রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ নির্বাহী ব্যবস্থা’য় বিশ্বাস করা পথভ্রষ্ঠতা, প্রকাশ্য ইসলাম বিরোধীতা, আল্লাদ্রোহিতা ও কুফর -কেনো ? (৪র্থ পর্ব)
[পৃষ্ঠা-….] -এর আলোচনার পরের অংশ নিম্নরূপ
খলিফা’র ফরয দায়িত্ব : ইসলামী অর্থব্যবস্থা কায়েম করা
‘একটি সৎ শক্তিশালী অর্থব্যবস্থা’ যে কোনো জাতির মেরুদন্ড স্বরূপ। যেমনটা বলা হয়, ‘ব্যাক্তির আচার-ব্যবহারই বলে দেয় যে সে কোন্ ধরনের পরিবার থেকে এসেছে’, তেমনি যে জাতির ‘অর্থব্যবস্থা’ যতটা অসৎ ও দূর্বল অবস্থায় থাকে, সেই জাতিও সার্বিক ভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ততটাই অসৎ ও দূর্বল প্রমাণিত হয়।
আল্লাহ তাআলা তাঁর সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ ﷺ-এর মাধ্যমে মুসলীম জাতির জন্য একটি ‘ইসলামী অর্থব্যবস্থা’ দান করেছেন, যাতে তারা আল্লাহ তাআলা’র কাছে বিনাবাক্যে আত্বসমর্পণ করে তাঁর দেয়া ‘অর্থনৈতিক স্কিম’কে কায়মনোবাক্যে গ্রহন করে নিয়ে এই প্রমাণ দেয় যে, তারা বাস্তবেই মুসলীম (আত্বসমর্পণকারী) এবং আল্লাহ’র খলিফা (প্রতিনিধি)। অপর দিকে যারা আল্লাহ তাআলা’র দেয়া স্কিমকে পিঠের পিছনে নিক্ষেপ করে কোনো দার্শনিক/নেতা/লিডার-এর দেয়া স্কিমের কাছে কায়মনোবাক্যে আত্বসমর্পণ করে, তারা প্রকাশ্যে প্রমাণ দেয় যে, তারা ওই দার্শনিক/নেতা/লিডার-এর মত ও পথের কাছে আত্বসমর্পণকারী এবং ওরই খলিফা (প্রতিনিধি)।
আপনারা নিচের সংক্ষিপ্ত আলোচনায় অনুধাবন করতে পাবেন যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল ﷺ-এর দেয়া ‘ইসলামী অর্থব্যবস্থা’র সাথে ‘ধর্মনিরপেক্ষ অর্থব্যবস্থা’র আকাশ-পাতাল পার্থক্য রয়েছে, রয়েছে দা-কুমড়ার সম্পর্ক। কারণ, ‘ইসলামী অর্থব্যবস্থা’ কায়েম হলে ‘ধর্মনিরপেক্ষ অর্থব্যবস্থা’ কায়েম থাকা অসম্ভব, আবার ‘ধর্মনিরপেক্ষ অর্থব্যবস্থা’ কায়েম হলে ‘ইসলামী অর্থব্যবস্থা’ কায়েম থাকা অসম্ভব। এ দুইয়ের যে কোনো একটিকে প্রতিষ্ঠা করতে হলে অন্যটিকে বিদায় করতে হবে -এছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ নেই।
ইসলামী অর্থব্যবস্থা’র সংক্ষিপ্ত স্বরূপ
‘দারুল-ইসলাম (ইসলামী রাষ্ট্র)-এর আওতাধীন প্রতিটি মানুষের ব্যাক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় জীবন ও অন্তর্জাতিক জীবনের নানাবিধ ক্ষেত্রের সাথে ‘ইসলামী অর্থব্যবস্থা’ আষ্টে-পিষ্টে জড়িত। এজন্য অর্থব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে ‘দারুল-ইসলাম (ইসলামী রাষ্ট্র)-এর খলিফা/শাসকের বহু গুরু দায়িত্ব রয়েছে। যেমন:-
(১) ইসলামী রাষ্ট্রের ‘আমদানী ও আয়ের খাত গুলো’ থেকে শরয়ী পন্থায় সরকারী ভাবে অর্থ-সম্পদ উসূল করে ‘বায়তুল মাল’ (রাষ্ট্রীয় কোষাগার)-কে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করে তোলা;
(২) ‘বায়তুল মাল’-এর আওতাধীন আমদানী ও আয় গুলোকে সরকারী ভাবেই বিভিন্ন শরয়ী খাতে ব্যয় ও ব্যবহার করা;
(৩) কুরআন-সুন্নাহ’য় প্রমাণিত সকল হারাম ও নাজায়েয আয়-ব্যায়ের পথগুলোকে সরকারী ভাবে বন্ধ করে দেয়া, প্রয়োজনে শরয়ী শাস্তির ব্যবস্থা করা;
(৪) অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও জনগণের সহজ জীবন যাত্রার উদ্দেশ্যে শরীয়ত অনুমদিত হালাল ও মুবাহ পন্থার বিভিন্ন ব্যবসা, শ্রম ও কায়কারবারের পথ যথাসম্ভব খুলে দেয়া ও প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রন বজায় রাখা।
নিম্নে উপরের এই ৪টি পয়েন্টকে যথাসম্ভব সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করছি, যাতে ইসলামের সাথে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের মৌলিক বৈরী পার্থক্যগুলো পাঠকের সামনে পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
(১) ইসলামী রাষ্ট্রের ‘আমদানী ও আয়ের খাত গুলো’ থেকে শরয়ী পন্থায় সরকারী ভাবে অর্থ-সম্পদ উসূল করে ‘বায়তুল মাল’ (রাষ্ট্রীয় কোষাগার)-কে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করে তোলা;
‘বায়তুল মালে’র আমদানী ও আয়ের জন্য ‘ইসলামী অর্থব্যবস্থা’য় রয়েছে বিভিন্ন শরীয়ত ভিত্তিক আয়-খাত, যা ‘দ্বীন-ইসলাম’কে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ থেকে সুস্পষ্ট ভাবে স্বতন্ত্র বৈশিষ্টের অধিকারী করে তোলে। খাতগুলো নিম্নরূপ:-
(১) যাকাত
মুসলমানদের ধ্বনসম্পদের যাকাত বাবদ প্রাপ্ত অংশ বায়তুল-মালের একটি উল্লেখযোগ্য আয় খাত। আমরা ইতিপূর্বে বিস্তারিত আলোচনা করে এসেছি যে, মুসলমানরা তাদের যাকাতগুলোকে ইসলামী সরকারের হাতে সোপর্দ করে দিবে এবং সরকার তা নিয়ে যাকাতের হক্বদারদের মাঝে সরকারী ভাবে বন্টন করে দিবেন।
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করছেন- خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً -(হে নবী! তুমি খলিফা হিসেবে) তাদের ধ্বনসম্পদ থেকে যাকাত গ্রহন করো…’। [সূরা তাওবা ১০৩]
আনাস বিন মালেক রা. থেকে সহিহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন- أتى رجل من بني تميم رسول الله صلى الله عليه وسلم فقال: يا رسول اللّه، إني ذو مال كثير و ذو أهل و ولد و حاضرة فأخبرني كيف أنفق وكيف أصنع؟ فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم: تخرج الزكاة من مالك، فإنها طهرة تطهرك، وتصل أقرباءك، و تعرف حق السائل و الجار و المسكين, فقال: يا رسول اللّه: اقلل لى, قال: {وآت ذا القربى حقه والمسكين وابن السبيل ولا تبذر تبذيرًا}. فقال: حسبي يا رسول الله إذا أديت الزكاة إلى رسولك فقد برئت منها إلى اللّه و رسوله؛ فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم : نعم, إذا أديتها إلى رسولي فقد برئت منها، فلك أجرها، وإثمها على من بدلها . رواه أحمد في المسند: ١٠/٤٤١ رقم ١٢٣٣٤ و قال حمزة احمد الزين: اسناده صحيح , قال المنذري في الترغيب والترهيب: ٢/٣ رجاله رجال الصحيح , و قال الهيثمي: ٣/٦٣ رجاله رجال الصحيحين , قال الأرناؤوط : رجاله ثقات رجال الشيخين ; و البيهقي في السنن الكبري: ٤/١٦٣ رقم ٧٢٨٣ – ‘(একবার) বনী তামিম গোত্রের এক ব্যাক্তি এসে রাসুলুল্লাহ ﷺ কে জিজ্ঞেস করলো: ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি একজন ধ্বনকুবেড়, আমার পরিবার ও বালবাচ্চা রয়েছে, আমি রাজধাণীতে থাকি। এখন আমাকে বলুন, আমি কিভাবে (ধ্বনসম্পদ আল্লাহ’র রাস্তায়) ব্যয় করবো এবং কিভাবে কি করবো? তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন: ‘তুমি তোমার ধ্বনসম্পদ থেকে (হিসেব করে) যাকাত বেড় করবে। বস্তুতঃ এটা (তোমার ধ্বনসম্পদের) একটি পবিত্রতা, যা তোমাকে (তোমার ধ্বনসম্পদের মধ্যে মিশ্রিত হয়ে থাকা যাকাতের হক্বদারদের পাওয়া ময়লা হতে) পবিত্র করে নিবে। (যাকাত ছাড়াও) তুমি তোমার (ধ্বনসম্পদ দিয়ে তোমার) নিকটাত্বীয়, সওয়ালকারী, প্রতিবেশি ও মিসকীনের হক্ব’কে চিনে নিবে’। সে বললো: ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমাকে একটু সংক্ষেপে বলুন’। রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন: (যেমন আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন:) وَآتِ ذَا الْقُرْبَىٰ حَقَّهُ وَالْمِسْكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَلَا تُبَذِّرْ تَبْذِيرًا – (আর নিকতাত্বীয়, মিসকীন ও ইবনুস সাবিলকে তার হক্ব দিয়ে দাও এবং কোনো অবস্থাতেই অপব্যয় করবে না)। সে বললো: ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমি বুঝতে পরেছি। আমি যদি আপনার প্রেরিত ব্যাক্তির কাছে (আমার যাকাত) দিয়ে দিই, তাতে করে কি আমি (যাকাত দানের প্রশ্নে) আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের কাছ থেকে দায়মুক্ত হয়ে যাবো? রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন: হ্যাঁ, তুমি যখন আমার প্রেরিত ব্যাক্তির কাছে (তোমার যাকাত) দিয়ে দিবে, তখন তুমি (তোমার যাকাতের দায়িত্ব থেকে) দায়মুক্ত হয়ে গেলে। এতে তোমার জন্য রয়েছে সওয়াব। আর গোনাহ বর্তাবে তার উপরে যে তা বদলিয়ে ফেলবে’। [মুসনাদে আহমদ– ৩/১৩৬; সুনানুল কুবরা, বাইহাকী- ৪/১৬৩ হাদিস ৭২৮৩; মুআত্তা, হাদিস ১৯৯; আল-মুদাউয়ানাতুল কুবরা– ১/৩০৫]
কী কী জিনিসের উপরে কত নেসাবের মালিকের জন্য কতটুকু যাকাত আদায় করা ফরয হবে, তার বিস্তারিত আলোচনা দলিল সহ পেশ করার এটি মুনাসেব স্থান নয়। এর জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ক নির্ভরযোগ্য কিতাবসমূহ দেখা যেতে পারে। আলোচনা বোঝার স্বার্থে আমি এখানে শুধু মূল বিষয়গুলো উল্লেখ করেই ক্ষ্যান্ত হচ্ছি।
(ক) নগদ সম্পদের উপর যাকাত: কোনো মুসলমান কখনো নূন্যতম ৫২.৫০ ভরি রূপা অথবা ৭.৫০ ভরি সোনা (কিংবা এ দুইয়ের যে কোনোটির সমমূল্যের নগদ অর্থ)-এর মালিক হয়, তাহলে সে তখন থেকে ‘যাকাতের নেসাবের মালিক’ হিসেবে সাব্যস্থ হবে এবং ১ বৎসর পর তার ২.৫% হারে যাকাত আদায় করতে হবে -যদি যাকাত আদায়ের বছরে তার নূন্যতম নেসাবের পরিমাণ নগদ সম্পদ থাকে।
এযুগের প্রভিডেন্ড ফান্ড, গ্রাচুইটি, ব্যাংক একাউন্টে রক্ষিত নগদ মূলধন, শেয়ার ইত্যাদির উপরও নিয়মানুযায়ী যাকাত ধার্যযোগ্য। [ফাতওয়ায়ে উসমানী, মুফতি তক্বী উসমানী- ২/৩৯-৭৬; ফিতহী মাক্বালাত, মুফতি তক্বী উসমানী- ১/১৫৫; জাওয়াহিরুল ফিকাহ, মুফতি শফী -৩/২৫৮; ইমদাদুল আহকাম- ২/১৬; ফিকহুস সুন্নাহ- ১/৩৯৫]
(খ) গৃহপালিত পশুর উপরে যাকাত: বিচরণকারী ‘উট’, গরু/মহিষ’ এবং ‘ছাগল/ভেড়া’র যাকাতের নেসাব ভিন্ন ভিন্ন, যা নিম্নরূপ। তবে এগুলোর উপরে যাকাত ফরয হওয়ার ক্ষেত্রেও নেসাবের মালিক হওয়ার পর ১ বছর অতিক্রান্ত হওয়া শর্ত। যাকাত ফরয হওয়ার আরেকটি অন্যতম শর্ত হল, শুধুমাত্র সায়েমা জাতীয় গৃহপালিত পশুর উপরে যাকাত ফরয হবে; সায়েমা ভিন্ন নয়। সায়েমা বলা হয়, যে সকল গবাদী পশু বছরের বেশিরভাগ সময় বিচরণ করে ঘাস, লতা-পাতা ইত্যাদি খেয়ে বেড়ে ওঠে। পশুর মালিক নিজ থেকে খাবার সংগ্রহ করে পশুর খাবারের ব্যবস্থা করে বেড়ে ওঠালে সেগুলো সায়েমা হিসেবে গণ্য নয়, ফলে সেগুলোর উপরে যাকাতও ফরয নয়। তেমনি ভাবে ভার বহন ও গোশত খাওয়ার উদ্দেশ্যে পালিত পশুর উপরও যাকাত আসবে না।
বিচরণকারী ১টি থেকে ৯টি উটের উপরে ১টি ছাগী, ১০টি থেকে ১৪টি উটের উপরে ২টি ছাগী, ১৫টি থেকে ১৯টি উটের উপরে ৩টি ছাগী, ২০টি থেকে ২৪টি উটের উপরে ৪টি ছাগী যাকাত হিসেবে ধার্য হবে। উপরে আরো হিসেবে রয়েছে..
বিচরণকারী ৪০টি থেকে ১২০টি ভেড়া/ছাগলের উপরে ১টি ভেড়া/ছাগল যাকাত হিসেবে ধার্য হবে। এমনিভাবে ১২১ টি থেকে ২০০টি পর্যন্ত ভেড়া/ছাগলের উপরে ২টি ভেড়া/ছাগল এবং ২০১ টি থেকে ৩০০টি পর্যন্ত ভেড়া/ছাগলের উপরে ৩টি ভেড়া/ছাগল যাকাত হিসেবে ধার্য হবে।
বিচরণকারী ৩০টি থেকে ৩৯ টি গরু/মহিষের উপরে ১টি এক বছরের বাছুর যাকাত হিসেবে ধার্য হবে। এমনিভাবে ৪০টি থেকে ৫৯ টির জন্য ১টি দুই বছর বয়সী বাছুর যাকাত হিসেবে ধার্য হবে। আর ৬০টি থেকে ততধিক যে কোনো সংখ্যার গরু/মহিষের ক্ষেত্রে প্রতি ৩০টির জন্য ১টি এক বছর বয়সী বাছুর এবং প্রতি ৪০টির জন্য ১টি দুই বছর বয়সী বাছুর যাকাত হিসেবে ধার্য হবে।
(গ) ব্যবসায়ীক মালের উপর যাকাত: কোনো মুসলমান যদি কখনো ব্যবসায়ীক উদ্দেশ্যে মাল-সামান ক্রয় করে/প্রস্তুত করে এবং তার ওই মালের মোট মূল্য যদি নূন্যতম ৫২.৫০ ভরি রূপা অথবা ৭.৫০ ভরি সোনা’র বাজার মূল্যের সমান হয়, তাহলে ওই মালের উপরে ১ বছর পর ২.৫০% হারে যাকাত আদায় করা ফরয হবে -যদি যাকাত আদায়ের বছরে তার নূন্যতম নেসাবের পরিমাণ ব্যবসায়ীক মাল বিদ্যমান থাকে।
যেমন: ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে ক্রয়কৃত জমি-জমা, ফসল, খাদ্যশস্য, পোষাক-আসাক, খাদ্য-দ্রব্য, যন্ত্রপাতি, সাজসরঞ্জাম, ক্রয়কৃত/প্রস্তুতকৃত কাঁচামাল, বিল্ডিং-বাড়ি-ফ্লাট ইত্যাদি…।
[এছাড়াও কৃষিজাত ফসল ও খাদ্যশষ্যের উপরও যাকাত রয়েছে, যা আমরা আলাদা করে নিম্নে আলোচনা করেছি, কারণ তা উপরোক্ত যাকাতের শর্তাবলি থেকে ভিন্নতর।]
খলিফা সরকারী ভাবেই ‘বাইতুল মাল’-এর মধ্যে ‘যাকাত ফান্ড’ নামে আলাদা একটি ফান্ড রাখার ব্যবস্থা রাখবেন এবং সেখানে জমা হওয়া মুসলমানদের যাকাত থেকে (নিম্নে বর্ণিত সুরা তাওবা’র ৬০ নং আয়াতে উল্লেখীত) সংশ্লিষ্ট ৮টি খাতের যখন যেটিতে প্রয়োজন পড়ে শরয়ী পন্থায় ব্যয় করবেন, (যার আলোচনা নিম্নে আসছে)। আবার তিনি বিভিন্ন অঞ্চলের প্রশাসকদেরকে যাকাত আদায় ও বন্টনের নির্দেশ দিতে পারেন, যেমনটা রাসুলুল্লাহ ﷺ মুয়ায বিন যাবাল রা.-কে ইয়ামেনে পাঠানোর সময় নির্দেশ দিয়েছিলেন এই বলে যে, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে সহিহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন- تُؤْخَذُ مِنْ أَغْنِيَائِهِمْ وَتُرَدُّ عَلَى فُقَرَائِهِمْ – (হে মুয়ায, এমতাবস্থায়) তুমি তাদের ধ্বনী (মুসলমান)দের কাছ থেকে (যাকাত) উসূল করে নিবে এবং তা তাদের অভাবী (মুসলমানদের)দের উপরে (বিধি মোতাবেক) ব্যয় করবে’। [সহিহ বুখারী, হাদিস ১৩৯৫; সহিহ মুসলীম, হাদিস ১৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ১৫৭৪; সুনানুল কুবরা, বাইহাকী- ৪/১০১; সুনানে তিরমিযী, হাদিস ১/১২২; মুসনাদে আহমদ- ১/২৩৩; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস ১৭৮৩; সুনানে নাসায়ী, হাদিস ১/৩৩০]
(২) ওশর:
ওশর অর্থ এক দশমাংশ তথা দশ ভাগের এক ভাগ। শরয়ী পরিভাষায় মুসলমানদের জমি থেকে উৎপন্ন মোট ফসল ও খাদ্যশস্যের উপর আরোপিত যাকাত’কে ওশর নামে অবিহিত করা হয়ে থাকে। ‘ওশর আদায় করা ফরয হওয়ার ব্যাপারে মুসলীম উম্মাহ’র ইজমা রয়েছে। [বাদায়েইস সানায়ে, ইমাম কাসানী- ২/৫৪; আল-মুগণী, ইমাম ইবনে কুদামাহ- ২/৫৪৭]
আব্দুল্লাহ বিন ওমর রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেছেন- فِيمَا سَقَتْ السَّمَاءُ وَ الْعُيُونُ أَوْ كَانَ عَثَرِيًّا الْعُشْرُ ، وَمَا سُقِيَ بِالنَّضْحِ نِصْفُ الْعُشْرِ . رواه البخاري في الصحيح , كتاب الزكاة , باب العشر فيما يسقى من ماء السماء وبالماء الجاري : رقم ١٤٨٣ ; و ابن حبان في صحيحه بترتيب ابن بلبان: رقم ٣٢٨٧ ; و البيهقي في السنن الكبرى: ٤/٢١٩ ; و ابو داود في سننه: رقم ١٥٩٦ ; و النسائي في سننه: رقم ٢٤٨٨ ; الترمذي في سننه: رقم ٦٤٠ ; و ابن ماجه في سننه: رقم ١٨١٧ ; و ابن خزيمة في صحيحه: رقم ٢١٥٩- ‘আসমান (থেকে প্রাকৃতিক ভাবে নেমে আসা বৃষ্টির পানি) এবং নহর যে জমিকে সিক্ত করে কিংবা মাটির উর্বরতায় (যে জমি সিক্ত) হয়, (তাতে মোট ফলনের) ওশর (ফরয হবে)। আর যে জমি সেচ দ্বারা সিক্ত করা হয়, (তাতে মোট ফলনের) অর্ধ-ওশর (ফরয হবে) ’। [সহিহ বুখারী, হাদিস ১৪৮৩; সহিহ ইবনে ইব্বান, হাদিস ৩২৮৭; সহিহ ইবনে খুযাইমাহ, হাদিস ২১৫৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ১৫৯৬; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস ১৮১৭; সুনানে তিরমিযী, হাদিস ৬৪০; সুনানে নাসায়ী, হাদিস ২৪৮৮; সুনানুল কুবরা, বাইহাকী- ৪/২১৯]
এই ধরনের বেশ কিছু নির্ভরযোগ্য হাদিস থেকে প্রমাণিত হয় যে, বৃষ্টির পানি, নদী-খাল-বিলের প্রবাহিত পানির কারণে যে সকল জমির সেচ প্রাকৃতিক ভাবে হয়ে যায়, সেসকল জমির মোট ফলনের উপরে ওশর (দশ ভাগের এক ভাগ) আদায় করা ফরয হবে। আর যে সকল জমিতে কৃত্রিম কায়দায় সেচ দিতে হয় (যেমন ইন্দারা/কূপ খনন করে সেচ দিতে হয়), তার সেসকল জমির মোট ফলনের উপরে অর্ধ-ওশর (বিশ ভাগের এক ভাগ) আদায় করা ফরয হবে। [কিতাবুল খিরাজ, ইমাম আবু ইউসুফ- ৬৯ পৃষ্ঠা; শামী- ২/৬৬]
‘ওশর’ আদায়ের জন্য কোনো নেসাব নেই, বরং কম-বেশি যতটুকু ফসল ও খাদ্যশস্য উৎপন্ন হবে, তা কেটে উত্তলন কালে ‘ওশর’ আদায় করা ফলনের মালিকের উপরে অপরিহার্য হবে। [হিদায়াহ মাআ ফাতহুল কাদীর- ২/২৪২] এমনকি ‘ওশর’ আদায়ের জন্য ১ বছর অতিক্রান্ত হওয়ারও কোনো শর্ত নেই, বরং যতবারই ফলন হবে, ততবারই তা কেটে উত্তলন কালে ওশর আদায় করা অপরিহার্য হবে। যেমন: আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-
وَهُوَ الَّذِي أَنشَأَ جَنَّاتٍ مَّعْرُوشَاتٍ وَغَيْرَ مَعْرُوشَاتٍ وَالنَّخْلَ وَالزَّرْعَ مُخْتَلِفًا أُكُلُهُ وَالزَّيْتُونَ وَالرُّمَّانَ مُتَشَابِهًا وَغَيْرَ مُتَشَابِهٍ ۚ كُلُوا مِن ثَمَرِهِ إِذَا أَثْمَرَ وَآتُوا حَقَّهُ يَوْمَ حَصَادِهِ ۖ وَلَا تُسْرِفُوا ۚ إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ
‘তিনি (আল্লাহ) যিনি সৃষ্টি করেছেন উদ্যানসমূহ, (যার কোনোটা) লতাদার এবং (কোনোটা) লতামুক্ত (শক্ত কান্ডের উপর দন্ডায়মান। তিনি আরো সৃষ্টি করেছেন) খেজুর গাছ, বিভিন্ন ধরনের খাদ্যশস্য , যাইতুন এবং আনার সদৃশ (খাদ্য) ও তার বৈসাদৃশ্যপূর্ণ (খাদ্য)। তোমরা তা থেকে ফল ভক্ষন করো যখন তা ফল দেয় এবং তা (ক্ষেত-খামার বা গাছ থেকে) কাটার দিন তোমরা তাঁর হক্ব দিয়ে দাও। আর তোমরা ইসরাফ (অপচয়) করো না। নিশ্চই তিনি অপচয়কারীদেরকে ভালবাসেন না’। [সূরা আনআম ১৪১]
জমিতে চাষ এই আয়াতে وَآتُوا حَقَّهُ يَوْمَ حَصَادِهِ – ‘এবং তা (ক্ষেত-খামার বা গাছ থেকে) কাটার দিন তোমরা তাঁর হক্ব দিয়ে দাও’ -এর মধ্যে বলতে ‘ফলনের যাকাত’ (তথা ওশর) উদ্দেশ্য, যেমনটা আনাস রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে। [তাফসিরে তাবারী- ১২/১৫১-১৬১]
ফসল ও খাদ্যশস্য হিসেবে যাই উৎপাদন করা হবে (যেমন: ধান, যব, ভুট্টা, আঁখ/কুশার, ফল-মূল, , শাক-সবজী, সরিষা ইত্যাদি), তার ফল/ফলন কেটে উত্তলন কালে তার উপরই ‘ওশর’ আদায় করা অপরিহার্য হবে। উপরের আয়াত ও হাসিদটিই এর স্বপক্ষে সুস্পষ্ট দলিল। [বাদায়েউস সানায়ে, ইমাম কাসানী- ২/৫৯; আহকামুল কুরআন, ইবনুল আরাবী- ২/৭৪৯-৭৫২; শারহুত তিরমিযী, ইবনুল আরাবী- ৩/১৩৫; মাফাতেহুল গায়ব, ইমাম রাযী- ৭/৬৫; আল-মাবসুত, ইমাম সারাখসী- ৩/৪; কিতাবুল আছল- ২/১৩৪]
ইসলামী খিলাফত কায়েম হবার পর খলিফা/ইমাম/শাসক মুসলমানদের কাছ থেকে ‘ওশর’ বাবদ ফসল ও খাদ্যশস্য উসূল করে নিবেন এবং তা ‘ওশর’ লাভের হক্বদার প্রাপকদের কাছে গৌছানোর ব্যবস্থা করবেন। খলিফা ‘ওশর’ বাবদ প্রাপ্ত সম্পদকে পরবর্তীতে যথাযতভাবে ব্যায়ের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনে ‘বায়তুল-মাল’ (সরকারী কোষাগার/ফান্ড)-এও মওজুদ করে রাখতে পারেন এবং সময়ে সময়ে তা ব্যায় করতে পারেন, আবার চাইলে এই হুকুমও জারি রাখতে পারেন যে, যে অঞ্চলের মুসলমানদের থেকে ‘ওশর’ নেওয়া হবে, প্রশাসকগণ সেই অঞ্চলের হক্বদারদের মাঝে বন্টন করে দিবেন, (যেমনটা মুয়ায বিন যাবাল রা.-কে ইয়ামেনে প্রশাসক করে পাঠানোর সময় রাসুলুল্লাহ সা. নির্দেশ দিয়েছিলেন), আবার চাইলে প্রয়োজনে কিছু মওজুদও করে রাখতে পারেন। এমনকি যে সকল ফসল/ফল-মূল/সবজী দ্রুত পঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তা খোদ জমি থেকে উত্তলনের পরপরই দ্রুত হক্বদারদের কাছে পৌছানোর ব্যবস্থাও করতে পারেন। এব্যাপারে বাঁধাধরা কোনো নিয়ম নেই, বরং খলিফা যেভাবে ভাল মনে করেন শরীয়তের সীমা পরিসীমা লঙ্ঘন না করে বিভিন্ন যুগপযোগী ব্যবস্থা নিতে পারেন।
(৩) মা’দিন (খনিজ পদার্থ):
আরবী শব্দ مَعدِن (মা’দিন) অর্থ খনিজ পদার্থ তথা ভূ-গর্ভস্থ মূল্যবান কঠিন বা তরল পদার্থ, যা ভুমি থেকে বেড়িয়ে আসে বা মানুষ তা থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য ভূমি খুড়ে বেড় করে। مَعدِن (মা’দিন) -এর বহুবচন হল مَعَادِنُ (মাআদিন)। এগুলোকে আল্লাহ তাআলা প্রকৃতিগত ভাবেই জমিনের নিচে বিভিন্ন মূল্যবান খনিজ পদার্থ আকারে মওজুদ করে রেখেছেন। যেমন: স্বর্ণ, রৌপ্য, লোহা, তামা ইত্যাদি
পূর্বকালে খনিজ পদার্থ বলতে মানুষ এসব স্বর্ণ, রৌপ্য, লোহা, সিসা, তামা ইত্যাদি জাতীয় কিছু মূল্যবান পদার্থের সাথে পরিচিত ছিল। কিন্তু আজ আমাদের এই শেষ জামানার মানুষরা পেট্রোল তেল, গ্যাস, ইউরেনিয়াম ইত্যাদির মতো এমন কিছু মূল্যবান খনিজ পদার্থের সন্ধান পেয়েছে, যার ব্যাবহার দেখে আজ মনে হয়, এগুলো তাদের কাছে স্বর্ণের চাইতেও মূল্যবান ঠেঁকছে। যার দরূন আজ খনিজ পেট্রোল তেল’কে বলা হচ্ছে ‘কালো সোনা’। আরব-আজম যারাই এই কালো সোনার মালিক হয়েছে, পরিণতিতে তাদের পার্থিব উন্নতি ও ধ্বনসম্পদের প্রাচুর্যতা দেখে দুনিয়ার কাঙ্গালরা ইর্শা করছে। গ্যাসের মালিক দেশগুলো থেকে গ্যাস পাওয়ার জন্য হাজার হাজার মাইলের পাইপ যুক্ত করা হচ্ছে। এমনি ভাবে, পৃথিবীর উপরে দাপট দেখানোর জন্য যেসব ধ্বংসাত্বক এটোমিক বোম্ব তৈরী করা হচ্ছে তার অন্যতম একটি মৌলিক রাসায়নিক উপাদনই হল ইউরেনিয়াম, যা আজ সংগ্রহ করতে হয় ভূমি তলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রাকৃতিক খনিজ পদার্থ থেকে।
হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- أُتيَ النَّبيُّ صلَّى اللَّهُ عليهِ وسلَّمَ بقطعةٍ من ذهبٍ كانت أوَّلَ صدقةٍ جاءتْهُ من معدنٍ لنا فقالَ إنَّها ستكونُ معادنُ وسيكونُ فيها شرُّ الخلقِ . أخرجه الطبراني في المعجم الأوسط: رقم ٣٥٣٢ ; و قال الهيثمي في مجمع الزوائد: ٣/٧٨ و رجاله رجال الصحيح – ‘আমি রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে একটি স্বর্ণ খন্ড নিয়ে এলাম। প্রথমে সেটা সদকাহ (-র মাল ছিল), যা আমরা পেয়েছিলাম খনিজ-সম্পদ থেকে। তখন তিনি বললেন: নিশ্চই অতি শিঘ্রই (বিভিন্ন মূল্যবান) খনিজ-পদার্থ (বেড়) হবে এবং অতি শিঘ্রই সেখানে নিকৃষ্ট সৃষ্টি (কিছু মানুষদেরকে তাতে দখলদারী স্থাপন করার উদ্দেশ্যে উপস্থিত দেখতে) পাবে’। [আল-মু’জামুল আউসাত, ত্বাবরাণী, হাদিস ৩৫৩২; মাজমাউয যাওয়ায়ীদ, হাইছামী- ৩/৭৮]
ইমাম আব্দুর রাজ্জাক বিন হাম্মাম সানআনী রহ. নিজ সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেন- لَتَظْهَرَنَّ مَعَادِنُ فِي آخِرِ الزَّمَانِ يَخْرُجُ إِلَيْهِ شِرَارُ النَّاسِ . اخرجه فى المصنف ,كتاب الجامع, باب المعادن: ١١/١٢ رقم ١٩٧٦١ – ‘আখেরী জামানায় অবশ্যই খনিজ-পদার্থ সমূহ (ভূ-গর্ভ থেকে) বেড়িয়ে আসবে। (এ খবর জানার পর তাতে দখলদারী স্থাপনের জন্য) নিকৃষ্ট নিকৃষ্ট মানুষগুলো সেদিকে ধাবিত হবে’। [আল-মুসান্নাফ, আব্দুর রাজ্জাক- ১১/১২ হাদিস ১৯৭৬১]
এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, এই মূল্যবান খনিজ-পদার্থ সমূহ শেষ জামানায় বেড় হবে। আর আমরা (এখানে ) প্রমাণ করে এসেছি যে, আমরা শেষ জামানায় ঢুকে পড়েছি। আর খোদ একেবারে অত্যাধুনিক ভিডিও অডিও গ্রন্থ ও নির্ভরযোগ্য দালিলিক পেপার ইত্যাদিতে সংরক্ষিত তথ্য থেকে একথা প্রমাণিত যে, ব্রিটেন এবং আমেরিকার নিকৃষ্ট মানুষ নামের শয়তানগুলো এই শেষ জামানার খনিজ পদার্থগুলোর (যেমন: খনিজ তেলের) উপর কবজা বসানো জন্য সৌদি-আরব, ইরান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া ইত্যাদি দেশে বহু নিকৃষ্ট ছলে বলে কৌশলে ঢোকার চেষ্টা করেছে বা ঢুকেছে কিংবা তাদের দালাল’দেরকে বসিয়ে দিয়েছে। তাছাড়া নিকট ভবিষ্যতে ফুরাত নদী থেকে যে স্বর্ণের যে পাহাড় বেড় হবে, তাতেও নিকৃষ্ট লোকগুলি আসবে দলখদারীর জন্য। এসব অতীব মূল্যবান বলেই-তো মানুষ এগুলোকে পাওয়ার জন্য ধাবিত হয়। এগুলো এতই মূল্যবান যে, শুধু তেল বিক্রি করেই আজ সৌদি ধ্বকুবেড় দেশে পরিণত হয়ে গেছে, যারা দৈনিক প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার বা তারও বেশি তেল উত্তলন করতে সক্ষম। কিন্তু আক্ষেপ যে, এসব অর্থের মোটা অংশ লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ মানুষ হত্যা ও ইসলামের দুশমনদের কোমড় সোজা করা আর দ্বীন ইসলামের কোমড় ভেঙে দেয়ার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইনশাআল্লাহ ইমাম মাহদী রা.-এর ক্ষমতাতলে এসব খনিজ পদার্থ এলে দ্বীন ইসলাম, মুসলমান ও বিশ্ব জাহানের কল্যানে এর সহিহ ব্যবহার নিশ্চিত কর সম্ভব হবে।
এসব খনিজ পদার্থ যদি ইসলামী রাষ্ট্রের কারো ব্যাক্তি মালিকানাধিন ভূমির নিচে মওজুদ না থাকে, বরং রাষ্ট্রের সরকারী জায়গা জমিনের তলে বিদ্যমান পাওয়া যায়, তাহলে খলিফা তা দ্বীন ইসলামের উন্নতি এবং রাষ্ট্রের জনগণের উপকারার্থে যুগপযোগী কায়দায় বিভিন্ন ভাবে ব্যবহার করবেন। যেমন: এগুলো সরকারী খরচে উত্তলন করে সরাসরি ব্যবহার করতে পারেন, আবার প্রয়োজনে প্রক্রিয়াজাত করেও ব্যবহার করতে পারেন, আবার বিক্রি করে তার মূল্য দ্বীন ইসলামের উন্নতি ও জনকল্যানমূলক কাজেও ব্যবহার করতে পারেন।
(৪) লুকাত্বাহ (পড়ে পাওয়া জিনিস) ও রিকায (ভূমি তলে পুঁতে রাখা গুপ্তধন):
শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে লুকাত্বাহ (اللُّقَطَة) বলা হয় মাটির উপরে পড়ে পাওয়া জিনিসকে। আর রিকায (الرِّكاز) বলা হয় মূলতঃ কাফের কর্তৃক এমন ভূমি তলে মওজুদ করে রাখা গুপ্তধনকে, যে ভূমি এক সময় ‘দারুল-কুফর’ (কাফের শাসনাধিন রাষ্ট্র)-এর অংশ ছিল এবং পরে তা এক সময় মুসলমানদের খলিফার দ্বারা বিজীত হয়ে ইসলামী খিলাফতের পূর্ণ অধিকারে এসেছে।
এরকম যে কোনো সরকারী এলাকায় (কারো ব্যাক্তি মালিকানাধীন স্থানে নয়) কেউ কোনো গুপ্তধন পেলে তাকে ওই গুপ্তধ্বনের খুমুস (এক পঞ্চমাংশ) সরকারী বায়তুল-মালে প্রদান করতে হবে, আর বাকি চার ভাগ হবে তার।
আবু হুরায়রাহ রা. থেকে সহিহ সূত্রে বণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেন- وفي الرِّكازِ الخُمْس – রিকাযের মধ্যে খুমুস (এক-পঞ্চমাংশ) গণ্য’। [সহিহ বুখারী, হাদিস ১৪৯৯; সহিহ মুসলীম, হাদিস ১৭১০; মুসনাদে আহমদ, হাদিস ৮২৫২; সুনানে নাসায়ী- ৫/৪৬ হাদিস ২৪৯৩; মুসনাদে আবু আউয়ানাহ- ৪/১৫৮; মুসতাদরাকে হাকিম- ২/৬৫]
আমর বিন শুআইব রহ. তাঁর পিতা ও দাদা সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, এরশাদ করেন- سُئِلَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنِ اللُّقَطَةِ؟ فَقَالَ: مَا كَانَ فِي طَرِيقٍ مَأْتِيٍّ أَوْ فِي قَرْيَةٍ عَامِرَةٍ فَعَرِّفْهَا سَنَةً، فَإِنْ جَاءَ صَاحِبُهَا وَإِلَّا فَلَكَ، وَمَا لَمْ يَكُنْ فِي طَرِيقٍ مَأْتِيٍّ وَلَا فِي قَرْيَةٍ عَامِرَةٍ فَفِيهِ وَفِي الرِّكَازِ الْخُمْسُ . رواه النسائي في سننه, كتاب الزكاة , باب المعدن : ٣/٤٩٦ رقم ٢٤٩٤ ; و حسنه الالبانى في سنن النسائي; و ابو عبيد: ١/٤٣٢ – (একবার) , রাসুলুল্লাহ ﷺকে লুকাত্বাহ (কুড়িয়ে পাওয়া জিনিস) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হল। তখন তিনি বললেন: ‘যে জিনিস কোনো রাস্তাপথে কিংবা কোনো জনবসতিপূর্ণ এলাকায় পড়ে পাওয়া গেছে, তার প্রচারণা এক বৎসর ধরে চালাতে হবে। এতে যদি সেই জিনিসের মালিককে পাওয়া যায়, (তাহলে -তো জিনিসটি তাকেই দিয়ে দিবে) অন্যথায় সেটা তোমার। আর যদি তা কোনো রাস্তাপথে বা কোনো জনবসতিপূর্ণ এলাকায় পড়ে পাওয়া না যায়, তাহলে তাতে এবং রিকাযের মধ্যে খুমুস (এক-পঞ্চমাংশ) ধার্য হবে’। [সুনানে নাসায়ী- ৩/৪৯৬ হাদিস ২৪৯৪; আল-আমওয়াল, ইমাম আবু উবাইদ- ১/৪৩২]
এসকল হাদিস থেকে প্রমাণিত হয়:-
(১) মাটির উপরে পড়ে থাকা জিনিস ‘রিকায’ নয়, বরং ‘রিকায’ বলতে মূলতঃ ভূমির অভ্যন্তরে পুঁতে রাখা মূল্যবান সম্পদকে বোঝায়। কেননা, রাসুলুল্লাহ ﷺ মাটির উপরে কুড়িয়ে পাওয়া জিনিস থেকে আলাদা করে রিকায-এর কথা উল্লেখ করেছেন।
(২) যদি ইসলামী রাষ্ট্রের কোনো ব্যাক্তি মালিকানাহীন সরকারী ভূমিতে কোনো মূল্যবান জিনিস (যেমন: সোনা, রূপা, মনি-মুক্তা ইত্যাদি) পাওয়া যায় -চাই তা ভূমির উপরেই কুড়িয়ে পাওয়া যাক বা ভূমির অভ্যন্তরে -উভয় অবস্থাতেই তার ‘খুমুস’ আদায় করতে হবে। আর নিজ মালিকানাধিন জমিতে পাওয়া গেলে তা হবে তার নিজের।
(৩) হাদিসের ভাষ্য ব্যাপকভাবে মুসলীম অমুসলীম উভয়কেই অন্তর্ভূক্ত করে। তাই মুসলীম হোক বা অমুসলীম -উভয়কেই উক্ত প্রাপ্ত জিনিসের এক-পঞ্চমাংশ সরকারী কোষাগোরে দিতে হবে। [আল-মুগণী, ইবনে কুদামাহ]
এক্ষেত্রে মুসলমান ব্যাক্তি গুপ্তধ্বন পেলে-তো তার জন্য শরীয়তের নির্দেশ মেনেই খুমুস আদায় করা ওয়াজিব। কিন্তু কোনো অমুসলীম নাগরিত যদি কোনো গুপ্তধ্বন পায়, তাহলে ওসবের এক পঞ্চমাংশ সরকারের কাছে দেবে দেশের একটি আইনের অনুগত হয়ে, (শরয়ী আইন হিসেবে নয়), যেমনটা কোনো মুসলমান কোনো কাফের দেশে জীবন যাপন করলে তাকে কাফেরদের দেশীয় কিছু আইনও বিনা-প্রতিবাদে মেনে চলতে হয়।
(৪) রিকাযের উপরে ধার্যকৃত খুমুস (এক পঞ্চমাংশ) বেড় করার জন্য ১ বৎসর অতিক্রান্ত হওয়া শর্ত নয়, বরং যখন তা পাওয়া যাবে তার পরই তা প্রদেয় হবে।
(৫) রিকাযের উপরে ধার্যকৃত খুমুস (এক পঞ্চমাংশ) বেড় করার জন্য কোনো নেসাব শর্ত নয়। বরং কম পাওয়া যাক বা বেশি -উভয় অবস্থাতেই খুমুস প্রদেয় হবে।
(৫) ওয়াকফ:
মুসলমানদের মধ্যে যারা তাদের নিজ মালিকানাধিন স্থাবর বা অস্থাবর ধ্বনসম্পদ থেকে নির্দিষ্ট অংশ আল্লাহ’র রাস্তায় নিঃশ্বর্তভাবে দিয়ে দেয়, তাদের এধরনের দানকে বলা হয় ওয়াকফ।
ইসলামের ইতিহাসে অস্থাবর সম্পত্তির প্রথম দানকারী হলেন ওমর ফারূক রা.। মদিনা্য় আনসারদের মধ্যে আবূ ত্বলহা রা.-এর খেজুর বাগান-সম্পদ সবচেয়ে অধিক ছিল। আর তার সকল সম্পদের মধ্যে তাঁর কাছে সব থেকে প্রিয় ছিল মসজিদের সামনে অবস্থিত বায়রুহা বাগানটি। রাসূলুল্লাহ ﷺ সেই বাগানে যেতেন এবং এর সুস্বাদু পানি পান করতেন। আনাস বিন মালেক রা. থেকে সহিহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে- فلما نزلت : { لن تنالوا البر حتى تنفقوا مما تحبون } . قام أبو طلحةَ فقال : يا رسولَ اللهِ، إن الله يقول : { لَنْ تَنَالُوا البِرَّ حَتّى تُنْفِقُوا ممَّا تُحِبُّونَ } . وإنَّ أحبَّ أموالي إلي بيرُحاءَ، وإنها صدقةٌ لله، أرجو برَّها وذخرَها عند الله، فضعْها حيث أراك اللهُ، فقال : ( بخٍ، ذلك مال رابحٌ، أو رايحٌ – شك ابنُ مسلمة – وقد سمعتُ ما قلتَ، وإني أرى أن يجعلها في الأقربين ) . قال أبو طلحةَ : أفعلُ ذلك يا رسولَ الله، فقسمها أبو طلحةَ في أقاربه وفي بني عمِّه . اخرجه البخاري : ٢٧٦٩; و ومسلم : ٩٩٨ –‘যখন لَنْ تَنَالُوا البِرَّ حَتّى تُنْفِقُوا ممَّا تُحِبُّونَ – ‘তোমরা কখনই নেকী অর্জন করতে পারবে না, যাবৎ না তোমরা যা ভালবাস তা থেকে (আল্লাহ’র পথে) ব্যয় করো’ নাজিল হয়, তখন আবু ত্বালহা রা. দাঁড়িয়ে বললেন: ইয়া রাসুলাল্লাহ ! আল্লাহ তাআলা বলছেন- لَنْ تَنَالُوا البِرَّ حَتّى تُنْفِقُوا ممَّا تُحِبُّونَ , আর আমি আমার বায়রুহা’র সম্পদটিকে বেশি ভালবাসি। এটা (আমার পক্ষ থেকে) আল্লাহ’র (পথে) সদকাহ। আমি আল্লাহ’র কাছে এর সওয়াব ও জখিরাহ কামনা করি। আল্লাহ আপনাকে যেভাবে বলেন এটা ব্যয় করুন। তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন: বাহ ! ওটা (তোমার একটি) লাভজনক সম্পদ (হয়ে গেল), অথবা বলেছেন: অস্থায়ী সম্পদ। তুমি যা বললে আমি তা শুনেছি। আমার মতে, এটিকে (তোমার) নিকতাত্বীয়দেরকে দিয়ে দেয়া যায়। আবু ত্বালহা রা. বললেন: ‘আমি তাই করবো -ইয়া রাসুলাল্লাহ!’ ফলে আবু ত্বালহা রা. তা তার নিকতাত্বীয় ও চাচাত ভাইদের মাঝে বন্টন করে দিলেন’। [সহিহ বুখারী, হাদিস ২৭৬৯; সহিহ মুসলীম, হাদিস ৮৮৯]
কিতাবে বলা হয়েছে, যখন مَّن ذَا الَّذِي يُقْرِضُ اللَّهَ قَرْضًا حَسَنًا فَيُضَاعِفَهُ لَهُ وَلَهُ أَجْرٌ كَرِيمٌ – এবং/অথবা لَن -এই আয়াতটি নাজিল হয় তখন ত্বালহা রা. রাসুলুল্লাহ -এর কাছে আরোজ করলেন: ইয়া রাসুলুল্লাহ! [সহিহ বুখারী- ৩/২৫৭; সহিহ মুসলীম- ১/২৭৪; মুসনাদে আহমদ- ৩/১১৫, ১৪১; সুনানে তিরমিযী- ৪/৮১; আল-আমওয়াল, ইমাম আবু উবাইদ- ৫৬১ পৃষ্ঠা; তাবারী- ৭৩৯৪]
https://www.ahlalhdeeth.com/vb/showthread.php?t=223780
مَّا أَفَاءَ اللَّهُ عَلَىٰ رَسُولِهِ مِنْ أَهْلِ الْقُرَىٰ فَلِلَّهِ وَلِلرَّسُولِ وَلِذِي الْقُرْبَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَ الْمَسَاكِينِ وَابْنِ السَّبِيلِ كَيْ لَا يَكُونَ دُولَةً بَيْنَ الْأَغْنِيَاءِ مِنكُمْ ۚ وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانتَهُوا ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ ۖ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ [সূরা হাশর ৭]
থাক বা না থাক, মুসলমানদের মধ্যে যারা জমিতে ফসল ও খাদ্যশস্য ফলায়, তারা উপরে তা ‘বায়তুল মাল’-এর আয়ের অন্যতম একটি উৎস হল এই ‘ওশর’। ইসলামী সরকারের অধিনে জীবন যাপনকারী মুসলমানদের মধ্যে যারা জমিতে ফসল বা খাদ্যশস্য আবাদ করে, তাদের ফলন কেটে আনা কালিন সময় জমির মোট ফলনের যে এক দশমাংশ যাকাত দিতে হয়, তাকে ওশর বলা হয়। ফসল ফলালে সেই ফলনের একটি নির্দিষ্ট অংশ ‘বায়তুল মাল’-এ জমা দেয়া ফরয।
নগদ অর্থ, সোনা-রূপা ইত্যাদির যাকাত আদায় করতে হয় নেসাবের মালিক হলে তার এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর। কিন্তু ‘ওশর’ আদায় করতে হয়, যতবার জমিতে ফসল ও খাদ্যশস্য ফলানো হবে তত বারই।
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ هَلْ مِنْ خَالِقٍ غَيْرُ اللَّهِ يَرْزُقُكُمْ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ فَأَنَّى تُؤْفَكُونَ
– ‘ও হে মানুষ! তোমাদের উপরে আল্লাহ’র নেয়ামতের কথা স্মরণ করো। তিনি ছাড়া অন্য আর কেউ কি সৃষ্টিকর্তা আছে, যে তোমাদেরকে আসমান ও জমিন থেকে রিযক দিবেন। তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই’। [সূরা ফাতির ৩]
http://www.wahiralo.com/article/oshor-o-oshorer-bidhan/?fb_comment_id=1166917893399741_2098987686859419
(২) ‘বায়তুল মাল’-এর আওতাধীন অর্থসম্পদ গুলোকে সরকারী ভাবে বিভিন্ন খাতে শরয়ী পন্থায় ব্যয় ও ব্যবহার করা
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন- آمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَأَنفِقُوا مِمَّا جَعَلَكُم مُّسْتَخْلَفِينَ فِيهِ – ‘ও হে মানুষ! তোমরা ইমান আনো আল্লাহ’র প্রতি ও তাঁর রাসুলের প্রতি এবং তোমাদেরকে যে (রিযকের) ব্যাপারে খলিফা/প্রতিনিধি বানানো হয়েছে তোমরা তা থেকে ব্যয় করো’। [সূরা হাদিদ ৭]
ইমাম কুরতুবী রহ. বলেছেন- دليل على أن أصل الملك لله سبحانه ، وأن العبد ليس له فيه إلا التصرف الذي يرضي الله فيثيبه على ذلك بالجنة . فمن أنفق منها في حقوق الله وهان عليه الإنفاق منها ، كما يهون على الرجل النفقة من مال غيره إذا أذن له فيه – كان له الثواب الجزيل والأجر العظيم . وقال الحسن : مستخلفين فيه بوراثتكم إياه عمن كان قبلكم . وهذا يدل على أنها ليست بأموالكم في الحقيقة ، وما أنتم فيها إلا بمنزلة النواب والوكلاء ، فاغتنموا الفرصة فيها بإقامة الحق قبل أن تزال عنكم إلى من بعدكم . فالذين آمنوا وعملوا الصالحات منكم وأنفقوا في سبيل الله لهم أجر كبير وهو الجنة – ‘’। [তাফসিরে কুরতুবী- ১৭/২৩৮]
‘বায়তুল মালে’র আমদানী ও আয় গুলোকে ব্যয় ও ব্যবহার করারও শরয়ী শর্তশরায়েত রয়েছে, যা ‘দ্বীন-ইসলাম’কে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ থেকে সুস্পষ্ট ভাবে স্বতন্ত্র বৈশিষ্টের অধিকারী করে তোলে। ‘বায়তুল মালে’র ব্যয়-খাত গুলো নিম্নরূপ:-
(১) যাকাত-এর ব্যয় খাত সমূহ :
আল্লাহ তাআলা যাকাতের ব্যয় খাত গুলোকে নিজেই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। খলিফা’র উপরে অপরিহার্য দায়িত্ব হল, তিনি যাকাত’কে আল্লাহ’র বিধিবদ্ধ নিম্নোক্ত নির্ধারিত ৮টি খাতে প্রয়োজন মতো ব্যয় ও ব্যবহার করবেন; এর বাইরে নয়।
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করছেন-
إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَاءِ وَالْمَسَاكِينِ وَالْعَامِلِينَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغَارِمِينَ وَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَابْنِ السَّبِيلِ ۖ فَرِيضَةً مِّنَ اللَّهِ ۗ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ
‘নিশ্চই যাকাত (ব্যয়যোগ্য) শুধুমাত্র ফকির ও মিসকীনদের জন্য এবং একাজে নিয়োজিত আমেলদের জন্য ও মুয়াল্লাফাতুল কুলুব-এর জন্য, এবং দাস-মুক্তিতে ও ঋণগ্রস্থদের (ঋণমুক্তির) কাজে, এবং আল্লাহ’র পথে ও ইবনুস-সাবিল (-এর অভাব মোচনের) কাজে। (এই খাতগুলো) আল্লাহ’র থেকে ফরযকৃত। আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী মহাপ্রজ্ঞাময়’। [সূরা তাওবা ৬০]
যাকাতের উপরোক্ত ৮ টি খাতের বিস্তারিত আলোচনার স্থান-তো এটি নয়। এর জন্য ফুকাহায়ে কেরামের বড় বড় কিতাবে বিস্তারিত ফিকহী আলোচনা দলিল সহ বর্ণিত আছে। এখানে শুধু সামান্য একটু ধারনা দিতে চাই যাতে বিষয়টি মাথায় রেখে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের সাথে তুলনামূলক চিন্তা করা সম্ভব হয়।
(১) ফকির’দের জন্য:- এমন অভাবী যারা বিবেকবোধ ও লজ্জাবসত তাদের অভাবের মানসিক ও দৈহিক দুরাবস্থার কথা মানুষের কাছে মুখফুটে বলতে পারেনা। যেমন: সমাজের অনেক সম্মানীত ব্যাক্তিবর্গ যারা তাদের অল্প আয় দিয়ে অভাব মেটাতে পারেন না, আবার সেই অভাবের কথা কাউকে লজ্জায় বলতেও পারেন না..প্রমুখ। (এখানে ফকির বলতে আমাদের এযুগের ওই ফকিররা উদ্দেশ্য নয়, যারা ভিক্ষার নামে ব্যবসা করে বেড়ায়)।
(২) মিসকীন’দের জন্য: এমন অভাবী যারা বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণে হোক বা কৃত্রিম কারণে অভাবে পড়ে যায়। যেমন: নদী ভাঙ্গনে নিঃস্ব ব্যাক্তি, ব্যবসায়ীক ক্ষতিতে রিক্তহস্ত ব্যাক্তি, গরীব বিধবা নারী যার আয়ের উৎস নেই, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা যাদের সন্তান নেই আয়-উপার্জন করে দেখাশোনা করার মতো… প্রমুখ।
(৩) যাকাত উসূলের কাজে নিয়োজিত কর্মীদের জন্য: খলিফা যাদেরকে মুসলমানদের কাছ থেকে যাকাত উসূল করার বা যাকাতের হিসাব লেখার কাজে নিয়োগ দেন।
(৪) মুয়াল্লাফাতুল ক্বুলুব-এর জন্য (যাদের মনতুষ্টির প্রয়োজন): এরা হতে পারে- (ক) নব-মুসলীম যাদেরকে আর্থিক সহায়তা না করলে দ্বীন ইসলাম ত্যাগ করে পূণরায় কাফের হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়, বা (খ) দূর্বল ইমানের অধিকারী মুসলমান যারা যাদেরকে আর্থিক সহায়তা না করলে দ্বীন ইসলাম ত্যাগ করে অন্য ধর্ম গ্রহন করতে পারে (যেমনটা অনেক ক্ষেত্রে খৃষ্টান/কাদিয়ানী মিশনারীদের দেয়া আর্থিক প্রলোভনে অনেক দূর্বল ইমানের অধিকারী মুসলমানরা খৃষ্টান বা কাদিয়ানী হয়ে যায়), বা (গ) মুনাফেক/দূর্বল ইমানের অধিকারী মুসলমান যারা শুধু অর্থের লোভে কাফেরদের সাথে হাত মিলিয়ে তলে তলে ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষতি সাধনে তৎপর থাকে এবং আর্থিক প্রয়োজন পূরণ হলে তারা এ ধরণের ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে….ইত্যাদি ক্ষেত্রে যাকাতের অর্থ ব্যায় করা যাবে।
(৫) দাস-মুক্তি’র কাজে: মুসলমান দাস বা দাসীদেরকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করার জন্য তাদের মালিকদেরকে মুক্তিমূল্য যাকাত থেকে আদায় করা যাবে।
(৬) ঋণগ্রস্থদের (ঋণমুক্তির) কাজে: যে সকল মুসলমান বিভিন্ন স্বাভাবিক প্রয়োজন পূরণ করতে গিয়ে অভাবে পড়ে ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়ে এবং ঋণ মিটাতে পারে না। যাকাত দিয়ে তাদের ঋণমুক্ত করা যাবে। (উল্লেখ্য, এখানে ব্যবসায়ীক ঋণ উদ্দেশ্য নয়, যেমনটা বহু ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নেয়, তথা ব্যাংকের কাছে ঋণী থাকে। তাদের এজাতীয় ঋণ শোধের কাজে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে না। বরং উল্টো ব্যবসায়ীক ঋণেরও যাকাত আদায় করতে হবে মর্মে মুহাক্কেক ফুকাহায়ে কেরাম মত দিয়েছেন)।
(৭) আল্লাহ’র রাস্তায়: ‘আল্লাহ’র রাস্তা’ বলতে মূলতঃ শরীয়তসম্মত কিতাল/জিহাদ উদ্দেশ্য, যেমনটা বহু আয়াতে ‘আল্লাহ’র রাস্তা’ বলতে কিতাল/জিহাদ উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। যেমন: মুজাহিদগণের অস্ত্র/পোষাক/বাহন/খাদ্যসামগ্রী ইত্যাদি ক্রয়ে বা তাদেরকে যুদ্ধের ট্রেনিং দান কল্পে অর্থের প্রয়োজন হলে তাতে যাকাত থেকে ব্যয় করা যাবে। (শরীয়তসম্মত সকল সৎকাজ আল্লাহ’র রাস্তা হিসেবে গণ্য হলেও, উপরোক্ত আয়াতে ‘আল্লাহ’র রাস্তা’ বলতে পাইকারী হারে সকল সৎকাজ উদ্দেশ্য হতে পারে না। কারণ, যাকাতের বাকি ৭টি খাতও তো সৎ কাজ)। এছাড়াও যেসকল ধ্বনী ব্যাক্তির হজ্জ ফরয হয়ে গিয়েছিল কিন্তু কোনো কারণে আর্থিক সংকটে পড়ে হজ্জের ব্যয়ভাব বহন করতে পারছে না, তাদের হজ্জ আদায়ের জন্য যাকাত থেকে ব্যয় করা যাবে। এমনিভাবে দ্বীন ইসলামের হিফাজত ও বুলন্দীর উদ্দেশ্যে আলেম তৈরীও আল্লাহ’র রাস্তা হিসেবে গণ্য এবং এজন্যও গরীব ত্বালেবে ইলমগণকে যাকাত দিয়ে সাহায্য করা যাবে।..ইত্যাদি
(৮) ইবনুস সাবীল-এর (অভাব মোচনের) কাজে: ইবনুস সাবীল বলা হয় পথিককে। ধ্বনী হোক বা দরিদ্র -উভয় অবস্থাতেই অনেক মুসলমান নর-নারী বিভিন্ন স্থানে গিয়ে যদি ঘটনাক্রমে অভাবে পড়ে যায় এবং গন্তব্যস্থলে পৌছানো ও খাদ্যপানীয়র ব্যবস্থা করতে না পারে, তাহলে সে ক্ষেত্রে তাদেরকে যাকাত থেকে ব্যয় করা যাবে।
কিন্তু ইসলামী শরীয়তের এই মাসআলার বিপরীতে-
(ক) যেহেতু রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে ধর্মীয় বিধানকে ১০০% ছেটে ফেলে দেয়ায় বিশ্বাস (ইমান) রাখা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের অত্যাবশ্যক (ফরয) শর্ত, তাই জবরদখলকারীরাষ্ট্রপ্রধানের অনুগত্যতা স্বীকার ও উৎখাতের প্রশ্নেও ইসলামী শরীয়তের উপরোক্ত শর্তগুলিকেও রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে ১০০% ছেটে ফেলে দেয়ায় বিশ্বাস (ইমান) রাখাও তাদের মতে অবশ্যই অত্যাবশ্যক (ফরয)।
(খ) যেহেতু রাষ্ট্রযন্ত্রে কোনো ধর্মীয় বিধিবিধানকে টেনে আনা ১০০% নিষিদ্ধ (হারাম), তাই জবরদখলকারীরাষ্ট্রপ্রধানের অনুগত্যতা স্বীকার ও উৎখাতের প্রশ্নেও ইসলামী শরীয়তের উপরোক্ত শর্তগুলিকে রাষ্ট্রযন্ত্রে টেনে আনাও তাদের মতে অবশ্যই ১০০% নিষিদ্ধ (হারাম)।
(গ)ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ যেহেতু বিশ্বাস করে-যে ব্যাক্তিধর্মীয় বিধিবিধানকে রাষ্ট্রব্যাবস্থায় টেনে আনায় বিশ্বাসী সে আদপে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদেই বিশ্বাসী নয় বরং অস্বীকারকারী (কাফের), তাই যে ব্যাক্তি জবরদখলকারীরাষ্ট্রপ্রধানের অনুগত্যতা স্বীকার ও উৎখাতের প্রশ্নে ইসলামী শরীয়তের উপরোক্ত শর্তগুলিকেও রাষ্ট্রযন্ত্রে টেনে আনায় বিশ্বাসী, তাদের মতে সেও আদপে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে বিশ্বাসীই নয় বরং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে অস্বীকারকারী (কাফের)।
(ঘ) উপরোক্ত এই ৩টি পয়েন্টের ব্যাপারে খাঁটি ধর্মনিরপেক্ষতা বাদীদেরর ঐক্যমত (ইজমা) রয়েছে।
বাকি আলোচনা পরবর্তী পৃষ্ঠায় দেখুন…>>>
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ: [পৃষ্ঠা ১] , [পৃষ্ঠা ২] , [পৃষ্ঠা ৩] , [পৃষ্ঠা ৪] , [পৃষ্ঠা ৫] , [পৃষ্ঠা ৬] , [পৃষ্ঠা ৭] , [পৃষ্ঠা ৮] , [পৃষ্ঠা ৯] , …
(অথবা) নিম্নে বিষয় ভিত্তিক পেজ-এর পাশে ক্লিক করুন
# ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ একটি ইসলাম বিরোধী মতবাদ এবং কুফরী ফিতনা -কেনো ? [পৃষ্ঠা ১]
১ম বৈশিষ্ট: ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থা -এ বিশ্বাস করা প্রকাশ্য কুরআন-সুন্নাহ‘র বিরোধীতা, আল্লাদ্রহীতা, পথভ্রষ্ঠতা, মুনাফেকী ও কুফরী –কেনো? [পৃষ্ঠা ১]
# রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা’ -এ বিশ্বাস করা কেনো প্রকাশ্য ইসলাম বিরোধীতা, আল্লাদ্রোহিতা, পথভ্রষ্ঠতা, শিরক ও কুফর ? [পৃষ্ঠা ৮] , [পৃষ্ঠা ৯]