ইসলামে খলিফা’র ক্ষমতা ও কার্যাবলী vs ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদীদের প্রকাশ্য পথভ্রষ্ঠতা, ইসলাম বিরোধীতা, আল্লাদ্রোহিতা ও কুফর
পূর্ব আলোচনার পর..>>>
আমাদের ইতিপূর্বে উল্লেখীত ধর্মনিরপেক্ষতা’র ১ নং বৈশিষ্ট অনুযায়ী যেহেতেু— “রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে ধর্মকে ১০০% আলাদা রাখায় বিশ্বাস করা ধর্মনিরপেক্ষতা’র সর্ব প্রধান শর্ত ও ভিত্তি, যেটাকে তারা বলে থাকে Separation of religion and state(ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে বিভাজন)”, তাই একটি দেশকে Secular State (ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র) বানানোর ক্রমধারায় রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ (Executive Division) -এর নির্বাহী প্রধান/রাষ্ট্রপ্রধানের ক্ষমতা, কার্যাবলী ও দায়দায়িত্ব নির্ধারনের ক্ষেত্রে যে কোনো ধর্মের বিধিবিধানকে ১০০% ছেটে ফেলে দেয়ায় বিশ্বাস করা অবশ্যই ধর্মনিরপেক্ষতা’র প্রধান শর্তের অংশ।
সেখানে আমরা বিষয়টিকে খোলাসা করতে গিয়ে এভাবে উল্লেখ করেছিলাম—–“.…..(গ) রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ (Executive Division) -এর নির্বাহী প্রধান/রাষ্ট্রপ্রধান -এর কার্যাবলী ও দায়দায়িত্ব কী কী হবে -তার পরিধি নির্ধারনের ক্ষেত্রে যে কোনো ধর্মীয় বিধিবিধানকে ১০০% দূরে রাখা অত্যাবশ্যক শর্ত (ফরযে আইন) (ঘ) এই নির্বাহী বিভাগের আওতাধীন সকল পদ ও পদাধিকার, ক্ষমতায়ন ও কোনো পদের কার্যাবলি নির্ণয় ও প্রয়োগের গন্ডী থেকে যে কোনো ধর্মীয় বিধিবিধানকে ১০০% দূরে রাখা অত্যাবশ্যক শর্ত (ফরযে আইন)। (ঙ) এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ‘আইনসভা’র সদস্যদের দ্বারা রচিত সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক যে কোনো ধর্মীয় আইন মানা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ (হারাম), মানলে তা হবে আইনের দৃষ্টিতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ (পাপ), এর বিরোধীতা (বাগাওয়াত্) করলে তা হবে কখনো কখনো রাষ্ট্রদ্রোহিতা, যার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত রয়েছে”।
এর অর্থ দাঁড়ায়-
ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের নির্বাহী প্রধান তথা রাষ্ট্রপ্রধান (প্রধানমন্ত্রি/রাষ্ট্রপতি)-এর দেশ পরিচালনার নির্বাহী ক্ষমতা (Executive Power) বা শাসন ক্ষমতা এবং তার জরুরী কার্যাবলী ও দায়দায়িত্বের পরিধি নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্মের বিধিবিধানকে ১০০% দূরে রাখা হবে, আর তদস্থলে শুধুমাত্র রাষ্ট্রের ‘আইন সভা’য় পাশ হওয়া সংবিধানের বিধিবিধানের আলোকে তা নির্ধারণ করা হবে। শুধু তাই নয়, বরং এক্ষেত্রে ওই ‘আইনসভা’র সদস্যদের দ্বারা রচিত সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক যে কোনো কুরআর সুন্নাহ’র প্রমাণিত ইসলামী শরীয়াহ আইন মানা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ (হারাম)ই কেবল নয়, শরীয়াহ আইন মানলে সেটা হবে আইনের দৃষ্টিতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ (পাপ), এর বিরোধীতা (বাগাওয়াত্) করলে তা হবে কখনো কখনো রাষ্ট্রদ্রোহিতা, যার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত রয়েছে”।
যারা ইসলামী শরীয়ত এবং জরুরীয়তে-দ্বীন (দ্বীনের জরুরী বিষয়) সম্পর্কিত শতসিদ্ধ মাসআলা মাসায়েল গুলোর ব্যাপারে মোটা দাগে সামান্য ধারনাও রাখেন, তারাতো বুঝতেই পাচ্ছেন যে, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের উপরোক্ত শর্তে বিশ্বাসী হওয়ার অর্থ হল- ‘সুনিশ্চিত ভাবে ইসলামী নির্বাহি ব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট খলিফার যাবতীয় ক্ষমতা ও কার্যাবলী সম্পর্কিত আল্লাহ’র নাজিলকৃত ইসলামী শরীয়তের ১০০% অংশ’কেই পুরোপুরি বাতিল করায় বিশ্বাসী হওয়া’! যেখানে একজন মুসলমান, কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত ইসলামী শরীয়তের যে কোনো একটি বিধানকে অস্বীকার/প্রত্যাক্ষান করলে মুরতাদ (দ্বীন ত্যাগী কাফের) হয়ে যায়, সেখানে ইসলামী নির্বাহি ব্যবস্থার সকল শরয়ী আইনকে বাতিল করায় বিশ্বাসী ব্যাক্তিটি যে কত বড় আল্লাহদ্রোহি মুরতাদ (দ্বীন ত্যাগী কাফের) হতে পারে -তা তো বলাই বাহুল্য।
এজন্য আমাদের মতে, দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে ‘ইসলামী নির্বাহি ব্যবস্থা’ সংশ্লিষ্ট আল্লাহ’র নাজিলকৃত প্রমাণিত ইসলামী শরীয়তকে প্রত্যাক্ষান করা, অস্বীকার করা, ছেটে ফেলা বা বাতিল করায় বিশ্বাসী ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা প্রকাশ্য আল্লাহদ্রোহি, ইসলাম বিরোধী, পথভ্রষ্ঠ ও কাফের। আমি জানি এতটুকু কথা অনেকের জন্য যথেষ্ট নয়, তারা আরো বিস্তারিত জানতে চায়। এজন্য আমরা সামনের কয়েকটি পেজে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা পেশ করার চেষ্টা করবো, ইনশাআল্লাহ।
মুসলমানদের খলিফা’র নির্বাহী ক্ষমতা ও কার্যাবলি
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন-
إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً
“নিশ্চই আমি পৃথিবীতে (আমার) খলিফাহ্ (স্থলাভিষিক্ত প্রতিনিধি) সৃষ্টি করবো”। [সূরা বাকারাহ ৩০]
إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ ۚ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ ۚ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ
“হুকুম (চলে ও চলবে) শুধুমাত্র আল্লাহ’র। তিনি হুকুম করেছেন, তোমরা (জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই) তাঁকে ছাড়া অন্য আর কারোরই ইবাদত(উপাসনা ও গোলামী) করবে না (অন্য কারো আজ্ঞাবহ হবে না)। (ভাল করে জেনে রেখো) এটাই হল ‘দ্বীন-ই-কাইয়্যেম’ (প্রতিষ্ঠিত দ্বীন)। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই তা জানে না”।[সূরা ইউসূফ ৪০]
আমরা ইতিপূর্বে (এখানে) বিস্তারিত বলে এসেছি যে, আরবীতে خليفة (খলিফাহ) শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘স্থলাভিষিক্ত, প্রতিনিধি, প্রতিনিধিত্বকারী’। আর خلافة (খিলাফত/প্রতিনিধিত্ব) হল আল্লাহ’র সৃষ্ট পৃথিবীর বুকে আল্লাহর ইচ্ছা, হুকুম ও বিধিবিধান সমূহ তাঁর যোগ্য খলিফা (বা প্রতিনিধি)দের মাধ্যমে কায়েম হবার নাম। সুতরাং, একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনা’র প্রশ্নে, ইসলামী শরীয়তের মূল ভিত্তি তথা আল্লাহ’র নাজিলকৃত কুরআন এবং তাঁর সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ ﷺ-এর সুন্নাহ ও হাদিস– এ গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থা’কে যেভাবে পরিচালনা করার নির্দেশ এসেছে, যখন মুসলমানরা তাদের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সেই অনুপাতে পরিচালিত করবে, তখন একথা বলা যাবে যে—– “আল্লাহ তাআলা যে পবিত্র ও সুমাহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এই বিশ্বকারখানা পৃথিবী ও তার শ্রমিক মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন -যাতে এই জমিনের বুকে মানুষ আল্লাহ তাআলা’র সুযোগ্য প্রতিনিধি (খলিফাহ) হিসেবে নিরঙ্কুশভাবে শুধু তাঁর ইচ্ছা ও পরিকল্পনাকেই কায়েম করে দেখায় এবং সর্বক্ষেত্রে শুধুমাত্র তাঁরই বিধি-নিষেধ ও নীতিমালাকে অনুগত্যতার সাথে মান্য করে চলে, —-সেই উদ্দেশ্যরই একাংশ বাস্তবায়ীত হয়েছে তাঁরই দেয়া শরীয়ত অনুপাতে ‘ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা’ কায়েম ও পরিচালনা করার মাধ্যমে”। আর তখন ‘রাষ্ট্রব্যবস্থা’ পরিচালনার ক্ষেত্রে এটাই হবে আল্লাহ’র সমিপে খাঁটি আবদিয়াত (দাসত্ব/গোলামী) ও খিলাফাত (প্রতিনিধিত্ব)-এর জ্বলব্যান্ত বহিঃপ্রকাশ। মুসলমানদের এ রকম একতাবদ্ধ রাষ্ট্রব্যবস্থা’কে রাজনৈতিক পরিভাষায় خلافة (খিলাফত) এবং নেতা/রাষ্ট্রপ্রধানকে خليفة (খলিফা) বলে অবিহিত করা হয়ে থাকে।
يَا دَاوُودُ إِنَّا جَعَلْنَاكَ خَلِيفَةً فِي الْأَرْضِ فَاحْكُم بَيْنَ النَّاسِ بِالْحَقِّ وَلَا تَتَّبِعِ الْهَوَىٰ فَيُضِلَّكَ عَن سَبِيلِ اللَّهِ ۚ إِنَّ الَّذِينَ يَضِلُّونَ عَن سَبِيلِ اللَّهِ لَهُمْ عَذَابٌ شَدِيدٌ بِمَا نَسُوا يَوْمَ الْحِسَابِ
“হে দাউদ! নিশ্চই আমরা তোমাকে জমিনে খলিফা বনিয়েছি। সুতরাং, তুমি (তোমার রাজ্যের) মানুষজনের মাঝে (আমার নাজিলকৃত শরীয়ত অনুযায়ী) হুকম (শাসন ও বিচার) কার্যকর করো -হক্ব (ইনসাফ) সহকারে, আর তুমি (এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তোমার) কুপ্রবৃত্তির অনুগামী হয়ো না। তাহলে তা তোমাকে আল্লাহ’র পথ থেকে ভ্রষ্ঠ করে দিবে। নিশ্চই যারা আল্লাহ’র পথ থেকে ভ্রষ্ঠ হয়ে যায়, তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ আযাব -তা এজন্য যে তারা হিসাবের দিনকে ভুলে গিয়েছিল”। [সূরা সা’দ ২৬]
ইমাম ফখুরুদ্দিন রাযী রহ. (মৃ: ৬১৫ হি:) এখানে يَا دَاوُودُ إِنَّا جَعَلْنَاكَ خَلِيفَةً فِي الْأَرْضِ -‘হে দাউদ! নিশ্চই আমরা তোমাকে জমিনে খলিফা বনিয়েছি’ –এর ব্যাখ্যায় লিখেছেন- إنا جعلناك مالكاً للناس ونافذ الحكم فيهم فبهذا التأويل يسمى خليفة ، ومنه يقال خلفاء الله في أرضه ، وحاصله أن خليفة الرجل يكون نافذ الحكم في رعيته وحقيقة الخلافة ممتنعة في حق الله ، فلما امتنعت الحقيقة جعلت اللفظة مفيدة اللزوم في تلك الحقيقة وهو نفاذ الحكم – ‘নিশ্চই আমি তোমাকে (একটি রাজ্যের) জনগণের শাসক বানিয়েছি ও (বানিয়েছি) তাদের মাঝে (আমার) বিধান-কার্যকরকারী (স্বরূপ)’। বস্তুতঃ এই মর্মার্থের সাথেই (নবী দাউদ আ.-কে) খলিফা নামে সম্মোধন করা হয়েছে। তাঁকে বলা হয়েছে, তিনি হলেন আল্লাহ’র জমিনে আল্লাহ’র খলিফা। আর মূলতঃ খলিফা হলেন এমন ব্যাক্তি যিনি তার অধীনস্ত(নাগরিক)দের মাঝে (আল্লাহ’র) বিধান চালু/প্রয়োগ করতে পারেন। আর খিলাফতের মূল বৈশিষ্টই হল, আল্লাহ’র (দ্বীনী) হক্বের রক্ষনাবেক্ষন। যখন (খিলাফতের) মূল বৈশিষ্টের রক্ষনাবেক্ষন করা হবে, তখনই (খলিফা) কথাটির সার্থকতা প্রকাশ পাবে, উপকারী সাব্যস্থ হবে। আর এই মূল বৈশিষ্টের (সার্থকতার) জন্য অপরিহার্য হল (আল্লাহ’র) হুকুম-আহকাম’কে (মানুষের মাঝে) চালু/প্রয়োগ করা…”। [মাফাতিহুল গাইব, ইমাম রাযী- ১৩/১৮৪]
ইমাম কুরতুবী রহ. (মৃ: ৬২৭ হি:) এখানে إِنَّا جَعَلْنَاكَ خَلِيفَةً فِي الْأَرْضِ –নিশ্চই আমরা তোমাকে জমিনে খলিফা বনিয়েছি -এর অর্থ করেছেন: ملكناك لتأمر بالمعروف وتنهى عن المنكر ، فتخلف من كان قبلك من الأنبياء والأئمة الصالحين – ‘আমরা তোমাকে শাসক বানিয়েছি এজন্য যে, তুমি (তোমার নাগরীকদেরকে আমার নাজিলকৃত বিধান অনুযায়ী) ভাল’র নির্দেশ দিবে এবং মন্দ থেকে নিষেধ করবে। বস্তুতঃ তোমার পূর্বেও নবীগণ এবং নেককার ইমামদের (নেতা/শাসকদের) মধ্য থেকে (কাউকে কাউকে জামিনের বিভিন্ন এলাকার) খলিফা বানানো হয়েছিল’……। আর فَاحْكُم بَيْنَ النَّاسِ بِالْحَقِّ – ‘সুতরাং, তুমি (তোমার রাজ্যের) মানুষজনের মাঝে (আমার নাজিলকৃত শরীয়ত অনুযায়ী) হুকম (শাসন ও বিচার) কার্যকর করো -হক্ব সহকারে’ -এর মধ্যে بِالْحَقِّ – (হক্ব সহকারে)-এর অর্থ করেছেন- بِالعَدْلِ – (ইনসাফ সহকারে)। আর وَلَا تَتَّبِعِ الْهَوَىٰ – ‘এবং তুমি কুপ্রবৃত্তির অনুগামী হয়ো না’ -এর অর্থ করেছেন: لا تقتد بهواك المخالف لأمر الله – ‘তুমি আল্লাহ’র নির্দেশ/বিধানের বিপরীতে নিজের প্রবৃত্তিকে মান্য করবে না’…। [জামেউ লি-আহকামিল কুরআন, ইমাম কুরতুবী- ১৫/১৮৯]
ইমাম মুহাম্মাদ বিন আব্দির রহমান ইযিয়ী রহ. (মৃ: ৯০৫ হি:) এখানে إِنَّا جَعَلْنَاكَ خَلِيفَةً فِي الْأَرْضِ –নিশ্চই আমরা তোমাকে জমিনে খলিফা বনিয়েছি -এর অর্থ করেছেন: استخلفناك على الملك أو خليفة ممن قبلك من الأنبياء – আমরা তোমাকে রাষ্ট্রের খলিফা নিযুক্ত করেছি, বা তোমাকে আমরা তোমার পূর্বের আম্বীয়াগণের খলিফা/স্থলাভিষিক্ত বানিয়েছি’। আর فَاحْكُم بَيْنَ النَّاسِ بِالْحَقِّ – ‘সুতরাং, তুমি (তোমার রাজ্যের) মানুষজনের মাঝে (আমার নাজিলকৃত শরীয়ত অনুযায়ী) হুকম (শাসন ও বিচার) কার্যকর করো -হক্ব (ইনসাফ) সহকারে’ -এর অর্থ করেছেন: الذي هو حكم الله تعالى – ‘আল্লাহ তাআলা যে বিধান দিয়েছে (তা দিয়ে ইনসাফ সহকারে শাসন ও বিচার কার্যকর করো)’। [জামেউল বয়ান, ইমাম ইযিয়ী- ৩/৪৭৪]
শায়েখ মাহমুদ আলুসী রহ. (মৃ: ১২৮০ হি:) এখানে يَا دَاوُودُ إِنَّا جَعَلْنَاكَ خَلِيفَةً فِي الْأَرْضِ -‘হে দাউদ! নিশ্চই আমরা তোমাকে জমিনে খলিফা বনিয়েছি’-এর অর্থ করেছেন: اسْتَخْلَفْناكَ عَلى المُلْكِ فِيها، والحُكْمِ فِيما بَيْنَ أهْلِها، أوْ جَعَلْناكَ خَلِيفَةً مِمَّنْ قَبْلَكَ مِنَ الأنْبِياءِ القائِمِينَ بِالحَقِّ – আমরা তোমাকে রাষ্ট্রের নাগরীকদের খলিফা ও হাকেম নিযুক্ত করেছি, বা তোমাকে আমরা তোমার পূর্বের হক্বের উপর প্রতিষ্ঠিত আম্বীয়াগণের খলিফা/স্থলাভিষিক্ত বানিয়েছি’। আর فَاحْكُم بَيْنَ النَّاسِ بِالْحَقِّ – ‘সুতরাং, তুমি (তোমার রাজ্যের) মানুষজনের মাঝে (আমার নাজিলকৃত শরীয়ত অনুযায়ী) হুকম (শাসন ও বিচার) কার্যকর করো -হক্ব (ইনসাফ) সহকারে’ -এর অর্থ করেছেন: الَّذِي شَرَعَهُ اللَّهُ تَعالى لَكَ – আল্লাহ তাআলা তোমাকে যে শরীয়ত দিয়েছেন (তা দিয়ে ইনসাফ সহকারে শাসন ও বিচার কার্যকর করো)’। [রুহুল মাআনী, আলুসী- ২৩/১৮৬]
ইমাম শাওকানী রহ. (মৃ: ১২৫০ হি:) এখানে يَا دَاوُودُ إِنَّا جَعَلْنَاكَ خَلِيفَةً فِي الْأَرْضِ -‘নিশ্চই আমরা তোমাকে জমিনে খলিফা বনিয়েছি’ -এর অর্থ করেছেন : اسْتَخْلَفْناكَ عَلى الأرْضِ لِمَن قَبْلَكَ مِنَ الأنْبِياءِ لِتَأْمُرَ بِالمَعْرُوفِ وتَنْهى عَنِ المُنْكَرِ – ‘(হে দাউদ!) আমরা তোমাকে পৃথিবীতে পূর্ববর্তী আম্বীয়াগণের খলিফা/স্থলাভিষিক্ত বানিয়েছি, এজন্য যে, তুমি (তোমার অধীন্ত মানুষজনকে আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান অনুযায়ী) ভাল’র নির্দেশ দিবে এবং (আল্লাহর নিষেধকৃত) মন্দ হতে বিরত রাখবে’। আর فَاحْكُم بَيْنَ النَّاسِ بِالْحَقِّ – ‘সুতরাং, তুমি (তোমার রাজ্যের) মানুষজনের মাঝে (আমার নাজিলকৃত শরীয়ত অনুযায়ী) হুকম (শাসন ও বিচার) কার্যকর করো -হক্ব (ইনসাফ) সহকারে’ -এর অর্থ করেছেন: بِالعَدْلِ الَّذِي هو حُكْمُ اللَّهِ بَيْنَ عِبادِهِ– ‘আল্লাহ যে বিধান দিয়েছেন (তুমি তা দিয়ে) তাঁর বান্দাদের মাঝে ইনসাফের সহকারে (শাসন ও বিচার কার্যকর করো)’। [ফাতহুল ক্বাদির, শাওকানী- ৩/৪২৯]
ড. নসর বিন আলী আয়েয হাসান রহ. লিখেছেন- و هذه الآية فيها ارشاد و تعليم من الباري جل و علا لعباده المؤمنين انه لا بد من خليفة يقوم بالحكم بما انزل الله بين عباده لتصلح به البلاد العباد – ‘আল্লাহ তাআলা এই আয়াতের মধ্যে তাঁর মুমিন বান্দাদেরকে এই কথার তা’লিম দিয়েছেন যে, খলিফার বিশেষ কর্তব্য হবে, (তার কর্তৃত্বাধীন) রাজ্য ও (রাজ্যের) নাগরিকদের (দ্বীন-দুনিয়ার) ইসলাহ/সংশোধনের জন্য -আল্লাহ (বিধান হিসেবে) যা নাজিল করেছেন সেই বিধান তাঁর বান্দাদের মাঝে কায়েম করা’। [আকীদাতু আহলিস সুন্নাহ ফি সাহাবাতিল কিরাম: পৃ: ৫০৮]
উপরের আলোচনা থেকে বোঝা যায়, একজন খলিফা’র উপরে ফরয হল-
(১) আল্লাহ তাআলা’র নাজিলকৃত ইসলামী শরীয়ত মোতাবেক দেশ শাসন করা
(২) আল্লাহ তাআলা’র নাজিলকৃত ইসলামী শরীয়ত মোতাবেক নাগরিকদের বিচার-ফয়সালা করা
(৩) আদল ইনসাফ (ন্যায়পরায়নতা) কায়েম করা
এজন্য, একটি ইসলামী রাষ্ট্রের খলিফার প্রধানতম ফরয দায়িত্বই হল, “আল্লাহ’র নাজিলকৃত কুরআন ও তাঁর প্রেরিত সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ ﷺ-এর প্রদর্শিত সুন্নাহ (আদর্শ পথ) অনুযায়ী দেশের গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনা করা এবং দেশের জনগণকে শাসন করা”।
আবু হুরায়রাহ রা. থেকে সহিহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেছেন- كَانَتْ بَنُو إِسْرَائِيلَ تَسُوسُهُمْ الْأَنْبِيَاءُ كُلَّمَا هَلَكَ نَبِيٌّ خَلَفَهُ نَبِيٌّ وَإِنَّهُ لَا نَبِيَّ بَعْدِي وَسَيَكُونُ خُلَفَاءُ فَيَكْثُرُونَ قَالُوا فَمَا تَأْمُرُنَا قَالَ فُوا بِبَيْعَةِ الْأَوَّلِ فَالْأَوَّلِ أَعْطُوهُمْ حَقَّهُمْ فَإِنَّ اللَّهَ سَائِلُهُمْ عَمَّا اسْتَرْعَاهُمْ . رواه بخارى فى صحيحه, كتاب أحاديث الأنبياء, باب ما ذكر عن بني إسرائيل: رقم ٣٤٥٥; و مسلم فى صحيحه, كتاب الإمارة، باب الأمر بالوفاء ببيعة الخلفاء، الأول فالأول،,: ٣/١٤٧٢ رقم ١٨٤٢; السنة لالخلال: ١/١١ رقم ٦ اسناده صحيح ; أحمد في المسند: رقم ٧٩٤٧; ابن ماجه فى سننه: رقم ٢٨٧١; البيهقي فى دلائل النبوة: ٦/٣٣٨ – “বনী ইসরাঈলের সিয়াসাতী (রাজনৈতিক/পলিটিকাল) দায়িত্ব পালন করতেন তাদের নবীগণ। যখনই কোনো নবী মৃত্যুবরণ করতেন, তাঁর খলীফা (স্থলাভিষিক্ত) হতেন (তাঁর পরবর্তী আরেকজন) নবী। আর নিশ্চই আমার পর কোনো নবী নেই। শিঘ্রই (আমার পর রাজনৈতিক/পলিটিকাল দায়িত্ব পালনের জন্য) খলিফাগণ হবেন, পরে (ভাল-মন্দ খলিফা’র সংখ্যা) অনেক হবে’। জিজ্ঞেস করা হল: ‘(খলিফাগণ সম্পর্কে) আপনি আমাদেরকে কী নির্দেশ দেন’? তিনি বললেন: ‘অনুগত্য করবে তার, যার কাছে প্রথমে বায়েত করা হয়েছে, তারপর (তিনি ইন্তেকাল করলে অনুগত্য করবে তার, যার কাছে) প্রথমে (বায়েত করা হয়েছে)। (তারা খলিফা হিসেবে তোমার কাছ থেকে শরয়ী দৃষ্টিতে যে হক্ব প্রাপ্য), তাদের কাছে তাদের (সে) হক্ব (যথাযথ ভাবে) পৌছে দিবে। নিশ্চই আল্লাহ তাদেরকে যে ব্যাপারে (তোমাদের উপর) পৃষ্ঠপোষক বানিয়েছিলেন, (কেয়ামতের দিন) তাদেরকে সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন”। [সহিহ বুখারী- ৪/১৬৯ হাদিস ৩৪৫৫; সহিহ মুসলীম– ৩/১৪৭২ হাদিস ১৮৪২; আস-সুন্নাহ, ইমাম খাল্লাল-১/৭৭ হাদিস ৬; মুসনাদে আহমদ, হাদিস ৭৯৪৭; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস ২৮৭১; দালায়েলুন নাবুওত, বাইহাকী- ৬/৩৩৮]
উপরের এই হাদিসের শেষে বলা হয়েছে- فَإِنَّ اللَّهَ سَائِلُهُمْ عَمَّا اسْتَرْعَاهُمْ – “নিশ্চই আল্লাহ তাদেরকে যে ব্যাপারে (তোমাদের উপর) পৃষ্ঠপোষক বানিয়েছিলেন, (কেয়ামতের দিন) তাদেরকে সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন”। অন্য হাদিসে এভাবে এসেছে যে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেছেন- أَلَا كُلُّكُمْ رَاعٍ، وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، فَالْأَمِيرُ الَّذِي عَلَى النَّاسِ رَاعٍ، وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ . رواه مسلم في الصحيح , كتاب الإمارة , باب فضيلة الإمام العادل وعقوبة الجائر والحث على الرفق بالرعية والنهي عن إدخال المشقة عليهم: ٣/١٤٥٩ رقم ١٨٢٩ – “জেনে রেখো, তোমাদের প্রত্যেকে (কারো না কারো উপরে) তত্ত্বাবধায়ক (স্বরূপ) এবং তোমাদের প্রত্যেকেই (কেয়ামতের দিন) তার তত্ত্বাবধায়নী-দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসীত হবে। সুতরাং আমীর (খলিফা/ইমাম/সুলতান/শাসক) হল (তার অধীনস্ত) নাগরিকদের উপরে (নিযুক্ত একজন) তত্ত্বাবধায়ক এবং (কেয়ামতের দিন) সে তার তত্ত্বাবধায়নী-দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসীত হবে। ….”। [সহিহ মুসলীম- ৩/১৪৫৯ হাদিস ১৮২৯; সহিহ বুখারী- ৩/৪২০ হাদিস ২৪০৯; সহিহ ইবনে হিব্বান– ১০/৩৪৩ হাদিস ৪৪৯১; ; মুসনাদে আবু আউয়ানাহ– ৪/৩৮২ হাদিস ৭০২৭; জামে তিরমিযী, হাদিস ১৭০৫; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ২৯০৮]
বস্তুত: মুসলমানদের উপরে নিযুক্ত একজন খলিফা (আমীরে-আ’জম/সুলতান/ইমাম/রাষ্ট্রপ্রধান) হলেন একজন মুসলীম নাগরিক মাত্র, যার উপরে একটি ইসলামী রাষ্ট্রের সকল নাগরিকদের হক্ব (অধিকার) যথাযথভাবে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য তাকে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক শাসন ক্ষমতা প্রয়োগের শরয়ী দায়-দায়িত্বের বোঝা বহন করতে দেয়া হয়ে থাকে। কারণ মুসলমানদের খলিফা তার শাসনাধীন রাজ্যের কোনো মালিক যেমন নন, তেমনি তার অধীনস্ত নাগকিরা তার গোলাম বা দাসও নয়, বরং খলিফা’র জন্য গোটা খিলাফত ব্যাবস্থা’টাই হল এমন একটি আমানত, যে আমানতের সহিহ ব্যবহারের জন্য তাকে রাজ্যের নাগরিকদের উপরে শাসক পর্যায়ের খলিফা (আল্লাহ’র নিযুক্ত প্রতিনিধি) বানানো হয়েছে।
মা’কিল রা. থেকে সহিহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেছেন- مَا مِنْ أَمِيرٍ يَلِي أَمْرَ الْمُسْلِمِينَ، ثُمَّ لَا يَجْهَدُ لَهُمْ وَيَنْصَحُ، إِلَّا لَمْ يَدْخُلْ مَعَهُمُ الْجَنَّةَ . رواه مسلم في الصحيح , كتاب الإيمان , باب استحقاق الوالي الغاش لرعيته النار: ١/٤٢٦ رقم ١٤٢ – ‘এম কোনো আমীর নেই, যে মুসলমানদের বিষয়াবলির দায়িত্ব পেয়েছে, অতঃপর তাদের জন্য চেষ্টাপ্রচেষ্টা চালায়নি, তাদের কল্যান কামোনা করেনি, সে তাদের সাথে বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না’। [সহিহ মুসলীম- ১/৪২৬ হাদিস ১৪২; সহিহ বুখারী, হাদিস ৭১৫০; মুসনাদে আবু আউআনাহ, হাদিস ৮৯; সুনানে কবরা, বাইহাকী- ৯/৪১]
মা’কিল ইবনু ইয়াসার রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেছেন- مَا مِنْ عَبْدٍ يَسْتَرْعِيهِ اللهُ رَعِيَّةً، يَمُوتُ يَوْمَ يَمُوتُ وَهُوَ غَاشٌّ لِرَعِيَّتِهِ، إِلَّا حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ . رواه مسلم في الصحيح , كتاب الإيمان , باب استحقاق الوالي الغاش لرعيته النار: ١/٤٢٥ رقم ١٤٢ – “যে ব্যাক্তিই হোক, যাকে আল্লাহ (তাআলা) পৃষ্ঠপোষক বানিয়েছেন, সে এমন অবস্থায় মাড়া যায় যে, সে মড়ার সময়ও তার অধস্তনদের সাথে প্রতারক হিসেবে মড়ে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিবেন ”। [সহিহ মুসলীম- ১/৪২৫ হাদিস ১৪২]
কোনো পদ কি দায়িত্ব বিহীন হয় ? আর দায়িত্ব আছে বলেই-তো সে ব্যাপারে জিজ্ঞাসার প্রশ্ন আসে। দায়িত্ব না থাকলে আবার সে ব্যাপারে কোন যুক্তিতে জিজ্ঞাসাবাদের প্রশ্ন আসে !? সুতরাং, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের বিশ্বাস অনুসরণ করতে গিয়ে রাষ্ট্র ব্যাবস্থা থেকে ধর্মকে আলাদা রাখাই যদি দ্বীন ইসলামের শিক্ষা হত, তাহলে মুসলমানদের উপরে আমীর/খলিফা/ইমাম/রাষ্ট্রপ্রধান’কে কেনোই-বা তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করতে হবে, আর কেনোই-বা তাকে কেয়ামতের দিন জিজ্ঞেস করা হবে যে, সে তার অধীনস্ত নাগরিকদের সাথে আল্লাহ’র দেয়া দায়িত্বগুলো যথাযথ ভাবে পালন করেছে কিনা। সুতরাং বোঝা গেল, ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের ‘রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করা’র বিশ্বাসটি আদপে রাষ্ট্র থেকে ইসলামের খিলাফত ব্যাবস্থার গোটা দেহটি বিচ্ছিন্ন করায় বিশ্বাস করা ছাড়া আর কিছুই নয়। ইনশাআল্লাহ, আমার এ দাবীটি আরো পরিষ্কার হবে, যখন আপনি খলিফার দায়-দায়িত্বগুলো সম্পর্কে নিম্নে বিস্তারিত পড়বেন।
কিন্তু নিম্নের আয়াতটিতে দেখুন, আল্লাহ তাআলা মুসলমানদেরকে জমিনে খিলাফত (ইসলামী শাসন ব্যবস্থা) দানের পর তাদের উপরে কী কী দায়-দায়িত্ব বর্তাবে তার আলোচনা করতে গিয়ে এরশাদ করছেন-
الَّذِينَ إِن مَّكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنكَرِ
“(তারা হল আমার সেই সকল মুমিন বান্দা) যারা (এমন গুণের অধিকারী যে,) যদি তাদেরকে জমিনে শাসন-কর্তৃত্ব (খিলাফত) দেয়া হয়, তাহলে তারা নামায কায়েম করে, যাকাত আদায় করে এবং (লোকজনকে আল্লাহ’র নাজিলকৃত শরীয়ত মোতাবেক) মা’রুফ (সৎ বিষয়)-এর নির্দেশ দেয় এবং মুনকার (নাজায়েয ও হারাম বিষয়) থেকে নিষেধ করে”। [সূরা আল-হাজ্জ ৪১]
এ থেকে বোঝা গেল, এই আয়াতের মধ্যে- ‘মুসলমানদেরকে জমিনে শাসন কর্তৃত্ব (খিলাফত) দেয়া হলে তারা নামায কায়েম করে, যাকাত আদায় করে বা আমর’ বিল মা’রুফ (সৎ বিষয়ের নির্দেশ) ও নাহি আনিল মুনকার (হারাম ও নাজায়েয বিষয় থেকে নিষেধ)-এর দায়িত্ব পালন করে’ -দ্বারা খিলাফত পাওয়ার আগের সেই স্বভাবিক অবস্থার কেবল ব্যাক্তিকেন্দ্রিক/সামাজিক পর্যায়ের নামায কায়েম, যাকাত আদায় বা আমর’ বিল মা’রুফ ও নাহি আনিল মুনকার’ শুধু উদ্দেশ্য নয়, বরং খিলাফত লাভের পর এসব শরয়ী দায়িত্ব ব্যাক্তিকেন্দ্রিক/সামাজিক পর্যায় ছাড়াও রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক পর্যায়ের আরো প্রশস্থ ও ব্যাপক আকারে জড়িত হয়ে যায়। তখন খলিফা ও গোটা মুসলীম জামাআত সুম্মিলিত সহযোগীতামূলক ভাবে এসব দায়িত্ব পালনে এমন পর্যায়ে আদিষ্ট হয়ে যায়, যা খিলাফত-বিহীন অবস্থায় পালন করা সম্ভব নয়।
ইমাম ইবনে কাসির (মৃ: ৭৭৪ হি:) রহ. সিয়াহ্ব আল-কুন্দী’র সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, সিয়াহ্ব আল-কুন্দী রহ. বলেন- سمعت عمر بن عبد العزيز يخطب وهو يقول :الذين إن مكناهم في الأرض … الآية ، ثم قال : إلا أنها ليست على الوالي وحده ، ولكنها على الوالي والمولى عليه ، ألا أنبئكم بما لكم على الوالي من ذلكم ، وبما للوالي عليكم منه؟ إن لكم على الوالي من ذلكم أن يؤاخذكم بحقوق الله عليكم ، وأن يأخذ لبعضكم من بعض ، وأن يهديكم للتي هي أقوم ما استطاع ، وإن عليكم من ذلك الطاعة غير المبزوزة ولا المستكرهة ، ولا المخالف سرها علانيتها . تفسير ابن كثير ٥/٤٣٤ – আমি (একদিন খলিফায়ে রাশেদ) ওমর বিন আব্দুল আযীয’কে খুৎবা দিতে শুনলাম, তিনি الَّذِينَ إِن مَّكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ (তারা হল আমার সেই সকল মুমিন বান্দা) যাদেরকে -আমরা যদি জমিনে (অন্যের উপর) ক্ষমতাসীন করি….. (-এই আয়াতটি তেলাওয়াত করে) বললেন: এখানে শুধু শাসকের একার দায়িত্বের কথা বলা হচ্ছে না, বরং এখানে শাসক ও (তার অধীনস্থ) শাসিত (নাগরীক) -উভয়ের কথা বলা হচ্ছে। ওহে! আমি কি তোমাদেরকে জানাবো না যে, শাসকের উপর তোমাদের কী হক্ব রয়েছে এবং তোমাদের উপর শাসকের কী হক্ব রয়েছে? শাসকের উপর তোমাদের যে হক্ব রয়েছে, সেটা হল, তোমাদের উপর আল্লাহ’র যেসব হক্ব রয়েছে (তাতে ক্রটি দেখলে) তিনি তোমাদের থেকে তা আদায় করবেন, তোমাদের একজনের (হক্ব) অপরজনের থেকে আদায় করে দিবেন এবং সাধ্য মতো তোমাদেরকে হেদায়েতের পথে পরিচালিত করবেন। আর তোমাদের উপর (শাসকের) যেটা (হক্ব) রয়েছে, সেটা হল, (তোমরা তার) অনুগত্য (করবে) -বঞ্চনার সময়, অপছন্দ অবস্থায়, প্রকাশ্যে ও গোপনে’। [তাফসীরে ইবনে কাসির- ৫/৪৩৪]
উপরের আলোচনা থেকে বোঝা গেল, এই আয়াতে কারিমাটি খলিফা ও মুসলীম নাগরীকদের পারষ্পরিক সহযোগীতামূলক ও সম্মিলিত আমলের এমন একটি উৎকৃষ্ট দিকনির্দেশিকা, যা তাদের ব্যাক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রিয় ও রাজনৈতিক -সকল অঙ্গনকে অন্তর্ভূক্ত করে নেয়।
আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে সহিহ হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেন- مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرا فَلْيُغَيّرْهُ بِيَدِهِ. فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ. فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ. وَذَلِكَ أَضْعَفُ الإِيمَانِ . رواه مسلم في صحيحه , كتاب الإيمان , باب بيان أن النهي عن المنكر من الإيمان وأن الإيمان يزيد وينقص: ١/٦٩ رقم ٤٩ – ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যাক্তি কোনো মুনকার (তথা শরীয়তের দৃষ্টিতে নাজায়েয কিছু ঘটতে) দেখে, সে তার হাত দিয়ে তা (জায়েয অবস্থায়) পাল্টিয়ে/পরিবর্তন করে দিবে। তাতেও যদি তার সামর্থ না থাকে, তাহলে (কমপক্ষে তার) মুখ দিয়ে (তা জায়েয অবস্থায় পাল্টিয়ে/পরিবর্তন করে দিবে)। এতেও যদি তার সামর্থ না থাকে, তাহলে (কমপক্ষে তার) অন্তর দিয়ে (হলেও সেই নাজায়েয বিষয়টিকে ঘৃনা করবে এবং এই আকাঙ্খা করবে যে সেটা যেন জায়েয অবস্থায় ফিরে আসে), আর সেটা হল সবচাইতে দুর্বল ইমান’। [সহিহ মুসলীম– ১/৬৯ হাদিস ৪৯; সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস ৩০৬, ৩০৭; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস ১২৭৫; সুনানে তিরমিযী, হাদিস ২১৭২; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৪৩৪০; মুসনাদে আহমদ, হাদিস ১০৭৬৬; মুসনাদে আবু ইয়া’লা, হাদিস ১২০৩; মুসনাদে তায়ালিসী, হাদিস ২৩১০; সুনানুল কুবরা, বাইহাকী- ৭/২৬৫; কিতাবুল ইমান, ইমাম ইবনু ইসহাক- ১/৩৪১ হাদিস ১৭৯]
(১) আল্লাহ তাআলা’র নাজিলকৃত ইসলামী শরীয়ত মোতাবেক শাসন কায়েম
(২) আমর’ বিল মা’রুফ (সৎ বিষয়ের নির্দেশ) ও নাহি আনিল মুনকার (হারাম ও নাজায়েয বিষয় থেকে নিষেধ)
(৩) প্রত্যেক কাজে আদল ইনসাফ
(৪) কল্যান কামনা
আর তা কিভাবে অন্তর্ভূক্ত করে নেয়, তা ভাল মতো বোঝার জন্য আমরা এবারে খলিফা’র খিলাফত সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ শরয়ী দায়িত্বগুলো যথাসম্ভব বিস্তারিত আলোচনা করবো।
খলিফার গুরু দায়িত্ব হল: আল্লাহ’র দেয়া ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী তার রাজ্যে দ্বীন কায়েম রাখা ও সেটির হিফাজত করা, নাগরীকদের উপর শরয়ী বিধান জারি করা এবং এর মাধ্যমে মুসলীম অমুসলীম নির্বিশেষে সকল নাগরীকের জান, মাল, ইজ্জত সহ অপরাপর হক্ব/অধিকার সমূহ সংরক্ষন ও হিফাজত করা, যার বিস্তারিত আলোচনা আমরা নিম্নে পেশ করতে যাচ্ছি, যা থেকে প্রমাণিত হবে যে, ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’-এর রাষ্ট্র থেকে ধর্ম’কে আলাদা করার বিশ্বাস’টি কেনো পরিষ্কার আল্লাহদ্রোহিতা, ইসলাম বিরোধী ও নিরেট কুফরী মতবাদ।