খলিফা মনোনয়ন ও নির্বাচন পন্থা : ইসলামী শরীয়ত vs ধর্মনিরপেক্ষতা

রাষ্ট্রপ্রধান/ইমাম/আমীর/ খলিফা মনোনয়ন ও নির্বাচন পন্থা : ইসলামী শরীয়ত vs ধর্মনিরপেক্ষতা’র কুফর ও পথভ্রষ্ঠতা 


>>> মূল সূচিপত্র (index) থেকে এ পেজের পূর্ববর্তী বা পরবর্তী আলোচনা পড়তে [এখানে ক্লিক করুন] 


পূর্বের আলোচনার পরের অংশ নিম্নরূপ>>>

 

আমাদের ইতিপূর্বে উল্লেখীত ধর্মনিরপেক্ষতা’র  ১ নং বৈশিষ্ট অনুযায়ী যেহেতেু— “রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে ধর্মকে ১০০% আলাদা রাখায় বিশ্বাস করা ধর্মনিরপেক্ষতা’র সর্ব প্রধান শর্ত ও ভিত্তিযেটাকে তারা বলে থাকে Separation of religion and state(ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে বিভাজন)”, তাই একটি দেশকে  Secular State (ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র) বানানোর  ক্রমধারায় রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ (Executive Division) -এর নির্বাহী প্রধান/রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন ও মননয়নের ক্ষেত্রে কী কী পন্থা বৈধ বা অবৈধ বিবেচিত হবে -তা নির্ধারনের বিধান থেকেও ধর্মকে ১০০% ছেটে ফেলে দেয়ায় বিশ্বাস করা অবশ্যই ধর্মনিরপেক্ষতা’র প্রধান শর্তের অংশ। 
 
সেখানে আমরা বিষয়টিকে খোলাসা করতে গিয়ে এভাবে উল্লেখ করেছিলাম—–“(খ) রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ (Executive Division) -এর নির্বাহী প্রধান/রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন ও মননয়নের ক্ষেত্রে কী কী পন্থা বৈধ বা অবৈধ বিবেচিত হবে -তার নির্ধারনের ক্ষেত্রে যে কোনো ধর্মীয় বিধিবিধানকে ১০০% দূরে রাখা অত্যাবশ্যক শর্ত (ফরযে আইন)।ন্যকথায়, ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী খলিফা/রাষ্ট্রপ্রধান মনোনয়ন ও নির্বাচন করার সকল জায়েয পন্থাকে ১০০% প্রত্যাক্ষান করা, অস্বীকার করা  ধর্মনিরপেক্ষতা’র অন্যতম প্রধান শর্তের অন্তর্ভূক্ত
 
এবারে আমারা বিস্তারিত আলোচনা করবো, রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ (Executive Division) -এর নির্বাহী প্রধান/রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন ও মননয়নের ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ইসলামী শরীয়তের কোন্ কোন্ পন্থাকে বৈধতা দিতে মানতে নাক ছিটকায়। তবে তার আগে আমরা সংক্ষেপে দেখে বিনো, একটি ইসলামী রাষ্ট্রে কোন কোন পন্থায় মনোনিত ও নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান (খলিফা/আমীর/ইমাম)কে একজন “বৈধ রাষ্ট্রপ্রধান (খলিফা/আমীর/ইমাম)” হিসেবে মানতে মুসলমানদের উপরে শরীয়ত অপরিহার্য করে দিয়েছে। 

ইসলামী রাষ্ট্রের খলিফা এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান -এর মনোনয়ন ও নির্বাচন পন্থা ভিন্ন ভিন্ন; পরষ্পর বিরোধী

আমরা আগেই বলে এসেছি, যে কোনো কারখানার মালিকমাত্রই তার কারখানার সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বভার এমন এমন প্রতিনিধিদের উপর চাপিয়ে দেয়াকে ঝুঁকিমুক্ত মনে করবেন, যারা তার কারখানা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য, পরিকল্পনা ও কারখানার বিধিমালার সাথে আন্তরিকবাবে একাত্বতা পোষন করে, পূর্ণ বিশ্বাস রাখে এবং সেই অনুযায়ী কারখানা চালাতে বদ্ধপরিকর, যাদের উপর এ ব্যপারে আস্থা রাখা যায় এবং যারা এর উপযুক্ত। অর্থাৎ, কারখানার মালিকের মনকামনা থাকে যে, কারখানার একেবারে মহাপরিচালক/মহাব্যবস্থাপক থেকে নিয়ে একদম নিম্ন স্তরের কর্মচারীরা পর্যন্ত সকলে তার লোক হোক; তার বিরুদ্ধের কেউ বা কোনো মির্জাফর কেউ না হোক।

এটি এমন একটি স্বাভাবিক মূলনীতি যে, জ্ঞতে-অজ্ঞতে এই মূলনীতির আলোকেই পৃথিবীর প্রতিটি রাষ্ট্র পরিচালিত হয় – ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র সহ। কোন্ দলটা চায় যে তাদের দলপ্রধান বিরোধীদলীয় লোকদের দ্বারা মনোনীত হোক !!! এজন্যেই চায় না, কারণ তারা ভাল করেই জানে, দলের লক্ষ্য, বিশ্বাস ও চেতনার বিরোধীদের উপর দলপ্রধান মনোনায়নের দায়িত্বভার চাপিয়ে দিলে তারা এমন দলপ্রধানকে মনোনায়ন দিবে, যে বিরোধীদলীয় চেতনার পক্ষের লোক কিংবা কমপক্ষে তাদের পক্ষে কাজ করবে এবং সুযোগ বুঝে দলের মধ্যে ভাঙ্গন সৃষ্টির পায়তারায় লেগে থাকবে এবং একসময় নিজেদের লক্ষ্য, বিশ্বাস ও চেতনাই প্রতিষ্ঠা করে ফেলবে। ফলে দলটি একসময় হবে মূলতঃ বিরোধী দলের রঙে রঙিন।

মানুষের স্রষ্টা ভাল করেই জানেন, মানুষের খাসলত কী। বস্তুতঃ আল্লাহ তাআলা إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً‘নিশ্চই আমি পৃথিবীতে (আমার) খলিফা (প্রতিনিধি) সৃষ্টি করবো’[সূরা বাকারাহ ৩০] -এই আয়াতের মধ্যে পৃথিবী ও মানুষ সৃষ্টির পিছনে তাঁর যে মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের দিকে তিনি ইশারা করেছেন, তা সাফল্যমন্ডিত করার প্রশ্নে তাঁর হুকুমের কাছে আত্বসমর্পনণকারী বান্দা (মুসলমান)রা ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। দ্বীন ইসলামে মুসলমানরাই মুসলমানদের খলিফা/আমীর (রাষ্ট্রপ্রধান) নির্বাচন করবে মনোনয়ন দিবে। মুসলমানদের দ্বীনী বিষয়াদিতে খবরদারী করার সামান্যতম কোনো পথ আল্লাহ তাআলা তাঁর বিরোধীদল কাফের/মুরতাদদের জন্য খোলা রাখেন নি।

وَلَنْ يَجْعَلَ اللَّهُ لِلْكَافِرِينَ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ سَبِيلا
“আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের উপর (অভিভাবকত্ব ও খবরদারী করার) কোনো পথই কাফেরদের জন্য খোলা রাখেননি”। [সূরা নিসা ১৪৪]

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ مِن دُونِ الْمُؤْمِنِينَ ۚ أَتُرِيدُونَ أَن تَجْعَلُوا لِلَّهِ عَلَيْكُمْ سُلْطَانًا مُّبِينًا
হে ইমানদারগণ! তোমরা মুমিনদেরকে বাদ দিয়ে কাফেরদেরকে (তোমাদের) ওলী (অভিভাবক ও বন্ধু) হিসেবে গ্রহন করে নিবে না। তোমরা কি (কাফেরদেরকে নিজেদের অভিভাবক ও বন্ধ বানিয়ে নিয়ে) আল্লাহ’র কাছে তোমাদের নিজেদের বিরুদ্ধেই একথার সুস্পষ্ট দলিল দাঁড় করিয়ে দিতে চাও (যে, তোমরা আল্লাহর প্রতিনিধি হয়ে আল্লাহর মিশন কায়েম করার পরিবর্তে আল্লাদ্রোহিদের প্রতিনিধি হয়ে তাদের মিশন কায়েম করার বিষয়টিকে গ্রহন করে নিয়েছো)? [সূরা নিসা ১৪৪]

 يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا بِطَانَةً مِنْ دُونِكُمْ لَا يَأْلُونَكُمْ خَبَالًا وَدُّوا مَا عَنِتُّمْ قَدْ بَدَتِ الْبَغْضَاءُ مِنْ أَفْوَاهِهِمْ وَمَا تُخْفِي صُدُورُهُمْ أَكْبَرُ قَدْ بَيَّنَّا لَكُمُ الْآيَاتِ إِنْ كُنْتُمْ تَعْقِلُونَ
“হে ইমানদারগণ, তোমরা তোমাদের নিজেদের (মুসলমান) লোকদের ছাড়া অন্য(অমুসলীম) কাউকে তোমাদের অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে গ্রহন করে নিও না। তারা তোমাদের অনিষ্ট সাধনে কোনো সুযোগ হাতছাড়া করে না। তারা কামনা করে যাতে তোমরা সমস্যায় পড়ে যাও। তাদের মুখ থেকেই (তোমাদের প্রতি) তাদের বিদ্বেষ প্রকাশ হয়ে পড়েছে। আর তাদের মনগুলোর ভিতরে (তোমাদের অনিষ্ট সাধনের জন্য) যা লুকিয়ে রয়েছে তা আরো মারাত্মক। বস্তুতঃ আমি আমার আয়াতসমূহকে তোমাদের জন্য সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করে দিচ্ছি যাতে তোমাদের বিবেককে কাজে লাগাতে পারো” [সুরা আল-ইমরান ১১৮]

যারা আল্লাহ তাআলার প্রতিনিধি হওয়াকেই স্বীকার করে না, উল্টো শয়তান ও পথভ্রষ্ঠ নেতা ও মোড়লদের নীতি আদর্শ ও আইনকানুনকে দুনিয়ার বুকে দেখতে চায় এবং মুখ, হাত ও বিবেক-বুদ্ধির জোরে যখন যেভাবে সম্ভব হয় পদে পদে বাঁধা সৃষ্টি করতে বুক কাঁপে না, তারা কি শয়তান ও পথভ্রষ্ঠ নেতা ও মোড়লদের প্রতিনিধি (খলিফা) নয়? তারা কি আল্লাহর প্রতিনিধি (খলিফা) যে তিনি তাদের হাতে মুসলমানদের খলিফা/রাষ্ট্রপ্রধান কে হবে -তা ঠিক করার ভার দিবেন?!!! পাগল হয়েছেন? নাকি আল্লাহকে পাগল ও মুর্খ ভেবেছেন? এজন্য যে ব্যাক্তিই শরীয়তের দৃষ্টিতে ‘মুসলীম’ বলে গণ্য নয়, তথা কাফের বা মুরতাদ হিসেবে গণ্য, সে আল্লাহর দ্বীনের হেফাজতকারী খলিফা/আমীর (রাষ্ট্রপ্রধান) নির্বাচন ও মনোনয়ন দানকার্যে মত প্রকাশে অংশগ্রহনের সামান্যতম অধিকার রাখে না; সে একাজের সম্পূর্ণ অযোগ্য।

আয়েশা রা. থেকে সহিহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ (তাঁর মুমূর্ষ অবস্থায়) আয়েশা রা.-কে বললেন: ادْعِي لِي أَبَا بَكْرٍ وَأَخَاكِ حَتَّى أَكْتُبَ كِتَابًا فَإِنِّي أَخَافُ أَنْ يَتَمَنَّى مُتَمَنٍّ وَيَقُولَ قَائِلٌ أَنَا أَوْلَى ‏.‏ وَيَأْبَى اللَّهُ وَالْمُؤْمِنُونَ إِلاَّ أَبَا بَكْرٍ ‏. رواه مسلم في صحيحه , كتاب فضائل الصحابة رضى الله تعالى عنهم , باب من فضائل أبى بكر الصديق : ٤/٨٥٧ رقم ٢٣٨٧ – “(হে আয়েশা!) তোমার পিতা আবু বকর এবং তোমার ভাই (আব্দুর রহমান)-কে আমার কাছে ডেকে আনো যাতে আমি একটি বিষয় লিখে দিতে পারি। আমার ভয় হচ্ছে, (এ পদের) কোনো আকাঙ্খি আবার আকাঙ্খা করে বসে নাকি এবং যে কথা তোলার সে আবার এই কথা তোলে নাকি- ‘আমি (এ পদের) সবচাইতে যোগ্য’। (কিন্তু যে যাই বলুক, যাই করুক না কেনো) আল্লাহ -আবু বকরকে ছাড়া (অন্য কাউকে) গ্রহন করবে না, মুমিনরাও না”। [সহিহ মুসলিম– ৪/৮৫৭ হাদিস ২৩৮৭; সহিহ বুখারী, হাদিস ৫৩৪২; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস ২৪৭৯৫; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদিস ৬৫৯৮; সুনানুল কুবরা, নাসায়ী-৪/২৫৩; সুনানে বাইহাকী-৮/১৫৩; মুসতাদরাকে হাকীম-৩/৫৪২; ত্ববাকাতে ইবনে সা’দ-৩/১৮০]

এই হাদিসে ‘খলিফা’ নির্বাচনের বিষয়টিকে ইমানদারগণের চাওয়া না-চাওয়ার উপর সীমাবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। কাফের’রা কাকে ‘খলিফা’ দেখতে চায় বা না-চায় সেটা বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপযোগ্য বিষয় নয়। খিলাফত মুসলমানদের; তাই মুসলমানরাই তাদের খলিফা নির্বাচন করবে।

সুতরাং, মুসলীম সমাজের উপর ফরয হল, তারা মুসলমানরা মিলেই তাদের রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় অভিভাবক, ‘আমিরুল মুমিনীন’, খলিফা/আমীর বা রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন ও মনোনয়ন করবে। এই হক্ব শুধুমাত্র এবং কেবলমাত্র মুসলমানদের; মুসলমানরাই এর আহাল (উপযুক্ত ব্যাক্তি)। আর আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন– إِنَّ اللهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا – “নিশ্চই আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন, তোমরা আমানতগুলিকে তার (স্ব-স্ব) উপযুক্ত ব্যাক্তির কাছে সোপর্দ করে দিবে” [সুরা নিসা ৫৮]

এর বিপরীতে যে ব্যাক্তি খলিফা/আমীর (রাষ্ট্রপ্রধান) নির্বাচনের এই অধিকারকে মুসলমানদের হাত থেকে নিয়ে কোনো কাফের মুরতাদদের হাতে সোপর্দ করবে, সে হবে এই আমানতের এমন এক খিয়ানতকারী যে আল্লাহ তাআলার সাথে, তাঁর রাসুল ﷺ-এর সাথে এবং মুসলমানদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা (মিরজাফরী) করেছে।

ইসলামী শরীয়তের এই মাসআলার বিপরীতে-

(ক) ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে যেহেতু রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে ধর্মীয় বিধানকে ১০০% মুক্ত করায় বিশ্বাস (ইমান) রাখা অত্যাবশ্যক (ফরয) শর্ত, তাই রাষ্ট্রপ্রধান নিয়োগ দানের ক্ষেত্রেও ইসলামী শরীয়তের ‘শুধুমাত্র মুসলমানরাই মুসলমানদের খলীফা/আমীর নির্বাচন ও মনোনয়ন করবে’ মর্মে শর্তটিকে রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে ১০০% মুক্ত করায় বিশ্বাস (ইমান) রাখা তাদের মতে অত্যাবশ্যক (ফরয)

(খ) ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে যেহেতু রাষ্ট্রযন্ত্রে কোনো ধর্মীয় বিধিবিধানকে টেনে আনা ১০০% নিষিদ্ধ (হারাম), তাই রাষ্ট্রপ্রধান নিয়োগ দানের ক্ষেত্রেও ইসলামী শরীয়তের ‘শুধুমাত্র মুসলমানরাই মুসলমানদের খলীফা/আমীর নির্বাচন ও মনোনয়ন করবে’ মর্মে শর্তটিকে রাষ্ট্রযন্ত্রে টেনে আনাও তাদের মতে ১০০% নিষিদ্ধ (হারাম)

(গ) ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ যেহেতু বিশ্বাস করে- যে ব্যাক্তি ধর্মীয় বিধিবিধানকে রাষ্ট্রব্যাবস্থায় টেনে আনায় বিশ্বাসী সে আদপে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদেই বিশ্বাসী নয় বরং অস্বীকারকারী (কাফের), তাই যে ব্যাক্তি রাষ্ট্রপ্রধান নিয়োগ দানের ক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়তের ‘শুধুমাত্র মুসলমানরাই মুসলমানদের খলীফা/আমীর নির্বাচন ও মনোনয়ন করবে’ মর্মে শর্তটিকে রাষ্ট্রযন্ত্রে টেনে আনায় বিশ্বাসী, তাদের মতে সেও আদপে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে বিশ্বাসীই নয় বরং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে অস্বীকারকারী (কাফের)

(ঘ) উপরোক্ত এই ৩টি পয়েন্টের এব্যাপারে খাঁটি ধর্মনিরপেক্ষতা বাদীদেরর ঐক্যমত (ইজমা) রয়েছে।

খলিফা মনোনায়ন ও নির্বাচনের শরয়ী পদ্ধতি

যখন কোনো মুসলমান অন্য কোনো মুসলমানকে ‘খলিফা/আমীর’ করা যেতে পারে মর্মে মত প্রকাশ করে -(চাই তা মৌখিক ভাবেই প্রকাশ করুক বা লিখিতভাবে কিংবা বর্তমান যুগের ভোট সিষ্টেমের মাধ্যমেই করুক), তখন আসলে সে এই সাক্ষ্য দেয় ও সুপারিশ করে যে, ‘অমুক মুসলমান আমার মতে খলিফা হওয়ার যোগ্য, তাকে খলিফা হিসেবে নিয়োগ দান করা হোক’। সুতরাং, কেউ যদি (শরয়ী ওজর ছাড়া) খলিফা হওয়ার উপযুক্ত মুসলমানকে বাদ দিয়ে কোনো অযোগ্য মুসলমানকে খলিফা (রাষ্ট্রপ্রধান) বানানোর স্বপক্ষে মত প্রকাশ করে, তাখন সে মূলতঃ ওই অযোগ্য ব্যাক্তির স্বপক্ষে এই মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় ও সুপারিশ করে যে, ‘অমুক আমার মতে খলিফা (রাষ্ট্রপ্রধান) হওয়ার যোগ্য এবং তাকে খলিফা হিসেবে নিয়োগ দান করা হোক’। আর আল্লাহ তাআলা সত্য সাক্ষ্য দেওয়াকে ফরয করেছেন এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়াকে হারাম করে দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন– مَّن يَشْفَعْ شَفَاعَةً حَسَنَةً يَكُن لَّهُ نَصِيبٌ مِّنْهَا ۖ وَمَن يَشْفَعْ شَفَاعَةً سَيِّئَةً يَكُن لَّهُ كِفْلٌ مِّنْهَا ۗ وَكَانَ اللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ مُّقِيتًا – “যে ব্যাক্তি কোনো হাসান (ভাল) ব্যাপারে সুপারিশ করবে, তার জন্য তা থেকে (সওয়াবের) একটা অংশ রয়েছে। আর যে ব্যাক্তি কোনো সাইয়্যেয়াত (মন্দ ও গোনাহ’র) ব্যাপারে সুপারিশ করবে, তার জন্য তা থেকে (গোনাহ’র) একটা অংশ রয়েছে” [সুরা নিসা ৮৫]

সুতরাং, ‘আমার মতে অমুককে খলীফা/আমীর করা যায়’ মর্মে মত প্রকাশ করা কোনো মতেই ছেলে খেলা নয়, বরং এটা একটা আমানত। কাজেই এই আমানতের যাতে খেয়ানত না হয়ে যায়, সেজন্য যে ব্যাক্তি ‘মত’ প্রকাশ করবে, তার জন্য-

(১) দ্বীন ইসলামের ‘খলিফা ও খিলাফত ব্যবস্থা’ বিষয়ক পর্যাপ্ত ও পোক্ত ইলমের অধিকারী হওয়া একান্ত অপরিহার্য।

(২) আনুসঙ্গিক পার্থিব রাজনৈতিক অবস্থা ও তার গতিবিধি সম্পর্কে বিজ্ঞতা ও পারদর্শিতা থাকাও অপরিহার্য।

এখন প্রশ্ন হল, মুসলমানদের দ্বারা খলিফা মনোনয়ন ও নির্বাচনের শরয়ী পন্থা কী? বস্তুত: এর ইশারা খোদ্ রাসুলুল্লাহ ﷺ বলে বা দেখিয়ে দিয়ে গেছেন, যা বিভিন্ন হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। নিম্নে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হচ্ছে।

(১) কেউ নিজেই খলিফা হওয়ার কামনা করে নিজের পক্ষে প্রস্তাব রাখবে না

হাসান রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, আব্দুর রহমান বিন ছামুরাহ রা. বলেন- قَالَ لِي النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يَا عَبْدَ الرَّحْمَنِ بْنَ سَمُرَةَ ، لاَ تَسْأَلِ الإِمَارَةَ ، فَإِنَّكَ إِنْ أُعْطِيتَهَا عَنْ مَسْأَلَةٍ وُكِلْتَ إِلَيْهَا ، وَإِنْ أُعْطِيتَهَا عَنْ غَيْرِ مَسْأَلَةٍ أُعِنْتَ عَلَيْهَا  . رواه البخاري في صحيحه , كتاب الأحكام , باب من لم يسأل الإمارة أعانه الله عليها : ٩/٦٣ رقم ٧١٤٦ – “(একদিন) নবী ﷺ আমাকে বললেন: ‘হে আব্দুর রহমান বিন ছামুরাহ! তুমি (কখনো মন থেকে) ইমারাত (শাসন-ক্ষমতা) চেও না। কারণ তোমার চাওয়ার প্রেক্ষিতে যদি সেটা তোমাকে দেয়া হয়, তাহলে তোমার কাছেই ওটির দায়দায়িত্ব (সোপর্দ করে) দেয়া হবে। আর তুমি না চাওয়া সত্ত্বেও যদি সেটা তোমাকে দেয়া হয়, তাহলে ওব্যাপারে (আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে) তোমাকে সাহায্য করা হবে”। [সহিহ বুখারী- ৯/৬৩ হাদিস ৭১৪৬; সহিহ মুসলীম- ৩/৪৫৬ হাদিস ১৬৫২; মুসনাদে আহম- ৫/৬২; মুসনাদে আবু আউআনাহ- ৪/৩৭৭ হাদিস ৭০১১; সুনানুল কুবরা, ইমাম বাইহাকী- ১০/১৭১ হাদিস ২০২৪৬]

আবু মুসা আশআরী রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেছেন- إِنَّا وَاللَّهِ لَا نُوَلِّي عَلَى هَذَا الْعَمَلِ أَحَدًا سَأَلَهُ ، وَلَا أَحَدًا حَرَصَ عَلَيْهِ . أخرجه مسلم في صحيحه , كتاب الإمارة , باب النهي عن طلب الإمارة والحرص عليها : ٣/١٤٥٦ رقم ١٧٣٣ – “আল্লাহ’র কসম, নিশ্চই আমরা এই (সরকারী) কাজের দায়িত্ব -এমন কেউকে দিবো না, যে তা (আমাদের কাছে) চায়,  এমন কাউকেও (দিবো) না, যে তার প্রতি লোভ রাখে ”। [সহিহ মুসলীম- ৩/১৪৫৬ হাদিস ১৭৩৩]

আবু হুরায়রাহ রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেছেন- إِنَّكُمْ سَتَحْرِصُونَ عَلَى الإِمَارَةِ ، وَسَتَكُونُ نَدَامَةً يَوْمَ القِيَامَةِ. رواه البخاري في صحيحه , كتاب الأحكام , باب ما يكره من الحرص على الإمارة : ٩/٦٣ رقم ٧١٤٨ – “(আমার পর) অচিরেই (এমন জামানা আসবে, যখন দেখা যাবে) তোমরা (মুসলমানরা) ইমারাত (শাসন ক্ষমতা)’র জন্য লালায়ীত হয়ে উঠবে। আর অচিরেই কেয়ামতের দিন (এই শাসন ক্ষমতা) লজ্জা ও পরিতাপ(-এর কারণ) হবে”। [সহিহ বুখারী- ৯/৬৩ হাদিস ৭১৪৮; সহিহ ইবনে হিব্বান- ১০/৩৩৪; মুসনাদে আহমদ- ২/৪৭৬; সুনানে নাসায়ী- ৮/২২৫ হাদিস ৫৩৮৫; মুসনাদে আব্দুল্লাহ বিন মুবারক- ১/১৬৪ হাদিস ২৬৮]

ইবনু হুজাইরাহ আল-আকবার রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, আবু যর আল-গিফারী রা. বলেন- قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَلاَ تَسْتَعْمِلُنِي قَالَ فَضَرَبَ بِيَدِهِ عَلَى مَنْكِبِي ثُمَّ قَالَ ‏ ‏ يَا أَبَا ذَرٍّ إِنَّكَ ضَعِيفٌ وَإِنَّهَا أَمَانَةٌ وَإِنَّهَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ خِزْىٌ وَنَدَامَةٌ إِلاَّ مَنْ أَخَذَهَا بِحَقِّهَا وَأَدَّى الَّذِي عَلَيْهِ فِيهَا . أخرجه مسلم في صحيحه , كتاب الإمارة , باب كراهة الإمارة بغير ضرورة : ٣/١٤٥٧ رقم ١٨٢٥ – “আমি (একবার নবী করিম ﷺ-কে) বললাম: ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ ! আমাকে কি (রাষ্ট্রের) কোনো প্রশাসনিক দায়িত্ব দিবেন না’? আবু যর বলেন: ‘(একথা শুনে) তিঁনি তাঁর হাত দিয়ে আমার কাঁধে চাপরালেন, তারপর বললেন: ‘হে আবু যর ! (আমার বিবেচনায়) নিশ্চই তুমি (এ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে একজন) দুর্বল (ব্যাক্তি)। আর নিশ্চই এ(ই রাষ্ট্রীয় পদ)টি হল একটি আমানত (যার খেয়ানত হবার সম্ভাবনা তোমার মতো দুর্বল ব্যাক্তির সাথে সার্বক্ষনিক লেগে থাকবে। তুমি যথাসম্ভব এসব থেকে নিজকে বাঁচিয়ে রেখো)। আর (জেনে রেখো) নিশ্চই কিয়ামতের দিন এটি লজ্জা ও পরিতাপের কারণ হবে। ব্যাতিক্রম (হবে কেবল তার জন্য) যে ব্যাক্তি এটাকে তার হক্ব সহকারে গ্রহন করতে পারবে এবং (এ বাবদ) তার উপর যে দায়িত্ব বর্তায় সেটা সে (যথাযথ ভাবে) আদায় করতে পারবে”। [সহিহ মুসলীম– ৩/১৪৫৭ হাদিস ১৮২৫]

আওফ বিন মালেক আল-আশযায়ী  রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেছেন- إِنْ شِئْتُمْ أَنْبَأْتُكُمْ عَنِ الْإِمَارَةِ وَمَا هِيَ أَوَّلُهَا مَلَامَةٌ ، وَ ثَانِيهَا نَدَامَةٌ ، وَ ثَالِثُهَا عَذَابٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِلَّا مَنْ عَدَلَ . رواه الطبراني في الكبير: ١٨/٧٢ ؛ قال الهيثمي : ٥/٢٠٠ : رواه البزار و الطبراني في الكبير و الأوسط باختصار و رجال الكبير رجال الصحيح؛ و قال المنذري : رواه البزار و الطبراني في الكبير و رواته رواة الصحيح، و حسنه الألباني في صحيح الترغيب والترهيب : رقم ٢١٧٣ – “যদি তোমরা চাও আমি তোমাদেরকে বলে দিতে পারি ইমারত (শাসন ক্ষমতা) সম্পর্কে যে, সেটা কী? এর প্রথমটা হল (জনগণের) তিরষ্কার, দ্বিতীয়টা হল লজ্জা ও পরিতাপ, এবং তৃতীয়টা হল কেয়ামতের দিন আযাব; (এক্ষেত্রে) কেবল (সেই শাসকের কথা ভিন্ন) যে (মানুষের সাথে) আদল-ইনসাফ করবে”। [আল-মু’জামুল কাবীর, ইমাম ত্বাবরাণী- ১৮/৭২ হাদিস ১৩২; মুসনাদে বাযযার- ১২/১৮৮ হাদিস ২৭৫৬; আল আহাদ ওয়াল মাছানী, ইবনুল আছিম- ৩/৩ হাদিস ১২৮৪; মাজমাউয যাওয়ায়ীদ, হাইছামী– ৪/১৯২]

(২) মুসলমানরাই নির্বাচন করবে কে তাদের খলিফা হবে

ইরবাজ বিন সারিয়া রা. থেকে নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেছেন– اوصيكم بتقوى الله والسمع والطاعة وان كان عبدا حبشيا فإنه من يعش منكم يرى بعدي اختلافا كثيرا فعليكم بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين المهديين وعضوا عليها بالنواجذ وإياكم ومحدثات الأمور فان كل محدثة بدعة وان كل بدعة ضلالة . أخرجه احمد فى المسند: ٤/١٢٦ رقم ١٧١٨٤ و قال شعيب الأرنؤوط : حديث صحيح ورجاله ثقات; رَوَاهُ أَبُو دَاوُدَ: رقم ٤٦٠٧ و صححه الألباني في مشكاة المصابيح برقم ١٦٥ و السلسلة الصحيحة:٢/٦١٠، وَ اَلتِّرْمِذِيُّ رقم: ٢٦٧٦ وَقَالَ: حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ; و ابن ماجه في سننه: رقم ٤٤; الطحاوي في مشكل الآثار:٣/٢٢٣ و سند الحديث جيد ; البغوي في شرح السنة: ١/٢٠٥ و إسناده حسن ; الطبراني فى المعجم الكبير: ١٨/٢٤٦ رقم ٦١٧ ; ابن حبان فى الصحيح : رقم٥ قال شعيب الأرناؤوط: إسناده صحيح ; وقال الجورقاني في الأباطيل والمناكير: هذا حديث صحيح ثابت مشهور: ١/٤٧٢ رقم ٢٨٨; وقال الحافظ ابن حجر في موافقة: هذا حديث صحيح رجاله ثقات: ١/١٣٦-١٣٩; قال ابن عبدالبر فى جامع بيان العلم: هذا حديث ثابت صحيح: ٢/١١٦٤ رقم ٢٣٠٥ ; قال المنذري في الترغيب والترهيب: لا ينزل عن درجة الحسن وقد يكون على شرط الصحيحين أو أحدهما: ١/٦٠; قال الذهبي في سير أعلام النبلاء: إسناده صالح: ١٧/٤٨٢; قال ابن القيم في أعلام الموقعين: حسن، إسناده لا بأس به: ٤/١١٩ – “তোমাদেরকে আমি উপদেশ দিচ্ছি আল্লাহকে ভয় করে চলার এবং (তোমাদের উপর নিযুক্ত আমীরের নির্দেশ) শোনা ও মানার -চাই সে কোনো হাবশী গোলামই হোক (না কেনো)। নিশ্চয় অামার (ইন্তেকালের) পরে তোমাদের মধ্যে যে ব্যাক্তি জীবিত থাকবে সে অনেক দ্বন্দ্ব-বিরোধ দেখতে পাবে। (তখন) তোমারা আমার সুন্নাহ’কে এবং হেদায়েতপ্রাপ্ত খুলাফায়েরাশেদীনের সুন্নাহ’কে তোমাদের উপর অপরিহার্য করে নিবে এবং তা মাড়ির দাঁত দিয়ে তোমরা আঁকড়ে ধরে থাকে (কোনো মতেই ছাড়বে না)। আর তোমরা (দ্বীন ইসলামের মধ্যে আমদানী হওয়া) নতুন নতুন বিষয়গুলো থেকে বেঁচে থাকবে। কেননা, নিশ্চই (দ্বীনের মধ্যে সুন্নাহ বহির্ভূত) প্রত্যেক নতুন-বিষয় বিদআহ এবং নিশ্চই প্রত্যেক বিদআহ পথভ্রষ্ঠতা”। [মুসনাদে আহমাদ- ৪/১২৬ হাদিস ১৭১৮৪; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৪৬০৭; সুনানে তিরমিযী, হাদিস ২৬৭৬; সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস ৫; সুনানে ইবনে মাজা, হাদিস ৪৪; শারহু মাআনিল আছার, ইমাম তাহাবী- ৩/২২৩; শারহুস সুন্নাহ, ইমাম বাগাভী- ১/২০৫; আল-মু’জামুল কাবীর, ত্বাবরানী- ১৮/২৪৬ হাদিস ৬১৭; মুসতাদরাকে হাকীম- ১/৯৫-৯৭]

এই হাদিস থেকে মুসলমানরা তাদের খলিফা নির্বাচন করার পদ্ধতি কী হবে -তার একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ পেয়ে গেল, আর সেটা হল-

(১) রাসুলুল্লাহ ﷺ -এর সুন্নাহ

(২) খুলাফায়ে রাশেদীন (সরল সঠিক পথের উপর প্রতিষ্ঠিত খলিফাগণ)-এর সুন্নাহ

রাসুলুল্লাহ ﷺ তাঁর জীবন সায়াহ্নে পরবর্তী খলিফা নির্বাচন ও মনোনয়নের দু’টি পদ্ধতির দিকে ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন, যা একটি সহিহ হাদিসে হযরত আয়েশা রা.-এর সূত্রে এভাবে বিদ্ধৃত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ আয়েশা রা.-কে বললেন- ادْعِي لِي أَبَا بَكْرٍ وَأَخَاكِ حَتَّى أَكْتُبَ كِتَابًا فَإِنِّي أَخَافُ أَنْ يَتَمَنَّى مُتَمَنٍّ وَيَقُولَ قَائِلٌ أَنَا أَوْلَى ‏.‏ وَيَأْبَى اللَّهُ وَالْمُؤْمِنُونَ إِلاَّ أَبَا بَكْرٍ ‏. رواه مسلم في صحيحه , كتاب فضائل الصحابة رضى الله تعالى عنهم , باب من فضائل أبى بكر الصديق : ٤/٨٥٧ رقم ٢٣٨٧ – “(হে আয়েশা!) তোমার পিতা আবু বকর এবং তোমার ভাই (আব্দুর রহমান)-কে আমার কাছে ডেকে আনো যাতে আমি একটি বিষয় লিখে দিতে পারি। আমার ভয় হচ্ছে, (এ পদের) কোনো আকাঙ্খি আবার আকাঙ্খা করে বসে নাকি এবং যে কথা তোলার সে আবার এই কথা তোলে নাকি- ‘আমি (এ পদের) সবচাইতে যোগ্য’। (কিন্তু যে যাই বলুক, যাই করুক না কেনো) আল্লাহ -আবু বকরকে ছাড়া (অন্য কাউকে) গ্রহন করবে না, মুমিনরাও না”। [সহিহ মুসলিম– ৪/১৮৫৭ হাদিস ২৩৮৭; সহিহ বুখারী, হাদিস ৫৩৪২; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস ২৪৭৯৫; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদিস ৬৫৯৮; সুনানুল কুবরা, নাসায়ী-৪/২৫৩; সুনানে বাইহাকী-৮/১৫৩; মুসতাদরাকে হাকীম-৩/৫৪২; ত্ববাকাতে ইবনে সা’দ-৩/১৮০]

ওরওয়াহ রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন- حَضَرْتُ أَبِي حِينَ أُصِيبَ فَأَثْنَوْا عَلَيْهِ وَقَالُوا جَزَاكَ اللَّهُ خَيْرًا ‏.‏ فَقَالَ رَاغِبٌ وَرَاهِبٌ قَالُوا اسْتَخْلِفْ فَقَالَ أَتَحَمَّلُ أَمْرَكُمْ حَيًّا وَمَيِّتًا لَوَدِدْتُ أَنَّ حَظِّي مِنْهَا الْكَفَافُ لاَ عَلَىَّ وَلاَ لِي فَإِنْ أَسْتَخْلِفْ فَقَدِ اسْتَخْلَفَ مَنْ هُوَ خَيْرٌ مِنِّي – يَعْنِي أَبَا بَكْرٍ – وَإِنْ أَتْرُكْكُمْ فَقَدْ تَرَكَكُمْ مَنْ هُوَ خَيْرٌ مِنِّي رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏.‏ قَالَ عَبْدُ اللَّهِ فَعَرَفْتُ أَنَّهُ حِينَ ذَكَرَ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم غَيْرُ مُسْتَخْلِفٍ ‏.‏ رواه مسلم في الصحيح, كتاب الإمارة, باب الاِسْتِخْلاَفِ وَتَرْكِهِ: رقم ١٨٢٣ ; و ابو عوانة في مسنده: رقم ٦٩٩٩; و احمد في المسند: ١/٤٣ رقم ٢٩٩ – “আমার আব্বাজান (ওমর ইবনুল খাত্তাব রা.) যখন (বিষাক্ত তরবারীর আঘাতে) আহত হলেন, তখন আমি (তাঁর কাছে) উপস্থিত হলাম। লোকজন তার সুনাম করে বললো: আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন। এতে তিনি বললেন: আমি (আল্লাহ’র রহমতের উপর) আশাবাদী এবং (নিজের পাপের কারণে -কী হবে -তা ভেবে) সন্ত্রস্ত। লোকেরা বললো: ‘আপনি (কাউকে আপনার পরবর্তী) খলিফা বানিয়ে যান’। তিনি বললেন: ‘আমি কি (আমার) জীবনে মরনে (উভয় ক্ষেত্রেই) তোমাদের বিষয়াদির বোঝা বহন করবো?! আমি চাই, ওর মধ্য থেকে (শুধুমাত্র আমার খিলাফতের) মাত্রাবরাবর (অংশটুকুই) আমার ভাগ্যে জুটুক, (বাদবাকি অন্যকে খলিফা বানিয়ে যাওয়ার দায় কিয়ামতের দিন) আমার উপরে না আসুক এবং (আমার দ্বারা মনোনীত খলিফার সৎকাজের সওয়াবও) আমাকে দেয়া না হোক, (আমি শুধু আমার বোঝাটুকু নিয়েই আল্লাহ’র সামনে দাঁড়াতে চাই)। (বস্তুতঃ আমার সামনে দুটো পথই খোলা রয়েছে)। আমি যদি কাউকে (আমার পরবর্তী) খলীফা বানাই (তাহলে শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে সে পথও খোলা রয়েছে, কেননা) আমার চাইতে যিনি উত্তম ছিলেন – অর্থাৎ আবূ বাকর রা.- তিনি (তাঁর জীবদ্দশাতেই তাঁর পরবর্তী) খলীফা বানিয়ে গেছেন। আবার আমি যদি (খলীফা নির্বাচনের ভার) তোমাদের উপর ছেড়ে যাই, তাহলে (শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে সে পথও খোলা রয়েছে, কেননা) রাসুলুল্লাহ ﷺ -যিনি আমার চাইতে উত্তম ছিলেন- তিনি (খলীফা নির্বাচনের ভার) তোমাদের (মুসলমানদের) উপর ছেড়ে গিয়েছিলেন। আবদুল্লাহ (ইবনু ওমর রা.) বলেন: তিনি যখন রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কথা উল্লেখ করলেন তখনই আমি বুঝে গেলাম যে, তিনি (নিজে কাউকে তাঁর পরবর্তী) খলীফা বানাবেন না”। [সহিহ মুসলীম- ৩/১৪৫৪ হাদিস ১৮২৩; মুসনাদে আবু আউয়ানাহ- ৪/৩৭৪ হাদিস ৬৯৯৯; মুসনাদে আহমদ- ১/৪৩ হাদিস ২৯৯; সুনানুল কুবরা, বাইহাকী- ৮/২৫৬ হাদিস ১৬৫৭১]

উপরোক্ত হাদিস সমূহ থেকে প্রমাণিত হয়-

(১) বর্তমান খলিফা মুনাসেব (উপযোগী) মনে করলে নিজেই তার পরবর্তী খলীফা মনোনয়ন ও নির্বাচন করে যেতে পারেন। যেমনটা রাসুলুল্লাহ ﷺ প্রথমে আয়েশা রা. ও তাঁর ভাই আব্দুর রহমান রা.-এর কাছে আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর পরবর্তী খলিফা হওয়ার বিষয়টি লিখে দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। অথবা, যেমনি ভাবে, খলিফা আবু বকর সিদ্দিক রা. তাঁর জীবন কালেই তাঁর পরবর্তী খলিফা ননোনয়ন ও নির্বাচন করেছিলেন হযরত ওমর ফারূক রা.-কে। পরবর্তী আমীর নির্ধারনের নমুনা অন্য হাদিসেও রয়েছে। যেমন রাসুলুল্লাহ ﷺ মুতাহ’র যুদ্ধের দিন যায়েদ বিন হারেসাহ রা.-কে ইসলামের পতাকা দান করেন এবং এরশাদ করেন: فَإِنْ قُتِلَ زَيْدٌ أَوِ اسْتُشْهِدَ فَأَمِيرُكُمْ جَعْفَرٌ، فَإِنْ قُتِلَ أَوِ اسْتُشْهِدَ فَأَمِيرُكُمْ عَبْدُ اللهِ بْنُ رَوَاحَةَ . أخرجه أحمد في مسنده: ١/٢٠٤، من حديث عبد الله بن جعفر رضي الله عنهما. وصحّحه أحمد شاكر في تحقيقه مسند أحمد: ٣/١٩٢ ، والألباني في «أحكام الجنائز: ٢٠٩ – যদি যায়েদ কতল হয় বা শহিদ হয়ে যায়, তাহলে (জিহাদে) তোমাদের আমীর হবে যা’ফর। সেও যদি কতল হয় বা শহিদ হয়ে যায়, তাহলে তোমাদের আমীর হবে আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা’। [মুসনাদে আহমদ- ১/২০৪]

মুতাহ’র যুদ্ধে ঠিক উপরোক্ত ক্রমানুসারেই প্রথমে যায়েদ রা, তারপর যা’ফর রা. এবং তারপর আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা রা. একে একে শহিদ হয়ে যান। অথচ ওই জিহাদে আল্লাহ’র তরবারী হিসেবে সম্মানীত খালেদ বিন ওয়ালিদ রা. শরিক ছিলেন, কিন্তু তাঁকে কেউ আমীর মানেননি। কারণ মুসলীম উম্মাহ’র আমীরে আ’জম রাসুলুল্লাহ ﷺ খালেদ বিন ওয়ালিদ রা.কে আমীর না বানিয়ে উপরোক্ত তিনজনকে একের পর এক আমীর বানানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং মুসলমানগণ আমীরে আ’জম-এর নির্দেশ মেনেছিলেন, কারণ আমীরে আ’জম-এর অনুগত্য ফরয

(২) বর্তমান খলিফা মুনাসেব/উপযোগী মনে করলে তার পরবর্তী খলীফা মনোনয়ন ও নির্বাচনের দায়িত্ব মুসলমানদের মতের উপর ছেড়ে যেতে পারেন, যেমনটা রাসুলুল্লাহ ﷺ প্রথমে আয়েশা রা. ও তাঁর ভাই আব্দুর রহমান রা.-এর কাছে আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর পরবর্তী খলিফা হওয়ার বিষয়টি লিখে দিতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত এব্যাপারে কোনো নির্দেশ না দিয়ে তা মমিন মুসলমানদের মতের উপর ছেড়ে যান। 

তবে জেনে রাখা অতীব জরুরী যে, এখানে ‘মুসলমানদের মতের উপর ছেড়ে যাওয়া’র অর্থ ‘সকল মুসলমান কিংবা অধিকাংশ মুসলমানের মতের উপর ছেড়ে দেয়া নয়’, বরং অর্থ হল ‘মুসলমানদের প্রতিনিধি’গণের মতের উপর ছেড়ে দেয়া। মুসলীম উম্মাহ’র এই প্রতিনিধিগণকে ফিকহের পরিভাষায় ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’ বলা হয়ে থাকে। ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’ হল ওইসকল ওলামায়ে কেরাম ও মান্যবর চিন্তাবিদ ব্যাক্তিবর্গ যাঁরা মুসলীম উম্মাহ’র মাঝে সুউচ্চ ইলমের অধিকারী হওয়ার পাশাপাশি এসব ব্যাপারে মতামত দানের বেলায় মুরুব্বিয়ানা মর্তবায় প্রকাশ্যভাবে পরিচিত থাকেন। এইআহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’ নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে কাউকে খলিফ হিসেবে মনোনয়ন ও নির্বাচিত করে তাঁর হাতে বায়াত হয়ে গেল সেই ব্যাক্তি গোটা মুসলীম উম্মাহ’র পক্ষ থেকে ‘খলিফা’ নিযুক্ত হয়ে যান এবং তখন গোটা মুসলীম উম্মাহ’র জন্য সেই খলিফার অনুগত্যতা স্বীকার করে নেয়া ফরয হয়ে যায়। খোদ ইসলামী শরীয়তে সহিহ ও সারিহ অনমতি না পাওয়া পর্যন্ত ওই খলিফার অনুগত্য অস্বীকার করা বা অনুগত্য থেকে খারেজ (বেড়) হয়ে যাওয়া বা তার সাথে বিদ্রোহ করা নাজায়েয। খুলাফায়ে রাশেদীন এই অর্থই বুঝেছিলেন। [আল-আহকামুস সুলতানিয়্যাহ, মাওয়ারদী- ১/৫; উসুলুদ্দিন, বাগদাদী- ১/২৭৯; মিনহাযুত ত্বালেবীন, ইমাম নববী- ১/১৩১; আল মাওয়াফিক্ব- ৮/৩৪৫; শারহুল মুসলীম, ইমাম নববী- ১২/৭৭; শারহুল মাক্বাসীদ, তাফতানাযী- ২/২৭২; হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগাহ, দেহলাভী- ২/১১১]

যেমনটা, দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ফারূক রা. -তাঁর পরবর্তী খলিফা কে হবেন- তা আগাম নির্ধারন করে না গিয়ে তাঁর ‘আহলে-শুরা’ (পরামর্শ সভাসদবৃন্দ) থেকে শুধু ৬ জন ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’ ব্যাক্তিবর্গের উপরে ছেড়ে গিয়েছিলেন যে, তাঁরা ৬ জন পরামর্শ করে তাঁদেরই মধ্য থেকে কাউকে পরবর্তী খলিফা মনোনয়ন ও নির্বাচন করে নিবেন, (যার আলোচনা নিম্নে উসমান বিন আফফান রা.-এর আলোচনায় আসছে)।

নির্ভযোগ্য হাদিস ও ইতিহাসের কিতাবাদি দেখলে পরিষ্কার প্রতিভাত হয় যে,  রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর পর খুলাফায়ে রাশেদীন তথা ১ম খলিফা আবু বকর সিদ্দীক রা, ২য় খলিফা ওমর ফারুক রা, ৩য় খলিফা ওসমান গণী রা. এবং ৪র্থ খলিফা আলী রা.- কে খলিফা হিসেবে মনোনয়ন ও নির্বাচনের ক্ষেত্রে উপরোক্ত হাদিসগুলির শিক্ষার বাস্তব আমলেই কার্যকর ছিল। ধর্মনিরপেক্ষতা’র খাসলত বোঝার সুবিধার্থে নিম্নে আমাদের এই মহান খুলাফায়ে রাশেদীন কিভাবে মুসলমানদের খলিফা হিসেবে মনোনীত ও নির্বাচিত হয়েছিলেন, তার মূল মূল কিছু দিক নিয়ে অতীব সংক্ষেপে আলোচনা পেশ করা হল। (বিস্তারিত জানতে নির্ভযোগ্য হাদিস ও ইতিহাসের কিতাবাদি পড়ে নিন)।

আবু বকর সিদ্দীক রা-কে ১ম খলিফা হিসেবে নির্বাচন:-

রাসুলুল্লাহ ﷺ -এর দেহ মোবারক’কে দাফন করার পর আবু বকর সিদ্দীক রা ও ওমর ফারূক র ‘কে বলা হল যে, মুহাজের ও আনসার’গণের কেউ কেউ অমুক স্থানে ‘কে খীলফা হবে’ -তা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত দিচ্ছেন। ফলে তাঁরা দুজন সহ আরো কয়েকজন গণ্যমান্য সাহাবায়ে কেরাম সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলেন। সেখানে দেখতে পেলেন যে, এ ব্যাপারে ইলম কম ছিল -এমন কেউ কেউ এও মত দিয়েছেন যে, আনসার থেকে একজন আমীর এবং মুহাজেরদের থেকে একজন আমীর নিযুক্ত করা হোক। কিন্তু আবু বকর সিদ্দিক রা ও ওমর ফারূক রা. সহ অপরাপর উপস্থিত গণ্যমান্য সাহাবায়ে কেরাম উপস্থিত লোকদেরকে বুঝাতে সমর্থ হলেন যে, ‘সকল মুসলমানদের খলিফা হবেন একজনই এবং রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর উপদেশ মতো খলিফা হবেন কুরাইশ থেকে। সেখানে আলোচনার মুখ্য ভূমিকা রাখছিলেন আবু বকর সিদ্দিক রা. এবং তিনি তাঁর কথার শেষ দিকে ওমর রা.-এর বিভিন্ন যোগ্যতাগুণের কথা উল্লেখ করে তাঁকে খলিফা করা যায় মর্মে মত প্রকাশ করলেন এবং তাঁর হাতে সকলকে বাইয়াত হতে বললেন। কিন্তু ওমর রা. উপস্থিত মুসলমানদেরকে বুঝাতে সক্ষম হলেন যে, আবু বকর সিদ্দিক রা. এপদের সর্বাধিক যোগ্য এবং খোদ রাসুলুল্লাহ ﷺ তাঁর জীবন সায়াহ্নে নামাযের জামাআতে উপস্থিত হতে অপারগ হওয়ায় মুসলমানদের জামাআতের ইমাম বানিয়েছিলেন আবু বকর সিদ্দিক রা.-কে এবং তাঁকে ছাড়া আর কারো ইমামতী তিনি গ্রহন করেননি, সুতরাং গোটা মুসলীম জামায়াতের ইমাম (আমীর/খীলফা) হওয়ারও সর্বাধিক যোগ্য তিনিই। এতে উপস্থিত লোকজন সকলেই ‘হাঁ’ সূচক সম্মতি দেন। তখন ওমর রা. বায়াতের জন্য তাঁর হাতকে আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর দিকে বাড়িয়ে দেন এবং তিনি বায়াত করে নেন। এরপর উপস্থিত গণ্যমান্য সাহাবায়ে কেরাম তাঁর হাতে বায়াত হন। ফলে তাঁদের অনুসরণ করে উপস্থিত বাকি মুসলমানগণও তাঁর হাতে বায়াত করেন। [বিস্তারিত: সহিহ বুখারী- ৬/২৫০৪ হাদিস ৬৪৪২; মুসনাদে আহমদ- ১/৫ হাদিস ১৮; সুনানুল কুবরা, ইমাম বাইহাকী- /১৪৩ হাদিস ১৬৩১৫; তারিখে ত্বাবারী- ২/৪৪৬; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ইবনে কাসির- ৫/২১৮-২৬৮]

বস্তুতঃ ওখানে ওমর ফারুক রা. ও অন্যান্য গণ্যমান্য সাহাবায়ে কেরাম ছিলেন ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’ ওলামায়ে কেরাম, যাঁদের বায়াত দ্বারাই আবু বকর সিদ্দিক রা. সকল মুসলমানদের উপর শরয়ী পন্থায় ‘খলিফা’ নিযুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। বাদবাকি বাকি উপস্থিত আনসার ও মুহাজির সাধারণ মুসলমানগণের বায়াত ছিল ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’ সাহাবায়ে কেরামের অনুসরণে এবং খলিফার হাতে বায়াতের স্বীকারোক্তি স্বরূপ। তাঁদের পরে ‘খলিফা নির্বাচনের খবর পেয়ে’ মদিনার মুসলমানগণ আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর হাতে বায়াত হতে থাকেন, যাঁদের মধ্যে আলী বিন আবি ত্বালেব রা.ও ছিলেন। খোদ আলী রা.-এর মতো এত উচ্চ মর্তবার ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’ বায়াতের প্রথম অবস্থায় উপস্থিত না থাকা সত্ত্বেও ‘খলিফা নির্বাচন ও বায়াত সহিহ’ হওয়াও একথার প্রমাণ যে, ‘কাউকে খলিফা নির্বাচণের জন্য সকল ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’-এর উপস্থিতি জরুরী নয়, বরং উল্লেখযোগ্য ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’গণ উপস্থিত থেকে বায়াত হলেই ‘খলিফা নির্বাচন সহিহ’ হয়ে যায় এবং উক্ত অনুপস্থিত ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’-এর সদস্যের জন্যও উক্ত নির্বাচিত খলিফার হাতে বায়াত হওয়া ওয়াজিব হয়ে যায়’।

যেমন, ইমাম মুহিউদ্দিন আন-নববী (মৃ: ৬৭৬ হি:) রহ. বলেছেন- فقد اتفق العلماء على أنه لا يشترط لصحتها مبايعة كل الناس ولا كل أهل الحل والعقد وإنما يشترط مبايعة من تيسر إجماعهم من العلماء والرؤساء ووجوه الناس،….. لا يجب على كل واحد أن يأتي إلى الإمام فيضع يده في يده ويبايعه وإنما يلزمه إذا عقد أهل الحل والعقد للإمام الانقياد له، و أن لا يظهر خلافاً ولا يشق العصا  – “আলেমগণ একথার উপরে একমত যে, (খলিফার হাতে) বায়াত সহিহ হওয়ার জন্য (খলিফার হাতে) সকল মুসলমান এবং সকল আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’গণের বায়াত হওয়া (জরুরী কোনো) শর্ত নয়। মূলত: (এক্ষত্রে) যেটা শর্ত সেটা হল, (মুসলমানদের মধ্যে উচ্চমর্যাদাশীল) ওলামায়ে কেরাম, (গ্রহনযোগ্য মান্যবর) চিন্তাবিদ ব্যাক্তিবর্গ এবং গণ্যমান্য লোকজনের মধ্য থেকে একটি জামাআত উপস্থিতি থেকে (খলিফার হাতে) বায়াত হওয়া। ……. (এক্ষেত্রে) প্রত্যেক ব্যাক্তির জন্য একাজ জরুরী নয় যে, সে খলিফার কাছে আসবে, তারপর তার হাতকে ইমামের হাতের দিকে বাড়িয়ে তার কাছে বায়াত করবে, বরং তার (মতো সকল সাধারণ মুসলমানদের জন্য) কেবল এতটুকুই জরুরী যে, যখন (মুসলমানদের মধ্য থেকে) আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ ব্যাক্তিবর্গ খলিফার হাতে (বায়াতের) চুক্তি করে নিবেন, সে সেই খলিফাকে মেনে নিবে। (তখন তার জন্য এটা জরুরী হয়ে যাবে) যে, সে (উক্ত খলিফা এবং আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ ব্যাক্তিবরর্গের) বিরোধীতা প্রকাশ করবে না এবং (কোনো অবস্থাতেই সেই খলিফার) শাসনের লাঠিকে ভাঙতেও যাবে না (যাবৎ না শরীয়ত তাকে সে কাজের অনুমতি দেয়)”। [শারহুল মুসলীম, ইমাম নববী– ১২/৭৭]

ওমর ফরূক রা.-কে ২য় খলিফা হিসেবে নির্বাচন:-

আবু বকর সিদ্দিক রা. তাঁর খিলাফতের শেষ দিকে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং অনুভব করেন যে, তাঁর পার্থিব জীবন বোধহয় শেষ হয়ে আসছে। তখন তিনি ‘আহলে শুরা’ (তথা পরামর্শ সভা)’র কয়েকজন গণ্যমান্য সদস্য সাহাবায়ে কেরামের সাথে (যেখানে ওমর রা. অনুপস্থিত ছিলেন) এ মর্মে পরামর্শ করেন যে, তাঁর পর দ্বিতীয় খলিফা কাকে বানানো যায়। তিনি এব্যাপারে নিজ থেকে ওমর ফারূক রা- এর নাম উপস্থাপন করে উপস্থিত সদস্যগণের কাছে তাঁর ব্যাপারে তাঁদের নিজ নিজ মতামত জানতে চাইলেন। তাঁরা সকলে ওমর রা.-এর পক্ষে মত প্রকাশ করলেন। তখন আবু বকর রা. তাঁর পরবর্তী খলিফা হিসেবে ওমর ফারূক রা.-কে আগাম ভাবেই  মনোনীত ও নির্বাচন করে ফেলেন এবং এই মর্মে একটি সরকারী অঙ্গীকারনামা লিখিয়ে নেন খোদ হযরত ওসমান বিন আফফান রা.-এর দ্বারা। পরে সেই সরকারী অঙ্গীকারনামাটি জনসম্মুখে পড়ে শোনানো হয়। [বিস্তারিত: আত-ত্ববাক্বাতুল কুবরা, ইমাম ইবনে সা’দ- ৩/১৯৯; তারিখুল উমাম ওয়াল মুলুক, ইমাম ত্বাবারী- ৩/৪২৮; তারিখে উমার, ইবনুল যাওজী- ১/৬৬; তারিখে দিমাশক, ইবনে আসাকীর- ৩০/৪১১; উসদুল গাবাহ, ইবনুল আছীর- ৪/১৬৯]

এক্ষেত্রে কয়েখটি বিষয় লক্ষনীয়। (১) বর্তমান খলিফা আবু বকর সিদ্দিক রা. নিজেই তাঁর পরবর্তী খলিফা মনোনয়ন ও নির্বাচন করে যান, (২) এতে বর্তমান খলিফার কাছে উপস্থিত আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ সদস্যগণের প্রত্যক্ষ সম্মতি ছিল।

আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর মৃত্যুর পর ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’গণ ওমর ফারূক রা.-এর হাতে একে একে বায়াত হলে পর খলিফার প্রতি তাঁদের আনুগত্যের প্রকাশ্য স্বীকৃতি সংঘটিত হয়ে যায়। পরে মদিনার সাধারণ মুসলমানগণ খলিফার হাতে বায়াত করে অনুগত্যের প্রকাশ্য স্বীকৃতি দেন।

উসমান ইবনে আফফান রা.-কে ৩য় খলিফা হিসেবে নির্বাচন:-

ওমর রা. তাঁর শেষ জীবনে ফজরের নামাযের সময় দুশমনের বিষ মাখা তরবারী দ্বারা গুরুতর আহত হয়ে মুমূর্ষ হয়ে যাওয়ার পর তাঁর পরবর্তী খলীফা কে হবেন সে নিয়ে চিন্তিত ছিলেন বটে, কিন্তু তিনি এব্যাপারে আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর মতো আগাম কাউকে তাঁর পরবর্তী খলিফা মনোনয়ন ও নির্বাচন চুড়ান্ত করে যাননি, বরং তা ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’-এর উপর ছেড়ে যান। তবে ওমর রা. ‘আহলে শুরা’ (পরামর্শ সভাসদবৃন্দ)-এর সদস্যদের মধ্যে উসমান ইবনে আফফান রা, আলী বিন আবি ত্বালেব রা., ত্বালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ রা., যুবাইর ইবনুল আউআম রা., সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা এবং আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রা. -এই ৬ জন’কে নির্দেশ দেন যে, তাঁরা পরষ্পরে পরামর্শ করে তাঁদের ৬ জনের মধ্যে যাঁকে ভাল মনে হয় তাঁকে পরবর্তী ‘খলিফা’ মনোনয়ন ও নির্বাচন করে নিবেন। হযরত ওমর রা.-এর শুরা’র সদস্য হিসেবে আরো অনেকে ছিলেন, কিন্তু তাদের মধ্যে থেকে শুধুমাত্র এই ৬ জন’কে ‘খলিফা’ নির্বাচন চুড়ান্তকরনের ‘‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’’ নিযুক্ত করে দেন।

ওমর রা.কে দাফন করার পর তাঁরা ৬ জন জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একস্থানে তৃতীয় খলিফা নির্বাচনের জন্য আলোচনায় বসেন। এও বর্ণিত হয়েছে যে, তখন আমর ইবনুল আস রা. এবং মুগীরা ইবনে শু’বা রা. ওই ৬জনের আলোচনা শোনার জন্য দরজার পাশে এসে বসলে সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা. তাঁদেরকে ছোট ছোট পাথর টুকড়া নিক্ষেপ করে বেড় করে দেন। পরে আলোচনা সভায় ৩ জন সাহাবী যথা- যুবায়ের রা., সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা. এবং ত্বালহা রা. নিজ নিজ ‘খলিফা’ হওয়ার অধিকারটিকে ছেড়ে দিয়ে খিলাফতের গুরু দায়িত্বের বোঝা নেয়া থেকে সড়ে দাঁড়ালেন এবং তারা অধিকারটিকে যথাক্রমে আলী বিন আবি ত্বালেব রা., আব্দুর রহমান ইবনে আওফ রা. এবং উসমান ইবনে আফফান রা.-এর স্কন্ধে অর্পন করে দনে। পরে আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রা.ও নিজের অধিকার ছেড়ে দেন। তখন তাঁকে উসমান ইবনে আফফান রা. এবং আলী বিন আবি ত্বালেব রা.-এর মধ্য থেকে যে কোনো একজনকে ‘খলিফা’ নির্বাচন করার দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি এই দায়িত্বটিকে কেয়ামতের দিন হিসাবের প্রশ্নে প্রকান্ড ভারী হবে বোধ করে তখনই দুজনের কোনো একজনকে ‘খলিফা’ ঘোষনা করা থেকে বিরত থাকেন। বরং তিনি তিন দিন ধরে ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’-এর সদস্যদের বাইরে অবস্থিত বিশিষ্ট সাহাবায়ে কেরাম রা., সর্বসাধারণ মুসলমান পুরুষ, এমনকি পর্দানশীন নারীদের কাছে গিয়েও তাদের মতামত জিজ্ঞেস করে নেন। এমনকি বর্ণিত হয়েছে যে, ওই তিন দিনের মধ্যে মদিনায় আগত ব্যবসায়ী কাফেলা ও বেদুইনদেরকেও এব্যাপারে জিজ্ঞেসাবাদ করেন। তিনি যখন দেখলেন যে, সকলে উসমান বিন আফফান রা.-এর নাম বলছে -যদিও উসমান রা. ও আলী রা. দুজনই খলিফা হওয়ার উপযুক্ত ছিলেন, তখন তিনি সার্বিক দিক বিবেচনা করে অবশেষে উসমান বিন আফফান রা.কে চুড়ান্ড ভাবে খলিফা নির্বাচন করেন। পরে মুসলমানগণ তাঁর হাতে বায়াত হয়। [বিস্তারিত: সহিহ মুসলীম- ৩/১৪৫৪ হাদিস ১৮২৩; সহিহ বুখারী- ৫/১৫ হাদিস ৩৭০০, ৯/৭৮ হাদিস ৭২০৭; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ইবনে কাসির- ৫/১৫৮, ৭/১৫৯; উসদুল গাবাহ, ইবনুল আছীর- ৩/৩৮১; মিনহাজুস সুন্নাহ, ইবনে তাইমিয়্যাহ- ১/১৪৩]

এক্ষেত্রে কয়েখটি বিষয় লক্ষনীয়। (১) বর্তমান খলিফা ওমর রা. নিজে তাঁর পরবর্তী খলিফা মনোনয়ন ও নির্বাচন চুড়ান্ত করে যান নি, বরং ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’-এর হাতে সে দায়িত্ব অর্পণ করে গিয়েছিলেন, (২) ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’-এর সকল সদস্যকে দায়িত্ব না দিয়ে তাঁদের মধ্যে থেকে মাত্র ৬ জনকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন, (৩) ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’-এর ওই ৬ জন পরামর্শ করে তাদের ওই ৬ জনের মধ্য থেকেই যাকে উপযুক্ত বিবেচিত হয় তাঁকে পরবর্তী ‘খলিফা’ নির্বাচন করে নিতে আদেশ দিয়ে যান, (৪) উক্ত ৬ জন ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’-এর মধ্যে ৪ জন নিজেদের ‘খলিফা’ হওয়ার অধিকার ছেড়ে দেন, বাকি ২ জনের মধ্যে কাকে ‘খলিফা’ বানানো হবে -সেই পরামর্শ করেন, (৫) উক্ত ৬ জন ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’-এর সকলে আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রা.-এর একার হাতে চুড়ান্তভাবে ‘খলিফা’ নির্বাচনের দায়িত্ব অর্পণ করেন, এবং (৬) এই অধিকার বলে আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রা. একাই অপরাপর ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’ ব্যাক্তিবর্গের পক্ষ থেকে  উসমান বিন আফফান রা.-কে ‘খলিফা’ নির্বাচন করেন।

এখানে জেনে রাখা জরুরী যে, উক্ত ৬ জন ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’-এর সকলের সম্মতিক্রমে আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রা. এককভাবে ‘খলিফা’ নির্বাচনের অধিকার লাভ করার পর তিনি যদি ৩ দিন ধরে বাকি মুসলমানদের কারো সাথে পরামর্শ না করেও ওই সভাতেই উসমান রা. ও আলী রা. -এই ২ জনের মধ্যে যে কাউকে ‘খলিফা’ বলে ঘোষনা দিতেন, সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তি গোটা মুসলীম উম্মাহ’র ‘খলিফা’ হয়ে যেতেন এবং তখন সেই খলিফা’র অনুগত্য করা সকল মুসলমানের জন্য ওয়াজিব হয়ে যেতো।

আলী বিন আবি ত্বালেব রা.-কে ৪র্থ খলিফা হিসেবে নির্বাচন:-

৩৫ হিজরীর যিল-হজ্জ মাসের ১৮ তারিখ শুক্রবার আছরের নামাযের পর তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান বিন আফফান রা. মিশর ও ইরাকের কিছু বাগী সন্ত্রাসীদের হাতে শহিদ হওয়ার আগে নিজ ঘরে বন্দি অবস্থায় তাঁর কাছে অনেকের কাছ থেকে তাঁর পরবর্তী খলিফা মনোনয়ন ও নির্বাচন করার আবেদন এসেছিল, কিন্তু তিঁনি কাউকেই তাঁর পরবর্তী খলিফা নির্বাচন করে যান নি। পরে তিঁনি যখন শহিদ হন, তখন এই ন্যাক্কারজনক ঘটনায় মুসলমানরা পরবর্তী ‘খলিফা’ নির্বাচন নিয়ে বেশ দিশেহারা অবস্থার সম্মুখীন হয়ে পড়ে। কারণ, তখন মদিনার অবস্থা মোটেও স্বাভাবিক ছিল না, বরং উগ্র বাগী সন্ত্রাসীদের যত্রযত্র দৌরাত্বের এক অসহনীয় ও অনাকাঙ্খিত অবস্থার ভিতরে দিয়ে সময় অতিবাহিত হচ্ছিল মদিনাবাসী মুমিন মুসলমানদের। এমনকি সেই নাজুক মুহূর্তেও ‘ইসলামী খিলাফত’ ব্যবস্থাকে সম্ভাব্য সমূহ ক্ষতি ও ফিতনা থেকে দ্রুত রক্ষার জোরালো তাগিদে মদিনায় উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম রা. ও সর্বসাধারণ মুসলমানদের একটি জামাআত প্রথমে ‘আহলে শুরা’ (পরামর্শ সভাসদবৃন্দ)-এর মধ্যে সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা, ত্বালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ রা. এবং যুবাইর ইবনুল আউআম রা.-এর সাথে সাক্ষাত করেন এবং তাঁদের কাছে জোরালো ভাবে আকুতি রাখেন যে, ‘ইসলামী খিলাফত’-এর এই সঙ্গিন মুহূর্তে যত দ্রুত সম্ভব একজন যোগ্য ব্যাক্তিকে খলিফা হিসেবে মনোনিত ও নির্বাচিত করা নিতান্ত জরুরী এবং আপনারা ‘আহলে শুরা’ (পরামর্শ সভাসদবৃন্দ)-এর সদস্য, তাই আপনারাই এব্যাপারে জরুরী ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিন। ফলে ‘আহলে শুরা’ (পরামর্শ সভাসদবৃন্দ)-এর সদস্যগণের মধ্যে বিশেষ করে সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা, ত্বালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ রা. এবং যুবাইর ইবনুল আউআম রা. সহ সাহাবায়ে কেরাম ও সর্বসাধারণ মুসলমানদের একটি জামাআত হযরত আলী বিন আবি ত্বালেব রা.-কে বর্তমানে খিলাফতের সব থেকে যোগ্য ব্যাক্তি হিসেবে মত প্রকাশ করেন এবং তাঁকেই প্রাথমিক ভাবে মনোনিত করা হয়। পরে তাঁরা হযরত আলী রা.-এর বাড়িতে গিয়ে তার কাছে বায়াত হবার জন্য পিড়াপিড়ি করেন। কিন্তু প্রথমে তিঁনি খলিফা হওয়ার এ গুরুদায়িত্ব নিজ স্কন্ধে নিতে অস্বীকার করেন। (এমনকি বর্ণিত হয়েছে যে,  আলী রা. এ গুরু দায়ীত্ব থেকে বাঁচার জন্য কোনো এক বাগানে গিয়ে লুকিয়ে পড়েছিলেন)। পরে তারা তাঁকে বুঝাতে সমর্থ হন যে, এ মুহূর্তে তাঁর ‘খলিফা’ হওয়া থেকে পিছু হটার সময় নয় বরং এই নাজুক সময়ে তাঁর খিলাফতের হাল ধরা নিতান্ত জরুরী। এতে তিঁনি বিষয়টির গুরুত্ব অনুধারন করেন এবং তাদের প্রস্তাবে সম্মত হন এবং লোকজনকে মদিনার মসজিদে একত্র হতে বলেন। পরে জুমআর দিন ফজরের সময় আলী রা. মসজিদে প্রবেশ করলে পর প্রথমে মদিনায় উপস্থিত মুহাজির ও আনসার সাহাবীগণ এবং পরে সর্বসাধারণ মুসলমানদের একটি জামাআত তাঁর হাতে বায়াত হন। এভাবে হযরত আলী বিন আবি ত্বালেব রা. শরীয়ত সম্মত পন্থায় মুসলীশ জাহানের ৪র্থ ‘খলিফা’ নিযুক্ত হন। [বিস্তারিত: মুসনাদে আহমদ-১/৬৪; মুসতাদরাকে হাকিম- ৩/৩৬৩; ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার- ৭/৮৯, ১৩/৭৫; আত-ত্ববাক্বাতুল কুবরা, ইমাম ইবনে সা’দ- ৩/৩১; আস-সুন্নাহ, ইমাম আবু বকর আল-খাল্লাল- ২/৪১৫-৪১৭ আছার ৬২০-৬২৩; তারিখুল উমাম ওয়াল মুলুক, ইমাম ত্বাবারী- ৪/৪২৭; আল ইমামাহ, ইমাম আবু নুআইম- ১/৩৫৮-৩৬৮; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ইবনে কাসির- ৭/২৪৭; আল-কামেল, ইবনুল আছীর- ৩/১৯০-১৯৩; আক্বীদাতু আহলিস সুন্নাহ, ড. নাসির বিন আলী- ১/৬৭৮]

উপরের আলোচনা থেকে বোঝা গেল, সুন্নাহ পন্থা হল-

(ক) বর্তমান খলীফা কোনো যোগ্য মুসলমানকে পরবর্তী খলীফা হিসেবে মনোনীত করে যেতে পারেন। যেমন খোদ্ রাসুলুল্লাহ ﷺ তাঁর জীবদ্দশাতেই আবু বকর সিদ্দিক রা.কে পরবর্তী ‘খলিফা’ বানানোর কথাটি লিখে দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। [আল আহকামুস সুলতানিয়্যাহ, মাওয়ার্দী- ১০ পৃ:; শারহুল মুসলীম, নববী- ১০/২০৫; মারাতিবুল উজমা, ইবনে হাযাম- ১৪৫ পৃ:; মাআলিমুস সুনান, খাত্তাবী- ৩/৩৫১]

(খ) বর্তমান খলীফা কোনো যোগ্য মুসলমানকে পরবর্তী খলীফা হিসেবে প্রাথমিকভাবে মনোনীত করে যেতে চাইলে তিনি তাঁর ‘আহলে-শুরা’-এর সাথে পরামর্শ করে নিতে পারেন এবং আহলে-শুরা’র মধ্যে ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’ সদস্যবৃন্দ উম্মতের জন্য কল্যানকর মনে করে সমর্থন দিলে পর বর্তমান খলিফা তার জীবদ্দশাতেই উক্ত ব্যক্তিকে তাঁর পরবর্তী খলীফা হিসেবে চুড়ান্ত ভাবে নির্বাচিত করে যেতে পারেন। বর্তমান খলীফা’র মৃত্যুর পর ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’-এর সদস্যগণ উক্ত মনোনীত ব্যাক্তির হাতে বায়াত হওয়ার দ্বারা সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তির ‘খলিফা’ হওয়া সুন্নাহ পন্থায় শরীয়ত-শিদ্ধ হয়ে যাবে। ১ম খলিফা আবু বকর সিদ্দিক রা. এমনটাই করেছিলেন।

(গ) বর্তমান খলীফা তার জীবদ্দশায় নিজে কোনো যোগ্য মুসলমানকে ভাবী খলীফা হিসেবে আগাম মনোনীত করে না গিয়ে তিনি মুনাসেব মনে করলে সে দায়িত্ব ‘আহলে-শুরা’ (খলীফার পরামর্শ সভার সদস্যবৃন্দ)র হাতে সোপর্দ করে যেতে পারেন। পরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’-এর সদস্যগণ নিজেদের মধ্যে আলোচনা সাপেক্ষে কারো হাতে বায়াত হওয়ার দ্বারা সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তির ‘খলিফা’ হওয়া সুন্নাহ পন্থায় শরীয়ত-শিদ্ধ হয়ে যাবে। রাসুলুল্লাহ ﷺ, দ্বিতীয় খলিফা ওমর ফারূক রা. এমনটাই করেছিলেন।

(ঘ) বর্তমান খলীফা তাঁর জীবদ্দশায় পরবর্তী ‘খলিফা’ মনোনয়নের উপরোক্ত কোনো ব্যবস্থা গ্রহন না করে থাকলে বা করার আগেই মৃত্যু হয়ে গেলে, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’-এর সদস্যগণ নিজেদের মধ্যে আলোচনা সাপেক্ষে কারো হাতে বায়াত হওয়ার দ্বারা সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তির ‘খলিফা’ হওয়া সুন্নাহ পন্থায় শরীয়ত-শিদ্ধ হয়ে যাবে।এভাবেই আলী বিন আবি ত্বালেব রা., হাসান বিন আলী রা, ওমর বিন আব্দুল আজিজ রহ -এর ‘খিলাফত’ সুন্নাহ পন্থায় শরীয়ত-শিদ্ধ হয়েছিল। নিকট ভবিষ্যতে এভাবেই ইমাম মাহদী রা.-এর ‘খিলাফত’ তাঁর সময়কার ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’-এর বায়াত দ্বারা সুন্নাহ পন্থায় শরীয়ত-শিদ্ধ হয়ে যাবে।

ইসলামী শরীয়তের এই সুন্নাহ/আদর্শিক পন্থার বিপরীতে-

(ক) ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে যেহেতু রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে ধর্মীয় বিধানকে ১০০% মুক্ত করায় বিশ্বাস (ইমান) রাখা অত্যাবশ্যক (ফরয) শর্ত, তাই রাষ্ট্রপ্রধান নিয়োগ দানের ক্ষেত্রেও ইসলাম ধর্মের এই ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ কর্তৃক সুন্নাহ/আদর্শিক পন্থা’য় গোটা মুসলীম উম্মাহ’র রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন চুড়ান্ত হওয়ার’ শর্তটিকে রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে ১০০% মুক্ত করায় বিশ্বাস (ইমান) রাখা তাদের মতে অত্যাবশ্যক (ফরয)

(খ) ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে যেহেতু রাষ্ট্রযন্ত্রে কোনো ধর্মীয় বিধিবিধানকে টেনে আনা ১০০% নিষিদ্ধ (হারাম), তাই রাষ্ট্রপ্রধান নিয়োগ দানের ক্ষেত্রেও ইসলাম ধর্মের এই ‘‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ কর্তৃক সুন্নাহ/আদর্শিক পন্থা’য় গোটা মুসলীম উম্মাহ’র রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন চুড়ান্ত হওয়ার’ শর্তটিকে রাষ্ট্রযন্ত্রে টেনে আনাও তাদের মতে ১০০% নিষিদ্ধ (হারাম)

(গ) ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ যেহেতু বিশ্বাস করে- যে ব্যাক্তি ধর্মীয় বিধিবিধানকে রাষ্ট্রব্যাবস্থায় টেনে আনায় বিশ্বাসী সে আদপে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদেই বিশ্বাসী নয় বরং অস্বীকারকারী (কাফের), তাই যে ব্যাক্তি রাষ্ট্রপ্রধান নিয়োগ দানের ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্মের এই ‘‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ কর্তৃক সুন্নাহ/আদর্শিক পন্থা’য় গোটা মুসলীম উম্মাহ’র রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন চুড়ান্ত হওয়ার’ শর্তটিকে রাষ্ট্রযন্ত্রে টেনে আনায় বিশ্বাসী, তাদের মতে সেও আদপে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে বিশ্বাসীই নয় বরং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে অস্বীকারকারী (কাফের)

(ঘ) উপরোক্ত এই ৩টি পয়েন্টের এব্যাপারে খাঁটি ধর্মনিরপেক্ষতা বাদীদেরর ঐক্যমত (ইজমা) রয়েছে।

এজন্য, এযুগের গণতান্ত্রীক ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে সকল প্রাপ্তবয়ষ্ক নাগরীক -চাই সে মুসলীম, হিন্দু, বৈদ্ধ, ইহুদী, খৃষ্টান, কাদিয়ানী বা নাস্তিক হোক আর মুর্খই হোক – সবাই মিলে নিজ নিজ মত (ভোট) দান করে দেশের ‘রাষ্ট্রপ্রধান’ নির্বাচন করে থাকে। এতে অধিকাংশ নাগরীকের ভোটে যদি কোনো কট্টর ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিক’ও নির্বাচিত হয়, তাহলে হালের গণতান্ত্রীক ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে তাকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে মেনে নেয়া অপরিহার্য (ফরয), তাকে না মানা আইনতঃ নিষিদ্ধ (হারাম) এবং দাপ্তরিক ভাবে নির্বাচিত হওয়ার পরও কেউ মানতে অস্বীকার করলে সে রাষ্ট্রীয় অপরাধে অপরাধী (মুজরীম) হবে, যার কোনো কোনো সীমালঙ্ঘন তাকে মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত উপভোগ করতে হতে পারে।

ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের এই তথাকথিত অধিকাংশের মতের ভিত্তিতে নেতা/নেত্রী নির্বাচনের যে থিওরী তারা ‘গণতন্ত্র’ নাম দিয়ে পৃথিবীর মানুষকে বেউকুফ বানাচ্ছে আর ন্যায়বিচার ও উন্নয়নের মিথ্যা স্বপ্ন দেখাচ্ছে তা জানার জন্য আল্লাহ তাআলার এই আয়াতই যথেষ্ট-

وَإِن تُطِعْ أَكْثَرَ مَن فِي الْأَرْضِ يُضِلُّوكَ عَن سَبِيلِ اللَّهِ ۚ إِن يَتَّبِعُونَ إِلَّا الظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلَّا يَخْرُصُونَ
“আর তুমি যদি পৃথিবীতে যারা আছে তাদের অধিকাংশের অনুসরণ করো তাহলে তারা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে গোমরাহ করে দিবে। তারা শুধুমাত্র ধারনার অনুসরণ করে এবং তারা শুধু ধারনাই করে” [সুরা আনআম ১১৬]

এ কথা কে না জানে যে, ইসলামের ঊষালগ্নে মক্কার অধিকাংশ মানুষ ছিল ইসলাম বিরোধী, রাসুলুল্লাহ সা.-এর বিরোধী, এমন কী সংখ্যালঘু মুসলমানগণ মক্কার সংখ্যাগুরু কাফেরদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। হিজরতের পর মদিনাতেও মুসলমানরা ছিল প্রায় সংখ্যালঘু, আর কাফেররা ছিল সংখ্যাগুরু। যদি মক্কা বা মদিনায় অধিকাংশ নাগরীকের মতামত (ভোট)-এর ভিত্তিতে রাষ্ট্রপ্রধান বা গোত্রপ্রধান নির্বাচনের বিষয়টি সাব্যস্ত হত, তাহলে কাফেররা সর্বাবস্থায় চাইতো তাদের রাষ্ট্র/গোত্রপ্রধান হোক তাদের কেউ (অর্থাৎ কোনো কাফের)। আর বলাই বাহুল্য, এরকম হলে কোনো দিনই মক্কা মদিনা কোথায়ও ‘দ্বীন ইসলাম’ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারতো না এবং দুনিয়ার বুকে আল্লাহ’র খলিফারা আল্লাহ’র পছন্দনীয় ‘খিলাফত’ ব্যবস্থা পরিচালনার পরিবর্তে উল্টো শয়তানের খলিফারা জমিনের বুকে শয়তানী সাম্রাজ্যের শিকড় গেড়ে রাখতো। তখন রাসুলুল্লাহ সা., হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা., হযরত ওমর ফারুক র., হযরত ওসমান রা. কিংবা হযরত আলী রা.-কে মুসলীম জাহানের খলিফা হিসেবে ইতিহাস দেখতে পেতো না, দেখতে পেতো না এ ব্যাপারে ইসলামী শরয়ী দৃষ্টিকোণ কী। আর যে মহান উদ্দেশ্যে আল্লাহ তাআলা এ বিশ্বকে সৃষ্টি করেছেন তাও বাস্তবরূপে বিকশিত হতে পারতো না। কারণ তা পূর্ণতা দানে ভুমিকা রাখবে-তো তাঁর খলীফারা তাঁর প্রতিনিধিরা, যাদের জন্য এ জমিনকে সৃষ্টি করা হয়েছে।

إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً
‘নিশ্চই আমি পৃথিবীতে (আমার) খলিফা (প্রতিনিধি) সৃষ্টি করবো’ [সূরা বাকারাহ ৩০]

এই খিলাফতের মিশন আঞ্জাম দেয়ার জন্য এই শেষ জামানায় (ইনশাআল্লাহ অতীব নিকতবর্তী সময়ের মধ্যে) ইমাম মাহদী রা. যখন আবির্ভূত হবেন এবং ক্বাবা ঘরের রুকন ও মাক্বাম-এর মাঝখানে দাঁড়িয়ে তৎকালীন বিশ্বের ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’গণ তাঁর হাতে উপরোক্ত সুন্নাহ/আদর্শিক পন্থায় খিলাফতের বায়াত নিবেন এবং তাঁদের বায়াত দ্বারাই ইমাম মাহদী গোটা মুসলীম উম্মাহ’র ‘আমীরে আ’জম/খলিফা/ইমাম’ হয়ে যাবেন, তখন দেখতে পাবেন যে, যারা (সম্ভবতঃ বেশিরভাগ রাজনীতিক ও সর্বসাধারন মানুষ) ধর্মনিরপেক্ষতা’র উপরোক্ত আক্বীদায় পোক্তভাবে বিশ্বাসী থাকবে এবং খাঁটি তওবা করে ইসলামের ছায়ায় ফিরে আসবে না, তারা ইমাম মাহদী’র শরীয়তশুদ্ধ খিলাফতকে ইনকার/অস্বীকার করবে। ফলে তারা প্রকাশ্য মুনাফেক হয়ে কাফের গোষ্ঠিদের ও শেষমেস দাজ্জালের সহযোগী হয়ে ইমাম মাহদী ও মুমিনগণের বিরুদ্ধে তৎপরতা চালাবে।

শরীয়তশুদ্ধ ‘খলিফা’র বিদ্যমানতায় ২য় কারো হাতে খিলাফতের বায়াত হওয়া নাজায়েয

এখানে শরীয়ত শুদ্ধ ‘খলিফা’ -এজন্য বললাম, যেহেতু খোদ শরীয়ত যাদেরকে খলিফা (আমীরুল মু’মনীন/ইমাম/রাষ্ট্রপ্রধান) হওয়ার অধিকারই দেয়নি (যেমন কাফের, মুরতাদ, নারী প্রমূখ), তাদেরকে যদি খোদ্ শরীয়ত সম্মত পন্থায়ও ‘খলিফা’ হিসেবে মনোনয়ন ও নির্বাচন করা হয়, তবুও তারা মুসলমানদের শরয়ী ‘খলিফা (আমীরুল মু’মনীন/ইমাম/রাষ্ট্রপ্রধান) গণ্য হবে নয়। কারণ, নির্বাচনের কেবলমাত্র  ‘পন্থা ও পদ্ধতি’ শুদ্ধ হওয়া যথেষ্ট নয়, বরং এর সাথে সাথে খোদ পাত্র/ব্যাক্তি’র মধ্যেও খলিফা হওয়ার কমপক্ষে নূন্যতম যোগ্যতাগুণের সমাবেশ থাকাও অপরিহার্য, যা ছাড়া শরীয়তের দৃষ্টিতে কারোর খিলাফত সহিহ-শুদ্ধই হতে পারে না।

যে কোনো জামানায় কোনো মুসলমান যদি একবার শরীয়তের দৃষ্টিতে ‘খলিফা’ (আমীরুল মু’মনীন/ইমাম/রাষ্ট্রপ্রধান) হিসেবে নির্বাচিত হয়ে গেছে মর্মে গণ্য হয়ে যায়, তখন অপরাপর মুসলমানদের উপর ফরয হবে ওই ব্যাক্তিকেই ‘খলিফা’ হিসেবে মেনে নেয়া ও সাধ্যমতো তার (সকল জায়েয নির্দেশের) আনুগত্য করা। এই খলিফা’র খিলাফত বিদ্যমান থাকাবস্থায় পরে দ্বিতীয় অন্য কেউ নিজকে ‘খলিফা’ হিসেবে দাবী করা ও এই ওই দ্বিতীয় দাবীদারের হাতে মুসলমানদের বায়াত করা -উভয়টিই নাজায়েয -(চাই সেই দ্বিতীয় দাবীদার ব্যাক্তি খিলাফতের যত যোগ্যই হোক না কেনো)। 

আবু হুরায়রাহ রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেছেন- كَانَتْ بَنُو إِسْرَائِيلَ تَسُوسُهُمْ الْأَنْبِيَاءُ كُلَّمَا هَلَكَ نَبِيٌّ خَلَفَهُ نَبِيٌّ وَإِنَّهُ لَا نَبِيَّ بَعْدِي وَسَيَكُونُ خُلَفَاءُ فَيَكْثُرُونَ قَالُوا فَمَا تَأْمُرُنَا قَالَ فُوا بِبَيْعَةِ الْأَوَّلِ فَالْأَوَّلِ أَعْطُوهُمْ حَقَّهُمْ فَإِنَّ اللَّهَ سَائِلُهُمْ عَمَّا اسْتَرْعَاهُمْ . رواه بخارى فى صحيحه, كتاب أحاديث الأنبياء, باب ما ذكر عن بني إسرائيل: رقم ٣٤٥٥; و مسلم فى صحيحه, كتاب الإمارة، باب الأمر بالوفاء ببيعة الخلفاء، الأول فالأول،,: ٣/١٤٧٢ رقم ١٨٤٢; السنة لالخلال: ١/١١ رقم ٦ اسناده صحيح ; أحمد في المسند: رقم ٧٩٤٧; ابن ماجه فى سننه: رقم ٢٨٧١; البيهقي فى دلائل النبوة: ٦/٣٣٨ – “বনী ইসরাঈলের সিয়াসাতী (রাজনৈতিক/পলিটিকাল) দায়িত্ব পালন করতেন তাদের নবীগণ। যখনই কোনো নবী মৃত্যুবরণ করতেন, তাঁর খলীফা (স্থলাভিষিক্ত) হতেন (তাঁর পরবর্তী অন্য আরেকজন) নবী। আর নিশ্চই আমার পর কোনো নবী নেই। শিঘ্রই (আমার পর রাজনৈতিক/পলিটিকাল দায়িত্ব পালনের জন্য) খলিফাগণ হবেন, পরে (ভাল-মন্দ খলিফা’র সংখ্যা) অনেক হবে। জিজ্ঞেস করা হল: (খলিফাগণ সম্পর্কে) আপনি আমাদেরকে কী নির্দেশ দেন? তিনি বললেন: ‘আনুগত্য করবে তার, যার কাছে সর্বপ্রথমে (খিলাফতের) বায়েত করা হবে, তারপর (তিনি ইন্তেকাল করলে বা তার খিলাফত শেষ হলে পরে আনুগত্য করবে তার, যার কাছে পরবর্তীতে) সর্বপ্রথমে (খিলাফতের বায়েত করা হবে)। (তারা খলিফা হিসেবে তোমার কাছ থেকে শরয়ী দৃষ্টিতে যে হক্ব প্রাপ্য), তাদের কাছে তাদের (সে) হক্ব (যথাযথ ভাবে) পৌছে দিবে। নিশ্চই আল্লাহ তাদেরকে যে ব্যাপারে (তোমাদের উপর) পৃষ্ঠপোষক বানিয়েছিলেন, (কেয়ামতের দিন) তাদেরকে সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন”। [সহিহ বুখারী- ৪/১৬৯ হাদিস ৩৪৫৫; সহিহ মুসলীম– ৩/১৪৭২ হাদিস ১৮৪২; আস-সুন্নাহ, ইমাম খাল্লাল-১/৭৭ হাদিস ৬; মুসনাদে আহমদ, হাদিস ৭৯৪৭; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস ২৮৭১; দালায়েলুন নাবুওত, বাইহাকী- ৬/৩৩৮]

এই হাদিসে- فُوا بِبَيْعَةِ الْأَوَّلِ فَالْأَوَّلِ – ‘অনুগত্য করবে তার, যার কাছে সর্বপ্রথমে বায়েত করা হয়েছে, তারপর (তিনি ইন্তেকাল করলে বা তার খিলাফত শেষ হলে পরে অনুগত্য করবে তার, যার কাছে পরবর্তীতে) সর্বপ্রথমে (বায়েত করা হয়েছে)’ -এর মধ্যে প্রথমে বায়াত করার অর্থ হল, ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’গণ যাঁকে প্রথমে ‘খলিফা’ হিসেবে নির্বাচিত করে ফেলেছেন -তিনি উদ্দেশ্য। অর্থাৎ, ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’গণ খিলাফতের কমপক্ষে নূন্যতম যোগ্যতাসম্পন্ন কোনো মুসলমানের হাতে খলিফাতের বায়াত হয়ে যাওয়ার পর যখন থেকে তিঁনি মুসলমানদের শরীয়ত সম্মত ‘খলিফা (আমীরে আ’জম/আমীরুল মু’মনীন/ইমাম/রাষ্ট্রপ্রধান) হিসেবে গণ্য হবেন, তার পর থেকে যতদিন পর্যন্ত খোদ শরীয়তের দৃষ্টিতেই তার খিলাফত’টি বাতীল/নি:শ্বেস সাব্যস্ত না হয়ে যায়, ততদিন পর্যন্ত অন্য কারোর জন্যই খিলাফতের দাবী করা বা তার হাতে মুসলমানদের বায়াত হওয়া জায়েয নয়, হলেও তার হাতে হওয়া বায়াত’টি বাতীল বলে গণ্য হবে। 

ইমাম মুহিউদ্দিন আন-নববী (মৃ: ৬৭৬ হি:) রহ. বলেছেন- إذا بويع لخليفة بعد خليفة فبيعة الأول صحيحة يجب الوفاء بها ، وبيعة الثاني باطلة يحرم الوفاء بها ، ويحرم عليه طلبها ، وسواء عقدوا للثاني عالمين بعقد الأول أو جاهلين ، وسواء كانا في بلدين أو بلد ، أو أحدهما في بلد الإمام المنفصل والآخر في غيره – “অর্থাৎ যখন (আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’গণ কর্তৃক) একজন খলিফার হাতে (প্রথমে) বায়াত হওয়ার পর (আরেক গ্রুপ অন্য দ্বিতীয়) কোনো খলিফার হাতে বায়াত হয়, তখন প্রথম জনের হাতে হওয়া বায়াতটি (শরীয়তের দৃষ্টিতে গ্রহনযোগ্য ও) সহিহ (সাব্যস্থ হয়) এবং তার অনুগত্য করা (সকল মুসলমানদের উপর) ওয়াজিব (অপরিহার্য হয়ে যায়)। আর দ্বিতীয় (জনের হাতে হওয়া) বায়াতটি (শরীয়তের দৃষ্টিতে) বাতিল (ও অগ্রহনযোগ্য বলে বিবেচিত হয়) এবং (তাকে খলিফা মনে করে) তার অনুগত্য করাও (মুসলমানদের জন্য) যেমন হারাম, তেমনি তার (নিজের) জন্যও ওই দাবী করা হারাম -সেটা চাই (আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’ কর্তৃক) প্রথম খলিফার কাছে বায়াত হওয়া অবস্থায় (বাকি) সকল মানুষজন অথবা জাহেলরা (মিলে) দ্বিতীয়জনের হাতে বায়াত হোক না কেনো, চাই তারা দু’জন দু’নগরের বা একই নগরের লোক হোক অথবা তাদের দুজনের একজন বিচ্ছিন্ন কোনো রাজধানীর আর অপরজন ভিন্ন কোনো স্থানের লোক হোক না কেন”। [শারহুল মুসলীম, ইমাম নববী– ৬/২১; উমদাতুল কারী, ইমাম আইনী- ১৬/৬০]

আর প্রথম খলিফা’র বিদ্যমানতায় খিলাফতের দ্বিতীয় দাবীদার ও তার দলবল শরীয়তের দৃষ্টিতে ‘এক খলিফার অধীনে মুসলীম উম্মাহ’র একতাবদ্ধ জামাআতের মাঝে ফাটল/বিভেদ সৃষ্টিকারী অপরাধী গোষ্ঠি’ হিসেবে গণ্য। এমতাবস্থায়, শরীয়ত প্রথম খলিফা’কে অধিকার দিয়েছে, তিনি- (১) ওই পরের দাবীদারকে হত্যা করতে পারেন –যদি কতল করা ব্যতীত তাকে তাঁর আনুগত্যে ফিরিয়ে আনা সম্ভব না হয়, (২) ওই পরের দাবীদার ও তার গ্রুপের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে পারেন -যদি জিহাদ করা ব্যতীত তারা তাঁর বশ্যতা ও আনুগত্যতা স্বীকার না করে। [আল-মিনহাজ, ইমাম নববী- ১২/২৪২; ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার- ১২/১৫৬; মিরকাতুল মাফাতিহ, আলী কারী- ৭/২৩৫]

আরফাযাহ রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেছেন- مَنْ أَتَاكُمْ وَأَمْرُكُمْ جَمِيعٌ عَلَى رَجُلٍ وَاحِدٍ، يُرِيدُ أَنْ يَشُقَّ عَصَاكُمْ، أَوْ يُفَرِّقَ جَمَاعَتَكُمْ، فَاقْتُلُوهُ .صحيح مسلم, كتاب الإمارة, باب حكم من فرق أمر المسلمين وهو مجتمع: رقم ١٨٥٢; مسند أبي عوانة, كتاب الإمارة : ٤/٤١٢ رقم ٨١٤٠ – “তোমাদের (মুসলমানদের) শাসন (ব্যবস্থা) সার্বিকভাবে কোনো একজন ব্যাক্তির উপর (ন্যাস্ত) থাকাবস্থায় (অন্য) যে ব্যাক্তি তোমাদের কাছে এসে তোমাদের শাসনের লাঠিকে ভেঙ্গে দিতে চায়, অথবা তোমাদের জামাআতের মাঝে ফাটল ধরাতে চায়, তোমরা তাকে (তথা দ্বিতীয় দাবীদারকে) হত্যা করে ফেলো”। [সহিহ মুসলীম- ৩/১৪৭৯ হাদিস ১৮৫২; মুসনাদে আবু আউয়ানাহ- ৪/৪১২ হাদিস ৮১৪০; সুনানুল কুবরা, ইমাম বাইহাকী- ৮/১৬৯ হাদিস ১৬১৮১]

আবু সাঈদ খুদরী রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেছেন- إِذَا بُويِعَ لِخَلِيفَتَيْنِ فَاقْتُلُوا الْآخَرَ مِنْهُمَا . رواه مسلم, كتاب الإمارة, باب إذا بويع لخليفتين: رقم ١٨٥٣; و أبو عوانه في مستخرجه, كتاب الأمراء, بيان وجوب نصرة الخليفة: رقم ٥٧٦١; و البيهقي في السنن الكبرى, كتاب القسامة: رقم ٢٥٠٥٣; و الطبراني في المعجم الأوسط , باب الألف: ٢٨٥٠ – “যখন দু’জন খলিফার কাছে বায়াত করা হয়, তখন তাদের দুজনের শেষোক্তজনকে তোমরা হত্যা করে ফেলবে”। [সহিহ মুসলীম- ৩/১৪৮০ হাদিস ১৮৫৩; মুসনাদে আবু আউয়ানাহ, হাদিস ৫৭৬১; সুনানুল কুবরা, বাইহাকী, হাদিস ২৫০৫৩; মু’জামুল আউসাত, ত্বাবরাণী, হাদিস ২৮৫০]

আমর বিন আস রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেছেন- লিখেছেন- من بايع إماماً فأعطاه صفقة يده وثمرة قلبه فليطعه إن استطاع ، فإن جاء آخر ينازعه فاضربوا عنق الآخر . رواه مسلم, كتاب الإمارة:٣/١٤٧٣ رقم ١٨٤٤; و ابو داود: رقم ٤٢٤٨ و صححه الالباني في صحيح سنن أبي داود – “যে ব্যাক্তি কোনো ইমাম (খলিফা/আমী ‍ুল মু’মিনীন)-এর কাছে বায়াত করে, সে যেন (নাগরিক হিসেবে) তার হাতের চুক্তি ও মনের ফল (নিষ্ঠা) তাঁকে দিয়ে দেয়, তারপর সাধ্যমতো তার আনুগত্য করে। পরে অন্য কেউ যদি এসে তাঁর (তথা প্রথম ইমামের) সাথে (খিলাফত নিয়ে) দ্বন্দ্ব বাঁধায়, তাহলে তোমরা পরেরজনের গর্দান উড়িয়ে দাও”। [সহিহ মুসলীম-৩/১৪৭৩ হাদিস ১৮৪৪; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৪২৪৮]

আরফাযাহ রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেছেন-  إِنَّهُ سَتَكُونُ هَنَاتٌ وَهَنَاتٌ ، فَمَنْ أَرَادَ أَنْ يُفَرِّقَ أَمْرَ هَذِهِ الْأُمَّةِ وَهِيَ جَمِيعٌ ، فَاضْرِبُوهُ بِالسَّيْفِ كَائِنًا مَنْ كَانَ . أخرجه مسلم في صحيحه , كتاب الإمارة , باب حكم من فرق أمر المسلمين وهو مجتمع : ٣/١٤٧٩ رقم ١٨٥٢  – “নিশ্চই (আমার পরে) অচিরেই অনেক ফিতনা ফাসাদ হবে। তখন এই উম্মাহ (শরীয়ত সম্মত কোনো ইমাম/খলিফার অধীনে) একতাবদ্ধ (জামাআত হিসেবে) থাকাবস্থায় যে ব্যাক্তি উম্মাহ’র শাসন-ব্যবস্থায় ফাটল/বিভেদ সৃষ্টি করতে চাইবে, তোমরা তরবারী দিয়ে তার গর্দান উড়িয়ে দিবে -সে যে-ই হোক না কেনো”। [সহিহ মুসলীম- ৩/১৪৭৯ হাদিস ১৮৫২; সহিহ ইবনে হিব্বান- ১০/৪৩৭ হাদিস ৪৫৭৭; মুসনাদে আহমদ- ৪/২৬১; সুনানে আবু দাউদ- ৭/১৩৯ হাদিস ৪৭৬২; সুনানুল কুবরা, ইমাম নাসায়ী- ৩/৪২৯ হাদিস ৩৪৭১; মুসতাদরাকে হাকিম- ২/১৫৬]

এসকল রেওয়ায়েত থেকে আরো প্রমাণিত হয়, যে কোনো জামানায় গোটা পৃথিবীর গোটা মুসলীম উম্মাহ’র ‘খলিফা (আমীরে আ’জম/আমিরুল মু’মিনীণ)’ হবে শুধুমাত্র একজন। বাদবাকি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ বা অঞ্চলে আমীর (প্রশাসক)’রা থাকবে মূলতঃ  ‘খলিফা’র অধীনস্ত একেকজন নায়েব (প্রতিনিধি) মাত্র। [মাজমুউল ফাতাওয়া, ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ- ৩৪/১৭৫] ‘খলিফা’ প্রয়োজন হলে বিভিন্ন এলাকায় নিয়োগকৃদ তার এসকল নায়েব (প্রতিনিধি) স্বরূপ আমীর (প্রশাসক)’দেরকে অন্যত্র কোথাও বদলীও করতে পারেন, আবার প্রয়োজনে ছাটাইও করে অন্য কাউকে এই দায়িত্ব-পদের অধিকারী করতে পারেন। কিন্তু ‘খলিফা’-কে ছাটাই করা বা উৎখাত করার অধিকার -না আছে এসব প্রশাসকের আর আছে মুসলমানদের -যাবৎ না খোদ শরীয়ত এর অনুমতি দেয়)। [শরীয়ত কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে খলিফাকে উৎখাত করার অনুমতি দেয় সে ব্যাপারে সামনের কোনো পেজে বিস্তারিত আলোচনা আসছে]।

কিন্তু ইসলামী শরীয়তের এই মাসআলার বিপরীতে-

(ক) ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে যেহেতু রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে ধর্মীয় বিধানকে ১০০% মুক্ত করায় বিশ্বাস (ইমান) রাখা অত্যাবশ্যক (ফরয) শর্ত, তাই রাষ্ট্রপ্রধান নিয়োগ দানের ক্ষেত্রেও ইসলামী শরীয়তের ‘১ম খলীফার বিদ্যমানতায় ২য় কেউ খিলাফতের দাবী করতে পারবে না’ মর্মে শর্তটিকে রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে ১০০% মুক্ত করায় বিশ্বাস (ইমান) রাখা তাদের মতে অত্যাবশ্যক (ফরয)

(খ) ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে যেহেতু রাষ্ট্রযন্ত্রে কোনো ধর্মীয় বিধিবিধানকে টেনে আনা ১০০% নিষিদ্ধ (হারাম), তাই রাষ্ট্রপ্রধান নিয়োগ দানের ক্ষেত্রেও ইসলামী শরীয়তের ‘১ম খলীফার বিদ্যমানতায় ২য় কেউ খিলাফতের দাবী করতে পারবে না’ মর্মে শর্তটিকে রাষ্ট্রযন্ত্রে টেনে আনাও তাদের মতে ১০০% নিষিদ্ধ (হারাম)

(গ) ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ যেহেতু বিশ্বাস করে- যে ব্যাক্তি ধর্মীয় বিধিবিধানকে রাষ্ট্রব্যাবস্থায় টেনে আনায় বিশ্বাসী সে আদপে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদেই বিশ্বাসী নয় বরং অস্বীকারকারী (কাফের), তাই যে ব্যাক্তি রাষ্ট্রপ্রধান নিয়োগ দানের ক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়তের ‘১ম খলীফার বিদ্যমানতায় ২য় কেউ খিলাফতের দাবী করতে পারবে না’ মর্মে শর্তটিকে রাষ্ট্রযন্ত্রে টেনে আনায় বিশ্বাসী, তাদের মতে সেও আদপে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে বিশ্বাসীই নয় বরং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে অস্বীকারকারী (কাফের)

(ঘ) উপরোক্ত এই ৩টি পয়েন্টের এব্যাপারে খাঁটি ধর্মনিরপেক্ষতা বাদীদের ঐক্যমত (ইজমা) রয়েছে।

ক্ষমতা বা অস্ত্রের জোরে কেউ যদি মুসলমানদের উপরে নিজের শাসন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করে ফেলে, তাহলে তার অনুগত্য করা বা না-করা

উপরে আমরা খলিফা নির্বাচনের শরীয়তশুদ্ধ পন্থা ও পদ্ধতি -যা রাসুলুল্লাহ ﷺ ও খুলাফায়ে রাশেদীন রা. থেকে প্রমাণিত- তা নিয়ে মোটামুটি  বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এখন কথা হল, শরীয়তশুদ্ধ পন্থাগুলি-তো মানতে রাজি শুধুমাত্র পাক্কা মুমিন মুসলমানগণ, যারা কুরআন ও সুন্নাহ মেনে চলতে বদ্ধ পরিকর এবং আখেরাতে আল্লাহ তাআলা সামনে দন্ডায়মান হতে ভয় পায়। কিন্তু বাস্তব সত্য হল, পৃথিবীর বেশিরভাগ মুসলমান আখেরাত বিমুখ এবং দুনিয়াদার, যারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সামান্য পার্থিব স্বার্থে খলিফা/আমীর নির্বাচন ও তার অনুগত্যের উপরোক্ত শরয়ী হুকুম ও নির্দেশনাগুলোকে পিঠের পিছনে ফেলে দিয়ে যে যেভাবে পারে দুনিয়ার কর্তৃত্ব ক্ষমতা, ধ্বনসম্পদ ও সুখস্বাচ্ছন্দ হাসিল করতে চায়। আমাদের বিগত সাড়ে চোদ্দ’শ বছরের ইসলামী ইতিহাসে কেবলমাত্র খুলাফয়ে রাশেদীন ও নেককার কিছু খলিফা/শাসক ছাড়া বেশির ভাগ মুসলীম শাসকের অবস্থা এমনই, যারা মুসলমানদের উপরে –হয় শরয়ী পন্থা বাদ দিয়ে কোনো নাজায়েয পন্থায়, নয় তো অস্ত্র ও ক্ষমতা বলে জোরজবস্তি করে শাসন ক্ষমতায় গেছে, আর এসবের জন্য অসংখ্য মানুষের রক্ত ঝড়েছে, ইজ্জত-আব্রু বাড়ি-ঘর ও ধ্বনসম্পদ নষ্ট হয়েছে অগণিত।

এখন প্রশ্ন হল, মুসলমানদের কোনো গোষ্ঠি যদি খলিফা নির্বাচনের শরীয়তশুদ্ধ পন্থা মান্য না করে কোনো নাজায়েয পন্থায় -যেমন অস্ত্র ও ক্ষমতা বলে মুসলমানদের উপরে জবরদখল করে- ‘শাসন ক্ষমতা’ প্রতিষ্ঠা করে ফেলে, তাহলে সেই ‘শাসন ক্ষমতা’কে শরীয়ত কী দৃষ্টিতে দেখে? এক্ষেত্রে মুসলমানরা কি —ওই জবরদখলকারী শাসকের ইমামত (শাসন ক্ষমতা)-এর প্রতি আনুগত্যতা স্বীকার করে নিয়ে স্বাভাবিক ভাবে জীবনযাত্রা চালাবে -যেমনি ভাবে শরয়ী পন্থায় নির্বাচিত খলিফার আনুগত্য করা হয়ে থাকে, নাকি সেই জবরদখলকারী শাসকের কর্তৃত্ব’কে অস্বীকার করে তাকে উৎখাত করার জন্য তার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করবে যাতে তার বদলে অন্য কোনো মুসলমানকে পূণরায় শরয়ী পন্থায় খলিফা হিসেবে নির্বাচন করে নেয়া যায়? এটি শরীয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ জরুরী মাসআলা।

প্রথম কথা হল, ইসলামী শরীয়তে যেখানে শাসকের পদ নিজ থেকে কামনা করে প্রস্তাব পেশ করার ক্ষেত্রেই দুনিয়া ও আখেরাতে এত বিপদের বোঝা ও জাহান্নামের ধমকী প্রদর্শন করা হয়েছে, সেখানে শরীয়তসম্মত পদ্ধতির তোয়াক্কা না করে  শাসকের পদের জন্য প্রস্তাব পেশ করা থেকেও অরো এক ধাপ এগিয়ে একেবারে অস্ত্র ও ক্ষমতা বলে জোরজবরদস্তি করে মুসলমনাদের থেকে শাসন-কর্তৃত্ব ছিনিয়ে নেয়া যে কত বড় ধৃষ্টতা, কত বড় স্পর্ধার, কত বড় অপরাধ ও পাপের বিষয় -সেটা তো বলাই বাহুল্য। যে লোক আখেরাতে আল্লাহ তাআলার সামনে দাঁড়ানোর ব্যাপারকে ভুলেই গেছে এবং যার অন্তরে পার্থিব পদ-পদবির সাময়ীক সম্মান মর্যাদা ও ক্ষমতার গাঢ় লালশা জেঁকে বসেছে, কেবল সে-ই পারে শাসন-ক্ষমতা লাভ করার জন্য এমন জোরজবরদস্তি’র পদ বেঁছে নিতে। 

আয়েশা সিদ্দিকা রা. রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেছেন-  سِتَّةٌ لَعَنْتُهُمْ ، وَلَعَنَهُمُ اللَّهُ وَكُلُّ نَبِيٍّ مُجَابٌ : الزَّائِدُ فِي كِتَابِ اللَّهِ ، وَ الْمُكَذِّبُ بِقَدَرِ اللَّهِ ، وَ الْمُسَلَّطُ بِالْجَبَرُوتِ لِيُذِلَّ بِذَلِكَ مَنْ أَعَزَّ اللَّهُ ، وَلِيُعِزَّ بِهِ مَنْ أَذَلَّ اللَّهُ ، وَالْمُسْتَحِلُّ لِحَرَمِ اللَّهِ ، وَالْمُسْتَحِلُّ مِنْ عِتْرَتِي مَا حَرَّمَ اللَّهُ ، وَالتَّارِكُ لِسُنَّتِي  . رواه ابن حبان في صحيحه , كتاب الحظر والإباحة , باب اللعن , ذكر لعن المصطفى مع سائر الأنبياء أقواما من أجل أعمال ارتكبوها : ١٣/٦٠ رقم ٥٧٤٩ و قال شعيب الأرناؤوط: إسناده ضعيف، و الترمذي في سننه , كتاب القدر عن رسول الله صلى الله عليه وسلم , باب ما جاء في الرضا بالقضاء : ٤/٣٩٨ رقم ٢١٥٤ ، و الحاكم في المستدرك على الصحيحين , كتاب الإيمان , ستة لعنهم الله وكل نبي مجاب : ١/١٩٧ رقم ١٠٩ و قال: قد احتج البخاري بعبد الرحمن بن أبي الموال وهذا حديث صحيح الإسناد ، ولا أعرف له علة ولم يخرجاه، و ضعفه الألباني في السلسلة الضعيفة : رقم ٣٦٨٩  – “সাত (ব্যাক্তি এমন আছে) যাদেরকে আমি লা’নত করেছি, তাদের প্রতি আল্লাহ’র লা’নত এবং সকল মুজাব (যাদের দোয়া কবুল হয়- এমন) নবীর লা’নত: (১) আল্লাহ’র কিতাবেরমধ্যে বৃদ্ধিকারী/অতিরঞ্জিতাকারী, (২) আল্লাহ’র (নির্ধারিত) ভাগ্যকে মিথ্যা প্রতিপন্নকারী, (৩) জোরজবরদস্তি করে (মানুষের উপরে) চেপে বসা (শাসক, যে) এর সাহায্যে -আল্লাহ যাকে ইজ্জত দিয়েছেন সে তাকে জিল্লত (অপমান অপদস্ত) করতে চায় এবং আল্লাহ যাকে জিল্লতী (অপমান অপদস্ততা) দিয়েছেন সে তাকে ইজ্জত দিতে চায়, (৪) আল্লাহ’র হারামকৃত জিনিসকে যে হালাল বানাতে চায়, (৫) আল্লাহ যা হারাম করেছেন সেটাকে আমার বংশের যে ব্যাক্তি হালাল বানাতে চায়, এবং (৬) আমার (ইসলামী) সুন্নাহ (আদর্শ)কে পরিত্যাজ্যকারী”। [সহিহ ইবনে হিব্বান– ১৩/৬০ হাদিস ৫৭৪৯; সুনানে তিরমিযী– ৪/৩৯৮ হাদিস ২১৫৪; মুসতাদরাকে হাকিম- ১/১৯৭ হাদিস ১০৯]

দ্বিতীয় কথা হল, ইসলামী শরীয়ত সম্পর্কে সুগভীর ইলম ও হিকমতের অধিকারী আমাদের আইম্মায়ে মুজতাহিদীন ও মুহাক্কেক ফুকাহায়ে কেরাম মত পোষন করেছেন যে, কোনো মুসলীম ব্যাক্তি যদি তার ক্ষমতা বা অস্ত্রের জোরে মুসলমানদের উপরে ইমাম (শাসন/খলিফা/আমীরুল মু’মিনীন) হিসেব তার শাসন-কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে ফেলে, তাহলে তার একাজ শরীয়তের দৃষ্টিতে নাজায়েয ও গুনাহ হওয়া সত্ত্বেও মুসলমানদের কর্তব্য হবে তাকে তাদের শাসক হিসেবে মেনে নেয়া, তার শাসন-কর্তৃত্ব’কে (একজন শরীয়তসম্মত খলিফার মতোই) স্বাভাবিক ভাবে চলতে দেয়া -যাবৎ না খোদ শরীয়ত সেই জবরদখলকারী শাসককে উৎখাত করার অনুমতি দেয় (যা আমরা সামনের পেজে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ)। পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে তার আনুগত্যতা স্বীকার করে নিতে হবে -এজন্য, যাতে- (১) মুসলমানদের একতাবদ্ধ জীবনের মধ্যে ফাটল/চিঁর ধরতে না পারে এবং যাতে তারা দলে উপদলে বিভক্ত হয়ে না যায়, (২) মুসলমানদের মধ্যে একে অপরের রক্ত বহানোর দ্বার উন্মুক্ত হতে না পারে।

এক্ষেত্রে মুসলমানদের উপরে ইমাম (শাসন/খলিফা/আমীরুল মু’মিনীন) হিসেব তার শাসন-কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে ফেলার অর্থ হল, (১) মুসলমানদের উপরে তার ক্ষমতাকে এমনভাবে প্রবল ও পাকাপোক্ত করে নেয়া যে, মুসলমানরা তাকে মানতে বাহ্যত: বাধ্য হয়ে গেছে; মানে- তাকে শাসক হিসেবে অমান্য করার মতো ক্ষমতা মুসলমানদের নেই,  (২) আল্লাহ’র নাজিলকৃত বিধান দিয়ে শাসন ব্যবস্থা ও বিচার ব্যবস্থার কার্যক্রম জারি করে দেয়া।

এর সপক্ষে দলিল হল, শরীয়তের দৃষ্টিতে একজন মুসলমানের ‘খলিফা’ হওয়ার একটি অন্যতম যোগ্যতাগুণ হল ‘স্বাধীন হওয়া’, অর্থাৎ কারোর দাস/গোলাম না হওয়া। কিন্তু রাসুলুল্লাহ ﷺ মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ জীবনের মধ্যে যাতে ফাটল/চিঁর ধরতে না পারে, তারা যাতে দলে উপদলে বিভক্ত হয়ে না যায়, এবং যাতে মুসলমানদের মধ্যে একে অপরের রক্ত বহানোর দ্বার উন্মুক্ত হতে না পারে, এজন্য বলেছেন যে, ‘যদি কখনো এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যে, জোরজবস্তি করে কোনো দাস/গোলামকে মুসলমানদের উপরে শাসক বানিয়ে দেয়া হয়েছে, তাহলে সেই  দাস/গোলাম যদি আল্লাহ’র নাজিলকৃত বিধান দিয়ে শাসন কার্য পরিচালনা করতে থাকে, তাহলে মুসলমানরা যেন সেই দাস/গোলামকে তাদের শাসক হিসেবে মেনে নেয় এবং যেন তার শাসন-কর্তৃত্ব’কে (একজন শরীয়তসম্মত খলিফার মতোই) স্বাভাবিক ভাবে চলতে দেয়া -যাবৎ না খোদ শরীয়ত তাকে উৎখাত করার অনুমতি দেয়।

উম্মে হুসাইন রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেন- إِنْ أُمِّرَ عَلَيْكُمْ عَبْدٌ مُجَدَّعٌ – حَسِبْتُهَا قَالَتْ – أَسْوَدُ، يَقُودُكُمْ بِكِتَابِ اللهِ تَعَالَى، فَاسْمَعُوا لَهُ وَأَطِيعُوا . رواه مسلم, كتاب الحج, باب استحباب رمي جمرة العقبة يوم النحر راكبا، وبيان قوله صلى الله عليه وسلم «لتأخذوا مناسككم: رقم ١٢٩٨; و احمد في المسند: ١٨/٤٨٩ رقم ٢٧١٤٣ اسناده صحيح; الخلال في السنة: رقم ٥٢ – “যদি কোনো অঙ্গ কর্তিত গোলামকেও তোমাদের (মুসলমানদের) উপরে শাসক বানিয়ে দেয়া হয় -(রাবী বলেন: যতটুকু স্মরণে পড়ে) আমার মনে হয় তিনি (সাথে এও) বলেছেন যে, কালো (ও অঙ্গ কর্তিত গোলামকেও শাসক হিসেবে চাপিয়ে দেয়া হয়)- যে তোমাদেরকে আল্লাহ তাআলার কিতাব (কুরআন) অনুযায়ী পরিচালনা করে, তাহলে তোমরা তার (আদেশ নিষেধ) শুনবে ও (তার জায়েয নির্দেশগুলোর ক্ষেত্রে) তোমরা অনুগত্য করবে”[সহিহ মুসলীম- ২/৯৪৪ হাদিস ১২৯৮; মুসনাদে আহমদ– ১৮/৪৮৯ হাদিস ২৭১৪৩; আস-সুন্নাহ, ইমাম খাল্লাল, হাদিস ৫২]

আনাস বিন মালেক রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেছেন- اسْمَعُوا وَأَطِيعُوا وَإِنْ اسْتُعْمِلَ عَلَيْكُمْ عَبْدٌ حَبَشِيٌّ كَأَنَّ رَأْسَهُ زَبِيبَةٌ . صحيح البخاري, كتاب الأحكام, باب السمع والطاعة للإمام ما لم تكن معصية: رقم ٧١٤٢; سنن ابن ماجه: رقم ٢٨٦٠; مسند أحمد بن حنبل: رقم ١١٧١٦; السنن الكبرى للبيهقي: ٨/١٥٥; البحر الزخار بمسند البزار: ١٠/١٣ رقم ٧٣٧٤; مسند أبي يعلى الموصلي: ٤١٧٦; مسند ابن الجعد: ١٤١٣ – “যদি (এমন) কোনো হাবশী গোলাম’কেও তোমাদের (মুসলমানদের) উপরে শাসক বানিয়ে দেয়া হয়, যার মাথাটা কিসমিসের মতো (দেখতে), তবুও তোমরা (তার আদেশ-নির্দেশ) শুনবে ও (সেগুলোর মধ্যে জায়েয বিষয়গুলোর) অনুগত্য করবে”। [সহিহ বুখারী- ৯/৬২ হাদিস ৭১৪২; সুনানে ইবনে মাজাহ- ২/৯৫৪ হাদিস ২৮৬০; মুসনাদে আহমদ, হাদিস ১১৭১৬; সুনানুল কুবরা, বাইহাকী- ৮/১৫৫; মুসনাদে বাযযার- ১০/১৩ হাদিস ৭৩৭৪; মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদিস ৪১৭৬; মুসনাদে ইবনুল যা’দ, হাদিস ১৪১৩]

আব্দুল্লাহ বিন ছামেত রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, আবু যর রা. বলেছেন- إِنَّ خَلِيلِي أَوْصَانِي أَنْ أَسْمَعَ وَأُطِيعَ وَإِنْ كَانَ عَبْدًا مُجَدَّعَ الأَطْرَافِ . رواه مسلم في صحيحه , كتاب المساجد ومواضع الصلاة , باب كراهية تأخير الصلاة عن وقتها المختار، وما يفعله المأموم إذا أخرها الإمام : ١/٤٤٨ رقم ٦٤٨ – “আমার খলীল (রাসুলুল্লাহ ﷺ) আমাকে অসিয়ত করেছেন, আমি যেন (শাসকের আদেশ-নিষেধ) শুনি এবং (তার জায়েয নির্দেশ গুলিকে) মান্য করে চলি -যদিও সে হয় একজন অঙ্গ কর্তিত গোলাম”। [সহিহ মুসলীম-১/৪৪৮ হাদিস ৬৪৮; সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস ৫৯৬৪; সুনানে ইবনে মাজাহ- ২/৯৫৫ হাদিস ২৮৬২; আল আদাবুল মুফরাদ, ইমাম বুখারী- ১/৩৫ হাদিস ১১৩; মুসনাদে আবু আউয়ানাহ, হাদিস ৭১০৩]

ইরবাজ বিন সারিয়া রা. থেকে নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেছেন– أُوصِيكُمْ بِتَقْوَى اللَّهِ ، وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ ، وَإِنْ كَانَ عَبْدًا حَبَشِيًّا . أخرجه احمد فى المسند: ٤/١٢٦ رقم ١٧١٨٤ و قال شعيب الأرنؤوط : حديث صحيح ورجاله ثقات; رَوَاهُ أَبُو دَاوُدَ: رقم ٤٦٠٧ و صححه الألباني في مشكاة المصابيح برقم ١٦٥ و السلسلة الصحيحة:٢/٦١٠، وَ اَلتِّرْمِذِيُّ رقم: ٢٦٧٦ وَقَالَ: حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ; و ابن ماجه في سننه: رقم ٤٤; الطحاوي في مشكل الآثار:٣/٢٢٣ و سند الحديث جيد ; البغوي في شرح السنة: ١/٢٠٥ و إسناده حسن ; الطبراني فى المعجم الكبير: ١٨/٢٤٦ رقم ٦١٧ ; ابن حبان فى الصحيح : رقم٥ قال شعيب الأرناؤوط: إسناده صحيح ; وقال الجورقاني في الأباطيل والمناكير: هذا حديث صحيح ثابت مشهور: ١/٤٧٢ رقم ٢٨٨; وقال الحافظ ابن حجر في موافقة: هذا حديث صحيح رجاله ثقات: ١/١٣٦-١٣٩; قال ابن عبدالبر فى جامع بيان العلم: هذا حديث ثابت صحيح: ٢/١١٦٤ رقم ٢٣٠٥ ; قال المنذري في الترغيب والترهيب: لا ينزل عن درجة الحسن وقد يكون على شرط الصحيحين أو أحدهما: ١/٦٠; قال الذهبي في سير أعلام النبلاء: إسناده صالح: ١٧/٤٨٢; قال ابن القيم في أعلام الموقعين: حسن، إسناده لا بأس به: ٤/١١٩ – “তোমাদেরকে আমি উপদেশ দিচ্ছি আল্লাহকে ভয় করে চলার এবং (তোমাদের উপর নিযুক্ত শাসকের নির্দেশ) শোনা ও মানার -চাই সে কোনো হাবশী গোলামই হোক (না কেনো)”। [মুসনাদে আহমাদ- ৪/১২৬ হাদিস ১৭১৮৪; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৪৬০৭; সুনানে তিরমিযী, হাদিস ২৬৭৬; সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস ৫; সুনানে ইবনে মাজা, হাদিস ৪৪; শারহু মাআনিল আছার, ইমাম তাহাবী- ৩/২২৩; শারহুস সুন্নাহ, ইমাম বাগাভী- ১/২০৫; আল-মু’জামুল কাবীর, ত্বাবরানী- ১৮/২৪৬ হাদিস ৬১৭; মুসতাদরাকে হাকীম- ১/৯৫-৯৭]

ইমাম শাফেয়ী (মৃ: ২০৪ হি:) রহ. বলেন- كلُّ من غلبَ على الخلافةِ بالسيفِ حتّى يُسمّى خليفةً، ويجمع الناس عليه، فهو خليفةٌ – “(মুসলমানদের মধ্যে খলিফা/ইমাম হওয়ার মতো কমপক্ষে নূন্যতম যোগ্যতাগুণ সম্পন্ন) কেউ যদি (আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ কিংবা মুসলমানদের সম্মতি-অসম্মতির তোয়াক্কা না করে নিজের ক্ষমতা বা) তরবারীর জোরে এমন ভাবে খিলাফত (শাসন ক্ষমতা) দখল করে বসে যে, তাকে (রাষ্ট্রের) খলিফা (ইমাম/শাসক/আমীরুল মু’মিনীন বা সমপর্যায়ের কোনো উপাধী) বলে ডাকা হতে থাকে এবং নাগরিকরা (স্বেচ্ছায় হোক বা তার ক্ষমতার ভয়ে হোক) তার (শাসন কর্তৃত্বের) উপরে (প্রকাশ্যে বা মৌন ভাবে) সম্মত হয়ে যায়, (যার দ্বারা তার রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের স্বীকৃতি প্রকাশ পায়), তাহলে সে (মুসলমানদের) খলিফা (ইমাম/শাসক/আমীরুল মু’মিনীন বলে সাব্যস্ত হবে)”। [মানাক্বিবুশ শাফেয়ী, ইমাম বাইহাকী- ১/৪৪৯]

ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (মৃ: ২৪১ হি:) রহ. বলেছেন- ومن غلب عليهم بالسيف حتّى صار خليفة وسمّي أمير المؤمنين، فلا يحلّ لأحد يؤمن بالله واليوم الآخر أن يبيت ولا يراه إماماً، برّاً كان أو فاجراً – “(মুসলমানদের মধ্যে খলিফা/ইমাম হওয়ার মতো কমপক্ষে নূন্যতম যোগ্যতাগুণ সম্পন্ন) কেউ যদি (আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ কিংবা মুসলমানদের সম্মতি-অসম্মতির তোয়াক্কা না করে নিজের ক্ষমতা বা) তরবারীর জোরে এমন ভাবে তাদের উপরে (শাসন ক্ষমতা সমেত) চেপে বসে যে, সে (তাদের) শাসকে পরিণত হয়ে যায়, আর তাকে (রাষ্ট্রের) আমীরুল মু’মিনীন (খলিফা/ইমাম/শাসক/ সমপর্যায়ের কোনো উপাধী) বলে ডাকা হতে থাকে, তাহলে -আল্লাহ ও আখেরাতের দিবসের প্রতি ইমান রাখে- এমন কারোর জন্য তাকে ইমাম (আমীরুল মু’মিনীন/খলিফা/শাসক) হিসেবে মেনে না নেয়া ও গণ্য না করা হালাল নয় -চাই সে(ই শাসক ব্যাক্তি হিসেবে) ভাল হোক বা ফাজের (পাপী)”। [আহকামুস সুলতানিয়্যাহ, ইমাম আবু ইয়া’লা- ১/২৩]

ইমাম ইবনে কুদামাহ আল-মাকদিসী (মৃ: ৬২০ হি:) রহ. লিখেছেন- كل من ثبتت إمامته، حرم الخروج عليه وقتاله، سواء ثبتت بإجماع المسلمين عليه، كإمامة أبي بكر الصديق – رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ -، أو بعهد الإمام الذي قبله إليه، كعهد أبي بكر إلى عمر – رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا -، أو بقهره للناس حتى أذعنوا له ودعوه إماما، كعبد الملك بن مروان – “(মুসলমানদের উপরে) যে (মুসলীম) ব্যাক্তিরই ইমামত (শাসন ক্ষমতা) প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে, —চাই তার ইমামতের উপরে মুসলমানদের সর্বসম্মতি থাকুক- যেমনটা ঘটেছিল আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর ইমামতের ক্ষেত্রে, —কিংবা চাই তার ইমামতটি তার পূর্বের খলিফার (আদেশকৃত) চুক্তির মাধ্যমে সাব্যস্ত হোক, যেমনটা ঘটেছিল (দ্বিতীয় খলিফা হযরত) ওমর রা.-এর কাছে (তাঁর পূর্বের খলিফা) আবু বকর সিদ্দিক রা. কর্তৃক (প্রদানকৃত খিলাফতের) চক্তির মাধ্যমে, —অথবা চাই (তার ইমামতটি) নাগরিকদেরকে জোরজবস্তি করে (প্রতিষ্ঠিত করা হোক), যার কারণে তারা তাকে ইমাম (শাসক) হিসেবে স্বীকৃতি দিতে ও মানতে বাধ্য হয়ে যায়, যেমনটা (করেছিল উমাইয়্যা শাসক) আব্দুল মালেক বিন মারওয়ান —(এই তিন প্রকারের ইমাম/খলিফা/শাসককে উৎখাতের উদ্দেশ্যে) তার বিরুদ্ধে (অস্ত্রধারন করে) বের হওয়া ও তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হারাম”। [আল-কাফী, ইবনে কুদামাহ- ৪/৫৪]

ইমাম মুহিউদ্দিন আন-নববী (মৃ: ৬৭৬ হি:) রহ. বলেছেন-  إذا ثبتت الإمامة بالقهر والغلبة ، فجاء آخر ، فقهره ، انعزل الأول ، وصار القاهر الثاني إماما  – “যখন ক্ষমতা খাটিয়ে জোরজবস্তি করে (মুসলমানদের উপরে কারোর) ইমামত (শাসন ক্ষমতা) প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, তারপরে অন্যজন এসে ক্ষমতার জোরে প্রথমজনকে উৎখাত করে দেয়, তখন দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যাক্তি (মুসলমানদের) ইমাম (শাসক) হয়ে যাবে”। [রাওজাতুত ত্বালিবীন, ইমাম নববী– ১০/৪৭]

ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (মৃ: ৭২৮ হি:) রহ. লিখেছেন- والقدرةُ على سياسةِ الناسِ إمّا بطاعتِهم لهُ، وإمّا بقهرهِ لهم، فمتى صارَ قادراً على سياستِهم بطاعتِهم أو بقهرهِ، فهو ذو سلطانٍ مطاعٍ إذا أمرَ بطاعةِ اللهِ – “জনগণের রাজনৈতিক বিষয়াবলির উপর ক্ষমতাসীন (কর্তৃত্বকারী ব্যাক্তি) –চাই তারা (স্বেচ্ছায়) তার আনুগত্যতা মেনে নিক কিংবা (ক্ষমতা বা অস্ত্রের জোরে) তাদেরকে সে (তার আনুগত্যতা স্বীকার করতে) বাধ্য করুক, বস্তুত: যখনই সে তাদের আনুগত্যতার স্বীকৃতি সহকারে অথবা জোরজবস্তি করে তাদের রাজনীতির উপরে শাসন-কর্তৃত্ব স্থাপন করে ফেলবে, তখন (থেকেই) সে (তাদের উপরে) অনুগত্যযোগ্য (একজন) সুলতান (খলিফা/ইমাম/শাসক/আমিরুল মু’মিনীন হিসেবে গণ্য হবে এবং তাকে মান্য করে চলা করা ওয়াজিব) -যাবৎ সে (তাদেরকে) আল্লাহ’র (কিতাব অনুযায়ী) অনুগত্যতামূলক নির্দেশ দান করতে থাকবে”। [মিনহাজুস সুন্নাহ, ইবনে তাইমিয়্যাহ- ১/১৪২]

ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (মৃ: ৮৫২ হি:) রহ. লিখেছেন-  أجمع الفقهاء على وجوب طاعة السلطان المتغلب والجهاد معه، وأن طاعته خير من الخروج عليه، لما في ذلك من حقن الدماء، وتسكين الدهماء، ولم يستثنوا من ذلك إلا إذا وقع من السلطان الكفر الصريح، فلا تجوز طاعته في ذلك، بل تجب مجاهدته لمن قدر عليه، لحديث البخاري عن عبادة: إلا أن تروا كفراً بَواحاً عندكم من الله فيه برهان – “জোরজবরদস্তি করে হওয়া সুলতান (ইমাম/শাসক)-এর (জায়েয আদেশ নিষেধ গুলোর ক্ষেত্রে তার) আনুগত্য করা এবং (শরয়ী প্রয়োজনে দ্বীনের দুশমনের বিরুদ্ধে জিহাদের ক্ষেত্রে) তার সঙ্গি হয়ে জিহাদ করা ওয়াজিব হওয়ার এব্যাপারে ফুকাহায়ে কেরাম একমত। (তাঁরা এ ব্যাপারেও একমত যে, তাকে উৎখাত করার উদ্দেশ্যে), তার বিরুদ্ধে (আস্ত্রধারন করে) বের হওয়ার চেয়ে তার আনুগত্যের মধ্যেই (মুসলমানদের জন্য) খায়র (কল্যান) রয়েছে -বিশেষত এজন্য যে, এক্ষেত্রে (মুসলমানদের একে অপরের মধ্যে) খুনাখুনি ও (পারষ্পরিক ঐক্যবদ্ধতার মাঝে) দলাদলি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে, আর (পূর্বের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে) মুসলমানরা এসব (ফিতনা ফাসাদ) থেকে মুক্ত থাকতে পারে না। তবে যখন (সেই) সুলতান (ইমাম/শাসক)-এর পক্ষ থেকে পরিষ্কার কুফর সংঘটিত হবে, তখন সেক্ষেত্রে তার আনুগত্য করা জায়েয নয়, বরং তাকে উৎখাত করার মতো যার ক্ষমতা রয়েছে তার জন্য ওয়াজিব হল ওকে (শাসন ক্ষমতা থেকে) সরাতে সে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে। কেননা বুখারীর উবাদাহ (বিন ছামেত) বর্ণিত হাদিসে রয়েছে যে, (রাসুলুল্লাহ ﷺ শাসকের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারন করে বের হওয়ার পূর্ব শর্ত এই বর্ণনা করেছিলেন যে)- إِلَّا أَنْ تَرَوْا كُفْرًا بَوَاحًا، عِنْدَكُمْ مِنَ اللَّهِ فِيهِ بُرْهَانٌ যাবৎ না তোমরা (শাসকের মধ্যে) সুস্পষ্ট কুফর দেখতে পাও, যে ব্যাপারে আল্লাহ’র পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে বুরহান (সুস্পষ্ট দলিল) রয়েছে”। [ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার- ১৬/১১২]

কিন্তু ইসলামী শরীয়তের এই মাসআলার বিপরীতে-

(ক) যেহেতু রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে ধর্মীয় বিধানকে ১০০% ছেটে ফেলে দেয়ায় বিশ্বাস (ইমান) রাখা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের অত্যাবশ্যক (ফরয) শর্ত, তাই জবরদখলকারী রাষ্ট্রপ্রধানের অনুগত্যতা স্বীকার ও উৎখাতের প্রশ্নেও ইসলামী শরীয়তের উপরোক্ত শর্তগুলিকেও রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে ১০০% ছেটে ফেলে দেয়ায় বিশ্বাস (ইমান) রাখাও তাদের মতে অবশ্যই অত্যাবশ্যক (ফরয)

(খ) যেহেতু রাষ্ট্রযন্ত্রে কোনো ধর্মীয় বিধিবিধানকে টেনে আনা ১০০% নিষিদ্ধ (হারাম), তাই জবরদখলকারী রাষ্ট্রপ্রধানের অনুগত্যতা স্বীকার ও উৎখাতের প্রশ্নেও ইসলামী শরীয়তের উপরোক্ত শর্তগুলিকে রাষ্ট্রযন্ত্রে টেনে আনাও তাদের মতে অবশ্যই ১০০% নিষিদ্ধ (হারাম)

(গ) ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ যেহেতু বিশ্বাস করে- যে ব্যাক্তি ধর্মীয় বিধিবিধানকে রাষ্ট্রব্যাবস্থায় টেনে আনায় বিশ্বাসী সে আদপে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদেই বিশ্বাসী নয় বরং অস্বীকারকারী (কাফের), তাই যে ব্যাক্তি জবরদখলকারী রাষ্ট্রপ্রধানের অনুগত্যতা স্বীকার ও উৎখাতের প্রশ্নে ইসলামী শরীয়তের উপরোক্ত শর্তগুলিকেও রাষ্ট্রযন্ত্রে টেনে আনায় বিশ্বাসী, তাদের মতে সেও আদপে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে বিশ্বাসীই নয় বরং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে অস্বীকারকারী (কাফের)

(ঘ) উপরোক্ত এই ৩টি পয়েন্টের ব্যাপারে খাঁটি ধর্মনিরপেক্ষতা বাদীদেরর ঐক্যমত (ইজমা) রয়েছে।

 


>>> মূল সূচিপত্র (index) থেকে এ পেজের পূর্ববর্তী বা পরবর্তী আলোচনা পড়তে [এখানে ক্লিক করুন]