খলিফার দায়িত্ব মুসলমানদের মাঝে নামায কায়েম রাখা vs ধর্মনিরপেক্ষতা

খলিফার দায়িত্ব মুসলমানদের মাঝে নামায কায়েম রাখা vs ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের প্রকাশ্য পথভ্রষ্ঠতা, ইসলাম বিরোধীতা, আল্লাদ্রোহিতা ও কুফর

পূর্ব আলোচনার পর..>>>

# খলিফা’র সর্ব প্রধান দায়িত্ব: নামায কায়েম ও যাকাত আদায় -এর সরকারী ব্যাবস্থা জারি করা

খিলাফত (ইসলামী শাসন ব্যবস্থা) বিহীন অবস্থায়, মুসলমানরা তো সকলেই ফরয নামায আদায় করবে এবং (নেসাবের মালিক হলে বছরান্তে) ফরয যাকাত আদায় করবে। কিন্তু খিলাফত কায়েম হয়ে গেলে, খলিফার অপরিহার্য দায়িত্ব হল, ইসলামী শাসনের অধীনস্ত সকল বালেগ মুসলীম পুরুষ ও নারীর জন্য নামায কায়েম ও (নেসাবের মালিক হলে বছরান্তে) যাকাত আদায়ের সরকারী আইন জারি করা ও আইনকে যথাযথভাবে প্রয়োগ করা এবং প্রয়োজনে শরয়ী হদ্দ/শাস্তির ব্যবস্থা করা। (উল্লেখ্য, নামায ও যাকাত তরককারী ব্যাক্তি ‘মুরতাদ’ নাকি ‘ফাসেক’ -সে আলোচনার দিকে আমরা এখানে যেতে চাচ্ছিনা। কেয়ামতের দিন আল্লাহ এর সহিহ বিচার করবেন। তবে সে মুরতাদ হোক বা ফাসেক হোক -উভয় অবস্থাতেই তাদের উপর শরয়ী শাস্তি প্রযোজ্য হবে। এর বহু শক্তিশালি দলিল রয়েছে।)

আল্লাহ তাআলা এরশাদ করছেন-

  وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ وَيُقِيمُوا الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ ۚ وَذَٰلِكَ دِينُ الْقَيِّمَةِ 
“অথচ তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল -তারা শুধুমাত্র আল্লাহ’র ইবাদত (ও গোলামী) করবে -সম্পূর্ণ খাঁটিত্ব নিয়ে (শুধুমাত্র) তাঁরই দ্বীনের অভিমুখী হয়ে, আর তারা (ফরয) নামায আদায় করবে ও (ফরয) যাকাত আদায় করবে। আর ওটাই হল (আল্লাহ’র) ‘দ্বীন আল-কাইয়্যেম’ (সুপ্রতিষ্ঠিত দ্বীন)”। [সূরা আল-বাইয়্যেনাহ ১-৫]

لَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا بِالْبَيِّنَاتِ وَأَنْزَلْنَا مَعَهُمُ الْكِتَابَ وَالْمِيزَانَ لِيَقُومَ النَّاسُ بِالْقِسْطِ وَأَنْزَلْنَا الْحَدِيدَ فِيهِ بَأْسٌ شَدِيدٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ

https://www.alukah.net/library/0/72735/

যেমন, মক্কার মুশরেকরা বিভিন্ন সময়ে মহানবী ﷺ ও মুসলমানদের সাথে কৃত চুক্তি ভঙ্গ করেছিল এবং আল্লাহ তাআলা এসকল চুক্তি ভঙ্গকারী মুশরেকদের সাথে জিহাদ করার জন্য নবী ও মুসলমানদেরকে নির্দেশ দিয়ে বহু আয়াত নাজিল করেছেন, তবে এর সাথে সাথে এও বলেছেন: فَإِن تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَخَلُّوا سَبِيلَهُمْ ۚ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ – তবে তারা যদি (শিরক থেকে) তওবা করে (ইমান আনে) এবং নামায কায়েম করে ও যাকাত আদায় করে, তাহলে (তাদের সাথে যুদ্ধ করো না, বরং বায়তুল হারামে প্রবেশের জন্য) তাদের পথ ছেড়ে দাও। নিশ্চই আল্লাহ (বান্দার প্রতি) ক্ষমাশীল ও দয়ালু’। [সূরা তাওবাহ ৫] এর কিছু আয়াত পরে আরো বলেছেন: فَإِنْ تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَإِخْوَانُكُمْ فِي الدِّينِ وَنُفَصِّلُ الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ – তবে তারা যদি (শিরক থেকে) তওবা করে (ইমান আনে) এবং নামায কায়েম করে ও যাকাত আদায় করে, তাহলে তারা (হয়ে যাবে) তোমাদের দ্বীনের মধ্যকার (মুসলমান) ভাই। আর আমরা জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য আয়াতসমূহকে খুলে খুলে বর্ণনা করি’। [সূরা তাওবাহ ১১]

এই আয়াত দুটি এ কথার সুস্পষ্ট দলিল যে, মুশরেক বা অন্য কোনো কাফের যদি মুসলমানদেরকে এই শর্ত দেয় যে, সে কুফর থেকে তওবা করে ও শুধুমাত্র কালেমায়ে শাহাদাত পড়ে মুসলমান হতে রাজি, (সাথে নামায ও যাকাত যে আল্লাহ কর্তৃক মুমিন মুসলমানদের উপর আরোপিত ফরয ইবাদত -তা মনে মনে স্বীকার করে নিতেও রাজি) কিন্তু সে বাস্তব ক্ষেত্রে পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামায পড়তে রাজি নয় কিংবা (নেসাবের মালিক হলে বছরান্তে) ফরয যাকাত আদায় করতে রাজি নয়, তাহলে এরকম শর্তে সে মুসলমানদের দ্বীনী ভাই হিসেবে গণ্য নয়; অর্থাৎ সে মুসলমান হিসেবেই গণ্য নয়; বরং সে এমন কাফের, যে তখনো পর্যন্ত মুসলীম মিল্লাতের বাহিরেই রয়ে গেছে। 

এই স্বীকৃতি যদি হয় কাফের মুশরেকদের জন্য একজন মুসলীম (আত্বসমর্পণকারী অনুগত বান্দা) প্রমাণিত হওয়ার দ্ব্যার্থহীন ফরয শর্ত, তাহলে কি করে একথা মেনে নেয়া যেতে পারে যে, কোনো মুসলীম হিসেবে দাবীদার কেউ শুধুমাত্র কালেমা لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللّٰهِ (আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ  আল্লাহ’র রাসুল) – একথা বিশ্বাস করে বললেই ইসলামী হুকুমত তার পথ ছেড়ে দিবে ?! খিলাফতের চোখে কাফের মুশরেকদের জন্য মুসলীম (আত্বসমর্পণকারী অনুগত বান্দা) প্রমাণিত হওয়ার দ্ব্যার্থহীন ফরয শর্ত হল কালেমা শাহাদাতের স্বীকারোক্তির পর ফরয নামায কায়েম ও (নেসাবের মালিক হলে বছরান্তে) ফরয যাকাত আদায় করা, আর মুসলমান পরিবারে জন্ম গ্রহনকারী গদ্দিনশীন আব্দুল্লাহ ও মফিজ’দের জন্য মুসলীম (আত্বসমর্পণকারী অনুগত বান্দা) প্রমাণিত হওয়ার দ্ব্যার্থহীন ফরয শর্ত শুধু কালেমায়ে শাহাদাত !!! এটা কোন বিবেক গ্রহন করবে?

বোঝা গেল, খিলাফতের চোখে কারো ‘মুসলমান’ হওয়ার বাহ্যিক প্রমাণ হল- (১) তাকে কালেমায়ে শাহাদাতের স্বীকৃতি দিতে হবে, (২) পাঁচ ওয়াক্ত নামায বাস্তবে কায়েম/আদায় করতে হবে, (৩) (নেসাবের মালিক হলে বছরান্তে) বাস্তবেই ফরয যাকাত আদায় করতে হবে। তবেই সে মুসলমানদের দ্বীনী ভাই ‘মুসলীম’ হিসেবে গণ্য হয়ে থাকতে পারবে। খলিফা বা মুসলীম জামাআতের পক্ষে কারো অন্তরের বিশ্বাস চিড়ে দেখা সম্ভব নয়, তাই তারা শুধু ব্যাক্তির বাহ্যিক সম্ভাব্য আচরণের উপর শরয়ী সিদ্ধান্ত নিতে আদিষ্ট। আর সে ব্যাক্তির অন্তরের বিশ্বাসের হিসাব কিতাব শুধু আল্লাহ’ই জানেন।

এদিকে ইংগিত করেই (আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে সহিহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে,) রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেন- أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَشْهَدُوا أَنْ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ ، وَيُقِيمُوا الصَّلاةَ ، وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ ، فَإِذَا فَعَلُوا ذَلِكَ عَصَمُوا مِنِّي دِمَاءَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ ، إِلا بِحَقِّ الإِسْلامِ وَحِسَابُهُمْ عَلَى اللَّهِ . أخرجه البخاري , كتاب الإيمان, باب فإن تابوا وأقاموا الصلاة : رقم ٢٥ ; و مسلم , كتاب الإيمان : رقم ٣٥ – ‘আমাকে (আল্লাহ তাআলার তরফ থেকে) হুকুম করা হয়েছে, আমি যেন মানুষের সাথে কিতাল (স্বসস্ত্র জিহাদ) চালিয়ে যাই, যাবৎ না তারা এই সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই ও (আমি) মুহাম্মাদ হলাম আল্লাহ’র (সর্বশেষ নবী ও) রাসুল, (এবং যাবৎ না) তারা নামায কায়েম করে এবং যাকাত আদায় করে। যখন তারা তা করবে, তখন তারা আমার থেকে তাদের রক্ত (জীবন) ও ধ্বনসম্পদকে বাঁচিয়ে নিলো -অবশ্য ইসলামের (অন্য কোনো) হক্ব থাকলে ভিন্ন কথা। আর তাদের হিসাব আল্লাহ’র (মর্জির) উপর’। [সহিহ বুখারী, হাদিস ২৫; সহিহ মুসলীম, হাদিস ৩৫; মুসনাদে আহমদ- ২/৩৪৫; সহিহ ইবনে খুযাইমা- ৪/৮ হাদিস ২২৪৮; মুসতাদরাকে হাকিম– ১/৩৮৭]

এই হাদিসের অর্থ কোনো কাফেরকে জোর করে ইসলামে দাখেল করানো নয়, কারণ আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন: لَا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ ۖ قَد تَّبَيَّنَ الرُّشْدُ مِنَ الْغَيِّ ۚ فَمَن يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِن بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَىٰ لَا انفِصَامَ لَهَا – ‘দ্বীন (ইসলাম)-এর মধ্যে জবরদস্তি (করে ইমান আনায়ন ও মুসলমান বানানোর কোনো বিধান) নেই। বস্তুত: আল-গাই (বাতিল ও তাগুতী মত ও পথ) থেকে আল-রুশদ (হেদায়েতের পথ) পরিষ্কার হয়ে গেছে। সুতরাং, যে ব্যাক্তি ত্বাগুতকে ইনকার করবে এবং (তদস্থলে) আল্লাহ’র  উপর ইমান আনবে, সে মূলতঃ মজবুৎ কড়া/হাতলকে পাকড়িয়ে ধরলো, যা ছিন্ন হবার নয়। [সূরা বাকারাহ ২৫৬] এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা ইনশাআল্লাহ সামনে ‘জিহাদ’ বিষয়ক আলোচনায় আপনারা বুঝতে পাবেন। এখানে শুধু এতটুকু বুঝে নিন যে, সর্বসাধারণ কাফেরদের কাছে আল্লাহ’র দ্বীনের পয়গাম পৌছানোর পথে সর্বদাই বাঁধা দেয় তাদের উপর প্রভাবশালী কাফের ইমাম’রা (অর্থাৎ, কাফের নেতা ও শাসক শ্রেণিরা) -বেশিরভাগই রাজনৈতিক কারণে। তাদের ভয় ও প্রভাবের কারণে সর্বসাধারণ কাফের জনগণ স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহন করে ইসলাম গ্রহন করতে পারে না বা গ্রহন করলেও দ্বীন মানার প্রশ্নে অথবা কাফেররা ব্যাপক হারে মুসলমান হতে থাকলে তারা তাদের উপরে নানাবিধ বাঁধার সৃষ্টি করে। এই প্রভাবশালী কুফ্ফার শ্রেণিটিকে পথ থেকে ভালোয় ভালোয় সরে দাঁড়ানোরই জন্য উপরোক্ত হাদিসে জিহাদ চালিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই শ্রেণিটির সামনে ৩টি পথ খোলা: (১) হাদিসটির উল্লেখীত শর্তগুলো মেনে মুসলমান হয়ে যাওয়া, তাহলে মুসলমানদের মতোই তাদের জান ও মাল হিফাজত করা হবে, (২) ইসলাম কবুল না করলে, অন্ততঃ কোনো যুদ্ধ ছাড়াই ইসলামের পথ থেকে সরে দাঁড়ানো এবং সেখানে ইসলামী শাসন কর্তৃত্বের বস্যতা স্বীকার করে নিয়ে ইসলামী সরকারকে জিজিয়া দান পূর্বক সাধারণ নাগরীক হিসেবে জীবন জাপন করা। এমনটা করলেও মুসলমানদের মতোই তাদেরও জান ও মাল হিফাজত করা হবে, (৩) উপরের শর্ত দুটি পছন্দ না হলে এবং ইসলামের পথ থেকে সরে না দাঁড়ালে তখন মুসলমানরা আমীরের নির্দেশে তাদের সাথে কিতাল (স্বসস্ত্র জিহাদ) চালিয়ে যাবে। এক্ষেত্রে মুজাহিদগণ তাদেরকে সামনে পেলে হত্যা করবে  এবং তাদের উপর বিজীত হলে তাদের ধ্বনসম্পদ গণীমত হিসেবে গ্রহণ করবে। এক্ষেত্রে ওই হামলায় অংশগ্রহনকারী কাফেররা তাদের রক্ত ও ধ্বনসম্পদকে মুসলমানদের হাত থেকে বাঁচাতে পারলো না।

এভাবেই তাদের ইমাম শ্রেণিটির প্রভাব ও কর্তৃত্বক্ষমতা ধুলিস্মাৎ করে দিয়ে সেখানে ইসলামী কর্তৃত্ব কায়েম এবং সেখানকার সর্বসাধারণ কাফেরদের কাছে দ্বীনের পয়গাম পৌছানো এই জিহাদের উদ্দেশ্য, যাতে সেখানকার সর্বসাধারণ কাফেররা জনগণ  স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ইসলাম কবুল করতে পারে অথবা মন সায় না দিলে  পূর্ববৎ কাফের অবস্থায় থেকে যেতে পারে। তাদেরকে ইসলাম কবুলের ব্যাপারে কোনোই জোরজবস্তি করা হবে না। এই প্রসঙ্গেই বলা হয়েছে-   لَا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ – ‘দ্বীন (ইসলাম)-এর মধ্যে জবরদস্তি (করে ইমান আনায়ন ও মুসলমান বানানোর কোনো বিধান) নেই’। [সূরা বাকারাহ ২৫৬]

হাদিসটি এব্যাপারে পরিষ্কার যে, ইসলাম কবুল করার শর্ত হল, (১) তাকে কালেমা لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللّٰهِ (আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ  আল্লাহ’র রাসুল) -এর স্বীকৃতি দিতে হবে, (২) পাঁচ ওয়াক্ত নামায কায়েম/আদায় করবে মর্মে  স্বীকৃতি দিতে হবে, (৩) (নেসাবের মালিক হলে বছরান্তে) ফরয যাকাত আদায় করবে মর্মে মর্মে  স্বীকৃতি দিতে হবে। তবেই তাকে প্রাথমিক ভাবে মুসলমানদের ভাই ‘মুসলমান’ হিসেবে গ্রহন করে নেয়া হবে এবং তাদের রক্ত ও ধ্বনসম্পদ মুসলমানদের মতোই হিফাজত করা হবে।

কেউ উপরোক্ত শর্ত মেনে মুসলমান হয়ে গেলে পর তার ক্ষেত্রে আর-  لَا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ – ‘দ্বীন-এর মধ্যে জবরদস্তি নেই’ -প্রযোজ্য নয়। কারণ এই আয়াতটি-তো কাফেরকে জোর করে মুসলমান না বানোর কথা বলা হয়েছে; মুসলমানকে জোর করে ইসলামী শরীয়তের আওতায় আনতে নিষেধ করা হয়নি। এ দিকেই ইঙ্গিত করে হাদিসটিতে মুসলমানদের প্রসঙ্গেই বলা হয়েছে- إِلا بِحَقِّ الإِسْلامِ -‘অবশ্য ইসলামের (অন্য কোনো) হক্ব থাকলে ভিন্ন কথা’ -এর অর্থ হল, মুসলমান হওয়ার পর উপরোক্ত শর্তগুলোর কোনো একটি পরিত্যাগ করার মতো কুফরী করলে, যেমন: পূণরায় দ্বীন ইসলাম ত্যাগ করে মুরতাদ (কাফের) হয়ে গেলে বা নামায কায়েম করা পরিত্যাগ করলে কিংবা যাকাত আদায় না করলে, তার উপরে ইসলামী শরীয়তেরই হক্ব হল তার রক্ত ও ধ্বনসম্পদ শরয়ী কায়দায় হালাল হয়ে যাওয়া। অর্থাৎ, তাকে কতল করা হালাল হওয়া এবং তার ধ্বনসম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হালাল হওয়া ইত্যাদি। এই হুকুম ইসলামী খিলাফতের অধীন নব-মুসলীম ও পুরাণা মুসলীম উভয়ের বেলায়েই প্রযোজ্য। আমরা আগেও বলে এসেছি, খলিফা বা মুসলীম জামাআতের পক্ষে কারো অন্তরের বিশ্বাস চিড়ে দেখা সম্ভব নয়, তাই তারা শুধু ব্যাক্তির বাহ্যিক সম্ভাব্য আচরণের উপর শরয়ী সিদ্ধান্ত নিতে আদিষ্ট। আর সে ব্যাক্তির অন্তরের বিশ্বাসের হিসাব কিতাব শুধু আল্লাহ’ই জানেন, তিনি কেয়ামতের দিন তাঁর ইলম অনুযায়ী বে-নামাযীদের বিচার করবেন। এ প্রসঙ্গেই বলা হয়েছে- وَحِسَابُهُمْ عَلَى اللَّهِ – আর তাদের হিসাব আল্লাহ’র (মর্জির) উপর’।

 ইমাম ইবনে কাছির রহ. (মৃ: ৭৭৪ হি:) লিখেছেন- اعتمد الصديق رَضِيَ اللهُ عَنْهُ في قتال مانعي الزكاة على هذه الآية الكريمة وأمثالها حيث حرمت قتالهم بشرط هذه الأفعال وهي الدخول في الإسلام والقيام بأداء واجباته  – আবু বকর সিদ্দক রা. (তাঁর খিলাফতের জামানায়) এই আয়াত ও এই জাতীয় আয়াতে কারিমার ভিত্তিতে যাকাত দিতে অস্বীকারকারী’র বিরুদ্ধে কিতাল (স্বসস্ত্র জিহাদ) করেছিলেন। (কারণ) এই আয়াতে এসব শর্ত পালন সাপেক্ষেই তাদের সাথে কিতাল করাকে হারাম করা হয়েছে, অর্থাৎ (কালেমা স্বীকার করে) ইসলামে দাখেল হওয়া এবং (ফরয নামায ও ফরয যাকাতের মতো) অপরিহার্য আদায়যোগ্য ইবাদত কায়েম করা।… [তাফসিরে ইবনে কাসীর- ৪/১১১] 

আবু হুরায়রাহ রা. থেকে সহিহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে- لَمَّا تُوُفِّيَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، وَكَانَ أَبُو بَكْرٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ ، وَكَفَرَ مَنْ كَفَرَ مِنْ الْعَرَبِ فَقَالَ عُمَرُ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ : كَيْفَ تُقَاتِلُ النَّاسَ وَقَدْ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ “أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَقُولُوا لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ فَمَنْ قَالَهَا فَقَدْ عَصَمَ مِنِّي مَالَهُ وَنَفْسَهُ إِلا بِحَقِّهِ وَحِسَابُهُ عَلَى اللَّهِ” ؟ فَقَالَ : وَاللَّهِ لأُقَاتِلَنَّ مَنْ فَرَّقَ بَيْنَ الصَّلاةِ وَالزَّكَاةِ ، فَإِنَّ الزَّكَاةَ حَقُّ الْمَالِ ، وَاللَّهِ لَوْ مَنَعُونِي عَنَاقًا كَانُوا يُؤَدُّونَهَا إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَقَاتَلْتُهُمْ عَلَى مَنْعِهَا قَالَ عُمَرُ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ : فَوَاللَّهِ مَا هُوَ إِلا أَنْ قَدْ شَرَحَ اللَّهُ صَدْرَ أَبِي بَكْرٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ فَعَرَفْتُ أَنَّهُ الْحَقُّ . أخرجه البخاري , كتاب الزكاة باب وجوب الزكاة : رقم ١٤٠٠ ; و مسلم , كتاب الإيمان : رقم ٢٠ ; و الترمذي , كتاب الإيمان: ٢٥٣٢ ، والنسائي , كتاب الزكاة : ٢٤٠٠ ، وأبو داود, كتاب الزكاة ، وأحمد في المسنده: ٦٤ – ‘যখন রাসুলুল্লাহ ﷺ ইন্তেকাল করলেন এবং আবু বকর রা. (খলিফা) হলেন, (তখন) আরবের মধ্য যারা (ফরয যাকাত সরকারের হাতে দিতে) অস্বীকার করে বসলো, তিনি (সেই মুরতাদদের) বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন (এবং আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’গণের কাছে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ব্যাপারে তাঁর সিদ্ধানন্তের কথা জানালেন)। তখন ওমর রা. তাঁকে বলেন: ‘আপনি (লাা ইলাহা ইল্লাল্লাহ স্বীকৃতিদাতা) লোকদের সাথে কিভাবে কিতাল (স্বসস্ত্র জিহাদ) করবেন, অথচ রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেছেন: ‘আমাকে (আল্লাহ তাআলার তরফ থেকে) হুকুম করা হয়েছে, আমি যেন মানুষের সাথে কিতাল (স্বসস্ত্র জিহাদ) চালিয়ে যাই, যাবৎ না তারা বলে, ‘লাা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, যখন তারা তা বলবে, তখন তারা আমার থেকে তাদের ধ্বনসম্পদ ও জীবনকে বাঁচিয়ে নিলো -অবশ্য এর (তথা ইসলামের অন্য কোনো) হক্ব থাকলে ভিন্ন কথা। আর তাদের হিসাব আল্লাহ’র (মর্জির) উপর’। তখন তিনি বললেন: ‘আল্লাহ’র কসম, যারা নামায ও যাকাতের মাঝে পার্থক্য সৃষ্টি করে (বলে যে, আমরা নামায আদায় করতে রাজি, কিন্তু যাকাত আদায় করবো না), আমি অবশ্যই তাদের সাথে কিতাল (স্বসস্ত্র জিহাদ) করবো, কারণ যাকাত মালের হক্ব। আল্লাহ’র কসম, তারা রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে (ফরয যাকাত বাবদ পশুর) যে গলার রশি দিতো, সেটাও যদি আমাকে তারা দিতে অস্বীকার করে, তাহলেও আমি তাদের অস্বীকৃতির কারণে অবশ্যই তাদের সাথে কিতাল (স্বসস্ত্র জিহাদ) করবো। ওমর রা. বলেন: ‘আল্লাহ’র কসম, (ওই পাক জাত) আল্লাহ’ই আবু বকর রা.-এর অন্তরে (এ মাসআলার সঠিক বুঝ) ঢেলে দিয়েছিলেন। তার পরেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, তিনিই সঠিক (কথা বলেছেন)’ [সহিহ বুখারী, হাদিস ১৪০০; সহিহ মুসলীম, হাদিস ২০; সুনানে তিরমিযী, হাদিস ২৫৩২; সুনানে নাসায়ী, হাদিস ২৪০০; মুসনাদে আহমদ, হাদিস ৬৪; সুনানুল কুবরা, বাইহাকী- ৮/৩০৬ হাদিস ১৬৭৩০]

খিলাফত (ইসলামী শাসনব্যবস্থা)-এর সাথে মুসলমানদের ‘নামায কায়েম’-এর সম্পর্ক :

কোনো ‘বে-নামাযী খলিফা’ বা ‘বে-নামাযী মুসলমান’-এর অস্তিত্ব-তো পরের কথা, এর কল্পনা পর্যন্ত ইসলামী রাষ্ট্রের মধ্যে নেই। 

হযরত আওফ বিন মালেক রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেন- خِيَارُ أَئِمَّتِكُمْ الَّذِينَ تُحِبُّونَهُمْ وَيُحِبُّونَكُمْ، وَيُصَلُّونَ عَلَيْكُمْ وَتُصَلُّونَ عَلَيْهِمْ، وَشِرَارُ أَئِمَّتِكُمْ الَّذِينَ تُبْغِضُونَهُمْ وَيُبْغِضُونَكُمْ، وَتَلْعَنُونَهُمْ وَيَلْعَنُونَكُمْ ” قِيلَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ أَفَلَا نُنَابِذُهُمْ بِالسَّيْفِ ؟ فَقَالَ:” لَا مَا أَقَامُوا فِيكُمْ الصَّلَاةَ . رواه مسلم, كتاب الإمارة, باب خيار الأئمة وشرارهم: رقم ١٨٥٥ –‘তোমাদের ওই ইমাম (খলিফা/আমীর)গণই উত্তম, যাদেরকে তোমরা ভালবাসো এবং তারাও তোমাদেরকে ভালবাসে, তারা তোমাদের জন্য দোয়া করে এবং তোমরাও তাদের জন্য দোয়া করো। আর তোমাদের ওই ইমাম (রাষ্ট্রপ্রধান)গণই নিকৃষ্ট যাদেরকে তোমারা ঘৃনা করো এবং তারাও তোমাদেরকে ঘৃনা করে, তোমরা তাদেরকে অভিশাপ দেও, তারাও তোমাদেরকে অভিশাপ দেয়। বলা হল: ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমরা কি তাদের বিরুদ্ধে তরবারী নিয়ে বিদ্রোহ করবো না? তিনি বললেন: না, যাবৎ তারা তোমাদের মাঝে নামায আদায় করে’। [সহিহ মুসলীম – ৬/২৪ হাদিস ১৮৫৫]

হযরত উম্মে সালামাহ রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেন- سَتَكُونُ أُمَرَاءُ فَتَعْرِفُونَ وَتُنْكِرُونَ فَمَنْ عَرَفَ بَرِئَ وَمَنْ أَنْكَرَ سَلِمَ وَلَكِنْ مَنْ رَضِيَ وَتَابَعَ قَالُوا أَفَلَا نُقَاتِلُهُمْ قَالَ لَا مَا صَلَّوْا . رواه مسلم, كتاب الإمارة, باب وجوب الإنكار على الأمراء فيما يخالف الشرع وترك قتالهم ما صلوا ونحو ذلك: رقم ١٨٥٤; سنن الترمذي, أبواب الفتن / باب / حديث رقم ٢٢٦٥ و صححه الالبانى; سنن أبي داود, كتاب السنة / باب في قتل الخوارج / حديث رقم ٤٧٦٠ –‘শিঘ্রই (তোমাদের মুসলমানদের উপর কিছু) আমীর’রা হবে। (তাদের কাজ কারবার এমন হবে যে,) তোমরা তাদের (কিছু বিষয়ের) প্রশংসা করবে এবং (কিছু বিষয়’কে) অপছন্দ করবে। যে ব্যাক্তি (তাদের) মন্দ’কে চিনতে পেরে অপছন্দ করেছে সে নিরাপত্তা পেয়েছে। কিন্তু যে ব্যাক্তি (তাদের মন্দ’কে চিনতে পেরেও অপছন্দ করেনি, বরং মনে মনে রাজি) খুশি হয়েছে ও (সেই মন্দের) অনুগত্য করেছে (সে অপরাধী সাব্যস্থ হয়ে গেছে)। লোকেরা বললো: (এর পরেও কি) আমরা কি তাদের সাথে কিতাল (জিহাদ) করবো না? তিনি বললেন: না, (কিতাল করবে না) -যাবৎ তারা নামায আদায় করে’। [সহিহ মুসলীম– ৬/২৪ হাদিস ১৮৫৪; সুনানে তিরমিযী, হাদিস ২২৬৫; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৪৭৬০; মুসনাদে আবু আউয়ানাহ– ৪/৪১৮ হাদিস ৭১৬৪; মুসনাদে আহমদ, হাদিস ২৫৯৮৯; সুনানে দারেমী, হাদিস ২৭৯৭] 

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেন- عرى الإسلام و قواعد الدين ثلاثة ، عليهن أسس الإسلام ؛ من ترك واحدة منهن فهو بها كافر حلال الدم : شهادة أن لا إله إلا الله ، و الصلاة المكتوبة ، و صوم رمضان . رواه أبو يعلى: رقم ٢٣٤٩ , اسناده حسن كما في الفتح الرباني لترتيب مسند الإمام أحمد : ١/٢٣٧ – ইসলামের কড়া/হাতল  এবং দ্বীনের কাওয়ায়িদ তিনটি, যার উপর ইসলামের মৌলিকতা স্থাপিত। যে (মুসলমান) এগুলোর মধ্যে থেকে কোনো একটিকেও পরিত্যাগ করবে, সে এমতাবস্থায় কাফের (বিবেচিত হবে), তার রক্ত (তথা তাকে হত্যা করা) হালাল। (ওই তিনটি বিষয় হল): এই সাক্ষ্য দেয়া যে আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, ফরয নামায (আদায় করা) এবং রমযানে রোযা পালন করা।  ’। [মুসনাদে আবু ইয়া’লা, হাদিস ২৩৪৯; আত-তামহিদ, ইবনু আব্দীল বার- ১৬/২৬৯; ফাতহুর রাব্বানী- ১/২৩৭]

এসকল হাদিস ও উপরের দালিলিক আলোচনা থেকে পরিষ্কার প্রমাণিত হয়-

(১) প্রতিটি সাধারণ বালেগ মুসলীম পুরুষ ও নারী যাতে পাঁচ ওয়াক্ত নাময আদায় করে, সেটা সরকারী আইনের আওতায় নিশ্চিত করা খলিফা’র অন্যতম শরয়ী প্রশাসনিক দায়িত্ব। খলিফাও এই আইনের আওতা থেকে বাদ নন। খলিফা’র এই শরয়ী দায়িত্ব পালন হবে উপরোক্ত সূরা হাজ্জের ৪১ নং আয়াতের الَّذِينَ إِن مَّكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ ….. وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ –(তারা হল আমার সেই সকল মুমিন বান্দা) যারা (এমন গুণের অধিকারী যে,) যদি তাদেরকে জমিনে শাসন-কর্তৃত্ব (খিলাফত) দেয়া হয়, তাহলে তারা নামায কায়েম করে,……., মা’রুফ (সৎ বিষয়)-এর নির্দেশ দেয় ..-এর দায়িত্ব পালনের অন্তর্ভূক্ত।

(২) ‘খলিফা/আমীর/ইমাম/সুলতান’ কোনো ওযর ছাড়াই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কায়েম করা স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিয়েছেন মর্মে প্রমাণিত হয়, তাহলে মুসলমানদের সকলের উপর ওয়াজিব হল, যদি অস্ত্র ধারন ছাড়া সে পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায়ে রাজি না হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারন করে হলেও তাকে খলিফার পদ থেকে হটিয়ে দিয়ে অন্য যোগ্য কোনো নামাযী মুসলমানকে সে পদে নির্বাচন করা। [শারহু হাদিসি জিবরীল, ইবনে তাইমিয়্যাহ- ৫৬৪ পৃষ্ঠা] মুসলমানদের এই শরয়ী দায়িত্ব পালন হবে উপরোক্ত সূরা হাজ্জের ৪১ নং আয়াতের  وَنَهَوْا عَنِ الْمُنكَرِ – এবং মুনকার (নাজায়েয ও হারাম বিষয়) থেকে নিষেধ করে’ -এর দায়িত্ব পালনের অন্তর্ভূক্ত এবং এই শরয়ী দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যারা মৃত্যুবরণ করবেন, তারা হবে শহিদ। (যার শরয়ী শর্ত শরায়েত সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আইম্মায়ে ফুকাহা’র কিতাব সমূহ দেখে নিন)। 

(৩) স্বেচ্ছায় ও বিনা ওযরে নামায পরিত্যাগকারী মুসলমানের শাস্তি হল সরকারী প্রশাসনের আওতায় তাকে হত্যা করা -যদি নামায আদায়ে অস্বীকার/বিরোধীতা করে। (ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর মতে যদি সে নামায আদায়ে অস্বীকার/বিরোধীতা না করে নিছক অলসতা জনিত কারণে কোনো ওয়াক্তের নামায ছেড়ে দেয়, তাহলে তাকে জেলে বন্ধ করে রেখে শাস্তি দিতে হবে এবং সে তওবা করে পূণরায় ফরয নামায আদায় করা শুরু করলে তার শাস্তি বন্ধ হবে)। খলিফা’র এই শরয়ী দায়িত্ব পালন হবে  উপরোক্ত সূরা হাজ্জের ৪১ নং আয়াতের  وَنَهَوْا عَنِ الْمُنكَرِ – এবং মুনকার (নাজায়েয ও হারাম বিষয়) থেকে নিষেধ করে’ -এর দায়িত্ব পালনের অন্তর্ভূক্ত।

আর বলা বাহুল্য, বে-নামাযীর আইনানুগ শরয়ী শাস্তি দান কিংবা বে-নামাযী খলিফা/মুসলীম গ্রুপের বিরুদ্ধে জিহাদ ব্যাক্তিগত কোনো আমল নয়, বরং এগুলো যথাক্রমে খলিফা ও গোটা মুসলীম জামাআতের একটি শরয়ী রাজনৈতিক দায়িত্ব, যা ইসলামী শাসন ব্যবস্থা-এর সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। তার পরেও কি ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের মতো রাষ্ট্র থেকে ইসলামকে আলাদা রাখার বিশ্বাস করে আল্লাহ’র সাথে প্রকাশ্য কুফরীর সাক্ষ্য বহন করবেন ?!

ইসলামী রাষ্ট্রে নামায পড়ার আইন জারি করার ফায়দা:

(১) মুসলমানদের শিশুরা তাদের জীবনের শুরু থেকেই সকল মুসলমানকে মসজিদে গিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়তে দেখতে দেখতে বড় হবে। এটা মুসলীম শিশুদেরকে ছোট থেকেই পূর্ণ নামাজী জীবনের সাথে অভ্যস্ত করে তুলবে এবং এর সাথে সাথে তাদেরকে অনুসঙ্গিক শালীন ও সুষ্ঠু পরিবেশ দেয়া সম্ভব হলে ইনশাআল্লাহ তারাই পরে হবে মর্দে মুমিনদের একটি জেনারেশন। 

(২) পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের সময়ে সরকারী ভাবে দেশের সকল দোকান ও বাজার বন্ধ থাকলে সে সময়ে কেউই কোনো কিছু কেনাকাটার জন্য সেখানে খামোখা যাবে না। ফলে একথা বলারও কোনো অবকাশ থাকবে না যে, মুসলমানরা নামাযের সময়ে দোকান-পাট বন্ধ করে নামাযে ব্যাস্ত থাকায় তখন অমুসলীম’রা সেই সুযোগে কেনাবেচা করে সবসময়ই বেশি লাভবান হবে। কারণ, তখন মুসলমান ও কাফের -সকলের দোকানই বন্ধ থাকবে এবং নামায শেষ হলে মুসলমান ও কাফের -সকলের দোকানই খোলা হবে।     

(৩) পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের সরকারী আইন জারি থাকলে কোনো কাফের বা মুনাফেক তাদের অধিনস্তদেরকে নামাযের জামাআতে যেতে বাঁধা দিতে পারবে না। যেমন: ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে দোকান বা ফেক্টরীর মুসলীম কর্মী কিংবা মুসলীম ড্রাইভার প্রমূখরা তাদের যেসকল কাফের বা মুনাফেক বস্’দের কারণে পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করেত বিভিন্ন বাঁধার সম্মুখীন হয়, ইনশাআল্লাহ সেরকম কোনো সমস্যা ইসলামী রাষ্ট্রে কোনো সমস্যা হবে না (চাই এই আইনের কারণে কাফের মুনাফেকরা মনে মনে যতো কুদ্ধই হোক না কেনো।)

(৪) পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের সরকারী আইন জারি থাকলে ইসলামী রাষ্ট্রের ভিতরে বাস ইত্যাদিতে সফরের সময় কোনো কাফের/মুনাফেক কোনো মুসলমানকে নামাযের জামাআতে যেতে বাঁধা দিতে পারবে না। আপনাদের অনেকেরই অভিজ্ঞতা রয়েছে যে, সফরের সময় ড্রাইভারকে বলে বাস ইত্যাদি থামিয়ে নিকটস্থ কোনো সমজিদে ফরয নামাযটুকু আদায় করতে গেলে প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে থেকে (কোনো অমুসলীমকে নিষেধ করতে না দেখলেও খোদ) মুসলীম নামধারী বে-নামাযী লোকগুলিকে কত গোস্তাখানা কথা বলতে ও গোস্তাখানা আচরণ করতে শুনেছেন এবং দেখেছেন কত ক্রধ প্রকাশ করতে ! তাদের ওই জাতীয় কুফরী কথা বা আচরণ আদপে ইসলামী হুকুমতের অধিনে কতল হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।….ইত্যাদি ইত্যাদি…

কিন্তু এর বিপরীতে-

(ক)ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে যেহেতু রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে ধর্মীয় বিধানকে ১০০% মুক্ত করায় বিশ্বাস (ইমান) রাখা অত্যাবশ্যক (ফরযে) শর্ত, তাই ‘রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নামায কায়েম ও বে-নামাযীকে শরয়ী শাস্তি দান’ -এর ক্ষেত্রেও ইসলামী শরীয়তের বিধানকে রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে ১০০% মুক্ত করায় বিশ্বাস (ইমান) রাখা তাদের মতে অত্যাবশ্যক (ফরযে)।

(খ) ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে যেহেতু  রাষ্ট্রযন্ত্রে কোনো ধর্মীয় বিধিবিধানকে টেনে আনা ১০০% নিষিদ্ধ (হারাম), তাই ‘রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নামায কায়েম ও বে-নামাযীকে শরয়ী শাস্তি দান’ -এর ক্ষেত্রেও ইসলামী শরীয়তের বিধানকে রাষ্ট্রযন্ত্রে টেনে আনাও তাদের মতে ১০০% নিষিদ্ধ (হারাম)।

(গ)ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ যেহেতু বিশ্বাস করে-যে ব্যাক্তিধর্মীয় বিধিবিধানকে রাষ্ট্রব্যাবস্থায় টেনে আনায় বিশ্বাসী সে আদপে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদেই বিশ্বাসী নয় বরং অস্বীকারকারী (কাফের), তাই ‘রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নামায কায়েম ও বে-নামাযীকে শরয়ী শাস্তি দান’ -এর ক্ষেত্রেও ইসলামী শরীয়তের বিধানকে রাষ্ট্রযন্ত্রে টেনে আনায় বিশ্বাসী, তাদের মতে সেও আদপে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে বিশ্বাসীই নয় বরং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে অস্বীকারকারী (কাফের)।

(ঘ) উপরোক্ত এই ৩টি পয়েন্টের এব্যাপারে খাঁটি ধর্মনিরপেক্ষতা বাদীদেররইজমা(ঐক্যমত) রয়েছে।

এর পরিষ্কার অর্থ হল, যতদিন একটি রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ থাকবে, ততদিন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ‘নামায কায়েম’-এর উপরোক্ত কুরআন সুন্নাহ’র বিধানটি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত থাকতে বাধ্য। এটাই একথার দলিল যে, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করার বিশ্বাসটি দ্বীন ইসলামের খিলাফত ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিরোধী একটি কুফরী মতবাদ।

খিলাফত (ইসলামী শাসনব্যবস্থা)-এর সাথে মুসলমানদের ‘যাকাত আদায়’-এর সম্পর্ক :

# খলিফা যাকাতের সরকারী আইন জারি করবেন:-

ইসলামী রাষ্ট্রের ‘খলিফা’র অপরিহার্য শরয়ী দায়িত্ব হল, তিনি গোটা রাষ্ট্রে সরকারী আইন জারি করবেন যে-

(১) সকল বালেগ মুসলমান নারী ও পুরুষ -উভয়কে নেসাবের মালিক হলে বছরান্তে ‘ফরয যাকাত’ আদায় করতে হবে।

(২) কোনো মুসলমান তার ‘ফরয যাকাত’ বাবদ বেড় করা সম্পদকে নিজেই তার উচ্ছে মতো যাকাতের কোনো প্রাপককে দিয়ে দিবে না, বরং তা সরকার কর্তৃক নিয়োগকারী যাকাত উসূলকারী’র কাছে দিয়ে দিবে। 

(৩) ‘ফরয যাকাত’ সরকারের কাছে দিতে অস্বীকার করলে, সরকার জোর করে তার থেকে যাকাত হস্তগত করে নিবে। (সরকারের কাছে ফরয যাকাত দিতে অস্বীকার করার উপর মুনাসেব শাস্তিও নির্ধারণ করা যেতে পারে)   

(৪) কোনো মুসলমান যদি ‘যাকাত’কে জরুরীয়তে দ্বীন (দ্বীন ইসলামের অপরিহার্য অংগ) মানতে অস্বীকার করে, কিংবা যদি সে ‘যাকাত’ দিতে অস্বীকার করে, তাহলে সে মুরতাদ (ইসলাম পরিত্যাগকারী) হওয়ার কারণে তার শাস্তি হবে মৃত্যুদন্ড। 

# ‘খলিফা’ সরকারী ও প্রশাসনিক ভাবে যাকাত উসূল করবেন:-

ইসলামী খিলাফত কায়েম হওয়ার পর ‘ফরয যাকাত’ যে খলিফা কর্তৃক নিযুক্ত যাকাত উসূলকারীগণের কাছে সোপর্দ করা অপরিহার্য সে ব্যাপারে সকল আইম্মায়ে মুজতাহিদীন ও ফুকাহায়ে কেরাম একমত। এ ব্যাপারে কুরআন, সুন্নাহ, সাহাবায়ে কেরাম সহ উম্মাহর পরম্পরা আমলই শক্তিশালী দলিল। যেমন: আল্লাহ তাআলা এরশাদ করছেন-

 خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيهِم بِهَا

(হে নবী! তুমি খলিফা হিসেবে) তাদের ধ্বনসম্পদ থেকে যাকাত গ্রহন করো, (এভাবে) এর দ্বারা (আমা কর্তৃক তাদের কাছে রক্ষিত অভাবীদের হক্বটুকু নিয়ে) তাদেরকে পবিত্র করো এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করো…’। [সূরা তাওবা ১০৩]

সূরা তাওবা ৯ম হিজরীতে নাজিল হওয়া শুরু হয়, যে সময় মদিনায় ইসলামী খিলাফত পূর্ণরূপে স্থান করে নিয়েছিল। সূরা তাওবা’র উপরোক্ত এই আয়াতটিতে রাসুলুল্লাহ -কে শুধু নবী হিসেবে নয়, বরং ইসলামী হুকুমতের একজন খলিফা/আমীরে-আ’জম/ইমাম হিসেবেও এই নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তিনি ধ্বনী মুসলমানদের কাছ থেকে যাকাত উসূল করে নিবেন। এজন্য সকল আইম্মায়ে মুফাসসিরীন, মুজতাহিদীন ও ফুকাহায়ে কেরাম এব্যাপারে একমত যে, উপরোক্ত নির্দেশটি পরবর্তী সকল খলিফার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। খলিফা তার ধ্বনী মুসলমান নাগরীকদের কাছ থেকে ফরয যাকাত উসূল করে নিবেন। মুসলমানদের উপরও ওয়াজিব হল, তারা তাদের যাকাতকে হুকুমতের কাছে সোপর্দ করে দিবে। [তাফসীরে কাবীর, ইমাম রাযী- ১৬/১১৪; তাফসীরে কুরতুবী- ৮/১৭৭; আল-মাজমু’, ইমাম নববী- ৬/১৬৮; ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার- ৩/২৩; শারহুল কাবীর বি-হাশিয়ায়ে দুসুকী- ১/৫০৩; আহকামুল কুরআন, ইমাম জাসসাস- ৩/১৯০; শারহু মাআনিল আছার, ইমাম তাহাবী- ১/২৬৩; ফাতহুল কাদীর, ইবনুল হুমাম- ১/৪৮৭, ২/১১৯; নাইলুল আউতার, শাওকানী- ৪/১২৪; হাশিয়ায়ে ইবনে আবিদীন- ২/৫]

আনাস বিন মালেক রা. থেকে সহিহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন- أتى رجل من بني تميم رسول الله صلى الله عليه وسلم فقال: يا رسول اللّه، إني ذو مال كثير و ذو أهل و ولد و حاضرة فأخبرني كيف أنفق وكيف أصنع؟ فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم: تخرج الزكاة من مالك، فإنها طهرة تطهرك، وتصل أقرباءك، و تعرف حق السائل و الجار و المسكين, فقال: يا رسول اللّه: اقلل لى, قال: {وآت ذا القربى حقه والمسكين وابن السبيل ولا تبذر تبذيرًا}. فقال: حسبي يا رسول الله إذا أديت الزكاة إلى رسولك فقد برئت منها إلى اللّه و رسوله؛ فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم : نعم, إذا أديتها إلى رسولي فقد برئت منها، فلك أجرها، وإثمها على من بدلها . رواه أحمد في المسند: ١٠/٤٤١ رقم ١٢٣٣٤ و قال حمزة احمد الزين: اسناده صحيح , قال المنذري في الترغيب والترهيب: ٢/٣ رجاله رجال الصحيح , و قال الهيثمي: ٣/٦٣ رجاله رجال الصحيحين , قال الأرناؤوط : رجاله ثقات رجال الشيخين ; و البيهقي في السنن الكبري: ٤/١٦٣ رقم ٧٢٨٣ – ‘(একবার) বনী তামিম গোত্রের এক ব্যাক্তি এসে রাসুলুল্লাহ ﷺ কে জিজ্ঞেস করলো: ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি একজন ধ্বনকুবেড়, আমার পরিবার ও বালবাচ্চা রয়েছে, আমি রাজধাণীতে থাকি। এখন আমাকে বলুন, আমি কিভাবে (ধ্বনসম্পদ আল্লাহ’র রাস্তায়) ব্যয় করবো এবং কিভাবে কি করবো? তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন: ‘তুমি তোমার ধ্বনসম্পদ থেকে (হিসেব করে) যাকাত বেড় করবে। বস্তুতঃ এটা (তোমার ধ্বনসম্পদের) একটি পবিত্রতা, যা তোমাকে (তোমার ধ্বনসম্পদের মধ্যে মিশ্রিত হয়ে থাকা যাকাতের হক্বদারদের পাওয়া ময়লা হতে) পবিত্র করে নিবে। (যাকাত ছাড়াও) তুমি তোমার (ধ্বনসম্পদ দিয়ে তোমার) নিকটাত্বীয়, সওয়ালকারী, প্রতিবেশি ও মিসকীনের হক্ব’কে চিনে নিবে’। সে বললো: ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমাকে একটু সংক্ষেপে বলুন’। রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন: (যেমন আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন:) وَآتِ ذَا الْقُرْبَىٰ حَقَّهُ وَالْمِسْكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَلَا تُبَذِّرْ تَبْذِيرًا – (আর নিকতাত্বীয়, মিসকীন ও ইবনুস সাবিলকে তার হক্ব দিয়ে দাও এবং কোনো অবস্থাতেই অপব্যয় করবে না)। সে বললো: ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমি বুঝতে পরেছি। আমি যদি আপনার প্রেরিত ব্যাক্তির কাছে (আমার যাকাত) দিয়ে দিই, তাতে করে কি আমি (যাকাত দানের প্রশ্নে) আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের কাছ থেকে দায়মুক্ত হয়ে যাবো? রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন: হ্যাঁ, তুমি যখন আমার প্রেরিত ব্যাক্তির কাছে (তোমার যাকাত) দিয়ে দিবে, তখন তুমি (তোমার যাকাতের দায়িত্ব থেকে) দায়মুক্ত হয়ে গেলে। এতে তোমার জন্য রয়েছে সওয়াব। আর গোনাহ বর্তাবে তার উপরে যে তা বদলিয়ে ফেলবে’। [মুসনাদে আহমদ– ৩/১৩৬; সুনানুল কুবরা, বাইহাকী- ৪/১৬৩ হাদিস ৭২৮৩; মুআত্তা, হাদিস ১৯৯; আল-মুদাউয়ানাতুল কুবরা১/৩০৫]

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে সহিহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন- أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَعَثَ مُعَاذًا رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ إِلَى الْيَمَنِ فَقَالَ ادْعُهُمْ إِلَى شَهَادَةِ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَنِّي رَسُولُ اللَّهِ فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوا لِذَلِكَ فَأَعْلِمْهُمْ أَنَّ اللَّهَ قَدْ افْتَرَضَ عَلَيْهِمْ خَمْسَ صَلَوَاتٍ فِي كُلِّ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوا لِذَلِكَ فَأَعْلِمْهُمْ أَنَّ اللَّهَ افْتَرَضَ عَلَيْهِمْ صَدَقَةً فِي أَمْوَالِهِمْ تُؤْخَذُ مِنْ أَغْنِيَائِهِمْ وَتُرَدُّ عَلَى فُقَرَائِهِمْ . رواه البخاري، كتاب الزكاة , باب وجوب الزكاة برقم ١٣٩٥، و مسلم، كتاب الإيمان , باب الدعاء إلى الشهادتين وشرائع الإسلام برقم ١٩; و ابو داود: ١٥٧٤ – ‘নবী ﷺ (যখন) মুয়ায বিন যাবাল রা.-কে ইয়ামেনে (তাঁর অধিনস্ত প্রশাসক বানিয়ে) পাঠালেন, তখন (যাবার আগে তাকে) বললেন: ‘(সেখানে গিয়ে) তাদেরকে এই সাক্ষ্য দানের আহবান জানাবে যে- ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং আমি আল্লাহ’র রাসুল’। এব্যাপারে যদি তাদের সারা পাও, তাহলে তাদেরকে জানাবে যে, আল্লাহ তাদের উপরে প্রতি দিন ও রাতে (মিলে মোট) পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছেন। এব্যাপারেও যদি তাদের সারা পাও, তাহলে তাদেরকে জানাবে যে, আল্লাহ তাদের উপরে তাদের ধ্বনসম্পদের মধ্যে (নেসাবের মালিক হওয়া অবস্থায় বছরান্তে) যাকাত ফরয করেছেন। (হে মুয়ায, এমতাবস্থায়) তুমি তাদের ধ্বনী (মুসলমান)দের কাছ থেকে (যাকাত) উসূল করে নিবে এবং তা তাদের অভাবী (মুসলমানদের)দের উপরে (বিধি মোতাবেক) ব্যয় করবে’ [সহিহ বুখারী, হাদিস ১৩৯৫; সহিহ মুসলীম, হাদিস ১৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ১৫৭৪; সুনানুল কুবরা, বাইহাকী- ৪/১০১; সুনানে তিরমিযী, হাদিস ১/১২২; মুসনাদে আহমদ- ১/২৩৩; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস ১৭৮৩; সুনানে নাসায়ী, হাদিস ১/৩৩০]

বাহয বিন হাকিম রহ. তার পিতা ও দাদা থেকে নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত করেছেন, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেন- في كل إبل سائمة من كل أربعين ابنة لبون لا تفرق إبل عن حسابها من أعطاها مؤتجرًا له أجرها ومن منعها فإنا آخذها وشطر إبله … . رواه النسائي, كتاب الزكاة, باب: عقوبة مانع الزكاة : رقم ٢٢٤٤ و حسنه الشيخ الألباني في صحيح سنن النسائي ; و عبد الرزاق في المصنف: ٤/١٨ رقم ٦٨٢٤ ; و أبو داود , كتاب الزكاة, باب زكاة السائمة: رقم ١٥٧٥, و حسنه الشيخ الألباني في صحيح أبي داود ; و أحمد في المسند: رقم ٢٠٠١٦ , و حسنه الشيخ شعيب الأرنؤوط في تخريجه لمسند أحمد ج ٣٣ ص ٢٢٠ ; و الحاكم في المستدرك: ١/٣٧٧ وتعقبه بقوله: هذا حديث صحيح الإسناد على ما قدمنا ذكره في تصحيح هذه الصحيفة ولم يخرجاه. وأورده الذهبي في التلخيص ولم يعقب عليه بشيء   – ‘চারণভুমিতে বিচরণশীল উটের ক্ষেত্রে প্রতি চল্লিশটির মধ্যে থেকে একটি বিনতু-লাবুন (৩য় বছরে পা দেয়া উটনীর যাকাত ইসলামী সরকারী কোষাগারে প্রাপ্য) এবং (এটা করতে গিয়ে) কোনো উটকে এর হিসাব থেকে পৃথক করা যাবে না। যে (মুসলমান) সওয়াবের নিয়তে তা প্রদান করবে, তার জন্য রয়েছে সওয়াব। আর যে (মুসলমান) তা (ইসলামী সরকারী কোষাগারে দিতে) মানা’/অস্বীকার করবে, সেক্ষেত্রে আমরা অবশ্যই তা (তার কাছ থেকে জোর করে) নিবো, এবং (এর সাথে সাথে) আমরা তার অর্ধেক সংখ্যক উট নিয়ে নিবো।…’। [সুনানে নাসায়ী, হাদিস ২২৪৪; মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক- ৪/১৮ হাদিস ৬৮২৪; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ১৫৭৫; মুসনাদে আহমদ- ৩৩/২২০ হাদিস ২০০১৬; মুসতাদরাকে হাকিম- ১/৩৭৭; সহিহ উবনে খুযাইমা- ৪/১৮ হাদিস ২২৬৬]

আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে সহিহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন- ادفعوا صدقاتكم إلى من ولاه الله أمركم فمن بر فلنفسه ومن أثم فعليها . رواه الإمام ابو عبيد في الأموال: رقم ١٧٩٥ , إسناد صحيح على شرط الشيخين; و البيهقي في السنن الكبري: ٤/١١٥ و قال النووي في المجموع شرح المهذب, كتاب البيوع: ٦/١٦٣ بإسناد صحيح أو حسن, و صححه الالبانى اسناده في إرواء الغليل: ٣/٣٨٠ – ‘আল্লাহ যাকে তোমাদের বিষয়াবলির শাসক বানিয়েছেন, তোমরা তোমাদের যাকাতকে তার কাছেই দিয়ে দাও। পরে যে (তা দিয়ে) ভাল কাজ করবে সে তা তার নিজের নফসের (উপকারের) জন্যই করবে। আর যে গোনাহ করবে, সেটা তার উপরই বর্তাবে’।[আল-আমওয়াল, ইমাম আবু উবাইদ, হাদিস ১৭৯৫; সুনানুল কুবরা, বাইহাকী- ৪/১১৫]

সাহল বিন আবি সালেহ রহ. তাঁর পিতার সূত্রে বর্ণনা করেছেন-  اجتمع عندي نفقة فيها صدقة – يعني بلغت نصاب الزكاة – فسألت سعد بن أبي وقاص وابن عمر وأبا هريرة وأبا سعيد الخدري أن أقسمها أو أدفعها إلى السلطان فأمروني جميعا أن أدفعها إلى السلطان ما اختلف علي منهم أحد ، وفي رواية فقلت لهم : ” هذا السلطان يفعل ما ترون فأدفع إليهم زكاتي ؟ فقالوا كلهم : نعم فادفعها . رواهما الإمام سعيد بن منصور في مسنده . رواهما رواه الإمام سعيد بن منصور في مسنده كما في المجموع شرح المهذب, كتاب البيوع: ٦/١٦٣ ; و الإمام ابو عبيد في الأموال: رقم ١٧٨٩ و صححه الالبانى اسناده في تخريج أحاديث مشكلة الفقر وكيف عالجها الإسلام: ص ٤٣ , ٧٢ ; و ابن أبي شيبة في المسنف: ٣/١٥٦ ; و البيهقي في السنن الكبري: ٤/١١٥ – ‘(একবার) আমার কাছে ব্যয়যোগ্য সম্পদ জমা হয়ে গেল, যার মধ্যে যাকাতও ছিল -অর্থাৎ আমার যাকাতের নেসাব পরিমান সম্পদ হয়ে গেল- তখন আমি সা’দ বিন আবি ওয়াককাস রা., ইবনে ওমর রা., আবু হুরায়রাহ রা. এবং আবু সাঈদ খুদরী রা.কে জিজ্ঞেস করলাম যে, আমি কি তা (নিজেই) বন্টন করে দিবো, নাকি সেটা শাসকের কাছে দিয়ে দিবো। তাঁদের সকলেই আমাকে তা শাসকের কাছে দিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিলেন। তাঁদের একজনও এব্যাপারে ভিন্ন মত দেননি’। আরেক রেওয়ায়েতে এও আছে, ‘আমি তাঁদেরকে বললাম: এই সরকার কি করে তা-তো আপনারা দেখছেন, তার পরেও কি আমি আমার যাকাত তাদের কাছে দিয়ে দেবো? তাঁদের সকলেই বলেছেন: হ্যাঁ, তবুও তা (সরকারের কাছে) দিয়ে দেবে’। [মুসনাদে সাঈদ বিন মানসুর: আল-মাজমু’, ইমাম নববী- ৬/১৬৩;  আল-আমওয়াল, ইমাম আবু উবাইদ, হাদিস ১৭৮৯; আল-মুসান্নাফ, ইমাম ইবনু আবি শায়বা- ৩/১৫৬; সুনানুল কুবরা, বাইহাকী- ৪/১১৫]

নির্ভরযোগ্য হাদিস ও সিরাতের কিতাবসমূহে বহু রেওয়ায়েত দ্বারা প্রমাণিত যে,  রাসুলুল্লাহ ﷺ তাঁর বহু সাহাবীকে বিভিন্ন স্থানে যাকাত উসূলের জন্য নিয়োগ দিয়েছিলেন। আবার বিভিন্ন স্থানে প্রেরিত প্রশাসককেও এই দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল এবং তাঁরা কর্মী নিয়োগ করে যাকাত উসূল করতেন। সহিহ মুসলীমের রেওয়াতে আছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ ওমর ফারূক রা.-কে যাকাত উসূল করার জন্য পাঠিয়েছিলেন। মুসনাদে আহমদের রেওয়াতে আছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ আবু জাহম বিন হুযাইফা রা., উকবা বিন আমের রা., যাহহাক বিন কায়েস রা.-কে যাকাত উসূল করার জন্য পাঠিয়েছিলেন। মুসতাদরাকে হাকিমের রেওয়াতে আছে, তিনি উবাদাহ বিন সামেত রা., কায়েস বিন সায়াদ রা., এবং ওদীল বিন উকবা রা.-কে যাকাত উসূল করার জন্য পাঠিয়েছিলেন। সুনানে আবু দাউদের রেওয়াতে আছে, তিনি আবু জহম বিন হুযাইফা রা. এবং আবু মাসউদ রা.-কে যাকাত উসূল করার জন্য পাঠিয়েছিলেন। ত্বাবাকাতে ইবনে সা’দের রেওয়াতে আছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ উয়াইনা ইবনে হুসাইন রা.কে বনু তামীম গোত্রের কাছে, বুয়াইদা ইবনুল হাবিব রা.কে আসলাম গোত্রের কাছে, উবাদাহ বিন রাশার রা.-কে মুলাইম ও মুজাইনা গোত্রের কাছে, রাফে বিন মাকিস রা.কে জুহাইনা গোত্রের কাছে, আমর ইবনুল আস রা.-কে ফাজারাহ গোত্রের কাছে, দাহহাক রা.কে বনু কিলাবা গোত্রের কাছে, বুসর রা.কে বনু কা’ব গোত্রের কাছে এবং হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান রা.-কে আজদ গোত্রের কাছে যাকাত উসূল করার জন্য পাঠিয়েছিলেন। আল-ইসাবা’য় রয়েছে, কাহাল বিন মালেক রা.-কে হুযাইল গোত্রের যাকাত উসূল করার জন্য পাঠিয়েছিলেন। তাবারীর রেওয়ায়েতে আছে, তিনি ইকরামা রা.-কে হাওয়াযিন গোত্রের কাছে যাকাত উসূল করার জন্য পাঠিয়েছিলেন। এমনিভাবে খুযাইমা রা., খালেদ বিন সাঈদ রা., সাহম বিন মিনযাব রা., মালিক বিন নুয়াইরাতা রা., মুরদাম বিন মালেক রা. প্রমূখ সাহাবীর ব্যাপারে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ ﷺ তাঁদেরকে একাজে নিযুক্ত করেছিলেন। যাকাতের হিসাব লেখার জন্য রাসুলুল্লাহ ﷺ কর্তৃক যুবাইর ইবনে আউয়াম রা., হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান রা.-কে নিয়োগ দানের কথাও বর্ণিত হয়েছে। [আত-ত্বাবাকাত, ইমাম ইবনে সা’দ- ২/১৬; যাদুল মাআদ, ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম- ২/৪৭২; আর-রওজাহ- ২/২১; আত-তালখিস, ইবনে হাজার- ২/১৫৯; আত-তারাতিব- ৩৯৬-৩৯৮ পৃ:; ফিকহুয যাকাত, কারযাভী- ২/৮৫০]

খুলাফায়ে রাশেদীন রা. সম্পর্কে বিভিন্ন রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে, তাঁরা তাঁদের নিজ নিজ খিলাফত কালে রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে যাকাত উসূলকারী কর্মী পাঠাতেন, বিভিন্ন অঞ্চলের প্রশাসকদেরকে যাকাত উসূল করার দায়িত্ব দিতেন, আবার কোনো কেনো ক্ষেত্রে তাঁরা নিজেরাই মুসলমানদের কাছ থেকে যাকাত উসূল করে নিতেন মর্মে বর্ণিত হয়েছে। 

 কাসেম রহ. থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন- وَكَانَ أَبُو بَكْرٍ إِذَا أَعْطَى النَّاسَ أُعْطِياتِهِمْ يَسْأَلُ الرَّجُلَ هَلْ عِنْدَكَ مِنْ مَالٍ قَدْ وَجَبَتْ فِيهِ الزَّكَاةُ ؟ فَإِنْ قَالَ : نَعَمْ ، أَخَذَ مِنْ عَطَائِهِ زَكَاةَ ذَلِكَ الْمَالِ ، وَإِنْ قَالَ لا ، سَلَّمَ إِلَيْهِ عَطَاءَهُ  . رواه الامام محمد بن الحسن الشيباني في موطأ مالك, كِتَابُ الزَّكَاةِ : رقم ٢٩٧; و الامام يحي في موطأ مالك: ٢/٢٣١ رقم ٦٣٣ ; البيهقي في السنن الكبري: ٤/١٠٣; و عبد الرزاق في المسنف : ٤/٧٥ رقم ٧٠٢٤ ; بن أبي شيبة في المسنف: ٣/١٨٤ ; و أبو عبيد في الأموال: ٣/٩١٣ – ‘ আবু বকর রা. (তাঁর খিলাফতের জামানায়) লোকজনকে যখন (কোষাগার থেকে) তাদের (সরকারী) অনুদানসমূহ দিয়ে দিতেন, তখন (সংশ্লিষ্ট) ব্যাক্তিকে জিজ্ঞেস করতেন: ‘তোমার কাছে কি এমন ধ্বনসম্পদ রয়েছে, যার মধ্যে যাকাত অপরিহার্য হয়ে গেছে’? এতে সে যদি বলতো” ‘জি হ্যাঁ’, তখন তিনি তার ওই (প্রাপ্ত সরকারী) অনুদানের মাল থেকে যাকাত উসূল করে নিতেন। আর সে যদি বলতো: ‘জি না’, তখন তিনি তাকে তার অনুদান ঠিকঠাক দিয়ে দিতেন’। [মুআত্তা মালেক, ইমাম মুহাম্মাদ- ২৯৭; মুআত্তা মালেক, ইমাম ইয়াহইয়া- ২/২৩১ হাদিস ৬৩৩;  আল-মুদাউয়ানাতুল কুবরা, ইমাম ইবনুল কাসেম- ১/৩২৫; আল-মুসান্নাফ, ইমাম আব্দুর রাজ্জাক- ৪/৭৫ হাদিস ৭০২৪; আল-মুসান্নাফ, ইবনু আবি শায়বাহ- ৩/১৮৪; আল-আমওয়াল, ইমাম আবু উবাইদ- ৩/৯১৩; সুনানুল কুবরা, বাইহাকী- ৪/১০৩]

হুমায়েদ বিন আব্দির রহমান রহ. বর্ণনা করেছেন আব্দুর রহমান বিন আব্দেল ক্বারী রহ. থেকে যে- وَ كَانَ عَلَى بَيْتِ الْمَالِ فِي زَمَنِ عُمَرَ مَعَ عُبَيْدِ اللَّهِ بْنِ الْأَرْقَمِ فَإِذَا خَرَجَ الْعَطَاءُ جَمَعَ عُمَرُ أَمْوَالَ التِّجَارَةِ فَحَسَبَ عَاجِلَهَا وَآجِلَهَا ، ثُمَّ يَأْخُذُ الزَّكَاةَ مِنَ الشَّاهِدِ وَالْغَائِبِ . أخرجه ابن أبي شيبة في المسنف , كتاب الزكاة , ما قالوا في العطاء إذا أخذ: ٦/٥٢٧ رقم ١٠٥٦٧ ; و أبو عبيد في الأموال، ص ٥٢٠-٥٢٦، برقم ١١٧٨ و ١٢١١،: اسناده حسن كما في إعلاء السنن: ١٢/٥٩٦، و صححه ابن حزم في المحلى: ٥/٢٣٤    – ‘তিনি (মুসলীম জাহানের দ্বিতীয় খলিফা) ওমর রা.-এর (খিলাফতের) জামানায় উবাইদুল্লাহ বিন আরক্বামের সাথে বায়তুল মালের দায়িত্বে ছিলেন। (তিনি বলেন: মানুষজনকে প্রদানের জন্য) যখন (বাৎসরীক সরকারী) অনুদান/ভাতা বেড় করা হত, তখন ওমর রা. সকল ব্যবসায়ীক মালসামগ্রী গুলোকে একত্রিত করতেন, তারপর তার নগদ ও বাকীর হিসাব করতেন। এরপর (তা থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিদের) উপস্থিত ও অনুপস্থিত -(উভয় প্রকার ধ্বনমাল) থেকে যাকাত উসূল করে নিতেন’। [আল-মুসান্নাফ, ইবনু আবি শায়বাহ– ৬/৫৬৭ হাদিস ১০৫৬৭; আল-আমওয়াল, ইমাম আবু উবাইদ- ১/৫২০-৫২৬ হাদিস ১১৭৮, ১২১১; আল-মুহাল্লা, ইবনে হাযাম- ৫/২৩৪]

 আয়েশা বিনতে কুদামাহ রহ. তাঁর পিতার সূত্রে বর্ণনা করেন- كُنْتُ إِذَا جِئْتُ عُثْمَانَ بْنَ عَفَّانَ أَقْبِضُ عَطَائِي سَأَلَنِي هَلْ عِنْدَكَ مِنْ مَالٍ وَجَبَتْ عَلَيْكَ فِيهِ الزَّكَاةُ قَالَ فَإِنْ قُلْتُ نَعَمْ أَخَذَ مِنْ عَطَائِي زَكَاةَ ذَلِكَ الْمَالِ وَإِنْ قُلْتُ لَا دَفَعَ إِلَيَّ عَطَائِي . موطأ مالك, كتاب الزكاة, باب الزكاة في العين من الذهب والورق: ١/٢٤٢ اسناده صحيح ; ابن قاسم في المدونة الكبرى: ١/٣٢٥ ; الامام محمد بن الحسن الشيباني في موطأ مالك, كِتَابُ الزَّكَاةِ : رقم ٣٢٨ ; و البيهقي في السنن الكبري: ٤/١٨٤ رقم ٧٣٥٥; و عبد الرزاق في المسنف : ٤/٧٧ رقم ٧٠٢٩ ; و أبو عبيد في الأموال: ٤/٩١٥ رقم ١٦١٩; و الإمام الشافعي في كتاب الأم: ٢/١٤ – ‘ ওসমান রা.-এর (খিলাফতের জামানায়) আমি যখন (তাঁর কাছে) আমার (জন্য সরকারী কোষাগারের বরাদ্দ) অনুদান/ভাতা নিতে যেতাম, তখন তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করতেন: ‘তোমার কাছে কি এমন ধ্বনসম্পদ রয়েছে, যার মধ্যে যাকাত অপরিহার্য হয়ে গেছে’? তিনি বলেন: ‘ আমি যদি বলতাম- ‘জি হ্যাঁ’, তখন তিনি আমার ওই (প্রাপ্ত সরকারী) অনুদান/ভাতা (বাবদ) মাল থেকে যাকাত উসূল করে নিতেন। আর আমি যদি বলতাম: ‘জি না’, তখন তিনি আমাকে আমার অনুদান/ভাতা (পুরোই) দিয়ে দিতেন’। [মুআত্তা ইমাম মালেক- ১/২৪২; আল-মুদাউয়ানাতুল কুবরা, ইমাম ইবনুল কাসেম- ১/৩২৫; মুআত্তা, ইমাম মুহাম্মাদ, হাদিস ৩২৮; আল-মুসান্নাফ, ইমাম আব্দুর রাজ্জাক- ৪/৮৮ হাদিস ৭০২৯; আল-আমওয়াল, ইমাম আবু উবাইদ- ৪/৯১৫ হাদিস ১৬১৯; আল-উম্ম, ইমাম শাফেয়ী- ২/১৪; সুনানুল কুবরা, বাইহাকী- ৪/১৮৪ হাদিস ৭৩৫৫]

উপরের বর্ণিত কুরআন, হাদিস এবং খুলাফায়ে রাশেদীনের পরম্পরা আমল একথার দলিল যে, ইসলামী রাষ্ট্রের মুসলীম নাগরীকদের থেকে ফরয যাকাত উসূল করে নেয়া ইসলামী সরকারের শরয়ী হক্ব। অন্য কথায়, এই হক্ব আদায় করে দেয়া সংশ্লিষ্ট মুসলমানদের উপর ওয়াজিব। [বিস্তারিত: আহকামুল কুরআন, ইমাম জাসসাস- ৩/১৯০; শারহু মাআনিল আছার, ইমাম তাহাবী- ১/২৬৩; আল-মাজমু’, ইমাম নববী- ৬/১৬৮; ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার- ৩/২৩; শারহুল কাবীর বি-হাশিয়ায়ে দুসুকী- ১/৫০৩; ফাতহুল কাদীর, ইবনুল হুমাম- ১/৪৮৭, ২/১১৯; নাইলুল আউতার, শাওকানী- ৪/১২৪; হাশিয়ায়ে ইবনে আবিদীন- ২/৫]

# ইসলামী সরকারের কাছে যাকাত সোপর্দ করে দিতে না চাইলে খলিফা কর্তৃত জোর করে যাকাত উসূল করা ও শান্তি দান :-

আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করে এসেছি যে, কুরআন ও সুন্নাহ’র আলোকে একথা প্রমাণিত যে, খলিফা’র যে কোনো জায়েয নির্দেশ মানা মুসলমানদের উপর ওয়াজিব -চাই পছন্দ হোক চাই না হোক। সেখানে, খোদ শরীয়তই যখন মুসলমানদের যাকাত উসূল করাকে ইসলামী সরকারের শরয়ী হক্ব সাব্যস্থ করেছে, সে ক্ষেত্রে-তো বলাই বাহুল্য যে, খলিফা মুসলমানদেরকে সরকারের কাছে যাকাত যাকাত দিয়ে দেয়ার নির্দেশ জারি করলে সে নির্দেশ মান্য করে চলা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পরিষ্কার হুকুমের আলোকে আরো শক্ত ওয়াজিব দায়িত্ব হয়ে যায়।

যেমন, আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন- يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَ أُولِي الْأَمْرِمِنكُمْ – ‘হে মুমিনগণ! তোমরা অনুগত্য করো আল্লাহ’র এবং অনুগত্য করো রাসুলের, এবং (অনুগত্য করো) তোমাদের (মুসলমানদের) মধ্যকার উলুল-আমর’-এর[সূরা নিসা ৫৯] এর আগে আমরা এই আয়াতের ‘উলুল-আমর’ -এর মধ্যে কারা গণ্য -তার ব্যাখ্যা দিয়ে এসেছি। ‘উলুল-আমর’ -এর মধ্যে আমীর/খলিফা অন্তর্ভূক্ত থাকার ব্যাপারে সকলেই একমত। সুতরাং, খলিফা কর্তৃক কুরআন-সুন্নাহ’র আওতাধীন সকল জায়েয নির্দেশগুলোকে মান্য করে চলতে খোদ আল্লাহ’ই নির্দেশ দিয়েছেন।
 
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে সহিহ সনদে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেন- السمع والطاعة على المرء المسلم فيما أحب وكره، ما لم يؤمر بمعصية،  . رواه البخاري في الصحيح, كتاب الأحكام، باب السمع والطاعة للإمام ما لم تكن معصية: ٨/١٣٤ رقم ٧١٤٤  ، و مسلم في الصحيح, كتاب الإمارة، باب وجوب طاعة الأمراء في غير معصية، وتحريمها في المعصية: ٣/١٤٦٩ رقم ١٨٣٩ –‘(খলিফা/আমীরের) মধ্যে কিছু পছন্দ হোক বা অপছন্দ হোক – প্রত্যেক মুসলমানের জন্য (তার নির্দেশ) শোনা ও (তার) অনুগত্য করা (ওয়াজিব) -যদি না সে (আল্লাহ’র কোনো) নাফরমানী করার নির্দেশ দেয়’। [সহিহ বুখারী- ৮/১৩৪ হাদিস ৭১৪৪; সহিহ মুসলীম- ৩/১৪৬৯ হাদিস ১৮৩৯]
 
আবু হুরায়রাহ রা. থেকে সহিহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেছেন- مَنْ أَطَاعَنِي فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ، وَمَنْ يَعْصِنِي فَقَدْ عَصَى اللهَ، وَمَنْ يُطِعِ الْأَمِيرَ فَقَدْ أَطَاعَنِي، وَمَنْ يَعْصِ الْأَمِيرَ فَقَدْ عَصَانِي . صحيح مسلم, كتاب الإمارة , باب وجوب طاعة الأمراء في غير معصية وتحريمها في المعصية: رقم ١٨٣٥; سنن النسائي, كتاب البيعة, الترغيب في طاعة الإمام: رقم ٤١٩٣ و كتاب الاستعاذة, الاستعاذة من فتنة المحيا: رقم٥٥١٠; سنن ابن ماجه, كتاب الجهاد, باب طاعة الإمام: رقم ٢٨٥٩; مسند أحمد: ٢/٢٥٣ رقم ٧٣٨٦ , ٢/٢٧٠ رقم ٧٦٠٠; مسند أبي عوانة, كتاب الأمراء: ٤/٤٠١ رقم ٧٠٩٠-٧٠٩٦; شعب الأيمان للبيهقى: ٩/٤٠٩ رقم ٦٩٦٤  – ‘যে আমার অনুগত্য করলো, সে মূলত: (আমাকে মানা সম্পর্কিত আল্লাহ তাআলার নির্দেশ পালনের মাধ্যমে প্রকারন্তে) আল্লাহ’র অনুগত্য করলো। আর যে আমার অবাধ্য হল, সে মূলত: (আমাকে মানা সম্পর্কিত আল্লাহ তাআলার নির্দেশের অবাধ্য হওয়ার মাধ্যমে প্রকারন্তে) আল্লাহ’র অবাধ্য হল। আর যে আমীর -এর অনুগত্য করলো, সে মূলত: (আমীর’কে মানা সম্পর্কিত আমার নির্দেশ পালনের মাধ্যমে প্রকারন্তে) আমার অনুগত্য করলো। আর যে আমীরের অবাধ্য হল, সে মূলত: (আমীর’কে মানা সম্পর্কিত আমার নির্দেশের অবাধ্য হওয়ার মাধ্যমে প্রকারন্তে) আমার অবাধ্য হল’। [সহিহ মুসলীম, হাদিস ১৮৩৫; সুনানে নাসায়ী, হাদিস ৪১৯৩, ৫৫১০; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস ২৮৫৯; মুসনাদে আহমদ- ২/২৫৩ হাদিস ৭৩৮৬, ২/২৮০ হাদিস ৭৬০০; মুসনাদে আবু আউয়ানাহ- ৪/৪০১ হাদিস ৭০৯০-৭০৯৬; শুআবুল ইমান, বাইহাকী- ৯/৪০৯, হাদিস ৬৯৬৪]

উপরের এজাতীয় বহু হাদিস প্রমাণ করে যে, খলিফার জায়েয নির্দেশগুলো মান্য করে চলা মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব এবং শরয়ী কোনো ওযর ছাড়া সরকারী আদেশ অমান্য পরে সমাজে বিশৃঙ্খলার দ্বার উন্মুক্ত করা বা ফিতনা সৃষ্টি করা নাজায়েয।

আপনারা উপরে বর্ণিত বাহয বিন হাকিম রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হাদিসটিতে দেখেছেন যে, খলিফার কাছে যে যাকাত সোপর্দ করবে না, তার সম্পর্কে বলা হয়েছে যে – ومن منعها فإنا آخذها  – ‘আর যে (মুসলমান) তা (ইসলামী সরকারী কোষাগারে দিতে) মানা’/অস্বীকার করবে, সেক্ষেত্রে আমরা অবশ্যই তা (তার কাছ থেকে জোর করে) নিয়ে নিবো….’। [সুনানে নাসায়ী, হাদিস ২২৪৪; মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক- ৪/১৮ হাদিস ৬৮২৪; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ১৫৭৫; মুসনাদে আহমদ- ৩৩/২২০ হাদিস ২০০১৬; মুসতাদরাকে হাকিম- ১/৩৭৭; সহিহ উবনে খুযাইমা- ৪/১৮ হাদিস ২২৬৬]

এমনিভাবে উপরে আবু হুরায়রাহ রা. থেকে সহিহ সূত্রে বর্ণনা রেওয়ায়েত করা হয়েছে যে, আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর তাঁর খিলাফতের জামানায় যাকাত দিতে অস্বীকারকারীদের সম্পর্কে বলেছিলেন-  وَاللَّهِ لَوْ مَنَعُونِي عَنَاقًا كَانُوا يُؤَدُّونَهَا إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَقَاتَلْتُهُمْ عَلَى مَنْعِهَا  – ‘আল্লাহ’র কসম, তারা রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে (ফরয যাকাত বাবদ পশুর) যে গলার রশি দিতো, সেটাও যদি আমাকে তারা দিতে অস্বীকার করে, তাহলেও আমি তাদের অস্বীকৃতির কারণে অবশ্যই তাদের সাথে কিতাল (স্বসস্ত্র জিহাদ) করবো’। [সহিহ বুখারী, হাদিস ১৪০০; সহিহ মুসলীম, হাদিস ২০; সুনানে তিরমিযী, হাদিস ২৫৩২; সুনানে নাসায়ী, হাদিস ২৪০০; মুসনাদে আহমদ, হাদিস ৬৪; সুনানুল কুবরা, বাইহাকী- ৮/৩০৬ হাদিস ১৬৭৩০] এই হাদিসে খলিফা আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর কথার একটি অর্থ এও যে, যেমনিভাবে রাসুলুল্লাহ সা.-এর জামানায় যাকাতকে  খলিফা বা তাঁর নায়েব (প্রতিনিধি)দের কাছে সোপর্দ করে দেয়ার নির্দেশ ছিল ও সে অনুযায়ী উম্মাহ’র আমল চলে আসছিল, আজ যদি আমি খলিফা আবু বকরের কাছে তারা তাদের যাকাত বাবদ পশুর গলার রশিটি দিতেও অস্বীকার করে, তাহলে তাদের সাথে যুদ্ধ করে হলেও যাকাত উসূল করে নিবো।

সুতরাং, খলিফার সরকারী নির্দেশ থাকাবস্থায় কেউ সরকারের কাছে যাকাত সোপর্দ না করে নিজে নিজে আদায় করতে চায় কিংবা আদায় না করে মিথ্যা বলে ও তা শরয়ীভাবে প্রমাণিত হয়, তাহলেও সরকার তা আইন প্রয়োগ করে জোর করে তার যাকাত বাবদ সম্পদ উসূল করে নিতে পারবে। [ফাতহুল কাদীর, ইবনুল হুমাম- ১/৪৮৭; বাদায়েউস সানায়ে, কাসানী- ২/৭; বাহরুয যুখার- ২/১৯০; শারহুল কাবীর বি-হাশিয়ায়ে দুসূকী- ১/৫০৩; দুররুল মুখতার-২/২৬; আল-মুগনী, ইবনে কুদামাহ- ২/৬৪৪; মাত্বালেব-২/১২; শারহুল আজহার- ১/৫৩]

কুরআন সুন্নাহ’য় নির্দিষ্ট করে যাকাত দানে অস্বীকারকারীর জন্য বিশেষ ভাবে কোনো ‘হদ্দ’ নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। সুতরাং-

(১) অপরাপর বিধানের মতোই যদি কোনো মুসলমান খোদ ‘যাকাত’-এর ফরয হওয়ার বিষয়টিকেই ইনকার/অস্বীকার করে, কিংবা যাকাতকে ‘জরুরীয়তে দ্বীন’ (দ্বীন ইসলামের অপরিহার্য অংশ) মানতে অস্বীকার করে, অথবা যাকাত বিধানকে আল্লাহ’র হুকুম জেনেও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য বা অবমাননা করে, তাহলে সে মুরতাদ (ইসলাম ত্যাগকারী কাফের) হিসেবে গণ্য হবে। আর মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদন্ড।

(২) যদি মুসলমানদের কোনো গোষ্ঠি যাকাত’কে অস্বীকার করে মুরতাদ হয়ে যায় এবং তওবা না করে, তাহলে তাদেরকে মুরতাদ হিসেবে কতল করা সম্ভব না হলে, তাদের সাথে কিতাল (স্বসস্ত্র জিহাদ) করে হলেও তাদেরকে ধরাপৃষ্ঠ থেকে উচ্ছেদ করতে হবে, যেমনটা আবু বকর সিদ্দীক রা. তাঁর খিলাফতের জামানায় যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেছিলেন। এতে করে দ্বীনের মধ্যে রদবদলকারীদের শিকড় উপড়ে যাবে এবং দ্বীন ইসলাম পূর্ববৎস্ব-অবস্থা  হিফাজত থাকবে।  

(৩) আর যদি কোনো মুসলমান উপরের পয়েন্টর মতো মুরতাদ হয়ে না যায়, বরং যাকাতকে সার্বিকভাবে স্বীকার করা সত্ত্বেও শুধুমাত্র ইমানী দূর্বলতা বসতঃ (ক) যাকাত না দিয়ে মিথ্যা কথা বলে যে তার উপর যাকাত ফরয হয়নি, অথচ পরে শরয়ী ভাবে প্রমাণিত হয় যে, সে মিথ্যা বলেছে, (খ) নিজে নিজে আদায় করবে মর্মে জেদ ধরে এবং এজন্য ইসলামী সরকারের কাছে তার যাকাত সোপর্দ করতে অস্বীকার করে ইত্যাদি, তাহলে খলিফা শরীয়তের মধ্যে থেকে যে কোনো ধরনের দৃষ্টান্তমূলক মুনাসেব শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারবেন। যেমন: জেলে কয়েদ করা, বেত্রাঘাত করা, মানুষকে তার সাথে সালাম কালাম ও মেলামেশা বন্ধ করে দেয়া ইত্যাদি। যদি কেউ ইসলামী সরকারের কাছে যাকাত সোপর্দ না করার একটা রেওয়াজী ফিতনা চালু করতে উদ্দত হয়, তাহলে প্রয়োজনে শাস্তির মাত্রা চড়ম দৃষ্টান্তমূলক পর্যায়েও বৃদ্ধি করা যেতে পারে, যেমনটা করেছিলেন ওমর ফারূক রা. তাঁর জামানায় কুরআনের ‘মুক্বাত্তাআত’ আয়াতগুলোর ব্যাপারে ফিতনা সৃষ্টিকারী এক ব্যাক্তির বেলায় -আবু মুশা আশয়ারী রা.-এর নালিশের প্রেক্ষিতে। ওমর ফারূক রা. সেই লোকটিকে এত মাড়ছিলেন যে, তার শরীর ও মাথার চামড়া ফেটে রক্ত বেড় হচ্ছিল ও সে মাটিতে গড়াগড়ি করছিল। এরপর তাকে সুস্থ্য হওয়ার জন্য অবসর দেন। কিন্তু কিছুদিন পর জখম ভাল করে না শুকানো অবস্থায় একইভাবে মাড়তে থাকেন। এমনটা কিছুদিন পন আরো একবার করেন। পরে সে তওবা করায় তাকে তিনি মাফ করে দেন। [সুনানে দারেমী] এমনকি এসবের পরও যদি তার এজাতীয় বদ তৎপরতা না থামে, তাহলে তাকে শরীয়তের হিফাজত ও মুসলমানদের ঐক্য অটুট রাখার স্বার্থে শরয়ী বিচারের আওতায় কতল করা যাবে। 

# খলিফা যাকাতের নির্দিষ্ট ৮টি খাতে সরকারী দায়িত্বে যাকাত ব্যয় করবেন:-

আল্লাহ তাআলা যাকাতের ব্যয় খাত নিজেই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। খলিফা’র জন্য ফরয হল, তিনি যাকাত’কে আল্লাহ’র বিধিবদ্ধ এসকল নির্ধারিত খাতে প্রয়োজন মতো ব্যয় করবেন; এর বাইরে নয়।

আল্লাহ তাআলা এরশাদ করছেন-

 إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَاءِ وَالْمَسَاكِينِ وَالْعَامِلِينَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغَارِمِينَ وَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَابْنِ السَّبِيلِ ۖ فَرِيضَةً مِّنَ اللَّهِ ۗ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ

‘নিশ্চই যাকাত (ব্যয়যোগ্য) শুধুমাত্র ফকির ও মিসকীনদের জন্য এবং একাজে নিয়োজিত আমেলদের জন্য ও মুয়াল্লাফাতুল ক্বুলুব-এর জন্য, এবং দাস-মুক্তিতে ও ঋণগ্রস্থদের (ঋণমুক্তির) কাজে, এবং আল্লাহ’র পথে ও ইবনুস-সাবিল (-এর অভাব মোচনের) কাজে। (এই খাতগুলো) আল্লাহ’র থেকে ফরযকৃত। আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী মহাপ্রজ্ঞাময়’। [সূরা তাওবা ৬০]

যাকাতের উপরোক্ত ৮ টি খাতের বিস্তারিত দালিলিক আলোচনার স্থান-তো এটি নয়। এর জন্য ফুকাহায়ে কেরামের বড় বড় কিতাবে বিস্তারিত ফিকহী আলোচনা দলিল সহ বর্ণিত আছে। এখানে শুধু সামান্য একটু ধারনা দিতে চাই, যাতে অল্পতেই বিষয়বস্তু বুঝে আসে।

(১) ফকির’দের জন্য:- আরবীতে ‘ফকির’ বলা হয় মূলত: দরিদ্র ও অভাবী ব্যাক্তিকে, যে তার বা তার উপরে দায়িত্ব রয়েছে -এমন পরিবারের দৈনিক মৌলিক প্রয়োজন গুলো ঠিক মতো পূরণ করতে পারে, বরং দরিদ্রতা বা অভাব লেগে থাকাটাই যেন তার জীবনধারায় স্বাভাবিক। ‘ফকির’ কথাটির মধ্যে– (১) ওই ব্যাক্তিও শামিল, যে তার অভাব ও দরিদ্রতার কথা মানুষের কাছে বলেও ফেলে, যাতে তার প্রয়োজনটুকু পূরণ হয়ে যায়ে। (২) ওই ব্যাক্তিও শামিল, যে তার আত্বমর্যাদাবোধ ও লজ্জার কারণে তার অভাবী দুরাবস্থার কথা মানুষের কাছে মুখফুটে বলতে পারেনা। যেমন, আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন- لِلْفُقَرَاءِ الَّذِينَ أُحْصِرُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ لَا يَسْتَطِيعُونَ ضَرْبًا فِي الْأَرْضِ يَحْسَبُهُمُ الْجَاهِلُ أَغْنِيَاءَ مِنَ التَّعَفُّفِ تَعْرِفُهُم بِسِيمَاهُمْ لَا يَسْأَلُونَ النَّاسَ إِلْحَافًا ۗ وَ مَا تُنفِقُوا مِنْ خَيْرٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِ عَلِيمٌ – “আর (হে মুমিনগণ, তোমরা ওই সকল) ফকীর’দের জন্য (সাধ্য মতো দান-সদকাহ করার ব্যবস্থা অবশ্যই করো) যারা আল্লাহ’র পথে ব্যাপৃত হয়ে আছে (এবং দ্বীনের জরুরী সব খেদমতের কারণে) তাদের পক্ষে (উপার্জনের কাজে আলাদা ভাবে) জমিন মাড়িয়ে বেড়ানো সম্ভবপর হয়ে ওঠে না, (কারণ তারা দ্বীনের খেদমত ছেড়ে উপার্জনের পিছনে লেগে গেলে সে কাজ করবে কে? আর তাদের বাহ্যিক) ভদ্রতা-নম্রতা দেখে জাহেল-মুর্খরা তাদেরকে মনে করে তারা (বুঝি যথেষ্ট স্বচ্ছল ও) ধ্বনী। (বস্তুত:) তুমি তাদেরকে চিনতে পারবে তাদের চেহারা(য় গাম্ভীর্যতা ও আত্বসম্মানবোধের আলোকচ্ছটা) দেখে। তারা লোকজনের কাছে কাকুতি করে সওয়াল করে না। আর তোমরা কল্যানকর যা কিছু দান করো, বস্তুত: আল্লাহ সে ব্যাপের ভাল করেই জ্ঞান রাখেন”। [সূরা বাকারাহ ২৭৩]

উল্লেখ্য: এখানে ‘ফকির’ বলতে আমাদের দেশীয় ভাষায় ‘ফরিক’ নামে পরিচিত ওই সকল ব্যাক্তিরা উদ্দেশ্য নয়, যাদের অভাবকে কেউ পূরণ করে দিলেও তারা প্রয়োজনের অতিরিক্ত জমানোর জন্য ভিক্ষার নামে ব্যবসা করে বেড়ায়; আবার ওই সকল সুস্থ্যদেহী ভিক্ষুকরাও উদ্দেশ্য নয়, যারা কর্মক্ষম হওয়া সত্ত্বেও ভিক্ষা করে বেড়ায়। তবে এদের মধ্যে যারা বৃদ্ধ, বিকলাঙ্গ ও অকর্মক্ষম, যাদের ভিক্ষা ছাড়া বাহ্যত: এমন কোনো আয়ের উৎস নেই যা দ্বারা তারা নূন্যতম খানাপিনা বা মাথাগোঁজার মতো ঠাই কিংবা কাপড়চোপড়ের অভাব পূরণ করতে পারে, তাদেরকে প্রয়োজন পূরণের জন্য যাকাত থেকে দেয়া যেতে পারে। 

(২) মিসকীন’দের জন্য: মিসকীন বলতে বুঝায় মূলত: এমন ব্যাক্তিকে, যে তার জীবনের মৌলিক প্রয়োজনটুকু পূরণের প্রশ্নেও বলা যায় যে, সে নিঃস্ব বা রিক্তহস্ত হয়ে গেছে -চাই সেই নিস্বতা প্রাকৃতিক কারণে হোক বা কৃত্রিম কারণে। যেমন: ব্যবসায়ীক ক্ষতিতে রিক্তহস্ত ব্যাক্তি, নদী ভাঙ্গনে নিঃস্ব ব্যাক্তি, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা কিংবা বিধবা নারী যাদের আয়-উপার্জনের উৎস নেই, এক্সিডেন্টে শারীরীক ক্ষয়-ক্ষতি হওয়া ব্যাক্তি যার আয়-উপার্জনের পথ রুদ্ধ হয়ে আছে … প্রমুখ।

আবু হুরায়রাহ রা.-এর সূত্রে রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেন:لَيْسَ الْمِسْكِينُ الَّذِي يَطُوفُ عَلَى النَّاسِ تَرُدُّهُ اللُّقْمَةُ وَاللُّقْمَتَانِ وَالتَّمْرَةُ وَالتَّمْرَتَانِ وَلَكِنِ الْمِسْكِينُ الَّذِي لَا يَجِدُ غِنًى يُغْنِيهِ وَلَا يُفْطَنُ بِهِ فَيُتَصَدَّقُ عَلَيْهِ وَلَا يَقُومُ فَيَسْأَلُ النَّاسَ . أخرجه البخاري، كتاب الزكاة، باب قول الله تعالى: لاَ يَسْأَلُونَ النَّاسَ إِلْحَافًا  وكم الغِنى  برقم: ١٤٧٩، ومسلم، كتاب الزكاة، باب المسكين الذي لا يجد غنى، ولا يفطن له فيتصدق عليه، برقم ١٠٣٩، و غيرهما ايضا – “মিসকীন সে নয়, যে (ভিক্ষার উদ্দেশ্যে) মানুষের চারপাশে ঘুরঘুর করে বেড়ায়, যাকে এক লোকমা বা দুই লোকমা (খাবার) কিংবা দু-একটি খেজুরই ফিরিয়ে দিতে পারে। বরং মিসকীন হল সে, যে এতটুকু সম্পদও (উপার্জন করতে) পায় না, যা তাকে (অন্যের দ্বরস্থ হওয়া থেকে) অমুকাপেক্ষী বানিয়ে দিতে পারে, আর না সে অবস্থায় তাকে (দেখে) চেনা যায় (যে, সে অভাবে আছে)। ফলে কেউ তাকে দানও করে না, আর না সে মানুষের কাছে সওয়াল (যাঞ্চা) করার জন্য দাঁড়ায়। ”। [সহিহ বুখারী- ২/১২৫ হাদিস ১৪৭৯; সহিহ মুসলীম- ২/৭১৯ হাদিস ১০৩৯; মুসনাদে আহমদ- ১/৩৮৪; সুনানে নাসায়ী- ৫/৮৪ হাদিস ২৫৭১; সুনানে আবু দাউদ- ২/২৮৩ হাদিস ১৬৩১; সুনানে দারেমী- ১/৪৬২ হাদিস ১৬১৫; সুনানুল কুবরা, বাইহাকী– ৭/১৬ হাদিস ১৩১৪৭]

উপরের হাদিসটির অর্থ এই নয় যে, ‘মিসকীন পর্যায়ের কোনো নিঃস্ব অভাবী ব্যাক্তি তার দারিদ্রতা ও অভাবের কথা কাউকে বলে ফেললে সে আর মিসকীন বলেই বণ্য হবে না’। বরং, এর অর্থ কেবল ‘অভ্যস্থ ভিক্ষুক’ এবং ‘প্রকৃত মিসকীন’ কারা -তা চিনিয়ে দেয়া। যেমন, আবু হুরায়রাহ রা.-এর সূত্রে রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেন:لَيْسَ الشَّدِيدُ بالصُّرَعَةِ؛ إِنَّمَا الشَدِيدُ الَّذِي يَمْلِكُ نَفْسَهُ عِنْدَ الْغَضَبِ . أخرجه البخاري، كتاب الأدب، باب الحذر من الغضب : ٥/٢٢٦٧ رقم ٥٧٦٣، و مسلم، كتاب البر والصلة والآداب، باب فضل من يملك نفسه عند الغضب وبأي شيء يذهب الغضب : ٤/٢٠١٤ رقم ٢٦٠٩  – “(মূলত: প্রতিপক্ষকে ধরাসায়ী করে দেয়ার প্রশ্নে তার) কুস্তিগিরি’র (শক্তি-সামর্থ) দ্বারা (কোনো মানুষের) শক্তিমত্তা (প্রমাণিত) হয় না। (প্রকৃত) শক্তিমত্তা কেবল তারই রয়েছে, যে ক্রধের সময় তার নফস (প্রবৃত্তি)-কে কাবুতে রাখতে পারে”। [সহিহ বুখারী– ৫/২২৬৭ হাদিস ৫৭৬৩; সহিহ মুসলীম- ৪/২০১৪ হাদিস ২৬০৯] নিঃসন্দেহে এই হাদিসের উদ্দেশ্যও কোনো কুস্তিগিরের কুস্তি-শক্তি’কে মূল থেকেই অস্বীকার করা নয়, বরং উদ্দেশ্য হল, শারীরীক শক্তির অধিকারী কুস্তিগিরের চাইতেও বড় কুস্তিগির হল যে তার ক্রধের সময় নিজকে শরীয়তের সীমার মধ্যে কন্ট্রোল করে রাখতে পারে।

একই ভাবে, উপরের মিসকীন সম্পর্কিত হাদিসটিরও একই জাতীয় অর্থ উদ্দেশ্য। হাদিসটির অর্থ হল, ‘প্রকৃত মিসকীনই হল যাকাতের অধিক হক্বদার এবং এরকম মিসকীনকেই খুঁজে নিয়ে যাকাত থেকে তার অভাব পূরণের বন্দোবস্থ করা উচিৎ’। সুতরাং, ‘মিসকীন’ কথাটির মধ্যে– (১) ওই ব্যাক্তিও শামিল রয়েছে, যে তার নিঃস্বতা বা রিক্তহস্ত দরিদ্রতার কথা মানুষের কাছে বলেও ফেলে, যাতে তার প্রয়োজন পূরণের কোনো সুরাহা হতে পারে, (২) ওই ব্যাক্তিও শামিল রয়েছে, যে তার আত্বমর্যাদাবোধ ও লজ্জার কারণে তার নিঃস্বতা বা রিক্তহস্ত দরিদ্রতার কথা মানুষের কাছে মানুষের কাছে মুখফুটে বলতে পারেনা।

(৩) যাকাত উসূলের কাজে নিয়োজিত আমেল (কর্মী)দের জন্য: এরা হল ওই সকল মুসলমানগণ যাদেরকে ধ্বনীদের মাল-সম্পদ থেকে ‘যাকাত’ উসূল করা ও তা যোগ্য খাত সমূহে বন্টনের কাজে নিয়োগ দেয়া হয়। তাদেরকে যাকাতের মাল থেকে পারিশ্রমিক দেয়া যাবে।

একাজে নিয়োগ পাওয়ার অধিকারী শুধুমাত্র একজন আমানতদার মুসলীম; কোনো অমুসলীম কাফের নয়। কারণ, কোনো শরয়ী বিষয়ের ক্ষেত্রে অমুসলীমকে অবিশ্বাসযোগ্য মনে করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা আরো এরশাদ করেন- يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ مِن دُونِ الْمُؤْمِنِينَ– ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা মুমিনদেরকে বাদ দিয়ে কাফেরদেরকে (তোমাদের) ওলী (অভিভাবক ও বন্ধু) হিসেবে গ্রহন করে নিবে না’। [সূরা নিসা ১৪৪]

 ‘ফরয যাকাত’ উসূল করণ ও তা নির্ধারিত খাতে বন্টন কাজটি যেহেতু একটি বিরাট আমানতদারী ও বিশ্বস্ততার কাজ এবং এর সাথে মুসলমানদের আর্থিক শক্তি-সামর্থ চাঙ্গা করা, জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি’র বিষয়টি অতপ্রত ভাবে জড়িত, তাই এ কাজে অবশ্যই কোনো অমুসলীম/কাফের’কে নিয়োগ দেয়া যাবে না। কারণ, একে-তো অমুসলীম/কাফেররা কোনো দিনই তাদের নিজেদের চাইতে মুসলমানদের অর্থনৈতিক শক্তি ও জীবনযাত্রার মান উচ্চতর ও মজবুত হোক -তা মোটেও চাইবে না। তাই চোরা শত্রুদের হাতে এমন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া, আর এই সুযোগের হাত ধরে ধীরে ধীরে মুসলমানদের কোমড় ভাঙ্গার কাজে খাল কেটে কুমির আনা -শেষমেস একথাই প্রমাণিত হবে।

হযরত আইয়্যাসের সূত্রে উত্তম সনদে একটি রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত ওমর রা. একবার হযরত হযরত আবু মুসা আশআরী রা.কে নির্দেশ দিলেন, তিনি কত আয় করেছেন কত ব্যয় করেছেন তার হিসেব একটি চামড়ায় লিখে যেন তার কাছে পেশ করেন। সে সময় আবু মুসা আশআরীর ছিল একজন খৃষ্টান লেখক, তিনি তাকেই (হিসাব সহ হযরত ওমরের সামনে) পেশ করলেন। এতে হযরত ওমর রা. অবাক হয়ে বললেন-  إن هذا لحفيظ  – ‘এই ব্যাক্তি হিসাব সংরক্ষক’ !!! তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন- هل أنت قارئ لنا كتابا في المسجد جاء من الشام؟ ‘তুমি কি মসজিদের মধ্যে আমাদেরকে শাম (বৃহত্তর সিরিয়া) থেকে আগত ফরমান পড়ে শোনাবে’? তখন হযরত আবু মুসা আশআরী রা. বললেন-(إنه لا يستطيع ( أن يدخل المسجد -‘না, তার পক্ষে (মসজিদে ঢোকা) সম্ভব নয়’। হযরত ওমর রা. জিজ্ঞেস করলেন- أجنب هو؟ – ‘সে কি অপবিত্র (যে, মিসজিদে প্রবেশ করতে পারবে না)’? হযরত আবু মুসা আশআরী রা. বললেন- لا بل نصراني – ‘না, বরং সে একজন খৃষ্টান’। হযরত আবু মুসা আশআরী রা. বললেন: একথা শুনে হযরত ওমর রা. আমাকে ধমক দিলেন এবং পিঠে একটি চাপড় দিয়ে বললেন- أخرجوه -‘তাকে (এই দায়িত্ব থেকে) বহিষ্কার করো’। এরপর তেলাওয়াত করলেনيَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَىٰ أَوْلِيَاءَ  – ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা ইহুদী ও খৃষ্টানদেরকে তোমাদের বন্ধু হিসেবে গ্রহন করো না। [তাফসীরে ইবনে আবি হাতেম- ৪/১১৫৬, হাদিস ৬৫১০; সুনানুল কুবরা, বাইহাকী-১০/১২৭, ৩২৮; শুয়াবুল ইমান, বাইহাকী, হাদিস ৯৩৮৪; তাফসীরে ইবনে কাসির-৫/১৩৬ ; মুসনাদে ফারুক, ইবনে কাসির-২/৪৯৪; আদ্দুররুল মানসুর, ইমাম সুয়ূতী- ২/৫১৬]

ইমাম ইবনে কুদামাহ রহ. লিখেছেন, যেখানে ওমর রা. আবু মুসা আশঅারী’র দফতরে কেরানী পদে একজন খৃষ্টানকে নিয়োগ দান করাকে সমর্থন করেন নি, সেখানে যাকাত হল ইসলামের এটি ফরয বিষয়, সেখানে (অমুসলীমকে আমাদের এজাতীয় মুসলমানদের বিষয় আসয়ে যুক্ত না করার) এই নীতি তো অবশ্যই অনিবার্য হবে। [আল-মুগনী, ইবনে কুদামাহ- ২/৪৬]

(৪) মুয়াল্লাফাতুল ক্বুলুব-এর জন্য (যাদের মনতুষ্টির প্রয়োজন):  এরা হতে পারে- (ক) নব-মুসলীম যাদেরকে আর্থিক সহায়তা না করলে দ্বীন ইসলাম ত্যাগ করে পূণরায় কাফের হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়, বা (খ) দূর্বল ইমানের অধিকারী মুসলমান যাদেরকে আর্থিক সহায়তা না করলে দ্বীন ইসলাম ত্যাগ করে অন্য ধর্ম গ্রহন করতে পারে (যেমনটা অনেক ক্ষেত্রে খৃষ্টান/কাদিয়ানী মিশনারীদের দেয়া আর্থিক প্রলোভনে অনেক দূর্বল ইমানের অধিকারী মুসলমানরা খৃষ্টান বা কাদিয়ানী হয়ে যায়), বা (গ) মুনাফেক/দূর্বল ইমানের অধিকারী মুসলমান যারা শুধু অর্থের লোভে কাফেরদের সাথে হাত মিলিয়ে তলে তলে ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষতি সাধনে তৎপর থাকে এবং আর্থিক প্রয়োজন পূরণ হলে তারা এ ধরণের ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে….ইত্যাদি ক্ষেত্রে যাকাতের অর্থ ব্যায় করা যাবে।

(৫) দাস-মুক্তি’র কাজে: মুসলমান দাস বা দাসীদেরকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করার জন্য তাদের মালিকদেরকে মুক্তিমূল্য বাবদ যাকাত থেকে আদায় করা যাবে। 

(৬) ঋণগ্রস্থদের (ঋণমুক্তির) কাজে: যে সকল মুসলমান বিভিন্ন স্বাভাবিক প্রয়োজন পূরণ করতে গিয়ে অভাবে পড়ে ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়ে এবং ঋণ মিটাতে পারে না, যাকাত দিয়ে তাদের ঋণমুক্ত করা যাবে। (উল্লেখ্য, এখানে ব্যবসায়ীক ঋণ উদ্দেশ্য নয়, যেমনটা বহু ব্যবসায়ী ব্যাংকে থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নেয়, তথা ব্যাংকের কাছে ঋণী থাকে। তাদের ঋণ শোধের কাজে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে না। বরং ব্যবসায়ীক ঋণের যাকাত আদায় করতে হবে মর্মে মুহাক্কেক ফুকাহায়ে কেরাম মত দিয়েছেন)। 

(৭) ফি সাবিলিল্লাহ (আল্লাহ’র পথে): এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, কুরআন সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত দ্বীন ইসলামে সকল ইবাদত ও নেক কাজই ‘আল্লাহ’র পথ’ হিসেবে গণ্য। কিন্তু যখন যাকাত আদায়ের প্রশ্ন আসে, তখন দ্বীন ইসলামে সকল ইবাদত ও নেক কাজই ‘ফি সাবিলিল্লাহ (আল্লাহ’র পথ)’র মধ্যে গণ্য ধরে সেগুলোর সবগুলোকেই যাকাত খাত হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে না। কারণ, খোদ আল্লাহ তাআলা উপরের আয়াতে- إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ ‘যাকাত (ব্যয়যোগ্য) শুধুমাত্র……’ – বলে যাকাতের খাতগুলোকে কেবলমাত্র উক্ত ৮টি খাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ ও সুচিহ্নিত করে দিয়েছেন। কাজেই, এখানে ‘ফি সাবিলিল্লাহ (আল্লাহ’র পথ)’ বলতে যাবতীয় ইবাদত ও নেক কাজে যাকাত দান উদ্দেশ্য হলে বহু নেক কাজের মধ্যে থেকে নির্দিষ্ট ভাবে ৮টি খাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হত না। দ্বিতীয়ত: যখন ৮টি খাতের এক একটিকে যাকাতের আলাদা আলাদা একটি করে খাত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, তখন অবশ্যই ‘ফি সাবিলিল্লাহ (আল্লাহ’র পথ)’ও আলাদা স্বতন্ত্র একটি খাত। সুতরাং, একথা বলার কোনো অবকাশ নেই যে, ‘ফি সাবিলিল্লাহ (আল্লাহ’র পথ)’ বলতে যাবতীয় ইবাদত ও নেক কাজই ‘ফি সাবিলিল্লাহ (আল্লাহ’র পথ)’র মধ্যে গণ্য তাই যাবতীয় যাবতীয় ইবাদত ও নেক কাজেই যাকাত দান করা যাবে! যদি তাই হত, তাহলে তো ৮টি খাতের বাকি ৭টি খাতও ‘ফি সাবিলিল্লাহ (আল্লাহ’র পথ)’, তাহলে আবার স্বতন্ত্র ভাবে ‘ফি সাবিলিল্লাহ (আল্লাহ’র পথ)’ নামের আলাদা একটি খাতের উল্লেখ করার কী অর্থ হতে পারে! এ থেকে বোঝা গেল, ‘ফি সাবিলিল্লাহ (আল্লাহ’র পথ)’ একটি আলাদা যাকাত খাত, যা বাকি ৭টি খাত থেকে আলাদা।

যাকাতের খাত ‘ফি সাবিলিল্লাহ (আল্লাহ’র পথ)’-এর ব্যাখ্যায় যে ব্যাপারে সকলে একমত সেটা হল, এখানে ‘দ্বীন ইসলামকে সুউচ্চে তুলে ধরার উদ্দেশ্যে কৃত শরীয়তসম্মত কিতাল/জিহাদ উদ্দেশ্য। অর্থাৎ, গরিব মুসলমান কিংবা এমন মুসলমান যে নিজ বাসস্থানে স্বচ্ছল হওয়ায় যাকাত পাওয়ার অধিকারী নয় বটে, কিন্তু জিহাদ/ক্বিতালের সফরে মুজাহিদগণের সাথে বের হওয়ার প্রশ্নে নূন্যতম পাথেয়, খাদ্যসামগ্রী, যুদ্ধের অস্ত্র, বাহন, পোষাক ইত্যাদি ক্রয়/জোগার করতে সমর্থ হয়নি, সে আল্লাহ’র পথে জিহাদ/ক্বিতালে বের হওয়ার জন্য এই উদ্দেশ্যে যাকাত থেকে গ্রহন করতে পারবে। [শারহে সিয়ারুল কাবীর– ১/১১৪; বাদায়েউস সানায়ে, ইমাম কাসানী- ২/৪৬] 

(৮) ইবনুস সাবীল-এর (অভাব মোচনের) কাজে:  ইবনুস সাবীল বলা হয় সফরকারী পথিককে। ধ্বনী হোক বা দরিদ্র -উভয় অবস্থাতেই অনেক মুসলমান নর-নারী বিভিন্ন স্থানে সফরে গিয়ে যদি অভাবে পড়ে যায় এবং গন্তস্থলে পৌছানো ও খাদ্যপানীয়র ব্যবস্থা করতে না পারে, তাহলে সে ক্ষেত্রে তাদের জন্য যাকাত থেকে ব্যয় করা যাবে। 

খলিফা ‘বাইতুল মাল’ (সরকারী কোষাগার/ট্রেজারী)-এর মধ্যে ‘যাকাত ফান্ড’ নামে আলাদা একটি ফান্ড রাখার সরকারী ব্যবস্থা রাখবেন এবং সেখানে জমা হওয়া মুসলমানদের যাকাত থেকে উপরোক্ত ৮টি খাতের যখন যেটিতে প্রয়োজন পড়ে শরয়ী পন্থায় ব্যয় করবেন। আবার তিনি বিভিন্ন অঞ্চলের প্রশাসকদেরকে যাকাত আদায় ও বন্টনের নির্দেশ দিতে পারেন, যেমনটা রাসুলুল্লাহ ﷺ মুয়ায বিন যাবাল রা.-কে ইয়ামেনে পাঠানোর সময় নির্দেশ দিয়েছিলেন এই বলে যে,  আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে সহিহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন-  تُؤْخَذُ مِنْ أَغْنِيَائِهِمْ وَتُرَدُّ عَلَى فُقَرَائِهِمْ – (হে মুয়ায, এমতাবস্থায়) তুমি তাদের ধ্বনী (মুসলমান)দের কাছ থেকে (যাকাত) উসূল করে নিবে এবং তা তাদের অভাবী (মুসলমানদের)দের উপরে (বিধি মোতাবেক) ব্যয় করবে’ [সহিহ বুখারী, হাদিস ১৩৯৫; সহিহ মুসলীম, হাদিস ১৯]

# সূরা আল-হজ্জের ৪১ নং আয়াতের সাথে খলিফা, মুসলীম জনগণ ও যাকাত আদায় ব্যবস্থার সম্পর্ক:-

(১) ইসলামী হুকুমত কায়েম হলে পর যাকাতের আইন জারি করা, যাকাতের নেসাবের মালিকদের কাছ থেকে সরকারী ভাবে যাকাত উসূল করা এবং সেগুলোকে যাকাতের নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় করার বিষয়টিকে সরকারী আইনের আওতায় নিশ্চিত করা খলিফা’র অন্যতম শরয়ী প্রশাসনিক দায়িত্ব। খলিফাও এই আইনের আওতা থেকে বাদ নন। খলিফা’র এই শরয়ী দায়িত্ব পালন হবে উপরোক্ত সূরা হাজ্জের ৪১ নং আয়াতের- الَّذِينَ إِن مَّكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ …… وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ – (তারা হল আমার সেই সকল মুমিন বান্দা) যারা (এমন গুণের অধিকারী যে,) যদি তাদেরকে জমিনে শাসন-কর্তৃত্ব (খিলাফত) দেয়া হয়, তাহলে তারা ……..যাকাত আদায় করে এবং মা’রুফ (সৎ বিষয়)-এর নির্দেশ দেয়… -এর দায়িত্ব পালনের অন্তর্ভূক্ত।

(২) স্বেচ্ছায় ও বিনা ওযরে যাকাত আদায় না করার শরয়ী শাস্তি দান, যাকাত অস্বীকার করে মুরতাদ হয়ে গেলে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা, অথবা যাকাত অস্বীকারীদের বিরুদ্ধে জিহাদকরে তাদের মূলৎপাটন করার মতো  এই শরয়ী দায়িত্ব পালন হবে উপরোক্ত সূরা হাজ্জের ৪১ নং আয়াতের الَّذِينَ إِن مَّكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ ….. وَآتَوُا الزَّكَاةَ ……. وَنَهَوْا عَنِ الْمُنكَرِ  (তারা হল আমার সেই সকল মুমিন বান্দা) যারা (এমন গুণের অধিকারী যে,) যদি তাদেরকে জমিনে শাসন-কর্তৃত্ব (খিলাফত) দেয়া হয়, তাহলে তারা ….. মুনকার (নাজায়েয ও হারাম বিষয়) থেকে নিষেধ করে.’ -এর দায়িত্ব পালনের অন্তর্ভূক্ত।

উপরের আলোচনা থেকে পরিষ্কার প্রমাণীত হল যে, যেহেতু রাষ্ট্রে যাকাতের বিধান জারি করা, জোর করে হলেও যাকাত উসূল করা, যাকাতের অস্বীকারকারীদেরকে আইন ও আদালত বলে শাস্তি দান এবং প্রয়োজন হলে তাদের বিরুদ্ধে স্বসস্ত্র জিহাদ চালানোর দায়িত্বটি শরীয়তের দৃষ্টিতেই মুসলমানদের খলিফা/আমীর/ইমাম/সুলতানের কাজ; কোনো মুসলমানই ব্যাক্তিগত ভাবে রাষ্ট্রের আইনকে হাতে তুলে নিয়ে যাকাতের উপরোক্ত কোনো বিধান কার্যকর করার কোনো হক্ব রাখে না, জায়েযও নেই, সেহেতু ‘যাকাত’ শুধু ব্যাক্তিগত ইবাদত নয়, বরং এর সাথে ইসলামী রাষ্ট্র, ইসলামী খিলাফত/সরকার, শাসন ক্ষমতারাজনীতি অতপ্রত ভাবে জাড়িত।

কিন্তু এর বিপরীতে-

(ক)  ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে যেহেতু রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে ধর্মীয় বিধানকে ১০০% মুক্ত করায় বিশ্বাস (ইমান) রাখা অত্যাবশ্যক (ফরযে) শর্ত, তাই ‘রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পূর্ণ যাকাত ব্যবস্থা কায়েম’ -এর ক্ষেত্রেও ইসলামী শরীয়তের বিধানকে রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে ১০০% মুক্ত করায় বিশ্বাস (ইমান) রাখা তাদের মতে অত্যাবশ্যক (ফরযে)।

(খ) ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে যেহেতু  রাষ্ট্রযন্ত্রে কোনো ধর্মীয় বিধিবিধানকে টেনে আনা ১০০% নিষিদ্ধ (হারাম), তাই ‘রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পূর্ণ যাকাত ব্যবস্থা কায়েম’ -এর ক্ষেত্রেও ইসলামী শরীয়তের বিধানকে রাষ্ট্রযন্ত্রে টেনে আনাও তাদের মতে ১০০% নিষিদ্ধ (হারাম)।

(গ)ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ যেহেতু বিশ্বাস করে-যে ব্যাক্তিধর্মীয় বিধিবিধানকে রাষ্ট্রব্যাবস্থায় টেনে আনায় বিশ্বাসী সে আদপে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদেই বিশ্বাসী নয় বরং অস্বীকারকারী (কাফের), তাই ‘রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পূর্ণ যাকাত ব্যবস্থা কায়েম’ -এর ক্ষেত্রেও ইসলামী শরীয়তের বিধানকে রাষ্ট্রযন্ত্রে টেনে আনায় বিশ্বাসী, তাদের মতে সেও আদপে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে বিশ্বাসীই নয় বরং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে অস্বীকারকারী (কাফের)।

(ঘ) উপরোক্ত এই ৩টি পয়েন্টের এব্যাপারে খাঁটি ধর্মনিরপেক্ষতা বাদীদেরর  ইজমা  (ঐক্যমত) রয়েছে।

এর পরিষ্কার অর্থ হল, যতদিন একটি রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ থাকবে, ততদিন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ‘যাকাত কায়েম’-এর উপরোক্ত কুরআন সুন্নাহ’র বিধানটি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত থাকতে বাধ্য। এটাই একথার দলিল যে, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করার বিশ্বাসটি দ্বীন ইসলামের খিলাফত ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিরোধী একটি কুফরী মতবাদ।

# খলিফা’র দায়িত্ব: সরকারী ভাবে কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক শরয়ী বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও কার্যকর করা 
 
খলিফা’র উপর অন্যতম ফরয দায়িত্ব হল, ইসলামী রাষ্ট্রে মুসলমানদের জন্য সরকারী ভাবে কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক শরয়ী বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে শরীয়ত বহির্ভূত কোনো আইন দ্বারা মুসলমানদের বিচার হবে না।
 
শরয়ী বিচার ব্যবস্থা বলতে উদ্দেশ্য হল:-
(১) ইসলামী শরীয়াহ’র মাফকাঠিতে উত্তির্ণ যোগ্যতাগুণ সম্পন্ন ব্যাক্তিকে বিচারক (কাযী/হাকেম) হিসেবে নিয়োগ দান করা। যেমন: মুসলীম হওয়া, পুরুষ হওয়া, বালেগ হওয়া, ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী বিচারিক জ্ঞান সম্পর্কে মাহের (পারদর্শী) হওয়া ইত্যাদি।
(২) শুধু মুসলমানদের বিচার-ফয়সালা হবে কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক ইসলামী শরিয়াহ দিয়ে।
(৩) শুধু মুসলমানদের উপরে ইসলামী শরিয়াহ সম্মত বিচার কার্যকর হবে। 
 
[কাযী/বিচারকের যোগ্যতাগুণ সম্পর্কে আরো বিস্তারিত আলোচনাে এসেছে ধর্মনিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা : কেনো পথভ্রষ্ঠতা, আল্লাদ্রোহিতা ও কুফর ?’ পৃষ্ঠায়। এখানে আবারো সেগুলো উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকলাম। প্রয়োজনে আন্ডারলাইকৃত অংশে ক্লিক করে উক্ত পেজে দেখে নিন।] 
 
আল্লাহ তাআলা  এরশাদ করেন-

 ثُمَّ جَعَلْنَاكَ عَلَىٰ شَرِيعَةٍ مِنَ الْأَمْرِ فَاتَّبِعْهَا وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَ الَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ

‘অতঃপর (হে নবী মুহাম্মাদ!) আমি তোমাকে (আমার) নির্দেশিত একটি শরীয়তের উপর স্থাপন করেছি। অতএব তুমি তার অনুসরণ করে চলো এবং যারা (এই শরীয়ত সম্পর্কে) জানে না তুমি তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না’।[সূরা জাসিয়া ১৮]
 
إِنَّا أَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِتَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ بِمَا أَرَاكَ اللَّهُ ۚ وَلَا تَكُنْ لِلْخَائِنِينَ خَصِيمًا
(হে নবী মুহাম্মাদ!) আমি তোমার প্রতি সত্যসহকারে আল-কিতাব (কুরআন) নাজিল করেছি যাতে তুমি মানুষের মাঝে (সৃষ্ট বিবাদ বিসম্বাদের) বিচার-ফয়সালা ওইভাবে করতে পারো, যেভাবে আল্লাহ তোমাকে দেখিয়ে দিয়েছেন। আর তুমি (বিশ্বাসঘাতক) খিয়ানতকারীদের পক্ষ নিয়ে (আমার বিপক্ষে) বিতর্ককারী হয়ে বসো না’। [সূর নিসা ১০৫]
 
فَاحْكُمْ بَيْنَهُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ ۖ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ عَمَّا جَاءَكَ مِنَ الْحَقِّ
‘অতএব (হে নবী মুহাম্মাদ!) আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান দিয়ে তাদের মাঝে বিচার-ফয়সালা করো এবং তোমার কাছে যে আল-হক্ব (মহাসত্য ওহী) এসেছে তা বাদ দিয়ে তাদের মনকামনাগুলির অনুসরণ করবেন না’। [সূরা মায়েদাঃ ৪৮]
 
وَأَنِ احْكُمْ بَيْنَهُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ وَاحْذَرْهُمْ أَنْ يَفْتِنُوكَ عَنْ بَعْضِ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ إِلَيْكَ
‘আর (হে নবী!) তুমি আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান দিয়ে তাদের মঝে বিচার-ফয়সালা করো এবং তাদের মনকামনাগুলির অনুসরণ করবেন না। আর তাদের ব্যপারে সতর্ক থেকো, তারা যেন তোমার প্রতি আল্লাহর নাজিলকৃত কোনো কোনো বিধানের ব্যপারে তোমাকে ফেতনায় ফেলে দিতে না পারে’। [সূরা মায়েদা ৪৯]

فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا 
 ‘আপনার রবের শপথ, কক্ষোনো নয়! যতক্ষন পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের মাঝে সৃষ্ট বিবাদ-বিসম্বাদগুলোর জন্য (হে নবী মুহাম্মাদ!) তোমাকে বিচারক না মানবে, অতঃপর তুমি যে ফয়সালা করে দিয়েছ সে ব্যপারে (যতক্ষন পর্যন্ত) তাদের মনে দ্বিধামুক্ততা অনুভূত না হবে এবং (যতক্ষন পর্যন্ত) তারা (তোমার ফয়সালাকে) ঐকান্তিকভাবে গ্রহন করে না নিবে, ততক্ষন পর্যন্ত তারা (মূলতঃ তোমার উপর) ইমানআনায়নকারী (বিবেচিতই হবার) নয়, (বরং বিবেচিত হবে সন্দেহপোষনকারী মোনাফেক বেইমান হিসেবে)।[নিসা ৬৫]
 
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ ۗ وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُبِينًا
‘আর আল্লাহ ও তাঁর রাসুল যখন কোনো বিষয়ে কোনো ফয়সালা দিয়ে দেন, তখন কোনো মুমিন পুরুষ ও মুমিনা নারীর জন্য তাদের নিজেদের বিষয়গুলোতে (ভিন্ন ফয়সালা দানের) কোনো এখতিয়ার থাকে না। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে অমান্য করলো, সে মূলতঃ সুস্পষ্ট পথভ্রষ্ঠতায় নিমজ্জিত হয়ে গেল’।[সূরা আহযাব ৩৬]
 
 أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ آَمَنُوا بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَنْ يَتَحَاكَمُوا إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُوا أَنْ يَكْفُرُوا بِهِ وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُضِلَّهُمْ ضَلَالًا بَعِيدًا . وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا إِلَى مَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَإِلَى الرَّسُولِ رَأَيْتَ الْمُنَافِقِينَ يَصُدُّونَ عَنْكَ صُدُودًا
(হে নবী মুহাম্মাদ!) তুমি কি তাদেরকে দেখোনি যারা দাবী করে যে, ‘আপনার কাছে যা নাজিল করা হয়েছে এবং আপনার পূর্বে যা নাজিল করা হয়েছিল -আমরা সে ব্যাপারে ইমান এনেছি’!। (এরা যদি বাস্তবেেই আমার নাজিলকৃত বিধানের উপর ইমান এনে থাকতো, তাহলে তারা ফয়সালা পাওয়ার জন্য সর্বাবস্থায় আমার বিধানের দিকেই ধাবিত হত)। (বাস্তবে) তাদের মনকামনা থাকে যে, তারা (বিচারীক) ফয়সালা করিয়ে নিবে তাগুতের কাছে। অথচ তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, তারা যেন তাকে (তথা তাগুতকে) অস্বীকার/ইনকার করে। আর শয়তান চায় যে, সে তাদেরকে পথভ্রষ্ঠ করে বহুদূর নিয়ে যাবে। আর তাদেরকে যখন বলা হয়, আল্লাহ যা নাজিল করেছেন তোমরা সেদিকে আসো এবং (আসো) রাসুলের দিকে (যাতে তিনি আল্লাহ’র বিধান অনুযায়ী তোমাদের মাঝে ফয়সালা করে দিতে পারেন), তখন তুমি মুনাফেকদেরকে দেখবে যে, তারা তোমার কাছে আসতে ইতস্ততঃ করছে ও পাশকেটে সরে পড়ছে’। [সূর নিসা ৬০, ৬১]
 
وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ
‘আর আল্লাহ যা নাজিল করেছেন যারা তা দিয়ে বিচার করে না, তারাই হল কাফের’।[সুরা মায়েদা ৪৪]
 
উপরোক্ত আয়াতগুলো একথার পরিষ্কার দলিল যে-
 
(১) কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক ইসলামী শরীয়ত দিয়ে মুসলমানদের যাবতীয় মামলা মোকাদ্দমার বিচার-ফয়সালা করা ফরয
 
(২) ইসলামী শরীয়তের সাথে সাংঘর্ষিক/বিরোধী যে কোনো মানবরচিত আইন দিয়ে মুসলমানদের যে কোনো মামলা মোকাদ্দমার বিচার-ফয়সালা করা বিলকুল হারাম
 
(৩) কুরআন-সুন্নাহ’র সাথে সাংঘর্ষিক/বিরোধী যে কোনো মানবরচিত আইন দিয়ে বিচার পাওয়ার কামনা কোনো মুমিন ব্যাক্তি করবে না, এটা করবে সে-ই যে মুনাফেক
 
(৪) শরীয়ত অনুযায়ী মুসলমানদের বিচার-ফয়সালা করা ফরয হওয়ায় তা অবশ্যই জরুরিয়তে দ্বীন (দ্বীন ইসলামের অপরিহার্য বিষয়)-এর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত। আর জরুরিয়তে দ্বীন’কে অস্বীকারকারী ব্যাক্তি কাফের/মুরতাদ। সুতরাং কোনো মুসলমান কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক ইসলামী শরীয়ত দিয়ে বিচার করতে বা বিচার মানতে অস্বীকার করলে সে মুরতাদ/কাফের হয়ে যাবে। (এর কিছুটা খোলাসা নিম্নে আসছে)
 
সুতরাং, খলিফা’র উপরও ফরয দায়িত্ব হল, মুসলমানদের ছোট বড় যাবতীয় মামলা-মুকাদ্দমাগুলোর বিচার-ফয়সালা যাতে কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক শরয়ী আইন দিয়ে কার্যকর হয় -তা নিশ্চিত করা। খলিফা’র এই শরয়ী দায়িত্ব পালন হবে উপরোক্ত সূরা হাজ্জের ৪১ নং আয়াতের- الَّذِينَ إِن مَّكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ …… ..وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ – (তারা হল আমার সেই সকল মুমিন বান্দা) যারা (এমন গুণের অধিকারী যে,) যদি তাদেরকে জমিনে শাসন-কর্তৃত্ব (খিলাফত) দেয়া হয়, তাহলে তারা ……..এবং মা’রুফ (সৎ বিষয়)-এর নির্দেশ দেয়… -এর দায়িত্ব পালনের অন্তর্ভূক্ত।
 
মাসআলাহ: খলিফার যোগ্যতা থাকলে তিনি নিজেও বিচার-ফয়সালা করতে পারবেন, যেমনটা করেছিলেন রাসুলুল্লাহ সা., খলিফা আবু বকর সিদ্দিক রা., খলিফা ওমর ফারুক রা., খলিফা উসমান গণী রা. এবং খলিফা আলী রা. প্রমূখ। আবার খলিফা প্রয়োজন মনে করলে অন্য কোনো যোগ্য ব্যাক্তিকেও কাযী/বিচারকের দায়িত্ব দিতে পারেন -চাই তা রাজধানীতে হোক বা অন্য কোনো অঞ্চলে। যেমন: রাসুলুল্লাহ সা. বিভিন্ন স্থানে প্রশাসক ও কাযী পাঠাতেন, আবার কখনো কখনো প্রশাসকের বিচারকার্যে পর্যাপ্ত শরয়ী জ্ঞান থাকলে তিনিও বিচার করতেন। ওমর ফারূক রা. তাঁর খিলাফতের জামানায় আলী রা.-কে সহকারী বিচারক বানিয়েছিলেন ইত্যাদি। বিচারের জন্য আলাদা কোর্টও প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে, আবার মসজিদের ভিতরে বা বাহিরে যে কোনো মুনাসেব স্থানে বিচার করতেও করলেও শরীয়তের দিক থেকে কোনো অসুবিধে নেই।
 
আমরা উপরে বলে এসেছি, শরীয়ত অনুযায়ী মুসলমানদের বিচার-ফয়সালা করা ফরয হওয়ায় তা অবশ্যই জরুরিয়তে দ্বীন (দ্বীন ইসলামের অপরিহার্য বিষয়)-এর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত। আর কুরআন সুন্নাহ’য় ইজমায়ী ভাবে প্রমাণিত কোনো জরুরিয়তে দ্বীন’কে অস্বীকারকারী ব্যাক্তি সর্বসম্মতিক্রমে কাফের/মুরতাদ। সুতরাং কোনো মুসলমান (চাই খলিফা হোক, বা কাযী হোক বা সাধারণ মুসলমান) যদি আল্লাহ’র নাজিলকৃত বিধান দিয়ে বিচার করাকে মুখে পরিষ্কার অস্বীকার করে অথবা যদি তার কাজ/আচরণ দ্বারা  পরিষ্কার অস্বীকৃতি প্রকাশ পায়, তাহলে সে মুসলীম মিল্লাত থেকে বেড়িয়ে যাওয়া মুরতাদ/কাফের হিসেবে গণ্য হবে।
 
উপরোক্ত আয়াত- وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ ‘আর আল্লাহ যা নাজিল করেছেন যারা তা দিয়ে বিচার করে না, তারাই হল কাফের’-এর মধ্যে কোন মুসলমান কোন অবস্থায় আল্লাহ’র বিধান দিয়ে বিচার না করলে ‘কুফরীয়ে ছুগরা’ (ছোট কুফরী/অস্বীকৃতি) করে বসার কারণে মুসলীম হিসেবে গণ্য হবার যোগ্য, আর কোন মুসলমান কোন অবস্থায় আল্লাহ’র বিধান দিয়ে বিচার না করলে ‘কুফরীয়ে কুবরা’ (বড় কুফরী/অস্বীকৃতি) করে বসার কারণে কাফের/মুরতাদ হিসেবে গণ্য হবার যোগ্য, তা জানা অতীব জরুরী। কারণ, উপরোক্ত আয়াতের মর্ম খারেজীদের কন্ঠকাণী দিয়ে ঢুকে অন্তরে হৃদয়ঙ্গম না হওয়ার কারণে খোদ এই আয়াতকে দলিল হিসেবে পেশ করেই খলিফা আলী মরতুজা রা.-কে এবং পরে সকল সাহাবায়ে কেরাম ও তাঁদের অনুসারী তাবেয়ীগণকে পাইকারী হারে কাফের/মুরতাদ আখ্যা দিয়েছিল। (নাঊযু-বিল্লাহি-মিন-যালিক) তাই মুজতাহিদ ও মুহাক্কিক মুমিনগণের ইসতিহাদী শরয়ী রায়, মুসলমানদের ইমানী দূর্বলতার কারণে কোনো কুফরী করে ফেলা, বা ইমান নষ্ট করে বড় কুফরী করে ফেলে ইসলামী মিল্লাহ থেকে বেড় হয়ে যাওয়া কাফের/মুরতাদদের মধ্যে পার্থক্য করতে না পারলে মহা বিপদ। অন্যথায়, খারেজীদের মতো প্রথভ্রষ্ঠ হয়ে দ্বীন থেকে কখন ছিটকে বেড় হয়ে চলে যাবেন বুঝতেও পাবেন না।
 
সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, আইম্মায়ে মুফাসসিরীন ও মুজতাহিদীন এবং মুহাক্কেক ফুকাহায়ে কেরাম থেকে উপরোক্ত আয়াত- وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ ‘আর আল্লাহ যা নাজিল করেছেন যারা তা দিয়ে বিচার করে না, তারাই হল কাফের’ এবং এই জাতীয় বিভিন্ন আয়াতে কারিমার যে সকল ব্যাখ্যা ও ফিকহী বিধান বর্ণিত হয়েছে, তার খোলাসা হল, আল্লাহ’র নাজিলকৃত বিধান দিয়ে বিচার না করার ঘটনা ৩ ভাবে ঘটতে পারে, যার মধ্যে ১ টি ঘটতে পারে ইসতিহাদী ভূলের কারণে, ২য় টি ঘটতে পারে ‘কুফরীয়ে ছুগরা’ (ছোট কুফর/অস্বীকৃতি)-এর কারণে, আর ৩য় টি ঘটতে পারে ‘কুফরীয়ে কুবরা’ (বড় কুফর/অস্বীকৃতি)-এর কারণে।  
 
(১) ইসতিহাদী ভূলের কারণে: ইসতিহাদ বলা হয় কুরআন ও সুন্নাহ’য় মাহের (বৎপত্তি অর্জনকারী ও সুদক্ষ) আলেম কর্তৃত কোনো বিষয়ে শরীয় বিধান উদ্ভাবনকে। [এব্যাপারে দলিল সহ আরো বিস্তারিত বোঝার জন্য ক্লিক করুন এখানে]। মুসলমানদের বিভিন্ন বিষয়ের বিচার-ফয়সালা করার জন্য  কুরআন সুন্নাহ’র ইলমে মাহের না হলে কারো জন্য কাযী (বিচারক) হওয়াই জায়েয নেই। কিন্তু কুরআন-সুন্নাহ’য় পরিষ্কার কোনো ফয়সালা না থাকলে সে ব্যাপারে পূর্ণ যোগ্যতা খাটিয়ে কোনো ইজতিহাদী শরয়ী বিধান কী তা বেড় করতে গিয়ে ভুলও হতে পারে। কিন্তু কোনো মাহের কাযীর এরকম ভুল করাকে খোদ আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সা. উপরোক্ত সূরা মায়েদা’র ৪৪ নং আয়াতের মধ্যে-তো গণ্য করেনই নি, উল্টো একটি সওয়াবের সুসংবাদ দিয়েছেন। যেমন, হযরত আমর ইবনুল আস রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ সা. এরশাদ করেন– إذا حكم الحاكم فاجتهد ثم أصاب فله أجران وإذا حكم فاجتهد ثم أخطأ فله أجر – যখন কোনো হাকিম (বিচারক) ইসতিহাদ করে ফয়সালা দেন ও ফয়সালাটি সঠিক হয়, তখন তিনি (আমলনামায়) দুটি পুরষ্কার পান। আর তিনি যখন ইসতিহাদ করে ফয়সালা দেন কিন্তু ফয়সালাটা ভুল হয়ে যায়, তখন তিনি একটি পুরষ্কার পান। [সহীহ বুখার, হাদিস ৭৩৫২; সহীহ মুসলীম, হাদিস ১৭১৬; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৩৫৭৪; মুসনাদে আহমাদ-৪/১৯৮] এখানে একটি সওয়াব সত্যে পৌছানোর পূর্নোদ্যমে চেষ্টা করার কারণে, আর দুটি সওয়াবের মধ্যে একটি সত্যে পৌছানোর পূর্নোদ্যমে চেষ্টা করার কারণে এবং আরেকটি সত্যে পৌছানোর কারণে। [শারহুল মুসলীম, ইমাম নববী- ১২/১৪] 
 
(২) কুফরীয়ে ছুগরা (ছোট কুফরী)-র কারণে: ‘কুফরীয়ে ছুগরা’ (ছোট কুফর/অস্বীকৃতি) হল এমন কুফরী, যার কারণে সে মুরতাদ/কাফের হয়ে ইসলামী মিল্লাত থেকে বেড় হয়ে যায় না, বরং সে একজন (পাপী) মুসলীম হিসেবেই গণ্য হয়। ‘ছোট’ বলা হয়েছে মূলতঃ ‘বড়’র তুলনায় এটি ছোট বিধায়, অন্যথায় আল্লাহ’র সাথে ছোট ‍ কুফরীও কেয়ামতের দিন সর্বনাশের কারণ হতে পারে। যাহোক, ‘কুফরীয়ে ছুগরা’ (ছোট কুফর/অস্বীকৃতি) হতে পারে-
 
(ক) যদি খলিফা (শাসক) রাষ্ট্রে মুসলমানদের জন্য আল্লাহ’র নাজিলকৃত বিধান দিয়ে বিচার করাকে ‘জরুরিয়তে দ্বীন’ (দ্বীনের অপরিহার্য অংশ)-এর অন্তর্ভূক্ত বলে বিশ্বাস করে এবং এই উদ্দেশ্যে শরয়ী বিচার ব্যবস্থা এভাবে জারি রাখে যে, বিচার করার জন্য কুরআন সুন্নাহ’র প্রমাণিত কোনো ইজমায়ী একটি বিধানকেও পরিবর্তন না করে, কিন্তু ইমানী দূর্বলতার কারণে পার্থিব কোনো স্বার্থে শরয়ী আইনের সুযোগ ও ফাঁক-ফোকড়কে কৌশলে কাজে লাগিয়ে মুসলমানদের সাথে বিভিন্ন ভাবে বিচার কার্যে অন্যায়-অবিচার ও জুলুম করে থাকে। বলা বাহুল, আল্লাহ’র নাজিলকৃত বিধান দিয়ে ইনসাফের সাথে বিচার করেনি বলেই তো বলা হচ্ছে সে অন্যায়-অবিচার ও জুলুম করেছে। কিন্তু খলিফা (শাসক) এভাবে অন্যায়-অবিচার ও জুলুম করাকে ‘কুফরীয়ে ছুগরা’ (ছোট কুফর/অস্বীকৃতি) বলা হবে এবং তখনো পর্যন্ত তাকে (জালেম ও পাপী) মুসলমান হিসেবেই গণ্য করা হবে। 
 
উদাহরণ স্বরূপ: খলিফা কাউকে ফাঁসানোর জন্য রফিকের বাড়িতে গোপনে অস্ত্রস্বস্ত্র ও বিভিন্ন আনুসঙ্গিক প্রমাণাদি রেখে দিয়ে রফিককে কয়েকজন সাক্ষ্যির সামনে তাকে খলিফার বিদ্রোহী প্রমাণ করলো এবং  তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করলো। আর দলিল হিসেবে কুরআনের আয়াত দিলো, সাথে এও বললো যে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেছেন- مَنْ أَتَاكُمْ وَأَمْرُكُمْ جَمِيعٌ عَلَى رَجُلٍ وَاحِدٍ، يُرِيدُ أَنْ يَشُقَّ عَصَاكُمْ، أَوْ يُفَرِّقَ جَمَاعَتَكُمْ، فَاقْتُلُوهُ .صحيح مسلم, كتاب الإمارة, باب حكم من فرق أمر المسلمين وهو مجتمع: رقم ١٨٥٢; مسند أبي عوانة, كتاب الإمارة : ٤/٤١٢ رقم ٨١٤٠  ‘তোমাদের (মুসলমানদের) শাসন (ব্যবস্থা) সার্বিকভাবে কোনো একজন ব্যাক্তির উপর (ন্যাস্ত) থাকাবস্থায় (অন্য) যে ব্যাক্তি তোমাদের কাছে এসে তোমাদের শাসনের লাঠিকে ভেঙ্গে দিতে চায়, অথবা তোমাদের জামাআতের মাঝে ফাটল ধরাতে চায়, তোমরা তাকে হত্যা করে ফেলো’[সহিহ মুসলীম, হাদিস ১৮৫২; মুসনাদে আবু আউয়ানাহ- ৪/৪১২ হাদিস ৮১৪০] 
 
যারা চোখ-কান খোলা রাখেন তারা জানেন যে এযুগেও র‌্যাব-পুলিশ’রা দেশের আইনকে লঙ্ঘন না করে বরং দেশের আইনের অধিনেই নিজেদেরকে রেখে ও প্রমাণাদি মিটিয়ে ফেলে এজাতীয় এমন সব ধুরন্ধর কৌশলের আশ্রয়ে নিরপরাধ নাগরিককে হত্যা করে বা বিকলাঙ্গ করে দেয় যে, যা আদালতের পক্ষে প্রমাণ করাও সম্ভব হয়ে ওঠে না যে, ওই র‌্যাব-পুলিশ’রা খুনি/অপরাধি আর নিহত ব্যাক্তি নিরপরাধ। 
 
দেখুন, খলিফা উপরোক্ত উদাহরণের ক্ষেত্রে শরয়ী বিচার ব্যবস্থার অধিনে অবস্থান করে এবং শরয়ী দলিল দেখিয়েই কৌশলে রফিককে অন্যায় ভাবে হত্যা করলো। সামান্য দুনিয়ার স্বার্থে অন্যায়-অবিচার করে খলিফা একটি বিরাট পাপের বোঝা কাঁধে নিলো এবং আল্লাহ’র সাথে একটি কুফরী করলো বটে, কিন্তু কিন্তু খলিফা (শাসক)-এর এই কুফরীকে ‘কুফরীয়ে ছুগরা’ (ছোট কুফর/অস্বীকৃতি) বলা হবে এবং তখনো পর্যন্ত তাকে (জালেম ও পাপী) মুসলমান হিসেবেই গণ্য করা হবে। 
 
(খ) যদি যদি কাযী (বিচারক) রাষ্ট্রে মুসলমানদের জন্য আল্লাহ’র নাজিলকৃত বিধান দিয়ে বিচার করাকে ‘জরুরিয়তে দ্বীন’ (দ্বীনের অপরিহার্য অংশ)-এর অন্তর্ভূক্ত বলে বিশ্বাস করে এবং বিচার করার সময় কুরআন সুন্নাহ’র প্রমাণিত কোনো একটি বিধানকেও পরিবর্তন না করে, কিন্তু ইমানী দূর্বলতার কারণে পার্থিব কোনো স্বার্থে শরয়ী আইনের সুযোগ ও ফাঁক-ফোকড়কে কৌশলকে কাজে লাগিয়ে (উপরোক্ত উদাহরণের মতো কোনো পার্থিব স্বার্থে) মুসলমানদের সাথে বিভিন্ন ভাবে বিচার কার্যে অন্যায়-অবিচার ও জুলুম করে থাকে, তাহলে তার ওই কাজকে ‘কুফরীয়ে ছুগরা’ (ছোট কুফর/অস্বীকৃতি) বলা হবে এবং তখনো পর্যন্ত তাকে (জালেম ও পাপী) মুসলমান হিসেবেই গণ্য করা হবে।
 
(৩) কুফরীয়ে কুবরা (বড় কুফরী)-র কারণে: এমন ‘কুফরীয়ে কুবরা’ (বড় কুফর/অস্বীকৃতি) যার কারণে সে মুরতাদ/কাফের হয়ে ইসলামী মিল্লাত থেকে বেড় হয়ে যায়, এবং এজন্য সে মুসলীম হিসেবেই গণ্য হয় না, বরং গণ্য হয় কাফের/মুরতাদ হিসেবে।
 
আমরা উপরে বলে এসেছি যে, কোনো মুসলমান (চাই খলিফা হোক, বা কাযী হোক বা সাধারণ মুসলমান) যদি আল্লাহ’র নাজিলকৃত বিধান দিয়ে বিচার করাকে মুখে পরিষ্কার অস্বীকার করে অথবা যদি তার কাজ/আচরণ দ্বারা পরিষ্কার অস্বীকৃতি প্রকাশ পায়, তাহলে সে মুসলীম মিল্লাত থেকে বেড়িয়ে যাওয়া মুরতাদ/কাফের হিসেবে গণ্য হবে। যেমন:-
 
(ক) কোনো মুসলমান (চাই শাসক হোক বা বিচারক হোক কিংবা সাধারণ মুসলমানই হোক, সে) যদি তার এই মত’কে পরিষ্কার করে প্রকাশ করে দেয় যে, সে কুরআন-সুন্নাহ’র আইন দিয়ে বিচারে বিশ্বাসী নয়, তাহলে-তো এটা কোনো সন্দেহ ছাড়াই ‘আল্লাহ’র নাজিলকৃত আইন দিয়ে বিচার না করা’র ব্যাপারে তার পরিষ্কার ইনকার/অস্বীকৃতির জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ। বিধায়,  এটা তার ‘কুফরীয়ে কুবরা’ (বড় কুফর/অস্বীকৃতি), যার কারণে সে মুসলীম মিল্লাত থেকে বেড় হয়ে যাওয়া মুরতাদ/কাফের হিসেবে গণ্য।
 
(খ) কোনো মুসলমান (চাই শাসক হোক বা বিচারক হোক কিংবা সাধারণ মুসলমানই হোক, সে) যদি কুরআন সুন্নাহ’য় প্রমাণিত কোনো একটি ইজমায়ী বিধানের স্থলেও অন্য কোনো বিধান (চাই আগেকার আসমানী কিতাবের কোনো মানসুখ হওয়া বিধান হোক বা অন্য কারো বানানো বিধান) দিয়ে মুসলমানদের বিচার করাকে হালাল/বৈধ বলে বিশ্বাস করে এবং তা তার কথা বা আচরণ দ্বারা পরিষ্কার করে প্রকাশ করে, তাহলে এটা তার ওই বিধানের ক্ষেত্রে ‘আল্লাহ’র নাজিলকৃত আইন দিয়ে বিচার না করা’র ব্যাপারে তার পরিষ্কার ইনকার/অস্বীকৃতির প্রমাণ।  বিধায়, এটা তার ‘কুফরীয়ে কুবরা’ (বড় কুফর/অস্বীকৃতি), যার কারণে সে মুসলীম মিল্লাত থেকে বেড় হয়ে গিয়ে মুরতাদ/কাফের হয়ে গেছে মর্মে গণ্য। 
 
(গ) কোনো মুসলমান (চাই শাসক হোক বা বিচারক হোক কিংবা সাধারণ মুসলমানই হোক, সে) যদি জেনেবুঝে আগেকার আসমানী কিতাবের কোনো মানসুখ হওয়া বিধানকে কিংবা যে কারো বানানো বিধানকে (নবী মুহাম্মাদ ﷺ-এর উপর নাজিল হওয়া) আল্লাহ’র নাজিলকৃত বিধান বলে চালায় বা তা দিয়ে বিচার করাকে বৈধ মনে করে, তাহলে সেটা তার ওই বিধানের ক্ষেত্রে ‘আল্লাহ’র নাজিলকৃত আইন দিয়ে বিচার না করা’র ব্যাপারে তার পরিষ্কার ইনকার/অস্বীকৃতির প্রমাণ। বিধায়, এটা তার ‘কুফরীয়ে কুবরা’ (বড় কুফর/অস্বীকৃতি), যার কারণে সে মুসলীম মিল্লাত থেকে বেড় হয়ে গিয়ে মুরতাদ/কাফের হয়ে গেছে মর্মে গণ্য। 
 
(ঘ) কোনো মুসলমান (চাই শাসক হোক বা বিচারক হোক কিংবা সাধারণ মুসলমানই হোক, সে) যদি কুরআন সুন্নাহ’য় প্রমাণিত কোনো একটি ইজমায়ী বিধানের ক্ষেত্রেও এই মত পোষন করে যে, আল্লাহ বা তাঁর রাসুল মুহাম্মাদ ﷺ ওই বিধানের ক্ষেত্রে সামান্যতম কোনো অবিচার/বেইনসাফী/অন্যায্যতা’র পরিচয় দিয়েছেন এবং এজন্য সে ওই বিধানের পরিবর্তে অন্য কারো কোনো বিধানকে অধিক ন্যয়ানুগ/ইনসাফপূর্ণ/ন্যায্য বলে বিশ্বাস করে তা দিয়ে বিচার করাকে হালাল/বৈধ মনে করে অথবা সেকথা তার জবান বা আচরণ দ্বারা পরিষ্কার প্রকাশ পায়, তাহলে সেটা তার ওই বিধানের ক্ষেত্রে ‘আল্লাহ’র নাজিলকৃত আইন দিয়ে বিচার না করা’র ব্যাপারে পরিষ্কার ইনকার/অস্বীকৃতির প্রমাণ। বিধায়, এটা তার ‘কুফরীয়ে কুবরা’ (বড় কুফর/অস্বীকৃতি), যার কারণে সে মুসলীম মিল্লাত থেকে বেড় হয়ে গিয়ে মুরতাদ/কাফের হয়ে গেছে মর্মে গণ্য। 
 
উদাহরণ স্বরূপ: যারা বিশ্বাস করে যে, শরীয় বিবাহ ও তালাক আইন, নারী-পুরুষের উত্তরাধিকার আইন, ফরয পর্দা আইন, রাষ্ট্রপ্রধান পদে নারী-পুরুষের ক্ষমতায়ন আইন ইত্যাদি ব্যাপারে কুরআন-সুন্নাহ’য় ইজমায়ী ভাবে প্রমাণিত বিভিন্ন বিধান সম্পর্কে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল ﷺ অবিচার/বেইনসাফী/অন্যায্যতা/বৈষম্যতা’র পরিচয় দিয়েছেন এবং এজন্য উল্লেখীত ওই বিধানগুলোকে বাতিল করে তদস্থলে অমুক অমুক অধিক ন্যয়ানুগ/ইনসাফপূর্ণ/ন্যায্য বিধান রচনা করা উচিত, তাদের এহেন পরিষ্কার মত বা আচরণের বহিঃপ্রকাশ তাদেরকে ইসলামী মিল্লাতের সীমা থেকে বেড় করে মুরতাদ/কাফের বানিয়ে দিবে। 
 
(ঙ) কোনো মুসলমান (চাই শাসক হোক বা বিচারক হোক কিংবা সাধারণ মুসলমানই হোক, সে) যদি জেনেবুঝে আল্লাহ’র কোনো নাজিলকৃত বিধান দিয়ে বিচার করাতে প্রকাশ্যে বাঁধার সৃষ্টি করে, তাহলে সেটা তার ওই বিধানের ক্ষেত্রে ‘আল্লাহ’র নাজিলকৃত আইন দিয়ে বিচার না করা’র ব্যাপারে তার পরিষ্কার ইনকার/অস্বীকৃতির প্রমাণ। বিধায়, এটা তার ‘কুফরীয়ে কুবরা’ (বড় কুফর/অস্বীকৃতি), যার কারণে সে মুসলীম মিল্লাত থেকে বেড় হয়ে গিয়ে মুরতাদ/কাফের হয়ে গেছে মর্মে গণ্য। 
 
(চ) কোনো মুসলমান (চাই শাসক হোক বা বিচারক হোক কিংবা সাধারণ মুসলমানই হোক, সে) যদি জেনেবুঝে আল্লাহ’র কোনো নাজিলকৃত বিধানকে নিয়ে অবমাননাকর/তুচ্ছ-তাচ্ছিল্লতামূলক কথা বলে বা আচরণ প্রদর্শন করে, তাহলে সেটা তার ওই বিধানের সাথে পরিষ্কার কুফরী (ইনকার/অস্বীকৃতি)র প্রমাণ। বিধায়, এটা তার ‘কুফরীয়ে কুবরা’ (বড় কুফর/অস্বীকৃতি), যার কারণে সে মুসলীম মিল্লাত থেকে বেড় হয়ে গিয়ে মুরতাদ/কাফের হয়ে গেছে মর্মে গণ্য। 
 
(ছ) কোনো মুসলমান (চাই শাসক হোক বা বিচারক হোক কিংবা সাধারণ মুসলমানই হোক, সে) যদি জেনেবুঝে আল্লাহ’র কোনো নাজিলকৃত বিধান দিয়ে বিচার করার বিরোধীতায় নামে, তাহলে সেটা তার ওই বিধানের ক্ষেত্রে ‘আল্লাহ’র নাজিলকৃত আইন দিয়ে বিচার না করা’র ব্যাপারে তার পরিষ্কার ইনকার/অস্বীকৃতির প্রমাণ। বিধায়, এটা তার ‘কুফরীয়ে কুবরা’ (বড় কুফর/অস্বীকৃতি), যার কারণে সে মুসলীম মিল্লাত থেকে বেড় হয়ে গিয়ে মুরতাদ/কাফের হয়ে গেছে মর্মে গণ্য। 
 
(জ) কোনো মুসলমান (চাই শাসক হোক বা বিচারক হোক কিংবা সাধারণ মুসলমানই হোক, সে) যদি জেনেবুঝে আল্লাহ’র কোনো নাজিলকৃত বিধান দিয়ে বিচার করাকে নিষিদ্ধ করে দেয়, তাহলে সেটা তার ওই বিধানের ক্ষেত্রে ‘আল্লাহ’র নাজিলকৃত আইন দিয়ে বিচার না করা’র ব্যাপারে তার পরিষ্কার ইনকার/অস্বীকৃতির প্রমাণ। বিধায়, এটা তার ‘কুফরীয়ে কুবরা’ (বড় কুফর/অস্বীকৃতি), যার কারণে সে মুসলীম মিল্লাত থেকে বেড় হয়ে গিয়ে মুরতাদ/কাফের হয়ে গেছে মর্মে গণ্য। 
 
আর আমরা আগেও বলে এসেছি যে, শরীয়তে মুরতাদের শাস্তি হল মৃত্যুদন্ড। সুতরাং, খলিফা/কাযীর উপর অপরিহার্য হল, শরয়ী আদালতের অধিনে মুরতাদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা। আর যদি মুরতাদদের গোষ্ঠিটি বড় হয় এবং তারা তাদের মৃত্যুদন্ড কার্যকরের বিরুদ্ধে নামে, তাহলে তাদের ফিতনা-ফ্যাসাদ থেকে রাষ্ট্রকে মুক্ত করে শান্তি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে খলিফা প্রয়োজনে তাদের সাথে কিতাল (স্বসস্ত্র জিহাদ) করে তাদের মূলৎপাটন করবেন। খলিফা’র এই শরয়ী দায়িত্ব পালন হবে উপরোক্ত সূরা হাজ্জের ৪১ নং আয়াতের الَّذِينَ إِن مَّكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ ……. وَنَهَوْا عَنِ الْمُنكَرِ  (তারা হল আমার সেই সকল মুমিন বান্দা) যারা (এমন গুণের অধিকারী যে,) যদি তাদেরকে জমিনে শাসন-কর্তৃত্ব (খিলাফত) দেয়া হয়, তাহলে…….. তারা মুনকার (নাজায়েয ও হারাম বিষয়) থেকে নিষেধ করে.’ -এর দায়িত্ব পালনের অন্তর্ভূক্ত।
 
আর যদি খোদ খলিফা/আমীর/ইমাম/সুলতান/শাসক’ই (উপরোক্ত ক থেকে জ পর্যন্ত কোনো একটি কারণে) ‘আল্লাহ’র নাজিলকৃত বিধান দিয়ে বিচার করতে অস্বীকার করে মুরতাদ হয়ে যায়, তাহলে মুসলমানদের উপর ফরয হল (শরীয়ত সম্মত শক্তি সামর্থ থাকলে) তারা (শরয়ী পন্থায় তাদের আমীর নিযুক্ত করে তার অধিনে) ওই মুরতাদ শাসকের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে কিতাল (স্বসস্ত্র জিহাদ) করে হলেও তাকে উৎখাত করবে।
 
উবাদাহ বিন সামেত রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেন- دَعَانَا النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَبَايَعْنَاهُ ، فَقَالَ فِيمَا أَخَذَ عَلَيْنَا: «أَنْ بَايَعَنَا عَلَى السَّمْعِ وَالطَّاعَةِ، فِي مَنْشَطِنَا وَمَكْرَهِنَا، وَعُسْرِنَا وَيُسْرِنَا وَأَثَرَةً عَلَيْنَا، وَأَنْ لاَ نُنَازِعَ الأَمْرَ أَهْلَهُ، إِلَّا أَنْ تَرَوْا كُفْرًا بَوَاحًا، عِنْدَكُمْ مِنَ اللَّهِ فِيهِ بُرْهَانٌ . رواه البخاري, كتاب الفتن, باب قول النبي صلى الله عليه وسلم: سترون بعدي أمورا تنكرونها: رقم ٧٠٥٥; و مسلم: رقم ١٨٤٠; البزار في البحر الزخار: ٧/١٤٤  রাসুলুল্লাহ ﷺ আমাদেরকে (বায়াত হওয়ার জন্য) ডাক দিলেন, আমরা তখন তাঁর কাছে বায়াত হলাম’। তিনি (তথা উবাদাহ রা.) বলেন: তিনি সে সময় আমাদের থেকে যে ওয়াদা নিয়েছিলেন, তাতে আমারা বায়াত করছিলাম একথার উপর যে, (আমরা) আমাদের পছন্দসই অবস্থায়, আমাদের অপছন্তনীয় অবস্থায়, আমাদের দুঃখ-কষ্টের সময়ে, আমাদের সুখ-সাচ্ছন্দের সময়ে এবং (কাউকে) আমাদের উপরে অগ্রাধিকার দিলেও (আমরা) শুনবো ও মানবো। (এরও বায়াত করছিলাম) যে, আমরা শাসনব্যবস্থা নিয়ে (শরীয়ত শুদ্ধ) শাসকের সাথে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষে/বিরোধীতায় লিপ্ত হবো না, (বললেন:) -যাবৎ না তোমরা (শাসকের মধ্যে) সুস্পষ্ট কুফর দেখতে পাও, যে ব্যাপারে আল্লাহ’র পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে বুরহান (সুস্পষ্ট দলিল) রয়েছে’। [সহিহ বুখারী, হাদিস ৭০৫৫; সহিহ মুসলীম, হাদিস ১৮৪০; মুসনাদে বাযযার- ৭/১৪৪]
 
এক্ষেত্রে (উপরোক্ত ক থেকে জ পর্যন্ত কোনো একটি কারণে) ‘আল্লাহ’র নাজিলকৃত বিধান দিয়ে বিচার করতে কোনো মুসলীম শাসকের প্রকাশ্য ইনকার/অস্বীকৃতিই তার সুস্পষ্ট কুফর। আর তা সুস্পষ্ট কুফর বলেই-তো সে ইসলামী মিল্লাত থেকে বেড় হয়ে মুরতাদ হয়ে যাওয়া একজন শাসক। আর ক্ষমতাধর মুরতাদ বলেই-তো তাকে উৎখাত করতে মুমিনদেরকে সম্মিলিত ভাবে প্রয়োজনে জিহাদে নামতে হয়। কারণ মুসলমানদের খলিফা/শাসক হওয়ার নূন্যতম যোগ্যতাগুণ হল মুসলমান হওয়া। [আল মুদাওয়ানাতুল কুবরা-২/১১৬; শারহু সহীহ মুসলীম, ইমাম নববী- ৬/৩১৫; বিদায়াতুল মুজতাহিদ, ইবনে রুশদ-২/১৪; তুহফাতুল মুহতাজ ফি শারহিল মিনহাজ, রমলী-৩৮/১৮১; আল-মুগনী, ইবনে কুদামা-৯/৩৭৭; [শরহুল কাবীর-২০/১৯৩; আল-ইকনা, মাকদিসী-২/২০৫; আল-কাফী-২/৫২২; কাশফুল ক্বিনা-৫/২৬-৫৭; মুগনীল মুহতাজ-৩/২০৯; আল-ওয়াসিত-৫/৭৪; আল মুবদা’, ইবনুল মুফলেহ-৭/৩৪; আল লুবাব-২/১২; আদ্দুররুল মুখতার-১/৫৯০; তাকমিলাতু হাশিয়া রাদ্দুল মুহতার-১/৬১; আল ইনসাফ, মাওয়ার্দী-৮/৭৮; মানহুল জালিল শারহু মুখতাসারিল খালিল-১৭/২৮৫;  ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার- ১৩/১২৩; ইহইয়াউ উলুমুদ্দিন, ইমাম গাযালী- ২/৩১৫; [ইবনে আবেদীন-৩/২৮১] মুমিনদের’র এই শরয়ী দায়িত্ব পালন হবে উপরোক্ত সূরা হাজ্জের ৪১ নং আয়াতের الَّذِينَ إِن مَّكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ ……. وَنَهَوْا عَنِ الْمُنكَرِ  (তারা হল আমার সেই সকল মুমিন বান্দা) যারা (এমন গুণের অধিকারী যে,) যদি তাদেরকে জমিনে শাসন-কর্তৃত্ব (খিলাফত) দেয়া হয়, তাহলে…….. তারা মুনকার (নাজায়েয ও হারাম বিষয়) থেকে নিষেধ করে.’ -এর দায়িত্ব পালনের অন্তর্ভূক্ত।
 

কিন্তু এর বিপরীতে-

(ক)  ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে যেহেতু রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে ধর্মীয় বিধানকে ১০০% মুক্ত করায় বিশ্বাস (ইমান) রাখা অত্যাবশ্যক (ফরযে) শর্ত, তাই ‘মুসলমানদের জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শরয়ী বিচার ব্যবস্থা কায়েম’ -এর ক্ষেত্রেও ইসলামী শরীয়তের এই বিধানকে রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে ১০০% মুক্ত করায় বিশ্বাস (ইমান) রাখা তাদের মতে অত্যাবশ্যক (ফরয)।

(খ) ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে যেহেতু  রাষ্ট্রযন্ত্রে কোনো ধর্মীয় বিধিবিধানকে টেনে আনা ১০০% নিষিদ্ধ (হারাম), তাই ‘মুসলমানদের জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শরয়ী বিচার ব্যবস্থা কায়েম’ -এর ক্ষেত্রেও ইসলামী শরীয়তের এই বিধানকে রাষ্ট্রযন্ত্রে টেনে আনাও তাদের মতে ১০০% নিষিদ্ধ (হারাম)।

(গ) ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ যেহেতু বিশ্বাস করে-যে ব্যাক্তিধর্মীয় বিধিবিধানকে রাষ্ট্রব্যাবস্থায় টেনে আনায় বিশ্বাসী সে আদপে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদেই বিশ্বাসী নয় বরং অস্বীকারকারী (কাফের), তাই ‘মুসলমানদের জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শরয়ী বিচার ব্যবস্থা কায়েম’ -এর ক্ষেত্রেও ইসলামী শরীয়তের এই বিধানকে রাষ্ট্রযন্ত্রে টেনে আনায় বিশ্বাসী, তাদের মতে সেও আদপে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে বিশ্বাসীই নয় বরং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে অস্বীকারকারী (কাফের)।

(ঘ) উপরোক্ত এই ৩টি পয়েন্টের এব্যাপারে খাঁটি ধর্মনিরপেক্ষতা বাদীদেরর  ইজমা  (ঐক্যমত) রয়েছে।

এর পরিষ্কার অর্থ হল, যতদিন একটি রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ থাকবে, ততদিন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ‘মুসলমানদের জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শরয়ী বিচার ব্যবস্থা কায়েম’ -এর উপরোক্ত কুরআন সুন্নাহ’র বিধানটি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত থাকতে বাধ্য। এটাই একথার দলিল যে, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করার বিশ্বাসটি দ্বীন ইসলামের খিলাফত ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিরোধী একটি কুফরী মতবাদ। যারা গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র থেকেই ইসলামের গোটা বিচার ব্যবস্থাকে ছেটে ফেলে দেয়ায় বিশ্বাসী, যারা রাষ্ট্রে ইসলামী বিচারব্যবস্থার আগমনের পথে জেনেবুঝে বাঁধার সৃষ্টি করে, বিরোধীতা করে এবং আইন করে নিষিদ্ধ করে দেয়, যারা ইসলামী বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আকাঙ্খি  মুমিনদেরকে বিভিন্ন অযুহাতে জেলে ঢোকায় শাস্তির ইষ্ট্রিমরোলার চালায় হত্যা করে শুধু এই কারণে যে, ওই মুমিন’রা ধর্মনিরপেক্ষতাকে অস্বীকার করে তদস্থলে ইসলামী বিচারব্যবস্থা চায়, যদি এরা মুরতাদ না হয় তবে আর কারা মুরতাদ।