মহানবী ﷺ-এর মদিনায় হিজরত ও ক্বিতাল/ সশস্ত্র জিহাদের সুচনা

মহানবী ﷺ-এর মদিনায় হিজরতের সময় ক্বিতাল/ সশস্ত্র জিহাদের সূচনা অনুমতি লাভ সুচনা হওয়ার প্রেক্ষাপট ও পরিবেশ পরিস্থিতি  

بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیۡمِ

الحمد لله و الصلاة و السلام على رسوله محمد و على أله و أمّته


>>> মূল সূচিপত্র (index) থেকে এ পেজের পূর্ববর্তী বা পরবর্তী আলোচনা পড়তে [এখানে ক্লিক করুন


 
পূর্ব আলোচনার পর…

 

মক্কা থেকে হিজরত করে ইয়াসরিব (মদিনা)-এর উদ্দেশ্যে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর যাত্রা 

আমরা ইতিপূর্বে বলে এসেছি যে, রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর মক্কা থেকে হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হন (অগ্রাধিকারযোগ্য মতানুসারে) নবুওতের ১৪ ম বছরের ‘সফর’ মাসের ২৭ তারিখ বৃহ:ষ্পতিবার দিবাগত শুক্রবার রাতে (মোতাবেক ১০-ই সেপ্টেম্বর ৬২২ ইং তারিখে)। মক্কার মুশরেকরা যখন বুঝতে পারে যে, রাসুলুল্লাহ ﷺ তাদের চোখে ধুলো দিয়ে ঘর থেকে হিজরতের জন্য বেরিয়ে গেছেন, তখন তারা বড় বড় পুরষ্কার ঘোষনা করে তাঁকে ধরে আনার জন্য পিছনে লোক লেলিয়ে দেয়। রাসুলুল্লাহ ﷺ বিষয়টি আশঙকা করতে পেরে মক্কা থেকে প্রায় ৬ মাইল দূরে অবস্থিত সাওর’ পাহাড়ের গুহায় ঢুকে আবু বকর সিদ্দিক রা. সহ তিন দিন তিন রাত –অর্থাৎ, সফর মাসের ২৭ তারিখ (শুক্রবার), ২৮ তারিখ (শনিবার), এবং ২৯ তারিখ (রবিবার)–পর্যন্ত আত্বগোপন করে থাকতে বাধ্য হন। কাফেররা খুঁজতে খুঁজতে ‘সাওর’ পাহাড়ের গুহার একেবারে মুখেও চলে আসে, কিন্তু আল্লাহ তাআলা নিজ কুদরতে সেখানেও তাঁদের দুজনকে কাফেরদের চোখ ও কবজা থেকে বাঁচিয়ে নেন। যাহোক, তিন দিন তিন রাত গুহায় অবস্থানের পর রবিউল আউয়াল মাসের ১লা তারিখ সোমবার (মোতাবেক ১৪-ই সেপ্টেম্বর ৬২২ ইং) রাতের বেলা ইয়াসরিব (মদিনা)র উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। 

পথিমধ্যে কিতাল (সশস্ত্র জিহাদ) -এর প্রথম অনুমতি সহ কুরআনের আয়াত নাজিল হওয়া 

ইয়াসরিব (মদিনা) যাওয়ার রাস্তাপথেই রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর উপরে ‘সশস্ত্র জিহাদ’-এর অনুমতি সহ আয়াত নাজিল হয়। যেমন, সাঈদ বিন যুবায়ের-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বর্ণনা করেন- لَمَّا أُخْرِجَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ مَكَّةَ قَالَ أَبُو بَكْرٍ: أَخْرَجُوا نَبِيَّهُمْ إِنَّا لِلَّهِ، وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ لَيُهْلَكُنَّ، فَنَزَلَتْ {أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوا وَإِنَّ اللهَ عَلَى نَصْرِهِمْ لَقَدِيرٌ} . فَعَرَفْتُ أَنَّهُ سَيَكُونُ قِتَالٌ قَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ: فَهِيَ أَوَّلُ آيَةٍ نَزَلَتْ فِي الْقِتَالِ . رواه النسائي في السنن الكبرى , كتاب الجهاد , وجوب الجهاد: ٥/٢٨١ رقم ٤٤٨٧ و في كتاب التفسير , سورة الحج , قوله تعالى أذن للذين يقاتلون بأنهم ظلموا: ١١/٢٣٦ رقم ١١٤٥٧، و في السنن الصغرى , كتاب الجهاد , باب وجوب الجهاد : ٢/٦ رقم ٣٠٨٥ ، و قال الألباني في صحيح النسائي : رقم: ٣٠٨٥ : إسناده صحيح ، و الحاكم في المستدرك على الصحيحين , كتاب الجهاد : ٢/٦٢٦ رقم ٣٠٢٢ و قال: هذا حديث صحيح على شرط الشيخين فقد حدثه غير أبي حذيفة و لم يخرجاه و وافقه الذهبي، و البزار في البحر الزخار: ١/١٩٤ إسناده حسن، و الترمذي : رقم ٣١٧١، و أحمد في مسنده: ١/٢١٦ رقم ١٨٦٥ و قال شعيب الارنؤوط : إسناده صحيح على شرط الشيخين – “(মক্কার কাফের মুশরেকরা) যখন নবী ﷺ-কে (তাঁর জন্মভূমি) মক্কা থেকে বের করে দিলো, তখন আবু বকর রা. বলেন: ‘ওরা তাদের নবীকে (তার জন্মভূমি থেকে) বের করে দিলো! ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাযিউন। ওদের ধ্বংস অনিবার্য’। এরপরেই নাজিল হয়- أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوا ۚ وَإِنَّ اللَّهَ عَلَىٰ نَصْرِهِمْ لَقَدِيرٌ  – ‘((তোমাদের মুসলমানদের মধ্যে) যাদের বিরুদ্ধে ক্বিতাল (যুদ্ধ) করা হবে, তাদেরকে (আল্লাহ’র পক্ষ থেকে ক্বিতাল//সশস্ত্র জিহাদ/যুদ্ধ চালানোর) অনুমতি দেয়া হল। তা এজন্য যে, তারা (কাফেরদের দ্বারা) জুলুমের শিকার হয়েছে। আর নিশ্চই আল্লাহ (তাআলা) তাদেরকে সাহায্য করতে পূর্ণ ক্ষমতাবান))’। তখন আমার বুঝে আসলো, অচিরেই (মক্কার মুশরেকদের সাথে আমাদের মুসলমানদের) ক্বিতাল (সশস্ত্র যুদ্ধ সংঘটিত হবে)’। (আব্দুল্লাহ) ইবনে আব্বাস বলেন: ‘ক্বিতাল সম্পর্কে নাজিল হওয়া এটিই প্রথম আয়াত”[সুনানুল কুবরা, ইমাম নাসায়ী- ৫/২৮১ হাদিস ৪৪৮৭, ১১/২৩৬ হাদিস ১১৪৫৭; সুনানুস সুগরা, ইমাম নাসায়ী- ২/৬ হাদিস ৩০৮৫; সহিহ ইবনে হিব্বান-৮/১১ হাদিস ৪৭১০; মুসনাদে আহমদ– ১/২১৬ হাদিস ১৮৬৫; সুনানে তিরমিযী- ৮/৩১৬ হাদিস ৩১৭১; মুসতাদরাকে হাকিম– ২/৬২৬ হাদিস ৩০২২; আল-মু’জামুল কাবীর, ইমাম ত্বাবরাণী- ১৬/১২ হাদিস ১২৩৩৬; মুসনাদে বাযযার- ১/১৯৪; জামেউল বায়ান, ইমাম ত্বাবারী- ১৭/১২৩; সুনানুল কুবরা, ইমাম বাইহাকী- ৯/১১]
 
 ইউনুস রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, যুহরী রহ. বর্ণনা করেন- فَكَانَ أَوَّلَ آيَةٍ نَزَلَتْ فِي الْقِتَالِ كَمَا أَخْبَرَنِي عُرْوَةُ، عَنْ عَائِشَةَ: {أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوا وَإِنَّ اللهَ عَلَى نَصْرِهِمْ لَقَدِيرٌ} إِلَى قَوْلِهِ {إِنَّ اللهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ} ، ثُمَّ أَذِنَ بِالْقِتَالِ فِي آيٍ كَثِيرٍ مِنَ الْقُرْآنِ . رواه النسائي في السنن الكبرى , كتاب التفسير , سورة الحج , قوله تعالى أذن للذين يقاتلون بأنهم ظلموا: ١١/٢٣٧ رقم ١١٤٥٧، قال ابن حجر في فتح الباري , كتاب المغازي برقم ٣٩٤٩ : ٧/٩ : إسناده صحيح – “(উম্মুল মু’মিনীন) আয়েশা’র কাছ থেকে (শুনে) উরওয়াহ আমার কাছে বর্ণনা করেছে যে, ক্বিতাল সম্পর্কে যে আয়াতটি সর্বপ্রথম নাজিল হয় সেটা হল- أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوا ۚ وَإِنَّ اللَّهَ عَلَىٰ نَصْرِهِمْ لَقَدِيرٌ  – ‘((তোমাদের মুসলমানদের মধ্যে) যাদের বিরুদ্ধে ক্বিতাল (যুদ্ধ) করা হবে, তাদেরকে (আল্লাহ’র পক্ষ থেকে ক্বিতাল//সশস্ত্র জিহাদ/যুদ্ধ চালানোর) অনুমতি দেয়া হল। তা এজন্য যে, তারা (কাফেরদের দ্বারা) জুলুমের শিকার হয়েছে। আর নিশ্চই আল্লাহ (তাআলা) তাদেরকে সাহায্য করতে পূর্ণ ক্ষমতাবান))’ থেকে- إِنَّ اللَّهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ – ‘((নিশ্চই আল্লাহ অবশ্যই মহা শক্তিমান, মহা পরাক্রমশালী))’ পর্যন্ত। এরপর কুরআনের আরো বহু স্থানে ক্বিতালের অনুমতি দেয়া হয়েছে”[সুনানুল কুবরা, ইমাম নাসায়ী-  ১১/২৩৭ হাদিস ১১৪৫৮; ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার- ৭/৯, কিতাবুল মাগাজী]
 
ফায়দা: (১) উপরের এই হাদিস দুটি সম্পূর্ণ সহিহ সনদে বর্ণিত। হাদিস দুটি একথার সুস্পষ্ট দলিল হয় যে- (১-ক) সুরা হজ্জের ৩৯ এবং ৪০ নং আয়াত দুটি ক্বিতাল (সশস্ত্র জিহাদ)-এর অনুমতি বিষয়ক নাজিল হওয়া কুরআনের সর্বপ্রথম আয়াত। আর (১-খ) রাসুলুল্লাহ ﷺ হিজরতের উদ্দেশ্যে মক্কা থেকে বের হওয়ার পর কোনো এক সময় এই আয়াতটি নাজিল হয়; হিজরতের আগে নয়। আর বিষয়টি এজন্য আরো জোরালো যে, ১ম হাদিসটি রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর একমাত্র হিজরত সঙ্গি ও সর্বশ্রেষ্ঠ সাহাবী হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর নিজের চাক্ষুস বর্ণনা, আর ২য় হাদিসটি হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর প্রিয় কন্যা উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা রা.-এর বর্ণনা, যা তিঁনি অবশ্যই তার পিতার সূত্রেই জেনে বর্ণনা করে থাকবেন। ‘ক্বিতাল (সশস্ত্র জিহাদ) বিষয়ক নাজিল হওয়া আয়াতসমূহের মধ্যে এই আয়াতটি যে সর্বপ্রথমে নাজিল হয়েছে’ সে মর্মে ইমাম মুজাহিদ, ইবনে যায়েদ, ক্বাতাদাহ, যাহহাক, উরওয়াহ ইবনে যুবায়ের, আ’মাশ, মুক্বাতিল বিন হাইয়্যান রহ. প্রমুখ থেকেও একই মত বর্ণিত হয়েছে। (১-গ) এই আয়াত দুটি যে মক্কায় নাজিল হয়নি, বরং মক্কা থেকে বের হওয়ার পর নাজিল হয়েছিল তার একটি প্রমাণ হল, আয়াতে বলা হয়েছে- الَّذِينَ أُخْرِجُوا مِن دِيَارِهِم بِغَيْرِ حَقٍّ إِلَّا أَن يَقُولُوا رَبُّنَا اللَّهُ – “যাদেরকে নাহক্ব (অন্যায়) ভাবে তাদের ঘরবাড়ি থেকে বেড় করে দেয়া হয়েছে, (তাদের দোষ ছিল এই যে,) তারা শুধু বলতো – ‘আল্লাহ আমাদের রব (প্রভু); (কোনো মুর্তিও নয়, কোনো মানুষও নয়; আমরা কেবল আমাদের রব আল্লাহ তাআলার হুকুমই মানবো)”। তার মানে, রাসুলুল্লাহ ﷺ ও তাঁর সাহাবীগণকে মক্কা থেকে বের করে দেয়ার পরই সে ঘটনাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে এ আয়াত নাজিল হয়েছে। [জামেউল বায়ান, ইমাম ত্বাবারী- ১৭/১২৩; তাফসীরে ইমাম ছাউরী- ১/২১৪ আছার ৬৯০; যাদুল মাআদ, ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম– ৩/৬৩; তাফসিরে ইবনে কাসির- ৫/৪৩৩; আল-হাউয়ী লিল-ফাতাওয়া, ইমাম সুয়ূতী- ১/২৮৮]
 
(২) সুরা হজ্জের ৩৯ এবং ৪০ নং আয়াত দুটি ক্বিতাল (সশস্ত্র জিহাদ)-এর অনুমতি বিষয়ক নাজিল হওয়া কুরআনের সর্বপ্রথম আয়াত। আর (১-খ) রাসুলুল্লাহ ﷺ হিজরতের উদ্দেশ্যে মক্কা থেকে বের হওয়ার পর কোনো এক সময় এই আয়াতটি নাজিল হয়; হিজরতের আগে নয়। আর বিষয়টি এজন্য আরো জোরালো যে, ১ম হাদিসটি রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর একমাত্র হিজরত সঙ্গি ও সর্বশ্রেষ্ঠ সাহাবী হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর নিজের চাক্ষুস বর্ণনা, আর ২য় হাদিসটি হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর প্রিয় কন্যা উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা রা.-এর বর্ণনা, যা তিঁনি অবশ্যই তার পিতার সূত্রেই জেনে বর্ণনা করে থাকবেন। ‘ক্বিতাল (সশস্ত্র জিহাদ) বিষয়ক নাজিল হওয়া আয়াতসমূহের মধ্যে এই আয়াতটি যে সর্বপ্রথমে নাজিল হয়েছে’ সে মর্মে ইমাম মুজাহিদ, ইবনে যায়েদ, ক্বাতাদাহ, যাহহাক, উরওয়াহ ইবনে যুবায়ের, আ’মাশ, মুক্বাতিল বিন হাইয়্যান রহ. প্রমুখ থেকেও একই মত বর্ণিত হয়েছে। (১-গ) এই আয়াত দুটি যে মক্কায় নাজিল হয়নি, বরং মক্কা থেকে বের হওয়ার পর নাজিল হয়েছিল তার একটি প্রমাণ হল, আয়াতে বলা হয়েছে- الَّذِينَ أُخْرِجُوا مِن دِيَارِهِم بِغَيْرِ حَقٍّ إِلَّا أَن يَقُولُوا رَبُّنَا اللَّهُ – “যাদেরকে নাহক্ব (অন্যায়) ভাবে তাদের ঘরবাড়ি থেকে বেড় করে দেয়া হয়েছে, (তাদের দোষ ছিল এই যে,) তারা শুধু বলতো – ‘আল্লাহ আমাদের রব (প্রভু); (কোনো মুর্তিও নয়, কোনো মানুষও নয়; আমরা কেবল আমাদের রব আল্লাহ তাআলার হুকুমই মানবো)”। তার মানে, রাসুলুল্লাহ ﷺ ও তাঁর সাহাবীগণকে মক্কা থেকে বের করে দেয়ার পরই সে ঘটনাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে এ আয়াত নাজিল হয়েছে। [জামেউল বায়ান, ইমাম ত্বাবারী- ১৭/১২৩; তাফসীরে ইমাম ছাউরী- ১/২১৪ আছার ৬৯০; যাদুল মাআদ, ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম– ৩/৬৩; তাফসিরে ইবনে কাসির- ৫/৪৩৩; আল-হাউয়ী লিল-ফাতাওয়া, ইমাম সুয়ূতী- ১/২৮৮]
 
নিচে সুরা হজ্জের ৩৯ এবং ৪০ নং আয়াতের সাথে ৪১ নং আয়াতটিরও তরজমা পেশ করে দিলাম, যাতে বোঝা যায় যে, ‘জিহাদের অনুমতি’ দানের সাথে ‘জমিনে খিলাফত ব্যবস্থা কায়েম’-এর কতটা নিবিড় সম্পর্ক যে, আয়াত তিনটিতে এই দুটি বিষয়কে একই বন্ধনে রাখা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে-
 
  أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوا ۚ وَإِنَّ اللَّهَ عَلَىٰ نَصْرِهِمْ لَقَدِيرٌ – الَّذِينَ أُخْرِجُوا مِن دِيَارِهِم بِغَيْرِ حَقٍّ إِلَّا أَن يَقُولُوا رَبُّنَا اللَّهُ ۗ وَلَوْلَا دَفْعُ اللَّهِ النَّاسَ بَعْضَهُم بِبَعْضٍ لَّهُدِّمَتْ صَوَامِعُ وَبِيَعٌ وَصَلَوَاتٌ وَمَسَاجِدُ يُذْكَرُ فِيهَا اسْمُ اللَّهِ كَثِيرًا ۗ وَلَيَنصُرَنَّ اللَّهُ مَن يَنصُرُهُ ۗ إِنَّ اللَّهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ – الَّذِينَ إِن مَّكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنكَرِ ۗ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُورِ  
“‘(৩৯) (তোমাদের মুসলমানদের মধ্যে) যাদের বিরুদ্ধে ক্বিতাল (যুদ্ধ) করা হবে, তাদেরকে (আল্লাহ’র পক্ষ থেকে ক্বিতাল//সশস্ত্র জিহাদ/যুদ্ধ চালানোর) অনুমতি দেয়া হল। তা এজন্য যে, তারা (কাফেরদের দ্বারা) জুলুমের শিকার হয়েছে। আর নিশ্চই আল্লাহ (তাআলা) তাদেরকে সাহায্য করতে পূর্ণ ক্ষমতাবান। (৪০) যাদেরকে নাহক্ব (অন্যায়) ভাবে তাদের ঘরবাড়ি থেকে বেড় করে দেয়া হয়েছে, (তাদের দোষ ছিল এই যে,) তারা শুধু বলতো – ‘আল্লাহ আমাদের রব (প্রতিপালক প্রভু); (কোনো মুর্তিও নয়, কোনো মানুষও নয়; আমরা কেবল আমাদের রব আল্লাহ তাআলার হুকুমই মানবো)। আর আল্লাহ যদি তাদের কতককে কতকের মাধ্যমে দিফা/প্রতিহত (করার ব্যবস্থা) না করতেন, (তাহলে) তারা অবশ্যই বিধ্বস্ত করে দিতো উপাসনালয়গুলোকে, গীর্জা, ইহুদীদের উপাসনালয়গুলোকে এবং মসজিদগুলোকে -যেগুলোর মধ্যে অধিক পরিমাণে আল্লাহ’র নাম স্মরণ করা হয়। আল্লাহ অবশ্যই তাদেরকে সাহায্য করবে, যারা তাঁকে (তাঁর দ্বীন কায়েমের কাজে) সাহায্য করবে। নিশ্চই আল্লাহ অবশ্যই মহা শক্তিমান, মহা পরাক্রমশালী (৪১) (আর তারা হল আমার সেই সকল মুমিন বান্দা) যারা (এমন গুণের অধিকারী যে,) যদি তাদেরকে জমিনে শাসন-কর্তৃত্ব (খিলাফত) দেয়া হয়, তাহলে তারা নামায কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, মা’রুফ (সৎ বিষয়)-এর নির্দেশ দেয় এবং মুনকার (নাজায়েয ও হারাম বিষয়) থেকে নিষেধ করে। আর সকল বিষয়ের পরিণতি আল্লাহ’র কাছে”[সূরা হজ্জ ৩৯-৪১]
 
ফায়দা: সুরা হজ্জের এই আয়াতগুলোর মধ্যে বহু গুরুত্বপূর্ণ মাসআলাহ নিহিত রয়েছে, যা পাঠকবৃন্দের খুব ভালো করে বুঝে নেয়া জরুরী। যথা-
 
(১) মুহাক্কেক অলেমগণের মতে, সুরা হজ্জ-এর এই ৩৯ নং আয়াত’টিতে আল্লাহ তাআলা’র এরশাদ- “أُذِنَ – “অনুমতি দেয়া হল” -দ্বারা উদ্দেশ্য হল- رخّص“অনুমোদন/বৈধতা দেয়া হল” বা أُبِيحَ – “মুবাহ (বৈধ/জায়েয) করা হল”। এখানে মুবাহ (বৈধ/জায়েয) অর্থ হল- “এতদিন পর্যন্ত দ্বীনের দুশমন কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নেয়া তথা ‘সশস্ত্র জিহাদ’ করার ব্যাপারে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল-এর পক্ষ থেকে মুসলমানদের উপরে যে নিষেধাজ্ঞা চলে আসছিল, সেই নিষেধাজ্ঞাটি এই আয়াতটি নাজিলের মাধ্যমে তুলে নেয়া হল এবং এখন থেকে ‘সশস্ত্র জিহাদ’ জায়েয করা হল”। আইম্মায়ে ফুকাহা ও মুহাক্কেক আলেমগণের মতে, এই আয়াতের মধ্যে তখনকার মুসলমানদের উপরে ক্বিতাল (সশস্ত্র জিহাদ) ফরয করে দেয়ার ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা বিদ্যমান ছিল না, (ক্বিতাল (বা শস্ত্র জিহাদ ফরয করা হয়েছিল আরো অনেক পরে, যার আলোচনা সামনে আসছে)। [আহকামুল কুরআন, ইমাম ইবনুল আরাবী- ৩/৩০০; জামে’ লি-আহকামিল কুরআন, ইমাম কুরতুবী- ১২/৬৮; আল-উম্মু, ইমাম শাফেয়ী- ৪/১৬১; তাফসীরুল কুরআন, ইমাম মানসুর সামআনী- ৩/২৩; আল-হাউয়ীউল কাবীর, ইমাম সুয়ূতী- ১/২৪৬; ফাতহুল কাদীর, শাওকানী- ৩/৪৫৬; আল-কিতাল ওয়াল জিহাদ, মুহাম্মাদ খায়র হায়কাল- ১/৪৬৩; তাফসীরুল মুনীর, ওয়াহবাহ যুহাইলী- ১৭/২২৪]  
 
(২) সুরা হজ্জ-এর এই ৩৯ নং আয়াত’টিতে আল্লাহ তাআলা’র এরশাদ- أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ – “(তোমাদের মুসলমানদের মধ্যে) যাদের বিরুদ্ধে ক্বিতাল (যুদ্ধ) করা হবে, তাদেরকে (আল্লাহ’র পক্ষ থেকে ক্বিতাল//সশস্ত্র জিহাদ/যুদ্ধ চালানোর) অনুমতি দেয়া হলবলে, এ অনুমতির কারণ সম্পর্কে বলা হয়েছে- بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوا – “তা এজন্য যে, তারা (কাফেরদের দ্বারা) জুলুমের শিকার হয়েছে। তারপর সুরা হজ্জ-এর ৩০ নং আয়াত’টিতে তাদের সম্পর্কে আরো বলা হয়েছে- الَّذِينَ أُخْرِجُوا مِن دِيَارِهِم بِغَيْرِ حَقٍّ إِلَّا أَن يَقُولُوا رَبُّنَا اللَّهُ – “যাদেরকে নাহক্ব (অন্যায়) ভাবে তাদের ঘরবাড়ি থেকে বেড় করে দেয়া হয়েছে, (তাদের দোষ ছিল এই যে,) তারা শুধু বলতো – ‘আল্লাহ আমাদের রব (প্রভু); (কোনো মুর্তিও নয়, কোনো মানুষও নয়; আমরা কেবল আমাদের রব আল্লাহ তাআলার হুকুমই মানবো)। এসকল বিষয় স্পষ্ট প্রমাণ করে যে, (২-ক) এখানে মক্কার মুসলমানদের কথা বলা হচ্ছে, যাঁরা –শুধুমাত্র আল্লাহ’র দ্বীন ইসলাম কবুল করার কারণে– বিগত প্রায় দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে মক্কার মুশরেকদের হাতে নির্মম জুলুম ও অন্যায় অত্যাচারের শিকার হয়ে আসছিলেন এবং যিঁনি যখন সুযোগ পেয়েছেন তিঁনি তখনই ইমান ও জীবন বাঁনোর তাগিদে মক্কা ছেড়ে অন্য নিরাপদ কোথাও হিজরত করেছেন। হিজরতের এ ধারা নবুওতের প্রায় ৫ম বছর থেকে শুরু হয়ে আজ নবুওতের ১৪ তম বছরে এ আয়াতটি নাজিল হওয়ার সময় পর্যন্ত অব্যাহত ছিল; খোদ রাসুলুল্লাহ ﷺ ও আবু বকর রা. একই কারণে মক্কা ছেড়ে ইয়াসরিব (মদিনা)-এর দিকে হিজরত করছিলেন, এমতাবস্থায় চলার পথেই কোথাও এই আয়াতটি নাজিল হয়। (২-খ) এর আগের আলোচনায় আমরা দেখিয়ে এসেছি যে, মক্কার জীবনে মজলুম মুসলমানগণ মক্কার মুশরেকদের জুলুম অত্যাচারকে প্রতিহত করণার্থে তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়ার জন্য রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে অনুমতি চেয়েছিলেন, কিন্তু তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ এই বলে অনুমতি দেননি যে- إِنِّي أُمِرْتُ بِالْعَفْوِ ، فَلَا تُقَاتِلُوا الْقَوْمَ – “আমাকে ক্ষমা করে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কাজেই (আল্লাহ’র পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট হুকুম না আসা পর্যন্ত) তোমরা (তোমাদের) কওমের সাথে কিতাল (সশস্ত্র যুদ্ধ) করো না। সুরা হজ্জ-এর এই ৩৯ নং আয়াত দ্বারা এই নিষেধাজ্ঞাটিকেই উঠিয়ে নেয়া হল এবং ইয়াসরিব (মদিনা)-এ হিজরতকারী মুহাজির মুসলমানগণকে সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হল। [সুনানুল কুবরা, ইমাম নাসায়ী- ১০/৬৮ হাদিস ১১০৪৭; মুসতাদরাকে হাকিম- ২/৩৮৩ হাদিস ২৪২৪; আত-তাহরিরুত তানউয়ীর, ইবনু আশুর- ১৮/২৭৩]
 
(৩) এর আগে নবুওদের ১৩ তম বছরে মদিনার মুসলমানগণ মক্কায় রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে এসে ‘আক্বাবাহ’র ২য় বাইয়াত’-এর সময় এই শপথ নিয়েছিলেন যে, তাঁরা ইয়াসরিব (মদিনা)য় রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে দ্বীন ইসলামের সকল দুশমনের হাত থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করণের জন্য প্রয়োজন হলে যুদ্ধ করে নিজেদের জীবন ও ধ্বনসম্পদ উৎসর্গ করে দিতেও কুন্ঠিত হবেন না, তখন সাহাবী আব্বাস বিন উবাদাহ বিন নাদ্বলাহ রা. বলেছিলেন যে- وَالَّذِي بَعَثَكَ بِالْحَقِّ لَئِنْ شِئْتَ لَنَمِيلَنَّ عَلَى أَهْلِ مِنًى غَدًا بِأَسْيَافِنَا – “(ইয়া রাসুলাল্লাহ!) ওই সত্ত্বার কসম যিঁনি আপনাকে সত্য সহকারে পাঠিয়েছেন, আপনি যদি চান তাহলে আগামিকাল আমরা মিনা’য় অবস্থানকারী (মক্কার মুশরেক)দের উপরে আমাদের তরবারীর সাহায্যে আক্রমন চালাতে পারি”, তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছিলেন- لَمْ أُؤمَرْ بِذَلِكَ  – “আমাকে (এখনো পর্যন্ত) এব্যাপের নির্দেশ দেয়া হয়নি। (সুতরাং, তোমরা এমন কিছুই করতে যাবে না)”। এটা একথার দলিল যে, ‘আক্বাবাহ’র ২য় বাইয়াত’-এর সময় মদিনার মুসলমানগণ রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে যে যুদ্ধের বাইয়াত করেছিলেন, সেটা মদিনাবাসী মুসলমানদের উপরে -নবুওদের ১৩ তম বছরে সংঘটিত উক্ত বাইয়াতের দিন থেকেই- কার্যকর হবার জন্য ছিল নয়, বরং যখন আল্লাহ তাআলা’র পক্ষ থেকে অনুমতি আসবে, তখন থেকে কার্যকর হবে, তার আগ পর্যন্ত নিষিদ্ধ থাকেবে। বস্তুত: সুরা হজ্জ-এর এই ৩৯ নং আয়াত’টিতে আল্লাহ তাআলা’র এরশাদ- أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ – “(তোমাদের মুসলমানদের মধ্যে) যাদের বিরুদ্ধে ক্বিতাল (যুদ্ধ) করা হবে, তাদেরকে (আল্লাহ’র পক্ষ থেকে ক্বিতাল//সশস্ত্র জিহাদ/যুদ্ধ চালানোর) অনুমতি দেয়া হল” –এই আয়াতাংশের দ্বারাই মদিনাবাসী মুসলমানদেরকেও ইসলামের দুশমনদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়ার নিষেধাজ্ঞাটি উঠিয়ে নিয়ে তাঁদেরকে ‘সশস্ত্র জিহাদ’ করার অনুমতির দেয়া হল, কারণ রাসুলুল্লাহ ﷺ ইয়াসরিব (মদিনা)-এ প্রবেশ করলেই সেখানকার অধিবাসী মুসলমানগণের উপরে ‘আক্বাবাহ’র ২য় বাইয়াত’-এ কৃত প্রতিরক্ষা’র ওয়াদা পূরণের সময় শুরু হয়ে যাবে[মুসনাদে আহমদ– ২৫/৮৯ হাদিস ১৫৭৯৮, ৩৭/৩৭৩  হাদিস ২২৭০০; দালাইলুন নুবুওয়াহ, ইমাম বাইহাকী- ২/৪৪৪; আত-তাহরিরুত তানউয়ীর, ইবনু আশুর- ১৮/২৭৩] 
 
(৪) সুরা হজ্জ-এর এই ৩৯ নং আয়াত’টিতে আল্লাহ তাআলা’ “أُذِنَ – “(ক্বিতাল//সশস্ত্র জিহাদ/যুদ্ধ চালানোর) অনুমতি দেয়া হল” বলে তারপর -‘কাদেরকে ‘সশস্ত্র জিহাদ/যুদ্ধ’ করার অনুমতি দেয়া হচ্ছে’, তাদের বৈশিষ্ট ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এরশাদ করেছেন- لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ – “(তোমাদের মুসলমানদের মধ্যে) যাদের বিরুদ্ধে ক্বিতাল (যুদ্ধ) করা হবে”। এর দ্বারা এদিকে ইশারা করা হয়েছে যে, ইসলামের দুশমনরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রথমে যুদ্ধে নামলে বা নামতে উদ্দত হলে, কেবলমাত্র তখনই মুসলমানগণ দুশমনকে প্রতিহত করার জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নেয়ার অনুমতি পাবে। আর যখন দুশমন মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোনো যুদ্ধই করছে না বা  করতে উদ্দতও হচ্ছে না, সেই পরিস্থিতিতে মুসলমানদের জন্য দুশমনদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়ার (তথা সশস্ত্র জিহাদ করার) কোনো অনুমতি এই আয়াতে দেয়া হয়নি। অন্য কথায়, এই আয়াতে মুসলমানদেরকে শুধুমাত্র দিফায়ী জিহাদ (আত্মরক্ষা মূলক সশস্ত্র যুদ্ধ) করার অনুমতি দেয়া হয়েছে -দুশমনের আক্রমন থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য, তাও আবার শুধু ওই ক্ষেত্রে যখন প্রথমে দুশমনরা মুসলমানদের উপরে আক্রমন করতে আসবে। অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা’র এরশাদ- أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ – “(তোমাদের মুসলমানদের মধ্যে) যাদের বিরুদ্ধে ক্বিতাল (যুদ্ধ) করা হবে, তাদেরকে (আল্লাহ’র পক্ষ থেকে ক্বিতাল//সশস্ত্র জিহাদ/যুদ্ধ চালানোর) অনুমতি দেয়া হল-এর আলোকে এখন থেকে (পরবর্তী ব্যাতিক্রমী কোনো  নির্দেশ নাজিল না হওয়া পর্যন্ত) মদিনায় হিজরত করে আসা মুহাজির মুসলমানগণ এবং আগে থেকেই মদিনাতে বসবাসকারী আনসার মুসলমানগণ -উভয়ে যৌথ ভাবে দিফায়ী জিহাদ (আত্মরক্ষা মূলক সশস্ত্র যুদ্ধ) পরিচালনার মাধ্যমে দুশমনের আক্রমন প্রতিহত করতে পারবে। [জাহরাতুত তাফাসীর, আবু জাহরাহ- ৯/৪৯৯১; তাফসীরুল মুনীর, ওয়াহবাহ যুহাইলী- ১৭/২২৪; আল-কিতাল ওয়াল জিহাদ, মুহাম্মাদ খায়র হায়কাল- ১/৪৬৪]
 
(৫) এখানে একথাও জানা জরুরী যে, এ আয়াতের দ্বারা তখনকার মদিনার (মুহাজির ও আনসার) মুসলমানদের জন্য ‘দিফায়ী জিহাদ (আত্মরক্ষা মূলক সশস্ত্র যুদ্ধ) মুবাহ (অনুমোদিত/বৈধ/জায়েয) করা হয়েছিল’ মানে তার অর্থ এই ছিল না যে, ‘কাফের মুশরেকদের দ্বারা সশস্ত্র আক্রমনের শিকার হলেও দিফায়ী জিহাদ করাটা মুসলমানদের ঐচ্ছিক বিষয় ছিল যে, যার ইচ্ছে তিনি জিহাদে শরিক হবেন ও জিহাদের সওয়াব পাবেন, আর যার ইচ্ছে নেই তিনি জিহাদে শরিক হবেন না ও তার এতে কোনো পাপও হবে না’। এমনটা কখনোই নয়। বরং, এক্ষেত্রে এই ‘দিফায়ী জিহাদ (আত্মরক্ষা মূলক সশস্ত্র যুদ্ধ) মুবাহ (অনুমোদিত/বৈধ/জায়েয) হওয়ার অর্থ কেবল এতটুুকু যে — “এতদিন পর্যন্ত দ্বীনের দুশমন কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নেয়া তথা ‘সশস্ত্র জিহাদ’ করার ব্যাপারে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল-এর পক্ষ থেকে মুসলমানদের উপরে যে নিষেধাজ্ঞা চলে আসছিল, সেই নিষেধাজ্ঞাটি এই আয়াতটি নাজিলের মাধ্যমে তুলে নেয়া এবং এখন থেকে মুসলমানদের জন্য ‘সশস্ত্র জিহাদ’ বৈধ/জায়েয করা”। অর্থাৎ, সশস্ত্র জিহাদের অনুমতি দেয়া হল বলেই মুসলমানরা এই ‘দিফায়ী জিহাদ (আত্মরক্ষা মূলক সশস্ত্র যুদ্ধ) করার সুযোগ লাভ করলো। এই অনুমতি’টুকুন না দেয়া হলে তো তখনো পর্যন্ত সশস্ত্র জিহাদ করাটা মুসলমানদের জন্য হারাম ও না-জায়েযই থাকতো। এখন অনুমতি দেয়া হল যে, কাফের মুশরেকদের দ্বারা সশস্ত্র আক্রমনের শিকার হলে তাদেরকে প্রতিহত করার জন্য মুসলমানরা দিফায়ী জিহাদ (আত্মরক্ষা মূলক সশস্ত্র যুদ্ধ) করতে পারবে। বাস, সুরা হজ্জ-এর ৩৯ নং আয়াত’টিতে আল্লাহ তাআলা’র এরশাদ- “أُذِنَ – “অনুমতি দেয়া হল” -এর অর্থ শুধু এতটুকুই। এই আয়াতে বলা নেই যে, এই অনুমতিটি’র প্রয়োগ-মান কী? এটা কি -মুস্তাহাব, ওয়াজিব, নাকি ফরয।
 
মুহাক্কেক আলেমগণের মতে, তখনো পর্যন্ত যদিও (মুহাজির ও আনসার) মুসলমানদের উপরে ‘সশস্ত্র জিহাদ’ ফরয হয়নি (ফরয হয়েছিল আরো অনেক পরে তথা ১ম হিজরীর শেষের দিকে কিংবা ২য় হিজরীর প্রথম দিকে), কিন্তু তখন এই ‘দিফায়ী জিহাদ (আত্মরক্ষা মূলক সশস্ত্র যুদ্ধ)টি মুবাহ (অনুমোদিত/বৈধ/জায়েয) হওয়ার অর্থ এই ছিল যে, “মদিনার (মুহাজির ও আনসার) মুসলমানগণ সশস্ত্র জিহাদের অনুমতি পেয়ে থাকলো, এভাবে পরিস্থিতি যতদিন বিনা-যুদ্ধে স্বাভাবিক অবস্থায় চলতে থাকবে থাকুক, কিন্তু যখনই কাফের-মুশরেকরা মদিনার মুসলমানদের উপরে সশস্ত্র আক্রমন করবে, তখন মদিনায় বসবাসকারী সকল (মুহাজির ও আনসার) মুসলমানদের উপরে ওইসব কাফের-মুশরেকদের আক্রমনকে প্রতিহত করা ফরয হয়ে যাবে। ‘আক্বাবা’র ২য় বাইয়াত’-এর সময় মদিনার মুসলমানগণ তো দরকার হলে গোটা দুনিয়ার আক্রমন থেকে –রাসুলুল্লাহ ﷺ, দ্বীন ইসলাম এবং মুসলমানদেরকে হিফাজত ও নিরাপত্তা দানের জন্য প্রয়োজনে নিজেদের জীবন ও ধ্বনসম্পদ উৎসর্গ করার এই ওয়াদাই করে এসেছিলেন। পরে মুহাজির মুসলমানগণ যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় এলেন, তখন তারাও মদিনার আনসার মুসলমাদের সাথে এক দেহের মতো একই উদ্দেশ্য নিয়ে একাকার হয়ে গেলেন, ফলে একই কারণে মুহাজির মুসলমানদের উপরও এধরনের পরিস্থিতিতে ‘দিফায়ী জিহাদ (আত্মরক্ষা মূলক সশস্ত্র যুদ্ধ) করা ফরয হয়ে গেল। দুশমনরা সশস্ত্র আক্রমন না করলে মদিনার মুহাজির ও আনসার কোনো মুসলমানের উপরই সশস্ত্র জিহাদ ফরয থাকবে না (যতদিন পর্যন্ত সশস্ত্র জিহাদ ফরয হওয়ার হুকুম নাজিল না হয়)। [আল-কিতাল ওয়াল জিহাদ, মুহাম্মাদ খায়র হায়কাল- ১/৪৬৩, ৪৬৪]  
 
(৬-ক) মুহাক্কেক অলেমগণের মতে, সুরা হজ্জ-এর এই ৩৯ নং আয়াত’টিতে আল্লাহ তাআলা’র এরশাদ- “أُذِنَ – “অনুমতি দেয়া হল” -এই কথাটির মধ্যে ইক্বদামী জিহাদ (অগ্রগামী আক্রমনাত্মক সশস্ত্র জিহাদ)ও অন্তর্ভূক্ত ছিল, যা শুধু মুবাহ (বৈধ/জাযেয) পর্যায়ের ছিল; তখনো পর্যন্ত তা ফরয করা হয়নি। (৬-খ) ইক্বদামী জিহাদ (অগ্রগামী আক্রমনাত্মক সশস্ত্র জিহাদ)-এর অর্থ হল, “দ্বীনের দুশমন কাফেল মুশরেকরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার সশস্ত্র আক্রমন চালায়নি, কিন্তু মুসলমানরা (শরয়ী কিছু শর্ত সাপেক্ষে) নিজেরাই আগ বেড়েই দুশমনদের উপরে সশস্ত্র জিহাদ পরিচালনা করা, যাতে দুশমনদের  শক্তিসামর্থ ধ্বংস বা অকেজো হয়ে যায় এবং তাদের উপরে মুসলমানদের প্রাধান্য ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা পেয়ে আল্লাহ’র দ্বীন ইসলাম পৃথিবীর বুকে সুউচ্চে সমুন্নত থাকে”(৬-গ) সুরা হজ্জ-এর এই ৩৯ নং আয়াত’টির হুকুম বলবৎ থাকা পর্যন্ত ‘দিফায়ী জিহাদ (আত্মরক্ষা মূলক সশস্ত্র যুদ্ধ) এবং ইক্বদামী জিহাদ (অগ্রগামী আক্রমনাত্মক সশস্ত্র জিহাদ) -এর মধ্যে এই পার্থক্য ছিল যে, ‘দিফায়ী জিহাদ (আত্মরক্ষা মূলক সশস্ত্র যুদ্ধ) মূলে মুবাহ (বৈধ/জায়েয) ছিল তবে দুশমনরা আক্রমন করলে তাদেরকে প্রতিহত করাটা মদিনার মুসলমানদের উপরে ফরয হয়ে যেতো, অপরদিকে ইক্বদামী জিহাদ (অগ্রগামী আক্রমনাত্মক সশস্ত্র জিহাদ) মূলে মুবাহ (বৈধ/জায়েয)-ই ছিল, তবে তখন কোনো অবস্থাতেই ইক্বদামী জিহাদ (অগ্রগামী আক্রমনাত্মক সশস্ত্র জিহাদ) করা কারোর উপরেই ফরয হওয়ার ছিল না। (৬-ঘ) ইক্বদামী জিহাদ (অগ্রগামী আক্রমনাত্মক সশস্ত্র জিহাদ) মূলে মুবাহ (বৈধ/জায়েয) হওয়ার অর্থ এও ছিল যে, রাসুলুল্লাহ ﷺ মদিনার পথে চলার সময় রাস্তাপথে যখন সশস্ত্র জিহাদের এই অনুমতি দেয়া হল, তখন যদি তাঁর এত পরিমাণ মুজাহির সাহাবা সঙ্গে থাকতো, যাদের সাহায্যে যুদ্ধ করে মক্কা নগরীর উপরে পূর্ণ কবজা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হতেন তাহলে সেটা করাও রাসুলুল্লাহ ﷺ এবং মুহাজির মুসলমানগণের জন্য জায়েয/বৈধ হত, (কিন্তু এটা ভিন্ন কথা যে, আল্লাহ’র ইচ্ছে ছিল অন্য রকম, ফলে রাসুলুল্লাহ ﷺ মদিনায় যাওয়ার পর থেকে নিয়ে বহু যুদ্ধের পর অবশেষে ৮ম বছরে মক্কা বিজয় করেন)। [আল-কিতাল ওয়াল জিহাদ, মুহাম্মাদ খায়র হায়কাল- ১/৪৬৩, ৪৬৪]  
 
(৭) উপরের এই মাসআলাহ গুলো আলাদা আলাদা করে ব্যাখ্যা করে বুঝানোর পরেও মনে হচ্ছে যে, অনেক পাঠকের কাছে মুবাহ ও ফরয নিয়ে এখনো সামান্য কিছু বিষয়ের সুক্ষ জট রয়েই গেছে। তাদের মাথায় হয়তো একথা বুঝে আসছে না যে, “একদিকে বলা হচ্ছে যে, এই আয়াতে মুসলমানদের জন্য সশস্ত্র জিহাদ’কে মুবাহ (বৈধ/জায়েয) করা হয়েছিল, কিন্তু তখনো পর্যন্ত সশস্ত্র জিহাদ’কে ফরয করা হয়নি, আবার বলা হচ্ছে যে, দুশমনরা আক্রমন করলে তখন মুসলমানদের উপরে সেই আক্রমন প্রতিহত করা ফরয হয়ে যাবে”; তাহলে এখানে এই দুই প্রকারের ‘ফরয’-এর মধ্যে কী পার্থক্য?
 
আল্লাহ তাআলা (১ম হিজরীর শেষের দিকে কিংবা ২য় হিজরীর প্রথম দিকে) যখন ‘সশস্ত্র জিহাদ’কে মুসলমানদের উপরে ফরয করে দিয়েছিলেন, তখন এর অর্থ এই দাঁড়ালো যে- ‘তখন থেকে মুসলমানদের উপরে ‘দিফায়ী জিহাদ (আত্মরক্ষা মূলক সশস্ত্র যুদ্ধ) এবং ইক্বদামী জিহাদ (অগ্রগামী আক্রমনাত্মক সশস্ত্র জিহাদ) -দু প্রকার সশস্ত্র জিহাদই ফরয হয়ে গেল, যার শরয়ী বিধান সর্বাবস্থায় হয় ‘ফরযে কেফায়া’ অবস্থায় থাকবে, না হয় ‘ফরযে আইন’ অবস্থায়। অর্থাৎ, ‘সশস্ত্র জিহাদ’ ফরয হওয়ার পর থেকে সেই বিধানটি আর মুবাহ (বৈধ/জায়েয) পর্যায়ের নফল ইবাদতের স্তরে থাকার কোনো সুযোগ নেই, ঠিক যেমনি ভাবে মক্কার জীবনে একসময় সালাত (নামায) নফল অবস্থায় থাকার পর মিরাজের রজনীতে যখন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত (নামায)কে ফরয করা হল, তখন সেই পাঁচ ওয়াক্ত সালাত (নামায) আজীবনের জন্য ফরযই রয়ে গেল, সেটা আর নফল হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। (‘সশস্ত্র জিহাদ’ কী অবস্থায় ‘ফরযে কেফায়া’ হয়, আর কী অবস্থায় সেটা ‘ফরযে আইন’ হয় -তার আলোচনা সামনে আসছে)। [আল-হাউয়ীউল কাবীর, ইমাম সুয়ূতী- ১/২৪৬; আস সিরাতুন নাবাউইয়্যাহ, আবু শুহবাহ- ১/৮৫, ৮৬; মাঈনুস সিরাহ, সালেহ আহমদ শামী- ১/১৭৫; আল-কিতাল ওয়াল জিহাদ, মুহাম্মাদ খায়র হায়কাল- ১/৪৬৩, ৪৬৪]
 
(৮) সুরা হজ্জ-এর ৪০ নং আয়াত’টিতে আল্লাহ তাআলা’র এরশাদ-  الَّذِينَ أُخْرِجُوا مِن دِيَارِهِم بِغَيْرِ حَقٍّ إِلَّا أَن يَقُولُوا رَبُّنَا اللَّهُ – “যাদেরকে নাহক্ব (অন্যায়) ভাবে তাদের ঘরবাড়ি থেকে বেড় করে দেয়া হয়েছে, (তাদের দোষ ছিল এই যে,) তারা শুধু বলতো – ‘আল্লাহ আমাদের রব (প্রভু); (কোনো মুর্তিও নয়, কোনো মানুষও নয়; আমরা কেবল আমাদের রব আল্লাহ তাআলার হুকুমই মানবো)-এর সকল মধ্যে- بِغَيْرِ حَقٍّ – “নাহক্ব (অন্যায়) ভাবে -কথাটির অর্থ হল- بغير موجب في الإخراج استحقوا به – “যে কারণে কাউকে (দেশ থেকে) বের করে দেয়া অপরিহার্য হয়ে যায়, সেরকম কারণ ব্যাতিরেকে (অযথা অন্যায় ভাবে বের করে দেয়া)”। মক্কার মুশরেকরা মুসলমানদেরকে শুধুমাত্র যে কারণে মক্কা থেকে বের করে দেয়াটাকে বৈধ ও সঠিক পদক্ষেপ বলে মনে করতো, সেটা হল, মুসলমানরা মুশরকেদের হাজার বছরের পরম্পরায় মেনে চলে আসা (মিথ্যা) সব দেব-দেবীদের মূর্তি পুঁজার (শিরকী ও কুফরী) সর্বস্ব ধর্ম পরিত্যাগ করে (তাঁদের প্রকৃত প্রভু-পালনকর্তা আল্লাহ’র নাজিলকৃত) ধর্ম ইসলামকে কবুল করে নিয়েছিলেন। আল্লাহ’র ভাষায়- إِلَّا أَن يَقُولُوا رَبُّنَا اللَّهُ – “তারা শুধু বলতো – ‘আল্লাহ আমাদের রব (প্রতিপালক প্রভু); (কোনো মুর্তিও নয়, কোনো মানুষও নয়; আমরা কেবল আমাদের রব আল্লাহ তাআলার হুকুমই মানবো)। মসলমানদের এই স্লোগানটি তো ছিল মহা এক সত্য ও হক্বের উপর প্রতিষ্ঠিত, যে মহা সত্য ও হক্ব স্লোগানটির সাথে একাত্বতা প্রকাশ না করে উল্টো এর কারণেই মুসলমানদেরকে মক্কা থেকে বের করে দেয়াটা ছিল মুলত: আল্লাহ’র সাথেই চরম হঠকারিতা ও অহংকারের বহি:প্রকাশ এবং এক ভয়ঙ্কর না-হক্ব (অন্যায়) পদক্ষেপ। এ থেকে একথাও প্রমাণিত হয় যে, দ্বীন ইসলামের যাঁরা কান্ডারী ও ধারকবাহক মর্দে মুমিন, তাঁদেরকে যারা -দ্বীন ইসলামের প্রচার প্রসার ও  প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়জিত থাকার কারণে জেল-হাজতে আটকিয়ে রাখে জুলুম অত্যাচার করে কিংবা গুম করে অথবা দেশ থেকে বের করে দেয় কিংবা পথ থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য মেড়ে ফেলে, তারা অবশ্যই জালেম এবং তাদের পদক্ষেপও না-হক্ব (অন্যায়)। [আয়সারুত তাফাসীর, আবু বকর আল-জাযায়েরী- ৩/৪৭৮; তাফসীরুল মুনীর, ওয়াহবাহ যুহাইলী- ১৭/২২৫; ছফওয়াতুত তাফাসীর, মুহাম্মাদ আলী সাবুনী- ২/২৬৭]
 
(৯) উপরের আলোচনা থেকে একথাও প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল –যখন যে যে অবস্থায় যাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদ/যুদ্ধ করতে নিষিদ্ধ করেছেন -অনুমতি দেননি, তখন সেই সেই অবস্থায় তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদ/যুদ্ধ করা ইসলামী শরীয়তে হারাম ও নাজায়েয। একই ভাবে, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল –যখন যে যে অবস্থায় যাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদ/যুদ্ধ করার অনুমতি দিয়েছেন, কেবলমাত্র তখন সেই সেই অবস্থায় তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদ/যুদ্ধ করা ইসলামী শরীয়তে জায়েয/বৈধ। [আহকামুল কুরআন, ইমাম ইবনুল আরাবী- ৩/৩০০]
 
(১০) এখানে আরেকটি প্রণিধানযোগ্য বিষয় হল, যারা জোড়েসোড়ে একথা প্রচার করে বেড়ায় যে, সশস্ত্র জিহাদ করার জন্য সর্বাবস্থায় ‘ইসলামী রাষ্ট্র ও সেই রাষ্ট্রের আমীরে-আজম (খলিফা/রাষ্ট্রপ্রধান)-এর অনুমতি’ থাকা শর্ত, তা নাহলে সশস্ত্র জিহাদ করা জায়েয নয়”, তাদের বুঝটা যে অপরিপূর্ণ ও অসম্পূর্ণ, তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ হল, সুরা হজ্জের ৩৯ ও ৪০ নং আয়াত দুটি নাজিল হওয়ার মাধ্যমে ‘সশস্ত্র জিহাদের অনুমতি দেয়া হল এমন এক মুহূর্তে, যখন মুসলমানদের আমীর (দলপ্রধান) মুহাম্মাদ ﷺ-এর হাতে না ছিল কোনো রকম রাষ্ট্রক্ষমতা, আর না ছিল সহায়ক কোনো সৈন্যবাহিনী; না তিঁনি ‘কাফেরদের শাসনাধিন রাষ্ট্র/অঞ্চল’ মক্কার ভিতরে ছিলেন, আর না তিঁনি তখনো পর্যন্ত ‘মুসলমানদের শাসনাধিন রাষ্ট্র/অঞ্চল’ মদিনায় পা রেখেছিলেন; রাসুলুল্লাহ ﷺ তখন কোনো রাষ্ট্রেরই নাগরীক নন; একদম সৈন্যসামন্তহীন রাষ্ট্রহীন মুসাফীর এক আমীর (মুসলামনাদের দলপ্রধান) তখন তিঁনি। আল্লাহ তাআলা ঠিক এমন মুহূর্তে কেনো ‘সশস্ত্র জিহাদের অনুমতি’ নাজিল করলেন? আল্লাহ কি পারতেন না -রাসুলুল্লাহ ﷺ মদিনায় পা রাখার পর যখন মুহাজির ও আনসার মুসলমানদের একটি বিরাট জামাআতের মাঝে আমীর (দলপ্রধান) হিসেবে প্রবেশ করতেন -তখন ‘সশস্ত্র জিহাদের অনুমতি’ সহ আয়াত দুটি নাজিল করতে? বস্তুত: এমন রাষ্ট্রহীন সৈন্যহীন অবস্থায় রাস্তাপথে চলার সময় যখন এই আয়াত দুটি নাজিল হয়েছিল, তখন যদি শত্রুরা তাঁদের দুজনের উপরে আক্রমন করতো, তাহলে রাসুলুল্লাহ ﷺ ও আবু বকর রা.-এর জন্য দুশমনদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়া ও জিহাদ করতে করতে শহিদ হয়ে যাওয়া জায়েয ছিল। এটা একথারই প্রকৃষ্ট প্রমাণ যে, মুসলমানরা দুশমন দ্বারা সশস্ত্র আক্রমনের শিকার হলে ‘দিফায়ী জিহাদ (আত্মরক্ষা মূলক সশস্ত্র যুদ্ধ) করার জন্য -না আমীর থাকা শর্ত, আর না রাষ্ট্রক্ষমতা; মুসলমানরা নিজেদের জান মাল ও ইজ্জত বাাঁচানোর জন্য কোনো আমীর বা রাষ্ট্রক্ষমতা ছাড়াই ‘সশস্ত্র জিহাদ’ সম্পাদন করতে পারে। হ্যাঁ, ইক্বদামী জিহাদ (অগ্রগামী আক্রমনাত্মক সশস্ত্র জিহাদ) -এর জন্য ‘আমীরে-আজম’ (খলিফা/রাষ্ট্রপ্রধান)-এর অনুমতি জরুরী শর্ত (যার বিস্তারিত আলোচনা আমরা যথাস্থানে করবো, ইনশাআল্লাহ)। 
 
(১১) রাস্তাপথে হিজরত রত অবস্থায় সুরা হজ্জের ৩৯ এবং ৪০ নং আয়াত নাজিলের মাধ্যমে ক্বিতাল (সশস্ত্র জিহাদ)-এর অনুমতি দেয়া হল, আর এর পরের ৪১ নং আয়াতে এই আগাম বার্তা দেয়া হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর হিজরতের স্থান ‘মদিনা মুনাওয়ারা’য় মুসলমানদের কাছে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ‘ইসলামী হুকুমত/শাসন ব্যবস্থা’ দেয়া হতে যাচ্ছে, যা কায়েম করে দেখানোর গুরু দায়িত্ব মদিনার মুসলমানদের উপরে বর্তাতে যাচ্ছে। এরশাদ হচ্ছে-  الَّذِينَ إِن مَّكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنكَرِ ۗ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُورِ  – (আর তারা হল আমার সেই সকল মুমিন বান্দা) যারা (এমন গুণের অধিকারী যে,) যদি তাদেরকে জমিনে শাসন-কর্তৃত্ব (খিলাফত) দেয়া হয়, তাহলে তারা নামায কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, মা’রুফ (সৎ বিষয়)-এর নির্দেশ দেয় এবং মুনকার (নাজায়েয ও হারাম বিষয়) থেকে নিষেধ করে। আর সকল বিষয়ের পরিণতি আল্লাহ’র কাছে”[সূরা হজ্জ ৪১]
 
(১২) এরপর আল্লাহ তাআলা মদিনায় ক্বিতাল/স্বসস্ত্র জিহাদ জিহাদ বিষয়ক আয়াত সমূহ একে একে নাজিল করে মুসলমানদেরকে দিকনির্দেশনা দিতে থাকেন। যেমন আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন- وَ قَاتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَكُمْ وَ لَا تَعْتَدُوا ۚ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْمُعْتَدِين – “(হে মুসলমানগণ!) যারা তোমাদের বিরুদ্ধে কিতাল (যুদ্ধ) করে, তোমরাও তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহ’র পথে কিতাল (সশস্ত্র যুদ্ধ/ জিহাদ) করো। আর তোমরা সীমালঙ্ঘন করো না। নিশ্চই আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে ভালবাসেন না”। [সূরা বাকারাহ ১৯০]
 
এরশাদ হচ্ছে- كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِتَالُ وَهُوَ كُرْهٌ لَّكُمْ ۖ وَعَسَىٰ أَن تَكْرَهُوا شَيْئًا وَهُوَ خَيْرٌ لَّكُمْ ۖ وَعَسَىٰ أَن تُحِبُّوا شَيْئًا وَهُوَ شَرٌّ لَّكُمْ ۗ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ – “((হে মুসলমানগণ) তোমাদের উপরে ক্বিতাল’কে বিধিবদ্ধ (ফরয) করে দেয়া হল। অথচ তা তোমাদের কাছে অপছন্দনীয়/কষ্টকর ঠেঁকছে। এমনও হতে পারে যে, তোমরা কোনো কিছুকে অপছন্দ করছো, আর (বাস্তবে) সেটাই তোমাদের জন্য মঙ্গলজনক। আবার এমনও হতে পারে যে, তোমরা কোনো কিছুকে পছন্দ করছো, আর (বাস্তবে) সেটাই তোমাদের জন্য অমঙ্গলজনক। আর আল্লাহ (সব কিছুর পরিণতি সম্পর্কে খুব ভালকরে) জানেন, আর তোমরা জানো না’। [সূরা বাকারাহ ২১৬]
 
এরশাদ হচ্ছে- وَ قَاتِلُوا الْمُشْرِكِينَ كَافَّةً كَمَا يُقَاتِلُونَكُمْ كَافَّةً ۚ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ مَعَ الْمُتَّقِينَ – “তোমরা সকলে মিলে মুশরিকদের বিরুদ্ধে কিতাল (সশস্ত্র জিহাদ) করো, যেমনি ভাবে তারা সকলে মিলে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। আর তোমরা জেনে রেখো, নিশ্চই (তোমাদের প্রভু) আল্লাহ মুত্তাকীদের সাথে রয়েছেন”। [সূরা তাওবা ৩৬]
 
আল্লাহ তাআলা পরিত্র কুরআনে মুসলমানদের উপরে ‘ক্বিতাল ফি সাবিলিল্লাহ’ (আল্লাহ’র পথে সশস্ত্র জিহাদ)কে ফরয করে দিয়েছেন। সুতরাং, ‘ক্বিতাল (সশস্ত্র জিহাদ)’ অবশ্যই ‘জরুরিয়াতে দ্বীন (তথা দ্বীনের অত্যাবশ্যক অংগ)-এর অন্তর্ভূক্ত।  আর কোনো মুসলমান যদি কুরআন-সুন্নাহ’র যে কোনো প্রমাণিত ‘জরুরিয়াতে দ্বীন’কে অস্বীকার করে বা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্ল/অপমান করে, তাহলে সে মুরতাদ (ইসলাম পরিত্যাগকারী কাফের) হিসেবে বিবেচিত হয়।
 
ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম জাওযী (মৃ: ৭৫১ হি:) রহ. লিখেছেন- أول ما أوحى إليه ربه تبارك وتعالى أن يقرأ باسم ربه الذي خلق وذلك أول نبوته فأمره أن يقرأ في نفسه ولم يأمره إذ ذاك بتبليغ ، ثم أنزل عليه ( يا أيها المدثر قم فأنذر ) فنبأه بقوله اقرأ ، وأرسله بـ يا أيها المدثر . ثم أمره أن ينذر عشيرته الأقربين ، ثم أنذر قومه ، ثم أنذر من حولهم من العرب ، ثم أنذر العرب قاطبة ، ثم أنذر العالمين ، فأقام بضع عشرة سنة بعد نبوته ينذر بالدعوة بغير قتال ولا جزية ويؤمر بالكف والصبر والصفح . ثم أُذن له في الهجرة ، وأذن له في القتال . ثم أمره أن يقاتل مَن قاتله ويكف عمن اعتزله ولم يقاتله . ثم أمره بقتال المشركين حتى يكون الدين كله له . ثم كان الكفار معه بعد الأمر بالجهاد ثلاثة أقسام : أهل صلح وهدنة ، وأهل حرب ، وأهل ذمة – “নবী মুহাম্মাদ ﷺ-এর কাছে তার  রব (আল্লাহ) তাবারক ওয়া তাআলা সর্বপ্রথমে যে ওহী পাঠান সেটা এই ছিল যে, তিনি যেন (তার উপরে নাজিল হওয়া ওহীকৃত আয়াতকে) তার সেই রবের নামে পাঠ করেন, যিঁনি (সব কিছুকে) সৃষ্টি করেছেন। আর এটা ঘটেছিল নবুওতের প্রথম দিকে। পরে তিঁনি (তাঁর) নবী ﷺকে নির্দেশ দেন যে, তিনি (কুরআনের যা কিছু ওহী হিসেবে নাজিল হয় তা শুধু) নিজে নিজে পাঠ করবেন। তখনও পর্যন্ত ওর তাবলীগ করার নির্দেশ তাঁকে দেয়া হয়নি। অত:পর তার উপরে নাজিল হয়: يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ قُمْ فَأَنذِرْ“হে কম্বোলধারী, আপনি উঠে (লোকজনকে আল্লাহ ও আখেরাতের ব্যাপারে) সতর্ক করুন’। বস্তুত: আল্লাহ’র বাণী اقْرَأْ -(পাঠ করো)-এর দ্বারা নবুওতের জানান দেয়া হয়েছে এবং يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ – (হে কম্বোলধারী, ….)-এর দ্বারা তাকে রিসালাত দেয়া হয়েছে। এরপর তাঁকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তিনি যেন তার নিকট-আত্বীয় স্বজনদেরকে সতর্ক করেন। তারপর (নির্দেশ দেয়া হয়েছে) তাঁর (আরব) কওমকে সতর্ক করতে, তারপর আরবের চারপাশে(র লোকদেরকে) সতর্ক করতে, এরপর গোটা আরবকে সতর্ক করতে, তারপর গোটা বিশ্বকে সতর্ক করতে (বলা হয়েছে)। ফলে তাঁর নবুওতের পর প্রায় দশ বছর এ দায়িত্ব পালন করে যান -(লোকদেরকে দ্বীন ইসলামের দিকে মৌখিক) দাওয়াতের মাধ্যমে; কোনো ক্বিতাল (সমর যুদ্ধ) ও জিজিয়া (গ্রহন) ছাড়াই। তখন তাঁকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল (কাফেরদের অন্যায় অত্যাচারের মোকাবেলায় তাঁর) হাতকে সংবরন করা, সবর করা এবং ক্ষমা প্রদর্শন করে চলার। এরপর তাঁকে হিজরত করার অনুমতি দেয়া হয়, অনুমতি দেয়া হয় ক্বিতাল (সমর জিহাদ/যুদ্ধ) করার। এরপর তাঁকে নির্দেশ দেয়া হয়, যারা তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তিনি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন, আর যারা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকে তিনি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন না। এরপর তাঁকে নির্দেশ দেয়া হয়, তিনি মুশরেকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন যাবৎ না (জমিনে) দ্বীন সার্বিক ভাবে আল্লাহ’রই হয়ে যায়। (সমর) জিহাদের নির্দেশের পর তাঁর সাথে থাকা কাফেররা মূলত: তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়: أهل صلح وهدنة (সন্ধি-চুক্তিবদ্ধ কাফের), أهل حرب (যুদ্ধরত কাফের), أهل ذمة (আহলে যিম্মা)”। [যাদুল মাআদ, ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম– ৩/১৫৯]
 
ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম রহ.-এখানে খুবই চমৎকার ভাবে সংক্ষেপে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর নবুওত লাভের পর থেকে নিয়ে জমিনের বুকে আল্লাহ’র দ্বীনকে পরিপূর্ণ রূপে কাায়েম করার জন্য কাফের-মুশরেকদের বিরুদ্ধে ক্বিতাল/সমর-জিহাদের নির্দেশ দানের পর ইসলামের দৃষ্টিতে কাফেরদের যে তিনটি ভাগের কথা বলেছে, তা মাথায় রাখলে আমাদের আলোচনা বোঝা সহজ হয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ। 

 

[[[এই পেজের বর্ণিত তথ্য ও তাহ্বক্বীক আরো বিস্তারিত ভাবে জানতে দেখুন: সিরাতে ইবনে হিশাম- ১/৪৮০-৪৯৪; আনসাবুল আশরাফ, ইমাম বালাযুরী- ১/২৫৯-২৬১; আত-ত্ববাক্বাত, ইবনে সা’দ- ১/১৭৫-১৮২; আস-সিরাতুন নাববিয়্যাহ, ইমাম ইবনে হিব্বান- ১/১২৭-১৪০; আদ-দুরার ফি ইখতিছারিল মাগাজী ওয়াস সিয়ার, ইমাম ইবনু আব্দিল বার- ১/৮০-৮৭; আর-রাউজুল উনুফ, ইমাম সুহাইলী- ৪/১২২-১৮০; উয়ূনুল আছার, ইবনু সাইয়্যেদুন নাস- ১/২০০-২২০; আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইবনে কাসির- ৩/১৭৪-২০৫; শারহু মাওয়াহিবিল লাদুনিয়্যাহ, যুরকানী- ২/৮৯-১৭৫; রাসুলে রহমত, মওলানা আবুল কালাম আযাদ- ১৯৩-২২৯ পৃষ্ঠা (ইঃফাঃ); সিরাতুল মুস্তফা, মওলানা ইদ্রিস কান্দালভী- ১/৩৬১-৩৯৯; খাতামুন নাবিয়্যীন, মুহাম্মাদ আবু জাহরাহ- ১/৪৫৭-৪৬৬ ]]]

 


>>> মূল সূচিপত্র (index) থেকে এ পেজের পূর্ববর্তী বা পরবর্তী আলোচনা পড়তে [এখানে ক্লিক করুন