কিতাল / শসস্ত্র জিহাদ ফরযে কেফায়া নাকি ফরযে আইন ? কুরআন সুন্নাহ ও ফিকহি দলিল
بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیۡمِ
الحمد لله و الصلاة و السلام على رسوله محمد و على أله و أمّته
اَللّٰهُمَّ صَلِّ عَليٰ مُحَمَّدٍ النبي الأمي عَدَدَ خَلْقِك وَ رِضَا نَفْسِك وَزِنَةَ عَرْشِك وَ مِدَادَ كَلِمَاتِك، صَلِّ عَليه صَلاَةً كَامِلَةً دَائِمَةً كَمَا يَنْبَغِي أَنْ يُصَلَّى عَلَيهِ وَ سَلِّمْ تَسلِيمَاً بِقَدرِ عَظَمَةِ ذَاتِكَ فِى كُلِّ وَقتٍ وَ حِين، صلاة تكون لك رضاء و له جزاء، صلاة لا غاية لها ولا منتهى ولا انقضاء باقية ببقائك الى يوم الدين ، و اعطه الوسيلة و الفضيلة و المقام المحمود الذي وعدته، و اجزه عنا ما هو اهله، و على اله وأصحابه و أزواجه و ذريته و أهل بيته و سلم تسليما مثل ذلك، اَللّٰهُمَّ اجمعني معه في الفردوس و جنة المأوى، اَللّٰهُمَّ صَلِّ عَليٰ مُحَمَّدٍ صَلوٰةً تُنَجِّيْنَا بِهَا مِنْ جَمِيْعِ الْأَهْوَالِ وَاْلآفَاتِ وَتَقْضِيْ لَنَا بِهَا مِنْ جَمِيْعِ الْحَاجَاتِ وَتُطَهِّرُنَا بِهَا مِنْ جَمِيْعِ السَّيِّاٰتِ وَتَرْفَعُنَا بِهَا عِنْدَكَ اَعْليٰ الدَّرَجَاتِ وَتُبَلِّغُنَا بِهَا اَقْصىٰ الْغَايَاتِ مِنْ جَمِيْعِ الْخَيْرَاتِ فِي الْحَيَاتِ وَبَعْدَ الْمَمَاتِ – اِنَّكَ عَليٰ كُلِّ شَيْئٍ قَدِيْرٍ بِرَحْمَتِكَ يَا اَرْحَمَ الرَّاحِمِيْنَ
>>> মূল সূচিপত্র (index) থেকে এ পেজের পূর্ববর্তী বা পরবর্তী আলোচনা পড়তে [এখানে ক্লিক করুন]
পূর্ব আলোচনার পর…
ইসলামী শরীয়তে জিহাদ ফরযে কেফায়া নাকি ফরযে আইন ?
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-
كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِتَالُ
“(হে মুসলমানগণ) তোমাদের উপরে ক্বিতাল (সশস্ত্র জিহাদ)’কে ফরয করে দেয়া হল”। [সূরা বাকারাহ ২১৬]
এখন প্রশ্ন হল, ‘ক্বিতাল বা শসস্ত্র জিহাদ’ কি –পাঁচ ওয়াক্ত সালাত (নামায), সিয়াম (রোযা) প্রভৃতি আমলের ন্যায় প্রতিটি মুকাল্লাফ (আকেল, বালেগ, সুস্থ্য) মুসলমানের উপরে একক একক ভাবে ফরযে আইন, নাকি জানাযার নামায ইত্যাদি আমলের ন্যায় সকল মুসলমানের উপরে সামষ্টিক ভাবে ফরযে কেফায়া (যা পর্যাপ্ত কিছু সংখ্যক মুসলমান আদায় করলেই বাকি সকল মুসলমানের পক্ষ থেকে ফরযটি আদায় হয়ে যায়)? এ প্রশ্নের জবাব পাওয়ার আগে সর্বপ্রথমে একথা জানা জরুরী যে, ইসলামী শরীয়ত মোতাবেক ফরযে আইন এবং ফরযে কেফায়া কী? এর পরে আমাদেরকে দেখতে হবে যে, শরীয়ত মতে ‘ক্বিতাল বা শসস্ত্র জিহাদ’ মুসলমানদের উপরে ফরযে আইন, নাকি ফরযে কেফায়া -কোন্ কোন্ অবস্থায়। নিম্নে এ বিষয়ে সংক্ষেপে কিছু কথা পেশ করা হল।
ফরযে আইন : ফরযে আইন হল ইসলামী শরীয়তের এমন ফরয আমল, যা প্রতিটি মুকাল্লাফ (আকেল, বালেগ, সুস্থ্য) মুসলমানের উপরে স্বতন্ত্র/একক ভাবে আদায় করা ফরয থাকে, ফলে তা নিজে আমল করে আদায় না করলে খোদ তার উপরই উক্ত ফরয আমলটি তরকের দায় ও গুনাহ বর্তায়, আর সাধারণ অবস্থায় অন্য কোনো মুসলমান তার পক্ষ থেকে উক্ত ফরযটি আদায় করলেও ফরযটি আদায় হয় না। [শারহুল কাউকাবিল মুনীর, ইবনু নাজ্জার- ১/২৭৪; রাদ্দুল মুহতার, ইবনে আবিদীন- ১/৪২, ১/৫৩৮, ৪/১২৩]
ইমাম তক্বীউদ্দীন ইবনু নাজ্জার (মৃ: ৯৭২ হি:) রহ. বলেন- سمى فرض عين، لأن خطاب الشارع يتوجه إلى كل مكلف بعينه، ولا تبرأ ذمة المكلف منه إلا بأدائه بنفسه – “(একে এজন্য) ফরয়ে আইন (সুনির্দিষ্ট/স্বতন্ত্র ফরয) নামকরণ করা হয়েছে, কেননা শরীয়ত-প্রবক্তা (নবী মুহাম্মাদ ﷺ) সংশ্লিষ্ট (ওই ফরয) বিষয়টির আদেশ দানের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট ভাবে তাঁর মূল লক্ষ্যবস্তু রেখেছেন প্রত্যেক মুকাল্লাফ (আকেল, বালেগ, সুস্থ্য মুসলমান)কে, আর (তা এমন এক ফরয আমল) যা সংশ্লিষ্ট মুকাল্লাফ ব্যাক্তি নিজে নিজে আদায় না করা পর্যন্ত উক্ত আমলের জিম্মাদারী (দায়িত্বভার) তার থেকে আদায় হয় না”। [শারহুল কাউকাবিল মুনীর, ইবনু নাজ্জার- ১/২৭৪]
যেমন: পাঁচ ওয়াক্ত সালাত (নামায)। এই আমলটি প্রতিটি মুকাল্লাফ (আকেল, বালেগ, সুস্থ্য) মুসলমানের উপরে স্বতন্ত্রে/একক ভাবে আদায় করা ফরয থাকে এবং তা নিজে আদায় না করলে খোদ তার উপরই উক্ত ফরয আমলটি তরকের দায় ও গুনাহ বর্তায়, আর অন্য কোনো মুসলমান তার পক্ষ থেকে উক্ত ফরযটি আদায় করলেও তা আদায় হয় না।
ফরযে কেফায়া : ফরযে কেফায়া বলতে ইসলামী শরীয়তের এমন ফরয আমল উদ্দেশ্য, যা সাধারণ অবস্থায় প্রতিটি মুকাল্লাফ (আকেল, বালেগ, সুস্থ্য) মুসলমানের উপরে আলাদা আলাদা ভাবে আদায় ফরয থাকে না, বরং সকল মুকাল্লাফ মুসলমানের উপরে সামষ্টিক ভাবে আদায় করা ফরয থাকে, তবে পর্যাপ্ত সংখ্যক মুসলমানের দ্বারা তা আদায়হয়ে গেলে বাদবাকি অপরাপর মুসলমানদের পক্ষ থেকে উক্ত ফরয দায়িত্বটি আদায় হয়েছে বলে গণ্য হয়। অপর দিকে- (ক) যদি কোনো মুসলমানই ওই ফরযটি আদায় না করে তাহলে সকল মুসলমানের উপরে উক্ত ফরয আমল তরকের দায় ও গুনাহ বর্তায়, আর (খ) যদি অপর্যাপ্ত সংখ্যক মুসলমান মিলে ফরযটি আদায় করে যার কারণে ফরযটি পুরোপুরি পালনের হক্ব আদায় হয় না, তাহলে যারা ফরযটি পালনে লিপ্ত রয়েছে তারা বাদে বাকি সকল মুসলমানের উপরে উক্ত ফরয আমলটি তরকের দায় ও গুনাহ বর্তায় -যাবৎ না ফরযটি আদায় করতে এত সংখ্যক মুসলমান অংশগ্রহন করে যে, তা আদায়ে পর্যাপ্ত সংখ্যক ব্যাক্তি শরিক হয়েছে বলে ধর্তব্য হয়। [আল-হিদায়াহ, ইমাম মারগিনাণী- ২/৩৭৮; আল-মুগনী, ইবন কুদামাহ- ৯/১৬৩; শারহুল কাউকাবিল মুনীর, ইবনু নাজ্জার- ১/২৭৪; বাদায়ীউস সানায়ী, ইমাম কাসানী- ১৫/২৭০; মুগণীল মুহতাজ- ৬/১৬; মাজমুঅতুল কাওয়ায়ীদিল ফিকহী- ১/৪১০; মাজমাউল আনহুর- ১/৯; আল জাওয়াহারাতুন নায়্যীরাহ- ১/৪]
ইমাম ইবনু কুদামাহ আল-মাকদীসী (মৃ: ৬২০ হি:) রহ. লিখেছেন- معنى فرض الكفاية، الذي إن لم يقم به من يكفي، أثم الناس كلهم، وإن قام به من يكفي، سقط عن سائر الناس . فالخطاب في ابتدائه يتناول الجميع، كفرض الأعيان، ثم يختلفان في أن فرض الكفاية يسقط بفعل بعض الناس له، وفرض الأعيان لا يسقط عن أحد بفعل غيره . اهـ – “ফরযে কেফায়া অর্থ হল (এমন ফরয আমল) যা পর্যাপ্ত সংখ্যক (মুসলীম) ব্যাক্তি যদি তা কায়েম না করে, তাহলে সকল মুসলমানই গুনাহগার হয়। আর যদি পর্যাপ্ত সংখ্যক (মুসলীম) ব্যাক্তি তা কায়েম করে, তাহলে বাকি সকল মুসলমানের উপর থেকে (ওই ফরয আদায়ের দায়িত্বটি) সাকেত (স্থগিত) হয়ে যায়। বস্তুত: (যে কোনো ফরযে কেফায়া আমল কায়েম করার অত্যাবশ্যকতা ও অপরিহার্যতা সম্পর্কে কথা হল) এটি প্রথমাবস্থায় ফরযে আইনের মতোই সকল (মুসলমান)-এর উপরে (সমভাবে) আদিষ্ট থাকে। এ দুয়ের মাঝে (মূল) পার্থক্য হল, কিছু (পর্যাপ্ত) সংখ্যক ব্যাক্তি কর্তৃক (এ ফরয) আমলটি আদায়ের দ্বারা (অপরাপর সকল মুসলমানের উপর থেকে উক্ত) ফরযে কেফায়ার দায়িত্বটি সাকেত (স্থগিত) হয়ে যায়, কিন্তু (অন্য দিকে) একজনের আমলের দ্বারা আরেকজনের উপরে থেকে ফরযে আইন আদায়ের দায়িত্ব সাকেত (স্থগিত) হয় না”। [আল-মুগনী, ইবন কুদামাহ- ৯/১৬৩]
ইমাম তক্বীউদ্দীন ইবনু নাজ্জার (মৃ: ৯৭২ হি:) রহ. বলেন- سمي فرض كفاية لأن قيام بعض المكلفين به يكفي للوصول إلى مقصد الشارع في وجود الفعل، ويكفي في سقوط الإثم عن الباقين، مع كونه واجباً على الجميع – “ফরয়ে কেফায়া (‘যথেষ্ট সংখ্যকের আদায়কৃত ফরয’- এই) নামকরণ করা হয়েছে, কারণ আমলটি অস্তিত্ব লাভের পিছনে শরীয়ত-প্রবক্তা (নবী মুহাম্মাদ ﷺ)-এর যে উদ্দেশ্য ছিল, সেই উদ্দেশ্যটি -(পর্যাপ্ত) কিছু সংখ্যক মুকাল্লাফ (আকেল, বালেগ, সুস্থ্য মুসলমান) কর্তৃক আমালটি কায়েম করার দ্বারা- যথেষ্ট মাত্রায় হাসিল হয়ে যায় এবং তা বাদবাকি মুসলমানদের উপর থেকে গুনাহকে রুখে দেয়ার জন্য যথেষ্ট হয় –যদিও আমলটি(কে আদায় করার দায়ভার প্রথমাবস্থায়) সকল মসলমানের উপরে ফরয হিসেবে থাকে”। [শারহুল কাউকাবিল মুনীর, ইবনু নাজ্জার- ১/২৭৪]
উদাহরণ-১: সালাতে জানাযা (জানাযার নামায) হল ফরযে কেফায়া। অর্থাৎ, কোনো মুসলমানের মৃত্যুতে তার জানাযার নামায আদায় করা প্রত্যেকটি মুকাল্লাফ মুসলমানের উপরে স্বতন্ত্র ভাবে ফরয দায়িত্ব নয় যে, যে-ই তা আদায় না করবে সেই ফরয তরকের গুনাহ করবে। বরং এর অর্থ হল, মৃত মুসলমানের জানাযার নামায আদায় করার দায়িত্বটি সামষ্টিকভাবে সকল মুসলমানদের উপরে ফরয হিসেবে বিদ্যমান থাকে, এবং যখন কমপক্ষে এত সংখ্যক মুসলমান উক্ত মৃতের জানাযার নামায আদায় করে নেয় যে, তাতে জানাযার নামাযটি শরীয়ত সম্মত ভাবে আদায় হওয়ার জন্য ‘পর্যাপ্ত সংখ্যক হওয়ার’ শর্ত পূরণ হয়ে যায়, তখন -যেসকল মুসলমান উক্ত জানাযার নামাযে শরিক হয়নি তাদের সকলের পক্ষ থেকে উক্ত ফরযটি আদায় হয়ে যায়। (যেহেতু কমপক্ষে একজন মুসলমান জানাযার নামায আদায় করলেই ফরযটি আদায় হয়ে যায়, তাই এক্ষেত্রে ওই একজনের এই ফরযটি আদায়ের দ্বারাই বাকি সকল মুসলমানের উপর থেকে ফরয দায়িত্বটি আদায় হয়ে যাবে। অপরদিকে, যদি উক্ত মৃতের জানাযার নামায কোনো মুসলমানই আদায় না করে, তাহলে সকল মুসলমানের উপরে উক্ত ফরয আমলটি তরকের দায় ও কবীরা গুনাহ বর্তাবে।
উদাহরণ-২: মৃতকে গোসল দেয়া এবং কবরে দাফন করা হল ফরযে কেফায়া। এক্ষেত্রেও এর অর্থ হল, সংশ্লিষ্ট মৃতকে গোসল ও কাফন দাফন দেয়ার দায়িত্বটি প্রতিটি মুকাল্লাফ মুসলমানের উপরে আলাদা আলাদা ভাবে ফরয নয় বরং সামষ্টিকভাবে সকল মুসলমানদের উপরে ফরয হওয়ায়, ওই মৃতকে যদি একজন কোনো মুসলমানও গোসল দিয়ে কাফন দাফনের ব্যবস্থা সম্পন্ন করে নেয় তাহলে বাকি সকল মুসলমানের পক্ষ থেকে এই ফরযটি আদায় হয়ে যাবে এবং এই ফরয কাজে অনুপস্থিত মুসলমানরা ওই মৃতের গোসল ও কাফন দাফনের দায়িত্ব আদায় না করার কারণে ফরয তরকের গুনাহে গুনাহগার হবে না। অপরদিকে, যদি উক্ত মৃতকে গোসল ও কাফন দাফন দেয়ার দায়িত্ব কোনো মুসলমানই আদায় না করে, তাহলে সকল মুসলমানের উপরে উক্ত ফরয আমলটি তরকের দায় ও কবীরা গুনাহ বর্তাবে।
কিন্তু মনে করুন, কোনো কারণে (যেমন: ভূমিকম্প, ঝর, প্লাবন, টর্নেডো ইত্যাদির কারণে) কোথাও এত বেশি সংখ্যক মুসলমান মাড়া গেল যে, মাত্র ১ জনের পক্ষে তাদের সকলকে গোসল ও কাফন দাফন দেয়া বাহ্যত স্বাভাবিক সাধ্যের বাহিরে, বরং সেখানে এ দায়িত্বটি আদায়ের জন্য কমপক্ষে আরো এত বেশি সংখ্যক মুসলমানের দরকার যে, তাতে সেখানকার সকল মৃতের গোসল ও কাফন দাফন কার্যটি নূন্যতম শরয়ী মাত্রার হলেও আদায় হয়ে যায়। মনে করুন, তাদের সকলের গোসল ও কাফন দাফন সুসম্পন্ন করার জন্য কমপক্ষে ২০ জন মুসলমান দরকার। তাহলে এক্ষেত্রে উক্ত ২০ জন মুসলমানকে বলা হবে, এ ফরয দায়িত্বটি আদায়ের জন্য তারা হল নূন্যতম ‘পর্যাপ্ত সংখ্যক মুসলমান’, যাদের দ্বারা উক্ত সকল মৃতের গোসল ও কাফন দাফন দেয়ার ফরযে কেফায়া আদায় হওয়া বাহ্যত সম্ভব। এখন যদি ২০ জন মুসলমান এসে সকল মৃতের গোসল ও কাফন দাফন সুসম্পন্ন করে ফেলে তাহলে বাকি সকল মুসলমান ফরয তরকের গুনাহ থেকে বেঁচে যাবে। কিন্তু যদি সেক্ষেত্রে (মনে করুন) ১৫ জন মুসলমান এ কাজে শরীক হয়ে তাদের সাধ্য মতো যথা-সংখ্যক মৃতদেরকে গোসল ও কাফন দাফন দিয়ে বাকি মৃত’দেরকে ফেলে রেখে চলে গেল, যার কারণে বাকি ওই লাশগুলো গলে-পঁচে গন্ধ ছড়াতে লাগলো, তাহলে এই ১৫ জন মুসলমান তাদের সাধ্য মতো দায়িত্ব পালন করার কারণে তারা ফরয তরকের অপরাধে গুনাহগার হবে না, বরং তারা বাদে যে সকল মুসলমান শক্তি-সামর্থ থাকা সত্ত্বেও এ ফরয দায়িত্বটি পালন করা থেকে বিরত থেকেছে যার কারণে অবশিষ্ট মৃতদেহগুলোর এই দুরাবস্থা হয়েছে তাদের সকলের উপরে ফরয তরকের গুনাহহ বর্তাবে।
এ থেকে বোঝা গেল, ফরযে কেফায়া’র বিভিন্ন সংজ্ঞায় বর্ণিত- “ بعض (কিছু সংখ্যক)” মুসলমান -কথাটি থেকে ভুল বুঝে যারা এই মনে করে বসে থাকে যে, “ কিছু সংখ্যক মুসলমান তো ফরযটি আদায় করতে নেমেছেই, আমরা যদি শরীক না হই তাহলেও আমাদের ফরয তরকের গোনাহ হবে না” -এধারনাটা অসম্পূর্ণ। কারণ, কিছু সংখ্যক মুসলমান যদি ফরযটি সুসম্পন্ন ভাবে আদায়ের ক্ষেত্রে অপর্যাপ্ত সংখ্যা হিসেবে গণ্য হয় যার দরুন কাজটি অসম্পন্নই থেকে যায়, সেক্ষেত্রে এই ‘কিছু সংখ্যক মুসলমান’ ফরযদি আদায়ে নেমেছে বলে ফরযে কেফায়া আদায় হয়ে গেছে -তা মোটেও নয়। বরং, মূল বিষয় হল, ফরযটি সুসম্পন্ন ভাবে কায়েম হওয়া। যদি কিছু সংখ্যক মুসলমান শরীক হয়েও ফরযটি সুসম্পন্ন ভাবে আদায় না হয়, তাহলে শুধু ‘কিছু সংখ্যক মুসলমান’ আমল করছে -এ অযুহাত উক্ত ফরযে শরীক না হওয়া শরীয়তে গ্রহনযোগ্য নয়, যাবৎ না -‘কিছু সংখ্যক’- আদপেই -‘এত সংখ্যক’- হয় যা ওই ফরযটি সুসম্পন্ন ভাবে কায়েম/আদায় করতে পর্যাপ্ত সংখ্যক মুসলমান আমল করার মাধ্যমে তা সুসম্পন্ন করে না ছাড়ে। সংশ্লিষ্ট ফরযে কেফায়া’টি যতক্ষন পর্যন্ত কায়েম হবে না, ততক্ষন পর্যন্ত যত সংখ্যক মুসলমানকেই শরীক হতে হোক না কেনো, যতক্ষন পর্যন্ত সংখ্যার সেই নূন্যতম কোটাটি পূর্ণ হয়ে ফরযটি অসম্পূর্ণ ও অনাদায়ী অবস্থায় রয়ে যাবে, ততক্ষন পর্যন্ত ওই সকল মুসলমানদের সবাই ফরয তরকের গুনাহে গুনাহগার হবে যারা ওই ফরযটি সুসম্পন্ন করার জন্য সাধ্য মতো চেষ্টা করেনি।
এবারে আমরা দেখবো, ক্বিতাল/ শসস্ত্র জিহাদ কী ফরযে আইন, নাকি ফরযে কেফায়া?
সাধারণ অবস্থায় কিতাল / সশস্ত্র জিহাদ হল ফরযে কেফায়া ; ফরযে আইন নয় : কুরআন সুন্নাহ ও ফিকহি দলিল
কুরআন ও সুন্নাহ’র বিভিন্ন দলিলাদির আলোকে একথা প্রমাণিত হয় যে, সাধারণ অবস্থায় মুসলমানদের উপরে الْقِتَالُ (আল ক্বিতাল) বা الجِهَادُ (আল জিহাদ/সশস্ত্র জিহাদ) মূলত: ফরযে কেফায়া থাকে -যাবৎ না তাতে ফরযে আইন হওয়ার শর্ত পাওয়া যায় (সামনের কোনো পৃষ্ঠায় আমরা জিহাদ ফরযে আইন হবার শর্ত সমূহ নিয়ে আলোচনা করবো)। আমরা এখন নিম্নে জিহাদ সাধারণ অবস্থায় ফরযে কেফায়া হওয়া সম্পর্কিত দলিল সমূহ নিয়ে আলোকপাত করছি।
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-
وَ مَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ لِيَنفِرُوا كَافَّةً ۚ فَلَوْ لَا نَفَرَ مِن كُلِّ فِرْقَةٍ مِّنْهُمْ طَائِفَةٌ لِّيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَ لِيُنذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ
“মুমিনদের জন্য (একাজ) সমীচীন নয় যে, তারা (তাদের নবীকে মদিনায় একাকী রেখে) সবাই (এক সাথে একযোগে আল্লাহ’র রাস্তায় জিহাদের উদ্দেশ্যে) বেরিয়ে পরবে। কাজেই, এমন কেনো হল না যে, তাদের মধ্যকার প্রতিটি দল থেকে একটি অংশ (মদিনায় তাদের নবীর কাছে হাজির হওয়ার উদ্দেশ্যে) বেরিয়ে পড়তো, যাতে তারা (তাদের নবীর কাছ থেকে) দ্বীনের ব্যাপারে গভীর ইলম অর্জন করতে পারে, এবং যাতে তাদের জাতীগোষ্ঠি যখন (জিহাদ থেকে) তাদের কাছে ফিরে আসবে, তখন তাদেরকে (আল্লাহ’র বাণীর মাধ্যমে) ভয় প্রদর্শন করতে পারে, যেন তারা (দ্বীন মানা ও আখেরাখে তাদের প্রভু আল্লাহ’র কাছে জবাবদিহিতার ব্যাপারে) সতর্ক হতে পারে”। [সূরা তাওবা ১২২]
মুফাসসিরীনে কেরাম এই আয়াতের যে সকল ‘শানে নুজুল’ বর্ণনা করেছেন, তা থেকে বোঝা যায় যে, আয়াতটি দ্বীনী ইলম অর্জনকারী দল এবং মুজাহিদ বাহিনী -উভয়র ব্যাপারে নাজিল হয়েছে। [জামেউল বায়ান, ইমাম তাবারী- ১৪/৫৬৬ আছার ১৭৪৭১ – ১৭৪৮০; তাফসীরে ইবনু আবি হাতীম- ৬/১৯০৯ – ১৯১৩ আছার ১০১১৬ – ১০১৩৫; মাআলিমুত তানজীল, ইমাম বাগাভী- ২/৩৩৯; তাফসীরে ইনে কাসির- ২/৪১৫; আদ-দুররুল মানসুর, ইমাম সুয়ূতী – ৭/৫৯৫] এবং সাধারণ অবস্থায় উভয় আমলই ফরযে কেফায়া প্রমাণ করে, কারণ সকল মুসলমানের উপরে ইলম অর্জন বা জিহাদ যদি সর্বাবস্থায়ই ‘ফরযে আইন’ হত, তাহলে কোনো মাসলমানের জন্যই বাড়িতে বসে থাকা জায়েয হত না বরং দ্বীনী ইলম অর্জন হোক বা জিহাদে গমন হোক -উভয় ক্ষেত্রেই সর্বদা ইলম হাসিলের জন্য বা জিহাদ করার জন্য গৃহের বাইরে বের না হয়ে গত্যন্তর ছিল না। কিন্তু, এই আয়াতের শানে নজুল মোতাবেক মুসলমানদের একদল ব্যাক্তিবর্গকে মদিনায় রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে বসে দ্বীনী ইলম অর্জন করায় নিরত থাকতে বলা, আর অন্যদিকে মুসলমানদের আরেক দল ব্যাক্তিবর্গকে দ্বীনী ইলম বা জিহাদে বের হওয়ার জন্য বলার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, দ্বীনী ইলম অর্জন বা জিহাদ সাধারন অবস্থায় ফরযে কিফায়া; ফরযে আইন নয়। বিশেষ করে জিহাদ যদি সাধারণ অবস্থায়ও সকল মুকাল্লাফ মুসলমানের জন্য সর্বাবস্থায়ই ‘ফরযে আইন’ হত, তাহলে একথা কি করে চিন্তা করা যায় যে, খোদ্ রাসুলুল্লাহ ﷺ জিহাদে না গিয়ে মদিনায় বসে থাকবেন? এটা একথারই দলিল যে, সাধারণ অবস্থায় মুসলমানদের উপরে জিহাদ মূলত: ফরযে কেফায়া।
এই আয়াতের তাফসীরে মুফসসীরে কেরাম এখানে -মুসলমানদের কিছু অংশকে জিহাদে গমন ও দ্বীনী ইলম হাসিল করতে বলার ব্যাপারে- দু’ধরনের ব্যাখ্যা পেশ করেছেন। নিম্নে ব্যাখ্যা দুটির সারমর্ম পেশ করা হল।
(১) এই আয়াতের চাহিদা এই যে, সাধারণ অবস্থায় সকল মুসলমানের জন্য একই সাথে এক যোগে জিহাদে বেরিয়ে পড়া সমীচীন নয়। তবে মুসলমানদের মধ্যে যারা রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর সাথে জিহাদে গমন করবে তারা সেই জিহাদের সফর কালে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর উপরে ওহী সূত্রে যাকিছু নাজিল হবে তারা সে সম্পর্কে গভীর ইলম হাসিল করে নিবে এবং পরে যখন জিহাদ থেকে বাড়িতে ফিরে আসবে তখন তারা নিজ নিজ কওমকে সেসব ইলম শিক্ষা দিবে এবং এর সাথে সাথে সেখানে দুশমনদের সঙ্গে মুসলমানদের কী কী ঘটনা ঘটেছিল বা ওহীর আলোকে তাদের সাথে কী কী করতে হয়েছে সেসব আহকামের ব্যাপারেও তারা তাদের কওমের লোকদেরকে জানাবে ও সতর্ক করবে।
যেমন, ইমাম আবুল ফিদা ইমাদুদ্দিন ইবনে কাসির আদ-দামেষ্কি (মৃ: ৭৭৪ হি:) রহ. লিখেছেন- هَذَا بَيَانٌ مِنَ اللَّهِ تَعَالَى لَمَّا أَرَادَ مِنْ نَفير الْأَحْيَاءِ مَعَ الرَّسُولِ فِي غَزْوَةِ تَبُوكَ، فَإِنَّهُ قَدْ ذَهَبَ طَائِفَةٌ مِنَ السَّلَفِ إِلَى أَنَّهُ كَانَ يَجِبُ النَّفِيرُ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ إِذَا خَرَجَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ؛ وَلِهَذَا قَالَ تَعَالَى: ﴿انْفِرُوا خِفَافًا وَثِقَالا﴾ ، وَقَالَ: ﴿مَا كَانَ لأهْلِ الْمَدِينَةِ وَمَنْ حَوْلَهُمْ مِنَ الأعْرَابِ أَنْ يَتَخَلَّفُوا عَنْ رَسُولِ اللَّهِ﴾ ، قَالُوا: فنسخ ذلك بهذه الآية . وَ قَدْ يُقَالُ: إِنَّ هَذَا بَيَانٌ لِمُرَادِهِ تَعَالَى مِنْ نَفِيرِ الْأَحْيَاءِ كُلِّهَا، وَشِرْذِمَةٍ مِنْ كُلِّ قَبِيلَةٍ إِنْ لَمْ يَخْرُجُوا كُلُّهُمْ، لِيَتَفَقَّهَ الْخَارِجُونَ مَعَ الرَّسُولِ بِمَا يَنْزِلُ مِنَ الْوَحْيِ عَلَيْهِ، وَيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ بِمَا كَانَ مِنْ أَمْرِ الْعَدُوِّ، فَيَجْتَمِعُ لَهُمُ الْأَمْرَانِ فِي هَذَا: النَّفِيرُ الْمُعِينُ وَبَعْدَهُ، صَلَوَاتُ اللَّهِ وَسَلَامُهُ عَلَيْهِ، تَكُونُ الطَّائِفَةُ النَّافِرَةُ مِنَ الْحَيِّ إِمَّا لِلتَّفَقُّهِ وَإِمَّا لِلْجِهَادِ؛ فَإِنَّهُ فَرْضُ كِفَايَةٍ عَلَى الْأَحْيَاءِ. – “এ(ই আয়াত)টি আল্লাহ তাআলার তখনকার বর্ণনা, যখন মুসলমানরা সকলে মিলে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর সাথে তাবুকের যুদ্ধে গমনের ইচ্ছে করেছিল। পূর্বসূরীদের মধ্যে একদল (মুফাসসীরে কেরাম এই আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে) এই মত পোষন করেন যে, রাসুলুল্লাহ ﷺ যখন (কোনো জিহাদের জন্য) বের হতেন তখন সকল মুসলমানের উপরে ব্যাপক ভাবে (জিহাদে) বের হওয়া অত্যাবশ্যক হয়ে যেতো, আর এজন্যই আল্লাহ তাআলা বলেছেন- انْفِرُوا خِفَافًا وَثِقَالا– ((তোমরা (জিহাদের জন্য) বেরিয়ে পড়ো -(চাই) হালকা হও, চাই ভারী হও)) [সুরা তাওবা ৪১], তিঁনি আরো এরশাদ করেন- مَا كَانَ لأهْلِ الْمَدِينَةِ وَمَنْ حَوْلَهُمْ مِنَ الأعْرَابِ أَنْ يَتَخَلَّفُوا عَنْ رَسُولِ اللَّهِ – “((মদিনাবাসী (মুসলমানগণ) এবং তাদের চারপাশে আরাবদের মধ্যে যারা রয়েছে তাদের জন্য এটা (মোটেও) সমীচীন নয় যে, তারা আল্লাহ’র রাসুলের (সাথে জিহাদে সঙ্গি হওয়া) থেকে পিছে রয়ে যাবে (এবং নিজেদের গৃহে বসে থাকবে….)) [সুরা তাওবা ১২০]”। তারা বলেন যে, (পরে যখন সুরা তাওবার ১২২ নং আয়াত নাজিল হয় তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর সাথে জিহাদে অত্যাবশ্যকীয় ভাবে শরীক হওয়া সম্পর্কিত) ওসব আয়াত এই (১২২ নং) আয়াত দ্বারা রহিত হয়ে যায়। (মুফাসসীরে কেরামের কারো কারোর পক্ষ থেকে একথাও) বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলার এই বর্ণনার লক্ষ্যস্থল (মদিনার) ওইসকল (মুজাহিদ) ব্যাক্তিবর্গ, যারা সকলেই (জিহাদে) বেরিয়ে পড়েছিল এবং তারাও (যারা মদিনার চারপাশে বিদ্যমান) প্রত্যেক অঞ্চল থেকে (এসে জিহাদে শরিক হয়েছিল) –যদিও-বা তাদের (একেবারে) সকলে (জিহাদে) বের হয়নি। (আল্লাহ তাআলা তাদেরকে এজন্য বলেছেন), যাতে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর সাথে জিহাদে গমনকারীরা (ওই জিহাদের সফর কালে) রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর উপরে ওহী সূত্রে যাকিছু নাজিল হয়েছে সে ব্যাপারে গভীর ইলম হাসিল করে নিতে পারে এবং দুশমনদের ব্যাপার নিয়ে (সেখানে) যাকিছু (মুআমালাহ) হয়েছিল সে ব্যাপারে যখন তারা তাদের কওমের লোকদের কাছে ফিরে আসবে তখন যেন তারা তাদেরকে (সে ব্যাপারে জানাতে ও) সতর্ক করতে পারে। সুতরাং, এব্যাপারে তাদের জন্য দুটি বিষয় একত্রিত হয়ে যায়: (১) অপরিহার্য ভাবে জিহাদে বের হওয়া (যখন স্বয়ং রাসুলুল্লাহ ﷺ জিহাদে বের হবেন বা মুসলমানদেরকে বের হতে বলবেন), এবং (২) তাঁর পর মুসলমানদের কোনো দলের বের হওয়া -চাই দ্বীনের গভীর ইলম অর্জনের জন্য (বের) হোক বা জিহাদের জন্য। কারণ, (ইলম অর্জন বা জিহাদ) এটা মূলত: মুসলমানদের উপরে ফরযে কেফায়া”। [তাফসীরে ইনে কাসির- ২/৪১৫]
(২)এই আয়াতের চাহিদা এই যে, সাধারণ অবস্থায় রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে মদিনায় একা রেখে সকল মুসলমানের জন্য একই সাথে এক যোগে জিহাদে বেরিয়ে পড়া সমীচীন নয়। বরং, কিছু মুসলমান মদিনায় রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে দ্বীনী ইলম অর্জন করতে থাকবে, আর কিছু মুসলমান -যাদেরকে রাসুলুল্লাহ ﷺ সারিয়ায়/জিহাদে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে- তারা আল্লাহ’র রাস্তায় জিহাদের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়বে। তারা যখন জিহাদ শেষে মদিনায় ফিরে আসবে, তখন যারা এযাবৎ মদিনায় রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে দ্বীনী ইলম অর্জন করে যাচ্ছিল, তারা ওই ফিরে আসা মুজাহিদ বাহিনীকে তা শিক্ষা দিবে, যাতে তারা (আল্লাহ’র বিধান ও আখেরাতে জবাবদিহিতার ব্যাপারে) সতর্ক হতে পারে। এরপর রাসুলুল্লাহ ﷺ চাইলে অন্য কোথাও আরেকটি মুজাহিদ বাহিনীকে জিহাদের উদ্দেশ্যে প্রেরন করবেন, আর মুসলমানদের আরেকটি অংশ রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে দ্বীনী ইলম অর্জন করতে থাকবে। এভাবে সময়ে সময়ে কেউ জিহাদে বের হবে, কেউ ইলম অর্জন করবে।
আলী বিন আবি ত্বালহা রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন- وَ مَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ لِيَنفِرُوا كَافَّةً ، يقول: ما كان المؤمنون لينفروا جميعًا، ويتركوا النبي ﷺ وحده ، فَلَوْ لَا نَفَرَ مِن كُلِّ فِرْقَةٍ مِّنْهُمْ طَائِفَةٌ ، يعني عصبة، يعني السرايا، ولا يتَسرَّوا إلا بإذنه، فإذا رجعت السرايا وقد نزل بعدهم قرآن، تعلمه القاعدون من النبي ﷺ، قالوا: إن الله قد أنزل على نبيكم بعدكم قرآنا، وقد تعلمناه . فيمكث السرايا يتعلَّمون ما أنزل الله على نبيهم بعدهم، ويبعث سرايا أخر، فذلك قوله: لِّيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ ، يقول يتعلمون ما أنزل الله على نبيه و يعلموا السرايا إذا رجعت إليهم لعلهم يحذرون . أخرجه الطبري في جامع البيان : ١٤/٥٦٦ رقم ١٧٤٧١، اسناده حسن كما في كتاب الصحيح المسبور من التفسير بالمأثور لحكمت بن بشير بن ياسين الناشر: ٢/٥٠١ – “(এই আয়াতে প্রথমে বলা হয়েছে)- وَ مَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ لِيَنفِرُوا كَافَّةً – “((মুমিনদের জন্য (একাজ) সমীচীন নয় যে, তারা সবাই (এক সাথে একযোগে আল্লাহ’র রাস্তায় জিহাদের উদ্দেশ্যে) বেরিয়ে পরবে))”, অর্থাৎ মুমিনরা যেন নবী ﷺ-কে (মদিনায়) একাকি রেখে সকলে (একই সাথে এক যোগে জিহাদে) বেরিয়ে না পড়ে। (তারপর বলা হয়েছে)- فَلَوْ لَا نَفَرَ مِن كُلِّ فِرْقَةٍ مِّنْهُمْ طَائِفَةٌ – “((কাজেই, এমন কেনো হল না যে, তাদের মধ্যকার প্রতিটি দল থেকে একটি অংশ বেরিয়ে পড়তো))”, (এখানে طَائِفَةٌ – ‘গোষ্ঠি’ অর্থ) عصبة (লোকদের একটি দল), আর ( نَفَرَ – বেরিয়ে পড়তো) অর্থ ‘সারিয়া(য় তথা ছোট মুজাহিদ বাহিনী জিহাদে বেরিয়ে পড়তো’। (এখানে বলতে চাওয়া হয়েছে যে,) তারা যেন নবী ﷺ-এর অনুমতি ছাড়া জিহাদে বেরিয়ে না পড়ে। পরে তারা যখন জিহাদ থেকে ফিরে আসলো, (ততক্ষনে তো) তাদের যাওয়ার পরে কুরআন(-এর অনেক আয়াত রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর উপরে) নাজিল হয়ে গিয়েছিল, যা (মদিনায়) রয়ে যাওয়া ব্যাক্তিরা নবী ﷺ-এর কাছ থেকে শিখে নিয়েছিল। (ফলে) তারা (মুজাহিদগণকে) বললো: ‘তোমরা (জিহাদে চলে) যাওয়ার পরে আল্লাহ তাআলা তোমাদের নবীর উপরে কুরআন নাজিল করেছিলেন (যা তোমরা এখানে অনুপস্থিত থাকার কারণে শিখে নিতে পারোনি), আমরা তা শিখে নিয়েছি’। ফলে জিহাদ থেকে ফেরত আসা ব্যাক্তিগণ -তাদের (জিহাদে বের হওয়ার) পরে আল্লাহ (তাআলা) তাঁর নবীর উপরে যাকিছু নাজিল করেছিলেন তা তারা (মদিনায় রয়ে যাওয়া মুসলমানদের কাছ থেকে) শিখে নিলো। এরপর অন্য (কোথোও আরেকটি) সারিয়া (ছোট মুজাহিদ বাহিনী) পাঠানো হল। আর এটাই হল আল্লাহ’র বাণী- لِّيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ – ((যাতে তারা দ্বীনের ব্যাপারে গভীর ইলম হাসিল করতে পারে)) (-এর উদ্দেশ্য, যেখানে) তিঁনি বলতে চেয়েছেন যে, আল্লাহ (তাআলা) তাদের নবীর উপরে যা নাজিল করেছেন তা তারা শিখে নিবে এবং যখন মুজাহিদ বাহিনী তাদের কাছে ফিরে আসবে তখন তারা (নবী ﷺ-এর কাছ থেকে যাকিছু শিখেছে) তা তাদেরকে শিখাবে, لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ – ((যেন তারা সতর্ক হতে পারে))”। [জামেউল বায়ান, ইমাম তাবারী- ১৪/৫৬৬ আছার ১৭৪৭১; তাফসীরে ইবনু আবি হাতীম– ৬/১৯০৯; তাফসীরে ইবনে কাসির– ২/৪১৫; আদ দুররুল মানসুর, ইমাম সুয়ূতী- ৩/২৯৩; তাফসীরুস সাহিহ- ২/৫০১]
উপরের আয়াতের এই দুটি তাফসীরের যেটিই নেয়া হোক না কেনো, দু অবস্থাতেই একথা প্রমাণিত হয় যে, ক্বিতাল/শসস্ত্র জিহাদ সর্বাবস্থায় সকল মুসলমানের উপরে ফরযে আইন হয় না। জিহাদ যদি সর্বাবস্থায়-ই ফরযে আইন হত, তাহলে -না রাসুলুল্লাহ ﷺ কখনো জিহাদের ফরয আদায় ছেড়ে মদিনায় বসে থাকতেন, আর না সাহাবীগণের বড় একটি জামাআত জিহাদে না গিয়ে মদিনায় রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে ইলম অর্জনে লিপ্ত থাকতেন। এটা একথারই দলিল যে, সাধারণ অবস্থায় মুসলমানদের উপরে জিহাদ মূলত: ফরযে কেফায়া।
ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু জুযায় উন্দুলুসী (মৃ: ৭৪১ হি:) রহ. লিখেছেন- قال ابن عباس: هذه الآية في البعوث إلى الغزو والسرايا: أي لا ينبغي خروج جميع المؤمنين في السرايا، وإنما يجب ذلك إذا خرج رسول الله ﷺ بنفسه، ولذلك عاتبهم في الآية المتقدمة على التخلف عنه، فالآية الأولى في الخروج معه ﷺ، وهذه في السرايا التي كان يبعثها، وقيل: هي ناسخة لكل ما ورد من الأمر بخروج الجميع، فهو دليل على أن الجهاد فرض كفاية لا فرض عين – “(আব্দুল্লাহ) ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন: এই আয়াতটি গাজওয়া ও সারিয়ায় বের হওয়ার ব্যাপারে নাজিল হয়েছে। অর্থাৎ, মুসলমানদের সবার একই সাথে সারিয়ায় (জিহাদে) বের হওয়া সামীচীন নয়। বস্তুত: একাজ (তাদের উপরে) তখনই অপরিহার্য হবে, যখন রাসুলুল্লাহ ﷺ স্বয়ং জিহাদে বের হবেন। কেননা, রাসুলুল্লাহ ﷺকে (মদিনায়) একা রেখে (সবাই জিহাদে চলে) যাওয়ার কারণে এই আয়াতের শুরুর দিকে তাদেরকে মৃদু বকা দেয়া হয়েছে। এজন্য আয়াতটির প্রাথমিক চাহিদা হল রাসুলুল্লাহ ﷺ স্বয়ং জিহাদের বের হওয়া। তদুপরি এটা ওইসকল সারিয়ার (জিহাদের ছোট দলের) ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য যা তিঁনি (বিভিন্ন স্থানে জিহাদের জন্য) পাঠাতেন। (এ আয়াতের তাফসীরে) আরো বলা হয়েছে যে, এই আয়াতটি ওই সকল আয়াতকে মানসুখ (রহিত) করে দিয়েছে যেসকল আয়াতে (ইতিপূর্বে) সকল মুসলমানকে জিহাদে বের হওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। সুতরাং, (এসব তাফসীরের যেটিই নেয়া হোক না কেনো) এটি একথারই দলিল যে, (সাধারন অবস্থায়) জিহাদ ফরযে কেফায়া; ফরযে আইন নয়”। [আত-তাসহিল লি-উলুমিত তানজিল, ইবনু জুযায় উন্দুলুসী- ১/৩৫১]
ইমাম আবু মানসুর মুহাম্মাদ আল-মাতুরিদী (মৃ: ৩৩৩ হি:) রহ. লিখেছেন- و فيه أيضاً دلالة سقوط فرض الجهاد عن الجماعة إذا قام بعضهم عن بعض– “এ আয়াতটি একথারও দলিল যে, যখন কিছু সংখ্যক (মুসলমান -যখন যেখানে প্রয়োজন সেখানে জিহাদকে) কায়েম রাখে, তখন (বাকি) সকল মুসলমানের উপর থেকে জিহাদের ফরযিয়াত সাকেত (স্থগিত) হয়ে যায়”। [তাউয়ীলাতু আহলিস সুন্নাহ, ইমাম মাতুরিদী- ৫/৫১০]
ইমাম আবু বকর আল-জাসসাস রাযী (মৃ: ৩৭০ হি:) রহ. লিখেছেন- و إنما قلنا إنه فرض على الكفاية، وليس هو على كل أحد في عينه، لقول الله تعالى- وَ مَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ لِيَنفِرُوا كَافَّةً – فدل على أن فرض الجهاد على الكفاية، فهذه الآية قد تضمنت لزوم الجهاد، وانه على الكفاية – “আমাদের মত হল, জিহাদ (সাধারণ অবস্থায়) ফরযে কেফায়া; এটা প্রত্যেকের উপরে (সর্বাবস্থায়) ফরযে আইন নয়। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেছেন- وَ مَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ لِيَنفِرُوا كَافَّةً – “((মুমিনদের জন্য (একাজ) সমীচীন নয় যে, তারা সবাই (এক সাথে একযোগে আল্লাহ’র রাস্তায় জিহাদের উদ্দেশ্যে) বেরিয়ে পরবে))”। এটাই একথার দলিল যে, জিহাদ (সাধারণ অবস্থায়) ফরযে কেফায়া”। [শারহু মুখতাসারিত ত্বাহাবী, ইমাম জাসসাস- ৭/৮]
মুহাম্মাদুল মুখতার আল-শিনকিতী লিখেছেন- فجعل النفير مختصاً بالبعض دون البعض، ولذلك ذهب جماهير الأمة من السلف والخلف إلى أن الجهاد يعتبر فرضاً على الكفاية، بمعنى: أنه لو قام به البعض سقط الإثم عن الباقين – “বস্তুত: (এই আয়াতে) জিহাদে বের হওয়াকে কিছু লোকের সাথে সম্পর্কিত করা হয়েছে; আর কিছু লোকের সাথে নয়। এজন্য উম্মতের মধ্যে পূর্বেকার ও পরের জমহুর ওলামায়ে কেরাম এই মত ব্যাক্ত করেছেন যে, (সাধারণ অবস্থায়) জিহাদ (মূলত:) ফরযে কেফায়া হিসেবে গণ্য, যার অর্থ হল, কিছু মুসলমান যদি তা কায়েম করে তাহলে বাকি মুসলমানদের থেকে (এ আমল না আদায় করার) গুনাহ হটে যায়”। [শারহু যাদিল মুসতাক্বনী, শিনকিতী- ৭/১৩৬]
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-
وَ لَّا يَسْتَوِي الْقَاعِدُونَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ غَيْرُ أُولِي الضَّرَرِ وَالْمُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ ۚ فَضَّلَ اللَّهُ الْمُجَاهِدِينَ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ عَلَى الْقَاعِدِينَ دَرَجَةً ۚ وَكُلًّا وَعَدَ اللَّهُ الْحُسْنَىٰ ۚ وَفَضَّلَ اللَّهُ الْمُجَاهِدِينَ عَلَى الْقَاعِدِينَ أَجْرًا عَظِيمًا
“মুমিনদের মধ্য থেকে -যারা কোনো ওযর-অক্ষমতা ছাড়াই (জিহাদে না গিয়ে গৃহে) উপবেশন করে থাকে, আর (অন্যদিকে) যারা তাদের ধ্বনসম্পদ ও জীবন দিয়ে আল্লাহ’র পথে (জিহাদে নিরত থাকে, সেই সকল) মুজাহিদগণ (মর্যাদার দিক দিয়ে আল্লাহ’র কাছে কখনোই) সমান নয়। (মুসলমানদের মধ্যে যারা) তাদের ধ্বনসম্পদ ও জীবন দিয়ে (নিজকে জিহাদে নিরত রাখে, (তোমাদের প্রভু) আল্লাহ (তাআলা) -সেই সকল) মুজাহিদগণকে -(গৃহে) বসে থাকা ব্যাক্তিদের উপরে (বিশেষ) মর্যাদা দিয়ে ফজিলতমন্ডিত করেছেন। আর আল্লাহ (তাআলা মুমিনদের এই উভয় দলের) প্রত্যেককেই (আখেরাতে) আল-হুসনাহ (বিশেষ কল্যান)-এর ওয়াদা করেছেন। তবেআল্লাহ (তাআলা সঙ্গত কারণেরই) মুজাহিদগণকে -(গৃহে) বসে থাকা ব্যাক্তিদের উপরে (এক) মহা পুরুষ্কারে ফজিলতমন্ডিত করেছেন”। [সূরা নিসা ৯৫]
হযরত ক্বাতাদাহ, হযরত আবু আলীয়াহ, হযরত সুদ্দী সহ ইমাম ইবনে জারীর তাবারী রহ. প্রমুখ এই আয়াতে বর্ণিত- “ الحسنى (আল হুসনা)”-এর ব্যাখ্যায় বলেছেন- “ الجنة (আল জান্নাহ তথা বেহেশত)”। [জামেউল বায়ান, ইমাম তাবারী- ৯/৯৭ আছার ১০২৫৩, ১০২৫৪; আদ-দুররুল মানসুর, ইমাম সুয়ূতী- ] এ ব্যাখ্যা থেকে বোঝা যায়, এখানে মুসলমানদের মধ্যে যারা জিহাদে বের হয়েছে এবং যারা কোনো রকম ওযর ছাড়াই বাড়িতে রয়ে গেছে -তাদের উভয় প্রকার মুসলমানদের জন্যই রয়েছে আল্লাহ’র পক্ষ থেকে জান্নাতের ওয়াদা -যদিও এদুজনের মধ্যে মুজাহিদ ব্যাক্তি উচ্চ মর্যাদা ও পুরষ্কারের অধিকারী হবেন।
আর এটা কেবল তখনই সম্ভব, যখন জিহাদ ‘ফরযে কেফায়া’ হবে, কারণ কেবল এক্ষেত্রেই এক দল মুজাহিদ জিহাদে লিপ্ত থেকে আল্লাহ’র কাছে উচ্চ মর্যাদা ও পুরষ্কারের অধিকারী হতে পারেন, আর যারা তখন জিহাদে না গিয়ে পাড়া-মহল্লায় আল্লাহ’র অন্যান্য ইবাদত আমলে নিজকে লিপ্ত রাখবে তারা তাদের এসব নেক আমলের সওয়াব লাভ করবে আবার জিহাদ তরকের গুনাহে গুনাহগারও হবে না। পরিণতিতে উভয় দলের জন্যই রয়েছে জান্নাতের সুসংবাদ, যদিও তারা উভয়ে সওয়ার ও পুরষ্কারের দিক দিয়ে কখনো সমান হবে না।যেমন, যাকওয়ান রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, আবু হুরায়রাহ রা বর্ণনা করেছেন-جَاءَ رَجُلٌ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ دُلَّنِي عَلَى عَمَلٍ يَعْدِلُ الْجِهَادَ قَالَ لَا أَجِدُهُ قَالَ هَلْ تَسْتَطِيعُ إِذَا خَرَجَ الْمُجَاهِدُ أَنْ تَدْخُلَ مَسْجِدَكَ فَتَقُومَ وَ لَا تَفْتُرَ وَتَصُومَ وَ لَا تُفْطِرَ قَالَ وَمَنْ يَسْتَطِيعُ ذَلِكَ . رواه البخاري في صحيحه , كتاب الجهاد والسير , باب فضل الجهاد والسير : ٤/١٥ رقم ٢٧٨٥، و احمد في مسنده : ٢/٣٤٥ قال احمد شاكر : ٨/٣٤٣ رقم ٨٥٢١ : اسناده صحيح – “(একবার) এক ব্যাক্তি রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে এসে বললো: ‘আমাকে এমন আমলের কথা জানান, যা জিহাদের বরাবর হয়’। তিনি বললেন: ‘আমি তা পাচ্ছি না’। (তারপর) বললেন: ‘(তুমি ঘরে বসে মুজাহিদের সমান ফজিলত পেতে চাও!) তোমার পক্ষে কি এটা সম্ভব যে, মুজাহিদ যখন (জিহাদের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে) বের হবে, তখন তুমি মসজিদে প্রবেশ করে নামায পড়তে থাকবে, (আর তাতে) ক্লান্ত হবে না এবং (অনবরত) রোযা রাখতে থাকবে, (আর তা) ভাংবে না’? সে বললো: ‘সেটা কার পক্ষে সম্ভব’?! [সহিহ বুখারী- ৪/১৫ হাদিস ২৭৮৫; মুসনাদে আহমদ- ৮/৩৪৩]
কিন্তু জিহাদ যখন কোনো মুসলমানের উপরে ‘ফরযে আইন’ হয়, তখনকার ক্ষেত্রে এ আয়াতটি প্রযোজ্য নয়। কারণ জিহাদ প্রত্যেক মুসলমানের উপরে সর্বাবস্থায় ‘ফরযে আইন’ হলে, কোনো অবস্থাতেই এই আয়াতে ‘জিহাদে না গিয়ে বাড়িতে বসে থাকা মুসলমানদের’কেও জান্নাতের সুসংবাদ দেয়া হত না। কেননা, ফরযে আইন তরককারী মুসলমান একজন কবীরা গুনাহে লিপ্ত গুনাহগার, যার ব্যাপারে কুরআন ও হাদিসের বহু স্থানে বলা হয়েছে যে, উক্ত গুনাহ থেকে তওবা না করে মড়লে জাহান্নামে যাওয়ার দু:সংবাদ দেয়া হয়েছে। এজন্য এ আয়াতটিও একথারই দলিল যে, সাধারণ অবস্থায় জিহাদ ফরযে কেফায়া।
ইমাম ফখুরুদ্দিন রাযী ( মৃ: ৬০৬ হি:) রহ. বলেন- قالَ الفُقَهاءُ: وفِيهِ دَلِيلٌ عَلى أنَّ فَرْضَ الجِهادِ عَلى الكِفايَةِ، ولَيْسَ عَلى كُلِّ واحِدٍ بِعَيْنِهِ؛ لِأنَّهُ تَعالى وعَدَ القاعِدِينَ الحُسْنى كَما وعَدَ المُجاهِدِينَ، ولَوْ كانَ الجِهادُ واجِبًا عَلى التَّعْيِينِ لَما كانَ القاعِدُ أهْلًا لِوَعْدِ اللَّهِ تَعالى إيّاهُ الحُسْنى – “ফিকাহবীদগণ বলেছেন, এ আয়াতটি একথারই দলিল যে, (সাধারণ অবস্থায়) জিহাদ -ফরযে কিফায়া; প্রত্যেক ব্যাক্তির উপরে ফরযে আইন নয়। কারণ, আল্লাহ তাআলা (এখানে) যেমনিভাবে মুজাহিদগণের জন্য হুসনা’র (তথা জান্নাতের) ওয়াদা করেছেন, তেমনি ভাবে (জিহাদে না গিয়ে গৃহে) বসে থাকা (মুসলমান)দের সাথেও (একই) ওয়াদা করেছেন (যদিও উভয়ের মর্যাদাগত স্তরের মাঝে অচিন্তনীয় ভিন্নতা রয়েছে)। জিহাদ যদি (সাধারণ অবস্থায়ও প্রত্যেক মুসলমানের উপরে) ফরয়ে আইন হতই, তাহলে (জিহাদে না গিয়ে গৃহে) বসে থাকা ব্যাক্তি -আল্লাহ তাআলা ওয়াদাকৃত হুসনা’র (জান্নাতের) উপযুক্ত হত না। (কারণ, যে মুসলমান কোনো ওযর ছাড়াই ফরযে আইন পরিত্যাগ করে সে কবীরা গুনাহে লিপ্ত, আর কবীরা গুনাহে লিপ্ত ব্যাক্তির খোদ গৃহে বসে থাকার গুনাহর প্রশংসা করে তার জন্য জান্নাতের ওয়াদা করার কথা কী করে কল্পনা করা যেতে পারে)”। [মাফাতিহুল গাইব, ইমাম রাযী- ১১/৯]
আবু বকর আদ-দুমইয়াতী আশ-শাফেয়ী ( মৃ: ১৩১০ হি:) রহ. বলেন- ففاضل بين المجاهدين والقاعدين، ووعد كلا الحسنى وهي الجنة، والعاصي لا يوعد بها… فدل ذلك على أن الجهاد فرض كفاية، لا فرض عين – “এখানে মুজাহিদীন এবং গৃহে উপবিষ্টদের মাঝে ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে এবং তাদের প্রত্যেকের জন্য আল-হুসনা তথা জান্নাতের ওয়াদা করা হয়েছে। আর (ফরয তরক’কারী) পাপীর জন্য এমন ওয়াদা করা হয় না।…. এটা একথারই দলিল যে, জিহাদ (সাধারণ অবস্থায়) ফরযে কিফায়া; ফরযে আইন নয়”। [ইয়ানাতুত ত্বালেবিন আলা হাল্লি আলফাজ ফাতহুল মুঈন, আদ-দুমইয়াতী- ৪/২০৬]
মুফতীয়ে আজম মুহাম্মাদ শফী (মৃ: ১৩৯৬ হি:) রহ. বলেন- “মুফাসসীরগণ বলেছেন, এ আয়াত থেকে জানা যায় যে, সাধারণ অবস্থায় জিহাদ করা ফরযে কিফায়া। কিছু মুসলমান এ ফরয আদায় করলে বাকি সকল মুসলমান দায়িত্বমুক্ত হয়ে যায়। তবে শর্ত এই যে, যারা জিহাদে লিপ্ত থাকবে, তাদের সংখ্যা সেই জিহাদের জন্য যথেষ্ট হতে হবে। যদি যথেষ্ট না হয়, তাহলে পাশ্ববর্তী মুসলমানদের উপরে তাদেরকে সাহায্য করা ফরযে আইন হয়ে যাবে”। [তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন, মুফতী শফী- ২/৫৯৭]
আবু হুরায়রাহ রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেন- وَ الَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَوْ لاَ أَنَّ رِجَالًا مِنَ المُؤْمِنِينَ لاَ تَطِيبُ أَنْفُسُهُمْ أَنْ يَتَخَلَّفُوا عَنِّي، وَ لاَ أَجِدُ مَا أَحْمِلُهُمْ عَلَيْهِ مَا تَخَلَّفْتُ عَنْ سَرِيَّةٍ تَغْزُو فِي سَبِيلِ اللَّهِ، وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَوَدِدْتُ أَنِّي أُقْتَلُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ، ثُمَّ أُحْيَا، ثُمَّ أُقْتَلُ، ثُمَّ أُحْيَا، ثُمَّ أُقْتَلُ، ثُمَّ أُحْيَا، ثُمَّ أُقْتَلُ . رواه البخاري في صحيحه , كتاب الجهاد والسير , باب تمني الشهادة : ٤/١٧ رقم ٢٧٩٧، و مسلم في صحيحه , كتاب الإمارة , باب فضل الجهاد والخروج في سبيل الله : ٣/١٤٩٥ رقم ١٨٧٦ – “ওই সত্ত্বার কসম যাঁর হাতে আমার জীবন, মুমিনদের মধ্যে যদি (এমন) ব্যাক্তিরা না থাকতো, যারা (আমার জিহাদে গমনের কথা শুনলেই তারা) তাদের নিজেদেরকে (তাতে শরিক না করে) আমার থেকে পিছনে (মদিনায়) রয়ে যাওয়াকে পছন্দ করে না, আর (এদিকে) আমিও (সবসময়) তাদের আরোহনের জন্য বাহন (জোগার করে দিতে) পাই না, তাহলে আল্লাহ’র পথে যারা গাজওয়ায় (জিহাদে) লিপ্ত, (তাদের কোনো একটি) সারিয়া (ছোট মুজাহিদ বাহিনী) থেকেও আমি আমার নিজকে পিছু রয়ে যেতে দিতাম না। ওই সত্ত্বার কসম যাঁর হাতে আমার জীবন, আমার তো মন চায় যে, আমি আল্লাহ’র পথে (দ্বীনের দুশমনের হাতে) নিহত (শহিদ) হই, আবার আমাকে জীবিত করা হোক, আবার আমি নিহত (শহিদ) হই, আবার আমাকে জীবিত করা হোক, আবার আমি নিহত (শহিদ) হই, আবার আমাকে জীবিত করা হোক, আবার আমি নিহত (শহিদ) হই”। [সহিহ বুখারী- ৪/১৭ হাদিস ২৭৯৭; সহিহ মুসলীম- ৩/১৪৯৫ হাদিস ১৮৭৬; সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস ৪৭৩৭; সুনানে নাসায়ী- ৬/৩২ হাদিস ৩১৫২; সুনানুল কুবরা, ইমাম বাইহাকী- ৯/১৫৭]
ফায়দা: এই হাদিসে বলা হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ ﷺ অনেক ক্ষেত্রেই হাদিসে উল্লেখীত কারণে জিহাদে অংশ নেয়া থেকে বিরত থাকতেন। এটা একথারই দলিল যে, সাধারণ অবস্থায় জিহাদ মূলত: ফরযে কেফায়া। জিহাদ যদি সকল মুসলমানের উপরে সর্বাবস্থায় ‘ফরযে আইন’ হতই, তাহলে একথা কি করে চিন্তা করা যেতে পারে যে, স্বয়ং রাসুলুল্লাহ ﷺ জিহাদের ফরয দায়িত্ব আদায়ের জন্য আল্লাহ’র পথে বের না হয়ে মদিনায় অবস্থান করবেন?! এজন্য ইমাম মুহিউদ্দিন ইয়াহইয়া আন-নববী (মৃ: ৬৭৬ হি:) রহ. এই হাদিসের ব্যাখ্যার এক পর্যায়ে বলেন- وفيه أن الجهاد فرض كفاية لا فرض عين – “এই হাদিসটি একথারই দলিল যে, জিহাদ (সাধারণ অবস্থায়) ফরযে কেফায়া; ফরযে আইন নয়”। [শারহুল মুসলীম, ইমাম নববী- ১৩/১৯]
ইমাম বদরুদ্দীন আল-আইনী (মৃ: ৮৫৫ হি:) রহ. বলেন- وفيه: أن الجهاد ليس بفرض معين على كل أحد، ولو كان معينا ما تخلف الشارع ولا أباح لغيره التخلف عنه، ولو شق على أمته إذا كانوا يطيقونه، هذا إذا كان العدو لم يفجأ المسلمين في دارهم ولا ظهر عليهم وإلا فهو فرض عين على كل من له قوة – “এই হাদিসটি একথারই দলিল যে, জিহাদ প্রত্যেক (মুসলমান) ব্যাক্তির উপরে ফরযে আইন নয়। যদি ফরযে আইন হতই তাহলে -না শরীয়ত প্রবক্তা (মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ ﷺ) নিজে (জিহাদে না গিয়ে) পিছনে রয়ে যেতেন, আর না অন্য কারোর জন্য জিহাদ থেকে পিছনে রয়ে যাওয়া জায়েয হত -চাই তা তাঁর উম্মাতের উপরে কষ্টকরই হোক না কেনো। (জিহাদে না যাওয়ার) এ(বিষয়)টা (মূলত:) তখনকার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যখন (জিহাদ ফরযে কেফায়া হয়, তথা যখন ইসলামের) দুশমনরা মুসলমানদের দেশে/ভূমিতে আক্রমন করেও কসে নি, আর না তারা মুসলমানদের উপরে বিজয় লাভ করে (কর্তৃত্ব গেড়ে) বসেছে। অন্যথায়, শক্তি-সামর্থ রয়েছে -এমন প্রত্যেক মুসলমানের উপরে জিহাদ ফরযে আইন হয়ে যায়”। [উমদাতুল ক্বারী শারহু সাহিহিল বুখারী, ইমাম আইনী- ১৪/৯৬]
আবু সাঈদ মাওলায়ে আল-মাহরী রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, আবু সাঈদ খুদরী রা. বর্ণনা করেন- أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَعَثَ إِلَى بَنِي لَحْيَانَ: لِيَخْرُجْ مِنْ كُلِّ رَجُلَيْنِ رَجُلٌ، ثُمَّ قَالَ لِلْقَاعِدِ: أَيُّكُمْ خَلَفَ الْخَارِجَ فِي أَهْلِهِ وَمَالِهِ بِخَيْرٍ، كَانَ لَهُ مِثْلُ نِصْفِ أَجْرِ الْخَارِجِ . رواه مسلم في صحيحه , كتاب الإمارة , باب فضل إعانة الغازي في سبيل الله بمركوب وغيره، وخلافته في أهله بخير: ٣/١٥٠٧ رقم ١٨٩٦ – “রাসুলুল্লাহ ﷺ (একবার হুজাইল গোত্রের একটি শাখা) বনু লাহ্বইয়ানের দিকে (একটি মুজাহিদ বাহিণী) প্রেরন করেছিলেন। তখন (মুজাহিদগণকে প্রেরনের আগে উপস্থিত মুসলমানদেরকে উদ্দেশ্য করে একথাও বলেছিলেন যে- ‘তোমাদের) প্রত্যেক দুই ব্যাক্তির মধ্যে (যে কোনো) একজনকে অবশ্যই (জিহাদে) বের হতে হবে’। তারপর (বাড়িতে) বসে থাকাদেরকে বললেন: ‘তোমাদের মধ্যে যে-ই (আল্লাহ’র পথে) বের হওয়া (কোনো মুজাহিদ)-এর পরিবার ও ধ্বন-মালের উত্তম ভাবে দেখভাল করবে, তার জন্য রয়েছে (জিহাদে) বের হওয়া ব্যাক্তির সওয়াবের অর্ধেক (পরিমান সওয়াব)”। [সহিহ মুসলীম- ৩/১৫০৭ হাদিস ১৮৯৬; সহিহ ইবনে হিব্বান– ১০/৪৮৭ হাদিস ৪৬২৯; সুনানে আবু দাউদ- ৩/১২ হাদিস ২৫১০; মুসতাদরাকে হাকিম– ২/৪০২ হাদিস ২৪৭৪; সুনানুল কুবরা, ইমাম বাইহাকী- ৯/৪০ হাদিস ১৭৩৩৯]
ফায়দা: ইমাম আবু বকর ইবনে মুনযীর আন-নিশাপুরী (মৃ: ৩১৯ হি:) রহ. এই হাদিসের ব্যাখ্যার এক পর্যায়ে বলেন- ففي تخلفه عن الخروج مع السرايا مع إذنه في أن ينبعث من كل رجلين رجل، دليل بين على أن فرض الجهاد ساقط عن الناس إذا قام منهم من فيه الكفاية – “এখানে স্বয়ং রাসুলুল্লাহ ﷺ একটি সারিয়ার (ছোট মুজাহিদ বাহিনীর) সাথে বের হওয়ার জন্য প্রতি দুইজন ব্যাক্তির মধ্যে একজন’কে (জিহাদে) পাঠিয়ে অন্যজনকে (মদিনায়) রয়ে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছেন। এটা একথারই পরিষ্কার দলিল যে, যখন মুসলমানদের মধ্য থেকে একটি পর্যাপ্ত সংখ্যক লোকের জামাআত জিহাদকে কায়েম রাখে, তখন (অপরাপর) মুসলমানদের উপর থেকে (জিহাদের এই) ফরয দায়িত্বটি সাকেত (স্থগিত) হয়ে যায় (এবং তারা ফরয তরকের গুনাহ থেকে বেঁচে যায়)”। [আল-ইশরাফ আলা মাযাহিবিল উলামা, ইবনে মুনযীর- ৪/১২] এ হাদিসটিও একথার প্রমাণ যে, সাধারণ অবস্থায় জিহাদ মূলত: ফরযে কেফায়া ।
পিতামাতার জায়েয আদেশ নিষেধ মান্য করে চলা সন্তানের জন্য ফরযে আইন। যখন কারোর উপরে জিহাদ ‘ফরযে কেফায়া’ হয়, তখন তার জন্য জিহাদে বের হওয়ার আগে প্রথমে তার পিতামাতার অনুমতি নেয়া জরুরী, কারণ শরীয়তে ফরযে কেফায়া আদায়ের চাইতে ফরযে আইন পালন অগ্রাধিকার ভারে জরুরী। নিচের হাদিসগুলো এর জ্বলজ্যান্ত দলিল। এর সবগুলো ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তির উপরে জিহাদ ফরযে কেফায়া ছিল বিধায় রাসুলুল্লাহ ﷺ তাদের প্রত্যেককে প্রথমে তাদের পিতামাতার কাছে জিহাদে বের হবার অনুমতি নেয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। যেমন-
আবুল আব্বাস আশ-শায়ের রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. বলেন-جَاءَ رَجُلٌ إلى النبيِّ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ، فَاسْتَأْذَنَهُ في الجِهَادِ، فَقَالَ: أحَيٌّ والِدَاكَ؟، قَالَ: نَعَمْ، قَالَ: فَفِيهِما فَجَاهِدْ . رواه البخاري في صحيحه , كتاب الجهاد والسير, باب الجهاد بإذن الأبوين: ٤/٥٩ رقم ٣٠٠٤ ، و مسلم في صحيحه , كتاب الجهاد والسير, باب بر الوالدين وأنهما أحق به: ٤/١٩٧٥ رقم ٢٥٤٩ – “(একবার) এক ব্যাক্তি নবী ﷺ-এর কাছে এসে তাঁর কাছে জিহাদে শরিক হওয়ার অনুমতি চাইলো। তখন তিনি বললেন: ‘তোমার পিতামাতা কি জীবিত আছেন’? সে বললো: ‘জি (জীবিত আছেন)’। নবী ﷺ বললেন: ‘তাহলে (যাও,) তাদের দুজনের মাঝেই জিহাদ করো”। [সহিহ বুখারী- ৪/৫৯ হাদিস ৩০০৪; সহিহ মুসলীম– ৪/১৯৭৫ হাদিস ২৫৪৯; আল-মুসান্নাফ, ইবনু আবি শায়বাহ- ১৮/১৩৫ হাদিস ৩৪১৪২; সহিহ ইবনে হিব্বান- ২/১৬৪ হাদিস ৪২০; সুনানে তিরমিযী, হাদিস ১৬৭১; সুনানে আবু দাউদ- ৩/১৭; মুসনাদে আহমদ- ২/২২১ হাদিস ৭০৬২; মুসনাদে হুমাইদী- ২/২৬৭; সুনানুল কুবরা, ইমাম বাইহাকী- ৯/৪৪ হাদিস ১৭৮২৭]
আবুল হাইছাম রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, আবু সাঈদ খুদরী রা. বলেন- أَنَّ رَجُلًا هَاجَرَ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنَ الْيَمَنِ، فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ ، إِنِّي هَاجَرْتُ، فَقَالَ لَهُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: قَدْ هَجَرْتَ الشِّرْكَ، وَلَكِنَّهُ الْجِهَادُ، هَلْ لَكَ أَحَدٌ بِالْيَمَنِ؟ قَالَ: أَبَوَايَ، قَالَ: أَذِنَا لَكَ؟ قَالَ: لَا، قَالَ: فَارْجِعْ، فَاسْتَأْذِنْهُمَا، فَإِنْ أَذِنَا لَكَ فَجَاهِدْ، وَإِلَّا فَبِرَّهُمَا . أخرجه سعيد بن منصور في سننه , كتاب الجهاد , باب ما جاء فيمن غزا وأبواه كارهان: ٢/١٦٣ رقم ٢٣٣٤، و ابن حبان في صحيحه , كتاب البر و الإحسان , باب حق الوالدين , ذكر البيان بأن بر الوالدين أفضل من جهاد التطوع: ٢/١٦٥ رقم ٤٢٢، و أبو داود في سننه , كتاب الجهاد، باب في الرجل يغزو وأبواه كارهان : ٣/١٧ رقم ٢٥٣٠، قال الألباني في صحيح أبي داود: صحيح ، و قال في الإرواء: ٥/٢١ رقم ١١٩٩: الحديث بمجموع طرقه صحيح– “(একবার) এক ব্যাক্তি ইয়েমেন থেকে হিজরত করে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে এসে বললো: ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমি হিজরত করেছি’। তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ তাকে জিজ্ঞেস করলেন: ‘তুমি শিরক থেকে (ইমানের দিকে) হিজরত করেছো বটে, কিন্তু জিহাদের কি হবে? ইয়েমেনে কি তোমার কেউ আছে’? সে বললো: ‘(সেখানে) আমার পিতামাতা (আছেন)’। তিঁনি জিজ্ঞেস করলেন: ‘তারা দুজন কি তোমাকে (জিহাদের) অনুমতি দিয়েছিলেন’? সে বললো: ‘না’। তিঁনি বললেন: ‘তাহলে তুমি (এখনই তাদের কাছে) ফিরে গিয়ে (প্রথমে) তাদের দুজনের অনুমতি নাও। তারা দুজনেই যদি তোমাকে অনুমতি দেন, তাহলে (ফিরে এসে) তুমি (আমাদের সঙ্গি হয়ে) জিহাদ করতে পারো। অন্যথায় (তাদের কাছে থেকে) তাদের উভয়ের সাথে সদাচারণ করো (তাদের অনুগত্য করো, তাদের খিদমত করো, এমতাবস্থায় এটাই হবে তোমার জন্য জিহাদ)”। [সুনানে সাঈদ বিন মানসুর- ২/১৬৩ হাদিস ২৩৩৪; সহিহ ইবনে হিব্বান– ২/১৬৫ হাদিস ৪২২; সুনানে আবু দাউদ- ৩/১৮ হাদিস ২৫৩০; মুসনাদে আহমদ- ৩/৭৫; মুসতাদরাকে হাকিম- ২/১২৫ হাদিস ২৫৫৬; আল-মুনতাকা, ইবনে জারুদ- ১/২৫৯; সুনানুল কুবরা, ইমাম বাইহাকী- ৯/৪৫ হাদিস ১৭৮৩১]
ত্বালহাহ রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, মুআবিয়া বিন জাহিমাহ আস-সুলামী রা. বলেন- أَنَّ جَاهِمَةَ، جَاءَ إِلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَرَدْتُ أَنْ أَغْزُوَ وَقَدْ جِئْتُ أَسْتَشِيرُكَ . فَقَالَ هَلْ لَكَ مِنْ أُمٍّ . قَالَ نَعَمْ . قَالَ ” فَالْزَمْهَا فَإِنَّ الْجَنَّةَ تَحْتَ رِجْلَيْهَا . أخرجه النسائي في السنن الكبرى , كتاب الجهاد , باب الرخصة في التخلف لمن له والدة : ٥/٢٩٢ رقم ٤٥٠٦، و في في السنن الصغرى , كتاب الجهاد , باب الرخصة في التخلف لمن له والدة : ٦/١١ رقم ٣١٠٤، و قال الألباني في صحيح النسائي : حسن صحيح – “(একবার আমার পিতা) জাহিমাহ (আস-সুলামী রা.) নবী ﷺ-এর কাছে গিয়ে বললেন: ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি গাজওয়া (জিহাদ)-এর ইরাদাহ (ইচ্ছে) করেছি। আর (এজন্য) আমি আপনার কাছে পরামর্শ নিতে এসেছি। নবী ﷺ জিজ্ঞেস করলেন: ‘তোমার কি মা আছেন’? তিনি বললেন: ‘জি হ্যাঁ’। (তখন) নবী ﷺ বললেন: ‘তাহলে তুমি তাঁ(র খেদমত ও তাঁর সাথে সদাচারণ)কে অপরিহার্য করে নাও। কারণ তার দু পায়ে’র নিচেই (তোমার) জান্নাত”। [সুনানুল কুবরা, ইমাম নাসায়ী- ৫/২৯২ হাদিস ৪৫০৬; সুনানুস সুগরা, ইমাম নাসায়ী– ৬/১১ হাদিস ৩১০৪; সুনানে ইবনে মাজাহ- ২/৯২৯ হাদিস ২৭৮১; মুসনাদে আহমদ- ৩/৪২৯; মুসতাদরাকে হাকিম- ৪/১৫১; আল-মু’জামুল কাবীর, ইমাম ত্বাবরাণী- ২/২৮৯ হাদিস ২২০২]
মাওলায়ে উম্মু সালমাহ রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, আব্দুল্লাহ রা. বলেন- أَقْبَلَ رَجُلٌ إِلَى نَبِيِّ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: أُبَايِعُكَ عَلَى الْهِجْرَةِ وَالْجِهَادِ، أَبْتَغِي الْأَجْرَ مِنَ اللهِ، قَالَ: فَهَلْ مِنْ وَالِدَيْكَ أَحَدٌ حَيٌّ؟ قَالَ: نَعَمْ، بَلْ كِلَاهُمَا، قَالَ: فَتَبْتَغِي الْأَجْرَ مِنَ اللهِ؟ قَالَ: نَعَمْ، قَالَ: فَارْجِعْ إِلَى وَالِدَيْكَ فَأَحْسِنْ صُحْبَتَهُمَا . رواه مسلم في صحيحه , كتاب الجهاد والسير, باب بر الوالدين وأنهما أحق به: ٤/١٩٧٥ رقم ٢٥٤٩، – “(একবার) এক ব্যাক্তি নবী ﷺ-এর কাছে এসে বললো: ‘আমি আপনার কাছে হিজরত ও জিহাদের উপরে বায়াত করবো এবং (এর কারণে) আমি আল্লাহ’র কাছ থেকে সওয়াব পাওয়া প্রত্যাশা করি’। নবী ﷺ জিজ্ঞেস করলেন: ‘তোমার পিতামাতার মধ্যে কেউ কি জীবিত আছেন’? সে বললো: ‘জি, তারা উভয়ে জীবিত আছেন’। তখন নবী ﷺ বললেন: ‘তুসি কি (সত্যই) আল্লাহ’র কাছে সওয়াব পাওয়া প্রত্যাশা করো’? সে বললো: ‘জি’। নবী ﷺ বললেন: ‘তাহলে তোমার পিতামাতার কাছে ফিরে গিয়ে তাদের উভয়ের সাথে হুসনে সুহবত (সদাচারণ) করো”। [সহিহ মুসলীম– ৪/১৯৭৫ হাদিস ২৫৪৯; সুনানে সাঈদ বিন মানসুর- ২/১৬৩ হাদিস ২৩৩৫; সুনানুল কুবরা, ইমাম বাইহাকী- ৯/৪৪ হাদিস ১৭৮২৯]
কাযী মুহাম্মাদ বিন আলী আশ-শাওকানী (মৃ: ১২৫০ হি:) রহ. বলেন- و هذا كله إن لم يتعين عليه الجهاد، فإذا تعين فتركه معصية، ولا طاعة لمخلوق في معصية الله عز وجل – “এই হাদিসগুলোর সবগুলোই ওই ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যখন কারোর উপরে জিহাদ ‘ফরযে আইন’ থাকে না, (বরং থাকে ফরযে কিফায়া)। (কিন্তু জিহাদ) যদি ফরযে আইন হয়ে যায়, তাহলে সেটা পরিত্যাগ করা (আল্লাহ’র প্রকাশ্য) অবাধ্যতা/অপরাধ। আর ‘আল্লাহ তাআলা’র অবাধ্যতার ক্ষেত্রে কোনো সৃষ্টির অনুগত্য জায়েয নেই”। [নাইলুল আউতার, শাওকানী- ৮/৩৭]
ইমাম মুহাম্মাদ বিন আব্দিল বাকী বিন ইউসুফ আল-জুরকানী (মৃ:১১২২ হি:) রহ. বলেন- قال الجمهور : يحرم الجهاد إذا منع الأبوان أو أحدهما بشرط أن يكونا مسلمين لأن برهما فرض عين والجهاد فرض كفاية ، فإذا تعين الجهاد فلا إذن – “জমহুর ওলামায়ে কেরাম বলেন, যদি পিতামাতা বা তাদের মধ্যে যে কোনো একজন জিহাদে যেতে নিষেধ করেন, তাহলে জিহাদে বের হওয়া হারাম, তবে এই শর্তে যে, তাদের দুজনকে মুসলীম হতে হবে। কেননা, পিতামাতার সাথে সদাচারণ ফরযে আইন, আর জিহাদ হল ফরযে কেফায়া। তাই, যখন জিহাদ ফরযে আইন হয়ে যবে, তখন অনুমতির কোনো প্রয়োজন নেই”। [শারহুল মুআত্তা, জুরকানী- ৩/২২]
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেন– لَا يَخْلُوَنَّ رَجُلٌ بِامْرَأَةٍ إِلَّا وَمَعَهَا ذُو مَحْرَمٍ، وَلَا تُسَافِرِ الْمَرْأَةُ إِلَّا مَعَ ذِي مَحْرَمٍ ، فَقَامَ رَجُلٌ، فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللهِ، إِنَّ امْرَأَتِي خَرَجَتْ حَاجَّةً، وَإِنِّي اكْتُتِبْتُ فِي غَزْوَةِ كَذَا وَكَذَا، قَالَ: انْطَلِقْ فَحُجَّ مَعَ امْرَأَتِكَ . أخرجه مسلم في صحيحه , كتاب الحج , باب سفر المرأة مع محرم إلى حج وغيره : ٢/٩٧٩ رقم ١٣٤١ – “কোনো নারীরর সাথে তার মাহরাম (কেউ উপস্থিত) না থাকলে কোনো পুরুষ তার সাথে একান্তে সাক্ষাত করবে না। আর নারীর সাথে মাহরাম কেউ না থাকলে সে (একাকি কোথাও) সফর করবে না’। তখন এক ব্যাক্তি জিজ্ঞেস করলো: ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার স্ত্রী হজ্জের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেছে, আর এদিকে আমি অমুক অমুক গাজওয়ায় (জিহাদে বের হওয়ার জন্য) নাম লিখিয়েছি, (এখন আমার স্ত্রীর মাসআলা কী হবে?)। রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন; ‘(তোমার স্ত্রীকে একা যেতে দিও না, বরং) ফিরে গিয়ে তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে হজ্জ করো’’। [সহিহ মুসলিম- ২/৯৭৮ হাদিস ১৩৪১]
ফায়দা: এই হাদিসে, রাসুলুল্লাহ ﷺ কর্তৃক -লোকটিকে জিহাদে যাওয়া থেকে বিরত রেখে বরং তার স্ত্রীর মাহরাম সফস-সঙ্গি হিসেবে হজ্জে যেতে বলাই একথার সুস্পষ্ট দলিল যে, জিহাদ প্রত্যেকের উপরে সর্বাবস্থায় ফরযে আইন নয়, বরং সাধারণ অবস্থায় তা ফরযে কেফায়া”। [শারহু মুখতাসারিত ত্বাহাবী, ইমাম জাসসাস- ৭/৯]
ত্বাউস রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন- أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ يَوْمَ الفَتْحِ: لاَ هِجْرَةَ بَعْدَ الفَتْحِ وَلَكِنْ جِهَادٌ وَنِيَّةٌ، وَإِذَا اسْتُنْفِرْتُمْ فَانْفِرُوا . رواه البخاري في صحيحه , كتاب الجهاد والسير , باب وجوب النفير، وما يجب من الجهاد والنية: ٤/٢٣ رقم ٢٨٢٥ ، و مسلم في صحيحه , كتاب الإمارة , باب المبايعة بعد فتح مكة على الإسلام والجهاد والخير، وبيان معنى لا هجرة بعد الفتح : ٣/١٤٨٧ رقم ١٣٥٣ – “(মক্কা) বিজয়ের দিন নবী ﷺ বলেছিলেন: ‘(মক্কা) বিজয়ের পর (আমার সাথে) আর কোনো (ফরয) হিজরত নেই, তবে (আমার পরেও ভবিষ্যতে) জিহাদ ও নিয়ত থাকবে। আর (তোমাদের খলিফা/ইমাম/রাষ্ট্রপ্রধান/সুলতান) যখন তোমাদেরকে (জিহাদে) বের হতে আহবান জানান, তখন তোমরা বের হয়ে পরো”। [সহিহ বুখারী- ৪/২৩ হাদিস ২৮২৫; সহিহ মুসলীম- ৩/১৪৮৭ হাদিস ১৩৫৩]
এই হাদিসের ব্যাখ্যায় ইমাম মুহিউদ্দিন নববী (মৃ: ৬৭৬ হি:) রহ. লিখেছেন- معناه : إذا طلبكم الإمام للخروج إلى الجهاد فاخرجوا ، وهذا دليل على أن الجهاد ليس فرض عين ، بل فرض كفاية إذا فعله من تحصل بهم الكفاية سقط الحرج عن الباقين ، وإن تركوه كلهم أثموا كلهم ، قال أصحابنا : الجهاد اليوم فرض كفاية ، إلا أن ينزل الكفار ببلد المسلمين فيتعين عليهم الجهاد ، فإن لم يكن في أهل ذلك البلد كفاية وجب على من يليهم تتميم الكفاية ، وأما في زمن النبي صلى الله عليه وسلم فالأصح عند أصحابنا أنه كان أيضا فرض كفاية . والثاني : أنه كان فرض عين ، واحتج القائلون بأنه كان فرض كفاية بأنه كان تغزو السرايا ، وفيها بعضهم دون بعض – “এর অর্থ হল, ‘ইমাম (খলিফা/সুলতান/শাসক) যখন তোমাদেরকে জিহাদে বের হওয়ার জন্য ডাক দেন, তখন তোমরা (জিহাদে) বেরিয়ে পরো’। আর এটাই একথার দলিল যে, জিহাদ (সর্বাবস্থায়) ফরযে আইন নয়, বরং ফরযে কেফায়া। যখন মুসলমানদের পর্যাপ্ত সংখ্যক ব্যাক্তির দ্বারা (জিহাদের) সংশ্লিষ্ট উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে যায়, তখন বাকি (মুসলমান)দের (জিহাদে) বের হওয়ার (ফরযিয়াত/অত্যাবশ্যকতা)ও সাকেত (স্থগিত) হয়ে যায়। যদি তাদের সকলেই জিহাদ পরিত্যাগ করে তাহলে তাদের সকলেই গুনাহগার হবে। আমাদের ওলামায়ে কেরাম বলেছেন যে, সাধারণ অবস্থায় জিহাদ হল ফরযে কেফায়া। তবে কাফেররা যদি মুসলমানদের ভূমিতে আক্রমন করে বসে তাহলে তাদের (এলাকার) সকল মুসলমানের উপরে জিহাদ ফরয হয়ে যায়। এমতাবস্থায় যদি সে এলাকার অধিবাসীরা (জিহাদ পরিচালনা)র জন্য যথেষ্ট না হয়, তাহলে তাদের অধিক নিকটবর্তী (এলাকার মুসলীম অধিবাসী)দের উপরে ফরয হয়ে যায় (ওইসকল দুশমনদের মোকাবেলায় জিহাদকে) পূর্ণাঙ্গরূপে আঞ্জাম দিতে যতজন লাগে ততজন (জিহাদে) যোগ দেয়া। আমাদের ওলামায়ে কেরামের মতে, নবী ﷺ-এর জামানাতেও জিহাদ (সাধারণ অবস্থায়) ফরযে কেফায়াই ছিল। দ্বিতীয়ত: যারাও বলেছেন যে, (তখন) জিহাদ ফরযে আইন ছিল, তারাও একথা বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, জিহাদ মূলত: ফরয়ে কেফায়া, কেননা (নবী ﷺ-এর জামানায় বহু ক্ষেত্রেই বিভিন্ন স্থানে পাঠানো) সারিয়া (ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুজাহিদ বাহিনী) জিহাদ করতো, যার মধ্যে (মুসলমানদের মধ্য থেকে) কিছু লোক শরিক থাকতেন, আবার অনেকে শরিক থাকতেন না, (যা -জিহাদ ফরযে কেফায়া হওয়ার সুস্পষ্ট দলিল)”। [শারহুল মুসলীম, ইমাম নববী- ১৩/৯]
সাধারণ অবস্থায় জিহাদ ফরযে কেফায়া হওয়ার ব্যাপারে আকাবীর আলেমগণের মতামত
ইমাম আবু বকর আল-জাসসাস রাযী (মৃ: ৩৭০ হি:) রহ. লিখেছেন- و إنما قلنا إنه فرض على الكفاية، وليس هو على كل أحد في عينه – “আমাদের মত হল, জিহাদ (সাধারণ অবস্থায়) ফরযে কেফায়া; এটা প্রত্যেকের উপরে (সর্বাবস্থায়) ফরযে আইন নয়”। [শারহু মুখতাসারিত ত্বাহাবী, ইমাম জাসসাস- ৭/৮]
ইমাম আবু মুহাম্মাদ ইবনু আতিয়্যাহ আল-উন্দুলুসী (মৃ: ৫৪৬ হি:) রহ. লিখেছেন- والذي استمر عليه الإجماع أن الجهاد على كل أمة محمد صلى الله عليه وسلم فرض كفاية، فإذا قام به من قام من المسلمين سقط عن الباقين، إلا أن ينزل العدو بساحة الإسلام فهو حينئذ فرض عين – “যে বিষয়ের উপরে (উম্মাহ’র মাঝে) ইজমা চলে আসছে তা এই যে, (সাধারণ অবস্থায়) মুহাম্মাদ ﷺ-এর সকল উম্মতের উপরে জিহাদ হল ফরযে কেফায়া। মুসলমানদের মধ্যে যারা কায়েম রাখার (দায়িত্বভার প্রাপ্ত) তারা যদি তা কায়েম রাখে, তাহলে (মুসলমানদের) বাকিদের উপর থেকে (এই ফরয আমলের দায়ভার) সাকেত (স্থগিত) হয়ে যায় (এবং তারা ফরয তরকের গুনাহ থেকে বেঁচে যায়)। তবে দুশমনরা (ইসলাম বা মুসলমানদের ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যে দ্বারুল) ইসলামের সীমার ভিতরে ঢুকে পড়লে এমতাবস্থায় (জিহাদ সকলের উপরে) ফরযে আইন হয়ে যায়”। [আল-মুহাররার ওয়াল ওয়াজিয, ইমাম ইবনে আতিয়্যাহ- ১/২৮৯; আল-জামে লি-আহকামিল কুরআন, ইমাম কুরতুবী- ৮/৩৮]
ইমাম আবু বকর আলাউদ্দিন আল-কাসানী (মৃ: ৫৮৭ হি:) রহ. লিখেছেন- وأما بيان كيفية فرضية الجهاد فالامر فيه لا يخلو من أحد وجهين اما إن كان النفير عاما (واما) ان لم يكن فإن لم يكن النفير عاما فهو فرض كفاية ومعناه ان يفترض على جميع من هو من أهل الجهاد لكن إذا قام به البعض سقط عن الباقين– “জিহাদ ফরয হওয়ার বৈশিষ্ট সম্পর্কে কথা এই যে, এটি দুটি বিষয়ের যে কোনো একটি হওয়া থেকে খালি থাকে না। হয় তা নাফিরে আম হবে, (আর এমনটা হলে তো জিহাদ ফরযে আইন হয়ে যায়), নতুবা তা (নাফিরে আম) হবে না। যদি নাফিরে আম না হয়, তাহলে জিহাদ ফরযে কেফায়া হয়। এর অর্থ হল, তখন যারা জিহাদ করার উপযোগী তাদের সকলের উপরে জিহাদ ফরয হয়ে যায় বটে, তবে (পর্যাপ্ত) কিছু সংখ্যক মুসলমানদের যদি তা কায়েম রাখে, তাহলে (মুসলমানদের) বাকিদের উপর থেকে (এই ফরয আমলের দায়ভার) সাকেত (স্থগিত) হয়ে যায় (এবং তারা ফরয তরকের গুনাহ থেকে বেঁচে যায়)”। [আল-বাদায়েউস সানায়ে, ইমাম কাসানী- ৭/৯৮]
ইমাম আবুল হাসান বুরহানুদ্দিন মারগিনানী (মৃ: ৫৯৩ হি:) রহ. লিখেছেন- الجهاد فرض على الكفاية إذا قام به فريق من الناس سقط عن الباقين– “জিহাদ (সাধারণ অবস্থায়) ফরযে কেফায়া। যখন মুসলমানদের মধ্যে কোনো দল তা কায়েম রাখে, তখন (মুসলমানদের) বাকিদের উপর থেকে (এই ফরয আমলের দায়ভার) সাকেত (স্থগিত) হয়ে যায় (এবং তারা ফরয তরকের গুনাহ থেকে বেঁচে যায়)”। [আল-হিদায়াহ, ইমাম মারগিনানী- ২/৩৭৮]
ইমাম মুয়াফফাক ইবনু কুদামাহ আল-মাকদীসী (৫৪১ – ৬২০ হি:) রহ. লিখেছেন- و الجهاد فرض على الكفاية ، إذا قام به قوم ، سقط عن الباقين ; معنى فرض الكفاية ، الذي إن لم يقم به من يكفي ، أثم الناس كلهم ، وإن قام به من يكفي ، سقط عن سائر الناس . فالخطاب في ابتدائه يتناول الجميع ، كفرض الأعيان ، ثم يختلفان في أن فرض الكفاية يسقط بفعل بعض الناس له ، وفرض الأعيان لا يسقط عن أحد بفعل غيره والجهاد من فروض الكفايات ، في قول عامة أهل العلم– “জিহাদ (সাধারণ অবস্থায়) ফরযে কেফায়া -যখন একদল (মুসলমান) তা কায়েম রাখে, তখন (মুসলমানদের) বাকিদের উপর থেকে (এই ফরয আমলের দায়ভার) সাকেত (স্থগিত) হয়ে যায় (এবং তারা ফরয তরকের গুনাহ থেকে বেঁচে যায়)। ‘ফরযে কেফায়া’ হওয়ার অর্থ হল, পর্যাপ্ত সংখ্যক (মুসলমান) যদি জিহাদ’কে কায়েম না রাখে, তাহলে সকল মুসলমানই (জিহাদ কায়েম না রাখার দায়ে) গুনাহগার হবে, আর যদি পর্যাপ্ত সংখ্যক (মুসলমান) জিহাদ’কে কায়েম রাখে, তাহলে বাকি সকলের উপর থেকে (জিহাদ কায়েম রাখার ফরয দায়িত্ব) সাকেত (স্থগিত) হয়ে যাবে। বস্তুত: (যে কোনো ফরযে কেফায়া আমল কায়েম করার অত্যাবশ্যকতা ও অপরিহার্যতা সম্পর্কে কথা হল) এটি প্রথমাবস্থায় ফরযে আইনের মতোই সকল (মুসলমান)-এর উপরে (সমভাবে) আদিষ্ট থাকে। এ দুয়ের মাঝে (মূল) পার্থক্য হল, কিছু (পর্যাপ্ত) সংখ্যক ব্যাক্তি কর্তৃক (এ ফরয) আমলটি আদায়ের দ্বারা (অপরাপর সকল মুসলমানের উপর থেকে উক্ত) ফরযে কেফায়ার দায়িত্বটি সাকেত (স্থগিত) হয়ে যায়, কিন্তু (অন্য দিকে) একজনের আমলের দ্বারা আরেকজনের উপরে থেকে ফরযে আইন আদায়ের দায়িত্ব সাকেত (স্থগিত) হয় না। জিহাদও ফরযে কেফায়া সমূহের মধ্যে অন্যতম। ওলামায়ে কেরাম আমভাবে এমনটাই বলেছেন”। [আল-মুগনী, ইবন কুদামাহ- ৯/১৬৩]
ইমাম মুহিউদ্দিন ইয়াহইয়া আন-নববী (মৃ: ৬৭৬ হি:) রহ. বলেন- أن الجهاد فرض كفاية لا فرض عين – “জিহাদ (সাধারণ অবস্থায়) ফরযে কেফায়া; ফরযে আইন নয়”। [শারহুল মুসলীম, ইমাম নববী- ১৩/১৯]
ইমাম আবুল বারাকাত আন-নাসাফী (মৃ: ৬৭৬ হি:) রহ. বলেন- الجهاد فرض كفايةٍ ابتداءً فإن قام به بعضٌ سقط عن الكلّ وإلّا أثموا بتركه . و لا يجب على صبيٍّ وامرأةٍ وعبدٍ وأعمى ومقعدٍ وأقطع . و فرض عينٍ إن هجم العدوّ . فتخرج المرأة والعبد بلا إذن زوجها وسيّده – “(সাধারণ অবস্থায়) জিহাদ প্রথম দিকে ফরযে কেফায়া থাকে। তখন (পর্যাপ্ত) কিছু সংখ্যক মুসলমানদের যদি তা কায়েম রাখে, তাহলে বাকি সকল মুসলমনের উপর থেকে (এই ফরয আমলের দায়ভার) সাকেত (স্থগিত) হয়ে যায়, অন্যথায় জিহাদ তরকের কারণে সকলে গুনাহগার হয়ে যায়। শিশু, নারী, দাস, অন্ধ, অসুস্থ্য এবং পঙ্গু ব্যাক্তির উপরে জিহাদ ফরয নয়। (মুসলমানদের ভূমিতে ইসলামের) দুশমনরা আক্রমন করে বসলে (মুসলমানদের উপরে) জিহাদ ফরযে আইন হয়ে যায়। ফলে তখন স্ত্রী তার স্বামীর এবং গোলাম তার মনিবের অনুমতি ব্যতীতই (জিহাদে) বেরিয়ে পড়বে”। [কানজুদ দাক্বায়েক্ব, ইমাম নাসাফী- ১/৩৬৯]
শায়েখ আব্দুল আযীয বিন বায (মৃ: ১৪২০ হি:) লিখেছেন- أن الجهاد فرض كفاية لا فرض عين، وعلى جميع المسلمين أن يجاهدوا في نصر إخوانهم بالنفس والمال والسلاح والدعوة والمشورة، فإذا خرج منهم من يكفي سلم الجميع من الإثم، وإذا تركوه كلهم أثموا جميعا، فعلى المسلمين في المملكة وإفريقيا والمغرب وغيرها أن يبذلوا طاقتهم والأقرب فالأقرب، فإذا حصلت الكفاية من دولة أو دولتين أو ثلاث أو أكثر سقط عن الباقين، وهم مستحقون للنصر والتأييد، والواجب مساعدتهم ضد عدوهم لأنهم مظلومون، والله أمر بالجهاد للجميع، وعليهم أن يجاهدوا ضد أعداء الله حتى ينصروا إخوانهم، وإذا تركوا ذلك أثموا وإذا قام به من يكفي سقط الإثم عن الباقين . اورده الشيخ ابن باز في مجموع فتاوى ومقالات : ٧/٣٣٨ – “জিহাদ (সাধারণ অবস্থায়) ফরযে কেফায়া; ফরযে আইন নয়। আর এটা সকল মুসলমানের উপরে ফরয যে, তারা তাদের জান, মাল, অস্ত্রশস্ত্র, আহবান ও পরামর্শ (যার যে সামর্থ রয়েছে সে তা) দিয়ে তাদের (আক্রান্ত মুসলমান) ভাইদের সাহায্যার্থে জিহাদ করবে। এতে যদি তাদের মধ্য থেকে এত লোক (জিহাদে) বের হয়, যারা (জিহাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য) যথেষ্ট, তাহলে বাদবাকি সকল মুসলমান গুনাহ থেকে বেঁচে যাবে। আর যদি তাদের সকলে জিহাদ পরিত্যাগ করে, তাহলে তাদের সবাই গুনাহগার হবে। এজন্য (পৃথিবীর) বিভিন্ন (মুসলীম) দেশগুলো সহ আফ্রিকা ও ইউরোপের মুসলমানদের উপরে দায়িত্ব হল, তারা তাদের শক্তি-সামর্থকে (জিহাদকে পূর্ণতা দানে) যথাসাধ্য ব্যয় করবে। (এক্ষেত্রে আক্রান্ত মুসলমানদের যারা অধিক) নিকটবর্তী (প্রথমে তাদের এগিয়ে আসা অপরিহার্য। এরপর যারা) নিকটবর্তী (তাদের উপরে এ দায়িত্ব বর্তাবে)। এভাবে যখন একটি বা দুটি অথবা তিনটি রাষ্ট্র কিংবা আরো বেশি সংখ্যক রাষ্ট্র (হোক -প্রয়োজন মোতাবেক রাষ্ট্রশক্তি মিলে এ জিহাদের উদ্দেশ্য) যথেষ্ট মাত্রায় সাহিল করে নিবে, তখন বাকি মুসলমনদের উপর থেকে (জিহাদের এই ফরয আমলের দায়ভার) সাকেত (স্থগিত) হয়ে যাবে। (আক্রান্ত মুসলমানগণ অন্যান্য দেশের মুসলমানদের পক্ষ থেকে যথাসম্ভব) সাহায্য সহযোগীতা ও সমর্থন পাবার পরিপূর্ণ হক্ব রাখে। এক্ষেত্রে তাদের থেকে তাদের (উপরে আক্রমনকারী) দুশমনদেরকে প্রতিহতকরণে (যথাসম্ভব) সাহায্য করা (মুসলমানদের উপরে) ফরয, কেননা তারা মজলুম। আল্লাহ তাআলা (জিহাদ করার উপযোগী) সকল মুসলমানকে জিহাদ করার নির্দেশ দিয়েছেন। আর তাদের উপরে ফরয হল, তারা আল্লাহ’র দুশমনদেরকে প্রতিহতকরণে জিহাদ করবে, যাতে (এর দ্বারা) তারা তাদের (মুসলমান) ভাইদেরকে সাহায্য করতে পারে। তারা যখন (জিহাদের এ ফরয দায়িত্ব) তরক করবে, তখন তারা (সকলেই) গুনাহগার হবে। আর যদি পর্যাপ্ত সংখ্যক (মুসলমান) জিহাদ’কে কায়েম রাখে, তাহলে বাকি সকলের উপর থেকে (জিহাদ কায়েম রাখার ফরয দায়িত্ব) সাকেত (স্থগিত) হয়ে যাবে”। [মাজমুউল ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাত, শায়েখ বিন বায- ৭/৩৩৮]
>>> মূল সূচিপত্র (index) থেকে এ পেজের পূর্ববর্তী বা পরবর্তী আলোচনা পড়তে [এখানে ক্লিক করুন]