ইসলামে বিচারক (কাজী) মুসলিম হওয়া শর্ত vs ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ

ইসলামী শরীয়তে মুসলমানদের উপরে বিচারক (কাজী) মুসলিম হওয়া জরুরী শর্ত vs ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে প্রকাশ্য শরীয়ত বিরোধীতা ও কুফর


>>> মূল সূচিপত্র (index) থেকে এ পেজের পূর্ববর্তী বা পরবর্তী আলোচনা পড়তে [এখানে ক্লিক করুন] 


 
পূর্ব আলোচনার পর…
 
আমাদের ইতিপূর্বে উল্লেখীত ধর্মনিরপেক্ষতা’র  ১ নং বৈশিষ্ট অনুযায়ী যেহেতেু— “রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে ধর্মকে ১০০% আলাদা রাখায় বিশ্বাস করা ধর্মনিরপেক্ষতা’র সর্ব প্রধান শর্ত ও ভিত্তিযেটাকে তারা বলে থাকে Separation of religion and state(ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে বিভাজন)”, তাই একটি দেশকে  Secular State (ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র) বানানোর  ক্রমধারায় রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ (Judicial Division) -এর আওতাধীন কোনো বিচারক নিয়োগ দানের ক্ষেত্রেও তার নূন্যতম যোগ্যতাগুণ কী কী হবে -তার মাপকাঠি নির্ধারনের বিধান থেকেও ধর্মকে ১০০% ছেটে ফেলে দেয়ায় বিশ্বাস করা অবশ্যই ধর্মনিরপেক্ষতা’র প্রধান শর্তের অংশ। 
 
সেখানে আমরা বিষয়টিকে খোলাসা করতে গিয়ে এভাবে উল্লেখ করেছিলাম—–“ধর্মনিরপেক্ষতা মতবাদটি বিশ্বাস করে, (ক) রাষ্ট্রে বিচার বিভাগ (Judicial Division)-এর আওতাধীন যে কোনো বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে তার নূন্যতম যোগ্যতাগুণ কী কী হবে -তার মাপকাঠি নির্ধারনের ক্ষেত্রে যে কোনো ধর্মীয় বিধিবিধানকে ১০০% দূরে রাখা অত্যাবশ্যক শর্ত (ফরযে আইন)।…………..। অন্যকথায়, ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী বিচারক  নিয়োগ দান করার নূন্যতম অপরিহার্য যোগ্যতাগুণ গুলোকে ১০০% প্রত্যাক্ষান করা, অস্বীকার করে সম্পূর্ণ ধর্মমুক্ত দৃষ্টিতে এসব নির্ধারণ করা ধর্মনিরপেক্ষতা’র অন্যতম প্রধান শর্তের অন্তর্ভূক্ত
 
এবারে আমারা বিস্তারিত আলোচনা করবো, রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ (Judicial Division) -এর আওতাধীন কোনো বিচারক নিয়োগ দানের ক্ষেত্রে তার নূন্যতম কোন্ কোন্ যোগ্যতাগুণ নির্ধারনে ইসলামী আইন মানতে নাক ছিটকায় –ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। তবে তার আগে সংক্ষেপে দেখে নেই, একটি ইসলামী রাষ্ট্রে একজন বিচারক হতে হলে কী কী নূন্যতম যোগ্যতাগুণ থাকা অপরিহার্য।
 
ইসলামে ‘বিচারক (কাজী)’ পদটি আল্লাহ’র দেয়া একটি আমানত, আর আমানত আদায় ইবাদত বিধায় এই ইবাদতটিও আল্লাহ’র নাজিলকৃত বিধান মোতাবেক বাস্তবায়ীত করতে মুসলমানরা নির্দেশিত 

আল্লাহ তাআলা ‘আমানত’ সম্পর্কে এরশাদ করেন-

….إِنَّا عَرَضْنَا الْأَمَانَةَ عَلَى السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَالْجِبَالِ فَأَبَيْنَ أَنْ يَحْمِلْنَهَا وَأَشْفَقْنَ مِنْهَا وَحَمَلَهَا الْإِنْسَانُ 

 ‘নিশ্চই আমি ‘আল-আমানত’কে আসমানসমূহ, জমিন ও পর্বতমালার সামনে  পেশ করেছিলাম। তখন তারা তা বহন করতে অপারগতা প্রকাশ করলো এবং সকলে এতে ভীত হয়ে গেল। আর একে গ্রহন করে নিলো মানুষ…..’।[সুরা আহযাব ৭২]

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা, হযরত মুজাহিদ, হাসান বসরী, সাঈদ বিন যুবায়ের, যিহহাক, কাতাদাহ রহ. প্রমূখ থেকে ‘আমানত’- কথাটির যে সকল তাফসীর বর্ণিত হয়েছে তার সারমর্ম আদপে একই, অর্থাৎ আয়াতে বর্ণিত ‘আমানত’ বলতে বোঝাবে “আল্লাহ’র দ্বীন ও শরীয়ত পালনের দায়দায়িত্ব, যা তাঁর নাজিলকৃত সকল আদেশ নিষেধ ও উপদেশকে অন্তর্ভূক্ত করে”।[জামেউল বায়ান, ইমাম তাবারী- ২০/৩৩৬; তাফসীরুল কুরআন, ইমাম ইবসে কাসির-৬/৪৮৮; আল-জামে লি আহকামিল কুরআন, ইমাম কুরতুবী-১৪/২৫২; ফাতহুল কাদীর, ইমাম ইবনুল হুমাম- ৪/৪৩৭আল্লাহ তাআলা এই আমানতকে কেবলমাত্র তাঁরই হুকুম অনুসারে সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে পালন করার জন্য মানুষকে দুনিয়ায় তাঁর খলিফা (প্রতিনিধি) করে পাঠিয়েছেন। আর ইসলামী বিচার ব্যবস্থা আল্লাহ তাআলার দ্বীন ইসলামের একটি অতপ্রত শরয়ী জরুরী অংগ (যার আলোচনা আমরা ইতিপূর্বে করে এসেছি) বিধায় ‘ইসলামী বিচার ব্যবস্থা’ও সন্দেহাতীতভাবে উপরোক্ত আয়াতে বর্ণিত ‘আমানত’-এরই একটি অংশ, যার মধ্যে খিয়ানত করা হারাম। আর আল্লাহ তাআলা ‘আমানত’ সম্পর্কে আরো এরশাদ করেন-

إِنَّ اللهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا 
‘নিশ্চই আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন, তোমরা আমানতগুলিকে তার (স্ব-স্ব) আহাল (তথা উপযুক্ত ব্যাক্তি)র কাছে সোপর্দ করে দিবে’[সুরা নিসা ৫৮]

এখন প্রশ্ন হল, ইসলামী শরীয়ত মোতাবেক বিচার কার্য সম্পাদনের মতো এত বড় গুরুত্বপূর্ণ ‘আমানত’টিকে কোন্ যোগ্যতাগুণের অধিকারী ব্যাক্তির হাতে সোপর্দ করে দিতে ইসলাম নির্দেশ দেয়, যাতে এর দায়িত্বভার তার আহাল বা উপযুক্ত ব্যাক্তির স্কন্ধে থাকে এবং এ আমানতের খিয়ানত না হয়ে যায়? 

জি হ্যাঁ, ইসলামী শরীয়ত দেখিয়ে দিয়েছে -ইসলামী রাষ্ট্রে একজন বিচারক (কাজী)-এর কী কী যোগ্যতাগুণ থাকা জরুরী। কিন্তু এসবের বিস্তারিত আলোচনা দলিল সহ উপস্থাপন করা এই ক্ষুদ্র পরিসরে সম্ভব নয়ও নয়, স্থানও এটি নয়। কুরআন হাদিস সুন্নাহ ও ফিকহী বিধিবিধানগুলোর আলোকে দেখা যায়, ইসলামী রাষ্ট্রের একজন বিচারক (কাজী) হতে হলে তার মধ্যে নিম্নোক্ত যোগ্যতাগুণ গুলো থাকা আবশ্যক। যথা:- 

(১) মুসলিম হওয়া (অমুসলিম কাফের/মুরতাদ না হওয়া)
(২) পুরুষ হওয়া (নারী না হওয়া)
(৩) স্বাধীন হওয়া (কারোর গোলাম/দাস না হওয়া)
(৪) বালেগ/প্রাপ্তবয়ষ্ক হওয়া
(৫) বিবেক/জ্ঞানবোধ থাকা (পাগল/মিস্তিষ্কবিকৃত না হওয়া)
(৬) বিচার কার্য সম্পাদনের মতো পর্যাপ্ত দ্বীনী ইলম থাকা
(৭) আদল-ইনসাফ’কারী হওয়া
 
যারা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের দাবী-দাওয়া ও চাওয়াপাওয়া সম্পর্কে জানাশোনা রাখেন, তারা জানেন যে, বিচারক হওয়ার ক্ষেত্রে উপরোক্ত মৌলিক যোগ্যতাগুণ গুলোর মধ্যে ৪ নং থেকে ৭ নং যোগ্যতাগুণের উপরে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের আঙ্গুল তোলার তেমন কিছু নেই, কারণ ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরাও চায় যে তাদের ‘ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রপ্রধান’-এর মধ্যেও উক্ত নূন্যতম যোগ্যতাগুণগুলো থাকা দোষের কিছু নয় বরং থাকা উচিৎ বা অপরিহার্যই। আর ৩ নং যোগ্যতাগুণ তথা বিচারক একজন স্বাধীন ব্যাক্তি হওয়া তথা কারোর দাস/গোলাম না হওয়ার বৈশিষ্টটি ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী’দের চোখে তেমন প্রধান সমস্যা (!) নয়, কারণ এখন পৃথিবীতে ‘দাস/গোলাম’ প্রথাটি বিলুপ্তপ্রায় (তদুপরি ইসলামী শরীয়ত মতেও একজন গোলাম/দাস রাষ্ট্রপ্রধান না হতে পারার মতটি সর্বসম্মত নয়)। বাকি থাকলো, ১ নং এবং ২ নংযোগ্যতাগুণ দুটি, তথা একজন বিচারক (কাজী)-কে মুসলীমপুরুষ হতে হবে (অন্য কথায় কোন অমুসলিম বা কোনো নারী মুসলমানদের বিচারক হতে পারবে না)। মূলত: ইসলামী শরীয়তের নির্ধারিত এই দুটি যোগ্যতাগুণ এমন, যা একজন ‘খাঁটি ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী’ কোনো দিনই মন থেকে মেনে নিতে পারবে না। অন্য কথায়, একজন ‘খাঁটি ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী’ ব্যাক্তি আল্লাহ’র ও তাঁর রাসুলﷺ-এর নির্ধারণকৃত এই দুটি ইসলামী আইনকে ‘অন্যায্য’ বলে বিশ্বাস করে, আর এজন্যই সে এ আইনকে মানতে অস্বীকার করে এবং রাষ্ট্রে তা কায়েম হওয়াকেও প্রকাশ্য প্রত্যাখ্যান করে, যাকে আমরা আরবীতে ‘কাফের (অস্বীকারকারী/প্রত্যাখ্যানকারী)’ বলে থাকি।
 
এবারে আমরা নিচে এই ১ নং এবং ২ নংযোগ্যতাগুণকে কুরআন হাদিস ও ফিকহি দলিলের আলোকে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবো এবং তাতে দেখবো যে, “এই দুটি বিশেষ যোগ্যতাগুণ পৃথিবীর কোনো ব্যাক্তির মধ্যে পাওয়া না গেলে তার অন্য বাকি যতপ্রকার যোগ্যতাগুণই থাকুক না কেনো, ইসলামী শরীয়ত তাকে মুসলমানদের উপরে বিচারক বানানোর ক্ষেত্রে অযোগ্য সাব্যস্ত করেছেআর এই দুইটি যোগ্যতাগুণ এমন যা ইসলামকে ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা বৈশিষ্টের অধিকারী করে রেখেছে। বৈশিষ্ট ২টি হল-
 
(ক) বিচারক (কাজী) হবেন একজন মুসলীম
(খ) বিচারক (কাজী) হবেন একজন পুরুষ

(ক) বিচারক (কাজী) হবেন একজন মুসলিম

একথা সর্বজন বিদিত যে, যে কোনো কারখানার মালিক জেনেশুনে –তার কারখানা প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, পরিকল্পনা ও বিধি নিষেধেরবিরোধীকোনো ব্যাক্তিকে কখনই তার কারখানার সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনার সাথে জড়িত ছোট কোনো পদেও নিয়োগ দিতে চাবেন না, সেখানে গুরুত্বপূর্ণ বড় কোনো পদে নিয়োগ দানের কথা তো চিন্তাও করা যায় না। এটা কি কোনো গায়রত (আত্বসম্মানবোধ)-এর কথা হল যে, কারখানার মালিক তার কারখানার অনুগত কর্মী গোষ্ঠির উপরে সম্মানজনক কোনো পদে খবরদারী করার জন্য তারই বিরোধী কাউকে বসিয়ে দিবেন?! এটা তো মালিকের জন্য যেমন গায়রত (আত্বসম্মানবোধ)-এর বিষয়, তেমনি তার অনুগত কর্মীদের জন্যও  গায়রত (আত্বসম্মানবোধ)-এর বিষয়। মালিক কর্মী কেউই এটা চাবে না, তাদের উভয়ের কাছে খুব বেশি হলে এতটুকু পর্যন্ত সহনীয় হলেও হতে পারে যে, বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও সে অন্যান্য সাধারণ কর্মীদের মতো কর্মের বিনিময়ে বেতন ভোগ করে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ পেতে পারে, এর বেশি কোনো পদের আসনে বসে কারখানার পক্ষের লোকদের উপরে অভিভাবক সুলভ খবরদারী করার সহ্য করার কেউ হবে না।  

কারণ নিঃসন্দেহে এরকম ‘বিরোধী লোকের মনে সর্বদাই শয়তানী ও মিরজাফরী বাসনা লেগে থাকবে যাতে কারখানার মালিকের মূল লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, পরিকল্পনা ও নীতিমালার কোনোটাই ঠিক মতো বাস্তবায়ীত হতে না পারে, ফলে পদে পদে সে সাধ্য মতো কৌশলে বাঁধার সৃষ্টি করবে। দ্বিতীয়ত, সে সুযোগ পেলে মালিকের পক্ষের কর্মীদেরও নানাবিধ ক্ষতি না করে বসে থাকবে বলে আশা করা যায় না।  এমন কি যদি একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের আচরনও পর্যবেক্ষন করে দেখি, তাহলেও সেক্ষেত্রে দেখতে পাবো যে, রাষ্ট্রের চেতনা ও সংবিধানের আংশিক বা সম্পূর্ণ বিরোধীদেরকে বিচারক বানানো তো দূরের কথা, খোদ্ বিচারক পদে তার নিয়োগ পাওয়ার উপরোও বাঁধা দান বা অনেক সময় নিষেধাজ্ঞা পর্যন্ত জারি করা হয়ে থাকে। আর সেটা এই একই কারণে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বিষয়টি সর্বজনবিদিত ও গ্রহনযোগ্য একটি বিষয়।

আল্লাহ তাআলাও চান, পৃথিবীতে তাঁর খলিফা (প্রতিনিধি) হিসেবে তাঁর কাজগুলো সম্পাদন করুক এমন ব্যক্তি, যে হবে তাঁর পক্ষের লোক, যে তাঁকে একমাত্রইলাহ (উপাস্য) ও রব (প্রভু)হিসেবে স্বীকার করেছে, তাঁর শেষ নবী ও রাসুলের উপর নাজিলকৃত বিধিবিধানসমূহে পূর্ণ বিশ্বাসী এবং তা কায়মনোবাক্যে নিজের মত ও পথ হিসেবে গ্রহন করে নিয়েছে; যার উপর তাঁর সৃষ্ট এই  বিশ্বকারখানা (পৃথিবী)’র কোনো দায়িত্বভার দেয়ার ব্যাপারে আস্থা রাখা যায়। আর তাই তিনি একাজে আস্থা রেখেছেন একজনমুসলীম (আল্লাহ’র আনুগত্য স্বীকারকারী) ব্যাক্তির উপর। বাদবাকি যে সকল অমুসলীম কাফের’রা তাঁকে তাঁর একমাত্রইলাহ (উপাস্য) ও রব (প্রভু)হিসবে তাঁর অনুগত হতে আংশিকভাবে কিংবা পূর্ণাঙ্গভাবে অস্বীকারকার করেছে, তিনি তাঁর দ্বীনী মিশনকে মূল লক্ষ্যে পৌছানোর জন্য তাদের উপর কোন্ যুক্তিতে আস্থা রাখতে যাবেন?!!! আর ইসলামী রাষ্ট্রের একজন বিচারক (কাজী) হলেন মুসলমানদের উপর নিযুক্ত বড় মাপের অভিভাবক (ওলী)। আর এটা আল্লাহ তাআলা’র গায়রত (আত্বসম্মানবোধ) যে, তিঁনি মুসলীম (আত্বসমর্পণকারী) বান্দাদের উপরে অভিভাবকত্বের পদ গ্রহনের কোনো পথ আল্লাহ তাআলা কোনো অমুসলীম কাফেরের জন্য মোটেই খোলা রাখেননি। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-

وَلَنْ يَجْعَلَ اللَّهُ لِلْكَافِرِينَ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ سَبِيلا
“আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের উপর (অভিভাবকত্ব ও খবরদারী করার) কোনো পথই কাফেরদের জন্য খোলা রাখেননি”।[সূরা নিসা ১৪৪]

ইমাম আবু বকর ইবনুল আরাবী (মৃ: ৫৪৩ হি:) রহ. লিখেছেনإنَّ الله سبحانه لا يَجعل للكافرين على المؤمنين سبيلاً بالشَّرع، فإن وجد فبِخلاف الشرع – ‘আল্লাহ সুবহানাহুয়া তাআলা কাফেরদের জন্য মুমিনদের উপর (অভিভাবকত্ব ও খবরদারী করার) শরয়ী কোনো পথই খোলা রাখেননি। তাই কোথাও যদি (মুসলমানদের উপর কোনো কাফেরকে অলী বা অভিভাবক বানানো হয়েছে মর্মে) পাওয়া যায়, তাহলে (বুঝতে হবে,) সেটা (আল্লাহ’র) শরীয়তের বিরুদ্ধাচারন করেই করা হয়েছে’[আহকামুল কুরআন, ইবনুল আরাবী- ১/৬৪১, আল-জামেউ লি আহকামিল কুরআন, ইমাম কুরতুবী- ৫/৪২১]

ইমাম আলাউদ্দিন আল-কাসানী (মৃ: ৫৮৭ হি:) রহ. লিখেছেন- ولأن الكافر ليس من أهل الولاية على المسلم لأن الشرع قطع ولاية الكافر على المسلمين قال الله تعالى : { ولن يجعل الله للكافرين على المؤمنين سبيلا } وقال صلى الله عليه وسلم { الإسلام يعلو ولا يعلى } ولأن إثبات الولاية للكافر على المسلم تشعر بإذلال المسلم من جهة الكافر وهذا لا يجوز – “…..আর এটা এজন্য যেএকজন কাফের ব্যাক্তি কোনো মুসলমানের উপর ওলী (অভিভাবক) হওয়ার যোগ্যতা রাখে না, কারণ শরীয়ত মুসলমানদের উপর কাফের ব্যাক্তির অভিভাবকত্ব করার পথ বন্ধ করে দিয়েছে। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন وَلَنْ يَجْعَلَ اللَّهُ لِلْكَافِرِينَ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ سَبِيلا –‘আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের উপর (অভিভাবকত্ব ও খবরদারী করার) কোনো পথই কাফেরদের জন্য খোলা রাখেননি’।আর রাসুলুল্লাহ বলেছেনالإسلام يعلو ولا يعلى -‘ইসলাম (এসেছে) সমুন্নত (হওয়ার জন্য), হেও হবার (জন্য) নয়’। আর মুসলমানের উপর কোনো কাফেরের অভিভাবকত্ব চলতে দেয়া হল ওই মুসলীম ব্যাক্তিকে কাফেরের চাইতে হেও করা; আর সেটা করা জায়েয নয়” [বাদায়েউস সানায়ে, ইমাম কাসানী- ২/২৩৯]

আল্লাহ তাআলা আরো এরশাদ করেছেন-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَ أُولِي الْأَمْرِمِنكُمْ  ۖ   فَإِن تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ۚ ذَٰلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا
“ওহে যারা ইমান এনেছো! তোমরা অনুগত্য করো আল্লাহ’র এবং অনুগত্য করো রাসুলের, এবং (অনুগত্য করো) তোমাদের (মুসলমানদের) মধ্যকার উলুল-আমর’-এর। এতে তোমরা যদি কোনো বিষয়ে বিবাদে লিপ্ত হয়ে পরো, তাহলে যদি আল্লাহ ও কেয়ামতের দিবসের প্রতি তোমাদের ইমান থেকে থাকে, তাহলে বিষয়টি আল্লাহ ও (তাঁর) রাসুলের (ফয়সালার) কাছে ছেড়ে দাও। এই (নির্দেশনাটি তোমাদের জন্য) কল্যানকর এবং (এটাই এবিষয়ক) সর্বোত্তম ব্যাখ্যা’।[সূরা নিসা ৫৯]
 
আরবী শব্দ أَمْر (আমর্)-এর এক অর্থ হল হুকুম, আদেশ, নির্দেশ (Order)। এই অর্থ হিসেবে أُولي الْأَمْر (উলুল-আমর্) বলতে বুঝায় এমন ব্যাক্তিকে, যিনি কারো উপর হুকুম, আদেশ বা নির্দেশ (Order) দান করার অধিকার (Authority) রাখেন। আর উপরে সূরা নিসা’র ৫৯ নং আয়াতটিতে أُولي الْأَمْر (উলুল-আমর) বলতে এমন ব্যাক্তিকে বুঝানো হয়েছে, যিনি মুসলমানদের উপর নিযুক্ত এমন একজন ওলী (অভিভাবক), যিনি শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে মুসলমানদের উপর কুরআন সুন্নাহ’র হুকুম, আদেশ বা নির্দেশ (Order) দান করা বা জারি করার অধিকার (Authority) রাখেন। আমরা ইতিপূর্বে বলে এসেছি যে, মুফাসসীরীন ও ফুকাহাগণের মতে এখানে, উলুল-আমর বলতে এখানে- আমীরে আ’জম (খলিফা/ইমাম/সুলতান/রাষ্ট্রপ্রধান), হাকেম (শাসক), আমেল (প্রশাসক), জিহাদের আমীর (সেনাপতি), কাজী (বিচারক), ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’গণ প্রমুখকে বোঝানো হয়েছে। [বিস্তারিত: আর রিসালাহ, ইমাম শাফেয়ী- ৭৯ পৃ:; জামেউল বয়ান, তাবারী– ৫/১৫০; আল উসূল ওয়াল ফুরু’, ইবনে হাযাম- ২/২৯২; তাফসীরে কাবীর, ইমাম রাজী- ৫/২৫০; আহকামুল কুরআন, ইবনুল আরাবী- ১/৫৭৩; আহকামুল কুরআন, জাসসাস- ২/২৯৮; আল মাজমুউল ফাতাওয়া, ইবনে তাইমিয়্যাহ- ২৮/১৭০; ই’লামুল ময়াক্কিঈন, ইবনুল কাইয়্যেম- ১/১০; আল-জামেউ লি আহকামিল কুরআন, ইমাম কুরতুবী- ৫/২৬১; তাফসিরে ইবনে কাসির- ১/৪৪৫; ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার- ৮/১৯১; ফাতহুল কাদীর, শাওকানী- ১/৪৮১]
 
উপরোক্ত আয়াতে يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا – ‘হে যারা ইমান এনেছো!’ -বলে প্রত্যেক মুমিন-মুসলমান নর-নারী’র দৃষ্টি আকর্ষন করা হয়েছে এবং এরপর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে তাদের জীবনে মেনে চলতে নির্দেশ দান করা হচ্ছে যা এখানে বিশেষভাবে প্রনিধানযোগ্য। যথা:-
(১) أَطِيعُوا اللَّهَ – (তোমরা অনুগত্য করো আল্লাহ’র) -এখানে আল্লাহ’র নিঃশর্ত অনুগত্য করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
(২)أَطِيعُوا الرَّسُولَ – (তোমরা অনুগত্য করো রাসুলের) -এখানে শেষ নবী ও রাসুল মুহাম্মাদ -এর নিঃশর্ত অনুগত্য করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। 
(৩)وَ أُولِي الْأَمْرِ مِنكُمْ – (এবং তোমাদের মধ্যকার উলুল-আমর’-এর)-আল্লাহ তাআলা এই আয়াতে মুসলমানদের জন্য তাদের উপরে নিযুক্ত উলুল-আমর-এর আদেশ নির্দেশ মান্য করে চলাকে ওয়াজিব (অতিব আবশ্যক কর্তব্য) বনিয়ে দিয়েছেন।কিন্তু  এখানে ব্যাতিক্রমী ভাবে এই বিশেষ শর্ত এঁটে দিয়েছেন যে, আল্লাহ’র এই হুকুম ওই উলুল-আমর’-এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে, যখন ‘উলুল-আমর’ হবেন مِنكُمْ (তোমাদের মধ্য থেকে), অর্থাৎ যখন তোমাদের মুসলমানদের মধ্য থেকে ‘উলুল-আমর’ নিযুক্ত হবেন। সুতরাং, এই আয়াতে বর্ণিত হুকুম মোতাবেক, মুসলমানদের বিচার ফয়সালা করার  বিচারক (কাজী) মুসলমানদের মধ্য থেকেই কাউকে মনোনীত ও নির্বাচিত করা মুসলমানদের উপরে ফরয দায়িত্ব, অন্য কথায় অমুসলীম/কাফের কাউকে মুসলমানদের উপরে বিচারক (কাজী) হিসেবে নিয়োগ দেয়া  হারাম এ থেকে আরো বোঝা গেল,  যদি কোনো অমুসলীম/কাফের ব্যাক্তি মুসলমানদের উপরে ‘উলুল-আমর (রাষ্ট্রপ্রধান/বিচারক)’ হিসেবে সমাসীন হয় -চাই সে নিজের ক্ষমতা বলে জোর করে সমাসীন হোক কিংবা কোনো গোষ্ঠি তাকে মুসলমানদের উপরে ‘উলুল-আমর (রাষ্ট্রপ্রধান)’ হিসেবে চাপিয়ে দিক -সর্বাবস্থায় ওই পদে সমাসীন উক্ত অমুসলীম/কাফের ব্যাক্তিটি মুসলমানদের ওই ‘উলুল-আমর (রাষ্ট্রপ্রধান/বিচারক)’ হিসেবে গণ্য নয়,  যাকে মানার কথা উপরোক্ত আয়াতে বলা হয়েছে।
 
অমুসলীম/কাফেরকে যে মুসলমানদের খলিফা/কাজী বানানো জায়েয নেই তার সুস্পষ্ট দলিল হল এই হাদিস। যুনাদাহ বিন আবি উমাইয়্যাহ’র সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, উবাদাহ বিন সামেত রা. বলেন- دَعَانَا النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَبَايَعْنَاهُ ، فَقَالَ فِيمَا أَخَذَ عَلَيْنَا: «أَنْ بَايَعَنَا عَلَى السَّمْعِ وَالطَّاعَةِ، فِي مَنْشَطِنَا وَمَكْرَهِنَا، وَعُسْرِنَا وَيُسْرِنَا وَأَثَرَةً عَلَيْنَا، وَأَنْ لاَ نُنَازِعَ الأَمْرَ أَهْلَهُ، إِلَّا أَنْ تَرَوْا كُفْرًا بَوَاحًا، عِنْدَكُمْ مِنَ اللَّهِ فِيهِ بُرْهَانٌ . رواه البخاري, كتاب الفتن, باب قول النبي صلى الله عليه وسلم: سترون بعدي أمورا تنكرونها: رقم ٧٠٥٥; و مسلم: رقم ١٨٤٠; البزار في البحر الزخار: ٧/١٤٤ – “(আক্বাবা’র বাইয়াতের রাতে) রাসুলুল্লাহ ﷺ আমাদেরকে (বায়াত হওয়ার জন্য) ডাক দিলেন, আমরা তখন তাঁর কাছে বায়াত হলাম’। তিনি (তথা উবাদাহ রা.) বলেন: তিনি সে সময় আমাদের থেকে যে ওয়াদা নিয়েছিলেন, তাতে আমারা বায়াত করছিলাম একথার উপর যে, (আমরা) আমাদের পছন্দসই অবস্থায়, আমাদের অপছন্তনীয় অবস্থায়, আমাদের দুঃখ-কষ্টের সময়ে, আমাদের সুখ-সাচ্ছন্দের সময়ে এবং (কাউকে) আমাদের উপরে অগ্রাধিকার দিলেও (আমরা) শুনবো ও মানবো। (এরও বায়াত করছিলাম) যে, আমরা শাসনব্যবস্থা নিয়ে এর (শরীয়ত শুদ্ধ) আহাল (দায়িত্বরত শাসক)-এর সাথে (ততক্ষন পর্যন্ত তাকে উৎখাত করার উদ্দেশ্যে) দ্বন্দ্ব/সংঘর্ষে লিপ্ত হবো না, (বললেন:) -যাবৎ না তোমরা (শাসকের মধ্যে) সুস্পষ্ট কুফর দেখতে পাও, যে ব্যাপারে আল্লাহ’র পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে বুরহান (সুস্পষ্ট দলিল) রয়েছে”[সহিহ বুখারী, হাদিস ৭০৫৫; সহিহ মুসলীম, হাদিস ১৮৪০; মুসনাদে বাযযার- ৭/১৪৪] 
 
কারণ আমরা ইতিপূর্বে, ইসলামী রাষ্ট্রের খলিফা ‘মুসলীম’ হওয়া শর্ত হওয়ার ব্যাখ্যায় দলিল সহ দেখিয়ে এসেছি যে, এই আয়াতটি ‘আমীর’ প্রসঙ্গে নাজিল হয়েছিল। যেমন, ইমাম ইবনে জারীর আত-তাবারী (মৃ: ৩১০ হি:) রহ. সহিহ সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, আবু হুরায়রাহ রা. أولو الأمر (উলুল-আমর) -এর ব্যাখ্যায় বলেছেন: هم الأمراء – ‘তারা হচ্ছেন আমীরগণ’[জামেউল বয়ান, ইমাম তাবারী, আছার ৯৮৫৬; ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার- ৮/১৯১] ইমাম বাইহাকী (মৃ: ৪৫৮ হি:) রহ. লিখেছেন-قال الامام احمد: والحديث الذى ورد فى نزول هذه الآية دليل على أنها فى الأمراء – “ইমাম আহমদ  বলেছেন: ‘আয়াতটির শানে নুজুল প্রসঙ্গে যে হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে, সেটিই একথার দলিল যে, আয়াতটি (মুসলমানদের উপরে নিযুক্ত) আমীরগণ সম্পর্কে নাজিল হয়েছে”। [শুআবুল ইমান, ইমাম বাইহাকী- ৯/৪০৯] এখানে আমীর —চাই আমীরে-আ’জম খলিফা হোক বা আমেল (গভর্ণর বা প্রশাসক) পর্যায়ের আমীর হোক বা মুজাহিদ বাহিনীর আমীর (সেনাপতি) হোক।
 
আমরা ইতিপূর্বে আমীরের প্রকারভেদ নিয়ে আলোচনায় এও বলে এসেছি যে, ইসলামী শরীয়ত মতে, মুসলমানদের এ আমীরে-আ’জম (খলিফা) ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনা ও শাসনের প্রশ্নে একজন নির্বাহী প্রধান-তো বটেই, পাশাপাশি যোগ্যতা থাকলে তিনি নিজেই বিচার বিভাগ, অর্থায়ন বিভাগ, সেনাযুদ্ধ বিভাগ প্রভৃতির প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করতে পারেন, যার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ হলেন খোদ্ বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ । কারণ তিনি আল্লাহ তাআলার প্রেরিত সর্বশেষ নবী ও রাসুল তো অবশ্যই ছিলেন, তদুপরি ইসলামী রাষ্ট্রব্যাবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তিনি ছিলেন একাধারে রাষ্ট্রের নির্বাহীপ্রধান ‘খলিফা’ (আমীরে আ’জম/রাষ্ট্রপ্রধান)প্রধান বিচারপতিঅর্থায়ন বিভাগের প্রধান (গভর্নর)প্রধান মুফতী, জিহাদ ও গাযওয়া’র প্রধান-পরিচালক (সেনাপ্রধান), কোনো কোনো জিহাদের প্রধান সেনাপতি (Commander in Chief) ইত্যাদি। তাঁর পর যাঁদের নাম আসে তাঁরা হলেন খুলাফায়ে রাশেদীন- হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা., হযরত ওমর ফারুক রা., হযরত ওসমান গণী রা. এবং হযরত আলী বিন আবি ত্বালেব রা.। এমনকি খলিফা ভালো মনে করলে কোনো অঞ্চল/প্রদেশ/শহরে নিয়োগকৃত একই গভর্ণর/প্রশাসকের মধ্যে সবগুলো যোগ্যতা পাওয়া যায়, তাহলে তাকে একাধারে আমেল (প্রশাসক/গভর্ণর), কাযী (বিচারক), প্রধান সেনাপতি, প্রধান মুফতী ইত্যাদি হিসেবেও নিয়োগ দিতে পারেন, আবার ভালো মনে করলে অন্য কোনো যোগ্য কাউকে তার সহযোগী হিসেবে এসব পদে নিয়োগ দিতে পারেন। যেমন: রাসুলুল্লাহ ﷺ মুয়ায বিন জাবাল রা.-কে ইয়ামেনের আমেল বানিয়ে পাঠিয়েছিলেন. যিনি সেখানকার প্রশাসক/গভর্ণর হওয়ার পাশাপাশি কাযী (বিচারক) ও মুফতীও ছিলেন।
 
এ থেকে প্রমাণিত হয় বিচারক (কাজী)’র মূল দায়িত্ব মূলত খলিফা’রই, যা তিঁনি যেমন নিজেও সম্পাদন করতে পারেন, তেমনি কাজের সুবিধার্থে অন্য যোগ্য কোনো মুসলমানকেও বিচারক (কাজী) হিসেবে নিয়োগ দিতে পারেন, যিনি খলিফার প্রতিনিধি হিসেবে বিচারকার্য আঞ্জাম দিবেন। [বিদায়াতুল মুজতাহীদ, ইবনে রুশদ- ২/৩৮৪; শারহু আদাবিল কাজী, ইবনে মাজাহ- ১/১২৯; তাবসিরাতুল হুক্কাম, ইবনে ফারহুন- ১/২১;  রাদ্দুল মুহতার, ইবনে আবিদীন- ৫/৩৬৮, ৪০৯; নিযামুল কাজা- ১/৩৩]
 
আল্লাহ তাআলা আরো এরশাদ করেন-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ مِن دُونِ الْمُؤْمِنِينَ ۚ أَتُرِيدُونَ أَن تَجْعَلُوا لِلَّهِ عَلَيْكُمْ سُلْطَانًا مُّبِينًا
হে ইমানদারগণ! তোমরা মুমিনদেরকে বাদ দিয়ে কাফেরদেরকে (তোমাদের) ওলী (অভিভাবক ও বন্ধু) হিসেবে গ্রহন করে নিবে না। তোমরা কি (কাফেরদেরকে নিজেদের অভিভাবক ও বন্ধ বানিয়ে নিয়ে) আল্লাহ’র কাছে তোমাদের নিজেদের বিরুদ্ধেই একথার সুস্পষ্ট দলিল দাঁড় করিয়ে দিতে চাও (যে, তোমরা আল্লাহর প্রতিনিধি হয়ে আল্লাহর মিশন কায়েম করার পরিবর্তে আল্লাদ্রোহিদের প্রতিনিধি হয়ে তাদের মিশন কায়েম করার বিষয়টিকে গ্রহন করে নিয়েছো)?[সূরা নিসা ১৪৪]

ইমাম আবু বকর জাসসাস রাযী রহ. (মৃ: ৩৭০ হি:) উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন هو يدل على ان الكافر لا يستحق الولاية على المسلم بوجه – “এ আয়াতাটি এ কথারই দলিল যে, কোনো মুসলমানের উপর অভিভাবকত্ব করার কোনো হক্ব কোনো কাফেরের কোনো ভাবেই নেই”। [আল-আহকামুল কুরআন, ইমাম জাসসাস ২/২৯১]

ইমাম ইবনে কাসির (মৃ: ৭৭৪ হি:) রহ. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেনيَنهى تعالى عباده المؤمنين عن اتِّخاذ الكافرين أولياءَ من دون المؤمنين؛ يَعني: مصاحبَتَهم، ومُصادقتهم، ومناصحتهم، وإسرارَ المودَّةِ إليهم، وإفشاءَ أحوال المؤمنين الباطنةِ إليهم – “আল্লাহ তাআলা তাঁর মুমিন বান্দাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন তারা যেন মুমিনদেরকে বাদ দিয়ে কাফেরদেরকে তাদের বন্ধু ও অভিভাবক হিসেবে গ্রহন করে না নেয়। অর্থাৎ, তাদেরকে অন্তরঙ্গ সাথী বানাবে না, অন্তরঙ্গ বন্ধু (জিগরী দোস্ত) বানাবে না, তাদেরকে (তাদের খায়েরখায়ী) পরামর্শদানকারী বানাবে না, তাদের প্রতি কোনো গোপন হৃদ্যতা (Affection) রাখবে না, মুমিনদের গোপনীয় অবস্থাদি তাদের সামনে প্রকাশ করবে না”।[তাফসীরে ইবনে কাসির- ১/৮৬৭]


আল্লাহ তাআলা আরো এরশাদ করেন-


يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَىٰ أَوْلِيَاءَ ۘ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ ۚ وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ ۗ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ 
‘হে ইমানদারগণ! তোমরা ইহুদী ও খৃষ্টানদেরকে তোমাদের বন্ধু হিসেবে গ্রহন করো না। ওরা একে অন্যের বন্ধু। আর তোমাদের মধ্যে যে ব্যাক্তি তাদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহন করে নিবে, সে তাদেরই মধ্যে গণ্য হবে। নিশ্চই আল্লাহ জালেম গোষ্টিকে হেদায়েত দেন না।’ [সুরা মায়েদাহ ৫১]

হযরত আইয়্যাসের সূত্রে উত্তম সনদে একটি রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে যে,হযরত ওমর রা. একবার হযরত হযরত আবু মুসা আশআরী রা.কে নির্দেশ দিলেন, তিনি কত আয় করেছেন কত ব্যয় করেছেন তার হিসেব একটি চামড়ায় লিখে যেন তার কাছে পেশ করেন। সে সময় আবু মুসা আশআরীর ছিল একজন খৃষ্টান লেখক, তিনি তাকেই (হিসাব সহ হযরত ওমরের সামনে) পেশ করলেন। এতে হযরত ওমর রা. অবাক হয়ে বললেন- إن هذا لحفيظ  – ‘এই ব্যাক্তি হিসাব সংরক্ষক’ !!! তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন- هل أنت قارئ لنا كتابا في المسجد جاء من الشام؟ ‘তুমি কি মসজিদের মধ্যে আমাদেরকে শাম (বৃহত্তর সিরিয়া) থেকে আগত ফরমান পড়ে শোনাবে’? তখন হযরত আবু মুসা আশআরী রা. বললেন-(إنه لا يستطيع (أن يدخل المسجد -‘না, তার পক্ষে (মসজিদে ঢোকা) সম্ভব নয়’। হযরত ওমর রা. জিজ্ঞেস করলেন- أجنب هو؟ – ‘সে কি অপবিত্র (যে, মিসজিদে প্রবেশ করতে পারবে না)’? হযরত আবু মুসা আশআরী রা. বললেন- لا بل نصراني – ‘না, বরং সে একজন খৃষ্টান’। হযরত আবু মুসা আশআরী রা. বললেন: একথা শুনে হযরত ওমর রা. আমাকে ধমক দিলেন এবং পিঠে একটি চাপড় দিয়ে বললেন- أخرجوه -‘তাকে (এই দায়িত্ব থেকে) বহিষ্কার করো’। এরপর তেলাওয়াত করলেনيَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَىٰ أَوْلِيَاءَ  – ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা ইহুদী ও খৃষ্টানদেরকে তোমাদের বন্ধু হিসেবে গ্রহন করো না। [তাফসীরে ইবনে আবি হাতেম- ৪/১১৫৬ হাদিস ৬৫১০; সুনানুল কুবরা, বাইহাকী-১০/১২৭, ৩২৮; শুয়াবুল ইমান, বাইহাকী, হাদিস ৯৩৮৪; তাফসীরে ইবনে কাসির-৫/১৩৬ ; মুসনাদে ফারুক, ইবনে কাসির-২/৪৯৪; আদ্দুররুল মানসুর, ইমাম সুয়ূতী- ২/৫১৬]

ইমাম ইবনে জারীর আত-তাবারী (মৃ: ৩১০ হি:) রহ. লিখেছেন-والصواب من القول في ذلك عندنا أن يقال: إن الله تعالى ذكره نهى المؤمنين جميعا أن يتخذوا اليهود والنصارى أنصارا وحلفاء على أهل الإيمان بالله ورسوله وأخبر أنه من اتخذهم نصيرا وحليفا ووليا من دون الله ورسوله والمؤمنين فإنه منهم في التحزب على الله وعلى رسوله والمؤمنين وأن الله ورسوله منه بريئان……….ومن يتولَّ اليهود والنصارى دون المؤمنين، فإنه منهم. يقول: فإن من تولاهم ونصرَهم على المؤمنين، فهو من أهل دينهم وملتهم، فإنه لا يتولى متولً أحدًا إلا وهو به وبدينه وما هو عليه راضٍ . وإذا رضيه ورضي دينَه، فقد عادى ما خالفه وسَخِطه، وصار حكُمه حُكمَه  – “এ ব্যাপারে যেসকল কওল রয়েছে তার মধ্যে আমাদের কাছে সবচেয়ে গ্রহনযোগ্য কওল হল তাঁদেরটা যাঁরা বলেছেন, এখানে আল্লাহ তাআলা সকল মুমিনদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন তারা যেন আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের উপর ইমান আনায়নকারী (মুমিন মুসলমান)দের বিপক্ষে ইহুদী ও খৃষ্টানদেরকে তাদের সাহায্যকারী মিত্র না বানায়। তিনি আরো জানাচ্ছেন যে, যে ব্যাক্তি আল্লাহ, তাঁর রাসুল সা. এবং মুমিনদেরকে বাদ দিয়ে ইহুদী ও খৃষ্টানদেরকে সাহায্যকারী মিত্র ও অভিভাবক বন্ধু বানাবে, সেও তাদের সাথে আল্লাহ’র বিরুদ্ধে, তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধে এবং মুমিনদের বিরুদ্ধে অবস্থানকারী হিসেবে গণ্য হবে। আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সা. এরকম ব্যাক্তির দায়িত্ব থেকে মুক্ত।…….যে ব্যাক্তি মুমিনদেরকে বাদ দিয়ে ইহুদী ও খৃষ্টানদেরকে বন্ধু বানায়, সে তাদেরই অন্তর্ভূক্ত। আল্লাহ জানাচ্ছেন যে, যে ব্যাক্তি  ইহুদী ও খৃষ্টানদেরকে মুমিনদের বিরুদ্ধে সাহায্যকারী বন্ধু বানাবে, সে তাদেরই দ্বীন ও মিল্লাতের আহাল (ধারকবাহক) বলে গণ্য হবে। কারণ কেউ যখন কাউকে বন্ধু বানায়, তখন সে সন্তুষ্টচিত্বেই তার বন্ধুর পাশে থাকে, বন্ধু যে চিন্তা বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলে তার উপর সে রাজি থাকে বলেই কেবল তাকে বন্ধু বানায়। আর সে যখন তার বন্ধুর উপর খুশি থাকে এবং বন্ধুর চিন্তা বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গির উপরও খুশি থাকে, তখন তার বন্ধু যা কিছুর বিরোধী করে, যা কিছুর প্রতি ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করে করে, সেটা তার কাছেও (একসময়) স্বাভাবিক হয়ে যায়। (যেন আল্লাহ, তাঁর রাসুল, মুমিন-মুসলমান ও ইসলামী শরীয়তের বিপক্ষে তার বন্ধুর অসন্তোষ ও ক্ষোভকে তখন তার কাছে আর এমন মনে হয় না যে, আমার বন্ধু আমার বিশ্বাসের বিপক্ষে অসন্তোষ ও ক্ষোভ   প্রকাশ করছে)। ফলে তার বন্ধুর উপর (শরীয়তের) যে হুকুম, সেই হুকুম তার উপরও বর্তালো”।[জামেউল বায়ান, ইমাম তাবারী- ৬/২৭৬]


আল্লাহ তাআলা আরো এরশাদ করেন-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا بِطَانَةً مِنْ دُونِكُمْ لَا يَأْلُونَكُمْ خَبَالًا وَدُّوا مَا عَنِتُّمْ قَدْ بَدَتِ الْبَغْضَاءُ مِنْ أَفْوَاهِهِمْ وَمَا تُخْفِي صُدُورُهُمْ أَكْبَرُ قَدْ بَيَّنَّا لَكُمُ الْآيَاتِ إِنْ كُنْتُمْ تَعْقِلُونَ
‘‘হে ইমানদারগণ, তোমরা তোমাদের নিজেদের (মুসলমান) লোকদের ছাড়া অন্য(অমুসলীম) কাউকে তোমাদের অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে গ্রহন করে নিও না। তারা তোমাদের অনিষ্ট সাধনে কোনো সুযোগ হাতছাড়া করে না। তারা কামনা করে যাতে তোমরা সমস্যায় পড়ে যাও। তাদের মুখ থেকেই (তোমাদের প্রতি) তাদের বিদ্বেষ প্রকাশ হয়ে পড়েছে। আর তাদের মনগুলোর ভিতরে (তোমাদের অনিষ্ট সাধনের জন্য) যা লুকিয়ে রয়েছে তা আরো মারাত্মক। বস্তুতঃ আমি আমার আয়াতসমূহকে তোমাদের জন্য সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করে দিচ্ছি যাতে তোমাদের বিবেককে কাজে লাগাতে পারো। [সুরা আল-ইমরান ১১৮]

এই আয়াতে مِنْ دُونِكُمْ – “তোমাদের নিজেদের লোকদের ছাড়া অন্য কাউকে” –দ্বারা মুসলমান ছাড়া অন্য সকল অমুসলীম কাফেরকে অন্তরঙ্গ বন্ধু বানাতে নিষেধ করা হয়েছে। [তাফসীরে খাযেন- ১/৪০৯] কেউ কেউ বলেছেন, এর দ্বারা মুনাফেকরা উদ্দেশ্য। বলাবাহুল্য, মুনাফেকদেরকে অন্তরঙ্গ বন্ধু বানানো নাজায়েয হলে, দালালাতুন্নাস হিসেবে কাফেরদেরকে অন্তরঙ্গ বন্ধু বানানো আরো শক্ত নাজায়েয অপরাধ হবে -এতে কোনোই সন্দেহ নেই। যাহোক, কাফেরদেরকে অন্তরঙ্গ বন্ধু বানানো নাজায়েয হওয়ার ব্যাপারে সকল আইম্মায়ে মুফাসসিরীন, মুজতাহিদীন ও ফুকাহায়ে কেরাম একমত।

ইমাম ইবন আবি হাতেম আর-রাযী (মৃ: ৩২৭ হি:) রহ. সহিহ সনদে হযরত ইবন আবু দাহকান রহ.-এর সূত্রে একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন, তাতে আছে যে, ইবন আবু দাহকান রহ. খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত ওমর ফারুক রা.কে বললেন, এখানে (ইরাকের) হিরাহ অঞ্চলের এক (খৃষ্টান) লোক আছে, সে ভাল লিখতে পারে; স্মরণশক্তিও ভাল। আপনি তাকে আপনার লেখক হিসেবে নিয়োগ দিতে পারেন। একথা শুনে হযরত ওমর রা. বললেন– قد اتخذت إذا بطانة من دون المؤمنين  – “আমি যদি তাকে নিয়োগ দেই, তাহলে-তো আমি মুমিনদেরকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধু বানিয়ে নিলাম” ![তায়সীরে ইবনে আবি হাতেম, হাদিস ৪০৩৮; আল-মুসান্নাফ, ইবনে আবি শায়বা, হাদিস ২৫৮৬৩; আহকামুল কুরআন, ইমাম জাসসাস- ২/৪৬; তাফসীরে ইবনে কাসির- ১/৩৭৬; আদ্দুররুল মানসুর, সুয়ূতী-২/৬৬]

ইমাম কুরতুবী (মৃ: ৬৭১ হি:) রহ. লিখেছেন– نَهى الله المؤمنين بِهذه الآية أن يَتَّخِذوا من الكُفَّار واليهود وأهل الأهواء دُخلاءَ ووُلَجاء يُفاوضونهم في الآراء، ويُسندون إليهم أمورَهم – “আল্লাহ তাআলা এই আয়াতে কারিমার দ্বারা মুমিনদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, তারা যেন যুক্তিতর্কের আড়ালেকাফেরদের মধ্যে কাউকে -চাই সে ইহূদী হোক, প্রবৃত্তির আজ্ঞাবহ কাফের হোক, দ্বীন বহির্ভূত কেউ হোক -তাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহন করে না নেয় এবং তাদের কাছে কোনো পদ অর্পণ করে না দেয়”। [জামেউ আহকামিল কুরআন, কুরতুবী- ৩/৭৮]

আল্লাহ তাআলা আরো এরশাদ করেন-

لَّا يَتَّخِذِ الْمُؤْمِنُونَ الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ مِن دُونِ الْمُؤْمِنِينَ ۖ وَمَن يَفْعَلْ ذَٰلِكَ فَلَيْسَ مِنَ اللَّهِ فِي شَيْءٍ إِلَّا أَن تَتَّقُوا مِنْهُمْ تُقَاةً
‘মুমিনরা মুমিনগণকে বাদ দিয়ে কাফেরদেরকে ওলী ( অভিভাবক ও বন্ধু) হিসেবে গ্রহন করবে না’। আর যে (মুমিন) এমন কাজ করবে, তাতে (তার সাথে) আল্লাহ’র কোনো সম্পর্ক অবশিষ্ট থাকবে না। তবে তাদের থেকে (কোনো ক্ষতির) আশংকা থেকে থাকলে (নিছক বাহ্যিকভাবে বন্ধুত্ব আছে মর্মে আচরণ প্রকাশ করলে সেটা ভিন্ন কথা)[সূরা আল-ইমরান ২৮]

এই আয়াতে কারিমার ব্যাখ্যায় হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-বলেছেন– نهى الله سبحانه المؤمنين أن يُلاطفوا الكفار أو يتخذوهم وليجةً من دون المؤمنين، إلا أن يكون الكفارُ عليهم ظاهرين، فيظهرون لهم اللُّطف، ويخالفونهم في الدين. وذلك قوله: ” إلا أن تتقوا منهم تقاةً – “আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা মুমিনদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, তারা যেন মুমিনদেরকে বাদ দিয়ে কাফেরদের সাথে হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে না তোলে কিংবা তাদেরকে অন্তরঙ্গ বন্ধু না বানায়। তাবে যদি কাফেররা তাদের উপর (শক্তি ও ক্ষমতার) প্রভাব বিস্তার করে রাখে, তাহলে (বিপদের আশংকার ক্ষেত্রে) বাহ্যিকভাবে তাদের সাথে হৃদ্যতা প্রদর্শন করা যেতে পারে। কিন্তু দ্বীনের প্রশ্নে তাদের বিপক্ষে অবস্থান করতে হবে। আর আল্লাহ তাআলা এজন্যই বলেছেন- إِلَّا أَن تَتَّقُوا مِنْهُمْ تُقَاةًতবে তাদের থেকে (কোনো ক্ষতির) আশংকা থেকে থাকলে (নিছক বাহ্যিকভাবে বন্ধুত্ব আছে মর্মে আচরণ প্রকাশ করলে সেটা ভিন্ন কথা)”।[জামেউল বায়ান, ইমাম তাবারী, আছার ৬৮২৫]

হযরত হাসান বসরী রহ. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন- صاحبهم في الدنيا معروفًا، الرحم وغيره. فأما في الدّين فلا – “পার্থিব ব্যাপারে কাফেরদের সাথে মেলামেশা করা, তাদের সাথে আত্বীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা ইত্যাদি বিষয়-তো জানাই আছে (যে, এগুলো বিশেষ সীমা পর্যন্ত জায়েয)। কিন্তু যদি দ্বীনের প্রশ্ন আসে তাহলে -নাহ্ (তাদেরকে অভিভাবকের মতো বন্ধু বানানো জায়েয নেই)”। [জামেউল বায়ান, ইমাম তাবারী, আছার ৬৮৩৮]

হযরত কাতাদাহ রহ. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন– نهى الله المؤمنين أن يوادّوا الكفار أو يتولَّوْهم دون المؤمنين….لا يحل لمؤمن أن يتخذ كافرًا وليًّا في دينه – “আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, তারা যেন মুমিনদেরকে বাদ দিয়ে কাফেরদের প্রতি ঝুঁকে না পড়ে কিংবা তাদেরকে অভিভাবক ও বন্ধু না বানায়। মুমিনদের জন্য এটা হালাল নয় যে, তারা দ্বীন ইসলামরে প্রশ্নে কোনো কাফেরকে তার অভিভাবক ও বন্ধু বানিয়ে নিবে”। [জামেউল বায়ান, ইমাম তাবারী, আছার ৬৮৩৬, ৬৮৩৭]


ইমাম ইবনে জারীর আত-তাবারী (মৃ: ৩১০ হি:) রহ. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেনوهذا نهيٌ من الله عز وجل المؤمنين أن يتخذوا الكفارَ أعوانًا وأنصارًا وظهورًا……….ومعنى ذلك: لا تتخذوا، أيها المؤمنون، الكفارَ ظهرًا وأنصارًا توالونهم على دينهم، وتظاهرونهم على المسلمين من دون المؤمنين…..فإنه مَنْ يفعل ذلك =” فَلَيْسَ مِنَ اللَّهِ فِي شَيْءٍ “، يعني بذلك: فقد برئ من الله وبرئ الله منه، بارتداده عن دينه ودخوله في الكفر =” إِلَّا أَن تَتَّقُوا مِنْهُمْ تُقَاةً “، إلا أن تكونوا في سلطانهم فتخافوهم على أنفسكم، فتظهروا لهم الولاية بألسنتكم، وتضمروا لهم العداوة، ولا تشايعوهم على ما هم عليه من الكفر، ولا تعينوهم على مُسلم بفعل – “এখানে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকেই মুমিনদের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তারা যেন কাফেরদেরকে তাদের সাহায্য-সহায়তাকারী পৃষ্ঠপোষক বানাবে না।……..এর অর্থ, হে মুমিনগণ ! তোমরা দ্বীন ইসলামের প্রশ্নে মুমিনদেরকে বাদ দিয়ে কাফেরদেরকে তোমাদের সাহায্যকারী পৃষ্ঠপোষক ও অভিভাবক বানিয়ে নিবে না এবং তাদেরকে মুসলমানদের উপর প্রভাবশালী হতে সাহায্য করবে না। যে একাজ করবেفَلَيْسَ مِنَ اللَّهِ فِي شَيْءٍ(তার সাথে) আল্লাহ’র কোনো সম্পর্ক অবশিষ্ট থাকবে না। অর্থাৎ, এর দ্বারা সে আল্লাহ তাআলা থেকে দায়িত্বমুক্ত এবং আল্লাহ তাআলা তার থেকে দায়িত্বমুক্ত হয়ে যাবেনকারণ সে দ্বীন থেকে বেড় হয়ে গিয়ে কুফরের ভিতরে প্রবেশ করেছে। إِلَّا أَن تَتَّقُوا مِنْهُمْ تُقَاةً –তবে তাদের থেকে (কোনো ক্ষতির) আশংকা থেকে থাকলে (নিছক বাহ্যিকভাবে বন্ধুত্ব আছে মর্মে আচরণ প্রকাশ করলে সেটা ভিন্ন কথা- অর্থাৎ যদি সে কাফেরদের শক্তি ও ক্ষমতার অধীনে থাকে এবং নিজের জীবনের প্রশ্নে তাদের থেকে কোনো আশংকা বোধ করে, তাহলে বাহ্যিক ভাবে তাদের অভিভাবকত্ব-রীতির প্রতি সম্মতি প্রকাশ করা এবং তাদের সাথে শত্রুতার বিষয়টিকে চেঁপে যাওয়ার অবকাশ রয়েছে বটে, কিন্তু তারা যে কুফরএর উপর রয়েছে তাদের সেই কুফরের সাথে শরীক হতে পারবে না এবং মুসলীমদের বিপক্ষে তাদেরকে কোনো সাহায্য সহযোগীতা করতে পারবে না”।[জামেউল বায়ান, ইমাম তাবারী-৬/৩১৩] বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য আরো দেখুন [তাফসীরে ইবনে কাসির-১/৩৩৭; আল-ওয়াসিত-১/৪২৭; মাআলিমুত তানজিল-২/২৬; তাফসীরে কাশশাফ, জামাখশারী-১/৩৫১; আল-বাহরুল মুহিত, আবু হাইয়ান-২/৪৪০]
 
উপরোক্ত এজাতীয় আয়াতসমূহে বর্ণিত সুস্পষ্ট হুকুম ও সুন্নাহ’র আলোকে সকল মুহাক্কিক মুজতাহিদীন ফুকাহায়ে কেরামের এব্যাপারেইজমারয়েছে যেকোনো কাফের ব্যাক্তিকে মুসলমানদের উপর ওলী (অভিভাবক) বানানো সর্বসম্মতভাবে হারাম
ইমাম ইবনুল কায়্যেম আল-যাওজীয়্যাহ (মৃ: ৭৫১ হি:) রহ. ইমাম ইবনুল মুনযীরের সূত্রে বলেছেন– أجمع كلُّ مَن يُحفَظ عنه مِن أهل العلم أنَّ الكافر لا ولايةَ له على المسلم بِحال – “এব্যাপারে আলেমগণের ইজমা রয়েছে যে,  কোনো কাফেরকে কোনো অবস্থাতেই কোনো মুসলমানের উপর ওলী (অভিভাবক) বানানো জায়েয নেই” ’[আহকামু আহলিজ জিম্মাহ, ইবনুল কাইয়্যেম- ২/৭৮৭]

ইমাম ইবনে আবেদীন শামী (মৃ: ১২৫২ হি:) রহ. লিখেছেন-لا ولاية لكافر على مسلم، لا ولاية عامة ولا خاصة – “কোনো কাফেরের জন্য কোনো মুসলমানের উপর অভিভাবক (ওলী) হওয়ার -চাই তা ব্যাপক অভিভাবকত্ব হোক বা বিশেষভাবে নির্দিষ্ট অভিভাবকত্ব হোক- তার কোনো সুযোগ নেই”[ইবনে আবেদীন-৩/২৮১]

যেহেতেু ইসলামী রাষ্ট্রের কোনো বিচারক (কাজী) হলেন মুসলমানদের উপর নিযুক্ত একজন ওলী (অভিভাবক), এজন্য কোনো কাফেরকে মুসলমানদের উপর বিচারক (কাজী) বানানো সর্বসম্মতভাবে  হারাম। 

ইমাম মুহিউদ্দিন আন-নববী (মৃ: ৬৭৬ হি:) রহ. বলেছেন-  لا يجوز ان يكون القاضى كافرا –কোনো কাফের ব্যাক্তিকে কাযী/বিচারক বানানো জায়েয নেই”। [আল মাজমু’ শারহুল মুহাযযাব, ইমাম নববী- ২/১২৬]

ইমাম ইবনে কুদামাহ আল-মাকদেসী (মৃ: ৪৫৮ হি:) রহ. লিখেছেন: لا يولى قاض حتى يكون بالغا عاقلا مسلم حرا …الخ – “কোনো ব্যাক্তিকে কাজী (বিচারক)  বানানো জায়েয নেই যাবৎ না সে বালেগ, আক্বেল, মুসলীম, স্বাধীন…হয়….”। [আল-মুগনী, ইবনে কুদামাহ- ১১/৩৮০]

ইমাম ইব্রাহিম বুরহানুদ্দিন বিন ফারহুন (মৃ: ৭৯৯ হি:) রহ. লিখেছেন: قال القاضي عياض رحمه الله : وشروط القضاء التي لا يتم القضاء إلا بها ولا تنعقد الولاية ولا يستدام عقدها إلا معها عشرة : الإسلام والعقل والذكورية والحرية والبلوغ والعدالة والعلم وكونه واحدا وسلامة حاسة السمع والبصر من العمى والصمم وسلامة اللسان من البكم , فالثمانية الأول هي المشترطة في صحة الولاية والثلاثة الأخر ليست بشرط في الصحة , لكن عدمها يوجب العزل , فلا تصح من الكافر اتفاقا , ولا المجنون ” انتهى من تبصرة الحكام : ١/٢٦، و ينظر : الموسوعة الفقهية : ٣٣/٢٩٥– “কাজী ইয়াজ রহ. বলেন: ‘(ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে একজন) কাজী (বিচারক) হওয়ার যেসকল শর্ত রয়েছে -যা ছাড়া কাজীর -না যোগ্যতাগুণ (কমপক্ষে নূন্যতম মানদন্ডে) উত্তির্ণ হয়, না (মুসলমানদের উপরে তার) ওলী (অভিভাবক) হওয়ার শর্ত পূর্ণ হয়, আর না তাকে কাজী বানানো শুদ্ধ হয়– সেই শর্তগুলো (মোটামুটি) দশটি: মুসলমান হওয়া, আক্বল (জ্ঞানবোধ/বিবেক বুদ্ধি) থাকা, পুরুষ হওয়া, স্বাধীন হওয়া (দাস না হওয়া), বালেগ হওয়া, ন্যায়বিচারক হওয়া, আলেম হওয়া, আর এই(যোগ্যতাগুণ)গুলো একজনের মাঝেই (একই সাথে বিদ্যমান) থাকতে হবে। এছাড়া শ্রবন শক্তি ও দৃষ্টি শক্তি সহিহ-সালামত থাকা, অন্ধ ও বধির না হওয়া এবং বাকশক্তি সহিহ-সালামত থাকা, বোবা না হওয়া। (এই দশটি শর্তের মধ্যে) প্রথম আটটি হল (কাজীর) ওলীত্ব (অভিভাবকত্ব) সহিহশুদ্ধ হওয়ার অন্যতম জরুরী শর্ত। আর বাকি তিনটি (কাজীর ওলীত্ব বা অভিভাবকত্ব) সহিহশুদ্ধ হওয়ার অন্যতম জরুরী শর্ত নয়। তবে এগুলোর অনুপস্থিতিতে কাজী পদ বাতিল হয়ে যাবে। বিধায়, (উম্মাহ’র আলেমগণের) সর্বসম্মতিক্রমে -না কোনো কাফের (ব্যাক্তির ওলীত্ব বা অভিভাবকত্ব) সহিহ হয়, আর না কোনো পাগলের(টা সহিহ হয়)……………”। [তাবসিরাতুল হুক্কাম, ইমাম ইবনে ফারহুন- ১/২৬; আল-মাউসুআতুল ফিকহিয়াহ- ৩৩/২৯৫]

ইমাম ইবনে আবেদীন শামী (মৃ: ১২৫২ হি:) রহ. লিখেছেন-لا ولاية لكافر على مسلم، لا ولاية عامة ولا خاصة، فلا يكون الكافر إماما على المسلمين، ولا قاضيا عليهم، ولا شاهدا، ولا ولاية له في زواج مسلمة، ولا حضانة له لمسلم، ولا يكون وليا عليه ولا وصيا – “কোনো কাফেরের জন্য কোনো মুসলমানের উপর অভিভাবক (ওলী) হওয়ার -চাই তা ব্যাপক অভিভাবকত্ব হোক বা বিশেষভাবে নির্দিষ্ট অভিভাবকত্ব হোক- তার কোনো সুযোগ নেই। তাই কোনো কাফেরকে মুসলমানদের উপর ইমাম (খলিফা) বানানো জায়েয নেই, কাজী (বিচারক) বানানো জায়েয নেই, সাক্ষ্যি বানানো জায়েয নেই। এমনিভাবে তাকে কোনো মুসলীম নারীর বিয়ের ওলী (অভিভাবক) বানানোও জায়েয নেই”[ইবনে আবেদীন-৩/২৮১]

তাই কোনো কাফের ব্যাক্তিকে জোর করে মুসলমানদের উপর বিচারক বানালেও তার বিচার/রায় শরীয়তের দৃষ্টিতে কোনোই মূল্য রাখে না ও তা মুসলমানদের উপর বিন্দুমাত্র  প্রয়োগযোগ্য নয়। [হাওয়াশিউশ শিরওয়ানী আলা তুহফাতিল মুহতায- ১০/১০৬; দুররুল মুহতার- ৫/৩৫৪; বুহুসুন ফি কাজায়া ফিকহিয়্যাহ, তকী উসমানী- ২/২৪৫-২৫৪] 

এজন্য মুসলমানদের বিচার ফয়সালার জন্য বিচারক (কাজী) হওয়ার সর্বপ্রধান ও নূন্যতম যোগ্যতাগুণ হল ‘মুসলিম হওয়া’। আর মুসলীম সমাজের উপরফরযহল, তারা তাদের উপরে যে কোনো বিচার ফয়সালার জন্য বিচারক (কাজী) হিসেবে নিয়োগের ব্যবস্থা করবে একজন মুসলমানকে (যিনি এই পদের সবচাইতে উপযুক্ত)এটাই হবে খিলাফতের মতো আমানতকে তার উপযুক্ত ব্যাক্তির হাতে সোপর্দ করা। যেমন আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন- إِنَّ اللهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا – “নিশ্চই আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন, তোমরা আমানতগুলিকে তার (স্ব-স্ব) আহাল (তথা উপযুক্ত ব্যাক্তি)র কাছে সোপর্দ করে দিবে”[সুরা নিসা ৫৮]

জানা জরুরী যে, মুসলিমবলতে নুন্যতম পক্ষে এমন ব্যক্তিকে বুঝায়, যিনি দ্বীন ইসলামের মৌলিক আকিদায় বিশ্বাসী এবং তার থেকে এমন কোনো বিশ্বাস, কথা বা কাজের বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি, যা থেকে তার কুফরী প্রমাণিত হয়ে সে দ্বীন ইসলাম থেকে বেরিয়ে যায়। এটাই হল মুসলীম বিবেচিত হওয়ার নূন্যতম বৈশিষ্টগুণ। এই বৈশিষ্টগুণ যার মধ্যে পাওয়া যাবে না, তার মধ্যে অন্য আর যত ভাল বৈশিষ্টগুণই থাক না কেনো তাকে মুসলমানদের বিচারক (কাজী) বানানোহারাম। যে ব্যাক্তি তার মতাতম বা ক্ষমতা বলে এই আমানতকে কোনো কাফের মুরতাদের হাতে সোপর্দ করবে, সে হবে এই আমানতের এমন এক খিয়ানতকারী যে আল্লাহ তাআলার সাথে, তাঁর রাসুল সা.-এর সাথে, মুসলমানদের সাথে এবং দ্বীন ইসলামের সাথে প্রকাশ্যবিশ্বাসঘাতকতা (মিরজাফরী) করেছে।

ইসলামী শরীয়তের এই ইজমায়ী মাসআলার বিপরীতে-

(ক)  ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে যেহেতু রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে ধর্মীয় বিধানকে ১০০% মুক্ত করায় বিশ্বাস (ইমান) রাখা অত্যাবশ্যক (ফরয) শর্ত, তাই বিচারক (কাজী)  নিয়োগ দানের ক্ষেত্রেও ইসলাম ধর্মের এই ‘মুসলীম’ হওয়ার শর্তটিকে রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে ১০০% মুক্ত করায় বিশ্বাস (ইমান) রাখা তাদের মতে অত্যাবশ্যক (ফরয)।

(খ) ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে যেহেতু  রাষ্ট্রযন্ত্রে কোনো ধর্মীয় বিধিবিধানকে টেনে আনা ১০০% নিষিদ্ধ (হারাম), তাই বিচারক (কাজী)  নিয়োগ দানের ক্ষেত্রেও ইসলাম ধর্মের এই ‘মুসলীম’ হওয়ার শর্তটিকে রাষ্ট্রযন্ত্রে টেনে আনাও তাদের মতে ১০০% নিষিদ্ধ (হারাম)।

(গ)  ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ যেহেতু বিশ্বাস করে-যে ব্যাক্তিধর্মীয় বিধিবিধানকে রাষ্ট্রব্যাবস্থায় টেনে আনায় বিশ্বাসী সে আদপে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদেই বিশ্বাসী নয় বরং অস্বীকারকারী (কাফের), তাই যে ব্যাক্তি বিচারক (কাজী)  নিয়োগ দানের ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্মের এই ‘মুসলীম’ হওয়ার শর্তটিকে রাষ্ট্রযন্ত্রে টেনে আনায় বিশ্বাসী, তাদের মতে সেও আদপে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে বিশ্বাসীই নয় বরং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে অস্বীকারকারী (কাফের)।

(ঘ) উপরোক্ত এই ৩টি পয়েন্টের এব্যাপারে খাঁটি ধর্মনিরপেক্ষবাদীদেররইজমা(ঐকমত) রয়েছে।

এজন্য ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের কাছে নাস্তিক, হিন্দু, ইহূদী, খৃষ্টান, শিক, বৈধ্য, কাদিয়ানী সহ যে কোনো কাফের বিচারক হওয়ার পথে বিন্দুমাত্র কোনো অন্তরায় নয়, বরং আইনতঃ তার রায় যে কোনো নাগরীকের উপর কার্যকরযোগ্য !!! এটা কত ভয়াবহ হতে পারে নিম্নে তার একটি উদাহরণ দিচ্ছি।

কুরআন সুন্নাহ’র আলোকে এ ব্যাপারে ইজমা রয়েছে যে, ‘মুসলীম দস্পতির বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে তালাক দানের শরয়ী এখতিয়ার রয়েছে শুধুমাত্র স্বামীর হাতে; স্ত্রীর হাতে নয়। যদি স্বামী বিবাহ সম্পাদন হওয়ার আগেই স্ত্রীকে এখতিয়ার দিয়ে থাকে যে, পরে বিবাহ বিচ্ছেদ করতে চাইলে স্ত্রী নিজেই নিজের উপরে তালাক নিয়ে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে পারবে, তাহলেই কেবল সে নিজের উপর তালাক নিতে পারে, (স্বামীকে তালাক দান নয়)। কিন্তু এই এখতিয়ার হবু স্ত্রীকে না দেয়া সত্ত্বেও যদি তাতে রাজি হয়ে উভয়ের মাঝে বিবাহ সম্পাদিত হয়ে যায়, তাহলে বিবাহ বিচ্ছেদের প্রয়োজনে স্বামী তাতে তালাক দিতে অস্বীকার করলে সে শরয়ী কোর্টের কাযী/বিচারকের মাধমে তালাক নিতে পারে এবং পরে শরয়ী পন্থায় অন্য কোনো মুসলমানকে বিয়ে করতে পারে। কিন্তু কোর্টের বিচারকই যদি হয় ‘কাফের’ তাহলে সে বিবাহ বিচ্ছেদের রায় দিলেও শরীয়তের দৃষ্টিতে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়নি, বরং তারা পূর্ববৎ স্বামী স্ত্রী হিসেবেই রয়ে গেছে। এখন ওই নারী যদি ওই কাফের বিচারকের রায়ের ভিত্তিতে দ্বিতীয় কোনো মুসলীমের সাথে খোদ শরীয়ত সম্মত পন্থায়ও বিবাহ পড়ায় তবুও তাদের বিবাহের আক্বদ সহিহ হবে না, কারণ শরীয়তের দৃষ্টিতে ওই নারীর প্রথম স্বামী রয়েছে। অথচ, এরকম ঘটা অহরহ ঘটছে যে, যারা ধর্মনিরপেক্ষ কোর্টের কাছে ধর্মনিরপেক্ষ আইন মেনে অ-শরীয়তসম্মত পন্থায় কাগজ কলমে ডিভোর্স/তালাক নিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করছে এবং শরীয়তের দৃষ্টিতে বাস্তবে ওই দ্বিতীয়জনের সাথে প্রতিনিয়ত জেনা-ব্যাভিচার করছে, আবার এভাবেই তাদের বাচ্চাকাচ্চাও হচ্ছে।

যাহোক, কোনো মুসলীম নারী যদি প্রয়োজনে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে চায়, তাহলে তাকে শরীয়ত সম্মত কোর্টের কাছেই শরনাপন্ন হয়ে মুসলীম বিচারকের মাধ্যমে শরয়ী পন্থায় বিবাহ বিচ্ছেদ করিয়ে নিতে হবে। যদি কোনো অমুসলীম রাষ্ট্রের অধিনে মুসলমানদের বিচার ফয়সালার জন্য আলাদা শরয়ী কোর্ট না থাকে, তাহলে ওই নারীর উচিৎ বিজ্ঞ মুফতীগণের শরনাপন্ন হওয়া এবং তাদের পরামর্শ ক্রমে মুসলমানদের এমন কোনো জামাআতের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটিয়ে নেয়া, যে জামাআতকে বিজ্ঞ আলেমগণ শরয়ী কাযী’র বিকল্প বলে সিদ্ধান্ত দেন। [বুহুসুন ফি কাজায়া ফিকহিয়্যাহ মুআসিরাহ, মুফতী তকী উসমানী- ২/২৪৫-২৫৪] 

এবারে বিবেক থাকলে বিচার করে দেখুন, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা কোন্ পথের পথিক !!!!

 


>>> মূল সূচিপত্র (index) থেকে এ পেজের পূর্ববর্তী বা পরবর্তী আলোচনা পড়তে [এখানে ক্লিক করুন]