হিজরতের পূর্বে মহানবী ﷺ এবং মুসলমানদের উপরে মক্কার কুরায়েশ নেতৃবর্গের জুলুম অত্যাচার ও নিপিড়ন
>>> মূল সূচিপত্র (index) থেকে এ পেজের পূর্ববর্তী বা পরবর্তী আলোচনা পড়তে [এখানে ক্লিক করুন]
পূর্ব আলোচনার পর…
ভাতিজা মুহাম্মদ মুস্তফা ﷺকে থামানোর জন্য চাচা আবু তালেবকে বারবার সতর্ক করার পরও যখন তিনি প্রতিবারই ভাতিজার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার পরিবর্তে উল্টো তাঁর উপরের নমনীয়তা দেখাচ্ছিলেন তাঁকে রক্ষা করে যাচ্ছিলেন, তখন কুরায়েশ নেতৃবর্গ আরো বেশি হারে উত্তেজিত হয়ে ওঠে এবং বিভিন্ন সমাবেশে একে অপরকে উত্তেজিত করতে থাকে, যাতে মুহাম্মাদ ﷺ ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে বিশেষ ভাবে ব্যবস্থা নেয়া হয়। এর ফলে কুরায়েশ নেতৃবর্গ এক মিটিং-এ সিদ্ধান্ত নেয় যে, প্রত্যেক গোত্রের লোকেরা তাদের নিজ নিজ গোত্রের মুসলমানদেরকে চিহ্নিত করে এমন শায়েস্তা করবে যাতে তারা বাধ্য হয়ে পূণরায় তাদের পূর্বপুরুষদের ধর্মে ফিরে আসে। এই সিদ্ধান্ত মোতাবেক মক্কার নেতৃবর্গ ও সাধারণ মুশরেকরা তাদের স্ব স্ব গোত্রের মুসলমানদের উপরে জুলুম অত্যাচার শুরু করে দেয়।
মক্কায় এ নির্মম অবস্থা চলতে দেখে চাচা আবু তালেব বিশেষ করে তার ভাতিজা মুহাম্মাদ ﷺ-এর জীবনের ব্যাপারে শংকিত হয়ে ওঠেন। এজন্য তিনি ভাতিজাকে মুশরেকদের জুলুম অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষার জন্য বনু হাশিম ও বনু আব্দুল মুত্তালীব গোত্রকে সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়ার জন্য আহবান জানান। এর ফলে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর আরেক চাচা আবু লাহাব ছাড়া বনু হাশিম ও বনু আব্দুল মুত্তালীব গোত্রের প্রায় সকলে মুহাম্মাদ ﷺকে রক্ষার জন্য এ আহবানে সাড়া দেয়, যার কারণে মুশরেকরা প্রাথমিক ভাবে নবীজী ﷺ-এর উপরে তখনো পর্যন্ত পরিপূর্ণ ভাবে চড়াও হতে পারছিল না বিধায় সেসময়ে মুশরেকদের হাত থেকে রাসুলুল্লাহ ﷺ আপাতত বেঁচে যায়। কিন্তু মুশরেকরা তাদের মনের ঝাল মিটাতে সময়ে সুযোগে তাঁকে গালিগালাজ করা, কষ্টদায় কটুবাক্য শোনানো, কখনো কখনো চরথাপ্পর কিলঘুষি দেয়া, ধস্তাধস্তি করা বা অন্য কোনো প্রকারের কষ্ট দেয়ার কোনো সুযোগ হাতছাড়া করতে দিতো না। যেমন, বিন শাদ্দাদ রহ-এর পিতার সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, ত্বারেক ইবনু আব্দিল্লাহ আল-মুহারিবী রা. বর্ণনা করেন- رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَرَّتَيْنِ : مَرَّةً بِسُوقِ ذِي الْمَجَازِ ، وَأَنَا فِي بِيَاعَةٍ لِي أَبِيعُهَا ، وَمَرَّ عَلَيْهِ جُبَّةٌ لَهُ حَمْرَاءُ يُنَادِي بِأَعْلَى صَوْتِهِ : أَيُّهَا النَّاسُ قُولُوا : لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ تُفْلِحُوا ، قَالَ : وَرَجُلٌ يَتْبَعُهُ بِالْحِجَارَةِ ، وَقَدْ أَدْمَى كَعْبَيْهِ وَعُرْقُوبَيْهِ ، وَيَقُولُ : يَا أَيُّهَا النَّاسُ لَا تُطِيعُوهُ ، فَإِنَّهُ كَذَّابٌ ، قُلْتُ : مَنْ هَذَا ؟ قَالُوا : هَذَا غُلَامُ بَنِي عَبْدِ الْمُطَّلِبِ ، قُلْتُ : فَمَنْ هَذَا الَّذِي يَتْبَعُهُ يَرْمِيهِ ؟ قَالُوا : عَمُّهُ عَبْدُ الْعُزَّى وَهُوَ أَبُو لَهَبٍ . أخرجه ابن أبي شيبة في مسنده , طارق بن عبد الله المحاربي : ٢/٣٢٢ رقم ٨٢٢ اسناده صحيح ، و الدارقطني في سننه , كتاب البيوع , باب البيوع: ٢/٦٤٠ رقم ٢٩٤٤، و صححه شعيب الأرناؤوط في تخريج سنن الدارقطني : رقم ٢٩٧٦، و صححه الوادعي في الصحيح المسند: رقم ٥١٦ – “আমি রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে দু’বার দেখেছি। একবার (দেখেছি আমার) জাহেলী জামানায় (মক্কার) জুল-মাযাজ বাজারে; তখন আমি আমার জন্য যা কিছু কেনার তা কেনাকাটা করায় লিপ্ত ছিলাম। (এক সময় দেখি) তিঁনি (আমার পাশ দিয়ে) চলে গেলেন; তখন তার পড়নে ছিল লাল রঙের জুব্বা। তিঁনি (সেখানে উপস্থিত লোকদেরকে উদ্দেশ্য করে) উচ্চ আওয়াজে বলছিলেন: ‘হে লোকসকল! তোমরা বলো- لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ – আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই’, (তাহলে) তোমরা (দুনিয়া ও আখেরাতে) সফলকাম হয়ে যাবে’। (তখন দেখলাম) এক ব্যাক্তি পাথর নিয়ে তাঁর পিছু পিছু যাচ্ছে, আর (ওই পাথর গুলি নিক্ষেপ করে করে) তাঁর দু’পায়ের গোড়ালী ও টাখনুকে রক্তাক্ত করছে আর বলছে: ‘হে লোক সকল! তোমরা তার কথা শুনো না; সে একটা মিথ্যুক’। আমি (লোকদেরকে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর দিকে ইংগীত করে) জিজ্ঞেস করলাম: ‘ইনি কে’? তারা বললো: ‘ইনি হলেন বনু আব্দুল মুত্তালীবের এক সন্তান (যার নাম মুহাম্মাদ)’। আমি (পূণরায়) জিজ্ঞেস করলাম: ‘যে ব্যাক্তি তাঁর পিছু পিছু যাচ্ছিল তাঁকে পাথর মাড়ছিল -সে কে’? তারা বললো: ‘তাঁরই চাচা -আব্দুল উযযা; সে হল আবু লাহাব”। [আল-মুসনাদ, ইমাম ইবনু আবি শাইবাহ- ২/৩২২ হাদিস ৮২২; আল-মুসান্নাফ, ইমাম ইবনু আবি শাইবাহ- ৭/৩৩২ হাদিস ৩৬৫৬৫; সহিহ ইবনে খুযাইমাহ- ১/৮২; সুনানে দ্বারাকুতনী– ২/৬৪০ হাদিস ২৯৪৪; আল-মুহাল্লা, ইমাম ইবনে হাযাম- ৯/১১২; আল-মুনতাজাম, ইবনুল জাওযী- ২/৩৬৫; মাত্বালিবুল আলীয়্যাহ, ইবনে হাজার- ১২/১৫৩ হাদিস ৪৩৪০]
ওরওয়াহ ইবনুল জুবায়েরের সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. বর্ণনা করেন- حَضَرْتُهُمْ وَقَدْ اجْتَمَعَ أَشْرَافُهُمْ يَوْمًا فِي الْحِجْرِ ، فَذَكَرُوا رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، فَقَالُوا : مَا رَأَيْنَا مِثْلَ مَا صَبَرْنَا عَلَيْهِ مِنْ هَذَا الرَّجُلِ قَطُّ ، سَفَّهَ أَحْلَامَنَا ، وَشَتَمَ آبَاءَنَا ، وَعَابَ دِينَنَا ، وَفَرَّقَ جَمَاعَتَنَا ، وَسَبَّ آلِهَتَنَا ، لَقَدْ صَبَرْنَا مِنْهُ عَلَى أَمْرٍ عَظِيمٍ ، أَوْ كَمَا قَالُوا ، قَالَ : فَبَيْنَمَا هُمْ كَذَلِكَ ، إِذْ طَلَعَ عَلَيْهِمْ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، فَأَقْبَلَ يَمْشِي ، حَتَّى اسْتَلَمَ الرُّكْنَ ، ثُمَّ مَرَّ بِهِمْ طَائِفًا بِالْبَيْتِ ، فَلَمَّا أَنْ مَرَّ بِهِمْ غَمَزُوهُ بِبَعْضِ مَا يَقُولُ ، قَالَ : فَعَرَفْتُ ذَلِكَ فِي وَجْهِهِ ، ثُمَّ مَضَى ، فَلَمَّا مَرَّ بِهِمْ الثَّانِيَةَ ، غَمَزُوهُ بِمِثْلِهَا ، فَعَرَفْتُ ذَلِكَ فِي وَجْهِهِ ، ثُمَّ مَضَى ، ثُمَّ مَرَّ بِهِمْ الثَّالِثَةَ ، فَغَمَزُوهُ بِمِثْلِهَا ، فَقَالَ : ” تَسْمَعُونَ يَا مَعْشَرَ قُرَيْشٍ ، أَمَا وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ ، لَقَدْ جِئْتُكُمْ بِالذَّبْحِ ، فَأَخَذَتْ الْقَوْمَ كَلِمَتُهُ ، حَتَّى مَا مِنْهُمْ رَجُلٌ إِلَّا كَأَنَّمَا عَلَى رَأْسِهِ طَائِرٌ وَاقِعٌ ، حَتَّى إِنَّ أَشَدَّهُمْ فِيهِ وَصَاةً قَبْلَ ذَلِكَ لَيَرْفَؤُهُ بِأَحْسَنِ مَا يَجِدُ مِنَ الْقَوْلِ ، حَتَّى إِنَّهُ لَيَقُولُ : انْصَرِفْ يَا أَبَا الْقَاسِمِ ، انْصَرِفْ رَاشِدًا ، فَوَاللَّهِ مَا كُنْتَ جَهُولًا ، قَالَ : فَانْصَرَفَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، حَتَّى إِذَا كَانَ الْغَدُ ، اجْتَمَعُوا فِي الْحِجْرِ وَأَنَا مَعَهُمْ ، فَقَالَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ : ذَكَرْتُمْ مَا بَلَغَ مِنْكُمْ وَمَا بَلَغَكُمْ عَنْهُ ، حَتَّى إِذَا بَادَأَكُمْ بِمَا تَكْرَهُونَ تَرَكْتُمُوهُ ! فَبَيْنَمَا هُمْ فِي ذَلِكَ ، إِذْ طَلَعَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَوَثَبُوا إِلَيْهِ وَثْبَةَ رَجُلٍ وَاحِدٍ ، فَأَحَاطُوا بِهِ ، يَقُولُونَ لَهُ : أَنْتَ الَّذِي تَقُولُ كَذَا وَكَذَا ؟ لِمَا كَانَ يَبْلُغُهُمْ عَنْهُ مِنْ عَيْبِ آلِهَتِهِمْ وَدِينِهِمْ ، قَالَ : فَيَقُولُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ” نَعَمْ ، أَنَا الَّذِي أَقُولُ ذَلِكَ ” ، قَالَ : فَلَقَدْ رَأَيْتُ رَجُلًا مِنْهُمْ أَخَذَ بِمَجْمَعِ رِدَائِهِ ، قَالَ : وَقَامَ أَبُو بَكْرٍ الصِّدِّيقُ رَضِيَ اللَّهُ تَعَالَى عَنْهُ ، دُونَهُ يَقُولُ وَهُوَ يَبْكِي : أَتَقْتُلُونَ رَجُلا أَنْ يَقُولَ رَبِّيَ اللَّهُ ؟ ثُمَّ انْصَرَفُوا عَنْهُ . رواه أحمد في مسنده , مسند المكثرين من الصحابة , مسند عبد الله بن عمرو بن العاص رضي الله تعالى عنهما : ٢/٢١٨ رقم ٦٩٩٦، و قال الهيثمي في مجمع الزاوئد : ٦/١٦ : قلت في الصحيح طرف منه رواه أحمد و قد صرح ابن إسحاق بالسماع و بقية رجاله رجال الصحيح، و قال الشيخ أحمد شاكر: ٦/٤٦٢ رقم ٧٠٣٦ : إسناده صحيح، و قال شعيب الأرنؤوط : إسناده حسن – “কুরায়েশদের গণ্যমান্য ব্যাক্তিরা একদিন (মসজিদে হারামের) হিজরের (হাতীমের) মধ্যে (একটি বিশেষ মিটিং-এর জন্য) সমবেত হল, আমিও (সেখানে) তাদের সাথে উপস্থিত ছিলাম। তখন তারা রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে নিয়ে আলোচনা করতে লাগলো। তারা বললো: ‘(মক্কার অবস্থা বর্তমানে যেখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তাতে) আমরা কি (আজ এটা পরিষ্কার) দেখতে পাচ্ছি না যে, (আমাদের পূর্বপুরুষদের ধর্মত্যাগী) এই ব্যাক্তিটির উপরে আমরা (এখনো পর্যন্ত) যতটা ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছি, তেমনটা আর কারোর ক্ষেত্রেই দেইনি!? (আমরা অনেক বেশিই ছাড় দিয়ে রেখেছি তাকে। অথচ) সে আমাদের (সমাজের) দূরদৃষ্টিসম্পন্ন (সুশীল ও বুদ্ধিজীবী)দেরকে নির্বোধ বলেছে, সে আমাদের পূর্বপুরুষদের (বিশ্বাস ও ধর্মীয় সংস্কৃতির) সমালোচনা করেছে, সে আমাদের ধর্মের দোষ ধরেছে, সে আমাদের জামাআত থেকে বের হয়ে গেছে, সে আমাদের উপাস্যদের সমালোচনা করেছে। আমরা তার ব্যাপারে খুব বেশিই ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছি। অথবা তারা (কম বেশি) এরকমই কিছু বললো (যা এখন আমার হুবহু স্মরণে নেই)। তাদের মাঝে এরকম কথাবার্তা চলছিল, এমন সময় তাদের সামেনে রাসুলুল্লাহ ﷺ এসে হাজির হলেন। এরপর তিঁনি (উপস্থিত কারোর সাথে কোনো কথা না বলে) সোজা হেটে গিয়ে রুকন ইস্তালাম (হাজরে আসওয়াদ চুম্মন) করলেন, তারপর তাদের সামন দিয়ে গিয়ে বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করতে লাগলেন। তিঁনি যখন (প্রথমবার) তাদের সামন দিয়ে অতিক্রম করলেন, তখন তারা -যেসকল কথা তিঁনি (মক্কার লোকদেরকে বিভিন্ন সময়ে) বলতেন (আল্লাহ’র পথে ডাকার জন্য), সেসব (কথা ব্যাঙ্গ বিদ্রুপের ছলে) বলে তারা (তাঁর সাথে) কটুক্তি (ঠাট্টা মশকরা ও তুচ্ছ তাচ্ছিল্লতা প্রদর্শন) করলো। (এসব শুনে তখন তাঁর মনে যে অনেক কষ্ট হচ্ছিল, সেটা) তখন আমি তার চেহারয় (এর প্রতিক্রিয়া দেখে) বুঝতে পেলাম। এরপরও তিঁনি (তাওয়াফ) চালিয়ে যেতে থাকলেন। তিঁনি যখন দ্বিতীয়বার তাদের সামন দিয়ে অতিক্রম করলেন, তখনও তারা একই রকম কটুক্তি (ও ঠাট্টা মশকরা) করলো। (এবারও যে তাঁর মনে ওসব কথা অনেক কষ্ট দিল, সেটা) তখন আমি তার চেহারয় (আবারও একই প্রতিক্রিয়া দেখে) বুঝতে পেলাম। এরপরও তিঁনি (তাওয়াফ) চালিয়ে যেতে থাকলেন। যখন তিঁনি তৃতীয়বার তাদের সামন দিয়ে অতিক্রম করলেন, তখনও তারা একই রকম কটুক্তি (ও ঠাট্টা মশকরা) করলো। এবারে তিঁনি বললেন: ‘তোমরা শোনো, হে কুরায়েশ সম্প্রদায়! ওই সত্ত্বার কসম যাঁর হাতে মুহাম্মাদের জীবন, আমি তোমাদের জবেহ (হওয়ার মতো বিষয়) নিয়ে এসেছি’। (তাঁর মুখ থেকে এ কথা শুনতেই) লোকেরা তখনই কথা বলা থামিয়ে দিলো (একদম পিন-পতন নিরব নিস্তব্ধতা); এমনকি তাদের মধ্যে (ওখানে তখন) এমন কেউ ছিল না, (যাকে দেখে একথা না মনে হচ্ছিল যে, সে এজন্য চুপচাপ হয়ে আছে যে,) তার মাথায় পাখি বসে আছে, (নড়লেই উড়ে যাবে)। অবশেষে (লোকজনের এ ঘোরের অবস্থা কাটাতে) এর আগে তাদের মধ্যে সবথেকে যে কট্টর ওকালতকারী (পরিচয় দিচ)ছিল, সে (রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর উক্ত) কথাটির (এমন কোনো) সর্বত্তম অর্থ ধরে নিলো যা সে (তার মতো করে) বুঝেছিল। সে বলেই বসলো: ‘(ভালোয় ভালোয় এদের এখান থেকে) কেটে পরো -হে আবুল কাসেম (মুহাম্মাদ)! সোজা কেটে পরো! আল্লাহর কসম, তুমি তো মুর্খ নও’! তখন (সেদিনকার মতো) রাসুলুল্লাহ ﷺ (সেখান থেকে) চলে গেলেন। এর পরের দিন সকালে তারা (আবারও) হিজরের (হাতীমের) মধ্যে সমবেত হল; (সেবারও) আমি তাদের সঙ্গে ছিলাম। তখন তারা একে অন্যে বলাবলি করতে লাগলো: ‘(মুহাম্মাদ এযাবৎ) তোমাদের কারোর কাছে (তাঁর) যেসব কথা পৌছিয়েছে এবং (সে কার কাছে কী পৌছাচ্ছে, কোথায় কী করছে -এ সম্পর্কে) তার ব্যাপারে তোমাদের কাছে যে খবর পৌছেছে -তা তো তোমরা উল্লেখ করলে। অথচ তোমাদের কাছে অপছন্দনী ঠেঁকছে -এমন বিষয়গুলো যখন সে (আমাদের সমাজে) চালু করছে, তখন তোমরা তাকে (প্রতিহত না করে তাকে তার কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য এমনিতেই) ছেড়ে দিয়ে রাখলে! তাদের মাঝে এরকম কথাবার্তা চলছিল, এমন সময় তাদের সামেনে রাসুলুল্লাহ ﷺ এসে হাজির হন (এবং যখনই নামাযে দাঁড়ান), তখনই সকলে মিলে একযোগে তাঁর উপরে ঝাপিয়ে পড়ে। আর যেহেতু (এ ঘটনার আগেই) তাদের কাছে এমন কথা পৌছেছিল যে, রাসুলুল্লাহ ﷺ তাদের উপাস্য সমূহ ও (পূর্বসূরীদের) দ্বীন-ধর্মের দোষ ধরেন, তাই তারা তাঁকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে, তারপর তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে: ‘তুমিই সেই ব্যাক্তি (তাই না?), যে (আমাদের দেব দেবী ও ধর্মের ব্যাপারে) এই এই কথা বলে থাকো’? তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন: ‘হ্যাঁ, আমিই সেই ব্যাক্তি যে ওসব বলে থাকি’। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. বলেন: ‘তখন আমি তাদের মধ্যে এক ব্যাক্তিকে দেখলাম, সে তার চাদরের দুপাশ একত্রিত করে (রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর গলাকে পেঁচিয়ে) ধরে আছে (এবং তাঁর দম বন্ধ করার জন্য চাদরটিকে কঁসে খিঁচছে)। তখন আবু বকর সিদ্দিক রা. তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে কেঁদে কেঁদে (উপস্থিত লোকজনকে উদ্দেশ্য করে) বলছেন: ‘ أَتَقْتُلُونَ رَجُلًا أَنْ يَقُولَ رَبِّيَ اللَّهُ -“তোমরা কি এমন ব্যাক্তিকে হত্যা করে ফেলবে, যে বলে- ‘আমার রব (প্রতিপালক প্রভু হল) আল্লাহ, (আর আমি শুধু তাঁরই ইবাদত ও গোলামী করবো)” [সূরা গাফের ২৮] । এরপর তারা রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে রেখে চলে যায়”। [মুসনাদে আহমদ- ২/২১৮ হাদিস ৬৯৯৬; সহিহ ইবনে হিব্বান– ১৪/৫২৫; মুসনাদে বাযযার– ৬/৪৫৭ হাদিস ২৪৯৭; মাজমাউয যাওয়ায়ীদ, হাইছামী- ৬/১৬]
সহিহ বুখারীতে এসেছে যে, আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. বর্ণনা করেন- رَأَيْتُ عُقْبَةَ بْنَ أَبِي مُعَيْطٍ، جَاءَ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ يُصَلِّي، فَوَضَعَ رِدَاءَهُ فِي عُنُقِهِ فَخَنَقَهُ بِهِ خَنْقًا شَدِيدًا، فَجَاءَ أَبُو بَكْرٍ حَتَّى دَفَعَهُ عَنْهُ، فَقَالَ: {أَتَقْتُلُونَ رَجُلًا أَنْ يَقُولَ رَبِّيَ اللَّهُ، وَقَدْ جَاءَكُمْ بِالْبَيِّنَاتِ مِنْ رَبِّكُمْ} . رواه الإمام البخاري في صحيحه , كتاب فضائل الصحابة , باب قول النبي صلى الله عليه وسلم لو كنت متخذا خليلا: ٥/١٠ رقم ٣٦٧٨ – “আমি (একদিন) দেখি, রাসুলুল্লাহ ﷺ (ক্বাবার হেরেমের মধ্যে) নামায পড়ছেন, এমন সময় উক্ববাহ বিন আবি মুয়াইত্ব তাঁর কাছে এসে সে তার চাদর দিয়ে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর গলাকে পেঁচিয়ে ধরলো, তারপর তা দিয়ে সে (রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর গলাকে) খুবই শক্তভাবে কঁসে খিঁচছিলো (যেন রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয়)। তখন আবু বকর এসে রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে ওর থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে (কুরআনের এই আয়াতটি) তেলাওয়াত করেন- أَتَقْتُلُونَ رَجُلًا أَنْ يَقُولَ رَبِّيَ اللَّهُ، وَقَدْ جَاءَكُمْ بِالْبَيِّنَاتِ مِنْ رَبِّكُمْ -“তোমরা কি এমন ব্যাক্তিকে হত্যা করে ফেলবে, যে বলে- ‘আমার রব (প্রতিপালক প্রভু হল) আল্লাহ, (আর আমি শুধু তাঁরই ইবাদত ও গোলামী করবো)! অথচ সেঁ তোমাদের কাছে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে আলা-বাইয়্যেনাহ (পরিষ্কার নিদর্শন সমূহ) নিয়ে এসেছে” [সূরা গাফের ২৮]। [সহিহ বুখারী– ৫/১০ হাদিস ৩৬৭৮]
আমর ইবন মাইমুন রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বর্ণনা করেন- مَا رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ دَعَا عَلَى قُرَيْشٍ غَيْرَ يَوْمٍ وَاحِدٍ، فَإِنَّهُ كان يصلّى ورهط من قريش جلوس، وسلا جَزُورٍ قَرِيبٌ مِنْهُ. فَقَالُوا: مَنْ يَأْخُذُ هَذَا السلا فيلقيه على ظهره؟ فقال عقبة ابن أَبِي مُعَيْطٍ أَنَا، فَأَخَذَهُ فَأَلْقَاهُ عَلَى ظَهْرِهِ. فَلَمْ يَزَلْ سَاجِدًا حَتَّى جَاءَتْ فَاطِمَةُ فَأَخَذَتْهُ عَنْ ظَهْرِهِ. فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «اللَّهمّ عَلَيْكَ بِهَذَا الْمَلَأِ مِنْ قُرَيْشٍ، اللَّهمّ عَلَيْكَ بِعُتْبَةَ بْنِ رَبِيعَةَ، اللَّهمّ عَلَيْكَ بِشَيْبَةَ بْنِ رَبِيعَةَ، اللَّهمّ عَلَيْكَ بِأَبِي جَهْلِ بْنِ هِشَامٍ، اللَّهمّ عَلَيْكَ بِعُقْبَةَ بْنِ أَبِي مُعَيْطٍ، اللَّهمّ عَلَيْكَ بِأُبَيِّ بْنِ خَلَفٍ- أَوْ أُمَيَّةَ بْنِ خَلَفٍ-» شُعْبَةُ الشَّاكُّ قَالَ عَبْدُ اللَّهِ: فَلَقَدْ رَأَيْتُهُمْ قُتِلُوا يَوْمَ بَدْرٍ جَمِيعًا، ثُمَّ سُحِبُوا إِلَى الْقَلِيبِ غَيْرَ أُبَيٍّ- أو أمية بن خلف- فَإِنَّهُ كَانَ رَجُلًا ضَخْمًا فَتَقَطَّعَ . رواه أحمد في مسنده , مسند المكثرين من الصحابة , مسند عبد الله بن مسعود رضي الله تعالى عنه : ١/٤١٧ رقم ٣٩٥٢، – “আমি রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে (আমার জীবনে শুধুমাত্র) একদিন ছাড়া আর কখনই কুরায়েশদের উপরে বদ দোয়া দিতে দেখিনি। (সেদিন ঘটনা এমন ছিল যে,) তিঁনি তখন (ক্বাবার হারামে) (একাকি) নামায পড়ছিলেন, আর (অনতি দূরেই) কুরায়শের কিছু লোকজন বসে ছিল। তাঁর অনতিদূরেই (জমিনে পড়ে) ছিল মৃত উটের নাড়িভুঁড়ি। তারা বললো: ‘কে আছে, যে এই নাড়িভুঁড়ি(র স্তুপ)টি নিয়ে গিয়ে ওর পিঠের উপরে নিক্ষেপ করবে’? তখন উক্ববাহ বিন আবি মুয়াইত্ব বললো: ‘আমি (এ কাজ করবো)’। ফলে সে ওটাকে নিয়ে গিয়ে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর পিঠের উপরে নিক্ষেপ করলো। তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ (নাড়িভুঁড়ির ওজনে সিজদা থেকে মাথা উঠাতে পারছিলেন না, যার কারণে তিঁনি বাধ্য হয়ে) সিজদাহ’র হালতেই রয়ে গেলেন। পরে (এ খবর শুনতে পেয়ে তাঁর মেয়ে) ফাতেমা এসে ওটাকে তাঁর পিঠের উপর থেকে নামিয়ে দিলেন। পরে (নামায থেকে উঠে) রাসুলুল্লাহ ﷺ (আল্লাহ’র কাছে ফরিয়াদ করে) বলেন: ‘হে আল্লাহ! কুরায়েশদের এসব মালা’ (নেতা, মোড়ল বা নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তি দে)র উপরে তোমার অভিশাপ হোক! হে আল্লাহ! উৎবাহ বিন রাবিয়াহ’র উপরে তোমার অভিশাপ হোক! হে আল্লাহ! আবু জাহল বিন হিশামের উপরে তোমার অভিশাপ হোক! হে আল্লাহ! উক্ববাহ বিন আবি মুয়াইত্বের উপরে তোমার অভিশাপ হোক! হে আল্লাহ! উবাই বিন খলফের (অথবা বলেছেন) উমাইয়্যাহ বিন খলফের উপরে তোমার অভিশাপ হোক! আব্দুল্লাহ (ইবনে মাসউদ রা) বলেন: ‘আমি তাদেরকে দেখেছি, তারা সকলেই বদরের (জিহাদের) দিন নিহত হয়েছিল। পরে উবাই (বিন খলফ) অথবা উমাইয়্যা বিন খলফ ব্যতীত সকলকে টেনে নিয়ে গিয়ে কুপে ফেলে দেয়া হয়। কারণ সে ছিল মোটাসোটা ব্যাক্তি, তাই (কুঁপে ফেলার আগে) তা(র শরীরটা)কে (কিছুটা টুকরো করে) কাটতে হয়েছিল”। [মুসনাদে আহমদ– ১/৪১৭ হাদিস ৩৯৫২]
উল্লেখ্য: এই হাদিসে উমাইয়্যাহ বিন খালফ-কে বদরের দিন কুপে নিক্ষেপ করার কথাটি সহিহ, কেননা বদরের জিহাদের দিনই তার মৃত্যু হয়েছিল। আর উমাইয়্যাহ’র ভাই উবাই বিন খালফ মড়েছিল আরো পরে উহূদের জিহাদের দিন। [আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ইবনে কাসির- ৩/৫৯] এখানে বর্ণনাকারী শু’বার সন্দেহ হয়েছে যে, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. কার নাম বলেছিলেন।
রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর সাথে এধরনের নিকৃষ্ট আচরণ করা হচ্ছিল কুরায়েশ নেতৃবর্গের অন্যতম সম্মানীত ব্যাক্তিত্ব চাচা আবু তালেব জীবিত থাকাবস্থাতেই, যখন বনু হাশিম ও বনু আব্দুল মুত্তালীব গোত্র তাঁকে নিরাপত্তা দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। তাহলে চিন্তা করে দেখুন, ওই সকল সাধারণ মুসলমানদের অবস্থা কেমন দূর্বিসহ ও সোচনীয় ছিল, যাদের উপরে না ছিল কোনো উচ্চ বংশ বা গোত্রীয় ছাঁয়া, না ছিল কোনো আত্বীয় স্বজন, আর না ছিল কোনো সামাজিক মর্যাদা, যারা সমাজে দাস দাসী হয়ে অমানবিক জীবন কাটাচ্ছিল। সে সময়কার সমাজে দাস সাদসীদেরকে সমাজের সবচাইতে নিচু স্তরের অজাত পর্যায়ের গণ্য করা হত, বিধায় তাদের মালিকরা তাদের উপরে যত নির্মম নির্যাতনই চালাক না কেনো -কেউ তাদেরকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসতো না। যে সকল মুসলমানরা আরবের কোনো গণ্যমান্য গোত্র বা বংশের লোক ছিলেন, তাদের উপরে অপর কোনো গোত্রের কেউ তো নির্যাতন করার সাহস করতো না বটে, কিন্তু যে সকল মুসলমানদের পিছনে তাদের গোত্রিয় কোনো পৃষ্ঠপোষকতা ছিল না, তাদের মধ্যে কেউ পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া দ্বীন-ধর্ম পরিত্যাগ করে দ্বীন-ইসলাম গ্রহন করেছে জানতে পেলেই তার উপরে শুরু হয়ে যেতো নির্যাতনের ষ্টিমরোলার। কষ্টদায়ক গালিগালাজ ও কটাক্ষ করা, হৃদয় বিদারক তুচ্ছতাচ্ছিল্লতা প্রদর্শন করা, হাত/পা/লাঠি/চাবুক ইত্যাদি দিয়ে মারপিট করা, মরুভূমির উত্তপ্ত বালুর উপরে শুইয়ে দিয়ে বুকের উপরে ভারী পাথড় চাপা দিয়ে রাখা, জ্বলন্ত কয়লার উপরে শুইয়ে দিয়ে বুকের উপরে পা দিয়ে চেঁপে ধরা, গলা চেঁপে ধরে শ্বাসরুদ্ধ করার চেষ্টা করা, গলায় রশি বেঁধে এদিক সেদিক টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে বেড়ানো, বুক পর্যন্ত মাটির নিচে চাঁপা দিয়ে রাখা, দেহে বল্লম বিদ্ধ করে শহিদ করে দেয়া, দুই পা’কে দুই দিকে মুখকারী দু’টি উটের সাথে বেঁধে উটদুটিকে তাদের মুখ বরাবর তাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে শরীর থেকে পা’কে ছিড়ে ফেলা, পা’কে উটের সাথে বেঁধে ছেঁচড়িয়ে নিয়ে বেড়ানো -কোন্ নির্যাতনটা সে সময় বাদ গেছে কাফের-মুশরেকদের পক্ষ থেকে ?!!! নিম্নে আমরা পাঠকদেরকে তখনকার পরিবেশ পরিস্থিতি বোঝানোর সুবিধার্থে হাতে গোণা মাত্র কয়েকজন সাহাবীর কিছু লোমহর্ষক দূরাবস্থার কথা নমুনা স্বরূপ উল্লেখ করছি, যাতে অনুমান করা সহজ হয় যে, কী রকম পরিস্থিতির কারণে তখনকার মক্কার মুসলমানদের উপরে মক্কা ছেড়ে অন্য অনুকুল কোথাও হিজরত করা ফরয করা হয়েছিল।
তখনকার মক্কার সাধারণ মুসলমানদের উপরে জুলুম অত্যাচারের দুরাবস্থার কথা যআলোচনায় আসে, তখন তাদের মধ্যে বিশেষ ভাবে আসে সাহাবী আম্মার বিন ইয়াসির রা. ও তাঁর পরিবারের কথা। ইসলামের সূচনাকালে মুসলমানরা যখন আরকাম রা.-এর গৃহে সমবেত হতেন, তখন আম্মার বিন ইয়াসীর রা. ও তাঁর সাথী সুহাইব ইবনে সিনান রা. একই সঙ্গে ইসলাম কবুল করেন। পরে আম্মার রা. তাঁর পরিবারকে ইসলামের দাওয়াত দিলে তারাও ইসলাম কবুল করে নেন। তাঁর বয়বৃদ্ধ পিতা ইয়াসীর বিন আমের রা. ছিলেন ইয়ামেনের কাহতান গোত্রের লোক, যিঁনি জাহেলী জামানায় মক্কায় আসেছিলেন তাঁর হারিয়ে যাওয়া এক ছেলের খোঁজে, পরে তাকে খুঁজে না পেয়ে তিঁনি আর কখনো ইয়ামেনে ফিরে যাননি, বরং মক্কাতেই বনু মাখজুম গোত্রের আবু হুজাইফা বিন মুগীরাহ বিন আব্দুল্লাহ বিন মাখজুমে’র সাথে চুক্তি করে সেই গোত্রের একজন সদস্য হয়ে মক্কাতেই বসবাস করতে থাকেন। পরে আবু হুজাইফাহ বিন মুগীরাহ তার মালিকানাধীন সুমাইয়্যাহ বিনতে খাইয়্যাত নামীয় এক দাসীকে ইয়াসির বিন আমেরকে উপহার দেন। পরে ইয়াসির বিন আমের ওই দাসী সুমাইয়্যাহ বিনতে খাইয়্যাতকে বিয়ে করে নেন এবং তার গর্ভে আম্মার বিন ইয়াসির জন্মগ্রহন করেন (যাঁর আব্দুল্লাহ নামে একজন ভাইয়ের কথাও জানা যায় যিনি ইসলাম গ্রহন করেছিলেন, তবে ভাইটি সুমাইয়্যাহ বিনতে খাইয়্যাতের গর্ভে জন্মগ্রহন করেছিল কিনা তা জানা যায়না)। সে সময়, মক্কায় এই ইয়াসির পরিবারের নিজেদের না ছিল কোনো বংশ, না ছিল কোনো গোত্র, যারা তাদের সেই বিপদের দিন গুলিতে এগিয়ে আসতে পারতো। এজন্য বনু মাখজুম গোত্র যখন ইয়াসীর পরিবারের ইসলাম গ্রহনের কথা জানতে পায়, তখন ওরা তাঁদেরকে আটকে রেখে নির্মম ভাবে নির্যাতন করা শুরু করে দেয়। তারা তাঁদেরকে ঘর থেকে বের করে দেয়। ইয়াসির পরিবারের উপরে নির্যাতনের নমুনা এই ছিল যে, কখনো কখনো তাদেরকে দিনের প্রখর রোদ্রে উত্তপ্ত বালুর উপরে দাঁড় করিয়ে রাখা হত, কখনো খালি গায়ে রেখে কখনো লৌহবর্ম পড়িয়ে দিয়ে সূর্য ও বালুর মিশ্রিত তেজ চাখানো হত, কখনো বালুর উপরে শুইয়ে দিয়ে গায়ের চামড়ায় উত্তাপের ছেঁকার স্বাদ আসাদনের জন্য ছেড়ে দেয়া হত, দিনের পর দিন তাদেরকে খাবার পানি না দিয়ে ভুখা রাখা হত। [ত্বাবাক্বাত, ইবনে সা’দ- ৩/১৮৭, ৮/২০৭; আল-ইস্তিয়াব, ইবনু আব্দিল বার- ১/৩৫১; মুসতাদরাকে হাকিম- ৪/৪৭০; সিয়ারু আ’লা মিন নুবালা, ইমাম যাহাবী- ১/৪০৯; উসদুল গাবাহ, ইবনুল আছীর- ৪/১২২; আল-ইসাবাহ, ইবনে হাজার- ৮/১৮৯; শারহু নাহজুল বালাগাহ, ইবনু আবি হাদীদ- ২০/৩৬]
বিশ্বনবী মুহাম্মাদ মুস্তফা ﷺ কখনো কখনো তাঁদেরকে দেখতে যেতেন, কিন্তু সেসময় নবু মাখজুমের হাত থেকে তাঁদেরকে উদ্ধার করার মতো বাহ্যত কোনো ক্ষমতা না থাকায় মনকষ্ট ও ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তাঁদেরকে -আল্লাহ’র সন্তুষ্টির জন্য এই বিপদে সবর (ধৈর্যধারন) এখতিয়ার করার- উপদেশ দিতেন, তাঁদের মাগফেরাতের জন্য আল্লাহ’র কাছে দেয়া করতেন এবং জান্নাতের সুসংবাদ দিতেন। আবু জুবায়ের রহ.-এর পিতার সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, যাবের বিন আব্দুল্লাহ রা. বর্ণনা করেন- أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَرَّ بِعَمَّارٍ وَأَهْلِهِ وَهُمْ يُعَذَّبُونَ، فَقَالَ: أَبْشِرُوا آلَ عَمَّارٍ، وَآلَ يَاسِرٍ، فَإِنَّ مَوْعِدَكُمُ الْجَنَّةُ . أخرجه الحاكم في المستدرك , كتاب معرفة الصحابة رضي الله تعالى عنهم , ما خير عمار بين أمرين إلا اختار أرشدهما : ٣/٤٣٨ رقم ٥٦٦٦ و قال: صحيح على شرط مسلم و لم يخرجاه و وافقه الذهبي، و قال الهيثمي في المجمع: ٩/٢٩٣ : رواه الطبراني في الأوسط و رجاله رجال الصحيح غير إبراهيم بن عبد العزيز المقوم و هو ثقة – “(একদিন) আম্মার ও তার পরিবারকে নির্যাতন করা হচ্ছিল, এমন সময় রাসুলুল্লাহ ﷺ তাঁদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বললেন: ‘সুসংবাদ গ্রহন করো, হে আম্মার পরিবার! হে ইয়াসির পরিবার! (আল্লাহ’র সন্তুষ্টির আশায় তোমরা এই বিপদে সবর এখতিয়ার করো), কারণ তোমাদের জন্য রয়েছে জান্নাতের ওয়াদা”। [মুসতাদরাকে হাকিম- ৩/৪৩৮ হাদিস ৫৬৬৬; আল-মু’জামুল আউসাত, ইমাম ত্বাবরাণী- ২/১৪১ হাদিস ১৫০৮; তারিখে দিমাশক, ইবনুল আসাকীর- ৪৩/৩৭২ হাদিস ৯২৩০]
আমর বিন মুররাহ রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, সালেম বিন আবি জা’দ রহ. বর্ণনা করেন- دَعَا عُثْمَانُ نَاسًا مِنْ أَصْحَابِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فِيهِمْ عَمَّارُ بْنُ يَاسِرٍ، …….. فَبَعَثَ إِلَى طَلْحَةَ وَالزُّبَيْرِ، فَقَالَ عُثْمَانُ: أَلا أُحَدِّثُكُمَا عَنْهُ – يَعْنِي عَمَّارًا -؟ أَقْبَلْتُ مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ آخِذًا بِيَدِي نَتَمَشَّى فِي الْبَطْحَاءِ، حَتَّى أَتَى عَلَى أَبِيهِ وَأُمِّهِ وَعَلَيْهِ يُعَذَّبُونَ، فَقَالَ أَبُو عَمَّارٍ: يَا رَسُولَ اللهِ، الدَّهْرَ هَكَذَا؟ فَقَالَ لَهُ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: اصْبِرْ ثُمَّ قَالَ: اللهُمَّ اغْفِرْ لِآلِ يَاسِرٍ . رواه الإمام أحمد في مسنده , مسند العشرة المبشرين بالجنة , مسند الخلفاء الراشدين , مسند عثمان بن عفان رضي الله عنه : ١/٦٢ رقم ٤٤١، قال الهيثمي في مجمع الزاوئد : ٧/٢٢٧ : رواه أحمد و رجاله رجال الصحيح إلا أنه منقطع– “(একদিন) উসমান (বিন আফফান রা. তাঁর খিলাফতের জামানায়) রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর সাহাবীগণের মধ্যে কিছু লোককে ডাকলেন, যাঁদের মধ্যে আম্মার বিন ইয়াসীরও ছিলেন।…… পরে ত্বালহা ও জুবায়ের রা.-এর কাছে লোক পাঠালেন (তাদেরকে নিয়ে আসার জন্য। তাঁরা দুজনে এলে কথাবর্তার এক পর্যায়ে) উসমান রা. (আম্মার বিন ইয়াসীর রা.-এর দিকে ইশারা করে) বললেন: ‘আমি কি তার- তথা আম্মারের- সম্পর্কে আপনাদের দুজনকে জানাবো না (যে, সে ও তার পরিবার ইসলামের জন্য কী পরিমাণ কষ্ট সহ্য করেছে)’? (একবার) আমি রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর সাথে (আম্মারের পরিবারের অবস্থা দেখার জন্য) যাচ্ছিলাম; তিঁনি (তখন) আমার হাত ধরে ছিলেন; আমরা (একই সাথে) আল-বাত্বহায় গেলাম। অবশেষে তিঁনি যখন আম্মারের পিতা (ইয়াসীর রা.), তার মা (সুমাইয়্যাহ রা.) এবং তার কাছে পৌছলেন, তখন (দেখতে পেলেন যে), তাদের উপরে (অসম্ভব) নির্যাতন করা হচ্ছে। তখন আম্মারের পিতা (ইয়াসীর রা.) বললেন: ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! (এমনই নির্মম নির্যাতনের সাথে আমাদের দিন রাত কাটছে), এমনই (মন্দতর) দীর্ঘ সময় (এটা! আল্লাহ’র সাহায্য কবে আসবে?)। তখন নবীজী ﷺ তাকে বললেন: ‘(হে ইয়াসীর পরিবার! আল্লাহ’র সন্তষ্টির জন্য এই বিপদের উপরে) সবর (ধৈর্যধারন) করো, (কারণ তোমাদের এই সবরের বিনিময়ে রয়েছে জান্নাত)’। তারপর বললেন: ‘হে আল্লাহ! ইয়াসীর পরিবারকে ক্ষমা করে দিন”।[মুসনাদে আহমদ– ১/৬২ হাদিস ৪৪১; ত্ববাক্বাত, ইমাম ইবনে সা’দ- ৩/২৪৮, ৪/১৩৬; মাজমাউয যাওয়ায়ীদ, হাইছামী- ৭/২২৭ হাদিস ১১৯৯৬]
এই উম্মতর ফেরাউন এবং মাখজুম গোত্রের নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তি আবু জাহলও নির্যাতন করতে লেগে পড়েছিল ইয়াসির পরিবারকে। সুমাইয়্যা রা. একবার আবু জাহলের আদেশ পালন না করায় সে রেগে গিয়ে তাঁর লজ্জাস্থানে বল্লম বিদ্ধ করে শহিদ করে দেয়; (এঘটনা ঘটে হিজরতের প্রায় ৭ বছর আগে)। মানসুর রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, মুজাহিদ রহ. বর্ণনা করেন- أَوَّلُ شَهِيدٍ اسْتُشْهِدَ فِي الإِسْلامِ سُمَيَّةُ أُمُّ عَمَّارٍ أَتَاهَا أَبُو جَهْلٍ فَطَعَنَهَا بِحَرْبَةٍ فِي قُبُلِهَا . أخرجه ابن سعد في الطبقات الكبرى, سمية بنت خباط: ٨/٢٠٨ – “ইসলামের সূচনাকালেই (মুশরেকদের হাতে) প্রথম শহিদ হয়েছিলেন আম্মারে মা সুমাইয়্যাহ (বিনতে খাইয়্যাত রা.)। আবু জেহেল তাঁর কাছে এসে একটি বল্লমকে তার লজ্জাস্থানে বিদ্ধ করে দিয়েছিল, (এরপর তিঁনি শহিদ হয়ে যান)”। [আত-ত্ববাক্বাত, ইবনে সা’দ- ৮/২০৮; আদ-দালায়েল, ইমাম বাইহাকী- ২/২৮২; আল-ইস্তিয়াব, ইবনু আব্দিল বার- ৪/৩৩০] আরেক রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে, মুজাহিদ রহ. বলেন- أول شهيد في الإسلام سمية والدة عمار بن ياسر، وكانت عجوزا كبيرة ضعيفة، ولما قتل أبو جهل يوم بدر قال النبيّ صلّى اللَّه عليه وسلّم لعمار: قتل اللَّه قاتل أمّك . أخرجه ابن سعد في الطبقات الكبرى: ٨/١٩٣، قال ابن حجر في الإصابة : ٨/١٩٠ : و أخرج ابن سعد بسند صحيح عن مجاهد – “ইসলামের প্রথম শহিদ হলেন আম্মার বিন ইয়াসিরের মা সুমাইয়্যাহ। (সেসময়) তিঁনি ছিলেন খুবই বয়বৃদ্ধ ও দূর্বল। বদরের দিন যখন আবু জেহেল নিহত হয়, তখন নবীজী ﷺ আম্মারকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন: ‘(হে আম্মার! দেখো, আজ) আল্লাহ তোমার মায়ের হত্যাকারীকে হত্যা করেছেন”। [ত্বাবাক্বাত, ইবনে সা’দ- ৮/১৯৩; আল-ইসাবাহ, ইবনে হাজার- ৮/১৯০] মুশরেকদের নির্যাতনের মুখে বয়বৃদ্ধ ইয়াসির বিন আমেরও পরলোক গমন করেন। [আল-বাদউ ওয়াত তারিখ, ইমাম ত্বাহির আল-মাকদিসী- ৫/১০০]
ইয়াসির ও সুমাইয়্যাহ রা.-এর পুত্র আম্মার বিন ইয়াসির রা.কেও নির্মম ভাবে নির্যাতন করা হত। আবু বালজের সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, আমর বিন মাইমুন বলেন-أَحْرَقَ الْمُشْرِكُونَ عَمَّارَ بْنَ يَاسِرٍ بِالنَّارِ، فَكَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَمُرُّ بِهِ، فَيَمُرُّ يَدَهُ عَلَى رَأْسِهِ فَيَقُولُ: يا نارُ كُونِي بَرْداً وَسَلاماً على عَمَّارٍ كَمَا كُنْتِ عَلَى إِبْرَاهِيمَ . رواه البلاذري في انساب الاشراف: ١/١٦٧ رقم ٣٩٧، و ابن سعد في الطبقات الكبرى : ٣/١٨٨، و هذا إسناد حسن إلا أن عمرو بن ميمون لم يحضر القصة – “মুশরেকরা আম্মার বিন ইয়াসিরকে আগুনের ছেঁকা দিতো। রাসুলুল্লাহ ﷺ যখন তাঁর পাশ দিয়ে যেতেন; তখন তিঁনি তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন: ‘হে আগুন! তুই আম্মারের জন্য ঠান্ডা ও আরামদায়ক হয়ে যা, যেমনি ভাবে তুই (নমরুদের সময় নবী) ইব্রাহিমের জন্য (ঠান্ডা ও আরামদায়ক) হয়েছিল”। [আল-আনসাবুল আশরাফ, ইমাম বালাজুরী- ১/১৬৭ আছার ৩৯৭; আত-ত্বাবাক্বাত, ইবনু সা’দ- ৩/১৮৮; তারিখে দিমাশক, ইবনুল আসাকীর- ৪৩/৩৭২] মুহাম্মাদ বিন কা’ব আল-কুরাইত্ব বলেন- أَخْبَرَنِي مَنْ رَأَى عَمَّارَ بْنَ يَاسِرٍ مُتَجَرِّدًا فِي سَرَاوِيلَ قَالَ: فَنَظَرْتُ إِلَى ظَهْرِهِ فِيهِ حَبَطٌ كَثِيرٌ. فَقُلْتُ: مَا هَذَا؟ قَالَ: هَذَا مِمَّا كَانَتْ تُعَذِّبُنِي بِهِ قُرَيْشٌ فِي رَمْضَاءِ مَكَّةَ – “আম্মার বিন ইয়াসিরকে (একদম) খালি-গায়ে (শুধু) পাজামা পরিহিত অবস্থায় দেখেছে -এমন এক ব্যাক্তি আমার কাছে বর্ণনা করেছে, সে বলেছে: ‘আমি (সেদিন) তাঁর পিঠের মধ্যে তাকিয়ে দেখি তাতে অনেক ক্ষতচিহ্ন! আমি (অবাক হয়ে) জিজ্ঞেস করলাম: ‘(আপনার পিঠে) এগুলো কী’? তিঁনি বললেন: ‘মক্কায় কুরায়শরা উত্তপ্ত বস্তুর সাহায্যে আমাকে যে শাস্তি দিতো -এগুলো তারই (চিহ্ন)”। [আত-ত্বাবাক্বাত, ইবনু সা’দ- ৩/১৮৮] আব্দুল হাকীম বিন সুহাইবের সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, উমার ইবনুল হাকাম বলেন- انَ عَمَّارُ بْنُ يَاسِرٍ يُعَذَّبُ حَتَّى لا يَدْرِي مَا يَقُولُ – “আম্মার বিন ইয়াসিরের উপরে এত নির্যাতন চালানো হত যে, তিঁনি কী বলছেন, নিজেই জানতেন না”। [আত-ত্বাবাক্বাত, ইবনু সা’দ- ৩/১৮৮]
মুহাম্মাদ বিন আম্মার বিন ইয়াসির রহ. তাঁর পিতা আম্মার বিন ইয়াসির রা.-এর সূত্রে বর্ণনা করেন- أَخَذَ الْمُشْرِكُونَ عَمَّارَ بْنَ يَاسِرٍ فَلَمْ يَتْرُكُوهُ حَتَّى سَبَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، وَذَكَرَ آلِهَتَهُمْ بِخَيْرٍ ثُمَّ تَرَكُوهُ ، فَلَمَّا أَتَى رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : مَا وَرَاءَكَ ؟ قَالَ : شَرٌّ يَا رَسُولَ اللَّهِ ، مَا تُرِكْتُ حَتَّى نِلْتُ مِنْكَ ، وَذَكَرْتُ آلِهَتَهُمْ بِخَيْرٍ قَالَ : كَيْفَ تَجِدُ قَلْبَكَ ؟ قَالَ : مُطْمَئِنٌّ بِالْإِيمَانِ قَالَ : إِنْ عَادُوا فَعُدْ . رواه الحاكم في المستدرك , كتاب التفسير , تفسير سورة النحل , حكاية أسارة عمار بن ياسر بيد الكفار : ٣/١٠٢ رقم ٣٤١٣ و قال هذا حديث صحيح على شرط الشيخين و لم يخرجاه، قال الحافظ ابن حجر في فتح الباري : ١٢/٣٢٦ : و هو مرسل و رجاله ثقات أخرجه الطبري و قبله عبد الرزاق وعنه عبد بن حميد ، و أخرجه البيهقي من هذا الوجه فزاد في السند فقال : ” عن أبي عبيدة بن محمد بن عمار عن أبيه ” و هو مرسل أيضا ، و أخرج الطبري أيضا من طريق عطية العوفي عن ابن عباس نحوه مطولا و في سنده ضعف، و قال في الدراية في تخريج أحاديث الهداية: ٢/١٩٧ رقم ٨٧٩ : وإسناده صحيح إن كان محمد بن عمار سمعه من أبيه، قال ابن كثير في إرشاد الفقيه إلى معرفة أدلة التنبيه في فروع الشافعية , كتاب الجنايات : ١/٥٥٣ : رواه البيهقي بإسناده صحيح و زاد بعضهم وفي هذا أنزلت: من كفر بالله من بعد إيمانه.. الآية – “মুশরেকরা আম্মার বিন ইয়াসিরকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। এরপর তারা আর তাকে ছেড়ে দেয়নি, যতক্ষন পর্যন্ত তিনি (তাদের দাবী মোতাবেক) নবী ﷺ-এর সমালোচনা (ও তাঁর উপরে মন্দ বাক্য প্রয়োগ) না করেছিলেন এবং তাদের উপাস্যদের ব্যাপারে ভালো কিছু না বলেছিলেন। (বস্তুত: আম্মার রা. মুশরেকরা জুলুম নির্যাতন আর সইতে না পেরে ওরা তাঁর কাছে যেমনটা দাবী করেছিল তিঁনি সেই অনুপাতে শুধু বাহ্যত: মৌখিক ভাবে নবী ﷺ-এর উপরে কিছু কটুবাক্য প্রয়োগ করেছিলেন এবং তাদের উপাস্যদের ব্যাপারে ভালো কিছুও বলে দিয়েছিলেন)। (কেবলমাত্র) এরপরেই তারা তাঁকে ছেড়ে দেয়। পরে যখন তিনি রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে (সাক্ষাত করতে) আসেন, তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ (তাকে) জিজ্ঞেস করেন: ‘তোমার সাথে (ওখানে কী) কী ঘটেছিল’? আম্মার রা. বললেন: ‘(খুবই) নিকৃষ্ট (ঘটনা ঘটেছিল) -ইয়া রাসুলাল্লাহ! (তারা সেখানে আমার উপরে দিনের পর দিন অমানুসিক নির্যাতন চালাতে থাকে, আর তারা) আমাকে রেহাই দিচ্ছিল না, যতক্ষন পর্যন্ত না আমি (তাদের দাবী মোতাবেক) আঁপনার (ব্যাপারে কিছু) সমালোচনা (ও কটুবাক্য প্রয়োগ) করে দেই এবং তাদের উপাস্যদের ব্যাপারে (প্রশংসা সূচক) ভালো কিছু বলে দেই’। রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন: ‘তুমি (এখন) তোমার ক্বলব (অন্তর)-কে কেমন অবস্থায় পাচ্ছো’? আম্মার রা. বললেন: ‘ইমান দ্বারা প্রশান্ত (ও ভরপুর অবস্থায় আছে মর্মে অনুভব করছি -ইয়া রাসুলাল্লাহ)’। রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন: ‘তারা যদি আবারো (কখনো তোমার উপরে ওই ধরনের অসহনীয় নির্মম) জুলুম নির্যাতন করে, তাহলে (বাহ্যিক ভাবে তারা যা বলতে বলে) তুমি বলে দিতে পারো, (তবে সেই মুহূর্তে তোমার অন্তর যেন আল্লাহ ও তাঁর রাসুলﷺ-এর উপরে পরিপূর্ণ ইমান রাখে, তোমার অন্তর যেন তোমার ওসব কথিত মৌখিক কথাগুলোকে সম্পূর্ণ না-হক্ব ও অসত্য বলেই বিশ্বাস করে, তাহলে এতটুকুর কারণে তোমার উপরে কুফরের অপরাধ বর্তাবে না)”। [মুসতাদরাকে হাকিম– ৩/১০২ হাদিস ৩৪১৩; সুনানুল কুবরা, ইমাম বাইহাকী- ৮/৩৬২ হাদিস ১৬৮৯৬; আল-আনসাবুল আশরাফ, ইমাম বালাজুরী- ১/১৫৯ আছার ৩৫০; জামেউল বায়ান, ইমাম তাবারী- ১৭/৩০৩; তারিখে দিমাশক, ইবনুল আছাকীর- ৪৩/৩৭৪]
ফায়দা: এ ব্যাপারেই আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন- مَن كَفَرَ بِاللَّهِ مِن بَعْدِ إِيمَانِهِ إِلَّا مَنْ أُكْرِهَ وَ قَلْبُهُ مُطْمَئِنٌّ بِالْإِيمَانِ وَ لَٰكِن مَّن شَرَحَ بِالْكُفْرِ صَدْرًا فَعَلَيْهِمْ غَضَبٌ مِّنَ اللَّهِ وَلَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ – “যে ব্যাক্তি তার ইমান (আনায়ন)-এর পর আল্লাহ’র সাথে কুফরী করে, তবে (তার কথা ভিন্ন) যে সে(ই কুফরী)টিকে (মনে মনে) ঘৃনা করে এবং (তখন) তার অন্তর ইমান দ্বারা মুত্বমাইন (প্রশান্ত) থাকে, কিন্তু যে ব্যাক্তি (ইমান আনায়নের পর তার) অন্তর থেকে কুফরীকে মেনে নেয়, বস্তুত: তাদের উপরে আল্লাহ’র পক্ষ থেকে ক্রোধ (বর্ষিত হয়), আর (আখেরাতে) তাদের জন্য রয়েছে বিশাল (ভয়ঙ্কর ধরনের) আযাব”। [সূরা নাহল ১০৬]
এই আয়াতের প্রথমাংশ তথা- مَن كَفَرَ بِاللَّهِ مِن بَعْدِ إِيمَانِهِ – “((যে ব্যাক্তি তার ইমান (আনায়ন)-এর পর আল্লাহ’র সাথে কুফরী করে…))” -এখানে যারাই ইমানের পর কুফরী অবলম্বন করে তাদের কথা বলা হয়েছে। তবে এর পরের অংশে দু প্রকারের কুফরী অবলম্বনকারীর কথা বলা হয়েছে-
(১) এক প্রকারের মুসলমান এমন, যে তার অন্ততের মধ্যে সত্যিকার ইমান নিয়ে থাকে এবং সাথে সংশ্লিষ্ট কুফরী’টিকে মন থেকে ঘৃনাও করে, তবে নির্মম জুলুম নির্যাতনের মুখে অনন্যপায় হয়ে তা থেকে বাঁচার জন্য সাময়ীক ভাবে কাফেরদের দাবী মোতাবেক সে লোকদেখানো ভাবে কিছু কুফরী কথা বলে ফেলে। এধরনের ব্যাক্তি আল্লাহ’র চোখে মুসলীম হিসেবেই গণ্য হয়। এরকম মুমিন মুসলমানদের ব্যাপারেই আল্লাহ তাআলার এই আয়াতে এরশাদ করেছেন বাণী- إِلَّا مَنْ أُكْرِهَ وَقَلْبُهُ مُطْمَئِنٌّ بِالْإِيمَانِ – “((তবে (তার কথা ভিন্ন) যে সে(ই কুফরী)টাকে (মনে মনে) ঘৃনা করে এবং তার অন্তর ইমান দ্বারা মুত্বমাইন (প্রশান্ত) থাকে))”। আয়াতটির এই অংশের তাফসীর সম্পর্কে আলী বিন আবি ত্বালহাহ রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন- أَخْبَرَ اللَّهُ سُبْحَانَهُ إِنَّهُ مَنْ كَفَرَ بَعْدَ إِيمَانِهِ فَعَلَيْهِ غَضَبٌ مِنَ اللَّهِ ، وَلَهُ عَذَابٌ عَظِيمٌ ، فَأَمَّا مَنْ أُكْرِهَ فَتَكَلَّمَ بِلِسَانِهِ ، وَخَالَفَهُ قَلْبُهُ بِالْإِيمَانِ لِيَنْجُوَ بِذَلِكَ مِنْ عَدُوِّهِ فَلَا حَرَجَ عَلَيْهِ ، إِنَّ اللَّهَ سُبْحَانَهُ إِنَّمَا يَأْخُذُ الْعِبَادَ بِمَا عَقَدَتْ عَلَيْهِ قُلُوبُهُمْ . رواه أبو بكر البيهقي في سنن الكبرى , كتاب المرتد , باب المكره على الردة : ٨/٣٦٣ رقم ١٦٨٩٩ – “(এই আয়াতে) আল্লাহ তাআলা সংবাদ দিচ্ছেন যে, যে ব্যাক্তি ইমান আনায়নের পর কুফরী করবে, তার উপরে আল্লাহ’র ক্রোধ বর্ষিত হবে এবং (আখেরাতের জীবনে) তার জন্য রয়েছে বিশাল (ভয়ঙ্কর রকমের) আযাব। তবে যে ব্যাক্তি ওই (কুফরী কথা বা কাজকে মন থেকে) ঘৃনা করবে, সে যদি তার দুশমনের (অসহনীয় জুলুম নির্যাতন) থেকে বাঁচার জন্য (দুশমনের দাবীর প্রেক্ষিতে ওজর বসত: নিছক) তার জবান দ্বারা (কোনো কুফরী কথা) বলেও ফেলে কিন্তু তার অন্তর যদি (তখন) ইমানের কারণে ওই (কুফর)টির বিরোধীতা করা অবস্থায় থাকে, তাহলে (সেক্ষেত্রে) তার উপরে (কুফরী করার) কোনো দোষ বর্তাবে না। আল্লাহ তাআলা মূলত: তাঁর বান্দাদের অন্তরগুলোতে -তাঁর ব্যাপারে কী আকীদা বিশ্বাস রাখে- সে ব্যাপারটিকেই গণ্য করে থাকেন, (কুফরীর প্রতি ঘৃনা ও অন্তর ইমান দ্বারা প্রশান্ত থাকাবস্থায় কেউ বিপদে পড়ে ওজর বসত: শুধু কুফরী বাক্য বলে দেয়ার কারণে তাকে বাস্তবে কাফের গণ্য করবেন না)”। [সুনানুল কুবরা, ইমাম বাইহাকী- ৮/৩৬৩ হাদিস ১৬৮৯৯; জামেউল বায়ান, ইমাম তাবারী- ১৭/৩০৫] ইমাম ইবনে হাযাম আল-উন্দুলুসী রহ. (মৃ: ৪৫৬ হি:) বলেন- اتَّفقُوا على أَن الْمُكْره على الْكفْر وَقَلبه مطمئن بالايمان انه لَا يلْزمه شَيْء من الْكفْر عِنْد الله تَعَالَى – “আলেমগণ এব্যাপারে একমত যে, যে ব্যাক্তি কোনো কুফরী (কথা বা কাজে)র উপরে (মন থেকে) অসন্তষ্ট এবং তার অন্তর ইমান দ্বারা প্রশান্ত থাকে, সেই ব্যাক্তি (কারোর নির্মম জুলুম নির্যাতন ও জোরজবস্তিতে) কোনো কুফরী (কথাকে তার জবান দ্বারা আদায় করলেও সে মূলত:) আল্লাহ’র কাছে (কুফর সংঘটনের দোষে) দোষী সাব্যস্ত হবে না”। [মারাতিবুল ইজমা, ইমাম ইবনে হাযাম- ১/৬১] আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা., আবু মালেক, ক্বাতাদাহ প্রমুখ থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, কুরআনের এই আয়াতের- إِلَّا مَنْ أُكْرِهَ وَقَلْبُهُ مُطْمَئِنٌّ بِالْإِيمَانِ – “((তবে (তার কথা ভিন্ন) যে সেটাকে (মনে মনে) ঘৃনা করে এবং তার অন্তর ইমান দ্বারা মুত্বমাইন (প্রশান্ত) থাকে))”– এই অংশটুকু আম্মার বিন ইয়াসির রা.-এর ব্যাপারে নাজিল হয়েছে। [জামেউল বায়ান, ইমাম তাবারী- ১৭/৩০৫; তাফসীরে ইবনে কাসির- ২/৫২৯; আদ দুররুল মানসুর, ইমাম সুয়ূতী- ৪/১৩২]
এজন্য মুশরেকদের নির্মম জুলুম নির্যাতন থেকে বাঁচার তাকিদে ওজর বসত: আম্মার বিন ইয়াসির রা.-এর বাহ্যিক কুফরী বাক্য উচ্চারণকে আল্লাহ তাআলা বাস্তবেই কুফর হিসেবে গণ্য করেননি, যার সাক্ষ্য খোদ্ রাসুলুল্লাহ ﷺ দিয়ে গেছেন। আলী রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ- এরশাদ করেন– مُلِئَ عَمَّارٌ إِيمَانًا إِلَى مُشَاشِهِ . رواه بن أبي شيبة في مصنّفه , كتاب الفضائل , ما ذكر في عمار بن ياسر رضي الله عنه : ٧/٥٢٣- “আম্মারের আপাদমস্তক ইমানে পরিপূর্ণ”। [আল-মুসান্নাফ, ইমাম ইবনু আবি শায়বাহ- ৭/৫২৩] তবে, শরীয়তের এ রুখসত (সুযোগ/সহজতা) কেবল মুখে ‘কুফরী বাক্য’ উচ্চারণ করা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। কোনো জালেম যদি কোনো কুফরী বা শিরকী আমল/আচরণ প্রদর্শন করে আল্লাহ’র সাথে কুফরীর বহি:প্রকাশ ঘটাতে বলে, (যেমন: তাদের দেব দেবীর মূর্তির সামনে সিজদাহ করা বা পুঁজাঅর্চনা করা ইত্যাদি), তাহলে এমন কাজ করা জায়েয নয় -চাই এজন্য আপনাকে কেটে দিখন্ডিত করা হোক বা আগুনে পুড়িয়ে ভষ্ম করে দেয়া হোক। উম্মুল দারদা রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, আবুদ্দারদা রা. বলেন– أَوْصَانِي خَلِيلِي صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ شَيْئًا وَإِنْ قُطِّعْتَ وَحُرِّقْتَ وَلَا تَتْرُكْ صَلَاةً مَكْتُوبَةً مُتَعَمِّدًا فَمَنْ تَرَكَهَا مُتَعَمِّدًا فَقَدْ بَرِئَتْ مِنْهُ الذِّمَّةُ وَلَا تَشْرَبْ الْخَمْرَ فَإِنَّهَا مِفْتَاحُ كُلِّ شَرٍّ . رواه ابن ماجه في سننه , كتاب الفتن , باب الصبر على البلاء: ٢/١٣٣٩ رقم ٤٠٣٤ ، قال الأرنؤوط : ٥/١٦١ : حسن لغيره، و حسَّنه الألباني في صحيح ابن ماجه – “(একবার) আমার খালীল (মুহাম্মাদ মুস্তফা) ﷺ আমাকে ওসিয়ত করেন বলেন: ‘তুমি আল্লাহ’র সাথে কোনো কিছুকেই শরীক করবে না -চাই (এজন্য) তোমাকে কেটে ফেলা হোক কিংবা পুড়িয়ে ফেলা হোক। আর তুমি ইচ্ছে করে ফরয নামায তরক করবে না। কারণ যে (মুসলমান) স্বেচ্ছায় তা তরক করে, বস্তুত: তার থেকে (আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের) জিম্মাহ (দায়দায়িত্ব) উঠে যায়। আর তুমি (কখনো) মদ পান করবে না, কারণ সেটা প্রত্যেক মন্দের চাবি (স্বরূপ)”। [সুনানে ইবনে মাজাহ- ২/১৩৩৯ হাদিস ৪০৩৪]
(২) দ্বিতীয় প্রকারের মুসলমান এমন, যে ইমান এনে মুসলমান হওয়ার পর কখনো সংশ্লিষ্ট কোনো কুফরী’টিকে অন্তর দিয়ে কবুল করে নেয়, যার মধ্যে কুফরীটির প্রতি কোনো ঘৃনা অবশিষ্ট থাকে না -এমতাবস্থায় সে অন্তরে অন্তরে ইমান-ত্যাগকারী ও কুফর-কবুলকারী একজন নিরেট কাফের-ই হয়ে যায়। অন্তরে কুফরী লুকিয়ে রাখা এমন ব্যাক্তি যদি বাহ্যিক ভাবে মুসলমান হিসেব জীবন যাপন করে তাহলে তাকে বলা হয় মুনাফের, আর সে যদি অন্তরে কুফরী লুকিয়ে রাখার পাশাপাশি বাহ্যিক ভাবেও তার কথা বা কাজ দ্বারা পরিষ্কার ভাবে তার কুফরী আচরণ প্রকাশ করে, তাহলে তাকে বলা হয় মুরতাদ (ইসলাম ত্যাগী কাফের)। বস্তুত: এই দুই প্রকারের ব্যাক্তিই আল্লাহ’র দৃষ্টিতে কাফের হিসেবে গণ্য। এই দুই প্রকারের কাফের সম্পর্কেই আলোচ্য আয়াতে ইংগীত করে বলা হয়েছে- مَن كَفَرَ بِاللَّهِ مِن بَعْدِ إِيمَانِهِ ……. وَ لَٰكِن مَّن شَرَحَ بِالْكُفْرِ صَدْرًا فَعَلَيْهِمْ غَضَبٌ مِّنَ اللَّهِ وَلَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ – “((যে ব্যাক্তি তার ইমান (আনায়ন)-এর পর আল্লাহ’র সাথে কুফরী করে, …….. আর যে ব্যাক্তি (ইমান আনায়নের পর তার) অন্তর থেকে কুফরীকে মেনে নেয়, বস্তুত: তাদের উপরে আল্লাহ’র পক্ষ থেকে ক্রোধ (বর্ষিত হয়), আর (আখেরাতে) তাদের জন্য রয়েছে বিশাল (ভয়ঙ্কর ধরনের) আযাব))”। বস্তুত: সে সময় মক্কায় এমন ব্যাক্তিরাও ছিল, যারা ইসলাম কবুল করে মুসলমান হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু পরে মুসলমানদের উপরে মুশরেকদের প্রদত্ত জুলুম নির্যাতনের অবস্থা দেখে পূণরায় ইমান ত্যাগ করে কুফরকে কবুল করে নিয়ে বাস্তবেই মুরতাদ (ইসলাম ত্যাগী কাফের) হয়ে গিয়েছিল। মুক্বাতিল রহ.-এর মতে, আব্দুল্লাহ বিন সা’দ বিন আবি রাবহ্ব আল-কুরাশী, মিক্বইয়াস বিন সুবাবাহ, আব্দুল্লাহ বিন আনাস বিল খাত্বাল, তু’মাহ বিন উবাইরিক্ব, কায়েস ইবনুল ওয়ালিদ বিন মুগিরাহ এবং কায়েস ইবনুল ফাকিহ আল-মাখযুমী, যারা ইসলাম কুবল করার পর পূণরায় মুরতাদ হয়ে গিয়েছিল, তাদের সম্পর্কে এই আয়াতাংশটি নাজিল হয়। [যাদুল মাসীর, ইবনুল যাওজী- ৪/৪৯৫]
হাকিম বিন যুবায়েরের সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, সাঈদ বিন যুবায়ের বর্ণনা করেন- قُلْتُ لِابْنِ عَبَّاسٍ : يَا أَبَا عَبَّاسٍ أَكَانَ الْمُشْرِكُونَ يَبْلُغُونَ مِنَ الْمُسْلِمِينَ فِي الْعَذَابِ مَا يُعْذَرُونَ بِهِ فِي تَرْكِ دِينِهِمْ ؟ فَقَالَ : نَعَمْ ، وَاللَّهِ إِنْ كَانُوا لَيَضْرِبُونَ أَحَدَهُمْ وَيُجِيعُونَهُ وَيُعْطِشُونَهُ حَتَّى مَا يَقْدِرُ عَلَى أَنْ يَسْتَوِيَ جَالِسًا مِنْ شِدَّةِ الضُّرِّ الَّذِي بِهِ ، حَتَّى إِنَّهُ لَيُعْطِيهِمْ مَا سَأَلُوهُ مِنَ الْفِتْنَةِ . رواه أبو بكر البيهقي في سنن الكبرى , كتاب المرتد , باب المكره على الردة : ٨/٣٦٣ رقم ١٦٨٩٨ – “আমি (আব্দুল্লাহ) ইবনে আব্বাসকে জিজ্ঞেস করলাম: ‘হে আবু আব্বাস! (মক্কার) মুশরেকরা কি মুসলমানদের মধ্যে কাউকে কাউকে এত নির্যাতন করতো যে, সে কারণে তারা তাদের দ্বীন (ইসলাম) ত্যাগ করতে বাধ্য হয়ে যেতো’? তিনি বললেন: ‘হ্যাঁ! আল্লাহ’র কসম, তারা যখন কাউকে (নির্মম ভাবে) মারধর করতো এবং তাকে (দিনের পর দিন) খারার না দিয়ে উপোস করে রাখতো, এমনকি (এসব জুলুম নির্যাতনের কারণে) তার অবস্থা এমন হত যে, আঘাত ও ক্ষত’র কারণে তার পক্ষে নিতম্বের উপরে বসার মতো শক্তিটুকুও আর থাকতো না, তখন শেষ পর্যন্ত (অবস্থা এই দাঁড়াতো যে), তারা তার থেকে যা-ই (আদায় করতে) চাইতো সে তাদেরকে তা-ই দিতো”। [সুনানুল কুবরা, ইমাম বাইহাকী- ৮/৩৬৩ হাদিস ১৬৮৯৮] ইমাম ইবনে ইসহাকের রেওয়ায়েতে এও আছে যে- و زاد ابن إسحاق في السيرة النبوية : ١/٦٦ : و حَتَّى يقولوا: أاللات والعزى إلهك من دون الله؟ فيقول: نعم، وحتى أن الجعل ليمر بهم فيقولون أهذا الجعل إلهك من دون الله؟ فَيَقُولُ: نَعَمْ، افْتِدَاءً مِنْهُمْ بما يَبْلُغُونَ مِنْ جُهْدِهِ، فيه حكيم بن جبير تكلم فيه الأئمة فقد ضعفه أحمد و يعقوب بن شيبة و أبو حاتم و غيرهم و قال الدارقطني متروك و قال أبو زرعة محله الصدق – “এমনকি তারা (তাকে) বলতো: ‘(বল্) আল্লাহ ছাড়াও লাত এবং উযযাও কি তোর উপাস্য নয়’? তখন সে (জীবন বাঁচানোর জন্য বাহ্যিক ভাবে মুখে) বলে দিতো: ‘হ্যাঁ’। এমনকি যদি তাদের পাশ দিয়ে কোনো পোকা মাকড়ও অতিক্রম করে যেতো, তাহলেও তারা তাকে বলতো: ‘(বল্) আল্লাহ ছাড়াও এই পোকা মাকড়ও কি তোর উপাস্য নয়’? তখন সে (জীবন বাঁচানোর জন্য বাহ্যিক ভাবে মুখে) বলে দিতো: ‘হ্যাঁ’। (বস্তুত:) তাদের থেকে সে যেসব (নির্মম) কষ্ট-নির্যাতন ভোগ করতো, তার কারণেই সে তাদের কাছে (এভাবে) মুখ খুলতো”। [সিরাতুন নাববীয়্যাহ, ইমাম ইবনে ইসহাক- ১/৬৬; সিরাতে ইবনে হিশাম- ১/২১২; আল-মাজমু’ শারহুল মুহাজজাব, ইমাম নববী- ২৪/১৬৩; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ইবনে কাসির- ৪/১৪৪]
আম্মার বিন ইয়াসির রা.-এর এই ঘটনা থেকে অনুমান করা যায় যে, মুশরেকরা তাঁর উপরে কী পরিমান নির্মম জুলুম নির্যাতন করে যাচ্ছিল যে, তিঁনি বাধ্য হয়ে মৌখিক ভাবে কিছু কুফরী কথা বলে তাদেরকে বাহ্যিক একটা বুঝ দিয়ে কোনো মতে জান নিয়ে পালিয়ে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে এসেছিলেন! শুধু আম্মার বিন ইয়াসির রা-ই নন, আরো অনেক সাহাবীই মক্কার মুশরেকদের দ্বারা এরকম অমানবিক জুলুম নির্যাতনের স্বীকার হয়েছিলেন। যেমন: বিলাল বিন রাবাহ রা., খাব্বাব বিন আরত রা., সুহাইব রা. প্রমুখ।
যীর বিন হুবায়েশ রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বর্ণনা করেন-كَانَ أَوَّلَ مَنْ أَظْهَرَ إِسْلَامَهُ سَبْعَةٌ: رَسُولُ اللَّهِ – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ -، وَأَبُو بَكْرٍ، وَعَمَّارٌ، وَأُمُّهُ سُمَيَّةُ، وَصُهَيْبٌ، وَبِلالٌ، وَالْمِقْدَادُ، فَأَمَّا رَسُولُ اللَّهِ – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ – فَمَنَعَهُ اللَّهُ بِعَمِّهِ أَبِي طَالِبٍ، وَأَمَّا أَبُو بَكْرٍ فَمَنَعَهُ اللَّهُ بِقَوْمِهِ، وَأَمَّا سَائِرُهُمْ فَأَخَذَهُمْ الْمُشْرِكُونَ، وَأَلْبَسُوهُمْ أَدْرَاعَ الْحَدِيدِ، وَ صَهَرُوهُمْ فِي الشَّمْسِ، فَمَا مِنْهُمْ مِنْ أَحَدٍ إِلَّا وَقَدْ وَاتَاهُمْ عَلَى مَا أَرَادُوا إِلَّا بِلالًا، فَإِنَّهُ هَانَتْ عَلَيْهِ نَفْسُهُ فِي اللَّهِ، وَهَانَ عَلَى قَوْمِهِ، فَأَخَذُوهُ، فَأَعْطَوْهُ الْوِلْدَانَ، فَجَعَلُوا يَطُوفُونَ بِهِ فِي شِعَابِ مَكَّةَ وَهُوَ يَقُولُ: أَحَدٌ أَحَدٌ . رواه ابن ماجه في سننه , كتاب المقدمة , أبواب في فضائل أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم , باب فضل سلمان وأبي ذر والمقداد : ١/ ٥٣ رقم ١٥٠ و حسنه الألباني في صحيح ابن ماجه، و قال عبد العزيز الراجحي في شرح سنن ابن ماجة : ٩/١٣ : وهذا لا بأس بسنده، وعاصم بن أبي النجود لا بأس به، قال المحقق: إسناده صحيح؛ عاصم بن بهدلة بن أبي النجود عندنا ثقة كما حققناه في تعقباتنا على تقريب الحافظ ابن حجر، وباقي رجاله ثقات، ، و الإمام أحمد في مسنده : ١/٤٠٤ رقم ٣٨٣٢ و قال شعيب الأرنؤوط : إسناده حسن – “সর্বপ্রথম যারা (তাদের) ইসলাম(গ্রহনের বিষয়টি)কে (জনসম্মুখে) প্রকাশ করেছিলেন, তাঁরা ছিলেন সাতজন। রাসুলুল্লাহ ﷺ, আবু বকর, আম্মার (বিন ইয়াসির), তার মা সুমাইয়্যাহ (বিনতে খাইয়্যাত), সুহাইব (বিন সিনান), বিলাল (বিন রাবাহ) এবং মিক্বদাদ। রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর সম্পর্কে কথা হল, আল্লাহ তাঁকে (তাঁর আপন চাচা) আবু তালেবের মাধ্যমে (মুশরেকদের হিংস্র কবজা থেকে) বাঁচিয়েছিলেন। আর আবু বকরকে আল্লাহ (তাআলা) বাঁচিয়েছিলেন তার স্বগোত্রীয়দের দ্বারা। আর বাকি (পাঁচজনের) সকলকে মুশরেকরা ধরে নিয়ে যায়। ওরা তাঁদেরকে লৌহবর্ম পরিধান করিয়ে দিতো এবং (ওই লৌহবর্ম সহই) তাঁদেরকে (উত্তপ্ত) রৌদ্রে(র তাপে) ঝলসানোর জন্য ফেলে রাখতো। তাঁদের মাঝে এমন একজনও ছিলেন না, যাঁদের উপরে ওরা (মুখ দিয়ে কিছু বলানোর ক্ষেত্রে) ওদের ইচ্ছের বহি:প্রকাশ না ঘটিয়ে ছেড়েছে, (তাঁরা সকলে নির্যাতনের অতিসহ্যে জান বাঁচানোর জন্য মুখে তা-ই বলে ফেলেছিলেন, যেসব কথা মুশরেকরা তাঁদের মুখ দিয়ে বলাতে চেয়েছিল)। শুধুমাত্র বিলাল ছিলেন ব্যাতিক্রম; তিঁনি এমন ছিলেন যে, (শুধু আল্লাহকে পাওয়ার জন্য) তার নিজকে আল্লাহ’র পথে হেয়-লাঞ্চিত হতে দিয়েছিলেন, (এজন্য মুশরেকদের প্রদত্ত অকথ্য অপমান লাঞ্চনার কোনোই পরোয়া করেননি তিঁনি)। তিঁনি তাঁর স্বগোত্রের কাছেও অপমানিত-হেয়-লাঞ্চিত হয়েছিলেন। তারা তাঁকে ধরে নিয়ে গিয়ে (স্বগোত্রের ছোট ছোট) বালকদের হাতে তুলে দিয়েছিল, যারা তাঁকে মক্কার অলিতে গলিতে দাবরিয়ে নিয়ে বেড়াতো (যেভাবে কোনো পাগলকে পাথর নিক্ষেপ করে বা মেড়ে মেড়ে কষ্ট দিয়ে বিরক্ত করে দাবরিয়ে নিয়ে বেড়ানো হয়ে থাকে। এত কষ্ট ও নির্যাতনের পরও) তিঁনি (শুধু) বলতেন: (আমার আল্লাহ) একক (ও অদ্বিতীয় সত্ত্বা)! (আমার আল্লাহ) একক (ও অদ্বিতীয় সত্ত্বা)!”। [সুনানে ইবনে মাজাহ– ১/৫৩ হাদিস ১৫০; মুসনাদে আহমদ- ১/৪০৪ হাদিস ৩৮৩২; সহিহ ইবনে হিব্বান– ১৫/৫৫৯ হাদিস ৭০৮৩; মুসতাদরাকে হাকিম- ৪/৩২৮ হাদিস ৫২৮৯; সুনানুল কুবরা, ইমাম বাইহাকী- ৮/৩৬২ হাদিস ১৬৮৯৭] আবু ইসহাক আল-জুরযানী তাঁর তারিখ-এ মানসুরের সূত্রে মুজাহিদ রহ. থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আম্মার বিন ইয়াসির রা. বলেন- كلّ قد قال: ما أرادوا- يعني المشركين- غير بلال – “(মক্কার সেই জুলুম নির্যাতনের সময়ে) ওরা -তথা মুশরেকরা- (অসহায় মুসলমানদের মুখ থেকে) যাকিছু (বলাতে) চেয়েছিল, বিলাল ছাড়া (বাকি) সকলেই তা (ওদের নির্মম অত্যাচারের কেবলে পড়ে বাঁচার তাগিদে) বলে ফেলেছিল”। [আল-ইসাবাহ, ইবনে হাজার- ১/৪৫৬]
সাহাবী বিলাল বিন রাবাহ রা. ছিলেন মূলত: মক্কায় জন্মগ্রহনকারী একজন হাবশী (আবিসিনিয়ান বা বর্তমান ইথিওপিয়ান) বংশদ্ভুত ব্যাক্তি। তাঁর পিতা মাতা কোনো দাস ছিলেন না, তবে আবরাহার যে বছর মক্কায় আক্রমন করে, সে বছরেই মক্কাবাসীরা তাদেরকে বন্দি করে দাস বানিয়ে নেয়। ফলে বিলাল রা. জন্মানোর পরেই প্রথা অনুযায়ী তিঁনিও দাস-দাসির ছেলে হওয়ায় একজন দাস হিসেবেই বেড়ে ওঠেন। রাসুলুল্লাহ ﷺ যখন মক্কায় ইসলামের দাওয়াত পেশ করা শুরু করেন, তখন প্রথম দিকেই বিলাল রা. ইসলাম কুবল করে নেন। তাঁর ইসলাম কবুলের কথা তাঁর মুশরেক মনিব উমাইয়্যাহ বিন খালফ জানতে পারলে তাঁকে ইসলাম ত্যাগের জন্য সে তাঁর উপরে অবর্ণনীয় মাত্রার জুলুম অত্যাচার করা শুরু করে দেয়। সে বিলাল রা.কে মরুভূমির উত্তপ্ত বালুতে পিঠ পাশে শুইয়ে দিয়ে তাঁর বুকের উপরে ভারী পাথর চাপা দিয়ে রাখতো যাতে বালুর অসহনীয় উত্তাপে ছটপট করার জন্য তিঁনি ঠিকমতো নড়াচড়াও করতে না পারেন, আর এর ফলে তাঁর ভীষন শ্বাসকষ্ট হত, এ সময় উমাইয়্যাহ বিন খালফ তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলতো: لا يزال على ذلك حتى يموت أو يكفر بمحمد – “(আল্লাহ’র কসম)! (তোর উপরে) এরকম (শাস্তি) চলতেই থাকবে, যতক্ষন পর্যন্ত না তুই হয় মড়বি, নাহয় মুহাম্মাদের সাথে কুফরী করবি, (মুহাম্মাদের দ্বীন থেকে নিজকে আলাদা করে নিবি)”। তখনও বিলাল রা. বলতেন: أَحَدٌ أَحَدٌ – (আমার আল্লাহ) একক (ও অদ্বিতীয় সত্ত্বা)! (আমার আল্লাহ) একক (ও অদ্বিতীয় সত্ত্বা)”। কখনো কখনো তাঁর পরিবারের লোকেরা তাঁকে গরুর চামড়ায় মুড়িয়ে মাটিতে ফেলে রাখতো আর তাঁকে বলতে বলতো: رَبُّكَ اللاتُ وَالْعُزَّى – “(বল্), তোর রব (প্রতিপালক প্রভু) হলেন লাত ও উযযা”। কিন্তু বিলাল রা. কোনো অবস্থাতেই তাদের কথা মানতেন না, বরং নির্যাতন সহ্য করে নিয়ে হলেও বলতেন: ربي الله أحد أحد، ولو أعلم كلمة أحفظ لكم منها لقلتها – “আমার রব আল্লাহ! (তিঁনি) একক (ও অদ্বিতীয় সত্ত্বা)! (তিঁনি) একক (ও অদ্বিতীয় সত্ত্বা)! আমি যদি (তোমাদের দাবীকৃত কথার মতো কোনো) কথা(কে বাস্তব সত্য বলে) জানতাম, তাহলে আমি তোমাদের এই (নির্মম নির্যাতন) থেকে বাঁচার জন্যে তা অবশ্যই বলতাম”। মুশরেকরা তাঁকে কখনো কখনো লৌহবর্ম পড়িয়ে দিয়ে প্রখর রোদ্রের উত্তপ্ত বালুর উপরে ফেলে রেখে শাস্তি দিতো। এভাবে দিনের পর দিন তাঁর উপরে জুলুম অত্যাচার চলতে থাকে। পরে হযরত আবু বরক রা. বিলালের এমন দুরাবস্থা সহ্য করতে না পেরে নিজের অর্থ খরচ করে তাঁকে উমাইয়্যার বিল খালফের কাছ থেকে কিনে নিয়ে তাঁকে মুক্ত করে দেন। [আত-ত্বাবাক্বাত, ইবনে সা’দ- ৩/১৭২; আনসাবুল আশরাফ, ইমাম বালাযুরী- ১/১৮৪; সিরাতে ইবনে হিশাম- ১/৩৩৯; হিলইয়াতুল আউলিয়াহ, ইমাম আবু নুআইম- ১/১৪৮; তারিখে দিমাশক, ইবনুল আসাকীর- ১০/৪৪১; সিয়ারু আ’লা মিন নুবালা, ইমাম যাহবী- ১/৩০২; আল-ইসাবাহ, ইবনে হাজার- ১/৪৫৬]
তখনকার মক্কার মজলুম সাহাবীগণের মধ্যে অন্যতম আরেকজন ছিলেন সাহাবী খাব্বাব বিন আরাত রা.। তিঁনি মূলত: মক্কার লোক ছিলেন না, বরং মক্কার পূর্ব দিকে অবস্থিত নজদ এলাকার বনু তামীম গোত্রের এক দাস ছিলেন তিঁনি, যাঁকে বনু খুযায়া গোত্রের উম্মু আনমার নামীয় এক মহিলা তাঁর কিশোর বয়সেই তাঁকে ক্রয় করেছিলো। খাব্বাব রা. ইসলাম কবুলকারীগণের মধ্যে ৬ষ্ঠ তম ব্যাক্তি ছিলেন মর্মে বলা হয়ে থাকে; তবে মুজাহিদ রহ.-এর মতে খাব্বাব রা. ইসলাম কবুলকারীগণের মধ্যে ৩য় তম ব্যাক্তি ছিলেন। যা হোক, তিঁনি ইসলাম কবুল করার পর সেকথা জানা জানি হয়ে গেলে তিঁনি বিভিন্ন সামাজিক চাপের মুখে পরেন। যেমন, মাসরুক রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, খাব্বাব বিন আরাত রা. বর্ণনা করেন– كُنْتُ قَيْنًا فِي الْجَاهِلِيَّةِ وَكَانَ لِي عَلَى الْعَاصِ بْنِ وَائِلٍ دَرَاهِمُ فَأَتَيْتُهُ أَتَقَاضَاهُ فَقَالَ لَا أَقْضِيكَ حَتَّى تَكْفُرَ بِمُحَمَّدٍ فَقُلْتُ لَا وَاللَّهِ لَا أَكْفُرُ بِمُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَتَّى يُمِيتَكَ اللَّهُ ثُمَّ يَبْعَثَكَ قَالَ فَدَعْنِي حَتَّى أَمُوتَ ثُمَّ أُبْعَثَ فَأُوتَى مَالًا وَوَلَدًا ثُمَّ أَقْضِيَكَ فَنَزَلَتْ {أَفَرَأَيْتَ الَّذِي كَفَرَ بِآيَاتِنَا وَقَالَ لَأُوتَيَنَّ مَالًا وَوَلَدًا} الْآيَةَ . رواه البخاري في صحيحه , كتاب الخصومات , باب التقاضي : ٦/٩٦ رقم ٤٧٣٥ – “জাহেলী যুগে আমি ছিলাম একজন কামার (ব্যাক্তি)। আল-আস বিন ওয়ায়েলের কাছে আমি কিছু দেরহাম পাওনা ছিলাম। (একদিন) আমি আমার পাওনা (অর্থ) চাওয়ার জন্য তার কাছে গেলাম। (আমাকে) সে তখন বললো: ‘আমি তোমার পাওনা পরিশোধ করবো না, যতক্ষন না তুমি মুহাম্মাদের সাথে কুফরী করো’। আমি (তাকে) বললাম: ‘আল্লাহ’র কসম! আমি মুহাম্মাদ ﷺ-এর সাথে (কখনোই) কুফরী করবো না, এমনকি (এক সময়) আল্লাহ তোমার মৃত্যু ঘটাবেন, তারপর (আখেরাতের জিন্দেগীতে তোমাকে আবারো) পূণরুজ্জীবিত করবেন’। সে বললো: ‘আমার কাছ থেকে দূরেই থাকো, যাবৎ না আমি মড়ে যাই, তারপর (আবারও দ্বিতীয় বারের মতো তোমার কথিত পরকালে) পূণরুজ্জীবিত হই, তখন আমার কাছে ধ্বনসম্পদ ও সন্তানসন্ততি এলে তারপরই আমি তোমার পাওনা পরিশোধ করবো’। এ সম্পর্কেই নাজিল হয়- أَفَرَأَيْتَ الَّذِي كَفَرَ بِآياتِنا وَقالَ لَأُوتَيَنَّ مالًا وَوَلَداً –“তুমি কি তাকে দেখোনি, যে আমার আয়াত সমূহের ব্যাপারে কুফরী করে এবং (উদ্ধ্যত্বতার সাথে ঠাট্টা বিদ্রুপ করে) বলে: ‘(কথিত পরকালেও) আমাকে অবশ্যই ধ্বনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দেয়া হবে” (থেকে فَرْداً পর্যন্ত) আয়াতটি”। [সহিহ বুখারী- ৬/৯৬ হাদিস ৪৭৩৫; সহিহ মুসলীম- ৪/২১৫৩ হাদিস ২৭৯৫; আত-ত্বাবাক্বাত, ইবনে সা’দ- ৩/১২২; সুনানুল কুবরা, ইমাম বাইহাকী- ৬/৫২]
খাব্বাব রা.-এর ইসলাম গ্রহনের কথা জানতে পেরে তাঁর মালিকা উম্মু আনমার ও তার ভাই সিবা ইবনু আব্দিল উযযা এবং তার গোত্রের মুশরেকরা তাঁর উপরে নির্মম জুলুম অত্যাচার করার জন্য চড়াও হয়ে পড়ে। তাঁর মালিকা উম্মু আনমার একদিন পরপর লোহার পাত আগুনে গরম করে তাঁর মাথায় ঠেঁসে ধরতো, আর তিঁনি তীব্র যন্ত্রনায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন। এমনকি কখনো কখনো তাঁকে জ্বলন্ত কয়লার উপরে জোর করে শুইয়ে দেয়া হত, যার কারণে তাঁর দেহের হোশত ও চর্বি গলে যেত। [উসদুল গাবাহ, ইবনুল আছীর- ২/১৪৭; সিয়ারু আ’লা মিন নুবালা, ইমাম যাহবী- ২/৩২৩; আল-ইসাবাহ, ইবনে হাজার- ২/২২১] মুজালিদ রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, শা’বী রহ. বর্ণনা করেন- دخل خباب بن الأرت عَلَى عُمَرَ بِنِ الْخَطَّابِ فَأَجْلَسَهُ عَلَى مُتَّكَئِهِ وَقَالَ: مَا عَلَى الأَرْضِ أَحَدٌ أَحَقُّ بِهَذَا الْمَجْلِسِ مِنْ هَذَا إِلا رَجُلٌ وَاحِدٌ. قَالَ لَهُ خَبَّابٌ: مَنْ هُوَ يَا أَمِيرَ الْمُؤْمِنِينَ؟ قَالَ: بِلالٌ. قَالَ فَقَالَ لَهُ خَبَّابٌ: يَا أَمِيرَ الْمُؤْمِنِينَ مَا هُوَ بِأَحَقِّ مِنِّي. إِنَّ بِلالا كَانَ لَهُ فِي الْمُشْرِكِينَ مَنْ يَمْنَعُهُ اللَّهُ بِهِ وَلَمْ يَكُنْ لِي أَحَدٌ يَمْنَعُنِي. فَلَقَدْ رَأَيْتُنِي يَوْمًا أَخَذُونِي وَأَوْقَدُوا لِي نَارًا ثُمَّ سَلَقُونِي فِيهَا ثُمَّ وَضَعَ رَجُلٌ رِجْلَهُ عَلَى صَدْرِي فَمَا اتَّقَيْتُ الأَرْضَ أَوْ قَالَ بَرْدَ الأَرْضِ إِلا بِظَهْرِي. قَالَ: (و في رواية خرى: يا أمير المؤمنين انظر إلى ظهري) ثُمَّ كَشَفَ عَنْ ظَهْرِهِ فَإِذَا هُوَ قَدْ بَرِصَ (و في رواية خرى: فقال عمر: ما رأيت كاليوم، قال: أوقدوا لي ناراً فما أطفأها إلا ودك ظهري) . رواه ابن سعد في الطبقات الكبرى: ٣/١٢٣، و البلاذري في أنساب الأشراف : ١/١٧٧ رقم ٤٤١، و ابن الجوزي في المنتظم في تاريخ الملوك والأمم : ٥/١٣٨، و قال الصوياني في: السيرة النبوية : ١/٩٢ : رواه ابن سعد… الإسناد ظاهره الإرسال لكن له شواهد كثيرة ترفعه إلى درجة الحسن، رواه أبو نعيم في الحلية عن الشعبي: ١/١٤٤ : فقال خباب: يا أمير المؤمنين انظر إلى ظهري، فقال عمر: ما رأيت كاليوم. قال: أوقدوا لي ناراً فما أطفأها إلا ودك ظهري. قال: أوقدوا لي ناراً فما أطفأها إلا ودك ظهري، و هذه الرواية فيها انقطاع في السند؛ لأن الشعبي كان يرسل عن عمر كما قال العلائي في جامع التحصيل، فالسند منقطع بين الشعبي وعمر، وقال الصوياني: رواه أبو نعيم… وظاهر هذا السند الإرسال لكن يشهد له ما سبق. انظر: السيرة النبوية : ١/٩٣ – “(একবার) খাব্বাব বিন আরাত (রা. সেসময়ে মুসলীম জাহানের দ্বিতীয় খলিফা) ওমর বিন খাত্তাব রা.-এর (সমাবেশ) ঘরে প্রবেশ করলেন। ওমর রা. তাকে নিজের গদিতে বসালেন এবং বললেন: ‘(বর্তমান) পৃথিবীতে মাত্র একজন ব্যাক্তি ছাড়া এই সমাবেশের মধ্যে আর কেউই এর বেশি হক্বদার নন, (তবুও আমি আজ খাব্বাবকে আমার পাশে গদিতে বসতে দিলাম -ইসলামের জন্য তাঁর ত্যাগতিতিক্ষার সম্মানে)’। তখন খাব্বাব রা. তাঁকে বললেন: ‘কেঁ সেঁ, হে আমিরুল মু’মিনীন’! ওমর রা. বললেন: ‘বিলাল’। তখন খাব্বাব রা. তাঁকে বললেন: ‘হে আমিরুল মু’মিনীন! (বিলালের উপরে সেসময় মুশরেকদের পক্ষ থেকে আপতিত দু:খ কষ্টের কথা আপনি জানেন, কিন্তু আমার দু:খ কষ্টের কথা কে জানে? বাস্তবে যদি দেখা যায়, তাহলে এর জন্য) আমার চাইতে বেশি হক্বদার আর কে হতে পারে? বেলালের জন্য তো মুশরেকদের মধ্যে এমন লোকও ছিল, যার দ্বারা আল্লাহ (তাআলা) তাঁকে বাঁচিয়ে নিয়েছিলেন। অপরদিকে (মুশরেকদের জুলুমের হাত থেকে) আমাকে বাঁচাবে -এমন কেউই (তখন) ছিল না আমার জন্যে। এমন দিনও আমাকে দেখতে হয়েছে, যেদিন তারা আমারকে ধরে আমার জন্য আগুন জ্বালিয়েছে, তারপর তার মধ্যে তারা আমাকে (নির্দয় নির্মমতার সাথে) ভাঁজা করেছে, এরপর এক ব্যাক্তি আমার বুকের উপরে তার পা দিয়ে চেঁপে ধরেছে, তখন (অন্য কিছু নয়,) শুধু আমার পিঠের (গলিত গোশত ও চর্বির) দ্বারাই জমিন বা (বলেছেন) জমিনের ঠান্ডা (মাটি আগুনের জ্বলন থেকে) বেঁচে গেছে। ((অন্য বর্ণনায় আছে, খাব্বাব রা. বললেন: ‘হে আমিরুল মু’মিনীন! আমার পিঠটা দেখুন’))। রাবী বলেন: এরপর খাব্বাব রা. (ওমর রা.-এর সামনে) তাঁর পিঠটা বের করে ধরলেন; তখন (দেখা গেল, তাঁর) পিঠটি ভিষন ভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে। ((অন্য বর্ণনায় আছে, তখন ওমর রা. বললেন: ‘আমি আজকের মতো (এমন বিভৎস কিছু কখনো) দেখিনি’! তখন খাব্বাব রা. বললেন: ‘তারা আমার জন্য আগুন জ্বালাতো, আর আমার (গায়ের পোড়া) চর্বি দিয়েই সেই আগুন নিভে যেতো))! ”। [আত-ত্ববাক্বাত, ইমাম ইবনে সা’দ- ৩/১২৩; আনসাবুল আশরাফ, ইমাম বালাযুরী- ১/১৭৮ আছার ৪৪১; হিলইয়াতুল আউলিয়াহ, ইমাম আবু নুআইম- ১/১৪৪; আল-মুনতাজিম, ইবনুল জাওযী- ৫/১৩৮]
শা’বী রহ. বলেন- إن خبابا صبر ولم يعط الكفار ما سألوا، فجعلوا يلزقون ظهره بالرضف، حتى ذهب لحم متنه – “খাব্বাব (বিন আরত রা. মুশরেকদের জুলুম অত্যাচারের উপরে) সবর করেছিলেন; তারা তাঁর থেকে যে কুফরী (করাতে) চেয়েছিল তিঁনি তাদেরকে তা (হতে) দেননি। ফলে তারা তার পিঠে (আগুনে গরম করা) পাথরের সাহায্যে ছেঁকা দিতো, এতে তাঁর পিঠের গোশত গলে পড়তো”। [উসদুল গাবাহ, ইবনুল আছীর- ২/১৪৭]
খাব্বাব বিন আরত রা. একবার এত নির্মম নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে খোদ্ রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে গিয়ে অভিযোগ করেছিলেন যে, কেনো রাসুলুল্লাহ ﷺ তাঁদের মুক্তির জন্য আল্লাহ তাআলা’র কাছে দোয়া করছেন না?! তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ তাকে যে জবাব দিয়েছিলেন সেটা প্রত্যেক দ্বীনের দায়ী ও মুজাহিদগণের মস্তিষ্কে সংরক্ষন করে রাখার মতো, কেননা বাড়িতে বসে ইবাদতকারীদের তো আর এমন জুলুমের স্বীকার হতে দেখা যায় না, হলে হয় দ্বীনের দায়ী ও মুজাহিদগণের মধ্য থেকেই কাউকে। কায়েস রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, খাব্বাব ইবনুল আরত রা. বর্ণনা করেন- شَكَوْنَا إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ مُتَوَسِّدٌ بُرْدَةً لَهُ فِي ظِلِّ الكَعْبَةِ فَقُلْنَا: أَلاَ تَسْتَنْصِرُ لَنَا أَلاَ تَدْعُو لَنَا؟ فَقَالَ: قَدْ كَانَ مَنْ قَبْلَكُمْ، يُؤْخَذُ الرَّجُلُ فَيُحْفَرُ لَهُ فِي الأَرْضِ، فَيُجْعَلُ فِيهَا، فَيُجَاءُ بِالْمِنْشَارِ فَيُوضَعُ عَلَى رَأْسِهِ فَيُجْعَلُ نِصْفَيْنِ، وَيُمْشَطُ بِأَمْشَاطِ الحَدِيدِ، مَا دُونَ لَحْمِهِ وَعَظْمِهِ، فَمَا يَصُدُّهُ ذَلِكَ عَنْ دِينِهِ، وَاللَّهِ لَيَتِمَّنَّ هَذَا الأَمْرُ، حَتَّى يَسِيرَ الرَّاكِبُ مِنْ صَنْعَاءَ إِلَى حَضْرَمَوْتَ، لاَ يَخَافُ إِلَّا اللَّهَ، وَالذِّئْبَ عَلَى غَنَمِهِ، وَلَكِنَّكُمْ تَسْتَعْجِلُونَ . رواه البخاري في الصحيح , كتاب الإكراه , باب من اختار الضرب والقتل والهوان على الكفر : ٩/٢٠ رقم ٦٩٤٣ – “(মক্কী জীবনে একবার) রাসুলুল্লাহ ﷺ ক্বাবা’র ছায়ায় চাদরে মাথা ঠেঁস দিয়ে ছিলেন, এমন সময় আমরা তাঁর কাছে অভিযোগ তুলে বললাম: ‘আপনি কি আমাদের জন্য (আল্লাহ’র কাছে) সাহায্য চাইবেন না? আমাদের জন্য দোয়া করবেন না’? তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন: ‘(মক্কার কাফের মুশরেকরা আজ তোমাদের সাথে যে সমস্ত জুলুম অত্যাচার করছে, এতেই তোমরা ধৈর্যহারা হয়ে যাচ্ছো?) বস্তুত: তোমাদের পূর্বে (বিভিন্ন নবী আর.-এর উম্মত) যারা ছিল, (তাদের ক্ষেত্রে তো এমনও হত যে,) এক ব্যাক্তিকে ধরা হত, পরে তার জন্য জমিনে গর্ত খোঁদা হত, তারপর তাকে তার মধ্যে (কোমড় বা বুক পর্যন্ত পূঁতে) রাখা হত, পরে করাত এনে তার মাথা’র উপর থেকে চালিয়ে তাকে দ্বিখন্ডিত করে ফেলা হত এবং লোহার চিরুনী দিয়ে তার (দেহের) গোশতের নিচের হাড় পর্যন্ত আচঁড় দেয়া হত। এতদসত্ত্বেও এসব তাঁকে তার দ্বীন থেকে ফিরাতে পারতো না। আল্লাহ’র কসম! আল্লাহ (তাআলা নিকট ভবিষ্যতে) এই দ্বীন (ইসলাম)কে অবশ্য-অবশ্যই পরিপূর্ণ করে দিবেন। এমনকি (একজন) আরোহী (একাই) সানআ থেকে হাজরা-মাউত পর্যন্ত সফর করে যাবে, (কিন্তু) সে আল্লাহকে ছাড়া এবং তার মেষপালের উপরে নেকড়ে(র হামলা) ছাড়া কিছুকেই ভয় করবে না। কিন্তু তোমরা তাড়াহুড়া করছো”। [সহিহ বুখারী- ৯/২০হাদিস ৬৯৪৩; আল-মু’জামুল কাবির, ইমাম ত্বাবরাণী- ১১/৪৩৭ হাদিস ৩৫৫৩]
ফায়দা: এই হাদিসটির শেষে যে বলা হয়েছে- وَلَكِنَّكُمْ تَسْتَعْجِلُونَ – “কিন্তু তোমরা তাড়াহুড়া করছো”-তা দ্বারা বোঝা যায় যে, মানব স্বভাবের স্বাভবিক চাহিদা মোতাবেক মক্কার মুসলমানগণ তখনকার জুলুম অত্যাচারের সেই ভয়াবহ পরিস্থিতিটিকে দ্রুত অতিক্রম করে মুক্তির যে একটা দীর্ঘশ্বাস নেয়ার চিন্তা করছিলেন, সেই পরিস্থিতি -তাদের মন না চাইলেও- অত দ্রুত চলে যাওয়ার পর্যায়ে মোটেও ছিল না, বরং আল্লাহ তাআলার নির্ধারিত একটি বিশেষ ইমানী পরীক্ষার নির্ধারিত সময়সীমা বাঁধাধরা ছিল, যার ঠিক সময়ক্ষন আসার আগে তা অতিক্রম করে চলে যাওয়ার দ্বিতীয় কোনো পথ ছিল না, যার কথা কেবল বিশ্বনবী ﷺ জানতেন, আর এজন্যই তিঁনি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ওই নির্ধারিত সময়টি আগমনের হুকুম বা ইশারা ইংগীত না আসা পর্যন্ত মজলুম মুসলমানগণকে মক্কার মুশরেকদের জুলুম-অত্যাচারের উপরে সবর (ধৈর্যধারন) করার উপদেশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। কারণ, তখন মুমিনদের জন্য ‘সবর (ধের্য) করা’র এই একটিমাত্র পথই ছিল খোলা যার শেষ ফলাফল ছিল জান্নাত। দ্বিতীয় কোনো পথে নিরাপদে বেরুতে হলে তো মুশরেকদের কথা মতো পূণরায় আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সাথে কুফরী করে তবেই ওদের দেয়া জুলুম অত্যাচার থেকে মুক্তি লাভের সুযোগ পেতো, যার একমাত্র পরিণিতি ছিল জাহান্নাম।
আমি এখানে, সেসময়কার মক্কার মুসলমানগণকে ইসলাম গ্রহন করার কারণে মক্কার মুশরেকদের দ্বারা কী করুন পরিস্থিতির স্বীকার হতে হত -তার কিছু সংক্ষিপ্ত ঘটনার কথা নমুনা স্বরূপ উল্লেখ করলাম মাত্র। অন্যথায়, হাদিস ও ইসলামী ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য কিতাব সমূহে বহু সাহাবীর ব্যাপারে বিভিন্ন লোমহর্ষক ঘটনার কথা বিস্তারিত বর্ণিত আছে, যার সবগুলো এখানে উল্লেখ করা সম্ভব নয়।
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-
أَحَسِبَ النَّاسُ أَن يُتْرَكُوا أَن يَقُولُوا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ – وَ لَقَدْ فَتَنَّا الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ ۖ فَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ الَّذِينَ صَدَقُوا وَ لَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِينَ
“মানুষ কি ধারনা করেছে যে, তারা বলবে ‘আমরা (আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের উপরে) ইমান এনেছি’ আর (শুধু এতটুকু-তেই) তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে, আর তাদেরকে পরীক্ষায় লিপ্ত করা হবে না। তাদের পূর্বে যারা ছিল, আমরা তাদেরকেও পরীক্ষায় লিপ্ত করেছিলাম। বস্তুত: আল্লাহ অবশ্যই জেনে নিতে চান কারা (ইমানের ব্যাপারে) সত্য বলে, এবং তিঁনি অবশ্যই (এও) জেনে নিতে চান (কারা) মিথ্যুক”। [সূরা আনক্বাবুত ২, ৩]
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা., হাসান বসরী, ক্বাতাদাহ, আত্বা, যাবের বিন যায়েদ, মুক্বাতিল প্রমুখের মতে, উপরের এই আয়াত দুটি ছিল হিজরতপূর্ব মক্কার মুসলমানদের ব্যাপারে নাজিল হওয়া দুটি আয়াত। [যাদুল মাসীর, ইবনুল যাওজী- ৬/২৫৩] সে সময় কোনো কাফের যখন- اشْهَدُ انْ لّآ اِلهَ اِلَّا اللّهُ وَ حْدَه لَا شَرِيْكَ لَه، وَ اَشْهَدُ اَنَّ مُحَمَّدً اعَبْدُه وَ رَسُولُه – ((আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তিঁনি একক (ও অদ্বিতীয়), তাঁর কোনো শরীক নেই, এবং আমি (আরো) সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, মুহাম্মাদ ﷺ তাঁর বান্দা ও তাঁর রাসুল))– এই সাক্ষ্য দিয়ে মুসলমান হত, তখন তার উপরে অপরাপর কাফের মুশরেকদের পক্ষ থেকে যেসকল বৈরী আচরণ, জুলুম অত্যাচার ও বালা মুসিবত আপতিত হত, তখন মুসলমানদের মধ্যে যারা এসবের পরও তাদের ইমানী সাক্ষ্যে ও দ্বীন ইসলামের উপরে অটল অবিচল থাকতো, তারা মূলত: তাদের কথা ও কাজে আল্লাহ’র কাছে সত্যবাদী হিসেবে প্রমাণিত হত, আর যারা এসব নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সাথে বাস্তবেই কুফরী করতো, তারা মূলত: ইমানী স্বাক্ষ্যের প্রশ্নে তাদের কথা ও কাজে আল্লাহ’র কাছে মিথ্যুক হিসেবে প্রমাণিত হত। আগের জামানাগুলিতে যঁতজন আম্বীয়া কেরাম আ. এসেছিলেন তাঁদের উম্মতদের মধ্যে ইমান কবুলকারী মুসলমানদেরকেও এই একই ইমানী পরীক্ষা দেয়া লাগতো। বিশ্বনবী ﷺ-এর জামানার মুসলমানরাও এই একই পরীক্ষারই সম্মুখীন হয়েছিলেন। এবং যতদিন ইসলাম থাকবে ততদিন পর্যন্ত মুসলমানদেরকে এই পরীক্ষাই দিয়ে যেতে হবে। [রুহুল মাআনী, ইমাম আলুসী- ১০/৩৪০] যেমন আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-
سُنَّةَ اللَّهِ فِي الَّذِينَ خَلَوْا مِن قَبْلُ ۖ وَلَن تَجِدَ لِسُنَّةِ اللَّهِ تَبْدِيلًا
“যারা (তোমাদের) পূর্বে (এই ধরা থেকে) চলে গেছে তাদের ক্ষেত্রেও আল্লাহ’র সুন্নাহ (আচরণ নীতি -একই রকম ছিল)। আর (হে নবী), তুমি কখনোই আল্লাহ’র সুন্নাহ (আচরণ-নীতি)তে কোনো পরিবর্তন (দেখতে) পাবে না”। [সূরা আহযাব ৬২]
>>> মূল সূচিপত্র (index) থেকে এ পেজের পূর্ববর্তী বা পরবর্তী আলোচনা পড়তে [এখানে ক্লিক করুন]