوْلًا مَّعْرُوفًا 
“‘হে নবীপত্নীগণ! (তোমরা নবীর স্ত্রীর মর্যাদা প্রাপ্ত -এটি যেমন নিয়ামত, তেমনি আমানতও বটে, কাজেই) তোমরা অন্যান্য (সাধারণ মুসলীম) নারীদের মতো নও। (তোমাদের এই মর্যাদা উপকারী হবে তখন) যদি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করে চলো। (তার জন্য শর্ত এটাই। নতুবা শুধুমাত্র নবীপত্নী হওয়াতে কোনো ফায়দা নেই। বরং অবাধ্যতা দ্বিগুণ শাস্তির কারণ হবে এবং অনুগত্য দ্বিগুণ পুরষ্কারের কারণ হবে)। সুতরাং (শরীয়তের হুকুমগুলোতে তোমাদেরকে অনুগত্য করে অবশ্যই চলতে হবে, তবে বিশেষ ভাবে এই হুকুমও তোমাদের দেয়া হল যে, প্রয়োজনের সম্মুখিন হলে পরপুরুষের  সাথে যখন কথাবার্তা বলবে, তখন) তোমরা কোমল কন্ঠে কথা বলবে না। এতে (কন্ঠের কোমলতায়) ওই ব্যাক্তি প্রলুব্ধ হবে যার অন্তরে রোগ রয়েছে। আর (কন্ঠের পর্দা রক্ষা করে এমনভাবে) কথা বলবে, যা হবে (হালাল, প্রয়োজন পরিমান এবং অতিরঞ্জিততা থেকে মুক্ত) যথার্থ কথা”।[সূরা আহযাব ৩২]

وَإِذَا سَأَلْتُمُوهُنَّ مَتَاعًا فَاسْأَلُوهُنَّ مِن وَرَاءِ حِجَابٍ ۚ ذَٰلِكُمْ أَطْهَرُ لِقُلُوبِكُمْ وَقُلُوبِهِنَّ
‘আর (হে মুমিনগণ) তোমরা যখন তাদের (তথা নবীপত্নীগণের) কাছে কিছু চাবে, তখন (তাঁরা তোমাদের দৃষ্টির অন্তরালে হিজাব বা পর্দার ভিতরে অবস্থান করবে, আর তোমরা) তাঁদের কাছে চাবে হিজাবের (বা পর্দার) আড়াল থেকে। (তোমাদের) এ(কাজ)টি তোমাদের মন ও তাঁদের মনকে উত্তমভাবে পাকপবিত্র রাখার কারণ হবে”।[সূরা আহযাব ৫৩]

وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَىٰ ۖ  وَ أَقِمْنَ الصَّلَاةَ وَآتِينَ الزَّكَاةَ وَأَطِعْنَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ ۚ إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا
“(আর হে নবী পরিবারের নারীরা!) তোমরা তোমাদেরকে (নিজদের) গৃহের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখো (নিজকে এতে অভ্যস্থ করে নাও), আর (জরুরী প্রয়োজনে গৃহের বাহিরে যেতে হলে) জাহেলী যুগের সাজসজ্জায় সজ্জিত হয়ে বাহিরে বেড়িও না (বরং মরয়ী পর্দা পালন করে বের হও)। আর তোমরা নামায কায়েম করো, (নিসাবের মালিক হলে) যাকাত আদায় করো এবং (বিনা বাক্যে) আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের অনুগত্য করো। আসলে (তোমাদের প্রভু) আল্লাহ চান, যেন তোমাদের থেকে মন্দ-মলিনতা দূর হয়ে যায় এবং তোমরা পবিত্রের মতো পবিত্রহয়ে যাও -(হে) নবী পরিবারের লোকজন”।[সূরা আহযাব ৩৩]
 
আল্লাহ তাআলা আসলে ‘মুসলীম নারী’দেরকে সমাজে কিরকম জীবনযাপনে অভ্যস্থ দেখতে চান -তার কিছু ঝলক এইসকল আয়াতে কারিমার মধ্যে তুলে ধরা হয়েছে -নবী পরিবারের নারীগণকে নির্দেশ দিয়ে প্রকারন্তে সকল মুসলীম নারীদেরকে নির্দেশ মাধ্যমে। যেমন, ইমাম কুরতুবী (মৃ: ৭৪৫ হি:) রহ. লিখেছেন- معنى هذه الآية الامر بلزوم البيت، وإن كان الخطاب لنساء النبي صلى الله عليه وسلم فقد دخل غيرهن فيه بالمعنى  “এই আয়াতের অর্থ হল, গৃহে থাকাকে অপরিহার্য করে নেয়া। আর এখানে বক্তব্যের মুখ্যপাত্র যদিও নবী-এর স্ত্রীগণ কিন্তু তাঁরা ছাড়াও অপরাপর নারীগণও এ(ই আয়াতে)র অর্থ ও মর্মের মধ্যে শামিল রয়েছে। [আল-জামে লি আহকামিল কুরআন, ইমাম কুরতুবী- ১৪/১৭৯]
 
এই আয়াতে قَرْنَ – “আবদ্ধ হয়ে থাকো”কথাটি অতিব তাৎপর্যপূর্ণ। হিজাজী আরবী ভাষায় এই قَرْنَ শব্দের মূল হল أَقَرُّ যার অর্থ হল ثَبَّتَ – “ভিত্তি গেড়ে নেয়া বা সুদৃঢ় করে নেয়া”। আবার মাদানী আরবী ভাষাতে যেমন বলা হয়ে থাকে- قَرِرْتُ فِي الْمَكَانِ إِذَا أَقَمْتُ فِيهِ – “আমি ঘরের মধ্যে (একবার) পা রাখলে, (সেখান থেকে বেরুবার আর নাম নিই না) সেখানে থাকতে থাকি”। এখানেقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ “(আর হে নবী পরিবারের নারীরা!) তোমরা তোমাদেরকে (নিজদের) গৃহের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখো (নিজকে এতে অভ্যস্থ করে নাও)”-এর অর্থ হবে – সর্বদা বাড়ির চার-দেয়ালের সীমানায় নিজকে আবদ্ধ করে রাখার উপর যত্ন সহকারে অভ্যস্থ হওয়া। শুধুমাত্র শরীয়ত যেসকল প্রয়োজনে মুসলীম নারীকে গৃহের বাহিরে বের হওয়ার সাধারণ অনুমতি দিয়েছে, সেসকল শরয়ী প্রয়োজন পুরণার্থে গৃহ থেকে বের হওয়ার মধ্যেই নিজকে যথাসম্ভব সীমাবদ্ধ রাখা; অ-প্রয়োজনে গৃহের বাহিরে বের হওয়ার চর্চা না করা”। এর উদাহরণ হতে পারে- যেমন: (গৃহের অভ্যন্তরে ব্যবস্থা না থাকলে)  পেশাব পায়খানার জন্য প্রয়োজনে গৃহের বাইরে বের হওয়া, মাহরাম ও পর্দার শরয়ী শর্ত পূরণ করে হজ্জ, ওমরা, জিহাদ বা সাধারণ কোনো সফরে বের হওয়া, পর্দার শর্ত পূরণ করে মসজিদে নামাযের জামাআতে শরিক হওয়া ইত্যাদি। এদিকে ইংগীত করেই ইমাম ইবনে কাসির (মৃ: ৭৭৪ হি:) রহ. এ আয়াতের তাফসীরে বলেছেন-  أي : الزمن بيوتكن فلا تخرجن لغير حاجة ومن الحوائج الشرعية الصلاة في المسجد بشرطه “এর অর্থ, তোমরা তোমাদের গৃহে অবস্থানকে অপরিহার্য করে নাও, কোনো হাজত (উপযুক্ত প্রয়োজন) ছাড়া (গৃহ থেকে) বের হয়ো না। আর (নারীদের) শরয়ী প্রয়োজন সমূহের মধ্যে -মসজিদের শর্ত রক্ষা করে সালাত আদায়ও- অন্তর্ভূক্ত রয়েছে”।[তাফসীরে ইবনে কাসির- ১/৮৬৭]
 
‘নারীদেরকে তাদের গৃহের অভ্যন্তরে থাকতে অভ্যস্ত হওয়া’র ব্যাপারে এ নির্দেশ দানের পিছনে যে হেকমত লুকায়ীত রয়েছে, তা এই হাদিসে খুব সুন্দর করে ব্যাক্ত করা হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, নবীয়ে করিম এরশাদ করেনالْمَرْأَةُ عَوْرَةٌ ، فَإِذَا خَرَجَتِ اسْتَشْرَفَهَا الشَّيْطَانُ ، وَ أَقْرَبُ مَا تَكُونُ مِنْ رَبِّهَا إِذَا هِيَ فِي قَعْرِ بَيْتِهَا . رواه ابن حبان في الصحيح ( بترتيب ابن بلبان) , كتاب الحظر والإباحة , ذكر الأمر للمرأة بلزوم قعر بيتها لأن ذلك خير لها عند الله جل و علا : ١٢/٤١٣ رقم ٥٥٩٩ و قال شعيب الأرنؤوط : اسناده صحيح علي شرط مسلم ، و ابن خزيمة في الصحيح : ٣/٩٣ رقم ١٦٨٥ و في التوحيد : ١/٤٠ و أشار في المقدمة أنه صح، و الطبراني في المعجم الكبير: ١٠/١٠٨ رقم ١٠١١٥ و في المعجم الأوسط: ٨/١٠١ رقم ٨٠٩٦، و صححه الألباني في السلسة الصحيحة : رقم ٢٦٨٨ و في صحيح الترغيب : رقم ٣٤٤ – “নারী হল আউরাহ (গোপনীয় থাকার পাত্র)। তাই, সে যখন বাহিরে বেড় হয়, তখন (পুরুষদের পদস্খলন ঘটানোর জন্য) শয়তান তার পশ্চাদানুসরণে লেগে যায়। আর নারী তার রবের (সন্তষ্টির) অধিক নিকটবর্তী হয় তখন, যখন সে তার গৃহের অন্দরমহলে থাকে”[সহিহ ইবনে হিব্বান- ১২/৪১৩ হাদিস ৫৫৯৯; সহিহ ইবনে খুযাইমা-৩/৯৩ হাদিস ১৬৮৫; আল-মু’জামুল কাবীর, ইমাম ত্বাবরাণী- ১০/১০৮ হাদিস১০১১৫]
 
এরপর মুসলীম নারীদেরকে শরয়ী প্রয়োজনে গৃহের বাইরে যেতে হলে তাদেরকে না-মাহরাম (পরপুরুষ)-এর সামনে দেহ ও অলঙ্কারের জিনাত (রূপ-সৌন্দর্য ও চাকচিক্ক) প্রদর্শন করে বেপর্দায় বের হতে নিষেধ করা হয়েছে। বলা হয়েছে- وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَىٰ – “…আর (জরুরী প্রয়োজনে গৃহের বাহিরে যেতে হলে) জাহেলী যুগের সাজসজ্জায় সজ্জিত হয়ে বাহিরে বেড়িও না, (বরং শরয়ী পর্দা পালন করে বের হও)”। শরয়ী পর্দা বিধান মেনে যেন বাহিরে গমন করে। বলা বাহুল্য, শরয়ী পর্দা বিধান আর আজকালকার তথাকথিত ফ্যশানমার্কা পর্দার মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য রয়েছে।

অথচ দ্বীন ইসলামের বহু গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের বৈশিষ্ট’টাই এমন যে, ওগুলোকে গৃহ থেকে বেড় হয়ে বাহিরে সম্পাদন করতে হয়, বরং বাহিরে সম্পাদন না করলে ওগুলোর ফরযিয়াত বা ওয়াজিবাত শরীতসম্মতভাবে আদায় করাটাই অসম্ভব। শরীয়ত ওসব ইবাদতকে পালন করার দায়িত্বটা মূলত পুরুষদের স্কন্ধে অর্পণ করেছে, অপরদিকে নারীদেরকে তা থেকে যথাসম্ভব দূরে রাখতে চেয়েছে। নিম্নে কিছু নমুনা পেশ করা হল-

(ক) জুমআ’র নামাযের জামাআতে নারীদের শরিক হওয়া

জুমআর নামায কত ফজীলতপূর্ণ একটি ইবাদত। কিন্তু শরীয়ত এই ইবাদতটি সম্পাদন করার দায়িত্বটা মূলত মুসলীম পুরুষদের স্কন্ধে অর্পণ করেছে, অপরদিকে নারীদেরকে তা থেকে দূরে রেখেছে। যেমন, এক হাদিসে এসেছে যে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেনالْجُمُعَةُ حَقٌّ وَاجِبٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ فِي جَمَاعَةٍ إِلاَّ أَرْبَعَةً عَبْدٌ مَمْلُوكٌ أَوِ امْرَأَةٌ أَوْ صَبِيٌّ أَوْ مَرِيضٌ . رواه أبو داود في سننه , كتاب الصلاة، باب الجمعة للمملوك والمرأة : رقم ١٠٦٧، قال محيى الدين النووي في المجموع : ٤/٤٨٣ : رواه أبو داود باسناد صحيح على شرط البخاري ومسلم إلا أن أبا داود قال طارق بن شهاب رأى النبي صلى الله عليه وسلم ولم يسمع منه شيئا وهذا الذي قاله أبو داود لا يقدح في صحة الحديث لأنه ان ثبت عدم سماعه يكون مرسل صحابي ومرسل الصحابي حجة عند أصحابنا وجميع العلماء الا أبو إسحاق الأسفرايني، و صححه الألباني في صحيح أبي داود: ١/ ٢٩٤، و رواه الحاكم عن طارق بن شهاب عن أبي موسى الأشعري رضي الله عنهما، ١/ ٢٨٨، وقال: هذا حديث صحيح على شرط الشيخين و وافقه الذهبي -“জুমআ(’র নামায) জামাআতে(র সাথে) আদায় করা প্রত্যেক মুসলমানের উপরে ওয়াজিব হক্ব, শুধু চার ব্যাক্তি ব্যতীত- (১) মালিকানাধীন গোলাম, (২) নারী, (৩) শিশু, (৪) রোগী”। [সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১০৬৭; মুসতাদরাকে হাকিম- ১/২৮৮]

(খ) নামাযের জামাতে শরীক হওয়া

সহিহ সূত্রে বর্ণিত আছে যে,রাসুলুল্লাহ তাঁর জামানায় নারীদেরকে এমনকি রাত্রি বেলাতেও মসজীদে নববীতে এসে জামাতে নামায পড়ার অনুমতি দিতেন; নিষেধ করতেন না। 

তবে কুরআনের আয়াত ও রাসুলুল্লাহ -এর হাদিসসমূহ সামনে রাখলে দেখা যায়, নববী যুগে মুসলীম নারীদের মসজিদে গমনের এই অনুমতিটিও ছিল অত্যন্ত শক্ত শর্ত সাপেক্ষে। মোটামুটি যে  শর্তগুলো পালন করে মসজিদে যাওয়ার অনুমতি থাকে, সেগুলো হল- (ক) নারীরা পরিপূর্ণ পর্দাসহ গোটা শরীর আবৃত অবস্থায় গৃহ থেকে বের হবে। (খ) ঝুনঝুন আওয়াজকারী অলঙ্কারাদি পরে বের হতে পারবে না। (গ) সাজগোজ করে ও সুগন্ধি মেখে বের হতে পারবে না। (ঘ) পুরুষদের সামন দিয়ে চোর সময় আকর্ষনীয় অঙ্গভঙ্গি করে (ঢং করে) চলতে পারবে না। (ঙ) পুরুষদের ভিড় এড়িয়ে রাস্তার একেবারে একপাশের কিনারা দিয়ে চলালচ করবে। (চ) অপ্রয়োজনে পরপুরুষের সঙ্গে কথা বলতে পারবে না, প্রয়োজনে বলতে হলেও আকর্ষনীয় ও কোমল বাচনভঙ্গি পরিহার করে কথা বলবে। (ছ) সবচেয়ে বড় বিষয় হল, তাদের গৃহ থেকে এ বের হওয়াটা ফিতনার কারণ হতে পারবে না। [বাযলুল মাজহূদ শারহু আবি দাউদ, খলিল আহমদ- ৪/১৬১]

আমরা নির্ভরযোগ্য হাদিসসমূহ থেকে জানতে পারি যে, রাসুলুল্লাহ নারীদেরকে মসজিদে এসে নামায পড়ার অনুমতি দিতেন সত্য, তবে আসলে চাইতেন নারীরা মসজিদে না এসে তাদের নিজ নিজ গৃহেই নামায আদায় করুক। কারণ, একে-তো নারীদের জন্য জামাআতে নামায আদায় করা ওয়াজিব নয়, দ্বিতীয়ত এতে করে নারী-পুরুষ উভয়েই আরো উত্তমভাবে ফিতনা থেকে নিরাপদ দূরুত্বে অবস্থান করতে পারবে। যেমন, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. -এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেন- لاَ تَمْنَعُوا نِسَاءَكُمُ الْمَسَاجِدَ وَبُيُوتُهُنَّ خَيْرٌ لَهُنَّ . رواه أبو داود في سننه , كتاب الصلاة , باب ما جاء في خروج النساء إلى المسجد : رقم ٥٦٧ و صحَّحه الألباني في صحيح سنن أبي داود ، و أحمد في مسنده : ٢/٧٦ رقم ٥٤٦٨ و صحَّح إسناده أحمدُ شاكر في تحقيق المسند: ٧/٢٣٤، و ابن خزيمة : رقم ١٦٨٤، صحَّحه النوويُّ في المجموع: ٤/١٩٧ – “তোমরা তোমাদের (পরিবারের) নারীদেরকে মসজিদে যেতে বাঁধা দিও না। তবে তাদের গৃহই তাদের জন্যে কল্যানজনক”। [সুনানে আবু দাউদ- ১/৪২৬ হাদিস ৫৬৭; মুসনাদে আহমদ- ২/৭৬ হাদিস ৫৪৬৮; সহিহ ইবনে খুযাইমাহ, হাদিস ১৬৮৪; মুসতাদরাকে হাকিম- ১/২০৯] 

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেন-صَلاَةُ الْمَرْأَةِ فِي بَيْتِهَا أَفْضَلُ مِنْ صَلاَتِهَا فِي حُجْرَتِهَا وَصَلاَتُهَا فِي مَخْدَعِهَا أَفْضَلُ مِنْ صَلاَتِهَا فِي بَيْتِهَا . رواه أبو داود في سننه , كتاب الصلاة , باب التشديد في ذلك : رقم ٥٧٠ و قال شعَيب الأرنؤوط: إسناده حسن من أجل عمرو بن عاصم و هو أبو عثمان البصري و باقي رجاله ثقات ، و صحَّحه الألباني في صحيح الترغيب والترهيب : ١/١٣٦ “নারীর (জন্য) তার (বাড়ির) ঘরের ভিতরে আদায়কৃত নামায -তার হুজরায় আদায়কৃত তার নামায হতে অধিক উত্তম। আর তার ঘরের অন্দরমহলে আদায়কৃত তার নামায -তার (বাড়ির) ঘরে আদায়কৃত তার নামায হতে অধিক উত্তম”।[সুনানে আবু দাউদ- ১/৪২৬ হাদিস ৫৭০; আল-মু’জামুল কাবীর, ইমাম ত্বাবরাণী- ৯/৩৪১ হাদিস ৯৪৮২; সহিহ ইবনে খুযাইমাহ, হাদিস; ১৬৮৮; সুনানে তিরমিযী, হাদিস ১১৭৩; মুসতাদরাকে হাকিম- ১/২০৯; সুনানুল কুবরা, ইমাম বাইহাকী- ৩/১৩১]

আব্দুল্লাহ বিন সুওয়াইদ আল-আনসারী রহ. বর্ণনা করেছেন আবু হুমাইদ আস-সায়েদী’র স্ত্রী উম্মে হুমাইদ-এর সূত্রে এভাবে যে-  أَنَّهَا جَاءَتِ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَتْ : يَا رَسُولَ اللَّهِ ، إِنِّي أُحِبُّ الصَّلَاةَ مَعَكَ ، قَالَ : قَدْ عَلِمْتُ أَنَّكِ تُحِبِّينَ الصَّلَاةَ مَعِي ، وَ صَلَاتُكِ فِي بَيْتِكِ خَيْرٌ لَكِ مِنْ صَلَاتِكِ فِي حُجْرَتِكِ ، وَ صَلَاتُكِ فِي حُجْرَتِكِ خَيْرٌ مِنْ صَلَاتِكِ فِي دَارِكِ ، وَصَلَاتُكِ فِي دَارِكِ خَيْرٌ لَكِ مِنْ صَلَاتِكِ فِي مَسْجِدِ قَوْمِكِ ، وَصَلَاتُكِ فِي مَسْجِدِ قَوْمِكِ خَيْرٌ لَكِ مِنْ صَلَاتِكِ فِي مَسْجِدِي ، قَالَ : فَأَمَرَتْ فَبُنِيَ لَهَا مَسْجِدٌ فِي أَقْصَى شَيْءٍ مِنْ بَيْتِهَا وَأَظْلَمِهِ ، فَكَانَتْ تُصَلِّي فِيهِ حَتَّى لَقِيَتِ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ . رواه أحمد في مسنده , باقي مسند الأنصار , حديث أم حميد رضي الله عنها : ٦/٣٧١ رقم ٢٦٥٥٠ قال المحقق: شعيب الأرنؤوط: حديث حسن ، ابن خزيمة في صحيحه , باب اختيار صلاة المرأة في حجرتها على صلاتها في دارها و صلاتها في مسجد : ٣/٩٥ و صححه، و ابن حبان في صحيحه : ٥ / ٥٩٥، و ابن عبد البر في التمهيد : ٢٣/٣٩٨، و الحديث صححه أحمد شاكر في تعليقه على المحلى، صححه الألباني في صحيح الترغيب والترهيب : ١ / ١٣٥،  – “উম্মে হুমায়েদ রা. একবার নবী -এর কাছে এসে বললেন: ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি আপনার সাথে নামায পড়াকে ভালবাসি’। নবী বললেন: আমি জানি তুমি আমার সাথে নামায পড়তে ভালবাসো। তবে তোমার (বাড়ির একেবারে) ঘরের ভিতরে আদায়কৃত নামায তোমার জন্য তোমার (ঘরের বাহির দিকে অবস্থিত) হুজরা (কুঠরী)তে পড়া নামায হতে অধিক উত্তম। আবার তোমার হুজরা (কুঠরী)তে আদায়কৃত তোমার নামায তোমার (বাড়ির) দরজায় পড়া তোমার নামায হতে অধিক উত্তম। তোমার (বাড়ির) আদায়কৃত তোমার নামায তোমার জন্য তোমার লোকালয়ের মসজিদে পড়া তোমার নামায হতে অধিক উত্তম। আর তোমার লোকালয়ের মসজিদে আদায়কৃত তোমার নামায আমার মসজিদে আদায়কৃত তোমার নামায হতে অধিক উত্তম’। (রাবী) বলেন: (রাসুলুল্লাহ -এর এই কথা শোনার পর উম্মে হুমায়েদ রা.) আদেশ দেন, ফলে তার ঘরের মধ্যে সবচাইতে অন্ধকারময় কোনো স্থানে তার জন্য নামাযের জায়গা বানিয়ে দেয়া হয়। পরে আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লা’র সাথে (পরপারে) সাক্ষাত লাভ পর্যন্ত তিনি সেখানেই (নিয়মিত) নামায পড়তে থাকেন”। [মুসনাদে আহমাদ– ৬/৩৭১ হাদিস ২৬৫৫০; সহিহ ইবনে খুযাইমা-৩/৯৫; সহিহ ইবনে হিব্বান- ৫/৫৯৫; আত-তামহিদ, ইবনু আব্দিল বার- ২৩/৩৯৮; সহিহ তারগীব ওয়া তারহীব- ১/১৩৫]

শুধু তাই নয়, রাসুলুল্লাহ -এর পবিত্র জামানায় নারী সাহাবীরা যতটা শালীন ও মার্জিত ভাবে শরয়ী পর্দার যথাসম্ভব হক্ব আদায় করে মসজিদে নববীতে উপস্থিত হতেন এবং পুরুষ সাহাবীদের শেষ কাতারের পিছনের কাতারে জামাআতে নামায আদায় করে চলে যেতেন এবং পরে পুরুষ সাহাবীরা পিছন ফিরতেন, পরে রাসুলুল্লাহ -এর ওফাতের পর উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রা. যখন লক্ষ্য করলেন যে, নবীযুগের সেই শালীন ও মার্জিত পর্দার মধ্যে নারীদের মধ্যে খলৎমলৎ শুরু হয়ে গেছে, তখন তিনি একবার বলেছিলেনلَوْ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَأَى مَا أَحْدَثَ النِّسَاءُ لَمَنَعَهُنَّ الْمَسْجِدَ كَمَا مُنِعَتْ نِسَاءُ بَنِي إِسْرَائِيلَ . رواه مسلم في صحيحه , كتاب الصلاة , باب خروج النساء إلى المساجد إذا لم يترتب عليه فتنة ، : رقم ٤٤٥  – “(এখনকার) নারীরা (শরয়ী পর্দার সাথে) কি (জুলুম) শুরু করেছে সেটা যদি (আজ) রাসুলুল্লাহ দেখতে পেতেন, তাহলে তিঁনি অবশ্যই তাদেরকে মসজিদে যাওয়া নিষেধ করে দিতেন, যেমনিভাবে (পর্দা ব্যবস্থায় খলৎমলৎ করে ফেলার কারণে) বনী-ইসরাঈলদের নারীদেরকে (মসজিদে যাওয়াকে) নিষেধ করে দেয়া হয়েছিল”। [সহিহ মুসলীম– ১/৮২৮ হাদিস ৪৪৫; সহিহ বুখারী, হাদিস ৮৩১; সুনানে আবু দাউদ- ১/৪২৬ হাদিস ৫৬৯

এই বিষয়টি শুধু হযরত আয়েশা রা.-এর নজরে পড়েছিল -শুধু তাই নয়, অনেক সাহাবীও অবস্থার নাজুকতা অনুধাবন করেছিলেন।  আবু আমর শাইবানি বলেন, আমি হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রা.কে দেখেছি, তিনি জুমার দিন মহিলাদেরকে মসজিদ থেকে বের করে দিতেন এবং বলতেন, আপনারা বের হয়ে যান। আপনাদের ঘরই আপনাদের জন্য উত্তম। [আল-মুজামুল কাবির ৯৪৭৫; এই রেওয়ায়েতের সকল বর্ণনাকারী সিকাহ-নির্ভরযোগ্য। মজমাউয যাওয়াইদ, হাইছামী- ২/৩৫] হযরত জুবাইর ইবন আওয়াম রা. তাঁর পরিবারের কোন নারিকে ঈদের জামাতে যেতে দিতেন না। [মুসান্নাফ ইবন আবি শাইবাহ, হাদিস ৫৮৪৬]

(গ) পুরুষদের সহযাত্রী হয়ে জানাযা’র সাথে নারীদের গমন

সাধারণ অবস্থায় এটা প্রত্যেক মুসলমানের হক্ব যে, তার মৃত্যু হলে অপরাপর মুসলমানগণ তার জানাযার সাথে কবরস্থান পর্যন্ত গমন করবে এবং তার দাফন কার্য সম্পাদন করবে। যেমন- আবু হুরায়রাহ রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেনحَقُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ سِتٌّ، قِيلَ: مَا هُنَّ يَا رَسُولَ اللهِ؟ قَالَ: إِذَا لَقِيتَهُ فَسَلِّمْ عَلَيْهِ، وَإِذَا دَعَاكَ فَأَجِبْهُ، وَإِذَا اسْتَنْصَحَكَ فَانْصَحْ لَهُ، وَإِذَا عَطَسَ فَحَمِدَ اللَّهَ فَشَمِّتْهُ، وَإِذَا مَرِضَ فَعُدْهُ، وَإِذَا مَاتَ فَاتَّبِعْهُ . أخرجه البخاري في صحيحه برقم : ١٢٤٠، و مسلم في صحيحه برقم : ٢١٦٢ – “(এক) মুসলীমের উপরে (অপর) মুসলীমের হক্ব (অধিকার) ছয়টি’। জিজ্ঞেস করা হল: ‘ওগুলো কী কী -ইয়া রাসুলাল্লাহ’! তিঁনি বললেন: ‘(১) তুমি যখন তার সাক্ষাত পাবে তাকে সালাম দিবে, (২) সে যখন তোমাকে দাওয়াত দিবে তুমি তা কবুল করবে, (৩) যখন সে তোমার কাছে উপদেশ চাবে তুমি তাকে সদুপদেশ দিবে, (৪) যখন সে হাঁচি দিয়ে আল-হামদুল্লিাহ বলবে তখন তুমিও (ইয়ারহ্বামুকাল্লাহ বলে) তার জবাব দিবে, (৫) সে যখন অসুস্থ্য হবে তুমি তাকে দেখতে যাবে, (৬) সে যখন মাড়া যাবে, তখন তুমি তার (জানাযার) সাথে যাবে”। [সহিহ বুখারী, হাদিস ১২৪০; সহিহ মুসলীম, হাদিস ২১৬২]

আবার, কোনো মুসলমানের জানাযার নামায আদায় করা এবং জানাযার সাথে গিয়ে মাইয়্যেতকে কবরস্থ করার এই আমলের বিরাট সওয়াব রাখা হয়েছে মুসলমানদের জন্য। যেমন, আবু হুরায়রাহ রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেনمَنْ خَرَجَ مَعَ جَنَازَةٍ مِنْ بَيْتِهَا ، وَصَلَّى عَلَيْهَا ، ثُمَّ تَبِعَهَا حَتَّى تُدْفَنَ كَانَ لَهُ قِيرَاطَانِ مِنْ أَجْرٍ ، كُلُّ قِيرَاطٍ مِثْلُ أُحُدٍ ، وَمَنْ صَلَّى عَلَيْهَا ، ثُمَّ رَجَعَ ، كَانَ لَهُ مِنَ الْأَجْرِ مِثْلُ أُحُدٍ . أخرجه مسلم في صحيحه , كتاب الجنائز . باب فضل الصلاة على الجنازة واتباعها : ٢/٦٥٣ رقم ٩٤٥- “(মৃতের) জানাযার সাথে তার ঘর থেকে যে ব্যাক্তি বের হয় এবং জানাযার নামায আদায় করে, এরপর কবরস্থ করা না পর্যন্ত জানাযার সাথে সাথে চলে, তার জন্য রয়েছে দু’ক্বিরাত্ব পুরষ্কার। প্রত্যেক ক্বিরাত্ব উহূদ (পাহাড়)-এর অনুরূপ। আর যে ব্যাক্তি জানাযার নামায আদায় করলো, তারপর (জানাযার সাথে না গিয়ে) ফিরে এলো, তার রয়েছে উহূদ (পাহাড়)-এর অনুরূপপুরষ্কার”। [সহিহ মুসলীম- ২/৬৫৩ হাদিস ৯৪৫]

কিন্তু শরীয়ত মূলত: মুসলমানের জানাযার নামায আদায় থেকে নিয়ে জানাযার খাটলী বহন ও তাকে কবরস্থ করার এই ইবাদতটি সম্পাদন করার দায়িত্বটি মুসলীম পুরুষদের স্কন্ধে অর্পণ করেছে। অপরদিকে মুসলীম নারীদেরকে জানাযার সাথে গমন করতে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন-

আবু সাঈদ খুদরী রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেনإِذَا وُضِعَتِ الْجِنَازَةُ وَاحْتَمَلَهَا الرِّجَالُ عَلَى أَعْنَاقِهِمْ، فَإِنْ كَانَتْ صَالِحَةً قَالَتْ قَدِّمُونِي‏.‏ وَإِنْ كَانَتْ غَيْرَ صَالِحَةٍ قَالَتْ يَا وَيْلَهَا أَيْنَ يَذْهَبُونَ بِهَا يَسْمَعُ صَوْتَهَا كُلُّ شَىْءٍ إِلاَّ الإِنْسَانَ، وَلَوْ سَمِعَهُ صَعِقَ . أخرجه البخاري في صحيحه , كتاب الجنائز , باب حمل الرجال الجنازة دون النساء : رقم ١٣١٤ – “যখন (কোনো মুসলমানের) জানাযা তৈরী হয়ে যায় এবং পুরুষরা সেটাকে তাদের স্কন্ধে বহন করে, তখন যদি সে নেককার হয় তাহলে বলে: ‘আমাকে (তাড়াতাড়ি কবরের দিকে) অগ্রসর করো, আর সে যদি নেককার না হয় তাহলে বলে: ‘হায় ওর দুর্ভোগ! ওকে তোমরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছো’। (তখন) ওর (ওই) আওয়াজকে মানুষ ছাড়া সকল কিছুই শুনতে পায়। মানুষ যদি (তার ওই আওয়াজ) শুনতে পেতো তাহলে অজ্ঞান হয়ে যেতো”। [সহিহ বুখারী- ২/৮৫ হাদিস ১৩১৪] ইমাম বুখারী রহ. এই হাদিসটি বর্ণনা করার ক্ষেত্রে ‘অধ্যায়’-এর শিরনাম দিয়েছেন এভাবে- باب حمل الرجال الجنازة دون النساء – (অধ্যায়: জানাযা বহল করবে পুরষরা; নারীরা নয়)”।

মুআবিয়া বিন সুওয়াইদ বিন মুক্বাররিন রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, বারা বিন আযীব রা. বলেন أَمَرَنَا رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم بِسَبْعٍ وَنَهَانَا عَنْ سَبْعٍ: أَمَرَنَا بِاتِّبَاعِ الْجَنَائِزِ…... أخرجه البخاري في صحيحه , كتاب الجنائز , باب الأمر باتباع الجنائز: ٢/٧١ رقم ١٢٣٩ – “রাসুলুল্লাহ ﷺ আমাদের (পুরুষদের)কে সাতটি বিষয়ের নির্দেশ দিয়েছেন এবং সাতটি বিষয় থেকে নিষেধ করেছেন। তিঁনি আমাদেরকে (মুসলমানদের) জানাযার সাথে যেতে নির্দেশ দিয়েছেন……..”। [সহিহ বুখারী- ২/৭১ হাদিস ১২৩৯; সহিহ মুসলীম, হাদিস ২০৬৬]

মুহাম্মাদ বিন সিরীন রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, উম্মে আতীয়া রা. বলেনكُنَّا نُنْهَى عَنِ اتِّبَاعِ الجَنَائِزِ، وَلَمْ يُعْزَمْ عَلَيْنَا . أخرجه مسلم في صحيحه , كتاب الجنائز, باب نهي النساء عن اتباع الجنائز : رقم ٩٣٨، و البخاري في صحيحه : رقم ١٢٧٨ – “(রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর জামানায়) আমাদের (মুসলীম নারীদের)কে জানাযার সাথে যেতে নিষেধ করা হত। বস্তুত: (জানাযার সাথে যাওয়াকে) আমাদের উপরে অপরিহার্য করে দেয়া হয়নি”। [সহিহ মুসলীম- ২/৬৪৬ হাদিস ৯৩৮; সহীহ বুখারী, হাদিস ১২৭৮]

আবু আব্দুর রহমান আল-হুবুলী রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল আস রা. বলেনقَبَرْنَا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمًا ، فَلَمَّا فَرَغْنَا ، انْصَرَفَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، وَانْصَرَفْنَا مَعَهُ ، فَلَمَّا حَاذَى بَابَهُ ، وَتَوَسَّطَ الطَّرِيقَ ، إِذَا نَحْنُ بِامْرَأَةٍ مُقْبِلَةٍ ، فَلَمَّا دَنَتْ إِذَا هِيَ فَاطِمَةُ ، فَقَالَ لَهَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : مَا أَخْرَجَكِ يَا فَاطِمَةُ مِنْ بَيْتِكِ ؟ قَالَتْ : أَتَيْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَهْلَ هَذَا الْبَيْتِ ، فَعَزَّيْنَا مَيِّتَهُمْ ، فَقَالَ لَهَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : لَعَلَّكِ بَلَغْتِ مَعَهُمُ الْكُدَى ؟ قَالَتْ : مُعَاذَ اللَّهِ ، وَقَدْ سَمِعْتُكَ تَذْكُرُ فِيهَا مَا تَذْكُرُ قَالَ : لَوْ بَلَغْتِ مَعَهُمُ الْكُدَى مَا رَأَيْتِ الْجَنَّةَ حَتَّى يَرَاهَا جَدُّكَ أَبُو أَبِيكِ . رواه ابن حبان في صحيحه , كتاب الجنائز وما يتعلق بها مقدما أو مؤخرا , فصل في زيارة القبور: ٧/٤٥٠ رقم ٣١٧٧، و الحاكم في المستدرك على الصحيحين , كتاب الجنائز, كتاب الجنائز: ١/٧٠٦ رقم ١٤٢٢ و ١٤٢٣ و قال : هذا حديث صحيح على شرط الشيخين ، ولم يخرجاه , و وافقه الذهبي ، و حسنه ظفر احمد في إعلاء السنن: ٨/٣٣٤   – “আমরা একদিন রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর সাথে (এক ব্যাক্তিকে) কবরস্থ করলাম। তারপর আমরা যখন (দাফন সম্পন্ন করে) অবসর হলাম, তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ (সেখান থেকে) এক দিকে ফিরে চলে যেতে থাকলে আমরাও তার সাথে সেদিকে চলতে থাকলাম। যখন তিঁনি তাঁর গৃহের সম্মুখ পানে (যেতে যেতে) রাস্তার মাোমাঝি (কোথাও) ছিলেন, তখন আমাদের ঠিক বিপরীত দিকে এক নারীর সাথে (আমাদের সাক্ষাত ঘটলো)। যখন সে কাছে এলো তখন (জানতে পারলাম যে) তিনি হলেন (রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কন্যা) ফাতেমাহ। তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ তাকে জিজ্ঞেস করলেন: ‘হে ফাতেমা! (তোমার তো এসময় ঘর থেকে বের হবার কথা নয়), কী (এমন ঘটেছে যা) তোমাকে (এই সময়) তোমার ঘর থেকে বের করে এনেছে’? তিনি বললেন: ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি এই মৃতের পরিবারের কাছে এসেছিলাম। আমি (সেখানে গিয়ে) তাদের সাথে (সমবেদনা প্রকাশার্থে তাদের মৃতের জন্য) আফসোস প্রকাশ করেছি’। তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ তাকে বললেন: ‘(তাহলে) তুমিও মনে হয় তাদের সাথে (জানাযার পিছু পিছু) কবরস্থানে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলে’? তিনি বললেন: ‘আল্লাহ’র পানাহ! আপনি এসম্পর্কে যা আলোচনা করেছিলেন সে আলোচনাটা আমি শুনেছিলাম, (তার পরও আমি কোন সাহসে জানাযার সাথে পুরুষদের পিছে পিছে কবরস্থানে যেতে পারি!)’। (তখন) রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন: ‘তুমি যদি তাদের সাথে কবরস্থানে গিয়ে উপস্থিত হতে, তাহলে তুমি (ততক্ষন পর্যন্ত) জান্নাত দেখতে পেতে না, যতক্ষন পর্যন্ত না তুমি (দোযখের মধ্যে ঢুকে) তোমার দাদা (মানে) তোমার পিতার বাবা (আব্দুল মুত্তালেব)কে না দেখতে”। [সহিহ ইবনে হিব্বান- ৭/৪৫০ হাদিস ৩১৭৭; মুসতাদরাকে হাকিম– ১/৭০৬ হাদিস ১৪২২, ১৪২৩; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৩১২৩; সুনানুল কুবরা, ইমাম বাইহাকী- ৪/৬০]

অন্য রেওয়ায়েতে রাসুলুল্লাহ ﷺ থেকে এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে-  ليس على النساء غزو ولا جمعة ولا تشييع جنازة . رواه الطبراني في المعجم الصغير: ٢/١٥٢، ضعفه الالباني في ضعيف الجامع الصغير: رقم ٤٨٩٧  – ‘নারীর দায়িত্বে না আছে জীহাদ, না জুমআ(র নামায), আর না জানাযার পিছে পিছে চলা’। [আল-মু’জামুস সাগীর, ইমাম ত্বাবরাণী- ২/১৫২; তারিখে বাগদাদ, খতীব- ১৬/৬২৯; কানজুল উম্মাল- ৮/২৬৪]

(ঘ) মুসলীম নারী’র জন্য রাস্তায় পুরুষদের সাথে একাকার হয়ে হাটাচলা করা নিষেধ 

ইসলামী শরীয়তে নারী-পুরুষ একাকার হয়ে রাস্তা দিয়ে চলা নিষেধ। রাস্তা দিয়ে চলাচলের মূল হক্ব হল পুরুষদের। আর নারীরা মূলে তাদের বাড়িতে থাকতে আদিষ্ট, তবে প্রয়োজনে বাড়ির বাহিরে কোথাও যেতে হলে তারা পুরুষদের সাথে রাস্তার মাঝ দিয়ে চলাচল করবে না, বরং রাস্তার এক কিনারা দিয়ে চলাচল করবে। যেমন, হামজাহ বিন আবি উসাঈদ আল-আনসারী রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, (তার পিতা) আবু উসাঈদ আল-আনসারী রা. বলেন- أَنَّهُ سَمِعَ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ وَهُوَ خَارِجٌ مِنَ الْمَسْجِدِ فَاخْتَلَطَ الرِّجَالُ مَعَ النِّسَاءِ فِي الطَّرِيقِ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم لِلنِّسَاءِ ‏: اسْتَأْخِرْنَ فَإِنَّهُ لَيْسَ لَكُنَّ أَنْ تَحْقُقْنَ الطَّرِيقَ عَلَيْكُنَّ بِحَافَاتِ الطَّرِيقِ ‏‏.‏ فَكَانَتِ الْمَرْأَةُ تَلْتَصِقُ بِالْجِدَارِ حَتَّى إِنَّ ثَوْبَهَا لَيَتَعَلَّقُ بِالْجِدَارِ مِنْ لُصُوقِهَا بِهِ ‏. رواه أبو داود في سننه,كتاب الأدب , باب في مشي النساء مع الرجال في الطريق: ٤/٣٦٩ رقم ٥٢٧٢، و الطبراني في المعجم الكبير : ١٩/٢٦١ رقم ٥٨٠، حسنه ابن حجر العسقلاني في تخريج مشكاة المصابيح : ٤/٣٤٥، قال الالباني في كتاب سلسلة الأحاديث الصحيحة : ٢/٥١٢ رقم ٨٥٦ : و بالجملة فالحديث حسن بمجموع الطريقين – “(একদিন তিনি) —রাস্তায় নারীদের সাথে পুরুষরা একাকার হয়ে (চলতে দেখে) রাসুলুল্লাহ ﷺকে মসজিদ থেকে বের হওয়া অবস্থায়– এরশাদ করতে শুনলেন (যে), রাসুলুল্লাহ ﷺ নারীদেরকে (উদ্দেশ্য করে) বলছেন: ‘তোমরা (পুরুষদের) পরে যাও। নিশ্চয় রাস্তা তোমাদের নারীদের হক্বের বিষয় নয় (যে তোমরা রাস্তা দিয়ে চলাচল করবে); তোমাদের নারীদের উপরে ওয়াজিব হল রাস্তার এক কিনারা (দিয়ে চলা)’। তখন (থেকে মুসলীম যে কোনো) নারী (মাত্রই রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর আদেশ পালনার্থে এমন ভাবে রাস্তার পার্শস্থ) দেয়াল ঘেঁসে (ঘেঁসে চলত যে), তার (গায়ের) কাপড় পর্যন্ত দেয়ালের (অমসৃণ অংশে লেগে) সেটা তাতে আটকে যেতো’। [সুনানে আবু দাউদ– ৪/৩৬৯ হাদিস ৫২৭২; আল-মু’জামুল কাবীর, ইমাম ত্বাবরাণী- ২/৫১২ হাদিস ৮৫৬; শুআবুল ইমান, ইমাম বাইহাকী, হাদিস ৭৮২২]

আবু হুরায়রাহ রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেনلَيْسَ لِلنِّسَاءِ وَسَطُ الطَّرِيقِ . رواه ابن حبان في صحيحه , كتاب الحظر والإباحة , ذكر الزجر عن أن تمشي المرأة في حاجتها في وسط الطريق : ١٢/٤١٥ رقم ٥٦٠١، و حسنه الألباني في السلسلة الصحيحة” : رقم ٨٥٦ – “নারীর জন্য রাস্তার মাঝামাঝি (চলার কোনো হক্ব নেই)”। [সহিহ ইবনে হিব্বান- ১২/৪১৫ হাদিস ৫৬০১] 

এখানে রাসুলুল্লাহ ﷺ যে নারী-পুরুষ এক সাথে একাকার হয়ে রাস্তা চলাচল করতে নিষেধ করেছেন, তার অন্যতম একটি কারণ অবশ্যই নারী ও পুরুষের মাঝে সম্ভাব্য ফিতনার পথ রুদ্ধ করে দেয়া পদক্ষেপ স্বরূপ। তাহলে শরীয়তের দৃষ্টিতে কোনো অপ্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের একসাথে উঠাবসা চলাফেরা কথাবার্তা কী করে জায়েয হতে পারে? [আল ইখতিলাত্ব বাইনার রিজাল ওয়ান নিসা- ১/৯৯]

(ঙ) মুসলীম নারী’র একাকি সফর করা

এমনিভাবে নারীকে একাকি সফর করতেও নিষেধ করা হয়েছে, আর তাগিদ দেয়া হয়েছে তারা যেন কোনো ‘মাহরাম’ ছাড়া সফর না করে। 

আবু সাঈদ খুদরী রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেন لَا يَحِلُّ لِامْرَأَةٍ تُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ، أَنْ تُسَافِرَ سَفَرًا يَكُونُ ثَلَاثَةَ أَيَّامٍ فَصَاعِدًا، إِلَّا وَمَعَهَا أَبُوهَا، أَوِ ابْنُهَا، أَوْ زَوْجُهَا، أَوْ أَخُوهَا، أَوْ ذُو مَحْرَمٍ مِنْهَا . أخرجه مسلم في صحيحه , كتاب الحج , باب سفر المرأة مع محرم إلى حج وغيره : ٢/٩٧٧ رقم ١٣٤٠ –‘যে নারী আল্লাহ’র ব্যাপারে এবং আখেরাতের দিবসের (ব্যাপারে) ঈমান রাখে, তার জন্য এটা হালাল নয় যে, সে তিন দিনের (সফর পরিমাণ দূরুত্ব) বা ততধিক (দূরত্বের কোনো) সফরে (একাকি) গমন করবে —যদি না তার সাথে তার পিতা বা তার ছেলে অথবা তার স্বামী কিংবা তার ভাই অথবা (অন্য) মাহরামদের মধ্যে কেউ থাকে’’। [সহিহ মুসলীম- ২/৯৭৭ হাদিস  ১৩৪০; জামে তিরমিযী, হাদিস ১১৭৯]

(চ) নারীদের  একাকি হজ্জ বা ওমরা’র সফরে যাওয়া

হজ্জের ন্যয় পবিত্র ফরয কাজ -যা ইসলামের ‘আরকান চতুষ্টয়ে’র মধ্যে অন্যতম, তা আদায়ের জন্যেও মুসলীম নারীর সাথে তার ‘মাহরাম’ কেউ থাকা শর্ত। যেমন, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেনلَا يَخْلُوَنَّ رَجُلٌ بِامْرَأَةٍ إِلَّا وَمَعَهَا ذُو مَحْرَمٍ، وَلَا تُسَافِرِ الْمَرْأَةُ إِلَّا مَعَ ذِي مَحْرَمٍ ، فَقَامَ رَجُلٌ، فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللهِ، إِنَّ امْرَأَتِي خَرَجَتْ حَاجَّةً، وَإِنِّي اكْتُتِبْتُ فِي غَزْوَةِ كَذَا وَكَذَا، قَالَ: انْطَلِقْ فَحُجَّ مَعَ امْرَأَتِكَ . أخرجه مسلم في صحيحه , كتاب الحج , باب سفر المرأة مع محرم إلى حج وغيره : ٢/٩٧٩ رقم ١٣٤١“কোনো নারীরর সাথে তার মাহরাম (কেউ উপস্থিত) না থাকলে কোনো পুরুষ তার সাথে একান্তে সাক্ষাত করবে না। আর নারীর সাথে মাহরাম কেউ না থাকলে সে (একাকি কোথাও) সফর করবে না’। তখন এক ব্যাক্তি জিজ্ঞেস করলো: ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার স্ত্রী হজ্জের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেছে, আর এদিকে আমি অমুক অমুক গাজওয়ায় (জিহাদে বের হওয়ার জন্য) নাম লিখিয়েছি, (এখন আমার স্ত্রীর মাসআলা কী হবে?)। রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন; ‘(তোমার স্ত্রীকে একা যেতে দিও না, বরং) ফিরে গিয়ে তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে হজ্জ করো’’[সহিহ মুসলিম- ২/৯৭৮ হাদিস  ১৩৪১]

নারীর একাকি ‘হজ্জ সফরে’ যাওয়া কারও মতেই জায়েয নয়। মুসলীম নারীর সাথে কোনো মাহরাম কেউ না থাকলে সে একাকি হজ্জে যাবে না, যাবৎ না তার কোনো মাহরাম তার সঙ্গি হয়। সে যতদিন মাহরাম পাবে না, ততদিন তার উপরে হজ্জ আদায়ের শরয়ী দায়িত্ব সাকেত (স্থগিত) থাকবে। এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত কোনো মাহরাম পাওয়া না গেলে তাকে হজ্জ আদায় করতে হবে না। অবশ্য বদলী হজ্জের জন্য সে ওসিয়ত করে যাবে। মাহরাম ছাড়া একাকী হজ্জে গেলে গুনাহগার হবে। [আল-মুসান্নাফ, ইবনু আবি শায়বাহ- ৮/৬৩৬-৬৪১; আদ-দুররুল মুখতার, ইমাম হাসকাফী- ২/৪৬৪; বাদায়েউস সানাায়ে, ইমাম কাসানী- ২/১২৩; আল-বাহরুর রায়েক ২/৩১৪-৩১৫; আল-মুহিতুল বুরহানী- ৩/৩৯৪; ফাতহুল কাদীর, ইবনে হুমাম- ২/৩৩০; রাদ্দুল মুহতার, শামী-২/৪৬৫; ইমদাদুল ফাতাওয়া ২/১৫৬]

(ছ) আল্লাহ’র পথে সশস্ত্র জিহাদে গমন করা

ইসলামে জিহাদ কত গুরুত্বপূর্ণ একটি ফরয আমল! জীহাদের ফজীলত দিয়ে কুরআন হাদিস ভরে আছে।

كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِتَالُ 

“(হে মুসলমানগণ) তোমাদের উপরে ক্বিতাল (সশস্ত্র জিহাদ)’কে বিধিবদ্ধ (ফরয) করে দেয়া হল”[সূরা বাকারাহ ২১৬]

ইসলামী শরীয়তে সাধারণ অবস্থায় কিতাল (সশস্ত্র জিহাদ)-এর এই ফরয দায়িত্ব অর্পন করা হয়েছে ‘মুসলীম পুরুষ’-এর উপরে। আর এ আমলটি যেহেতু গৃহের বাহিরের একটি আমল এবং তা পালন করতে গেলে মুসলীম-অমুসলীম সকল প্রকারের পুরুষদের সামনে ও সংস্পর্শে আসা অবধারিত, যা থেকে নানাবিধ ফিতনা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাব্যতাই প্রবল, তাই এত বড় ফজিলতপূর্ণ এই ‘ফরয’ কাজটিকেও সাধারণ অবস্থায় নারীদের দায়িত্ব থেকে বাহিরে রাখা হয়েছে। যেমন,আল্লাহ তাআলা  এরশাদ করেন-

وَ لَا تَتَمَنَّوْا مَا فَضَّلَ اللَّهُ بِهِ بَعْضَكُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ ۚ لِّلرِّجَالِ نَصِيبٌ مِّمَّا اكْتَسَبُوا ۖ وَلِلنِّسَاءِ نَصِيبٌ مِّمَّا اكْتَسَبْنَ ۚ  وَ اسْأَلُوا اللَّهَ مِن فَضْلِهِ ۗ إِنَّ اللَّهَ كَانَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمًا
“আর তোমরা ওই বিষয়ের তামান্না (আকাঙ্খা পোষন) করো না, যা দিয়ে (তোমাদের রব) আল্লাহ (তাআলা পৃথিবীর জীবনে তাঁর বান্দাদেরই মধ্যে) কতক’কে কতকের উপরে ফজিলত (শ্রেষ্ঠত্ব) দান করেছেন। (পার্থিব ধ্বনসম্পদ ও অভিভাবকত্ব-সুলভ ক্ষমতা লাভই হোক কিংবা আখেরাতে সাওয়াব লাভই হোক, উভয় ক্ষেত্রেই তোমাদের রব আল্লাহ তাআলা যে সকল বিধিবিধান দিয়েছে, সেই অনুসারে) পুরুষদের জন্য থাকবে সেই অংশ যা তারা উপার্জন/লাভ করবে, আর নারীদের জন্য থাকবে সেই অংশ যা তারা উপার্জন/লাভ করবে। আর তোমরা (বরং) আল্লাহ’র কাছে (তাঁর বিধান মতো চলার) ফজল (আমলের তৌফিক) চাও। নিশ্চই আল্লাহ সব কিছুর ব্যাপারে পূর্ণজ্ঞান রাখেন”। [সূরা নিসা ৩২]

এই আয়াতের শানে-নুজুল প্রসঙ্গে হযরত মুজাহিদ রহ. থেকে সহিহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, উম্মে সালমাহ রা. (একবার রাসুলুল্লাহ ﷺ-কেঁ) জিজ্ঞেস করলেন-  يَا رَسُولَ اللَّهِ ، أَيَغْزُو الرِّجَالُ وَلَا نَغْزُو وَلَا نُقَاتِلُ فَنُسْتَشْهَدُ وَإِنَّمَا لَنَا نِصْفُ الْمِيرَاثِ . فَأَنْزَلَ اللَّهُ { وَلَا تَتَمَنَّوْا مَا فَضَّلَ اللَّهُ بِهِ بَعْضَكُمْ عَلَى بَعْضٍ } . اخرجه الحاكم في المستدرك على الصحيحين: ٢/٣٠٥ و قال الذهبي قي التلخيص : على شرط البخاري ومسلم ; و اخرجه ايضا غيره ; و صححه أحمد شاكر في عمدة التفسير: ١/٤٩٥ و في حاشية تفسير ابن جرير: ٨/٢٦٣ , و الالباني في صحيح الترمذي  – “ইয়া রাসুলাল্লাহ! পুুরুষরা গাজওয়া (জিহাদ) করে, আমরা (নারীরা) কি গাজওয়া (জিহাদ) করবো না, কিতাল (সমর যুদ্ধ) করবো না ?! তাছাড়া সাক্ষ্য দান এবং মিরাছের ক্ষেত্রেও আমাদের জন্য (বিধান রাখা) রয়েছে (মুসলীম পুরুষগণের) অর্ধেক’! তখন আল্লাহ (তাআলা কুরআন কারিমের এই আয়াতটি) নাজিল করেন- وَ لَا تَتَمَنَّوْا مَا فَضَّلَ اللَّهُ بِهِ بَعْضَكُمْ عَلَىٰ بَعْضٍআর তোমরা ওই বিষয়ের তামান্না (আকাঙ্খা পোষন) করো না, যা দিয়ে (তোমাদের প্রভু) আল্লাহ (তাআলা তাঁর বান্দাদেরই মধ্যে) কতক’কে কতকের উপরে ফজিলত (শ্রেষ্ঠত্ব) দান করেছেন”। [মুসতাদরাকে হাকিম– ২/৩০৫ হাদিস ৩১৯৫; জামে তিরমিযী, হাদীস ৩০২২; মুসনাদে আহমদ- ৬/৩২২; তাফসিরে আব্দুর রাজ্জাক- ১/১৫৬; মুসনাদে ইসহাক বিন রাহওয়াইহ- ১৮৭০; তাফসিরে তাবারী– ৮/২৬৩ আছার ৯২৩৬, ৯২৩৭, ৯২৪১; তাফসিরে ইবনু আবি হাতিম- ৩/৫২২৪; মাআলিমুত তানযিল, ইমাম বগভী- ২/২০৪; আদ-দুররুল মানসুর, সুয়ূতী- ২/২৬৬]

একই বিষয়বস্তুর সমর্থন উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রা.-এর একটি সহিহ হাদিস থেকেও হয়।আয়েশা বিনতে ত্বলহাহ রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা সিদ্দিকাহ রা. বলেন- قُلتُ يا رَسولَ اللَّهِ، ألَا نَغْزُو ونُجَاهِدُ معكُمْ؟ فَقالَ: لَكُنَّ أحْسَنَ الجِهَادِ وأَجْمَلَهُ الحَجُّ، حَجٌّ مَبْرُورٌ، فَقالَتْ عَائِشَةُ فلا أدَعُ الحَجَّ بَعْدَ إذْ سَمِعْتُ هذا مِن رَسولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ . رواه البخاري في الصحيح , كتاب جزاء الصيد , باب حج النساء: رقم ١٨٦١ ، و البيهقى : ٤/٣٢٦، و أحمد في مسنده : ٦/٧٩ – “আমি (একবার রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে) জিজ্ঞেস করলাম: ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! (মুসলীম পুরুষদের মতো) আমরা (নারীরাও) কি আপনার সঙ্গি হয়ে গাজওয়া করবো না, জিহাদ করবো না’? রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন: ‘বরং তোমাদের নারীদের জন্য সর্বোত্তম ও সুন্দরতম জিহাদ হল হজ্জ; হজ্জে মাবরুর (কবুলযোগ্য হজ্জ)’। আয়েশা রা. বলেন: ‘আমি রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছ থেকে একথা শোনার পর হতে কখনো হজ্জ ত্যাগ করিনি”। [সহিহ বুখারী, হাদিস ১৮৬১; মুসনাদে আহমদ- ৬/৭৯; সুনানুল কুবরা, ইমাম বাইহাকী- ৪/৩২৬] 

অন্য রেওয়ায়েতে এভাবে এসেছে যে, উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রা. বলেন- قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ عَلَى النِّسَاءِ جِهَادٌ قَالَ ‏ :‏ نَعَمْ عَلَيْهِنَّ جِهَادٌ لاَ قِتَالَ فِيهِ الْحَجُّ وَالْعُمْرَةُ ‏. أخرجه ابن ماجه في سننه , كتاب المناسك , باب الحج جهاد النساء : رقم ٢٩٠١ ; و أحمد في مسنده : ٦/١٦٥ ; و ابن خزيمة في صحيحه , كتاب المناسك , باب الدليل على أن جهاد النساء الحج و العمرة : رقم ٣٠٧٣ ; و ابن حبان في صحيحه: رقم ٣٧٠٢ ; و الدار قطني في سننه: ٣/٣٤٥ ; صححه النووي في المجموع شرح المهذب : ٤/٧ , و ابن القيم في تهذيب السنن : ٥/٢٤٩ , و ابن الملقن في البدر المنير: ٩/٣٦ و في تحفة المحتاج : ٢/١٢٦ , و ابن كثير في إرشاد الفقيه : ١/٣٠٠ ; و الالباني في صحيح سنن ابن ماجه : ٣/١٠ و في الإرواء : ٩٨١    – “আমি রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে জিজ্ঞেস করলাম: ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! নারীদের উপরে জিহাদ আছে কি’? তিনি বললেন: ‘হ্যাঁ (আছে বৈকি, তবে) তাদের উপরে এমন জিহাদ আছে, যার মধ্যে কোনো যুদ্ধ নেই। (আর সেটা হল) হজ্জ ও উমরাহ”। [সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস ২৯০১; মুসনাদে আহমদ- ৬/১৬৫; সহিহ ইবনে খুযাইমাহ, হাদিস ৩০৭৩; সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস ৩৭০২; সুনানে দ্বারাকুতনী– ৩/৩৪৫]

উপরোক্ত এই হাদিস গুলি একথার পরিষ্কার দলিল যে, সুরা নিসার’র ৩২ নং আয়াতটি নাজিল হওয়ার আগেও কুরআনের যতগুলো আয়াতে ‘আল্লাহ’র রাস্তায় ক্বিতাল (সশস্ত্র-জিহাদ) করা’র নির্দেশ বা উৎসাহ’ দেয়া হয়েছিল, তার সবগুলোই শুধুমাত্র মুসলীম পুরুষদেরকে উদ্দেশ্য করে করা হয়েছিল; মুসলীম নারী’দেরকে নয়। আর এ বিষয়টি রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর যুগের মুসলীম নারী পুরুষ উভয়েরই জানা ছিল। আর একথা উম্মে সালমাহ রা. এবং আয়েশা রা.-এর উপরোক্ত প্রশ্ন থেকেও বোঝা যায় যে, তখনকার মুসলীম নারীদের কাছে মাসআলাহ’টি একদম জানাশোনা একটি মাসলা ছিল। আর জিহাদ বিষয়ক প্রশ্নের জবাবে খোদ্ আল্লাহ তাআলা সুরা নিসা’র উপরোক্ত ৩২ নং আয়াতটি নাজিল করার মাধ্যমে বিষয়টিকে আরো জোরালো করে দিয়েছেন। তবে, রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে নারীদের এরকম প্রশ্ন রাখার কারণ হল, আসলে নারীরা ‘জিহাদের বিরাট ফজিলত’ এবং এর দ্বারা শহিদ হওয়ার মতো আল্লাহ’র দরবারে বিরাট মর্যাদা লাভের সুবর্ণ সুযোগ দেখে মুসলীম পুরুষদের উপরে এত ঈর্ষাহ্নিত হতেন যে, তারা মনে মনে কামনা করতেন- ‘হায়, পুরুষদের মতো আমরা নারী’রাও যদি জিহাদে শরিক হওয়ার সুযোগ পেতাম’। মূলত: মনের এই রকম বাসনা থেকেই হযরত উম্মে সালমাহ রা. এবং হযরত আয়েশা রা. জিহাদের ব্যাপারে উপরোক্ত প্রশ্নটি করেছিলেন।

আবু হুরায়রাহ রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেন- جِهَادُ الْكَبِيرِ وَالضَّعِيفِ وَالْمَرْأَةِ الْحَجُّ وَالْعُمْرَةُ . رواه النسائي في سننه , كتاب الحج ، باب فضل الحج : ٥/١١٤ رقم ٢٦٢٦ ; و قد حَسّن الإمام الحافظ المُنذري إسناده في الترغيب والترهيب : ٢/١٠٩ ; و قال الإمام بدر الدين العيني في عمدة القاري : ٩/١٩٣ : بسند لا باس به , و قال الحافظ ابن حجر في موافقة الخبر الخبر:٢/٣٠ : إسناده صحيح مرفوعاً ; و اخرجه ايضا أحمد في مسنده : ١٠/٢٧٢ رقم ٩٤٥٩ ; و الطبراني في الاوسط : ٦/٢٧٢ رقم ٨٧٥١ ; و البيهقي في سننه : ٤/٣٠٠ و ٩/٢٣ – “বৃদ্ধ, দূর্বল (ব্যাক্তি) এবং নারী’র জিহাদ হল হজ্জ ও উমরাহ”। [সুনানে নাসায়ী,- ৫/১১৪ হাদিস ২৬২৬; সুনানুল কুবরা, বাইহাকী– ৪/৩০০, ৯/২৩; আল-মু’জামুল আউসাত, ত্বাবরাণী- ৬/২৭২ হাদিস ৮৭৫১; মুসনাদে আহমদ- ১০/২৭২ হাদিস ৯৪৫৯ ] 

পবিত্র কুরআনের বেশ কিছু আয়াত এবং বিখ্যাত মুফাসসিরীনে কেরামের তাফসির সমূহ থেকেও নারী’র জিহাদে অংশগ্রহন ফরয না হওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হয়। যেমন, আল্লাহ তাআলা  এরশাদ করেন-

لَا يَسْتَأْذِنُكَ الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ أَن يُجَاهِدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ ۗ وَاللَّهُ عَلِيمٌ بِالْمُتَّقِينَ – إِنَّمَا يَسْتَأْذِنُكَ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَارْتَابَتْ قُلُوبُهُمْ فَهُمْ فِي رَيْبِهِمْ يَتَرَدَّدُونَ – وَلَوْ أَرَادُوا الْخُرُوجَ لَأَعَدُّوا لَهُ عُدَّةً وَلَٰكِن كَرِهَ اللَّهُ انبِعَاثَهُمْ فَثَبَّطَهُمْ وَقِيلَ اقْعُدُوا مَعَ الْقَاعِدِينَ – لَوْ خَرَجُوا فِيكُم مَّا زَادُوكُمْ إِلَّا خَبَالًا وَلَأَوْضَعُوا خِلَالَكُمْ يَبْغُونَكُمُ الْفِتْنَةَ وَفِيكُمْ سَمَّاعُونَ لَهُمْ ۗ وَاللَّهُ عَلِيمٌ بِالظَّالِمِينَ
“(হে আমার নবী, মুহাম্মাদ! তুমি লক্ষ্য করবে), যারা (খাঁটি ভাবে আন্তরিকতার সাথে) ইমান এনেছে আল্লাহ’র প্রতি এবং আখেরাতের প্রতি, তারা তাদের জান ও মাল দিয়ে (ইসলামের দুশমনদের বিরুদ্ধে) জিহাদ করা থেকে (অব্যহতি লাভের জন্য) তোমার কাছে (কখনই) অনুমতি চাবে না। আর আল্লাহ -মুত্তাকীগণকে ভাল করেই জানেন। (তুমি দেখবে), যারা আল্লাহ’র প্রতি এবং আখেরাতের প্রতি (খাঁটি ভাবে আন্তরিকতার সাথে) ইমান আনেনি, বরং তাদের অন্তরগুলো (এখনো) সন্দেহে পড়ে আছে, যার কারণে তারা তাদের সন্দেহ-সংশয়ের মধ্যে দোদুল্যমান (অবস্থায়) রয়েছে, কেবলমাত্র তারাই (নিজেদের জান ও মাল দিয়ে ইসলামের দুশমনদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা থেকে অব্যহতি লাভের জন্য) তোমার কাছে অনুমতি চাবে। বস্তুত: তারা যদি (জিহাদে) বের হওয়ার (পাক্কা) এরাদা/ইচ্ছা করতোই, তাহলে তো তারা তার জন্য অবশ্যই (আগে ভাগেই) বিশেষ প্রস্তুতি নিয়ে রাখতো। কিন্তু (তাদের অন্তরের কলুষ নিয়তের কারণে পবিত্র জিহাদের ময়দানে) তাদের অভিযাত্রাকে (তোমার প্রভু) আল্লাহ’ই পছন্দ করেন নি। ফলে তিঁনি তাদেরকে (জিহাদে বের হওয়া থেকে) বিরত রাখলেন এবং তাদেরকে বলা হল: ‘তোমরা (গৃহে) উপবেশনকারীদের সাথে বসে থাকো’; (তোমাদের জিহাদের মাঠে গিয়ে কাজ নেই)’। (শোনো), তারা যদি তোমাদের মাঝে বের হত, তাহলে তারা তোমাদের মধ্যে কেবল অনিষ্ট-বিভ্রান্তি-বিশৃঙ্খলাই বৃদ্ধি করতো, (যাতে তোমাদের ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের মাঝে ফাটল সৃষ্টি হয়), এবং তোমাদের মাঝে ফিতনা লাগানোর মতলবে তারা অবশ্যই তোমাদের সারি গুলোর মধ্যে ছোটাছুটি করতো। আর (এও জেনে রোখো যে), তোমাদের মাঝে তাদের জন্য কানপাতা লোকজনও রয়েছে। আর আল্লাহ -মজালেমদেরকে ভাল করেই জানেন। ”। [সূরা তাওবা ৪৪-৪৭]
 
এই আয়াতে কারিমার মধ্যে- مَعَ الْقَاعِدِينَ – “(গৃহে) উপবেশনকারীদের সাথে (বসে থাকো)”-এর একটি অর্থ হল ‘মুসলীম নারীগণ’। যেমন: এর তাফসীরে ইমাম ইবনে জারীর তাবারী (মৃ: ৩১০ হি:) রহ. এবং ইমাম মাক্কী বিন আবি ত্বালিব (মৃ: ৪৩৭ হি:) রহ. বলেন- يعني: اقعدوا مع المرضى والضعفاء الذين لا يجدون ما ينفقون، ومع النساء والصبيان – “এর অর্থ হল, তোমরা -অসুস্থ্য ব্যাক্তিবর্গ, দূর্বল ব্যাক্তিবর্গ, যারা (জিহাদের ব্যয়ভার বহন করার মতো) খরচপাতি (যোগার করতে) পায় না, নারী মহল এবং শিশু’দের সাথে (গৃহে বসে থাকো)”। [জামেউল বায়ান, ইমাম তাবারী- ১০/১৮৬; আল হিদায়াহ ইলা বুলুগিন নিহায়াহ, ইমাম মাক্কী- ৩/২৮২] ইমাম কুরতুবী (মৃ: ৬৭১ হি:) রহ. বলেছেন- أي مع أولى الضرر والعميان والزمني والنسوان والصبيان – “এর অর্থ হল, আহত, অন্ধ,……, নারী মহল এবং শিশুদের সাথে (গৃহে বসে থাকো)”। [আল-জামে লি-আহকামিল কুরআন, ইমাম কুরতুবী- ৮/১৫৬] শায়েখ সা’দী (মৃ: ১৩৭৬ হি:) রহ. বলেছেন- من النساء والمعذورين – “(এর অর্থ হল), নারী মহল এবং যাদের (জিহাদে না যাওয়া শরয়ী) ওজর (অপারগতা/অসামর্থতা) আছে (তারা)”। [তাইসিরুল কারীম, শায়েখ সা’দী- ১/৩৩৯]

আল্লাহ তাআলা আরো এরশাদ করেন-

وَ إِذَا أُنزِلَتْ سُورَةٌ أَنْ آمِنُوا بِاللَّهِ وَ جَاهِدُوا مَعَ رَسُولِهِ اسْتَأْذَنَكَ أُولُو الطَّوْلِ مِنْهُمْ وَ قَالُوا ذَرْنَا نَكُن مَّعَ الْقَاعِدِينَ  – رَضُوا بِأَن يَكُونُوا مَعَ الْخَوَالِفِ وَطُبِعَ عَلَىٰ قُلُوبِهِمْ فَهُمْ لَا يَفْقَهُونَ
“(৮৬) আর (হে নবী মুহাম্মাদ!) যখন (এ আদেশ সহকারে) কোনো সুরা নাজিল হয় যে, ‘তোমরা আল্লাহ’র প্রতি ইমান আনো এবং তাঁর রাসুলের সাথে থেকে (ইসলামের দুশমনদের বিরুদ্ধে) জিহাদ করো’, (তখন তুমি দেখবে যে), তাদের মধ্য থেকে উলুত্ব-ত্বাওল (শক্তি সামর্থবান বা স্বচ্ছল/ধ্বনী লোকেরা) তোমার কাছে (বিভিন্ন ঠুনকো অযুহাতে জিহাদে অংশ গ্রহন করা থেকে) অব্যহতি চাচ্ছে। আর তারা বলে, (দেখুন আমাদের অমুক অমুক সমস্যা আছে, এযাত্রায়) আমাদেরকে (যোদ্ধাদের লিষ্ট থেকে) বাদ রাখুন, আমরা (গৃহে রয়ে যাওয়া নারী, শিশু ও অক্ষম) উপবেশনকারীদের সাথে থাকবো। (৮৭) তারা (জিহাদে বের না হয়ে বরং) পিছনে রয়ে যাওয়াদের সাথে থাকা’তেই খুশি হল। বস্তুত: (তাদের মুনাফেকির কারণে) তাদের অন্তরগুলোর উপরে মোহর লেগে গেছে, কাজেই তারা উপলব্ধি করতে পারবে না (যে তারা আখেরাতে কি পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখিন হওয়ার উপক্রম হল)”। [সূরা তাওবা ৮৬, ৮৭]
 
উপরের আয়াতে বর্ণিত- رَضُوا بِأَن يَكُونُوا مَعَ الْخَوَالِفِ – “তারা (জিহাদে বের না হয়ে বরং) পিছনে রয়ে যাওয়াদের সাথে থাকা’তেই খুশি হল-এই আয়াতাংশের মধ্যে উল্লেখীত আরবী শব্দ الْخَوَالِفِ – (পিছনে রয়ে যাওয়াদের)-এর এক তাফসীর হল- ‘মুসলীম নারীগণ’। যেমন: -এর তাফসীরে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন- النساء – (নারীগণ)। এই একই তাফসীর ইবন আতিয়াহ, মুজাহিদ, কাতাদাহ, জিহহাক, ইকরিমাহ, হাসান বসরী, আব্দুর রহমান ইবন জায়েদ, সুদ্দী রহ. প্রমুখ থেকেও বর্ণিত হয়েছে। [জামেউল বায়ান, ইমাম তাবারী- ১৪/৪১৩, ৪১৪ আছার ১৭০৬৪-১৭০৭২; তাফসীরে ইবনু আবি হাতিম- ১/১৮৫৯ আছার ১০২০৪, ১০২০৫; ফাতহুল কাদীর, শাওকানী- ২/৩৯০] ইমাম মাক্কী বিন আবি ত্বালিব (মৃ: ৪৩৭ হি:) রহ. এর তাফসিরে বলেন- مع النساء اللواتي لا فرض عليهن في الجهاد – “(ওইসকল) নারীদের সাথে -যাদের উপরে (স্বাভাবিক অবস্থায়) জিহাদে যাওয়া ফরয নয় (তাদের সাথে গৃহেই রয়ে যাওয়াকেই তারা পছন্দ করে নিলো)”। [আল হিদায়াহ ইলা বুলুগিন নিহায়াহ, ইমাম মাক্কী- ৩/৩১৫] ইমাম ইবনে কাছির (মৃ: ৭৭৪ হি:) রহ. এর তাফসিরে বলেন- ورضوا لأنفسهم بالعار والقعود في البلد مع النساء – وهن الخوالف – بعد خروج الجيش – “তারা এলাকায় (রয়ে যাওয়া) নারীদের সাথে (গৃহে) বসে থাকাকেই নির্লজ্জের মতো নিজেদের জন্য পছন্দ করে নিয়েছিল। আর মুজাহিদ বাহিনী (জিহাদের উদ্দেশ্যে) বের হয়ে যাওয়ার পর –(আয়াতে বর্ণিত) الخوالف (পিছনে রয়ে যাতওয়া’রা) হল নারী মহল (যাদের উপরে জিহাদ ফরয ছিলনা বিধায় তারা নিজ নিজ গৃহে অবস্থান করছিলেন)”। [তাফসিরে ইবনে কাছির- ৪/১৯৬] ইমাম ফখুরুদ্দিন রাযী (মৃ: ৬৭১ হি:) রহ. এর এক তাফসিরে বলেন- عبارة عن النساء اللاتي تخلفن في البيت فلا يبرحن، والمعنى: رضوا بأن يكونوا في تخلفهم عن الجهاد كالنساء – “বক্তব্যটি নারী মহল সম্পর্কে, যারা (তাদের উপরে জিহাদ ফরয না হওয়ার কারণে নিজ নিজ) গৃহে রয়ে গিয়েছিল, সুতরাং, তাদের উপরে (আল্লাহ’র) কোনো গোষ্মা/রাগ নেই। অর্থাৎ, (আল্লাহ তাআলা এখানে মুসলমান নামধারী কিছু পুরুষদেরকে তিরষ্কার করছেন যে), তারা (মূলত:) এতেই রাজি খুশি হয়ে রইলো যে, তারা নারীদের মতো জিহাদ থেকে পিছনে রয়ে গেলো”। [মাফাতিহুল গাইব, ইমাম রাযী- ১৬/১৫৭] ইমাম কুরতুবী (মৃ: ৬৭১ হি:) রহ. এর তাফসিরে বলেন- أي مع النساء والصبيان وأصحاب الأعذار من الرجال– “অর্থাৎ, নারী মহল, শিশু বাচ্চারা এবং পুরুষদের মধ্যে যারা ওজরযোগ্য (যাদের উপরে মূলত: জিহাদ ফরয ছিল না) -তাদের সাথে (গৃহে বসে থাকাকেই এসব নামধারী মুসলমান পুরুষগুলি পছন্দ করে নিলো)”। [আল-জামে লি-আহকামিল কুরআন, ইমাম কুরতুবী- ৮/২২৩] 
 
সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. সহ উপরোল্লখীত মুফাসসির’গণের এসকল তাফসির একথার দলিল যে, জিহাদের সময় -মুসলীম নারীগণ তাদের গৃহেই অবস্থান করবেন -এটাই শরীয়তের স্বাভাবিক বিধান, অপর দিকে মুসলীম পুরুষগণ ময়দানে জিহাদের ফরয দায়িত্ব আঞ্জাম দিবেন -এটাই আল্লাহ’র আহবান। কিন্তু কিছু মুসলীম নামধানী পুরুষ যখন কোনো যথাযোগ্য কারণ ছাড়াই জিহাদের ফরয দায়িত্ব পালনার্থে বের না হয়ে বরং বাড়িতে রয়ে যাওয়া নারী মহল, শিশু বাচ্চা, মাজুর (অপারগ/অসমর্থ ব্যাক্তি) ও দূর্বল মুসলমানদের সাথে থাকাকেই পছন্দ করে নিলো, তখনই সেই পুরুষগুলো আল্লাহ’র তিরষ্কারের মুখোমুখি হল। এ থেকে প্রমাণিত হয়, জিহাদ ও ক্বিতালের ফরয দায়িত্ব পালন করার মূল আহাল (উপযুক্ত ব্যাক্তি) হল ‘মুসলীম পুরুষ(গণ)’; নারী(গণ) নয়। 
 
উপরের এই দীর্ঘ আলোচনা থেকে একথাও প্রমাণিত হল যে, কুরআন কারিমের যেসকল স্থানে ‘মুমিন’ বা ‘মুসলীম’(দের)কে সম্মোধন করে ‘জিহাদ ও ক্বিতাল’-এর জন্য ময়দানে বের হওয়ার ডাক দেয়া হয়েছে এবং জিহাদে গিয়ে শহিদ হওয়ার উৎসাহ দেয়া হয়েছে, সেসকল স্থানে মূল লক্ষ্যবস্তু হল ‘মুমিন/মুসলীম পুরুষ’(গণ)।  এজন্যই ইমাম শাফেয়ী (মৃ: ২০৪ হি:) রহ. বলেছেন- و قد قال لنبيه صلى الله عليه وسلم ” حَرِّضِ الْمُؤْمِنِينَ عَلَى الْقِتَالِ ” فدل على أنه أراد بذلك الذكور دون الإناث لأن الإناث المؤمنات . و قال عز و جل “وَمَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ لِيَنْفِرُوا كَافَّةً ” وقال ” كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِتَالُ ” وكل هذا يدل على أنه أراد به الذكور دون الإناث– “আল্লাহ তাআলা তাঁর নবী-কে উদ্দেশ্য করে বলেছেন- حَرِّضِ الْمُؤْمِنِينَ عَلَى الْقِتَالِ – “(হে নবী) তুমি মু’মিনুন (তথা মুমিনদের)কে (আল্লাহ’র পথে) ক্বিতালের জন্য উৎসাহিত করো”। এ আয়াতটি প্রমাণ করে যে, এর দ্বারা আল্লাহ তাআলা’র উদ্দেশ্য হল (মু’মিন) পুরুষগণ; -নারী’গণ নয়। কেননা (আরবী সম্মোধন অনুযায়ী) নারীরা  হল ‘মু’মিনাত’; (অপরদিকে এই আয়াতে পুরুষ’দেরকে সম্মোধন করে বলা হয়েছে ‘মুমিনুন’)। (তেমনি ভাবে) আল্লাহ তাআলা আরো এরশাদ করেন- وَمَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ لِيَنْفِرُوا كَافَّةً – “মুমিনগণের জন্য সমিচিন নয় যে, তারা সকলে (মিলে একই সাথে জিহাদের উদ্দেশ্যে) বেরিয়ে পড়বে” । তিঁনি আরো এরশাদ করেন- كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِتَالُ -“(হে মুসলমানগণ) তোমাদের উপরে ক্বিতাল (সমর জিহাদ)’কে বিধিবদ্ধ (ফরয) করে দেয়া হল”। এসকল আয়াতের সবগুলোই প্রমাণ করে যে, এর দ্বারা আল্লাহ তাআলা’র উদ্দেশ্য হল (মু’মিন) পুরুষগণ; -নারী’গণ নয়”। [কিতাবুল উম্ম, ইমাম শাফেয়ী- ৪/১৭০]
 
তবে একথা ঠিক যে, রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর জামানায় কোনো কোনো নারী সাহাবীয়া জিহাদে আহতদের ঔষধ-পট্টি প্রভৃতির বন্দোবস্থ করার জন্য সাথে গিয়েছিলেন। কিন্তু প্রথমতঃ কথা হল, এব্যাপারে পূর্বাপর সকল আহলে হক্ব ওলামায়ে কেরাম একমত যে, নারীদের উপর নিয়মানুগভাবে জিহাদকে ফরয করা হয় নি; দ্বিতীয়ত তাদেরকে কখনই নিয়মানুগ ভাবে যুদ্ধেও শামিল করা হয় নি। যেমন, জা’ফর বিন মুহাম্মাদ রহ. থেকে তার পিতা মুহাম্মাদ রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, ইয়াযিদ বিন হুরমুয রহ. বলেন- أَنَّ نَجْدَةَ ، كَتَبَ إِلَى ابْنِ عَبَّاسٍ يَسْأَلُهُ ، عَنْ خَمْسِ خِلَالٍ ، فَقَالَ : ابْنُ عَبَّاسٍ : لَوْلَا أَنْ أَكْتُمَ عِلْمًا مَا كَتَبْتُ إِلَيْهِ ، كَتَبَ إِلَيْهِ نَجْدَةُ : أَمَّا بَعْدُ ، فَأَخْبِرْنِي هَلْ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَغْزُو بِالنِّسَاءِ ؟ وَهَلْ كَانَ يَضْرِبُ لَهُنَّ بِسَهْمٍ ؟  ……. ؟ فَكَتَبَ إِلَيْهِ ابْنُ عَبَّاسٍ : كَتَبْتَ تَسْأَلُنِي هَلْ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَغْزُو بِالنِّسَاءِ ؟ وَقَدْ كَانَ يَغْزُو بِهِنَّ ، فَيُدَاوِينَ الْجَرْحَى ، وَيُحْذَيْنَ مِنَ الْغَنِيمَةِ ، وَأَمَّا بِسَهْمٍ فَلَمْ يَضْرِبْ لَهُنَّ ،  ……... رواه مسلم في صحيحه , كتاب الجهاد والسير, باب النِّسَاءُ الْغَازِيَاتُ يُرْضَخُ لَهُنَّ وَلاَ يُسْهَمُ وَالنَّهْىُ عَنْ قَتْلِ صِبْيَانِ أَهْلِ الْحَرْبِ : رقم ١٨١٢، و أحمد في مسنده : ٤/٢٩١ و قال أحمد شاكر: إسناده صحيح، و أبو داود في سننه : ٢٧٢٧ و ٢٧٢٨ مفرقاً مختصرا، و الترمذي في سننه : ١٥٥٦، و النسائي في سننه : ٤١٣٤ مختصراً، – “নাজদাহ (রহ.-একবার আব্দুলল্লাহ) ইবনে আব্বাস রা.-এর কাছে পাঁচটি প্রশ্ন লিখে পাঠালেন। (উত্তরে) ইবনে আব্বাস রা. বললেন: ‘আমি যদি ইলম গোপন (করার অপরাধের আশংকা) না করতাম, তাহলে (এসব প্রশ্নের কোনো উত্তরই) আমি তাকে লিখে পাঠাতাম না। (রাবী বলেন:) নাজদাহ তাঁকে লিখে পাঠিয়েছিল: ‘আম্মা বা’দ, আমি জানতে চাই, রাসুলুলল্লাহ ﷺ কি মহিলাদেরকে নিয়ে গাজওয়া’য় (জিহাদে) যেতেন? এবং তিঁনি কি তাদেরকে গণীমতের অংশ দিতেন? ………………। তখন ইবনে আব্বাস রা. তাকে লিখলেন: তুমি পত্র লিখে আমার কাছে জানতে চেয়েছো, রাসুলুল্লাহ ﷺ কি নারীদেরকে নিয়ে যুদ্ধে যেতেন? (এর উত্তর হল: হ্যাঁ) তারা (কেউ কেউ) তাঁর সাথে যুদ্ধে যেতো। তারা (সেখানে) আহতদের সেবা করতো। (আর এজন্য) তাদেরকে ‘গনীমতের মাল’ থেকে পুরষ্কার (স্বরূপ কিছু) দেয়া হত (বটে), তবে গণীমতের ভাগ সম্পর্কে কথা এই যে, তিনি (গণীমতের নিয়মানুগ অংশে) তাদের জন্য বরাদ্দ রাখতেন না।………….”[সহিহ মুসলীম- ১/১৪৪৪ হাদিস ১৮১২; মুসনাদে আহমদ- ৪/২৯১; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ২৭২৭, ২৭২৮; সুনানে নাসায়ী, হাদিস ৪১৩৪; সুনানে তিরমিযী, হাদিস ১৫৫৬; মুসনাদে আবু আউয়ানাহ- ৪/৩৩৬ হাদিস ৬৮৯০]

এখন ভেবে দেখার বিষয়, যে ‘দ্বীন ইসলাম’ মুসলিম নারীর ‘পবিত্রতা ও ‘ইজ্জত আব্রু’কে যথাসম্ভব হিফাজতের উদ্দেশ্যে স্থানে স্থানে এত গুরুত্ব দিয়েছে যে, দ্বীনের বড় বড় আরকান, শিয়ার ও হুকুম’কে পালনের দায়িত্ব থেকেও অব্যাহতি দেয়া হয়েছে, সেই দ্বীন সম্পর্কে একথা কি করে চিন্তা করা যেতে পারে যে, সে নারীকে এমন বড় অভিভাবকত্বের কোনো পদের দায়িত্ব সোপর্দ করে দিবে, যে দায়িত্ব পালনের জন্য তাকে বারবার বাড়ির বাহিরে পুরুষদের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিবে এবং যখনতখন পুরুষদের সাথে উঠাবসা পুরুষদের সাথে কথাবার্তা পুরুষদের সাথে চলাফেরা ও তর্কবিতর্ক করে বেরাতে হবে?! সেই দ্বীন সম্পর্কে একথা কি করে চিন্তা করা যেতে পারে যে, যেসব কাজের দায়িত্ব নারীর উপরে ব্যাক্তি-পর্যায়গত ভাবেও আরোপিত হবার নয়, ওই সমস্ত কাজ সে পুরুষদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংঘবদ্ধভাবে করার জন্য নারীর দায়িত্বে ন্যস্ত করে দিবে?! 

দু’জাহানের সর্দার রাসুলে করীম ﷺ-এর যুগ থেকে নিয়ে খুলাফায়ে রাশেদীন, বরং ‘খুলাফায়ে রাশেদীনের পরেও কয়েক যুগ পর্যন্ত মুসলমানদের ‘খলিফা ও হাকেম (শাসক) নির্বাচন করা এবং প্রয়োজনে অতিরিক্ত কাজী (বিচারক) নিয়োগ দানের বিষয়টি উম্মাহর একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অঙ্গোন পরিগ্রহ করে রেখেছিল, যারা শরীয়থ মোতাবেক বিচার ফয়সালার দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়েছিলেন। কোথায় কে বিচার ফয়সালার দায়িত্ব পালন করবে -এ বিষয়টি খিলাফতের ভিতরে বারবার সামনে এসেছে। সে যুগে এমন অসংখ্য মুসলিম নারী অবশ্যই বিদ্যমান ছিলেন, যারা তাদের ইলম, ফজল, পবিত্রতা, পরহেজগারী ও বিবেক-বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে অনন্য পর্যায়ের অধিকারী ছিলেন, যা হয়তো আমাদের এ যুগে কল্পনাও করতে পারবো না, কিন্তু তাদের মধ্যে কোনো নারীকে কখনই যে কাজী (বিচারক) বানানো হয়নি- ব্যাপার শুধু সেটাই নয়, বরং তখন কারোর পক্ষ থেকে নিম্ন স্তরের এমন কোনো মতামতও সামনে আসেনি যে, ‘অমুক নারীকে অমুক স্থানের কাজী (বিচারক) বানানো হোক’। না কোনো হাদিসে, না কোনো ইতিহাসের কিতাবে এরকম মতের কোনো অস্তিত্ব মেলে। এটা একথারই সুস্পষ্ট দলিল যে, এ ব্যপারে প্রতি যুগের মুসলমানদের সামনে কুরআন-সুন্নাহ’র আহকাম এতটাই পরিষ্কার ছিল যে, কখনো কোনো মুসলমানের অন্তরে কোনো নারীকে কাজী (বিচারক) বানানোর সামান্য খেয়ালটুকু পর্যন্ত আসেনি। আর আসবেই-বা কেমন করে, যখন দ্বীন ইসলামে এমন কোনো হাকেম/কাজী (বিচারক)-এর কথা কল্পনাও করা যায় না-

  • যে হাকেম/কাজী (বিচারক)-এর জন্য বাড়ির সীমানার মধ্যে থাকাটাই (নারী-পুরুষের) ফেতনা থেকে বাঁচার মূল উপায়।
  • যে হাকেম/কাজী (বিচারক)-এর জন্য শরীয়ত সম্মত হাজত/প্রয়োজন ছাড়া তার নিজ গৃহ থেকে বাইরে বের হওয়া জায়েয নয়।
  • যে হাকেম/কাজী (বিচারক)-এর জন্য বিনা প্রয়োজনে পরপুরুষের সাথে অযথা কথাবর্তা বলা জায়েয নয়। এমনকি কথা বলার প্রয়োজন হলে পর্দার আড়াল থেকে আকর্ষনীয় কোমল আওয়াজ পরিহার করে কথা বলতে হয়।
  • যে হাকেম/কাজী (বিচারক)-এর জন্য পুরুষদের সাথে একাকার হয়ে রাস্তা দিয়ে চলা জায়েয নয়। 
  • যে হাকেম/কাজী (বিচারক)-এর জন্য পুরুষদের মতো -রাস্তার মাঝ দিয়ে চলার হক্ব নেই, বরং তাকে পুরো পর্দা রক্ষা করে রাস্তার এক কিনারা ঘেঁষে চলতে হয়। 
  • যে হাকেম/কাজী (বিচারক)-এর জন্য মাহরাম সঙ্গে থাকা ছাড়া একাকি সফর করা জায়েয নয়।
  • যে হাকেম/কাজী (বিচারক)কে -স্বামী মড়ে গেলে/তালাক দিলে (স্বাভাবিক অবস্থায়) স্বামীর বাড়িতে (অবস্থা ও শর্ত ভেদে) তিন মাসিক কাল অথবা তিন মাস কিংবা বাচ্চা প্রসব না হওয়া পর্যন্ত ইদ্দত পালন করতে হয় এবং উদ্দত চলাকালীন সময়ে (শরয়ী ঠেঁকা ছাড়া) স্বামীর বাড়ির বাইরে বের হওয়া জায়েয নয়।
  • যে হাকেম/কাজী (বিচারক)-এর জন্য সুগন্ধি লাগিয়ে বা আকর্ষনীয় পোষাকে বা সাজগোঝ করে কোনো পরপুরুষদের সমাবেশে যাওয়া জায়েয নয়।
  • যে হাকেম/কাজী (বিচারক)-এর জন্য কোনো মসজিদে জামাআতের সাথে নামায আদায়ের চাইতে তার নিজ গৃহের অন্দর মহলে নামায আদায় অধিক কল্যানকর, যেখানে বেশি পর্দা পালন হয়।
  • যে হাকেম/কাজী (বিচারক)-এর জন্য মসজিদে জামাআতের সাথে নামায পড়তে হলে পুরুষদের কাতারে ঢুকে নামায আদায় করা কোনো অবস্থাতেই জায়েয নয়, বরং দাঁড়াতে হবে সকল পুরুষ মুসল্লিদের শেষ কাতারের পিছনের কাতারে নারীদের সাথে পূর্ণ পর্দা রক্ষা করে, তাও এমন ভাবে যে, কখনো ইমামের ভুলের লোকমা দিতে হলে তার জন্য কণ্ঠ ব্যবহার করে লোকমা দেওয়াও জায়েয নয় (লোকমা দিতে হবে হাতের উপরে হাত মেড়ে শব্দ করে)।
  • যে হাকেম/কাজী (বিচারক)-এর প্রত্যেক মাসে হায়েযের নাপাকী আসার কারণে শরীর পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত নিজের উপর নামায ফরয থাকে না, যে অবস্থায় তার জন্য কোনো মসজিদেই প্রবেশ করা পর্যন্ত জায়েয নয়, (সেখানে সে মসজিদে বিচার ফয়সালা করবে কী করে)!!!!
  • যে হাকেম/কাজী (বিচারক)-এর জন্য কোনো মুসলমানের জানাযার নামাযের ইমামতী করা করা জায়েয নয়। ইমামতী করা-তো পরের কথা, তার জন্য কোনো জানাযার পিছনে পিছনে চলারই অনুমতি নেই।   
  • যে হাকেম/কাজী (বিচারক)-এর উপর জুমআর নামায ফরয নয়।
  • যে হাকেম/কাজী (বিচারক)-এর উপর জিহাদ/কিতাল ফরয নয়।
  • যে হাকেম/কাজী (বিচারক)-এর ‘ভাত-কাপড়’ বিয়ের আগে পিতার উপর এবং বিয়ের পর স্বামীর উপর ওয়াজিব থাকে।
  • যে হাকেম/কাজী (বিচারক) নারী-পুরুষ কারোরই বিয়েতে ওলী (অভিভাবক) পর্যন্ত হতে পারে না।
  • যে হাকেম/কাজী (বিচারক)-এর সর্বোচ্চ গন্ডি সীমা তো এই যে, সে খোদ্ তার নিজ ঘরেও ‘ঘর প্রধান’ হওয়ার আসনটুকুও লাভ করে না। 

দ্বীন ইসলাম তামাশা করার জন্য আসেনি। দ্বীন ইসলাম যে জন্য এসেছে, তা সুগঠিত ভাবে কায়েম করার জন্য সে এমন কাউকে খুঁজে, যার মধ্যে উপরোক্ত একটি দূর্বলতাও নেই। এই যে সামনে ইমাম মাহদী রা. এবং ঈসা ইবনে মারইয়াম আ. আসছেন, যারা পৃথিবী শাসন ও বিচার ফয়সালা করবেন কুরআন-সুন্নাহ’র আলোকে, তাঁরাও হবেন পুরুষ। এগুলো কি প্রমাণ করে না যে, দ্বীন ইসলামে নারীকে খলিফা/আমীর/হাকেম/কাযী বানানোর কোনো কল্পনাও কুরআন-সুন্নাহয় নেই এবং এই বিধান কেয়ামত সংঘটিত হওয়ার আগ পর্যন্ত যতদিন ইসলামী শরীয়ত ও মুসলীম উম্মাহ বিদ্যমান থাকবে ততদিন পর্যন্ত তা বলবৎ থাকবে!?

 এজাতীয় বিভিন্ন মজবুত দলিলাদির কারণে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর যুগ থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত নির্ভরযোগ্য সকল আহলে হক্ব ওলামায়ে কেরামের ইজমা (ঐক্যমত) রয়েছে যে, ইসলামী শরীয়তে কোনো নারীকে মুসলমানদের হাকেম/কাজী (বিচারক) বানানো এবং সংশ্লিষ্ট নারীর তা হওয়া -সম্পূর্ণ নাজায়েয়।

ইমাম আবু মুহাম্মাদ হুসাঈন বিন মাসউদ বগভী (মৃ: ৫১৬ হি:) রহ. লিখেছেন–  اتفقوا على أن المرأة لا تصلح أن تكون إماماً ولا قاضياً – “এব্যাপারে আলেমগণ একমত যে, নারীকে (মুসলমানদের) ইমাম (খলিফা/শাসক) বানানোও জায়েয নেই, কাজী (বিচারক) বানানোওজায়েয নেই” [শারহুস সুন্নাহ, ইমাম বাগাভী- ১০/৭৭]

ইমাম আবু ওয়ালীদ আল-বাজী (মৃ: ৪৭৪ হি:) রহ. লিখেছেন– ويكفي في ذلك عمل المسلمين من عهد النبي صلى الله عليه وسلم لا نعلم أنه قدم امرأة لذلك في عصر من الأعصار ولا بلد من البلاد، كما لم يقدم للإمامة امرأة – “এর প্রমাণ হিসেবে এতটুকুই যথেষ্ট যে, রাসুলুল্লাহ -এর জামানা থেকে মুসলমানদের আমল চলে আসছে। আমরা কখনও শুনিনি যে, তিনি তাঁর জীবনের কোনো একটি মুহূর্তেও কোনো নারীকে এতগুলো অঞ্চলের মধ্যে কোনো একটি অঞ্চলেও কাজী (বিচারক) হিসেবে নিয়োগ দেয়ার পদক্ষেপ গ্রহন করেছেন। একইভাবে তিনি কখনই কোনো নারীকে ইমাম (শাসক) হিসেবেও নিয়োগ দেননি”। [আল মুনতাক্বা শারহুল মুআত্তা, ইমাম বাজী- ৫/১৮২]

ইমাম ইবনে কুদামা (মৃ: ৬২০ হি:) রহ. লিখেছেনولا تصلح للإمامة العظمى ولا لتولية البلدان ولهذا لم يول النبي صلى الله عليه وسلم ولا أحد من خلفائه ولا من بعدهم امرأة قضاء ولا ولاية بلد فيما بلغنا، ولو جاز ذلك لم يخل منه الزمان غالبا  – “কোনো নারীকে -না ইমামে আজম (খলিফা/রাষ্ট্রপ্রধান) বানানো জায়েয, আর না কোনো অঞ্চলের প্রশাসক বানানো জায়েয। এজন্যই দেখা যায়, ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানা যেসকল অঞ্চল পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছিল, তার কোথায়ও -না রাসুলুল্লাহ , না আমাদের খুলাফায়ে রাশেদীনের মধ্যে কেউ, আর না তাদের পরবর্তী তে কেউ কোনো নারীকে কাজী (বিচারক) বানিয়েছিলেন, না কোনো অঞ্চলের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। যদি একাজ জায়েয হতই, তাহলে সেই জামানায় আমরা তার কোনো ঝলক অবশ্যই দেখতে পেতাম”।[আল মুগনী, ইবনে কুদামা- ১০/৯২]

আর হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেন إِنَّ اللَّهَ لَا يَجْمَعُ أُمَّتِي عَلَى ضَلَالَةٍ – وصححه الألباني في “صحيح الترمذي“নিশ্চই আল্লাহ আমার উম্মতকে পথভ্রষ্ঠতার উপর ইজমাবদ্ধ/ঐক্যবদ্ধ করবেন না”। [সুনানে তিরমিযী, হাদিস ২১৬৭; মুসতাদরাকে হাকিম- ১/১৯৯, ২০১, হাদিস ৩৯১, ৩৯৭; আল-মু’জামুল কাবির, ত্বাবরানী-৩/২৯২, ১২/৪৪৭, হাদিস ৩৪৪০, ১৩৬২৩; সুনানে আবু দাউদ-২/৫০০ , হাদিস ৪২৫৩; মুসনাদে আহমাদ-৫/১৪৫, হাদিস ২১৩৩১; সুনানে ইবনে মাজাহ- ২/১৩০৩, হাদিস ৩৯৫০; মুসনাদে আব্দ বিন হুমায়েদ- ১/৩৬৭, হাদিস ১২২০; হিলইয়া, আবু নুআইম- ৩/৩৭; আল-মুসান্নাফ, ইবনে আবি শায়বা- ৭/৪৫৭]  যারাই এই বিধানের বিপক্ষে অবস্থান করবে, তারাই পথভ্রষ্ঠ, কুরআন-সুন্নাহ’র বিরোধী, মুসলীম উম্মাহ’র বিরোধী। 

وَمَنْ يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّى وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيرًا
“আর যে ব্যাক্তির কাছে আল-হুদা (সঠিক পথ) প্রতিভাত হয়ে যাওয়ার পরও রাসুলের বিপক্ষে অবস্থান নেয় এবং ইমানদারেগণের পথ ভিন্ন অন্য পথের অনুসরণ করে, সে যেদিকে মুখ ফিরিয়েছে আমরা তাকে সেদিকেই ফিরিয়ে দিবো এবং তাকে জাহান্নামে দগ্ধ করবো। আর (সেটা কতই-না) নিকৃষ্ট গন্তব্যস্থল”। [সূরা নিসা ১১৫]
 
এজন্য মুসলীম সমাজের উপর ফরয হল, তারা তাদের উপরে কাজী (বিচারক) হিসেবে নিয়োগ দান করবে একজন (মুসলীম) পুরুষকে (যিনি এই পদের সবচাইতে উপযুক্ত)। এটাই হবে খিলাফতের মতো আমানতকে তার উপযুক্ত ব্যাক্তির হাতে সোপর্দ করা। إِنَّ اللهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا –‘নিশ্চই আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন, তোমরা আমানতগুলিকে তার (স্ব-স্ব) উপযুক্ত ব্যাক্তির কাছে সোপর্দ করে দিবে’[সুরা নিসা ৫৮]

কিন্তু (শরীয়ত সম্মত কোনো ওজর ছাড়া) যে ব্যাক্তি এই আমানতকে কোনো নারীর হাতে সোপর্দ করবে, সে হবে এই আমানতের এমন এক খিয়ানতকারী যে আল্লাহ তাআলার সাথে, তাঁর রাসুল -এর সাথে, মুসলমানদের সাথে এবং দ্বীন ইসলামের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা (মিরজাফরী) করেছে।

ইসলামী শরীয়তের এই ইজমায়ী মাসআলার বিপরীতে-

(ক)  ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে যেহেতু রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে ধর্মীয় বিধানকে ১০০% মুক্ত করায় বিশ্বাস (ইমান) রাখা অত্যাবশ্যক (ফরয) শর্ত, তাই কাজী (বিচারক) নিয়োগ দানের ক্ষেত্রেও ইসলাম ধর্মের এই ‘পুরুষ কাজী (বিচারক)’ হওয়ার শর্তটিকে রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে ১০০% মুক্ত করায় বিশ্বাস (ইমান) রাখা তাদের মতে অত্যাবশ্যক (ফরয)।

(খ) ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে যেহেতু  রাষ্ট্রযন্ত্রে কোনো ধর্মীয় বিধিবিধানকে টেনে আনা ১০০% নিষিদ্ধ (হারাম), তাই কাজী (বিচারক) নিয়োগ দানের ক্ষেত্রেও ইসলাম ধর্মের এই ‘পুরুষ কাজী (বিচারক)’ হওয়ার শর্তটিকে রাষ্ট্রযন্ত্রে টেনে আনাও তাদের মতে ১০০% নিষিদ্ধ (হারাম)।

(গ)  ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ যেহেতু বিশ্বাস করে-যে ব্যাক্তিধর্মীয় বিধিবিধানকে রাষ্ট্রব্যাবস্থায় টেনে আনায় বিশ্বাসী সে আদপে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদেই বিশ্বাসী নয় বরং অস্বীকারকারী (কাফের), তাই যে ব্যাক্তি কাজী (বিচারক) নিয়োগ দানের ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্মের এই ‘পুরুষ কাজী (বিচারক)’ হওয়ার শর্তটিকে রাষ্ট্রযন্ত্রে টেনে আনায় বিশ্বাসী, তাদের মতে সেও আদপে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে বিশ্বাসীই নয় বরং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে অস্বীকারকারী (কাফের)।

(ঘ) উপরোক্ত এই ৩টি পয়েন্টের এব্যাপারে খাঁটি ধর্মনিরপেক্ষতা বাদীদেরর ইজমা(ঐক্যমত) রয়েছে।

পুরুষ ও নারী যতদিন পর্যন্ত তাদের উপর আল্লাহ’র আরোপিত স্ব-স্ব দায়িত্বগুলিকে পালন করবে ততদিন দ্বীন-দুনিয়ার ফিতরাতী-নেজাম (স্বাভাবিক ব্যবস্থাপনা) সবকিছুই সুষ্ঠুভাবে চলবে। অপরদিকে পুরুষরা যখন নারীদের দায়িত্ব গ্রহন করবে এবং নারীরা পুরুষের দায়িত্ব গ্রহন করে সব এলোমেলো করে দিবে, তখন তারা দ্বীন-দুনিয়ার ফিতরাতী-নেজাম (স্বাভাবিক ব্যবস্থাপনা)-কে নষ্ট করে দেয়ার কারণে জীবনের সকল ক্ষেত্রে ফিতনা-ফ্যাসাদের দ্বার উন্মুক্ত করে দিবে। এদিকে ইশারা করেই আবু হুরায়রাহ রা. -এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে,  রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেন- إِذَا كَانَ أُمَرَاؤُكُمْ خِيَارَكُمْ وَأَغْنِيَاؤُكُمْ سُمَحَاءَكُمْ وَأُمُورُكُمْ شُورَى بَيْنَكُمْ فَظَهْرُ الأَرْضِ خَيْرٌ لَكُمْ مِنْ بَطْنِهَا وَإِذَا كَانَ أُمَرَاؤُكُمْ شِرَارَكُمْ وَأَغْنِيَاؤُكُمْ بُخَلاَءَكُمْ وَأُمُورُكُمْ إِلَى نِسَائِكُمْ فَبَطْنُ الأَرْضِ خَيْرٌ لَكُمْ مِنْ ظَهْرِهَا ‏. رواه الترمذي في سننه : رقم ٢٢٦٦ و قال الترمذي: هذا حديث غريب لا نعرفه إلا من حديث صالح المري، وصالح المري في حديثه غرائب ينفرد بها لا يتابع عليها وهو رجل صالح، و البزار في البحر الزخار : ١٧/٢٠ رقم ٩٥٢٩، و ابن جرير ألطبري في تهذيب الآثار: ١/١٦٦ رقم ١٥٣، أبو نعيم في الحلية : ٦/١٧٦، و أبو عمرو الداني في السنن الواردة في الفتن: ١/١٠٦ رقم ٣٠٣ ، و ضعف الشيخ الألباني هذا الحديث في السلسلة الضعيفة : رقم ٦٩٩٩ و في ضعيف سنن الترمذي যখন তোমাদের উৎকৃষ্ট লোকগুলি তোমাদের আমীর (প্রশাসক) হবে, তোমাদের ধ্বনবান লোকগুলি তোমাদের দানশীলরাই হবে এবং তোমাদের বিষয়আশয়গুলি তোমাদের মাঝে পরামর্শের মাধ্যমে সম্পাদিত হবে, তখন জমিনের উপরিভাগ তোমাদের জন্য জমিনের গহবর থেকে উত্তম হবে। আর যখন তোমাদের নিকৃষ্ট লোকগুলি তোমাদের আমীর (প্রশাসক) হবে, তোমাদের ধ্বনবান লোকগুলি তোমাদের কৃপণরাই হবে এবং তোমাদের বিষয়গুলিকে তোমাদের নারীদের হাতে সোপর্দ করা হবে, তখন জমিনের গহবর তোমাদের জন্য জমিনের উপরিভাগ থেকে উত্তম হবে”। [সুনানে তিরমিযী- ২/৪২, হাদিস ২২৬৭; মুসনাদে বাযযার- ১৭/২০ হাদিস ৯৫২৯; তাহযীবুল আছার, ইমাম ত্বাবারী- ১/১৬৬ হাদিস ১৫৩; সুনানুল ওয়ারিদাহ, ইমাম দানী- ১/১০৬ হাদিস ৩০৩; তারিখে বাগদাদ, খতীব– ২/৫৮৭; হিলইয়াতুল আউলিয়াহ, আবু নুআইম- ৬/১৭৬; আল-উকুবাত, ইবনু আবিদ্দুনিয়া, হাদিস ২৭৯]

এই হাদিসে এমন যুগের কথা বলা হচ্ছে, যখন -ইসলামী শরীয়ত যেসকল পদের দায়িত্ব পালনের ভার মুসলীম পুরুষদের কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছে- দেখা যাবে যে, সে যুগে উম্মাহ’র একটি গোষ্ঠি ওসকল পদের দায়িত্ব নারীদের হাতে সোপর্দ করতে থাকবে, যার পরিণতিতে এমন সমাজ তৈরী হতে থাকবে যেখানে মুমিন নারী-পুরুষের জন্য ইমান নিয়ে চলাটা এত কঠিন হয়ে পড়বে যে, তাদের জন্য জীবিত থাকার চেয়ে মড়ে কবরে চলে যাওয়াটাই ইমান হিফাজতের প্রশ্নে অধিক নিরাপদ বিবেচিত হবে। বস্তুতঃ ‘নারী-স্বাধীনতা’, ‘নারী-পুরুষের সম অধিকার’, ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ ইত্যাদির নামে আজ উম্মাহ যা কিছু শুরু করে দিয়েছে, তা এই হাদিসেরই বাস্তব রূপ। আর এখন-তো এমপি, মন্ত্রী, প্রধান স্পিকার, সরকারী বিভিন্ন প্রশাসনিক পদ, শহর গ্রামের চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর, মেয়র, আর্মী-র‌্যাব-পুলিশ-ট্রাফিক-সিকিউরিটি গার্ড, শো-রূম, মার্কেট-দোকানপাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মিডিয়া, এনজিও -এমন কোনো স্থান নেই, যেখানে দায়িত্বগুলোকে নারীর হাতে সোপর্দ করা হচ্ছে না। তাই বিনা-দ্বিধায় বলা যায়, হাদিসটির ভবিষ্যতবাণী আমাদের এই শেষ জামানার দিকেই ইংগীত করে করা হয়েছিল। নিচের বর্ণনাটি আমার এই দাবীকে আরো পরিষ্কার করে দেয়।

আরেক রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে, আলী রা. বর্ণনা করেছেন- ليأتين على الناس زمان؛ يطرى فيه الفاجر، ويقرب فيه الماحل، ويعجز فيه المنصف، في ذلك الزمان تكون الأمانة فيه مغنمًا، والزكاة فيه مغرمًا، والصلاة تطاولًا، والصدقة منا، وفي ذلك الزمان استشارة الإماء، وسلطان النساء، وإمارة السفهاء . رواه ابن المنادي كما جاء في جامع الأحاديث لجلال الدين السيوطي : ٣٢/٦١ رقم ٣٤٧١٢ ; و في إتحاف الجماعة بما جاء في الفتن والملاحم وأشراط الساعة : ٢/٣٨ ; اورده المتقي في كنز العمال : ١٤/٥٧٥ رقم ٣٩٦٤١  – ‘মানুষের উপরে অবশ্যই এমন জামানা আসবে, যখন ফাজের (পাপঘেঁষা খবিস কিসিমের) ব্যাক্তির (অমূলক) প্রশংসা করা হবে, প্রতারককে কাছে রাখা হবে, ইনসাফগার ব্যাক্তিকে (সামাজিক ভাবে) কোণঠাসা করে দেয়া হবে। ওই জামানায় এমন হবে যে, তখন (মানুষজনের দ্বীনদারিত্ব না থাকায় তাদের কাছে) আমানত হয়ে যাবে গণীমত (স্বরূপ, যা তারা নিজেদের ব্যাক্তিগত সম্পর্দের মতো ভোগ করবে। তাদের মধ্যে মুনাফেকী, বদদ্বীনীতা ও ভোগবাদীতা জেঁকে বসার কারণে শরীয়তে ফরযকৃত) যাকাত (-কে তাদের কাছে মনে) হবে জরিমানা (স্বরূপ), নামায হবে দীর্ঘায়িত (তবে অন্তসারশুন্য অথবা বারাবারি মূলক), (তারা যাও-বা কিছু) দান-সদকাহ (করবে, তা) হবে খোঁটাদানমূলক। সেই জামানায় বাদীর কাছে পরমর্শ চাওয়া হবে, নারী সুলতান (রাষ্ট্রপ্রধান) হবে এবং মন্ত্রীরা হবে নির্বোধ’। [ইবনু মুনাদী: আল-জামেউল কাবির, ইমাম সুয়ূতী- ৩২/৬১ হাদিস ৩৪৭১২; কানজুল উম্মাল- ১৪/৫৭৫ হাদিস ৩৯৬৪১; ইতহাফুল জামাআহ – ২/৩৮]

যেমন আমরা উপরে প্রমাণ এসেছি যে, ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে ‘নারী’  কাজী (বিচারক) পদটির ‘আহাল (যোগ্যতা সম্পন্ন)’ নয়, বরং গায়রে-আহাল (অযোগ্য), বিধায় ইসলামী শরয়তে নারী-কাজী (বিচারক) সম্পূর্ণ রূপে নাজায়েযশরীয়তের এই বিধানটিকে পালনার্থে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর বরকতময় যুগ থেকে শুরু করে নিয়ে গত ১৯২০ ইং সালে তুরষ্কের উসমানী খিলাফত ধ্বংসের আগ পর্যন্ত ইসলামী শাসনের সুদীর্ঘ প্রায় ১৪৫০ বছরের ইতিহাসে কোনো দ্বারুল ইসলামের মুসলমানরা কোনো দিন কোনো নারীকে তাদের হাকেম/কাজী (বিচারক) বানানোর কথা কল্পনাও করেনি, ফরে বাস্তবেও মুসলমানদের উপরে কোনো নারী-হাকেম/কাজী ছিল না। কিন্তু গত ১৯২০ ইং সালের পর দেশে দেশে ইসলামী শরীয়তের আইন কানুনগুলোকে রাষ্ট্র থেকে বিলুপ্ত করার যুগ শুরু হয় এবং আইনকানুনেরে মধ্যে গণতন্ত্র (democracy), ধর্মনিরপেক্ষতা (secularism) অথবা সমাজতন্ত্র (socialism) বা কমিউনিজমের রং বসা শুরু হয়। এর ক্রমধারায় ইসলামী শরীয়তের ‘মুসলমান-হাকেম/কাজী হওয়ার বিধানটি বাতিল হওয়ার সাথে সাথে পুরুষ-হাকেম/কাজী (বিচারক)’ হওয়ার শরয়ী বিধানটিও বাতিল হয়ে যায়। এ থেকে বোঝা গেল, উপরের ভবিষ্যৎবাণীটি আমাদের এই শেষ জামানার দিকে ইশারা করেই করা হয়েছে।

কতই না ভাল হত, যদি কমপক্ষে মুসলিম বলে পরিচিত নারীরা বিশ্বাস করতে পারতো যে, আল্লাহ তাআলা তাদের উপরে পুরুষদের চাইতে কম দায়িত্ব অর্পণের মাধ্যমে জান্নাতে যাওয়ার পথকে সহজ করে দিয়েছেন, আর কতই না ভাল হত যদি এযুগের ব্রেনওয়াশড নারীরা তাদের প্রভু আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসুল কে এসব ব্যাপারে তাদের সাথে -প্রতারনা বা পক্ষপাতিত্ব- করেছেন মর্মে বিশ্বাস না করতো। যদি তারা বুঝতো, তাহলে আল্লাহ’র কসম, তাদের জন্য এবং তারা যে দুনিয়ায় বাস করে তার জন্য ভাল হত। কিন্তু আজ এমন এক যুগে বাস করছি, যখন সাদা চামড়ার ওই শয়তান রাজনীতিকদের ফাঁদে পা দিয়ে প্রতিটি দেশে দেশে সুলতানা কামাল তৈরী হয়েছে ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ স্লোগানের ইমামতী করার জন্য, আর তাদের পিছনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এক্বতেদা করেছে কোটি কোটি নারী, যারা কমোড় বেঁধে নেমেছে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল -এর বিরুদ্ধাচারন করার ভিশন নিয়ে। মনে হয়, আমাদের এই আখেরী জামানার এইসব নারীদের আল্লাহদ্রোহিতার দিকেই ইশারা করেই এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ ভবিষ্যদ্বাণী এভাবে বর্ণিত হয়েছে- كيف بكم – أيها الناس! – إذا طغى نساؤكم، وفسق فتيانكم؟ قالوا: يا رسول الله! إن هذا لكائن؟! قال: نعم، وأشد منه – ‘হে লোকসকল! তখন তোমাদের কেমন অবস্থা হবে যখন তোমাদের নারীরা তাগুত (আল্লাহদ্রোহি) হয়ে যাবে এবং তোমাদের ছেলেরা ফাসেক (পাপঘেঁষা/পাপে অভ্যস্ত) হবে যাবে? (উপস্থিত লোকরা (অবাক হয়ে) বললো: ইয়া রাসুলাল্লাহ ! এমন ঘটনাও ঘটবে !!! রাসুলুল্লাহ সা. বললেন: হা, এর চেয়েও কঠিন অবস্থা হবে।… [মুসনাদে আবু ইয়া’লা ১৪/৩০৪; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাইসামী-৭/২৮০; মু’জামে আউসাত, ত্বাবরাণী-৯/১২৯, হাদিস ৯৩২৫; ইবনে আবিদ্দুনইয়া, হাদিস ৭৯]

 


>>> মূল সূচিপত্র (index) থেকে এ পেজের পূর্ববর্তী বা পরবর্তী আলোচনা পড়তে [এখানে ক্লিক করুন]