Uncategorized

আমানত (الأَمَانَةُ) ও শেষ জামানা – রাষ্ট্র, বিচার, প্রশাসন সর্ব স্তরে খেয়ানত

আমানত (الأَمَانَةُ) ও শেষ জামানা – রাষ্ট্র, বিচার, প্রশাসন সর্ব স্তরে খেয়ানত ও বরবাদী বিশ্বনবী সা. -এর ভবিষ্যতবাণীকে অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণ করে

بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیۡمِ

الحمد لله و الصلاة و السلام على رسوله محمد و على أله و أمّته

 

আল্লাহ তাআলা ‘আল-আমানত’ সম্পর্কে এরশাদ করেন-

….إِنَّا عَرَضْنَا الْأَمَانَةَ عَلَى السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَالْجِبَالِ فَأَبَيْنَ أَنْ يَحْمِلْنَهَا وَأَشْفَقْنَ مِنْهَا وَحَمَلَهَا الْإِنْسَانُ 

 ‘নিশ্চই আমি ‘আল-আমানত’কে আসমানসমূহ, জমিন ও পর্বতমালার সামনে  পেশ করেছিলাম। তখন তারা তা বহন করতে অপারগতা প্রকাশ করলো এবং সকলে এতে ভীত হয়ে গেল। আর একে গ্রহন করে নিলো মানুষ…..’। [সুরা আহযাব ৭২]

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা, হযরত মুজাহিদ, হাসান বসরী, সাঈদ বিন যুবায়ের, যিহহাক, কাতাদাহ রহ. প্রমূখ থেকে ‘আমানত’- কথাটির যে সকল ব্যাখ্যা এসেছে তার সারমর্ম একই, অর্থাৎ আল্লাহ’র দ্বীন ও শরীয়ত পালনের দায়দায়িত্ব, যা তাঁর নাজিলকৃত সকল আদেশ নিষেধ ও উপদেশকে অন্তর্ভূক্ত করে। [তাফসীরে তাবারী- ২০/৩৩৬; তাফসীরে ইবসে কাসির-৬/৪৮৮;  তাফসীরে কুরতুবী-১৪/২৫২; ফাতহুল কাদীর, ইবনুল হুমাম-৪/৪৩৭]

 আর আল্লাহ তাআলা ‘আমানত’ সম্পর্কে আরো এরশাদ করেন-

إِنَّ اللهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا 
 ‘নিশ্চই আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন, তোমরা আমানতগুলিকে তার (স্ব-স্ব) আহাল (তথা হক্বদার/উপযুক্ত ব্যাক্তি)র কাছে সোপর্দ করে দিবে’ [সুরা নিসা ৫৮]
 
কিন্তু কেয়ামতের আগে অর্থাৎ শেষ জামানায় আমানত’কে তার উপযুক্ত ব্যাক্তি তথা হক্বদারের দায়িত্বে সোপর্দ করা হবে না, বরং আমানতের সাথে ব্যাপকভাবে খেয়ানত করা হবে। খেয়ানতের এই মহামারীর সময় পেলে তখন থেকে কিয়ামতের অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে।

 আবু হুরায়রাহ রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন- بَيْنَمَا النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي مَجْلِسٍ يُحَدِّثُ القَوْمَ، جَاءَهُ أَعْرَابِيٌّ فَقَالَ: مَتَى السَّاعَةُ؟ فَمَضَى رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُحَدِّثُ، فَقَالَ بَعْضُ القَوْمِ: سَمِعَ مَا قَالَ فَكَرِهَ مَا قَالَ. وَقَالَ بَعْضُهُمْ: بَلْ لَمْ يَسْمَعْ، حَتَّى إِذَا قَضَى حَدِيثَهُ قَالَ: «أَيْنَ – أُرَاهُ – السَّائِلُ عَنِ السَّاعَةِ» قَالَ: هَا أَنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ، قَالَ: «فَإِذَا ضُيِّعَتِ الأَمَانَةُ فَانْتَظِرِ السَّاعَةَ»، قَالَ: كَيْفَ إِضَاعَتُهَا؟ قَالَ: «إِذَا وُسِّدَ الأَمْرُ إِلَى غَيْرِ أَهْلِهِ فَانْتَظِرِ السَّاعَةَ . رواه البخاري في الصحيح, كتاب العلم, باب من سئل علما وهو مشتغل في حديثه، فأتم الحديث ثم أجاب السائل: حديث رقم ٥٩ –‘(একদিন) রাসুলুল্লাহ ﷺ মজলিসে (বসে) লোকদের সাথে কথা বলছিলেন, এমন সময় এক বেদুইন এসে (তাঁকে) জিজ্ঞেস করলো: কেয়ামত করে হবে? (কিন্তু) রাসুলুল্লাহ ﷺ (তার কথার উত্তর না দিয়ে) আলোচনা করতে থাকলেন। তখন (মজলিসে উপস্থিত লোকদের মধ্যে) কেউ কেউ (নিজেদের মধ্যে) বললো: সে যা বলেছে, তিঁনি তা শুনেছেন, কিন্তু সে যেটা জিজ্ঞেস করেছে, তিনি (মনে হয় কোনো কারণে ) তা অপছন্দ করেছেন, (তাই উত্তর দিচ্ছেন না)। আবার তাদের কেউ কেউ বললো: বরং, তিনি (আসলে তার কথাই) শুনতে পাননি। একসময় যখন তাঁর আলোচনা শেষ হলো, তখন জিজ্ঞেস করলেন: কেয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞেসকারী কোথায় -দেখি! সে বললো: (এই যে) এখানে -ইয়া রাসুলাল্লাহ! তখন তিনি বললেন: فَإِذَا ضُيِّعَتِ الأَمَانَةُ فَانْتَظِرِ السَّاعَةَ – ‘যখন আল-আমানত’কে নষ্ট-বরবাদ করে ফেলা হবে, তখন কেয়ামতের অপেক্ষা করো’। সে জিজ্ঞেস করলো: ‘সেটা কিভাবে নষ্ট-বরবাদ করা হবে’? তিনি বললেন: إِذَا وُسِّدَ الأَمْرُ إِلَى غَيْرِ أَهْلِهِ فَانْتَظِرِ السَّاعَةَ – ‘যখন (বিভিন্ন পদাধিকার সম্পর্কিত শরয়ী) নির্দেশিত ব্যাপারে সেটির হক্বদার ভিন্ন অন্য কাউকে কর্তাধিকারী/প্রাধিকারী (authority) বানানো হবে’, তখন কেয়ামতের অপেক্ষা করো’। [সহিহ বুখারী, হাদিস ৫৯]

ইমাম হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ. (মৃ: ৮৫২ হি:) হাদিসটিতে বর্ণিত الأمر (নির্দেশিত বিষয়)-এর ব্যাখ্যায় লিখেছেন:  والمراد من الأمر جنس الأمور التي تتعلق بالدين كالخلافة والامارة والقضاء والافتاء وغير ذلك – ‘এখানে الأمر (নির্দেশীত বিষয়) দ্বারা উদ্দেশ্য হল দ্বীনের সাথে সম্পর্ক রাখে -এমন বিভিন্ন নির্দেশীত বিষয়, যেমন:  খিলাফত, ইমারত (আমীরত্ব/প্রশাসনীক দায়িত্ব), বিচারকার্য, ফাতওয়া কার্য ইত্যাদি’। [ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার- ১১/২৮৬] একই ব্যাখ্যা অন্যান্য মুহাদ্দেসগণও করেছেন। বিস্তারিত জানতে দেখুন: অাল-কাওয়াকিবুদ দারারী, ইমাম কিরমানী- ২/৭; উমদাতুল ক্বারী, ইমাম আইনী- ২/৭ইরশাদুস সারী শারহুল বুখারী, ইমাম কাস্তালানী- ১/১৫৫]

মোল্লা আলী ক্বারী রহ. (মৃ: ১০১৪ হি:) وُسِّدَ -(দায়িত্বে বসাবে) -এর ব্যাখ্যায়  লিখেছেন : أسند وفوض – ‘(যখন) মসনদে/দায়িত্বের আসনে বসাবে ও নিয়োগ দিবে’। [মিরক্বাত, আলী ক্বারী- ১০/৭৯] খোদ বুখারী শরিফের আরেকটি হাদিসে আছে- إِذَا أُسْنِدَ الْأَمْرُ إِلَى غَيْرِ أَهْلِهِ فَانْتَظِرْ السَّاعَةَ‘যখন (বিভিন্ন পদাধিকার সম্পর্কিত শরয়ী) নির্দেশিত ব্যাপারে সেটির হক্বদার ভিন্ন অন্য কাউকে মসনদে/দায়িত্বর আসনে বসানো হবে, তখন কেয়ামতের অপেক্ষা করো’ [সহিহ বুখারী, হাদিস ৬৪৯৬] এখানে  وُسِّدَ -এর স্থলে  أُسْنِدَ (মসনদে/দায়িত্বর-আসনে বসানো হবে) কথাটি এসেছে। এজন্য মোল্লা আলী ক্বারী রহ. -এর এ ব্যাখ্যাটি যথার্থ। الله اعلم بالصواب

এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, ইসলামী শরীয়তে -ছোট হোক বড় হোক- যে কোনো পদ আল্লাহ’র একেকটি আমানত এবং শরীয়ত যে পদের জন্য যে বৈশিষ্টের ব্যাক্তিকে তার আহাল/হক্বদার বলে নির্ণয় করে দিয়েছে, সেই পদে সেই বৈশিষ্টের ব্যাক্তি ছাড়া অন্য কোনো ব্যাক্তিকে সমাসীন করলে বা নিয়োগ দিলে সেটা হবে আল্লাহ’র দেয়া আমানতের সাথে খেয়ানত। এই খেয়ানতের মাত্রা নূন্যতম থেকে উচ্চতর মাত্রার হতে পারে। যেমন:

(১) রাষ্ট্রপ্রধান/প্রশাসক পদ ও শাসনকার্যের মধ্যে খেয়ানত

আল্লাহ’র নির্দেশিত খিলাফত ব্যবস্থা হল আল্লাহ’র দেয়া একটি আমানত এবং তা তাঁর বিধান মতো পরিচালনা করা আরেকটি আমানত।

ইসলামী শরীয়তে মুসলমানদের উপর নিযুক্ত রাষ্ট্রপ্রধান/প্রশাসক (যেমন খলিফা/আমীর/আমেল) পদটির জন্য নূন্যতম শর্ত হল- মুসলীম হওয়া, পুরুষ হওয়া, বালেগ (প্রাপ্তবয়ষ্ক) হওয়া, আকেল (বোধ-বুদ্ধিসম্পন্ন) হওয়া ইত্যাদি। আর এর অতিব গুরুত্বপূর্ণ ও উচ্চতর শর্ত হল- ইসলামী শরীয়ত সম্পর্কে উচ্চতর আলেম হওয়া, দ্বীনদার হওয়া, অর্ভন্তরীন ও বৈশ্বিক রাজনৈতিক অংগন সম্পর্কে ভাল জ্ঞান থাকা ইত্যাদি। যদি রাষ্ট্রপ্রধান/প্রশাসকের মধ্যে এসকল অতিব গুরুত্বপূর্ণ ও উচ্চতর শর্তের মধ্যে কোনো ব্যাপারে দূর্বলতা বা কমতী থাকে, আহলে-শূরা (শরয়ী পার্লামেন্ট) – এ এমন সদস্য রাখতে হবে, যার উক্ত বিষয়ে ভাল জ্ঞান ও দক্ষতা রয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধান/শাসকের মধ্যে নূন্যতম শর্তগুলোর কোনো একটি মাত্র শর্ত পাওয়া না গেলেই তাকে মুসলমানদের উপর  রাষ্ট্রপ্রধান/শাসকে  বানানো নাজায়েয। [বিস্তারিত]

এজন্য মুসলমানদের উপর (উদাহরণ স্বরূপ) কোনো অমুসলীম/কাফের/মুরতাদ’কে কিংবা কোনো নারীকে রাষ্ট্রপ্রধান/প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দিলে সেটা হবে আল্লাহ’র দেয়া রাষ্ট্রীয় পদ সংশ্লিষ্ট  আমানতের সাথে উচ্চ মাত্রার খেয়ানত করা। কারণ যেখানে নূন্যতম শর্তটুকু পর্যন্ত পরিত্যাজ্য হল, সেখানে সেই খেয়ানতটি-তো তার লাল দাগ ক্রস করে ইসলাম বিরোধীতা ও আল্লাদ্রোহিতার পর্যায়ে চলে গেল! কিন্তু যদি রাষ্ট্রপ্রধান / প্রশাসক নিয়োগ পর্যায়ে ইসলামী শরীয়তের নূন্যতম শর্তগুলো পালন করা হয়, তবে উচ্চতর গুরুত্বপূর্ণ শর্তগুলোতে অনিয়ম করা হয়, যেমন: বদদ্বীন (ফাসেক/ফাজর) প্রকৃতির মুসলীম জাহেল পুরুষ ব্যাক্তি’কে এপদে নিয়োগ দেয়া হয়, তাহলে সেটা অবশ্যই আমানতের থেয়ানত হবে, তবে সেই খেয়ানতটা হবে তুলনামূলক কম খেয়ানত। এভাবে বুঝে নিন যে, রাষ্ট্রপ্রধান/প্রশাসক নিয়োগ পর্যায়ে শরীয়তের ছোট বড় শর্তগুলো যতই মেনে চলা হতে থাকবে, খেয়ানতের পরিমান ততই কম হতে থাকবে।

আমরা এই শেষ জামানায় দেখতে পাচ্ছি, মুসলমান নামধারীরা দ্বীন ইসলামকে বাদ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও গণতন্ত্র’কে তাদের রাষ্ট্রীয় চেতনা ও আদর্শ হিসেবে গ্রহন করে নেয়ায় এই পদ সম্পৃক্ত আমানতের সাথে এইভাবে খেয়ানত হতে দেখছি :

(ক) তারা মুসলমানদের উপর নিযুক্ত রাষ্ট্রপ্রধান/শাসক -এর ‘মুসলমান’ হওয়ার শর্তটিকে উঠিয়ে দিয়ে তদস্থলে আইন করে মুসলীম-অমুসলীম নির্বিশেষে সবার জন্য এই পদের আহাল/হক্বদার হওয়াকে হালাল বানিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে ইহূদী, খৃষ্টান, হিন্দু, বৈদ্ধ, শিক, কাদিয়ানী সহ সকল অমুসলীম কাফের/মুরতাদ এ জামানায় সাংবিধানিক ভাবে মুসলমানদের উপর রাষ্ট্রপ্রধান/শাসক হতে পারবে। বস্তুতঃ এটা আল্লাহ তাআলা’র দেয়া আমানতের খেয়ানত প্রসঙ্গে তাদের লাল দাগ ক্রস করার একটি উল্লেখযোগ্য নমুনা।

(খ) তারা মুসলমানদের উপর নিযুক্ত রাষ্ট্রপ্রধান/শাসক -এর ‘পুরুষ’ হওয়ার শর্তটিকে উঠিয়ে দিয়ে তদস্থলে আইন করে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্য এই পদের আহাল/হক্বদার হওয়াকে হালাল বানিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে ইহূদী, খৃষ্টান, হিন্দু, বৈদ্ধ, শিক, কাদিয়ানী সহ সকল অমুসলীম কাফের/মুরতাদ -চাই নারী হোক চাই পুরুষ- এ জামানায় সাংবিধানিক ভাবে মুসলমানদের উপর রাষ্ট্রপ্রধান/শাসক হতে পারবে। বস্তুতঃ এটা আল্লাহ তাআলা’র দেয়া আমানতের খেয়ানত প্রসঙ্গে তাদের লাল দাগ ক্রস করার আরেকটি উল্লেখযোগ্য নমুনা।

(গ) এসব পদে সমাজের উল্লেখযোগ্য মাত্রার সব অসৎ, হারামখোর, ঘুষখোর, খুনি, ধর্ষক, মুনাফেক, প্রতারক, স্বার্থপর ইত্যকার সব বৈশিষ্টের লোকগুলিকে বসানো হচ্ছে। জনগণ যেমন দ্বীনী আমানতের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বরং তাদের দুনিয়াবী স্বার্থ (যেমন: এলাকাপ্রীতি, দলপ্রীতি, আত্বীয়তাপ্রীতি, অর্থ-সম্পদ ইত্যাদি)র জন্য বিভিন্ন কৌশলে খেয়ানত করে তাদেরকে ক্ষমতায় বসাচ্ছে, তেমনি ক্ষমতাসীনরাও বিভিন্ন কৌশলে ধুমিয়ে জনগণের সম্পদ কুক্ষিগত করা সহ ক্ষমতার অপব্যাবহার করে আমানতের খেয়ানত করছে। এই অবস্থা এখন ব্যাপক মহামারীর রূপ নিয়েছে। 

বস্তুতঃ উপরের (ক) ও (খ) পয়েন্টের বিষয় দুটি এই জামানায় আল্লাহ তাআলা’র নির্দেশীত আমানতের সাথে এমন এক নব-পদ্ধতির খেয়ানত, যা রাসুলুল্লাহ সা.-এর জামানা থেকে নিয়ে ১৯১৮ ইং সালে উসমানী খিলাফত ধ্বংসের আগ পর্যন্ত মুসলীম জাতি তাদের শাসন ব্যবস্থায় ঢুকায়নি। মূলতঃ এই ফিতনাটি এনেছে ব্রিটিশ ইহূদী-খৃষ্টানরা এবং সেটাকে তারা মুসলীম জাতির মাঝে রপ্তানী করেছে তাদের কৌশলী শিক্ষা-কারিকুলামে পরিচালিত স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে ব্রেন-ওয়াশ হওয়া (মুসলীম নামধারী) বুদ্ধিজীবী ও নেতা শ্রেণীর লোকদের হাত দিয়ে, যারা দ্বীন ইসলামকে বাদ দিয়ে  ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ , সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র’কে তাদের আদর্শ ও চেতনা হিসেবে মনে প্রাণে গ্রহন করে নিয়েছিল। আমার মতে, এ সব পথভ্রষ্ঠ বুদ্ধিজীবী ও নেতা শ্রেণীর লোকদের দিকে ইংগীত করা হয়েছে নিম্নোক্ত হাদিসে। 

হযরত হুযাইফা রা. থেকে সহিহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন- كَانَ النَّاسُ يَسْأَلُونَ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم عَنِ الْخَيْرِ وَكُنْتُ أَسْأَلُهُ عَنِ الشَّرِّ مَخَافَةَ أَنْ يُدْرِكَنِي فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّا كُنَّا فِي جَاهِلِيَّةٍ وَشَرٍّ فَجَاءَنَا اللَّهُ بِهَذَا الْخَيْرِ فَهَلْ بَعْدَ هَذَا الْخَيْرِ شَرٌّ قَالَ ‏”‏ نَعَمْ ‏”‏ فَقُلْتُ هَلْ بَعْدَ ذَلِكَ الشَّرِّ مِنْ خَيْرٍ قَالَ ‏”‏ نَعَمْ وَفِيهِ دَخَنٌ ‏”‏ ‏.‏ قُلْتُ وَمَا دَخَنُهُ قَالَ ‏”‏ قَوْمٌ يَسْتَنُّونَ بِغَيْرِ سُنَّتِي وَيَهْدُونَ بِغَيْرِ هَدْيِي تَعْرِفُ مِنْهُمْ وَتُنْكِرُ ‏”‏ ‏.‏ فَقُلْتُ هَلْ بَعْدَ ذَلِكَ الْخَيْرِ مِنْ شَرٍّ قَالَ ‏”‏ نَعَمْ دُعَاةٌ عَلَى أَبْوَابِ جَهَنَّمَ مَنْ أَجَابَهُمْ إِلَيْهَا قَذَفُوهُ فِيهَا ‏”‏ ‏.‏ فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ صِفْهُمْ لَنَا ‏.‏ قَالَ ‏”‏ نَعَمْ قَوْمٌ مِنْ جِلْدَتِنَا وَيَتَكَلَّمُونَ بِأَلْسِنَتِنَا ‏”‏ ‏.‏ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ فَمَا تَرَى إِنْ أَدْرَكَنِي ذَلِكَ قَالَ ‏”‏ تَلْزَمُ جَمَاعَةَ الْمُسْلِمِينَ وَإِمَامَهُمْ ‏”‏ ‏.‏ فَقُلْتُ فَإِنْ لَمْ تَكُنْ لَهُمْ جَمَاعَةٌ وَلاَ إِمَامٌ قَالَ ‏”‏ فَاعْتَزِلْ تِلْكَ الْفِرَقَ كُلَّهَا وَلَوْ أَنْ تَعَضَّ عَلَى أَصْلِ شَجَرَةٍ حَتَّى يُدْرِكَكَ الْمَوْتُ وَأَنْتَ عَلَى ذَلِكَ – ‘লোকেরা রাসুলুল্লাহ -কে কল্যান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতো, আর আমি জিজ্ঞেস করতাম মন্দ সম্পর্কে -এই ভয়ে ভীত হয়ে যে পাছে তা আমাকে পেয়ে বসে কিনা। আমি জিজ্ঞেস করলাম: ইয়া রাসুলাল্লাহ ! আমরা জাহেলিয়াত ও মন্দের ভিতরে ছিলাম। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে (আপনার মাধ্যমে দ্বীন ইসলামের মতো) এই কল্যান এনে দিলেন। এই কল্যানের পর কি কোনো মন্দ কিছু আছে? তিনি বললেন: হ্যাঁ। আমি বললাম: সেই মন্দের পর কি কোনো কল্যানের কিছু আছে? তিনি বললেন: হ্যাঁ, আর তাতে থাকবে দাখান (ধোঁয়া)। আমি জিজ্ঞেস করলাম: ওই দাখান কি? তিনি বললেন: (সে জামানায়) এমন গোষ্ঠি (-র আবির্ভাব হবে) যারা (মানব সমাজে আমার আনীত) আদর্শ বহির্ভূত আদর্শ চালু করবে এবং (আমার দেখানো) পথনির্দেশিকা বহির্ভূত (পথের দিকে মানুষজনকে) পথ দেখাবে (তাদেরকে পরিচালিত করবে)। তাদের মধ্যে (শরীয়ত সম্মত) মা’রুফ/ভাল বিষয়ও (দেখতে) পাবে এবং মুনকার/শরীয়ত-বহির্ভূত বিষয়ও পাবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম: এই কল্যানের পর কি কোনো মন্দ রয়েছে? তিনি বললেন: হ্যা, (এদের পর এমন গোষ্ঠির আবির্ভাব হবে যারা মানব জাতিকে এমন মত ও পথের দিকে ডাক দিবে, যা হবে মূলতঃ) জাহান্নামের বিভিন্ন দরজা থেকে (দেয়া) ডাক। যে ব্যাক্তি তাদের ডাকে সেদিকে সারা দিবে, তারা তাকে ওর মধ্যে নিক্ষেপ করবে। আমি বললাম: ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমাদেরকে তাদের বৈশিষ্ট (কী হবে -তা) বলে দিন। তিনি বললেন: (এই জাহান্নামী পথভ্রষ্ঠ) গোষ্ঠিটির চামড়া আমাদের মতোই হবে, তারা কথাও বলবে আমাদের (মুসলমানদের) ভাষা (ভঙ্গি)তে। আমি বললাম: ইয়া রাসুলাল্লাহ ! আমি যদি তাদেরকে পাই, তাহলে আপনি আমাকে কি করতে বলেন? তিনি বললেন: মুসলমানদের জামাআত’ ও তাদের ইমামকে (আমীরকে) আঁকড়িয়ে ধরে থাকবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম: যদি (তখন) কোনো জামাআতও না থাকে, কোনো ইমামও (আমীরও) না থাকে? তিনি বললেন: তাহলে ওই প্রতিটি ফেরকা থেকে নিজকে বিছিন্ন করে রাখবে- যদিও-বা তোমাকে গাছের শিকড় খেয়ে থাকতে হয় এমনকি এ অবস্থার উপরই তোমার মৃত্য চলে আসে।  [সহিহ মুসলীম, হাদিস ৪৮৯০, সহিহ বুখারী, হাদিস ৬৬৭৩] আরেক হাদিসে এও আছে-  فتنة عمياء صماء عليها دعاة على أبواب النار وأنت أن تموت يا حذيفة وأنت عاض على جذل خير لك من أن تتبع أحدا منهم. مسند الإمام أحمد: ٥/٣٨٦ رقم ٢٣٣٣٠ , تعليق شعيب الأرنؤوط : حديث حسن – ‘…(এমন এক) ফিতনা যা (আকিদা ও বিশ্বাসগত) অন্ধত্ব ও বধিরতা (-র অন্ধকার নিয়ে আবির্ভূত হবে), যার উপর ভিত্তি করে দোযখের বিভিন্ন দরজায় দাঁড়িয়ে (পথভ্রষ্ঠতার ধারক-বাহক নেতা ও লিডার’দের পক্ষ থেকে তোমাদের মুসলমানদেরকে তাদের আদর্শ গ্রহনের দিকে) ডাক দেয়া হবে। হে হুযাইফা, তুমি যদি (তখন আল্লাহ’র রাস্তায় মড়ে যেতে পরো, তো) মড়ে যেও (তবুও কোনো অবস্থাতেই ওদের অনুসরণ করতে যেও না)। ওদের (মতো পথভ্রষ্ঠ লিডারদের) কোনো একজনের অনুগত্য-অনুসরণ করার থেকে তুমি আনন্দ-উল্লাসে (তোমার ধ্বনসম্পদ) উড়িয়ে দিবে সেটাও তোমার জন্য অধিক কল্যানকর হবে’। [মুসনাদে আহমদ- ৫/৩৮৬, হাদিস ২৩৩৩০; সুনানুল কুবরা, নাসায়ী- ৫/১৮ হাদিস ৮০৩২, ৮০৩৩; আত-তবাকাত, ইবনে সা’দ- ৪/২৫২]

হযরত ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন- سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول : إن في أمتي لنيفا وسبعين داعيا ، كلهم داع إلى النار ، لو أشاء لأنبأتكم بأسمائهم وقبائلهم . رواه أبو يعلى الموصلي فى مسنده: ١٠/٦٥ رقم ٥٧٠١ . قال ابن كثير فى البداية والنهاية , كتاب الفتن والملاحم وأشراط الساعة والأمور العظام يوم القيامة: ١٩/١١٨ وهذا إسناد لا بأس به; قال الهيثمى : رواه أبو يعلى وفيه ليث بن أبي سليم وهو مدلس،وبقية رجاله ثقات:٧/٣٣٢ – ‘আমি রাসুলুল্লাহ -কে একথা বলতে শুনেছি: ‘আমার উম্মতের মধ্যে সত্তর জনের বেশি আহবানকারী (লিডার/গুরু) হবে। তাদের প্রত্যেকেই (একেকজন পথভ্রষ্ঠ এবং তাদের জীবনকালে তারা নিজ নিজ প্রথভ্রষ্ঠ মত ও পথকে মুক্তির সঠিক পথ বলে প্রচার করবে, ফলে আদপে তারা মানুষকে) দোযখের দিকে আহবান করবে। (তাদের থেকে সাবধান থেকো)। আমি চাইলে তোমাদেরকে তাদের নাম ও তাদের এলাকার খবর বলে দিতে পারি’। [মুসনাদে আবু ইয়া’লা- ১০/৬৫ হাদিস ৫৭০১; আল-বিদায়াহ ওয়ান্নিহায়াহ, ইবনে কাছির- ১৯/১৮৮; মাজমাউয যাওয়ায়ীদ, হাইছামী- ৭/৩৩২]

আরেক হাদিসে এসছে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেন-  يكون بعدى أئمة لا يهتدون بهداى ولا يستنون بسنتى وسيقوم فيهم رجال قلوبهم قلوب الشياطين فى جثمان أنس – ‘আমার পর এমন নেতা/লিডার’রা আসবে, যারা না আমার দেখানো পথে চলবে আর না আমার সুন্নাহ মতো চলবে। তাদের মধ্যে এমন কিছু লোক দাঁড়াবে যাদের মনুষ্য দেহের ভিতরে বিদ্যমান অন্তরগুলো হবে একেকটা শয়তানের অন্তর’। [সহিহ মুসলীম, হাদিস ১৮৪৭]

(২) বিচারকের পদ ও বিচারকার্যের মধ্যে খেয়ানত

আল্লাহ’র নাজিলকৃত আইনগুলো হল আল্লাহ’র দেয়া একটি আমানত। আর তা দিয়ে ইনসাফের সাথে বিচার করার দায়িত্ব হল আরেকটি আমানত।

ইসলামী শরীয়তে মুসলমানদের উপর নিযুক্ত বিচারক (কাযী/হাকেম) পদটির জন্য নূন্যতম প্রধান শর্ত হল- মুসলীম হওয়া, পুরুষ হওয়া, বালেগ (প্রাপ্তবয়ষ্ক) হওয়া, আকেল (বোধ-বুদ্ধিসম্পন্ন) হওয়া  ইত্যাদি। আর এ পদের অপরিহার্য শর্ত হল- ইসলামী শরীয়ত সম্পর্কে এমন উচ্চতর আলেম হওয়া, যিনি উদ্ভত বিষয়ে শরয়ী ফাতওয়া ও রায় দানের পূর্ণ যোগ্যতা রাখেন। নূন্যতম প্রধান প্রধান শর্তের সাথে এই অপরিহার্য শর্ত পাওয়া না গেলে তাকে মুসলমানদের উপর বিচারক বানানো সম্পূর্ণ নাজায়েয। কারণ শরীয়তের ইলম ছাড়া মুসলমানদের মামলা-মুকাদ্দমার রায় দান করার দ্বিতীয় কোনো পথ কাযী/বিচারকের জন্য খোলা নেই। 

আমরা এই শেষ জামানায় দেখতে পাচ্ছি, মুসলমান নামধারীরা দ্বীন ইসলামকে বাদ দিয়ে সমাজতন্ত্র কিংবা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও গণতন্ত্র’কে তাদের রাষ্ট্রীয় চেতনা ও আদর্শ হিসেবে গ্রহন করে নেয়ায় তারা মুসলমানদের উপর নিযুক্ত বিচারক/কাযী -এর ‘মুসলীম, পুরুষ ও মুফতী’ হওয়ার শর্তকে উঠিয়ে দিয়ে তদস্থলে আইন করে মুসলীম-অমুসলীম, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্য এই পদের আহাল/হক্বদার হওয়াকে হালাল বানিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে ইহূদী, খৃষ্টান, হিন্দু, বৈদ্ধ, শিক, কাদিয়ানী সহ সকল অমুসলীম কাফের/মুরতাদ -চাই নারী হোক চাই পুরুষ- এ জামানায় সাংবিধানিক ভাবে মুসলমানদের উপর বিচারক/কাযী হতে পারবে।

এই ফিতনাটিও ঢুকেছে ব্রিটিশদের মাধ্যমে, তাদের শিক্ষা-কারিকুলামে ব্রেন-ওয়াশ হওয়া ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও গণতন্ত্র’কে তাদের আদর্শ ও চেতনা হিসেবে মনে প্রাণে গ্রহন করে নেয়া (মুসলীম নামধারী) বুদ্ধিজীবী ও নেতা শ্রেণীর লোকদের হাত দিয়ে। এর আগে এই ফিতনাটি ছিল না। 

ইয়াযীদ বিন মাছরাদ রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত, হযরত মুআয বিন জাবাল রা. বলেছেন-

سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ : خُذُوا الْعَطَاءَ مَا دَامَ عَطَاءً ، فَإِذَا صَارَ رِشْوَةً فِي الدِّينِ فَلَا تَأْخُذُوهُ ، وَلَسْتُمْ بِتَارِكِيهِ ؛ يَمْنَعْكُمُ الْفَقْرَ وَالْحَاجَةَ ، أَلَا إِنَّ رَحَى الْإِسْلَامِ دَائِرَةٌ ، فَدُورُوا مَعَ الْكِتَابِ حَيْثُ دَارَ ، أَلَا إِنَّ الْكِتَابَ وَالسُّلْطَانَ سَيَفْتَرِقَانِ ، فَلَا تُفَارِقُوا الْكِتَابَ ، أَلَا إِنَّهُ سَيَكُونُ عَلَيْكُمْ أُمَرَاءُ يَقْضُونَ لِأَنْفُسِهِمْ مَا لَا يَقْضُونَ لَكُمْ ، إِنْ عَصَيْتُمُوهُمْ قَتَلُوكُمْ ، وَإِنْ أَطَعْتُمُوهُمْ أَضَلُّوكُمْ . قَالُوا: يَا رَسُولَ اللهِ ، كَيْفَ نَصْنَعُ ؟ قَالَ: كَمَا صَنَعَ أَصْحَابُ عِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ ، نُشِرُوا بِالْمَنَاشِيرَ ، وَحُمِلُوا عَلَى الْخَشَبِ ، مَوْتٌ فِي طَاعَةِ اللهِ خَيْرٌ مِنْ حَيَاةٍ فِي مَعْصِيَةِ اللهِ . اخرجه الطبراني في ” المعجم الكبير”: ٢٠/٩٠، و” المعجم الصغير”: ٢/٤٢، و مسند الشاميين : ١/٣٧٩, أبو نعيم في ” حلية الأولياء: ٥/١٦٦, قال الهيثمي : ” رَوَاهُ الطَّبَرَانِيُّ ، وَيَزِيدُ بْنُ مَرْثَدٍ لَمْ يَسْمَعْ مِنْ مُعَاذٍ ، وَالْوَضِينُ بْنُ عَطَاءٍ وَثَّقَهُ ابْنُ حِبَّانَ وَغَيْرُهُ ، وَضَعَّفَهُ جَمَاعَةٌ ، وَبَقِيَّةُ رِجَالِهِ ثِقَاتٌ : مجمع الزوائد:  ٥/٢٢٨; الوضين بن عطاء الشامي ، مختلف في توثيقه, قال يحيى بن معين: ” الوضين بن عطاء لا بأس به, قال الإمام أحمد: ” الوضين بن عطاء ثقة ، ليس به بأس, قال ابن أبي حاتم : سألت أبي عن الوضين بن عطاء فقال: ” تعرف وتنكر – ‘আমি রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে একথা বলতে শুনেছি: (খলিফা/প্রশাসকের) উপহার গ্রহন করতে পারো যতক্ষন তা উপহার হিসেবে থাকে। তবে সেটা যদি দ্বীনের দৃষ্টিতে ঘুষ হয়ে যায়, তখন তা গ্রহন করো না। কিন্তু (আক্ষেপ হল) তোমরা (মুসলমানরা ভবিষ্যতে) তা পরিহার করে চলবে না। অভাব ও প্রয়োজন -তোমাদের জন্য (আমার এই নির্দেশ পালনে) বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে। ভাল করে শুনে রাখো,  (কুরআনের মাধ্যমে দ্বীন) ইসলামের পরিধি সচল হয়ে গেছে। সুতরাং তোমরা আল-কিতাব (কুরআন)-এর সাথে থাকবে তা যেখানেেই যাক না কোনো, (কোনো অবস্থাতেই কুরআনকে ছাড়বে না)। ভাল করে শুনে রাখো, নিশ্চয় আল-কিতাব ও রাষ্ট্র ক্ষমতা অতিশিঘ্রই (একটি অপরটি থেকে) আলাদা হয়ে যাবে, (আল্লাহ’র কিতাব অনুযায়ী রাষ্ট্র-ব্যবস্থা চলবে না; চলবে মানুষের বানানো আইন দিয়ে)। তখনও তোমরা আল-কিতাব থেকে আলাদা হয়ো না। ভাল করে শুনে রাখো, অতি শিঘ্রই তোমাদের উপর এমনসব আমীররা (রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রি, প্রশাসক’রা) আসবে, যারা তাদের নিজেদের জন্য (সুবিধা মতো) যে বিচার-ফয়সালা করবে, সে বিচার-ফয়সালা তারা তোমাদের জন্য করবে না। তোমরা যদি তাদের অবাধ্যতা প্রদর্শন করো তাহলে তারা তোমাদেরকে (বিভিন্ন অযুহাতে) মেড়ে ফেলবে। আর তোমরা যদি তাদের অনুগত্য করো, তাহলে তারা তোমাদেরকে (আল্লাহ’র দ্বীন থেকে) পথভ্রষ্ঠ করে দিবে। লোকেরা বললো: ইয়া রাসুলাল্লাহ! (এমতাবস্থায়) আমরা কি করবো? তিনি বললেন: (তোমরাও তা-ই করবে) যেমনটা ঈসা ইবনে মারইয়াম আ.-এর সাহাবীগণ করেছিলেন। তাদেরকে করাত দিয়ে চিড়ে ফেলা হয়েছিল, শুলিতে চড়ানো হয়েছিল (কিন্তু তারা আল্লাহ’র দ্বীন ছাড়েনি)। আল্লাহ’র নাফরমানীর জীবনের চাইতে আল্লাহ’র অনুগত্যের পথে মৃত্যুও শ্রেয়। [আল-মু’জামুল কাবীর, ত্বাবরাণী- ২০/৯০; আল-মু’জামুস সগীর, ত্বাবরাণী- ২/৪২;  মুসনাদে শামেয়ীন, ত্বাবরাণী- ১/৩৭৯; হিলইয়াতুল আউলিয়াহ, আবু নুআইম- ৫/১৬৬; মাজমাউয যাওয়ায়ীদ, হাইছামী- ৫/২২৮]

আল্লাহ’র আইনগুলো-তো নাজিলই হয়েছিল তা দিয়ে বিচার করে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করার জন্য। আল্লাহ’র আইন গুলোর সাথে সাংঘর্ষিক সকল মানব রচিত আইনই-তো অবিচার বেইনসাফী। কিন্তু  ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও গণতন্ত্রের ধারক-বাহক বুদ্ধিজীবী ও নেতা/শাসকরা মুসলীম প্রধান দেশ গুলো থেকে এজন্য আল্লাহ’র আইন প্রয়োগের রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে, কারণ তারা বিশ্বাস করে, আল্লাহ’র আইনগুলোর মধ্যে বহু আইনে অমুসলীম ও নারীদের প্রতি বে-ইনসাফী করা হয়েছে !!! তাই তারা নিজেরা আইন রচনা করে তাদের সাথে ইনসাফ ও ন্যায়বিচারের দ্বার খুলে দিয়ে আল্লাহ’র বে-ইনসাফীর পথ বন্ধ করে দিয়েছে !!! আজ পৃথিবীতে আমরা মুসলীম উম্মাহ (!) বলতে যাদেরকে বুঝি, তাদের বেশিরভাগ (প্রায় ৮০%-৯০%) জনগণ এই কুফরী আক্বিদাটা মনে প্রাণে গহন করে নিয়েছে। আপনাদের কি মনে হয়, সমাজে আল্লাহ’র আইন দিয়ে মুসলমানদের বিচার করার ব্যাবস্থা চালু হোক -তারা তা কামনা করে?! আপনার কি মনে হয়, আল্লাহ তাআলা এই রকম লোকদের জন্য আসমান-জমিনে তাঁর রহমতের দরজা উন্মুক্ত করে দিবেন ?! আপনার বাড়ির চাকর-চাকরানী দিয়েই একবার চিন্তা করে দেখুন, তারা আপনার বাড়িতে আপনার হুকুম দানের রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে নিজেরা বাড়ির হুকুমদাতা হয়ে বসলে আপনি খুশি হয়ে হয়-তো বলবেন: ‘আমি তোদের উপর খুশি, তোরা আজ আমার কাছে যা যা চাওয়া চা, আমি তোদের চাওয়াকে পূরণ করবো’!!! না কি? মনে হয়, আমার উত্তর দেয়ার প্রয়োজন নেই।

আর সকল দেশে একে-তো আল্লাহ’র দেয়ার আইন দিয়ে ইনসাফ ও ন্যায়বিচারের রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, তদুপরি তারা তাদের নিজেদের তৈরী যে আইন গুলোকে ন্যায়বিচার বলে বিশ্বাস করে, সেগুলো প্রয়োগের ক্ষেত্রেও ‘অবিচার’ আজ মহামারী আকার ধারণ করেছে। বিচারক ও বিচার-তো আজ টাকা ও ক্ষমতার খেলা হয়ে গেছে। মানুষ মামলা-মোকাদ্দমার নাম শুনলেই আঁতকে ওঠে। মানুষ কোনো আশার আলো দেখছে না, শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার। 

(৩) ইলম ও ফাতওয়ার পদ ও দায়িত্বের মধ্যে খেয়ানত

আল্লাহ তাআলা তাঁর সর্ব শেষ নবী ও রাসুল মুহাম্মাদ ﷺ-এর মাধ্যমে এই উম্মতকে কুরআন ও সুন্নাহ’র মতো আজিমুশ শান নেয়ামত দ্বারা ধন্য করেছেন, সম্মানীত করেছেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসুল ﷺ-এর কারণে এই উম্মতের উপর আরেকটি এহসান করেছেন এভাবে যে, দ্বীন ইসলাম কেয়ামতের আগ পর্যন্ত যতদিন বাকি থাকবে, ততদিন এই দ্বীনের হিফাজত করার জন্য এই উম্মতের মধ্যে বিভিন্ন জামানায় সুযোগ্য আলেমগণের একটি জামাআত সবসময় বিদ্যমান থাকবে। 

হযরত মুয়াবিয়া রা.-এর সূত্রে বণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ সা. এরশাদ করেন- مَنْ يُرِدِ اللَّهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِي الدِّينِ ، وَإِنَّمَا أَنَا قَاسِمٌ وَيُعْطِي اللَّهُ وَلَنْ يَزَالَ أَمْرُ هَذِهِ الْأُمَّةِ مُسْتَقِيمًا حَتَّى تَقُومَ السَّاعَةُ ، أَوْ حَتَّى يَأْتِيَ أَمْرُ اللَّهِ – আল্লাহ যার কল্যান করতে চান, তাকে দ্বীনের (ফকিহ বানান) গভীর জ্ঞান দান করেন। আর আমি (দ্বীনী ইলমের) নিছক একজন বন্টনকারী মাত্র, (বাস্তবে ইলম) আল্লাহ’ই দান করেন। আর এই উম্মতের (দ্বীনী) বিষয়াদি সব সময় (সিরাতে) মুস্তাকিম (সোজা পথের উপর স্থাপিত) থাকবে যাবৎ না কিয়ামত এসে যায় অথবা যাবৎ না আল্লাহ’র নির্দেশ আসে। [সহীহ বুখারী-১/১৬, হাদিস ৬৭৯৫] 

যেমন: সহিহ হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেন- لاَ يَزَالُ مِنْ أُمَّتِي أُمَّةٌ قَائِمَةٌ بِأَمْرِ اللَّهِ ، لاَ يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ ، وَلاَ مَنْ خَالَفَهُمْ ، حَتَّى يَأْتِيَهُمْ أَمْرُ اللَّهِ وَهُمْ عَلَى ذَلِكَ আমার উম্মতের মধ্যে একটি উম্মত (জামাআত/দল/গোষ্ঠি) সর্বদা আল্লাহ’র নির্দেশের উপর কায়েম থাকবে। যারা তাঁদেরকে দমন করতে যাবে এবং যারা তাঁদের বিরোধীতায় লাগবে, তারা তাঁদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। এমনকি তাঁদের কাছে আল্লাহ’র হুকুম না এসে পৌছা পর্যন্ত তারা এর উপরই কায়েম থাকবে। [সহিহ বুখারী, হাদিস ৩৬৪১]  

আর হযরত সওবান রা. বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেন- لَا تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي ظَاهِرِينَ عَلَى الْحَقِّ لَا يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ حَتَّى يَأْتِيَ أَمْرُ اللَّهِ وَهُمْ كَذَلِكَ আমার উম্মতের একটি গোষ্ঠি  সর্বদা  সত্যের উপর বিরাজমান থাকবে। যারা তাঁদেরকে দমন করতে যাবে, তারা তাঁদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। এমন কি তাঁদের কাছে আল্লাহ’র হুকুম না এসে পৌছা পর্যন্ত তারা (এভাবে সত্যের উপরই) বিরাজমান থাকবে। [সহীহ মুসলীম- ২/১৪৩, হাদিস ১৯২০] 
 
ইমাম নববী রহ. লিখেছেন- وأما هذه الطائفة فقال البخاري : هم أهل العلم ، وقال أحمد بن حنبل : إن لم يكونوا أهل الحديث فلا أدري من هم ؟ قال القاضي عياض : إنما أراد أحمد أهل السنة والجماعة ، ومن يعتقد مذهب أهل الحديث ، قلت : ويحتمل أن هذه الطائفة مفرقة بين أنواع المؤمنين منهم شجعان مقاتلون ، ومنهم فقهاء ، ومنهم محدثون ، ومنهم زهاد وآمرون بالمعروف وناهون عن المنكر ، ومنهم أهل أنواع أخرى من الخير ، ولا يلزم أن يكونوا مجتمعين بل قد يكونون متفرقين في أقطار الأرض . وفي هذا الحديث معجزة ظاهرة ؛ فإن هذا الوصف ما زال بحمد الله تعالى من زمن النبي صلى الله عليه وسلم إلى الآن ، ولا يزال حتى يأتي أمر الله المذكور في الحديث . وفيه دليل لكون الإجماع حجة …, এই الطائفة (গোষ্ঠি/দল) সম্পর্কে ইমাম বুখারী রহ. বলেছেন- هم أهل العلمতাঁরা হলেন আহলে ইলম (ইলমের ধারক-বাহকগণ)। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহ. বলেছেন- إن لم يكونوا أهل الحديث فلا أدري من هم ؟ তাঁরা যদি আহলুল হাদিস (হাদিসের ধারক-বাহক) না হন তাহলে তাঁরা আর কারা – তা আমি জানি না। কাযি আইয়ায রহ. বলেছেন- (একথার দ্বারা) ইমাম আহমদ বিন হাম্বলের উদ্দেশ্য হল ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ’ এবং যাঁরা আহলুল হাদিস (হাদিসের ধারক-বাহক) হিসেবে বিবেচিত। (ইমাম নববী বলেন:) আমার মতে, এই الطائفة  (জামাআত/গোষ্ঠি/দল) দ্বারা এমন ব্যাক্তিবর্গ উদ্দেশ্য, যাঁরা (পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে বিদ্যমান) বিভিন্ন ধরনের মুমিনদের ভিতরে (ছড়িয়ে ছিটিয়ে) থাকা একটি (বিশেষ মর্যাদাবান) গোষ্ঠি, যাঁদের মধ্যে কেউ কেউ হলেন বীর মুজাহীদ, কেউ কেউ ফকিহ (ফিকাহশ্বাস্ত্রবিদ আলেম), কেউ কেউ মুহাদ্দেস, কেউ বা জাহেদ (দুনিয়ার মায়া ত্যাগী আবেদ), কেউ নেকির কাজে আদেশকারী ও অন্যায় কাজের নিষেধকারী, এভাবে তাঁদের মধ্যে (ইসলামের) কল্যানকারী অন্য আরো অনেক ধরনের ব্যাক্তিগণ থাকতে পারেন। (আর) এর জন্য এমনটা হওয়া আবশ্যক নয় যে, তাঁরা সবাই মিলে এক সাথে বসবাস করবেন। বরং তাঁরা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে পারেন। (তবে তাঁরা যেখানেই থাকুন না কেনো, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁরা ইজমাবদ্ধ/ঐক্যবদ্ধ থাকবেন)। আর (দেখুন) এই যে হাদিসভান্ডার, এটা-তো একটি সুস্পষ্ট মু’জিযা। বস্তুতঃ (মুহাদ্দেসগণের প্রচেষ্টায় সংরক্ষিত হাদিসের) এই বিস্তারিত ভান্ডার নবী সা.-এর জামানা থেকে আজ পর্যন্ত আল্লাহ’র মহিমার প্রতিফলন ঘটিয়ে আসছে। আর এ ধারা অব্যাহত থাকবে যাবৎ উপরোক্ত হাদিসে বণিত আল্লাহ’র নির্দেশ এসে না পৌছে। এটা একথারই দলিল যে, (আহলে হক্ব আলেমগণের ঐক্যমত বা) ইজমা হল (শরীয়তের) হুজ্জত/দলিল।….[শারহুল মুসলীম, ইমাম নববী- ১৩/৬৭]
 
আব্দুর রহমান উযরী রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেন- يَحْمِلُ هَذَا الْعِلْمَ مِنْ كُلِّ خَلَفٍ عُدُولُهُ ، يَنْفُونَ عَنْهُ تَحْرِيفَ الْغَالِينَ ، وَانْتِحَالَ الْمُبْطِلِينَ ، وَتَأْوِيلَ الْجَاهِلِينَ . رواه البيهقي في السنن الكبرى: ١٠/٢٠٩, و و ابن عبد البر في التمهيد: ١/٥٩; صححه الإمام أحمد كما ذكر الخطيب البغدادي في شرف أصحاب الحديث: ص ٢٨-٢٩ ‘(আমা কর্তৃক কুরআন ও সুন্নাহ’র) এই (রেখে যাওয়া) ইলম’কে বহন করবে প্রত্যেক পরবর্তী ন্যায়ানুগ ব্যাক্তিগণ। তাঁরা একে বাড়াবাড়িকারীদের তাহরিফ (পরিবর্তন) থেকে, বাতিলপন্থিদের অনাধিকার চর্চা থেকে এবং মুর্খ-জাহেলদের অপব্যাখ্যা থেকে বাঁচাবেন’। [সুনানুল কুবরা, বাইহাকী- ১০/২০৯; আত-তামহীদ, ইমাম আব্দুল বার- ১/৫৯] 
 
এ থেকে বোঝা গেল, ইসলামী দ্বীন ও শরীয়ত হিফাজতের জন্য প্রত্যেক জামানাতেই সহিহ ইলম বহনকারী ওলামায়ে কেরাম বিদ্যমান থাকবেন -কেয়ামতের আগ পর্যন্ত -যতদিন দ্বীন থাকবে, যাঁদের ইলম হাসিলের উস্তাদ থাকবে এবং উস্তাদগণের ইলম হাসিলের উর্ধ্বতন সূত্র গিয়ে ঠেঁকবে সকল মুসলমানের দ্বীনী উস্তাদ বিশ্বনবী মুহাম্মাদ ﷺ। সহিহ দ্বীনী ইলম হাসিল করতে হলে আলেমগণের এই ধারার জামাআত থেকেই সহিহ উসূলের আওতায় ইলম হাদিস করতে হবে। বড় মুহাক্কি আলেম, মুহাদ্দেস ও মুফতী সাহেবগণের সন্ধান এই ধারাতেই পাবেন। 
 
কিন্তু শেষ জামানায়, ইলম হাসিলের ক্ষেত্রে বেশিরভাগের এই অবস্থা হবে যে- 
 
(১) এই ধারায় পূর্ণ যোগ্যতা হাসিল না করেও ফাতওয়াদাতা, হাদিসবেত্তা, আল্লামাহ’র আসনে সমাসীন হবে বা মানুষ তাদেরকেই এসব পদের জন্য মান্যবর হিসেবে গ্রহন করে নিবে; (প্রকৃত আলেম, মুহাদ্দিস ও মুফতীগণের কাছে যাবে না)। আজকালকার বেশিরভাগ ওয়ায়েজ, মসজিদের ইমাম ও খতিব, ছোট ছোট মাদ্রাসা-মক্তবের দ্বীনী শিক্ষকদের মধ্যে ইলমী দৈন্যের এই সমস্যা প্রকট আকার ধারন করেছে। এদের বেশির ভাগই মসজিদ, পাঁচ ওয়াক্ত নামায ও কসর -এর সামান্য কিছুটা ভিতরের মাসআলাহ’র ইলমও পূর্ণ ভাবে রাখে না, সেখানে খিলাফত, জিহাদ, আমর বিল মা’রুফ নাহি আনিল মুনকার, শরয়ী বিচার ব্যবস্থা, সনাতন ও আধুনিক শরয়ী অর্থনীতি ইত্যাদি অন্যান্য বড় বড় বিষয়ের ভারী, সুক্ষ ও জটিল মাসআলাহ জানা-তো আরো পরের কথা। তা সত্ত্বেও এসব বিষয়ে কেউ প্রশ্ন করলে তাদের বেশিরভাগের মুখ থেকে ‘জানি না’ বের হয় না, কিংবা ‘বড় কোনো মুফতীর কাছে জিজ্ঞেস করে জানাবো’ -তাও বলে না, অথবা ‘অমুক বড় মুফতী সাহেবের কাছে জিজ্ঞেস করে নিন’ -তাও বলে না, বরং ফস্ করে একটি ফতওয়া বা ব্যাখ্যা দিয়ে দেয় !!! এদের শরয়ী জ্ঞানের দৈন্যের অবস্থা যখন সাধারণ মানুষের কাছে দৃষ্টিকটুভাবে ধরা পড়ে, তখন তারা মনে করে যে, সব আলেমই এরকম। ফলে এরা বড় আলেমগণের কাছে যাওয়ার পথে একটি প্রাথমিক বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।   
 
(২) এই ধারা বহির্ভূত লোকেরা শুধুমাত্র নিজে নিজে বই পড়ে একেকজন শরীয়তের পন্ডিত হিসেবে আত্বপ্রকাশ করবে এবং মুর্খ মানুষজন তাদের কুরআন-হাদিসের আলোচনা ও কথাবার্তায় আকৃষ্ট হয়ে তাদেরকে অনুসরণ করে। এযুগের আধুনিক শিক্ষিতদের মধ্যে (হাতে গোণা সচেতন কিছু মুমিন বাদে) প্রায় ১০০% -ই এরকম স্ব-শিক্ষিত হাতুড়ে মুফতী, মুহাদ্দেস ও আল্লামাহ’র পদ গ্রহন করে আছে, যারা যে কোনো ব্যাপারে আলেম-জাহেল সকলের কোথায় কী ভুল -তা  স্ক্যান করার মতো জ্ঞান ও যোগ্যতা পূর্ণমাত্রায় আছে বলে তাদের নিজেদের ধারনা। এই মহামারী আজ এমন এক বিকট আকার ধারণ করেছে যে, বাজার আজকে এরাই দখল করে নিয়েছে। শহুরে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার থেকে শুরু করে গ্রাম্য সাধারণ ব্যাক্তি পর্যন্ত এই মহামারীতে আক্রান্ত। আর আম পাবলিকের অবস্থাও এত সোচনীয় যে, তারা বিবেকের মাথা খেয়ে এদের কাছে কুরআন ও সুন্নাহ’র ইলম অন্বেষন করে, মাসআলাহ জিজ্ঞেস করে, কোন আলেম কোথায় ভুল করেছে -তার সমাধান তলব করে ইত্যাদি।
 
এই শেষ জামানা এই দুই শ্রেণির লোকজন (তথা অল্প ইলমধারী আলেম ও স্বশিক্ষিত ইলমধারী লোকদের) এবং বিবেকহীন সাধারণ মুর্খ জনগণ দিয়ে প্রায় গোটা পৃথিবী কাণয় কাণায় পূর্ণ। মুহাক্কিক আলেম ও সচেতন বিবেকবান সাধারণ মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে অতি নগন্য।
 
সম্ভবতঃ কিছু হাদিসের ইশারা এদিকেই। যেমন: হযরত  আনাস বিন মালেক রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেন-  إن من أشراط الساعة أن يرفع العلم ويظهر الجهل – ‘কেয়ামতের লক্ষনসমূহের মধ্যে এও রয়েছে যে, (দ্বীনী) ইলম উঠে যাবে এবং মুর্খতা প্রকাশ পাবে।[সহিহ বুখারী, হাদিস ৬৮০৮; সহিহ মুসলীম, হাদিস ২৬৭১;  মুসনাদে আহমাদ-৩/১৫১; জামে তিরমিযী, হাদিস ২২০৫; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস ৪০৪৫] আরেক হাদিসে এসেছে , রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেন- إِنَّ اللَّهَ لاَ يَقْبِضُ الْعِلْمَ انْتِزَاعًا، يَنْتَزِعُهُ مِنَ الْعِبَادِ، وَلَكِنْ يَقْبِضُ الْعِلْمَ بِقَبْضِ الْعُلَمَاءِ، حَتَّى إِذَا لَمْ يُبْقِ عَالِمًا، اتَّخَذَ النَّاسُ رُءُوسًا جُهَّالاً فَسُئِلُوا، فَأَفْتَوْا بِغَيْرِ عِلْمٍ، فَضَلُّوا وَأَضَلُّوا . رواه البخاري: رقم ١٠٠ , و مسلم : ٢٦٧٣, و الترمذي :٢٦٥٢ , وابن ماجه : المقدمة٥٢ , وأحمد: ٢/١٦٢ , والدارمي : المقدمة ٢٣٩ –‘নিশ্চই আল্লাহ (কুরআন ও সুন্নাহ’র সহিহ) ইলমকে লোকজনের অন্তর থেকে ছিনিয়ে নেয়ার ন্যায় ছিনিয়ে নিবেন না। তবে তিনি আলেমগণকে (একে একে মৃত্যু দিয়ে দুনিয়া থেকে) উঠিয়ে নেয়ার মাধ্যমে ইলমকে তুলে নিবেন। যখন কোনো আলেম থাকবে না, তখন লোকজন তাদের জাহেল-মুর্খ প্রধানদেরকে ধরে তাদের কাছে প্রশ্ন করবে। তখন তারা ইলম ছাড়াই ফাতওয়া/জবাব দিবে। ফলে তারা (নিজেরাও) পথভ্রষ্ঠ হবে, (যারা প্রশ্ন করেছে) তাদেরকেও পথভ্রষ্ঠ করবে’।[সহিহ বুখারী, হাদিস ১০০; সহিহ মুসলীম, হাদিস ২৬৭৩;  মুসনাদে আহমাদ-২/১৬২; জামে তিরমিযী, হাদিস ২৬৫২; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস ৫২; সুনানে দারেমী, হাদিস ২৩৯] 
 
ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহ. তাঁর কিতাব ‘আল-যুহদ’-এ উত্তম সনদে হযরত আবু উমাইয়্যাহ আল-যামহী রা.-এর  সূত্রে একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেন- إِنَّ مِنْ أَشْرَاطِ السَّاعَةِ ثَلاثًا : إِحْدَاهُنَّ أَنْ يُلْتَمَسَ الْعِلْمُ عِنْدَ الأصَاغِرِ- أخرجه ابن المبارك في ” الزهد ” ٦١ , و عنه أبو عمرو الداني في ” السنن الواردة في الفتن “٢/٦٢ رقم ٤٣٨, و اللالكائي في ” شرح أصول السنة ” ١/٢٣٠ كواكب ٥٧٦, قال الألباني في “السلسلة الصحيحة” ٢/٣١٦: قلت اسناده جيد, والطبراني في الكبير ٢٢/٣٦١، ابن عبد البر في جامع بيان العلم وفضله: ٢/٢٤٩ , الهيثمي في المجمع ١/١٣٥, – ‘কেয়ামতের লক্ষনসমূহের মধ্যে তিনটি লক্ষন আছে, যার একটি হল- (দ্বীনের) ইলম’কে একদম ছোটদের কাছে তলব করা হবে’। [আল-যুহদ, ইবনুল মুবারকহাদিস ৬১; ‘আস-সুন্নাহ, ইমাম দানী-২/৬২, হাদিস ৪৩৮; শারহু উসূলীস সুন্নাহ, আলকানী-১/২৩০, কাওয়াকিব ৫৭৬; আল-মু’জামুল কাবির, ত্বাবরানী- ২২/৩৬১; জামেঊ বায়ানিল ইলম, ইবনে আব্দল বার-২/২৪৯; মাজমাউয যাওয়ায়ীদ, হাইছামী- ১/১৩৫] ছোটদের কাছ থেকে ইলম হাসিলের অর্থ আমরা এখানে করে এসেছি।
 
(৪) মসজিদের মুতাওয়াল্লি (সেক্রেটারী) পদ ও দায়িত্বের মধ্যে খেয়ানত: আল্লাহ তাআলা’র অনুগত বান্দা মুসলমানদের জন্য নামায ও যিকিরের সর্বত্তম স্থান হল আল্লাহ’র ঘর মসজিদ। যে ব্যাক্তি শরীয়তের দৃষ্টিতে নূন্যতম মাত্রারও মুসলমান, তার জন্য মসজিদে প্রবেশ করে নামায ও আল্লাহ’র যিকির করার হক্ব রয়েছে -যতক্ষন পর্যন্ত তারা কুরআন ও সুন্নাহ’র অপরাপর সংশ্লিষ্ট বিধান লঙ্ঘন না কর এটা আল্লাহ’র পক্ষের লোকদের ইবাদতখানা; বিপক্ষের লোকদের েনয়। কিন্তু এই শেষ জামানায় এসে ভাল করে খোঁজ করে দেখুন, মসজিদগুলোর কমিটিতে মুতাওল্লী/সেক্রেটারী/সভাপতি, অর্থরক্ষক ও সাধারণ সদস্যরা হল তারা-
(ক) যাদের একজনও -পূর্ণ ইসলাম কায়েম হোক -তা চায় না, মানে সেকুলার (রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলামী শরীয়ত বাদ দেয়ার) আদর্শে বিশ্বাসী মর্মে সমাজে পরিচিত।
(খ) যারা সারাটা জীবন সূদী ব্যাংকের কর্মকর্তা বা কর্মচারী হিসেবে চাকুরী করে প্রকাশ্যভাবে হারাম খেয়েছে মর্মে সমাজে পরিচিত। 
(গ) যারা সূদ ও জুয়া নির্ভর ইন্সুরেন্স কোম্পনীর কর্মকর্তা বা কর্মচারী হিসেবে চাকুরী করে প্রকাশ্যভাবে হারাম খেয়েছে মর্মে সমাজে পরিচিত। (ঘ) যারা সমাজের এমন নেতা যার -মাস্তান পোষা, অর্থ আত্বসাৎ, অন্যান্য অসততা, এমনকি কাউকে খুন করার দোষে দোষী মর্মে সমাজে পরিচিত।
(ঘ) যারা এযুগের নাজায়েয কায়দায় কন্ট্রক্টরী ব্যবসার মাধ্যমে হারাম কামাই করে মর্মে সমাজে পরিচিত।
(ঙ) যারা কুরআন-সুন্নাহ’র পর্দা ব্যবস্থাকে নারীর অধিকার হনন বলে বিশ্বাস করে অথবা নিজের পরিবারের মধ্যে পর্দার কোনো ব্যবস্থা রাখে না -এমন ব্যাক্তি মর্মে সমাজে পরিচিত। ইত্যাদি
 
মসজিদ কমিটিগুলোতে হাতে গোণা দুই একজন বাদে প্রায় সকলের এই একই অবস্থা। যেমন মুসুল্লী সমাজ তেমনি তাদের মসজিদ কমিটির সদস্যরা। 
 
একটা জামানা ছিল যখন রাসুলুল্লাহ সা. সকল মুসলমানকে তিন জন সাহাবী রা.-এর সাথে প্রায় চল্লিশ দিন সালাম-কালাম করতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন -‘জিহাদে অংশগ্রহন না করার অপরাধে’, যদিও-বা তখন তাঁদের তিন জনের জিহাদে যাওয়া না যাওয়ার উপর জিহাদের বিজয় নির্ভরশীল ছিল না। পরে তাঁদের তওবা কবুল হওয়ার পর রাসুলুল্লাহ সা. সকল মুসলমানকে তাঁদের সাথে সালাম-কালামের অনুমতি দেন। আমরা এও দেখতে পাই যে, রাসুলুল্লাহ সা. বহু মুনাফেককে নাম ধরে ধরে মসজিদ থেকে বেড় করে দিয়েছিলেন রাসুলুল্লাহ সা.-এর বিরুদ্ধে ষঢ়যন্ত্র করার এক অপরাধে।
 
কিন্তু এই শেষ জামানায় অবস্থা হয়ে গেছে একেবারে উল্টো। আজ উপরের (ক) থেকে (ঙ) পর্যন্ত লোকগুলি মসজিদের নামাযের প্রথম কাতারে দাড়ানোর বা মুসুল্লদের প্রতিনিধি হয়ে মসজিদের বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলা সম্মান পায়, তারাই মিটিং করে নির্ধারণ করে যে, কোন খতীব/ইমাম/মুয়াযযীনকে মসজিদে রাখা হবে আর কাকে বেড় করে দেয়া হবে !!! ধর্মনিরপেক্ষতার মতো কুফরী আক্বিদা অন্তরে রেখে আর হারাম কামাইয়ের শরীর নিয়ে মসজিদে গমন ও নামায পড়ে কোন বেহেশতের আশা করা যায়!!!

শাদ্দাদ বিন মা’কিল আল-আসাদী রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-কে বলতে শুনেছি: أَوَّلُ مَا تَفْقِدُونَ مِنْ دِينِكُمَ الأَمَانَةُ ، وَآخِرُ مَا تَفْقِدُونَ مِنْهُ الصَّلاَةُ ، وَسَيُصَلِّي قَوْمٌ وَلاَ دَيْنَ لَهُمْ – ‘তোমাদের দ্বীন (ইসলাম) থেকে প্রথমে যে জিনিসটিকে উঠিয়ে নেয়া হবে (সেটা হল) ‘আমানত’, আর সর্বশেষে যে জিনিসটিকে উঠিয়ে নেয়া হবে (সেটা হল) নামায। একটি কওম নামায পড়বে কিন্তু (ইসলাম) তাদের দ্বীন হবে না, (তাদের দ্বীন হবে অন্য কোনো বিশ্বাস বা মতবাদ)’। [আল-মুসান্নাফ, ইবনু আবি শায়বাহ- ১৪/১৬১]

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. থেকে বর্ণিত,  তিনি বলেন-  يأتي على الناس زمان يجتمعون في المساجد ليس فيهم مؤمن ” . أخرجه الحاكم في المستدرك: ٤/٤٨٩ و قال هذا حديث صحيح الإسناد على شرط الشيخين ولم يخرجاه . و وافقه الذهبي. والطحاوي في “مشكل الآثار”- ٥٩٠ , ابن أبي شيبة في “المصنف: ٣٠٣٥٥, ٣٧٥٨٦ , ابن عدي في “الكامل: ٢/٢١٤, والفريابي في “صفة المنافق”: ١٠٨, ١٠٩, ١١٠, الخلال في السُّنَّة: ٥/٥٩, رقم ١٦٠٩ – ‘মানুষের উপর এমন জামানা আসবে, যখন (লোকজন) মসজিদে একত্রিত হবে, (কিন্তু) তাদের মধ্যে কোনো মু’মিন ব্যাক্তি থাকবে না। [মুসতাদরাকে হাকিম- ৪/৪৮৯; শারহু মুশকিলিল আছার, ত্বাহাবী- ৫৯০; আল-মুসান্নাফ, ইবনু আবি শায়বা, আছার ৩০৩৫৫, ৩৭৫৮৬; আল-কামেল, ইবনুল আদী- ২/২১৪; সিফাতুল মুনাফেক, ফারইয়াবী- ১০৮, ১০৯, ১১০; আস-সুন্নাহ, ইমাম খাল্লাল- ৫/৫৯, আছার ১৬০৯]

ইমাম দাইলামী রহ. বর্ণনা করেছেন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেছেন- سيأتي على الناس زمان يصلي في المسجد منهم ألف رجل أو زيادة لا يكون فيهم مؤمن. رواه الديلمي في الفردوس بمأثور الخطاب: ١/٢٣٣ رقم ٣٤٤٧ -‘অতি শিঘ্রই মানুষের উপর এমন জামানা আসবে, যখন মসজিদের মধ্যে (জামাআতে) নামায হবে, যাদের মধ্যে এক-হাজার বা তার বেশি পুরুষ (লোক জামাআতে শরীক) থাকবে, (কিন্তু) তাদের মধ্যে কোনো মু’মিন ব্যাক্তি থাকবে না’। [আল-ফিরদাউস, দাইলামী- ১/২৩৩, আছার ৩৪৪৭] হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে,  তিনি বলেন-  إن من اقتراب الساعة أن يصلي خمسون نفسا لا تقبل لأحدهم صلاة‏ .‏ رواه  ‏أبو الشيخ في كتاب الفتن كذا فى كنز العمال : ٣٨٤٢٧ , بإسناد ضعيف كذا فى التيسير بشرح الجامع الصغير لالمناوي: ١/٧٠٣  – ‘কেয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে (এমনও হবে যে, মসজিদে গিয়ে জামাআতে) পঞ্চাশন মানুষ নামায পড়বে, কিন্তু তাদের কারোর নামাযই কবুল হবে না’। [আবুশ শায়েখ: কাঞ্জুল উম্মাল, আছার ৩৮৪৬৭; আত-তাইসির, মুনাবী-  ১/১৭২] ইমাম আবু শুআইব রহ. বর্ণনা করেছেন –  يأتي على الناس زمان يحجون ويصلون ويصومون وما فيهم مؤمن . رواه أبو شعيب الحراني في “فوائده”، وإسناده لا بأس به. كذا فى إتحاف الجماعة بما جاء في الفتن والملاحم وأشراط الساعة لحمود بن عبد الله التويجري : ٢/٦٤ ‘মানুষের উপর এমন জামানা আসবে, যখন (মুসলমান হিসেবে পরিচিত লোকজন) হজ্জ করবে, নামায পড়বে, রোযা রাখবে, কিন্তু তাদের মধ্যে কোনো মু’মিন ব্যাক্তি থাকবে না’। [আল-ফাওয়ায়িদ, ইমাম আবু শুআইব: ইতহাফুল জামাআহ বিমা যাআ ফিল ফিতান ওয়াল মালাহিম ওয়া আশরাতিস সাআহ- ২/৬৪] 

 

শেষ কথা:

এখানে মাত্র কয়েকটি বিশেষ পদ ও তার কার্যাবলির মধ্যে খিয়ানত করার উদাহরণ দিলাম; সবগুলো এক এক করে উল্লেক করা সম্ভব নয়। একইভাবে প্রতিটি প্রশাসনিক পদ, শিক্ষাগত পদ, ইন্টেলিজেন্স ও ইনফোর্সমেন্ট এজেন্সি (যেমন: পুলিশ, র‌্যাব, সিআইডি, বিবিডি, সিআইএ ইত্যাদি)র পদ সহ বাকিগুলোও বুঝে নিন। মুসলীম উম্মাহ’র বেশিরভাগ অংশে আজ খেয়ানতের পঁচন ধরে গেছে। আমার বিশ্বাস, নিম্নোক্ত হাদিসগুলোতে এদিকেই ইংগীত করা হয়েছে।

 হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা.-এর  সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেন- كيف بكم وبزمان أو يوشك أن يأتي زمان يغربل الناس فيه غربلة تبقى حثالة من الناس قد مرجت عهودهم وأماناتهم واختلفوا فكانوا هكذا وشبك بين أصابعه، فقالوا: وكيف بنا يا رسول الله؟ قال: تأخذون ما تعرفون وتذرون ما تنكرون وتقبلون على أمر خاصتكم وتذرون أمر عامتكم – رواه أبو داود ٤٣٤٢ ، والإمام أحمد في المسند ٧٠٢٣ ، وانظر صحيح سنن أبي داود ٣٦٤٨ – ‘তখন তোমাদের বা (বলেছেন তোমাদের) জামানার কি অবস্থা হবে অথবা (বলেছেন) অতি শিঘ্রই এমন জামানা আসছে, যখন মানুষজন একদম (পঁচন ধরা) বিকৃত হয়ে যাবে, অবশিষ্ট থাকবে (আবর্জনায়) পরিত্যাক্ত (জিনিসের মতো নিকৃষ্ট বদ স্বভাবের এমন সব) মানুষজন, যাদের প্রতিশ্রুতি ও আমানতগুলো খলৎমলৎ হয়ে যাবে এবং তারা দ্বন্দ্ব ও বিরোধ বাঁধাবে। তখন তারা এরকম হয়ে যাবে–(একথা বলে তিঁনি) তাঁর আঙ্গুলগুলোকে একটার মাঝে অরেকটা ঢুকিয়ে দিলেন। তখন লোকেজন জিজ্ঞেস করলেন: ইয়া রাসুলাল্লাহ, তখন আমরা (মুসলমানরা) কি করবো? তিনি বললেন: (সে সময় -আমার আনীত দ্বীনের) যা কিছু তোমরা (নির্ভরযোগ্য ভাবে) চিনে নিতে পারো তা গ্রহন করবে এবং (শরীয়ত ও বিবেকগত ভাবে) যা কিছু নিন্দনীয় দেখো তা পরিত্যাগ করবে, আর (সংশোধনের আশা আছে- এরকম) তোমাদের বিশেষ লোকজনের ব্যাপারগুলো গ্রহন করবে (ও সে ব্যাপারে শরীয়তের হক্ব আদায় করবে) এবং তোমাদের আম-জনতার বিষয়গুলোকে ছেড়ে দিবে, (কারণ তাদের ফিতনার সাগরে গেলে তোমাদের ইমান-আমলও তাদের ঢেউ-এর তোড় তোমাদেরকে তাদের সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে)। [সুনানে আবু দাউদহাদিস ৪৩৪২; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস ৭০২৩]

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা.-এর  সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন-  بَيْنَمَا نَحْنُ حَوْلَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِذْ ذَكَرَ الْفِتْنَةَ فَقَالَ ‏”‏ إِذَا رَأَيْتُمُ النَّاسَ قَدْ مَرِجَتْ عُهُودُهُمْ وَخَفَّتْ أَمَانَاتُهُمْ وَكَانُوا هَكَذَا ‏”‏ ‏.‏ وَشَبَّكَ بَيْنَ أَصَابِعِهِ قَالَ فَقُمْتُ إِلَيْهِ فَقُلْتُ كَيْفَ أَفْعَلُ عِنْدَ ذَلِكَ جَعَلَنِي اللَّهُ فِدَاكَ قَالَ ‏”‏ الْزَمْ بَيْتَكَ وَامْلِكْ عَلَيْكَ لِسَانَكَ وَخُذْ بِمَا تَعْرِفُ وَدَعْ مَا تُنْكِرُ وَعَلَيْكَ بِأَمْرِ خَاصَّةِ نَفْسِكَ وَدَعْ عَنْكَ أَمْرَ الْعَامَّةِ – رواه أبو داود ٤٣٤٣ – আমরা রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর সামনে গোল হয়ে বসা ছিলাম, তখন তিনি ফিতনা সম্পর্কে কথা বলছিলেন। তিনি বললেন: তোমরা যখন মানুষ জনকে দেখবে যে, তাদের প্রতিশ্রুতিগুলো খলৎমলৎ হয়ে হয়ে গেছে এবং তাদের আমানতদারী নিভুপ্রায় হয়ে গেছে, তখন তারা এরকম হয়ে যাবে–(একথা বলে তিঁনি) তাঁর আঙ্গুল গুলোকে একটার মাঝে অরেকটা ঢুকিয়ে দিলেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা বলেন: তখন আমি উঠে তাঁর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম: আল্লাহ আমাকে আপনার তরে জীবন উৎসর্গ করুন। ওই অবস্থার সম্মুখীন হলে আমি কি করবো? রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন: (লোকজনের সংশোধনের চিন্তা পরিত্যাগ করে সময় অতিবাহিত করার জন্য) তোমার ঘরকে অপরিহার্য করে নাও, (ফিতনা’য় অংশ নিও না, বরং) তোমার জিহবাকে (যথাসাধ্য) সংযত করে রাখো (কারণ তুমি জানো না, তোমার কোন কথা ফিতনা’র আগুনকে ভরকিয়ে দিবে আর তুমি সেই পাপের অংশীদার হয়ে বসবে), এবং (সে সময় -আমার আনীত দ্বীনের) যা কিছু তুমি (নির্ভরযোগ্য ভাবে) চিনে নিতে পারো তা গ্রহন করো এবং (শরীয়ত ও বিবেকগত ভাবে) যা কিছু নিন্দনীয় দেখো তা পরিত্যাগ করো। আর তুমি শুধু তোমার নিজের বিশেষ ব্যাপার (কে নিয়ে চিন্তিত থাককাকে) অপরিহার্য করে নাও, আর সর্বসাধারণের ব্যাপারাদি থেকে নিজকে বিরত রাখো’। [সুনানে আবু দাউদহাদিস ৪৩৪৩]

 

الله اعلم بالصواب و أخر دعوانا عن الحمد لله رب العالمين و الصلاة و السلام على رسوله محمد و على أله و أمّته و استغفر الله و أتوب إليه

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *