ইসলামী শরীয়ত বনাম আইয়ূব খানের মুসলিম পারিবারিক আইন
লেখক: মুফতী মওলানা মুহাম্মাদ ত্বকী উসমানী দা:বা:
[ভাইস চেয়ারম্যান, ইসলামী ফিকহ একাডেমী জেদ্দাহ; শাইখুল হাদিস, দারুল উলূম করাচী; সাবেক প্রধান বিচারপতি, শরীয়াহ সুপ্রিম কোর্ট, পাকিস্তান]
[বি:দ্র: তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান আইয়ূব খান পাকিস্তানের মুসলমানদের জন্য মুসলিম পারিবারিক আইন নামে একটি শরীয়ত বিরোধী আইন রচনা করে তা জোর করে মুসলমানদের উপরে চাপিয়ে দেয়, (যার মধ্যে বিয়ের বয়স, একাধিক বিয়ে, তালাক ও উত্তরাধিকার আইন অন্তর্ভূক্ত ছিল)। তৎকালীন পাকিস্তানের গ্রান্ড মুফতী মুহাম্মাদ শফী রহ. ওইসকল শরীয়ত বিরোধী আইনগুলোর ভুল সংশোধন করানোর লক্ষ্যে তাঁর সুযোগ্য পুত্র মুফতী মুহাম্মাদ ত্বাকী উসমানী দা:বা:-কে একটি দলিল ভিত্তিক জবাবী বই লেখার নির্দেশ দেন। মুফতী মুহাম্মাদ ত্বাকী উসমানী দা:বা: পিতার নির্দেশ পালনার্থে ‘হামারা আয়েলী মাসায়েল (আমাদের পারিবারিক মাসায়েল)’ নামে একটি কিতাব লেখেন। বক্ষমান প্রবন্ধটি সেই কিতাবেরই বঙ্গানুবাদ। কিতাবটি যদিও তৎকালীন পাকিস্তানের শাসকের রচিত শরীয়ত বিরোধী সব পারিবারিক আইনের জবাবে লেখা হয়েছিল, কিন্তু মাসআলাহ গুলো পৃথিবীর সকল মুসলমানের ক্ষেত্রেই সমভাবে প্রযোজ্য বিধায়, আপনি এব্যাপারে আপনার ইলমী মুর্খতা দূর করনের জন্য এই অনুবাদটি আদ্যপান্ত অনায়াসে পড়তে পারেন; শুধুমাত্র পড়ার সময় পাকিস্তানের পরিবর্তে আপনার নিজের দেশ এবং আইয়ূব খানের পরিবর্তে আপনার দেশের শাসকের কথা চিন্তা করে পড়লেই চলবে। এব্যাপারে আমি নিজ থেকে স্বতন্ত্র কোনো প্রবন্ধ না লিখে মুফতী মুহাম্মাদ ত্বাকী উসমানী দা:বা: কর্তৃক লিখিত বইটিকেই এখানে অনুবাদ করে দেয়া এজন্য অধিক মুনাসেব মনে করেছি, কারণ মুফতী মুহাম্মাদ ত্বাকী উসমানী দা:বা: বর্তমান বিশ্বের সর্বোচ্চ সারির শরীয়ত বিশেষজ্ঞ আলেমগণের মধ্যে অন্যতম একজন আলেমে দ্বীন, যার লেখার উপরে যে কেউ আস্থা রাখতে পারে। তদুপরি তাঁর পিতা গ্রান্ড মুফতী মুহাম্মাদ শফী রহ. কিতাবটি আদ্যপান্ত পড়ে দেখে তা সত্ত্বায়ন করায় বইটির গ্রহনযোগ্যতা বহুগুণে বেড়ে গেছে। এজন্য এর অনুবাদ করে দেয়াকেই এখানে অধিক মুনাসেব মনে করেছি।]
গ্রান্ড মুফতী
হযরত মুফতী মওলানা মুহাম্মাদ শফী সাহেব রহ.-এর অভিমত
[সাবেক মুফতীয়ে আজম/গ্রান্ড মুফতী, পাকিস্তান]
بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیۡمِ
نحمده و نصلى على رسوله الكريم
আজ অমুসলীমদের পক্ষ থেকে ইসলামের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক, সামাজিক ও মতবাদগত ধারায় যে সমস্ত ষঢ়যন্ত্র ও তৎপরতা চলছে, তা আজকের নয়। বরং ইসলাম তার প্রত্যেক যুগেই এসব বিরুদ্ধবাদীদের বেড়াজালে আবদ্ধ থেকেছে, তাতে বেড়ে উঠেছে, পরিস্ফটিত হয়েছে। এদের ‘অনিষ্টতা ঝুঁকি’ -ইসলাম এবং মুসলমানদের জন্য চিন্তা বা শংকার কোনো বিষয় নয়।
কিন্তু ইউরোপের সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিত ‘তদবীর’ মুসলমানদেরকে শিক্ষা ও সংস্কুতির সঙ্গে যে যুৎসই বিষ গলদ্ধকরণ করিয়েছে, সেটা মুসলমানদের ‘বিবেক-বেধ’কে এতটাই বিষাক্ত বানিয়ে দিয়েছে যে, এতে করে তাদের চিন্তা- চেতনার ধরনটাই পাল্টে গেছে।
একজন মুসলমানের চিন্তা-চতনার মূল কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিৎ আখেরাত, আখেরাতের উন্নতি ও সফলতা এবং খোদা তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন ও তাঁর নারাজির ভীতি। তার জীবন ব্যবস্থার সমস্ত শাখা-প্রশাখা এর-ই সাথে বিজড়িত হওয়া বাঞ্চনীয়। ইসলামের শেষ দিককার জামানাগুলোতে যদিও-বা এই চিন্তা-ফিকির ও দৃষ্টিভঙ্গি‘র মধ্যে আমলগত দৃষ্টিকোণ থেকে নির্ঘাত দূর্বলতা এসে পড়েছিল, আমলে’র মধ্যেও অনেক অবহেলা হয়েছিল, কিন্তু সেসব হয়েছিল পাপকে পাপ মনে করেই। ফলত: (ভাগ্যে) তওবা নসিব হওয়ার আশাও রয়ে গিয়েছিল। মন্দকে কলানকর, আর পাপকে অনুগত্য মনে করার মত ব্যপক বিভ্রান্তির শিকার হয়নি এই উম্মত।
কিন্তু আজকের হীন সাংস্কৃতিক-পরিবেশ, ধর্মহীন শিক্ষা-দিক্ষা এবং আল্লাহ ও রাসূল থেকে মুক্তবিহঙ্গ সমাজ জীবন মুসলমানদেরকে তাদের মূল চিন্তা-চেতনার কেন্দ্রবিন্দু আখেরাত থেকে হটিয়ে নিয়ে অপরাপর জাতীগুলোর মত কেবল পার্থীব জীবন এবং এর সাথে জড়িত বস্তুসামগ্রীর মধ্যেই খুইয়ে দিয়েছে। তারা এখন তাদের জীবনকে কুরআনের অনুগামী বানানোর পরিবর্তে কুরআনকেই টেনে হেঁচড়ে তাদর জীবনের অনুগামী বানানোর ফিকিরে লেগে গেছে। এই রং-তো জীবন জীবিকা ও সাধারণ লেনদেনগুলোর মধ্যে বহু আগ থেকেই ব্যপক ভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল, কিন্তু আক্ষেপের বিষয় হল, এখন একেবারে নিরেট ইবাদতি ও নির্ভেজাল ধর্মীয় মাসআলাহ’গুলোর পালাও চলে এসেছে। এমনকি এগুলোর উপকার ও ক্ষতি নির্ণয় করতে গিয়ে -এসবের বিভিন্ন রুহানী ও তাৎপর্যগত যেসব প্রভাব ছিল, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বরং তাদের ওই ধর্মবর্জীত চিন্তা-চেতনাকে সামনে রেখে নিছক পার্থীব জীবনের লাভালাভের ভিত্তিতে বিচার করে- এসকল দ্বীনী বিষয়ের উপর যুক্তি চালানোর চর্চা শুরু হয়ে গেছে। এর মধ্যে ‘বিয়ে-তালাক’, ওয়ারিসী আইন, ‘নসব’, ইদ্দত প্রভৃতি পারিবারিক আ্ইনগুলোও রয়েছে।
আখেরাত সম্পর্কে বে-ফিকির কিছু লোক এগুলোকে কয়েক বছর ধরে তাদের ক্ষমতাসনের চর্চাক্ষেত্র বানিয়ে রেখেছে। এর শেষ ফল এই দাঁড়িয়েছে যে, সরকার এসমস্ত দ্বীনী বিষয়কে কেন্দ্র করে এমনসব আইন চালু করেছে, যা শরয়ী আহকামের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ নীতির উপর স্থাপিত। সর্বসাধারণ মসলমান, প্রত্যেক স্তরের ওলামায়ে কেরাম সহ প্রত্যেক জামাতের পক্ষ থেকে এর প্রতিবাদ করা হয়েছে। এই অধমও এসব বিষয়ের উপর একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা লিপিবদ্ধ করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের খেদমতে পেশ করেছিলাম। সেখানে -এসকল আইন যে ‘কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী’ -তা পরিষ্কার করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এতে করে -প্রত্যেক যুগেই যেমনটা হয়ে থাকে- কেউ কেউ এসব ব্যপারে কুরআন সুন্নাহ’র জ্ঞান না থাকার কারণে, আবার কেউ কেউ তাদের যুক্তিরদৌড় চালানোর কারণে বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে, আবার কেউ কেউ সম্ভবতঃ জেনে বুঝেই কারো মনতুষ্টি হাসিল করার জন্য এর ভুলটাকেই শুদ্ধ প্রমাণ করার খেদমত (!) আঞ্জাম দিয়েছে । এ কাজ করতে গিয়ে তারা কুরআন সুন্নাহ’র সুস্পষ্ট ফয়সালাগুলোর মধ্যে বিভিন্ন অপকৌশলে গলত ব্যাখ্যা ও সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি করে দিয়েছে। তদুপরি বিভিন্ন সংবাদপত্র, বিবৃতি ও পাবলীক অধিবেশনের মাধ্যমে ওই সমস্ত গলত ব্যাখ্যার দিকেই অজ্ঞ জনগণের মন-মগজকে আকৃষ্টও করা হয়েছে।
সুতরাং, কুরআন-সুন্নাহ ও উম্মাহ’র ইজমায় বর্ণিত সুস্পস্ট দলিল প্রমাণের আলোকে এ সমস্ত মাসআলাহ’র উপর বিশদ আলোচনা করা এবং প্রতিটি মাসআলার যেখানে যেখানে ব্যপকভাবে খেয়ালী অভিমত কিংবা ইলমী তাবীল ও ছলচাতুরীর আশ্রয়ে ভ্রান্ত ধারনা সৃষ্টি করা হয়েছে, তার প্রত্যেকটির উপযুক্ত জবাব দেয়া এখন জরুরী হয়ে পড়েছে।
চেয়েছিলাম নিজেই কাজটি করবো কিন্তু বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি ও দূর্বলতার পাশা পাশি সীমাহীন ব্যস্ততা সেই কাজের ফুসরত দেয়নি। এজন্য কাজটি আমার (সন্তান) মুদাররেস মওলানা তক্বী উসমানী’র (আল্লাহ তাকে নিরাপদে রাখুন) সোপর্দ করেছিলাম। তিনি -মাশাআল্লাাহ- গোটা আলোচনাটিকে তানক্বীদ ও তাহক্বীক্বের সাথে মননসই ভঙ্গিতে লিপিবদ্ধ করে দিয়েছেন। অধম তা আগা-গোড়া শ্রবন করেছি। আল-হামদু-লিল্লাহ, খুবই উপযোগী, যথার্থ ও পূর্ণাঙ্গ পেয়েছি। আল্লাহ তাআলা তার বয়স, ইলম ও আমলের মধ্যে ‘জাহেরী বাতেনী’ বরকত দান করুন!
আমার মতে, আলোচ্য মাসআলাহ সম্পর্কে সহিহ ফয়াসালা বোঝার ক্ষেত্রে একজন ইনসাফগার ব্যাক্তির জন্য এ কিতাবই যথেষ্ট । و الله المستعان و عليه التكلان
বান্দা (মুফতী) মুহাম্মাদ শফী
(আফাল্লাহু আনহু)
১৩রা সাওয়াল, ১৩৮২ হিজরী
লেখক
শাইখুল ইসলাম
মুফতী মুহাম্মাদ তাক্বী উসমানী (দা:বা:)-এর ভ’মিকা
[শাইখুল হাদিস, দারুল উলূম করাচী; সাবেক প্রধান বিচারপতি, শরীয়াহ সুপ্রিম কোর্ট, পাকিস্তান]
بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیۡمِ
الحمد لله و كفى و سلام على عباده الذين اصطفى
প্রত্যেক জাতির গড়ন, উন্নতি ও আনন্দঘন জীবন সৃষ্টিতে তার পারিবারিক আইন-কানুন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। যে জাতি ব্যক্তিপারিবারিক কোন্দলে জড়িয়ে পড়ে, সে জাতি উন্নতির গতি প্রবাহে সব সময়ই পিছপা থেকে যায়। পারিবারিক আইন-কানুনের প্রভাব যদিও-বা কতক ব্যাক্তির উপর গিয়ে পড়ে, কিন্তু ব্যক্তিরাই-তো একটি জাতির বুনিয়াদ। ব্যক্তি থেকে ঘর, ঘর থেকে বংশ এবং বংশ থেকে গোত্র গড়ে ওঠে, আর এই ভিত্তির উপরই সমাজ সভ্যতার প্রচির প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তাই পারিবারিক আইন নিছক-যে কয়েকটি বংশকেই প্রভাবিত করে তা-ই নয়, বরং এসবের প্রভাব (অনেক সময়) গোটা জাতির জন্যও যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করে থাকে। আর এজন্যই প্রত্যেকটি জাতি তার পারিবারিক বিধান গুলোকে নিজ নিজ আদর্শ, চেতনা ও বিশ্বাসের ছকে গড়ে নেয় এবং এই পারিবারিক বিধানগুলোকেই তাদের নিজেদের আদর্শ ও চেতনার পরিচয়চিহ্ন বলে মনে করে।
কেননা, এই পারিবারিক সমস্যাগুলো এতটাই নাজুক হয়ে থাকে যে, অধিকাংশ মানুষই এসব সমস্যার সমাধান দিতে গিয়ে মনুষ্যবিবেক প্রসূত: জবাব দিয়ে বসে। সে একটি সমস্যার সমাধান বেড় করলে অন্য আরেক দিকে আরও বহু সমস্যা দাঁড়িয়ে যায়। অনেক সময় এমনও হয় যে, মনুষ্যবিবেক তার সমস্ত শক্তি ব্যয় করার পর কোনো একটি সমস্যার সমাধান বেড় করে নিয়ে এই ধারনা করে বসে যে, সমস্যাটির বিশুদ্ধ সমাধান দেয়া হয়ে গেছে, এখন আর কোনো অনিষ্টতা জন্ম লাভ করবে না। কিন্তু সামনে এগুলে এই অভিজ্ঞতা হয় যে, মনুষ্যবিবেক প্রসূতঃ অমুক ধারনাটি ছিল কেবলই এক প্রবঞ্চনা বা ধোকা, যা থেকে অসংখ্য অনিষ্টতা জন্ম নিয়েছে; ব্যাপার আগেও যা ছিল, এখনোও তা-ই রয়ে গেছে।
এজন্য কুরআনুল কারিম -যা সকল প্রকার মানুষের জন্য তাদের জীবনের সকল অঙ্গনে সংশোধন ও সফলতা লাভের মননসই পয়গাম নিয়ে এসেছিল, সেই কুরআনুল কারিম পারিবারিক সমস্যালোকে নিছক মনুষ্য ধারনা-নির্ভর সিদ্ধাতের ভরসায় ছেড়ে দেয়নি। এমনটা না করে বরং পারিবারিক নানান সমস্যা ও মাসআলাহ সম্পর্কে অত্যন্ত ব্যাপক ও সুউজ্জল হেদায়েত দান করেছে এই কুরআন। এক্ষেত্রে সে তার সাধারণ অভ্যাসের বিপরীতে পারিবারিক আইনের এক একটি অংশকে অত্যন্ত খুলে খুলে বর্ণনা করেছে, যাতে করে এসব মাসআলা নিয়ে কোনো প্রকার জটিলতা ও সন্দেহ সংশয় অবশিষ্ট না থাকে।
ইতিহাসের উপর একটু ভাসা ভাসা দৃষ্টি বুলালেও আপনার কাছে দিনের আলোর ন্যায় এবিষয়টি প্রতিভাত হয়ে উঠবে যে, কুরআন কারিম মানব জাতিকে যেসকল হেদায়েত ও পথনির্দেশিকা দিয়েছিল, যতদিন পর্যন্ত তারা সেসমস্ত হেদায়েত ও পথনির্দেশিকার সীমার ভিতরে থেকে জীবন অতিবাহিত করেছে, ততদিন পর্যন্ত তাদের পারিবারিক পরিস্থিতি নিতান্ত আনন্দঘনতার মধ্যেই কেটেছে। তারা ব্যাক্তি-পারিবারিক কোন্দলে জড়িয়ে পড়ার পরিবর্তে জাতি গঠনের দিকে মুতাওয়াজ্জু থেকেছে এবং তাদের নিজ নিজ (মূল্যবান) সময়গুলোকে ঘড়োয়া ঝগড়াঝাটিতে ব্যয় করার পরিবর্তে তারা দিন-রাত ওইসমস্ত পয়গামকে (গোটা) দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেয়ার কাজে ব্যস্ত থেকেছে, যেসকল পয়গাম তাদের অাঁকা হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা ﷺ আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তাদেরকে দিয়েছিলেন। এরপর যেদিন থেকে তারা এই সমস্ত কুরআনী হেদায়েত ও পথনির্দেশিকাসমূহকে পিঠের পিছনে নিক্ষেপ করেছে কিংবা যেদিন থেকে এর উপর আমল করার প্রশ্নে দূর্বলতা পথা করে নিয়েছে, সেদিন থেকেই তাদের ‘পারিবারিক জীবন’ উত্থান-পতন ও বিপদ-আপদের এক প্রাণঘাতী সমস্যায় পরিণত হয়ে গেছে।
ভারতে পশ্চিমা-আধিপত্যের যুগটি মুসলমানদের জন্য এ দিক থেকেও দ্বীন-বর্জনের একটি যুগ ছিল যে, একে-তো অমুসলমানদের আধিপত্যের কারণে তাদের (রচিত) পারিবারিক আইন-কানুনগুলো কুরআনে প্রদত্ত হেদায়েত ও পথনির্দেশিকা মোতাবেক আর ঠিক-ঠাক বিদ্যমান থাকে নি, অপর দিকে দিন-রাত হিন্দুদের সংসর্গ ও ঘনিষ্ঠতা তাদের সমাজ-জীবনে এমন সব অগণিত রূসম-রেওয়াজ ও সংস্কৃতি জন্মীয়ে দিয়েছে, সেটা যে শুধু ইসলামী উসূল সমূহেরই সম্পূর্ণ বিরোধী ছিল তা-ই নয়, বরং তা ছিল বড়ই হৃদয় বিদারক, নিতান্ত পাশবিক এবং চরম অবিচার মূলক ।
তদুপরি যে মুসলিম জাতির কাছে জীবন কাটিয়ে দেয়ার জন্য একটি অতিব ওজনদার এবং একশত ভাগ ‘ফিতরী’ (মানব স্বভাবের সাথে সামঞ্জস্যশীল) জীবন-ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল, সেই মুসলীম জাতিটিই বেধর্মীদের জীবন-সংস্কৃতি গ্রহন করে নিয়ে নিজেরাই নিজদেরকে ধ্বংসাত্বক রুসম রেওয়াজের মধ্যে শক্ত করে বেঁধে নিয়েছিল। পরিস্থির এই পরিবর্তনের সবচেয়ে মারাত্মক আছোর ও প্রভাব গিয়ে পরেছে বেচারী নারী জাতির উপর। এই পুরো সময় জুড়ে এই ‘অবলা’ -অন্যয়, অবিচার ও দুঃখ কষ্টের উদ্বেলিত অগ্নিকুন্ডের মধ্যে পতিত হয়ে হাসফাস করতে থেকেছে।
সে সময় (ঈমানদার) বুদ্ধিজীবী এবং দ্বীপ্ত চিন্তাধারার ওলামায়ে কেরামগন যদিও-বা এ সমস্ত সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন, কিন্তু তাদের হাতে না ছিল ক্ষমতা, আর না তাদের সংখ্যা এত অধিক ছিল যে, খয়বর উপত্তকা পর্যন্ত বিস্তৃত আবর্জনাগুলোকে দূরীভূত করতে পারতেন। ফলত: তাদের ওই আওয়াজ ঢোলের আসোরে তোতা পাখির কিচিরমিচির-ই প্রমাণিত হয়েছে। তাই এসব অন্যয় অবিচারের সন্তোষ জনক কোনো চিকিৎসা হয়ে উঠতে পারে নি।
সুদীর্ঘ দু’শ বৎসরের প্রচেষ্ট এবং জান-মালের চরম ত্যাগ-তিতিক্ষার পর মুসলমানরা তাদের নিজেদের জন্য একটি স্বাধীন ইসলামী রাষ্ট্র অর্জন করে নেয়। যে জোশ ও আশা-আকাঙ্খা নিয়ে আমরা এই রাষ্ট্র অর্জন করেছিলাম, তার দাবী এই ছিল যে, অমুসলীমদের সাথে (এতদিন) গড়াগড়ি খেয়ে বসবাস করার কারণে আমাদের উপর যেসকল ইস্যূ চড়াও হয়েছিল, আমরা আমাদের জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে থাকা সেসব ময়লা-আবর্জনাকে নিজেদের আচোল থেকে ঝেড়ে ফেলে দিবো, একইভাবে আমরা ওই সমস্ত আবর্জনা থেকেও নিজেদেরকে পাক-সাফ করে নিবো, যা মন্দ আকারে আমাদের পারিবারিক জীবনে এসে ঢুকে পরেছিল, এরপর আমারা আমাদের জীবনকে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে ইসলামী জীবন-ব্যবস্থার ওই মননসই ছাঁচে ঢেলে নিবো, যে জীবনব্যবস্থা সর্বদাই আমাদের সফলতা ও সৌভাগ্যের জামীনদার থেকেছে।
পারিবারিক কমিশন
যা হোক, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কয়েক বছর পর সম্ভবতঃ এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই সরকার একটি ‘পারিবারিক কমিশন’ গঠন করে, যার মর্যাদাগত অবস্থান এমনটা হওয়াই আবশ্যক ছিল যে, আমাদের সমাজ জীবনে যে সমস্ত অনিষ্টতা ও অকল্যানকর বিষয়ের অনুপ্রবেশ ঘটেছে, তার সবগুলোকেই তারা খঁতিয়ে দেখবেন; এরপর ইসলামী শিক্ষার আলোকে তার সঠিক সমাধান বেড় করবেন, যাতে করে আমাদের সমাজ কুরআন-সুন্নাহ’র পরিষ্কিার প্রস্রবনে সিঞ্চিত হয়ে পুনরায় সতেজ হয়ে উঠতে পারে। এই উদ্দেশ্যটি ছিল অতীব বরকতময়। কিন্তু –
قسمت کی خوبی ديکہئے ٹوٹی کھاں کمند
دو چار ہاتھ جبکہ لب بام رہ گيا
আক্ষেপ এই যে, সরকার এ পর্যায়ে দুটো বুনিয়াদী ভুল করে বসলো। (১) এই কমিশনের সমস্ত রোকন দেরকে তারাই নির্বাচন করলেন, যারা পশ্চিমা শক্তির অন্ধকারচ্ছন্ন রাতে নিজেদের ইসলামী দৃষ্টিশক্তির সবটুকুই খুইয়ে রেখেছিলেন। এই লোকগুলি না ইসলামের প্রথমা উত্তম যুগের সেই জৌলুস দর্শন করেছিলেন, আর না (কমপক্ষে সেই যুগ সম্পর্কে লিখিত হাদিস ও ইতিহাসের) গ্রন্থসমূহের মাধ্যমে মুক্তমনে তা অধ্যায়ন করেছিলেন। ফলে তাদের চিন্তাধারা -ইসলামী ব্যবস্থার আহবায়ক হওয়ার পরিবর্তে পশ্চিমা জীবন ব্যবস্থার ওই বাহ্যিক চমক ও উজ্জলতার প্রেমাশক্ত ছিল, যা মূলতঃ কবি ইকবালের ভাষায়-
جوٹے نگوں کی ريزہ کاری ہے
‘যেসকল বিধিবিধান তৈরী করা হবে, সেগুলো কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেকই করা হবে’ -যেহেতু একথার উপরই এসমস্ত সংশোধনীর সফলতা নির্ভরর্শীল ছিল, তাই জরুরী ছিল, কমিশনের সিংহভাগই থাকবেন এমনসব ওজনদার ওলামায়ে কেরাম, যাঁরা তাঁদের গোটা জীবন কুরআন-সুন্নাহ বুঝতে অতিবাহিত করে দিয়েছেন, তদুপরি তাঁদের ইলম, আমল ও দূরদৃষ্টির উপর পুরাপুরি আস্থাও রাখা যায়। কিন্তু এর বিপরীতে যা ঘটলো, সেটা হল, কমিশনে কেবল একজন মাত্র আলেমে দ্বীন মওলানা ইহতেশামুল হক সাহেব থানভী রহ. ছাড়া আর কোনো আলেমকে নেয়া হল না। কমিশনের সিংহভাগ রয়ে গেল তারাই, যাদের জীবনের কোনো অংশেও ‘কুরআন কারিম’ ও ‘সুন্নতে নববী’ নিয়মতান্ত্রিক ভাবে পড়া ও পড়ানোর কখনোই সুযোগ হয়নি। ফল এই হল যে, তারা এর ক্রমধারায় ‘কুরআন-সুন্নাহ’র একদম বিরুদ্ধ কিছু আইন রচনা করে দিলেন। আর যাও-বা একজন আলেমে দ্বীন মওলানা ইহতেশামুল হক সাহেব রহ. কমিশনের রোকন হিসেবে বিদ্যমান ছিলেন, তাঁর কথাকেও খোলাখুলিভাবে রদ্ করে দেয়া হলো। এতে করে ইতিপূর্বে যে ভুলটি আমাদের পারিবারিক বরবাদীর উপকরণ তৈরী করে দিয়েছিল, যেহেতু আবারও সেই একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করা হচ্ছিলো, তাই রাষ্ট্রের চতুর্দিক থেকে ওলামায়ে দ্বীন ও সর্বসাধারণ মুসলমানদের পক্ষ থেকে এর বিরুদ্ধে প্রচন্ড প্রতিবাদ উঠলো এবং দেশের সম্মানীত চিন্তাবীদগন এসব আইনের ভুল-ভ্রান্তিগুলোকে স্পষ্ট করে দিলেন। এসব ঘটনার চাহীদা এই ছিল যে, এসমস্ত মাসআলাহর উপর পুণরায় গভীর ভাবে চিন্তাভাবনা করে তা কুরআন-সুন্নাহর আলোকে প্রস্তুত করে আইনের রূপ দান করা হবে এবং যতক্ষন পর্যন্ত না এ ব্যাপারে সুনিশ্চিৎ হওয়া যায় যে, এখন এসকল আইনের মধ্যে আর কোনো আবর্জনা অবশিষ্ট নেই, ততক্ষন পর্যন্ত এর উপর সমালোচনা করা ও দৃষ্টি দানের সাধারণ স্বাধীনতা দেয়া হবে, এবং নিশ্চিন্ত হওয়ার পরই তা কার্যকর করা হবে।
ফ্যামেলী ল’জ্ অর্ডিনেন্স (পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ)
কিন্তু মার্শাল-ল’ সরকার ক্ষমতায় আসার পর জানি না (মুসলমানদের) পারিবারিক মাসআলাহ গুলোকে এতটা গুরুত্বহীন মনে করলো কেনো যে, (ওলামায়ে কেরাম ও সর্বসাধারণ মুসলমানদের পক্ষ থেকে) প্রচন্ড বিরোধীতার পরও এমন এক বাকস্বাধীনতারুদ্ধ যুগে তা কার্যকর করার ঘোষনা দেয়া হল, যখন মার্শাল-ল’র বিরুদ্ধে মুখ খোলাও ছিল পাপ।
কিন্তু বিষয়টি যেহেতু এমন ছিল যে, এর প্রতিবাদ না করাটাই যেন ওই উদ্দেশ্যকে ভুল আখ্যায়িত করার নামান্তর, যে মহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কসম খেয়ে পাকিস্তান বানানো হয়েছিল, এজন্য ‘ওলামায়ে হক্ব’ এবং সর্বসাধারণ মুসলমানগণ চতুর্দিক থেকে এর বিরুদ্ধে নিজ নিজ ধারায় প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু জানি না কেনো (তাদের বানানো) এসমস্ত প্রকৃতিবিরুদ্ধ আইনগুলোকেই পাকিস্তানী (মুসলমান)দের উপর চাপিয়ে দেয়াকে এত জরুরী মনে করা হল যে, এতসব প্রতিবাদের পরও ওগুলোকেই তাদের উপর কার্যকর করে দেয়া হল, বরং বলবো, ঠেঁসে (খাইয়ে) দেয়া হলো।
আরও ভয়ঙ্কর কথা হল, এসকল জনাবরা তাদের ওই আইনগুলিকেই ‘ইসলামী আইন’ (!) নাম দিয়ে কার্যকর করে দিচ্ছেন! এর ক্রমধারয় কমিশন আবার কিছু অযাচিত দলিল-দস্তাবেজের এক স্তুপও জমা করে ফেলেছে। এর অবিসম্ভাবি পরিণতি-তো এই দাঁড়াবে যে, যখন এ আইনগুলি শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় সরাসরি ব্যর্থ হয়ে যাবে, তখন অমুসলীমরা একথা বলার বাহনা পাবে যে- ‘‘তোমরা তোমাদের ইসলাম সম্পকে বলে থাকো যে, ইসলামের মধ্যে সকল যুগের যাবতীয় সমস্যার নিশ্চিৎ সমাধান রয়েছে। বস্তুত: তোমরা তোমাদের পারিবারিক সমস্যাগুলোকে খতম করে দেয়ার জন্য কুরআন সুন্নাহ’র নামে যে ‘মুসলিম পারিবারিক আইন’ রচনা করেছিলে, সেই আইন যে কোনো সমাধান দিতে পারেনি ব্যাপার শুধু তা-ই নয় বরং এতে সমস্যা আরও বেড়ে গেছে!’’
কিন্তু এসকল বিষয়ের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে এমন কিছু লোক এসব আইনের সাফাই গেয়ে আওয়াজ উঠলো, যারা না কুরআন-সুন্নাহ’র সাথে কোনো সম্পর্ক রাখে, আর না দেশ ও জাতির উপকার অর্জনের ব্যাপারে তাদের কোনো আন্তরিকতা আছে। বরং তাদের কাছে মানব জাতির উন্নতির শিড়ি হল, তারা হয় পশ্চিমা সভ্যতার একটি পরিপূর্ণ নমুনা বনে যাবেন, না হয় ক্ষমতাশীল সভাসদের দরগায় গিয়ে কিছু মনতুষ্টি হাসিল করে নিবেন। জনসাধারণের কাছে এরা দু’ধরনের দাবী প্রচার করা শুরু করে দিয়েছে। (১) বর্তমান ‘পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ’ টি একেবারে কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেকই রয়েছে। (২) এর উদ্ধেশ্য হল নারীদের উপর সংঘটিতব্য অন্যয়–অবিচার দূর করা; আর এর দ্বারা অন্যয় অবিচার দূরও হয়ে যাবে। [বাংলাদেশে ইসলামী ফাউন্ডেশনের হালের মহাপরিচালক শামীম মোহাম্মদ আফজাল ও তার সমমনা ওলামা লীগের কথাবার্তা ও কান্ডকারখানা এরকমই।- অনুবাদক ]
এ দাবীটি যদিও সম্পূর্ণ ভ্রান্ত এবং একথা প্রমাণকল্পে পেশকৃত দলিলগুলো একদম অথর্ব ও দূর্বল ছিল, বরং এর অধিকাংশকে ‘দলিল’ বলাটা ‘দলিল’ শব্দটির পদমর্যাদাকে খাটো করারই নামান্তর, তাই এসমস্ত ‘দলিল’ স্বত্ত্বাগতভাবে তো এর যোগ্যই ছিল না যে, এর কোনো ইলমী জবাব দিতে হবে। বলা বাহুল্য, কেউ যদি একথা প্রমাণ করতে বসে যায় যে- ‘তাউহীদ (একত্ববাদ) কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা (নাউযুবিল্লাহ) প্রমাণিত নয়’, কিংবা ‘ইসলামে শুয়োর হারাম নয়’; এবং সে এর স্বপক্ষে কোনো দলিলও দিয়ে বসে, তখন এরও কি জবাব দিতে হবে? এর খন্ডনেও কি কিতাব লিখতে হবে?
কিন্তু আক্ষেপ এই যে, আমাদের সাধারণ জনগন দ্বীনি শিক্ষা-দিক্ষা থেকে এতটাই দূরে সরে গেছে যে, তারা তাদের নিজেদের ধর্মের বুনিয়াদি বিষয় সম্পর্কেও জ্ঞান রাখে না। ফলত: তারা প্রত্যেক এমন ব্যক্তির পিছনে পিছনে চলে, যে তাদের সামনে কুরআনের কোনো আয়াত পাঠ করে দেয়, কোনো হাদিস শুনিয়ে দেয়, কিংবা কোনো কিতাবের রেফারেন্স দিয়ে দেয় -চাই ওসব বিষয় তার দাবীর সাথে যত সম্পর্কহীনই হোক না কেনো! যেমন, কেউ যদি নবুওতের দাবী করে বসে, তাহলে একটি বিশেষ সম্ভ্রান্ত মহল তার অনুগামী হয়ে যায়। কেউ হাদিসকে মানতে অস্বীকার করে বসলে বহু লোক সেটাকেই ইসলাম ভেবে বসে। আবার কেউ যদি ‘কমিউনিজম’ ও ‘ইসলাম’ এদুয়ের মাঝে ঐক্য ও একাত্বতা প্রমাণে লেগে যায়, তাহলে একটি মহল তাদের সুরে সুর মিলাতে শুরু করে দেয়।
আর এজন্যই ওইসমস্ত ধোঁকা ও প্রতারনাগুলোর প্রকৃত চেহারা উম্মোচন করে দেয়াটাকে জরূরী মনে হল, যা (তাদের রচিত) বর্তমানকার পারিবারিক -আইনগুলোকে কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক হওয়া (!) এবং অন্যয়-অবিচারের সমাধান বলে প্রমাণ করার জন্য পেশ করা হয়েছে।
বক্ষমান কিতাবে ‘‘পারিবারিক ল’ অর্ডিনেন্স’’-এর যে সমস্ত দফা’গুলোর কুরআন ও সুন্নাহ’র বিরোধী -তার উপর পর্যালোচনা করা হয়েছে । এই কিতাবে শরীয়ত ও যুক্তি -দু’ দৃষ্টিকোণ থেকেই ‘একাধিক বিয়ে’, ‘তালাকের মাসআলাহ’ এবং ‘বিয়ের বয়স’ সম্পকির্ত বিধানকে পর্যালোচনা করা হয়েছে। অধিকন্তু (আইয়ূব খানের পাশ করা এসকল) পারিবারিক-আইনের তরফদারী পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট লেখকদের (রচনায়) এ যাবৎ যতগুলো দলিল দৃষ্টিগোচর হয়েছে, এখানে তার সবগুলোর বিস্তারিত জবাব দেয়া হয়েছে। এ কিতাবের কোথাও কোথাও নিরেট ইলমী ভঙ্গির বহছও এসে গেছে। ওগুলোর ক্ষেত্রে অামি চেষ্টা করেছিলাম, যাতে আলোচনার ধরন সাধারণ বোধগম্য ও সহজ-সরল হয়। কিন্তু এজাতীয় বহছকে একেবারে সাধারণ বোধগম্য ভঙ্গিতে নিয়ে আসা খুবই কঠিন। তাই কারও যদি কোথাও এ ধরনের কাঠিন্যতা অনুভূত হয়, তাহলে আমি (সেক্ষেত্রে) অপারগ ছিলাম মনে করে সেটা কোনো যোগ্য আলেমের কাছে তা বুঝিয়ে নিবেন।
কিতাবটি এজন্যেও দীর্ঘ হয়ে গেছে যে, আমার আকাঙ্খাও ছিল, যাতে ‘পারিবারিক মাসায়েল’ অথবা ‘শরীয়তের বুনিয়াদী উসূল’ বক্ষমান কিতাবে অধিক থেকে অধিক পরিমাণে জমা হতে পারে; যাতে করে কুরআনের পাঠকগন ইসলামী শরীয়তের মেজাজ-মর্জি, ভাবধারা এবং এর বিভিন্ন হিকমত সম্পর্কেও অধিক থেকে অধিক পরিমানে জ্ঞান লাভ করতে পারেন। বস্তুত: যে ব্যক্তি এ কিতাবটি আগাগোড়া পড়ে নিবেন, তিনি সংশ্লিষ্ট মাসআলাহ সমূহ ছাড়াও কমপক্ষে শরীয়তের দলিল উপস্থাপনের ঊসূল সম্পর্কেও পরিচিতি লাভ করতে পারবেন।
এটা কোনো ইখতিলাফী মাসআলাহ নয়
তবে এই কিতাব দেখে কেউ যেন এই ধারনা করে না বসেন যে, আলোচ্য মাসায়েল সম্পর্কে ওলামায়ে কেরামদের মাঝে কোনো ইখতিলাফ (মতপার্থক্য) রয়েছে, কিংবা অপরাপর ইখতিলাফী মাসায়েলের ন্যয় এগুলোও এমন কোনো ইখতিলাফী মাসআলাহ, যেক্ষেত্রে কোনো এক পক্ষে অবস্থান করাতে কোনো অসুবিধা থাকে না। কেননা, ইখতিলাফী মাসআলাহ তো হল সেই মাসআলাহ, যেক্ষেত্রে দ্বীনি ইলমের প্রশ্নে বিজ্ঞ হওয়ার পাশা পাশি তাতে অন্তদৃষ্টি ও গভীরতা রাখেন -এমন ব্যক্তিগণ পরষ্পরে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষন করেন। আর আপনারাও দেখতে পাবেন যে, এসকল মাসআলাহ সম্পর্কে উম্মাহ’র একজন আলেমও ভিন্নমত পোষন করেন নি।
রাসুলুল্লাহ ﷺ থেকে নিয়ে আজ পর্যন্তকার সকল ‘মাকতাব-ফিকির’ ওলামায়ে কেরাম আলোচ্য মাসায়েল সম্পর্কে একমত ও একজবান। তাঁদের বিপরীত কথা বলেছে মুধুমাত্র ওই সমস্ত পশ্চিমা-ঘেঁষা কিছু লোক, যাদের জীবনের কোনো অংশেও ‘দ্বীনি ইলমে’র সাথে কোনো যোগসূত্র ছিলনা। ফলত: বক্ষমান কিতাবের বৈশিষ্ট দাঁড়িয়েছে ঠিক তেমনই, যেমনটা হয়ে থাকে ‘হাদিস অস্বীকৃতি’ বা ‘কাদিনিয়াত’-এর বিরুদ্ধে লিখিত কিতাবসমূহ হয়ে থাকে। অর্থাৎ ইসলামে যদিও এই মাসআলাহ’গুলো ইখতিলাফপূর্ণ নয়, কিন্তু ‘হাদিস অস্বীকারকারীরা’ অথবা ‘কাদিয়ানী-মতালম্বীরা’ যেহেতু তাদের দয়াপরায়নতার (!) দ্বারা (নিজেদের বানানো আকীদা-বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে) মুসলমানদের মনে কিছু সন্দেহ সৃষ্টি করে দিয়েছে, তাই তাদের প্রতি উত্তর দান করা জরুরী, (আর এজন্যই আলেমগণ ওদের ভন্ডামী উন্মোচন করার উদ্দেশ্যে কলম ধরেছিলেন)। এমনিভাবে এ গ্রন্থের উদ্দেশ্য ওইসমস্ত সন্দেহ-সংশয়কে দূর করা, যা এ যুগের কতিপয় করুনাকারী জনাব (!) গোটা মুসলিম উম্মাহ’র বিরূদ্ধে ছড়িয়ে দিয়েছে। সুতরাং, এ থেকে -‘‘এগুলোও কোনো ইখতিলাফী মাসআলাহ’’-একথা বুঝে নেয়া ভুল হবে।
পরিশেষে অামরা আমাদের ওই সমস্ত বন্ধুদের কাছে আন্তরিকভাবে নিবেদন করবো, যারা বর্তমানকার পারিবারিক আইনের তত্ত্বাবধান করছেন; আপনারা আল্লাহ’র ওয়াস্তে পরকালের দিকে তাকিয়ে এই বইটি নিরপেক্ষভাবে অধ্যায়ন করুন। এর মধ্যে যে সকল দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে, আপনার অন্তকরণ যদি তাতে প্রশান্ত হয় , তাহলে পুণঃব্যাখ্যার পথ পরিত্যাগ করে নিজের চিন্তাধারা থেকে ফিরে আসুন। হক্ব কথা মেনে নেয়ার দ্বারা মানুষের মর্যাদায় ঘাটতি সৃষ্টি হয় না, বরং মর্যাদা আরো বেড়ে যায়।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে হক্ব পথে দৃঢ়পদ থাকার এবং স্বীয় দ্বীনের বেশি থেকে বেশি খেদমত করার তৌফিক দান করুন। —-আমীন!!! و ما توفيقى الا بالله
(মুফতী) মুহাম্মাদ তাক্বী উসমানী
৮-ই জানুয়ারী, ১৯৬৩ইং
(শাইখুল ইসলাম মুফতী মুহাম্মাদ তাক্বী উসমানী দা.বা.-এর মূল আলোচনা শুরু)
কয়েকটি বুনিয়াদী কথা
মূল আলোচনা শুরু করার পূর্বে দলিল উপস্থাপনের বুনিয়াদী উসূল টিকে পরিষ্কার করে দেয়া দরকার এবং যেসকল উৎসধারা থেকে শরয়ী মাসআলা ইস্তিম্বাত (উদ্ভাবন) করা হয়, তা এখানে চিহ্নিত করে দেয়াটা মুনাসেব মনে হচ্ছে। ইসলামী শরীয়তের বুনিয়াদী উৎসধারা হল ৪ টি-
(১) কুরআন কারিম;
(২) রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর সুন্নাহ (বা কথা, কাজ ও জীবনাদর্শ)
(৩) উম্মাহ’র ইজমা (ঐক্যমত); এবং
(৪) কিয়াস।
তবে এখন আমরা প্রথম তিনটি উৎসধারা নিয়ে আলোচনা করবো। [কারণ, বিয়ে ও তালাক বিষয়ক যে মাসআলাহ নিয়ে বক্ষমান কিতাবে আলোচনা পেশ করা হবে, তাতে উম্মাহ’র ইজমা (ঐক্যমত) রয়েছে। সুতরাং, কিয়াসের আলোচনা আনার প্রয়োজন এখানে নেই। ইজমা ও কিয়াস সম্পর্কে দলিল সহ বিস্তারিত জানতে হলে পড়ুন আমাদের লিখিত ইসলামী শরীয়তের উৎস ও মানদন্ড : কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস– আলোচনাটি।- অনুবাদক]
(১) কুরআন কারিম
উপরোক্ত উৎসধারাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন উৎসধারাটি হল ‘কুরআন কারিম’, যার কোনো একটি কথার প্রত্যাক্ষান বা অস্বীকৃতিও মানুষকে ইসলামের সীমানা থেকে বেড় করে দিয়ে কুফরী’র সীমায় পৌছে দেয়। কুরআন যেহেতু আল্লাহ’র কালাম (বাণী), তাই কোনো যুগেও এর বিধিবিধানে রদ-বদল চলতে পারে না। কুরআনের বিধানগুলো প্রত্যেক যুগে সমমাত্রায় উপকারী এবং সর্বাবস্থায় অত্যাবাশ্যক ও অপরিহার্যভাবে আমলযোগ্য।কুরআন গোটা মুসলিম জাতির জন্য সর্বাধিক প্রমাণপুষ্ট উৎসমূল। এটা এ কারণে যে, খোদ আল্লাহ তাআলাই এর হিফাজতের দায়িত্ব নিয়েছেন। মূলতঃ চোদ্দ’শ বছরের দূর ব্যবধানেও এর মধ্যে একটি নোকতা’রও বিয়োজন সম্ভব হয় নি । কিন্তু এখানে একটি কথা বুঝে নেয়া বাঞ্চনিয়। আর সেটা হল, আজকাল একটি বড় সমস্যা এই দেখা দিয়েছে যে, সামান্য আরবী পড়েছে এমন প্রত্যেক ব্যক্তিই কুরআন কারিমকে নিজের চর্চার বিষয় বস্তু বানাতে শুরু করে দেয় এবং কুরআন কারিমের বিধান গুলোকে যেভাবে ইচ্ছা দুমড়ে-মুচড়ে রেখে দেয়।
قرآن تو برحق هے مگر اپنے مفسر
এটা একদম পরিষ্কার কথা যে, ‘কুরআন’ আল্লাহ তাআলার اصولی کلام (উসূলী কালাম/মূলনীতিগত বাণীসম্ভার), যার তাৎপর্য ও উদ্দেশ্য বোঝা যার-তার সাধ্যের কর্ম নয়। সামান্য একটি বিধান বা নীতিমালার কিতাবও কেউ নিছক ভাষা জানার দ্বারা বুঝতে পারে না। সেক্ষেত্রে কুরআন কারিমের ব্যপারটি-তো সর্বাবস্থায়ই অতি উচ্চ মার্গের । বিধায়, আল্লাহ তাআলা কুরআনকে সোজা-সুজি পাঠানোর পরিবর্তে রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে উদ্দেশ্য করে বলেছেন-
وَأَنزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ
‘‘আর(হে নবী মুহাম্মাদ!) আমি আপনার উপর কুরআনকে এই জন্য নাজিল করেছি, যাতে আপনি মানুষের সামনে ওই সমস্ত বিষয়কে খুলে খুলে বয়ান করে দিতে পারেন, যা তাদের জন্য নাজিল করা হয়েছে‘’। [সূরা নাহল ৪৪]
অন্যথায়, আরবের মুশরেকরা তো এই কামনাই করতো যে, সোজাসুজি তাদের হাতে একটি ‘কিতাব’ ধরিয়ে দেয়া হোক, যা দেখে দেখে তারা আমল করে নিবে। আল্লাহ তাআলার নিরঙ্কুশ কুদরতের কাছে এটা সমস্যার কিছুই ছিল না। কিন্তু তিনি সেটা করেন নি। কেননা, এমনটা যদি করা হত, তাহলে প্রত্যেক ব্যক্তি কুরআনের মনগড়া অর্থ বেড় করে নিতো এবং দ্বীন ইসলাম প্রত্যেক ব্যক্তির খাহেশাত ও কু-প্রবৃত্তির হাতে একটা খেলনায় পরিণত হয়ে যেতো।
এর বিপরীতে, আল্লাহ তাআলা কুরআন কারিমের সাথে একজন ‘মুআল্লেম’ (শিক্ষক)কেও পাঠিয়ে দিয়েছেন, যার সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য এই যে, কুরআনের ওই তাফসীর বা ব্যাখ্যাই গ্রহনযোগ্য হবে, যা রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, কিংবা ওই সকল সাহারায়ে কেরাম রা. প্রদান করেছেন, যাঁরা সরাসরি রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে কুরআন মজিদ পড়তেন এবং রাসুলের পবীত্র জীবনে কুরআনের আমলগত ব্যাখ্যা প্রত্যক্ষ করতেন।
বলা বহুল্য, আমরা কুরআন কারিমের তাফসীর বা ব্যাখ্যাকে ওই আঙ্গিকে বুঝতে পারবো না, যেভাবে বুঝেছিলেন হযরতে সাহাবায়ে কেরাম রা.। কেননা, কথকের কথা বোঝার জন্য মুধুমাত্র তার ভাষা বোঝাই যথেষ্ট হয় না বরং কথাবার্তার পরিবেশ ও মুহূর্তকাল, কথকের আওয়াজ বা শব্দগত বাচনভঙ্গি, কন্ঠের উচ্চগ্রাম-নিম্নগ্রাম, শিক্ষার্থীর মেজাজগত আন্দায -এসবকিছুই একজনের কথার মর্ম ও অর্থ বোঝার জন্য সীমাহীন জরুরী হয়ে থাকে। আমরা এর সবগুলো থেকেই একেবারে রিক্তহস্ত-পদ অপর দিকে সাহাবায়ে কেরাম রা এর সবগুলো দ্বারা সমৃদ্ধ ছিলেন। বিধায় এ সকল ব্যাঁক্তিবৃন্দের বর্ণিত ব্যাখ্যার মোকাবেলায় আমাদের ব্যাখ্যা কোনো মর্যাদাই রাখে না -চাই আরবী ভাষায় আমরা যত দক্ষই হই না কেনো এবং এর শব্দাবলী ও বাকভঙ্গির উপর আমাদের যত উচ্চাসনই অর্জিত থাক না কেনো। আবু জেহেল ও আবু লাহাব কি আরবী ভাষার জবরদস্ত পন্ডীত ছিল না? কিন্তু বলা বাহুল্য, তাদেরকে কুরআনের আলেম বলা যেতে পারে না।
এজন্য বিবেকগতভাবে কুরআন কারিমকে বোঝার সঠিক মাপকাঠি হল, কুরআনকে ওই সকল সাহাবায়ে কেরাম রা. থেকে বুঝতে হবে, যাঁরা সরাসরি রাসুলুল্লাহ ﷺ থেকে কুরআনের ইলম অর্জন করেছেন।
এই অনস্বীকার্য উসূল/মূলনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে যে তাফসীর বা ব্যাখ্যাটি সাহাবীদের থেকে বর্ণিত ব্যাখ্যা সমূহের সাথে সাংঘর্ষিক হবে, তা দরিয়ায় নিক্ষেপ করার উপযুক্ত।
বস্তুতঃ কুরআন কারিম বুঝতে গিয়ে যতগুলো গোমরাহী ও পথভ্রষ্ঠতার পথ বেড় হয়, তা বেড় হয় মূলতঃ এই বুনিয়াদী বিষয়টিতে ভুল করার কারণেই। তাই যে ব্যক্তি কুরআন মজিদ বুঝতে চায়, তার জন্য অতীব জরুরী হল, সে এ বিষয়টিকে সর্বক্ষন দৃষ্টির সামনে রাখবে এবং যে তাফসীরটি রাসুলুল্লাহ ﷺ অথবা সাহাবায়ে কেরাম কর্তৃক বর্ণিত তাফসীরসমূহের সাথে সাংঘর্ষিত হবে, সে তার (নিজের) প্রত্যেকটি (ব্যাখ্যা)কেই গলত ও ভ্রান্ত মনে করবে। যদি এই উসূলগত বিষয়টিকে সম্মুখে রাখা যায়, তাহলে এর মাধ্যমে বহু ভ্রান্ত ধারনা আপনা আপনিই দূর হয়ে যাবে।
(২) রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর সুন্নাহ (কথা, কাজ ও জীবনাদর্শ)
ইসলামী শরীয়তের দ্বিতীয় উৎস হল ওই সমস্ত কথা ও কাজ, যা রাসুলুল্লাহ ﷺ হতে ‘হাদিস’ আকারে বর্ণিত হয়েছে।
বিগত আলোচনা থেকে একথা প্রতিভাত হয়ে যায় যে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এর সুন্নাহ (কথা, কাজ ও জীবনাদর্শ) থেকে দৃষ্টিকে সরিয়ে নিয়ে কুরআনকে বোঝা কক্ষোনই সম্ভব নয়। যদি বোঝা যেতোই, তাহলে দ্বীন শিক্ষা ও প্রশিক্ষনের জন্য শুধুমাত্র কুরআনই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু আল্লাহ তাআলা মুধুমাত্র কুরআন নাজিল করেই যেহেতু ক্ষান্ত হন নি, বরং কুরআনের সাথে সাথে রাসুলুল্লাহ ﷺকেও পঠিয়ে দিয়েছেন, আর এই পাঠানোর উদ্দেশ্য স্বয়ং এই বলে দিয়েছেন যে- لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ – যাতে আপনি মানুষের সামনে ওই সমস্ত বিষয়কে খুলে খুলে বয়ান করে দিতে পারেন’। তাই এ থেকে পরিষ্কার প্রতিভাত হল যে, সুন্নাহ’র উপর থেকে দৃষ্টিকে সরিয়ে নিয়ে ইমলামী শরীয়তের ‘‘বিধিবিধান’’ ইস্তেম্বাত (চয়ন) করা সম্ভব নয়। যে ব্যক্তি দাবী করে যে, সুন্নাহ ছাড়াও শরয়ী বিধিবিধান ইস্তেম্বাত করা সম্ভব, সে মূলতঃ নবীগণের প্রেরণের বুনিয়াদী উদ্দেশ্য সম্পর্কেই জাহেল ও মুর্খ এবং সে বিশ্বের সামনে যেসব কথা পেশ করছে, সেটা কোনো নতুন মতবাদ হলে হতে পারে, কিন্তু সেটা ওই ইসলাম হতে পারে না, যে ইসলামকে আল্লাহ তাআলা রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর মাধ্যমে বিশ্বের জন্য প্রেরণ করেছিলেন।
আল্লাহ তাআলা নিজেই যেখানে কুরআন মজিদের আলফাজ/শব্দমালা হিফাজত করার দায়ীত্ব নিয়েছেন, সেখানে তিনি কুরআনের অর্থ, মর্ম এবং ব্যাখ্যা বিশ্লেষন হিফাজতেরও জামানত দিয়েছেন।
إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ – ‘নিশ্চই আমিই (সেই সত্ত্বা, যিনি) আল-যিকর নাজিল করেছি এবং আমিই তার হিয়াজতকারী। [সূরা হিজর ৯] –এই আয়াত থেকে বোঝাই যাচ্ছে যে, এখানে الذِّكْر (আল-যিকর) দ্বারা শুধুমাত্র কুরআনের শব্দমালা হিফাজত করাই উদ্দেশ্য নয়, কেননা ‘কুরআন’ শুধু মব্দমালার নাম নয়, বরং ‘শব্দ-মর্ম’ -দুটোর’ই নাম। বিধায়, এ আয়াতের মধ্যে (শব্দমালার সাথে সাথে) কুরআনের অর্থ ও মর্ম হিফাজতেরও ওয়াদা করা হয়েছে। কুরআনের এই অর্থ ও মর্মই হল হাদিস। ফলত: আল্লাহ তাআলা যখন ‘সুন্নাহ’ মোতাবেক ‘আমল’ করাকে অত্যাবশ্যক ও অপরিহার্য করে দিয়েছেন, তখন তিনি এই ‘সুন্নাহ’কে হিফাজত করার উপায়-উপকরণও সরবরাহ করে দিয়েছেন।
আর এটা নিছক বিবেকপ্রসূত কথা নয়। ঘটনাসমূহও এই বিবেকগত ফসলকে সমর্থ করে। যিনি মুহাদ্দেসগণের তথ্যানুসন্ধান বিষয়ক বিস্ময়কর ঘটনাবলি এবং হাদিসের হাফেজগণের হাদিস বর্ণনার আশ্চর্যকর অবস্থা সমূহ গভীরভাবে অধ্যায়ন করেছেন, তিনি অগত্যা এই সিদ্ধান্তেই গিয়ে উপনীত হন যে, এই ব্যাক্তিবৃন্দকে সৃষ্টিই করা হয়েছিল এজন্য যে, আল্লাহ তাঁদের দ্বারা স্বীয় দ্বীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ খুঁটির রক্ষনাবেক্ষন করিয়ে নিবেন। আর তাঁরাও এ কাজটিকে সঠিকভাবে আঞ্জাম দিয়ে বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, আল্লাহ তাআলা অযথা কোনো জিনিসকে ‘অপরিহার্যভাবে অনুসরণযোগ্য বলে ঘোষনা দান করেন না। বরংচ তিনি যখন কোনো কিছুকে এই মর্যাদা দান করেন, তখন তিনি সেটার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত অবশিষ্ট রাখার উপায় উপকরণও সরবরাহ করে দেন। নতুবা বিবেক কি এ কথায় সায় দিতে পারে যে, একজন মানুষ (১) একটি স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে কোনো কসরত ছাড়াই হাজার হাজার হাদিস পূর্ণ সনদ সহকারে স্মৃতিপটে অঙ্কিত রেখে তা শুনিয়ে দিবেন এবং বছরকে বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পর তাকে যখন ওই হাদিসগুলোর ব্যপারেই প্রশ্ন করা হবে, ততক্ষনাৎ তিনি উক্ত পর্যায়ক্রম অনুসারে কোনো ‘জের-জবর’ পরিবর্তন করা কিংবা কানো রাবী (বর্ণনাকারী)-র নাম কম-বেশ করা ব্যতীরেকে সবগুলোই শুনিয়ে দিবেন এবং কোনোখানেও সন্দেহ-সংকোচ বা আটকে যাওয়ার নামও নিবেন না, তাও আবার এমতাবস্থায় যে, তাঁর কাছে পূর্বে শ্রুত হাদিসগুলোর সংকলিত কোনো রেকর্ডও বিদ্যমান নেই! (ইমাম যুহরী রহ.-এর এই ঘটনাটি ইতিহাসের বিভিন্ন কিতাবে মওজুদ রয়েছে।- লেখক) এ ধরনের বিস্মীত করার মত অসংখ্য নমুনা একথারই জ্বলন্ত প্রমাণ যে, এরাঁ সাধারণ মনুষ্য মাপকাঠি থেকে বহু উর্ধ্বমার্গের মানুষ ছিলেন। দুনিয়াতে তাঁদেরকে এজন্যই পাঠানো হয়েছিল যে, তাঁরা রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর ‘সুন্নাহ’কে দুশমনের হস্তক্ষেপ থেকে এমনভাবে হিফাজত করে রাখবেন, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এতে গড়বড় সৃষ্টি করার দুঃসাহস দেখাতে না পারে।
(৩) উম্মহ’র ইজমা (ঐক্যমত)
ইসলামী শরীয়তের তৃতীয় উৎসধারাটি হল উম্মতের ‘ইজমা’। ইজমা হল এমন একটি সর্বসম্মত বিষয়, যার উপর সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম রা. এবং মহান তাবেয়ীগণ ঐক্যমত্যতার ভিত্তিতে কোনো রায় দিয়েছেন। এর পরিপন্থী কোনো রায় পেশ করা নাজায়েয।
উম্মাহ’র ‘ইজমা’ যে দ্বীনের একটি ‘হুজ্জত’ (Authority), তা খোদ কুরআন-হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। কুরআন কারিমে আল্লাহ তাআলা এশাদ করেন-
অর্থাৎ, যে বিষয়টি গোটা মুসলিম জাতির কাছে সর্ব সম্মত, তার পরিপন্থী কোনো কথা বলা জায়েয নয়। হাদীসে রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন- ما راه المسلمون حسنا فهو عند الله حسن – অর্থাৎ, মুসলিম (উম্মাহ) যে জিনিসকে ভাল হিসেবে বিবেচনা করে, সেটা আল্লাহ তাআলার কাছেও ভাল হিসেবে বিবেচিত হয়। [মুআত্তা, ইমাম মুহাম্মাদ ১৪০ পৃষ্টা]
তিনি আরও বলেছেন – لن تجْتمَعُ أُمَّتِي عَلَى ضَلَالَةٍ –‘‘আমার উম্মত কক্ষোনই পথভ্রষ্টতার উপর একমত হবে না।
তাছাড়া, বিবেকও এই দাবী করে যে, ইজমা একটি ‘হুজ্জত’, একটি দলীল। কেননা, যদি উম্মাহ’র ইজমার পরিপন্থী কোনো কথা বলা হয়, তাহলে তার অর্থ এই দাঁড়াবে যে, (আল্লাহ’র পানাহ) ‘দ্বীন ইসলাম’ এই কতকটা রহস্যজনক (?) থেকে গিয়েছিল যে, চোদ্দ’শ বৎসর হল এসকল মাসায়েল ঠিক ঠিকভাবে বোঝার তৌফিক উম্মাহ’র কোনো একজন ব্যাক্তিরও হয়নি ! এমনকি ওই সকল সাহাবায়ে কেরাম -যাঁরা রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর সার্বোক্ষনিক সঙ্গী ছিলেন, দ্বীনকে পরিপূর্ণভাবে বোঝার মতো সুযোগ তাঁদেরও হয়নি ! অথচ আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছিলেন- الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ – ‘‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম।” [সূরা মায়েদা ৩]
এখন আপনি নিজেই বলুন, (আপনার ধারনা মতে) যে দ্বীনকে তার উচ্চমর্যাদাবান দিশারীগন এর প্রথমা যুগেই সহিহ ভাবে বুঝতে পারেন নি, সেই দ্বীন কি এরই উপযুক্ত যে, চোদ্দ’শ বৎসর পেড়িয়ে যাওয়ার পর কেউ সেটার অনুসরন-অনুকরন করবে? যদি উম্মতের ‘ইজমা’ কে ‘দ্বীনের হুজ্জত’ হওয়াকে অস্বীকার করা হয়, তাহলে সেটা এমন এক আপত্তিকর বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, যা থেকে পাশ কেটে যাওয়া কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। তাছাড়া ইজমা’কে হুজ্জত রূপে ঘোষনা দানের মাঝে একটি হেকমত এও রয়েছে যে, আম্বীয়ায়ে কেরাম আ.-এর ধরাপৃষ্ঠে আগমনের ক্রমধারা সমাপ্ত হয়ে যাওয়ার পর কোনো মানুষ এতটা মা’ছুম বা নিষ্পাপ এবং ভুল ভ্রান্তি থেকে মুক্ত হতে পারে না, যার কথাকে সর্ব-হালতে মেনে নেয়াকে জরুরী মনে করা যেতে পারে। অন্য দিকে নিত্য-নতুন সমস্যার সমাধান করার জন্য গোটা সোসাইটিতে এমন নির্ভরযোগ্য কারো বিদ্যমান থাকাটাও জরুরী, যাকে নিষ্পাপ এবং ভুল-ভ্রান্তি থেকে মুক্ত কল্পনা করা যেতে পারে। বিধায়, আল্লাহ তাআলা উম্মতের ‘সামষ্টিক-রূপ’ কে মা’ছুম বলে অবিহিত করেছেন, যার অর্থ এই যে, যে কথার উপর উম্মত ‘একজোট’ ও একমত হয়ে যাবে, তা ভুল হতে পারে না।
[উপরোক্ত আলোচনাটির সাথে একটিবার হলেও আমাদের লিখিত ইসলামী শরীয়তের উৎস ও মানদন্ড : কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস পাঠের আবেদন জানাচ্ছি। সেখানে আরো বিস্তারিতভাবে দলিল সহকারে আলোচনা করা হয়েছে।- অনুবাদক]
এবারে আমরা ‘পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ’-এর যে সমস্ত দফাগুলো কুরআন-সুন্নাহ পরিপন্থী, সেগুলোকে এক এক করে আলোচনায় দিয়ে আসবো।
মুফতী মুহাম্মাদ তাক্বী উসমানী দা:বা: লিখিত ‘মুসলমি পারিবারিক আইন’ বিষয়ক আলোচনা পড়তে নিম্নে ক্লিক করুন।
# ইসলামী শরীয়ত বনাম আইয়ূব খানের মুসলিম পারিবারিক আইন: ভূমিকা
- ইসলামী শরীয়তে বিয়ে বনাম আইয়ূব খানের বিবাহ রেজিস্ট্রেশন আইন
- ইসলামী শরীয়তে বহু বিবাহ বনাম আইয়ূব খানের পাশকৃত আইন
- ইসলামী শরীয়তে বাল্যবিবাহ ও বিয়ের বয়স বনাম আইয়ূব খানের পাশকৃত আইন
- ইসলামী শরীয়তে তিন তালাক বনাম আইয়ূব খানের পাশকৃত আইন