বহু বিবাহ আইন : ইসলামী শরীয়াহ বনাম আইয়ূব খানের পাশকৃত আইন – ২য় পৃষ্ঠা
এই আলোচনার পূর্বের অংশ পড়তে <<< এখানে ক্লিক করুন <<<
সন্দেহ এবং ভুল ধারনা
এবারে আমরা ওই সকল সন্দেহ সংশয়ের বিষয়টিকে খঁতিয়ে দেখবো, যা একাধিক বিয়ে সম্পর্কিত আয়াতগুলোর উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। আফসোসের কথা এই যে, আমাদের দেশে যে চিন্তাধারাটি একটি মহামারী আকার ধারন করছে, সেটি হল, পশ্চিমাপুজারী জনাবরা ইসলামের যে বিধানটিকে ‘পশ্চিমা সভ্যতা’র পরিপন্থী দেখতে পান, সেক্ষেত্রে তারা-তো আর নিজেদের মধ্যে এ ঘোষনা দানের সাহস পান না যে, ‘এ ব্যাপারে ইসলামের অমুক উসূল বা মুলনীতির সাথে আমাদের মতবিরোধ রয়েছে’, অপরদিকে তারা যদি পশ্চিমা-মনিবদের সাথে বিরোধ বাঁধাতে যান, তাহলে আবার ওসব মনিবদের অসন্তুষ্টির ভয় তাদেরকে এ কাজ করতে বিরত রাখে। ফলতঃ তারা এ সমস্যার একটি সমাধান এই বেড় করে নিয়েছেন যে, ‘মুখে ইসলামের গুনগান করতে থাকো, কিন্তু ইসলামের যে কথাটি পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে যায়, সেটাকে ইসলামের মূলনীতি মানতেই অস্বীকার করে দাও এবং একাজের জন্য কুরআন-সুন্নাহ’কে যেভাবে ইচ্ছা দুমড়েমুছড়ে রেখে দাও’।
এজাতীয় চিন্তাধারার জনাবরা একইভাবে বহু বিবাহ মাসআলাটির ক্ষেত্রেও এরকম গোজামিল আরোপ করার চেষ্টা চালিয়েছেন(৬), যার দরূন বহু সাদাসিধা মুসলমানও ভুল ধারনার শিকার হয়ে গেছে। তবে এ মাসআলাটির ক্ষেত্রে তাদের সামনে এই একটি সমস্যা দেখা দিয়েছে যে, পবিত্র কুরআন একাধিক বিয়ে করার অনুমতি দিয়েছে একেবারে সোজাসাপটা ভঙ্গিতে। ফলতঃ এই জনাবরা-তো আর স্পষ্ট ভাবে একথা বলতে পারেননা যে, ‘‘কুরআন একাধিক বিয়ের অনুমতি দেয়নি’’। তবে এখানে তারা এই ব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়েছেন যে, ‘‘স্ববিশেষ মুহূর্তে এবং জরুরী বা এমারজেন্সি (Emergency) অবস্থায় একাধিক বিয়ে করা জায়েয; সর্বাবস্থায় জায়েয নয়। যখন সমাজ জীবনে এতীম মেয়ে ও বিধবা নারীর সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে, তখন তাদের দুঃখ-দুর্দশা দূর করার জন্য একাধিক বিয়ের অনুমতি রয়েছে। কিন্তু যখন এ সকল এতীম ও বিধবা নারীদের কোনো সমস্যা সামনে আসবে না, তখন আমরা একাধিক বিয়েকে জায়েয বলি না’’।
এখন একথা বলার জন্য এই জনাবরা কুরআন কারিমের আয়াতগুলির সাথে কি আচরনটা করেছেন, তার অনুমান আপনারা করতে পারবেন নিম্নক্ত আলোচনায়।
একাধিক বিয়ে জায়েয হওয়ার ব্যাপারে কুরআন কারিমের এ আয়াতটি অত্যন্ত পরিস্কার-
এ আয়াত প্রসঙ্গে সাহাবায়ে কেরামদের থেকে যেসকল তাফসির বর্ণিত হয়েছে, আমরা আলোচনার শুরুর দিকে তা উল্লেখ করে এসেছি। আয়াতের উপরোক্ত অনুবাদটি আমরা হযরত আয়েশা রা.-এর তাফসির মোতাবেক করেছি। কিন্তু এসব জনাবরা আয়াতের এই অর্থের পরিপন্থী এমন এক অর্থ বর্ণনা করেন, যা না বিবেকগত দিক থেকে সঠিক, আর না আরবী সরফ্ , নাহু ও উসূলে বালাগাত সম্পর্কে যার সামান্যতম জানাশোনা আছে, সে এমন অর্থ কল্পনা করতে পারে; তদুপরি তাদের এ অর্থটি সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন ও ওলামায়ে উম্মতের তাফসিরের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। তাদের এ তাফসিরের বিপরীতে এত রেওয়ায়েত বর্ণিত রয়েছে যে, সম্ভবতঃ তা বর্ণনা করাও মুশকিল।
তারা আয়াতটির অনুবাদ করেন এভাবে-
‘আর যদি তোমাদের এই আশংকাবোধ হয় যে, তোমরা যুবতী এতীম মেয়ে এবং বিধবা মহীলাদের সাথে ইনসাফ করতে পারবে না, তাহলে উল্লেখীত (এসব) নারীদের থেকেই যাকে যাকে তোমাদের পছন্দ হয়, তাদের দু’জন, তিনজন এবং চার জনকে (পর্যন্ত) বিয়ে করে নিতে পারো’।
এই অনুবাদের মধ্যে কুরআনে কারীমের الْيَتَامَىٰ (এতীম মেয়ে) শব্দটির সাথে এই অবিচার করা হয়েছে যে, তারা এর দ্বারা শুধুমাত্র ‘যুবতী মেয়ে এবং বিধবা মহীলা’ অর্থ নিয়েছেন !!! এর সাথে দ্বিতীয় অত্যাচার এই করেছেন যে, সামনের النِّسَاء (নারীরা) অথাটির তারা অর্থ নিয়েছেন ‘এসব উল্লেখীত নারীরা’ই অর্থাৎ ‘এতীম মেয়ে এবং বিধবা মহীলা ! এর পর আয়াতটির তাফসিরে বলেছেন:-
‘কুরআন কারিম যে একাধিক বিয়েকে এই শর্ত সাপেক্ষে অনুমতি দিয়েছে যে, ‘যদি তোমাদের সমাজ জীবনে এতীম মেয়ে এবং বিধবা মহীলাদের সাথে সুবিচার ও ইনসাফ করতে না পারার আশংকা দেখা দেয়, (শুধুমাত্র) তখনই একাধিক বিয়ের অনুমতি রয়েছে’ -এ কথাটিকে কি করে এড়িয়ে যাওয়া চলে? উসূলের প্রসিদ্ধ নীতি হল اذا فات الشرط فات الشروط (যখন মূল শর্ত বিলুপ্ত হয়ে যায়, তখন যাবতীয় শর্তাধীন বিষয়গুলোও বাতিল হয়ে যায়)। এখন আমাদেরকে প্রথমে দেখতে হবে, বর্তমানকার সমাজ জীবনে এতীম মেয়ে ও বিধবা মহীলাদের এমন কোনো সমস্যা সামনে আসছে কি-না, যার ফলশ্রুতিতে তাদেরকে দেখাশোনা করা বা তত্ত্বাবধায়নে নেয়া ছাড়া তাদের চলবেই না। যদি গোড়াতেই এই সমস্যা দেখা না দেয়, তাহলে কুরআন কারিমের এই অনুমতি থেকে ফায়দা লাভ করার কি অধিকারটাই-বা আমাদের আছে’’?!
এর জবাব
কিন্তু এক্ষেত্রে তারা তাদের এই ‘স্ব-মতপ্রসূত উদ্ভাবিত জ্ঞানে’র ভিত্তি রেখেছেন একথার উপর যে, ‘‘উপরোক্ত আয়াতে الْيَتَامَىٰ (এতীম নারীরা) এবং النِّسَاء (নারীগণ) দ্বারা একই নারীদেরকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে’’ !
বস্তুতঃ এটা কুরআন কারিমের উপর এমন প্রকাশ্য একটি অপবাদ, যদি একে সঠিক বলে মেনে নেয়া হয়, তাহলে একথা অবিশ্বম্ভাবী হয়ে দাঁড়াবে যে, কুরআন কারিমের আয়াতগুলি নিজেস্ব فصاحت (বচনভঙ্গি) ও بلاغت (ভাষালঙ্কার) এর মাপকাঠি থেকে ধ্বসে পড়েছে ! (নাঊযুবিল্লাহ) কেননা, যদি النِّسَاء (নারীগণ) দ্বারা ওই এতীম নারীগণই উদ্দেশ্য হত, তাহলে অবশ্যই একথা বলা হত যে- وَإِنْ خِفْتُمْ أَلَّا تُقْسِطُوا فِي الْيَتَامَىٰ فَانكِحُوا مَا طَابَ لَكُم مِّنَهن – “আর তোমরা যদি এই আশংকাবোধ করো যে, এতিম নারীদের প্রতি ইনসাফ করতে পারবে না, তাহলে, তাহলে তাদেরই মধ্য থেকে যাদেরকে তোমাদের পছন্দ হয়, তাদের বিয়ে করে নাও”। অর্থাৎ এমনটা হলে তখন النِّسَاء (নারীগণ) শব্দটি উল্লেখ করার পরিবর্তে ‘এতীম নারী’দেরকে উদ্দেশ্য করে (مِّنَهن) ‘সর্বনাম’ জুড়ে দেয়া হত।
যদি তাদের কথাকে সঠিক বলে গ্রহন করে নেয়া হয়, তাহলে (আয়াতটির মধ্যে) এসব নারীদের কথা যখন একবার এসেই গেছে, তখন স্পষ্টত:ই এখানে তাদের আর উল্লেখ না হওয়াই উচিৎ ছিল; বরং এটা ছিল সর্বনাম ব্যবহারের স্থল। আর ভাষালঙ্কার শ্বাস্ত্রের গ্রহনযোগ্য মূলনীতি অনুসারে ‘সর্বনাম’ এর স্থলে ‘নাম-বিশেষ্য’ ব্যবহার করা বাচন ভঙ্গির পরিপন্থী। যেমন: আপনি যদি বলেন যে- ‘আমার কাছে খালেদ এসেছিল এবং খালেদ আমার কাছে কিছু অর্থ চেয়েছিল’ -তাহলে এটা হবে বাচনভঙ্গি এবং ভষালঙ্কার নীতির পরিপন্থী। এক্ষেত্রে বলা উচিৎ ‘আমার কাছে খালেদ এসেছিল এবং সে আমার কাছে কিছু অর্থ চেয়েছিল’। একই ভাবে, যদি বলা হয় ‘তোমরা যদি এই আশংকাবোধ করো যে, এতীম নারীদের প্রতি ইনসাফ করতে পারবে না, তাহলে এতীম নারীদের মধ্য থেকেই তোমরা বিয়ে করে নাও’ -তাহলে এটাও হবে বাচনভঙ্গির পরিপন্থী। এখানে বলা উচিৎ ‘তোমরা যদি এই আশংকাবোধ করো যে, এতীম নারীদের প্রতি তোমরা ইনসাফ করতে পারবে না, তাহলে তাদের মধ্য থেকেই তোমরা বিয়ে করে নাও’।
যদি এভাবে বলা না হয়, তাহলে আয়াতের অর্থ ও তাৎপর্য অন্য রকম পরিগ্রহ করবে। কিন্তু কুরআন কারিম এমনটা করেনি। এ থেকে বোঝা গেলো, এখানে النِّسَاء (নারীগণ) দ্বারা ওই এতীম নারীরাই উদ্দেশ্য নয়; বরং উদ্দেশ্য হল তারা বাদে অপরাপর নারীগণ। যদি এ কথা গ্রহন করে নেয়া না হয়, তাহলে (আল্লাহ’র পানাহ) আল্লাহ তাআলার ‘কালামের’ ভাষালংকারহীন হওয়াটা অবধারিত হয়ে পড়ে -যা সম্পূর্ণ অবাস্তব, সম্পূর্ণ অসম্ভব। কুরআন তো বারংবার এই চ্যালেঞ্জই করে থাকে যে, কোনো মাখলুক এই কালামের চেয়ে উন্নত মানের ‘কালাম’ নিয়ে আসতে পারবে না। আর বাস্তবিকই আজ পর্যন্ত কোনো বড় থেকে বড় সাহিত্যিকও কুরআনের বাচনভঙ্গি ও অলঙ্কার শ্বাস্ত্রের উপর কখনো আগুল রাখারও দুঃসাহস করে নি।
তাছাড়া এ বিষয়টিও এখানে গভীর চিন্তা করে দেখার মতো যে, আল্লাহ তাআলা এখানে النِّسَاء (নারীগণ) শব্দটিকে ব্যবহার করলেন কেনো ? গভীরভাবে চিন্তা করে দেখলে বোঝা যায়, এখানে النِّسَاء (নারীগণ) শব্দটি ব্যবহার করে এই সন্দেহের অপনোদন ঘটানোরই উদ্দেশ্য ছিল যে, একাধিক বিয়ের অনুমতিটা শুধুমাত্র এতীম নারীদের সাথে নিদিষ্ট মনে না করা চাই। আর তাই আল্লাহ তাআলা এমন একটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ ব্যবহার করেছেন, যা এতীম অ-এতীম উভয়কেই অন্তর্ভূক্ত করে নিয়েছে।
তদুপরি (৭)হযরত আয়েশা রা. আলোচ্য আয়াতের তাফসিরে একথা স্পষ্ট করেই বলেছেন যে, এখানে النِّسَاء (নারীগণ) দ্বারা এতীম নারীরা উদ্দেশ্য রয়; বরং অপরাপর নারীরা উদ্দেশ্য। এ আয়াতের শানে নজুল প্রসঙ্গে তিনি যে ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন, তা সন্দেহ সংশয়ের অপরাপর সমস্ত পথ বন্ধ করে দেয়।
শর্ত ও শর্তাধীন বিষয়ের ফয়সালা
থাকলো একথা যে, ‘‘আলোচ্য আয়াতে একাধিক বিয়েকে এই শর্তের সাথে শর্তাধীন করে দেয়া হয়েছে যে- ‘যদি এতীম নারীদের সাথে বেইনসাফী করার সংশয় দেখা দেয়’। তাই যখন এতীম নারীদের সমস্যা সৃষ্টি হবে, তখন একাধীক বিয়ে জায়েয হবে; অন্যথায় নয় ! ”
বস্তুতঃ এ কথাটি কথোকের জ্ঞানবোধ এবং উপলব্ধি শক্তির ব্যপারে বেশ বড় সড় একটি সিদ্ধান্ত দাঁড় করিয়ে দেয় বৈকি ! কথাটি যদি সঠিকই হয়, তাহলে-তো এর চাহিদা এই দাঁড়ায় যে, যে পর্যন্ত এতীম নারীদের সমস্যাটি পেশ না হবে, সে পর্যন্ত একজন নারীকেও বিয়ে করা জায়েয নয়। কেননা, উক্ত আয়াতের মধ্যে যেখানে ‘একাধিক বিয়ে’কে উপরোক্ত শর্তের সাথে শর্তাধীন রাখা হয়েছে, সেখানে খোদ্ ‘বিয়ে করাটা’কেও-তো ওই একই শর্তের সাথেই শর্তাধীন রাখা হয়েছে। দেখুন, আয়াতটি তো বলছে-
এখানে (একাধিক বিয়ে করার) শর্তের পয়লা শর্তাধীন বিষয়টি-তো খোদ বিয়ে’ই ; একাধিক বিয়ের কথা তো পরে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং, আপনার যুক্তিদর্শন অনুসারে আয়াতের অর্থ এই হওয়া উচিৎ যে- ‘‘একটি বিয়ে করাও জায়েয হবে তখন, যখন এতীম নারীদের হক্ব ও অধিকার নষ্ট হওয়ার আশংকা বিদ্যমান থাকবে। যদি কোনো যুগে এতীমদের এই সমস্যাটির উদ্ভব না ঘটে, কিংবা ঘটলেও তাদের হক্ব ও অধিকার নষ্ট হবার কোনো আশংকা না থাকে, তাহলে এই মর্মে অর্ডিনেন্স জারি করে দেয়া উচিৎ যে, ‘কোনো ব্যক্তি একটি বিয়েও করতে পারবে না। অন্যথায় তাকে জেলে পাঠিয়ে দেয়া হবে, তার উপর জরিমানা করা হবে, কিংবা উভয় শাস্তিই দান করা হবে’’!
এ বিষয়টি ছাড়াও আল্লাহ তাআলা সামনে যে এরশাদ করেছেন-
আপনার বক্তব্য অনুসারে তাহলে এর এই অর্থ দাঁড়াবে যে, ‘একজন নারীকে বিয়ে করা জায়েয হবে তখন, যখন কারোর এই সংশয় দেখা দিবে যে, আমি একাধিক স্ত্রীর মাঝে ইনসাফ করতে পারবো না’। অপরদিকে যদি এই আশংকা না থাকে এবং কেউ যদি তার নিজের উপরে এই ভরসা করতে পারে যে, আমি একাধিক স্ত্রীর সাথে ইনসাফ করতে পারবো, তাহলে উক্ত ব্যাক্তির জন্য একজন মাত্র স্ত্রীর উপর ক্ষ্যান্ত হওয়া উচিৎ নয়, বরংচ তার চারজন নারীকে বিয়ে করে নেয়া কর্তব্য’ ! কেননা, কুরআন কারিমে একজন নারীকে বিয়ে করার কথাটি বে-ইনসাফী করার সংশয়ের সাথে শর্তযুক্ত রাখা হয়েছে ! আর (আপনি-তো নিজেই বলেছেন যে) اذا فات الشرط فات الشروط (যখন মূল শর্ত বিলুপ্ত হয়ে যায়, তখন যাবতীয় শর্তাধীন বিষয়গুলোও বাতিল হয়ে যায়)। সুতরাং, (আপনার) এ দৃষ্টিভঙ্গির চাহিদা এই যে, যদি এমন কোনো যুগ আসে, যে যুগে সমস্ত মানুষ ইনসাফ প্রিয়, একজন জালেমও নেই, তাহলে সে যুগে এই অর্ডিনেন্স জারি হওয়া উচিৎ যে, ‘‘কোনো ব্যক্তি চারজন নারীর কমে বিয়ে করতে পারবে না ! এর অন্যথা হলে সে আইনের চোখে একজন মস্তবড় অপরাধী সাব্যস্ত হবে’ ! (আপনার দেখানো উসূল মতে) যখন ‘বে-ইনসাফী’র আশংকাই নিশ্বেস হয়ে গেল, তখন একজন নারীর উপর ক্ষ্যান্ত হওয়ার বিধানটিও নিশ্বেস হয়ে গেল’।
আপনি যদি একথা মেনে নিতে প্রস্তুত থাকেন, তাহলে-তো নিঃসন্দেহে আপনার এই হক্ব রয়েছে যে, একাধিক বিয়ের অনুমতিটিকেও আপনি এতীম নারীদের হক্ব ও অধিকার নষ্ট করা আশংকার সাথে শর্তযুক্ত করে দিবেন। কিন্তু আপনি যদি একথা মেনে না নেন, তাহলে এর কি অর্থ হয় যে, একাধিক বিয়েকে-তো আপনি এর শর্তের সাথে শর্তযুক্ত করে দিচ্ছেন, অন্যদিকে একই আয়াতের মধ্যেই ‘বিয়ে’র উপর যে শর্ত সংযুক্ত হয়ে আছে, সেটাকে একদম অর্থহীনভাবে ছেড়ে দিচ্ছেন, তদুপরি এর সামনে উল্লেখীত একজন স্ত্রীর উপর ক্ষ্যান্ত থাকাকে যে শর্তের সাথে শর্তযুক্ত করে দেয়া হয়েছে, সে শর্তটিকেও আপনি অনর্থক বলে ঘোষনা দিচ্ছেন ? আপনি একাধিক বিয়ে করার উপর-তো এই পদশৃঙ্খল লাগিয়ে দিচ্ছেন যে, এটা এতীম নারীদের উদ্ভুত সমস্যার সাথে নির্দিষ্ট, কিন্তু আপনি একজন নারী বিয়ে করাকে কোনো শর্তাধীন বিষয় হিসেবে ঘোষনা দিচ্ছেন না ? অথচ কুরআন কারিমে যেখানে একাধিক বিয়ের পূর্বে একটি শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে খোদ্ ‘বিয়ে’ এবং ‘একটি মাত্র বিয়ের উপর ক্ষ্যান্ত’ থাকার বিষয়টিকেও এভাবে শর্তযুক্ত করে দেয়া হয়েছে যে- فَإِنْ خِفْتُمْ أَلَّا تَعْدِلُوا فَوَاحِدَةً – ‘পরন্তু (এতেও) যদি তোমরা আশংকাবোধ করো যে, তোমরা (দই,তিন, বা চার জন স্ত্রীর মাঝে) ন্যায়বিচার করতে পারবেনা, তাহলে একজন (-এর উপরই ক্ষ্যান্ত থাকো)’।[সূরা নিসা ৩]
আসল কথা
এ-তো ছিল এসব জনাবদের বক্তব্যের উপর একটি অভিযোগ ও নীতিগত প্রতিবাদ, যার জবাব এরা কেয়ামত পর্যন্ত দিতে পারবে না। এবারে আপনারা- اذا فات الشرط فات الشروط (যখন মূল শর্ত বিলুপ্ত হয়ে যায়, তখন যাবতীয় শর্তাধীন বিষয়গুলোও বাতিল হয়ে যায়) -‘এর আসল অর্থ ও তাৎপর্য কী এবং এই নিয়মটি কোন স্থানে তার নিজেস্ব ভূমিকা রাখে’– তার ইলমী হাক্বীক্ব বোঝার চেষ্টা করুন।
যে পর্যন্ত এই (ফিকহী) নীতির সম্পর্ক তাতে কথা হল, তা নিঃসন্দেহে স্বস্থানে সঠিক। তবে নীতিটি প্রথমতঃ তো ‘কুল্লিয়াহ’ নয় (তথা সর্বক্ষেত্রেই ব্যাপকভাবে প্রযোজ্য হবে -এমন নয়), দ্বিতীয়তঃ কখনো কখনো এমনও হয় যে, বাহ্যতঃ একটি বাক্যকে তার পূর্বে আগত কোনো শর্তের সাথে শর্তাধীন (বাক্য) ও ফলাফল বলে মনে (৮) হয় বটে, কিন্তু আসলে তা সেই বাক্যের কোনো ফলাফল নয়; বরং বাক্যের মূল ফলাফলটি (বাক্যের মধ্যে উহ্য ও প্রচ্ছন্ন আকারে) বিদ্যমান থাকে; (দৃশ্যত:) সংযুক্ত থাকে না। আরবী নাহু শ্বাস্ত্রের পরিভাষায় এ ধরনের বাক্যকে دال بر جزا বলা হয়ে থাকে। কুরআন কারিমে এর অসংখ্য নমুনা রয়েছে, যার মধ্য থেকে কয়েকটি নমুনা নিম্নে পেশ করা হল:-
হযরত ঈসা আ. আল্লাহ তাাালার কাছে তার উম্মত সম্পর্কে বলছেন- إِن تُعَذِّبْهُمْ فَإِنَّهُمْ عِبَادُكَ ۖ وَإِن تَغْفِرْ لَهُمْ فَإِنَّكَ أَنتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ –‘‘(হে আল্লাহ !) আপনি যদি তাদেরকে শাস্তি দেন, তাহলে তারা-তো আপনারই বান্দা। আর যদি আপনি তাদেরকে ক্ষমা করে দেন, তাহলে আপনি মহাপরাক্রমশালী, মহাবিজ্ঞ”। [সূরা মায়েদাহ ১১৮]
কোনো বিবেকবান কি এর এই অর্থ নিতে পারে যে, ‘‘আপনি যদি তাদেরকে শাস্তি না দেন, তাহলে (নাউযুবিল্লাহ) এরা আপনার বান্দা নয়’’; অথবা ‘‘আপনি যদি তাদেরকে ক্ষমা না করেন, তাহলে (নাউযুবিল্লাহ) আপনি মহাপরাক্রমশালী মহাবিজ্ঞ নন’’ ?
এমনিভাবে রাসুলুল্লাহ সা.-এর পবিত্র স্ত্রীগণকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ তাআলা বলছেন- وَإِن تَظَاهَرَا عَلَيْهِ فَإِنَّ اللَّهَ هُوَ مَوْلَاهُ ‘‘সুতরাং, তোমরা যদি তাঁর (অর্থাৎ রাসুলুল্লাহ’র ) বিপক্ষে একত্রিত হও, তাহলে আল্লাহ কিন্তু তাঁর অবিভাবক”। [সূরা তাহরীম ৪]
কোনো ব্যক্তি কি এ থেকে এই অর্থ নিতে পারে যে, ‘‘তোমরা যদি একত্রিত না হও, তাহলে আল্লাহ তাআলা, তাঁর অবিভাবক নন’’?
বস্তুুতঃ যদি (বাক্যের মধ্যে) শর্ত ও শর্তাধীন ব্যপার স্যপারের ওই ভাসাভাসা তর্কতর্কি চালানো যায়, তাহলে এর এরকম অর্থই বেড় হবে বৈকি।
এদুটি-তো ছিল ওই বিষয়ের নমুনা, যেখানে اذا فات الشرط فات الشروط (যখন মূল শর্ত বিলুপ্ত হয়ে যায়, তখন যাবতীয় শর্তাধীন বিষয়গুলোও বাতিল হয়ে যায়) -নীতিটির বাস্তব প্রয়োগিক রূপ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এবারে ওই নমুনার দিকে লক্ষ্য করুন, যেখানে (বাক্যের) মূল ফলাফলটি (বাক্যের মধ্যে) বাহ্যত সংযুক্ত নেই বটে, কিন্তু তা কার্যতই (বাক্যের) শর্তের সাথে (প্রচ্ছন্ন ও উহ্য আকারে) শর্তযুক্ত অবস্থায় রয়েছে।
فَإِنْ خِفْتُمْ أَلَّا تَعْدِلُوا فَوَاحِدَةً
‘পরন্তু (এতেও) যদি তোমরা আশংকাবোধ করো যে, তোমরা (দই,তিন, বা চার জন স্ত্রীর মাঝে) ন্যায়বিচার করতে পারবেনা, তাহলে একজন (-এর উপরই ক্ষ্যান্ত থাকো)’।[সূরা নিসা ৩]
এ আয়াতের অর্থ ও তাৎপর্য সুস্পষ্ট। এখানে কেউ একথা বলতে পারে না যে, যদি বে-ইনসাফীর আশংকা না থাকে , তাহলে একজন নারীকেও বিয়ে করা জায়েয নয় ! বস্তুত: এক্ষেত্রে কেউই একথা অস্বীকার করতে পারে না যে, এখানে বাক্যের মূল ফলাফলটি (উহ্য ও প্রচ্ছন্ন আকারে বাক্যের ভিতরে) বিয়োজিত অবস্থায় রয়েছে; (দৃশ্যত: বিদ্যমান নেই)। বাস্তবে কথাটি এরকম ছিল – فَإِنْ خِفْتُمْ أَلَّا تَعْدِلُوا فَلا تَكِحُوا مَثْنَىٰ وَثُلَاثَ وَرُبَاعَ بَل فَا نكِحُوا واحدة – আর তোমরা যদি এই আশংকাবোধ করো যে, ইনসাফ করতে পারবে না, তাহলে তোমরা দুই, তিন, চার জনকে বিয়ে করতে যেও না, বরং একজনকে বিয়ে করে(-ই ক্ষ্যান্ত হও) ।
এখানে (মূল বাক্যের বাইরে) যে কথাগুলোকে অতিরিক্তভাবে আন্ডারলাইন করে সংযুক্ত করা হয়েছে, সে কথাগুলো মূলতঃ (মূল বাক্যের) শর্তের সাথে শর্তাধীনভাবে (উহ্য ও প্রচ্ছন্ন আকারে) রয়েছে; অার (মূল বাক্যের) আসল ফলাফল এটাই। নিঃসন্দেহে বাক্যের এই (উহ্য ও প্রচ্ছন্ন) শর্তাধীন অংশটি তার পূর্বের শর্তের উপর মুরাত্তাব। তাই কোনো ব্যক্তির জন্য একের অধিক বিয়ে কর নিষিদ্ধ হয় তখন, যখন সে বে-ইনসাফী করার আশংকাবোধ করে। কিন্তু যদি বে-ইনসাফী করার আশংকা না থাকে, তাহলে একাধিক বিয়ে করা জায়েয। রইলো সামনের বাক্যাংশটুকু فَوَاحِدَةً ‘‘তাহলে একজন (স্ত্রীর উপরই ক্ষন্ত থাকো)’। বস্তুত: এ অংশটি তার পূর্ববর্তী শর্তের সাথে শর্তযুক্ত অবস্থায় বিদ্যমান নয়। এজন্য একজন নারীকে বিয়ে করা সর্বাবস্থায়ই জায়েয -চাই একাধিক স্ত্রীর মাঝে বে-ইনসাফী করার আশংকা থাক, চাই না থাক।
ঠিক এই ঘটনাটাই ঘটেছে এর পূর্ববর্তী আয়াতে কারিমাটিতে, যা এখন আমাদের আলোচ্য বিষয়। অর্থাৎ, এ আয়াতটির ফলাফলটিও মূলত: (উহ্য ও প্রচ্ছন্ন আকারে বাক্য থেকে) বিয়োজিত অবস্থায় ছিল। হযরত আয়েশা রা.-এর বক্তব্য মোতাবেক আয়াতটি মূলতঃ এভাবে ছিল- وَإِنْ خِفْتُمْ أَلَّا تُقْسِطُوا فِي الْيَتَامَىٰ فَلاَ تَنكِحُوهن بَل فَانكِحُوا مَا طَابَ لَكُم مِّنَ النِّسَاءِ مَثْنَىٰ وَثُلَاثَ وَرُبَاعَ –‘আর তোমরা যদি এই আশংকাবোধ করো যে, এতিম নারীদের মধ্যে ইনসাফ করতে পারবে না, তাহলে তোমরা তাদেরকে বিয়ে করো না, বরং তোমরা বিয়ে করে নিতে পারো –(অন্য) নারীদের মধ্যে থেকে- যাদেরকে তোমাদের পছন্দ হয় -দুই, তিন, চার জনকে (পর্যন্ত)।
এক্ষেত্রেও আন্ডালাইনকৃত কথাগুলো মূলতঃ ছিল (বাক্যটির উহ্য ও প্রচ্ছন্ন) ফলাফল এবং তা বাস্তবেই তার পূর্বের শর্তের সাথে শর্তযুক্ত হয়ে রয়েছে। এতিম নারীদের সাথে বিয়ে জায়েয না হওয়ার বিষয়টি ‘তাদের হক্ব ও অধিকার নষ্ট করার আশংকা বিদ্যমান থাকা’র শর্তের সাথে শর্তযুক্ত অবস্থায় রয়েছে। যদি তাদের অধিকার নষ্টের আশংকা বিদ্যমান না থাকে, তাহলে তাদেরকে বিয়ে করা জায়েয।
রইলো সামনের একথাটি فَانكِحُوا مَا طَابَ لَكُم مِّنَ النِّسَاءِ مَثْنَىٰ وَثُلَاثَ وَرُبَاعَ -‘ তোমরা বিয়ে করে নিতে পারো –(অন্য) নারীদের মধ্যে থেকে- যাদেরকে তোমাদের পছন্দ হয় -দুই, তিন, চার জনকে (পর্যন্ত)।’। বস্তুতঃ এখানে একথাটি উল্লেখীত শর্তের সাথে শর্তযুক্ত নয়। অন্যথায় একে যদি এর সামনের শর্তের সাথে শর্তযুক্ত বলে মেনে নেয়া হয়, তাহলে এর চাহিদা এই দাঁড়ায় যে, যতক্ষন পর্যন্ত না এতিম নারীদের সমস্যাটি উদ্ভুত হয়, ততক্ষন পর্যন্ত একটি বিয়ে করাও আর জায়েয থাকে না ! বস্তুতঃ এটা এমন একটি কথা, যা কেউই গ্রহন করতে পারে না।
আমরা একথা নিছক আমাদের পক্ষ থেকে বলছি না, বরং সাহাবা ও তাবেয়ীনে কেরামের পক্ষ থেকে এ আয়াতের তাফসীর বর্ণিত আছে। তাঁরা সকলেই এক্ষেত্রে (বাক্যটির) একটি (উহ্য ও প্রচ্ছন্ন) ফলাফল চয়ন করেছেন এবং فَانكِحُوا (তাহলে তোমরা বিয়ে করে নিতে পারো) -কথাটিকে তারা শর্তটির মূল শর্তাধীন বিষয় বলে মানেন নি। হযরত আয়েশা রা. বলেছেন-
هي اليتيمة تكون في حجر وليها تشاركه في ماله فيعجبه مالها وجمالها فيريد وليها أن يتزوجها بغير أن يقسط في صداقها فيعطيها مثل ما يعطيها غيره فنهوا أن ينكحوهن إلا أن يقسطوا لهن ويبلغوا بهن على سنتهن من الصداق وأمروا أن ينكحوا ما طاب لهم من النساء سواهن – এই আয়াতটি ওই এতিম মেয়ের কথা বলছে, যে তার অভিভাবকের (তত্ত্বাবধানে লালিতো পালিতো হত এবং তার) হুজরায় থাকতো এবং….। তার অভিভাবকের কাছে ওই মেয়ের সম্পদ ও রূপলাবন্য পছন্দসই মনে হলে সে তাকে বিয়ে করতে চাইতো। কিন্তু অন্যরা দেনমোহরের ক্ষেত্রে যেভাবে ইনসাফ করে, সে ওই মেয়েকে ভরনপোষন ও দেনমোহর প্রদানের ব্যাপারে ওভাবে ইনসাফের সাথে আমল করার ইচ্ছা পোষন করতো না। ফলতঃ এ সকল অভিভাবকদেরকে এরকম এতিম মেয়েদেরকে বিয়ে করতে নিষেধ করে দেয়া হয়েছে। তবে তারা যদি তাদের সাথে ইনসাফ করে এবং দেনমোহরের ক্ষেত্রে তাদের হক্ব পুরোপুরি আদায় করে, তাহলে ভিন্ন কথা। (এর সাথে) তাদেরকে এই নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা যেন এসব এতিম মেয়েদেরকে বাদ দিয়ে বরং অপরাপর (হালাল) নারীদের মধ্য থেকে যাকে যাকে পছন্দ হয়, বিয়ে করে নেয়। [সহিহ মুসলীম, হাদিস ৩০১৮; সহিহ বুখারী-৮/২৩৯ ; সুনানুল কুবরা, বাইহাকী- ৭/২২৯, হাদিস ১৩৮১০; মা’রিফতুস সুনান, বাইহাকী, হাদিস ৪১১৭; তাফসীরে তাবারী; ইবনে জারীর- ৪/১৪৪](৯)
এই রেওয়ায়েতটিতে হযরত আয়েশা রা. যে বলেছেন- ‘এ সকল অভিভাবকদেরকে এরকম এতিম মেয়েদেরকে বিয়ে করতে নিষেধ করে দেয়া হয়েছে’ -এর অর্থ এই যে, মূলতঃ এই নিষেধাজ্ঞাটাই উল্লেখীত শর্তের (উহ্য) ফলাফল। এছাড়া এর অর্থ আর কি হতে পারে ? কেননা, যদি (বাক্যের এই উহ্য) ফলাফলটিকে (বাক্য থেকে প্রচ্ছন্ন আকারে) বিয়োজিত অবস্থায় রয়েছে বলে মেনে নেয়া না হয়, তাহলে আয়াতের কোন্ বাক্য থেকে তাদের সাথে বিয়ের নিষেধাজ্ঞা জনিত হুকুমের কথা প্রমাণিত হতে পারে ?
২) ইমামুল মুফাসসিরীন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এই আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে বলেছেন-
وَإِنْ خِفْتُمْ أَلاَّ تُقْسِطُواْ فِي اليتامى } أن لا تعدلوا بين اليتامى في حفظ الأموال فكذلك خافوا أن لا تعدلوا بين النساء في النفقة والقسمة وكانوا يتزوجون من النساء ما شاؤوا تسعاً أو عشراً وكان تحت قيس بن الحارث ثمان نسوة فنهاهم الله عن ذلك وحرم ما فوق الأربعة فقال { فانكحوا مَا طَابَ لَكُمْ } فتزوجوا ما أحل الله لكم { مِّنَ النسآء مثنى وَثُلاَثَ وَرُبَاعَ } يقول واحدة أو اثنتين أو ثلاثاً أو أربعاً لا يزاد على ذلك { فَإِنْ خِفْتُمْ أَلاَّ تَعْدِلُواْ } بين أربع نسوة في القسمة والنفقة { فَوَاحِدَةً } فتزوجوا امرأة واحدة حرة
অর্থাৎ, وَإِنْ خِفْتُمْ أَلَّا تُقْسِطُوا فِي الْيَتَامَىٰ (আর তোমরা যদি এই আশংকাবোধ করো যে, এতিম নারীদের মধ্যে ইনসাফ করতে পারবে না) –এর অর্থ হল, ‘‘তোমরা যদি এতিম নারীদের ধনসম্পদ (শরয়ী পন্থায়) হেফাজত করে রাখার ব্যাপারে আশংকাবোধ করো, একইভাবে তোমরা যদি অপরাপর নারীদের মাঝে অন্ন বস্ত্র ও ব্যয়ভার বন্টন করার ক্ষেত্রেও ইনসাফ করতে না পারার আশংকাবোধ করো’’। আরব’রা -নয়’জন, দশজন -(যার) যতজন নারীকে ইচ্ছা বিয়ে করে নিতো। কায়েস বিন হারেছের অধিনে ছিল আটজন স্ত্রী। এতে করে আল্লাহ তাআলা এ কাজ করতে তাদেরকে নিষেধ করে দেন এবং চারজনের অধিক (নারীকে বিয়ে করা তাদের উপর) হারাম করে দেন। তিনি এরশাদ করেন- فَانكِحُوا مَا طَابَ لَكُم….الخ (তাহলে তোমরা বিয়ে করে নিতে পারো –(অন্য) নারীদের মধ্যে থেকে- যাদেরকে তোমাদের পছন্দ হয়…..আয়াতের শেষ পর্যন্ত)। [তানউইরুল মিকবাস মিন তাফসীরে ইবন আব্বাস- ১/৮২](১০)
এখানেও হযরত ইবনে আব্বাস রা. যে বলেছেন- ‘‘তোমরা যদি অপরাপর নারীদের মাঝে ইনসাফ করতে না পারার আশংকাবোধ করো’’ এবং ‘‘আল্লাহ তাআলা চারজনের অধিক নারীকে বিয়ে করাকে তাদের উপর হারাম করে দিয়েছেন’’ -এরও অর্থ ও তাৎপর্যও এটাই যে, (বাক্যটির) ফলাফল বাস্তবে এটাই ছিল এটাই, যা (আয়াতে) উহ্য ও প্রচ্ছন্ন আকারে রাখা হয়েছে। অন্যথায় এ কথা বলাই বাহুল্য যে, আল্লাহ তাআলা আয়াতের কোথায়ও (স্পষ্ট বাক্যে) তা নিষেধ করেন নি।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এ বিষয়টি মনে হয় পরিষ্কার হয়ে গেছে- فَانكِحُوا مَا طَابَ لَكُم….الخ (তাহলে তোমরা বিয়ে করে নিতে পারো –(অন্য) নারীদের মধ্যে থেকে- যাদেরকে তোমাদের পছন্দ হয়…..আয়াতের শেষ পর্যন্ত) -অংশটি বাক্যের ওই ফলাফল নয়, যাকে এর পূর্ববর্তী শর্তের সাথে শর্তযুক্ত বলে গণ্য করা হবে। বরং এর আসল ফলাফলটি উহ্য ও প্রচ্ছন্ন আকারে রয়েছে। বস্তুতঃ এই উহ্য ও পচ্ছন্ন হওয়ার বিষয়টি বিবেকগত ভাবে যেমন প্রমাণিত হয়, তেমনিভাবে যেসকল সাহাবা ও তাবেয়ীনে কেরাম থেকে এ আয়াতের তাফসীর বর্ণিত রয়েছে, তাঁরা সকলেই এখানে (বাক্যের) ফলাফলটিকে উহ্য ও প্রচ্ছন্ন আকারে নিয়েছেন, বিধায় এটি বর্ণনাগত দিক থেকেও প্রমাণিত হয়।
সুতরাং, এসব জনাবরা যে বলছেন যে- ‘‘যেহেতু (এ অংশটি তার) পূর্ববর্তী বাক্যাংশটিরই ফলাফল,তাই একাধিক বিয়ের অনুমতি এই শর্তের সাথে শর্তযুক্ত রয়েছে যে, তখন (সমাজে) এতীম নারীদের সমস্যাটিকে উদ্ভুত অবস্থায় থাকতে হবে’’ -এটা কুরআন কারিমের উপর খোলাখুলি অপবাদ আরোপ, যার পিছনে কোনোই দলিল নেই এবং তাদের একথার উপর এমন এমনসব উসূলী অভিযোগ সৃষ্টি হয়, যার জবাব এরা কেয়ামত পর্যন্ত দিতে পারবে না।
আপনি যদি কাউকে বলেন যে-‘তোমার যদি গোনাহে লিপ্ত হবার আশংকা দেখা দেয়, তাহলে বিয়ে করে নাও’ এবং আপনার একথার দ্বারা কেউ যদি এই বুঝে নেয় যে- ‘যদি গোনাহে লিপ্ত হবার আশংকা না থাকে, তাহলে আমার জন্য বিয়ে করা জায়েয নয়’- তাহলে আপনি ওই ব্যক্তির জন্য কি রায় দাঁড় করাবেন? এটাই কি নয় যে, এই ব্যক্তি কারো কথা সঠিক ভাবে বোঝার উপযুক্তই নয়? তাহলে কুরআন যদি একথা বলে যে- ‘তোমরা যদি এতিম নারীদের হক্ব নষ্ট করার ব্যপারে আশংকাবোধ করো, তাহলে তাদেরকে বিয়ে না করে বরং অপরাপর নারীদের মধ্য থেকে দুইজন, তিনজন এবং চারজনকে পর্যন্ত বিয়ে করে নিতে পারো’, আর এ থেকে কেউ যদি একথা বুঝে নেয় যে, ‘যদি এতিম নারীদের হক্ব নষ্ট হওয়ার আশংকা না থাকে, তাহলে দুজন নারীকে বিয়ে করা জায়েয নয়’- তাহলে এরকম ব্যক্তি সম্পর্কে আপনার কি মত? তার কি এই অধিকার আছে যে, সে কুরআন কারিম থেকে আহকাম ‘ইস্তেমবাত (উদ্ভাবন) করতে বসে যাবে?
হযরত আয়েশা রা.-এর রেওয়ায়েত
আপনারা ইতিপূর্বে কয়েকবার হযরত আয়েশা’র বর্ণনা পাঠ করে এসেছেন। কয়েক পৃষ্ঠা পূর্বে আমরা সেটার মতন (Text) ও অনুবাদ উল্লেখ করে দিয়েছি। আপনারা সেটাকে আরও একবার পাঠ করে দেখুন। সেটা পড়া মাত্রই আপনাদের সামনে একথা খুব ভালভাবেই প্রতিভাত হয়ে যাবে যে, কুরআন কারিম এই আয়াতের মধ্যে একাধিক বিয়েকে এমারজেন্সি পরিস্থিতির সাথে শর্তযুক্ত করে দেয়নি। বরং এক্ষেত্রে একাধিক বিয়ের ভূতপূর্ব অনুমতি থেকে এমারজেন্সি অবস্থায় উপকৃত হওয়ার তারগীব বা উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে মাত্র। এ পর্যায়ে হযরত আয়েশা’র নিম্নক্ত কথাটি কতই না প্রতিভাতপ্রদ, কতই না সুস্পষ্ট !
‘ফলতঃ এ সকল অভিভাবকদেরকে এরকম এতিম মেয়েদেরকে বিয়ে করতে নিষেধ করে দেয়া হয়েছে। তবে তারা যদি তাদের সাথে ইনসাফ করে এবং দেনমোহরের ক্ষেত্রে তাদের হক্ব পুরোপুরি আদায় করে, তাহলে ভিন্ন কথা। (এর সাথে) তাদেরকে এই নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা যেন এসব এতিম মেয়েদেরকে বাদ দিয়ে বরং অপরাপর (হালাল) নারীদের মধ্য থেকে যাকে যাকে পছন্দ হয়, বিয়ে করে নেয়’।
উপরোক্ত এ বক্তব্য থেকে এসব জনাবদের দলিল-দস্তাবেজের গোটা প্রাচিরটাই অধ্বঃমুখী হয়ে ধ্বসে পড়ে; বিশেষ করে তারা যে এই দাবী করেছেন যে- ‘আয়াতটিতে النسآء (নারীগণ) শব্দ দ্বারা ‘এতীম মেয়েরা’ই উদ্দেশ্য’ -তাদের একথা পরিষ্কার রদ্ হয়ে যায়। ফলত: তারা হযরত আয়েশা’র উপরোক্ত বর্ণনা থেকে বাঁচার জন্য হিলা-বাহানার আশ্রয় নেবার চেষ্টা করছেন। যেমন: একজন জনাব বলেছেন-
‘‘ওলামায়ে উসূল’গণের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত এই যে, العبرة بعموم اللفظ لا لخصوص المورد (অর্থাৎ, কথার সাধারণ ও ব্যাপকার্থ বোধক অর্থ ও তাৎপর্যটাই মূলতঃ বিবেচ্য হয়ে থাকে; বিশেষ কোনো শানে নজুল ধর্তব্য হয় না)। কাজেই, এখানে শানে নজুলের উপর নির্ভর করলে সেটা হবে খোদ উসূলে ফিকাহ’র গ্রহনযোগ্য মূলনীতিরই পরিপন্থী। বস্তুতঃ আমাদেরকে এই শানে নাজুলের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে কুরআন কারিমের বক্তব্যমালার উপর গভীর ভাবে চিন্তা করে দেখতে হবে এবং কুরআন কারিমের বক্তব্যমালা যে কথা বলছে, আমাদেরকে তারই অনুসরন করতে হবে’’।
এর জবাবে আমরা সর্বপ্রথম যা আরোজ করবো, সেটা হলো, ওলামায়ে কেরামের বক্তব্য দ্বারা দলিল দানের কোনো অধিকার আপনাদের নেই। সমস্ত ওলামা ও ফুকাহায়ে কেরাম নাবালেগ (অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক মেয়ে)দের বিয়ের কথা কুরআন-সুন্নাহ থেকে চয়ন করে জায়েয বলছেন, অথচ এ বিধানটি নিছক নাজুক চিন্তাধারার বিপরীত হওয়ার কারণে তাঁরা (আপনাদের চোখে) ভ্রান্তিতে রয়েছেন ! এই আলেম সমাজ যখন কুরআনের পরিষ্কার বক্তব্য অনুসারে একাধিক বিয়েকে জায়েয বলে অবিহিত করেন, তখন সেটা আপনাদের কাছে পছন্দ হয় না ! আর এটাও-বা কেমন আশ্চর্যের কথা যে, একাধিক বিয়ে‘ নিষিদ্ধ প্রমাণ করার জন্য আপনারা তাঁদেরই বিপরীতে তাঁদেরই কোনো মূলনীতি উদ্ধৃত করে সেটার উপরই নির্ভর করে বসছেন?
আরো মশকরাজনক দুঃখের কথা হল, তাঁদের কথা পুরাপুরি না বুঝে কিংবা বুঝে থাকলেও না বোঝার ভান করে আদাজল খেয়ে নামছেন !!!!!!!
ايں ہم اندر عاشقی با لائے غم ہائے دگر
শানে নজুলের বৈশিষ্ট
উপরোল্লখীত বক্তব্য দ্বারা ফুকাহায়ে কেরামের উদ্দেশ্য কখনো এই নয় যে, কুরআনের অর্থ ও তাৎপর্য বোঝার জন্য শানে নজুলের কোনোই প্রয়োজন নেই। যদি শানে নজুলকে এক দিকে তুলে রেখে শুধু মাত্র কুরআনের বক্তব্যমালা থেকে অর্থ উৎঘাটন করা শুরু করে দেয়া হয়, তাহলে কুরআন থেকে না ‘নামায’ প্রমাণিত হবে, না যাকাত, না হজ্জ, আর না রোযা।
কুরআন কারিমে বলা হয়েছে أَقِيمُوا الصَّلَاةَ (সালাত প্রতিষ্ঠা করো)। আরবী পরিভাষায় صَّلَاةَ (সালাত) শব্দটির কয়েকটি অর্থ হয়, যার একটি অর্থ হল تحريك الصلوين অর্থাৎ ‘কোমর দুলানো’। শানে নজুলকে আপনি যদি একদমই দেশান্তর করে ছাড়েন এবং আপনাকে কেউ যদি একথা বলে যে- أَقِيمُوا الصَّلَاةَ (সালাত প্রতিষ্ঠা করো) -দ্বারা ড্যান্স বা নৃত্যের বৈধতা প্রমাণিত হয় এবং এই বাক্যাংশটির অর্থ হল ‘ড্যান্সের আসোর প্রতিষ্ঠা করো’, তাহলে তাকে আপনি কি জবাব দিবেন ?
صَّلَاةَ (সালাত) -এর বহু অর্থের মধ্য থেকে শুধু মাত্র ‘নামায” অর্থ নেয়ার দলিল হল, রাসুলুল্লাহ ﷺ এবং হযরত সাহাবায়ে কেরাম রা. একে ‘নামায’ সম্পর্কে নাজিলকৃত হিসেবে গণ্য করেছেন। তাই, ফিকাহবীদগণের উদ্দেশ্য কখনো এই নয় যে, শানে নজুল একদমই ধর্তব্য হয় না। বরং তাঁদের উদ্দেশ্য হল, শানে নজুলকেই যাবতীয় পরিধিক্ষেত্র গণ্য করা হয় না। অর্থাৎ, যদি কোনো বিশেষ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো কিছুকে হারাম করা হয়ে থাকে, তাহলে ওই জিনিসের হারাম হওয়াটা শুধুমাত্র উক্ত ঘটনার সাথেই নির্দিষ্ট হয়ে থাকে না; কিংবা যদি কেনো বিশেষ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো কিছু বৈধ বলে অবিহিত হয়ে থাকে, তবে সেটির বৈধতা শুধুমাত্র উক্ত ঘটনার সাথেই নির্দিষ্ট হয়ে থাকে না।
এছাড়াও একটি সহজ- সরল কথা হল, শানে নজুলকেই যাবতীয় পরিধিক্ষেত্র গণ্য করা হয় না বটে, কিন্তু যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আয়াতটি নাজিল হয়েছে, সেটাই আয়াতের সত্যায়ন ও প্রমাণ থেকে বাদ যাবে -এটা একেবারে অসম্ভব। একাধিক বিয়ের বিরোধীরা এখানে কুরআন কারিমের আয়াতটির যে অর্থ বর্ণনা করতে ইচ্ছুক, হযরত আয়েশা রা.-এর রেওয়ায়েতটি তার একদম বিপরীত কথা বর্ণনা করছে। তাদের কথার আলোকে-তো (আয়াতের শানে নজুল হিসেবে বর্ণিত) হযরত আয়েশা রা. বর্ণিত ঘটনাটি -আয়াতের উদ্দেশ্য থেকে সম্পূর্ণরূপে বেড়িয়ে যায়। সুতরাং, এখানে النسآء (নারীগণ) -এর অর্থ শুধুমাত্র ‘প্রাপ্তবয়ষ্ক এতিম নারী’ -একথা কিভবে মেনে নেয়া যেতে পারে ?
বস্তুতঃ হযরত আয়েশা রা. যে ঘটনাটিকে এ আয়াতের শানে নজুল হিসেবে গণ্য করছেন, তাতে এর দ্বারা এতিম নারীরা বাদে অপরাপর নারীগণই অর্থ হয়, যা (বিরোধীবাদীদের কথিত) পূর্বল্লোখীত অর্থের সস্পূর্ণ উল্টো। এটা-তো হওয়া সম্ভব যে, আয়াতের হুকুমটিকে শানে নজুল ছাড়াও অপরাপর ঘটনাবলীর উপর প্রয়োগ করা হবে, (আর এটাই হল ফিকাহবিদগণের কথা العبرة بعموم اللفظ لا لخصوص المورد (অর্থাৎ, কথার সাধারণ ও ব্যাপকার্থ বোধক অর্থ ও তাৎপর্যটাই মূলতঃ বিবেচ্য হয়ে থাকে; বিশেষ কোনো শানে নজুল ধর্তব্য হয় না) -এর অর্থ। কিন্তু আয়াতটিকে এমন কোনো মর্মার্থের সাথে নির্দিষ্ট ও পরিবেষ্টিত করে দেয়া -যা তার শানে নজুলের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়ায় এবং শানে নজুল পর্যায়ে বর্ণিত ঘটনাতেও উক্ত হুকুমটি প্রযোজ্য হয় না -এমনটা হওয়া আদপে সম্ভব নয়।
সুতরাং, আলোচ্য আয়াতের ক্ষেত্রে খুব বেশী হলে একথা বলা যেতে পারে যে, النسآء (নারীগণ) শব্দটি عام (আম/সাধারণ ও ব্যাপক অর্থজ্ঞপক), এবং শানে নজুলই যেহেতু যাবতীয় পরিভ্রমন ক্ষেত্র নয়, তাই ‘এতিম’ বা ‘এতিম নয়’ -এমন সব নারীই এতে অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। কিন্তু (তাই বলে) খোদ যে সকল নারীদের ব্যাপারে আয়াতটি নাজিল হয়েছে, তাদেরকে এ আয়াত থেকে বেড় করে দেয়া যেতে পারে না। আপনি যদি তাদেরকে বেড় করে দেন, তাহলে যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আয়াতটি নাজিল হয়েছে, সেই ঘটনাটিই আয়াতের সত্যায়ন থেকে যে বেড় হয়ে যাবে।
ব্যাপার শুধু তা-ই নয়, বরং এটা খোদ العبرة بعموم اللفظ (অর্থাৎ, কথার সাধারণ ও ব্যাপকার্থ বোধক অর্থ ও তাৎপর্যটাই মূলতঃ বিবেচ্য হয়ে থাকে) -এরও পরিপন্থী হয়ে যাবে। কেনন, النسآء (নারীগণ) শব্দটি ব্যাপকার্থবোধক। তাহলে একে শুধুমাত্র এতিম নারীদের সাথে নির্দিষ্ট করে দেয়াটা উল্লেখীত মূলনীতির পরিপন্থী হবে না-তো, কি স্বপন্থী হবে ?
নিজের ফাঁদে নিজেই পড়লেন !
মনের প্রশান্তির জন্য এখানে আরও একটি সুক্ষ বিষয়ের উপর দৃষ্টি বুলিয়ে নিন। একাধিক বিয়ের একজন চরম বিরোধী, যিনি ঘটনাক্রমে একজন ‘মুনকেরুল হাদীস (১১) (হাদীস অস্বীকারকারী)ও বটে, তিনি এ পর্যায়ে জোশের সাথে এসে লিখে দিয়েছেন-
‘একটু চিন্তা-তো করে দেখুন, এটা কত হাস্যকর বিষয় হয়ে দাঁড়ায় যে, আলোচ্য আয়াতের এক লাইন পরে এই শর্ত এঁটে দেয়া হচ্ছে যে- فَإِنْ خِفْتُمْ أَلَّا تَعْدِلُوا فَوَاحِدَةً –‘পরন্তু (এতেও) যদি তোমরা আশংকাবোধ করো যে, তোমরা (দই,তিন, বা চার জন স্ত্রীর মাঝে) ন্যায়বিচার করতে পারবেনা, তাহলে একজন (-এর উপরই ক্ষ্যান্ত থাকো)’….; আর এক লাইন পূর্বেই যখন ওই একই কথা – وَإِنْ خِفْتُمْ أَلَّا تُقْسِطُوا فِي الْيَتَامَىٰ فَانكِحُوا مَا طَابَ لَكُم مِّنَ النِّسَاءِ مَثْنَىٰ وَثُلَاثَ وَرُبَاعَ –‘আর তোমরা যদি এই আশংকাবোধ করো যে, এতিম নারীদের মধ্যে ইনসাফ করতে পারবে না, তাহলে তোমরা বিয়ে করে নিতে পারো -(অন্য) নারীদের মধ্যে থেকে- যাদেরকে তোমাদের পছন্দ হয় -দুই, তিন, চার জনকে (পর্যন্ত) -এসে যাচ্ছে, তখন আপনি উক্ত শর্তটিকে একদম ‘অযথা’ ও নিষ্ক্রিয় বলে ঘোষনা দিচ্ছেন’ !
এসব শ্রদ্ধেয়ের তো এই বাহ্যিক বৈপরীত্যের উপর হাসি পেয়ে বসছে ! কিন্তু তার কাছে আমাদের জিজ্ঞাসা- ‘‘আমাদের কাছে তো এ আয়াতেও فَوَاحِدَةً –তাহলে একজনর উপরই ক্ষ্যান্ত থাকো -কথাটি (পূর্বের শর্ত ‘আশংকা করা’র সাথে) শর্তাধীন নয়। কিন্তু এতেও যদি আপনার একথার উপর জেদ বহাল থাকে, তাহলে (তর্কের খাতিরে কিছুক্ষনের জন্য) তা গ্রহন করে নিলাম, কিন্তু এমতাবস্থায় এর অর্থ এই দাঁড়াবে যে, ‘তোমাদের যদি বেইনসাফীর আশংকা না থাকে, তাহলে একজনকে (মাত্র) বিয়ে করা জায়েয নয়, বরং তখন একাধিক বিয়ে করা শুধু জায়েয -তাই নয়, ওয়াজিব হয়ে যাবে ! (কেননা, فَوَاحِدَةً -তাহলে একজনর উপরই ক্ষ্যান্ত থাকো -কথাটি (আপনার মতে) তার পূর্ববর্তী শর্তের সাথে শর্তযুক্ত অবস্থায় বিদ্যমান !)। আপনি কি এতে রাজি ?
এতে কেউ কখনো অবাক হবেন না যে, এসব জনাবরা নিজেদের পেশকৃত দলিল-দস্তাবেজের মধ্যে খোদ নিজেরাই ফেঁসে যাচ্ছেন। কেননা, আমরা আগেও বলে এসেছি যে, এক্ষেত্রে তারা নিরেট মাজুর ব্যাক্তি। হাদিসের আলো থেকে ঘাঁড় ফিরিয়ে নেয়া এবং দু’চোখের উপর পশ্চিমাদের অন্ধানুসরনের পট্টি বেঁধে নেয়ার এটাই হল যৌক্তিক পরিণতি।
পূর্বসূরীদের একাধিক বিয়ে
আমরা শুরুর দিকে একথা লিখে এসেছি যে, আমাদের পূর্বসূরীদের ইতিহাস ‘একাধিক বিয়ে’র ঘটনায়
ভরে আছে। খোদ্ রাসুলুল্লাহ ﷺ এবং খুলাফায়ে রাশেদীন রা.-এর পবিত্র স্ত্রী ছিলেন কয়েকজন করে। একাধিক বিয়ে যদি খারাপ কাজই হয়, তাহলে এ সকল হযরতগণের ব্যাপারে কি বলা যাবে? একথা কি বলা যাবে যে, তাঁরা এই খারাপ কাজটির (!) উপর উপর্যপুরী লিপ্ত হয়ে এসেছেন ?!!!
কেউ কেউ এই দলিলের জবাবে অনেক দূরের আবর্জনা নিয়ে এসেছেন এবং এই উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য বিশেষ জ্ঞান (!) ব্যয় করেছেন। (তারা বলেছেন যে,) ‘‘আমাদের পূর্বসূরীদের গোটা জিন্দেগী জিহাদ ও গাযওয়া দ্বারা ভরপুর হয়ে আছে। তখনকার বিভিন্ন জিহাদে যে সকল মুসলমান শহীদ হতেন, তাঁদের বহু সন্তান এতিম হয়ে যেতো, ফলতঃ এতীমদের সমস্যা উদ্ভুত হত। এজন্য তারা একাধিক বিয়ে করতেন’’ !
এ পর্যায়ে তাদেরকে প্রথমতঃ একথা প্রমাণ করতে হবে যে, ‘যে মুসলমানই একাধিক বিয়ে করেছেন, তার তাত্ত্বাবধানে এতিম মেয়েরা বিদ্যমান ছিল’।কিন্তু এ কথা প্রমাণ করা (তাদের জন্য) মূলতঃ ‘জোয়ে শির’ নিয়ে আসার থেকে কম নয়। তদুপরি, এ কথার দলিল দেয়াও তাদেরই দায়ীত্বে যে, ‘প্রত্যেক যুগে যুদ্ধের মধ্যে এত মসলমান শহীদ হয়ে যেতেন যে, তাদের পরিত্যাক্ত উত্তরাধিকারদের কারণে ‘এতিম মেয়ে’দের সমস্যা উদ্ভুত হত’। কিন্তু এর কি দলিল মিলবে, বরং এর উল্টো দলিলই মওজুদ রয়েছে।
রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর মক্কী জিন্দেগীতে-তো একটি যুদ্ধও হয়নি। মদিনা মুনাওয়ারার ‘দশ বছরের হায়াতে তৈয়্যেবাতে’ বিভিন্ন যুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু ওগুলোতে শহীদদের সংখ্যা এতটা কক্ষোনই ছিল না যে, সমাজ জীবনে এতিম মেয়েদের সমস্যা উদ্ভুত হয়ে যাবে। বদর জীহাদে মোট দশ-বার’জন এবং ওহুদ জীহাদের মোট সত্তর’জন মুসলীম শহীদ হন। বাদ বাকি গাযওয়াগুলোর মধ্যে কোনো কোনোটি-তো এমন, যেখানে কোনো যুদ্ধই হয় নি।‘গাযওয়ায়ে তবুক’, গাযওয়ায়ে খায়বার’, ‘মক্কা বিজয়’ ইত্যাদি এরই অন্তর্ভুক্ত। আর কতগুলো আছে এমন, যেগুলোতে যুদ্ধ হয়েছে বটে, কিন্তু ওগুলো সামান্য বোঝাপড়া মূলক যুদ্ধের অধিক বৈশিষ্ট রাখে না। এগুতে শহীদগণের সংখ্যা সম্ভবত: দশ’ জনের বেশী হবে না। ‘গাযওয়ায়ে খন্দক’ এরই মধ্যে শামিল । বলি, এটা কি বিবেকে ধরার মতো কথা যে, নিছক এত সামান্য সংখক মুসলমান শহীদ হয়ে যাওয়ার কারণে মুসলমানদের গোটা সমাজ জীবনে ‘এতিম মেয়ে’দের এমন সমস্যা দেখা দিয়েছিল, যার দরূন একটি খারাপ কাজকে (!) জায়েয বলে ঘোষনা দিতে হয়েছে! একথা নিশ্চিৎভাবে বলা যায়, সে সময় যুদ্ধ-জিহাদের কারণে এ ধরনের কোনো সমস্যা বিদ্যমান ছিল না। এতদ্বসত্ত্বেও রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর বরকতময় যুগে খোদ তিনি সহ সাহাবায়ে কেরামগণ রা. কয়েকটি করে বিয়ে করেছিলেন।
তধিকন্তু এই জনাবদের উপরই এই দায়ীত্ব বর্তায় যে, তারা একথার প্রমাণ পেশ করবেন যে, “রাসুলুল্লাহ ﷺ-এবং সাহাবায়ে কেরামগণ রা. শুধুমাত্র এই অবস্থাতেই একাধিক বিয়েকে জায়েয বলে অবিহিত করতেন, যখন সমাজ জীবনে এতিম মেয়েদের সমস্যা বিদ্যমান থাকতো, এবং তাঁরা যে সকল বিয়ে করেছেন, সেগুলো শুধু মাত্র এই একটি সুরতের দিকে তাকিয়েই করেছেন। যদি এ সমস্যাটি দেখা না দিতো, তাহলে তারা একাধিক বিয়ে করতেন না ।”
কুরআন কারিম থেকে এই শর্তটিকে প্রমাণ করার হাশর-তো আপনারা দেখে এসেছেন। এবারে হাদিস ও ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে দেখুন, সেখানে আপনারা এমন একটি কথাও পাবেন না, যা থেকে এ শর্তটি প্রমাণিত হয়। উল্টো এ শর্তের বিপরীত অসংখ্য কথা আপনাদের হস্তগত হবে, যার মধ্যে থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমরা এখানে পেশ করছি।
রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর এরশাদ মোবারক
(১) রিসালাতের জামানায় এরকম বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছিল যে, চারের অধিক বিয়ে নিষিদ্ধ হবার পর বহু লোক মুসলমান হয়ে যায়। তখনও তাদের বিবাহাধীনে চারের অধিক স্ত্রী বিদ্যমান ছিল। তারা রাসুলুল্লহ ﷺ-এর কাছে মাসআলাহ জিজ্ঞেস করলেন যে, এখন কি করা যাবে ? রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন- اختر منهم اربعا –
‘তাদের মধ্য থেকে চারজনকে পছন্দ করে নাও’। [সুনানে আবু দাউদ- ১/৩০৪, হাদিস ২২৪১; সহিহ ইনে হিব্বান- ৯/৪৬৫; জামে তিরমিযী- ৩/৪৩০ হাদিস ১১২৮; সুনানে ইবনে মাজাহ- ১/৬২৮, হাদিস ১৯৫৩; মু’জামুল কাবীর, ত্বাবরাণী- ১৮/৯২৩; মুসনাদে আহমদ, হাদিস ৪৫৯৫, ৪৬১৭, ৫০০৭, ৫৫৩৩; মুসতাদরাকে হাকিম– ২/১৯২; মুআত্তা ইমাম মালেক, হাদিস ১২১৯; আত-তামহিদ, ইবনু আব্দিল বার- ১২/৫৪; আল-উম্ম, ইমাম শাফেয়ী- ৪/২৮৭; সুনানুল কুবরা, বাইহাকী- ৭/১৮২; তাফসীরে ইবনে কাসির- ১/৪৬১](১২)
কোনো কোনো ঘটনায় এও বলেছিলেন- اخترأربعا ايتهن شئت – ‘তাদের মধ্য থেকে যে চারজনকে তোমার ইচ্ছা গ্রহন করে নাও’। [সুনানুল কুবরা, বাইহাকী- ৭/২৯৯, হাদিস ১৩৮৩৮; মা’রিফাতুস সুনান, বাইহাকী- হাদিস ৩৬৭৯; আল-উম্ম, ইমাম শাফেয়ী- ৪/২৮৭ হাদিস ১১১১; তাফসীরে ইবনে কাসির- ১/৪৬১](১৩)
এখানে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কথা اختر (পছন্দ করে নাও) এবং ايتهن شئت (তাদের মধ্য থেকে যাকে তোমার ইচ্ছা )-এর উপর বিশেষ ভাবে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে দেখুন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) প্রশ্নকর্তার কাছে এ নিয়ে বিশেষ কিছু জানতে চাননি যে, ‘ওই দশজন মহিলার মধ্যে কতজন এতিম বা বিধবা নারী রয়েছে’? তিনি এই দিকনির্দেশিকাও দেননি যে, ‘যদি কিছু এতিম ও বিধবা মহিলা না থাকে, তাহলে তাদেরকে (স্ত্রী হিসেবে) কক্ষোনই রাখবে না’।
বরংচ ইমাম ইবনে কাসির রহ.‘মুসনাদে শাফেয়ী’র সূত্রে একটি রেওয়ায়েত উদ্ধৃত করেছেন, যা এসব জনাবদের ধারনানির্ভর বক্তব্যকে খোলাখুলি প্রত্যাক্ষান করে দেয়-
عن نوفل بن معاوية الديلي ، رضي الله عنه ، قال : أسلمت وعندي خمس نسوة ، فقال لي رسول الله صلى الله عليه وسلم : ” اختر أربعا أيتهن شئت ، وفارق الأخرى ” ، فعمدت إلى أقدمهن صحبة عجوز عاقر معي منذ ستين سنة ، فطلقتها
‘হযরত নওফেল বিন মুআবিয়া আদ্দাইলী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি এমতাবস্থায় ইসলাম গ্রহন করলাম যে, তখন আমার বিবাহাধীনে পাঁচজন স্ত্রী ছিল। রাসুলুল্লাহ ﷺ আমাকে বললেন: ‘তাদের মধ্য থেকে যে চারজনকে তোমার ইচ্ছা গ্রহন করে নাও এবং অপরজনকে ‘তালাক’ দিয়ে দাও’। তখন আমি তাদের মধ্যে সর্বাধিক সনাতন স্ত্রীর কাছে গেলাম, যে ছিল একজন বন্ধা বৃদ্ধা এবং আমার সাথে ষাট বৎসর যাবৎ ছিল। আমি তাকে তালাক দিয়ে দিলাম’। [তাফসীরে ইবনে কাছীর- ১/৪৫১; মুসনাদে শাফেয়ী-২/১৬, সিন্ধি; সুনানুল কুবরা, বাইহাকী- ৭/২৯৯, হাদিস ১৩৮৩৮; সুনানুছ ছুগরা, বাইহাকী- ৩/৫১; তালখিসুল হাবীর, ইবনে হাজার- ৩/১৭০](১৪)
বলা বাহুল্য, যদি একাধিক স্ত্রীর অনুমতি শুধুমাত্র এতিম ও বিধবা নারীদের প্রয়োজন পূরণার্থেই হত, তাহলে রাসুলুল্লাহ ﷺ এই নির্দেশ দিতেন যে, ‘এতিম ও বিধবাদেরকে রেখে বাকিদেরকে ‘তালাক’ দিয়ে দাও’। আর এক্ষেত্রে সাহাবী হযরত নওয়েল রা. ‘তালাক’ দিলেন তো দিলেন একজন বন্ধা বৃদ্ধাকে। যদি একাধিক বিয়ের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র অসহায় এতিম নারীদেরকে সাহায্য করাই হত, তাহলে বৃদ্ধাকে সাহায্য করা এবং তাকে বিবাহাধীনে রাখাটাই তো সর্বপ্রথম অপরিহার্য হত। শুধু তাকেই তালাক দেয়া হল কেনো ?
(২) এবারে আপনি আরেকটি রেওয়ায়েতের উপর ভাল করে দৃষ্টি নিবদ্ধ করুন-
لا تسأل المرأة طلاق أختها لتستفرغ صحفتها ولتنكح فإنما لها ما قدر لها
‘হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লহ ﷺ এরশাদ করেছেন: কোনো নারী তার (মুসলিম) বোনের (১৫)পাত্র খালি করে দেয়ার উদ্দেশ্যে (ওই স্ত্রীর স্বামীর কাছে) তাকে তালাক দানের আবেদন করবে না। বরং (ওই স্ত্রীকে পূর্ববৎ বিবাহাধীনে থাকতে দিয়ে তার স্বামীকে বিয়ে করতে চাইলে) বিয়ে করে নিবে। বস্তুতঃ তার তক্বদিরে যা আছে, সে তা পাবে’। [সুনানে আবু দাউদ– ২/২৯৬; সহিহ মুসলীম, হাদিস ১৪১৩; সহিহ বুখারী, হাদিস ৪৮৫৭; সহিহ ইবনে হিব্বান- ৯/৩৭৮; আত-তামহিদ, ইবনু আব্দিল বার- ১৮/১৬৫](১৬)
অর্থাৎ, যদি কোনো ব্যক্তির বিবাহাধীনে কোনো স্ত্রী থাকে এবং সে অন্য কোনো নারীকে বিয়ের পয়গাম পাঠায়, তাহলে এই (দ্বিতীয়) নারীর জন্য এটা জায়েজ নয় যে, সে(ওই ব্যক্তির) প্রথম স্ত্রী কে ‘তালাক’ দিয়ে দেয়ার র্শত এঁটে দিবে (এই বলে যে, আগে তাকে তালাক দাও, তার পর আমি তোমাকে বিয়ে করবো, তার আগে নয়)।
আপনি ইনসাফের দৃষ্টিতে গভীরভাবে চিন্তা করে দেখুন যে, কোনো ব্যক্তি -যে এতিম অথবা বিধবা মহিলার উপর দয়া পরবশ হয়ে তার প্রয়োজন পূরণ করার জন্য বিয়ে করছ, সেই এতিম বা বিধবা মহিলা-তো এই তামাশা করতে পারেনা যে, ‘প্রথমে তোমার পয়লা স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দাও, তবেই বিয়ে করবো’! সুতরাং এই রেওয়ায়েতটি এমন কোনো এতিম অথবা বিধবা নারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে না, যার সাথে নিছক এজন্য বিয়ে করা হচ্ছে যে, তাকে সাহায্য করা হবে। নিশ্চিৎভাবেই বলা যায়, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল ওই নারী, যার কোনো বিশেষত্বের কারণে খোদ কোনো পুরুষ তাকে বিয়ে করতে আগ্রহী। রাসুলুল্লাহ ﷺ এ ধরনের নারীকে কোনো শর্ত ছাড়াই বিয়ে করার নির্দেশ দিয়েছেন, যা থেকে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, একাধিক বিয়ে করাটা রাসুলুল্লাহ ﷺ এর কাছে নিছক এতিম অথবা বিধবা নারীদেরকে সাহায্য-সহায়তা করার জন্য ছিল না, বরং এই উদ্দেশ্য ছাড়াও তা জায়েয ছিল।
অপরাপর সাহাবায়ে কেরাম রা. ও তাবেয়ীন রহ.
(৩) আলোচ্য আয়াতের তাফসীরে আপনারা হযরত ইবনে আব্বাস রা. এবং হযরত আয়েশা রা.-এর বক্তব্য পড়ে এসেছেন, যা থেকে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এ সকল হযরতগণেও কাছে একাধিক বিয়ের অনুমতিটা এতিম নারীদের উদ্ভুত সমস্যার সাথে শর্তযুক্ত নয়।
(৪) ইতিপূর্বে হযরত সাঈদ বিন যুবায়ের রহ., হযরত সুদ্দী রহ., হযরত কাতাদাহ রহ. এবং হযরত যাহহাক রহ.-এর বক্তব্যও আপনারা দেখে এসেছেন, যা থেকে একথা পষ্কিার হয়ে যায় যে, এসকল হযরতগণ ‘একধিক বিয়ে’কে শুধুমাত্র এতিম নারীর উদ্ভুত সমস্যার সময়ই জায়েয বলেন না, বরং তাঁদের মতে এর অনুমতি সাধারণ ও ব্যাপক।
(৫) তাবেয়ীনে কেরামের মধ্য থেকে একজন জলীল কদর বুজুর্গ হযরত রাবীয়াহ রহ.-এর বক্তব্যও শুনে নিন, যা সুনানে আবু দাউদে বিদ্যমান রয়েছে-
وقال ربيعة في قول الله عز وجل وإن خفتم ألا تقسطوا في اليتامى قال يقول اتركوهن إن خفتم فقد أحللت لكم أربعا
‘আল্লাহ তাআলার এরশাদ وَإِنْ خِفْتُمْ أَلاَّ تُقْسِطُواْ فِي اليتامى (আর তোমরা যদি এই আশংকাবোধ করো যে, এতিম নারীদের মধ্যে ইনসাফ করতে পারবে না)-এর তাফসীর প্রসঙ্গে হযরত রাবীয়াহ রহ. বলেন: ‘যদি এতিম নারীদের হক্ব নষ্ট করার ভয় হয়, তাহলে তাদেরকে পরিত্যাগ করো, (তাদেরকে বিয়ে করো না)। কেননা, আমি-তো চারজন নারীকে তোমাদের জন্য হালাল করে দিয়েছি’। [সুনানে আবু দাউদ– ২/২৭৩; সুনানুল কুবরা, বাইহাকী হাদিস ১৩৮১২](১৭)
এ থেকে পরিষ্কার প্রতিভাত হয় যে, হযরত রাবীয়াহ রহ-এর মতে চারটি বিয়ে করার অনুমতি এতিম নারীদের উদ্ভুত সমস্যার উপর ঝুলন্ত নয়, বরং তিনি বলছেন যে, এ আয়াতে এই অনুমতির মাধ্যমে এতিম নারীদের (সাথে বেইনসাফীর আশংকার ) সুরতে (অপরাপর হালাল নারীদেরকে বিয়ে করে) উপকৃত হবার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
ফুকাহা ও মুহাদ্দিসীসে কেরাম
সমস্ত ফুকাহা ও মুহাদ্দিসীনে কেরাম যাঁদের মধ্যে কাউকেই পৃথক করা চলেনা- তাঁদের বক্তব্য হল, চারটি বিয়ে করার অনুমতি কোনো শর্তের অধিনে বিদ্যমান নয়। একারণে তাঁরা মাসআলাটিকে এভাবে উল্লেখ করেন না যে ‘এতিম নারীদের সমস্যা উদ্ভুত হলে চারটি বিয়ে করা জায়েয’। বরং তারা এ মাসআলাটিকে এভাবে উল্লেখ করেন- ‘চারের অধিক বিয়ে করা জায়েয নয়’।
যেমন, ইমাম বুখারী রহ. বলেছেন: لا يتزوج اكثر من اربع لقوله تعالى مثنى وَثُلاَثَ وَرُبَاعَ -‘চারের অধিক বিয়ে করা জায়েয নয়। কেননা, আল্লাহ তাআলা বলেছেন- مثنى وَثُلاَثَ وَرُبَاعَ (তোমরা বিয়ে করতে পারো) দুজন, তিনজন এবং চারজনকে’। [সহিহ বুখারী ]
বস্তুতঃ চারটি বা চারটির কম বিয়ে সর্বাবস্থায় জায়েয হওয়া এমন গ্রহনযোগ্য একটি মাসআলাহ যে, তা উল্লেখ করারও প্রয়োজন নেই।
সমস্ত মুফাসসিরীনে কেরাম
এছাড়াও আজ পর্যন্তকার (সকল নির্ভরযোগ্য) মুফাসসিরীনে কেরাম একথার উপর একমত যে, একাধিক বিয়ের অনুমতি এতিম নারীদের সমস্যা’র সাথে শর্তযুক্ত নয়। সকল মুফাসসিরীনে কেরামের বক্তব্য আলাদা আলাদাভাবে উদ্ধৃত করা কঠিন।
সংক্ষেপ কথা হল, আজ পর্যন্ত একজন আলেমও এর বিপরীত রায় দেননি। এমন কি পরবর্তীতে (আমাদের এ যুগে) যারা তাফসীর লিখেছেন এবং বহু স্থানে জমহুর ওলামায়ে কেরামের বিপরীত কথা লিখে দিয়েছেন, যেমন: মুফতী মুহাম্মাদ আব্দুহু, সাইয়্যেদ আহমদ খান প্রমূখ -তাদের মধ্যেও কেউ এরকম অবাঞ্চিত কথা বলেন নি।
মোট কথা, আজ পর্যন্ত বারায়ে-নাম আলেমও একাধিক বিয়ের অনুমতিকে এই শর্তের সাথে শর্তযুক্ত করে রাখেননি যে, ‘যদি সমাজে এতিম মেয়েদের সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে একাধিক বিয়ে করা জায়েয হবে’।
তাহলে তারা আবার কোন পূর্বসূরী ব্যাক্তিত্ব, যাদের ব্যাপারে এসব জনাবদের প্রমাণবিহীন দাবী এই যে, ‘তারা মুধুমাত্র এমারজেন্সি অবস্থার কারণে একাধিক বিয়ে করেছেন’! আর যদি ধরেও নেয়া হয় যে, ‘কেউ এমারজেন্সি অবস্থায় কয়েকটি বিয়ে করেছিলেন’, তাহলে এটা কোথাকার ইনসাফের কথা যে, সে ঘটনা থেকে আমরা এই বুঝে নিবো যে, যদি এমারজেন্সি অবস্থা না হত, তাহলে তারা এমনটা করতেন না! অথচ তাঁদের বক্তব্যমালা থেকে যে এর (স্বপক্ষে) কোনো সনদ পাওয়া যায় না -ব্যাপার শুধু এটাই নয়, বরং তাদের অসংখ্য বক্তব্য থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, এসকল ব্যাক্তিবৃন্দ শর্তবিহীন ভাবেই একাধিক বিয়ে জায়েয হওয়ার প্রবক্তা ছিলেন।
এহতিয়াত ও বে-এহতিয়াতী
ফেমিলি লজ অর্ডিনেন্স-এর …পর ১৪ জন ওলামায়ে েকরাম অর্ডিনেন্সের উপর যেসব সমালোচনা করেছিলেন, তার মধ্যে একটি এই ছিল যে, (দ্বিতীয়) বিয়ের আগে (প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নেয়া হয়েছে কিনা সে ব্যাপারে) আদালতের নিশ্চিত হওয়া না-হওয়ার বিষয়টি কোর্টের পক্ষ থেকে তদন্ত করা উচিৎ নয়। কারণ ইনসাফ এমন এক দায়িত্ব যা বিয়ের দ্বারা কায়েম হয়। আর যতক্ষন পর্যন্ত দায়িত্বের বুনিয়াদই কায়েম না হবে এবং (দ্বিতীয়) স্ত্রী বে-ইনসাফীর প্রমাণ পেশ না করে, ততক্ষন পর্যন্ত অপরাধ প্রমাণিত হয় না।
কুরআনের নাম নিয়ে এর এই মনসাকে পূরণ করার এই শেকেল কুরআনের কোনো লফজ বা ইশারা বা ফাহওয়া দ্বারা গ্রহন করা হয়েছে
-:টিকা:- (বক্ষমান ওয়েব পেজের টিকা)
((টিকা-৬)) শেষ জামানার কিছু জ্ঞানপাপী -যারা আলেমগণের সাথে শরীয়তের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বাকবিতন্ডার ফেতনা সৃষ্টি করবে, সেদিকে ইঙ্গিত করে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর বেশ কয়েকটি ভবিষ্যৎ বাণী বর্ণিত আছে। যেমন: হযরত উকবা বিন আমের রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেন-
سيهلك من أمتي أهل الكتاب وأهل اللبن ” ، قال عقبة : ما أهل الكتاب يا رسول الله ؟ قال : ” قوم يتعلمون كتاب الله يجادلون به الذين آمنوا ” قال : فقلت : ما أهل اللبن يا رسول الله ؟ ” قال : ” قوم يتبعون الشهوات ويضيعون الصلوات ” . اخرجه الحاكم فى المستدرك: ٦/٣٧٤, و قال: هذا حديث صحيح الإسناد ولم يخرجاه و وافقه الذهبى; و ابن جرير الطبري فى تفسيره: تحت سورة الغفير -٦٩ , و الرويانى فى المسند: ١/١٨٣ رقم ٢٣٩, ٢٤٠
‘অতি শিঘ্রই আমার উম্মতের মধ্যে কিতাবধারী ও দুধধারী’রা বরবাদ হয়ে যাবে। হযরত উকবা রা. জিজ্ঞেস করলেন: কিতাবধারী কি -ইয়া রাসুলাল্লাহ? তিনি ﷺ বললেন: ওই (মুনাফেক) গোষ্ঠি, যারা আল্লাহ’র কিতাব (আল-কুরআন)-কে শিখবে এবং তা দিয়ে বাকবিতন্ডা করবে তাদের সাথে যারা ইমানদার। হযরত উকবা রা. বলেন: আমি জিজ্ঞেস করলাম: দুধধারী কি -ইয়া রাসুলাল্লাহ? তিনি ﷺ বললেন: ওইসমস্ত লোক যারা কুপ্রবৃত্তির পিছে পিছে চলবে এবং নামাযকে নষ্ট ও বরবাদ করে ফেলবে’। [মুসতাদরাকে হাকিম- ৬/৩৭৪; মুসনাদে রুইয়ানী– ১/১৮৩, হাদিস ২৩৯, ২৪০; তাফসীরে তাবারী, ইবনে জারীর- ১৮/২৯৬]
ফায়দা: ইমাম ত্বাবরাণী রহ. হযরত উকবা বিন আমের রা. থেকে বর্ণনা করেছে যে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেন- أتخوف على أمتي اثنتين: يتبعون الأرياف والشهوات، ويتركون الصلاة والقرآن؛ يتعلمه المنافقون يجادلون به أهل العلم. اخرجه طبراني ,كنز العمال: ١١/١١٦ رقم ٣٠٨٤٢ –‘আমি আমার উম্মতের উপর দুটি বিষয় নিয়ে ভয় করি: (১) তারা গ্রামাঞ্চলের উন্নয়ন ও কুপ্রবৃত্তির পিছনে পড়বে এবং নামায ও কুরআন’কে ছেড়ে দিবে। (তখন মোক্ষম সুযোগ দেখে মুসলমানদের মধ্যে ফিতনা ছড়ানোর উদ্দেশ্যে) মুনাফেকরা কুরআনের ইলম শিখে নিবে (এবং) তা দিয়ে আহলে-ইলম (হক্কানী আলেম)গণের সাথে বাকবিন্ডা করবে’। [ত্বাবরাণী: কাঞ্জুল উম্মাল– ৫/৬৪৫, হাদিস ৩০৮৪৬]
ইমাম হাকেম তিরমিযী, ইমাম ত্বাবরাণী এবং ইমাম ইবনু আব্দিল বার রহ. নিজ নিজ সনদে হযরত আবু হুরায়রাহ রা. থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেছেন- سيأتي على أمتي زمان تكثر فيه القراء ، وتقل الفقهاء ويقبض العلم ، ويكثر الهرج ” قالوا : وما الهرج يا رسول الله ؟ قال : ” القتل بينكم ، ثم يأتي بعد ذلك زمان يقرأ القرآن رجال لا يجاوز تراقيهم ، ثم يأتي من بعد ذلك زمان يجادل المنافق الكافر المشرك بالله المؤمن بمثل ما يقول “- اخرجه الحاكم فى المستدرك : ٤/ ٤٥٧ رقم ٨٤١٢ , كتاب الفتن والملاحم و قال: هذا حديث صحيح الإسناد ، ولم يخرجاه و وافقه الذهبى, المعجم الأوسط للطبراني, رقم الحديث ٣٣٨٥; جامع بيان العلم وفضله لابن عبد البر: , رقم ١٠٤٣ ; مجمع الزوائد – ١/١٢٩ , الجامع الصغيرلالسيوطي: ٢ / ٥٧, هذا الحديث حسن –‘অতি শিঘ্রই আমার উম্মাতের উপর এমন জামানা আসবে, যখন (কুরআনের) পাঠক হবে প্রচুর, কিন্তু (কুরআনের গভীর জ্ঞনের ধারক) ফকিহ হবে অল্প, (আল্লাহ তাআলাে একে একে ফকিহ আলেমবৃন্দকে তাঁর কাছে উঠিয়ে নিবেন এবং এভাবেই) ইলম উঠে যাবে, (ফলে সর্বক্ষেত্রে জাহেল ও মুর্খ মানুষদের ঢল নামবে) এবং (এর ক্রমধারায় এমন পরিবেশ সৃষ্টি হবে যে,) হারাজ বেড়ে যাবে। জিজ্ঞেস করা হল: হারাজ কী -ইয়া রাসুলাল্লাহ? তিনি ﷺ বললেন: (শেস জামানায়) তোমাদের (মুসলমানদের) মধ্যে (সংঘটিত) খুনাখুনি (-যা হবে একটি বিশেষ ফিতনা)। সেই জামানার পর আমার উম্মতের মধ্যে থেকে এমনসব ব্যাক্তিদের আবির্ভাব হবে, যারা কুরআন-তো পড়বে, কিন্তু (কুরআনের মর্মার্থ জিহবা থেকে) তাদের (গলার) হলকূমও অতিক্রম করবে না, (ক্বলব ও মস্তিষ্কে ঢোকা-তো পরের কথা)। সেই জামানার পর এমন হবে যে, মুনাফেক, কাফের ও মুশরেক ব্যাক্তি মুমিনের সাথে আল্লাহ’র ব্যাপারে বাক-বিতন্ডা করবে -এমন উদাহরণ টেনে, যা সে বলে থাকে। [মুসতাদরাকে হাকীম- ৪/৫০৪, হাদিস ৮৪১২; আল-মু’জামুল আউসাত, তাবরাণী, হাদিস ৩২৭৭; জামেউ বায়ানিল ইলম, আব্দুল বার- ১০৪৩; মাজমাউয যাওয়ায়ীদ, হাইছামী- ১/১২৯ ;জামেউস সাগীর, সুয়ূতী- ২/৫৭]
((টিকা-৭)) এই রেওয়ায়েতের অনুবাদ আলোচনার শুরুর দিকে করে আসা হয়েছে এবং এর মতন (মূল আরবী পাঠ)টি সামনে আসছে। -(লেখক)
((টিকা-৮)) মূল শব্দটি হল جزا (যাজা)। এর শাব্দিক অর্থ করেছি ‘ফলাফল”। এখানে বাক্যের ‘ফলাফল‘ বলতে বুঝানো হয়েছে বাক্যের মধ্যে বিদ্যমান এমন উহ্য অংশকে, যে অংশটি মূল বাক্যে স্পষ্টভাবে উদ্ধৃত করা হয় নি বটে, তবে তা মূল বাক্যের দাবীকৃত অর্থ ও তাৎপর্যের পূর্ণতা বিধানের জন্য প্রচ্ছন্ন আকারে বিদ্যমান রয়েছে। এ পর্যায়ে বিজ্ঞ লেখক দুটি সুন্দর উদাহরণ দিয়েছেন এবং একথা বুঝাতে চেয়েছেন যে, এক্ষেত্রে সূরা মায়েদার ১১৮ নং আয়াতে যে বলা হয়েছে যে, إِن تُعَذِّبْهُمْ فَإِنَّهُمْ عِبَادُكَ ۖ وَإِن تَغْفِرْ لَهُمْ فَإِنَّكَ أَنتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ –‘‘(হে আল্লাহ !) আপনি যদি তাদেরকে শাস্তি দেন, তাহলে তারা-তো আপনারই বান্দা। আর আপনি যদি তাদেরকে ক্ষমা করে দেন, তাহলে আপনি মহাপরাক্রমশালী, মহাবিজ্ঞ”। [সূরা মায়েদাহ ১১৮] -এ বাক্য দুটিতে ‘আপনি যদি’’- বলে যে শর্ত এঁটে দেয়া হয়েছে, তার পরে আন্ডারলাইনকৃত বাক্যাংশ দুটি সেই শর্তের ফলাফল নয়, যদিও বা বাহ্য দৃষ্টিতে এ দুটোকে বাক্যের ফলাফল মনে হচ্ছে। বরং নিম্নে উল্লেখীত ‘প্রথম বন্ধনীর’ ভিতরে উদ্ধৃত কথাগুলোই হল বাক্য দুটির মূল ফলাফল, যা উপরোক্ত বাক্য দুটিতে সুস্পষ্ট ভাবে উদ্ধৃত হয় নি বটে, তবে তা উহ্য ও প্রচ্ছন্ন আকারে নিম্নক্ত আঙ্গিকে বিদ্যমান রয়েছে। অথাৎ-
‘‘(হে আল্লাহ !) আপনি যদি তাদেরকে শাস্তি দেন, তাহলে (তা দেয়ার এখতিয়ার আপনার আছে। কেননা) তারা-তো আপনারই বান্দা। আর আপনি যদি তাদেরকে ক্ষমা করে দেন, তাহলে (তাও করার এখতিয়ার আপনি রাখেন। কারন) আপনি মহা পরাক্রমশালী, মহাবিজ্ঞ’’। -(অনুবাদক)
((টিকা-৯)) বিজ্ঞ লেখক এখানে শুধুমাত্র তাবারী’র রেফারেন্স দিয়েছেন। তাফসীরে তাবারীতে বর্ণনাটি সংক্ষেপে আছে। কিন্তু তিনি যে আরবী ইবারতটি তরজমা সহ উদ্ধৃত করেছেন, তা সহিহ মুসলীমের। হয়-তো তিনি ‘সহিহ মুসলীম’ লিখতে ভুলে গেছেন বা টাইপিষ্ট কর্তৃক লিখতে বাদ পড়ে গেছে। যা হোক আমি ‘সহিহ মুসলীম’ সহ বিভিন্ন হাদিসের কিতাবের রেফারেন্স যুক্ত করে দিয়েছি। -(অনুবাদক)
((টিকা-১০)) বিজ্ঞ লেখক এখানে শুধু ইবনে আব্বাসের কথার আরবী ইবারত ও তরজমা উদ্ধৃত করেছেন। আমি এখানে ‘তাইসিরুল মিকবাস’-এর রেফারেন্সটি যুক্ত করে দিয়েছি। -(অনুবাদক)
((টিকা-১১)) এক হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সা. এরশাদ করেন- لَا أُلْفِيَنَّ أَحَدَكُمْ مُتَّكِئًا عَلَى أَرِيكَتِهِ يَأْتِيهِ الْأَمْرُ مِنْ أَمْرِي مِمَّا أَمَرْتُ بِهِ أَوْ نَهَيْتُ عَنْهُ فَيَقُولُ لَا نَدْرِي مَا وَجَدْنَا فِي كِتَابِ اللَّهِ اتَّبَعْنَاهُ – এমন যেন না হয় যে, তোমাদের কেউ গদিতে ঠেস দিয়ে বসে আছে, (এমতাবস্থায়) আমি নির্দেশ দিয়েছি বা কিছু করতে নিষেধ করেছি এমন নির্দেশসমূহের মধ্যে কোনো নির্দেশ তার কাছে চলে আসে, আর সে বলে: আমি (এসব হাদিস-টাদিস বলে কিছু) জানিনা। আমরা আল্লাহ’র কিতাবে যা পাবো তারই অনুসরণ করবো। [সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৪৬০৫; সুনানে ইবনে মাজা, হাদিস ২৬৬৩]
হযরত মিকদাম বিন মা’দীকারাব রা. থেকে একটি হাদিস বর্নিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেছেন- أَلَا إِنِّي أُوتِيتُ القُرآنَ وَمِثلَهُ مَعَهُ ، أَلَا يُوشِكُ رَجُلٌ شَبعَان عَلَى أَرِيكَتِهِ يَقُولُ : عَلَيكُم بِهَذَا القُرآنِ ، فَمَا وَجَدتُم فِيهِ مِن حَلَالٍ فَأَحِلُّوهُ ، وَمَا وَجَدتُم فِيهِ مِن حَرَامٍ فَحَرِّمُوهُ ، أَلَا وَإِنَّ مَا حَرَّمَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيهِ وَسَلَّمَ كَمَا حَرَّمَ اللَّهُ . رواه الترمذي ٢٦٦٤ وقال : حسن غريب من هذا الوجه ، وحسنه الألباني في “السلسلة الصحيحة” ٢٨٧٠ – খুব ভাল করে শুনে রাখো, আমাকে (ওহী সূত্রে) কুরআন দেয়া হয়েছে এবং এর সাথে অনুরূপ (ওহী সূত্রেই হিকমত ও সুন্নাহ) দেয়া হয়েছে। খুব ভাল করে শুনে রাখো, অতি শিঘ্রই এমন হবে যে, উদরপূর্ণ লোক আরামকেদারায় ঠেস দিয়ে বলবে: তোমরা শুধু এই কুরআন’কেই গ্রহন করো; এর মধ্যে তোমরা যা হালাল পাবে তাই হালাল মনে করবে এবং তাতে যা হারাম পাবে তোমরা (শুধু) সেটাকেই হারাম মনে করবে। (কিন্তু) খুব ভাল করে শুনে রাখো, আল্লাহ’র রাসুল কর্তৃক হারামকৃত জিনিস আল্লাহ কর্তৃক (কোনো কিছু) হারাম করার মতোই, (কেননা আল্লাহ’র রাসুল কোনো শরয়ী কিছুই ওহীর ইঙ্গিত ছাড়া নিজ থেকে হারাম করেন না)। [জামে তিরমিযী, হাদিস ২৬৬৪; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৪৬০৪]
এই শেষ জামানায় এক পথভ্রষ্ঠ ফেরকাহ’র অাবির্ভাব হয়েছে, যারা বলে তাদের জন্য শুধু কুরআনই যথেষ্ট, আর এদিকে মুসলীম উম্মাহ’র কাছে রাসুলুল্লাহ সা.-এর যেসকল হাদিসসমূহ নির্ভরযোগ্যসূত্রে সংরক্ষিত আছে তা আগাগোড়া অস্বীকার করে। তারা ‘আহলে কুরআন’ নামে পরিচিত, যাদেকে ‘মুনকেরুল হাদিস’ (হাদিস অস্বীকারকারী) বা ‘মুনকেরুস সুন্নাহ’ (সুন্নাহ অস্বীকারকারী)ও বলা হয়ে থাকে। এরকম একটি নামকরা ফেতনাবাজ গ্রুপ হল ভারতের আহমদ রেজা খান পারভেজ দ্বারা হালে পানিপ্রাপ্ত ফেরকাহ, যা ‘রেজা খানী’ বা ‘পারভেজী’ নামে প্রসিদ্ধ। আজকালকার লিবারাল ঘরানার লোকেরা এই ফাঁদের বেশি শিকার হয়ে থাকে। -(অনুবাদক)
((টিকা-১২)) বিজ্ঞ লেখক এখানে হাদিসটির আরবী ইবারত ও তরজমার সাথে শুধু আবু দাউদ-এর রেফারেন্স দিয়েছেন। বাকি রেফারেন্সগুলো আমি সংযুক্ত করে দিয়েছি। -(অনুবাদক)
((টিকা-১৩)) বিজ্ঞ লেখক এখানে শুধু হাদিসের আরবী ইবারত ও তরজমা পেশ করেছেন; কোনো রেফারেন্স উল্লেখ করেননি। রেফারেন্সগুলো আমি সংযুক্ত করে দিয়েছি। -(অনুবাদক)
((টিকা-১৪)) বিজ্ঞ লেখক এখানে হাদিসটির আরবী ইবারত ও তরজমার সাথে শুধু ‘তাফসীরে ইবনে কাসির’-এর রেফারেন্স দিয়েছেন। বাকি রেফারেন্সগুলো আমি সংযুক্ত করে দিয়েছি। -(অনুবাদক)
((টিকা-১৫)) এখানে ‘বোন’ বলতে যে কোনো ‘মুসলীম নারী’ উদ্দেশ্য, কারণে এক মুসলীম নারী অপর মুসলীম নারীর দ্বীনী বোন স্বরূপ। যেমন, হাদিসে আছে যে, এক মুসলমান আরেক মুসলমানের ভাই। এই হাদিসে বলা হচ্ছে যে, যে মুসলীম পুরুষের স্ত্রী আছে, সেই পুরুষকে অন্য কোনো নারী বিয়ে করার ইচ্ছে করলে সে যেন ওই পুরুষ ব্যাক্তিটিকে একথা না বলে যে, ‘তুমি তোমার ওই স্ত্রীকে আগে তালাক দিয়ে বিদায় করে দাও, তারপর আমি তোমাকে বিয়ে করবো, তার আগে নয়’। বিস্তারিত জানতে: ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার- ১১/৫০২; আল-মিনহাজ, নববী- ৯/১৯১ । -(অনুবাদক) এখানে উদ্দেশ্য হল, যা কিছু তার স্বামীর তরফ থেকে হাসিল হওয়ার তা থেকে তাকে মাহরূম ও বঞ্চিত করে দেয়া। -(লেকক)
((টিকা-১৬)) বিজ্ঞ লেখক এখানে হাদিসটির আরবী ইবারত ও তরজমার সাথে শুধু আবু দাউদ-এর রেফারেন্স দিয়েছেন। বাকি রেফারেন্সগুলো আমি সংযুক্ত করে দিয়েছি। -(অনুবাদক)
((টিকা-১৭)) বিজ্ঞ লেখক এখানে রেওয়ায়েতটির আরবী ইবারত ও তরজমার সাথে শুধু আবু দাউদ-এর রেফারেন্স দিয়েছেন। বাকি রেফারেন্স আমি সংযুক্ত করে দিয়েছি। -(অনুবাদক)
মুফতী মুহাম্মাদ তাক্বী উসমানী দা:বা: লিখিত ‘মুসলমি পারিবারিক আইন’ বিষয়ক আলোচনা পড়তে নিম্নে ক্লিক করুন।
# ইসলামী শরীয়ত বনাম আইয়ূব খানের মুসলিম পারিবারিক আইন
- ইসলামী শরীয়তে বিয়ে বনাম আইয়ূব খানের বিবাহ রেজিস্ট্রেশন আইন
- ইসলামী শরীয়তে বহু বিবাহ বনাম আইয়ূব খানের পাশকৃত আইন
- ইসলামী শরীয়তে বাল্যবিবাহ ও বিয়ের বয়স বনাম আইয়ূব খানের পাশকৃত আইন
- ইসলামী শরীয়তে তিন তালাক বনাম আইয়ূব খানের পাশকৃত আইন