মহানবী ﷺ-এর নবুওত লাভ ও মক্কার দাওয়াতী জীবন এবং কুরআনের আয়াত নাজিলের প্রেক্ষাপট ও পরিবেশ পরিস্থিতি
بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیۡمِ
الحمد لله و الصلاة و السلام على رسوله محمد و على أله و أمّته
اَللّٰهُمَّ صَلِّ عَليٰ مُحَمَّدٍ النبي الأمي عَدَدَ خَلْقِك وَ رِضَا نَفْسِك وَزِنَةَ عَرْشِك وَ مِدَادَ كَلِمَاتِك، صَلِّ عَليه صَلاَةً كَامِلَةً دَائِمَةً كَمَا يَنْبَغِي أَنْ يُصَلَّى عَلَيهِ وَ سَلِّمْ تَسلِيمَاً بِقَدرِ عَظَمَةِ ذَاتِكَ فِى كُلِّ وَقتٍ وَ حِين، صلاة تكون لك رضاء و له جزاء، صلاة لا غاية لها ولا منتهى ولا انقضاء باقية ببقائك الى يوم الدين ، و اعطه الوسيلة و الفضيلة و المقام المحمود الذي وعدته، و اجزه عنا ما هو اهله، و على اله وأصحابه و أزواجه و ذريته و أهل بيته و سلم تسليما مثل ذلك، اَللّٰهُمَّ اجمعني معه في الفردوس و جنة المأوى، اَللّٰهُمَّ صَلِّ عَليٰ مُحَمَّدٍ صَلوٰةً تُنَجِّيْنَا بِهَا مِنْ جَمِيْعِ الْأَهْوَالِ وَاْلآفَاتِ وَتَقْضِيْ لَنَا بِهَا مِنْ جَمِيْعِ الْحَاجَاتِ وَتُطَهِّرُنَا بِهَا مِنْ جَمِيْعِ السَّيِّاٰتِ وَتَرْفَعُنَا بِهَا عِنْدَكَ اَعْليٰ الدَّرَجَاتِ وَتُبَلِّغُنَا بِهَا اَقْصىٰ الْغَايَاتِ مِنْ جَمِيْعِ الْخَيْرَاتِ فِي الْحَيَاتِ وَبَعْدَ الْمَمَاتِ- اِنَّكَ عَليٰ كُلِّ شَيْئٍ قَدِيْرٍ بِرَحْمَتِكَ يَا اَرْحَمَ الرَّاحِمِيْنَ
>>> মূল সূচিপত্র (index) থেকে এ পেজের পূর্ববর্তী বা পরবর্তী আলোচনা পড়তে [এখানে ক্লিক করুন]
পূর্ব আলোচনার পর…
আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মক্কায় হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা ﷺ-এর কাছে ওহীর আগম, নবুওত লাভ এবং রিসালাতের গুরু দায়িত্ব অর্পণ
প্রথম প্রথম হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা ﷺ-এর কাছে ঘুমের মধ্যে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ওহী নাজিল হত এবং চলার পথে গাছপালা, পাথড় ইত্যাদি সমূহ তাঁকে ‘নবী’ সম্মোধর করে সালাম দিতো। তিঁনি যখন চল্লিশ বছরে পদার্পণ করেন, তখন একদিন তিঁনি মক্কার হিরা গুহায় আল্লাহ’র ধ্যানমগ্ন থাকাবস্থায় আল্লাহ তাআলার সম্মানীত ফিরিশতা হযরত জিবরীল আ. তাঁকে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে নবুওত ও রিসালাতের সুসংবাদ দান করেন এবং কুরআনের ‘সুরা আলাক্ব’-এর কিছু আয়াত শিক্ষা দেন। [সিরাতুন নাবুউয়ীয়াহ, ইবনে হিশাম- ১/২৩৬; তারিখুর রুসুল ওয়াল মুলুক, ইমাম ত্বাবারী- ২/৪৯; খাসাইসুল কুবরা, ইমাম সুয়ূতী- ১/৯৩; সহিহ মুসলীম- ১/১৩৯ হাদিস ১৬০] এসময় হযরত জিবরীল আ. রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে ওজু ও নামায শিক্ষাও দিয়েছিলেন মর্মে হাদিসে ইংগীত পাওয়া যায়। যেমন, উসামা বিন যায়েদ রা.-এর পিতার সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, তাঁর পিতা যায়েদ বিন হারেছাহ রা. রাসুলুল্লাহ ﷺ সম্পর্কে বর্ণনা করেন- أَنَّ جِبْرِيلَ عَلَيْهِ السَّلَامُ أَتَاهُ فِي أَوَّلِ مَا أُوحِيَ إِلَيْهِ ، فَعَلَّمَهُ الْوُضُوءَ وَالصَّلَاةَ . رواه أحمد في المسند , مسند الشاميين ,حديث زيد بن حارثة رضي الله تعالى عنه : ٤/١٦١ رقم ١٧٠٢٦ ، حسنه الشيخ الألباني في مشكاة المصابيح وذكره في السلسلة الصحيحة برقم ٨٤١ و صححه في صحيح الجامع برقم ٧٦, و المتابع هو رشدين بن سعد، وهو ضعيف كابن لهيعة، ولكن قال الشيخ الألباني رحمه الله: وهو في الضعف مثل ابن لهيعة، فأحدهما يقوي الآخر، لاسيما وله شاهد من حديث أبي هريرة مرفوعا بلفظ: جاءني جبريل، فقال: يا محمد إذا توضأت فانتضح، حسنه أيضا الشيخ ملا القاري في مرقاة المفاتيح شرح مشكاة المصابيح، فقد قال عنه: وَسَنَدُهُ حَسَنٌ – “(সম্মানীত ফিরিশতা হযরত) জিবরীল আ. যখন প্রথমবার তাঁর কাছে এসে তার প্রতি ওহী করেছিলেন, তখন তিঁনি তাঁকে (এর সাথে সাথে) ওজু ও নামায(ও) শিক্ষা দিয়েছিলেন”। [মুসনাদে আহমদ– ৪/১৬১ হাদিস ১৭০২৬; সুনানে ইবনে মাজাহ- ১/১৭২ হাদিস ৪৬২; সুনানে দ্বারাকুতনী- ১/৪২; মুসতাদরাকে হাকিম- ৩/২১৭] নবুওত লাভের পর কোনো নবী তাঁর রব আল্লাহ তাআলার সামনে জমিনে নিঁজের মাথা ঠেঁকিয়ে আবদিয়াত (দাসত্ব্য)-এর বহি:প্রকাশ নিবেদনের সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম ও সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত (যা আত্বীক উন্নতীর অন্যতম খোরাক) নামায থেকে দূরে থাকবেন, সেটা কী করে কল্পনা করা যেতে পারে ?!! এজন্য যেদিন হযরত জিবরীল আ.-এর মাধ্যমে নবুওত লাভের সুসংবাদ ও ওহী নাজিলের সূচনা হল, সে দিন থেকেই নামাযও নবীর গুরুত্বপূর্ণ আমলের মধ্যে যোগ করা হল।
হেরা গুহা থেকে বেরিয়ে রাসুলুল্লাহ ﷺ ভয়ে আতঙ্গে সোজা বাড়িতে খাদিজা রা.-এর কাছে আসেন এবং সব কিছু খুলে বলেন। খাদিজা রা. তাঁকে সান্তনা দেন এবং তার বৃদ্ধ চাচাত ভাই ওয়ারাক্বাহ বিন নাওফিল -যিনি জাহেলী যুগে খৃষ্টান ধর্ম গ্রহন করেছিলেন ও পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবের পন্ডিতও ছিলেন- তার কাছে রাসুলুল্লাহ ﷺকে নিয়ে যান। রাসুলুল্লাহ ﷺ তাকে সব কিছু খুলে বললে বৃদ্ধ ওয়ারাক্বাহ বলেন: هَذَا النَّامُوسُ الَّذِي أُنْزِلَ عَلَى مُوسَى صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، يَا لَيْتَنِي فِيهَا جَذَعًا، يَا لَيْتَنِي أَكُونُ حَيًّا حِينَ يُخْرِجُكَ قَوْمُكَ، قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «أَوَ مُخْرِجِيَّ هُمْ؟» قَالَ وَرَقَةُ: نَعَمْ لَمْ يَأْتِ رَجُلٌ قَطُّ بِمَا جِئْتَ بِهِ إِلَّا عُودِيَ، وَإِنْ يُدْرِكْنِي يَوْمُكَ أَنْصُرْكَ نَصْرًا مُؤَزَّرًا . رواه مسلم في صحيحه , كتاب الإيمان , باب بدء الوحي إلى رسول الله صلى الله عليه وسلم: ١/١٣٩ رقم ١٦٠، رواه البخاري في صحيحه , كتاب التعبير باب أول ما بدئ به رسول الله صلى الله عليه وسلم من الوحي الرؤيا الصالحة: ٩/٢٩ رقم ٦٩٨٢ – “‘ইনি তো সেই আল-নামুস (বিশেষ দৈবদূত ফিরিশতা -জিবরীল আ.) যাঁকে (নবী) মুসা ﷺ-এর কাছে (ওহী সহকারে) পাঠানো হয়েছিল। (তোমাকে অচিরেই দ্বীনের প্রচার প্রসারে নিয়োগ করানো হবে), হায় আফসোস, আমি যদি সেসময় যুবক হতাম! হায় আফসোস, তোমার কওম যখন তোমাকে (দেশ থেকে) বের করে দিবে, আমি যদি তখন জীবিত থাকতাম (এবং তোমার সাথে হিজরত করার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারতাম)’! রাসুলুল্লাহ ﷺ (অবাক হয়ে) বললেন: ‘তারা আমাকে (দেশ থেকে) বের করে দিবে’! ওয়ারাক্বাহ বললেন: ‘হ্যাঁ, (নবীগণের ইতিহাসে) এমন কোনো ব্যাঁক্তিই নেই, যিঁনি -তুমি যা নিয়ে এসেছো, তিঁনিও তা (তাঁর কওমের জন্য) নিয়ে এসেছিলেন, আর (তার) বিরোধীতা না করা হয়েছে। (তোমার আনীত দ্বীনের কারণে যখন তোমাকে দেশ থেকে বের করে দিতে উদ্দত হবে, তখন) যদি তোমার (সেই নবুওতী) জীবনকালটির সাক্ষাত আমার ভাগ্যে জোটে, তাহলে আমি তোমাকে সর্বোতভাবে সাহায্য করবো”। [সহিহ মুসলীম– ১/১৩৯ হাদিস ১৬০; সহিহ বুখারী– ৬/১৬২ হাদিস ৪৯২৬]
ফায়দা: পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবের পন্ডিত ওয়ারাক্বা বিন নাওফিলের বিজ্ঞচিত কথা থেকে রাসুলুল্লাহ ﷺ খুব স্পষ্ট ভাবে বুঝতে পেরেছিলেন যে- (১) তাঁর পূর্ববর্তী নবীগণকে যেমন তাদের নিজ নিজ কওমের কাছে বিশেষ দ্বীনী মিশন দিয়ে প্রেরন করা হয়েছিল, অচিরে সেরকম দ্বীনী মিশন দিয়ে তাঁকেও তাঁর কওমের কাছে অচিরেই পাঠানো হবে, (২) মক্কার লোকেরা তাঁর মিশনের সাথে একমত হবে না এবং মক্কায় তাঁর মিশনকে সফল হতেও দিতে চাইবে না, (৩) বরং মক্কার লোকেরা হাজার বছরের পরম্পরায় মেনে আসা তাদের পূর্বপুরুষদের মূর্তিপূঁজার ধর্ম রক্ষার জন্য প্রয়োজন হলে তাঁকেই মক্কা থেকে বের করে দিবে, (৪) তাঁকে আল্লাহ’র দ্বীনের জন্য একসময় মক্কা থেকে হিজরত করে অন্য কোথাও চলে যেতে হবে, (৫) তাঁর দ্বীনী মিশনকে পূর্ণতায় পৌছানোর জন্য তাঁকে অনেক রকমের বিরোধীতা, বিপদ আপদ ও ষঢ়যন্ত্রের শিকার হতে হবে এবং তাঁর অনুগত্যকারীদের সাহায্যের প্রয়োজন পড়বে -হিজরতের আগে, হিজরতের সময় এবং হিজরতের পরেও।
এরপর কিছু দিনের জন্য ওহী নাজিল হওয়া বন্ধ থাকে। তারপর হঠাৎ একদিন নবীজী ﷺ রাস্তায় চলার পথে আসমান থেকে ফিরিশতা জিবরীল আ.-এর ডাকার আওয়াজ পান। নবীজী ﷺ দেখেন যে, জিবরীল আ. আসমান জমিনের মাঝে একটি চেয়ারে বসে আছেন। এভাবে বিরাট আকৃতিতে জিবরীল আ.-কে আসনে বসে থাকতে দেখে নবীজী ﷺ মানুসিক ভাবে দারুন ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন এবং ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বাড়িতে ফিরে গিয়ে লোকজনের কাছে গরম কাপড় চান গায়ে জড়ানোর জন্য। তারপর তাঁর কম্বোল জড়ানো অবস্থায় আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তাঁর উপরে সুরা মুদ্দাস্সিরের নিম্নোক্ত আয়াত গুলো নাজিল হয় এবং নবুওতের গুরু দায়িত্ব পালনের জন্য ময়দানে নামতে তাঁকে আদেশ করা হয়। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-
يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ – قُمْ فَأَنذِرْ – وَ رَبَّكَ فَكَبِّرْ – وَ ثِيَابَكَ فَطَهِّرْ – وَ الرُّجْزَ فَاهْجُرْ
“হে কম্বলে আবৃত (নবী)! তুমি (তোমার নবুওতী গুরু দায়িত্ব পালনের জন্য) উঠে পড়ো, (মানুষকে আল্লাহ’র নির্দেশ এবং মৃত্যু পরবর্তি জীবনে আল্লাহ’র সামনে আখেরাতে হিসাব নিকাশের ব্যাপারে) সতর্ক করো। আর তুমি তোমার রব (প্রভু আল্লাহ’র) তাকবীর পড়ো, এবং তোমার (আত্মীক) পোষাককে পরিত্র করো, এবং (শিরক, কুফরের সহ সকল প্রকারের) অপবিত্রতাকে বর্জন করো”। [সূরা মুদ্দাসসির ১-৫]
আবু সালামাহ বিন আব্দুর রহমান রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, যাবের বিন আব্দুল্লাহ আল-আনসারী রা. বর্ণনা করেন-قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ يُحَدِّثُ عَنْ فَتْرَةِ الْوَحْيِ – قَالَ فِي حَدِيثِهِ -: «فَبَيْنَا أَنَا أَمْشِي سَمِعْتُ صَوْتًا مِنَ السَّمَاءِ، فَرَفَعْتُ رَأْسِي، فَإِذَا الْمَلَكُ الَّذِي جَاءَنِي بِحِرَاءٍ جَالِسًا عَلَى كُرْسِيٍّ بَيْنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ»، قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ” فَجُئِثْتُ مِنْهُ فَرَقًا، فَرَجَعْتُ، فَقُلْتُ: زَمِّلُونِي زَمِّلُونِي، فَدَثَّرُونِي، فَأَنْزَلَ اللهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى: {يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ قُمْ فَأَنْذِرْ وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ – وَهِيَ الْأَوْثَانُ – ” قَالَ: «ثُمَّ تَتَابَعَ الْوَحْيُ»، . رواه مسلم في صحيحه , كتاب الإيمان , باب بدء الوحي إلى رسول الله صلى الله عليه وسلم: ١/١٤٣ رقم ١٦١، رواه مسلم في صحيحه , كتاب تفسير القرآن , سورة المدثر , باب قوله والرجز فاهجر: ٦/١٦٢ رقم ٤٩٢٦ – “(একবার) রাসুলুল্লাহ ﷺ (তাঁর উপরে) ওহী (আসা) বন্ধ হওয়া নিয়ে আলোচনা করছিলেন, (তখন) তিঁনি (কথার এক পর্যায়ে) বললেন: ‘আমি (রাস্তার পথ ধরে) সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, এমন সময় আসমান থেকে একটি উচ্চ আওয়াজ শুনতে পেলাম। তখন আমি উপরের দিকে মাথা উঠালাম, তখন (দেখতে পেলাম যে, যেই) ফেরেশতাটি হিরা (গুহায়) আমার কাছে এসেছিলেন, তিঁনি আসমান ও জমিনের মাঝে একটি চেয়ারে বসে আছেন’। রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন: ‘(তাঁকে অত বিরাট আকারে ওভাবে দেখতেই) আমি তাঁর ভায়ে ভিষন ভাবে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে (বাড়িতে) ফিরে আসি, তারপর (উপস্থিত লোকজনকে) বলি: ‘তোমরা আমাকে (গরম কাপড়ে) আবৃত করো! তোমরা আমাকে (গরম কাপড়ে) আবৃত করো’! ফলে (ওখানে যারা উপস্থিত ছিল) তারা আমাকে কম্বলে আবৃত করলো। এরপরে আল্লাহ তাআলা নাজিল করলেন- يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ قُمْ فَأَنْذِرْ وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ وَالرُّجْزَ – “হে কম্বলে আবৃত (নবী)! তুমি (তোমার নবুওতী গুরু দায়িত্ব পালনের জন্য) উঠে পড়ো, (মানুষকে আল্লাহ’র নির্দেশ এবং মৃত্যু পরবর্তি জীবনে আল্লাহ’র সামনে আখেরাতে হিসাব নিকাশের ব্যাপারে) সতর্ক করো। আর তুমি তোমার রব (প্রভু আল্লাহ’র) তাকবীর পড়ো, এবং তোমার (আত্মীক) পোষাককে পরিত্র করো, এবং (শিরক, কুফরের সহ সকল প্রকারের) অপবিত্রতাকে বর্জন করো”। (রাবী আবু সালামাহ বলেন: এ আয়াতে الرُّجْزَ – অপবিত্রতা) হল الْأَوْثَانُ (মূর্তি সমূহ)। (যাবের রা.) বলেন: ‘এরপর থেকে ওহী (নাজিলে)র ধারা অব্যাহত থাকে”। [সহিহ মুসলীম– ১/১৪৩ হাদিস ১৬১; সহিহ বুখারী– ৬/১৬২ হাদিস ৪৯২৬]
নবুওতী দায়িত্ব আদায়ের লক্ষ্যে সর্ব সাধারণ মানুষের কাছে দ্বীন ইসলামের প্রচার ও প্রসারে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর আত্মনিয়োগ এবং মক্কার মুশরেকদের বিরোধীতার শুরুর দিককার পরিবেশ পরিস্থিতি
নবুওতী কাজের এই গুরু দায়িত্ব স্কন্ধে আসার পর, বিশ্বনবী মুহাম্মাদ মুস্তফা ﷺ-এর হিকমতের একটি নিদর্শন হল, তিঁনি প্রথমেই গিয়ে আরবের নেতৃবর্গের কাছে তার নবুওত ও একত্ববাদী দ্বীন ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন নি, কারণ তিঁনি ভালো করেই জানতেন যে, প্রথমেই মক্কার নেতৃবর্গ একথা জানালে তারা কী ধরনের কুৎসীত প্রতিক্রিয়া দেখাবে এবং কিভাবে তার এই দাওয়াতকে পয়লা পদক্ষেপেই থামিয়ে দিতে উদ্দত হবে। এজন্য, রাসুলুল্লাহ ﷺ সর্বপ্রথম ওই সকল ব্যাক্তিদের কাছে তাঁর নবুওত লাভ ও দ্বীন ইসলামের দাওয়াত পেশ করলেন, যাদের ব্যাপারে বাহ্যত: তাঁর আশা ছিল যে, তারা হয়-তো তার কথা বিশ্বাস করে ইসলাম কবুল করবে। এ হিকমত কাজে লাগানোতে দেখা গেল যে, প্রথমাবস্থায় নারীদের মধ্যে সর্বপ্রথম তার স্ত্রী খাদিজাহ রা, বালকদের মধ্যে সর্বপ্রথমে তাঁর চাচাত ভাই আলী বিন আবি ত্বালেব রা, দাসদের মধ্যে যায়েদ বিন হারেসাহ রা. এবং পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথমে আবু বকর ইবনে আবি কুহাফাহ রা. ইসলাম কবুল করেন। আবু বকর সিদ্দিক রা. ইসলাম কবুল করা পর তিঁনি গিয়ে তার বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতদের মাঝে ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন, ফলেপাঁচজন তার হাতে ইসলাম কবুল করেন, যেমন: উসমান ইবনে আফফান রা., যুবায়ের ইবনে আউয়াম রা., আব্দুর রহমান বিন আউফ রা., ত্বালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ রা., সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা.। [তারিখে ইবনে ইসহাক- ১/১৪০; তারিখে তাবারী- ১/৩৯৭; তারিখে দিমাশক, ইবনু আসাকীর- ৩০/৪৯] এভাবে যারাই নতুন মুসলমান হচ্ছিলেন, তারা সাধ্য মতো গোপনে গোপনে এমন লোকদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পেশ করতে থাকলেন যাদের ইসলাম গ্রহনের আশা ছিল। ফলে আরো কিছু লোক ইসলাম কবুল করেন এবং এভাবে মুসলমানদের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে।
তখন যারাই ইসলাম কবুল করতেন, তাদেরকে আমল হিসেবে প্রথমে নামায শিক্ষা দেয়া হত এবং তাদের যার যেখানে সুযোগ হত কোনো গোপন স্থানে নামায আদায় করতেন। যেমন, প্রথম প্রথম রাসুলুল্লাহ ﷺ, খাদিজা রা. এবং আলী রা. নামায পড়তে যেতেন আব্বাস বিন আব্দিল মুত্তালীবের বাসায়। আব্বাস ছিলেন রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর নিজের চাচা যিনি প্রায় সমবয়সী ছিলেন; আব্বাস তখনও ইসলাম কবুল না করলেও রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কোনো বিরোধীতা করেতেন না বরং সময় সুযোগে উপকারই করতে দেখা যেত। ইয়াস বিন আফীফ রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, আফীফ আল-কিন্দী বিন আমর রা. বর্ণনা করেন-كُنْتُ امْرَأً تَاجِرًا وَكُنْتُ صَدِيقًا لِلْعَبَّاسِ بْنِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ فِي الْجَاهِلِيَّةِ ، فَقَدِمْتُ لِتِجَارَةٍ فَنَزَلْتُ عَلَى الْعَبَّاسِ بْنِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ بِمِنًى ، فَجَاءَ رَجُلٌ فَنَظَرَ إِلَى الشَّمْسِ حِينَ مَالَتْ فَقَامَ يُصَلِّي ، ثُمَّ جَاءَتِ امْرَأَةٌ فَقَامَتْ تُصَلِّي ، ثُمَّ جَاءَ غُلَامٌ حِينَ رَاهَقَ الْحُلُمَ فَقَامَ يُصَلِّي ، فَقُلْتُ لِلْعَبَّاسِ : مَنْ هَذَا ؟ فَقَالَ : هَذَا مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ ابْنِ أَخِي يَزْعُمُ أَنَّهُ نَبِيٌّ ، وَلَمْ يُتَابِعْهُ عَلَى أَمْرِهِ غَيْرُ هَذِهِ الْمَرْأَةِ وَهَذَا الْغُلَامُ وَهَذِهِ الْمَرْأَةُ خَدِيجَةُ بِنْتُ خُوَيْلِدٍ امْرَأَتُهُ ، وَهَذَا الْغُلَامُ ابْنُ عَمِّهِ عَلِيِّ بْنِ أَبِي طَالِبٍ قَالَ عَفِيفٌ الْكِنْدِيُّ : وَأَسْلَمَ وَحَسُنَ إِسْلَامُهُ ، لَوَدِدْتُ أَنِّي كُنْتُ أَسْلَمْتُ يَوْمَئِذٍ فَيَكُونُ لِي رُبْعُ الْإِسْلَامِ . رواه الحاكم في المستدرك على الصحيحين , كتاب معرفة الصحابة رضي الله تعالى عنهم , أول ما بدئ به رسول الله من الوحي الرؤيا الصادقة : ٤/١٨١ رقم ٤٨٩٥ و قال: هذا حديث صحيح الإسناد ولم يخرجاه و له شاهد معتبر من أولاد عفيف بن عمرو، و وافقه الذهبي، و قال الهيثمي: ٩/١٠٣ رواه أحمد وأبو يعلى بنحوه و الطبراني و رجال أحمد ثقات – “আমি ছিলাম একজন ব্যবসায়ী ব্যাক্তি। আর জাহেলিয়াতের জামানায় আমি ছিলাম (রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর চাচা) আব্বাস বিন আব্দিল মুত্তালিবের বন্ধু। আমি (একবার) ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ি এবং (পথিমধ্যে) মিন এলাকায় আব্বাস বিন আব্দিল মুত্তালিবের (বাসায় তার সাথে দেখা সাক্ষাত করার জন্য) উঠি। তখন (দেখলাম, কোথাও থেকে সেখানে) এক ব্যাক্তি এলো, তারপর সূর্য যখন (এক দিকে কিছুটা) ঢোলে পড়লো তখন সে সূর্যের দিকে দিকে তাকালো, তারপর নামায আদায় করলো। এরপর (দেখলাম, সেখানে) একজন মহিলা এলো, তারপর সেও দাঁড়িয়ে নামায পড়লো। এরপর ( আবারো দেখলাম, সেখানে) বালেগ হওয়ার নিকটবর্তী বয়সের একটা বালক এলো, তারপর সেও দাঁড়িয়ে নামায পড়লো। তখন আমি আব্বাস’কে জিজ্ঞেস করলাম: ‘এরা কারা’? আব্বাস বললো: ‘এ হল আমার ভাতিজা মুহাম্মাদ বিন আব্দিল্লাহ বিন আব্দিল মুত্তালিব; সে দাবী করে যে, সে একজন নবী (যাঁর কাছে আল্লাহ’র পক্ষ থেকে ওহী আসে)। আর (আমার জানা মতে) এখনো পর্যন্ত এই মহিলা এবং এই বালকটি ছাড়া আর কেউই তাঁর (দাবীকৃত) বিষয়ের অনুগত্যতা স্বীকার করে নেয়নি। আর এই মহিলাটি হল তাঁরই স্ত্রী খাদিজাহ বিনতে খুওয়াইলীদ। আর এই ছেলেটি হল তারই চাচাত ভাই আলী বিন আবি ত্বালিব (বিন আব্দিল মুত্তালিব)’। ‘(বস্তুত:) আফীফ আল-কিন্দী – যিনি (ওই দিনের ঘটনার অনেক পরে) ইসলাম কবুল করেছিলেন এবং যিনি একজন ভালো মুসলমান ছিলেন- তিনি বলেন: ‘আক্ষেপ, আমি যদি সেদিনই ইসলাম কবুল করে নিতাম, তাহলে আমি হতাম চতুর্থ ইসলাম(কবুলকারী ব্যাক্তি)”।[মুসতাদরাকে হাকিম- ৪/১৮১ হাদিস ৪৮৯৫; মুসনাদে আহমদ- ১/২০৯; আল-ইস্তিয়াব, ইবনু আব্দিল বার- ৩/১০৯৬; আল-আহাদিসুল মুখতারাহ, ইমাম দ্বীয়াউদ্দিন- ৮/৩৮৮ হাদিস ৪৭৯; মাজমাউয যাওয়ায়ীদ, হাইছামী- ৯/১০৩]
তখন নব-মুসলীমদের প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার করতে অনুৎসাহিত করা হত, কারণ মুসলমানদের সংখ্যা ছিল তখন নিতান্তই কম, আর ফলে প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার শুরু করলে নব-মুসলীমদের উপরে মুশরেকদের পক্ষ থেকে যে বৈরী আচরণ শুরু হবে, তার ধকল সইয়ে ওঠা সুকঠিন হয়ে যাবে। কিন্তু সে সময় এমন লোকও তো অনেকে ছিল যাদের কাছে গোপনে ইসলাম পেশ করা হয়েছিল বটে কিন্তু তারা তাদের পূর্বপুরুষদের ধর্ম ত্যাগ করেনি, আবার এমন মুসলমানও ছিল যারা আবেগে নিজেদের ইসলাম কবুল করার কথা জনসম্মুখে প্রকাশ করতে কারোর পরোয়া করতো না, ফলে যত গোপনেই দ্বীন ইসলামের প্রচার ও ইবাদত বন্দেগী করা হোক না কেনো -এই উভয় ধরনের ব্যাক্তিদের দ্বারা কিছু দিনের মধ্যেই মক্কার সর্বসাধারণ জনগণ ও নেতৃবর্গের কানে একথা পৌছে গেল এবং মক্কায় এটা জানাজানি হয়ে গেল যে, “আব্দুল মুত্তালেবের নাতী ও আবু ত্বালিবের ভাতিজা মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ নিজকে নবী দাবী করছে এবং তার বাপদাদা পূর্বপুরুষরা হাজার বছরের পরম্পরায় যে দেব-দেবতার পুজাঅর্চনার ধর্ম অনুসরণ করে আসছে -সেঁ সেই ধর্মকে পরিত্যাগ করতে বলে এবং তাঁর আনিত একটি তাওহিদী (একত্ববাদী) নতুন ধর্মকে গ্রহন করার আহবান জানাচ্ছে”। একথাটি শুধু মক্কা’তেই নয়, মক্কার সীমা পেরিয়ে আরবের বহু স্থানে তা এর-ওর মাধ্যমে ছড়িয়ে যায়। এখানে আমরা নমুনা স্বরূপ দুটি ঘটনা উল্লেখ করছি; একটি খালীদ বিন সাঈধ ইবনুল আস রা.-এর ইসলাম গ্রহন এবং দ্বিতীয়টি হযরত আবু যর গিফারী রা.-এর ইসলাম গ্রহনের ঘটনা (বলা হয়ে থাকে যে আবু যর রা. ছিলেন ৪র্থ ইসলামগ্রহণকারী ব্যাক্তি), যা থেকে কিছুটা অনুমান করা যেতে পারে যে, মক্কার সামাজিক অবস্থা তখন কতটা নাজুক ছিল।
জা’ফর ইবনু মুহাম্মাদ বিন খালীদ বিন যুবায়ের-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, মুহাম্মাদ ইবনু আব্দিল্লাহ বিন আমর বিন উসমান রহ. বর্ণনা করেন যে, খালীদ বিন সাঈদ ইবনুল আস রা. ইসলাম শুরুর প্রথম দিকেই ইসলাম কবুল করেছিলেন। তিঁনি ইসলাম কবুলের পূর্বে এব্যাপারে একটি নেক স্বপ্ন দেখেন যে, ‘তিনি একটি আগুনের গর্তের ধারে দাঁড়িয়ে আছেন, আর তার পিতা সাঈদ তাকে গর্তে ফেলে দিতে চাইছে, তখনই মুহাম্মাদ ﷺ এসে তার কোমড় ধরে বাঁচিয়ে নিলেন’। তিনি এ স্বপ্নের কথা আবু বকর সিদ্দিক রা.কে বলেন এবং তখন আবু বকর রা. তাঁকে বলেন:أريد بك خير . هذا رسول الله صلى الله عليه وسلم فاتبعه فإنك ستتبعه وتدخل معه في الإسلام ، والإسلام يحجزك أن تدخل فيها وأبوك واقع فيها – “(তোমার এই স্বপ্নের কথা শুনে আমার মনে হচ্ছে) তোমার সাথে কল্যানের ইচ্ছে করা হয়েছে। তিঁনি (অবশ্যই) আল্লাহ’র রাসুল। তুমি (বিনা দ্বিধায়) তাঁর অনুগত্য অনুসরণ করো। (আমার মনে হচ্ছে) তুমি অচিরেই তাঁর অনুগত্যতা স্বীকার করে নিয়ে তাঁর কাছেই ইসলাম কবুল করবে। আর (নি:সন্দেহে একমাত্র দ্বীন) ইসলামই তোমাকে আগুন থেকে বাঁচাতে পারে। আর (আমার আরো মনে হচ্ছে) তোমার পিতা আগুনে পতিত হবে”। এরপর খালীদ বিন সাঈদ ইবনুল আস রা. সোজা গিয়ে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর সাথে সাক্ষাত করেন এবং তাঁকে জিজ্ঞেস করেন: يا محمد، إلى من تدعو – “হে মুহাম্মাদ! আপনি (মানুষকে) কার দিকে আহবান করেন’? জবাবে রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন- أدعوك إلى الله وحده لا شريك له وأن محمداً عبده ورسوله وتخلع ما أنت عليه من عبادة حجر لا يسمع ولا يبصر ولا يضر ولا ينفع ولا يدري من عبده ممن لم يعبده – “আমি (মানুষকে) আহবান করি আল্লাহ’র দিকে, যিঁনি একক (ও অদ্বিতীয়), যাঁর কোনো শরীক নেই, এবং (আমি আরো আহবান করি একথার দিকে) যে, (আমি) মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও তাঁর (প্রেরিত সর্বশেষ নবী ও) রাসুল। (আমি তোমাকে আহবান করছি), তুমি যে ধর্মের উপরে (এখন প্রতিষ্ঠিত) আছো, (সেই ধর্মে মুশরেকদের অনুসৃত এসব মাটি ও) পাথরের (তৈরী মূর্তী ও দেবদেবীর) পুঁজা পরিত্যাগ করো, যা না পারে (কিছু) শুনতে, না পারে (কিছু) দেখতে, আর না পারে (কারোর কোনো) ক্ষয়ক্ষতি করতে, আর না পারে (কারোর) উপকার করতে, (এমনকি) সে (তো) জানতেও পারে না -কে তার পুঁজাকারী, আর কে তার পুঁজা করে না”। রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর একথা শুনে খালীদ বিন সাঈদ ইবনুল আস বললেন- فإني أشهد أن لا إله إلا الله ، وأشهد أنك رسول الله – “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ (উপাস্য) নেই এবং আমি (আরো) সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি আল্লাহ’র রাসুল”। হাদিসের রাবী মুহাম্মাদ ইবনু আব্দিল্লাহ বিন আমর বিন উসমান বললেন- فسر رسول الله صلى الله عليه وسلم بإسلامه . وتغيب خالد ، وعلم أبوه بإسلامه فأرسل في طلبه ، فأتى به فأنبه وضربه بمقرعة في يده حتى كسرها على رأسه – “তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ তার ইসলামকে গ্রহন করে (তাকে মুসলমান হিসেবে কবুল করে) নিলেন। এরপর খালীদ রা. চলে যান। যখন তার পিতা (সাঈদ ইবনুল আস) তাঁর ইসলাম গ্রহনের কথা জানতে পারেন, তখন তাঁকে খুঁজে আনার জন্য কাউকে পাঠান। সে তাঁকে (খুঁজে) নিয়ে এলে তাঁর পিতা তাঁকে এইসেই বলে বলে লাঠি হাতে (এমন ভাবে) পিটাতে থাকেন যে শেষপর্যন্ত লাঠিটি তাঁর মাথায় (মাড়া অবস্থায়) ভেঙ্গে যায়। তারপর সাঈদ ইবনুল আস তার ছেলেকে বলেন: اتبعت محمداً وأصحابه وأنت ترى خلافة قومه وما جاء به من عيب آلهتهم وعيب من مضى من آبائهم – “তুই মুহাম্মাদ ও তার সাথিদের অনুসরণ করছিস, অথচ তুই দেখতে পাচ্ছিস তার (গোটা) জাতি তার বিরুদ্ধে, সে যা নিয়ে এসেছে (তার বিরুদ্ধে)। সে তাদের উপাস্যদের দোষ ধরেছে এবং তাদের বাপদাদাদের মধ্যে যারা গত হয়ে গেছে তাদের দোষ দরেছে”। তখন খালীদ রা. বলেন- قد والله تبعته على ما جاء به – “আল্লাহ’র কসম, তিঁনি যা নিয়ে এসেছেন -(তোমার এই ছেলে) সে তাঁর অবশ্যই অনুসরণ করবে”। ছেলের একথা শুনে পিতা রাগে ক্ষোভে গিয়ে বলে উঠলেন: أذهب يا لكع حيث شئت والله لأمنعنك القوت – “হে ছোটলোক! তোর যেখানে মন চায় চলে যা। আল্লাহ’র কসম! আমি অবশ্যই তোর খাদ্যপাণীয় বন্ধ করে দিবো’। তখন খালীদ রা. বলেন: إن منعتني فإن الله يرزقني ما أعيش به – ‘আপনি যদি আমার খাদ্যপাণীয় বন্ধ করে দেন, তাহলে জীবন জীবিকা চালানোর জন্য নিশ্চই আল্লাহই আমাকে রিজিক দান করবেন’। এরপর তিঁনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে চলে যান এবং রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর সাথেই থেকে যান (পরে হাবশায় হিজরত করেন)”। [আল-ইস্তিয়াব ফি মা’রিফাতিল আসহাব, ইমাম ইবনু আব্দিল বার- ১/১২৫; দালায়ীলুন নাবুওয়াহ, ইমাম বাইহাকী- ২/৪৫ হাদিস ৪৮০; উসদুল গাবাহ, ইবনুল আছীর- ২/১২৪; আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ইবনে কাসির- ৩/৪৪]
আবু হামযাহ রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রা. বর্ণনা করেন-أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِإِسْلاَمِ أَبِي ذَرٍّ ؟ قَالَ : قُلْنَا بَلَى ، قَالَ : قَالَ أَبُو ذَرٍّ : كُنْتُ رَجُلًا مِنْ غِفَارٍ ، فَبَلَغَنَا أَنَّ رَجُلًا قَدْ خَرَجَ بِمَكَّةَ يَزْعُمُ أَنَّهُ نَبِيٌّ ، فَقُلْتُ لِأَخِي : انْطَلِقْ إِلَى هَذَا الرَّجُلِ كَلِّمْهُ وَأْتِنِي بِخَبَرِهِ ، فَانْطَلَقَ فَلَقِيَهُ ، ثُمَّ رَجَعَ ، فَقُلْتُ مَا عِنْدَكَ ؟ فَقَالَ : وَاللَّهِ لَقَدْ رَأَيْتُ رَجُلًا يَأْمُرُ بِالخَيْرِ وَيَنْهَى عَنِ الشَّرِّ ، فَقُلْتُ لَهُ : لَمْ تَشْفِنِي مِنَ الخَبَرِ ، فَأَخَذْتُ جِرَابًا وَعَصًا ، ثُمَّ أَقْبَلْتُ إِلَى مَكَّةَ ، ( قَالَ لَهُ عَلِي) ….. هَذَا وَجْهِي إِلَيْهِ فَاتَّبِعْنِي ، ادْخُلْ حَيْثُ أَدْخُلُ ، فَإِنِّي إِنْ رَأَيْتُ أَحَدًا أَخَافُهُ عَلَيْكَ ، قُمْتُ إِلَى الحَائِطِ كَأَنِّي أُصْلِحُ نَعْلِي وَامْضِ أَنْتَ ، فَمَضَى وَمَضَيْتُ مَعَهُ ، حَتَّى دَخَلَ وَدَخَلْتُ مَعَهُ عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، فَقُلْتُ لَهُ : اعْرِضْ عَلَيَّ الإِسْلاَمَ ، فَعَرَضَهُ فَأَسْلَمْتُ مَكَانِي ، فَقَالَ لِي : يَا أَبَا ذَرٍّ ، اكْتُمْ هَذَا الأَمْرَ ، وَارْجِعْ إِلَى بَلَدِكَ ، فَإِذَا بَلَغَكَ ظُهُورُنَا فَأَقْبِلْ فَقُلْتُ : وَالَّذِي بَعَثَكَ بِالحَقِّ ، لَأَصْرُخَنَّ بِهَا بَيْنَ أَظْهُرِهِمْ ، فَجَاءَ إِلَى المَسْجِدِ وَقُرَيْشٌ فِيهِ ، فَقَالَ : يَا مَعْشَرَ قُرَيْشٍ ، إِنِّي أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ ، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ ، فَقَالُوا : قُومُوا إِلَى هَذَا الصَّابِئِ ، فَقَامُوا فَضُرِبْتُ لِأَمُوتَ ، فَأَدْرَكَنِي العَبَّاسُ فَأَكَبَّ عَلَيَّ ، ثُمَّ أَقْبَلَ عَلَيْهِمْ ، فَقَالَ : وَيْلَكُمْ ، تَقْتُلُونَ رَجُلًا مِنْ غِفَارَ ، وَمَتْجَرُكُمْ وَمَمَرُّكُمْ عَلَى غِفَارَ ، فَأَقْلَعُوا عَنِّي ، فَلَمَّا أَنْ أَصْبَحْتُ الغَدَ رَجَعْتُ ، فَقُلْتُ مِثْلَ مَا قُلْتُ بِالأَمْسِ ، فَقَالُوا : قُومُوا إِلَى هَذَا الصَّابِئِ فَصُنِعَ بِي مِثْلَ مَا صُنِعَ بِالأَمْسِ ، وَأَدْرَكَنِي العَبَّاسُ فَأَكَبَّ عَلَيَّ ، وَقَالَ مِثْلَ مَقَالَتِهِ بِالأَمْسِ ……. . رواه البخاري في صحيحه , كتاب المناقب , باب قصة زمزم : ٣/١٢٩٧ رقم ٣٣٢٨، و الحاكم في المستدرك على الصحيحين , كتاب الجهاد : ٣/٣٨٢ رقم ٥٤٥٦ – “আমি কি তোমাদেরকে আবু যরের ইসলামের ঘটনা শোনাবো না’? (রাবী আবু হামযাহ) বলেন: ‘আমরা বললাম: ‘জি (অবশ্যই বলুন)’। (তখন) ইবনে আব্বাস রা. বললেন: ‘আবু যর রা. বলেছেন: ‘আমি ছিলাম গিফার গোত্রের একজন। আমাদের কাছে (একদিন) খবর এল যে, মক্কায় এক ব্যাক্তি বের হয়েছে, যে নিজকে নবী বলে দাবী করছে। তখন আমি আমার ভাইকে বললাম: ‘তুমি যত দ্রুত সম্ভব ওই ব্যাক্তির সাথে সাক্ষাত করে কথাবার্তা বলে আমার কাছে তার খবরাখবর নিয়ে আসো’। ফলে সে দ্রুত রওয়ানা হয়ে গেল এবং তাঁর সাথে সাক্ষাত করে ফিরে এল। আমি জিজ্ঞেস করলাম: ‘(খুলে বলো, ওই লোকটির ব্যাপারে) তোমার কাছে কী খবর (মিলেছে)’? তখন সে বললো: ‘আল্লাহ’র কসম! আমি সেই ব্যাক্তিটিকে দেখেছি, তিঁনি (লোকজনকে) কল্যানকর বিষয়ের আদেশ করেন এবং অকল্যানকর বিষয় থেকে নিষেধ করেন’। তখন আমি তাকে বললাম: ‘(তোমার এতটুকু) খবরে আমার মন ভরলো না’। ফলত: আমি (আমার) ব্যাগ ও লাঠি নিয়ে মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। …. (এরপর দীর্ঘ আরো অনেক কথা রয়েছে। সারমর্ম হল, তিনি মক্কায় গিয়ে হযরত আলী রা.-এর সাক্ষাত পান এবং হযরত আলী তাকে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে বলেন) : ‘আমি তাঁর কাছেই যাবো। আপনি আমার অনুসরণ করতে থাকবেন; আমি (চলার পথে যেখানে) যেখানে প্রবেশ করবো আপনিও (আমার অনুসরণ করে সেখানে) সেখানে প্রবেশ করবেন; আমি যদি (পথিমধ্যে) এমন কাউকে দেখি, যাকে আমি আপনার জন্য শংকাজনক বলে মনে করি, তাহলে আমি আমার সেন্ডেল ঠিক করার ভান করে কোনো দেয়ালের কাছে দাঁড়িয়ে যাবো, আর আপনি (আমার অপেক্ষা না করে সামনের দিকে) চলতেই থাকবেন’। যা হোক, (কথা মতো) আলী চলতে থাকলো, আমিও তার সাথে চলতে থাকলাম। অবশেষে নবী ﷺ (যে বাড়িতে তখন অবস্থান করছিলেন) আলী তাতে প্রবেশ করলে আমিও তার সাথে সেখানে প্রবেশ করলাম। তখন আমি নবী ﷺ-কে বললাম: ‘আমার কাছে (সেই দ্বীন) ইসলামকে পেশ করুন (যে দ্বীন ইসলামের দিকে আপনি মানুষজনকে ডাকছেন)’। ফলে তিঁনি আমার কাছে (তখনকার মতো ইসলামকে যতটুকু পেশ করার) তা পেশ করলেন। আমি ওখানে থাকাবস্থায়ই ইসলাম কবুল করে নিলাম। তখন নবী ﷺ আমাকে বললেন: ‘হে আব যর! তোমার (এখন) একাজটাই করণীয় ছিল, (আর তুমি সেটা করে নিয়েছো), তুমি (এখন) তোমার অঞ্চলে ফিরে যাও (এবং ফিরে গিয়ে তোমার অঞ্চলের লোকদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পেশ করো)। পরে যখন (কাফের মুশরেকদের উপরে) আমাদের প্রাবাল্যতা/বিজয়ের খবর পাবা তখন এসো’। তখন আমি তাঁকে বললাম: ‘(ঠিক আছে, আমি ফিরে যাবো, কিন্তু যাওয়ার আগে আমি বলতে চাই), ওই সত্ত্বার কসম যিঁনি আপনাকে মহাসত্য সহকারে পাঠিয়েছেন, আমি অবশ্যই (যাওয়ার আগে মক্কার এই যে কাফের মুশরেকরা রয়েছে) তাদের সামনে (আমার ইসলাম গ্রহনের) একথা চিৎকার করে ঘোষনা দিবো’। ফলে (একথা বলে) তিনি মসজিদে (হারামে) আসলেন; সেখানে (তখন) কুরাইশী লোকজন উপস্থিত ছিল। তিনি বললেন: ‘হে কুরাইশগণ! (তোমরা কান খুলে শোন) আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসুল’। (ফলে তার একথা শুনতেই) তারা বলে উঠলো: ‘(হে কুরাইশ ভাইরা) তোমরা এই ধর্মত্যাগীকে ধরো’। ফলে তারা উঠে গিয়ে আমাকে (এমন বেদম) মারপিট করলো যেন আমি মড়ে যাই। তখন (কুরাইশদের মধ্য থেকে নবী ﷺ-এর চাচা) আব্বাস এসে আমাকে ঢেকে ধরলেন, তারপর তাদের নিকটে গিয়ে বললেন: ‘তোমাদের ধ্বংস হোক! তোমরা গিফার গোত্রের এক ব্যাক্তিকে (এভাবে অমানবিক ভাবে প্রহার করতে করতে তাকে) হত্যা কর(তে উদ্দত হ)চ্ছো! অথচ তোমাদের ব্যবসায়ীক পণ্যসামগ্রী আনানেয়ার রাস্তাপথ গিফার গোত্রের উপর দিয়েই’। এ(কথা শুন)তে(ই) তারা আমকে ছেড়ে দিলো। এরপর পরের দিন যখন সকাল হল তখন আমি আবার (মসজিদে হারামে) ফিরে গিয়ে (মুশরেকদের সামনে) সেসব কথাই বললাম যা গতকাল বলেছিলাম। ফলে তারা (রেগে গিয়ে আবারো) বলে উঠলো: ‘তোমরা এই ধর্মত্যাগীকে ধরো’। পরে তারা আমার ওই একই হাল করলো, যে হাল তারা আমার গতদিন করেছিল। (সেবারও) আব্বাস এসে আমাকে ঢেকে ধরলেন এবং (তাদেরকে পূণরায়) ওই একই কথাগুলো বললেন, যেসব কথা তিনি গতকাল তাদেরকে বলেছিলেন।…..”। [সহিহ বুখারী- ৩/১২৯৭ হাদিস ৩৩২৮; মুসনাদে বাযযার– ৯/৩৩১ হাদিস ৩৮৮৮; মুসতাদরাকে হাকিম- ৩/৩৮২ হাদিস ৫৪৫৬; তারিখে দিমাশক, ইবনুল আছীর- ৬৬/১৮২]
এ থেকে বোঝা যায় যে, সেসময়ে সর্বসাধারণ মুশরেক জনগণের সামনে ইসলামের কথা প্রকাশ্যে প্রচার করা অথবা নিজকে মুসলমান হিসেবে প্রকাশ করাটা কত বড় অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হত এবং কেউ তা প্রকাশ করলে তার উপর দিয়ে তখন কী অতিবাহিত হত। এজন্যই সেসময় মক্কায় মুসলমানদেরকে নিজেদের ‘মুসলমানিত্বের পরিচয়’কে গোপন করে চলতে হত। যাহোক, তখনও পর্যন্ত এভাবেই যথাসম্ভব গোপনে ইবাদত বন্দেগী ও ইসলামের দাওয়াতের কাজ চলছিল। তবে ধীরে ধীরে মুসলমানদের সংখ্যা কিছুটা বাড়তে থাকে। ফলে, কোনো জরুরী বৈঠক, আলোচনা বা দ্বীনী শিক্ষা দিক্ষা কিংবা দ্বীন প্রচার প্রসারের ভবিষ্যত পরিকল্পনা গ্রহন অথবা ইবাদত বন্দেগী ইত্যাদি বিষয়ের সুরাহারার জন্য মুসলমানদের একটি নির্দিষ্ট স্থানের প্রয়োজন হয়ে পরে। আর উক্ত নির্দিষ্ট স্থান হিসেবে ঠিক করা হয় সাহাবী আরকাম রা.-এর বাড়িকে। সেখানেই তারা যথাসাধ্য মুশরেকদের চোখ ফাঁকি দিয়ে সময়ে সময়ে উপস্থিত হতেন।
কাসেম বিন মুহাম্মাদ রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, আয়েশা রা. বর্ণনা করেন- لَمَّا اجْتَمَعَ أَصْحَابُ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَكَانُوا ثَمَانِيَةً وَثَلَاثِينَ رَجُلًا , أَلَحَّ أَبُو بَكْرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي الظُّهُورِ , فَقَالَ: «يَا أَبَا بَكْرٍ , إِنَّا قَلِيلٌ» , فَلَمْ يَزَلْ أَبُو بَكْرٍ يُلِحُّ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَتَّى ظَهَرَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَتَفَرَّقَ الْمُسْلِمُونَ فِي نَوَاحِي الْمَسْجِدِ , كُلُّ رَجُلٍ فِي عَشِيرَتِهِ , وَقَامَ أَبُو بَكْرٍ فِي النَّاسِ خَطِيبًا , وَكَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ جَالِسًا , فَكَانَ أَوَّلَ خَطِيبٍ دَعَا إِلَى اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ وَإِلَى رَسُولِهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ , وَثَارَ الْمُشْرِكُونَ عَلَى أَبِي بَكْرٍ وَعَلَى الْمُسْلِمِينَ فَضُرِبُوا فِي نَوَاحِي الْمَسْجِدِ ضَرْبًا شَدِيدًا , وَوُطِيَ أَبُو بَكْرٍ وَضُرِبَ ضَرْبًا شَدِيدًا , فَدَنَا مِنْهُ الْفَاسِقُ عُتْبَةُ بْنُ رَبِيعَةَ فَجَعَلَ يَضْرِبُهُ بِنَعْلَيْنِ مَخْصُوفَيْنِ وَيُحَرِّفُهُمَا لِوَجْهِهِ وَثَنَى عَلَى بَطْنِ أَبِي بَكْرٍ حَتَّى مَا يُعْرَفُ وَجْهُهُ مِنْ أَنْفِهِ , وَجَاءَتْ بَنُو تَيْمٍ يَتَعَادَوْنَ وَأَجْلَتِ الْمُشْرِكِينَ عَنْ أَبِي بَكْرٍ , وَحَمَلَتْ بَنُو تَيْمٍ أَبَا بَكْرٍ فِي ثَوْبٍ حَتَّى أَدْخَلُوهُ مَنْزِلَهُ , وَلَا يَشُكُّونَ فِي مَوْتِهِ , ثُمَّ رَجَعَتْ بَنُو تَيْمٍ فَدَخَلُوا الْمَسْجِدَ وَقَالُوا : وَاللَّهِ لَئِنْ مَاتَ أَبُو بَكْرٍ لَنَقْتُلَنَّ عُتْبَةَ بْنَ رَبِيعَةَ …… أخرجه الحافظ أبو الحسن خيثمة بن سليمان بن حيدرة بن سليمان القرشي الشامي الأطرابلسي (المتوفى: ٣٤٣هـ) في الفوائد فضائل الصحابة: ١/١٢٦ ، اورده ابن كثير في البداية والنهاية , كتاب سيرة رسول الله صلى الله عليه وسلم , فصل في ذكر أول من أسلم : ٤/٦١، – “(সে সময়) রাসুলুল্লাহ ﷺ -এর সাহাবীগণ যখন একত্রিত হলেন তখন তারা ছিলেন আটত্রিশ জন। (তাঁদের মধ্যে আমার পিতা) আবু বকর রা. পীড়াপীড়ি করছিলেন (এ দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে) প্রকাশ্যে যাওয়ার জন্য। তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন: ‘হে আবু বকর! আমরা তো সংখ্যায় কম”! কিন্তু আবু বকর রা. (এব্যাপারে) রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে (এতো) পীড়াপীড়ি করতেই থাকলেন (যে), অবশেষে রাসুলুল্লাহ ﷺ প্রকাশ্যে বের হলেন, আর মুসলমানগণ প্রত্যেকে তাদের নিজ নিজ গোত্রের লোকদের জন্য মসজিদের বিভিন্ন দিকে অবস্থান নিলেন। রাসুলুল্লাহ ﷺ (পাশে বসে ছিলেন) আর আবু বকর রা. লোকদের মাঝে বক্তব্য রাখার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। বস্তুত: আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের দিকে আহবানের ক্ষেত্রে তিঁনিই ছিলেন সর্বপ্রথম বক্তা। এতে মুশরেকরা (আব্বাজান) আবু বকর এবং মুসলানদের উপরে ভিষন ভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে গলে এবং মসজিদের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান গ্রহনকারী (মুসলমান)রা (মুশরেকদের হাতে) বেদম ভাবে প্রহারে শিকার হলেন। (বিশেষ ভাবে) আবু বকর রা.কে মাটিতে ফেলে ভিষন ভাবে প্রহার করা হল। তাঁর নিকটেই ছিল বদমাশ উৎবাহ বিন রাবিয়্যাহ; সে এক জোড়া ছেন্ডেল একত্রিত করে তা দিয়ে তাঁকে মারধর করতে লাগলো, তার মুখে আঘাত করলো। (এমন কি) সে (পিটাতে পিটাতে) আবু বকর রা.-এর পেটের উপর উঠে দাঁড়ায়। (তাঁকে সেদিন এমন ভিষন ভাবে মারধর করা হয়েছিল যে, দেখে), তাঁর নাক মুখ চেনাই যাচ্ছিল না। (খবর পেয়ে) বনু তায়েম (গোত্রের লোকেরা ঘটনাস্থলে দ্রুত) এসে ধস্তাধস্তি করে আবু বকর রা.কে মুশরেকদের হাত থেকে উদ্ধার করে। বনু তায়েমের লোকেরা (তখন) একটি (বহনযোগ্য শক্ত) কাপড়ের মধ্যে করে আবু বকর রা.কে উঠিয়ে নিয়ে একেবারে তাঁর বাড়িতে তাঁকে পৌছিয়ে দিয়ে আসে। (তখন আবু বকর রা.-এর নাজুক অবস্থা দৃষ্টে) তাঁর মৃত্যুর ব্যাপারে (বাহ্যত:) তাদের কোনো সন্দেহই ছিল না। পরে বনু তায়েমের লোকেরা (এ ঘটনায় এত ক্ষেপে গিয়েছিল যে, তারা পূণরায়) ফিরে গিয়ে মসজিদে প্রবেশ করে (উপস্থিত মুশরিকদেরকে উদ্দেশ্য করে) বলে: ‘আল্লাহ’র কসম! আবু বকর যদি মড়ে যায়, তাহলে আমরা উৎবাহ বিন রাবিয়্যাহকে খুন করে ফেলবো’। ……… ”। [আল-ফাওয়ায়িদ ফাজায়েলে সাহাবাহ, ইমাম খাইছামাহ ইবনে সুলাইমান আল-আত্বরাবুলসী- ১/১২৬; তারিখে দিমাশক, ইবনু আসাকীর- ৩০/৩৯; আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইমাম ইবনে কাসির- ৪/৬১]
নবুওতের ৩য়/৪র্থ বছর পর্যন্ত ইসলাম কবুল করা মক্কার মুসলমানদের সংখ্যা প্রায় ৪০ জনের মতো বলা হয়ে থাকে। তবে মক্কার বাইরে বহু ব্যাক্তি ইসলাম কবুল করেন। যেমন, উপরের হযরত আবু যর গিফারী রা.-এর ইসলাম কবুলের যে ঘটনার কথা উল্লেখ করা হল, এর পর তাঁরা দু ভাই মিলে তাঁদের গোত্রের লোকজনের কাছে ইসলামের দাওয়াত পেশ করলে তাঁদের গোত্রের প্রায় অর্ধেক লোক ইসলাম কবুল করে। [আল ইসাবাহ, ইবনে হাজার- ২/৬২]
আল্লাহ তাআলার তরফ থেকে রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে মক্কার গণ্যমান্য নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তিদের কাছে দ্বীন ইসলামের দাওয়াত পেশ করার নির্দেশ দান এবং তখনকার পরিবেশ পরিস্থিতি
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-
فَلَا تَدْعُ مَعَ اللَّهِ إِلَٰهًا آخَرَ فَتَكُونَ مِنَ الْمُعَذَّبِينَ – وَ أَنذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ – وَ اخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ – فَإِنْ عَصَوْكَ فَقُلْ إِنِّي بَرِيءٌ مِّمَّا تَعْمَلُونَ – وَتَوَكَّلْ عَلَى الْعَزِيزِ الرَّحِيمِ – الَّذِي يَرَاكَ حِينَ تَقُومُ – وَ تَقَلُّبَكَ فِي السَّاجِدِينَ – إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
“অতএব (হে নবী!) তুমি (তোমার একমাত্র রব) আল্লাহর সাথে অন্য আর কাউকে ইলাহ হিসেবে ডাকবে না, অন্যথায় তুমি (আখেরাতে) আযাবগ্রস্থদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাবে। আর তুমি তোমার নিকটতর আশীরাহ (সজাতি/স্বগোত্র/জ্ঞাতিবর্গ)’কে সতর্ক করো। আর মুমিনদের মধ্যে যে তোমার ইত্তেবা-অনুসরণ করে চলে তুমি তার জন্য তোমার (অনুকম্পাময়) ডানাকে (তার মাথার উপরে অভিভাবকের ন্যায়) ছেয়ে রাখো। আর যদি তারা তোমার অবাধ্য হয়, তাহলে বলে দাও, তোমরা (অবাধ্যতামূলক) যা কিছু করছো আমি তা(র দায়) থেকে মুক্ত। আর তুমি মহা-পরাক্রমশালী মহা-দয়ালু (আল্লাহ)র উপরে তাওয়াক্কুল (ভরসা) করো, যিঁনি তোমাকে দেখেন যখন তুমি (নামাযে) দাঁড়াও এবং (লক্ষ্য করেন) সিজদাহকারীদের মধ্যে তোমার গতিবিধি(ও)। নিশ্চই তিঁনি সর্বশ্রতা সর্বজ্ঞানী”। [সূরা শুয়ারা ২১৩-২২০]
আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, আলী বিন আবি ত্বালেব রা. বর্ণনা করেন- لَمَّا نَزَلَتْ هَذِهِ الْآيَةُ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَنْذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ، وَاخْفِضْ جَناحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ من الْمُؤْمِنِينَ , قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: عَرَفْتُ أَنِّي إِنْ بَادَأْتُ بِهَا قَوْمِي رَأَيْتُ مِنْهُمْ مَا أَكْرَهُ، فَصَمَتُّ. فَجَاءَنِي جِبْرِيلُ عَلَيْهِ السَّلَامُ فَقَالَ: يَا مُحَمَّدُ إِنْ لَمْ تَفْعَلْ ما أمرك به ربك عذبك بالنار . قال فَدَعَانِي فَقَالَ «يَا عَلِيُّ إِنَّ اللَّهَ قَدْ أَمَرَنِي أَنْ أُنْذِرَ عَشِيرَتِيَ الْأَقْرَبِينَ فَاصْنَعْ لَنَا يَا عَلِيُّ شَاةً عَلَى صَاعٍ مِنْ طَعَامٍ، وَأَعِدَّ لَنَا عُسَّ لَبَنٍ، ثُمَّ اجْمَعْ لِي بنى عبد المطلب» ففعلت فاجتمعوا له يومئذ وهم أَرْبَعُونَ رَجُلًا يَزِيدُونَ رَجُلًا أَوْ يَنْقُصُونَ فِيهِمْ أَعْمَامُهُ أَبُو طَالِبٍ، وَحَمْزَةُ وَالْعَبَّاسُ، وَأَبُو لَهَبٍ الْكَافِرُ الْخَبِيثُ . رواه البيهقي في دلائل النبوة: ٢/١٧٨، و في السنن الكبرى , كتاب السير , باب مبتدأ الفرض على النبي صلى الله عليه وسلم ثم على الناس وما لقي النبي من أذى قومه في تبليغ الرسالة : ٩/٧– “রাসুলুল্লাহ ﷺ -এর উপরে যখন- وَأَنْذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ، وَاخْفِضْ جَناحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ من الْمُؤْمِنِينَ – ((আর তুমি তোমার নিকটতর আশীরাহ (সজাতি/স্বগোত্র/জ্ঞাতিবর্গ)’কে সতর্ক করো। আর মুমিনদের মধ্যে যে তোমার ইত্তেবা-অনুসরণ করে চলে তুমি তার জন্য তোমার (অনুকম্পাময়) ডানাকে (তার মাথার উপরে অভিভাবকের ন্যায়) ছেয়ে রাখো)) -এই আয়াতটি নাজিল হয়, তখন তিঁনি বললেন: ‘আমি বুঝতে পারছি, আমি যদি আমার কওমের কাছে একাজ শুরু করে দিই, তাহলে আমি যেটার আশংকা করছি, সেটাই তাদের মধ্যে (ঘটতে) দেখবো। (এতে তারা নির্ঘাত তেলে বেগুনে জ্বলে উঠবে এবং মুসলমানদের উপরে আরো জুলুম অত্যাচার শুরু করে দিবে), তাই আমি (আপাতত) নিরব থাকি, (ভেবে চিন্তে সময় সুযোগে তাদের সামনে ইসলামের দাওয়াত পেশ করবো)’। কিন্তু জিবরীল আ. আমার কাছে চলে এলেন এবং বললেন: ‘হে (নবী) মুহাম্মাদ! আপনার রব আপনাকে যা করার নির্দেশ দিয়েছেন, আপনি যদি তা (অনতিবিলম্বে) না করেন, তাহলে তিঁনি আপনাকে(ও) দোযখের আযাব চাখাবেন’। আলী রা. বলেন: ‘ফলে রাসুলুল্লাহ ﷺ আমাকে ডেকে বললেন: ‘হে আলী! আল্লাহ আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, আমি যেন আমার নিকটতর আশীরাহ (সজাতি/স্বগোত্র/জ্ঞাতিবর্গ)কে সতর্ক করি। সুতরাং, হে আলী, তুমি আমাদের জন্য এক সা’ খাদ্য সমেত একটি বকরী (রান্না করে) আনো, আর (সাথে) আমাদের জন্য এক পাত্র দুধের ব্যবস্থা করো। এরপর আমার কাছে বনু আব্দিল মুত্তালীবের লোকদেরকে সমবেত করো’। ফলে আমি তাই করলাম। (যেদিন তাদের সমবেত হওয়ার কথা ছিল, ঠিক) সেদিন তারা রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে সমবেত হল। (সেদিন) তারা সংখ্যায় কম বেশি ৪০ জন ছিল। তাদের মধ্যে ছিল রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর চাচা আবু ত্বালেব, হামযাহ, আব্বাস এবং বদমাশ কাফের আবু লাহাব….”।[দালায়িলুন নাবুওয়াহ, ইমাম বাইহাকী- ২/১৭৮; সুনানুল কুবরা, ইমাম বাইহাকী- ৯/৭; সিরাতুন নাবুবিয়্যাহ, ইমাম ইবনে ইসহাক্ব- ২/১২৬; তারিখুল ইসলাম, ইমাম যাহাবী- ১/৩৩; আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইমাম ইবনে কাসির- ৪/৯৬]
উপরের এই রেওয়ায়েতটি থেকে বোঝা যায়- (১) বিশ্বনবী মুহাম্মাদ মুস্তফা ﷺ এই আয়াত নাজিল হওয়ার আগে তার আশীরাহ (সজাতি/স্বগোত্র/জ্ঞাতিবর্গ)-এর মধ্যে যারা মক্কায় গণ্যমান্য নেতা বা মোড়ল পর্যায়ের লোক ছিল তাদের সামনে তিঁনি তখনো পর্যন্ত সরাসরি ইসলামের দাওয়াত পেশ করেননি। কেননা, এর আগে তাদের কাছে দাওয়াত পেশ করে থাকলে এখন রাসুলুল্লাহ ﷺ নতুন করে আবার তাদের থেকে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আশককাবোধ করতেন না?!(২) রাসুলুল্লাহ ﷺ সুদীর্ঘ প্রায় চল্লিশ বছরের উপরে মক্কার এসব মুশরেক লোকদের মাঝে বড় হয়েছেন, ফলে তারা তাদের হাজার বছরের পরম্পরায় চলে আসা পূর্বপুরুষদের মুর্তি-পুঁজার ধর্মবিশ্বাসকে তাদের ব্যাক্তিজীবন, সামাজিক জীবন ও রাজনৈতিক জীবনে কতটা গাঢ় ও গভীর ভাবে লেপটে রেখেছে, তা তিঁনি ভালো করেই উপলব্ধি করতে পারতেন। এজন্য তিঁনি ভালো করেই বুঝতে পারছিলেন, মক্কার সাধারণ মুশরেক জনগণই যেখানে তাদের হাজার বছরের পরম্পরায় চলে আসা মুর্তি পুঁজার শিরকী ধর্ম পরিত্যাগ করতে প্রস্তুত হচ্ছে না, উল্টো ইসলাম ও মুসলমানদের বিপক্ষে ভয়ঙ্কর মারমুখী বৈরী আচরণ প্রদর্শন করছে, সেখানে সমাজের এসব গণ্যমান্য নেতৃবর্গের সামনে তাদের পূর্বপুরুষদের শিরকী ধর্ম পরিত্যাগ করে তাঁর নবুওত ও দ্বীন ইসলামকে কবুল করে নেয়ার দাওয়াত পেশ করা হলে তারা যে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠবে -তা বলাই বাহুল্য। কারণ, সাধারণ মুশরিক জনগণের চোখে, বিশ্বনবী ﷺ-এর নতুন ধর্ম দ্বীন ইসলামকে মক্কায় চলতে দেয়ার অর্থ ছিল শুধুমাত্র তাদের হাজার বছরের পরম্পরায় চলে আসা পূর্বপুরুষদের মুর্তি পুঁজার শিরকী ধর্মকে হুমকীর মুখে ফেলা। অপরদিকে সমাজের গণ্যমান্য নেতা ও মোড়লদের চোখে এর অর্থ ছিল দুটি – (ক) তাদের হাজার বছরের পরম্পরায় চলে আসা পূর্বপুরুষদের মুর্তি পুঁজার শিরকী ধর্মকে হুমকীর মুখে ফেলা, (খ) পূর্বপুরুষদের এই শিরকী ধর্মকে সম্বল করে এতদিন তারা সমাজে যে সম্মান মর্যাদার আসনে বসে জনগণের উপরে নেতাগীরী ও মোড়লগীরী করে আসছিল -তা নিজ চোখের সামনে অপমৃত্যুতে আক্রান্ত হতে দেখা। সুতরাং, ইসলাম কবুল করা কিংবা ইসলামকে মক্কায় বাড়তে দেয়া -দুটোই ছিল তাদের নিজেদের গলাল নিজে নিজেই দড়ি দেয়ার নামান্তর। এজন্য, রাসুলুল্লাহ ﷺ খুব ভালো করেই বুঝতে পারছিলেন, সাধারণ জনগণের সামনে ইসলামকে পেশ করার চাইতে, এসব নেতৃবর্গের সামনে ইসলামকে পেশ করার পরিণতি মুসলমানদের জন্য আরো কয়েকগুণ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে। বিধায়, وَأَنْذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ – ((আর তুমি তোমার নিকটতর আশীরাহ (সজাতি/স্বগোত্র/জ্ঞাতিবর্গ)’কে সতর্ক করো))– এ আয়াত নাজিল হবার পর রাসুলুল্লাহ ﷺ সময় নিতে চাচ্ছিলেন, কী ভাবে কী করা যায় তা ভেবে চিন্তে সময় সুযোগে তাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পেশ করবেন। কিন্তু আল্লাহ’র পরিকল্পনা ছিল অন্য রকম। এজন্য জিবরীল আ. এসে তাঁকে বললেন- يَا مُحَمَّدُ إِنْ لَمْ تَفْعَلْ ما أمرك به ربك عذبك بالنار – ‘হে (নবী) মুহাম্মাদ! আপনার রব আপনাকে যা করার নির্দেশ দিয়েছেন, আপনি যদি তা (অনতিবিলম্বে) না করেন, তাহলে তিঁনি আপনাকে(ও) দোযখের আযাব চাখাবেন’। ফলে, রাসুলুল্লাহ ﷺ তাঁর আশীরাহ (সজাতি/স্বগোত্র/জ্ঞাতিবর্গ)-কে খাবারের আমন্ত্রন জানালেন, যাতে এই ওসিলায় তারা সেখানে উপস্থিত থাকে এবং তিঁনি তাদের সামনে তাঁর নবুওত ও দ্বীন ইসলামের দিকে দাওয়াত পেশ এবং আখেরাতে আল্লাহ সামনে জবাবদিহিতার ব্যাপারে সতর্ক করতে পারেন। যাহোক, সেদিন উপস্থিত নেতৃবর্গের কাছে ইসলামের দাওয়াত পেশ করা হয়, কিন্তু তাদের মধ্যে কেউই ইসলাম কুবল করে নি, বরং রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর চাচা আবু লাহাব তো রেগে ক্ষোভে বলেই ওঠে- تَبًّا لَكَ سَائِرَ اليَوْمِ، أَلِهَذَا جَمَعْتَنَا – “(আজ) সারাটা দিন ধরে তোমার উপরে ধ্বংস নেমে আসুক (হে মুহাম্মাদ)! এরই জন্য কি তুমি আমাদেরকে (এখানে) জরো করেছো”? [সহিহ বুখারী- ৬/১১১ হাদিস ৪৭৭০] তাদের অনেকে হাসি-তামাশা ও হাট্টা বিদ্রুপ করে চলে যায়। [মাআলিমুত তানজীল, ইমাম বগভী- ৬/১৩২; আল-কামিল, ইবনুল আছির- ১/৬৫৯; আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইমাম ইবনে কাসির- ৩/৪০]
সেদিন উপস্থিত কেউ ইসলাম কবুল করেনি বটে, কিন্তু এ সমাবেশের বিশাল ফায়দা এই ছিল যে, (১) কুরায়েশদের গণ্যমান্য নেতা ও মোড়লদেরকে এভাবে কোথাও ডেকে তাদেরকে দ্বীন ইসলাম কবুল করার জন্য বলার মতো দু:সাহসিক ঘটনা মক্কার ইতিহাসে এই প্রথম ঘটে গেল, (২) ফলে মক্কার ঘরে ঘরে সরাসরি দাওয়াত পৌছানোর পথে এসব নেতৃবর্গের যে একটি প্রধানতম ভীতিকর বাঁধা ও সমস্যা হিসেবে মুসলমানদের কাছে প্রতিয়মান হচ্ছিল, সেই পয়লা জট’টি এই সমাবেশের দ্বারাই প্রাথমিক ভাবে খুলে গেল। (৩)এই ঘটনাটি এসব কুরায়েশী নেতৃবর্গের মাথা ব্যাথার প্রধান কারণ হিসেবে প্রতিভাত হয়ে উঠলো। কারণ তারা সুস্পষ্টই দেখতে পাচ্ছিল যে, ‘মুহাম্মাদ, তাঁর দ্বীন ইসলাম এবং মুসলমানরা মক্কার জমিনে একটি বিষ ফোঁড়া হয়ে বেড়ে ওঠা শুরু করে দিয়েছে’। ফলে তাদের আলোচনা সভাগুলোতে প্রধানতম গরম আলোচ্য বিষয় (Hot Topic) হিসেবে চর্চিত হতে লাগলো ‘মুহাম্মাদ ও তাঁর আনিত দ্বীন ইসলাম ও তাঁর অনুসারী মুসলমানরা’। (৪) এর ফলে গোটা মক্কার লোকজনের মুখেও প্রধানতম গরম আলোচ্য বিষয় (Hot Topic) হিসেবে চর্চিত হতে লাগলো ‘বিশ্বনবী মুহাম্মাদ মুস্তফা ﷺ ও তাঁর আনিত দ্বীন ইসলাম ও মুসলমানরা’ই। এর ফল এই দাঁড়ালো এই যে, ইসলামের মূল দাওয়াত তথা [তাওহীদ (আল্লাহ’র একত্ববাদ), রিসালাত (মুহাম্মাদ মুস্তফা ﷺ-এর নবুওতী মিশন) ও আখিরাত] -এই বিষয়বস্তুটি মৌলিকভাবে মক্কার উঁচু নিচু ধ্বনী গরীব সকলের কাছে খোলাখুলি ভাবে পৌছে গেল। ফলে ‘দ্বীন ইসলাম’ আর গোপনে গোপনে প্রচারিত কোনো ধর্ম রইলো না, বরং মক্কার সকলের সামনে একেবারে ‘প্রকাশ্য একটি ধর্ম’ হিসেবে প্রতিভাত হয়ে উঠলো।
এ দিক থেকে তো, সেদিনের ওই ঐতিহাসিক সমাবেশটি ইসলামের প্রচার প্রসারের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলো বটে, কিন্তু সেই দিনের ওই সমাবেশটিই মক্কার নেতৃবর্গের মনে ইসলামের সাথে মূল দ্বন্দ্বের বীজ বুনে দেয়। কারণ, ওই সামাবেশের পর থেকে মক্কার নেতা ও মোড়লরা পরিষ্কার বুঝতে পারে যে, ‘মক্কার রাজনৈতিক নেতৃবর্গকে দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দেয়ার অর্থ কী’। তারা বুঝতে পারছিল যে, এই ‘দ্বীন ইসলাম’ মূলত: মক্কার সামাজিক ও রাজনৈতিক মূল্যবোধ বিশ্বাসকেও তার নিজ রং-এ পাল্টানোর ভবিষ্যৎ দেখে, আর এ জন্যই মক্কার সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্ণধারদেরকেও এই দ্বীন গ্রহন করার দিকে আহবান জানানো হচ্ছে।
এতদিন পর্যন্ত ‘দ্বীন ইসলাম’ পালন ও প্রচার-প্রসারের ক্ষেত্রে তা প্রকাশ্যে বা গোপনে করা বা না-করার মাঝে কোনো বাঁধাধরা নির্দেশ ছিল না, ফলে মুসলমানরা কখনো সাহস করে প্রকাশ্যে, কখনো সাহস না পেলে গোপনে দ্বীন ইসলাম পালন ও প্রচার-প্রসারের চেষ্টা করে আসছিলেন। কিন্তু আর আল্লাহ তাআলাও চাচ্ছিলেন মুসলমানদেরকে আরো কিছু ইমানী কঠিন ধাপ অতিক্রম করানোর এবং চাচ্ছিলেন মুসলমানদের মাধ্যমে হক্ব ও বাতিলের মাঝে সুষ্পষ্ট পার্থক্য তৈরী করার। তাই, আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসুল ﷺ-কে প্রকাশ্যে দ্বীন ইসলাম পালন ও প্রচার প্রসারের নির্দেশ দিয়ে নাজিল করলেন- فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ وَ أَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِينَ – “অতএব (হে নবী!) তোমাকে যে ব্যাপারে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তুমি তা প্রকাশ্যে (আমল ও প্রচার) করো, আর (এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মক্কার কাফের) মুশরিকদের (পক্ষ থেকে যেসব বৈরীতা তোমার উপরে আপতিত হয়, তুমি সেগুলো)কে (আল্লাহ’র সন্তুষ্টির জন্য) উপেক্ষা করে চলো”। [সূরা হিজর ৯৪-৯৯]
আল্লাহ তাআলার তরফ থেকে রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে মক্কায় প্রকাশ্যে দ্বীন ইসলাম প্রচারের নির্দেশ দান এবং তখনকার পরিবেশ পরিস্থিতি
আল্লাহ তাআলা নাজিল করেন-
فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ وَ أَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِينَ – إِنَّا كَفَيْنَاكَ الْمُسْتَهْزِئِينَ – الَّذِينَ يَجْعَلُونَ مَعَ اللَّهِ إِلَٰهًا آخَرَ ۚ فَسَوْفَ يَعْلَمُونَ – وَ لَقَدْ نَعْلَمُ أَنَّكَ يَضِيقُ صَدْرُكَ بِمَا يَقُولُونَ – فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَكُن مِّنَ السَّاجِدِينَ – وَ اعْبُدْ رَبَّكَ حَتَّىٰ يَأْتِيَكَ الْيَقِينُ
“অতএব (হে নবী!) তোমাকে যে ব্যাপারে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তুমি তা প্রকাশ্যে (আমল ও প্রচার) করো, আর (এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মক্কার কাফের) মুশরিকদের (পক্ষ থেকে যেসব বৈরীতা তোমার উপরে আপতিত হয়, তুমি সেগুলো)কে (আল্লাহ’র সন্তুষ্টির জন্য) উপেক্ষা করে চলো। নিশ্চই (তোমার) বিদ্রুপকারীদের বিপক্ষে আমরাই তোমার জন্য যথেষ্ট। যারা আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে ইলাহ (উপাস্য) বানিয়ে নিয়েছে তারা খুব শিঘ্রই জানতে পারবে (তাদের পরিণতি কী)। আর আমরা জানি যে, তারা (বিদ্রুপ করে তোমাকে) যা কিছু বলে, তা তোমার হৃদয়কে (দু:ক কষ্টে) সংকুচিত করে ফেলে। সুতরাং, তুমি তোমার রবের হামদ সহকারে তাসবিহ পাঠ করো এবং সিজদাহকারীদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে থাকো। আর তোমার রবের ইবাদত (ও গোলামী) করতে থাকো -যাবৎ না তোমার আল-ইয়াকীন (মৃত্যু) চলে আসে”। [সূরা হিজর ৯৪-৯৯]
মূলত: فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ – “((অতএব (হে নবী!) তোমাকে যে ব্যাপারে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তুমি তা প্রকাশ্যে (আমল ও প্রচার) করো))” – এই আয়াতটি নবুওতের ৪র্থ অথবা ৫ম তম বছরে নাজিল হয়। [আত তাহরীর ওয়াত তানবীর- ১৫/৮৮] এই আয়াতে ব্যবহৃত الصدع শব্দের এক অর্থ হল الإعلان (ই’লান/ঘোষনা দান করা) বা الجهر (প্রকাশ করে দেয়া), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এখানে فَاصْدَعْ – “((অতএব (হে নবী!) তুমি প্রকাশ্যে করো))” – এর ব্যাখ্যায় বলেছেন- فأمضه ((তুমি তা প্রকাশ্যে বলে দাও))। [তাফসীরে তাবারী- ১৪/৯২] তিঁনি এভাবেও এর ব্যাখ্যা করেছেন- أَظْهِرْهُ ((তুমি তা প্রকাশ করে দাও))। [মাআলিমুত তানজীল, ইমাম বগভী- ৪/৩৯৫] তিঁনি এর ব্যাখ্যা এভাবেও করেছেন- أعْلِنْ بِما تُؤْمَرُ – “তোমাকে যে ব্যাপারে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তুমি তার ঘোষনা করে দাও”। [আদ দুররুল মানসুর, ইমাম সয়ূতী- ৪/১০৬] ইমাম মুজাহিদ রহ. বলেন- أجهر بالقرآن في الصلاة – “নামাযে কুরআনকে জিহরী ভাবে (জোরে জোরে পড়ো)”। ইমাম ইবনে যায়েদ রহ. বলেন- فاصدع بأمرنا، فقد أمرناك أن تدعو إلى ما بعثناك به من الدين خلقي وأذنَّا لك في إظهاره – “ (হে নবী) আমাদের নির্দেশকে পকাশ্যে (পালন করো এবং প্রচার প্রসার) করো। আমি তোমাকে নির্দেশ দিচ্ছি, তোমাকে যে দ্বীন সহকারে আমি পাঠিয়েছি, সেই দ্বীনের প্রতি আমার সৃষ্ট বান্দাদেরকে আহবান জানাও এবং তা প্রকাশ্যে খোলাখুলি ভাবে ঘোষনা দিয়ে দাও”। [তাফসীরে তাবারী- ১৪/৯২] ইমাম জামাখশারী (মৃ: ৫৩৮ হি:) বলেছেন- فاجهر به وأظهره. يقال: صدع بالحجة إذا تكلم بها جهاراً – “অতএব তুমি তা প্রকাশ্যে করো এবং খোলাখুলি ঘোষনা করে দাও’, (এর ব্যাখ্যায়) আরো বলা হয়েছে: ‘যখন এ ব্যাপারে কথাবার্তা বলবে তখন হুজ্জত/দলিলের মাধ্যমে তা প্রকাশ্যে খোলাখুলি ভাবে বলে দিবে”। [তাফসীরে কাশশাফ, জামাখশারী- ২/৬৮০] তবে الصدع শব্দের আরেকটি অর্থ হল الانشقاق – (ভাগ করা, পার্থক্য সৃষ্টি করা)। ইমাম আল-আখফাশ রহ. এর ব্যাখ্যায় বলেছেন- افْرُقْ بِالْقُرْآنِ بَيْنَ الْحَقِّ وَالْبَاطِلِ – “অতএব তুমি কুরআনের মাধ্যমে হক্ব ও বাতিলের মাঝে পার্থক্য সৃষ্টি করো”। [মাআলিমুত তানজীল, ইমাম বগভী- ৪/৩৯৫] বস্তুত: এসকল ব্যাখ্যার আলোকে فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ –এর অর্থ হল, ‘আল্লাহ’র নির্দেশ মোতাবেক মানুষকে এমন প্রকাশ্য ভাবে দ্বীন ইসলামের দিকে আহবান করা এবং এমন প্রকাশ্য ভাবে দ্বীনের আহকাম পালন করা, যাতে মক্কার মুশরেকদের সামনে হক্ব (ইসলামের সত্যতা) ও বাতিল (মুশরেকদের ধর্ম)-এর মাঝে একটি সুষ্পষ্ট পার্থক্য পরিলক্ষিত হতে থাকে। অর্থাৎ, এখন থেকে দ্বীন ইসলাম পালন ও প্রচার-প্রসার প্রকাশ্যে ও খোলাখুলিভাবে হতে থাকবে, চাই সেটা মুশরেকদের কাছে যতই অপছন্দনীয় ঠেঁকুক না কেনো’। [মাফাতিহুল গাইব, ইমাম রাযী -১৯/২১৫; মাদারিকুত তানজীল, ইমাম নাসাফী- ২/২০০; আনওয়ারুত তানজীল, ইমাম বাইজাভী- ৩/৩৮২] আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইদাহ বলেন- ما زال النبي ﷺ مستخفيا ، حتى نزلت – فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ – فخرج هو وأصحابه – “(নবুওত লাভের পর থেকে) নবী ﷺ (এবং মুসলমানগণ যতদূর সম্ভব) গা-ঢাকা দিয়ে (দ্বীন ইসলাম পালন ও এর প্রচার প্রসার) করে আসছিলেন, অবশেষে যখন فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ – ((অতএব (হে নবী!) তোমাকে যে ব্যাপারে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তুমি তা প্রকাশ্যে (আমল ও প্রচার) করো)) – নাজিল হয় তখন তিঁনি ও তাঁর সাহাবীগণ (গা-ঢাকার হালত থেকে) বেরিয়ে আসেন (এবং প্রকাশ্যে দ্বীন ইসলাম পালন ও এর প্রচার প্রসার শুরু করে দেন)”। [জামেউল বায়ান, ইমাম তাবারী- ১৭/১৫০; তাফসীরে ইবনে কাসীর- ২/৫৭৯]
এই আয়াতটি নাজিল হওয়ার পরে রাসুলুল্লাহ ﷺ জনসমাবেশে, হাটে বাজোরে, মক্কার হারামে, দোকানে, কখনো দিনে, কখনো রাতে ব্যাপক ভাবে প্রকাশ্যে দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দানের এই গুরুদায়িত্ব পালন করতে থাকেন। তিঁনি দ্বারে দ্বারে গিয়ে তাদেরকে প্রকাশ্যে যে কথা বোঝাতে থাকেন তার সারমর্ম এই ছিল যে, “তাদের নিজেদের হাতে বানানো পুজার মুর্তিগুলো নিছক নির্জীব জড়পদার্থ ছাড়া আর কিছু নয়; যেখানে এগুলো নিজেই নিজেদের কোনো লাভ ক্ষতি করার সামান্যতম কোনো ক্ষমতা রাখেনা, সেখানে এসব নির্জীব মূর্তিগুলো অন্যের কী ভাল-মন্দ করার ক্ষমতা রাখে। সুতরাং, তাদের কর্তব্য হল, এসব মূর্তির ইবাদত ও পুঁজু অর্চনা থেকে তাওবা করে শুধুমাত্র এই বিশ্বজাহানের সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা আল্লাহ তাআলাকে একক রব (প্রতিপালক প্রভু) হিসেবে গ্রহন করে নেয়া, যেভাবে তাদের জাতীর পিতা নবী ইব্রাহিম আ. ও ইসমাঈল আ. একমাত্র আল্লাহ তাআলাকেই তাদের একক রব (প্রতিপালক প্রভু) হিসেবে গ্রহন করে নিয়েছিলেন। তিঁনি আরো বোঝাতে থাকেন যে, আল্লাহ তাআলা তাঁকে দ্বীন ইসলাম সহকারে সর্বশেষ নবী হিসেবে মানব জাতির কাছে পাঠিয়েছেন এবং মৃত্যু পরবর্তী আখেরাতের জীবনে আল্লাহ তাআলার সামনে জীবনের হিসাব নিকাশ দিতে হবে, তখনকার সময়ে দোযখ থেকে বেঁচে জান্নাতে যেতে হলে তার একমাত্র সঠিক পথ হল, তাদের পূর্বপুরুষদের মূর্তিপুঁজার শিরকী ধর্মকে বাতিল বিশ্বাস হিসেবে পরিত্যাগ করে কেবল মাত্র তাঁর আনিত দ্বীন ইসলামকে হক্ব ও সত্যধর্ম হিসেবে কবুল করে তা পালন করে চলা”। রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর এই দাওয়াত ছিল, মক্কার মুশরেকদের জন্য তাদের হাজার বছরের পরম্পরায় অনুসরণ করে চলে আসা বিশ্বাস ও সংস্কৃতির উপরে প্রকাশ্য কুঠারাঘাত। আর পৃথিবীর শুরু থেকে মানুষের এই জীবনধারা পরিলক্ষিত হয়ে আসছে যে, তাদের বেশির ভাগই তাদের বাপদাদা পূর্বপুরুষদের যে বিশ্বাসের উপরে জীবনমন সব সপে দিয়ে আসতে থাকে, সেটাকে তারা সত্যের আলোর ছোঁয়ায় যদিও-বা কোনো এক সময় বাতিল ও মিথ্যা বিশ্বাস বলে অনুভব করেও, তবুও তারা সেটা তা পরিত্যাগ করতে প্রস্তুত হয় না, বরং একগুঁয়েমী ও গোঁয়ারতুমী করে ওই মিথ্যা ও বাতিল বিশ্বাসের উপরই টিকে থাকতে চায়, আর যারাই তার ওই বিশ্বাসের বিপরীতে আসে তাকেই সে তার প্রতিপক্ষ হিসেবে গণ্য করে নেয়। মক্কাবাসীর ক্ষেত্রেও মানব ইতিহাসের ওই একই চরিত্রের পূণরাবৃত্তি ঘটতে দেখা গেল। তাদের সিংহভাগ লোকই ইসলাম ও মুসলমানদেরকে তাদের বিশ্বাসের বিপরীতে বিষফোঁরা-শত্রু হিসেবে গণ্য করতে থাকলো। সঙ্গত কারণেই মক্কার সর্বসাধারণ জনগনের চাইতে তাদের নেতা ও মোড়লদের গায়ে নুনের ছিটা বেশি লাগায় তারাই সবচাইতে বেশি বিতশ্রদ্ধ ও ক্রধাহ্নিত হতে থাকলো রাসুলুল্লাহ ﷺ ও মুসলমানদের উপরে।
ফল দাঁড়ালো এই যে, মক্কার নেতৃস্থানীয়রা ও তাদের অনুগামী সাাধারণ মুশরেকরা- তাদের অধীনস্ত কেউ নিজ ধর্ম পরিত্যাগ করে মুসলমান হয়েছে শুনলে তার উপরে চড়াও হতে থাকে এবং নির্মম ভাবে জুলুম নির্যাতন করা শুরু করে দেয়, যেন সে দ্বীন ইসলাম ত্যাগ করে পূণরায় তাদের পূর্বপুরষদের ধর্মে ফিরে আসে। এক্ষেত্রে উঁচু নিচু সকল স্তরের মুসলমানই প্রথম প্রথম কম-বেশি বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে থাকে। তবে (১) যেসকল মুসলমান ইসলাম গ্রহনের আগে থেকেই মক্কার উচ্চ গোত্র ও সম্ভ্রান্ত বংশের গণ্যমান্য ব্যাক্তিদের মধ্যে গণ্য হত, কেবল তাদের উপরেই চড়াও হবার আগে মুশরেকরা কয়েকবার চিন্তা করতো। এর একটি অন্যতম কারণ এই ছিল যে, সেসময় মক্কায় এক গোত্রের কোনো ব্যাক্তির উপরে অপর কোনো গোত্রের ব্যাক্তি দ্বারা অপমান অপদস্ত হওয়া বা মারপিটকে তারা নিজ নিজ গোত্রের অপমান অপদস্ততা বা মারপিট বলে গণ্য করতো, যার কারণে এমন অযাচিত কিছু করতে গেলেই গোত্রে গোত্রে দ্বন্দ্ব সংঘাত এমনকি যুদ্ধ পর্যন্ত বেঁধে যাওয়ার শংকা ছিল, সেখানে উচ্চ গোত্র ও সম্ভ্রান্ত বংশের গণ্যমান্য কারোর উপরে চড়াও হলে তো পরিস্থিতি আরো খারাপ হবার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। দ্বিতীয়ত: উচ্চ বংশীয়/গোত্রীয় মুসলমানদের নিজ নিজ গোত্রের বেশির ভাগ লোকজন যদিও গোত্রীয় সম্পর্কের চাইতে ধর্মীয় সম্পর্কের কারণে ইসলাম ও মুসলমানদের উপরে চড়াও হবার পক্ষে ছিল, কিন্তু খোদ্ তাদের নিজ গোত্রগুলির মধ্যে এমন লোকজনও অনেকে ছিল যারা নিজেরা মুশরেক হওয়া সত্ত্বেও নিজ গোত্রের কোনো মর্যাদাবান ব্যাক্তির উপরে হাত উঠানোর পক্ষে ছিল না -চাই সে তাদের পূর্বপুরুষদের ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমানই হয়ে যাক না কেনো এবং এজন্য তারা নিজ গোত্রের কোনো মুসলমানকে নির্যাতিত হতে দেখলে তাকে যথাসাধ্য বাঁচানোর চেষ্টা করতো। (২) যে সকল মুসলমান কোনো উচ্চ বংশ বা সম্ভ্রান্ত গোত্রের কেউ ছিল না বরং সাধারণ গোত্র/বংশের কেউ ছিল, সে উচ্চ বংশীয়/গোত্রীয় মুসলমানদের চাইতে তুলনামূলক কিছুটা বেশি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছিল, কারণ উচ্চ গোত্র/বংশের না হওয়ারয় তারা সামাজিক ভাবে তেমন সম্মান মর্যাদা ও গুরুত্বের অধিকারী ছিল না বিধায় উচ্চ বংশীয়/গোত্রীয় মুশরেকদের দ্বারা সে অপমানিত অপদস্ত হলে তেমন সামাজিক সমস্যার কিছু ছিল না। সেখানে নিজ গোত্রের মুশরেকদের দ্বারা কোনো মুসলমান আক্রান্ত হলে কে তাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসবে? যারাও বা গোত্র/বংশের টানে এগিয়ে আসতো, তারা সংখ্যায় এত কম ছিল যে, তারা সেই মুসলমানকে চাইলেও তেমন কোনো উপকার করতে পারতো না। (৩) যেসকল মুসলমানের মক্কায় কোনো পরিবার পরিজন বংশ বা গোত্রের কেউ ছিল না, তারা উপরের দুই স্তরের মুসলমানদের চাইতে অনেক বেশি সমস্যার শিকার হচ্ছিল, কারণ তাদের উপরে জুলুম নির্যাতন করলে যেমন গোত্রে গোত্রে দ্বন্দ্ব সংঘাত বাঁধার কোনো ভয় ছিল না, তেমনি তাদেরকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে আসার মতোও কেউ ছিল না। (৪) এক্ষেত্রে উপরের তিন প্রকারের মক্কাবাসী মুসলমানদের মধ্যে সবচাইতে কঠিন সমস্যা ও দূরাবস্থার শিকার হয় ওই সকল দাস সাদীরা যারা ইসলাম কবুল করার পর কোনো ভাবে সেকথা তার মুশরেক মালিক জেনে ফেলে। কারণ, দাস সাদসীদেরকে সে সময়কার সমাজে সবচাইতে নিচু স্তরের অজাত গণ্য করা হত, বিধায় তাদের মালিকরা তাদের উপরে যত নির্মম নির্যাতনই চালাক না কেনো -কেউ তাদেরকে উদ্ধারে এগিয়ে আসতো না।
যেহেতু, রাসুলুল্লাহ ﷺ তখনকার মক্কার সুউচ্চ কুরায়েশ গোত্রের সম্ভ্রান্ত বনু হাশিম বংশের অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ও গণমান্য ব্যাক্তিত্ব (মৃত) আব্দুল মুত্তালিবের নাতি এবং তার ছেলে আবু তালেব ও হামযার মতো গণ্যমান্য ব্যাক্তির ভাতিজা ছিলেন, তাই মক্কার নেতা ও মোড়লরা প্রথম প্রথম রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর উপরে সরাসরি চড়াও হবার সাহস করেনি, শুধু তাঁর উপরে বিভিন্ন রকমের কষ্টদায়ক হাসি-ঠাট্টা, বিদ্রুত ও গালিগালাজ করেই মনের ঝাল মিটাতো। কিন্তু যখন তারা প্রতিদিনেই এ দৃশ্য দেখছিল যে, মুহাম্মাদ ﷺ তাঁর আনিত দ্বীন ইসলামকে প্রচার প্রসারের কাজ তাদেরই চোখে সামনে প্রকাশ্য ভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন এবং দিনকে দিন মুসলমানদের সংখ্যাও বাড়ছে, যা তাদের পূর্বপুরুষদের ধর্মের ভবিষ্যৎ অস্তিত্বের জন্য প্রকাশ্য হুমকি স্বরূপ, এতদসত্ত্বেও তারা মুহাম্মাদ ﷺ-এর উপরে হাতও তুলতে পারছে না, এটা তাদের মনের জ্বালা আরো বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। ফলে মক্কার বিভিন্ন গোত্রের লোকেরা একে অপরকে উসকে দিতে থাকে যে, এব্যাপারে তড়িৎ কোনো ব্যবস্থা গ্রহন করা হোক, এভাবে আর চলতে দেয়া যায় না। তখন মক্কার নেতৃস্থানীয়রা মিটিং-এ এই সিদ্ধান্ত নেয় যে, তারা সোজা মুহাম্মাদ ﷺ-এর চাচা ও অভিভাবক আবু তালেবের কাছে গোটা মক্কাবাসীর পক্ষ থেকে এব্যাপারে অভিযোগ দায়ের করবে। ফলে তারা একদিন সোজা রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর চাচা ও অভিভাবক আবু তালেব ইবনু আব্দিল মুত্তালিবের কাছে এসে এব্যাপারে জোরালো ভাবে নালিশ জানালো এবং ভাতিজাকে সাবধান করে দিতে বললো। যেমন, মুসা বিন ত্বালহা রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, আক্বীল বিন আবি ত্বালেব রা. বর্ণনা করেন- جَاءَتْ قُرَيْشٌ إِلَى أَبِي طَالِبٍ فَقَالُوا: إِنَّ ابْنَ أَخِيكَ يُؤْذِينَا فِي نَادِينَا، وَفِي مَسْجِدِنَا، فَانْهَهُ عَنْ أَذَانَا، فَقَالَ: يَا عَقِيلُ: ائْتِنِي بِمُحَمَّدٍ، فَذَهَبْتُ فَأَتَيْتُهُ بِهِ، فَقَالَ: يَا ابْنَ أَخِي، إِنَّ بَنِي عَمِّكَ يَزْعُمُونَ أَنَّكَ تُؤْذِيهِمْ فِي نَادِيهِمْ، وَفِي مَسْجِدِهِمْ، فَانْتَهِ عَنْ ذَلِكَ قَالَ: فَحَلَّقَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَصَرَهُ إِلَى السَّمَاءِ فَقَالَ: أَتَرَوْنَ هَذِهِ الشَّمْسَ؟». قَالُوا: نَعَمْ قَالَ: مَا أَنَا بِأَقْدَرَ عَلَى أَنْ أَدَعَ لَكُمْ ذَلِكَ عَلَى أَنْ تَسْتَشْعِلُوا لِي مِنْهَا شُعْلَةً . قَالَ: فَقَالَ أَبُو طَالِبٍ: مَا كَذَبَنَا ابْنُ أَخِي، فَارْجِعُوا . ورواه أبو يعلى في مسنده , مسند عبد الله بن جعفر الهاشمي : ١٢/١٧٦ رقم ٦٨٠٤ و قال حسين سليم أسد: إسناده قوي، و قال الهيثمي في مجمع الزوائد : ٦/١٥ : رواه أبو يعلى باختصار يسير من أوله و رجال أبي يعلى رجال الصحيح، قال ابن حجر في المطالب العالية : ٤/٣٧١ : هذا اسناد حسن، و حسنه الألباني في السلسلة الصحيحة : ١/١٤٧ رقم ٩٢ – “(একদিন মক্কার) কুরায়েশ (নেতৃবর্গ সোজা নবীজী ﷺ-এর চাচা) আবু ত্বালেবের কাছে এসে (নালিশ করে) বললো: ‘আপনার ভাতিজা (মুহাম্মাদ) আমাদের সমাবেশাস্থলে (এসে) আমাদের মসজিদে (হারামে এসে আমাদের উপাস্য দেবদেবীদের মূর্তিগুলোকে শক্তিসামর্থহীন ও নির্জীব বস্তু বলে, আমাদের সমাজের জ্ঞানী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন (সুশীল ও বুদ্ধিজীবী)দেরকে মূর্খ বলে এবং পূর্বপুরুষদের মুর্তি পুজার ধর্ম ত্যাগ করতে বলে) আমাদেরকে (বারংবার) কষ্ট দিচ্ছে। আমাদেরকে (এভাবে) কষ্ট দেয়া থেকে আপনি তাকে নিষেধ করুন’। তখন (আমার পিতা) আবু ত্বালেব (আমাকে) বললেন: ‘হে আক্বীল! (যাও তো) মুহাম্মাদকে (খুঁজে তাকে) আমার কাছে নিয়ে এসো’। ফলে আমি গিয়ে তাঁকে ওনার কাছে নিয়ে এলাম। তখন তিনি (রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে) বললেন: ‘হে ভাতিজা! তোমার চাচার (এই) স্বজাতি লোকেরা (তোমার ব্যাপারে) নালিশ করছে যে, তুমি নাকি তাদের সমাবেশাস্থলে (গিয়ে) তাদের মসজিদে (হারামে গিয়ে তাদের হাজার বছরের পরম্পরায় মান্য করে আসা উপাস্য দেবদেবীদের মূর্তিগুলোকে শক্তিসামর্থহীন নির্জীব বস্তু বলে এবং পূর্বপুরুষদের মুর্তি পুজার ধর্ম ত্যাগ করতে বলে) তাদেরকে কষ্ট দিচ্ছো?! (এদের কথা সত্য হলে) তুমি তা থেকে বিরত থাকো, (সমাজে কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করো না)’। তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ তাঁর দৃষ্টি আসমানের দিকে করে বললেন: ‘আপনারা কি এই সূর্যটিকে দেখতে পাচ্ছেন’? তারা বললো: ‘হ্যাঁ (অবশ্যই দেখতে পাচ্ছি, তাতে কী হয়েছে?)’। রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন; ‘আমি আপনাদেরকে যার দিকে আহবান করছি, আপনারা যদি তার বিনিময়ে ও(ই সূর্য)টা থেকে আমার জন্য কোনো শিখাও প্রজ্বলিত করে নিয়ে আসতে চান, তবুও আমার (পক্ষে এই নবুওতী দায়িত্ব পালন করা থেকে) পিছু-পা হওয়া সম্ভব নয়’। তখন আবু ত্বালেব ললেন: ‘আমার ভাতিজা মিথ্যা কথা বলে না, (সুতরাং বাস্তবেও সে তার কাজ থেকে পিছু-পা হবে না)। কাজেই তোমরা চলে যাও”। [মুসনাদে আবু ইয়া’লা- ১২/১৭৬ হাদিস ৬৮০৪; মুসনাদে বাযযার- ৬/১১২ হাদিস ২১৭০; তারিখুল কাবীর, ইমাম বুখারী- ৭/৫১; আল মু’জামুল কাবীর- ইমাম ত্বাবরাণী- ৭/৯২; মুসতাদরাকে হাকিম- ৩/৫৭৭; মাজমাউয যাওয়ায়ীদ, হাইছামী- ৬/১৫; তারিখে দিমাশক, ইবনু আসাকীর– ৪১/৪]
আবু তালেব তার ভাতিজা মুহাম্মাদকে কিছু না বলে উল্টো তাদের মতো নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তিদেরকে চলে যেতে বলায় তারা পরিষ্কার বুঝতে পারছিল যে, তিনি বাপদাদা পূর্বপুরুষদের ধর্মকে রক্ষা করার পক্ষে নন, বরং উল্টো তার ভাতিজা মুহাম্মাদের প্রতি নমনীয়তা প্রদর্শন করছেন। তারা যখন দেখলো যে, এ পদক্ষেপেও কাজ হল না, এদিকে মুহাম্মাদও তার নতুন ধর্মের প্রচার প্রসার অব্যাহত রেখেছে, যার কারণে দিন-কে-দিন মুসলমানদের সংখ্যা বেড়েই চলছে, তখন আবারো মক্কার বিভিন্ন গোত্রের লোকেরা একে অপরকে উসকে দিতে লাগলো, যে কোনো মূল্যে মুহাম্মাদ ﷺ কে তার মিশন সহ থামানোর জন্য। ফলে মক্কার নেতুস্থানীয়রা আবারো এক মিটিং-এ সিদ্ধান্ত নিলো যে, তারা আবারো আবু তালেবের কাছে একই অভিযোগ নিয়ে যাবে, যাতে তার মাধ্যমেই বিষয়টির রফাদফা করা যায়। এমর্মে তারা দ্বিতীয়বারের মতো আবু তালেবের সাথে সাক্ষাত করে তার ভাতিজা মুহাম্মাদ ﷺ-এর বিরুদ্ধে একই অভিযোগ তুললো এবং তাঁকে থামানোর জন্য জোর তাগিদ দিলো। কিন্তু সেবারও তারা লক্ষ্য করলো যে, আবু তালেবকে বাপদাদা পূর্বপুরুষদের ধর্মের রক্ষা না করে উল্টো তার ভাতিজা মুহাম্মাদের প্রতি নমনীয়তা প্রদর্শন করছেন। অন্য কথায় উম্মী (নিরক্ষর) ভাতিজা মুহাম্মাদের সামনে তাদের মতো মক্কার নামিদামী গোত্র ও উচ্চ বংশের নেতৃবর্গের কথার মূল্য রাখা হচ্ছে না। আর কার্যতই এমন আচরণ মক্কার নেতৃবর্গের কাছে অসম্মানজনক ও অসহ্যকর ঠেঁকলো। তারা ফিরে যাবার আগে আবু তালেবকে বলে গেল: ‘يَا أَبَا طَالِبٍ إِنَّ لَكَ سِنًّا وَشَرَفًا وَمَنْزِلَةً فِينَا وَإِنَّا قَدِ اسْتَنْهَيْنَاكَ مِنَ ابْنِ أَخِيكَ فَلَمْ تَنْهَهُ عَنَّا، وَإِنَّا وَاللَّهِ لَا نَصْبِرُ عَلَى هَذَا مِنْ شَتْمِ آبَائِنَا، وَتَسْفِيهِ أَحْلَامِنَا، وَعَيْبِ آلِهَتِنَا حَتَّى تَكُفَّهُ عَنَّا أَوْ نُنَازِلَهُ وَإِيَّاكَ فِي ذَلِكَ حَتَّى يَهْلِكَ أَحَدُ الْفَرِيقَيْنِ- أَوْ كَمَا قَالُوا – “হে আবু তালেব! আপনি আমাদের মধ্যে একজন মুরুব্বী, সম্ভ্রান্ত ও গণ্যমান্য ব্যাক্তিত্ব। আমরা (এর আগেও একদিন) আপনার ভাতিজাকে বারন করার জন্য আপনাকে বলে গিয়েছিলাম, কিন্তু (দেখছি) আপনি তাকে আমাদের ব্যাপারে (তার ওসব সমালোচনা করা থেকে) নিষেধ করেননি। আল্লাহ’র কসম, আমরা কিন্তু আমাদের বাপদাদা পূর্বপুরুষদের এধরনের সমালোচনা করা, আমাদের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন (সুশীল ও বুদ্ধিজীবী) দেরকে হেয় করা এবং আমাদের উপাস্যদের দোষত্রুটি বলে বেড়ানোকে (কোনো অবস্থাতেই) সহ্য করবো না। এখন সিদ্ধান্ত হোক, হয় সে আমাদের (দেবদেবী, ধর্ম ও জ্ঞানীদের সমালোচনা) থেকে বিরত থাকে, অন্যথায় আমরা এর জন্য তার সাথে সাথে আপনার উপরোও চড়াও হবো -যাবৎ না দু পক্ষের কোনো এক পক্ষ নি:শ্বেস হয়ে যায়। … অথবা তারা এরকম কিছু বলেছিল”। এটা বাস্তবেই মক্কার নেতৃবর্গের পক্ষ থেকে আবু তালেবের জন্য ছিল একটি মস্তবড় থ্রেট (হুমকি ধমকী)। এই থ্রেটের অর্থ কী -আবু তালেব মক্কার রাজনৈতিক মুরুব্বি ও নেতৃবর্গের একজন হওয়ার সুবাদে সেটা তিনি ভালো করেই বুঝতে পারলেন যে, এবার মক্কার নেতৃবর্গ ভাতিজা মুহাম্মাদ ﷺ-এর উপরে চুড়ান্ত পর্যায়ে ক্ষেপে ওঠার দিকে যাচ্ছে এবং এরপরও ভাতিজা বিরত না হলে তারা নিজেদের পূর্বপুরুষদের ধর্ম সংরক্ষনকে অগে প্রাধান্য দিবে, তারপর বংশ গোত্র বা আত্বীয়তা। এজন্য আবু তালেব রাসুলুল্লাহ ﷺকে ডেকে বললেন- يا بن أخي ان القوم جاؤوني فقالوا كذا وكذا للذي قالوا له واذنوني قبل الحرب فأبق علي وعلى نفسك ولا تحملني من الأمر ما لا أطيق أنا ولا أنت واكفف عن قومك ما يكرهون من قولك هذا الذي فرق بيننا وبينهم – “হে ভাতিজা! লোকজন (আজও) আমার কাছে (পূণরায় একই অভিযোগ নিয়ে) এসেছিল। তারা যার ব্যাপারে বলার তাকে এইসব বলে গেল। আমি তো যুদ্ধের পূর্বভাস উপলব্ধি করতে পারছি। কাজেই তুমি আমার এবং তোমার নিজের উপরে দয়া করো। (ভাতিজা) তুমি আমার উপরে এমন কোনো কিছুর বোঝা চাপিয়ে দিওনা, যা না আমি বহন করতে পারবো, আর না পারবে তুমি। তোমার জাতীর লোকেরা তোমার যেসব কথাবার্তা অপছন্দ করছে, যা আমাদের ও তাদের মাঝে ফাটল সৃষ্টি করছে, তুমি তাদের (সামনে তা পেশ করা) থেকে বিরত থাকো”। রাসুলুল্লাহ ﷺ চাচার এমন কথায় পরিষ্কার বুঝতে পারলেন, এখন যদি মক্কার নেতৃবর্গ তাঁর বিরুদ্ধে চড়াও হতে চায়, তাহলে তাঁকে ওদের হাত থেকে বাঁচানোর মতো শক্তি আর তার চাচা আবু তালেবের অবশিষ্ট নেই প্রায়। রাসুলুল্লাহ ﷺ চাচা আবু তালেবকে বললেন- يا عَمِّ لَوْ وُضِعَتِ الشَّمْسُ فِي يَمِينِي وَ الْقَمَرُ فِي يَسَارِي مَا تَرَكْتُ هَذَا الْأَمْرَ حَتَّى يُظْهِرَهُ اللَّهُ أَوْ أَهْلِكَ فِي طَلَبِهِ – “হে চাচা! আপনি যদি আমার ডান হাতে সূর্যকে আর আমার বাম হাতে চাঁদকেও এনে দেন, তবুও আমি একাজ ত্যাগ করবো না, (কারণ এটা বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহ’র আদেশ)। শেষ পর্যন্ত -হয় আল্লাহ এই দ্বীনকে বিজয়ী করবেন, না হয় আমি তাঁর (এ) পথে নি:শেষ হয়ে যাবো”। আবু তালেব বুঝতে পারলেন, ভাতিজা তাঁর মিশনে অনঢ় থাকবে -চাই তাঁর উপর দিয়ে যত বিশাল বিপদই অতিবাহিত হয়ে যাক না কেনো, তখন তিনি রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে বললেন- امض على أمرك وافعل ما أحببت، فو الله لا نسلمك بشيء أبداً – “(ঠিক আছে ভাতিজা)! তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করে যেতে থাকো এবং তুমি যেটা ভালো মনে করো তাই করো। আল্লাহ’র কসম, আমরা (বনু হাশেম) আজীবন তোমাকে (সাধ্য মতো) রক্ষা করে যাবো”। [সিরাতুন নাববীয়্যাহ, ইমাম ইবনু ইসহাক- ২/১৩৫; সিরাতুন নাববীয়্যাহ, ইবনে হিশাম- ১/২৬৬; আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ইবনে কাসির- ৩/৬৩; রাউযুল উনফ- ৩/৪৬]
বস্তুত: রাসুলুল্লাহ ﷺ ও চাচা আবু তালেবের এই সিদ্ধান্তের অর্থ ছিল, মক্কার মুশরেকদের সাথে দ্বন্দ্বে জড়ানোর চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহন করে নেয়া -চাই এজন্য মুশরেকদের পক্ষ থেকে দেয়া যত রকমের সমস্যা, বিপদ আপদ ও মুসিবতের মুখামুখী হতে হোক না কেনো। কিন্তু মুশরেক নেতৃবর্গ আবু তালেবকে তো থ্রেট দিয়ে গেল বটে, কিন্তু আবু তালেব সে সময় মক্কায় গোত্রীয় ও বংশগত উভয় দিক থেকে যে উচ্চ মর্যাদায় সমাসীন ছিলেন, তাতে ততক্ষনাৎ তার সাথে দ্বন্দ্বে মুখোমুখী অবস্থান নেয়ার মতো অবস্থা মুশরেক নেতৃবের্গের ছিল না। ফলে তারা আরেকটি মিটিং-এ নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে তৃতীয়বারের মতো আবারো আবু তালেবের সাথে সাক্ষাত করতে এলো এবং আরোজ করলো যে, তিনি যেন উমারা ইবনু ওয়াহীদ নামের মক্কার সুন্দর সুঠাম ও বুদ্ধিমান যুবকটি প্রতিপালনের জন্য সাথে রাখেন এবং তার পরিবর্তে তাদের সমাজে বিভেদ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী তার ভাতিজা মুহাম্মাদ ﷺ-কে তাদের হাতে তুলে দেন। এই আবেদন শুনে আবু তালেব রেগে গেলেন এবং বললেন- وَاللَّهِ لَبِئْسَ مَا تَسُومُونَنِي ، أَتُعْطُونَنِي ابْنَكُمْ أَغْذُوهُ لَكُمْ ، وَأُعْطِيكُمُ ابْنِي تَقْتُلُونَهُ ؟ هَذَا وَاللَّهِ مَا لا يَكُونُ أَبَدًا – “আল্লাহ’র কসম, তোমরা কত নিকৃষ্ট ধরনের আবেদন করছো আমার কাছে ! আমার কাছে দেয়া হবে তোমাদের ছেলেকে যাকে আমি তোমাদের জন্য লালনপালন করবো, আর আমি আমার (কওম ও নিজ বংশের) ছেলেকে (আমার নিজ সোনার টুকরা ভাতিজাকে) তোমাদের হাতে তুলে দিবো যাতে তোমরা তাকে খুন করে ফেলো! আল্লাহ’র কসম, (আমি বেঁচে থাকতে) এটা কোনোদিন হতে পারে না”। একথা শুনে কুরায়েশ নেতৃবর্গের মধ্যে মুতঈম বিন আদী বিন নাওফিল বিন আব্দে মানাফ বলে উঠলো: وَاللَّهِ يَا أَبَا طَالِبٍ لَقَدِ أَنْصَفَكَ قَوْمُكَ ، وَجَهِدُوا عَلَى التَّخَلُّصِ مِمَّا تَكْرَهُهُ ، فَمَا أَرَاكَ تُرِيدُ أَنْ تَقْبَلَ مِنْهُمْ شَيْئًا – “আল্লাহ’র কসম, হে আবু তালেব, (এই আবেদনের মাধ্যমে) আপনার জাতি আপনার সাথে ইনসাফেরই পরিচয় দিয়েছে; বস্তুত: তারা যা অপছন্দ করছে তা থেকে মুক্তির একটা পথ করার জন্য তারা চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু আমি দেখছি, আপনি তাদের থেকে কোনো কিছুই গ্রহন করতে চাইছেন না”। শুনে আবু তালেব রেগে গেলেন এবং বললেন- وَاللَّهِ مَا أَنْصَفُونِي ، وَلَكِنَّكَ قَدْ أَجْمَعْتَ خِذْلَانِي وَمُظَاهَرَةِ الْقَوْمِ عَلَيَّ ، فَاصْنَعْ مَا بَدَا لَكَ ، أَوْ كَمَا – “আল্লাহ’র কসম, তারা আমার সাথে (মোটেও) ইনসাফ করেনি। বরং তুমি আমাকে পরিত্যাগের (যতরকম পন্থা হয় তা সব) জড়ো করেছো এবং (আমার) কওমকে আমার বিরুদ্ধে ফুঁসলে দিয়েছো। (ঠিক আছে) তুমি তোমার যা করতে পারো করো… (অথবা এরকমই কিছু বলেছেন)”। আবু তালেবের এধরনের কথা শুনে তারা সেবারও নিরাশ হয়ে ফিরে গেল। [তারিখুল উমাম ওয়াল মুলুক, ইমাম তাবারী- ১/৫৪৫; তারিখে ইবনে হিশাম- ১/২৬৭; আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ইবনে কাসির- ৩/৬৩]
>>> মূল সূচিপত্র (index) থেকে এ পেজের পূর্ববর্তী বা পরবর্তী আলোচনা পড়তে [এখানে ক্লিক করুন]