খলিফা মুসলিম ও পুরুষ হওয়া জরুরী শর্ত vs ধর্মনিরপেক্ষতা’র কুফরী

ইসলামী খিলাফত ব্যবস্থা’য় রাষ্ট্রপ্রধান / খলিফা মুসলিম ও পুরুষ হওয়া জরুরী শর্ত vs ধর্মনিরপেক্ষতা’য় বিশ্বাসীদের প্রকাশ্য কুফরী


>>> মূল সূচিপত্র (index) থেকে এ পেজের পূর্ববর্তী বা পরবর্তী আলোচনা পড়তে [এখানে ক্লিক করুন] 


 
পূর্ব আলোচনার পর…
 
আমাদের ইতিপূর্বে উল্লেখীত ধর্মনিরপেক্ষতা’র  ১ নং বৈশিষ্ট অনুযায়ী যেহেতেু— “রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে ধর্মকে ১০০% আলাদা রাখায় বিশ্বাস করা ধর্মনিরপেক্ষতা’র সর্ব প্রধান শর্ত ও ভিত্তিযেটাকে তারা বলে থাকে Separation of religion and state(ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে বিভাজন)”, তাই একটি দেশকে  Secular State (ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র) বানানোর  ক্রমধারায় রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ (Executive Division) -এর নির্বাহী প্রধান/রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন ও মননয়নের ক্ষেত্রেও তার নূন্যতম যোগ্যতাগুণ কী কী হবে -তার মাপকাঠি নির্ধারনের বিধান থেকেও ধর্মকে ১০০% ছেটে ফেলে দেয়ায় বিশ্বাস করা অবশ্যই ধর্মনিরপেক্ষতা’র প্রধান শর্তের অংশ। 
 
সেখানে আমরা বিষয়টিকে খোলাসা করতে গিয়ে এভাবে উল্লেখ করেছিলাম—–“ধর্মনিরপেক্ষতা মতবাদটি বিশ্বাস করে, (ক)  রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ (Executive Division) -এর নির্বাহী প্রধান/রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন ও মননয়নের ক্ষেত্রে তার নূন্যতম যোগ্যতাগুণ কী কী হবে -তার মাপকাঠি নির্ধারনের ক্ষেত্রে যে কোনো ধর্মীয় বিধিবিধানকে ১০০% দূরে রাখা অত্যাবশ্যক শর্ত (ফরযে আইন)।…………..। অন্যকথায়, ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী খলিফা/রাষ্ট্রপ্রধান  মনোনয়ন ও নির্বাচন করার নূন্যতম অপরিহার্য যোগ্যতাগুণ গুলোকে ১০০% প্রত্যাক্ষান করা, অস্বীকার করে সম্পূর্ণ ধর্মমুক্ত দৃষ্টিতে এসব নির্ধারণ করা ধর্মনিরপেক্ষতা’র অন্যতম প্রধান শর্তের অন্তর্ভূক্ত
 
এবারে আমারা বিস্তারিত আলোচনা করবো, রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ (Executive Division) -এর নির্বাহী প্রধান/রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন ও মননয়নের ক্ষেত্রে তার নূন্যতম কোন্ কোন্ যোগ্যতাগুণ নির্ধারনে ইসলামী আইন মানতে নাক ছিটকায় –ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। তবে তার আগে সংক্ষেপে দেখে নেই, একটি ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান (খলিফা/আমীর/ইমাম) হতে হলে কী কী নূন্যতম যোগ্যতাগুণ থাকা অপরিহার্য।
 
ইসলামে ‘রাষ্ট্রপ্রধান’ পদটি আল্লাহ’র দেয়া একটি আমানত, আর আমানত আদায় ইবাদত বিধায় এই ইবাদতটিও আল্লাহ’র নাজিলকৃত বিধান মোতাবেক বাস্তবায়ীত করতে মুসলমানরা নির্দেশিত 

আল্লাহ তাআলা ‘আমানত’ সম্পর্কে এরশাদ করেন-

….إِنَّا عَرَضْنَا الْأَمَانَةَ عَلَى السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَالْجِبَالِ فَأَبَيْنَ أَنْ يَحْمِلْنَهَا وَأَشْفَقْنَ مِنْهَا وَحَمَلَهَا الْإِنْسَانُ 

 ‘নিশ্চই আমি ‘আল-আমানত’কে আসমানসমূহ, জমিন ও পর্বতমালার সামনে  পেশ করেছিলাম। তখন তারা তা বহন করতে অপারগতা প্রকাশ করলো এবং সকলে এতে ভীত হয়ে গেল। আর একে গ্রহন করে নিলো মানুষ…..’।[সুরা আহযাব ৭২]

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা, হযরত মুজাহিদ, হাসান বসরী, সাঈদ বিন যুবায়ের, যিহহাক, কাতাদাহ রহ. প্রমূখ থেকে ‘আমানত’- কথাটির যে সকল তাফসীর বর্ণিত হয়েছে তার সারমর্ম আদপে একই, অর্থাৎ আয়াতে বর্ণিত ‘আমানত’ বলতে বোঝাবে “আল্লাহ’র দ্বীন ও শরীয়ত পালনের দায়দায়িত্ব, যা তাঁর নাজিলকৃত সকল আদেশ নিষেধ ও উপদেশকে অন্তর্ভূক্ত করে”।[জামেউল বায়ান, ইমাম তাবারী- ২০/৩৩৬; তাফসীরুল কুরআন, ইমাম ইবসে কাসির-৬/৪৮৮; আল-জামে লি আহকামিল কুরআন, ইমাম কুরতুবী-১৪/২৫২; ফাতহুল কাদীর, ইমাম ইবনুল হুমাম- ৪/৪৩৭আল্লাহ তাআলা এই আমানতকে কেবলমাত্র তাঁরই হুকুম অনুসারে সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে পালন করার জন্য মানুষকে দুনিয়ায় তাঁর খলিফা (প্রতিনিধি) করে পাঠিয়েছেন। আর ইসলামী খিলাফত ব্যবস্থা আল্লাহ তাআলারদ্বীন ইসলামের একটি অতপ্রত শরয়ী জরুরী অংগ (যার আলোচনা আমরা ইতিপূর্বে করে এসেছি) বিধায় ‘ইসলামী খিলাফত ব্যবস্থা’ও সন্দেহাতীতভাবে উপরোক্ত আয়াতে বর্ণিত ‘আমানত’-এরই একটি অংশ, যার মধ্যে খিয়ানত করা হারাম। আর আল্লাহ তাআলা ‘আমানত’ সম্পর্কে আরো এরশাদ করেন-

إِنَّ اللهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا 
‘নিশ্চই আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন, তোমরা আমানতগুলিকে তার (স্ব-স্ব) আহাল (তথা উপযুক্ত ব্যাক্তি)র কাছে সোপর্দ করে দিবে’[সুরা নিসা ৫৮]

এখন প্রশ্ন হল, খিলাফতের মতো এত বড় গুরুত্বপূর্ণ ‘আমানত’টিকে কোন্ যোগ্যতাগুণের অধিকারী ব্যাক্তির হাতে সোপর্দ করে দিতে ইসলাম নির্দেশ দেয়, যাতে এর দায়িত্বভার তার আহাল বা উপযুক্ত ব্যাক্তির স্কন্ধে থাকে এবং এ আমানতের খিয়ানত না হয়ে যায়? 

জি হ্যাঁ, ইসলামী শরীয়ত দেখিয়ে দিয়েছে -একজন ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান তথা খলিফার কী কী যোগ্যতাগুণ থাকা জরুরী। কিন্তু এসবের বিস্তারিত আলোচনা দলিল সহ উপস্থাপন করা এই ক্ষুদ্র পরিসরে সম্ভব নয়ও নয়, স্থানও এটি নয়। কুরআন হাদিস সুন্নাহ ও ফিকহী বিধিবিধানগুলোর আলোকে দেখা যায়, ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান (খলিফা/আমীর/ইমাম) হতে হলে তার মধ্যে নিম্নোক্ত যোগ্যতাগুণ গুলো থাকা আবশ্যক। যথা:- 

(১) মুসলিম হওয়া (অমুসলিম কাফের/মুরতাদ না হওয়া)
(২) পুরুষ হওয়া (নারী না হওয়া)
(৩) স্বাধীন হওয়া (কারোর গোলাম/দাস না হওয়া)
(৪) বালেগ/প্রাপ্তবয়ষ্ক হওয়া
(৫) বিবেক/জ্ঞানবোধ থাকা (পাগল/মিস্তিষ্কবিকৃত না হওয়া)
(৬) রাষ্ট্র পরিচালনা সংশ্লিষ্ট জ্ঞান থাকা
(৭) আদল-ইনসাফ’কারী হওয়া
 
যারা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের দাবী-দাওয়া ও চাওয়াপাওয়া সম্পর্কে জানাশোনা রাখেন, তারা জানেন যে, রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার ক্ষেত্রে উপরোক্ত মৌলিক যোগ্যতাগুণ গুলোর মধ্যে ৪ নং থেকে ৭ নং যোগ্যতাগুণের উপরে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের আঙ্গুল তোলার তেমন কিছু নেই, কারণ ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরাও চায় যে তাদের ‘ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রপ্রধান’-এর মধ্যেও উক্ত নূন্যতম যোগ্যতাগুণগুলো থাকা দোষের কিচু নয় বরং থাকা উচিৎ বা অপরিহার্যই। আর ৩ নং যোগ্যতাগুণ তথা রাষ্ট্রপ্রধান’ একজন স্বাধীন ব্যাক্তি হওয়া তথা কারোর দাস/গোলাম না হওয়ার বৈশিষ্টটি ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী’দের চোখে তেমন প্রধান সমস্যা (!) নয়, কারণ এখন পৃথিবীতে ‘দাস/গোলাম’ প্রথাটি বিলুপ্তপ্রায় (তদুপরি ইসলামী শরীয়ত মতেও একজন গোলাম/দাস রাষ্ট্রপ্রধান না হতে পারার মতটি সর্বসম্মত নয়)। বাকি থাকলো, ১ নং এবং ২ নংযোগ্যতাগুণ দুটি, তথা রাষ্ট্রপ্রধানকে মুসলীম ও পুরুষ হতে হবে (অন্য কথায় কোন অমুসলিম বা কোনো নারী রাষ্ট্রপ্রধান হতে পারবে না)। মূলত: ইসলামী শরীয়তের নির্ধারিত এই দুটি যোগ্যতাগুণ এমন, যা একজন ‘খাঁটি ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী’ কোনো দিনই মত থেকে মেনে নিতে পারবে না। অন্য কথায়, একজন ‘খাঁটি ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী’ ব্যাক্তি আল্লাহ’র ও তাঁর রাসুলﷺ-এর নির্ধারণকৃত এই দুটি ইসলামী আইকে ‘অন্যায্য’ বলে বিশ্বাস করে, আর এজন্যই সে এ আইনকে মানতে অস্বীকার করে এবং রাষ্ট্রে তা কায়েম হওয়াকে প্রকাশ্য প্রত্যাখ্যান করে, যাকে আমরা আরবীতে ‘কাফের (অস্বীকারকারী/প্রত্যাখ্যানকারী)’ বলে থাকি।
 
এবারে আমরা নিচে এই ১ নং এবং ২ নংযোগ্যতাগুণকে কুরআন হাদিস ও ফিকহি দলিলের আলোকে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবো এবং তাতে দেখবো যে, এই দুটি বিশেষ যোগ্যতাগুণ পৃথিবীর কোনো ব্যাক্তি মধ্যে পাওয়া না গেলে তার অন্য বাকি যতপ্রকার যোগ্যতাগুণই থাক না কেনো, ইসলামী শরীয়ত তাকে রাষ্ট্রের খলিফা বানানোর ক্ষেত্রে অযোগ্য সাব্যস্ত করেছেআর এই দুইটি যোগ্যতাগুণ এমন যা ইসলামকে ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা বৈশিষ্টের অধিকারী করে রেখেছে। বৈশিষ্ট ২টি হল-
 
(ক) খলিফা রাষ্ট্রপ্রধান হবেন একজন মুসলীম
(খ) খলিফা হবেন একজন পুরুষ

              
(ক) খলিফা (রাষ্ট্রপ্রধান) হবেন একজন মুসলিম

একথা সর্বজন বিদিত যে, যে কোনো কারখানার মালিক তার কারখানা প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, পরিকল্পনা ও বিধি নিষেধের বিরোধী কোনো ব্যাক্তিকে কখনই তার কারখানার সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ‘মহাপরিচালক’ হিসেবে নিয়োগ দিতে চাবেন না। কারণ নিঃসন্দেহে এরকম ‘মহাপরিচালকের’ মনের শয়তানী ও মিরজাফরী বাসনা থাকবে যাতে কারখানার মালিকের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, পরিকল্পনা ও নীতিমালার কোনোটাই ঠিক মতো বাস্তবায়ীত হতে না পারে। ফলে পদে পদে সে সাধ্য মতো কৌশলে বাঁধার সৃষ্টি করবে, এমনকি সুযোগ পেলে একসময় কারখানার মালিকানা ও কর্তৃত্ব দাবি করে নিজেই মালিক সেজে নিজ ইচ্ছে মতো কারখানার পরিকল্পনা ও নীতিমালা তৈরী করবে এবং মূল মালিকের বিশ্বস্থ প্রতিনিধি কমীদের ছাটাই করে নিজের পক্ষের লোকদেরকে নিয়োগ দান করবে। এমন কি যদি একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের আচরনও পর্যবেক্ষন করে দেখি, তাহলেও সেক্ষেত্রে দেখতে পাবো যে, রাষ্ট্রের চেতনা ও সংবিধানের আংশিক বা সম্পূর্ণ বিরোধীদেরকে রাষ্ট্র-পরিচালনাতো দূরের কথা, খোদ্ নির্বাচনে অংশ গ্রহনের উপরোও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়ে থাকে। আর সেটা এই একই কারণে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বিষয়টি একটি সর্বজনবিদিত ও গ্রহনযোগ্য বিষয়।

আল্লাহ তাআলাও চান, পৃথিবীতে তাঁর খলিফা (প্রতিনিধি) হোক এমন ব্যক্তি, যে হবে তাঁর পক্ষের লোক, যে তাঁকে একমাত্র ইলাহ (উপাস্য) ও রব (প্রভু) হিসেবে স্বীকার করেছে, তাঁর শেষ নবী ও রাসুল মুহাম্মাদ সা.-এর উপর নাজিলকৃত বিধিবিধানসমূহে পূর্ণ বিশ্বাসী এবং তা কায়মনোবাক্যে নিজের মত ও পথ হিসেবে গ্রহন করে নিয়েছে; যার উপর তাঁর সৃষ্ট এই  বিশ্বকারখানা (পৃথিবী)’র দায়িত্বভার দেয়ার ব্যাপারে আস্থা রাখা যায়। আর তাই তিনি একাজে আস্থা রেখেছেন একজন মুসলীম (আল্লাহ’র আনুগত্য স্বীকারকারী) ব্যাক্তির উপর। বাদবাকি যে সকল অমুসলীম কাফের মুরতাদরা তাঁকে তাঁর একমাত্র ইলাহ (উপাস্য) ও রব (প্রভু) হিসবে তাঁর অনুগত হতে আংশিকভাবে কিংবা পূর্ণাঙ্গভাবে অস্বীকারকার করেছে, তিনি তাঁর মিশনকে লক্ষ্যে পৌছানোর জন্য তাদের উপর কোন্ যুক্তিতে আস্থা রাখতে যাবেন?!!!

ইসলামী রাষ্ট্রের একজন খলীফা হলেন মুসলমানদের উপর নিযুক্ত সবচেয়ে বড় অভিভাবক (ওলী), যার উপর দায়িত্ব থাকে, একজন রাখাল যেমন তার ভেরার পালকে ভালভাবে দেখভাল করে নেকড়ে থেকে বাচিঁয়ে রাখে, তেমনিভাবে খলিফার দায়িত্ব হল মুসলমানদের ইমান আমল জান মাল হিফাজতে রাখার ব্যবস্থায় নিয়োজিত থাকা, প্রয়োজনে জীবন উৎসর্গ করে দেয়া। কোনো অমুসলীম কাফের মুরতাদের কাছ থেকে কি এটা আশা করা যায়?!!! এজন্য মুসলমানদের উপর খলিফা’র মতো অভিভাবকত্বের এত বড় গুরুদায়িত্বপূর্ণ মর্যাদাবান পদ গ্রহনের কোনো পথ আল্লাহ তাআলা কোনো অমুসলীম কাফের মুরতাদদের জন্য একদমই খোলা রাখেননি।

আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-

وَلَنْ يَجْعَلَ اللَّهُ لِلْكَافِرِينَ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ سَبِيلا
“আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের উপর (অভিভাবকত্ব ও খবরদারী করার) কোনো সাবিল (পথ)ই কাফেরদের জন্য খোলা রাখেননি”। [সূরা নিসা ১৪৪]

ইমাম আবু বকর ইবনুল আরাবী (মৃ: ৫৪৩ হি:) রহ. লিখেছেন إنَّ الله سبحانه لا يَجعل للكافرين على المؤمنين سبيلاً بالشَّرع، فإن وجد فبِخلاف الشرع ‘আল্লাহ সুবহানাহুয়া তাআলা কাফেরদের জন্য মুমিনদের উপর (অভিভাবকত্ব ও খবরদারী করার) শরয়ী কোনো পথই খোলা রাখেননি। তাই কোথাও যদি (মুসলমানদের উপর কোনো কাফেরকে অলী বা অভিভাবক বানানো হয়েছে মর্মে) পাওয়া যায়, তাহলে (বুঝতে হবে,) সেটা (আল্লাহ’র) শরীয়তের বিরুদ্ধাচারন করেই করা হয়েছে’[আহকামুল কুরআন, ইবনুল আরাবী- ১/৬৪১, আল-জামেউ লি আহকামিল কুরআন, ইমাম কুরতুবী- ৫/৪২১]
 
ইমাম ইবনে হাযাম আল-আন্দুলুসী (মৃ: ৪৫৬ হি:) রহ. খলিফা’র যোগ্যতাগুণ আলোচনা করতে গিয়ে লিখেনو أن يكون مسلما، لأن الله تعالى يقول: (وَلَن يَجْعَلَ اللَّهُ لِلْكَافِرِينَ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ سَبِيلًا) و الخلافة أعظم السبيل، و لأمره تعالى بإصغار أهل الكتاب و أخذهم بأداء الجزية و قتل من لم يؤمن من أهل الكتاب حتي يسلموا  – “(খলিফা) হবেন একজন মুসলীম (ব্যাক্তি)। কেননা, আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন- وَلَنْ يَجْعَلَ اللَّهُ لِلْكَافِرِينَ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ سَبِيلا – “আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের উপর (অভিভাবকত্ব ও খবরদারী করার) কোনো সাবিল (পথ)ই কাফেরদের জন্য খোলা রাখেননি”। আর খিলাফত হল (পার্থিব দিক দিয়ে মুসলমানদের) সর্ববৃহৎ (সর্বোচ্চ মর্যাদাস্তরের) সাবিল (পথ)। কেননা আল্লাহ তাআলা খলিফা’কে নির্দেশ দিয়েছেন, আহলে কিতাবদেরকে হেয় অবস্থায় ফেলে তাদের থেকে জিযীয়া আদায় করার এবং আহলে কিতাবদের মধ্যে যারা ইসলাম কবুল করবে না, তাদের সাথে যুদ্ধ করার”[আল ফাসলু ফি মিলাল, ইবনে হাযাম- ৪/১২৮]

ইমাম আলাউদ্দিন আল-কাসানী (মৃ: ৫৮৭ হি:) রহ. লিখেছেন- ولأن الكافر ليس من أهل الولاية على المسلم لأن الشرع قطع ولاية الكافر على المسلمين قال الله تعالى : { ولن يجعل الله للكافرين على المؤمنين سبيلا } وقال صلى الله عليه وسلم { الإسلام يعلو ولا يعلى } ولأن إثبات الولاية للكافر على المسلم تشعر بإذلال المسلم من جهة الكافر وهذا لا يجوز – “…..আর এটা এজন্য যেএকজন কাফের ব্যাক্তি কোনো মুসলমানের উপর ওলী (অভিভাবক) হওয়ার যোগ্যতা রাখে না, কারণ শরীয়ত মুসলমানদের উপর কাফের ব্যাক্তির অভিভাবকত্ব করার পথ বন্ধ করে দিয়েছে। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন وَلَنْ يَجْعَلَ اللَّهُ لِلْكَافِرِينَ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ سَبِيلا –‘আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের উপর (অভিভাবকত্ব ও খবরদারী করার) কোনো পথই কাফেরদের জন্য খোলা রাখেননি’। আর রাসুলুল্লাহ বলেছেন الإسلام يعلو ولا يعلى -‘ইসলাম (এসেছে) সমুন্নত (হওয়ার জন্য), হেও হবার (জন্য) নয়’। আর মুসলমানের উপর কোনো কাফেরের অভিভাবকত্ব চলতে দেয়া হল ওই মুসলীম ব্যাক্তিকে কাফেরের চাইতে হেও করা; আর সেটা করা জায়েয নয়” [বাদায়েউস সানায়ে, ইমাম কাসানী- ২/২৩৯]

আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَ أُولِي الْأَمْرِمِنكُمْ  ۖ   فَإِن تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ۚ ذَٰلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا
“ওহে যারা ইমান এনেছো! তোমরা অনুগত্য করো আল্লাহ’র এবং অনুগত্য করো রাসুলের, এবং (অনুগত্য করো) তোমাদের (মুসলমানদের) মধ্যকার উলুল-আমর’-এর। এতে তোমরা যদি কোনো বিষয়ে বিবাদে লিপ্ত হয়ে পরো, তাহলে যদি আল্লাহ ও কেয়ামতের দিবসের প্রতি তোমাদের ইমান থেকে থাকে, তাহলে বিষয়টি আল্লাহ ও (তাঁর) রাসুলের (ফয়সালার) কাছে ছেড়ে দাও। এই (নির্দেশনাটি তোমাদের জন্য) কল্যানকর এবং (এটাই এবিষয়ক) সর্বোত্তম ব্যাখ্যা’।[সূরা নিসা ৫৯]
 
সহিহ বুখারী সহ বিভিন্ন হাদিসের কিতাবে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এই আয়াতের শানে নুজুল প্রসঙ্গে বলেছেন- نزلت في عبد الله بن حذافة بن قيس بن عدي، إذ بعثه النبي صلى الله عليه وسلم في سرية – “আয়াতটি আব্দুল্লাহ বিন হুযাফাহ বিন ক্বায়েস বিন আদী রা. সম্পর্কে নাজিল হয় (একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ঘটনাটি ঘটেছিল তখন) যখন রাসুলুল্লাহ ﷺ তাকে সারিয়া’য় (জিহাদে) পাঠিয়েছেলেন”। [সহিহ বুখারী-৪৫৮৪; সহিহ মুসলীম- ১৮৩৪; মুসনাদে আবু ইয়া’লা- ২৭৪৬; সুনানে আবু দাউদ- ২৬২৪; মুসতাদরাকে হাকেম- ২/১১৪; জামে তিরমিযী – ১৬৭২; সুনানে নাসায়ী- ৪১৯৪; মুসনাদে আবু আউয়ানাহ- ৪/৪৪২; দালায়েলুন নাবুয়াত, বাইহাকী- ৪/৩১১; জামেউল বয়ান, তাবারী- ৮/৪৯৭ আছার ৯৮৫৮; তাফসীরে ইবনে আবি হাতেম- ৩/৯৮৭; তাফসীরে ইবনে কাসির- ২/৪৯৭] ইমাম বাইহাকী রহ. সহিহ সূত্রে হযরত ইবনে যুরাইয রহ.-এর উক্তি বর্ণনা করেছেন যে-  نَزَّلَ : يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الأَمْرِ مِنْكُمْ فِي عَبْدِ اللَّهِ بْنِ حُذَافَةَ بْنِ قَيْسِ بْنِ عَدِيٍّ السَّهْمِيِّ ، بَعَثَهُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي سَرِيَّةٍ “ اخرجه البيحقى فى شعب الايمان: رقم ٦٩٦٣, اسناده صحيح  – অর্থাৎ, يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الأَمْرِ مِنْكُمْ  – “আয়াতটি আব্দুল্লাহ বিন হুযাফাহ বিন ক্বায়েস বিন আদী সাহমী রা. সম্পর্কে নাজিল হয়। রাসুলুল্লাহ ﷺ তাকে সারিয়া’য় (জিহাদে) পাঠিয়েছেলেন”। [শুআবুল ইমান, বাইহাকী- ৯/৪০৯, হাদিস ৬৯৬৩]
 
সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলীম সহ বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য হাদিসের কিতাবে হযরত আলী রা.-এর সূত্রে উক্ত ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে, যার সারমর্ম হল, কোনো কারণে মুজাহিদ গণের উপর তাদের আমীর (হযরত আব্দুল্লাহ বিন হুযাফা বিন কায়েস বিন আদী রা.) খুব ক্রধাহ্নিত হয়ে যান এবং তাদেরকে বলেন: أَلَيْسَ أَمَرَكُمُ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ تُطِيعُونِي – নবী কি তোমাদেরকে নির্দেশ দেননি যে, তোমরা আমার অনুগত্য করবে? এতে তারা হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলে তিনি তাদেরকে জ্বালানী কাঠ জোগার করতে বললেন। তারা জোগার করে নিয়ে এলে তিনি তাতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে তাদেরকে আগুনে ঝাপ দিতে বললেন। কিন্তু তারা তার আদেশ মানতে অস্বীকার করে এবং বিষয়টি পরে রাসুলুল্লাহ -কে জানায়। ঘটনা শুনে রাসুলুল্লাহ বললেন:  لَوْ دَخَلُوهَا مَا خَرَجُوا مِنْهَا أَبَدًا ، إِنَّمَا الطَّاعَةُ فِي المَعْرُوفِ – যদি তোমরা তাতে প্রবেশ করতে, তাহলে আর কখনই তা থেকে বেড়ুতে পারতে না। অনুগত্য শুধুমাত্র মা’রুফ (জায়েয) বিয়য়ে (করতে হয়); (আল্লাহ’র নাফরমানীমূলক কোনো কাজে নয়)। [সহিহ বুখারী- ৯/৬৩ হাদিস ৭১৪৫, ৪৩৪০; সহিহ মুসলীম- ৩/১৪৬৯  হাদিস ১৮৪০; মুসনাদে আহমদ-১/৮২; মুসনাদে বাযযার- ২/২০৩, হাদিস ৫৮৫; ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার- ৭/৬৫৫; তাফসীরে ইবনে কাসির- ২/৪৯৭]
 
ইমাম বাইহাকী (মৃ: ৪৫৮ হি:) রহ. লিখেছেন- قال الامام احمد: والحديث الذى ورد فى نزول هذه الآية دليل على أنها فى الأمراء – “ইমাম আহমদ  বলেছেন: ‘আয়াতটির শানে নুজুল প্রসঙ্গে যে হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে, সেটিই একথার দলিল যে, আয়াতটি (মুসলমানদের উপরে নিযুক্ত) আমীরগণ সম্পর্কে নাজিল হয়েছে”। [শুআবুল ইমান, ইমাম বাইহাকী- ৯/৪০৯]
 
ইমাম ইবনে জারীর আত-তাবারী (মৃ: ৩১০ হি:) রহ. সহিহ সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, আবু হুরায়রাহ রা. أولو الأمر (উলুল-আমর) -এর ব্যাখ্যায় বলেছেন: هم الأمراء – তারা হচ্ছেন আমীরগণ[জামেউল বয়ান, ইমাম তাবারী, আছার ৯৮৫৬; ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার- ৮/১৯১]
 
এই  আরবী শব্দ أَمْر (আমর্)-এর এক অর্থ হল হুকুম, আদেশ, নির্দেশ (Order)। এই অর্থ হিসেবে أُولي الْأَمْر (উলুল-আমর্) বলতে বুঝায় এমন ব্যাক্তিকে, যিনি কারো উপর হুকুম, আদেশ বা নির্দেশ (Order) দান করার অধিকার (Authority) রাখেন। আর উপরে সূরা নিসা’র ৫৯ নং আয়াতটিতে أُولي الْأَمْر (উলুল-আমর) বলতে এমন ব্যাক্তিকে বুঝানো হয়েছে, যিনি মুসলমানদের উপর নিযুক্ত এমন একজন ওলী (অভিভাবক), যিনি শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে মুসলমানদের উপর কুরআন সুন্নাহ’র হুকুম, আদেশ বা নির্দেশ (Order) দান করা বা জারি করার অধিকার (Authority) রাখেন। ইমাম শাওকানী (মৃ: ১২৫০ হি:) রহ. বলেন- أولي الأمر : هم الأئمة والسلاطين والقضاة وكل من كانت له ولاية شرعية لا ولاية طاغوتية – “(এখানে) أولي الأمر (উলুল আমর) হল ইমাম(খলিফা)গণ, সুলতান(শাসক)গণ, কাজী(বিচারক)গণ এবং যারা শরয়ী ওলী (অবিভাবক) হবার যোগ্য তারা সকলেই (অন্তর্ভূক্ত); (কিন্তু এখানে) তাগুতী (আল্লাহদ্রোহি/আল্লাহ বিরোধী/দ্বীন বিরোধী) ওলী(অভিভাবক)রা উদ্দেশ্য নয়”। [ফাতহুল কাদীর, শাওকানী- ১/৩০৯] বস্তুত:, উলুল-আমর বলতে এখানে- আমীরে আ’জম (খলিফা/ইমাম/সুলতান/রাষ্ট্রপ্রধান), আমেল (প্রশাসক), জিহাদের আমীর (সেনাপতি), হাকেম/কাযী (সরকারী বিচারক), ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’গণ প্রমুখকে বোঝানো হয়েছে। [আর রিসালাহ, ইমাম শাফেয়ী- ৭৯ পৃ:; জামেউল বয়ান, তাবারী– ৫/১৫০; আল উসূল ওয়াল ফুরু’, ইবনে হাযাম- ২/২৯২; তাফসীরে কাবীর, ইমাম রাজী- ৫/২৫০; আহকামুল কুরআন, ইবনুল আরাবী- ১/৫৭৩; আহকামুল কুরআন, জাসসাস- ২/২৯৮; আল মাজমুউল ফাতাওয়া, ইবনে তাইমিয়্যাহ- ২৮/১৭০; ই’লামুল ময়াক্কিঈন, ইবনুল কাইয়্যেম- ১/১০; আল-জামেউ লি আহকামিল কুরআন, ইমাম কুরতুবী- ৫/২৬১; তাফসিরে ইবনে কাসির- ১/৪৪৫; ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার- ৮/১৯১; ফাতহুল কাদীর, শাওকানী- ১/৪৮১]
 
উপরোক্ত আয়াতে يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا – ‘হে যারা ইমান এনেছো!’ -বলে প্রত্যেক মুমিন-মুসলমান নর-নারী’র দৃষ্টি আকর্ষন করা হয়েছে এবং এরপর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে তাদের জীবনে মেনে চলতে নির্দেশ দান করা হচ্ছে যা এখানে বিশেষভাবে প্রনিধানযোগ্য। যথা:-
(১) أَطِيعُوا اللَّهَ – (তোমরা অনুগত্য করো আল্লাহ’র) -এখানে আল্লাহ’র নিঃশর্ত অনুগত্য করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
(২) أَطِيعُوا الرَّسُولَ – (তোমরা অনুগত্য করো রাসুলের) -এখানে শেষ নবী ও রাসুল মুহাম্মাদ -এর নিঃশর্ত অনুগত্য করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। 
(৩) وَ أُولِي الْأَمْرِ مِنكُمْ – (এবং তোমাদের মধ্যকার উলুল-আমর’-এর) -আল্লাহ তাআলা এই আয়াতে মুসলমানদের জন্য তাদের উপরে নিযুক্ত উলুল-আমর-এর আদেশ নির্দেশ মান্য করে চলাকে ওয়াজিব (অতিব আবশ্যক কর্তব্য) বনিয়ে দিয়েছেন।কিন্তু  এখানে ব্যাতিক্রমী ভাবে এই বিশেষ শর্ত এঁটে দিয়েছেন যে, আল্লাহ’র এই হুকুম ওই উলুল-আমর’-এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে, যখন ‘উলুল-আমর’ হবেন مِنكُمْ (তোমাদের মধ্য থেকে), অর্থাৎ যখন তোমাদের মুসলমানদের মধ্য থেকে ‘উলুল-আমর’ নিযুক্ত হবেন। আর ইসলামী রাষ্ট্রের খলিফা (রাষ্ট্রপ্রধান) যেহেতু মুসলমানদের উপরে নিযুক্ত সবচেয়ে বড় আমীর (আমীরে আ’জম), সবচেয়ে বড় ওলী (অভিভাবক), সবচেয়ে বড় উলুল-আমর, তাই এই আয়াতে বর্ণিত হুকুম মোতাবেক, মুসলমানদের রাষ্ট্রপ্রধান মুসলমানদের মধ্য থেকেই কাউকে মনোনীত ও নির্বাচিত করা মুসলমানদের উপরে ফরয দায়িত্ব, অন্য কথায় অমুসলীম/কাফের কাউকে মুসলমানদের রাষ্ট্রপ্রধান মনোনীত ও নির্বাচিত করা মুসলমানদের উপরে হারাম এ থেকে আরো বোঝা গেল,  যদি কোনো অমুসলীম/কাফের ব্যাক্তি মুসলমানদের উপরে ‘উলুল-আমর (রাষ্ট্রপ্রধান)’ হিসেবে সমাসীন হয় -চাই সে নিজের ক্ষমতা বলে জোর করে সমাসীন হোক কিংবা কোনো গোষ্ঠি তাকে মুসলমানদের উপরে ‘উলুল-আমর (রাষ্ট্রপ্রধান)’ হিসেবে চাপিয়ে দিক -সর্বাবস্থায় ওই পদে সমাসীন উক্ত অমুসলীম/কাফের ব্যাক্তিটি মুসলমানদের ওই ‘উলুল-আমর (রাষ্ট্রপ্রধান)’ হিসেবে গণ্য নয়,  যাকে মানার কথা উপরোক্ত আয়াতে বলা হয়েছে।
 
অমুসলীম/কাফেরকে যে মুসলমানদের খলিফা বানানো জায়েয নেই তার সুস্পষ্ট দলিল হল এই হাদিস। যুনাদাহ বিন আবি উমাইয়্যাহ’র সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, উবাদাহ বিন সামেত রা. বলেন- دَعَانَا النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَبَايَعْنَاهُ ، فَقَالَ فِيمَا أَخَذَ عَلَيْنَا: «أَنْ بَايَعَنَا عَلَى السَّمْعِ وَالطَّاعَةِ، فِي مَنْشَطِنَا وَمَكْرَهِنَا، وَعُسْرِنَا وَيُسْرِنَا وَأَثَرَةً عَلَيْنَا، وَأَنْ لاَ نُنَازِعَ الأَمْرَ أَهْلَهُ، إِلَّا أَنْ تَرَوْا كُفْرًا بَوَاحًا، عِنْدَكُمْ مِنَ اللَّهِ فِيهِ بُرْهَانٌ . رواه البخاري, كتاب الفتن, باب قول النبي صلى الله عليه وسلم: سترون بعدي أمورا تنكرونها: رقم ٧٠٥٥; و مسلم: رقم ١٨٤٠; البزار في البحر الزخار: ٧/١٤٤ – “(আক্বাবা’র বাইয়াতের রাতে) রাসুলুল্লাহ ﷺ আমাদেরকে (বায়াত হওয়ার জন্য) ডাক দিলেন, আমরা তখন তাঁর কাছে বায়াত হলাম’। তিনি (তথা উবাদাহ রা.) বলেন: তিনি সে সময় আমাদের থেকে যে ওয়াদা নিয়েছিলেন, তাতে আমারা বায়াত করছিলাম একথার উপর যে, (আমরা) আমাদের পছন্দসই অবস্থায়, আমাদের অপছন্তনীয় অবস্থায়, আমাদের দুঃখ-কষ্টের সময়ে, আমাদের সুখ-সাচ্ছন্দের সময়ে এবং (কাউকে) আমাদের উপরে অগ্রাধিকার দিলেও (আমরা) শুনবো ও মানবো। (এরও বায়াত করছিলাম) যে, আমরা শাসনব্যবস্থা নিয়ে এর (শরীয়ত শুদ্ধ) আহাল (দায়িত্বরত শাসক)-এর সাথে (ততক্ষন পর্যন্ত তাকে উৎখাত করার উদ্দেশ্যে) দ্বন্দ্ব/সংঘর্ষে লিপ্ত হবো না, (বললেন:) -যাবৎ না তোমরা (শাসকের মধ্যে) সুস্পষ্ট কুফর দেখতে পাও, যে ব্যাপারে আল্লাহ’র পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে বুরহান (সুস্পষ্ট দলিল) রয়েছে”[সহিহ বুখারী, হাদিস ৭০৫৫; সহিহ মুসলীম, হাদিস ১৮৪০; মুসনাদে বাযযার- ৭/১৪৪] সুতরাং, কোনো কাফের ব্যাক্তি মুসলমানদের শাসনব্যবস্থা’র আহাল (দায়িত্বশীল/শাসক) হওয়ার যোগ্যতাই রাখে না। 
 
আল্লাহ তাআলা আরো এরশাদ করেন-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ مِن دُونِ الْمُؤْمِنِينَ ۚ أَتُرِيدُونَ أَن تَجْعَلُوا لِلَّهِ عَلَيْكُمْ سُلْطَانًا مُّبِينًا
হে ইমানদারগণ! তোমরা মুমিনদেরকে বাদ দিয়ে কাফেরদেরকে (তোমাদের) ওলী (অভিভাবক ও বন্ধু) হিসেবে গ্রহন করে নিবে না। তোমরা কি (কাফেরদেরকে নিজেদের অভিভাবক ও বন্ধ বানিয়ে নিয়ে) আল্লাহ’র কাছে তোমাদের নিজেদের বিরুদ্ধেই একথার সুস্পষ্ট দলিল দাঁড় করিয়ে দিতে চাও (যে, তোমরা আল্লাহর প্রতিনিধি হয়ে আল্লাহর মিশন কায়েম করার পরিবর্তে আল্লাদ্রোহিদের প্রতিনিধি হয়ে তাদের মিশন কায়েম করার বিষয়টিকে গ্রহন করে নিয়েছো)? [সূরা নিসা ১৪৪]

ইমাম আবু বকর জাসসাস রাযী রহ. (মৃ: ৩৭০ হি:) উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন هو يدل على ان الكافر لا يستحق الولاية على المسلم بوجه – “এ আয়াতাটি এ কথারই দলিল যে, কোনো মুসলমানের উপর অভিভাবকত্ব করার কোনো হক্ব কোনো কাফেরের কোনো ভাবেই নেই”। [আল-আহকামুল কুরআন, ইমাম জাসসাস ২/২৯১]

ইমাম ইবনে কাসির (মৃ: ৭৭৪ হি:) রহ. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেনيَنهى تعالى عباده المؤمنين عن اتِّخاذ الكافرين أولياءَ من دون المؤمنين؛ يَعني: مصاحبَتَهم، ومُصادقتهم، ومناصحتهم، وإسرارَ المودَّةِ إليهم، وإفشاءَ أحوال المؤمنين الباطنةِ إليهم – “আল্লাহ তাআলা তাঁর মুমিন বান্দাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন তারা যেন মুমিনদেরকে বাদ দিয়ে কাফেরদেরকে তাদের বন্ধু ও অভিভাবক হিসেবে গ্রহন করে না নেয়। অর্থাৎ, তাদেরকে অন্তরঙ্গ সাথী বানাবে না, অন্তরঙ্গ বন্ধু (জিগরী দোস্ত) বানাবে না, তাদেরকে (তাদের খায়েরখায়ী) পরামর্শদানকারী বানাবে না, তাদের প্রতি কোনো গোপন হৃদ্যতা (Affection) রাখবে না, মুমিনদের গোপনীয় অবস্থাদি তাদের সামনে প্রকাশ করবে না”। [তাফসীরে ইবনে কাসির- ১/৮৬৭]


আল্লাহ তাআলা আরো এরশাদ করেন-


يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَىٰ أَوْلِيَاءَ ۘ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ ۚ وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ ۗ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ 
‘হে ইমানদারগণ! তোমরা ইহুদী ও খৃষ্টানদেরকে তোমাদের বন্ধু হিসেবে গ্রহন করো না। ওরা একে অন্যের বন্ধু। আর তোমাদের মধ্যে যে ব্যাক্তি তাদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহন করে নিবে, সে তাদেরই মধ্যে গণ্য হবে। নিশ্চই আল্লাহ জালেম গোষ্টিকে হেদায়েত দেন না।’ [সুরা মায়েদাহ ৫১]

হযরত আইয়্যাসের সূত্রে উত্তম সনদে একটি রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত ওমর রা. একবার হযরত হযরত আবু মুসা আশআরী রা.কে নির্দেশ দিলেন, তিনি কত আয় করেছেন কত ব্যয় করেছেন তার হিসেব একটি চামড়ায় লিখে যেন তার কাছে পেশ করেন। সে সময় আবু মুসা আশআরীর ছিল একজন খৃষ্টান লেখক, তিনি তাকেই (হিসাব সহ হযরত ওমরের সামনে) পেশ করলেন। এতে হযরত ওমর রা. অবাক হয়ে বললেন-  إن هذا لحفيظ  – ‘এই ব্যাক্তি হিসাব সংরক্ষক’ !!! তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন- هل أنت قارئ لنا كتابا في المسجد جاء من الشام؟ ‘তুমি কি মসজিদের মধ্যে আমাদেরকে শাম (বৃহত্তর সিরিয়া) থেকে আগত ফরমান পড়ে শোনাবে’? তখন হযরত আবু মুসা আশআরী রা. বললেন-(إنه لا يستطيع ( أن يدخل المسجد -‘না, তার পক্ষে (মসজিদে ঢোকা) সম্ভব নয়’। হযরত ওমর রা. জিজ্ঞেস করলেন- أجنب هو؟ – ‘সে কি অপবিত্র (যে, মিসজিদে প্রবেশ করতে পারবে না)’? হযরত আবু মুসা আশআরী রা. বললেন- لا بل نصراني – ‘না, বরং সে একজন খৃষ্টান’। হযরত আবু মুসা আশআরী রা. বললেন: একথা শুনে হযরত ওমর রা. আমাকে ধমক দিলেন এবং পিঠে একটি চাপড় দিয়ে বললেন- أخرجوه -‘তাকে (এই দায়িত্ব থেকে) বহিষ্কার করো’। এরপর তেলাওয়াত করলেনيَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَىٰ أَوْلِيَاءَ  – ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা ইহুদী ও খৃষ্টানদেরকে তোমাদের বন্ধু হিসেবে গ্রহন করো না। [তাফসীরে ইবনে আবি হাতেম- ৪/১১৫৬, হাদিস ৬৫১০; সুনানুল কুবরা, বাইহাকী-১০/১২৭, ৩২৮; শুয়াবুল ইমান, বাইহাকী, হাদিস ৯৩৮৪; তাফসীরে ইবনে কাসির-৫/১৩৬ ; মুসনাদে ফারুক, ইবনে কাসির-২/৪৯৪; আদ্দুররুল মানসুর, ইমাম সুয়ূতী- ২/৫১৬]

ইমাম ইবনে জারীর আত-তাবারী (মৃ: ৩১০ হি:) রহ. লিখেছেন- والصواب من القول في ذلك عندنا أن يقال: إن الله تعالى ذكره نهى المؤمنين جميعا أن يتخذوا اليهود والنصارى أنصارا وحلفاء على أهل الإيمان بالله ورسوله وأخبر أنه من اتخذهم نصيرا وحليفا ووليا من دون الله ورسوله والمؤمنين فإنه منهم في التحزب على الله وعلى رسوله والمؤمنين وأن الله ورسوله منه بريئان……….ومن يتولَّ اليهود والنصارى دون المؤمنين، فإنه منهم. يقول: فإن من تولاهم ونصرَهم على المؤمنين، فهو من أهل دينهم وملتهم، فإنه لا يتولى متولً أحدًا إلا وهو به وبدينه وما هو عليه راضٍ . وإذا رضيه ورضي دينَه، فقد عادى ما خالفه وسَخِطه، وصار حكُمه حُكمَه  – “এ ব্যাপারে যেসকল কওল রয়েছে তার মধ্যে আমাদের কাছে সবচেয়ে গ্রহনযোগ্য কওল হল তাঁদেরটা যাঁরা বলেছেন, এখানে আল্লাহ তাআলা সকল মুমিনদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন তারা যেন আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের উপর ইমান আনায়নকারী (মুমিন মুসলমান)দের বিপক্ষে ইহুদী ও খৃষ্টানদেরকে তাদের সাহায্যকারী মিত্র না বানায়। তিনি আরো জানাচ্ছেন যে, যে ব্যাক্তি আল্লাহ, তাঁর রাসুল সা. এবং মুমিনদেরকে বাদ দিয়ে ইহুদী ও খৃষ্টানদেরকে সাহায্যকারী মিত্র ও অভিভাবক বন্ধু বানাবে, সেও তাদের সাথে আল্লাহ’র বিরুদ্ধে, তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধে এবং মুমিনদের বিরুদ্ধে অবস্থানকারী হিসেবে গণ্য হবে। আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সা. এরকম ব্যাক্তির দায়িত্ব থেকে মুক্ত।…….যে ব্যাক্তি মুমিনদেরকে বাদ দিয়ে ইহুদী ও খৃষ্টানদেরকে বন্ধু বানায়, সে তাদেরই অন্তর্ভূক্ত। আল্লাহ জানাচ্ছেন যে, যে ব্যাক্তি  ইহুদী ও খৃষ্টানদেরকে মুমিনদের বিরুদ্ধে সাহায্যকারী বন্ধু বানাবে, সে তাদেরই দ্বীন ও মিল্লাতের আহাল (ধারকবাহক) বলে গণ্য হবে। কারণ কেউ যখন কাউকে বন্ধু বানায়, তখন সে সন্তুষ্টচিত্বেই তার বন্ধুর পাশে থাকে, বন্ধু যে চিন্তা বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলে তার উপর সে রাজি থাকে বলেই কেবল তাকে বন্ধু বানায়। আর সে যখন তার বন্ধুর উপর খুশি থাকে এবং বন্ধুর চিন্তা বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গির উপরও খুশি থাকে, তখন তার বন্ধু যা কিছুর বিরোধী করে, যা কিছুর প্রতি ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করে করে, সেটা তার কাছেও (একসময়) স্বাভাবিক হয়ে যায়। (যেন আল্লাহ, তাঁর রাসুল, মুমিন-মুসলমান ও ইসলামী শরীয়তের বিপক্ষে তার বন্ধুর অসন্তোষ ও ক্ষোভকে তখন তার কাছে আর এমন মনে হয় না যে, আমার বন্ধু আমার বিশ্বাসের বিপক্ষে অসন্তোষ ও ক্ষোভ   প্রকাশ করছে)। ফলে তার বন্ধুর উপর (শরীয়তের) যে হুকুম, সেই হুকুম তার উপরও বর্তালো”। [জামেউল বায়ান, ইমাম তাবারী- ৬/২৭৬]


আল্লাহ তাআলা আরো এরশাদ করেন-

 يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا بِطَانَةً مِنْ دُونِكُمْ لَا يَأْلُونَكُمْ خَبَالًا وَدُّوا مَا عَنِتُّمْ قَدْ بَدَتِ الْبَغْضَاءُ مِنْ أَفْوَاهِهِمْ وَمَا تُخْفِي صُدُورُهُمْ أَكْبَرُ قَدْ بَيَّنَّا لَكُمُ الْآيَاتِ إِنْ كُنْتُمْ تَعْقِلُونَ
 ‘হে ইমানদারগণ, তোমরা তোমাদের নিজেদের (মুসলমান) লোকদের ছাড়া অন্য(অমুসলীম) কাউকে তোমাদের অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে গ্রহন করে নিও না। তারা তোমাদের অনিষ্ট সাধনে কোনো সুযোগ হাতছাড়া করে না। তারা কামনা করে যাতে তোমরা সমস্যায় পড়ে যাও। তাদের মুখ থেকেই (তোমাদের প্রতি) তাদের বিদ্বেষ প্রকাশ হয়ে পড়েছে। আর তাদের মনগুলোর ভিতরে (তোমাদের অনিষ্ট সাধনের জন্য) যা লুকিয়ে রয়েছে তা আরো মারাত্মক। বস্তুতঃ আমি আমার আয়াতসমূহকে তোমাদের জন্য সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করে দিচ্ছি যাতে তোমাদের বিবেককে কাজে লাগাতে পারো। [সুরা আল-ইমরান ১১৮]

এই আয়াতে مِنْ دُونِكُمْ – “তোমাদের নিজেদের লোকদের ছাড়া অন্য কাউকে” –দ্বারা মুসলমান ছাড়া অন্য সকল অমুসলীম কাফেরকে অন্তরঙ্গ বন্ধু বানাতে নিষেধ করা হয়েছে। [তাফসীরে খাযেন- ১/৪০৯] কেউ কেউ বলেছেন, এর দ্বারা মুনাফেকরা উদ্দেশ্য। বলাবাহুল্য, মুনাফেকদেরকে অন্তরঙ্গ বন্ধু বানানো নাজায়েয হলে, দালালাতুন্নাস হিসেবে কাফেরদেরকে অন্তরঙ্গ বন্ধু বানানো আরো শক্ত নাজায়েয অপরাধ হবে -এতে কোনোই সন্দেহ নেই। যাহোক, কাফেরদেরকে অন্তরঙ্গ বন্ধু বানানো নাজায়েয হওয়ার ব্যাপারে সকল আইম্মায়ে মুফাসসিরীন, মুজতাহিদীন ও ফুকাহায়ে কেরাম একমত।

ইমাম ইবন আবি হাতেম আর-রাযী (মৃ: ৩২৭ হি:) রহ. সহিহ সনদে হযরত ইবন আবু দাহকান রহ.-এর সূত্রে একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন, তাতে আছে যে, ইবন আবু দাহকান রহ. খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত ওমর ফারুক রা.কে বললেন, এখানে (ইরাকের) হিরাহ অঞ্চলের এক (খৃষ্টান) লোক আছে, সে ভাল লিখতে পারে; স্মরণশক্তিও ভাল। আপনি তাকে আপনার লেখক হিসেবে নিয়োগ দিতে পারেন। একথা শুনে হযরত ওমর রা. বললেন– قد اتخذت إذا بطانة من دون المؤمنين  – “আমি যদি তাকে নিয়োগ দেই, তাহলে-তো আমি মুমিনদেরকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধু বানিয়ে নিলাম” ! [তায়সীরে ইবনে আবি হাতেম, হাদিস ৪০৩৮; আল-মুসান্নাফ, ইবনে আবি শায়বা, হাদিস ২৫৮৬৩; আহকামুল কুরআন, ইমাম জাসসাস- ২/৪৬; তাফসীরে ইবনে কাসির- ১/৩৭৬; আদ্দুররুল মানসুর, সুয়ূতী-২/৬৬]

ইমাম কুরতুবী (মৃ: ৬৭১ হি:) রহ. লিখেছেন– نَهى الله المؤمنين بِهذه الآية أن يَتَّخِذوا من الكُفَّار واليهود وأهل الأهواء دُخلاءَ ووُلَجاء يُفاوضونهم في الآراء، ويُسندون إليهم أمورَهم – “আল্লাহ তাআলা এই আয়াতে কারিমার দ্বারা মুমিনদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, তারা যেন যুক্তিতর্কের আড়ালে কাফেরদের মধ্যে কাউকে -চাই সে ইহূদী হোক, প্রবৃত্তির আজ্ঞাবহ কাফের হোক, দ্বীন বহির্ভূত কেউ হোক -তাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহন করে না নেয় এবং তাদের কাছে কোনো পদ অর্পণ করে না দেয়”। [জামেউ আহকামিল কুরআন, কুরতুবী- ৩/৭৮]

আল্লাহ তাআলা আরো এরশাদ করেন-

لَّا يَتَّخِذِ الْمُؤْمِنُونَ الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ مِن دُونِ الْمُؤْمِنِينَ ۖ وَمَن يَفْعَلْ ذَٰلِكَ فَلَيْسَ مِنَ اللَّهِ فِي شَيْءٍ إِلَّا أَن تَتَّقُوا مِنْهُمْ تُقَاةً
‘মুমিনরা মুমিনগণকে বাদ দিয়ে কাফেরদেরকে ওলী ( অভিভাবক ও বন্ধু) হিসেবে গ্রহন করবে না’। আর যে (মুমিন) এমন কাজ করবে, তাতে (তার সাথে) আল্লাহ’র কোনো সম্পর্ক অবশিষ্ট থাকবে না। তবে তাদের থেকে (কোনো ক্ষতির) আশংকা থেকে থাকলে (নিছক বাহ্যিকভাবে বন্ধুত্ব আছে মর্মে আচরণ প্রকাশ করলে সেটা ভিন্ন কথা) [সূরা আল-ইমরান ২৮]

এই আয়াতে কারিমার ব্যাখ্যায় হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-বলেছেন– نهى الله سبحانه المؤمنين أن يُلاطفوا الكفار أو يتخذوهم وليجةً من دون المؤمنين، إلا أن يكون الكفارُ عليهم ظاهرين، فيظهرون لهم اللُّطف، ويخالفونهم في الدين. وذلك قوله: ” إلا أن تتقوا منهم تقاةً – “আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা মুমিনদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, তারা যেন মুমিনদেরকে বাদ দিয়ে কাফেরদের সাথে হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে না তোলে কিংবা তাদেরকে অন্তরঙ্গ বন্ধু না বানায়। তাবে যদি কাফেররা তাদের উপর (শক্তি ও ক্ষমতার) প্রভাব বিস্তার করে রাখে, তাহলে (বিপদের আশংকার ক্ষেত্রে) বাহ্যিকভাবে তাদের সাথে হৃদ্যতা প্রদর্শন করা যেতে পারে। কিন্তু দ্বীনের প্রশ্নে তাদের বিপক্ষে অবস্থান করতে হবে। আর আল্লাহ তাআলা এজন্যই বলেছেন- إِلَّا أَن تَتَّقُوا مِنْهُمْ تُقَاةً তবে তাদের থেকে (কোনো ক্ষতির) আশংকা থেকে থাকলে (নিছক বাহ্যিকভাবে বন্ধুত্ব আছে মর্মে আচরণ প্রকাশ করলে সেটা ভিন্ন কথা)”। [জামেউল বায়ান, ইমাম তাবারী, আছার ৬৮২৫]

হযরত হাসান বসরী রহ. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন- صاحبهم في الدنيا معروفًا، الرحم وغيره. فأما في الدّين فلا – “পার্থিব ব্যাপারে কাফেরদের সাথে মেলামেশা করা, তাদের সাথে আত্বীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা ইত্যাদি বিষয়-তো জানাই আছে (যে, এগুলো বিশেষ সীমা পর্যন্ত জায়েয)। কিন্তু যদি দ্বীনের প্রশ্ন আসে তাহলে -নাহ্ (তাদেরকে অভিভাবকের মতো বন্ধু বানানো জায়েয নেই)”। [জামেউল বায়ান, ইমাম তাবারী, আছার ৬৮৩৮]

হযরত কাতাদাহ রহ. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন– نهى الله المؤمنين أن يوادّوا الكفار أو يتولَّوْهم دون المؤمنين….لا يحل لمؤمن أن يتخذ كافرًا وليًّا في دينه – “আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, তারা যেন মুমিনদেরকে বাদ দিয়ে কাফেরদের প্রতি ঝুঁকে না পড়ে কিংবা তাদেরকে অভিভাবক ও বন্ধু না বানায়। মুমিনদের জন্য এটা হালাল নয় যে, তারা দ্বীন ইসলামরে প্রশ্নে কোনো কাফেরকে তার অভিভাবক ও বন্ধু বানিয়ে নিবে”। [জামেউল বায়ান, ইমাম তাবারী, আছার ৬৮৩৬, ৬৮৩৭]


ইমাম ইবনে জারীর আত-তাবারী (মৃ: ৩১০ হি:) রহ. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন وهذا نهيٌ من الله عز وجل المؤمنين أن يتخذوا الكفارَ أعوانًا وأنصارًا وظهورًا……….ومعنى ذلك: لا تتخذوا، أيها المؤمنون، الكفارَ ظهرًا وأنصارًا توالونهم على دينهم، وتظاهرونهم على المسلمين من دون المؤمنين…..فإنه مَنْ يفعل ذلك =” فَلَيْسَ مِنَ اللَّهِ فِي شَيْءٍ “، يعني بذلك: فقد برئ من الله وبرئ الله منه، بارتداده عن دينه ودخوله في الكفر =” إِلَّا أَن تَتَّقُوا مِنْهُمْ تُقَاةً “، إلا أن تكونوا في سلطانهم فتخافوهم على أنفسكم، فتظهروا لهم الولاية بألسنتكم، وتضمروا لهم العداوة، ولا تشايعوهم على ما هم عليه من الكفر، ولا تعينوهم على مُسلم بفعل – “এখানে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকেই মুমিনদের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তারা যেন কাফেরদেরকে তাদের সাহায্য-সহায়তাকারী পৃষ্ঠপোষক বানাবে না।……..এর অর্থ, হে মুমিনগণ ! তোমরা দ্বীন ইসলামের প্রশ্নে মুমিনদেরকে বাদ দিয়ে কাফেরদেরকে তোমাদের সাহায্যকারী পৃষ্ঠপোষক ও অভিভাবক বানিয়ে নিবে না এবং তাদেরকে মুসলমানদের উপর প্রভাবশালী হতে সাহায্য করবে না। যে একাজ করবে فَلَيْسَ مِنَ اللَّهِ فِي شَيْءٍ (তার সাথে) আল্লাহ’র কোনো সম্পর্ক অবশিষ্ট থাকবে না। অর্থাৎ, এর দ্বারা সে আল্লাহ তাআলা থেকে দায়িত্বমুক্ত এবং আল্লাহ তাআলা তার থেকে দায়িত্বমুক্ত হয়ে যাবেনকারণ সে দ্বীন থেকে বেড় হয়ে গিয়ে কুফরের ভিতরে প্রবেশ করেছে।  إِلَّا أَن تَتَّقُوا مِنْهُمْ تُقَاةً  –তবে তাদের থেকে (কোনো ক্ষতির) আশংকা থেকে থাকলে (নিছক বাহ্যিকভাবে বন্ধুত্ব আছে মর্মে আচরণ প্রকাশ করলে সেটা ভিন্ন কথা- অর্থাৎ যদি সে কাফেরদের শক্তি ও ক্ষমতার অধীনে থাকে এবং নিজের জীবনের প্রশ্নে তাদের থেকে কোনো আশংকা বোধ করে, তাহলে বাহ্যিক ভাবে তাদের অভিভাবকত্ব-রীতির প্রতি সম্মতি প্রকাশ করা এবং তাদের সাথে শত্রুতার বিষয়টিকে চেঁপে যাওয়ার অবকাশ রয়েছে বটে, কিন্তু তারা যে কুফরএর উপর রয়েছে তাদের সেই কুফরের সাথে শরীক হতে পারবে না এবং মুসলীমদের বিপক্ষে তাদেরকে কোনো সাহায্য সহযোগীতা করতে পারবে না”। [জামেউল বায়ান, ইমাম তাবারী-৬/৩১৩] বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য আরো দেখুন [তাফসীরে ইবনে কাসির-১/৩৩৭; আল-ওয়াসিত-১/৪২৭; মাআলিমুত তানজিল-২/২৬; তাফসীরে কাশশাফ, জামাখশারী-১/৩৫১; আল-বাহরুল মুহিত, আবু হাইয়ান-২/৪৪০]
 
উপরোক্ত এজাতীয় আয়াতসমূহে বর্ণিত সুস্পষ্ট হুকুম ও সুন্নাহ’র আলোকে সকল মুহাক্কিক মুজতাহিদীন ফুকাহায়ে কেরামের এব্যাপারে ইজমা রয়েছে যেকোনো কাফের ব্যাক্তিকে মুসলমানদের উপর ওলী (অভিভাবক) বানানো সর্বসম্মতভাবে হারাম
 
ইমাম ইবনুল কায়্যেম আল-যাওজীয়্যাহ (মৃ: ৭৫১ হি:) রহ. ইমাম ইবনুল মুনযীরের সূত্রে বলেছেন– أجمع كلُّ مَن يُحفَظ عنه مِن أهل العلم أنَّ الكافر لا ولايةَ له على المسلم بِحال – “এব্যাপারে আলেমগণের ইজমা রয়েছে যে,  কোনো কাফেরকে কোনো অবস্থাতেই কোনো মুসলমানের উপর ওলী (অভিভাবক) বানানো জায়েয নেই” ’[আহকামু আহলিজ জিম্মাহ, ইবনুল কাইয়্যেম- ২/৭৮৭]

ইমাম ইবনে আবেদীন শামী (মৃ: ১২৫২ হি:) রহ. লিখেছেন- لا ولاية لكافر على مسلم، لا ولاية عامة ولا خاصة – “কোনো কাফেরের জন্য কোনো মুসলমানের উপর অভিভাবক (ওলী) হওয়ার -চাই তা ব্যাপক অভিভাবকত্ব হোক বা বিশেষভাবে নির্দিষ্ট অভিভাবকত্ব হোক- তার কোনো সুযোগ নেই”[ইবনে আবেদীন-৩/২৮১]

যেহেতেু ইসলামী রাষ্ট্রের খলিফা হলেন মুসলমানদের উপর নিযুক্ত সবচাইতে বড় ওলী (অভিভাবক), এজন্য কোনো কাফেরকে মুসলমানদের উপর খলিফা’ (خليفة) বানানো সর্বসম্মতভাবে হারাম। 

মাসআলা: একইভাবে যেহেতেু ইসলামী রাষ্ট্রের আওতাধীন যে কোনো শহর বা অঞ্চলে খলিফা দ্বারা নিযুক্ত আমেল(عامل/প্রশাসকও) মুসলমানদের উপর নিযুক্ত একজন ওলী (অভিভাবক), এজন্য কোনো কাফের ব্যাক্তিকে মুসলমানদের উপর আমেল বানানোও নাজায়েযবর্তমান জামানায় বিভিন্ন অঞ্চলে মেয়র, ডিসি, চেয়াম্যান, কাউন্সিলর ইত্যাদি নামের যে পদগুলো সৃষ্টি করা হয়েছে, ওগুলোও আমেল-এর মধ্যে গণ্য এবং পদগুলো ওলী বা অভিভাবকত্বের পদ বিধায়, ইসলামী রাষ্ট্রে খলিফার জন্য এই পদগুলোতে কোনো অমুসলীম কাফেরকে নিয়োগ দেয়া জয়েয নয়।

ইমাম হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী (মৃ: ৮৫২ হি:) রহ. লিখেছেন– إنَّ الإمام “ينعزل بالكفر إجماعًا، فيَجِب على كلِّ مسلمٍ القيامُ في ذلك، فمَن قوي على ذلك فله الثَّواب، ومَن داهن فعليه الإثم، ومن عَجز وجبَتْ عليه الهجرةُ من تلك الأرض – “ইমাম (খলিফা) তার কুফরীর কারণে সর্বসম্মতভাবে (খিলাফতের দায়িত্ব থেকে) বহিষ্কৃত হয়ে যায়। তখন (কোনো যোগ্য মুসলীমকে) ইমাম বানানো সকল মুলমানের জন্য ওয়াজিব হয়ে যায়। যে একাজে শক্তি যোগাবে তার জন্য রয়েছে সওয়াব, আর যে ব্যাক্তি একাজে অবহেলা করবে সে গোনহগার হবে। আর যে ব্যাক্তি অপারগ হবে, তার জন্য ওয়াজিব হল, সে ওই জমিন থেকে হিজরত করে (অন্য কোথাও) চলে যাওয়া”[ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার- ১৩/১২৩]

ইমাম কাজী আয়ায রহ. বলেছেন-أجمع العلماءُ على أنَّ الإمامة لا تنعقد لكافر “এব্যাপারে আলেমগণের ইজমা রয়েছে যে, কাফেরকে ইমাম (খলিফা) বানানো জায়েয নেই”। [শারহু সহীহ মুসলীম, ইমাম নববী- ৬/৩১৫]

ইমাম আবু মুহাম্মাদ হুসাঈন বিন মাসউদ বগভী (মৃ: ৫১৬ হি:) রহ. লিখেছেন–  اتفقوا على أن المرأة لا تصلح أن تكون إماماً ولا قاضياً – “এব্যাপারে আলেমগণ একমত যে, নারীকে (মুসলমানদের) ইমাম (খলিফা/শাসক) বানানোও জায়েয নেই, কাজী (বিচারক) বানানোওজায়েয নেই” [শারহুস সুন্নাহ, ইমাম বাগাভী- ১০/৭৭]

ইমাম আলাউদ্দিন আল-কাসানী (মৃ: ৫৮৭ হি:) বলেছেন– لا يجوز أن يثبت للكافر ولاية السلطنة على المسلمين – “মুসলমানদের উপর কোনো কাফের ব্যাক্তিকে রাষ্ট্রীয় অভিভাবক (খলিফা/ইমাম/রাষ্ট্রপ্রধান) বানানো জায়েয নয়” [বাদায়েউস সানায়ে, কাসানী- ২/২০৫]

ইমাম ইবনে আবেদীন শামী (মৃ: ১২৫২ হি:) রহ. লিখেছেন- لا ولاية لكافر على مسلم، لا ولاية عامة ولا خاصة، فلا يكون الكافر إماما على المسلمين، ولا قاضيا عليهم، ولا شاهدا، ولا ولاية له في زواج مسلمة، ولا حضانة له لمسلم، ولا يكون وليا عليه ولا وصيا – “কোনো কাফেরের জন্য কোনো মুসলমানের উপর অভিভাবক (ওলী) হওয়ার -চাই তা ব্যাপক অভিভাবকত্ব হোক বা বিশেষভাবে নির্দিষ্ট অভিভাবকত্ব হোক- তার কোনো সুযোগ নেই। তাই কোনো কাফেরকে মুসলমানদের উপর ইমাম (খলিফা) বানানো জায়েয নেই, কাজী (বিচারক) বানানো জায়েয নেই, সাক্ষ্যি বানানো জায়েয নেই। এমনিভাবে তাকে কোনো মুসলীম নারীর বিয়ের ওলী (অভিভাবক) বানানোও জায়েয নেই”[ইবনে আবেদীন-৩/২৮১]

ইমাম ইবনে হাযাম আল-আন্দুলুসী (মৃ: ৪৫৬ হি:) রহ. লিখেছেন– واتَّفقوا أنَّ الإمامة لا تجوز لامرأةٍ ولا لكافر – “এব্যাপারে আলেমগণ একমত যে, নারীকে এবং কাফেরকে (মুসলমানদের) ইমাম (খলিফা/রাষ্ট্রপ্রধান) বানানো জায়েয নেই… ” [মারাতিবুল ইজমা, ইবনে হাযাম পৃঃ ২০৮]

ইমাম গাযালী (মৃ: ৫০৫ হি:) রহ. লিখেছেন-  أما الكافر فممنوع لما فيه من السلطنة وعز الاحتكام، والكافر ذليل فلا يستحق أن ينال عز التحكم على المسلم – “কোনো কাফের ব্যাক্তিকে প্রশাসকের আসনে বসানো ও শাসন করতে দেয়া নাজায়েয। কাফের ব্যাক্তি থাকবে (মুসলমানদের) অধিনস্ত হিসেবে। মুসলমানদের উপর শাসন ও খবরদারী করার মতো সম্মান লাভের কোনো হক্ব কোনো  কাফেরের নেই”। [ইহইয়াউ উলুমিদ্দিন, ইমাম গাযালী- ২/৩১৫]

বিস্তারিত জানতে আরো দেখা যেতে পারেন– আল-মিহাজ, ইমাম নববী-১/১৩১; আল মুদাওয়ানাতুল কুবরা-২/১১৬; বিদায়াতুল মুজতাহিদ, ইবনে রুশদ-২/১৪; তুহফাতুল মুহতাজ ফি শারহিল মিনহাজ, রমলী-৩৮/১৮১; আল-মুগনী, ইবনে কুদামা-৯/৩৭৭; আল-ইকনা, মাকদিসী-২/২০৫; আল-কাফী-২/৫২২; কাশফুল ক্বিনা-৫/২৬-৫৭; মুগনীল মুহতাজ-৩/২০৯; আল-ওয়াসিত-৫/৭৪; আল মুবদা’, ইবনুল মুফলেহ-৭/৩৪; আল লুবাব-২/১২; আদ্দুররুল মুখতার-১/৫৯০; তাকমিলাতু হাশিয়া রাদ্দুল মুহতার-১/৬১; আল ইনসাফ, মাওয়ার্দী-৮/৭৮; মানহুল জালিল শারহু মুখতাসারিল খালিল-১৭/২৮৫ প্রভৃতি কিতাব।

এজন্য ইসলামী রাষ্ট্রের খলিফা হওয়ার সর্বপ্রধান ও নূন্যতম যোগ্যতাগুণ হল ‘মুসলিম হওয়া’। আর মুসলীম সমাজের উপর ফরয হল, তারা তাদের রাষ্ট্রের খলিফা (রাষ্ট্রপ্রধান) হিসেবে মনোনয়ন ও নির্বাচন করবে একজন মুসলমানকে (যিনি এই পদের সবচাইতে উপযুক্ত)এটাই হবে খিলাফতের মতো আমানতকে তার উপযুক্ত ব্যাক্তির হাতে সোপর্দ করা। যেমন আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন- إِنَّ اللهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا – “নিশ্চই আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন, তোমরা আমানতগুলিকে তার (স্ব-স্ব) আহাল (তথা উপযুক্ত ব্যাক্তি)র কাছে সোপর্দ করে দিবে”[সুরা নিসা ৫৮]

জানা জরুরী যে, মুসলিম বলতে নুন্যতম পক্ষে এমন ব্যক্তিকে বুঝায়, যিনি দ্বীন ইসলামের মৌলিক আকিদায় বিশ্বাসী এবং তার থেকে এমন কোনো বিশ্বাস, কথা বা কাজের বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি, যা থেকে তার কুফরী প্রমাণিত হয়ে সে দ্বীন ইসলাম থেকে বেরিয়ে যায়। এটাই হল মুসলীম বিবেচিত হওয়ার নূন্যতম বৈশিষ্টগুণ। এই বৈশিষ্টগুণ যার মধ্যে পাওয়া যাবে না, তার মধ্যে অন্য আর যত ভাল বৈশিষ্টগুণই থাক না কেনো তাকে মুসলমানদের খলিফা বানানো হারাম। যে ব্যাক্তি (শরীয়ত সম্মত কোনো ওজর ছাড়া) খিলাফতের এই আমানতকে কোনো কাফের মুরতাদের হাতে সোপর্দ করবে, সে হবে এই আমানতের এমন এক খিয়ানতকারী যে আল্লাহ তাআলার সাথে, তাঁর রাসুল সা.-এর সাথে, মুসলমানদের সাথে এবং দ্বীন ইসলামের সাথে প্রকাশ্য বিশ্বাসঘাতকতা (মিরজাফরী) করেছে।

ইসলামী শরীয়তের এই ইজমায়ী মাসআলার বিপরীতে-

(ক) ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে যেহেতু রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে ধর্মীয় বিধানকে ১০০% মুক্ত করায় বিশ্বাস (ইমান) রাখা অত্যাবশ্যক (ফরয) শর্ত, তাই রাষ্ট্রপ্রধান নিয়োগ দানের ক্ষেত্রেও ইসলাম ধর্মের এই ‘মুসলীম’ হওয়ার শর্তটিকে রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে ১০০% মুক্ত করায় বিশ্বাস (ইমান) রাখা তাদের মতে অত্যাবশ্যক (ফরয)।

(খ) ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে যেহেতু  রাষ্ট্রযন্ত্রে কোনো ধর্মীয় বিধিবিধানকে টেনে আনা ১০০% নিষিদ্ধ (হারাম), তাই রাষ্ট্রপ্রধান নিয়োগ দানের ক্ষেত্রেও ইসলাম ধর্মের এই ‘মুসলীম’ হওয়ার শর্তটিকে রাষ্ট্রযন্ত্রে টেনে আনাও তাদের মতে ১০০% নিষিদ্ধ (হারাম)।

(গ) ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ যেহেতু বিশ্বাস করে- যে ব্যাক্তি ধর্মীয় বিধিবিধানকে রাষ্ট্রব্যাবস্থায় টেনে আনায় বিশ্বাসী সে আদপে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদেই বিশ্বাসী নয় বরং অস্বীকারকারী (কাফের), তাই যে ব্যাক্তি রাষ্ট্রপ্রধান নিয়োগ দানের ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্মের এই ‘মুসলীম’ হওয়ার শর্তটিকে রাষ্ট্রযন্ত্রে টেনে আনায় বিশ্বাসী, তাদের মতে সেও আদপে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে বিশ্বাসীই নয় বরং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে অস্বীকারকারী (কাফের)।

(ঘ) উপরোক্ত এই ৩টি পয়েন্টের এব্যাপারে খাঁটি ধর্মনিরপেক্ষবাদীদেরর ইজমা (ঐকমত) রয়েছে।

এবারে বিবেক থাকলে বিচার করে দেখুন, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা কোন্ পথের পথিক !!!!

(খ) খলিফা (রাষ্ট্রপ্রধান) হবেন একজন পুরুষ

কুরআন-সুন্নাহর সুস্পষ্ট দলিলাদির ভিত্তিতে এব্যাপারে পূর্বাপর সকল মুহাক্কেক ওলামায়ে কেরামের ইজমা রয়েছে যে, ইসলামী রাষ্ট্রের খলিফা (রাষ্ট্রপ্রধান) হওয়ার একটি অন্যতম শর্ত হল  পুরুষ হওয়া, এবং কোনো নারীর জন্য এ পদ গ্রহন করা কিংবা মুসলমানদের দ্বারা তাকে এ পদে অধিষ্ঠিত করানো দুটোই সমভাবে নাজায়েয

তার আগে, প্রতিটি মুসলমানের একথাটি তার মস্তিষ্কে গেঁথে নেয়া জুরুরী যে, ‘রাষ্ট্রপ্রধান বা খলিফা’র পদ গ্রহন করা এবং ইসলামী শরীয়ত মোতাবেক রাষ্ট্র পরিচালনা করাটা – অহংকার বা ফুটানী প্রদর্শনের ক্ষেত্র নয় মোটেও, বরং এটা নবুওতের পর সব থেকে বড় ও অতীব ভারী এমন এক আমানত, যার প্রতিটি পদক্ষেপে খেয়ানত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, যার পরিণতিতে দুনিয়া ও আখেরাতে লজ্জা ও জিল্লতীর সম্ভাব্যতাই অধিক।

হাসান রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, আব্দুর রহমান বিন ছামুরাহ রা. বলেন- قَالَ لِي النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يَا عَبْدَ الرَّحْمَنِ بْنَ سَمُرَةَ ، لاَ تَسْأَلِ الإِمَارَةَ ، فَإِنَّكَ إِنْ أُعْطِيتَهَا عَنْ مَسْأَلَةٍ وُكِلْتَ إِلَيْهَا ، وَإِنْ أُعْطِيتَهَا عَنْ غَيْرِ مَسْأَلَةٍ أُعِنْتَ عَلَيْهَا  . رواه البخاري في صحيحه , كتاب الأحكام , باب من لم يسأل الإمارة أعانه الله عليها : ٩/٦٣ رقم ٧١٤٦ – “(একদিন) নবী ﷺ আমাকে বললেন: ‘হে আব্দুর রহমান বিন ছামুরাহ! তুমি (কখনো মন থেকে) ইমারাত (শাসন-ক্ষমতা) চেও না। কারণ তোমার চাওয়ার প্রেক্ষিতে যদি সেটা তোমাকে দেয়া হয়, তাহলে তোমার কাছেই ওটির দায়দায়িত্ব (সোপর্দ করে) দেয়া হবে। আর তুমি না চাওয়া সত্ত্বেও যদি সেটা তোমাকে দেয়া হয়, তাহলে ওব্যাপারে (আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে) তোমাকে সাহায্য করা হবে”। [সহিহ বুখারী- ৯/৬৩ হাদিস ৭১৪৬; সহিহ মুসলীম- ৩/৪৫৬ হাদিস ১৬৫২; মুসনাদে আহম- ৫/৬২; মুসনাদে আবু আউআনাহ- ৪/৩৭৭ হাদিস ৭০১১; সুনানুল কুবরা, ইমাম বাইহাকী- ১০/১৭১ হাদিস ২০২৪৬]

আবু হুরায়রাহ রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেছেন- إِنَّكُمْ سَتَحْرِصُونَ عَلَى الإِمَارَةِ ، وَسَتَكُونُ نَدَامَةً يَوْمَ القِيَامَةِ. رواه البخاري في صحيحه , كتاب الأحكام , باب ما يكره من الحرص على الإمارة : ٩/٦٣ رقم ٧١٤٨ – “(আমার পর) অচিরেই (এমন জামানা আসবে, যখন দেখা যাবে) তোমরা (মুসলমানরা) ইমারাত (শাসন ক্ষমতা)’র জন্য লালচি হয়ে উঠবে। আর অচিরেই কেয়ামতের দিন (এই শাসন ক্ষমতা) লজ্জা ও পরিতাপ(-এর কারণ) হবে”। [সহিহ বুখারী- ৯/৬৩ হাদিস ৭১৪৮; সহিহ ইবনে হিব্বান- ১০/৩৩৪; মুসনাদে আহমদ- ২/৪৭৬; সুনানে নাসায়ী- ৮/২২৫ হাদিস ৫৩৮৫; মুসনাদে আব্দুল্লাহ বিন মুবারক- ১/১৬৪ হাদিস ২৬৮]

ইবনু হুজাইরাহ আল-আকবার রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, আবু যর রা. বলেন- قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَلاَ تَسْتَعْمِلُنِي قَالَ فَضَرَبَ بِيَدِهِ عَلَى مَنْكِبِي ثُمَّ قَالَ ‏ “‏ يَا أَبَا ذَرٍّ إِنَّكَ ضَعِيفٌ وَإِنَّهَا أَمَانَةٌ وَإِنَّهَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ خِزْىٌ وَنَدَامَةٌ إِلاَّ مَنْ أَخَذَهَا بِحَقِّهَا وَأَدَّى الَّذِي عَلَيْهِ فِيهَا . أخرجه مسلم في صحيحه , كتاب الإمارة , باب كراهة الإمارة بغير ضرورة : ٣/١٤٥٧ رقم ١٨٢٥ – “আমি জিজ্ঞেস করলাম: ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ ! আমাকে কি (রাষ্ট্রের) কোনো প্রশাসনিক দায়িত্ব দিবেন না’? আবু যর বলেন: ‘(একথা শুনে) তিঁনি তাঁর হাত দিয়ে আমার কাঁধে চাপরালেন, তারপর বললেন: ‘হে আবু যর ! (আমার বিবেচনায়) নিশ্চই তুমি (এ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে একজন) দুর্বল (ব্যাক্তি)। আর নিশ্চই এ(ই রাষ্ট্রীয় পদ)টি হল একটি আমানত (যার খেয়ানত হবার সম্ভাবনা তোমার মতো দুর্বল ব্যাক্তির জন্য সার্বক্ষনিক লেগে থাকবে। তুমি যথাসম্ভব এসব থেকে নিজকে বাঁচিয়ে রাখো)। আর নিশ্চই কিয়ামতের দিন এটি লজ্জা ও পরিতাপের কারণ হবে। ব্যাতিক্রম (হবে কেবল তার জন্য) যে ব্যাক্তি এটাকে তার হক্ব সহকারে গ্রহন করতে পারবে এবং (এ বাবদ) তার উপর যে দায়িত্ব বর্তায় সেটা সে (যথাযথ ভাবে) আদায় করতে পারবে”। [সহিহ মুসলীম- ৩/১৪৫৭ হাদিস ১৮২৫]

সাথে একথাও মস্তিষ্কে গেঁথে নেয়া জুরুরী যে, আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনের  বহু স্থানে ‘তাকওয়া’র প্রশ্নে পুরুষ ও নারী‘র মাঝে কোনো পার্থক্য করেননি, বরং তাদের দুজন-এর মধ্যে যে-ই আল্লাহ তাআলার অধিক অনুগত হবে ও তাঁকে ভয় করে চলবে, সে-ই আখেরাতে আল্লাহ তাআলা’র অধিক নৈকট্য লাভ করবে -চাই সে পুরুষ হোক বা নারী। যেমন, আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন– مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَىٰ وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَاةً طَيِّبَةً ۖ وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُمْ بِأَحْسَنِ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ -“যে ব্যাক্তিই মুমিন থাকা অবস্থায় নেক কাজ করবে -চাই সে পুরুষ হোক বা নারী, তাকে আমরা অবশ্যই হায়াতে তৈয়্যেবা’র জীবন যাপন করাবো এবং তারা যেসকল উৎকৃষ্ট কাজ করবে সে অনুযায়ী তাদেরকে আমরা অবশ্যই পুরুষ্কারে পুরষ্কৃত করবো”[সুরা নাহল ৯৭] উদাহরণ হিসেবে বলা যায় হযরত ঈসা আ.-এর সম্মানিত মাতা হযরত মারিয়াম রা. একজন নারী হয়েও আল্লাহর যে নৈকট্য লোভ করেছেন, আপনি-আমি পুরুষ হয়েও কি সেই নৈকট্যেল ধারের কাছেও যেতে পারবো? এথেকে বোঝা গেল, নিছক পুরুষ বা নারী হওয়াতে লাভ/ক্ষতির কিছু নেই, লাভ/ক্ষতি নির্ভর করবে ‘তাকওয়া’র উপরে। কিন্তু দুনিয়ার মানব জীবনকে সুষ্ঠু ও সুন্দর করে গড়ে তোলা ও আল্লাহ’র দ্বীন অনুয়ায়ী চলার জন্য আল্লাহ তাআলা তাঁর মহাজ্ঞান ও হিকমতের আলোকে পুরুষদের কাঁধে এমন কিছু বিশেষ দায়িত্ব বেশি চাপিয়ে দিয়েছেন, যেসকল দায়িত্বের বোঝা থেকে তিনি নারীদেরকে পরিত্রান দিয়েছেন। এদিকে ইশারা করেই আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন وَلِلرِّجَالِ عَلَيْهِنَّ دَرَجَةٌ – ‘আর (দায়িত্বের প্রশ্নে) নারীদের উপর পুরুষের জন্য (নির্ধারিত রয়েছে) একটি (অতিরিক্ত দরজা) স্তর’ [সুরা বাকারাহ ২২৮] তিঁনি আরো এরশাদ করেন الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ بِمَا فَضَّلَ اللَّهُ بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ وَبِمَا أَنْفَقُوا مِنْ أَمْوَالِهِمْ – ‘পুরুষ ব্যাক্তি নারী’র উপর কাউআম (ওলী ও অভিভাবক)। এটা এজন্য যে, আল্লাহ তাদের কতককে কতকের উপর মর্যাদা দিয়েছেন এবং এজন্য যে, তারা (পুরুষরা আল্লাহ’র পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত যে, নারীদের ভরনপোষনের জন্য তারা উপার্জনকৃত) অর্থকড়ির মধ্য থেকে ব্যায় করবে’ [সুরা নিসা ৩৪] 

নিঃসন্দেহে, রাসুলল্লাহ -এর হাদিস ও সুন্নাহ হল কুরআন কারিমের ব্যাখ্যা। এক্ষেত্রে সহিহ বুখারী’র নিম্নোক্ত এই মাশহুর হাদিসটি মূলতঃ উপরোক্ত সুরা বাকারাহ’র ২২৮ নং আয়াত এবং সুরা নিসার ৩৪ নং আয়াতেরই ব্যাখ্যা। হাসান রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, (সাহাবী) আবু বকরাহ রা. বর্ণনা করেন–  لَمَّا بَلَغَ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَنَّ أَهْلَ فَارِسَ قَدْ مَلَّكُوا عَلَيْهِمْ بِنْتَ كِسْرَى قَالَ : لَنْ يُفْلِحَ قَوْمٌ وَلَّوْا أَمْرَهُمُ امْرَأَةً . رواه البخاري في الصحيح , كتاب المغازي , باب كتاب النبي صلى الله عليه وسلم إلى كسرى وقيصر: رقم ٤١٦٣ রাসুলুল্লাহ -এর কাছে যখন এই খবর পৌছলো যে, পারস্যবাসীরা তাদের উপর কিসরার কন্যাকে রাষ্ট্রপ্রধান বানিয়ে রেখেছে, তখন তিঁনি এরশাদ করলেন-‘ওই জাতি কক্ষোনই সফলতা অর্জন করতে পারবে না, যে জাতি কোনো নারীকে তাদের বিষয় গুলোর ওলী (অভিভাবক) বানিয়ে দেয়”। [সহীহ বুখারী– ৪/১৬১০ হাদীস ৪১৬৩; মুসনাদে আহমাদ- ৫/৪৩, ৪৭, ৫১; জামে’ তিরমিজী- ৪/৫২৮, হাদিস ২২৬২; সুনানে নাসায়ী-৮/২২৭, হাদিস ৫৩৮৮; মুসনাদে বাযযার, হাদিস ৩৬৮৫; আল মুস্তাদরাকে হাকিম- ৩/১১৯]

হাদিসটিতে দেখা যায়, রাসুলুল্লাহ-কে – পারস্যের মতো একটি কাফের অধ্যুসিত রাষ্ট্রের একজন কাফের নারী-রাষ্ট্রপ্রধান সম্পর্কে সংবাদ দেয়া হয়েছিল, কিন্তু তিঁনি অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত কথায় একটি মূলনীতি বলে দিয়েছেন, আর সেটা হল, নারীকে কোনো রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান বানানো হলেই উপরোক্ত হাদিসে বর্ণিত ধমকীটি প্রযোগ্য হবে – চাই সে কোনো কাফের নারী হোক বা মুসলীম নারী হোক । 

জমহুর মুহাক্কিক মুহাদ্দিসীন ও ফুকাহায়ে কেরাম বলেছেন যে, উপরোক্ত হাদিসে বর্ণিত وَلَّوْا أَمْرَهُمُ امْرَأَةً – ‘কোনো নারীকে তাদের বিষয়গুলোর ওলী (অভিভাবক) বানিয়ে দেয়’ -এই বাক্যের মধ্যে امرهم ( তাদের বিষয়গুলো) কথাটি  عام  (আম/ব্যাপক অর্থবোধক)অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা দ্বীন-দুনিয়ার যে যে ব্যাপারে ওলী (অভিভাবক) হওয়ার দায়িত্ব পুরুষের উপরে চাপিয়ে দিয়েছেন, তার সব কয়টি ক্ষেত্রেই হাদিসের এই ধমকী প্রযোজ্য এবং ওর সবগুলোর ক্ষেত্রেই নারীকে ওলী (অভিভাবক) বানানো নাজায়েয ও গুনাহ’র কাজ। যেমন, ইমাম হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী (মৃ: ৮৫২ হি:) রহ. লিখেছেন- قال الخطابي : في الحديث أن المرأة لا تلي الإمارة ولا القضاء ، وفيه أنها لا تزوج نفسها ، ولا تلي العقد على غيرها  – “(ইমাম) খাত্তাবী বলেন- ‘হাদিসটিতে (এই মাসআলা অন্তর্ভূক্ত) রয়েছে যে, নারী -না রাষ্ট্রের ওলী (অভিভাবক) হতে পারবে, আর না পারবে বিচারকার্যের (ওলী/অভিভাবক হতে)। এই হাদিসে (এ মাসআলাও অন্তর্ভূক্ত) রয়েছে যে, নারী(’র মধ্যে ওলী/অভিভাবক হওয়ার শরয়ী যোগ্যতা বিদ্যমান না থাকায় সে) না (পুরুষের মতো নিজেই নিজের ওলী হয়ে নিজেই) নিজকে বিয়ে দিতে পারে, আর না সে- অন্য কারোর (বিয়ের) আক্বদ (সম্পন্ন করা)র ওলী (অভিভাবক) হতে পার[ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার- ৭/৭৩৪]

ইমাম মুহাম্মাদ শাওকানী (মৃ: ১২৫৫ হি:) রহ. লিখেছেন فيه دليل على أن المرأة ليست من أهل الولايات، ولا يحل لقوم توليتها؛ لأن تجنب الأمر الموجب لعدم الفلاح واجب – “এই হাদিসটি একথারই দলিল যে,  নারী (শরীয়তের দৃষ্টিতে) ‘ওলী’ হওয়ার উপযোগী ব্যাক্তিদের মধ্যে গণ্য নয়। কোনো জাতি বা গোষ্ঠির জন্যও একাজ হালাল নয় যে, তারা কোনো নারীকে তাদের ওলী (অভিভাবক) বানিয়ে নিবে। [নাইলুল আওতার, শাওকানী- ৩/১৩৭]

আর বলাই বাহুল্য, রাষ্ট্রপ্রধান হলেন রাষ্ট্রের সকল নাগরীকের উপর নিয়োগকৃত সবচাইতে বড় ওলী (অভিভাবক)। হাদিসেও শাসককে ‘ওলী (অভিভাবক)’ শব্দযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, হযরত আওফ বিন মালেক রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেন- خِيَارُ أَئِمَّتِكُمْ الَّذِينَ تُحِبُّونَهُمْ وَيُحِبُّونَكُمْ، وَيُصَلُّونَ عَلَيْكُمْ وَتُصَلُّونَ عَلَيْهِمْ، وَشِرَارُ أَئِمَّتِكُمْ الَّذِينَ تُبْغِضُونَهُمْ وَيُبْغِضُونَكُمْ، وَتَلْعَنُونَهُمْ وَيَلْعَنُونَكُمْ ” قِيلَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ أَفَلَا نُنَابِذُهُمْ بِالسَّيْفِ ؟ فَقَالَ:” لَا مَا أَقَامُوا فِيكُمْ الصَّلَاةَ، وَإِذَا رَأَيْتُمْ مِنْ وُلَاتِكُمْ شَيْئًا تَكْرَهُونَهُ، فَاكْرَهُوا عَمَلَهُ، وَلَا تَنْزِعُوا يَدًا مِنْ طَاعَةٍ. رواه مسلم, كتاب الإمارة, باب خيار الأئمة وشرارهم: رقم ١٨٥٥ -‘তোমাদের ওই ইমাম (খলিফা/আমীর)গণই উত্তম, যাদেরকে তোমরা ভালবাসো এবং তারাও তোমাদেরকে ভালবাসে, তারা তোমাদের জন্য দোয়া করে এবং তোমরাও তাদের জন্য দোয়া করো। আর তোমাদের ওই ইমাম (রাষ্ট্রপ্রধান)গণই নিকৃষ্ট যাদেরকে তোমারা ঘৃনা করো এবং তারাও তোমাদেরকে ঘৃনা করে, তোমরা তাদেরকে অভিশাপ দেও, তারাও তোমাদেরকে অভিশাপ দেয়। বলা হল: ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমরা কি তাদের বিরুদ্ধে তরবারী নিয়ে বিদ্রোহ করবো না? তিনি বললেন: না, যাবৎ তারা তোমাদের মাঝে নামায আদায় করে। আর তোমরা যখন তোমাদের (রাষ্ট্রের) ওলী’দের (অভিভাবক’দের/শাসক’দের মাঝে এমন) কিছু দেখতে পাও যা তোমরা অপছন্দ করো, তখন তোমরা তাদের ওই কাজটিকে অপছন্দ করবে, কিন্তু (তাদের) অনুগত্য থেকে (তোমাদের) হাত’কে সরিয়ে নিবে না’। [সহিহ মুসলীম – ৬/২৪ হাদিস ১৮৫৫; সুনানে দারেমী, হাদিস ২৮৩৫; মু’জামুল কাবীর, তাবরাণী- ১৮/৬২]  সুতরাং, কোনো নারীকে কোনো নিম্ন স্তরের ওলী (অভিভাবক) বানানোই যেখানে জায়েয নেই, সেখানে তো নারীকে রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান বানানো আরো শক্ত নাজায়েয কাজ হবে।

ইমাম আবু বকর ইবনুল আরাবী (মৃ: ৫৪৩ হি:) রহ লিখেছেন– هذا نص في أن المرأة لا تكون خليفة ولا خلاف فيه – এই হাদিসটি একথার দলিল যে, কোনো নারী খলিফা হতে পারবে না। আর (আহলে হ্বক ওলামায়ে কেরাম থেকে) এর বিপরীত কোনো মত নেই” [আহকামুল কুরআন, ইবনুল আরাবী- ৩/৪৮৪]

উপরোক্ত ‘নারী নেতৃত্ব নাজায়েয’ হওয়ার ব্যাপারে এই হাদিসটিই কেবল দলিল নয়, বরং এছাড়া আরো বহু দলিল রয়েছে, যার সবগুলো ব্যাখ্যা সহ উল্লেখ করা এই ক্ষুদ্র পরিসরে মোটেও সম্ভব নয়, কারণ তাতে পাঠকের মনোযোগ আমাদের মূল আলোচনা থেকে অন্যত্র সরে যেতে পারে। (আল্লাহ’র তৌফিক হলে পৃথক ভাবে  দলিল ও ব্যাখ্যা সহ এব্যাপারে আলোচনা পেশ করার ইচ্ছা রইলো)। এখানে শুধু কয়েকটি পয়েন্ট নিয়ে অতি সংক্ষেপে কিছু আলোচনা করেই ক্ষ্যান্ত হচ্ছি।

(১) এই মাসআলাহ’টি কে না জানে যে, মুসলমানদের বিয়ের আক্বদ্ শুদ্ধ হওয়ার জন্য ‘ওলী’ (অভিভাবক) শামিল হওয়া একটি অন্যতম পূর্ব শর্ত। সহিহ হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেন– لا نكاح إلا بولي -‘ওলী ছাড়া বিয়ে হয় না’। [সুনানে তিরমিজী, হাদিস ১১০১; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ২০৮৫; মুসনাদে আহমাদ-৪/৪১৩; সহীহ ইবনে হিব্বান-৯/৩৮৬] আবার বহু হাদিস একথার দলিল যে, পুরুষ ব্যাক্তি তার নিজের বিয়েতে নিজেই ‘বিয়ের ওলী (অভিবাবক)’ হতে পারে-তো বটেই, এর সাথে সাথে সে অন্য কোনো নারী বা পুরুষ উভয়ের বিয়ের অলী (অভিভাবক)ও হতে পারে, কিন্তু কোনো নারী কারোরই বিয়ের ওলী (অভিভাবক) হতে পারবে না – না নিজের, না অন্যের। যেমন এক হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেন– لا تزوج المرأة المرأة، ولا تزوج المرأة نفسها – “(ইসলামে) কোনো নারী অন্য কোনো নারীকে বিয়ে দিতে পারে না এবং কোনো নারী নিজেও নিজের বিয়ে দিতে পারে না”। [সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস ১৮৮২] এ থেকে প্রমাণিত হয়, ‘ বিয়ের ‘ওলী (অভিভাবক)’ হওয়ার জন্য পুরুষহওয়া অন্যতম একটি পূর্ব শর্ত ।

যেখানে বিয়ের মতো একটি পারিবারিক ব্যাপারেও নারীকে শরয়ী ওলী (অভিভাবক) বানানো জায়েয রাখা হয়নি, সেখানে দালালাতুন্নাস হিসেবে নারীকে রাষ্ট্রের মতো এত বিরাট ব্যাপারে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ওলী (অভিভাবক) তথা খলিফা বা রাষ্ট্রপ্রধান বানানো যে আরো শক্ত নাজায়েয গোনাহ’র কাজ হবে – তা সহজেই অনুমেয়। আর এটা নিছক অনুমান বা কিয়াস নয়। কারণ, যে নারীর নিকট-আত্বীয়ের মধ্যে কোনো ওলী (অভিভাবক) পাওয়া যায় না, তার বিয়ের আক্বদ্ শুদ্ধ হওয়ার জন্য খোদ্ রাসুলুল্লাহ -ই মুসলমানদের খলিফা বা রাষ্ট্রপ্রধানকেই তার ওলী (অভিভাবক) হওয়ার দায়িত্ব দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেন– فالسلطان ولي من لا ولي له -‘সেক্ষেত্রে যার কোনো ওলী নেই, সুলতানই হবে তার ওলী’। [সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ২০৮৩; সহীহ ইবনে হিব্বান-৩/৩৮৬; মুজামে আউসাত, ইমাম ত্বাবরাণী-৪/২৮২; মুসনাদে আহমাদ-১/২৫০; মুসনাদে আবু ইয়া’লা-৮/১৯১; সুনানে দ্বারাকুতনী-৩/২২৫; সুনানে বাইহাকী- ৭/১২৫] এই হাদিস থেকেও প্রমাণিত হল, নারী নিজের বা অন্যের -কারোর বিয়ের ওলী হতে পারে না বলেই সেই দায়িত্ব রাষ্ট্রের সুলতান (রাষ্ট্রপ্রধান/খলিফা/আমীর)-এর হাতে দেয়া হয়েছে, বিধায় মুসলমানদের রাষ্ট্রপ্রধান (খলিফা/আমীর/সুলতান/ইমাম) হওয়ার জন্য ‘পুরুষ’ হওয়া অন্যতম একটি পূর্ব শর্ত। বিষয়টি একদম পরিষ্কার। 

(২)  যেমনিভাবে কোনো সালাত (নামায)-এর জামাতে উপস্থিত মুক্তাদিদের নেতা হয়ে যিনি নামায পড়ান তাকে যেমন ইমাম বলা হয়, তেমনি রাষ্ট্রের খলিফাকেও ‘ইমাম’ বলা হয়ে থাকে। হাদিসের বহু স্থানে খলিফা’কে ইমাম বলেও সম্মোধন করা হয়েছে। যেমন, হযরত আবু হুরায়রাহ রা. থেকে সহিহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেছেন- سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمْ اللَّهُ فِي ظِلِّهِ يَوْمَ لا ظِلَّ إِلا ظِلُّهُ : الإِمَامُ الْعَادِلُ …. أخرجه البخاري في صحيحه : ٢/١٤٣ رقم ٦٦٠ و ١٣٢٣ و ٦٨٠٦ ; و مسلم صحيحه : ٧/١٦٩ برقم ١٧١٢; النسائي في سننه: رقم ٥٣٩٥; الترمذي في سننه: رقم ٢٣٩١ – ‘সাত (প্রকারের ব্যাক্তি রয়েছে), যাদেরকে আল্লাহ তাআলা এমন এক দিনে তাঁর (রহমতের) ছায়ার ভিতরে ছায়াচ্ছন্ন রাখবেন, যে দিন তাঁর (রহমতের) ছায়া ব্যতীত কোনো ছায়া থাকবে না। (তাদের একজন হল) الإِمَامُ الْعَادِل – ‘ইনসাফগার-ন্যায়পরায়ন ইমাম’…..’। [সহিহ বুখারী- ২/১৪৩ হাদিস ৬৬০, ১৩২৩, ৬৮০৬ মুসলীম-৭/১৬৯ হাদিস ১৭১২; সুনানে নাসায়ী, হাদিস ৫৩৯৫; সুনানে তিরমিযী, হাদিস ২৩৯১]

আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে সহিহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেছেন- كُلُّكُمْ رَاعٍ وَمَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ: فَالإِمَامُ رَاعٍ، وَهْوَ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالرَّجُلُ فِي أَهْلِهِ رَاعٍ، وَهْوَ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ. … . رواه البخاري في الصحيح: رقم ٢٥٥٨ و ٥١٨٨ و ٧١٣٨; ابن حبان في الصحيح: ١٠/٣٤٢ رقم ٤٤٩٠ اسناده صحيح على شرط مسلم ; أبو عوانة في المسند: ٤/٣٨٤ رقم ٧٠٣٩ ; و البزار فى مسنده: رقم ٥٣٧٧; أحمد فى مسنده: رقم ٥٩٩٠  – ‘তোমাদের প্রত্যেকে (কারো না কারো উপরে) তত্ত্বাবধায়ক (স্বরূপ) এবং (প্রত্যেককে) তার তত্ত্বাবধায়নী-দায়িত্ব সম্পর্কে (কেয়ামতের দিন) জিজ্ঞাসীত হবে। সুতরাং ইমাম (খলীফা/আমীর/সুলতান) হল (তার অধীনস্থ নাগরীকদের উপর নিযুক্ত একজন) তত্ত্বাবধায়ক এবং সে তার তত্ত্বাবধায়নী-দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসীত হবে। (একজন) পুরুষ হল তার পরিবারের ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক (স্বরূপ) এবং সে তার তত্ত্বাবধায়নী-দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসীত হবে।….. ’। [সহিহ বুখারী, হাদিস ২৫৫৮, ৫১৮৮, ৭১৩৮; সহিহ ইবনে হিব্বান– ১০/৩৪২ হাদিস ৪৪৯০; মুসনাদে আবু আউয়ানাহ– ৪/৩৮৪ হাদিস ৭০৩৯; মুসনাদে বাযযার, হাদিস ৫৩৭৭; মুসনাদে আহমদ, হাদিস ৫৯৯০]

এজন্য মুহাক্কিক ফুকাহায়ে কেরাম তাঁদের ফিকহে’র গ্রন্থাবলিতে নামাযের ইমামতীকে امامت صغرى (ইমামতে ছুগরা/ছোট ইমামত) এবং রাষ্ট্রীয় ইমামতী’কে امامت كبرى (ইমামতে কুবরা/বড় ইমামত) বলে অবিহিত করে থাকেন।

পৃথিবীর কোনো অঞ্চলে মুসলমানদের পক্ষে ‘ইসলামী খিলাফত’ ব্যবস্থা কায়েম করা সম্ভব হলে, সেখানে নামাযযাকাত এবং আমর বিল মা’রুফ (ভাল কাজের আদেশ) ও নাহি আনিল মুনকার (ভাল কাজের আদেশ)-এর রাষ্ট্রীয় বন্দোবস্থ সহ তা কায়েম রাখা এবং মুসলমানদের জন্য এর নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করা খলিফার উপর ফরয দায়িত্ব। যেমন আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-

الَّذِينَ إِن مَّكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنكَرِ
(তারা হল আমার সেই সকল মুমিন বান্দা) যারা (এমন গুণের অধিকারী যে,) যদি তাদেরকে জমিনে শাসন-কর্তৃত্ব (খিলাফত) দেয়া হয়, তাহলে তারা নামায কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, মা’রুফ (সৎ বিষয়)-এর নির্দেশ দেয় এবং মুনকার (নাজায়েয ও হারাম বিষয়) থেকে নিষেধ করে”। [সূরা আল-হাজ্জ ৪১]

এই আয়াত থেকে প্রতিয়মান হয় যে, খলিফার সর্ব প্রথম ফরয দায়িত্ব হল, নামায কায়েম করা। দ্বীন ইসলামে নামাযের ইমামতীর সাথে খলিফার কতটুকু অতপ্রত সম্পর্ক জড়িত -তা এই ঘটনা থেকেই অনুমান করা যায় যে, রাসুলুল্লাহ তাঁর মৃত্যুপূর্বে মারাত্মক অসুস্থতার কারণে মসজিদে এসে জামাতের ইমামতী করতে অপারগ হয়ে পড়লে তাঁর স্থলে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা.কে নামাজের ইমামতী করার হুকুম দেন। সাহাবয়ে কেরাম এ থেকেই বুঝে নিয়েছিলেন যে, হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা.কে امامت صغرى (ইমামতে ছুগরা/ছোট ইমামত)-এর দায়িত্ব দেয়ার দ্বারা  রাসুলুল্লাহ -এর ইশারা ছিল امامت كبرى (ইমামতে কুবরা/বড় ইমামত) তথা ইসলামী খিলাফতেরও সবচাইতে হক্বদার হলেন হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা.। ইব্রাহিম বিন আব্দির রহমান বিন আউফ রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত আলী রা. বলেন  وَ إِنَّا نَرَى أَبَا بَكْرٍ أَحَقَّ النَّاسِ بِهَا بَعْدَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، إِنَّهُ لِصَاحِبُ الْغَارِ ، وَثَانِيَ اثْنَيْنِ ، وَإِنَّا لَنَعْلَمُ بِشَرَفِهِ وَكِبَرِهِ ، وَلَقَدْ أَمَرَهُ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِالصَّلاَةِ بِالنَّاسِ وَهُوَ حَيٌّ . رواه الحاكم في المستدرك : ٣/٧٠ رقم ٤٤٢٢ و قال: هذا حديث صحيح على شرط الشيخين و لم يخرجاه، و وافقه الذهبي – “আমরা মূলত: রাসুলুল্লাহ -এর পর -লোকজনের মধ্যে আবু বকরকেই এর (তথা খিলাফতের) সবচাইতে বেশি হক্বদার হিসেবে গণ্য করতাম। নিশ্চই তিনি (সেই মহান হিজরতের সময় রাসুলুল্লাহ -এর) ‘সাহেবুল গার’ (গুহার সাথী), (সেই) দুইজনের দ্বিতীয়জন (যাঁদের প্রশংসাসুচক উল্লেখ খোদ কুরআনে এসেছে)। আর আমরা তাঁর শারাফত ও শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে অবশ্যই (খুব ভালো ভাবে) জ্ঞাত আছি। আর (তিঁনি খিলাফতের সবচাইতে যোগ্য ব্যাক্তি হবেননাই-বা কেনো, খোদ্) রাসুলুল্লাহ -তো জীবিত থাকতেই তাঁকে নামাযে লোকদের ইমামতী করার নির্দেশ দিয়েছিলেন”। [মুসতাদরাকে হাকীম- ৩/৭৪, হাদিস ৪৪২২]

রাসুলুল্লাহ থেকে নিয়ে খুলাফায়ে রাশেদীন রা.-এর জামানায় বরং তার আরো কয়েক যুগ পর্যন্ত এই আমল মুতাওয়াতির ছিল যে, মুসলমানদের যে মজমায় স্বয়ং ‘খলিফা’ উপস্থিত থাকতেন সেখানে খলিফাই নামাযের ইমামতী করতেন। আর ফুকাহায়ে কেরাম এব্যাপারে একমত যে, নামাযে ইমামতী করার প্রথম হক্বদার হলেন ‘খলিফা’।

আখেরী জামানায় যখন ইমাম মাহদী রা. মুসলীম জাহানের খলিফা হবেন, তখন (বিভিন্ন হাদিসের ভাষ্য মতে) সিরিয়ার দামেশক হবে তাঁর রাজধানী এবং তিনি হবেন দামেশক জামে মসজীদের ইমাম, যাঁর পিছনে হযরত ঈসা ইবনে মারইয়াম আ. মুক্তাদি হয়ে নামায আদায় করবেন। যাবের বিন আব্দুল্লাহ রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেন-  لاَ تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي يُقَاتِلُونَ عَلَى الْحَقِّ ظَاهِرِينَ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ ، قَالَ فَيَنْزِلُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ صلى الله عليه وسلم فَيَقُولُ أَمِيرُهُمْ تَعَالَ صَلِّ لَنَا ‏.‏ فَيَقُولُ لاَ ‏،‏ إِنَّ بَعْضَكُمْ عَلَى بَعْضٍ أُمَرَاءُ ‏.‏ تَكْرِمَةَ اللَّهِ هَذِهِ الأُمَّةَ ‏.‏ رواه مسلم في الصحيح, كتاب الإيمان , باب نُزُولِ عِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ حَاكِمًا بِشَرِيعَةِ نَبِيِّنَا مُحَمَّدٍ صلى الله عليه وسلم : ١/١٣٧ رقم ١٥٦ ; و أحمد في مسنده : ٣/٣٨٤ اسناده صحيح – “আমার উম্মতের একটি গোষ্ঠি কেয়ামত পর্যন্ত সর্বদা সত্যের উপর বিরাজমান (থেকে) জিহাদ করতে থাকবে’। তিনি বলেন: ‘পরে (শেষ জামানার মুসলমানদের) মাঝে ঈসা ইবনে মারইয়াম (আসমান থেকে পূণরায়) নাজিল হবেন। পরে তাদের আমীর (আল-মাহদী তাঁকে) বলবেন: ‘(হে ঈসা ইবনে মারইয়াম আ. !) আসুন, (ইমাম হয়ে) আমাদেরকে নামায পড়ান’। তখন তিনি বলবেন: ‘না, নিশ্চই তোমাদের (মুসলমানদেরই) কেউ তোমাদের কতকের উপর আমীর হবে -(এটা) এই উম্মাহকে আল্লাহ’র (দেয়া বিশেষ) সম্মাননা। (আপনি মুসলিম জাহানের ইমাম/আমীর/খলিফা, আপনিই নামাযের ইমামতি করুন, আমি আপনার পিছনে ইক্বতেদা করছি)”। [সহীহ মুসলীম- ১/১৩৭, হাদিস ১৫৬; মুসনাদে আহমদ- ৩/৩৮৪; মুসনাদে হারেছ: সহিহাহ, আলবানী-৫/২৭৬ হাদিস ২২৩৬]

নামাযের জামাতের ক্ষেত্রে খলিফার ইমামতীর অধিকারটি শরীয়তে এতই অধিক গুরুত্ব রাখে যে, ‘জানাযা নামাযে’র ইমামতীর ক্ষেত্রেও ‘খলিফা’-কে মৃতব্যক্তির উত্তরাধিকারদের উপরেও স্থান দেয়া হয়েছে। আর একথাও প্রমাণিত যে, খলিফা যদি মুসলমানদের কোনো জানাযার নামাযে স্বয়ং উপস্থিত থাকেন, তাহলে ইমামতীর সর্ব প্রথম হক্ব তাঁর; এর পরে উত্তরাধিকারদের।

কিন্তু কুরআন সুন্নাহ’র আলোকে এব্যাপারে পূর্বাপর সকল হক্কানী ওলামায়ে কেরামের ইজমা রয়েছে যে, (আর আমার মনে হয় সকল মুসলমােই এই মাসআলাহ জানে যে,) কোনো মুসলিম নারীর জন্যই পুরুষদের নামাযের জামাআতের ইমামতি করা কোনো ভাবেই জায়েয নয় -চাই তা ওয়াক্তিয়া নামাযের ইমামতী হোক বা জানাযার নামাযের ইমামতী।

এ থেকে একথাও পরিষ্কার হয়ে যায় যে, ইসলামী শরীয়তে খিলাফতের সাথে নামাযের ইমামতীর এতই গভীর সম্পর্ক রয়েছে যে, ইসলামে এমন কোনো ‘রাষ্ট্রপ্রধান’-এর কথা কল্পনাও করা যায় না, যিনি কোনো অবস্থাতেই মুসলমানদের নামাযের জামাআতের ইমামতী করার উপযুক্ত বিবেচিত হন না। তাই কোনো নারী তাকওয়া-পরহেজগারী ও পবিত্রতার প্রশ্নে যত উচ্চ মাকামের অধিকারিই হোন না কেনো, যেহেতু শরীয়ত তাকে امامت صغرى (ইমামতে ছুগরা/ছোট ইমামত) তথা নামাযে পুরুষের ইমামতী করার দায়িত্বই সোপর্দ করেনি, সেখানে কি কোরে ভাবতে পারেন যে, ইসলাম امامت كبرى (ইমামতে কুবরা/বড় ইমামত)-এর মতো এত বড় একটি দায়িত্ব কোনো নারীর স্কন্ধে চাপাতে পারে?!!!

(৩) দ্বীন ইসলামে নারীদের থেকে পুরুষদের এমন কিছু অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, যে দায়িত্ব পালনের দায়িত্ব থেকে নারীরা মুক্ত। অর্থাৎ, এগুলো এমন সব দায়দায়িত্ব, যে ক্ষেত্রে কোনো মুসলিম নারী তা আদায় না করলে কিয়ামতের দিন তাকে সে ব্যাপারে জিজ্ঞেসও করা হবে না যে -‘তুমি ওটা কেনো করো নি’। কিন্তু মুসলিম পুরুষদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে – ‘তুমি ওটা কোনো করো নি’। যেমন, একটি সহিহ হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেন- أَلا كُلُّكُمْ رَاعٍ وَ كُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ فَالْأَمِيرُ الَّذِي عَلَى النَّاسِ رَاعٍ وَ هُوَ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ وَ الرَّجُلُ رَاعٍ عَلَى أَهْلِ بَيْتِهِ وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْهُمْ وَ الْمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ عَلَى بَيْتِ بَعْلِهَا وَ وَلَدِهِ وَ هِيَ مَسْئُولَةٌ عَنْهُمْ . رواه الإمام مسلم في صحيحه , كتاب الإمارة » باب فضيلة الإمام العادل وعقوبة الجائر والحث على الرفق بالرعية والنهي عن إدخال المشقة عليهم : رقم ١٨٢٩ – “খুব ভাল করে শোন! তোমদের সকলেই খবরদারীকারী। প্রত্যেককেই তার খবরদারী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। সুতরাং আমীর (খলিফা/রাষ্ট্রপ্রধান/শাসক) হল জনগণের উপর খবরদারীকারী এবং তাকে তার খবরদারী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। এমনিভাবে পুরুষ হল তার গৃহের লোকজন (তথা পরিবার)-এর উপর খবরদারীকারী এবং তাকে তার খবরদারী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। আর নারী হল তার স্বামী ও স্বামীর সন্তানদের উপর খবরদারীকারী এবং তাকে তার খবরদারী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে”। [সহিহ মুসলীম– ৩/৪৬০ হাদিস ১৮২৯; সহিহ বুখারী, হাদিস ৭১৩৮; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ২৯২৮; সুনানে তিরমিযী, হাদিস ১৭০৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস ৫১৬৭]

এই হাদিস একথার পরিষ্কার দলিল যে, আল্লাহ’র শরীয়তে পুরুষই তার গৃহের কর্তা, আর তার স্ত্রী সহ পরিবারের অপরাপর লোকজন তার অধিনস্ত, এবং সে দুনিয়ার জীবনে তাদেরকে আল্লাহ তাআলার হুকুম অনুসারে পরিচালনা করেছে কি না সে ব্যাপারে সে কিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসিত হবে। এ থেকে একথাও প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ’র শরীয়তে নারীকে তার স্বামীর গৃহের কর্তা হবার মতো দায়িত্বটুকু পর্যন্ত সোপর্দ করা হয়নি, বরং এক্ষেত্রে তার উপরে অর্পিত দায়িত্ব হল, স্বামীর হক্ব আদায় করা এবং স্বামীর সন্তানদের দেখভাল করা, পরিচর্যা করা, তাদের দ্বীন শিক্ষা দান ও সুচরিত্র গঠনে সাধ্য মতো অবদান রাখা, আর এই অর্পিত দায়িত্বটুকু সেঠিক মতো  আদায় করেছে কিনা – সে ব্যাপারেই সে কিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসিত হবে।

দেখুন, নারীকে যেখানে স্বামীর গৃহের ভিতরের কর্তা হওয়ার দায়িত্বটুকু পর্যন্ত শরীয়ত দেয় নি, সেখানে গৃহের বাহিরের পরপুরুষে ভরা সমাজ বা রাষ্ট্রের কর্তা (যেমন রাষ্ট্রপ্রধান/প্রশাসক ইত্যাদি) হওয়ার দায়িত শরীয়ত নারীকে কি করে দিতে পারে? 

(৪) পর্দা সম্পর্কিত সম্ভাব্য সকল আয়াত ও হাদিসসমূহ একত্রিত করে পর্যালোচনা করে দেখলে যে বিষয়টি পরিষ্কার দৃষ্টিগোচর হয় তা এই যে, নারীকে এমন লাবনীয় ও আকর্ষনীয় পাত্র হিসেবে অবিহিত করা হয়েছে, যাকে শরীয়তের যে কোনো বিধান মানার ক্ষেত্রে পরপুরুষদের থেকে যথাসম্ভব নিরাপদ দূরত্বে থাকার ব্যাবস্থা করতে চেয়েছে এবং কোনো বাস্তব প্রয়োজন ছাড়া লোকজনের সাধারণ সমাবেশে তার আসাকে কোনো অবস্থাতেই পছন্দ করা হয় নি। যেমন- 

আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-

 يَا نِسَاءَ النَّبِيِّ لَسْتُنَّ كَأَحَدٍ مِّنَ النِّسَاءِ ۚ إِنِ اتَّقَيْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ وَقُلْنَ قَوْلًا مَّعْرُوفًا 
 ‘হে নবীপত্নীগণ! (তোমরা নবীর স্ত্রীর মর্যাদা প্রাপ্ত -এটি যেমন নিয়ামত, তেমনি আমানতও বটে, কাজেই) তোমরা অন্যান্য (সাধারণ মুসলীম) নারীদের মতো নও। (তোমাদের এই মর্যাদা উপকারী হবে তখন) যদি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করে চলো। (তার জন্য শর্ত এটাই। নতুবা শুধুমাত্র নবীপত্নী হওয়াতে কোনো ফায়দা নেই। বরং অবাধ্যতা দ্বিগুণ শাস্তির কারণ হবে এবং অনুগত্য দ্বিগুণ পুরষ্কারের কারণ হবে)। সুতরাং (শরীয়তের হুকুমগুলোতে তোমাদেরকে অনুগত্য করে অবশ্যই চলতে হবে, তবে বিশেষ ভাবে এই হুকুমও তোমাদের দেয়া হল যে, প্রয়োজনের সম্মুখিন হলে পরপুরুষের  সাথে যখন কথাবার্তা বলবে, তখন) তোমরা কোমল কন্ঠে কথা বলবে না। এতে (কন্ঠের কোমলতায়) ওই ব্যাক্তি প্রলুব্ধ হবে যার অন্তরে রোগ রয়েছে। আর (কন্ঠের পর্দা রক্ষা করে এমনভাবে) কথা বলবে, যা হবে (হালাল, প্রয়োজন পরিমান এবং অতিরঞ্জিততা থেকে মুক্ত) যথার্থ কথা”। [সূরা আহযাব ৩২]

وَإِذَا سَأَلْتُمُوهُنَّ مَتَاعًا فَاسْأَلُوهُنَّ مِن وَرَاءِ حِجَابٍ ۚ ذَٰلِكُمْ أَطْهَرُ لِقُلُوبِكُمْ وَقُلُوبِهِنَّ
‘আর (হে মুমিনগণ) তোমরা যখন তাদের (তথা নবীপত্নীগণের) কাছে কিছু চাবে, তখন (তাঁরা তোমাদের দৃষ্টির অন্তরালে হিজাব বা পর্দার ভিতরে অবস্থান করবে, আর তোমরা) তাঁদের কাছে চাবে হিজাবের (বা পর্দার) আড়াল থেকে। (তোমাদের) এ(কাজ)টি তোমাদের মন ও তাঁদের মনকে উত্তমভাবে পাকপবিত্র রাখার কারণ হবে”। [সূরা আহযাব ৫৩]

وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَىٰ ۖ  وَ أَقِمْنَ الصَّلَاةَ وَآتِينَ الزَّكَاةَ وَأَطِعْنَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ ۚ إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا
“(আর হে নবী পরিবারের নারীরা!) তোমরা তোমাদেরকে (নিজদের) গৃহের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখো (নিজকে এতে অভ্যস্থ করে নাও), আর (জরুরী প্রয়োজনে গৃহের বাহিরে যেতে হলে) জাহেলী যুগের সাজসজ্জায় সজ্জিত হয়ে বাহিরে বেড়িও না (বরং মরয়ী পর্দা পালন করে বের হও)। আর তোমরা নামায কায়েম করো, (নিসাবের মালিক হলে) যাকাত আদায় করো এবং (বিনা বাক্যে) আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের অনুগত্য করো। আসলে (তোমাদের প্রভু) আল্লাহ চান, যেন তোমাদের থেকে মন্দ-মলিনতা দূর হয়ে যায় এবং তোমরা পবিত্রের মতো পবিত্রহয়ে যাও -(হে) নবী পরিবারের লোকজন”। [সূরা আহযাব ৩৩]
 
আল্লাহ তাআলা আসলে ‘মুসলীম নারী’দেরকে সমাজে কিরকম জীবনযাপনে অভ্যস্থ দেখতে চান -তার কিছু ঝলক এইসকল আয়াতে কারিমার মধ্যে তুলে ধরা হয়েছে -নবী পরিবারের নারীগণকে নির্দেশ দিয়ে প্রকারন্তে সকল মুসলীম নারীদেরকে নির্দেশ মাধ্যমে। যেমন, ইমাম কুরতুবী (মৃ: ৭৪৫ হি:) রহ. লিখেছেন- معنى هذه الآية الامر بلزوم البيت، وإن كان الخطاب لنساء النبي صلى الله عليه وسلم فقد دخل غيرهن فيه بالمعنى  “এই আয়াতের অর্থ হল, গৃহে থাকাকে অপরিহার্য করে নেয়া। আর এখানে বক্তব্যের মুখ্যপাত্র যদিও নবী-এর স্ত্রীগণ কিন্তু তাঁরা ছাড়াও অপরাপর নারীগণও এ(ই আয়াতে)র অর্থ ও মর্মের মধ্যে শামিল রয়েছে। [আল-জামে লি আহকামিল কুরআন, ইমাম কুরতুবী- ১৪/১৭৯]
 
এই আয়াতে قَرْنَ – “আবদ্ধ হয়ে থাকো” কথাটি অতিব তাৎপর্যপূর্ণ। হিজাজী আরবী ভাষায় এই قَرْنَ শব্দের মূল হল أَقَرُّ যার অর্থ হল ثَبَّتَ – “ভিত্তি গেড়ে নেয়া বা সুদৃঢ় করে নেয়া”। আবার মাদানী আরবী ভাষাতে যেমন বলা হয়ে থাকে- قَرِرْتُ فِي الْمَكَانِ إِذَا أَقَمْتُ فِيهِ – “আমি ঘরের মধ্যে (একবার) পা রাখলে, (সেখান থেকে বেরুবার আর নাম নিই না) সেখানে থাকতে থাকি”। এখানে قَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ “(আর হে নবী পরিবারের নারীরা!) তোমরা তোমাদেরকে (নিজদের) গৃহের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখো (নিজকে এতে অভ্যস্থ করে নাও)”-এর অর্থ হবে – সর্বদা বাড়ির চার-দেয়ালের সীমানায় নিজকে আবদ্ধ করে রাখার উপর যত্ন সহকারে অভ্যস্থ হওয়া। শুধুমাত্র শরীয়ত যেসকল প্রয়োজনে মুসলীম নারীকে গৃহের বাহিরে বের হওয়ার সাধারণ অনুমতি দিয়েছে, সেসকল শরয়ী প্রয়োজন পুরণার্থে গৃহ থেকে বের হওয়ার মধ্যেই নিজকে যথাসম্ভব সীমাবদ্ধ রাখা; অ-প্রয়োজনে গৃহের বাহিরে বের হওয়ার চর্চা না করা”। এর উদাহরণ হতে পারে- যেমন: (গৃহের অভ্যন্তরে ব্যবস্থা না থাকলে)  পেশাব পায়খানার জন্য প্রয়োজনে গৃহের বাইরে বের হওয়া, মাহরাম ও পর্দার শরয়ী শর্ত পূরণ করে হজ্জ, ওমরা, জিহাদ বা সাধারণ কোনো সফরে বের হওয়া, পর্দার শর্ত পূরণ করে মসজিদে নামাযের জামাআতে শরিক হওয়া ইত্যাদি। এদিকে ইংগীত করেই ইমাম ইবনে কাসির (মৃ: ৭৭৪ হি:) রহ. এ আয়াতের তাফসীরে বলেছেন-  أي : الزمن بيوتكن فلا تخرجن لغير حاجة ومن الحوائج الشرعية الصلاة في المسجد بشرطه “এর অর্থ, তোমরা তোমাদের গৃহে অবস্থানকে অপরিহার্য করে নাও, কোনো হাজত (উপযুক্ত প্রয়োজন) ছাড়া (গৃহ থেকে) বের হয়ো না। আর (নারীদের) শরয়ী প্রয়োজন সমূহের মধ্যে -মসজিদের শর্ত রক্ষা করে সালাত আদায়ও- অন্তর্ভূক্ত রয়েছে”। [তাফসীরে ইবনে কাসির- ১/৮৬৭]
 
‘নারীদেরকে তাদের গৃহের অভ্যন্তরে থাকতে অভ্যস্ত হওয়া’র ব্যাপারে এ নির্দেশ দানের পিছনে যে হেকমত লুকায়ীত রয়েছে, তা এই হাদিসে খুব সুন্দর করে ব্যাক্ত করা হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, নবীয়ে করিম এরশাদ করেনالْمَرْأَةُ عَوْرَةٌ ، فَإِذَا خَرَجَتِ اسْتَشْرَفَهَا الشَّيْطَانُ ، وَ أَقْرَبُ مَا تَكُونُ مِنْ رَبِّهَا إِذَا هِيَ فِي قَعْرِ بَيْتِهَا . رواه ابن حبان في الصحيح ( بترتيب ابن بلبان) , كتاب الحظر والإباحة , ذكر الأمر للمرأة بلزوم قعر بيتها لأن ذلك خير لها عند الله جل و علا : ١٢/٤١٣ رقم ٥٥٩٩ و قال شعيب الأرنؤوط : اسناده صحيح علي شرط مسلم ، و ابن خزيمة في الصحيح : ٣/٩٣ رقم ١٦٨٥ و في التوحيد : ١/٤٠ و أشار في المقدمة أنه صح، و الطبراني في المعجم الكبير: ١٠/١٠٨ رقم ١٠١١٥ و في المعجم الأوسط: ٨/١٠١ رقم ٨٠٩٦، و صححه الألباني في السلسة الصحيحة : رقم ٢٦٨٨ و في صحيح الترغيب : رقم ٣٤٤ – “নারী হল আউরাহ (গোপনীয় থাকার পাত্র)। তাই, সে যখন বাহিরে বেড় হয়, তখন (পুরুষদের পদস্খলন ঘটানোর জন্য) শয়তান তার পশ্চাদানুসরণে লেগে যায়। আর নারী তার রবের (সন্তষ্টির) অধিক নিকটবর্তী হয় তখন, যখন সে তার গৃহের অন্দরমহলে থাকে”[সহিহ ইবনে হিব্বান- ১২/৪১৩ হাদিস ৫৫৯৯; সহিহ ইবনে খুযাইমা-৩/৯৩ হাদিস ১৬৮৫; আল-মু’জামুল কাবীর, ইমাম ত্বাবরাণী- ১০/১০৮ হাদিস১০১১৫]
 
এরপর মুসলীম নারীদেরকে শরয়ী প্রয়োজনে গৃহের বাইরে যেতে হলে তাদেরকে না-মাহরাম (পরপুরুষ)-এর সামনে দেহ ও অলঙ্কারের জিনাত (রূপ-সৌন্দর্য ও চাকচিক্ক) প্রদর্শন করে বেপর্দায় বের হতে নিষেধ করা হয়েছে। বলা হয়েছে- وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَىٰ – “…আর (জরুরী প্রয়োজনে গৃহের বাহিরে যেতে হলে) জাহেলী যুগের সাজসজ্জায় সজ্জিত হয়ে বাহিরে বেড়িও না, (বরং শরয়ী পর্দা পালন করে বের হও)”। শরয়ী পর্দা বিধান মেনে যেন বাহিরে গমন করে। বলা বাহুল্য, শরয়ী পর্দা বিধান আর আজকালকার তথাকথিত ফ্যশানমার্কা পর্দার মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য রয়েছে।

অথচ দ্বীন ইসলামের বহু গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের বৈশিষ্ট’টাই এমন যে, ওগুলোকে গৃহ থেকে বেড় হয়ে বাহিরে সম্পাদন করতে হয়, বরং বাহিরে সম্পাদন না করলে ওগুলোর ফরযিয়াত বা ওয়াজিবাত শরীতসম্মতভাবে আদায় করাটাই অসম্ভব। শরীয়ত ওসব ইবাদতকে পালন করার দায়িত্বটা মূলত পুরুষদের স্কন্ধে অর্পণ করেছে, অপরদিকে নারীদেরকে তা থেকে যথাসম্ভব দূরে রাখতে চেয়েছে। নিম্নে কিছু নমুনা পেশ করা হল-

(ক) জুমআ’র নামাযের জামাআতে নারীদের শরিক হওয়া

জুমআর নামায কত ফজীলতপূর্ণ একটি ইবাদত। কিন্তু শরীয়ত এই ইবাদতটি সম্পাদন করার দায়িত্বটা মূলত মুসলীম পুরুষদের স্কন্ধে অর্পণ করেছে, অপরদিকে নারীদেরকে তা থেকে দূরে রেখেছে। যেমন, এক হাদিসে এসেছে যে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেন الْجُمُعَةُ حَقٌّ وَاجِبٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ فِي جَمَاعَةٍ إِلاَّ أَرْبَعَةً عَبْدٌ مَمْلُوكٌ أَوِ امْرَأَةٌ أَوْ صَبِيٌّ أَوْ مَرِيضٌ . رواه أبو داود في سننه , كتاب الصلاة، باب الجمعة للمملوك والمرأة : رقم ١٠٦٧، قال محيى الدين النووي في المجموع : ٤/٤٨٣ : رواه أبو داود باسناد صحيح على شرط البخاري ومسلم إلا أن أبا داود قال طارق بن شهاب رأى النبي صلى الله عليه وسلم ولم يسمع منه شيئا وهذا الذي قاله أبو داود لا يقدح في صحة الحديث لأنه ان ثبت عدم سماعه يكون مرسل صحابي ومرسل الصحابي حجة عند أصحابنا وجميع العلماء الا أبو إسحاق الأسفرايني، و صححه الألباني في صحيح أبي داود: ١/ ٢٩٤، و رواه الحاكم عن طارق بن شهاب عن أبي موسى الأشعري رضي الله عنهما، ١/ ٢٨٨، وقال: هذا حديث صحيح على شرط الشيخين و وافقه الذهبي -“জুমআ(’র নামায) জামাআতে(র সাথে) আদায় করা প্রত্যেক মুসলমানের উপরে ওয়াজিব হক্ব, শুধু চার ব্যাক্তি ব্যতীত- (১) মালিকানাধীন গোলাম, (২) নারী, (৩) শিশু, (৪) রোগী”। [সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১০৬৭; মুসতাদরাকে হাকিম- ১/২৮৮]

(খ) নামাযের জামাতে শরীক হওয়া

সহিহ সূত্রে বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ তাঁর জামানায় নারীদেরকে এমনকি রাত্রি বেলাতেও মসজীদে নববীতে এসে জামাতে নামায পড়ার অনুমতি দিতেন; নিষেধ করতেন না। 

তবে কুরআনের আয়াত ও রাসুলুল্লাহ -এর হাদিসসমূহ সামনে রাখলে দেখা যায়, নববী যুগে মুসলীম নারীদের মসজিদে গমনের এই অনুমতিটিও ছিল অত্যন্ত শক্ত শর্ত সাপেক্ষে। মোটামুটি যে  শর্তগুলো পালন করে মসজিদে যাওয়ার অনুমতি থাকে, সেগুলো হল- (ক) নারীরা পরিপূর্ণ পর্দাসহ গোটা শরীর আবৃত অবস্থায় গৃহ থেকে বের হবে। (খ) ঝুনঝুন আওয়াজকারী অলঙ্কারাদি পরে বের হতে পারবে না। (গ) সাজগোজ করে ও সুগন্ধি মেখে বের হতে পারবে না। (ঘ) পুরুষদের সামন দিয়ে চোর সময় আকর্ষনীয় অঙ্গভঙ্গি করে (ঢং করে) চলতে পারবে না। (ঙ) পুরুষদের ভিড় এড়িয়ে রাস্তার একেবারে একপাশের কিনারা দিয়ে চলালচ করবে। (চ) অপ্রয়োজনে পরপুরুষের সঙ্গে কথা বলতে পারবে না, প্রয়োজনে বলতে হলেও আকর্ষনীয় ও কোমল বাচনভঙ্গি পরিহার করে কথা বলবে। (ছ) সবচেয়ে বড় বিষয় হল, তাদের গৃহ থেকে এ বের হওয়াটা ফিতনার কারণ হতে পারবে না। [বাযলুল মাজহূদ শারহু আবি দাউদ, খলিল আহমদ- ৪/১৬১]

আমরা নির্ভরযোগ্য হাদিসসমূহ থেকে জানতে পারি যে, রাসুলুল্লাহ নারীদেরকে মসজিদে এসে নামায পড়ার অনুমতি দিতেন সত্য, তবে আসলে চাইতেন নারীরা মসজিদে না এসে তাদের নিজ নিজ গৃহেই নামায আদায় করুক। কারণ, একে-তো নারীদের জন্য জামাআতে নামায আদায় করা ওয়াজিব নয়, দ্বিতীয়ত এতে করে নারী-পুরুষ উভয়েই আরো উত্তমভাবে ফিতনা থেকে নিরাপদ দূরুত্বে অবস্থান করতে পারবে। যেমন, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. -এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেন- لاَ تَمْنَعُوا نِسَاءَكُمُ الْمَسَاجِدَ وَبُيُوتُهُنَّ خَيْرٌ لَهُنَّ . رواه أبو داود في سننه , كتاب الصلاة , باب ما جاء في خروج النساء إلى المسجد : رقم ٥٦٧ و صحَّحه الألباني في صحيح سنن أبي داود ، و أحمد في مسنده : ٢/٧٦ رقم ٥٤٦٨ و صحَّح إسناده أحمدُ شاكر في تحقيق المسند: ٧/٢٣٤، و ابن خزيمة : رقم ١٦٨٤، صحَّحه النوويُّ في المجموع: ٤/١٩٧ – “তোমরা তোমাদের (পরিবারের) নারীদেরকে মসজিদে যেতে বাঁধা দিও না। তবে তাদের গৃহই তাদের জন্যে কল্যানজনক”। [সুনানে আবু দাউদ- ১/৪২৬ হাদিস ৫৬৭; মুসনাদে আহমদ- ২/৭৬ হাদিস ৫৪৬৮; সহিহ ইবনে খুযাইমাহ, হাদিস ১৬৮৪; মুসতাদরাকে হাকিম- ১/২০৯] 

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেন- صَلاَةُ الْمَرْأَةِ فِي بَيْتِهَا أَفْضَلُ مِنْ صَلاَتِهَا فِي حُجْرَتِهَا وَصَلاَتُهَا فِي مَخْدَعِهَا أَفْضَلُ مِنْ صَلاَتِهَا فِي بَيْتِهَا . رواه أبو داود في سننه , كتاب الصلاة , باب التشديد في ذلك : رقم ٥٧٠ و قال شعَيب الأرنؤوط: إسناده حسن من أجل عمرو بن عاصم و هو أبو عثمان البصري و باقي رجاله ثقات ، و صحَّحه الألباني في صحيح الترغيب والترهيب : ١/١٣٦   “নারীর (জন্য) তার (বাড়ির) ঘরের ভিতরে আদায়কৃত নামায -তার হুজরায় আদায়কৃত তার নামায হতে অধিক উত্তম। আর তার ঘরের অন্দরমহলে আদায়কৃত তার নামায -তার (বাড়ির) ঘরে আদায়কৃত তার নামায হতে অধিক উত্তম”। [সুনানে আবু দাউদ- ১/৪২৬ হাদিস ৫৭০; আল-মু’জামুল কাবীর, ইমাম ত্বাবরাণী- ৯/৩৪১ হাদিস ৯৪৮২; সহিহ ইবনে খুযাইমাহ, হাদিস; ১৬৮৮; সুনানে তিরমিযী, হাদিস ১১৭৩; মুসতাদরাকে হাকিম- ১/২০৯; সুনানুল কুবরা, ইমাম বাইহাকী- ৩/১৩১]

আব্দুল্লাহ বিন সুওয়াইদ আল-আনসারী রহ. বর্ণনা করেছেন আবু হুমাইদ আস-সায়েদী’র স্ত্রী উম্মে হুমাইদ-এর সূত্রে এভাবে যে-  أَنَّهَا جَاءَتِ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَتْ : يَا رَسُولَ اللَّهِ ، إِنِّي أُحِبُّ الصَّلَاةَ مَعَكَ ، قَالَ : قَدْ عَلِمْتُ أَنَّكِ تُحِبِّينَ الصَّلَاةَ مَعِي ، وَ صَلَاتُكِ فِي بَيْتِكِ خَيْرٌ لَكِ مِنْ صَلَاتِكِ فِي حُجْرَتِكِ ، وَ صَلَاتُكِ فِي حُجْرَتِكِ خَيْرٌ مِنْ صَلَاتِكِ فِي دَارِكِ ، وَصَلَاتُكِ فِي دَارِكِ خَيْرٌ لَكِ مِنْ صَلَاتِكِ فِي مَسْجِدِ قَوْمِكِ ، وَصَلَاتُكِ فِي مَسْجِدِ قَوْمِكِ خَيْرٌ لَكِ مِنْ صَلَاتِكِ فِي مَسْجِدِي ، قَالَ : فَأَمَرَتْ فَبُنِيَ لَهَا مَسْجِدٌ فِي أَقْصَى شَيْءٍ مِنْ بَيْتِهَا وَأَظْلَمِهِ ، فَكَانَتْ تُصَلِّي فِيهِ حَتَّى لَقِيَتِ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ . رواه أحمد في مسنده , باقي مسند الأنصار , حديث أم حميد رضي الله عنها : ٦/٣٧١ رقم ٢٦٥٥٠ قال المحقق: شعيب الأرنؤوط: حديث حسن ، ابن خزيمة في صحيحه , باب اختيار صلاة المرأة في حجرتها على صلاتها في دارها و صلاتها في مسجد : ٣/٩٥ و صححه، و ابن حبان في صحيحه : ٥ / ٥٩٥، و ابن عبد البر في التمهيد : ٢٣/٣٩٨، و الحديث صححه أحمد شاكر في تعليقه على المحلى، صححه الألباني في صحيح الترغيب والترهيب : ١ / ١٣٥،  – “উম্মে হুমায়েদ রা. একবার নবী -এর কাছে এসে বললেন: ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি আপনার সাথে নামায পড়াকে ভালবাসি’। নবী বললেন: আমি জানি তুমি আমার সাথে নামায পড়তে ভালবাসো। তবে তোমার (বাড়ির একেবারে) ঘরের ভিতরে আদায়কৃত নামায তোমার জন্য তোমার (ঘরের বাহির দিকে অবস্থিত) হুজরা (কুঠরী)তে পড়া নামায হতে অধিক উত্তম। আবার তোমার হুজরা (কুঠরী)তে আদায়কৃত তোমার নামায তোমার (বাড়ির) দরজায় পড়া তোমার নামায হতে অধিক উত্তম। তোমার (বাড়ির) আদায়কৃত তোমার নামায তোমার জন্য তোমার লোকালয়ের মসজিদে পড়া তোমার নামায হতে অধিক উত্তম। আর তোমার লোকালয়ের মসজিদে আদায়কৃত তোমার নামায আমার মসজিদে আদায়কৃত তোমার নামায হতে অধিক উত্তম’। (রাবী) বলেন: (রাসুলুল্লাহ -এর এই কথা শোনার পর উম্মে হুমায়েদ রা.) আদেশ দেন, ফলে তার ঘরের মধ্যে সবচাইতে অন্ধকারময় কোনো স্থানে তার জন্য নামাযের জায়গা বানিয়ে দেয়া হয়। পরে আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লা’র সাথে (পরপারে) সাক্ষাত লাভ পর্যন্ত তিনি সেখানেই (নিয়মিত) নামায পড়তে থাকেন”। [মুসনাদে আহমাদ– ৬/৩৭১ হাদিস ২৬৫৫০; সহিহ ইবনে খুযাইমা-৩/৯৫; সহিহ ইবনে হিব্বান- ৫/৫৯৫; আত-তামহিদ, ইবনু আব্দিল বার- ২৩/৩৯৮; সহিহ তারগীব ওয়া তারহীব- ১/১৩৫]

শুধু তাই নয়, রাসুলুল্লাহ -এর পবিত্র জামানায় নারী সাহাবীরা যতটা শালীন ও মার্জিত ভাবে শরয়ী পর্দার যথাসম্ভব হক্ব আদায় করে মসজিদে নববীতে উপস্থিত হতেন এবং পুরুষ সাহাবীদের শেষ কাতারের পিছনের কাতারে জামাআতে নামায আদায় করে চলে যেতেন এবং পরে পুরুষ সাহাবীরা পিছন ফিরতেন, পরে রাসুলুল্লাহ -এর ওফাতের পর উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রা. যখন লক্ষ্য করলেন যে, নবীযুগের সেই শালীন ও মার্জিত পর্দার মধ্যে নারীদের মধ্যে খলৎমলৎ শুরু হয়ে গেছে, তখন তিনি একবার বলেছিলেন لَوْ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَأَى مَا أَحْدَثَ النِّسَاءُ لَمَنَعَهُنَّ الْمَسْجِدَ كَمَا مُنِعَتْ نِسَاءُ بَنِي إِسْرَائِيلَ . رواه مسلم في صحيحه , كتاب الصلاة , باب خروج النساء إلى المساجد إذا لم يترتب عليه فتنة ، : رقم ٤٤٥  – “(এখনকার) নারীরা (শরয়ী পর্দার সাথে) কি (জুলুম) শুরু করেছে সেটা যদি (আজ) রাসুলুল্লাহ দেখতে পেতেন, তাহলে তিঁনি অবশ্যই তাদেরকে মসজিদে যাওয়া নিষেধ করে দিতেন, যেমনিভাবে (পর্দা ব্যবস্থায় খলৎমলৎ করে ফেলার কারণে) বনী-ইসরাঈলদের নারীদেরকে (মসজিদে যাওয়াকে) নিষেধ করে দেয়া হয়েছিল”। [সহিহ মুসলীম– ১/৮২৮ হাদিস ৪৪৫; সহিহ বুখারী, হাদিস ৮৩১; সুনানে আবু দাউদ- ১/৪২৬ হাদিস ৫৬৯

এই বিষয়টি শুধু হযরত আয়েশা রা.-এর নজরে পড়েছিল -শুধু তাই নয়, অনেক সাহাবীও অবস্থার নাজুকতা অনুধাবন করেছিলেন।  আবু আমর শাইবানি বলেন, আমি হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রা.কে দেখেছি, তিনি জুমার দিন মহিলাদেরকে মসজিদ থেকে বের করে দিতেন এবং বলতেন, আপনারা বের হয়ে যান। আপনাদের ঘরই আপনাদের জন্য উত্তম। [আল-মুজামুল কাবির ৯৪৭৫; এই রেওয়ায়েতের সকল বর্ণনাকারী সিকাহ-নির্ভরযোগ্য। মজমাউয যাওয়াইদ, হাইছামী- ২/৩৫] হযরত জুবাইর ইবন আওয়াম রা. তাঁর পরিবারের কোন নারিকে ঈদের জামাতে যেতে দিতেন না। [মুসান্নাফ ইবন আবি শাইবাহ, হাদিস ৫৮৪৬]

(গ) পুরুষদের সহযাত্রী হয়ে জানাযা’র সাথে নারীদের গমন

সাধারণ অবস্থায় এটা প্রত্যেক মুসলমানের হক্ব যে, তার মৃত্যু হলে অপরাপর মুসলমানগণ তার জানাযার সাথে কবরস্থান পর্যন্ত গমন করবে এবং তার দাফন কার্য সম্পাদন করবে। যেমন- আবু হুরায়রাহ রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেনحَقُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ سِتٌّ، قِيلَ: مَا هُنَّ يَا رَسُولَ اللهِ؟ قَالَ: إِذَا لَقِيتَهُ فَسَلِّمْ عَلَيْهِ، وَإِذَا دَعَاكَ فَأَجِبْهُ، وَإِذَا اسْتَنْصَحَكَ فَانْصَحْ لَهُ، وَإِذَا عَطَسَ فَحَمِدَ اللَّهَ فَشَمِّتْهُ، وَإِذَا مَرِضَ فَعُدْهُ، وَإِذَا مَاتَ فَاتَّبِعْهُ . أخرجه البخاري في صحيحه برقم : ١٢٤٠، و مسلم في صحيحه برقم : ٢١٦٢ – “(এক) মুসলীমের উপরে (অপর) মুসলীমের হক্ব (অধিকার) ছয়টি’। জিজ্ঞেস করা হল: ‘ওগুলো কী কী -ইয়া রাসুলাল্লাহ’! তিঁনি বললেন: ‘(১) তুমি যখন তার সাক্ষাত পাবে তাকে সালাম দিবে, (২) সে যখন তোমাকে দাওয়াত দিবে তুমি তা কবুল করবে, (৩) যখন সে তোমার কাছে উপদেশ চাবে তুমি তাকে সদুপদেশ দিবে, (৪) যখন সে হাঁচি দিয়ে আল-হামদুল্লিাহ বলবে তখন তুমিও (ইয়ারহ্বামুকাল্লাহ বলে) তার জবাব দিবে, (৫) সে যখন অসুস্থ্য হবে তুমি তাকে দেখতে যাবে, (৬) সে যখন মাড়া যাবে, তখন তুমি তার (জানাযার) সাথে যাবে”। [সহিহ বুখারী, হাদিস ১২৪০; সহিহ মুসলীম, হাদিস ২১৬২]

আবার, কোনো মুসলমানের জানাযার নামায আদায় করা এবং জানাযার সাথে গিয়ে মাইয়্যেতকে কবরস্থ করার এই আমলের বিরাট সওয়াব রাখা হয়েছে মুসলমানদের জন্য। যেমন, আবু হুরায়রাহ রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেন مَنْ خَرَجَ مَعَ جَنَازَةٍ مِنْ بَيْتِهَا ، وَصَلَّى عَلَيْهَا ، ثُمَّ تَبِعَهَا حَتَّى تُدْفَنَ كَانَ لَهُ قِيرَاطَانِ مِنْ أَجْرٍ ، كُلُّ قِيرَاطٍ مِثْلُ أُحُدٍ ، وَمَنْ صَلَّى عَلَيْهَا ، ثُمَّ رَجَعَ ، كَانَ لَهُ مِنَ الْأَجْرِ مِثْلُ أُحُدٍ . أخرجه مسلم في صحيحه , كتاب الجنائز . باب فضل الصلاة على الجنازة واتباعها : ٢/٦٥٣ رقم ٩٤٥- “(মৃতের) জানাযার সাথে তার ঘর থেকে যে ব্যাক্তি বের হয় এবং জানাযার নামায আদায় করে, এরপর কবরস্থ করা না পর্যন্ত জানাযার সাথে সাথে চলে, তার জন্য রয়েছে দু’ক্বিরাত্ব পুরষ্কার। প্রত্যেক ক্বিরাত্ব উহূদ (পাহাড়)-এর অনুরূপ। আর যে ব্যাক্তি জানাযার নামায আদায় করলো, তারপর (জানাযার সাথে না গিয়ে) ফিরে এলো, তার রয়েছে উহূদ (পাহাড়)-এর অনুরূপপুরষ্কার”। [সহিহ মুসলীম- ২/৬৫৩ হাদিস ৯৪৫]

কিন্তু শরীয়ত মূলত: মুসলমানের জানাযার নামায আদায় থেকে নিয়ে জানাযার খাটলী বহন ও তাকে কবরস্থ করার এই ইবাদতটি সম্পাদন করার দায়িত্বটি মুসলীম পুরুষদের স্কন্ধে অর্পণ করেছে। অপরদিকে মুসলীম নারীদেরকে জানাযার সাথে গমন করতে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন-

আবু সাঈদ খুদরী রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেনإِذَا وُضِعَتِ الْجِنَازَةُ وَاحْتَمَلَهَا الرِّجَالُ عَلَى أَعْنَاقِهِمْ، فَإِنْ كَانَتْ صَالِحَةً قَالَتْ قَدِّمُونِي‏.‏ وَإِنْ كَانَتْ غَيْرَ صَالِحَةٍ قَالَتْ يَا وَيْلَهَا أَيْنَ يَذْهَبُونَ بِهَا يَسْمَعُ صَوْتَهَا كُلُّ شَىْءٍ إِلاَّ الإِنْسَانَ، وَلَوْ سَمِعَهُ صَعِقَ . أخرجه البخاري في صحيحه , كتاب الجنائز , باب حمل الرجال الجنازة دون النساء : رقم ١٣١٤ – “যখন (কোনো মুসলমানের) জানাযা তৈরী হয়ে যায় এবং পুরুষরা সেটাকে তাদের স্কন্ধে বহন করে, তখন যদি সে নেককার হয় তাহলে বলে: ‘আমাকে (তাড়াতাড়ি কবরের দিকে) অগ্রসর করো, আর সে যদি নেককার না হয় তাহলে বলে: ‘হায় ওর দুর্ভোগ! ওকে তোমরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছো’। (তখন) ওর (ওই) আওয়াজকে মানুষ ছাড়া সকল কিছুই শুনতে পায়। মানুষ যদি (তার ওই আওয়াজ) শুনতে পেতো তাহলে অজ্ঞান হয়ে যেতো”। [সহিহ বুখারী- ২/৮৫ হাদিস ১৩১৪] ইমাম বুখারী রহ. এই হাদিসটি বর্ণনা করার ক্ষেত্রে ‘অধ্যায়’-এর শিরনাম দিয়েছেন এভাবে- باب حمل الرجال الجنازة دون النساء – (অধ্যায়: জানাযা বহল করবে পুরষরা; নারীরা নয়)”।

মুআবিয়া বিন সুওয়াইদ বিন মুক্বাররিন রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, বারা বিন আযীব রা. বলেন أَمَرَنَا رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم بِسَبْعٍ وَنَهَانَا عَنْ سَبْعٍ: أَمَرَنَا بِاتِّبَاعِ الْجَنَائِزِ…... أخرجه البخاري في صحيحه , كتاب الجنائز , باب الأمر باتباع الجنائز: ٢/٧١ رقم ١٢٣٩ – “রাসুলুল্লাহ ﷺ আমাদের (পুরুষদের)কে সাতটি বিষয়ের নির্দেশ দিয়েছেন এবং সাতটি বিষয় থেকে নিষেধ করেছেন। তিঁনি আমাদেরকে (মুসলমানদের) জানাযার সাথে যেতে নির্দেশ দিয়েছেন……..”। [সহিহ বুখারী- ২/৭১ হাদিস ১২৩৯; সহিহ মুসলীম, হাদিস ২০৬৬]

মুহাম্মাদ বিন সিরীন রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, উম্মে আতীয়া রা. বলেনكُنَّا نُنْهَى عَنِ اتِّبَاعِ الجَنَائِزِ، وَلَمْ يُعْزَمْ عَلَيْنَا . أخرجه مسلم في صحيحه , كتاب الجنائز, باب نهي النساء عن اتباع الجنائز : رقم ٩٣٨، و البخاري في صحيحه : رقم ١٢٧٨ – “(রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর জামানায়) আমাদের (মুসলীম নারীদের)কে জানাযার সাথে যেতে নিষেধ করা হত। বস্তুত: (জানাযার সাথে যাওয়াকে) আমাদের উপরে অপরিহার্য করে দেয়া হয়নি”। [সহিহ মুসলীম- ২/৬৪৬ হাদিস ৯৩৮; সহীহ বুখারী, হাদিস ১২৭৮]

আবু আব্দুর রহমান আল-হুবুলী রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল আস রা. বলেনقَبَرْنَا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمًا ، فَلَمَّا فَرَغْنَا ، انْصَرَفَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، وَانْصَرَفْنَا مَعَهُ ، فَلَمَّا حَاذَى بَابَهُ ، وَتَوَسَّطَ الطَّرِيقَ ، إِذَا نَحْنُ بِامْرَأَةٍ مُقْبِلَةٍ ، فَلَمَّا دَنَتْ إِذَا هِيَ فَاطِمَةُ ، فَقَالَ لَهَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : مَا أَخْرَجَكِ يَا فَاطِمَةُ مِنْ بَيْتِكِ ؟ قَالَتْ : أَتَيْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَهْلَ هَذَا الْبَيْتِ ، فَعَزَّيْنَا مَيِّتَهُمْ ، فَقَالَ لَهَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : لَعَلَّكِ بَلَغْتِ مَعَهُمُ الْكُدَى ؟ قَالَتْ : مُعَاذَ اللَّهِ ، وَقَدْ سَمِعْتُكَ تَذْكُرُ فِيهَا مَا تَذْكُرُ قَالَ : لَوْ بَلَغْتِ مَعَهُمُ الْكُدَى مَا رَأَيْتِ الْجَنَّةَ حَتَّى يَرَاهَا جَدُّكَ أَبُو أَبِيكِ . رواه ابن حبان في صحيحه , كتاب الجنائز وما يتعلق بها مقدما أو مؤخرا , فصل في زيارة القبور: ٧/٤٥٠ رقم ٣١٧٧، و الحاكم في المستدرك على الصحيحين , كتاب الجنائز, كتاب الجنائز: ١/٧٠٦ رقم ١٤٢٢ و ١٤٢٣ و قال : هذا حديث صحيح على شرط الشيخين ، ولم يخرجاه , و وافقه الذهبي ، و حسنه ظفر احمد في إعلاء السنن: ٨/٣٣٤   – “আমরা একদিন রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর সাথে (এক ব্যাক্তিকে) কবরস্থ করলাম। তারপর আমরা যখন (দাফন সম্পন্ন করে) অবসর হলাম, তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ (সেখান থেকে) এক দিকে ফিরে চলে যেতে থাকলে আমরাও তার সাথে সেদিকে চলতে থাকলাম। যখন তিঁনি তাঁর গৃহের সম্মুখ পানে (যেতে যেতে) রাস্তার মাোমাঝি (কোথাও) ছিলেন, তখন আমাদের ঠিক বিপরীত দিকে এক নারীর সাথে (আমাদের সাক্ষাত ঘটলো)। যখন সে কাছে এলো তখন (জানতে পারলাম যে) তিনি হলেন (রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কন্যা) ফাতেমাহ। তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ তাকে জিজ্ঞেস করলেন: ‘হে ফাতেমা! (তোমার তো এসময় ঘর থেকে বের হবার কথা নয়), কী (এমন ঘটেছে যা) তোমাকে (এই সময়) তোমার ঘর থেকে বের করে এনেছে’? তিনি বললেন: ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি এই মৃতের পরিবারের কাছে এসেছিলাম। আমি (সেখানে গিয়ে) তাদের সাথে (সমবেদনা প্রকাশার্থে তাদের মৃতের জন্য) আফসোস প্রকাশ করেছি’। তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ তাকে বললেন: ‘(তাহলে) তুমিও মনে হয় তাদের সাথে (জানাযার পিছু পিছু) কবরস্থানে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলে’? তিনি বললেন: ‘আল্লাহ’র পানাহ! আপনি এসম্পর্কে যা আলোচনা করেছিলেন সে আলোচনাটা আমি শুনেছিলাম, (তার পরও আমি কোন সাহসে জানাযার সাথে পুরুষদের পিছে পিছে কবরস্থানে যেতে পারি!)’। (তখন) রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন: ‘তুমি যদি তাদের সাথে কবরস্থানে গিয়ে উপস্থিত হতে, তাহলে তুমি (ততক্ষন পর্যন্ত) জান্নাত দেখতে পেতে না, যতক্ষন পর্যন্ত না তুমি (দোযখের মধ্যে ঢুকে) তোমার দাদা (মানে) তোমার পিতার বাবা (আব্দুল মুত্তালেব)কে না দেখতে”। [সহিহ ইবনে হিব্বান- ৭/৪৫০ হাদিস ৩১৭৭; মুসতাদরাকে হাকিম– ১/৭০৬ হাদিস ১৪২২, ১৪২৩; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৩১২৩; সুনানুল কুবরা, ইমাম বাইহাকী- ৪/৬০]

অন্য রেওয়ায়েতে রাসুলুল্লাহ ﷺ থেকে এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে-  ليس على النساء غزو ولا جمعة ولا تشييع جنازة . رواه الطبراني في المعجم الصغير: ٢/١٥٢، ضعفه الالباني في ضعيف الجامع الصغير: رقم ٤٨٩٧  – ‘নারীর দায়িত্বে না আছে জীহাদ, না জুমআ(র নামায), আর না জানাযার পিছে পিছে চলা’। [আল-মু’জামুস সাগীর, ইমাম ত্বাবরাণী- ২/১৫২; তারিখে বাগদাদ, খতীব- ১৬/৬২৯; কানজুল উম্মাল- ৮/২৬৪]

(ঘ) মুসলীম নারী’র জন্য রাস্তায় পুরুষদের সাথে একাকার হয়ে হাটাচলা করা নিষেধ 

ইসলামী শরীয়তে নারী-পুরুষ একাকার হয়ে রাস্তা দিয়ে চলা নিষেধ। রাস্তা দিয়ে চলাচলের মূল হক্ব হল পুরুষদের। আর নারীরা মূলে তাদের বাড়িতে থাকতে আদিষ্ট, তবে প্রয়োজনে বাড়ির বাহিরে কোথাও যেতে হলে তারা পুরুষদের সাথে রাস্তার মাঝ দিয়ে চলাচল করবে না, বরং রাস্তার এক কিনারা দিয়ে চলাচল করবে। যেমন, হামজাহ বিন আবি উসাঈদ আল-আনসারী রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, (তার পিতা) আবু উসাঈদ আল-আনসারী রা. বলেন- أَنَّهُ سَمِعَ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ وَهُوَ خَارِجٌ مِنَ الْمَسْجِدِ فَاخْتَلَطَ الرِّجَالُ مَعَ النِّسَاءِ فِي الطَّرِيقِ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم لِلنِّسَاءِ ‏: اسْتَأْخِرْنَ فَإِنَّهُ لَيْسَ لَكُنَّ أَنْ تَحْقُقْنَ الطَّرِيقَ عَلَيْكُنَّ بِحَافَاتِ الطَّرِيقِ ‏‏.‏ فَكَانَتِ الْمَرْأَةُ تَلْتَصِقُ بِالْجِدَارِ حَتَّى إِنَّ ثَوْبَهَا لَيَتَعَلَّقُ بِالْجِدَارِ مِنْ لُصُوقِهَا بِهِ ‏. رواه أبو داود في سننه,كتاب الأدب , باب في مشي النساء مع الرجال في الطريق: ٤/٣٦٩ رقم ٥٢٧٢، و الطبراني في المعجم الكبير : ١٩/٢٦١ رقم ٥٨٠، حسنه ابن حجر العسقلاني في تخريج مشكاة المصابيح : ٤/٣٤٥، قال الالباني في كتاب سلسلة الأحاديث الصحيحة : ٢/٥١٢ رقم ٨٥٦ : و بالجملة فالحديث حسن بمجموع الطريقين – “(একদিন তিনি) —রাস্তায় নারীদের সাথে পুরুষরা একাকার হয়ে (চলতে দেখে) রাসুলুল্লাহ ﷺকে মসজিদ থেকে বের হওয়া অবস্থায়– এরশাদ করতে শুনলেন (যে), রাসুলুল্লাহ ﷺ নারীদেরকে (উদ্দেশ্য করে) বলছেন: ‘তোমরা (পুরুষদের) পরে যাও। নিশ্চয় রাস্তা তোমাদের নারীদের হক্বের বিষয় নয় (যে তোমরা রাস্তা দিয়ে চলাচল করবে); তোমাদের নারীদের উপরে ওয়াজিব হল রাস্তার এক কিনারা (দিয়ে চলা)’। তখন (থেকে মুসলীম যে কোনো) নারী (মাত্রই রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর আদেশ পালনার্থে এমন ভাবে রাস্তার পার্শস্থ) দেয়াল ঘেঁসে (ঘেঁসে চলত যে), তার (গায়ের) কাপড় পর্যন্ত দেয়ালের (অমসৃণ অংশে লেগে) সেটা তাতে আটকে যেতো’। [সুনানে আবু দাউদ– ৪/৩৬৯ হাদিস ৫২৭২; আল-মু’জামুল কাবীর, ইমাম ত্বাবরাণী- ২/৫১২ হাদিস ৮৫৬; শুআবুল ইমান, ইমাম বাইহাকী, হাদিস ৭৮২২]

আবু হুরায়রাহ রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেনلَيْسَ لِلنِّسَاءِ وَسَطُ الطَّرِيقِ . رواه ابن حبان في صحيحه , كتاب الحظر والإباحة , ذكر الزجر عن أن تمشي المرأة في حاجتها في وسط الطريق : ١٢/٤١٥ رقم ٥٦٠١، و حسنه الألباني في السلسلة الصحيحة” : رقم ٨٥٦ – “নারীর জন্য রাস্তার মাঝামাঝি (চলার কোনো হক্ব নেই)”। [সহিহ ইবনে হিব্বান- ১২/৪১৫ হাদিস ৫৬০১] 

এখানে রাসুলুল্লাহ ﷺ যে নারী-পুরুষ এক সাথে একাকার হয়ে রাস্তা চলাচল করতে নিষেধ করেছেন, তার অন্যতম একটি কারণ অবশ্যই নারী ও পুরুষের মাঝে সম্ভাব্য ফিতনার পথ রুদ্ধ করে দেয়া পদক্ষেপ স্বরূপ। তাহলে শরীয়তের দৃষ্টিতে কোনো অপ্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের একসাথে উঠাবসা চলাফেরা কথাবার্তা কী করে জায়েয হতে পারে? [আল ইখতিলাত্ব বাইনার রিজাল ওয়ান নিসা- ১/৯৯]

(ঙ) মুসলীম নারী’র একাকি সফর করা

এমনিভাবে নারীকে একাকি সফর করতেও নিষেধ করা হয়েছে, আর তাগিদ দেয়া হয়েছে তারা যেন কোনো ‘মাহরাম’ ছাড়া সফর না করে। 

আবু সাঈদ খুদরী রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেন لَا يَحِلُّ لِامْرَأَةٍ تُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ، أَنْ تُسَافِرَ سَفَرًا يَكُونُ ثَلَاثَةَ أَيَّامٍ فَصَاعِدًا، إِلَّا وَمَعَهَا أَبُوهَا، أَوِ ابْنُهَا، أَوْ زَوْجُهَا، أَوْ أَخُوهَا، أَوْ ذُو مَحْرَمٍ مِنْهَا . أخرجه مسلم في صحيحه , كتاب الحج , باب سفر المرأة مع محرم إلى حج وغيره : ٢/٩٧٧ رقم ١٣٤٠ –‘যে নারী আল্লাহ’র ব্যাপারে এবং আখেরাতের দিবসের (ব্যাপারে) ঈমান রাখে, তার জন্য এটা হালাল নয় যে, সে তিন দিনের (সফর পরিমাণ দূরুত্ব) বা ততধিক (দূরত্বের কোনো) সফরে (একাকি) গমন করবে —যদি না তার সাথে তার পিতা বা তার ছেলে অথবা তার স্বামী কিংবা তার ভাই অথবা (অন্য) মাহরামদের মধ্যে কেউ থাকে’’। [সহিহ মুসলীম- ২/৯৭৭ হাদিস  ১৩৪০; জামে তিরমিযী, হাদিস ১১৭৯]

(চ) নারীদের একাকি হজ্জ বা ওমরা’র সফরে যাওয়া

হজ্জের ন্যয় পবিত্র ফরয কাজ -যা ইসলামের ‘আরকান চতুষ্টয়ে’র মধ্যে অন্যতম, তা আদায়ের জন্যেও মুসলীম নারীর সাথে তার ‘মাহরাম’ কেউ থাকা শর্ত। যেমন, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেন لَا يَخْلُوَنَّ رَجُلٌ بِامْرَأَةٍ إِلَّا وَمَعَهَا ذُو مَحْرَمٍ، وَلَا تُسَافِرِ الْمَرْأَةُ إِلَّا مَعَ ذِي مَحْرَمٍ ، فَقَامَ رَجُلٌ، فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللهِ، إِنَّ امْرَأَتِي خَرَجَتْ حَاجَّةً، وَإِنِّي اكْتُتِبْتُ فِي غَزْوَةِ كَذَا وَكَذَا، قَالَ: انْطَلِقْ فَحُجَّ مَعَ امْرَأَتِكَ . أخرجه مسلم في صحيحه , كتاب الحج , باب سفر المرأة مع محرم إلى حج وغيره : ٢/٩٧٩ رقم ١٣٤١“কোনো নারীরর সাথে তার মাহরাম (কেউ উপস্থিত) না থাকলে কোনো পুরুষ তার সাথে একান্তে সাক্ষাত করবে না। আর নারীর সাথে মাহরাম কেউ না থাকলে সে (একাকি কোথাও) সফর করবে না’। তখন এক ব্যাক্তি জিজ্ঞেস করলো: ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার স্ত্রী হজ্জের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেছে, আর এদিকে আমি অমুক অমুক গাজওয়ায় (জিহাদে বের হওয়ার জন্য) নাম লিখিয়েছি, (এখন আমার স্ত্রীর মাসআলা কী হবে?)। রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন; ‘(তোমার স্ত্রীকে একা যেতে দিও না, বরং) ফিরে গিয়ে তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে হজ্জ করো’’[সহিহ মুসলিম- ২/৯৭৮ হাদিস  ১৩৪১]

নারীর একাকি ‘হজ্জ সফরে’ যাওয়া কারও মতেই জায়েয নয়। মুসলীম নারীর সাথে কোনো মাহরাম কেউ না থাকলে সে একাকি হজ্জে যাবে না, যাবৎ না তার কোনো মাহরাম তার সঙ্গি হয়। সে যতদিন মাহরাম পাবে না, ততদিন তার উপরে হজ্জ আদায়ের শরয়ী দায়িত্ব সাকেত (স্থগিত) থাকবে। এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত কোনো মাহরাম পাওয়া না গেলে তাকে হজ্জ আদায় করতে হবে না। অবশ্য বদলী হজ্জের জন্য সে ওসিয়ত করে যাবে। মাহরাম ছাড়া একাকী হজ্জে গেলে গুনাহগার হবে। [আল-মুসান্নাফ, ইবনু আবি শায়বাহ- ৮/৬৩৬-৬৪১; আদ-দুররুল মুখতার, ইমাম হাসকাফী- ২/৪৬৪; বাদায়েউস সানাায়ে, ইমাম কাসানী- ২/১২৩; আল-বাহরুর রায়েক ২/৩১৪-৩১৫; আল-মুহিতুল বুরহানী- ৩/৩৯৪; ফাতহুল কাদীর, ইবনে হুমাম- ২/৩৩০; রাদ্দুল মুহতার, শামী-২/৪৬৫; ইমদাদুল ফাতাওয়া ২/১৫৬]

(ছ) আল্লাহ’র পথে জিহাদে গমন করা 

ইসলামে জিহাদ কত গুরুত্বপূর্ণ একটি ফরয আমল! জীহাদের ফজীলত দিয়ে কুরআন হাদিস ভরে আছে।

كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِتَالُ 

“(হে মুসলমানগণ) তোমাদের উপরে ক্বিতাল (সশস্ত্র জিহাদ)’কে বিধিবদ্ধ (ফরয) করে দেয়া হল”[সূরা বাকারাহ ২১৬]

ইসলামী শরীয়তে সাধারণ অবস্থায় কিতাল (সশস্ত্র জিহাদ)-এর এই ফরয দায়িত্ব অর্পন করা হয়েছে ‘মুসলীম পুরুষ’-এর উপরে। আর এ আমলটি যেহেতু গৃহের বাহিরের একটি আমল এবং তা পালন করতে গেলে মুসলীম-অমুসলীম সকল প্রকারের পুরুষদের সামনে ও সংস্পর্শে আসা অবধারিত, যা থেকে নানাবিধ ফিতনা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাব্যতাই প্রবল, তাই এত বড় ফজিলতপূর্ণ এই ‘ফরয’ কাজটিকেও সাধারণ অবস্থায় নারীদের দায়িত্ব থেকে বাহিরে রাখা হয়েছে। যেমন,আল্লাহ তাআলা  এরশাদ করেন-

وَ لَا تَتَمَنَّوْا مَا فَضَّلَ اللَّهُ بِهِ بَعْضَكُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ ۚ لِّلرِّجَالِ نَصِيبٌ مِّمَّا اكْتَسَبُوا ۖ وَلِلنِّسَاءِ نَصِيبٌ مِّمَّا اكْتَسَبْنَ ۚ  وَ اسْأَلُوا اللَّهَ مِن فَضْلِهِ ۗ إِنَّ اللَّهَ كَانَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمًا
“আর তোমরা ওই বিষয়ের তামান্না (আকাঙ্খা পোষন) করো না, যা দিয়ে (তোমাদের রব) আল্লাহ (তাআলা পৃথিবীর জীবনে তাঁর বান্দাদেরই মধ্যে) কতক’কে কতকের উপরে ফজিলত (শ্রেষ্ঠত্ব) দান করেছেন। (পার্থিব ধ্বনসম্পদ ও অভিভাবকত্ব-সুলভ ক্ষমতা লাভই হোক কিংবা আখেরাতে সাওয়াব লাভই হোক, উভয় ক্ষেত্রেই তোমাদের রব আল্লাহ তাআলা যে সকল বিধিবিধান দিয়েছে, সেই অনুসারে) পুরুষদের জন্য থাকবে সেই অংশ যা তারা উপার্জন/লাভ করবে, আর নারীদের জন্য থাকবে সেই অংশ যা তারা উপার্জন/লাভ করবে। আর তোমরা (বরং) আল্লাহ’র কাছে (তাঁর বিধান মতো চলার) ফজল (আমলের তৌফিক) চাও। নিশ্চই আল্লাহ সব কিছুর ব্যাপারে পূর্ণজ্ঞান রাখেন”। [সূরা নিসা ৩২]

এই আয়াতের শানে-নুজুল প্রসঙ্গে হযরত মুজাহিদ রহ. থেকে সহিহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, উম্মে সালমাহ রা. (একবার রাসুলুল্লাহ ﷺ-কেঁ) জিজ্ঞেস করলেন-  يَا رَسُولَ اللَّهِ ، أَيَغْزُو الرِّجَالُ وَلَا نَغْزُو وَلَا نُقَاتِلُ فَنُسْتَشْهَدُ وَإِنَّمَا لَنَا نِصْفُ الْمِيرَاثِ . فَأَنْزَلَ اللَّهُ { وَلَا تَتَمَنَّوْا مَا فَضَّلَ اللَّهُ بِهِ بَعْضَكُمْ عَلَى بَعْضٍ } . اخرجه الحاكم في المستدرك على الصحيحين: ٢/٣٠٥ و قال الذهبي قي التلخيص : على شرط البخاري ومسلم ; و اخرجه ايضا غيره ; و صححه أحمد شاكر في عمدة التفسير: ١/٤٩٥ و في حاشية تفسير ابن جرير: ٨/٢٦٣ , و الالباني في صحيح الترمذي  – “ইয়া রাসুলাল্লাহ! পুুরুষরা গাজওয়া (জিহাদ) করে, আমরা (নারীরা) কি গাজওয়া (জিহাদ) করবো না, কিতাল (সমর যুদ্ধ) করবো না ?! তাছাড়া সাক্ষ্য দান এবং মিরাছের ক্ষেত্রেও আমাদের জন্য (বিধান রাখা) রয়েছে (মুসলীম পুরুষগণের) অর্ধেক’! তখন আল্লাহ (তাআলা কুরআন কারিমের এই আয়াতটি) নাজিল করেন- وَ لَا تَتَمَنَّوْا مَا فَضَّلَ اللَّهُ بِهِ بَعْضَكُمْ عَلَىٰ بَعْضٍআর তোমরা ওই বিষয়ের তামান্না (আকাঙ্খা পোষন) করো না, যা দিয়ে (তোমাদের প্রভু) আল্লাহ (তাআলা তাঁর বান্দাদেরই মধ্যে) কতক’কে কতকের উপরে ফজিলত (শ্রেষ্ঠত্ব) দান করেছেন”। [মুসতাদরাকে হাকিম– ২/৩০৫ হাদিস ৩১৯৫; জামে তিরমিযী, হাদীস ৩০২২; মুসনাদে আহমদ- ৬/৩২২; তাফসিরে আব্দুর রাজ্জাক- ১/১৫৬; মুসনাদে ইসহাক বিন রাহওয়াইহ- ১৮৭০; তাফসিরে তাবারী– ৮/২৬৩ আছার ৯২৩৬, ৯২৩৭, ৯২৪১; তাফসিরে ইবনু আবি হাতিম- ৩/৫২২৪; মাআলিমুত তানযিল, ইমাম বগভী- ২/২০৪; আদ-দুররুল মানসুর, সুয়ূতী- ২/২৬৬]

একই বিষয়বস্তুর সমর্থন উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রা.-এর একটি সহিহ হাদিস থেকেও হয়। আয়েশা বিনতে ত্বলহাহ রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা সিদ্দিকাহ রা. বলেন- قُلتُ يا رَسولَ اللَّهِ، ألَا نَغْزُو ونُجَاهِدُ معكُمْ؟ فَقالَ: لَكُنَّ أحْسَنَ الجِهَادِ وأَجْمَلَهُ الحَجُّ، حَجٌّ مَبْرُورٌ، فَقالَتْ عَائِشَةُ فلا أدَعُ الحَجَّ بَعْدَ إذْ سَمِعْتُ هذا مِن رَسولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ . رواه البخاري في الصحيح , كتاب جزاء الصيد , باب حج النساء: رقم ١٨٦١ ، و البيهقى : ٤/٣٢٦، و أحمد في مسنده : ٦/٧٩ – “আমি (একবার রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে) জিজ্ঞেস করলাম: ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! (মুসলীম পুরুষদের মতো) আমরা (নারীরাও) কি আপনার সঙ্গি হয়ে গাজওয়া করবো না, জিহাদ করবো না’? রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন: ‘বরং তোমাদের নারীদের জন্য সর্বোত্তম ও সুন্দরতম জিহাদ হল হজ্জ; হজ্জে মাবরুর (কবুলযোগ্য হজ্জ)’। আয়েশা রা. বলেন: ‘আমি রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছ থেকে একথা শোনার পর হতে কখনো হজ্জ ত্যাগ করিনি”। [সহিহ বুখারী, হাদিস ১৮৬১; মুসনাদে আহমদ- ৬/৭৯; সুনানুল কুবরা, ইমাম বাইহাকী- ৪/৩২৬] 

অন্য রেওয়ায়েতে এভাবে এসেছে যে, উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রা. বলেন- قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ عَلَى النِّسَاءِ جِهَادٌ قَالَ ‏ :‏ نَعَمْ عَلَيْهِنَّ جِهَادٌ لاَ قِتَالَ فِيهِ الْحَجُّ وَالْعُمْرَةُ ‏. أخرجه ابن ماجه في سننه , كتاب المناسك , باب الحج جهاد النساء : رقم ٢٩٠١ ; و أحمد في مسنده : ٦/١٦٥ ; و ابن خزيمة في صحيحه , كتاب المناسك , باب الدليل على أن جهاد النساء الحج و العمرة : رقم ٣٠٧٣ ; و ابن حبان في صحيحه: رقم ٣٧٠٢ ; و الدار قطني في سننه: ٣/٣٤٥ ; صححه النووي في المجموع شرح المهذب : ٤/٧ , و ابن القيم في تهذيب السنن : ٥/٢٤٩ , و ابن الملقن في البدر المنير: ٩/٣٦ و في تحفة المحتاج : ٢/١٢٦ , و ابن كثير في إرشاد الفقيه : ١/٣٠٠ ; و الالباني في صحيح سنن ابن ماجه : ٣/١٠ و في الإرواء : ٩٨١    – “আমি রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে জিজ্ঞেস করলাম: ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! নারীদের উপরে জিহাদ আছে কি’? তিনি বললেন: ‘হ্যাঁ (আছে বৈকি, তবে) তাদের উপরে এমন জিহাদ আছে, যার মধ্যে কোনো যুদ্ধ নেই। (আর সেটা হল) হজ্জ ও উমরাহ”। [সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস ২৯০১; মুসনাদে আহমদ- ৬/১৬৫; সহিহ ইবনে খুযাইমাহ, হাদিস ৩০৭৩; সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস ৩৭০২; সুনানে দ্বারাকুতনী– ৩/৩৪৫]

উপরোক্ত এই হাদিস গুলি একথার পরিষ্কার দলিল যে, সুরা নিসার’র ৩২ নং আয়াতটি নাজিল হওয়ার আগেও কুরআনের যতগুলো আয়াতে ‘আল্লাহ’র রাস্তায় ক্বিতাল (সশস্ত্র-জিহাদ) করা’র নির্দেশ বা উৎসাহ’ দেয়া হয়েছিল, তার সবগুলোই শুধুমাত্র মুসলীম পুরুষদেরকে উদ্দেশ্য করে করা হয়েছিল; মুসলীম নারী’দেরকে নয়। আর এ বিষয়টি রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর যুগের মুসলীম নারী পুরুষ উভয়েরই জানা ছিল। আর একথা উম্মে সালমাহ রা. এবং আয়েশা রা.-এর উপরোক্ত প্রশ্ন থেকেও বোঝা যায় যে, তখনকার মুসলীম নারীদের কাছে মাসআলাহ’টি একদম জানাশোনা একটি মাসলা ছিল। আর জিহাদ বিষয়ক প্রশ্নের জবাবে খোদ্ আল্লাহ তাআলা সুরা নিসা’র উপরোক্ত ৩২ নং আয়াতটি নাজিল করার মাধ্যমে বিষয়টিকে আরো জোরালো করে দিয়েছেন। তবে, রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে নারীদের এরকম প্রশ্ন রাখার কারণ হল, আসলে নারীরা ‘জিহাদের বিরাট ফজিলত’ এবং এর দ্বারা শহিদ হওয়ার মতো আল্লাহ’র দরবারে বিরাট মর্যাদা লাভের সুবর্ণ সুযোগ দেখে মুসলীম পুরুষদের উপরে এত ঈর্ষাহ্নিত হতেন যে, তারা মনে মনে কামনা করতেন- ‘হায়, পুরুষদের মতো আমরা নারী’রাও যদি জিহাদে শরিক হওয়ার সুযোগ পেতাম’। মূলত: মনের এই রকম বাসনা থেকেই হযরত উম্মে সালমাহ রা. এবং হযরত আয়েশা রা. জিহাদের ব্যাপারে উপরোক্ত প্রশ্নটি করেছিলেন।

আবু হুরায়রাহ রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেন- جِهَادُ الْكَبِيرِ وَالضَّعِيفِ وَالْمَرْأَةِ الْحَجُّ وَالْعُمْرَةُ . رواه النسائي في سننه , كتاب الحج ، باب فضل الحج : ٥/١١٤ رقم ٢٦٢٦ ; و قد حَسّن الإمام الحافظ المُنذري إسناده في الترغيب والترهيب : ٢/١٠٩ ; و قال الإمام بدر الدين العيني في عمدة القاري : ٩/١٩٣ : بسند لا باس به , و قال الحافظ ابن حجر في موافقة الخبر الخبر:٢/٣٠ : إسناده صحيح مرفوعاً ; و اخرجه ايضا أحمد في مسنده : ١٠/٢٧٢ رقم ٩٤٥٩ ; و الطبراني في الاوسط : ٦/٢٧٢ رقم ٨٧٥١ ; و البيهقي في سننه : ٤/٣٠٠ و ٩/٢٣ – “বৃদ্ধ, দূর্বল (ব্যাক্তি) এবং নারী’র জিহাদ হল হজ্জ ও উমরাহ”। [সুনানে নাসায়ী,- ৫/১১৪ হাদিস ২৬২৬; সুনানুল কুবরা, বাইহাকী– ৪/৩০০, ৯/২৩; আল-মু’জামুল আউসাত, ত্বাবরাণী- ৬/২৭২ হাদিস ৮৭৫১; মুসনাদে আহমদ- ১০/২৭২ হাদিস ৯৪৫৯ ] 

পবিত্র কুরআনের বেশ কিছু আয়াত এবং বিখ্যাত মুফাসসিরীনে কেরামের তাফসির সমূহ থেকেও নারী’র জিহাদে অংশগ্রহন ফরয না হওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হয়। যেমন, আল্লাহ তাআলা  এরশাদ করেন-

لَا يَسْتَأْذِنُكَ الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ أَن يُجَاهِدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ ۗ وَاللَّهُ عَلِيمٌ بِالْمُتَّقِينَ – إِنَّمَا يَسْتَأْذِنُكَ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَارْتَابَتْ قُلُوبُهُمْ فَهُمْ فِي رَيْبِهِمْ يَتَرَدَّدُونَ – وَلَوْ أَرَادُوا الْخُرُوجَ لَأَعَدُّوا لَهُ عُدَّةً وَلَٰكِن كَرِهَ اللَّهُ انبِعَاثَهُمْ فَثَبَّطَهُمْ وَقِيلَ اقْعُدُوا مَعَ الْقَاعِدِينَ – لَوْ خَرَجُوا فِيكُم مَّا زَادُوكُمْ إِلَّا خَبَالًا وَلَأَوْضَعُوا خِلَالَكُمْ يَبْغُونَكُمُ الْفِتْنَةَ وَفِيكُمْ سَمَّاعُونَ لَهُمْ ۗ وَاللَّهُ عَلِيمٌ بِالظَّالِمِينَ
“(হে আমার নবী, মুহাম্মাদ! তুমি লক্ষ্য করবে), যারা (খাঁটি ভাবে আন্তরিকতার সাথে) ইমান এনেছে আল্লাহ’র প্রতি এবং আখেরাতের প্রতি, তারা তাদের জান ও মাল দিয়ে (ইসলামের দুশমনদের বিরুদ্ধে) জিহাদ করা থেকে (অব্যহতি লাভের জন্য) তোমার কাছে (কখনই) অনুমতি চাবে না। আর আল্লাহ -মুত্তাকীগণকে ভাল করেই জানেন। (তুমি দেখবে), যারা আল্লাহ’র প্রতি এবং আখেরাতের প্রতি (খাঁটি ভাবে আন্তরিকতার সাথে) ইমান আনেনি, বরং তাদের অন্তরগুলো (এখনো) সন্দেহে পড়ে আছে, যার কারণে তারা তাদের সন্দেহ-সংশয়ের মধ্যে দোদুল্যমান (অবস্থায়) রয়েছে, কেবলমাত্র তারাই (নিজেদের জান ও মাল দিয়ে ইসলামের দুশমনদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা থেকে অব্যহতি লাভের জন্য) তোমার কাছে অনুমতি চাবে। বস্তুত: তারা যদি (জিহাদে) বের হওয়ার (পাক্কা) এরাদা/ইচ্ছা করতোই, তাহলে তো তারা তার জন্য অবশ্যই (আগে ভাগেই) বিশেষ প্রস্তুতি নিয়ে রাখতো। কিন্তু (তাদের অন্তরের কলুষ নিয়তের কারণে পবিত্র জিহাদের ময়দানে) তাদের অভিযাত্রাকে (তোমার প্রভু) আল্লাহ’ই পছন্দ করেন নি। ফলে তিঁনি তাদেরকে (জিহাদে বের হওয়া থেকে) বিরত রাখলেন এবং তাদেরকে বলা হল: ‘তোমরা (গৃহে) উপবেশনকারীদের সাথে বসে থাকো’; (তোমাদের জিহাদের মাঠে গিয়ে কাজ নেই)’। (শোনো), তারা যদি তোমাদের মাঝে বের হত, তাহলে তারা তোমাদের মধ্যে কেবল অনিষ্ট-বিভ্রান্তি-বিশৃঙ্খলাই বৃদ্ধি করতো, (যাতে তোমাদের ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের মাঝে ফাটল সৃষ্টি হয়), এবং তোমাদের মাঝে ফিতনা লাগানোর মতলবে তারা অবশ্যই তোমাদের সারি গুলোর মধ্যে ছোটাছুটি করতো। আর (এও জেনে রোখো যে), তোমাদের মাঝে তাদের জন্য কানপাতা লোকজনও রয়েছে। আর আল্লাহ -মজালেমদেরকে ভাল করেই জানেন। ”। [সূরা তাওবা ৪৪-৪৭]
 
এই আয়াতে কারিমার মধ্যে- مَعَ الْقَاعِدِينَ – “(গৃহে) উপবেশনকারীদের সাথে (বসে থাকো)”-এর একটি অর্থ হল ‘মুসলীম নারীগণ’। যেমন: এর তাফসীরে ইমাম ইবনে জারীর তাবারী (মৃ: ৩১০ হি:) রহ. এবং ইমাম মাক্কী বিন আবি ত্বালিব (মৃ: ৪৩৭ হি:) রহ. বলেন- يعني: اقعدوا مع المرضى والضعفاء الذين لا يجدون ما ينفقون، ومع النساء والصبيان – “এর অর্থ হল, তোমরা -অসুস্থ্য ব্যাক্তিবর্গ, দূর্বল ব্যাক্তিবর্গ, যারা (জিহাদের ব্যয়ভার বহন করার মতো) খরচপাতি (যোগার করতে) পায় না, নারী মহল এবং শিশু’দের সাথে (গৃহে বসে থাকো)”। [জামেউল বায়ান, ইমাম তাবারী- ১০/১৮৬; আল হিদায়াহ ইলা বুলুগিন নিহায়াহ, ইমাম মাক্কী- ৩/২৮২] ইমাম কুরতুবী (মৃ: ৬৭১ হি:) রহ. বলেছেন- أي مع أولى الضرر والعميان والزمني والنسوان والصبيان – “এর অর্থ হল, আহত, অন্ধ,……, নারী মহল এবং শিশুদের সাথে (গৃহে বসে থাকো)”। [আল-জামে লি-আহকামিল কুরআন, ইমাম কুরতুবী- ৮/১৫৬] শায়েখ সা’দী (মৃ: ১৩৭৬ হি:) রহ. বলেছেন- من النساء والمعذورين – “(এর অর্থ হল), নারী মহল এবং যাদের (জিহাদে না যাওয়া শরয়ী) ওজর (অপারগতা/অসামর্থতা) আছে (তারা)”। [তাইসিরুল কারীম, শায়েখ সা’দী- ১/৩৩৯]

আল্লাহ তাআলা আরো এরশাদ করেন-

وَ إِذَا أُنزِلَتْ سُورَةٌ أَنْ آمِنُوا بِاللَّهِ وَ جَاهِدُوا مَعَ رَسُولِهِ اسْتَأْذَنَكَ أُولُو الطَّوْلِ مِنْهُمْ وَ قَالُوا ذَرْنَا نَكُن مَّعَ الْقَاعِدِينَ  – رَضُوا بِأَن يَكُونُوا مَعَ الْخَوَالِفِ وَطُبِعَ عَلَىٰ قُلُوبِهِمْ فَهُمْ لَا يَفْقَهُونَ
“(৮৬) আর (হে নবী মুহাম্মাদ!) যখন (এ আদেশ সহকারে) কোনো সুরা নাজিল হয় যে, ‘তোমরা আল্লাহ’র প্রতি ইমান আনো এবং তাঁর রাসুলের সাথে থেকে (ইসলামের দুশমনদের বিরুদ্ধে) জিহাদ করো’, (তখন তুমি দেখবে যে), তাদের মধ্য থেকে উলুত্ব-ত্বাওল (শক্তি সামর্থবান বা স্বচ্ছল/ধ্বনী লোকেরা) তোমার কাছে (বিভিন্ন ঠুনকো অযুহাতে জিহাদে অংশ গ্রহন করা থেকে) অব্যহতি চাচ্ছে। আর তারা বলে, (দেখুন আমাদের অমুক অমুক সমস্যা আছে, এযাত্রায়) আমাদেরকে (যোদ্ধাদের লিষ্ট থেকে) বাদ রাখুন, আমরা (গৃহে রয়ে যাওয়া নারী, শিশু ও অক্ষম) উপবেশনকারীদের সাথে থাকবো। (৮৭) তারা (জিহাদে বের না হয়ে বরং) পিছনে রয়ে যাওয়াদের সাথে থাকা’তেই খুশি হল। বস্তুত: (তাদের মুনাফেকির কারণে) তাদের অন্তরগুলোর উপরে মোহর লেগে গেছে, কাজেই তারা উপলব্ধি করতে পারবে না (যে তারা আখেরাতে কি পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখিন হওয়ার উপক্রম হল)”। [সূরা তাওবা ৮৬, ৮৭]
 
উপরের আয়াতে বর্ণিত- رَضُوا بِأَن يَكُونُوا مَعَ الْخَوَالِفِ – “তারা (জিহাদে বের না হয়ে বরং) পিছনে রয়ে যাওয়াদের সাথে থাকা’তেই খুশি হল-এই আয়াতাংশের মধ্যে উল্লেখীত আরবী শব্দ الْخَوَالِفِ – (পিছনে রয়ে যাওয়াদের)-এর এক তাফসীর হল- ‘মুসলীম নারীগণ’। যেমন: -এর তাফসীরে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন- النساء – (নারীগণ)। এই একই তাফসীর ইবন আতিয়াহ, মুজাহিদ, কাতাদাহ, জিহহাক, ইকরিমাহ, হাসান বসরী, আব্দুর রহমান ইবন জায়েদ, সুদ্দী রহ. প্রমুখ থেকেও বর্ণিত হয়েছে। [জামেউল বায়ান, ইমাম তাবারী- ১৪/৪১৩, ৪১৪ আছার ১৭০৬৪-১৭০৭২; তাফসীরে ইবনু আবি হাতিম- ১/১৮৫৯ আছার ১০২০৪, ১০২০৫; ফাতহুল কাদীর, শাওকানী- ২/৩৯০] ইমাম মাক্কী বিন আবি ত্বালিব (মৃ: ৪৩৭ হি:) রহ. এর তাফসিরে বলেন- مع النساء اللواتي لا فرض عليهن في الجهاد – “(ওইসকল) নারীদের সাথে -যাদের উপরে (স্বাভাবিক অবস্থায়) জিহাদে যাওয়া ফরয নয় (তাদের সাথে গৃহেই রয়ে যাওয়াকেই তারা পছন্দ করে নিলো)”। [আল হিদায়াহ ইলা বুলুগিন নিহায়াহ, ইমাম মাক্কী- ৩/৩১৫] ইমাম ইবনে কাছির (মৃ: ৭৭৪ হি:) রহ. এর তাফসিরে বলেন- ورضوا لأنفسهم بالعار والقعود في البلد مع النساء – وهن الخوالف – بعد خروج الجيش – “তারা এলাকায় (রয়ে যাওয়া) নারীদের সাথে (গৃহে) বসে থাকাকেই নির্লজ্জের মতো নিজেদের জন্য পছন্দ করে নিয়েছিল। আর মুজাহিদ বাহিনী (জিহাদের উদ্দেশ্যে) বের হয়ে যাওয়ার পর –(আয়াতে বর্ণিত) الخوالف (পিছনে রয়ে যাতওয়া’রা) হল নারী মহল (যাদের উপরে জিহাদ ফরয ছিলনা বিধায় তারা নিজ নিজ গৃহে অবস্থান করছিলেন)”। [তাফসিরে ইবনে কাছির- ৪/১৯৬] ইমাম ফখুরুদ্দিন রাযী (মৃ: ৬৭১ হি:) রহ. এর এক তাফসিরে বলেন- عبارة عن النساء اللاتي تخلفن في البيت فلا يبرحن، والمعنى: رضوا بأن يكونوا في تخلفهم عن الجهاد كالنساء – “বক্তব্যটি নারী মহল সম্পর্কে, যারা (তাদের উপরে জিহাদ ফরয না হওয়ার কারণে নিজ নিজ) গৃহে রয়ে গিয়েছিল, সুতরাং, তাদের উপরে (আল্লাহ’র) কোনো গোষ্মা/রাগ নেই। অর্থাৎ, (আল্লাহ তাআলা এখানে মুসলমান নামধারী কিছু পুরুষদেরকে তিরষ্কার করছেন যে), তারা (মূলত:) এতেই রাজি খুশি হয়ে রইলো যে, তারা নারীদের মতো জিহাদ থেকে পিছনে রয়ে গেলো”। [মাফাতিহুল গাইব, ইমাম রাযী- ১৬/১৫৭] ইমাম কুরতুবী (মৃ: ৬৭১ হি:) রহ. এর তাফসিরে বলেন- أي مع النساء والصبيان وأصحاب الأعذار من الرجال– “অর্থাৎ, নারী মহল, শিশু বাচ্চারা এবং পুরুষদের মধ্যে যারা ওজরযোগ্য (যাদের উপরে মূলত: জিহাদ ফরয ছিল না) -তাদের সাথে (গৃহে বসে থাকাকেই এসব নামধারী মুসলমান পুরুষগুলি পছন্দ করে নিলো)”। [আল-জামে লি-আহকামিল কুরআন, ইমাম কুরতুবী- ৮/২২৩] 
 
সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. সহ উপরোল্লখীত মুফাসসির’গণের এসকল তাফসির একথার দলিল যে, জিহাদের সময় -মুসলীম নারীগণ তাদের গৃহেই অবস্থান করবেন -এটাই শরীয়তের স্বাভাবিক বিধান, অপর দিকে মুসলীম পুরুষগণ ময়দানে জিহাদের ফরয দায়িত্ব আঞ্জাম দিবেন -এটাই আল্লাহ’র আহবান। কিন্তু কিছু মুসলীম নামধানী পুরুষ যখন কোনো যথাযোগ্য কারণ ছাড়াই জিহাদের ফরয দায়িত্ব পালনার্থে বের না হয়ে বরং বাড়িতে রয়ে যাওয়া নারী মহল, শিশু বাচ্চা, মাজুর (অপারগ/অসমর্থ ব্যাক্তি) ও দূর্বল মুসলমানদের সাথে থাকাকেই পছন্দ করে নিলো, তখনই সেই পুরুষগুলো আল্লাহ’র তিরষ্কারের মুখোমুখি হল। এ থেকে প্রমাণিত হয়, জিহাদ ও ক্বিতালের ফরয দায়িত্ব পালন করার মূল আহাল (উপযুক্ত ব্যাক্তি) হল ‘মুসলীম পুরুষ(গণ)’; নারী(গণ) নয়। 
 
উপরের এই দীর্ঘ আলোচনা থেকে একথাও প্রমাণিত হল যে, কুরআন কারিমের যেসকল স্থানে ‘মুমিন’ বা ‘মুসলীম’(দের)কে সম্মোধন করে ‘জিহাদ ও ক্বিতাল’-এর জন্য ময়দানে বের হওয়ার ডাক দেয়া হয়েছে এবং জিহাদে গিয়ে শহিদ হওয়ার উৎসাহ দেয়া হয়েছে, সেসকল স্থানে মূল লক্ষ্যবস্তু হল ‘মুমিন/মুসলীম পুরুষ’(গণ)।  এজন্যই ইমাম শাফেয়ী (মৃ: ২০৪ হি:) রহ. বলেছেন- و قد قال لنبيه صلى الله عليه وسلم ” حَرِّضِ الْمُؤْمِنِينَ عَلَى الْقِتَالِ ” فدل على أنه أراد بذلك الذكور دون الإناث لأن الإناث المؤمنات . و قال عز و جل “وَمَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ لِيَنْفِرُوا كَافَّةً ” وقال ” كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِتَالُ ” وكل هذا يدل على أنه أراد به الذكور دون الإناث– “আল্লাহ তাআলা তাঁর নবী-কে উদ্দেশ্য করে বলেছেন- حَرِّضِ الْمُؤْمِنِينَ عَلَى الْقِتَالِ – “(হে নবী) তুমি মু’মিনুন (তথা মুমিনদের)কে (আল্লাহ’র পথে) ক্বিতালের জন্য উৎসাহিত করো”। এ আয়াতটি প্রমাণ করে যে, এর দ্বারা আল্লাহ তাআলা’র উদ্দেশ্য হল (মু’মিন) পুরুষগণ; -নারী’গণ নয়। কেননা (আরবী সম্মোধন অনুযায়ী) নারীরা  হল ‘মু’মিনাত’; (অপরদিকে এই আয়াতে পুরুষ’দেরকে সম্মোধন করে বলা হয়েছে ‘মুমিনুন’)। (তেমনি ভাবে) আল্লাহ তাআলা আরো এরশাদ করেন- وَمَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ لِيَنْفِرُوا كَافَّةً – “মুমিনগণের জন্য সমিচিন নয় যে, তারা সকলে (মিলে একই সাথে জিহাদের উদ্দেশ্যে) বেরিয়ে পড়বে” । তিঁনি আরো এরশাদ করেন- كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِتَالُ -“(হে মুসলমানগণ) তোমাদের উপরে ক্বিতাল (সমর জিহাদ)’কে বিধিবদ্ধ (ফরয) করে দেয়া হল”। এসকল আয়াতের সবগুলোই প্রমাণ করে যে, এর দ্বারা আল্লাহ তাআলা’র উদ্দেশ্য হল (মু’মিন) পুরুষগণ; -নারী’গণ নয়”। [কিতাবুল উম্ম, ইমাম শাফেয়ী- ৪/১৭০]
 
তবে একথা ঠিক যে, রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর জামানায় কোনো কোনো নারী সাহাবীয়া জিহাদে আহতদের ঔষধ-পট্টি প্রভৃতির বন্দোবস্থ করার জন্য সাথে গিয়েছিলেন। কিন্তু প্রথমতঃ কথা হল, এব্যাপারে পূর্বাপর সকল আহলে হক্ব ওলামায়ে কেরাম একমত যে, নারীদের উপর নিয়মানুগভাবে জিহাদকে ফরয করা হয় নি; দ্বিতীয়ত তাদেরকে কখনই নিয়মানুগ ভাবে যুদ্ধেও শামিল করা হয় নি। যেমন, জা’ফর বিন মুহাম্মাদ রহ. থেকে তার পিতা মুহাম্মাদ রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, ইয়াযিদ বিন হুরমুয রহ. বলেন- أَنَّ نَجْدَةَ ، كَتَبَ إِلَى ابْنِ عَبَّاسٍ يَسْأَلُهُ ، عَنْ خَمْسِ خِلَالٍ ، فَقَالَ : ابْنُ عَبَّاسٍ : لَوْلَا أَنْ أَكْتُمَ عِلْمًا مَا كَتَبْتُ إِلَيْهِ ، كَتَبَ إِلَيْهِ نَجْدَةُ : أَمَّا بَعْدُ ، فَأَخْبِرْنِي هَلْ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَغْزُو بِالنِّسَاءِ ؟ وَهَلْ كَانَ يَضْرِبُ لَهُنَّ بِسَهْمٍ ؟  ……. ؟ فَكَتَبَ إِلَيْهِ ابْنُ عَبَّاسٍ : كَتَبْتَ تَسْأَلُنِي هَلْ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَغْزُو بِالنِّسَاءِ ؟ وَقَدْ كَانَ يَغْزُو بِهِنَّ ، فَيُدَاوِينَ الْجَرْحَى ، وَيُحْذَيْنَ مِنَ الْغَنِيمَةِ ، وَأَمَّا بِسَهْمٍ فَلَمْ يَضْرِبْ لَهُنَّ ،  ……... رواه مسلم في صحيحه , كتاب الجهاد والسير, باب النِّسَاءُ الْغَازِيَاتُ يُرْضَخُ لَهُنَّ وَلاَ يُسْهَمُ وَالنَّهْىُ عَنْ قَتْلِ صِبْيَانِ أَهْلِ الْحَرْبِ : رقم ١٨١٢، و أحمد في مسنده : ٤/٢٩١ و قال أحمد شاكر: إسناده صحيح، و أبو داود في سننه : ٢٧٢٧ و ٢٧٢٨ مفرقاً مختصرا، و الترمذي في سننه : ١٥٥٦، و النسائي في سننه : ٤١٣٤ مختصراً، – “নাজদাহ (রহ.-একবার আব্দুলল্লাহ) ইবনে আব্বাস রা.-এর কাছে পাঁচটি প্রশ্ন লিখে পাঠালেন। (উত্তরে) ইবনে আব্বাস রা. বললেন: ‘আমি যদি ইলম গোপন (করার অপরাধের আশংকা) না করতাম, তাহলে (এসব প্রশ্নের কোনো উত্তরই) আমি তাকে লিখে পাঠাতাম না। (রাবী বলেন:) নাজদাহ তাঁকে লিখে পাঠিয়েছিল: ‘আম্মা বা’দ, আমি জানতে চাই, রাসুলুলল্লাহ ﷺ কি মহিলাদেরকে নিয়ে গাজওয়া’য় (জিহাদে) যেতেন? এবং তিঁনি কি তাদেরকে গণীমতের অংশ দিতেন? ………………। তখন ইবনে আব্বাস রা. তাকে লিখলেন: তুমি পত্র লিখে আমার কাছে জানতে চেয়েছো, রাসুলুল্লাহ ﷺ কি নারীদেরকে নিয়ে যুদ্ধে যেতেন? (এর উত্তর হল: হ্যাঁ) তারা (কেউ কেউ) তাঁর সাথে যুদ্ধে যেতো। তারা (সেখানে) আহতদের সেবা করতো। (আর এজন্য) তাদেরকে ‘গনীমতের মাল’ থেকে পুরষ্কার (স্বরূপ কিছু) দেয়া হত (বটে), তবে গণীমতের ভাগ সম্পর্কে কথা এই যে, তিনি (গণীমতের নিয়মানুগ অংশে) তাদের জন্য বরাদ্দ রাখতেন না।………….”[সহিহ মুসলীম- ১/১৪৪৪ হাদিস ১৮১২; মুসনাদে আহমদ- ৪/২৯১; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ২৭২৭, ২৭২৮; সুনানে নাসায়ী, হাদিস ৪১৩৪; সুনানে তিরমিযী, হাদিস ১৫৫৬; মুসনাদে আবু আউয়ানাহ- ৪/৩৩৬ হাদিস ৬৮৯০]

এখন ভেবে দেখার বিষয়, যে ‘দ্বীন ইসলাম’ মুসলিম নারীর ‘পবিত্রতা ও ‘ইজ্জত আব্রু’কে যথাসম্ভব হিফাজতের উদ্দেশ্যে স্থানে স্থানে এত গুরুত্ব দিয়েছে যে, দ্বীনের বড় বড় আরকান, শিয়ার ও হুকুম’কে পালনের দায়িত্ব থেকেও অব্যাহতি দেয়া হয়েছে, সেই দ্বীন সম্পর্কে একথা কি করে চিন্তা করা যেতে পারে যে, দেশ ও জাতির অভিভাবকত্বের মতো এত বিশাল গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সেই নারীর কাঁধে সোপর্দ করে সে তাকে রাষ্ট্রের সামনেই শুধু নয় বরং গোটা পৃথিবীর সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিবে, কেবল তাই নয়, তাকে পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সব কাজ সংঘবদ্ধভাবে করার জন্য তার দায়িত্বে ওই সমস্ত কাজ কারবার ন্যস্ত করবে, যেসব কাজের দায়িত্ব তার উপর ব্যাক্তি পর্যায়গতভাবেও আরোপিত হয় না!!!

দু’জাহানের সর্দার রাসুলে করীম ﷺ-এর যুগ থেকে নিয়ে খুলাফায়ে রাশেদীন, বরং ‘খুলাফায়ে রাশেদীনের পরেও কয়েক যুগ পর্যন্ত মুসলমানদের ‘খলিফা’ বা ‘রাষ্ট্রপ্রধান’ নির্বাচন করার বিষয়টি উম্মাহর একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অঙ্গোন পরিগ্রহ করে রেখেছিল। এক খলীফার পর অন্য আরেকজন খলীফা নির্বাচনের সময় প্রত্যেক বারই বহু মতামত সামনে এসেছে যে, কাকে খলিফা বানানো হবে। সে যুগে এমন অসংখ্য মুসলিম নারী বিদ্যমান ছিলেন, যারা তাদের ইলম, ফজল, পবিত্রতা, পরহেজগারী ও বিবেক-বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে অনন্য পর্যায়ের অধিকারী ছিলেন। কিন্তু তাদের মধ্যে কোনো নারীকে কখনই যে রাষ্ট্র প্রধান বানানো হয়নি- ব্যাপার শুধু সেটা নয়, বরং তখন কারোর পক্ষ থেকে নিম্ন স্তরের এমন কোনো মতামতও সামনে আসেনি যে, ‘অমুক নারীকে ‘খলীফা’ বানানো হোক’। না কোনো হাদিসে, না কোনো ইতিহাসের কিতাবে এরকম মতের কোনো অস্তিত্ব মেলে। এটা একথারই সুস্পষ্ট দলিল যে, এ ব্যপারে প্রতি যুগের মুসলমানদের সামনে কুরআন-সুন্নাহ’র আহকাম এতটাই পরিষ্কার ছিল যে, কখনো কোনো মুসলমানের অন্তরে কোনো নারীকে ‘খলিফা’ বানানোর সামান্য খেয়ালটুকু পর্যন্ত আসেনি। আর আসবেই-বা কেমন করে, যখনদ্বীন  ইসলামে এমন কোনো খলিফা/রাষ্ট্রপ্রধানের কথা কল্পনাও করা যায় না-

  • যে খলিফা/রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য বাড়িতে থাকাই (নারী-পুরুষের) ফেতনা থেকে বাঁচার মূল উপায়।
  • যে খলিফা/রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য শরীয়ত সম্মত হাজত/প্রয়োজন ছাড়া তার নিজ গৃহ থেকে বাইরে বের হওয়া জায়েয নয়।
  • যে খলিফা/রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য বিনা প্রয়োজনে পরপুরুষের সাথে অযথা কথাবর্তা বলা জায়েয নয়। এমনকি কথা বলার প্রয়োজন হলে পর্দার আড়াল থেকে আকর্ষনীয় কোমল আওয়াজ পরিহার করে কথা বলতে হয়।
  • যে খলিফা/রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য পুরুষদের মতো -রাস্তার মাঝ দিয়ে চলার হক্ব নেই, বরং তাকে পুরো পর্দা রক্ষা করে রাস্তার এক পাশ ঘেঁষে চলতে হয়। 
  • যে খলিফা/রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য পুরুষদের সাথে একাকার হয়ে রাস্তা দিয়ে চলা জায়েয নয়।
  • যে খলিফা/রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য মাহরাম সঙ্গে থাকা ছাড়া একাকি সফর করা জায়েয নয়।
  • যে খলিফা/রাষ্ট্রপ্রধানকে -স্বামী মড়ে গেলে/তালাক দিলে (স্বাভাবিক অবস্থায়) স্বামীর বাড়িতে (অবস্থা ও শর্ত ভেদে) তিন মাসিক কাল অথবা তিন মাস কিংবা বাচ্চা প্রসব না হওয়া পর্যন্ত ইদ্দত পালন করতে হয় এবং উদ্দত চলাকালীন সময়ে (শরয়ী ঠেঁকা ছাড়া) স্বামীর বাড়ির বাইরে বের হওয়া জায়েয নয়।
  • যে খলিফা/রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য সুগন্ধি লাগিয়ে বা আকর্ষনীয় পোষাকে বা সাজগোঝ করে কোনো পরপুরুষদের সমাবেশে যাওয়া জায়েয নয়।
  • যে খলিফা/রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য মুসলমানদের জামে মসজিদে কোনো নামাযের ইমামতী করা জায়েয নয়।
  • যে খলিফা/রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য কোনো মসজিদে জামাআতের সাথে নামায আদায়ের চাইতে তার নিজ গৃহের অন্দর মহলেনামায আদায় অধিক কল্যানকর।
  • যে খলিফা/রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য মসজিদে জামাআতের সাথে নামায পড়তে হলে পুরুষদের কাতারে ঢুকে নামায আদায় করা কোনো অবস্থাতেই জায়েয নয়, বরং দাঁড়াতে হবে সকল পুরুষ মুসল্লিদের শেষ কাতারের পিছনের কাতারে নারীদের সাথে পূর্ণ পর্দা রক্ষা করে, তাও এমন ভাবে যে, কখনো ইমামের ভুলের লোকমা দিতে হলে তার জন্য কণ্ঠ ব্যবহার করে লোকমা দেওয়াও জায়েয নয় (লোকমা দিতে হবে হাতের উপরে হাত মেড়ে শব্দ করে)।
  • যে খলিফা/রাষ্ট্রপ্রধানের প্রত্যেক মাসে হায়েযের নাপাকী আসার কারণে শরীর পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত নিজের উপর নামায ফরয থাকে না, যে অবস্থায় তার জন্য কোনো মসজিদেই প্রবেশ করা পর্যন্ত জায়েয নয়, (সেখানে সে অন্যের ইমামতী কী করবে)!!!!
  • যে খলিফা/রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য কোনো মুসলমানের জানাযার নামাযের ইমামতী করা করা জায়েয নয়। ইমামতী করা-তো পরের কথা, তার জন্য কোনো জানাযার পিছনে পিছনে চলারই অনুমতি নেই।   
  • যে খলিফা/রাষ্ট্রপ্রধানেরে উপর জুমআর নামায ফরয নয়।
  • যে খলিফা/রাষ্ট্রপ্রধানেরে উপর জিহাদ/কিতাল ফরয নয়।
  • যে খলিফা/রাষ্ট্রপ্রধানেরে ‘ভাত-কাপড়’ বিয়ের আগে পিতার উপর এবং বিয়ের পর স্বামীর উপর ওয়াজিব থাকে।
  • যে খলিফা/রাষ্ট্রপ্রধান নারী-পুরুষ কারোরই বিয়েতে ওলী (অভিভাবক) হতে পারে না।
  • যে খলিফা/রাষ্ট্রপ্রধানের সর্বোচ্চ গন্ডি সীমা তো এই যে, সে খোদ্ তার নিজ ঘরেও ‘ঘর প্রধান’ হওয়ার আসনটুকুও লাভ করে না। 

দ্বীন ইসলাম তামাশা করার জন্য আসেনি। দ্বীন ইসলাম যে জন্য এসেছে, তা সুগঠিত ভাবে কায়েম করার জন্য সে এমন কাউকে খুঁজে, যার মধ্যে উপরোক্ত একটি দূর্বলতাও নেই। এই যে সামনে ইমাম মাহদী রা. এবং হযরত ঈসা ইবনে মারইয়াম আ. আসছেন, যারা পৃথিবী শাসন করবেন কুরআন-সুন্নাহ’র আলোকে, তাঁরাও-তো পুরুষ। দ্বীন ইসলামে নারীকে খলিফা (রাষ্ট্রপ্রধান) বানানোর কোনো কল্পনাও কুরআন-সুন্নাহয় নেই। আর এই বিধান কেয়ামত সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত প্রযোজ্য।

 এজাতীয় বিভিন্ন মজবুত দলিলাদির কারণে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর যুগ থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত নির্ভরযোগ্য সকল আহলে হক্ব ওলামায়ে কেরামের ইজমা (ঐক্যমত) রয়েছে যে, ইসলামী শরীয়তে কোনো নারীকে মুসলমানদের খলিফা (রাষ্ট্রপ্রধান/ইমাম/আমীর/সুলতান) বানানো এবং সংশ্লিষ্ট নারীর তা হওয়া -সম্পূর্ণ নাজায়েয়।

ইমাম ইবনে হাযাম রহ (মৃ. ৪৫৬ হি.). লিখেছেন– واتَّفقوا أنَّ الإمامة لا تجوز لامرأةٍ ولا لكافر  – “এব্যাপারে ওলামাগণ একমত যে, নারীকে ইমাম (খলিফা) বানানো জায়েয নেই… ”। [মারাতিবুল ইজমা, ইবনে হাযাম পৃঃ ২০৮]

ইমামুল হারামাইন যুওয়াইনী (মৃ: ৪৭৮ হি:) রহ. লিখেছেন وأجمعوا أن المرأة لا يجوز أن تكون إماماً – “এব্যাপারে (আহলে হ্বক ওলামায়ে কেরামের) ইজমা রয়েছে যে, নারীর জন্য ইমাম (খলিফা/রাষ্ট্রপ্রধান) হওয়া জায়েয নয়”। [আল ইরশাদ ৪২৭]

ইমাম আবু ওয়ালীদ আল-বাজী (মৃ: ৪৭৪ হি:) রহ. লিখেছেন– ويكفي في ذلك عمل المسلمين من عهد النبي صلى الله عليه وسلم لا نعلم أنه قدم امرأة لذلك في عصر من الأعصار ولا بلد من البلاد، كما لم يقدم للإمامة امرأة – “এর প্রমাণ হিসেবে এতটুকুই যথেষ্ট যে, রাসুলুল্লাহ -এর জামানা থেকে মুসলমানদের আমল চলে আসছে। আমরা কখনও শুনিনি যে, তিনি তাঁর জীবনের কোনো একটি মুহূর্তেও কোনো নারীকে এতগুলো অঞ্চলের মধ্যে কোনো একটি অঞ্চলেও কাযী হিসেবে নিয়োগ দেয়ার পদক্ষেপ গ্রহন করেছেন। একইভাবে তিনি কখনই কোনো নারীকে ইমাম (খলিফা/আমীরে আ’জম/রাষ্ট্রপ্রধান) হিসেবে নিয়োগ দেননি”।  [আল মুনতাক্বা শারহুল মুআত্তা, ইমাম বাজী- ৫/১৮২]

ইমাম ইবনে কুদামা (মৃ: ৬২০ হি:) রহ. লিখেছেন ولا تصلح للإمامة العظمى ولا لتولية البلدان ولهذا لم يول النبي صلى الله عليه وسلم ولا أحد من خلفائه ولا من بعدهم امرأة قضاء ولا ولاية بلد فيما بلغنا، ولو جاز ذلك لم يخل منه الزمان غالبا  – “কোনো নারীকে -না ইমামে আজম (খলিফা/রাষ্ট্রপ্রধান) বানানো জায়েয, আর না কোনো অঞ্চলের প্রশাসক বানানো জায়েয। এজন্যই দেখা যায়, ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানা যেসকল অঞ্চল পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছিল, তার কোথায়ও -না রাসুলুল্লাহ , না আমাদের খুলাফায়ে রাশেদীনের মধ্যে কেউ, আর না তাদের পরবর্তী তে কেউ কোনো নারীকে কাযী (বিচারক) বানিয়েছিলেন, না কোনো অঞ্চলের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। যদি একাজ জায়েয হতই, তাহলে সেই জামানায় আমরা তার কোনো ঝলক অবশ্যই দেখতে পেতাম”। [আল মুগনী, ইবনে কুদামা- ১০/৯২]

ইমাম কুরতুবী (মৃ: ৬৭১ হি:) রহ. লিখেছেন – وأجمعوا على أن المرأة لا يجوز أن تكون إماماً – “এব্যাপারে (আহলে হ্বক ওলামায়ে কেরামের) ইজমা রয়েছে যে, নারীর জন্য ইমাম (খলিফা/রাষ্ট্রপ্রধান) হওয়া জায়েয নয়”। [জামে লি-আহকামিল কুরআন, ইমাম কুরতুবী- ১/২৭০]

বর্তমান কালের কয়েকজন গবেষক আলেম -যাঁরা ‘ইসলামী রাজনীতি’র উপর গ্রন্থ রচনা করেছেন, তারাও এব্যপারে একমত যে, নারীর ‘রাষ্ট্র প্রধান’ হওয়া নাজায়েয হওয়ার ব্যপারে মুসলীম উম্মাহ’র ‘ইজমা’ রয়েছে। আমরা নিম্নে কিছু উদ্ধৃতি পেশ করছি।

ডঃ মুহাম্মাদ মুনীর আযলানী লিখেছেন- لا نعرف بين المسلمين من اجاز خلافة المراة فالاجماع فى هذه القضية تام لم يشذ عنه احد – ‘মুসলমানদের মধ্যে এমন কোনো আলেমের কথা আমাদের জানা নেই, যিনি নারীর খলিফা (রাষ্ট্রপ্রধান) হওয়াকে জায়েয বলেছেন। বস্তুতঃ এ মাসআলার উপর ‘মুকাম্মাল ইজমা’ (পূর্ণাঙ্গ ঐক্যমত) প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, যার বিপরীতে কারো থেকে কোনো ‘শাজ’ (স্বতন্ত্র ও একক) অভিমত বিদ্যমান নেই’। [আবকারিয়াতুল ইসলাম ফি উসুলিল হুকম, মুহাম্মাদ মুনীর- ৮০ পৃষ্ঠা]

ডঃ মুহাম্মাদ জিয়াউদ্দীন আররাইস লিখেছেন- اذا كان قد وقع بينهم خلاف فيما يتعلق بالقضاء فلم يرو عنهم خلاف فيما يتعلق بالامامة بل الكل متفق على انه لا يجوز ان يليها امراة – ‘যদিও ফিকাহবীদ আলেমগনের মাঝে ‘বিচার’ সম্পর্কে মতভিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে (যে, কোনো নারী বিচারক হতে পারবে কি-না), কিন্তু (নারীর) ‘রাষ্ট্র প্রধান’ হওয়া নিয়ে তাঁদের মাঝে কোনো রকম মতভিন্নতা নেই। বরং তাঁদের সকলেই এ ব্যপারে একমত যে, কোনো নারীকে ‘রাষ্ট্র প্রধান’ করা জায়েজ নয়[আন নাজরিয়াতুস সিয়াসিয়াতিল ইসলামিয়্যাহ, মুহাম্মাদ জিয়াউদ্দীন- ২৯৪ পৃষ্ঠা]

ডঃ ইবরাহীম ইউসূফ মুস্তাফা আযওয়া (عجو) লিখেছেন- مما اجمعت عليه الامة لا يجوز لها ان تلى رياست الدول – ‘এ ব্যপারে মুসলিম উম্মাহ একমত যে, কোনো নারীর জন্য রাষ্ট্রের নেতৃত্ব্য ও কর্তৃত্ব গ্রহন করা জায়েয নয়’[তা’লীক তাহযিবুর রিয়াসাত ওয়া তারতিবিস সিয়াসাত, ইব্রাহিম ইউসূফ- ৮২ পৃষ্ঠা]

আল্লামা আব্দুল্লাহ বিন ওমর বিন সুলাইমান আর-রমিযী (الرميجى) লিখেছেন-  من شروط الامام ان يكون ذكرا و خلاف فى ذالك بين العلماء – ‘রাষ্ট্রে প্রধান হওয়ার জন্য যে সব শর্তাবলী রয়েছে, তার মধ্যে একটি হল পুরুষ হওয়া। এ ব্যপারে উলামায়ে কেরামের মাঝে কোনো রকম মতদ্বন্দ্ব নেই’। [আল ইমামাতুল আজমা ইনদা আহলিসসুন্নাহ, বিন ওমর- ২৪৩ পৃষ্ঠা]

বর্তমান যুগের বিখ্যাত ‘মুফাসসিরে কুরআন’ আল্লামা মুহাম্মাদ আমীন শানক্বিতী রহ. লিখেছেন- من شروط الامام الاعظم كونه ذكرا و لا خلاف فى ذالك بين العلماء – ‘রাষ্ট্র প্রধান হওয়ার জন্য যেসব শর্তাবলী রয়েছে, তার মধ্যে একটি হচ্ছে তাকে পুরুষ হতে হবে। এ ব্যপারে ওলমায়ে কেরামের মাঝে কোনো মতবিরোধ নেই’। [আজওয়াউল বায়ান ফি তাফসীরিল কুরআন বিল কুরআন, শানক্বিতী- ২/৬৫]

এখানে সকল ওলামায়ে কেরামের উক্তিে উল্লেখ করা সম্ভব নয়। নারী নেতৃত্ব নাজায়েয হওয়ার ব্যপারে আরো বিস্তারিত জানার জন্য এই কিতাবগুলো দেখা যেতে পারে– [আল আহকামুস সুলতানিয়্যাহ, মাওয়ার্দি- ২/৭২৫; গিয়াছুল উমাম, ইমাম যুওয়াইনী- ৮২ পৃষ্ঠা; আল মুগনী, ইবনে কুদামা- ৭/৬১২; আল ইরশাদ ফি উসুলিল ই’তিকাদ, ইমামুল হারামাইন- ৩৫৯, ৪২৭ পৃষ্ঠা;  শারহুস সুন্নাহ, ইমাম বগভী- ১০/৭৭; আল আহকামুল কুরআন, ইবনুল আরাবী-৩/৪৪৫; আল-বাদায়েউস সানায়ে, ইমাম কাসানী- ৪/৪০, ৬/২০, ৭/৯৮; রাদ্দুল মুহতার আলা দুররিল মুখতার- ৩/৬১৫, ৫/৪২৭; হাশিয়ায়ে দুসুকী- ৩/৮, ৩/৩৭৭, ৪/১২৯; মুগনীল মুহতাজ- ২/৩৯২, ৩/৪৪৫; আল মুহাযযাব, নববী- ২/২৯০; আল ফুরু’, ইবনুল মুফলেহ- ৪/৩৮৪; কাশাফুল কিনা- ৩/৪৫৫; ফাজইহুল বাতিনিয়্যাহ, ইমাম গাযালী- ১৮০ পৃষ্ঠা; নকদু মারাতিবিল ইজমা, ইবনে তাইমিয়্যাহ- ১২৬ পৃষ্ঠা; শারহুল মাকাসিদ, তাফতাযানী- ২/৭৭; আল ইমামাতুল উজমা ইনদা আহলিস সুন্নাহ -২৪৩ পৃষ্ঠা; ইমদাদুল ফাতাওয়া, থানভী- ৫/৯২; তাফসীরে বায়ানুল কুরআন, থানভী ৮/৮৫; আহকামুল কুরআন, মুফতী শফি- ৩/২৯]

আর হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেন إِنَّ اللَّهَ لَا يَجْمَعُ أُمَّتِي عَلَى ضَلَالَةٍ – وصححه الألباني في “صحيح الترمذي“নিশ্চই আল্লাহ আমার উম্মতকে পথভ্রষ্ঠতার উপর ইজমাবদ্ধ/ঐক্যবদ্ধ করবেন না”। [সুনানে তিরমিযী, হাদিস ২১৬৭; মুসতাদরাকে হাকিম- ১/১৯৯, ২০১, হাদিস ৩৯১, ৩৯৭; আল-মু’জামুল কাবির, ত্বাবরানী-৩/২৯২, ১২/৪৪৭, হাদিস ৩৪৪০, ১৩৬২৩; সুনানে আবু দাউদ-২/৫০০ , হাদিস ৪২৫৩; মুসনাদে আহমাদ-৫/১৪৫, হাদিস ২১৩৩১; সুনানে ইবনে মাজাহ- ২/১৩০৩, হাদিস ৩৯৫০; মুসনাদে আব্দ বিন হুমায়েদ- ১/৩৬৭, হাদিস ১২২০; হিলইয়া, আবু নুআইম- ৩/৩৭; আল-মুসান্নাফ, ইবনে আবি শায়বা- ৭/৪৫৭]  যারাই এই বিধানের বিপক্ষে অবস্থান করবে, তারাই পথভ্রষ্ঠ, কুরআন-সুন্নাহ’র বিরোধী, মুসলীম উম্মাহ’র বিরোধী। 

وَمَنْ يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّى وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيرًا
“আর যে ব্যাক্তির কাছে আল-হুদা (সঠিক পথ) প্রতিভাত হয়ে যাওয়ার পরও রাসুলের বিপক্ষে অবস্থান নেয় এবং ইমানদারেগণের পথ ভিন্ন অন্য পথের অনুসরণ করে, সে যেদিকে মুখ ফিরিয়েছে আমরা তাকে সেদিকেই ফিরিয়ে দিবো এবং তাকে জাহান্নামে দগ্ধ করবো। আর (সেটা কতই-না) নিকৃষ্ট গন্তব্যস্থল”। [সূরা নিসা ১১৫]
 
এজন্য মুসলীম সমাজের উপর ফরয হল, তারা তাদের রাষ্ট্রের খলিফা (রাষ্ট্রপ্রধান) হিসেবে মনোনয়ন ও নির্বাচন করবে একজন (মুসলীম) পুরুষকে (যিনি এই পদের সবচাইতে উপযুক্ত)। এটাই হবে খিলাফতের মতো আমানতকে তার উপযুক্ত ব্যাক্তির হাতে সোপর্দ করা। إِنَّ اللهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا –‘নিশ্চই আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন, তোমরা আমানতগুলিকে তার (স্ব-স্ব) উপযুক্ত ব্যাক্তির কাছে সোপর্দ করে দিবে’ [সুরা নিসা ৫৮] 

কিন্তু (শরীয়ত সম্মত কোনো ওজর ছাড়া) যে ব্যাক্তি এই আমানতকে কোনো নারীর হাতে সোপর্দ করবে, সে হবে এই আমানতের এমন এক খিয়ানতকারী যে আল্লাহ তাআলার সাথে, তাঁর রাসুল -এর সাথে, মুসলমানদের সাথে এবং দ্বীন ইসলামের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা (মিরজাফরী) করেছে।

ইসলামী শরীয়তের এই ইজমায়ী মাসআলার বিপরীতে-

(ক) ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে যেহেতু রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে ধর্মীয় বিধানকে ১০০% মুক্ত করায় বিশ্বাস (ইমান) রাখা অত্যাবশ্যক (ফরয) শর্ত, তাই রাষ্ট্রপ্রধান নিয়োগ দানের ক্ষেত্রেও ইসলাম ধর্মের এই ‘পুরুষ রাষ্ট্রপ্রধান’ হওয়ার শর্তটিকে রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে ১০০% মুক্ত করায় বিশ্বাস (ইমান) রাখা তাদের মতে অত্যাবশ্যক (ফরয)।

(খ) ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে যেহেতু  রাষ্ট্রযন্ত্রে কোনো ধর্মীয় বিধিবিধানকে টেনে আনা ১০০% নিষিদ্ধ (হারাম), তাই রাষ্ট্রপ্রধান নিয়োগ দানের ক্ষেত্রেও ইসলাম ধর্মের এই ‘পুরুষ রাষ্ট্রপ্রধান’ হওয়ার শর্তটিকে রাষ্ট্রযন্ত্রে টেনে আনাও তাদের মতে ১০০% নিষিদ্ধ (হারাম)।

(গ) ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ যেহেতু বিশ্বাস করে- যে ব্যাক্তি ধর্মীয় বিধিবিধানকে রাষ্ট্রব্যাবস্থায় টেনে আনায় বিশ্বাসী সে আদপে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদেই বিশ্বাসী নয় বরং অস্বীকারকারী (কাফের), তাই যে ব্যাক্তি রাষ্ট্রপ্রধান নিয়োগ দানের ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্মের এই ‘পুরুষ রাষ্ট্রপ্রধান’ হওয়ার শর্তটিকে রাষ্ট্রযন্ত্রে টেনে আনায় বিশ্বাসী, তাদের মতে সেও আদপে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে বিশ্বাসীই নয় বরং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে অস্বীকারকারী (কাফের)।

(ঘ) উপরোক্ত এই ৩টি পয়েন্টের এব্যাপারে খাঁটি ধর্মনিরপেক্ষতা বাদীদেরর ইজমা (ঐক্যমত) রয়েছে।

পুরুষ ও নারী যতদিন পর্যন্ত তাদের উপর আল্লাহ’র আরোপিত স্ব-স্ব দায়িত্বগুলিকে পালন করবে ততদিন দ্বীন-দুনিয়ার ফিতরাতী-নেজাম (স্বাভাবিক ব্যবস্থাপনা) সবকিছুই সুষ্ঠুভাবে চলবে। অপরদিকে পুরুষরা যখন নারীদের দায়িত্ব গ্রহন করবে এবং নারীরা পুরুষের দায়িত্ব গ্রহন করে সব এলোমেলো করে দিবে, তখন তারা দ্বীন-দুনিয়ার ফিতরাতী-নেজাম (স্বাভাবিক ব্যবস্থাপনা)-কে নষ্ট করে দেয়ার কারণে জীবনের সকল ক্ষেত্রে ফিতনা-ফ্যাসাদের দ্বার উন্মুক্ত করে দিবে। এদিকে ইশারা করেই আবু হুরায়রাহ রা. -এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে,  রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেন- إِذَا كَانَ أُمَرَاؤُكُمْ خِيَارَكُمْ وَأَغْنِيَاؤُكُمْ سُمَحَاءَكُمْ وَأُمُورُكُمْ شُورَى بَيْنَكُمْ فَظَهْرُ الأَرْضِ خَيْرٌ لَكُمْ مِنْ بَطْنِهَا وَإِذَا كَانَ أُمَرَاؤُكُمْ شِرَارَكُمْ وَأَغْنِيَاؤُكُمْ بُخَلاَءَكُمْ وَأُمُورُكُمْ إِلَى نِسَائِكُمْ فَبَطْنُ الأَرْضِ خَيْرٌ لَكُمْ مِنْ ظَهْرِهَا ‏. رواه الترمذي في سننه : رقم ٢٢٦٦ و قال الترمذي: هذا حديث غريب لا نعرفه إلا من حديث صالح المري، وصالح المري في حديثه غرائب ينفرد بها لا يتابع عليها وهو رجل صالح، و البزار في البحر الزخار : ١٧/٢٠ رقم ٩٥٢٩، و ابن جرير ألطبري في تهذيب الآثار: ١/١٦٦ رقم ١٥٣، أبو نعيم في الحلية : ٦/١٧٦، و أبو عمرو الداني في السنن الواردة في الفتن: ١/١٠٦ رقم ٣٠٣ ، و ضعف الشيخ الألباني هذا الحديث في السلسلة الضعيفة : رقم ٦٩٩٩ و في ضعيف سنن الترمذي যখন তোমাদের উৎকৃষ্ট লোকগুলি তোমাদের আমীর (প্রশাসক) হবে, তোমাদের ধ্বনবান লোকগুলি তোমাদের দানশীলরাই হবে এবং তোমাদের বিষয়আশয়গুলি তোমাদের মাঝে পরামর্শের মাধ্যমে সম্পাদিত হবে, তখন জমিনের উপরিভাগ তোমাদের জন্য জমিনের গহবর থেকে উত্তম হবে। আর যখন তোমাদের নিকৃষ্ট লোকগুলি তোমাদের আমীর (প্রশাসক) হবে, তোমাদের ধ্বনবান লোকগুলি তোমাদের কৃপণরাই হবে এবং তোমাদের বিষয়গুলিকে তোমাদের নারীদের হাতে সোপর্দ করা হবে, তখন জমিনের গহবর তোমাদের জন্য জমিনের উপরিভাগ থেকে উত্তম হবে”। [সুনানে তিরমিযী- ২/৪২, হাদিস ২২৬৭; মুসনাদে বাযযার- ১৭/২০ হাদিস ৯৫২৯; তাহযীবুল আছার, ইমাম ত্বাবারী- ১/১৬৬ হাদিস ১৫৩; সুনানুল ওয়ারিদাহ, ইমাম দানী- ১/১০৬ হাদিস ৩০৩; তারিখে বাগদাদ, খতীব– ২/৫৮৭; হিলইয়াতুল আউলিয়াহ, আবু নুআইম- ৬/১৭৬; আল-উকুবাত, ইবনু আবিদ্দুনিয়া, হাদিস ২৭৯]

এই হাদিসে এমন যুগের কথা বলা হচ্ছে, যখন -ইসলামী শরীয়ত যেসকল পদের দায়িত্ব পালনের ভার মুসলীম পুরুষদের কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছে- দেখা যাবে যে, সে যুগে উম্মাহ’র একটি গোষ্ঠি ওসকল পদের দায়িত্ব নারীদের হাতে সোপর্দ করতে থাকবে, যার পরিণতিতে এমন সমাজ তৈরী হতে থাকবে যেখানে মুমিন নারী-পুরুষের জন্য ইমান নিয়ে চলাটা এত কঠিন হয়ে পড়বে যে, তাদের জন্য জীবিত থাকার চেয়ে মড়ে কবরে চলে যাওয়াটাই ইমান হিফাজতের প্রশ্নে অধিক নিরাপদ বিবেচিত হবে। বস্তুতঃ ‘নারী-স্বাধীনতা’, ‘নারী-পুরুষের সম অধিকার’, ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ ইত্যাদির নামে আজ উম্মাহ যা কিছু শুরু করে দিয়েছে, তা এই হাদিসেরই বাস্তব রূপ। আর এখন-তো এমপি, মন্ত্রী, প্রধান স্পিকার, সরকারী বিভিন্ন প্রশাসনিক পদ, শহর গ্রামের চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর, মেয়র, আর্মী-র‌্যাব-পুলিশ-ট্রাফিক-সিকিউরিটি গার্ড, শো-রূম, মার্কেট-দোকানপাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মিডিয়া, এনজিও -এমন কোনো স্থান নেই, যেখানে দায়িত্বগুলোকে নারীর হাতে সোপর্দ করা হচ্ছে না। তাই বিনা-দ্বিধায় বলা যায়, হাদিসটির ভবিষ্যতবাণী আমাদের এই শেষ জামানার দিকেই ইংগীত করে করা হয়েছিল। নিচের বর্ণনাটি আমার এই দাবীকে আরো পরিষ্কার করে দেয়।

আরেক রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে, আলী রা. বর্ণনা করেছেন- ليأتين على الناس زمان؛ يطرى فيه الفاجر، ويقرب فيه الماحل، ويعجز فيه المنصف، في ذلك الزمان تكون الأمانة فيه مغنمًا، والزكاة فيه مغرمًا، والصلاة تطاولًا، والصدقة منا، وفي ذلك الزمان استشارة الإماء، وسلطان النساء، وإمارة السفهاء . رواه ابن المنادي كما جاء في جامع الأحاديث لجلال الدين السيوطي : ٣٢/٦١ رقم ٣٤٧١٢ ; و في إتحاف الجماعة بما جاء في الفتن والملاحم وأشراط الساعة : ٢/٣٨ ; اورده المتقي في كنز العمال : ١٤/٥٧٥ رقم ٣٩٦٤١  – ‘মানুষের উপরে অবশ্যই এমন জামানা আসবে, যখন ফাজের (পাপঘেঁষা খবিস কিসিমের) ব্যাক্তির (অমূলক) প্রশংসা করা হবে, প্রতারককে কাছে রাখা হবে, ইনসাফগার ব্যাক্তিকে (সামাজিক ভাবে) কোণঠাসা করে দেয়া হবে। ওই জামানায় এমন হবে যে, তখন (মানুষজনের দ্বীনদারিত্ব না থাকায় তাদের কাছে) আমানত হয়ে যাবে গণীমত (স্বরূপ, যা তারা নিজেদের ব্যাক্তিগত সম্পর্দের মতো ভোগ করবে। তাদের মধ্যে মুনাফেকী, বদদ্বীনীতা ও ভোগবাদীতা জেঁকে বসার কারণে শরীয়তে ফরযকৃত) যাকাত (-কে তাদের কাছে মনে) হবে জরিমানা (স্বরূপ), নামায হবে দীর্ঘায়িত (তবে অন্তসারশুন্য অথবা বারাবারি মূলক), (তারা যাও-বা কিছু) দান-সদকাহ (করবে, তা) হবে খোঁটাদানমূলক। সেই জামানায় বাদীর কাছে পরমর্শ চাওয়া হবে, নারী সুলতান (রাষ্ট্রপ্রধান) হবে এবং মন্ত্রীরা হবে নির্বোধ’। [ইবনু মুনাদী: আল-জামেউল কাবির, ইমাম সুয়ূতী- ৩২/৬১ হাদিস ৩৪৭১২; কানজুল উম্মাল- ১৪/৫৭৫ হাদিস ৩৯৬৪১; ইতহাফুল জামাআহ – ২/৩৮]

যেমন আমরা উপরে প্রমাণ এসেছি যে, ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে ‘নারী’  রাষ্ট্রপ্রধান পদটির ‘আহাল (যোগ্যতা সম্পন্ন)’ নয়, বরং গায়রে-আহাল (অযোগ্য), বিধায় ইসলামী শরয়তে নারী-রাষ্ট্রপ্রধান সম্পূর্ণ রূপে নাজায়েয; যার উপরে গোটা মুসলিম উম্মাহ’র ইজমা রয়েছে। শরীয়তের এই ইজমায়ী বিধানটিকে পালনার্থে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর বরকতময় যুগ থেকে শুরু করে নিয়ে গত ১৯২০ ইং সালে তুরষ্কের উসমানী খিলাফত ধ্বংসের আগ পর্যন্ত ইসলামী শাসনের সুদীর্ঘ প্রায় ১৪৫০ বছরের ইতিহাসে কোনো দ্বারুল ইসলামের মুসলমানরা কোনো দিন কোনো নারীকে তাদের রাষ্ট্রপ্রধান বানানোর কথা কল্পনাও করেনি, ফরে বাস্তবেও মুসলমানদের উপরে কোনো নারী-রাষ্ট্রপ্রধান ছিল না। কিন্তু গত ১৯২০ ইং সালের পর দেশে দেশে ইসলামী শরীয়তের আইন কানুনগুলোকে রাষ্ট্র থেকে বিলুপ্ত করার যুগ শুরু হয় এবং আইনকানুনেরে মধ্যে গণতন্ত্র (democracy), ধর্মনিরপেক্ষতা (secularism) অথবা সমাজতন্ত্র (socialism) বা কমিউনিজমের রং বসা শুরু হয়। এর ক্রমধারায় ইসলামী শরীয়তের ‘মুসলমান-রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার বিধানটি বাতিল হওয়ার সাথে সাথে পুরুষ-রাষ্ট্রপ্রধান’ হওয়ার শরয়ী বিধানটিও বাতিল হয়ে যায়। অমুসলীমদের কথা তো আলাদা, খোদ মুসলীম বলে দাবীদার সমাজের মধ্যে ‘পুরুষ-রাষ্ট্রপ্রধান’ হওয়ার এই শরয়ী বিধানটি প্রথমবারে মতো সফলভাবে পদদলিত করা হয় গত ১৯৮৬ ইং সালে ‘বেনজির ভুট্টো’কে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান বানানোর মাধ্যমে, (পরে ১৯৯৩ ইং সালেও সে আবার পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান হয়)। দ্বিতীয়জন হল খালেদা জিয়া, যে ১৯৯১ ইং সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান হয়। আর তৃতীয়জন হল শেখ হাসিনা ওয়াজেদ, যে ১৯৯৬ ইং সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান হয় (এবং ২০০১ ইং পর্যন্ত এ পদে থাকে। এরপর ২০০৯ সালে আবারো রাষ্ট্রপ্রধান হয় এবং আজ ২০২২ অবধি একটাকা সে-ই রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে রয়েছে)। আমার জানা মতে, মুসলিম বলে দাবীদার নারীদের মধ্যে এই তিনজন ছাড়া (আজ ২০ মার্চ ২০২২ ইং পর্যন্ত) চতুর্থ কোনো (মুসলীম দাবীদার) নারী এই উম্মাহর মধ্যে কোনো দেশের একেবারে রাষ্ট্রপ্রধান-এর আসনে বসেনি। এ থেকে বোঝা গেল, উপরের ভবিষ্যৎবাণীটি আমাদের এই শেষ জামানার দিকে ইশারা করেই করা হয়েছে।

কতই না ভাল হত, যদি কমপক্ষে মুসলিম বলে পরিচিত নারীরা বিশ্বাস করতে পারতো যে, আল্লাহ তাআলা তাদের উপরে পুরুষদের চাইতে কম দায়িত্ব অর্পণের মাধ্যমে জান্নাতে যাওয়ার পথকে সহজ করে দিয়েছেন, আর কতই না ভাল হত যদি এযুগের ব্রেনওয়াশড নারীরা তাদের প্রভু আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসুল কে এসব ব্যাপারে তাদের সাথে -প্রতারনা বা পক্ষপাতিত্ব- করেছেন মর্মে বিশ্বাস না করতো। যদি তারা বুঝতো, তাহলে আল্লাহ’র কসম, তাদের জন্য এবং তারা যে দুনিয়ায় বাস করে তার জন্য ভাল হত। কিন্তু আজ এমন এক যুগে বাস করছি, যখন সাদা চামড়ার ওই শয়তান রাজনীতিকদের ফাঁদে পা দিয়ে প্রতিটি দেশে দেশে সুলতানা কামাল তৈরী হয়েছে ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ স্লোগানের ইমামতী করার জন্য, আর তাদের পিছনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এক্বতেদা করেছে কোটি কোটি নারী, যারা কমোড় বেঁধে নেমেছে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল -এর বিরুদ্ধাচারন করার ভিশন নিয়ে। মনে হয়, আমাদের এই আখেরী জামানার এইসব নারীদের আল্লাহদ্রোহিতার দিকেই ইশারা করেই এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ ভবিষ্যদ্বাণী এভাবে বর্ণিত হয়েছে- كيف بكم – أيها الناس! – إذا طغى نساؤكم، وفسق فتيانكم؟ قالوا: يا رسول الله! إن هذا لكائن؟! قال: نعم، وأشد منه – ‘হে লোকসকল! তখন তোমাদের কেমন অবস্থা হবে যখন তোমাদের নারীরা তাগুত (আল্লাহদ্রোহি) হয়ে যাবে এবং তোমাদের ছেলেরা ফাসেক (পাপঘেঁষা/পাপে অভ্যস্ত) হবে যাবে? (উপস্থিত লোকরা (অবাক হয়ে) বললো: ইয়া রাসুলাল্লাহ ! এমন ঘটনাও ঘটবে !!! রাসুলুল্লাহ সা. বললেন: হা, এর চেয়েও কঠিন অবস্থা হবে।… [মুসনাদে আবু ইয়া’লা ১৪/৩০৪; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাইসামী-৭/২৮০; মু’জামে আউসাত, ত্বাবরাণী-৯/১২৯, হাদিস ৯৩২৫; ইবনে আবিদ্দুনইয়া, হাদিস ৭৯]

 


>>> মূল সূচিপত্র (index) থেকে এ পেজের পূর্ববর্তী বা পরবর্তী আলোচনা পড়তে [এখানে ক্লিক করুন]