রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ আইন ও সংবিধান রচনা : পরিষ্কার কুফর, শিরক, আল্লাহদ্রোহিতা, ইসলাম বিরোধীতা ও পথভ্রষ্ঠতা -কেনো?
>>> মূল সূচিপত্র (index) থেকে এ পেজের পূর্ববর্তী বা পরবর্তী আলোচনা পড়তে [এখানে ক্লিক করুন]
পূর্ব আলোচনার পর………….
আমাদের ইতিপূর্বে উল্লেখীত ধর্মনিরপেক্ষতা’র ১ নং বৈশিষ্ট অনুযায়ী যেহেতেু- “রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে ধর্মকে আলাদা রাখায় বিশ্বাস করা ধর্মনিরপেক্ষতা’র সর্ব প্রধান শর্ত ও ভিত্তি, যেটাকে তারা বলে থাকে Separation of religion and state (ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে বিভাজন)”, তাই একটি দেশকে Secular State (ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র) বানানোর ক্রমধারায় রাষ্ট্রের আইন প্রণয়নী বিভাগ (Legislative Division) থেকেও ধর্মকে ১০০% ছেটে ফেলে দেয়ায় বিশ্বাস করা ধর্মনিরপেক্ষতা’র প্রধান শর্তের অংশ। তার মানে, এরকম বিশ্বাস যার নেই সে মূলত: ধর্মনিরপেক্ষতা’তেই বিশ্বাস করে না।
সেখানে আমরা ধর্মনিরপেক্ষতা’র১ নং বৈশিষ্ট’টিকে খোলাসা করতে গিয়ে আরো উল্লেখ করে এসেছি যে—–‘‘(ক) ধর্মনিরপেক্ষ আইন প্রণয়নী বিভাগ (Secular Legislative Division):এই বিভাগের আওতায় থাকে আইনসভা (Parliament/Legislative Assembly)। এই আইনসভা’র সদস্যরা ‘রাষ্ট্রের সংবিধান রচনার একক আইনানুগ অধিকারী কর্তা (Legislators)’ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে এবং নাগরীকদের জন্য সাংবিধানিক আইন রচনা করে থাকে। এই আইনসভা বাংলাদেশে ‘জাতীয়-সংসদ’ হিসেবে পরিচিত, আর এর সদস্যদেরকে বলা হয় সাংসদ। ধর্মনিরপেক্ষকাবাদ বিশ্বাস করে, (ক) এই আইনসভার সদস্যরাই হবে দেশের সংবিধানিক আইন রচনার একমাত্র আইনানুগ অধিকারী কর্তা (Legislators), (খ) তারা সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিধিবিধানকে ১০০% দূরে রেখে শুধুমাত্র নিজেদের জ্ঞান, বিবেক-বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা খাটিয়ে দেশের নাগরীকদের জন্য আইন রচনা করবে, (গ) আইনসভার সদস্যরা যে আইন তৈরী করবে সেটাই হবে রাষ্ট্রের চুড়ান্ত আইন, যা সকল জনগণের উপর সমভাবে প্রযোজ্য হবে এবং জনগণ শুধুমাত্র উক্ত সংবিধানকেই (ফরযে আইন হিসেবে) মানতে বাধ্য থাকবে, (ঘ) সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক যে কোনো ধর্মীয় আইন মানা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ (হারাম) থাকবে, মানলে তা হবে আইনের দৃষ্টিতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ (রাষ্ট্রিয় পাপ), এর বিরোধীতা (বাগাওয়াত্) করলে তা হবে কখনো কখনো রাষ্ট্রদ্রোহিতা, যার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত রয়েছে। এটাই হল ধর্মনিরপেক্ষ আইন-প্রণয়নী বিভাগ (Secular Legislative Division)-এর মূল চেহারা ও খাসলত’’।
যে ব্যাক্তি দ্বীন ইসলামের সামান্যতম জ্ঞানও রাখে, সে-ই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের উপরোক্ত বিশ্বাসটি দেখে একবারে অাঁতকে উঠবে !!! কারণ, একথা কে না জানে যে, আল্লাহ’র একটিমাত্র প্রমাণিত শরয়ী আইনকে অস্বীকার করলে বা বাতিল করলে বা পরিত্যাজ্য ও প্রত্যখ্যাত বলে গণ্য করলে কিংবা হীন হেও ও তুচ্ছজ্ঞান করলে অথবা আল্লাহ’র আইনের চাইতে অন্য কারো আইনকে উত্তম মনে করলে -সে আর মুসলীম থাকে না, মুরতাদ (ইসলাম ত্যাগকারী কাফের) হয়ে যায়। সেখানে কি করে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যাবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট আল্লাহ’র প্রায় সকল শরয়ী আইনকে কায়েম করণে অস্বীকার করলে অথবা প্রয়োগের প্রশ্নে তা বাতিল, পরিত্যাজ্য, প্রত্যখ্যাত বলে গণ্য করলে কিংবা হেও ও তুচ্ছজ্ঞান করলে অথবা আল্লাহ’র আইনের চাইতে আইনসভায় পাশ হওয়া আইনকে উত্তম মনে করলে সে মুসলীম থাকবে, কাফের হবে না?!!! অবশ্যই হবে। এজন্য ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী আকীদা-বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট সম্পর্কে অবগত সকল হক্কানী ওলামায়ে কেরাম এব্যাপারে একমত যে, যে ব্যাক্তি ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের এরকম কুফরী আকীদায় বিশ্বাসী, সে ‘কাফের’ বা ‘মুরতাদ’ হিসেবে গণ্য। [বিস্তারিত দেখুন:- আল ইহকাম, ইবনে হাযাম- ২/১৪৪; মাজমুউল ফাতাওয়া, ইবনে তাইমিয়্যাহ-৩/২৬৭, ১১/২৬২, ৩৫/৩৭২; আল মু’তামিদ ফি উসুলিদ্দীন, ইমাম আবু ইয়ালা পৃ: ২৭১; মিনহাজুস্ সুন্নাহ- ৫/১৩০; আহকামু আহলিযযিম্মাহ, ইবনুল কাইয়্যেম পৃ: ৫৩৩; তাফসীরে ইবনে কাসির- ৩/১৩১; আল বিদায়্যাহ ওয়ান নিহায়্যাহ, ইবনে কাসির- ১৩/১১৩; মাজাল্লাহ মাজমাউ ফিকহীল ইসলামী- ৩/২৫৯; ফাতওয়ায়ে আল-লাযনাতুদ দায়েমাহ- ২/১৪৩,১৪৪; আল মাওকাউর রাসমী, শায়েখ ফাউযান- ফাতওয়া নং ১০৪৪৩]
যা-হোক তবুও অনেকে বিষয়টির আরো খোলাসা ব্যাখ্যা জানতে আগ্রহী, তাই বিষয়টি নিয়ে নিম্নে বিস্তারিত দলিল ও ব্যাখ্যা সহ আলোচনা পেশ করার চেষ্টা করছি।
আল্লাহ তাআলা’র দাবী: তাঁর নিজের সৃষ্টির উপরে শুধু তাঁর নিজের বিধান চলবে
আল্লাহ তাআলা একথা দাবী করে বলেছেন যে, সকল কিছু তাঁর একার সৃষ্টি করা মাখলুক, তাই তাদের উপর কি হুকুম বা নির্দেশ তিনি দিবেন সেটা একমাত্র তাঁর একার ব্যাপার। তাঁর সৃষ্টির উপর কোনো রকম খবরদারি করার দ্বিতীয় কেউ নেই। তিঁনি বলেছেন-
أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ تَبَارَكَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ
“খুব ভাল করে জেনে রাখো, সৃষ্টি তাঁর, হুকুমও (চলে, চলবে) তাঁর; (তিনি) আল্লাহ (যিনি) বরকতময় (যিনি) বিশ্বজাহানের রব (মনিব/প্রভু)”। [সূরা আ’রাফ ৫৪]
وَلَا يُشْرِكُ فِي حُكْمِهِ أَحَدًا
“আর তিনি (আল্লাহ যিনি) তাঁর হুকুম দানের ক্ষেত্রে অন্য কাউকে অংশীদার বানান না”। [সূরা কাহফ ২৬]
এজাতীয় আয়াতে কারিমা থেকে বোঝা যায়, আল্লাহ তাআলা চান তাঁর সকল মাখলুক শুধু তাঁরই আজ্ঞাবহ হয়ে থাকুক। কাজেই, যে মানুষ ও জ্বিন জাতিকে তিঁনি বিশেষভাবে সৃষ্টিই করেছেন শুধুমাত্র এজন্য যে, তারা উভয়ে কেবলমাত্র তাঁকেই রব (প্রভু) হিসেবে মেনে চলবে, শুধুমাত্র তাঁরই ইবাদত ও গোলামী করবে, কেবল তাঁরই আজ্ঞাবহ হয়ে থাকবে, সেই মানুষ ও জ্বীন জাতিই বা কোন্ যুক্তিতে তাদের সৃষ্টিকর্তা প্রভু আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো কাল্পনীক কিছুকে কিংবা নিজেদের মধ্যে থেকেই কাউকে মান্যবর রব (মনিব/প্রভু) হিসেবে মেনে নিয়ে তার আজ্ঞাবহ হয়ে চলবে, আর আল্লাহ সেটা মেনে নিবেন ?!!! এদিকে ইংগীত করেই আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন-
أَوَلَمْ يَرَوْا إِلَىٰ مَا خَلَقَ اللَّهُ مِن شَيْءٍ يَتَفَيَّأُ ظِلَالُهُ عَنِ الْيَمِينِ وَالشَّمَائِلِ سُجَّدًا لِّلَّهِ وَهُمْ دَاخِرُونَ (٤٨) وَلِلَّهِ يَسْجُدُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ مِن دَابَّةٍ وَالْمَلَائِكَةُ وَهُمْ لَا يَسْتَكْبِرُونَ (٤٩) يَخَافُونَ رَبَّهُم مِّن فَوْقِهِمْ وَيَفْعَلُونَ مَا يُؤْمَرُونَ (٥٠) وَقَالَ اللَّهُ لَا تَتَّخِذُوا إِلَٰهَيْنِ اثْنَيْنِ ۖ إِنَّمَا هُوَ إِلَٰهٌ وَاحِدٌ –
“তারা কি আল্লাহ’র সৃষ্টির মধ্যে কোনো কিছুর প্রতি লক্ষ্য করে দেখে না যে, সেটার ছায়া কিভাবে বিনয়বনত অবস্থায় ডান ও বাম থেকে নুয়ে পড়ে আল্লাহ’র উদ্দেশ্যে সেজদাহরতঃ হয়ে যায়? আর আসমানসমূহে যা আছে এবং জমিনে যত জীবিত প্রাণি ও ফেরেশতা রয়েছে তারা আল্লাহ’র উদ্দেশ্যে সিজদাহ’রতঃ হয় এবং তারা (আল্লাহকে তাদের প্রতিপালক মনিব, প্রভু ও ইবাদতযোগ্য উপাস্য হিসেবে মানার ক্ষেত্রে কোনো) অহংকার করে না। তারা তাদেররব(মনিব/প্রভুআল্লাহ)কে ভয় করে যিনি তাদের উপরে রয়েছেন। (তাহলে, হে জ্বিন ও মানুষ ! কোন্ যুক্তিতে তোমরা আল্লাহকে তোমাদের একমাত্র প্রতিপালক, মনিব, প্রভু ও ইবাদতযোগ্য উপাস্য হিসেবে মানা ও তাঁর আজ্ঞাবহ হয়ে চলা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে অহংকার প্রকাশ করবে এবং তাঁকে ভয় করবে না?!)।(সিজদাহ)আর (তোমাদের সত্যিকার উপাস্য মনিব ও প্রভু) আল্লাহ বলছেন, তোমরা (তোমাদের জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই) দু’জন ইলাহ (উপাস্য)অবলম্বন করো না। (কারণ তোমাদের)ইলাহ(উপাস্য)শুধুমাত্র একজনই। (সর্বোক্ষেত্রে শুধুমাত্র তাঁকেই মনিব, প্রভু ও ইবাদতযোগ্য উপাস্য হিসেবে সিজদাহ করো শুধু তাঁরই নির্দেশ পালনের মাধ্যমে তাঁর আজ্ঞাবহ হয়ে চলো; দ্বিতীয় কাউকে রব ও ইলাহ হিসেবে গ্রহন করো না)”।[সুরা নহল ৪৮-৫০]
وَقَضَىٰ رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ
“আর তোমাররব (মনিব/প্রভু)ফয়সালা করেছেন, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য আর কারোরইইবাদত করবে না”। [সূরা আল-ইসরা ২৩]
إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ ۚ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ ۚ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ
‘‘হুকুম (চলে ও চলবে) শুধুমাত্র আল্লাহ’র। তিনি হুকুম করেছেন, তোমরা (জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই) তাঁকে ছাড়া অন্য আর কারোরই ইবাদত(উপাসনা ও গোলামী) করবে না (অন্য কারো আজ্ঞাবহ হবে না)। (ভাল করে জেনে রেখো) এটাই হল ‘দ্বীন-ই-কাইয়্যেম’ (প্রতিষ্ঠিত দ্বীন)। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই তা জানে না”। [সূরা ইউসূফ ৪০]
আল্লাহ’কে পরিত্যাগ করে –যখন একজন ব্যাক্তি অন্য কোনো আইন রচনাকারীকে তার নিজের রব (মনিব/প্রভু) ও ইলাহ (উপাস্য) হিসেবে মেনে নিয়ে তার ইবাদত করতে থাকে, করতে থাকে প্রকাশ্য শিরক ও কুফরী
উপরের আয়াতগুলো বোঝার আগে একটি বিষয় খেয়াল করুন যে, বেশিরভাগ মানুষ যখন রব (প্রভু) , ইলাহ (উপাস্য) বা ‘ইবাদত’ শব্দটি শোনে, তখন প্রথমেই যে চিত্রটি তাদের মস্তিষ্কে ভেসে ওঠে, সেটা হল “একজন ব্যাক্তি যাকে তার সৃষ্টিকর্তা পালনকর্তা প্রভু হিসেবে বিশ্বাস করে, তার সামনে নতজানু হয়ে আছে বা মাথা ঠেকিয়ে নিজের হেওতা ও ক্ষুদ্রতা প্রকাশ করছে কিংবা সে তার বিশ্বাস অনুযায়ী ধর্মীয় কোনো আনুষ্ঠানিকতা পালন করছে”।
এজন্যই দেখা যায়, সমাজে মুসলমান হিসেবে পরিচিত কেউ যখন এই আয়াতটি দেখে– وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ – “আমি মানুষ এবং জ্বিনকে আমার ইবাদত করা ছাড়া আর অন্য কিছুর জন্য সৃষ্টি করিনি”। [সুরা যারিয়াহ ৫৬] –তখন তাদের অনেকে তো বলেই ফেলে যে ‘ইবাদত ছাড়া কি মানুষের আর কাজ নেই! সমাজ সংসার বাদ দিয়ে সবসময় মসজিদে পড়ে থেকে খালি আল্লাহ-বিল্লাহ করে ইবাদত করা কি সম্ভব!!!’ এর কারণ এই একটাই; তারা মনে করে যে, আল্লাহ তাআলা মানুষ ও জ্বিন জাতিকে শুধুমাত্র এজন্যই সৃষ্টি করেছেন যে, তাদের ধারনা মতে তিঁনি দেখতে চান তাদের মধ্যে কে কে দুনিয়ার অপরাপর কাজ কাম ফেলে রেখে মসজিদে গিয়ে শুধু নামাজ পড়েই চলেছে, জিকির আযকার করেই চলেছে আর থামছেনা, শুধু এটা দেখার জন্যই আল্লাহ এই আয়াত নাজিল করেছেন। আর এরকম মনমানুসিকতার কারণেই কেউ যদি শুধুমাত্র ব্যাক্তি জীবন কেন্দ্রিক দ্বীন ইসলামের কিছু বিধিবিধানের উপর ইমান রেখে তা পালন করে (যেমন নামায, রোযা, কুরআন তিলাওযাত, দান-সদকাহ ইত্যাদি বেশ পালন করে), আর এদিকে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিয় পর্যায়ে আল্লাহ’র দ্বীন ইসলামের প্রমাণিত মজবুত বিভিন্ন শরয়ী বিধানবিধান (উদাহরণস্বরূপ: শরীয়তের বিবাহ-তালাক আইন, নারী-পুরুষের সম্পত্তির উত্তরাধিকার আইন, নারী ও পুরুষের নেতৃত্ব আইন, চুরি ডাকাতি বা হিবাহিত ব্যাভিচারির রজম আইন, খিলাফত, জিহাদ) ইত্যাদিকে অযৌক্তিক ভুল বা অশুদ্ধ বলে বিশ্বাস করে কিংবা এসবের বিরোধিতা করে, তবুও তাকে বলা হয় ‘ধর্মভিরু মুসলীম (!)’। কারণ, তারা একথা তাদের মনমগজে মুর্খতাবসতঃ বদ্ধমূল করে নিয়েছে যে, কালেমা পাঠ করে তারা ইমানদার মুসলীম-তো হয়েই গেছে, আর নামাজ, রোযা, হজ্জ, যাকাত আদায় করে ইসলামের পাঁচ খুঁটির উপরও দাঁড়ানো আছে, সাথে দৈনিক কুরআন তিলাওযাত, তাসবিহ-তাহলিল, দান-সদকাহও চলছে, সুতরাং তারা আল্লাহ’র কাছে ইমানদার মুসলীম – চাই এদিকে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিয় পর্যায়ে আল্লাহ’র দ্বীন ইসলামের প্রমাণিত মজবুত কোনো শরয়ী আইনের বিরোধিতাও করুক না কেনো কিংবা ইসলামবিরোধী কোনো মানবরচিত দ্বীন যেমন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ইত্যাদির মতো পথভ্রষ্ঠ মতবাদে পরিপূর্ণ বিশ্বাসী রেখে তা প্রতিষ্ঠায় তৎপরও হোক না কেনো !!!
এজন্যই, পাঠকের কাছে একথা পরিষ্কার হওয়া দরকার, কাউকে রব (প্রভু) অথবা ইলাহ (উপাস্য) হিসেবে গণ্য করা বলতে, কিংবা কারোর ইবাদত করা করা বলতে -খোদ্ আল্লাহ তাআলা কী বুঝাতে চান। এজন্য নিচের আলোচনাটি ভালো করে বোঝার চেষ্টা করুন, অন্যথায় আমার এই পেজের মূল বিষয়বস্তু বোঝা সম্ভব হবে না (লেখাটাই বৃথা যাবে)।
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-
أَلَمْ أَعْهَدْ إِلَيْكُمْ يَا بَنِي آدَمَ أَن لَّا تَعْبُدُوا الشَّيْطَانَ ۖ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِينٌ – وَأَنِ اعْبُدُونِي ۚ هَٰذَا صِرَاطٌ مُّسْتَقِيمٌ – وَلَقَدْ أَضَلَّ مِنكُمْ جِبِلًّا كَثِيرًا ۖ أَفَلَمْ تَكُونُوا تَعْقِلُونَ – هَٰذِهِ جَهَنَّمُ الَّتِي كُنتُمْ تُوعَدُونَ-اصْلَوْهَا الْيَوْمَ بِمَا كُنتُمْ تَكْفُرُونَ
“হে আদম সন্তান ! আমি কি তোমাদেরকে বলে রাখিনি যে, তোমরা শয়তানের ইবাদত করো না, সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। আর (আমি কি একথা বলে রাখিনি) যে, (শুধুমাত্র) আমারই ইবাদত করো; এটাই সিরাতে মুস্তাকিম (বক্রতামুক্ত সোজা পথ)। বস্তুতঃ সে তোমাদের মধ্যে অসংখ্য সৃষ্টিকে পথভ্রষ্ঠ করে দিয়েছে। তোমরা কি তখন বিবেকবুদ্ধি খাটিয়ে দেখোনি। এই সেই জাহান্নাম যার ওয়াদা তোমাদেরকে দেয়া হয়েছিল (এই বলে যে, এই সময়টি অবশ্যই আসবে। কিন্তু তোমরা দুনিয়াতে শয়তানের আজ্ঞাবহ হয়ে তারই ইবাদত করলে, আর এদিকে আমি যে আমার আজ্ঞাবহ হয়ে আমার ইবাদত করতে বললাম তা প্রত্যাক্ষান করলে। সুতরাং আমাকে প্রত্যাখ্যান করে আমার সাথে বেইমানী) কুফরী করার কারণে আজ এখানে দগ্ধ হও”। [সুরা ইয়াসিন ৬০]
খুব ভাল করে চিন্তা করে দেখুন, আদম আ.-এর সময় থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত কতজন মানুষের ব্যাপারে শুনেছেন যে, তারা সরাসরি শয়তানকে উদ্দেশ্য করে সিজদাহ বা পুজা-অর্চনা করেছে বা করে? কালো-জাদু (Black Magic) বিদ্যা কিংবা কালো-জগত (Black World)-এর সথে সংশ্লিষ্ট যারা শয়তান জ্বিনদের থেকে সাহায্য নেয় তাদের কেউ কেউ সরাসরি শয়তানকে উদ্দেশ্য করে সিজদাহ বা পুজা-অর্চনা করে বলে জানা যায়। কিন্তু সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত যত মত ও পথের মানুষ এসছে ও আসবে, তাদের সংখ্যার সাথে কি এই শয়তান-পুজারীদের সংখ্যার কোনো তুলনা করা শোভা পায়!!! তা সত্বেও আল্লাহ তাআলা এরশাদ করছেন যে, জাহান্নামবাসীরা আল্লাহ’র ইবাদত না করে শয়তানের ইবাদত করার কারণে কিয়ামতের দিন জাহান্নামেরে অধিবাসী হবে।
এ থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, আল্লাহ’র হুকুম ও নির্দেশিত পথে চলা তথা আল্লাহ’র দ্বীন মানা হল আল্লাহ’র গোলাম (عبد-আব্দ্) হয়ে আল্লাহ’র ইবাদত করা (যার মধ্যে নামাযে সিজদা’র মাধ্যমে নিজের তুচ্ছতা ও হেওতা প্রদর্শন হল সর্বোত্তম ইবাদত ও গোলামীর নমুনা)। অপরদিকে শয়তানের হুকুম ও নির্দেশিত পথে চলা তথা শয়তানের দ্বীন মানা হল শয়তানের গোলাম (عبد-আব্দ্) হয়ে শয়তানের ইবাদত করা -চাই শয়তানের দ্বীন সমাজের কোনো মানব-প্রতিনিধির মাধ্যমে প্রকাশ পাক না কেনো।
এখন মানুষ আল্লাহ’র মনোনীত সত্য দ্বীন মেনে তাঁর ইবাদত ও গোলামী করবে, নাকি শয়তান ও তার প্রতিনিধিদের রচিত পথভ্রষ্ঠ দ্বীন (বিশ্বাস, মতবাদ, মতাদর্শ, ধর্ম) মেনে তাদের ইবাদত ও গোলামী করবে – এদ্বন্দ্ব হযরত আদম আ.-এর জামানা থেকে চলে আসছে এবং মানুষ পথভ্রষ্ঠ হবার পর হযরত নূহ আ. থেকে নিয়ে শেষ নবী মুহাম্মাদ সা. পর্যন্ত সকল নবী ও রাসুলগণকে এ দুনিয়ায় পাঠানোর পিছনে আল্লাহ তাআলা’র একটাই মিশন ছিল, আর সেটা হল, পথভ্রষ্ঠ মানুষকে শয়তানের ইবাদত থেকে সরিয়ে এনে আল্লাহ’র ইবাদতে লাগিয়ে দেয়া, পথভ্রষ্ঠ মানুষকে শয়তানের উদ্ভাবীত পথভ্রষ্ঠ দ্বীন (বিশ্বাস, ধর্ম, মতবাদ, মতাদর্শ) থেকে বের করে এনে শুধুমাত্র আল্লাহ’র দ্বীনের উপর পরিচালিত করা।
شَرَعَ لَكُم مِّنَ الدِّينِ مَا وَصَّىٰ بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَىٰ وَعِيسَىٰ ۖ أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ
“(হে নবী মুহাম্মাদ !) তিনি (সেই আল্লাহ যিনি) তোমাদের জন্য (সেই একত্ববাদী) আল-দ্বীন (উল-কায়্যেম তথা প্রতিষ্ঠিত দ্বীন)-এর মধ্য থেকেই (একটি) শরীয়ত দিয়েছেন , যে দ্বীন সম্পর্কে (ইতিপূর্বে) নূহ’কে অসিয়ত করা হয়েছিল, আর যার ব্যাপারে আমি আপনাকে ওহীসূত্রে জানিয়েছি। আর (এই সেই দ্বীন) যার ব্যাপারে আমি নসিহত হরেছিলাম (একের পর এক) ইব্রাহীমকে, মুসাকে এবং ঈসাকে (এই বলে) যে, আল-দ্বীন’কে প্রতিষ্ঠিত করো এবং (এই একত্ববাদী দ্বীনকে পিঠের পিছনে ফেলে দিয়ে কোনো অভস্থাতেই শয়তানের কথায় একেকজন একেকটা স্বরচিত দ্বীন, বিশ্বাস ও মতোবাদ গ্রহন করে নিয়ে) এর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে রেখো না”। [সুরা শুরা ১৩]
কিন্তু বাস্তব সত্য হল, আল্লাহ তাআলা বিভিন্ন যুগে যত নবী ও রাসুল আ.-কে এ ধরায় পাঠিয়েছেন, তাঁদের উম্মতের অধিকাংশই আল্লাহ’র الدِّينُ الْقَيِّمُ (আল-দ্বীন-উল-কাইয়্যেম তথা আল্লাহকর্তৃক স্থাপিত মনোনিত দ্বীন)কে বাদ দিয়ে যুুগে যুগে শয়তানের উদ্ভবীত পথভ্রষ্ঠ দ্বীন (বিশ্বাস, মতবাদ, মতাদর্শ, ধর্ম, ism)কে গ্রহন করে নিয়ে নিজেদেরকে শয়তানের ইবাদতকারী গোলাম হিসেবে প্রমাণ দিয়েছে এবং আল্লাহর কছে পরিচয় পেয়েছে আল্লাহ’র দ্বীনে বিভেদ সৃষ্টিকারী হিসেবে। এ থেকে প্রমাণিত হল, শয়তানের উদ্ভবীত পথভ্রষ্ঠ দ্বীন (বিশ্বাস, মতবাদ, মতাদর্শ, ধর্ম, ism)-এর সকল অনুসারীরা সমাজের মূল বিভেদসৃষ্টিকারী (মুখে চাই যতই সমাজের উন্নয়ন ও সংশোধনের স্বপ্ন দেখাক না কেনো)।
আমরা যে এখানে বললাম –শয়তানের অনুসারীরা–; মূলতঃ এরা সকলেই যে সমাজের নিছক সাধারণ জনগণ -তেমনটা কিন্তু নয়। প্রত্যেক সমাজেই কিছু নেতা, গুরু, মাতব্বার, মনিব ও গণ্যমান্য শ্রেণির মানুষ থাকে, যাদেরকে মানুষজন শ্রদ্ধায় বা ভয়ে অনুসরণ করে, যারা সমাজের মাথা হিসেবে সর্বোসাধারণ মানুষের উপর খবরদাবী করে, বুদ্ধি পরামর্শ দেয় এবং সমাজ কিভাবে চলা উচিৎ তার নীতি নির্ধারণ করে, শালিশ ও বিচার ফয়সালা করে ইত্যাদি। প্রত্যেক নবী রাসুলের যুগেই শয়তান তার নতুন নতুন উদ্ভাবীত দ্বীন (বিশ্বাস, মতবাদ, মতাদর্শ, ধর্ম, ism)কে এই ধরনের নেতা, গুরু, মাতব্বার, মনিব ও গণ্যমান্য শ্রেণির বদকার মানুষগুলোর হাত ধরেই তাদের অনুসারীদের মধ্যে এবং আস্তে আস্তে সমাজের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছে। يَوْمَ تُقَلَّبُ وُجُوهُهُمْ فِي النَّارِ يَقُولُونَ يَا لَيْتَنَا أَطَعْنَا اللَّهَ وَأَطَعْنَا الرَّسُولَا – وَقَالُوا رَبَّنَا إِنَّا أَطَعْنَا سَادَتَنَا وَكُبَرَاءَنَا فَأَضَلُّونَا السَّبِيلَا – رَبَّنَا آتِهِمْ ضِعْفَيْنِ مِنَ الْعَذَابِ وَالْعَنْهُمْ لَعْنًا كَبِيرًا – “যেদিন তাদের মুখগুলিকে আগুনের মধ্যে ওলটপালক করা হবে, (তখন) তারা বলবে, হায় আমাদের দুর্ভোগ! (আমরা যদি) আল্লাহ’র কথা মানতাম এবং মানতাম রাসুলের কথাকে। তারা আরো বলবে- হে আমাদের প্রভু! আমরা আমাদের নেতৃস্থানীয় লোক এবং মুুরুব্বিদের অনুগত্য-অনুসরণ করেছিলাম; তারাই আমাদেরকে পথভ্রষ্ঠ করেছিল। হে আমাদের প্রভু! তাদেরকে দ্বীগুণ আযাব দাও এবং তাদেরকে বিরাট অভিশাপে অভিশপ্ত করো”। [সূরা আহযাব ৬৬-৫৮] وَلَيَحْمِلُنَّ أَثْقَالَهُمْ وَأَثْقَالًا مَّعَ أَثْقَالِهِمْ – “(সেই দিন) তারা নিজেদের (অপরাধের) বোঝা বহন করবে এবং তাদের বোঝার সাথে (আরো) বোঝা (যা তারা তাদের অনুসারীদেরকে আল্লাহ’র পথ থেকে ভ্রষ্ঠ করার কারণে অর্জন করেছে)”। [সূরা আনকাবুত ১৩]
এইসব নেতা ও অনুসারীরা সবাই মিলে প্রত্যেক নবী ও রাসুলগণকে তাদের স্ব-স্ব যুগে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য ভাবে আল্লাহ’র الدِّينُ الْقَيِّمُ (আল-দ্বীন-উল-কাইয়্যেম)প্রতিষ্ঠায় ও দ্বীনের পরিবেশ সৃষ্টিতে পদে পথে বাধা দিয়েছে, বিরোধীতা করেছে, লোমহর্ষক অত্যাচার করেছে, জন্মস্থান থেকে বেড় করে দিয়েছে, হত্যার চেষ্টা করেছে, কাউকে কাউকে হত্যাও করে ফেলেছে, যাতে তাদের পথের কাঁটা দূর হয়ে যায় এবং আল্লাহ’র الدِّينُ الْقَيِّمُ (আল-দ্বীন-উল-কাইয়্যেম) প্রতিষ্ঠিত হতে না পারে, বরং তাদের সমাজের ওইসকল গণ্যমান্য মাতব্বর মুরুব্বি বাপ-দাদা পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া প্রচলিত মানবরচিত পথভ্রষ্ঠ দ্বীন (বিশ্বাস, মতবাদ, মতাদর্শ) ও শরীয়ত (বিধিবিধান ও নিয়মকানুন) কায়েম থাকে, যারা শয়তানের প্ররোচনায় তা সমাজে উদ্ভাবন করেছিল। এজন্য তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে শুধু শয়তানেরই ইবাদত করেনি, বরং এর সাথে সাথে তাদের সমাজের ওইসকল গণ্যমান্য নেতা, গুরু, মনিব, মাতব্বর ও মুরুব্বিদেরও ইবাদতকরেছে। এই গোষ্ঠিটাকে ‘ত্বাগুত’ (طَّاغُوتَ) বলে অবিহিত করা হয়েছে কুরআনে, যারা তাদের মুখ, হাত, বুদ্ধি ও ক্ষমতা দিয়ে যখন যেভাবে পারে আল্লাহ’র দ্বীন প্রতিষ্ঠার সামনে পদে পদে বাঁধা সৃষ্টি করেছে ও করে।
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَّسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ
‘মূলতঃ আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যে রাসুল পাঠিয়েছি (এই মৌলিক আহবান সহকারে) যে, তোমরা আল্লাহ’র ইবাদত করো এবং ত্বাগুত’কে বর্জন করো’। [সুরা নাহল ৩৬]
এই একই অর্থে বলা হয়েছে- وَالَّذِينَ اجْتَنَبُوا الطَّاغُوتَ أَنْيَعْبُدُوهَا وَأَنَابُوا إِلَى اللَّهِ لَهُمُ الْبُشْرَى فَبَشِّرْ عِبَادِ –‘আর যারা ত্বাগুতের ইবাদত করা থেকে দূরে থাকে এবং আল্লাহ’র দিকে প্রত্যাবর্তন করে, তাদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ। [সূরা যুমার ১৭]
ইমাম কুরতুবী (মৃ: ৬৭১ হি:) রহ. লিখেছেন– واجتنبوا الطاغوت أي اتركوا كل معبود دون الله كالشيطان والكاهن والصنم ، وكل من دعا إلى الضلال – এখানে وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ – ‘এবং ত্বাগুত’কে বর্জন করো’ অর্থ আল্লাহ ছাড়া যাবতীয় মা’বুদ (উপাস্য) জিনিসকে বর্জন করো। যেমন: শয়তান, কাহীন, সনম (-এর মতো বিভিন্ন মিথ্যা দেবতা) এবং যারা পথভ্রষ্ঠতার দিকে ডাক দেয় তাদের সকেলেই (হল তাগুত)। [তাফসিরে কুরতুবী- ৫/৭৫; ফাতুহুল কাদির, শাওকানী- ৩/২০০]
এ থেকে প্রমাণিত হল-
(ক) আল্লাহ’র পথে বাাঁধা সৃষ্টিকারী শয়তান একটা ত্বাগুত।
(খ) আল্লাহ’র পথে বাাঁধা সৃষ্টিকারী পথভ্রষ্ঠ নেতা, মাতব্বার ও গণ্যমান্য শ্রেণির মানুষগুলো একেকটা ত্বাগুত।
(গ) আল্লাহ’র পথে বাাঁধা সৃষ্টিকারী পথভ্রষ্ঠ অনুগত্যকারী অনুসারীরাও ছোট খাটো ত্বাগুত এবং বড় ত্বাগুতের সাহায্যকারী হাত-পা।
আর এই তিন শ্রেণিকে -তাদের মত ও পথ সহ- সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করা, প্রত্যাখ্যান করা, বর্জন ও পরিত্যাগ করাই হল এদের ইবাদত করাকে অস্বীকার করা, প্রত্যাখ্যান করা, বর্জন ও পরিত্যাগ করা করা। আর এটাই হচ্ছে কেবলমাত্র ‘আল্লাহ আআলা’কেই ইবাদতের যোগ্য ইলাহ (উপাস্য) হিসেবে তাঁর উপর শিরকমুক্ত নির্ভেজাল ইমান আনার পূর্ব শর্ত। فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِنْ بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى – “সুতরাং, যে ব্যাক্তি ত্বাগুত (-এর সাথে) কুফরী করলো (ত্বাগুতকে অস্বীকার করলো, প্রত্যাখ্যান, বর্জন ও পরিত্যাগ করলো) এবং (ইবাদতযোগ্য উপাস্য হিসেবে একমাত্র) আল্লাহ’তে ইমান আনলো, সে মূলতঃ (ইমানের) সৃদৃঢ় কড়াকে শক্ত করে আঁকড়িয়ে ধরলো”। [সূরা বাকারাহ ২৫৬]
উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট বোঝা গেল, যারা ত্বাগুতের মত ও পথে বিশ্বাসী হয়ে ত্বাগুতের অনুগত্য অনুসরণ করে, তারা ত্বাগুতের ইবাদত করে; ত্বাগুত-ই তাদের ইলাহ (উপাস্য)। যারা সম্পূর্ণরূপে ত্বাগুতের ইবাদত করে, তারা সম্পূর্ণরূপেই আল্লাহ তাআলাকেইলাহ (উপাস্য)হিসেবে মানতে অবিশ্বাস করে অস্বীকার করে। আর যারা আংশিকভাবে ত্বাগুতের ইবাদত করে, তারা আংশিকভাবে আল্লাহ তাআলাকে ইলাহ (উপাস্য) হিসেবে মানতে অবিশ্বাস করে অস্বীকার করে; এতে কম হলে কম বেশি হলে বেশি। কারণ, মানুষের অন্তর দুটি নয় যে, একটির মধ্যে আল্লাহ’কে একমাত্রইলাহ (উপাস্য)হওয়ার বিশ্বাস রাখবে, আর আরেকটিতে ত্বাগুতকে ইলাহ (উপাস্য)হওয়ার বিশ্বাস রাখবে। مَّا جَعَلَ اللَّهُ لِرَجُلٍ مِّن قَلْبَيْنِ فِي جَوْفِهِ – “আল্লাহ কোনো মানুষের বক্ষে দুটি অন্তর সৃষ্টি করেননি”। [সূরা আহযাব ৪] একই অন্তরে একই সাথে দুইজন ইলাহ (উপাস্য)পূর্ণমাত্রায় জায়গা পায় না; এক ইলাহকে অন্তরে যতটুকু স্থান দেয়া হয়, অপর ইলাহ (উপাস্য)কে ততটুকু স্থান থেকে বহিঃষ্কার করে দেয়া ছাড়া বিকল্প কোনো পথ খোলা নেই। যারা যতটুকু পরিমান ত্বাগুতে বিশ্বাসী, তারা আল্লাহ’র সাথে ত্বাগুতকে ততটুকু পরিমান অংশীদার বানায়, শিরক করে। وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللَّهِ إِلا وَهُمْ مُشْرِكُونَ – “আর তাদের অধিকাংশই (এমন যে, তারা আল্লাহ’র সাথে অন্য কাউকে) শরীক করা ছাড়া আল্লাহ’র প্রতি ইমান আনে না”। [সূরা ইউসুফ ১০৬]
ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম (মৃ: ৭৫১ হি:) রহ. চমৎকারই বলেছেন: وهذه المقامات الثلاث هي أركان التوحيد : أن لا يتخذ سواه ربا ، ولا إلها ، ولا غيره حكما – ‘(বান্দার বিশ্বাসের) এই তিনটি স্তরই হল তাউহিদ (আল্লাহ’র একত্ববাদ)-এর (তিনটি) খুঁটি (যার কোনো একটির অনুপস্থিতি প্রমাণ করবে যে, সেই বান্দার বিশ্বাসে শিরক রয়েছে। সেই তিনটি রোকন হল): আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে- (১) রব (প্রভু) হিসেবে গ্রহন না করা, (২) ইলাহ (উপাস্য) হিসেবে গ্রহন না করা, এবং (৩) বিধানদাতা হিসেবে গ্রহন না করা’। [মাদারিজুস সালিকীন, ইবনুল কাইয়্যেম- ২/১৩৫]
এ থেকে পরিষ্কার বোঝা গেল, সকলের খালেক (স্রষ্টা)আল্লাহ তাআলা ছাড়া যে কোনো ত্বাগুত –চাই সে জ্বিন হোক বা মানুষ- ইবাদত ও গোলামী পাওয়ার উপযোগী ইলাহ (উপাস্য) নয়। ইবাদত ও গোলামী-তো করা হবে তাঁর যিনি সকল বান্দার প্রকৃত রব (মনিব/প্রভু), যিঁনি তাদেরকে হুকুম করবেন আর তারা তার হুকুমের তাবেদাবী করবে, এটাই ইবাদত এটাই গোলামী। এজন্যেই আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন– أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ تَبَارَكَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ – “খুব ভাল করে জেনে রাখো, সৃষ্টি তাঁর, হুকুমও (চলে, চলবে) তাঁর; (তিনি) আল্লাহ (যিনি) বরকতময় (যিনি) বিশ্বজাহানের রব (মনিব/প্রভু)”। [সূরা আ’রাফ ৫৪] وَلَا يُشْرِكُ فِي حُكْمِهِ أَحَدًا – “আর তিনি (আল্লাহ যিনি) তাঁর হুকুম দানের ক্ষেত্রে কাউকে অংশীদার বানান না”। [সূরা কাহফ ২৬] তাঁর নিজের সৃষ্টির উপরে একমাত্র তাঁর নিজের হুকুম ও বিধান চলার যে একচ্ছত্র দাবী তিনি করেছেন, তার পিছনে কারণ একটাই, আর তা হল, তিনিই তাঁর বান্দাদের একমাত্র রব (মনিব/প্রভু)। ঠিক যেমনিভাবে কোনো পরিবারের একজন মনিব/প্রভু তার মালিকানাধিন ভৃত্ত বা গোলামের দেখভাল করেন আবার গোলাম কী কী আদেশ নিষেধ পালন করবে তা তিনি নিজেই ঠিক করেন এবং অন্য কেউ তার গোলামের উপর খবরদারী করুক তা তিনি মোটেও পছন্দ করেন না, ঠিক তেমনিভাবে আল্লাহ তাআলা তাঁর নিজের সৃষ্টিকুলের মনিব/প্রভু (রব) হিসেবে নিজের মালিকানাধিন সকল গোলামের দেখভাল ও প্রতিপালন করেন আবার তাঁর গোলামরা তাঁর কী কী আদেশ নিষেধ পালন করবে তা তিনি নিজেই ঠিক করতে চান এবং অন্য কেউ তাঁর গোলামদের উপর খবরদারী ও অনধিকারচর্চা করুক তা যেমন তিনি বিন্দুমাত্র পছন্দ করেন না, তেমনি তাঁর গোলামরা তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে মনিব/প্রভু (রব) হিসেবে মানা-তো দূরের কথা বরং তাঁর সাথে অন্য কাউকে মনিব/প্রভু (রব) হিসেবে সামান্যতম অংশীদার বানাক -তা তিনি বিন্দুমাত্র বরদাস্ত করেন না। হাদিসে কুদসিতে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন– أنا أغنى الشركاء عن الشرك ، من عمل عملا أشرك فيه معي غيري تركته وشركه ن عمل عملا أشرك فيه معي غيري تركته وشركه – আমি অংশীবাদীদের শিরক থেকে মুক্ত। যে ব্যাক্তি কোনো আমল করে এবং তার মধ্যে আমার সাথে আমিভিন্ন অন্য কাউকে শরীক করে আমি তাকেও পরিত্যাগ করি, তার শিরককেও পরিত্যাগ করি। [মুসলিম] তিনি চান শিরকমুক্ত ইমান, শিরকমুক্ত ইবাদত ও শিরকমুক্ত গোলামী। وَقَضَىٰ رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ – “আর তোমার রব (মনিব/প্রভু) (এব্যাপারে) ফয়সালা করেছেন যে, তোমরা তাঁকে ভিন্ন অন্য আর কারোরই ইবাদত করবে না”। [সূরা আল-ইসরা ২৩]
দেখুন, আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসুল সা. রব (মনিব/প্রভু)-্এর ইবাদতকরা বলতে কী বুঝিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-
اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِّن دُونِ اللَّهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُوا إِلَّالِيَعْبُدُوا إِلَٰهًا وَاحِدًا ۖ لَّا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ۚ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ
“তারা (ইহুদী খৃষ্টানরা) আল্লাহকে ছেড়ে তাদের আহবার ও রুহবান’ (ধর্মযাজক ও পুরোহীত)দেরকে নিজেদের রব (মনিব/প্রভু) হিসেবে গ্রহন করে নিয়েছে। আর (ঈসা) মাসীহ ইবনে মারইয়ামকেও। অথচ তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, তারা একমাত্র ইলাহ্ (উপাস্য) ছাড়া আর কারো ইবাদত করবে না। তিনি (আল্লাহ যিনি) যিনি ছাড়া কোনো ইলাহ্ (উপাস্য) নেই। তারা (আল্লাহর একক রববিয়ত বা প্রভুত্বের মধ্যে যাদেরকে তাঁর) অংশীদার বানায়, তা থেকে তিনি পবিত্র”। [সুরা তাওবা ৩১]
এই আয়াতেরর ব্যাখ্যায় হাদিস ও তাফসীরের বিভিন্ন প্রসিদ্ধ গ্রন্থে বিখ্যাত সাহাবী হযরত আদী বিন হাতেম রা.-এর ইসলাম গ্রহনের ঠিক কিছু পূর্ব মুহূর্তে এই আয়াত প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ সা.-এর সাথে তার একটি গুরুত্বপূর্ণ কথোপকথন বর্ণিত হয়েছে, যা এই আয়াতের রব (মনিব/প্রভু) শব্দটির ভাবার্থকে একেবারে সূর্যের অালোর মতো পরিষ্কার করে দেয়।
আদী বিন হাতেম রা. জাহেলী যুগে একজন খৃষ্টান ছিলেন এবং ‘তাঈ’ গোত্রের নেতা ছিলেন। আদী বিন হাতেম যখন ইসলাম গ্রহনের জন্য মদিনায় রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে এলেন, তখন তার গলায় রৌপ্যের তৈরি একটি কুরুশ ঝুলানো ছিল। ওটা দেখে রাসুলুল্লাহ ﷺ তেলাওয়াত করলেন-.….اِتَّخَذُوۡۤا اَحۡبَارَهُمۡ وَرُهۡبَانَهُمۡ اَرۡبَابًا مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ ‘তারা (ইহুদী খৃষ্টানরা) আল্লাহকে ছেড়ে তাদের আহবার ও রুহবান (পুরহীত ও ধর্মযাজকদের)’দেরকে নিজেদের রব (মনিব/প্রভু) হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে.....’। তখন আদী বিন হাতেম বললেন- ‘إنهم لم يعبدوهم’ – ‘তারা-তো ওদের ইবাদত (পূজা-অর্চনা) করতো না’! তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন- بلى إنهم حرموا عليهم الحلال وأحلوا لهم الحرام فاتبعوهم فذلك عبادتهم إياهم – ‘হা, (বাহ্যতঃওরা ওদের পুরহীত ও ধর্মযাজকদের সামনে মাথা ঠেকিয়ে ইবাদত-অর্চনা করতো না ঠিকই, কিন্তু) তারা (আল্লাহ তাআলা’র নির্দেশিত) হালাল ও বৈধ বিষয়কে তাদের উপর হারাম করে দিতো এবং হারাম ও নিষিদ্ধ বিষয়কে তাদের জন্য হালাল ও বৈধ বানিয়ে দিতো। পরে ওরা (আল্লাহ’র বিধিবিধান ছেড়ে) ওদের (পুরহীত ও ধর্মযাজকদের) কথাই মানতো। আর এটাই হল (আল্লাহকে বাদ দিয়ে) ওদের (পুরহীত ও ধর্মযাজকদের) নিরঙ্কুশ ইবাদত করা’। রাসুলুল্লাহ ﷺ আরো বললেন- يا عدي ، ما تقول ؟ أيفرك أن يقال : الله أكبر ؟ فهل تعلم شيئا أكبر من الله ؟ ما يفرك ؟ أيفرك أن يقال : لا إله إلا الله ؟ فهل تعلم من إله إلا الله ؟ -‘হে আদী! কি বলো তুমি? তুমি কি الله أكبر (আল্লাহু আকবার, আল্লাহ সর্বোশ্রেষ্ঠ) বলা থেকে পালিয়ে ফিরবে? তুমি কি আল্লাহ’র চাইতেও শ্রেষ্ঠ কেউ আছে বলে জানো? কেনো পালিয়ে ফিরছো? তুমি কি لا إله إلا الله (লাা-ইলাহা-ইল্লাল্লহ, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই) বলা থেকে পালিয়ে বেড়াবে? তুমি কি আল্লাহ ছাড়াও কোনো ইলাহ’র কথা জানো? এরপর তিনি আদী বিন হাতেমকে ইসলামের দাওয়াত দেন এবং তিনি দ্বীন-ইসলাম কবুল করেন। অতঃপর রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন– إن اليهود مغضوب عليهم والنصارى ضالون – ‘নিশ্চই ইহূদীদের উপর (আল্লাহ’র) ক্রধ পতিত হয়েছে এবং খৃষ্টানরা পথভ্রষ্ঠ হয়ে গেছে”। [মুসনাদে আহমদ- ৪/৩৭৮; তাফসীরে ইবনে কাসির- ২/৩৪৮; আত-তাওহীদ, ইবনে খুযাইমাহ- ১/৩৮১; সুনানে তিরমিজী- ৫/১২৯ হাদিস ৩০৯৫; মু’জামুল-কাবীর, ত্বাবরানী- ১৭/৯২, হাদিস ২১৮; আল-জামেউল বয়ান, ইমাম তাবারী- ১০/৮০ আছার ১৬৬৩১, ১৬৬৩২, ১৬৬৩৩; ইবনু আবি হাতেম- ৬/১৭৮৪; সুনানে কুবরা, বাইহাকী- ১০/১১২, হাদিস ২০১৩৭; কিতাবুল ফাকিহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ, খতীব বাগদাদী- ১২৯ পৃঃ হাদিস ৭৫৩; আল-জামেউ বায়ানিল ইলম, ইবনে সা’দ-২/৯৭৫; আব্দ বিন হুমায়েদ, ইবনু মুনযীর, আবুশ্শায়েখ সূত্রে আদ-দুররুল মানসুর, ইমাম সুয়ূতী ৪/১৭৪]
উপরোক্ত এই আয়াতের ব্যাপারে তাঁর রাসুল মুহাম্মাদ সা.-এর ব্যাখ্যার চাইতে উত্তম ব্যাখ্যা আর হতে পারে না। উপরের প্রতিটি কথাকে আবারো ভাল করে পড়ে দেখুন। রাসুলুল্লাহ সা. হযরত আদী বিন হাতেম রা.-কে কয়েকটি বিষয়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষন করেছেন-
(ক) যারা আল্লাহ’র আইনে বিশ্বাসী আল্লাহ’র আইনের অনুগত্যকারী অনুসারী তাদের ইলাহ (উপাস্য) ও রব (মনিব/প্রভু) হল আল্লাহ তাআলা। তারা আল্লাহ তাআলা’র ইবাদত করে।
(খ) অপরদিকে যারা গাইরুল্লাহ’র (তথা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো) আইনে বিশ্বাসী গাইরুল্লাহ’র আইনের অনুগত্যকারী অনুসারী তাদের ইলাহ (উপাস্য) ও রব (মনিব/প্রভু) হল গাইরুল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ)। তারা গাইরুল্লাহ‘র ইবাদত করে (যদিও-বা তাকে মাথা ঠেকিয়ে সিজদাহ করা না হোক না কেনো)। [এই যে গাইরুল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ) যাকে জ্বিন বা মানুষজন আল্লাহ’র বিপরীতে তাদের ইলাহ (উপাস্য) বা রব (মনিব/প্রভু) হিসেবে গ্রহন করে থাকে, এটাই হল ত্বাগুত, যার কথা আমরা উপরে আলোচনা করে এসেছি]।
(গ) গাইরুল্লাহ’র আইনে বিশ্বাসী ও অনুসারীরা গোমরাহ-পথভ্রষ্ঠ।
(ঘ) গাইরুল্লাহ’র আইনে বিশ্বাসী ও অনুসারীরা لا إله إلا الله (লাা-ইলাহা-ইল্লাল্লহ, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই)–তে বিশ্বাসী নয়- চাই যতই দাবী করুক না কেনো। আইন দানের প্রশ্নে তাদের ইলাহ হল ওই আইন-রচনাকারী গাইরুল্লাহ, যার আইনে সে বিশ্বাসী ও অনুসারী।
(ঙ) গাইরুল্লাহ’র আইনে বিশ্বাসী ও অনুসারীরা الله أكبر (আল্লাহু আকবার, আল্লাহ সর্বোশ্রেষ্ঠ)-এ বিশ্বাসী নয়- চাই যতই দাবী করুক না কেনো। আইন দানের প্রশ্নে তাদের কাছে আল্লাহ’র চাইতেও শ্রেষ্ঠ হল ওই আইন-রচনাকারী গাইরুল্লাহ, যার আইনে সে বিশ্বাসী ও অনুসারী। সে বাস্তবেই الله أكبر (আল্লাহু আকবার, আল্লাহ সর্বোশ্রেষ্ঠ)–এ বিশ্বাসী হলে আল্লাহ’র আইনের চাইতে তার কাছে আর কারো আইন-ই শ্রেষ্ঠ ও খাঁটি বলে মনে হত না। وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ حُكْمًا لِّقَوْمٍ يُوقِنُونَ – “দৃঢ় বিশ্বাসীদের জন্য আল্লাহ’র চাইতে উত্তম বিধানদাতা আর কে হতে পারে”? [সুরা মায়েদা ৫০]
রইসুল মুফাসসিরীন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (মৃ: ৬৮ হি:) রা. থেকে এই আয়াতের ব্যাখ্যা এভাবে এসেছে, তিনে বলেছেন– لم يأمروهم أن يسجدوا لهم , ولكن أمروهم بمعصية الله , فأطاعوهم , فسماهم الله بذلك أربابا – ‘তাদের পুরহীত ও ধর্মযাজকরা ওদেরকে সিজদাহ করার নির্দেশ দিতোনা বটে, কিন্তু তারা আল্লাহ’র নাফরমানীমূলক নির্দেশ দিলেও ওরা তাদের কথা মানতো। বিধায় আল্লাহ তাদেরকে (ওদের) ‘রব (মনিব/প্রভু)’ বলে সম্মোধন করেছেন’। ইবনে আব্বাস রা. এও বলেছেন যে– وزينوا لهم طاعتهم – অর্থাৎ ‘পুরহীত ও ধর্মযাজকদের অনুসরণ করাটাকে ওদের কাছে চমৎকার বলে মনে হতো’। [আল-জামেউল বয়ান, ইমাম তাবারী-১০/৮১, আছার ১৬৬৪০, ১৬৬৪১] শয়তান তার কৌশল হিসেবে মানুষের চোখে তাদের নিজেদের পাপ ও অপরাধসমূহকেও কখনো কখনো এত ভাল, জাকজমক ও চমৎকৃত করে পেশ করে থাকে যে, তাদের কাছে পাপকে পাপ মনে করা তো দূরের কথা বরং পাপকেই ভালকাজ বলে মনে হতে থাকে; ইবনেআব্বাস রা. এদিকেই ইঙ্গিত করেছেন। جَدتُّهَا وَقَوْمَهَا يَسْجُدُونَ لِلشَّمْسِ مِن دُونِ اللَّهِ وَزَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ أَعْمَالَهُمْ فَصَدَّهُمْ عَنِ السَّبِيلِ فَهُمْ لَا يَهْتَدُونَ – “আমি তাকে ও তার কওমকে -আল্লাহকে বাদ দিয়ে সূর্যের সিজদাহ্ করতে দেখেছি। আর শয়তান তাদের কার্যকলাপকে তাদের কাছে চমৎকার বানিয়ে দিয়েছে। এভাবে সে (আল্লাহ’র) পথ থেকে তাদেরকে নিবৃত করে রেখেছে। ফলে তারা সঠিক পথ পাচ্ছে না”। [সুরা নামল ২৪] আমি-তো বলবো, শয়তান ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের চোখে তাদের এই মতবাদকে আল্লাহ’র দ্বীন ইসলামের চাইতে অধিক যৌক্তিক, অধিক সুন্দর, অধিক সুবিচারমুলক ও অধিক চমৎকার বানিয়ে দিয়েছে, যার দরূন তারা বিভিন্নভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশংসা করে মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করে যে, ইসলাম নয়; ধর্মনিরপেক্ষতাবাদই আসল পথ !!!
সাহাবী হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান (মৃ: ৩৬ হি:) রা.-কে এই আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি এই একই ব্যাখ্যাই দিয়েছিলেন, বলেছিলেন– أما إنّهم لم يكونوا يصومون لهم، ولا يصلّون لهم، ولكنّهم كانوا إذا أحلّوا لهم شيئًا استحلّوه، وإذا حرّموا عليهم شيئًا أحلّه اللّه لهم حرّموه، فتلك كانت ربوبيّتهم –‘হাঁ, তারা অবশ্যই (আল্লাহ’কে বাদ দিয়ে) তাদের (ধর্মযাজক ও পুরোহিতদের) উদ্দেশ্যে রোযাও রাখতো না, তাদেরকে উদ্দেশ্য করে নামাযও আদায় করতো না বটে, কিন্তু তারা যখন ওদের জন্য (আল্লাহ’র হারামকৃত) কোনো কিছুকে হালাল ও বৈধ বানিয়ে দিতো, তখন তারা সেটাকে হালাল ও বৈধ হিসেবেই গ্রহন করতো। আর যখন আল্লাহ’র হালালকৃত কোনো কিছুকে তারা হারাম ও নিষিদ্ধ বানিয়ে দিতো, তখন তারা সেটাকে হারাম ও নিষিদ্ধ বলেই গণ্য করতো। বিধায় এটাই ছিল তাদেরকে রব (মনিব/প্রভু) হিসেবে অবলম্বন করা। [আল-জামেউল বয়ান, ইমাম তাবারী-১0/৮১, আছার ১৬৬৩৬; সুনানে ইমাম সাঈদ বিন মানসুর- ৫/২৪৬; আল-মুসান্নাফ, ইমাম আব্দুর রাজ্জাক- ১/২৭২; মুসনাদে ইবনু আবি হাতেম- ৬/১৭৮৪; তাফসীরে ইমাম সাউরী, ইমাম আবু হুযাইফা- ১২৪ পৃঃ; বাইহাকী- ১০/১১২; কিতাবুল ফাকিহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ, খতীব বাগদাদী- ১৩০ পৃঃ হাদিস ৭৫৪ ; জামেঊ বায়ানিল ঈলম, ইমাম ইবনু আব্দিল বার- হাদিস ১৮২৩; আদ-দুররুল মানসুর, ইমাম সুয়ূতী ৭/৩২৪]
বিশিষ্ট মুফাসসির ইমাম আবুল আলীয়্যাহ রহ.-কে এব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন– قالوا: ما أمرونا به ائتمرنا، وما نهونا عنا انتهينا لقولهم: وهم يجدون في كتاب الله ما أمروا به وما نهوا عنه، فاستنصحوا الرجال، ونبذوا كتاب الله وراء ظهورهم – “তারা (ধর্মযাজক ও পুরোহিতরা) বলতো, ‘আমরা তোমাদেরকে যা নির্দেশ দেই সেটা মেনে চলো, আর যা করতে নিষেধ করি সেটা নিসিদ্ধ হিসেবেই মেনে নাও’। অথচ এই ধর্মযাজক ও পুরোহিতরা ওদেরকে যেসব নির্দেশ দিতো এবং যা থেকে নিষেধ করতো, সে সম্পর্কিত (বিধিবিধান তারা ঠিকই) আল্লাহ’র কিতাবে বিদ্যমান পেত। আর লোকজনও আল্লাহ’র কিতাবকে পিঠের পিছনে ফেলে রেখে তাদের কাছে উপদেশ চেয়ে বেড়াতো”। [আল-জামেউল বয়ান, ইমাম তাবারী-১০/৮১ আছার ১৬৬৪২]
ইমাম আবু বুখতারী রহ. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন– انطلقوا إلى حلال اللّه فجعلوه حرامًا، وانطلقوا إلى حرام اللّه فجعلوه حلالاً، فأطاعوهم في ذلك، فجعل اللّه طاعتهم عبادتهم، ولو قالوا لهم اعبدونا لم يفعلوا – “তারা (ধর্মযাজক ও পুরোহিতরা) আল্লাহ’র হালালকৃত (অনেক কিছুকে) হারাম বানাতো, আবার আল্লাহ’র হারামকৃত (অনেক কিছুকে) হালাল ও বৈধ বানিয়ে নিতো। পরে লোকজন ওতেই তাদেরকে অনুগত্য অনুসরণ করতো। বিধায় আল্লাহ তাআলা এরকম ধর্মযাজক ও পুরোহিতদের অনুসরণ করার কাজটিকে তাদের ইবাদত ও উপাসনা করা বলে গণ্য করেছেন- যদিওবা তাদেরকে বলা হয় তোমরা ‘তোমাদের ধর্মযাজক ও পুরোহিতদের (সিজদা’র মাধ্যমে) ইবাদত করো’, তারা তা করবে না”। [আল-জামেউল বয়ান, ইমাম তাবারী-১০/৮১ আছার ১৬৬৩৭; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা-৭/১৫৬]
ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (মৃ: ৭২৮ হি:) রহ . এই আয়াতের তাফসিরে লিখেছেন– وهؤلاء الذين اتخذوا أحبارهم ورهبانهم أرباباً حيث أطاعوهم في تحليل ما حرم الله وتحريم ما أحل الله يكونون على وجهين أحدهما : أن يعلموا أنهم بدّلوا دين الله فيتبعونهم على التبديل ؛ فيعتقدون تحليل ما حرم الله وتحريم ما أحل الله اتباعاً لرؤسائهم مع علمهم أنهم خالفوا دين الرسل ؛ فهذا كفرٌ … والثاني : أن يكون اعتقادهم وإيمانهم بتحريم الحلال وتحليل الحرام ثابتاً ؛ لكنهم أطاعوهم في معصية الله كما يفعله أهل المعاصي التي يُعْتَقدُ أنها معاصٍ ؛ – “এরা হল এমনসব লোক, যারা তাদের ধর্মযাজক ও পুরোহিতদেরকে নিজেদের রব (মনিব/প্রভু) হিসেবে গ্রহন করে নিয়েছিল, আর তা এভাবে যে, এই ধর্মযাজক ও পুরোহিতরা আল্লাহ’র (অনেক) হারামকৃত বিষয়কে হালাল এবং (অনেক) হালালকৃত বিষয়কে হারাম ও অবৈধ বানিয়ে নেয়া সত্ত্বেও ওরা তাদের অনুসরন করতো। তারা তাদের ধর্মযাজক ও পুরোহিতদেরকে রব (মনিব/প্রভু) বানিয়ে নিয়েছিল কয়েকভাবে- (১) তারা জানতো যে, তাদের ধর্মযাজক ও পুরোহিতরা আল্লাহ’র দ্বীনকে পরিবর্তন করে ফেলেছে, এতদস্বত্বেও তারা তাদেরকে অনুসরন করে ওই পরিবর্তিত দ্বীনটাকেই মেনে চলতো। তাদের ধর্মযাজক ও পুরোহিতরা রাসুলদের আনিত দ্বীন’কে পরিবর্তন করে ফেলেছে -একথা জানা স্বত্ত্বেও যেহেতু তারা -তাদের এই গুরুরা আল্লাহ’র হারামকৃত বিধানকে হালাল করলেও -তা মানতো এবং আল্লাহ’র হালালকৃত বিধানকে হারাম করলেও তা মেনে নিতো, তাই তাদের এ আচরন ছিল ‘কুফর (আল্লাহ’র বিধানকে অস্বীকার করা, প্রত্যাখ্যান করা)’……। (২) তাদের আকীদা ও বিশ্বাস ছিল, (আল্লাহ’র অনুমতি ছাড়াই) তাদের ধর্মযাজক ও পুরোহিতরা (আল্লাহ’র কৃত) হালালকে হারাম এবং হারামকে হালাল করতে পারে। পাপপ্রিয় ও পাপ-পরিবেষ্টিত মানুষরা যেভাবে পাপের পিছনে ছোটে পাপের অনুসরন করে, এরাও তেমনিভাবে আল্লাহ’র নাফরমানী ও গোস্তাখির প্রশ্নে তাদের ধর্মযাজক ও পুরোহিতদের অনুগত্য-অনুসরন করেছে”।…..[মাজমু-উল-ফাতাওয়া, ইমাম ইবনে তাইমিয়্যা- ৭/৭০]
যে কোনো নির্ভরযোগ্য তাফসীরের গ্রন্থ খুলে দেখুন, তাতে যতজন সাহাবী, তারেয়ীন, তাবে’ তাবেয়ীন, আইম্মায়ে মুহাদ্দেসীন ও আইম্মায়ে মুজতাহিদীনের মতামত বর্ণিত হয়েছে, তাঁদের সকলের ব্যাখ্যার সারমর্ম এক-ই।
আল্লাহ তাআলা ‘আহলে-কিতাব’দেরকে এই শিরক পরিত্যাগ করার আহবান জানিয়ে এরশাদ করেন-
قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ تَعَالَوْا إِلَى كَلِمَةٍ سَوَاءٍ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَلَّا نَعْبُدَ إِلَّا اللَّهَ وَلَا نُشْرِكَ بِهِ شَيْئًا وَلَا يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَقُولُوا اشْهَدُوا بِأَنَّا مُسْلِمُونَ
‘(হে নবী মুহাম্মাদ !) আপনি বলুন, হে আহলে কিতাব! তোমরা এমন এক কালেমার দিকে এসো, যা আমাদের ও তোমাদের মাঝে সমান। (তোমরা বলো) ‘আমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারো ইবাদত করি না এবং আমরা তাঁর সাথে কোনো কিছুকে শরীক করি না এবং আমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে আমাদেরর মধ্য থেকে একে-অন্যকে রব (মনিব/প্রভু) হিসেবে গ্রহন করি না। (হে নবী মুহাম্মাদ !) তারা যদি (এই তাওহিদী আহবান থেকে) মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে তাদেরকে বলে দিন, তোমরা আমাদের ব্যাপারে সাক্ষ্যি থাকো যে, আমরা মুসলীম (আল্লাহ’র এ আহবানে সারাদানকারী আত্বসমর্পণকারী বান্দা)’। [সুরা আল-ইমরান ৬৪]
এই আয়াত থেকে প্রমাণিত হয়-
(ক) যারা আল্লাহ তাআলাকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো ব্যাক্তিকে মানুষের উপর বিধান দানের হক্বদার (Authority) হিসেবে বিশ্বাস করে, ওই বিধান-রচয়িতাই হল তাদের রব (মনিব/প্রভু)। আল্লাহ তাআলা’র বিধিবিধান ত্যাগ করে তাদের রচিত বিধিবিধান-এর অনুগত্য-অনুসরণ করা হল ওই বিধানরচয়ীতার ইবাদত করা, যা শিরক।
(খ) মুসলীম হওয়ার একটি অন্যতম পূর্বশর্ত হল- একমাত্র আল্লাহ তাআলাকে তাঁর সৃষ্ট বান্দাদের উপর হুকুম/বিধান দানের একচ্ছত্র হক্বদার (Authority) হিসেবে বিশ্বাস করা এবং এব্যাপারে তাঁর সাথে অন্য কাউকে শিরক না করা।
মানুষ মানুষকে হুকুমদাতা বিধানদাতা রব (মনিব/প্রভু) বানানোর এইযে বিষধর বিশ্বাস, সেটা শুধু আহলে কিতাবদের মধ্যেই নয়, তৎকালনি মক্কার মুশরেক-কাফেরদের সমাজকেও অক্টোপাশের মতো প্যাঁচিয়ে ধরে রেখেছিল। তারা তাদের সমাজের গণ্যমান্য নেতা, গুরু, মুরুব্বি ও মাতব্বর শ্রেণির লোকেরা হালাল-হারাম, বৈধ-অবৈধতার নিয়ম-নীতি ও বিধিবিধান (শরীয়ত বা সংবিধান) তৈরী করে নিতো। হুকুম ও বিধা দানের আল্লাহ’র একক অধিকারের মধ্যে মক্কার কাফের মোশরেকদের এই ন্যাক্কারজনক হস্তক্ষেপের দিকে ইংগীত করে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
قُل أَرَأَيتُم مَا أَنزَلَ اللهُ لَكُم مِن رِزقٍ فَجَعَلتُم مِنهُ حَرَاماً وَحَلالاً قُل آلله أَذنَ لَكُم أَم عَلَى اللهِ تَفتَرُونَ
‘(হে নবী আপনি তাদেরকে) বলুন, তোমরা কি চিন্তা করে দেখেছো, যে রিজেককে আল্লাহ তোমাদের জন্য নাজিল করেছেন, তোমরা (সেই আল্লাহ’র অনুমতি ছাড়াই নিজেদের ইচ্ছে মতো) কোনোটিকে হালাল আর কোনোটিকে হারাম বানিয়ে নিয়েছো। (তাদেরকে) জিজ্ঞেস করুন, আল্লাহ কি তোমাদেরকে এর অনুমতি দিয়েছেন, নাকি তোমরা আল্লাহ’র উপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করছো? [সূরা ইউনুস ৫৯]
হযরত কাতাদাহ রহ. এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন– كل رزق لم أحرِّم حرَّمتموه على أنفسكم من نسائكم وأموالكم وأولادكم ، آلله أذن لكم فيما حرمتم من ذلك ، أم على الله تفترون؟ ‘(এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা বুঝাতে চাচ্ছেন) তোমাদের নারী, ধনসম্পদ, সন্তানসন্ততি ইত্যাদি সবধরনের রিযেক যেগুলোকে আমি হারাম করিনি, সেগুলোকে তোমরা নিজেদের উপর (ইচ্ছে মতো) হারাম করে নিয়েছো। এসব হারাম করার অনুমতি কি আল্লাহ তোমাদের দিয়েছেন, নাকি (এ আচরণের দ্বারা তোমরা) আল্লাহ’র উপর মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছো”? [জামেউল বায়ান, ইমাম তাবারী, আছার ১৭৬৯৩]
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (মৃ: ৬৮ হি:) রা.-এর সূত্রে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় এসেছে, তিনি বলেছেন– إن أهل الجاهلية كانوا يحرمون أشياء أحلها الله من الثياب وغيرها، وهو قول الله: (قُل أَرَأَيتُم مَا أَنزَلَ اللهُ لَكُم مِن رِزقٍ فَجَعَلتُم مِنهُ حَرَاماً وَحَلالاً) وهو هذا. فأنـزل الله تعالى: قُلْ مَنْ حَرَّمَ زِينَةَ اللَّهِ الَّتِي أَخْرَجَ لِعِبَادِهِ الآية –‘জাহেলীযুগের লোকেরা –আল্লাহ তাআলা হালাল করেছেন এমন বহু জিনিসকে হারাম ও নিষিদ্ধ করে নিয়েছিল; যেমনকাপড়-চোপড় ইত্যাদি। এসম্পর্কেই আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন- قُل أَرَأَيتُم مَا أَنزَلَ اللهُ لَكُم مِن رِزقٍ فَجَعَلتُم مِنهُ حَرَاماً وَحَلالاً (হে নবী আপনি তাদেরকে) বলুন, তোমরা কি চিন্তা করে দেখেছো, যে রিজেককে আল্লাহ তোমাদের জন্য নাজিল করেছেন, তোমরা (সেই আল্লাহ’র অনুমতি ছাড়াই নিজেদের ইচ্ছে মতো) কোনোটিকে হালাল আর কোনোটিকে হারাম বানিয়ে নিয়েছো। এরপর আল্লাহ তাআলা নাজিল করেন– قُلْ مَنْ حَرَّمَ زِينَةَ اللَّهِ الَّتِي أَخْرَجَ لِعِبَادِهِ الآية (হে নবী আপনি তাদেরকে) বলুন, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য যে সকল যিনাত (হালাল হিসেবে) দান করেছেন, কে তা হারাম করলো?’। [জামেউল বায়ান, ইমাম তাবারী, আছার ১৭৬৮৯]
হযরত ইবনে যায়েদ রহ.-এর সূত্রে এসেছে- قال ابن زيد في قوله: (قُل أَرَأَيتُم مَا أَنزَلَ اللهُ لَكُم مِن رِزقٍ فَجَعَلتُم مِنهُ حَرَاماً وَحَلالاً)، فقرأ حتى بلغ: (أم على الله تفترون)، وقرأ : وَقَالُوا مَا فِي بُطُونِ هَذِهِ الأَنْعَامِ خَالِصَةٌ لِذُكُورِنَا وَمُحَرَّمٌ عَلَى أَزْوَاجِنَا [سورة الأنعام: ١٣٩]، وقرأ: وَقَالُوا هَذِهِ أَنْعَامٌ وَحَرْثٌ حِجْرٌ حتى بلغ: لا يَذْكُرُونَ اسْمَ اللَّهِ عَلَيْهَا [سورة الأنعام: ١٣٨] فقال: هذا قوله: جعل لهم رزقًا، فجعلوا منه حرامًا وحلالا وحرموا بعضه وأحلوا بعضه. وقرأ: ثَمَانِيَةَ أَزْوَاجٍ مِنَ الضَّأْنِ اثْنَيْنِ وَمِنَ الْمَعْزِ اثْنَيْنِ قُلْ آلذَّكَرَيْنِ حَرَّمَ أَمِ الأُنْثَيَيْنِ أَمَّا اشْتَمَلَتْ عَلَيْهِ أَرْحَامُ الأُنْثَيَيْنِ [سورة الأنعام: ١٤٣]، أيّ هذين حرم على هؤلاء الذين يقولون وأحل لهؤلاء، نَبِّئُونِي بِعِلْمٍ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ – أَمْ كُنْتُمْ شُهَدَاءَ إِذْ وَصَّاكُمُ اللَّهُ بِهَذَا ، إلى آخر الآيات – ইবনে যায়েদ তিলাওয়াত করলেন قُل أَرَأَيتُم مَا أَنزَلَ اللهُ لَكُم مِن رِزقٍ فَجَعَلتُم مِنهُ حَرَاماً وَحَلالاً قُل آلله أَذنَ لَكُم أَم عَلَى اللهِ تَفتَرُونَ ‘(হে নবী আপনি তাদেরকে) বলুন, তোমরা কি চিন্তা করে দেখেছো, যে রিজেককে আল্লাহ তোমাদের জন্য নাজিল করেছেন, তোমরা (সেই আল্লাহ’র অনুমতি ছাড়াই নিজেদের ইচ্ছে মতো) কোনোটিকে হালাল আর কোনোটিকে হারাম বানিয়ে নিয়েছো। (তাদেরকে) জিজ্ঞেস করুন, আল্লাহ কি তোমাদেরকে এর অনুমতি দিয়েছেন, নাকি তোমরা আল্লাহ’র উপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করছো? তিনি আরো তিলাওয়াত করলেন- وَقَالُواْ مَا فِي بُطُونِ هَـذِهِ الأَنْعَامِ خَالِصَةٌ لِّذُكُورِنَا وَمُحَرَّمٌ عَلَى أَزْوَاجِنَا আরতারা বলে, এসকল গবাদী পশুর পেটের মধ্যে যা আছে, তা বিশেষভাবে আমাদের পুরুষদের জন্য (হালাল ও বৈধ), আর আমাদের নারীদের জন্য হারাম। (সূরা আনআম ১৩৯) তিনি এও তিলাওয়াত করলেন- وَقَالُوا هَٰذِهِ أَنْعَامٌ وَحَرْثٌ حِجْرٌ لَّا يَطْعَمُهَا إِلَّا مَن نَّشَاءُ بِزَعْمِهِمْ وَأَنْعَامٌ حُرِّمَتْ ظُهُورُهَا وَأَنْعَامٌ لَّا يَذْكُرُونَ اسْمَ اللَّهِ عَلَيْهَا – তারা বলে, এই এই গবাদিপশুগুলি আর এই এই ক্ষেতফসলাদি সংরক্ষিত (নিষিদ্ধ)। আমরা যাকে চাইবো সে ছাড়া আর কেউ তা ভক্ষন করতে পারবে না। (বস্তুতঃ এরা আমার দেয়া রিজিকের উপর যে স্বরচিত বিধান আরোপ করছে, সেটা করছে নিছক তাদের বানানো) চিন্তার আলোকে। (এমনিভাবে কল্পিত আইনের আলোকে) কিছু গবাদিপশু’র পৃষ্ঠদেশকে হারাম করে নেয়া হয়েছে (আরোহন ও বোঝা বহনের প্রশ্নে) এবং (কিছু) গবাদিপশু আছে যেগুলোর উপর তারা আল্লাহ’র নাম উচ্চারণ করে না…। (সূরা আনআম ১৩৮)তারপর বললেন: আল্লাহ তাআলা বলতে চাচ্ছেন, তোমাদের জন্য রিজিক দান করলেন আল্লাহ। আর (তাঁর কোনো অনুমতি ছাড়াই) তোমরা ওগুলোর মধ্য থেকে (ইচ্ছে মতো একেকটাকে) হালাল ও হারাম হিসেবে চিহ্নিত করে নিলে, আবার ওর কিছুকে হারাম আর কিছুকে হালাল বানিয়েও দিলে !!! তারপর তিলাওয়াত করলেন-ثَمَانِيَةَ أَزْوَاجٍ ۖ مِّنَ الضَّأْنِ اثْنَيْنِ وَمِنَ الْمَعْزِ اثْنَيْنِ ۗ قُلْ آلذَّكَرَيْنِ حَرَّمَ أَمِ الْأُنثَيَيْنِ أَمَّا اشْتَمَلَتْ عَلَيْهِ أَرْحَامُ الْأُنثَيَيْنِ – (গবাদিপশু) আট প্রকারের। (তার মধ্যে) মেষ রয়েছে (নর ও মাদী -এই) দুই প্রকারের, আর ছাগল রয়েছে (নর ও মাদী -এই) দুই প্রকারের। (হে নবী, আপনি ওদেরকে) জিজ্ঞেস করুন, (আল্লাহ কি এই) দুই শ্রেণির নর’পশুকে হারাম হরেছেন, নাকি (এই) দুই শ্রেণির মাদী’পশুকে? নাকি (ওই) মাদী পশু দু’টির গর্ভে যা ধারণ করে আছে তা? (সূরা আনআম ১৪৩)অর্থাৎ, যারা এসব কথা বলছে, আল্লাহ কি তাদের উপর এই দুই শ্রেণির পশুর একটিকেও হারাম করেছেন?!!! আসলে তিনি-তো তাদের জন্য এসব হালাল করে দিয়েছেন। نَبِّئُونِي بِعِلْمٍ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ যদি তোমরা সত্যবাদি হয়ে থাকো তাহলে (ওহী লব্ধ সহীহ) জ্ঞানের আলোকে তা আমাকে জানাও।(সূরা আনআম ১৪৩) أَمْ كُنتُمْ شُهَدَاءَ إِذْ وَصَّاكُمُ اللَّهُ بِهَٰذَا ۚ فَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَىٰ عَلَى اللَّهِ كَذِبًا لِّيُضِلَّ النَّاسَ بِغَيْرِ عِلْمٍ ۗ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ (বলি…এই সব মিথ্যা বিধান যে মানুষের জন্য চালু করছো, তা কি আল্লাহ’র পক্ষ থেকে পেয়েছো? তোমাদের ধারনা মতে) আল্লাহ যখন তোমাদেরকে এসবের নির্দেশ দিয়েছিলেন, তখন তোমরা কি উপস্থিত ছিলে? (সত্য হল, আল্লাহর পক্ষ থেকে এসব হারাম হওয়ার ব্যাপারে কোনো নির্দেশ তোমরা পাওনি। সব তোমাদের নিজেদের বানানো আইন)। তাহলে সেই ব্যাক্তির চাইতে বড় জালেম আর কে হতে পারে, যে (আল্লাহ’র পক্ষ থেকে কোনো ওহী’র) জ্ঞান (লাভ করা) ছাড়াই (বৈধতা-অবৈধতা সম্পর্কিত আইন রচনা করে প্রকারন্তে) আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করে, যাতে লোকজন পথভ্রষ্ঠ হয়ে যায়? নিশ্চই আল্লাহ এরকম জালেম লোকদেরকে হেদায়েত দান করেন না। (সূরা আনআম ১৪৪)। [জামেউল বায়ান, ইমাম তাবারী, আছার ১৭৬৯৪]
ইমাম ইবনে জারীর তাবারী (মৃ: ৩১০ হি:) রহ. বলেছেন– يقول الله لنبيه محمد صلى الله عليه وسلم: قل يا محمد (آلله أَذنَ لَكُم) بأن تحرِّموا ما حرَّمتم منه (أَم عَلَى اللهِ تَفتَرُونَ) ، : أي تقولون الباطل وتكذبون – “আল্লাহ তাআলা তাঁর নবী মুহাম্মাদ সা. কে উদ্দেশ্য করে বলছেন, হে মুহাম্মাদ ! আপনি (তাদেরকে) বলুন, তোমরা যেসব জিনিস হারাম করছো آلله أَذنَ لَكُم -(আল্লাহ কি তোমাদেরকে অনুমতি দিয়েছেন) তা হারাম করার ?, أَم عَلَى اللهِ تَفتَرُونَ -(নাকি তোমরা আল্লাহ’র উপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করছো’) অর্থাৎ তোমরা (এসব) বাতিল ও মিথ্যা কথা বলছো”। [জামেউল বায়ান, ইমাম তাবারী- ১৫/১১১]
আল্লাহ তাআলা আরো এরশাদ করেন-
وَلَا تَقُولُوا لِمَا تَصِفُ أَلْسِنَتُكُمُ الْكَذِبَ هَذَا حَلَالٌ وَهَذَا حَرَامٌ لِتَفْتَرُوا عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ إِنَّ الَّذِينَ يَفْتَرُونَ عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ لَا يُفْلِحُونَ
“আর তোমাদের মিথ্যা রচনাকারী জবানগুলো দিয়ে (আমার হুকুম ছাড়া) কোনো কিছুকে বলো না যে- এটা হালাল আর এটা হারাম। এ জন্য যে, (এতে প্রমাণিত হবে) তোমরা আল্লাহ’র উপর মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছো। নিশ্চই যারা আল্লাহ’র উপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে তারা সফলকাম হবে না”। [সুরা নাহল ১১৭]
قُل لَّا أَجِدُ فِي مَا أُوحِيَ إِلَيَّ مُحَرَّمًا عَلَىٰ طَاعِمٍ يَطْعَمُهُ إِلَّا أَن يَكُونَ مَيْتَةً أَوْ دَمًا مَّسْفُوحًا أَوْ لَحْمَ خِنزِيرٍ فَإِنَّهُ رِجْسٌ أَوْ فِسْقًا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللَّهِ بِهِ
“(হে নবী মুহাম্মাদ! আপনি তাদেরকে) বলুন, (তোমরা আল্লাহর অনুমতি ছাড়াই অনেক কিছুকে নিজেদের জন্য হারাম ও অবৈধ বানিয়ে নিয়েছো। অথচ) আমার প্রতি (আল্লাহ’র তরফ থেকে এযাবৎ) যা ওহী হিসেবে এসেছে, তার মধ্যে আমি (তোমাদের ওসব হারামকৃত জিনিসের একটা) কোনো কিছুও পাইনা যা (আল্লাহ তাআলার তরফ থেকে তার বান্দাদের) কারো জন্য খাওয়া হারাম করা হয়েছে; ব্যাতিক্রম শুধু মৃত প্রাণী কিংবা প্রবাহিত রক্ত অথবা শুওরের গোশত যেহেতু এসব অপবিত্র ও পঙ্কিল কিংবা যা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য উৎসর্গ করা হয়েছে”। [সুরা আনআম ১৪৫]
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (মৃ: ৬৮ হি:) রা. বলেন- كان أهل الجاهلية يأكلون أشياء ويتركون أشياء تقذرا ، فبعث الله تعالى نبيه – صلى الله عليه وآله وسلم – وأنزل كتابه وأحل حلاله وحرم حرامه فما أحل فهو حلال وما حرم فهو حرام وما سكت عنه فهو عفو ، وتلا هذه الآية : (قُل لَّا أَجِدُ فِي مَا أُوحِيَ إِلَيَّ مُحَرَّمًا عَلَىٰ طَاعِمٍ) الآية –জাহেলী যুগের লোকরা বহু জিনিস খাওয়া বা না খাওয়াকে (মনগড়াভাবে নিজেদের উপর) আবশ্যক করে নিয়েছিল। এরপর আল্লাহ তাআলা তাঁর নবী সা. কে পাঠালেন এবং আল-কিতাব (কুরআন) নাজিল করলেন এবং (তিনি যা) হালাল করার হালাল করলেন এবং (যা) হারাম করার হারাম করে দিলেন। সুতরাং আল্লাহ যা হালাল করেছেন তা-ই হালাল এবং তিনি যা হারাম করেছেন তা-ই হারাম, আর যে যে বিষয়ে তিনি নিশ্চুপ থেকেছেন তা মাফ। এরপর এই আয়াতটি শেষ পর্যন্ত তেলাওয়াত করলে- قُل لَّا أَجِدُ فِي مَا أُوحِيَ إِلَيَّ مُحَرَّمًا عَلَىٰ طَاعِمٍ (হে নবী মুহাম্মাদ! আপনি তাদেরকে) বলুন, আমার প্রতি (আল্লাহ’র তরফ থেকে) যা ওহী হিসেবে এসেছে, তার মধ্যে আমি এমন কোনো কিছু পাইনা যা কারো জন্য খাওয়া হারাম হতে পারে….. [মুসতাদরাকে হাকিম, হাদিস ৭১৯৪]
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর উপরোক্ত ব্যাখ্যার সমর্থন বহু হাদিসে রয়েছে। যেমন, এক হাদিসে হযরত আবু দারদা রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ সা. এরশাদ করেন– مَا أَحَلَّ اللهُ فِي كِتَابِهِ فَهُوَ حَلَالٌُ ، وَمَا حَرَّمَ فَهوَ حَرَامٌ ‘আল্লাহ তাঁর কিতাবে যা কিছু হালাল ও বৈধ করেছেন সেটাই হালাল ও বৈধ, আর যা কিছু হারাম ও অবৈধ করেছেন, সেটাই হারাম ও অবৈধ’। [মাসনাদে বাযযার- ; মুসনাদুস শামেইন, ত্বাবরানী- ৩/২০৯; সুনানে দ্বারেকুত্বনী-২/১৩৭; সুনানুল কুবরা, ইমাম বাইহাকী- ৯/৩২০; মুসতাদরাকে হাকীম- ২/৪০৬, ১০/১২; তাহযিবুত তাহযিব, ইবনে হাজার-৩/২২৯] আরেক হাদিসে হযরত সালমান ফারসী রা.-এর সূত্রে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সা. এরশাদ করেন– الحَلالُ مَا أَحَلَّ اللهُ فِي كِتَابِهِ ، وَالحَرَامُ مَا حَرَّمَ اللهُ فِي كِتَابِه -হালাল হল তা-ই যা আল্লাহ তাঁর কিতাবে হালাল করেছেন এবং হারাম হল তা-ই যা আল্লাহ তাঁর কিতাবে হারাম করেছেন। [মু’জামে কাবীর, ইমাম ত্বাবরাণী- ৬/২৫০; সুনানুল কুবরা, বাইহাকী-৯/৩২০; মুসতাদরাকে হাকীম- ৪/১২৯, সুনানে তিরমিজী, হাদিস ১৭২৬; সুনানে ইবনে মাজা, হাদিস ৩৩৬৭; ইলালুল হাদিস, ইবনে হাতেম- ২/১০; মাযমাউয যাওয়ায়েদ, হাইছামী-১/১৭১; তাহযিবুত তাহযিব, ইবনে হাজার-৩/২২৯]
উপরোক্ত সুরা আনআমের ১৪৫ নং আয়াত যখন নাজিল হয়, তার আগে মক্কার কাফের মোশরেকরা নিজেরাই নিজেদের জন্য যে সব জিনিস হালাল বা হারাম করে নিয়ে তা সমাজে বিধান হিসেবে চালাচ্ছিল, সেটা যে –বান্দাদের উপর বিধান দানের যে একক অধিকার আল্লাহ তাআলা একার রয়েছে এবং তাতে তারা হস্তক্ষেপ করে বসে আছে -সেটাই এখানে বুঝানো হচ্ছে এবং রাসুলুল্লাহ সা.-কে বলতে বলা হচ্ছে যে, তোমরা মনগড়া যা-ই হালাল বা হারাম করো না কোনো তার কোনো কিছুই নিছক তোমাদের কথা অনুযায়ী আল্লাহ’র বান্দাদের উপর বৈধ-অবৈধ হিসেবে আরোপিত হবে না, বরং ওহী সূত্রে (সুরা আনআমের ১৪৫ নং আয়াতে) যা কিছু হালাল বা হারাম করা হল, সেটাই আল্লাহ’র বান্দাদের উপর হালাল বা হারাম হিসেবে আরোপিত হবে। এটা ছিল তখনকার কাফের মুশরেকদের নিজ থেকে হালাল হারাম বিধান বানানোর উপর করা সমালোচনা। সুরা আনআমের উপরোক্ত ১৪৫ নং আয়াতের পরও কুরআনের আরো বহু আয়াত নাজিল হয় যেখানে হালাল হারাম সম্পর্কিত বহু বিধান রয়েছে, যা উপরোক্ত আয়াতে উল্লেখ নেই; বলা বাহুল্য যে সেগুলোও আল্লাহর-ই বিধান, তাই তাও যথাস্থানে ধর্তব্য। আমি সুরা আনআমের ১৪৫ নং আয়াতটি শুধুমাত্র আমাদের আলোচ্য বিষয়বস্তুর গুরুত্ব বোঝানোর জন্য উল্লেখ করলাম।
এখানে আরেককটি বিষয় না বললেই নয়। আর সেটা হল, রাসুলুল্লাহ রা. এবং হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. যে বলেছেন যে, আল-কিতাব কুরআনে যা হালাল বা হারাম করা হয়েছে তা-ই হালাল বা হারাম, এর অর্থ এই নয় যে, সাধারণ কোনো ব্যাক্তি তার মূর্খতাপূর্ণ বাহ্যদৃষ্টিতে কুরআনের কোথাও কোনো কিছু হারাম হওয়ার সুস্পষ্ট বিধান দেখতে না পেলে সে উপরোক্ত হাদিস দেখিয়ে তা হালাল হিসেবে গ্রহন করে নিবে। কারণ, বিশ্বনবী সা. হলেন কুরআনেরই ব্যাখ্যা। এজন্যই সুরা আনআমের ১৪৫ নং আয়াতের নাজিলকারক একই প্রভু আল্লাহ তাআলা বলেছেন– وَأَطِيعُواْ اللّهَ وَأَطِيعُواْ الرَّسُولَ وَاحْذَرُواْ فَإِن تَوَلَّيْتُمْ فَاعْلَمُواْ أَنَّمَا عَلَى رَسُولِنَا الْبَلاَغُ الْمُبِينُ – “তোমরা আল্লাহকে মেনে চলো এবং মেনে চলো রাসুল (মুহাম্মাদ সা.) কে এবং (তিনি যা নিষেধ করেন, তা থেকে) বেঁচে থাকো। সুতরাং (এর পরেও) যদি তোমরা (তাঁর কোনো আদেশ নিষেধ থেকে) মুখ ফিরিয়ে নাও, তাহলে জেনে রাখো, আমার রাসুলের উপর শুধু দায়িত্ব হল (ওহী প্রাপ্ত যে কোনো আদেশকে) সুস্পষ্টরূপে পৌছে দেয়া, (আর অমান্যকারীদের হিসাব কিতাব পরে চুকানো হবে)”। [সুরা মায়েদাহ ৯০] আল্লাহ তাআলা আরো বলেছেন- مَنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللَّهَ ۖ وَمَنْ تَوَلَّىٰ فَمَا أَرْسَلْنَاكَ عَلَيْهِمْ حَفِيظًا -“যে ব্যাক্তি রাসুলকে মানলো সে (মূলতঃ রাসুলের কাছে আগত আল্লাহ’র ওহী মানার কারণে প্রকারন্তে) আল্লাহ’রই অনুগত্য করলো। আর (হে নবী মুহাম্মাদ!) যে (তোমার) থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, (সে নিক, তার ফয়সালা পরে হবে। তোমার দায়িত্ব শুধু ওহী প্রাপ্ত আদেশ পৌছে দেয়া।) তোমাকে আমরা তাদের উপর পাহারাদার হিসেবে পাঠাইনি”। [সুরা নিসা ৮০]
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (মৃ: ৬৮ হি:) রা.-এর সূত্রেই এক হাদিসে এসেছে, সাওদা বিনতে আযমা রা.-এর একটি বকরী মাড়া গেলে তিনি রাসুলুল্লাহ সা.-কে তা জানালেন। তখন রাসুলুল্লাহ সা. বললেন–فلم لا أخذتم مسكها ؟ –তোমরা ওটার চামড়া দিয়ে মশক বানিয়ে নিলেনা কেনো?…..إنما قال الله ” قل لا أجد في ما أوحي إلي محرما على طاعم يطعمه إلا أن يكون ميتة أو دما مسفوحا أو لحم خنزير ” وإنكم لا تطعمونه أن تدبغوه فتنتفعوا به আল্লাহ শুধু বলেছেন- قُل لَّا أَجِدُ فِي مَا أُوحِيَ إِلَيَّ مُحَرَّمًا عَلَىٰ طَاعِمٍ يَطْعَمُهُ إِلَّا أَن يَكُونَ مَيْتَةً أَوْ دَمًا مَّسْفُوحًا أَوْ لَحْمَ خِنزِيرٍ – ‘(হে নবী আপনি তাদেরকে) বলুন, (তোমরা আল্লাহর অনুমতি ছাড়াই অনেক কিছুকে নিজেদের জন্য হারাম ও অবৈধ বানিয়ে নিয়েছো। অথচ) আমার প্রতি (আল্লাহ’র তরফ থেকে এযাবৎ) যা ওহী হিসেবে এসেছে, তার মধ্যে আমি (তোমাদের ওসব হারামকৃত জিনিসের একটা) কোনো কিছুও পাইনা যা (আল্লাহ তাআলার তরফ থেকে তার বান্দাদের) কারো জন্য খাওয়া হারাম করা হয়েছে; ব্যাতিক্রম শুধু মৃত প্রাণী কিংবা প্রবাহিত রক্ত অথবা শুওরের গোশত…..’। —তোমরা ওই (মৃত বকরীর গোশত) খেওনা, তবে (তার চামড়া) দাবাগাত করে নিয়ে তা দিয়ে (বিভিন্নভাবে) উপকৃত হতে পারো। [মুসনাদে আহমাদ, হাদিস ৩০২৭]
এই রেওয়াতের দিকে তাকিয়ে, দেখুন রাসুলুল্লাহ সা. সুরা আনআমের ১৪৫ নং আয়াতকে কিভাবে ব্যাখ্যা করে মাসআলাহ বলে দিলেন, যা তখন অনেকেই শুধুমাত্র উপরোক্ত আয়াতটি দেখে বুঝতে পারেননি।
ইমাম ইবনে কাসির (মৃ: ৭৭৪ হি:) রহ. সাঈদ বিন মানসুরের সূত্রে আরেকটি বর্ণনা উল্লেখ করেছেন, যা আমি এখানে শুধুমাত্র আমার আলোচ্য বিষয়বস্তু বোঝানোর জন্য উল্লেখ করছি। সেখানে আছে যে, হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর রা. কে এক ব্যাক্তি সজারু খাওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি সুরা আনআমের উপরোক্ত ১৪৫ নং আয়াতটি তিলাওয়াত করে বুঝাতে চাইলেন যে এই আয়াতে সজারুর কথা উল্লেখ নেই (তাই তা হারাম নয়)। তখন তাঁর পাশে উপবিষ্ট এক বৃদ্ধ ব্যাক্তি বললেন– سمعت أبا هريرة يقول ذكر عند النبي صلى الله عليه وسلم فقال “خبيثة من الخبائث – “আমি আবু হুরায়রা রা.কে বলতে শুনেছি, এব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সা. কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন- خبيثة من الخبائث এটা খবীস (অপবিত্র ও বিভৎস জিনিস) সমূহের মধ্যে একটি খবীস”। [সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৩৭৯৯; তালখিসুর হাবির, ইবনে হাজার-৪/২৮৬] দেখুন উপরে সুরা আনআমের ১৪৫ নং আয়াতে উক্ত হারাম জিনিসগুলোর সাথে এও বলা হয়েছে- فَإِنَّهُ رِجْسٌ أَوْ فِسْقًا – “(যেহেতু এসব অপবিত্র ও পঙ্কিল)”; অর্থাৎ ওসব জিনিস হারাম করার অন্যতম কারণ হল শরীয়তের দৃষ্টিতে তা অপবিত্রতা ও পঙ্কিলতা। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَآئِثَ – “(আর তাদের জন্য হালাল করা হয়েছে পবিত্র জিনিসকে এবং হারাম করা হয়েছে খবীস জিনিসকে)”। [সুরা আ’রাফ ১৫৭] আর উপরোক্ত রেওয়ায়েতে দেখা যাচ্ছে, রাসুলুল্লাহ সা. সজারুকে খবীস (অপবিত্র/পঙ্কিল/বিভৎস) বলে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এ থেকে বোঝা গেল, কুরঅান বোঝার জন্য রাসুলুল্লাহ সা.-এর সুন্নাহ ও হাদিস জানা জরুরী, কারণ তা কুরআনেরই ব্যাখ্যা এবং ওহী সুত্রে প্রাপ্ত। তাই রাসুলুল্লাহ সা. কোনো কিছু হালাল বা হারাম বলে থাকলে তা অবশ্য অবশ্যই আল্লাহ’র কিতাব আল-কুরআনে বর্ণিত হালাল বা হারাম আইনের সীমার মধ্যে করে থাকবেন বলে পূর্ণ বিশ্বাস করতে হবে, কারণ শরীয়তের কেনো বিষয় তিনি ওহী প্রাপ্ত হওয়া ছাড়া বলেননি বা করেননি।
أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوا لَهُمْ مِنَ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَنْ بِهِ اللَّهُ وَلَوْلَا كَلِمَةُ الْفَصْلِ لَقُضِيَ بَيْنَهُمْ وَإِنَّ الظَّالِمِينَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ
‘তাদের জন্য এমনসব শরীকরা আছে নাকি, যারা তাদের জন্য দ্বীন (-এর অংশ) হিসেবে (এমন) শরীয়ত (বিধিবিধান) রচনা করে দিয়েছে, যা করার কোনো অনুমতি আল্লাহ দেননি? আর যদি একটি কথা নির্দিষ্ট হয়ে না থাকতো, তাহলে তাদের মাঝে ফয়সালা হয়ে যেত। আর নিশ্চই যারা জালেম তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ আযাব’। [সূরা শুরা ২১]
ইমাম বাগাভী (মৃ: ৫১৬ হি:) রহ. উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন- يعني كفار مكة . يقول : أم لهم آلهة سنوا لهم من الدين ما لم يأذن به الله؟ قال ابن عباس – رضي الله عنهما – : شرعوا لهم دينا غير دين الإسلام – “এ আয়াতের উদ্দেশ্য মক্কার কাফেরগোষ্ঠি। বলা হচ্ছে, এদের কি (আল্লাহ ছাড়াও) এমনসব ইলাহ (উপাস্য) রয়েছে নাকি, যারা তাদের জন্য ‘দ্বীন’ হিসেবে এমন সব বিধিমালা চালু করছে, যা করার কোনো অনুমতি আল্লাহ দেন নি? ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন- (এর অর্থ) شرعوا لهم دينا غير دين الإسلام ‘তারা তাদের (অনুসারীদের) জন্য দ্বীন ইসলাম ভিন্ন অন্য দ্বীন (বিশ্বাস, রীতি ও বিধি নিষেধ) চালু করেছিল”। [মাআলিমুত তানজীল, ইমাম বাগাভী- ৪/১১০]
ইমাম আবু হাইয়্যান উন্দুলুসী (মৃ: ৭৪৫ হি:) রহ. তাঁর বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ ‘আল-বাহরুল মুহিত’-এ উপরোক্ত আয়াতে شُرَكَاءُ (শরীকরা) বলতে কাদেরকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে তার এক ব্যাখ্যায় বলেছেন– والشركاء هنا يحتمل أن يراد به شركاؤهم في الكفر ، كالشياطين والمغوين من الناس ……لما كانت سببا لضلالهم وافتتانهم جعلت شارعة لدين الكفر – “এখানে شُرَكَاءُ (শরীকরা) বলতে যাদেরকে উদ্দেশ্য করা হতে পারে তারা হল ‘তাদের কুফরী (আকিদা-বিশ্বাস, রীতি-নীতি ও বিধিবিধান রচনা ও চালু করার) কাজে অংশগ্রহনকারী শরীকরা, যেমন তাদের মধ্যে শয়তান বা বদমাইশ মানুষ এবং.পথভ্রষ্ঠকারী ব্যাক্তিরা……বস্তুতঃ এরা ছিল কুফরী দ্বীন’-এর বিধানরচয়ীতা যারা একেকজন ছিল তাদের (অনুসারীদের)কে পথভ্রষ্ঠ করা ও ফিতনায় নিপতিত করার মাধ্যম”। [আল-বাহরুল মুহিত, ইমাম আবু হাইয়্যান- ৭/৪৯১]
ইমাম ইবনে কাসির (মৃ: ৭৭৪ হি:) রহ. উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন– أي : هم لا يتبعون ما شرع الله لك من الدين القويم ، بل يتبعون ما شرع لهم شياطينهم من الجن والإنس ، من تحريم ما حرموا عليهم ، من البحيرة والسائبة والوصيلة والحام ، وتحليل الميتة والدم والقمار ، إلى نحو ذلك من الضلالات والجهالة الباطلة ، التي كانوا قد اخترعوها في جاهليتهم ، من التحليل والتحريم ، والعبادات الباطلة ، والأقوال الفاسدة – “অর্থাৎ, (হে নবী মুহাম্মাদ !) আল্লাহ আপনাকে যে দ্বীন-উল-কায়্যেম (প্রতিষ্ঠিত দ্বীন)-কে শরীয়তস্বরূপ দিয়েছেন ওরা তা মেনে নেয়নি। বরং মানুষ ও জ্বিনদের মধ্যে শয়তানগুলো যে শরীয়ত (বিধিবিধান) তাদেরকে বানিয়ে দেয় তারা সেটা মানে ও অনুসরণ করে। ওরা তাদের (সমাজের লোকদের) জন্য (অনেক কিছুই) হারাম ও নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল, যার মধ্যে কিছু হারামকৃত জিনিষ ছিল এই- বাহিরাহ, সাবিয়া, ওসীলা, হাম ইত্যাদি। আর হালাল করেছিল মৃত প্রাণি, রক্ত ও জুয়াকে। আর এর সবই ছিল একেকটা গোমরাহী, জাহালাত-মুর্খতা; সবই ছিল বাতিল কাজ। ওরা যা-ই হালাল বা হারাম বানাতো, বাতিল ইবাদত ও মনগড়া কথার অবতারনা করতো -তার সবটাই তারা গ্রহণ করেছিল তাদের জাহালাত ও মুর্খতার কারণে”। [তাফসীরে ইবনে কাসির- ৪/১১২]
ইমাম জারীর তাবারী (মৃ: ৩১০ হি:) রহ. উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন– ابتدعوا لهم من الدين ما لم يبح الله لهم ابتداعه – “তারা তাদের জন্য এমনসব (বিশ্বাস, রীতি ও বিধি নিষেধকে) দ্বীন হিসেবে উদ্ভাবিত করেছিল, যা উদ্ভাবন করার কোনো অনুমতি আল্লাহ তাদেরকে দেন নি”। [জামেউল বায়ান, ইমাম তাবারী- ২০/৪৯২]
ইমাম মাহমুদ আলুসী (মৃ: ১২৭০ হি:) রহ. উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন- أنهم في شرع يخالف ما شرعه الله تعالى من كل وجه – “তারা এমন শরীয়ত (বিধিবিধান) চালু করেছিল, যা সর্বদিক দিয়েই আল্লাহ তাআলার দেয়া শরীয়তের বিরোধী শরীয়ত ছিল”। [রুহুল মাআনী, আলুসী- ২৫/২৮]
শায়েখ সা’দী (মৃ: ১৩৭৬ হি:) রহ. উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন– يخبر تعالى أن المشركين اتخذوا شركاء يوالونهم ويشتركون هم وإياهم في الكفر وأعماله، من شياطين الإنس، الدعاة إلى الكفر شرعوا لهم من الدين ما لم يأذن به الله من الشرك والبدع، وتحريم ما أحل الله، وتحليل ما حرم الله ونحو ذلك مما اقتضته أهواؤهم. مع أن الدين لا يكون إلا ما …شرعه الله تعالى – “আল্লাহ তাআলা এই খবর দিচ্ছেন যে, (মক্কার) মুশরেকরা তাদের কিছু মানবরূপী শয়তানদেরকে বিভিন্ন কুফরী (বিশ্বাস ও কাজের) ব্যাপারে নিজেদেরঅভিভাবক অংশীদার বানিয়ে রেখেছিল। ওরা কুফরীর দিকে আহবান করতো এবং তাদের জন্য এমনসব শিরকী ও নব্য উদ্ভাবীত শরীয়ত (বিধিবিধান)কে দ্বীন হিসেবে চালু করতো যা করার কোনো অনুমতি আল্লাহ তাআলা দেননি। তারা আল্লাহ’র (বহু) হালালকৃত জিনিসকে হারাম করতো, আবার হারামকৃত জিনিসকে হালাল করতো। এসব করতো তারা তাদের প্রবৃত্তির অনুসরন করে।… বস্তুতঃ আল্লাহ তাআলা যা শরীয়ত হিসেবে দিয়েছেন – কেবলমাত্র সেটাই (আল্লাহ’র) দ্বীন। ...” [তাইসিরুল কারীম, ইমাম সা’দী- ১/৭৫৭]
এক হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সা. একবার বললেন– ألا إن ربي أمرني أن أعلمكم ما جهلتم مما علمني يومي هذا؛ كل مال نحلته عبدا حلال، وإني خلقت عبادي حنفاء كلهم، وإنهم أتتهم الشياطين فاجتالتهم عن دينهم، وحرمت عليهم ما أحللت لهم، وأمرتهم أن يشركوا بي ما لم أنزل به سلطانا -‘শোনো ! আমার রব (প্রভু আল্লাহ তাআলা) আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, তিনি আজকে আমাকে যা কিছু শিক্ষা দিয়েছেন তার থেকে আমি যেন তোমাদেরকে (ওই সকল বিষয়) শিক্ষা দেই, যে সম্পর্কে তোমরা অজ্ঞ। (তিনি বলেছেন) আমি বান্দাকে যে সকল মাল-সম্পদ (দুনিয়ায় ব্যবহার করার জন্য) দিয়েছি তার সবই হালাল (যারৎ না আমি নিজেই কোনো কিছুকে হারাম করে দেই)। আমি আমার বান্দাদের সবাইকে সরল (স্বভাবধর্মের উপর মুসলীম ও অনুগত) করে সৃষ্টি করেছি। এরপর শয়তানরা তাদের কাছে এসেছে এবং তাদেরকে তাদের দ্বীন থেকে বিচ্যুত করে দিয়েছে। আমি তাদের জন্য যা হালাল করেছি, সে তাদের জন্য তা হারাম করে দিয়েছে এবং তাদেরকে নির্দেশ দিয়েছে, তারা যেন আমার সাথে (অন্য এমন কাউকে) অংশীদার বানায়, যা করার কোনো অধিকার নাজিল করা হয়নি। [সহীহ মুসলীম, হাদিস ২৮৬৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস ১৭৮৭৪ ; মুশকিলুল আছার ত্বাহাবী, হাদিস ৩৮৭৫; সহীহ ইবনে হিব্বান হাদিস ৬৫৪; মুসনাদে বাযযার, হাদিস ৩৪৯০]
ইমাম মাহিউদ্দিন আন-নাবাবী (মৃ: ৬৭৬ হি:) রহ. উপরোক্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় লিখেছেন– والمراد إنكار ما حرموا على أنفسهم من السائبة والوصيلة والبحيرة والحامي وغير ذلك ، وأنها لم تصر حراما بتحريمهم ، وكل مال ملكه العبد فهو له حلال ، حتى يتعلق به حق – “এই হাদিসের উদ্দেশ্য হল, (আল্লাহ’র অনুমতি লাভ করা ছাড়াই) সায়েবাহ, ওসিলাহ, বাহিরাহ, হাম ইত্যাদি বিভিন্ন যেসব বিষয়কে তারা তাদের নিজেদের জন্য হারাম করে নিয়েছিল তা অস্বীকার করা যে, তারা কিছু হারাম করলেই তা (আল্লাহ’র বান্দাদের জন্য) হারাম হয়ে যায় না, বরং কোনো বান্দার মালিকানায় যা রয়েছে তা তার জন্য হালালই থাকে, যাবৎ না তাতে অন্য কারো হক্ব যুক্ত থাকে (বা স্বয়ং আল্লাহ তাআলাই কোনো কিছু হারাম করে দেন)”। [শরহে মুসলীম, ইমাম নববী- ১৭/১৯৭]
ইতিহাসের পাতায় মানুষের এই একই খাসলতের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে বার বার। একমাত্র ইলাহ (উপাস্য) ও রব (মনিব/প্রভু)হিসেবে মানুষকে ‘দ্বীন ও শরীয়ত’ দানের যে একক অধিকার ও মর্যাদার চাদর শুধুমাত্র আল্লাহ তাআলা‘র জন্য হওয়া উচিৎ ছিল, বিভিন্ন জামানার মানুষজন বার বার সেই প্রভুত্বের একচ্ছত্র অধিকার ও চাদরটিকে তাদের দেশ বা সমাজের নেতা, মুরুব্বি, মাতব্বর, গুরু ও গণ্যমান্য শ্রেণীর লোকদের গায়ে পরিয়ে দেয়াকে উচিৎ বলে বিশ্বাস করেছে, যারা -দেশ ও সমাজের জনগণ কিভাবে জীবন চালাবে, কিভাবে জীবন চালাবেনা, তাদের জন্য কী কী বৈধ থাকবে, কী কী বৈধ থাকবে না -তার মৌলিক বিধিবিধান (শরীয়ত) চালু করে দেয়ার হক্বদার (Authority) মনে করা হত। তাদের এসব নেতা, মুরুব্বি, মাতব্বর, গুরু ও গণ্যমান্য শ্রেণীর লোকরাই ছিল তাদের বিধানদাতা (Legislators) প্রভু অন্য কথায় শরীয়তদাতা প্রভু (রব)। তাদের পথভ্রষ্ঠ বিশ্বাস ও বানানো শরীয়ত বা বিধিবিধানের সামষ্টিক রূপ-ই ছিল তাদের দ্বীন (বিশ্বাস, মতবাদ, মতাদর্শ, ধর্ম, religion, ism)। إِنَّ الدِّينَ عِندَ اللَّهِ الْإِسْلَامُ –‘নিশ্চই আল্লাহ’র কাছে (একমাত্র গৃহীত) দ্বীন হল ইসলাম। [সুরা আল ইমরান ১৯] وَمَن يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَن يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ –‘আর যে ব্যাক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীনের তলবে লেগে যাবে, সেটা তার থেকে কখনই গ্রহন করা হবে না। আর সে আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্থদের একজন হবে। [সুরা আল ইমরান ৮৫]
‘ফাতহুল মাজীদ শারহু কিতাবিত তাওহীদ’ প্রণেতা লিখেছেন – كما هو الواقع في هذه الأمة، وهذا من الشرك الأكبر المنافي للتوحيد الذي هو مدلول شهادة لا إله إلا الله. فتبين بهذه الآية أن كلمة الإخلاص نفت هذا كله لمنافاته لمدلول هذه الكلمة. فأثبتوا ما نفته من الشرك وتركوا ما أثبتته من التوحيد -“এরকম ঘটনা এই উম্মাহ’র মধ্যেও ঘটছে। (যেমন, দেশের প্রশাসকরা আল্লাহর শরীয়ত বিরোধী আইন তৈরী করে তা দিয়ে দেশ শাসন করছে এবং জনগণ তা নির্দ্বিধায় মেনে নিচ্ছে)। আর এটা ‘শিরকে আকবর’(সর্বাপেক্ষা বড় শিরক)-এর মধ্যে একটি, যা لا إله إلا الله (আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ বা উপাস্য নাই) -এই তাওহীদী সাক্ষ্যকে নস্মাত করে দেয়। এ আয়াত থেকে একথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, কালেমায়ে ইখলাস (তথা لا إله إلا الله –আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নাই) –এই কালেমা এমন সকল বিষয়কে মিটিয়ে দেয়ার জন্য এসেছে যা খোদ্ এই কালেমাকেই মিটিয়ে দিতে চায় এবং চায় নিচু করে দিতে। অথচ, যে শিরক কালেমাকে নিচু করে দেয় মিটিয়ে দেয় –তারা তা (সমাজে) প্রতিষ্ঠিত করেছে, আর যে তাওহীদকে (সমাজে) প্রতিষ্ঠিত করার কথা তারা সেটা পরিত্যাগ করে বসে আছে”!!! [ফাতহুল মাজীদ- ১/১০৭]
أَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُونَ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ حُكْمًا لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ
‘তবে কি তারা জাহেলীয়াতের বিধান কামনা করছে? আর দৃঢ় বিশ্বাসীদের জন্য আল্লাহ’র চাইতে উৎকৃষ্ট বিধানদাতা আর কে আছে। [সুরা মায়েদা ৫০]
ইমাম হাসান বসরী (মৃ: ১১০ হি:) রহ বলেছেন– مَن حَكَمَ بِغَيْرِ حُكْمِ اللَّهِ فَحُكْمُ الجاهِلِيَّةِ – “যে ব্যাক্তি আল্লাহ’র আইন ছাড়া অন্য (কারো বানানো) আইন দিয়ে বিচার করে তার বিচারটা হল জাহেলীয়াতের (মুর্খতাযুগের) বিচার”। [তাফসীরুল কুরআনিল আজীম, ইমাম ইবনু আবি হাতেম- ৪/১১৫৫ আছার ৬৫০৪; তাফসীরে ইবনে কাসির- ৫/২০২;]
মানুষ আল্লাহ তাআলার আইন বাদ দিয়ে মানুষের বানানো আইন কামনা করে তখন, যখন আল্লাহ’র কোনো আইন তাদের মনমতো হয় না এবং তারা মানুষের উদ্ভাবিত এমন কোনো আইনের অনুসন্ধানে থাকে যা পেলে তাদের মন বলে ওঠে যে অমুক অমুক আইনগুলি আল্লাহ’র দেয়া অমুক অমুক আইনের চাইতে অনেক ভাল, যুক্তিযুক্ত, সুন্দর ও গ্রহনযোগ্য। তাদের এরকম মনমানসিকতা ও আচরণ বাস্তবেই -আল্লাহ তাআলাকে সঠিক বিধান দানের অযোগ্য স্বত্ত্বা হিসেবে পরিষ্কার অবমাননা ও অমর্যাদা প্রদর্শন করা ছাড়া আর কিছু প্রকাশ করে না। এক রেওয়ায়েতে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সা. এরশাদ করেন- أبغض الناس إلى الله عج و جل مبتغ في الإسلام سنة الجاهلية …. “আল্লাহ তাআলার কাছে সর্বাধিক ক্রধের পাত্র হল যে ইসলামের মধ্যে (থেকেও অনুসরণের জন্য) জাহেলীয়াতের আদর্শ তলবে লেগে থাকে….”। [আল-মু’জামুল কাবীর, ইমাম ত্বাবরাণী- ১০/৩৭৪, হাদিস ১০৭৪৯] إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا يُنَادَوْنَ لَمَقْتُ اللَّهِ أَكْبَرُ مِن مَّقْتِكُمْ أَنفُسَكُمْ إِذْ تُدْعَوْنَ إِلَى الْإِيمَانِ فَتَكْفُرُونَ – “নিশ্চই যারা কুফরী করেছে, তাদেরকে ডাক দিয়ে বলা হবে, (আজ) তোমরা নিজেদের প্রতি নিজেদের যে ক্ষোভ হচ্ছে, তার চাইতে অত্যধিক মাত্রার ক্রধ হত আল্লাহ’র (তোমাদের প্রতি তখন), যখন (পৃথিবীতে) তোমাদেরকে ইমানের দিকে ডাকা হত, তার পরও তোমরা কুফরী করতে”। [সুরা মু’মিন ১০]
ইমাম ইবনে কাসির (মৃ: ৭৭৪ হি:) রহ. উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন– ينكر تعالى على من خرج عن حكم الله المُحْكَم المشتمل على كل خير، الناهي عن كل شر وعدل إلى ما سواه من الآراء والأهواء والاصطلاحات، التي وضعها الرجال بلا مستند من شريعة الله، كما كان أهل الجاهلية يحكمون به من الضلالات والجهالات، مما يضعونها بآرائهم وأهوائهم، وكما يحكم به التتار من السياسات الملكية المأخوذة عن ملكهم جنكزخان، الذي وضع لهم اليَساق وهو عبارة عن كتاب مجموع من أحكام قد اقتبسها عن شرائع شتى، من اليهودية والنصرانية والملة الإسلامية، وفيها كثير من الأحكام أخذها من مجرد نظره وهواه، فصارت في بنيه شرعًا متبعًا، يقدمونها على الحكم بكتاب الله وسنة رسوله صلى الله عليه وسلم.ومن فعل ذلك منهم فهو كافر يجب قتاله، حتى يرجع إلى حكم الله ورسوله صلى الله عليه وسلم فلا يحكم سواه في قليل ولا كثير – ‘আল্লাহ তাআলা এখানে সেইসকল লোকদের বিরুদ্ধে কথা বলছেন, যারা আল্লাহ’র সুস্পষ্ট হুকুম ও বিধিবিধান থেকে বের হয়ে গেছে, যেগুলোর সবটাই কল্যানে ব্যবহারের জন্য এবং সকল অকল্যান থেকে ফিরিয়ে রাখার জন্য (নাজিল করা হয়েছিল)। বস্তুতঃ আল্লাহর আইন ও বিধিবিধান হল ন্যায় ও সুবিচারমন্ডিত যা মানুষের এমনসব খেয়ালখুশি ও মনগড়া আচার ও নিয়মনীতি থেকে মুক্ত যা তারা তৈরী করে নেয় আল্লাহর শরীয়তকে কোনো রকম তোয়াক্কা না করেই। এরকমই ছিল জাহেলী যুগের লোকজন; তারা যে সব আইন রচনা করতো সেগুলো ছিল একেকটা পথভ্রষ্ঠতা ও মুখতা, কারণ তারা আইন রচনা করতো তাদের নিজেস্ব খাহেশাতপূণ মত ও চিন্তা দিয়ে। এরকম (মনগড়া) আইন-কানুনই চলতো তাতার গোষ্ঠিদের রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক পর্যায়েও, আর এসব আইনের হোতা ছিল তাদের রাষ্ট্রপ্রধান চেংগিস খান। সে তাদের জন্য রচনা করেছিল اليَساق (আল-ইয়াসাক) নামক সংবিধান; এটা ছিলবিভিন্ন বিধিবিধান সম্বলিত একটি বই, যা ইহুদী ধর্ম, খৃষ্টান ধর্ম, ইসলাম ধর্ম সহ বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠির আইন কানুন থেকে নিবার্চন করে রচনা করা হয়েছিল, যার অনেক বিধানই ছিল তার মতবাদ ও প্রবৃত্তির সংমিশ্রণে গঠিত। এটা তার অনুসারীদের মাঝে একটি গ্রহনযোগ্য সংবিধানরূপে পরিগণিত হয়েছিল এবং তারা একে আল্লাহর কিতাব ও সুন্নাতে রাসুলুল্লাহ সা.-এর বিধিবিধানের চাইতেও প্রাধান্যযোগ্য ও অগ্রগণ্য বলে মনে করতো। যে এধরনের কাজ করবে সে কাফের। যতক্ষন পযন্ত তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিধানের দিকে ফিরে না আসবে, ততক্ষন পযন্ত তাদের সাথে কিতাল (স্বসস্ত্র জিহাদ) চালিয়ে যাওয়া ওয়াজিব। অল্প হোক চাই বেশি – (কোনো অবস্থাতেই তাদের এজাতীও কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী আইন দিয়ে) বিচার করা জায়েয নয়”। [তাফসীরে ইবনে কাসির- ৩/১৩১]
ইমাম ইবনে কাসির (মৃ: ৭৭৪ হি:) রহ. আরো বলেছেন- من ترك الشرع المحكّم المنـّزل على محمد خاتم الأنبياء عليه الصلاة والسلام وتحاكم إلى غيره من الشرائع المنسوخة كفر ، فكيف بمن تحاكم إلى الياسق وقدمها عليه ، ومن فعل ذلك كفر بإجماع المسلمين – “(মানুষের মাঝে) বিচার ফয়সালা করার জন্য সর্বোশেষ নবী মুহাম্মাদ সা.-এর উপর যে শরীয়ত নাজিল হয়েছে, যে ব্যাক্তি তা পরিত্যাগ করে এবং (তদস্থলে) অন্যান্য মানসুখ (তথা রহিত) হওয়া শরয়ী বিধিবিধান দিয়ে বিচার-ফয়সালা করে, সে কাফের হয়ে যায়। তাহলে তার কি অবস্থা, যে ব্যাক্তি (তাতারদের রাষ্ট্রপ্রধান চেংগিস খানের বানানো) আল-ইয়াসাক (الياسق নামক সংবিধান-এর বিধিবিধান) দিয়ে বিচার-ফয়সালা করতে যায় এবং তার ভিত্তিতে বিচার-ফয়সালাও করে? যে ব্যাক্তি এমন কাজ করে সে মুসলীম উম্মাহ’র সর্ববাদিসম্মতক্রমে কাফের হয়ে যায়”। [আল বিদায়্যাহ ওয়ান নিহায়্যাহ, ইবনে কাসির- ১৩/১১৩]
ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম (মৃ: ৭৫১ হি:) রহ. বলেছেন- وقد جاء القرآن وصح الإجماع بأن دين الإسلام نسخ كل دين كان قبله، وأن من التزم ما جاءت به التوراة والإنجيل، ولم يتبع القرآن فإنه كافر، وقد أبطل الله كل شريعة كانت في التوراة والإنجيل وسائر الملل، وافترض على الجن والإنس شرائع الإسلام، فلا حرام إلا ما حرمه الإسلام، ولا فرض إلا ما أوجبه الإسلام. اهـ – “কুরআনুল কারিম এবং সহীহ ইজমা দ্বারা একথা সাবেত হয়েছে যে, দ্বীন ইসলাম তাঁর পূর্ববর্তী সকল দ্বীনকে মানসুখ (রহিত) করে দিয়েছে। এখন কেউ যদি তাওরাত ও ইঞ্জিলে যা এসেছে তা মানা আবশ্যক করে নেয়, আর এদিকে কুরআনকে না মানে তাহলে সে কাফের। আল্লাহ তাআলা তাওরাত ও ইঞ্জিলের গোটা শরীয়তকে বাতিল করে দিয়েছেন; ওগুলো পরিত্যাজ্য। তিনি সকল জ্বিন ও ইনসানের জন্য দ্বীন ইসলামকে মানা ফরয করে দিয়েছেন। সুতরাং ইসলাম যা হারাম করেছে তা ছাড়া আর কোনো হারাম নেই এবং ইসলাম যা মানা ওয়াজেব (আবশ্যক) করে দিয়েছে তাছাড়া আর কিছু মানা আবশ্যক নয়”। [আহকামু আহলিয যিম্মাহ, ইবনুল কাইয়্যেম পৃ: ৫৩৩]
কুরআনকে পরিত্যাগ করে তদস্থলে মানসুখ হওয়া আগের জামানার কিতাব তাওরাত ও ইঞ্জিল (যা বর্তমানে তার আগের অবস্থাতেও সংরক্ষিত নেই, বরং তাতে সময়ে সময়ে ইচ্ছেমতো পরিবর্তন করা হয়েছে) -এসব দিয়ে বিচার করা জায়েয ও বৈধ বলে বিশ্বাস করলে যদি কাফের হয়ে যায়, তাহলে ওই ব্যাক্তি সম্পর্কে আপনার কি মত যে এই আকীদা পোষন করে যে, কুরআনী আইনের কোনো স্থান পার্লামেন্টে বা বিচারালয়ে নেই? এমন বিশ্বাসকারী নিঃসন্দেহে আরো বড় কাফের।
ইমাম ইবনে হাযাম (মৃ: ৪৫৬ হি:) রহ. লিখেছেন- فإن كان يعتقد أن لأحد بعد موت النبي صلى الله عليه وسلم أن يحرم شيئا كان حلالا إلى حين موته عليه السلام، أو يحل شيئا كان حراما إلى حين موته عليه السلام، أو يوجب حدا لم يكن واجبا إلى حين موته عليه السلام، أو يشرع شريعة لم تكن في حياته عليه السلام، فهو كافر مشرك حلال الدم والمال حكمه حكم المرتد ولا فرق – “কেউ যদি এই আকীদা পোষন করে যে, নবী মুহাম্মাদ সা.-এর মৃত্যু পর্যন্ত যে জিনিস হালাল ছিল, তাঁর মৃত্যুর পর তা এখন হারাম হতে পারে, কিংবা তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত যে জিনিস হারাম ছিল, তা এখন হালাল হতে পারে, অথবা (যদি বিশ্বাস করে যে, শরীয়তে) এমন কোনো ‘হদ্’-কে (ওয়াজিব হিসেবে নতুন করে) এঁটে দেয়া যেতে পারে যা তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত ওয়াজিব ছিল না (তথা শরীয়ত জরুরী ও অত্যাবশ্যক সাব্যস্থ করেনি), অথবা (যদি বিশ্বাস করে যে,) এমন কোনো শরীয়ত (বিধিবিধান) চালু কার যেতে পারে যা তাঁর জীবিত থাকা কালিন বিদ্যমান ছিল না, তাহলে সে ব্যাক্তি (ইসলামী শরীয়তকে অস্বীকারকারী ও প্রত্যাখ্যানকারী) কাফের, (এবং অন্য কাউকে বিধানদাতা-শরীয়তদাতা হিসেবে বিশ্বাসী একজন অংশিবাদী) মুশরেক। (সে মুরতাদ হওয়ার কারণে) তাকে (শরয়ী আদালতের মাধ্যমে) কতল করা হালাল এবং একজন মুরতাদের ধনসম্পদের ব্যাপারে যে বিধান সেই একই বিধান তার ধনসম্পদের ব্যাপারেও; তাতে কোনো তফাত নেই”। [আল ইহকাম, ইবনে হাযাম- ১/৭৩]
ইবনে হাযাম (মৃ: ৪৫৬ হি:) রহ. আরো লিখেছেন– وأما من ظن أن أحدا بعد موت رسول الله صلى الله عليه وسلم ينسخ حديث النبي صلى الله عليه وسلم ويحدث شريعة لم تكن في حياته صلى الله عليه وسلم فقد كفر وأشرك وحل دمه وماله ولحق بعبدة الأوثان، لتكذيبه قول الله تعالى: {اليوم أكملت لكم دينكم وأتممت عليكم نعمتي ورضيت لكم الإسلام دينا}، وقال تعالى: {ومن يبتغ غير الإسلام دينا فلن يقبل منه وهو في الآخرة من الخاسرين}، فمن ادعى أن شيئا مما كان في عصره صلى الله عليه وسلم على حكم ما ثم بدل بعد موته فقد ابتغى غير الإسلام دينا لأن تلك العبادات والأحكام والمحرمات والمباحات والواجبات التي كانت على عهده صلى الله عليه وسلم، هي الإسلام الذي رضيه الله تعالى لنا وليس الإسلام شيئا غيرها، فمن ترك شيئا منها فقد ترك الإسلام، ومن أحدث شيئا غيرها فقد أحدث غير الإسلام، ولا مرية في شيء أخبرنا الله تعالى به أنه قد أكمله، وكل حديث أو آية كانا بعد نزول هذه الآية فإنما هي تفسير لما نزل قبلها وبيان لجملتها وتأكيد لأمر متقدم، وبالله تعالى التوفيق –কেউ যদি এই মনে করে যে, রাসুলুল্লাহ সা.-এর মৃত্যুর পর তাঁর হাদিস (বানী ও নির্দেশ) মানসুখ (তথা রহিত) হয়ে গেছে (এখন আর তাঁর কথা মানার প্রয়োজন নেই) এবং সে যদি এমন কোনো শরীয়ত (বিধিবিধান) উদ্ভাবন করে যা রাসুলুল্লাহ সা.-এর জীবিত থাকাকালীন সময়ে (আল্লাহ ও তাঁর রাসুল কর্তৃক অনুমদিত ছিল না), তাহলে সে কাফের হয়ে যাবে। সে (বিধান দানের প্রশ্নে আল্লাহ’র সাথে নিজেকে বিধানদাতা হিসেবে) শিরক করলো (অংশীদার বানালো)। তাকে (শরয়ী আদালতের মাধ্যমে) কতল করা হালাল এবং তার ধনসম্পদ (মুরতাদের শরয়ী বিধান মাফিক বাজেয়াপ্ত করা) হালাল। সে মূলতঃ আল্লাহ তাআলার এই আয়াতকে মিথ্যা সাব্যস্থ করেছে- الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا – আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম এবং আমার নিয়ামতকে তোমাদের উপর পরিপূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে মনোনিত করলাম। (সুরা মায়েদাহ ৩) আল্লাহ তাআলা আরো বলেন- وَمَن يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَن يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ –‘আর যে ব্যাক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীনের তলবে লেগে যাবে, সেটা তার থেকে কখনই গ্রহন করা হবে না। আর সে আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্থদের একজন হবে। (সুরা আল ইমরান ৮৫) সুতরাং কেউ যদি এই দাবী করে যে, রাসুলুল্লাহ সা.-এর জীবনকালে যে বিষয়ে কোনো বিধান ছিল, সে বিধান তাঁর মৃত্যুর পর পরিবর্তন হয়ে গেছে, সে মুলতঃ ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো (আকীদা ও বিশ্বাস)-কে দ্বীন হিসেবে গ্রহন করে নিয়েছে। কারণ, রাসুলুল্লাহ সা.-এর জীবনকালে যা কিছু ইবাদত রূপে, আহকাম রূপে, হারাম রূপে, মুবাহ (বৈধ ও অনুমোদিত) রূপে বা ওয়াজিব (তথা দ্বীনের অত্যাবশ্যক অংগ) রূপে ছিল, সেটাই ছিল ওই ইসলাম যেটাকে আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্য মনোনীত করেছেন; এটা ছাড়া আর কোনো কিছুই (দ্বীন) ইসলাম নয়। সুতরাং যে ব্যাক্তি এর কোনো একটিকেও বাদ দিয়ে দিলো সে আসলে ইসলাম (-এর ওই অংশ)কেই বাদ দিয়ে দিলো এবং যে ব্যাক্তি ইসলামের মধ্যে অনৈসলামীক কিছু উদ্ভাবন করলো সে মূলতঃ ইসলাম ভিন্ন অন্য কিছু উদ্ভাবন করলো”। [আল ইহকাম, ইবনে হাযাম- ২/১৪৪]
ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (মৃ: ৭২৮ হি:) রহ. বলেছেন– والإنسان متى حلل الحرام المجمع عليه أو حرم الحلال المجمع عليه أو بدل الشرع المجمع عليه كان كافرا باتفاق الفقهاء. – “একটি জিনিস হারাম হওয়ার উপর ইজমা রয়েছে -কোনো ব্যাক্তি যদি তা হালাল করে নেয়, অথবা একটি জিনিস হালাল হওয়ার উপর ইজমা রয়েছে -কোনো ব্যাক্তি যদি তা হারাম করে নেয়, কিংবা কোনো ইজমায়ী শরীয়তকে পরিবর্তন করে ফেলে, সেক্ষেত্রে ফিকাবিদ আলেমগণের সর্বোসম্মত মত হল -সে কাফের হয়ে গেছে”। [মাজমুউল ফাতাওয়া, ইবনে তাইমিয়্যাহ- ৩/২৬৭] ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (মৃ: ৭২৮ হি:) রহ. আরো বলেন– الشرع المنزل من عند الله تعالى وهو الكتاب والسنة الذي بعث الله به رسوله، فإن هذا الشرع ليس لأحد من الخلق الخروج عنه، ولا يخرج عنه إلا كافر – “যে শরীয়ত আল্লাহ’র কাছে গ্রহনযোগ্য সেটা হল ওই আল-কিতাব (আল-কুরআন) ও আল-সুন্নাহ যা দিয়ে তিনি তাঁর রাসুল (সা.)-কে পাঠিয়েছেন। তাই এটি এমন এক শরীয়ত – যে কেউ এই শরীয়ত থেকে বের হয়ে যাবে, সে কাফের হয়েই (দ্বীন) থেকে বের হয়ে যাবে”। [মাজমুউল ফাতাওয়া, ইবনে তাইমিয়্যাহ- ১১/২৬২]
ইমাম আবু ইয়ালা রহ. লিখেছেন– من اعتقد تحليل ما حرم الله ورسوله بالنص الصريح، أو أجمع المسلمون على تحريمه؛ فهو كافر، كمن أباح شرب الخمر، ومنع الصلاة والصيام والزكاة، وكذلك من اعتقد تحريم شيء حلله الله وأباحه بالنص الصريح، أو أباحه رسوله أو المسلمون مع العلم بذلك، فهو كافر، كمن حرم النكاح والبيع والشراء على الوجه الذي أباحه الله عز وجل، والوجه فيه أن في ذلك تكذيباً لله تعالى ولرسوله في خبره، وتكذيباً للمسلمين في خبرهم، ومن فعل ذلك فهو كافر بإجماع المسلمين – “নস্-ই-সারিহ্ব তথা কুরআন সুন্নাহ’র সুস্পষ্ট বর্ণনার মাধ্যমে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সা. যা হারাম করেছেন কিংবা যা হারাম হওয়ার ব্যাপারে মুসলীম উম্মাহ’র ইজমা রয়েছে, সেটাকে যে ব্যাক্তি হালাল ও বৈধ হওয়ার আকীদা পোষন করে -যেমন মদ জায়েয হওয়া কিংবা নামায রোযা ও যাকাত নিষিদ্ধ হওয়ার আকীদা পোষন করে – তবে সে কাফের। একইভাবে আল্লাহ তাআলা যা হালাল করেছেন কিংবা নস-ই-সারিহ্ব’র মাধ্যমে কোনো কিছুকে মুবাহ (অনুমোদীত) করেছেন কিংবা তাঁর রাসুল সা. কোনো কিছুকে মুবাহ করেছেন কিংবা ওলামাতুল মুসলীমিন কুরআন-সুন্নাহ’র আলোকে (সর্বোসম্মতভাবে) মুবাহ বলেছেন -যেমন আল্লাহ’র দেয়া শরয়ী বিভিন্ন নিয়মনীতির আলোকে বিয়ে, ক্রয়-বিক্রয় ইত্যাদি – যে ব্যাক্তি তা হারাম হওয়ার আকীদা পোষন করে সেও কাফের। কারণ সে এসব উল্লেখিত ক্ষেত্রে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সা.-এর দেয়া (শরয়ী) বিষয়কে মিথ্যায় পর্যবশিত করেছে এবং মিথ্যা সাব্যস্থ করেছে মুসলমানদের শরয়ী ভিত্তি (কুরআন সুন্নাহ)-কে। যে ব্যাক্তি এমনটা করবে সে সর্বোসম্মতভাবে কাফের”। [আল মু’তামিদ ফি উসুলিদ্দীন, আবু ইয়ালা পৃ: ২৭১]
উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা দিবালোকের ন্যয় পরিষ্কার হয়ে গেল যে-
(১) ইলাহ (উপাস্য) ও রব (মনিব/প্রভু) হিসেবে মানব জাতিকে ‘হুকুম ও বিধান’ দানের যে একক অধিকার ও মর্যাদার সিংহাসন শুধুমাত্র আল্লাহ তাআলা‘র জন্য নির্দিষ্ট ছিল, ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসীরা সেইসিংহাসন থেকে আল্লাহ তাআলাকে হটিয়ে দিয়ে তাতে পার্লামেন্টের সদস্যদেরকে বসিয়ে দিয়েছে এবং তারা বিশ্বাস করে যে, দেশ ও সমাজের মানুষ কিভাবে জীবন চালাবে, কিভাবে জীবন চালাবেনা, তাদের জন্য কী কী বৈধ থাকবে, কী কী বৈধ থাকবে না -তার মৌলিক বিধিবিধান (শরীয়ত) রচনা ও চালু করার একমাত্র হক্বদার (Authority) হল তারা; আল্লাহ তাআলা নন। এজন্য, পার্লামেন্টের আইন-প্রনয়ণকারীরাই হল তাদের বিধানদাতা (Legislators) তথা শরীয়তদাতা রব (মনিব/প্রভু) , যাদেরকে তাদের অনুসারীরা বিধানদানের প্রশ্নে আল্লাহ তাআলা’র সমকক্ষ প্রতিদ্বন্দী অংশীদার সাব্যস্থ করেছে- যদিও-বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা ওইসব সাংসদদেরকে সিজদা করে না, পুজা-অর্চনা করে না।
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَتَّخِذُ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَنْدَاداً
‘আর মানুষের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে, যারা অনেককে আল্লাহর সমকক্ষ স্থির করে নিয়েছে। [সুরা বাকারাহ১৬৫]
تَاللَّهِ إِنْ كُنَّا لَفِي ضَلَالٍ مُبِينٍ , إِذْ نُسَوِّيكُمْ بِرَبِّ الْعَالَمِينَ
“(যারা শিরক করতো, তারা জাহান্নামে তাদের উপাস্যদের সাথে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে বলবে) আল্লাহর সপথ, আমরা অবশ্য অবশ্যই সুস্পষ্ট পথভ্রষ্ঠতায় নিমজ্জিত ছিলাম যখন আমরা তোমাদেরকে বিশ্বজাহানের রব (মনিব/প্রভু)-এর (সমমর্যাদা/ সমপর্যায়) সমকক্ষ স্থির করতাম”।[সূরা শুআরা-৯৭, ৯৮]
(২) শুধু সমকক্ষ বা সম-মর্যাদা বললে ভুল হবে, বরং বলতে হবে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা বিধান রচনার প্রশ্নে আল্লাহর তাআলার চাইতে আরো উচ্চ মর্যাদায় সমাসীন করেছে পার্লামেন্টের সাংসদ-মন্ত্রীদেরকে। কারণ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী বিশ্বাস মতে, পার্লামেন্টের সাংসদ-মন্ত্রীদের আইনের সাথে আল্লাহর আইন সাংঘর্ষিক হলে আল্লাহর আইন বাতিল বলে গণ্য হবে এবং যে ব্যাক্তি এক্ষেত্রে সাংসদ-মন্ত্রীদের রচিত আইন (শরীয়ত) বাদ দিয়ে আল্লাহ’র আইন (শরীয়ত) মানবে সে রাষ্ট্রের একজন অপরাধী (মুজরিম) হিসেবে বিবেচিত হবে, এমনকি সে যদি তাদের রচিত আইনের বিরোধীতা (বাগাওয়াত) করে বা মানতে অস্বীকার (কুফরী/ইনকার) করে কিংবা তাদের আইনকে বাতিল বলে গণ্য করে তা অমান্য করতে চায়, তাহলে সে রাষ্ট্রদ্রোহী (বাগী) হিসেবে বিবেচিত হবে, যার সর্বোচ্চ শাস্তি হল মৃত্যুদন্ড (ব্লাশফেমী) !!! (নাঊযুবিল্লাহী মিন যালিক)!!!
ইসলামী শরীয়তের এই ইজমায়ী (সর্বসম্মত) মাসআলার বিপরীতে-
(ক) ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে যেহেতু রাষ্ট্রের আইন বিভাগ থেকে কোনো ধর্মীয় বিধিবিধানকে ১০০% মুক্ত করায় বিশ্বাস (ইমান) রাখা মৌলিক অত্যাবশ্যক (ফরয) শর্ত, তাই রাষ্ট্রীয় সংবিধান ও অনুসঙ্গিক আইন-কানুন রচনা’র ক্ষেত্রেও ইসলাম ধর্মের ‘কুরআন-সুন্নাহ’র ভিত্তিতে সংবিধান ও অনুসঙ্গিক আইন-কানুন রচনা’র শর্তটিকে রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে ১০০% মুক্ত করায় বিশ্বাস (ইমান) রাখা তাদের মতে মৌলিক অত্যাবশ্যক (ফরয) শর্ত।
(খ)ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে যেহেতু রাষ্ট্রের আইন বিভাগে কোনো ধর্মীয় বিধিবিধানকে টেনে আনা ১০০% নিষিদ্ধ (হারাম), রাষ্ট্রীয় সংবিধান ও অনুসঙ্গিক আইন-কানুন রচনা’র ক্ষেত্রেও ইসলাম ধর্মের ‘কুরআন-সুন্নাহ’র ভিত্তিতে সংবিধান ও অনুসঙ্গিক আইন-কানুন রচনা’র শর্তটিকে রাষ্ট্রযন্ত্রে টেনে আনাও তাদের মতে ১০০% নিষিদ্ধ (হারাম)।
(গ) ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ যেহেতু বিশ্বাস করে-যে ব্যাক্তিধর্মীয় বিধিবিধানকে রাষ্ট্রব্যাবস্থায় টেনে আনায় বিশ্বাসী সে আদপে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদেই বিশ্বাসী নয় বরং অস্বীকারকারী (কাফের), তাই যে ব্যাক্তি রাষ্ট্রীয় সংবিধান ও অনুসঙ্গিক আইন-কানুন রচনা’র ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্মের ‘কুরআন-সুন্নাহ’র ভিত্তিতে সংবিধান ও অনুসঙ্গিক আইন-কানুন রচনা’র শর্তটিকে রাষ্ট্রযন্ত্রে টেনে আনায় বিশ্বাসী, তাদের মতে সেও আদপে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে বিশ্বাসীই নয় বরং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে অস্বীকারকারী (কাফের)।
(ঘ) উপরোক্ত এই ৩টি পয়েন্টের এব্যাপারে খাঁটি ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের ইজমা (ঐকমত) রয়েছে।
কী ভয়ঙ্কর স্পর্ধা, কতো মারাত্মক আল্লাদ্রোহিতা !!! নিঃন্দেহে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের এজাতীয় বিশ্বাস একটি খাঁটি কুফরী আকীদা এবং এমন আকীদায় বিশ্বাসী প্রত্যেক ব্যাক্তি বিনাদ্বিধায় একজন খাঁটি কাফের। বলি, এরা কাফের নয়-তো কারা কাফের।?! আর কাফের হবেই-না বা কেনো? ধর্মনিরপেক্ষতার দৃষ্টিতে যদি সাংসদদের রচিত আইন মানা দেশের নাগরীকদের জন্য অত্যাবশ্যক (ফরযে-আইন) হয় এবং তাদের রচিত সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক আল্লাহর যে কোনো আইন মানা যদি সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ (হারাম) হয় এবং তাদের রচিত আইন অস্বীকার (ইন্কার) করলে, বাতিল বলে মত প্রকাশ করলে বা বিরোধীতা (বাগাওয়াত) করলে যদি রাষ্ট্রদ্রোহী-দেশদ্রোহী হিসেবে বিবেচিত হয় ও দেশদ্রোহ- কুলাঙ্গার হিসেবে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড পাওয়ার যোগ্য হয়, তাহলে কোন্ যুক্তিতে আল্লাহর আইন মানা মুসলমানদের জন্য ফরযে-আইন হবে না ?! কোন্ যুক্তিতে অাল্লাহর আইনের সাথে সাংঘর্ষিক সাংসদদের রচিত যে কোনো আইন মানা সম্পূর্ণরূপে হারাম বা নাজায়েয হবে না?! কোন্ যুক্তিতে কেউ আল্লাহ’র আইন অস্বীকার (ইন্কার) করলে বা বাতিল বলে মত প্রকাশ করলে কিংবা বিরোধীতা (বাগাওয়াত) করলে আল্লাদ্রোহী-কাফের হিসেবে বিবেচিত হবে না ও দ্বীন ইসলামের কুলাঙ্গার-মুরতাদ হিসেবে মৃত্যুদন্ড পাওয়ার যোগ্য বিবেচিত হবে না?! অবশ্যই হবে।
আওফ বিন মালেক রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেছেন- سَتَفْتَرِقُ أُمَّتِي عَلَى بِضْعٍ وَسَبْعِينَ فِرْقَةً ، أَعْظَمُهَا فِرْقَةُ قَوْمٍ يَقِيسُونَ الْأُمُورَ بِرَأْيِهِمْ فَيُحَرِّمُونَ الْحَلَالَ وَيُحَلِّلُونَ الْحَرَامَ . رواه الحاكم في المستدرك, كتاب الفتن والملاحم : ٤/٥٩٤ رقم ٨٣٩٤ و قال: هذا حديث صحيح على شرط الشيخين ، ولم يخرجاه ; و البزار في مسنده البحر الزخار: رقم ٢٧٥٥; و الطبراني فيي المعجم الكبير: ٩٠, و قال الهيثمي:١/١٧٩ رواه الطبراني في الكبير والبزار ورجاله رجال الصحيح ; و البيهقي في المدخل إلى السنن الكبرى: ٢٠٧ ; و الطبراني في مسند الشاميين: ١٠٧٢ ; و ابن بطة في الإبانة الكبرى: ٢٠٥ و ٤١١; ابن حزم في المحلى بالآثار: ١/٨٢; الخطيب البغدادي في تاريخه:٤٢٠ -١٥/٤٢٥; ابن عبد البر في جامع بيان العلم وفضله : ١٩٩٧; – ‘অচিরেই আমার উম্মত প্রায় সত্তরটি ফিরকা’য় বিভক্ত হয়ে যাবে। ওগুলোর মধ্যে সব থেকে বড়-সুকঠিন (ফিতনাময়) ফিরকাটি হবে এমন এক গোষ্ঠি যারা তাদের (পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিয়) বিষয়গুলোকে (কুরআন ও সুন্নাহ’র শরয়ী বিধিবিধান বাদ দিয়ে) নিজেদের (নিছক বিবেকপ্রসূত যুক্তিগ্রাহ্য) মতামতের আলোকে সিদ্ধান্ত দিবে। ফলে তারা (আল্লাহ’র কৃত) হালাল’কে হারাম করে নিবে এবং হারামকে করে নিবে হালাল’। [মুসতাদরাকে হাকিম– ৪/৫৯৪ হাদিস ৮৩৯৪; মুসনাদে বাযযার, হাদিস ২৭৫৫; আল-মু’জামুল কাবীর, ত্বাবরাণী- ১৮/৫০ হাদিস ৯০; মুসনাদে শামেয়ীন, ত্বাবরাণী- ১০৭২; আল-মাদখাল, বাইহাকী, হাদিস ২০৭; আল ইবাহাতুল কুবরা, ইবনুল বাত্তাহ- ২০৫, ৪১১; আল মুহাল্লা, ইবনে হাযাম- ১/৮২; তারীখে বাগদাদী- ১৫/৪২০-৪২৫; জামেউল বয়ান, ইবনু আব্দিল বার- ১৯৯৭]
এই হাদিসে ‘প্রায় সত্তরটি ফিরকাহ’ বলতে এর আগের হাদিসের ‘৭৩ ফিরকা’ই উদ্দেশ্য, যার ৭২ টিই পথভ্রষ্ঠ ও দোযখী হবে। এই বাহাত্তরটির মধ্যে যে ফিরকা’র লোকসংখ্যা ও ফিতনার প্রভাব সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী হবে, তাদের বিশেষ বৈশিষ্ট সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন যে- يَقِيسُونَ الْأُمُورَ بِرَأْيِهِمْ – ‘তারা তাদের (পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিয়) বিষয়গুলোকে (কুরআন ও সুন্নাহ’র শরয়ী বিধিবিধান বাদ দিয়ে) নিজেদের (নিছক বিবেকপ্রসূত যুক্তিগ্রাহ্য) রায়/মতামতের আলোকে সিদ্ধান্ত দিবে’। এর দ্বারা মূলতঃ পার্লামেন্টে রাষ্ট্রীয় সংবিধান ও আইন-কানুন তৈরীর প্রশ্নে কুরআন-সুন্নাহ’কে সরিয়ে রেখে তদস্থলে পথভ্রষ্ট কর্ণধারদের নিজেদের বুদ্ধি-বিবেক খাটিয়ে আইন-কানুন রচনা করার দিকে ইশারা করা হয়েছে। এরপর বলা হয়েছে যে- فَيُحَرِّمُونَ الْحَلَالَ وَيُحَلِّلُونَ الْحَرَامَ – ‘ফলে তারা (আল্লাহ’র কৃত) হালাল’কে হারাম করে নিবে এবং হারামকে করে নিবে হালাল’। এর অর্থ হল, রাষ্ট্রে কী কী বৈধ (হালাল) থাকবে, আর কী কী অবৈধ (হারাম) থাকবে, সে বিষয়ক আইন রচনার ক্ষেত্রে তারা এমন সব আইন পাশ করবে যে, কুরআন-সুন্নাহ সংশ্লিষ্ট বিষয়কে বৈধ (হালাল) বললেও তারা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে তা অবৈধ (হারাম) হওয়া যুক্তিসঙ্গত মনে করলে বিনা দ্বিধায় তা অবৈধ (হারাম) হিসেবেই আইন পাশ করবে, আবার এমন হবে যে, কুরআন-সুন্নাহ কোনো বিষয়কে অবৈধ (হারাম) বললেও তারা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে তারা তা বৈধ (হালাল) হওয়াকে যুক্তিসঙ্গত মনে করলে বিনা দ্বিধায় তা বৈধ (হালাল) হিসেবেই আইন পাশ করবে। এই গোষ্ঠিটির সকলের মৌলিক আক্বীদা ও বিশ্বাস এইরকম চেতনার আদোলেই গঠিত থাকবে।
এই ফিরকাহটি হল আমাদের এ জামানার সেকুলারিজম (ধর্মনিরপেক্ষবাদ)-এ বিশ্বাসী ফিরকাটি (যাদের কেউ কেউ এর সাথে গণতন্ত্রকে আবার কেউ কেউ সোসালিজম’ কে যুক্ত করে নিয়েছে)। এই শেষ জামানায় পৃথিবীর সকল ইহূদী-খৃষ্টানরা সেকুলার চেতনাধারী; (এদের একেবারে অনুল্লেখযোগ্য নগণ্য অংশ তাদের বাইবেলের আইন বাস্তবায়নে বিশ্বাসী)। একই ভাবে এই শেষ জামানাতেই পৃথিবীতে প্রায় ১৭০ কোটির মতো উম্মাহ’র প্রায় সকলেই ইহূদী-খৃষ্টানদের পেশকৃত এই সেকুলারিজমকে নিজেদের মৌলিক চেতনা ও বিশ্বাস হিসেবে গ্রহন করে নিয়েছে; (এদের মধ্যে একেবারেই অনুল্লেখযোগ্য নগণ্য অংশই কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক ইসলামী খিলাফত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও শরীয়াহ বাস্তবায়নে বিশ্বাসী)। এ থেকে প্রমাণিত হয়, এই সেকুলারিজম (ধর্মনিরপেক্ষবাদ)-ই উম্মাহ’র সবচেয়ে বেশি সংখ্যক নারী-পুরুষকে (কুরআন-সন্নাহ থেকে সরিয়ে নিয়ে) নিজের দিকে আকৃষ্ট করে ইমান নষ্ট করতে সবচাইতে শক্তিশালী ভুমিকা রেখেছে এবং রেখে যাচ্ছে।
সেদিন হয়-তো বেশি দূরে নয়, যখন ইমাম মাহদী রা. ‘ইসলামী খিলাফত’ ব্যবস্থাকে পূণরায় কায়েম করার জন্য কাফের ও দাজ্জালের সাথে লড়বেন, আর দেখা যাবে যে, এই গোষ্ঠিটি কাফের ও দাজ্জালের সাথে যুক্ত হয়ে হয়ে ইমাম মাহদী রা.-এর বিরুদ্ধে কোমড় বেঁধে নেমেছে। কারণ উম্মাহ’র সেকুলারপন্থীরা চাইবে না যে, ইমাম মাহদী রা. এসে ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে তাদের কলিজার টুকরা সেকুলারিজম (ধর্মনিরপেক্ষবাদ)কে বিদায় করে দিক।
>>> মূল সূচিপত্র (index) থেকে এ পেজের পূর্ববর্তী বা পরবর্তী আলোচনা পড়তে [এখানে ক্লিক করুন]