ইসলামী শরীয়তের উৎস ও মানদন্ড : কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস

ইসলামী শরীয়তের উৎস ও মানদন্ড : কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস 

 

بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیۡمِ

الحمد لله و الصلاة و السلام على رسوله محمد و على أله و أمّته

اَللّٰهُمَّ صَلِّ عَليٰ مُحَمَّدٍ النبي الأمي عَدَدَ خَلْقِك وَ رِضَا نَفْسِك وَزِنَةَ عَرْشِك وَ مِدَادَ كَلِمَاتِك، صَلِّ عَليه صَلاَةً كَامِلَةً دَائِمَةً كَمَا يَنْبَغِي أَنْ يُصَلَّى عَلَيهِ وَ سَلِّمْ تَسلِيمَاً بِقَدرِ عَظَمَةِ ذَاتِكَ فِى كُلِّ وَقتٍ وَ حِين، صلاة تكون لك رضاء و له جزاء، صلاة لا غاية لها ولا منتهى ولا انقضاء باقية ببقائك الى يوم الدين ، و اعطه الوسيلة و الفضيلة و المقام المحمود الذي وعدته، و اجزه عنا ما هو اهله، و على اله وأصحابه و أزواجه و ذريته و أهل بيته و سلم تسليما مثل ذلك، اَللّٰهُمَّ اجمعني معه في الفردوس و جنة المأوى، اَللّٰهُمَّ صَلِّ عَليٰ مُحَمَّدٍ صَلوٰةً تُنَجِّيْنَا بِهَا مِنْ جَمِيْعِ الْأَهْوَالِ وَاْلآفَاتِ وَتَقْضِيْ لَنَا بِهَا مِنْ جَمِيْعِ الْحَاجَاتِ وَتُطَهِّرُنَا بِهَا مِنْ جَمِيْعِ السَّيِّاٰتِ وَتَرْفَعُنَا بِهَا عِنْدَكَ اَعْليٰ الدَّرَجَاتِ وَتُبَلِّغُنَا بِهَا اَقْصىٰ الْغَايَاتِ مِنْ جَمِيْعِ الْخَيْرَاتِ فِي الْحَيَاتِ وَبَعْدَ الْمَمَاتِ- اِنَّكَ عَليٰ كُلِّ شَيْئٍ قَدِيْرٍ بِرَحْمَتِكَ يَا اَرْحَمَ الرَّاحِمِيْنَ

 

আল্লাহ তাআলা  এরশাদ করেন-

 ثُمَّ جَعَلْنَاكَ عَلَىٰ شَرِيعَةٍ مِنَ الْأَمْرِ فَاتَّبِعْهَا وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَ الَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ

‘অতঃপর (হে নবী মুহাম্মাদ!) আমি তোমাকে (আমার) নির্দেশিত একটি শরীয়তের উপর স্থাপন করেছি। অতএব তুমি তার অনুসরণ করে চলো এবং যারা (এই শরীয়ত সম্পর্কে) জানে না তুমি তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না’। [সূরা জাসিয়া ১৮]
 
  اتَّبِعْ مَا أُوحِيَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ 
‘(হে নবী মুহাম্মাদ!) তোমার রবের পক্ষ থেকে তোমার কাছে যে ওহী আসে তুমি সেটারই অনুগত্য-অনুসরণ করে চলো’। [সূরা অানআম ১০৬]


اتَّبِعُوا مَا أُنزِلَ إِلَيْكُم مِّن رَّبِّكُمْ وَلَا تَتَّبِعُوا مِن دُونِهِ أَوْلِيَاءَ 

‘(হে মুমিনগণ!) তোমাদের রবের পক্ষ থেকে (নবী মুহাম্মাদের উপর) তোমাদের জন্য (শরীয়ত হিসেবে) যা নাজিল করা হয়েছে, তোমরা তার অনুগত্য করে চলো। আর তাঁকে বাদ দিয়ে (অন্য কোনো) অভি ভাবকের  অনুগত্য-অনুসরণ করো না’। [সূরা আ’রাফ ৩]

 
উপরের এসকল আয়াত থেকে সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয়-
 
  (১) আল্লাহ তাআলা তাঁর সর্বোশেষ নবী ও রাসুল মুহাম্মাদ ﷺ-কে নবুওত দানের পর তাঁর শেষ জীবন পর্যন্ত যে ইসলামী শরীয়তের উপর রেখেছেন, তাঁর অনুসারী বলে দাবীদার মুসলমানদের জন্য শুধু সেই শরীয়তের অনুগত্য-অনুসরণ করা মুসলমানদের জন্য ফরয (obligatory)। 
 
(২) ইসলামী শরীয়তের সাথে সাংঘর্ষিক বা বিরোধী যে কারো উদ্ভাবীত বা আমদানীকৃত যে কোনো বিশ্বাস, আদর্শ, মতবাদ-মতাদর্শ ও বিধি-নিষেধের অনুগত্য-অনুসরণ করা মুসলীম উম্মাহ’র জন্য সম্পূর্ণ হারাম।  
 
এখন জানা প্রয়োজন, ‘ইসলামী শরীয়ত কী’ এবং ‘ইসলামী শরীয়তের উৎস কী কী’? 

 ইসলামী শরীয়ত কী?

ইসলামী শরীয়তের উৎস ও মানদন্ড কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস

ইসলামী শরীয়ত (شريعة) বলতে আল্লাহ তাআল ‘র ওইসকল আদেশ নিষেধ ও অনুমতিকে বুঝায় যা তিঁনি তাঁর সর্বোশেষ নবী ও রাসুল মুহাম্মাদ -এর উপর ওহীসূত্রে নাজিল করেছেন এবং মুহাম্মাদ সা. সেই নাজিলকৃত ওহীসমূহকে যেভাবে মানা শিখিয়ে গেছেন
 
অন্যকথায়, ইসলামী শরীয়ত হল – আল্লাহ তাআলার’র হুকুম (যা ওহী সুত্রে কুরআন আকারে নাজিল হয়েছে) এবং মুহাম্মাদ -এর শরয়ী ব্যাখ্যা (যা তাঁর উপর সুন্নাহ বা আদর্শ হিসেবে ওহী সুত্রে নাজিল হয়েছে) -এই দুইয়ের সামষ্টিক রূপ। 
 
وَ أَنزَلَ اللَّهُ عَلَيْكَ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ  
‘‘আর (হে নবী মুহাম্মাদ!আল্লাহ তোমার কাছে নাজিল করেছেন আল-কিতাব (কুরআন) এবং হিকমাহ্ (সুন্নাহ)’ [সূরা নিসা ১১৩] 
 
وَاذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ وَمَا أَنزَلَ عَلَيْكُم مِّنَ الْكِتَابِ وَالْحِكْمَةِ يَعِظُكُم بِهِ
‘তোমরা তোমাদের উপর আল্লাহ’র অনুগ্রহের কথা স্মরণ করো এবং (স্মরণ করো) আল-কিতাব (কুরআন) ও হিকমাহ (সুন্নাহ) হতে তোমাদের উপর যা নাজিল করেছেন, যা দিয়ে তোমাদেরকে উপদেশ দান করা হয়’ [সূরা বাকারাহ ২৩১]
 
هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَ الْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُبِينٍ
‘‘তিঁনি (সেই সত্ত্বা) যিঁনি (আরবের) উম্মি(নিরক্ষর)দের মধ্যে তাদেরই একজনকে রাসুল হিসেবে পাঠিয়েছেন, (যে রাসুল) তাদের কাছে তাঁর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে শোনান, তাদেরকে পবিত্র করেন এবং তাদেরকে আল-কিতাবআল-হিকমাহ শিক্ষা দেন। আর ইতিপূর্বে তারা ছিল অবশ্যই পরিষ্কার পথভ্রষ্ঠয় লিপ্ত”। [সূরা আল-জুমআহ ২] 
 
 لَقَدْ مَنَّ اللَّهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولًا مِّنْ أَنفُسِهِمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَ الْحِكْمَةَ وَإِن كَانُوا مِن قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ –
  ‘বস্তুতঃ আল্লাহ মুমিনদের উপর অনুগ্রহ করেছিলেন, যখন তিনি তাদের মাঝে তাদেরই মধ্য থেকে (একজনকে) রাসুল (হিসেবে) পাঠালেন, যিনি তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করে শোনান ও তাদেরকে পবিত্র করেন এবং শিক্ষা দেন তাদেরকে আল-কিতাব (কুরআন) ও হিকমাহ্ (সুন্নাহ)। আর ইতিপূর্বে অবশ্যই তারা ছিল পরিষ্কার পথভ্রষ্ঠয় লিপ্ত। [সূরা আল-ইমরান ১৬৪]
 
উপরোক্ত আয়াতগুলোতে দু’টি শব্দ এসছে- الْكِتَابَ (আল-কিতাব) এবং الْحِكْمَةُ (আল-হিকমাহ)
 
الْكِتَابَ (আল-কিতাব)– বলতে ‘আল-কুরআন’ উদ্দেশ্য -এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
 
الْحِكْمَةُ (আল-হিকমাহ) অর্থ- নবী মুহাম্মাদ সা.-এর সুন্নাহ (বানী ও কর্মসমষ্টি), যা আল্লাহ তাআলা হযরত জিবরীল আ.-এর মাধ্যমে মুহাম্মাদ -এর উপর শরীয়ত হিসেবে কুরআনের পাশাপাশি অতিরক্তি নাজিল করেছেন, যার দ্বারা মুমিন ব্যাক্তি দ্বীনের সহীহ পরিচয় লাভ করে এবং কুরআন তার কাছে কি চায় কিভাবে চায় -তা উপলব্ধি করতে পারে, হক্ব ও বাতিল চিনতে পারে, হেদায়েতের উপর চলতে পারে।। [বিস্তারিত জানতে দেখুন: তাফসীরে তাবারী, আছার ৮১৭৭ ; তাফসীরে কাবীর, ইমাম রাজি- ৭/৭৩; তাফসীরে ইবনে কাসির; আল-মাওয়াফিকাত, শাতেবী- ৪/১৪; মাজমুঊল ফাতাওয়া, ইবনে তাইমিয়্যাহ- ১৯/৪৬; তাফসিরুস সাহীহ- ১/৩৪৮; ] 
 
ইমাম শাফেয়ী রহ. বলেন- ذكر الله الكتاب ، وهو القُرَآن ، وذكر الحِكْمَة ، فسمعتُ مَنْ أرْضى من أهل العلم بالقُرَآن يقول : الحكمة سنة رسول الله ؛ لأن القُرَآن ذُكر وأُتْبِعَتْه الحكمة ، وذكرَ الله منَّه على خَلْقه بتعليمهم الكتاب والحكمة ، فلم يَجُزْ – والله أعلم – أن يقال الحكمة هاهنا إلا سنةُ رسول الله . وذلك أنها مقرونة مع كتاب الله ، وأن الله افترض طاعة رسوله ، وحتَّم على الناس اتباع أمره ، فلا يجوز أن يقال لقول : فرضٌ ، إلا لكتاب الله ، ثم سنة رسوله – “আল্লাহ তাআলা الكتاب (আল-কিতাব)-এর কথা উল্লেখ করেছেন, আর তা হল আল-কুরআন। তিনি এরপর الحِكْمَة (আল-হিকমাহ)-র কথাও উল্লেখ করেছেন। আমি আমার দেশের ওলামায়ে কেরামগণ থেকে শুনেছি, কুরআন যে এখানে الحِكْمَة (আল-হিকমাহ)-র কথাও উল্লেখ করেছে তার অর্থ হল سنة رسول الله –‘রাসুলুল্লাহ -এর সুন্নাহ’কারণ, (এসকল আয়াতে) আল- কুরঅনের কথা বলা হয়েছে এবং তার অনুগামী হিসেবে বলা হয়েছে الحِكْمَة (আল-হিকমাহ)-র কথা। আল্লাহ তাআলা উল্লেখ করেছেন যে, তিনি তাঁর সৃষ্টি (মানুষের)কে আল-কিতাব ও আল-হিকমাহ শিক্ষা দেয়ার মাধ্যমে তাদের উপর অনুগ্রহ করেছন। তাই আল-হিকমাহ বলতে এখানে রাসুলুল্লাহ -এর সুন্নাহ ছাড়া অন্য কোনো অর্থের কথা বলা সঠিক হতে পারে না। আল্লাহ’ই অধিক জানেন। বস্তুতঃ আল্লাহ’র কিতাবের সাথে আল-হিকমাহ (নবীর সুন্নাহ) আষ্টেপিষ্টে জড়িত। আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসুলের অনুগত্য করতে বলেছেন এবং মানুষের জন্য রাসুলের নির্দেশের অনুগত্য করাতে বাধ্যবাধক করে দিয়েছেন। কাজেই কেবলমাত্র আল্লাহ’র কিতাব (আল-কুরআন) মানা ফরয, তারপর তাঁর রাসুলের সুন্নাহ -একথা বলা জায়েয নেই। (কারণ কুরআন ও সুন্নাহ দুটিই ওহী সূত্রে নাজিলকৃত এবং ইসলামী শরীয়ত হল এ দুই-এর সমহ্নিত রূপ)”। [আর-রিসালাহ, ইমাম শাফেয়ী- ১/৭৮]
 
ইমাম ইবনে রজব হাম্বলী রহ. বলেছেন- من قال الحكمة : السنة ، فقوله الحق ؛ لأن السنة تفسر القرآن ، وتبين معانيه ، وتحض على اتباعه…انتهى – “যারা বলেন الحِكْمَة (আল-হিকমাহ) অর্থ সুন্নাহ, তাদের কথা সঠিক। কারণ সুন্নাহ হল কুরআনের তাফসীর (ব্যাখ্যা), যা কুরআনের অর্থ ও মর্মকে খুলে খুলে বর্ণনা করে এবং তার অনুসরণের সোপান হিসেবে কাজ করে”। [লাত্বায়েফুল মাআরিফ, ইবনে রজব- ৮৪ পৃ:]
 
এক হাদিসে এসেছে, নবী মুহাম্মাদ এরশাদ করেন- أَلَا إِنِّي أُوتِيتُ الْكِتَابَ وَمِثْلَهُ مَعَهُ – “খুব ভাল করে শোন! নিশ্চই অামাকে (ওহী যোগে)  ‘আল-কিতাব’ দেয়া হয়েছে এবং এর সাথে এরই মতো (আরেকটি) জিনেস (ওহী সূত্রেই দেয়া হয়েছে)” [সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৪৬০৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস ১৭১৭৩; সুনানে তিরমিযী, হাদিস ২৬৬৪]
 
ইমাম ইবনুল বাত্তাল রহ. এই হাদিসের وَمِثْلَهُ مَعَهُ –এবং এর সাথে এরই মতো (আরেকটি) জিনেস (ওহী সূত্রেই দেয়া হয়েছে)’-এর ব্যাখ্যায় বলেছেন- قال أهل العلم : أراد بذلك السنة التي أوتي…انتهى – আলেমগণ বলেছেন, এর দ্বারা (রাসুলুল্লাহ’র) সুন্নাহ উদ্দেশ্য………।  তিনি আরা বলেন- كان جبريل ينزل عليه بالسنن كما يأتيه بالقرآن، ولذلك قال صلى الله عليه وسلم : – أوتيت الكتاب ومثله معه – يعنى : من السنن…. انتهى  হযরত জিবরীল আ. যেমন তাঁর কাছে কুরআন নিয়ে আসতেন, তেমনিভাবে তিনি তাঁর উপর সুন্নাহ’ নিয়েও নাজিল হতেন। আর এজন্যই রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেন- أوتيت الكتاب ومثله معه – আমাকে (ওহী যোগে)  ‘আল-কিতাব’ দেয়া হয়েছে এবং এর সাথে এরই মতো (আরেকটি) জিনেস (ওহী সূত্রেই দেয়া হয়েছে)’। অর্থাৎ সুন্নাহ…………….। [শারহুল বুখারী, ইবনুল বাত্তাল-১৯/৪৭৩]
 
 এখানে আমারা দেখতে পেলাম, আল্লাহ তাআলা তাঁর সর্বশেস নবী মুহাম্মাদ -এর উপর ওহীসূত্রে দু’টি জিনিস নাজিল করেছেন: (১) আল-কিতাব (আল-কুরআন) এবং আল-হিকমাহ (সুন্নাহ), যা ইসলামী শরীয়তের মূল উৎস। ثُمَّ جَعَلْنَاكَ عَلَىٰ شَرِيعَةٍ مِنَ الْأَمْرِ فَاتَّبِعْهَا وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَ الَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ – ‘অতঃপর (হে নবী মুহাম্মাদ!) আমি তোমাকে (আমার) নির্দেশিত একটি শরীয়তের উপর স্থাপন করেছি। অতএব তুমি তার অনুসরণ করে চলো এবং যারা (এই শরীয়ত সম্পর্কে) জানে না তুমি তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না’। [সূরা জাসিয়া ১৮]
 
 ইসলামী শরীয়তের ক্ষেত্রসীমা
 
 এখন প্রশ্ন হল, ইসলামী শরীয়ত মানুষের জীবনের কোন কোন ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এর জবাব হল, জীবনের সকল ক্ষেত্রে -চাই তা ব্যাক্তি বা পরিবারিক জীবন হোক কিংবা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন। গোটা কুরআন এবং সুন্নাহ এর জ্বলন্ত সাক্ষ্য। বলা বাহুল্য, কুরআন-সুন্নাহ’র সবকিছু এখানে পাঠকের সামনে তুলে ধরা সম্ভব নয়। আমি শুধু একটি আয়াত এখানে উল্লেখ করছি। হেদায়েত পাওয়া ইচ্ছে যার আছে, তার জন্য একটি আয়াতই যথেষ্ট হতে পারে।  
 
قُلْ إِنَّ صَلاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ * لا شَرِيكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ
 ‘(হে নবী মুহাম্মাদ!) তুমি বলো, নিশ্চই আমার সালাত, আমার নসক, আমার জীবন এবং আমার মৃত্যু বিশ্বজাহানের রব আল্লাহ’র জন্য (উৎসর্গীত)। তাঁর কোনো শরীক নেই। আর এব্যাপারেই আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং আমি (আল্লাহ’র কাছে আত্বসমর্পনকারী) মুসলীমদের মধ্যে প্রথম (মুসলীম বা আত্বসমর্পনকারী)। [সূরা আনআম ১৬২,১৬৩]
 
এই আয়াতে আল্লাহ’র কাছে আত্বসমর্পনকারী মুসলমানদের গোটা জীবন ও মৃত্যুকে শুধুমাত্র আল্লাহ’র জন্য উৎসর্গ করতে বলা হয়েছে। বলা বাহুল্য, আল্লাহ’র যখন যে হুকুম যেভাবে পালন করার নির্দেশ তিনি দেন, সেইভাবে তা পালনের মাধ্যমে তাঁর হুকুমের কাছে নিজের মন ও কর্মজীবনকে কায়মনোবাক্যে সপে দেয়াই হল তাঁর জন্য নিজকে উৎসর্গ করা। আল্লাহ’র হুকুমই দ্বীন, আল্লাহ’র হুকুমই শরীয়ত। মুহাম্মাদ -এর উপর নাজিলকৃত সুন্নাহ এজন্য শরীয়তের অংশ যেহেতু তা আল্লাহ’রই নাজিলকৃত হুকুম। পূর্ববর্তী নবী রাসুলগণের উপর নাজিল হওয়া কিতাব ও সুন্নাহ’গুলো এজন্য ইসলামী শরীয়তের অংশ নয় যেহেতু সেগুলো মানসুখ (রহিত) ও বাতিল হওয়া আল্লাহ’রই হুকুম। বিষয়টি একদম পরিষ্কার। যেখানে পূর্ববর্তী নবী রাসুলগণের উপর নাজিল হওয়া কিতাব ও সুন্নাহ’গুলোর সবই মানসুখ (রহিত) ও বাতিল এবং তা মানা উম্মাতে মুহাম্মাদীর জন্য হারাম, সেখানে যে সকল ইসলামী শরীয়তবিরোধী আইন-কানুন মানুষ পার্লামেন্টে কিংবা পার্লামেন্টের বাইরে তৈরী করে তা মানা মুসলমানদের জন্য আরো মারাত্মক হারাম
 

ইসলামী শরীয়ত চয়নের মানদন্ড : কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস

এখন যেহেতু মুসলমানদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে -চাই তা ব্যাক্তি-জীবন, পারিবারিক-জীবন, সমাজ জীবন বা রাষ্ট্রীয় জীবনই হোক না কেনো – ইসলামী শরীয়ত মানা ফরয এবং ইসলামী শরীয়ত বিরোধী অন্য যে কোনো শরীয়ত বা বিধিবিধান মানা হারাম, তাই তাদেরকে  এসবের যে কোনো ক্ষেত্রে-তো কুরআন ও সুন্নাহ‘য় বিদ্যমান শরয়ী বিধিবিধানগুলো মেনে চলতে হবে; তার বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। কিন্তু যেসকল বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহ’য় পরিষ্কার করে জবাব দেয়া নেই,  অথবা জবাব বিদ্যমান রয়েছে কিন্তু তার একাধিক অর্থ ও মর্মের সম্ভাবনা রয়েছে সে সকল ক্ষেত্রে খোদ্ কুরআন ও সুন্নাহ ‘তেই আরো দুটি শরয়ী মানদন্ডের কথা বলা হয়েছে, যার একটি হল ‘কিয়াস’ এবং অপরটি হল ইজমা। তবে এই দুইটি শরয়ী মানদন্ড তখনই গ্রহনযোগ্য বলে অবিহিত করা হয়েছে, যখন তার মূল ভিত্তি হবে কুরআন ও সুন্নাহ অথবা তাতে বিদ্যমান উসূল ও ইশারা-ইংগীতের আলোকে। 

এই হিসেবে ইসলামী শরীয়তের মানদন্ড হল ৪টি-

(১) কুরআন

(২) সুন্নাহ (নবী মুহাম্মাদ সা.-এর বাণী ও কর্মসমষ্টি)

(৩) ইজমা (আহলে হক্ব আলেমগণের ঐকমত)

(৪) কিয়াস (শরয়ী ইজতেহাদী অনুমান)

 নিম্নে এসম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা পেশ করা হল।  

(১) আল-কুরআন

আল্লাহ তাআলার কালাম আল-কুরআন হল ইসলামী শরীয়তের প্রধান উৎস ও শরয়ী মানদন্ড। আল্লাহ’র কালামকে রদ করার কোনো হক্ব কোনো সৃষ্টির নেই। সুতরাং, তিনি তার সৃষ্টির জন্য কোনো কিছু যা হালাল করেছেন তা হারাম করার কারো হক্ব নেই, এবং তিনি যা হারাম করেছেন তা হালাল করার কারো হক্ব নেই।  এ সম্পর্কিত সকল আয়াত ও তার ব্যাখ্যা পেশ করা এখানে সম্ভব নয়, নমুনা স্বরূপ কয়েকটি মাত্র আয়াতে কারিমা উল্লেখ করছি। হেদায়েত পাওয়ার ইচ্ছা থাকলে একটিমাত্র আয়াতই যথেষ্ট। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-
 
كِتَابٌ أَنزَلْنَاهُ إِلَيْكَ لِتُخْرِجَ النَّاسَ مِنْ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ بِإِذْنِ رَبِّهِمْ إِلَى صِرَاطِ الْعَزِيزِ الْحَمِيدِ
(হে নবী মুহাম্মাদ! এই) আল-কিতাব (কুরআন)কে আমি তোমার প্রতি  নাজিল করেছি যাতে তুমি  মানুষকে অন্ধকারসমূহ হতে বের করে নিয়ে আলোর দিকে নিয়ে যেতে পারো –তাদের রবের অনুমতিক্রমে, (নিয়ে যেতে পারো) মহাপরাক্রমশালী মহাপ্রশংসীতের পথের দিকে’। [সূর ইবরাহিম ১-২]
 
إِنَّا أَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِتَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ بِمَا أَرَاكَ اللَّهُ ۚ وَلَا تَكُنْ لِلْخَائِنِينَ خَصِيمًا
(হে নবী মুহাম্মাদ!) আমি তোমার প্রতি সত্যসহকারে আল-কিতাব (কুরআন) নাজিল করেছি যাতে তুমি মানুষের মাঝে (সৃষ্ট বিবাদ বিসম্বাদের) বিচার-ফয়সালা ওইভাবে করতে পারো, যেভাবে আল্লাহ তোমাকে দেখিয়ে দিয়েছেন। আর তুমি (বিশ্বাসঘাতক) খিয়ানতকারীদের পক্ষ নিয়ে (আমার বিপক্ষে) বিতর্ককারী হয়ে বসো না’।  [সূর নিসা ১০৫]
 
قُل أَرَأَيتُم مَا أَنزَلَ اللهُ لَكُم مِن رِزقٍ فَجَعَلتُم مِنهُ حَرَاماً وَحَلالاً  قُل آلله أَذنَ لَكُم أَم عَلَى اللهِ تَفتَرُونَ 
 ‘(হে নবী আপনি তাদেরকে) বলুন, তোমরা কি চিন্তা করে দেখেছো, যে রিজেককে আল্লাহ তোমাদের জন্য নাজিল করেছেন, তোমরা (সেই আল্লাহ’র অনুমতি ছাড়াই নিজেদের ইচ্ছে মতো) কোনোটিকে হালাল আর কোনোটিকে হারাম বানিয়ে নিয়েছো। (তাদেরকে) জিজ্ঞেস করুন, আল্লাহ কি তোমাদেরকে এর অনুমতি দিয়েছেন, নাকি তোমরা আল্লাহ’র উপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করছো? [সূরা ইউনুস ৫৯]
 
 إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ ۚ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ ۚ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ 
‘হুকুম (চলে ও চলবে) শুধুমাত্র আল্লাহ’র। তিনি হুকুম করেছেন, তোমরা (জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই) তাঁকে ছাড়া অন্য আর কারোরই ইবাদত (উপাসনা ও গোলামী) করবে না (অন্য কারো আজ্ঞাবহ হবে না)। (ভাল করে জেনে রেখো) এটাই হলদ্বীনই-কাইয়্যেম’ (প্রতিষ্ঠিত দ্বীন)। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই তা জানে না। [সূরা ইউসূফ ৪০]
 
أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوا لَهُمْ مِنَ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَنْ بِهِ اللَّهُ وَلَوْلَا كَلِمَةُ الْفَصْلِ لَقُضِيَ بَيْنَهُمْ وَإِنَّ الظَّالِمِينَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ
‘তাদের জন্য এমনসব শরীকরা আছে নাকি, যারা তাদের জন্য দ্বীন  (-এর অংশ) হিসেবে (এমন) শরীয়ত (বিধিবিধান) রচনা করে দিয়েছে, যা করার কোনো অনুমতি আল্লাহ দেননি? আর যদি একটি কথা নির্দিষ্ট হয়ে না থাকতো, তাহলে তাদের মাঝে ফয়সালা হয়ে যেত। আর নিশ্চই যারা জালেম তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ আযাব’। [সূরা শুরা ২১]
 
أَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُونَ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ حُكْمًا لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ 
 ‘তবে কি তারা জাহেলীয়াতের বিধান কামনা করছে? আর দৃঢ় বিশ্বাসীদের জন্য আল্লাহ’র চাইতে উৎকৃষ্ট বিধানদাতা আর কে আছে। [সুরা মায়েদা ৫০]
 
এসকল আয়াতে কারিমাসমূহ দ্বারা পরিষ্কার প্রমাণিত হয়, আল্লাহ’র কালাম, আল্লাহ’র হুকুমসমূহ যা কুরআনে ব্যাক্ত হয়েছে, তা ইসলামী শরীয়তের উৎস ও মানদন্ড। এব্যাপারে উম্মাহ’র ইজমা রয়েছে যে, যে ব্যাক্তি কুরআনকে শরীয়তের উৎস মানেনা সে কাফের।
 

(২) সুন্নাহ

সর্বশেষ নবী ও রাসুল মুহাম্মাদ .-এর সুন্নাহ (বাণী ও কর্মসমষ্টি) হল ইসলামী শরীয়তের দ্বিতীয় উৎস ও শরয়ী মানদন্ড -যেহেতু খোদ শরীয়তদাতা আল্লাহ তাআলাই ‘সুন্নাহ’কে শরীয়তের উৎস হিসেবে মানার হুকুম দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন- 
 
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ  وَ رَسُولَهُ وَلَا تَوَلَّوْا عَنْهُ وَأَنْتُم تَسْمَعُونَ
 ‘হে ইমানদারগণ! অনুগত্য করো আল্লাহ’র ও তাঁর রাসুলের। আর তোমরা (আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নির্দেশ) শোনার পর তা থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিও না। [সূরা আনফাল ২০]
 
 وَمَا آَتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا 
‘আর (আমার সর্বোশেষ নবী ও) রাসুল (মুহাম্মাদ) তোমাদের কাছে (আমার পক্ষ থেকে) যাকিছু (নির্দেশনা) এনেছে তা তোমরা আঁকড়িয়ে ধরো এবং তোমাদেরকে যা কিছু থেকে নিষেধ করে তা তোমরা পরিত্যাগ করো’। [সূরা হাশর ৭]
 
فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ۚ ذَٰلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا
‘সুতরাং তোমরা যদি কোনো বিষয়ে বিবাদে লিপ্ত হয়ে পরো, তাহলে যদি আল্লাহ ও কেয়ামতের দিবসের প্রতি তোমাদের ইমান থেকে থাকে, তাহলে বিষয়টি আল্লাহ ও (তাঁর) রাসুলের (ফয়সালার) কাছে ছেড়ে দাও। এই (নির্দেশনাটি তোমাদের জন্য) কল্যানকর এবং (এটাই হচ্ছে এবিষয়ক) সর্বোত্তম ব্যাখ্যা’। [সূরা নিসা ৫৯]
 
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ ۗ وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُبِينًا
‘আর আল্লাহ ও তাঁর রাসুল যখন কোনো বিষয়ে কোনো ফয়সালা দিয়ে দেন, তখন কোনো মুমিন পুরুষ ও মুমিনা নারীর জন্য তাদের নিজেদের বিষয়গুলোতে (ভিন্ন ফয়সালা দানের) কোনো এখতিয়ার থাকে না। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে অমান্য করলো, সে মূলতঃ সুস্পষ্ট পথভ্রষ্ঠতায় নিমজ্জিত হয়ে গেল’। [সূরা আহযাব ৩৬]

فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا 
  ‘আপনার রবের শপথ, কক্ষোনো নয়! যতক্ষন পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের মাঝে সৃষ্ট বিবাদ-বিসম্বাদগুলোর জন্য (হে নবী মুহাম্মাদ!) তোমাকে বিচারক না মানবে, অতঃপর তুমি যে ফয়সালা করে দিয়েছ সে ব্যপারে (যতক্ষন পর্যন্ত) তাদের মনে দ্বিধামুক্ততা অনুভূত না হবে এবং (যতক্ষন পর্যন্ত) তারা (তোমার ফয়সালাকে) ঐকান্তিকভাবে গ্রহন করে না নিবে, ততক্ষন পর্যন্ত তারা (মূলতঃ তোমার উপর) ইমানআনায়নকারী (বিবেচিতই হবার) নয়, (বরং বিবেচিত হবে সন্দেহপোষনকারী মোনাফেক বেইমান হিসেবে)। [নিসা ৬৫]
 
এসকল আয়াতে কারিমাসমূহ দ্বারা পরিষ্কার প্রমাণিত হয়-
 
(ক) মুহাম্মাদ -এর সুন্নাহ (বাণী ও কর্মসমষ্টি) হল ইসলামী শরীয়তের দ্বিতীয় উৎস ও শরয়ী মানদন্ড।
 
(খ) রাসুলুল্লাহ -এর সুন্নাহ হল শরয়ী হুজ্জত (দলিল), যা দ্বীন ইসলামের একটি জরুরী (অত্যাবশ্যক) অংগ। সুতরাং, রাসুলুল্লাহ -এর সুন্নাহ (আদর্শ)কে শরীয়তের হুজ্জত (দলীল) বলে বিশ্বাস করা ইমানের অন্যতম পূর্বশর্ত
 
(গ) মানুষের জন্য শুধু কুরআনই যদি যথেষ্ঠ হতো, তাহলে আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাবের সাথে সাথে তাঁর রাসুল মুহাম্মাদ সা.-এর নসিহত, আদেশ ও নিষেধগুলোকে মেনে চলতে বলতেন না। এর কারণ হল, মুহাম্মাদ সা.-এর বাণী ও কর্মসমষ্টি হল কুরআনের ব্যাখ্যা। অর্থাৎ, কুরআন কি চায় এবং তা কিভাবে চায় -তার ব্যাখ্যা হল মুহাম্মাদ সা.-এর বাণী ও তাঁর কর্মজীবন। ‍সুতরাং, তাঁকে বাদ দিয়ে কুরঅান বোঝা ও মানার পথে বিশ্বাসী হওয়া ও এমন মতবাদ গ্রহন করা পরিষ্কার গোমরাহী ছাড়া আর কিছু নয়। উদাহরণস্বরূপ: কুরআনে ইমান, কুফর, নিফাক, নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত, জিহাদ, খিলাফত, বিচার ইত্যাদি সম্পর্কিত নির্দেশ এসেছে, কিন্তু তা কিভাবে পালন করতে হবে তার বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়নি; তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে রাসুলুল্লাহ সা.-এর সুন্নাহ’য় (বাণী ও কর্মসমষ্টিতে)। 

কাজেই, এমনটা হতে পারে না যে, একদিকে আল্লাহ তাআলা নিজেই নির্দেশ দিবেন যে– وَمَا آَتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا‘আর (আমার) রাসুল (মুহাম্মাদ) তোমাদের কাছে যাকিছু (নির্দেশনা) এনেছে তা আঁকড়িয়ে ধরো এবং তোমাদেরকে যা কিছু করতে নিষেধ করে তা পরিত্যাগ করো’। [সূরা হাশর ৭] -আবার তিনি মুহাম্মাদ সা. কী কী নসিহত, আদেশ ও নিষেধ করেছেন তা পর্যাপ্ত মাত্রায় সংরক্ষনের ব্যবস্থা না করেই মুসলমানদেরকে শূন্যে ছেড়ে দিবেন?! জি হ্যা, তিনি মুসলমানদেরকে শূন্যে ছেড়ে দেন নি। তিনি নিজেই কুরআনের হিফাজতের দায়িত্ব নিয়েছেন, সাথে সাথে কুরআনের অর্থ, মর্ম ও ব্যাখ্যারও, যা কিয়ামত পর্যন্ত মুসলমানদের ইসলামী শরীয়ত অনুসারে জীবন অতিবাহিত করার জন্য যথেষ্ঠ হবে। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন– إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ‘নিশ্চই আমিই (সেই সত্ত্বা, যিনি) আল-যিকর নাজিল করেছি এবং আমিই তার হিয়াজতকারী। [সূরা হিজর ৯]  এখানে الذِّكْر (আল-যিকর) বলতে আল্লাহ’র কিতাব ‘আল-কুরআন’ উদ্দেশ্য। [বিস্তারিত: তাফসীরে ত্বাবারী-১৭/৬৮; তাফসীরে ইবনে কাছির-৪/৫২৭; তাফসীরে কুরতুবী-৭/১৬৩] আর কুরআন বলতে আল্লাহ’র শুধু বাণীসমষ্টিই নয়, তার অর্থ, মর্ম ও উদ্দেশ্যও অন্তর্ভূক্ত। অর্থাৎ, যে উদ্দেশ্যে কুরআন নাজিল হয়েছে সেই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য যতটুকু অর্থ, মর্ম ও ব্যাখ্যা জানা দরকার তা সংরক্ষন করাও উপরোক্ত আয়াতে ইংগিত করা হয়েছে। এজন্য, নির্দ্বিধায় বলা যায়, দ্বীন ইসলামের উপর চলার জন্য আল-কুরআনের পাশাপাশি মুহাম্মাদ সা.-এর সুন্নাহ (আদর্শ) যথেষ্ট মাত্রায়  হিফাজত রয়েছে- (১) তাঁর যুগ থেকে চলে আসা নির্ভরযোগ্য মুসলীম উম্মাহ’র মধ্যে পরম্পরা আমলের চর্চার মাধ্যমে, (২) হাদিস আকারে, যেখানে তাঁর বাণী ও কর্মসমষ্টি বর্ণিত হয়েছে। 


(ঘ) নবী মুহাম্মাদ -এর যে কোনো প্রমাণিত সিদ্ধান্ত ও বিচার-ফয়সালা বিনাদ্বিধায় মেনে নেয়া ইমানের পূর্বশর্ত ও ফরয দায়িত্ব। যে ব্যাক্তি তাঁর বিচার-ফয়সালা বিনাদ্বিধায় মেনে নেয় না, সে তাঁর রিসালাতের উপর ইমানই আনেনি। 
 
(ঙ) যে ব্যাক্তি রাসুলুল্লাহ -এর সুন্নাহ (আদর্শ)কে হুজ্জত হিসেবে মানতে ইনকার ও অস্বীকার করে, সে দ্বীন ইসলামের একটি জরুরী (অত্যাবশ্যক) বিষয়কে শরীয়তের অংশ হিসেবে মানতে ইনকার ও অস্বীকার করার আকীদা পোষন করায়  সন্দেহাতীতভাবে একজন পথভ্রষ্ঠ কাফের/মুরতাদ [আল আওয়াসেম ওয়াল কাওয়াসেম-২/২৭৪]
 
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-
 
إِنَّ الَّذِينَ يَكْفُرُونَ بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ وَيُرِيدُونَ أَن يُفَرِّقُوا بَيْنَ اللَّهِ وَرُسُلِهِ وَيَقُولُونَ نُؤْمِنُ بِبَعْضٍ وَنَكْفُرُ بِبَعْضٍ وَيُرِيدُونَ أَن يَتَّخِذُوا بَيْنَ ذَٰلِكَ سَبِيلًا – أُولَٰئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ حَقًّا ۚ وَأَعْتَدْنَا لِلْكَافِرِينَ عَذَابًا مُّهِينًا – وَالَّذِينَ آمَنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ وَلَمْ يُفَرِّقُوا بَيْنَ أَحَدٍ مِّنْهُمْ أُولَٰئِكَ سَوْفَ يُؤْتِيهِمْ أُجُورَهُمْ ۗ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَّحِيمًا 
‘নিশ্চই যারা কুফরী করে আল্লাহ’র সাথে ও তাঁর রাসুলের সাথে এবং কামনা করে যাতে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের মাঝে (স্থাপিত শরয়ী সম্পর্কের মধ্যে) পার্থক্য সৃষ্টি করা যায় এবং বলে আমরা কারো প্রতি ইমান আনছি আর কারো সাথে কুফরী করছি এবং কামনা করে এর মাঝ থেকে (তৃতীয় একটি) পথ অবলম্বন করতে, তারাই হল খাঁটি কাফের। আর আমি কাফেরদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছি লাঞ্চনাদায়ক আযাব। আর যারা ইমান আনে আল্লাহ’র প্রতি এবং তাঁর রাসুলের প্রতি এবং তাঁদের মধ্যে কারোরও মাঝে (স্থাপিত শরয়ী সম্পর্কের মধ্যে) পার্থক্য সৃষ্টি করে না (বরং আল্লাহ’র হুকুমও মানে নবীকেও মানে), তাদেকে তিনি অতি শিঘ্রই দিবেন তাদের পুরুষ্কার। আর আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল ও রহমকারী’। [সূরা নিসা ১৫০-১৫২] 
 
কিন্তু এই শেষ জামানায় একটি পথভ্রষ্ঠ ফেরকাহ’র অাবির্ভাব হয়েছে, যারা বলে তাদের জন্য শুধু কুরআনই যথেষ্ট, আর এদিকে মুসলীম উম্মাহ’র কাছে রাসুলুল্লাহ সা.-এর যেসকল হাদিসসমূহ নির্ভরযোগ্যসূত্রে সংরক্ষিত আছে তা আগাগোড়া অস্বীকার করে। তারা ‘আহলে কুরআন’ নামে পরিচিত। এজাতীয় লোকদের দিকে ইঙ্গিত করে এক হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সা. এরশাদ করেন- لَا أُلْفِيَنَّ أَحَدَكُمْ مُتَّكِئًا عَلَى أَرِيكَتِهِ يَأْتِيهِ الْأَمْرُ مِنْ أَمْرِي مِمَّا أَمَرْتُ بِهِ أَوْ نَهَيْتُ عَنْهُ فَيَقُولُ لَا نَدْرِي مَا وَجَدْنَا فِي كِتَابِ اللَّهِ اتَّبَعْنَاهُ – “এমন যেন না হয় যে, তোমাদের কেউ গদিতে ঠেস দিয়ে বসে আছে, (এমতাবস্থায়) আমি নির্দেশ দিয়েছি বা কিছু করতে নিষেধ করেছি এমন  নির্দেশসমূহের মধ্যে কোনো নির্দেশ তার কাছে চলে আসে, আর সে বলে: আমি (এসব হাদিস-টাদিস বলে কিছু) জানিনা। আমরা আল্লাহ’র কিতাবে যা পাবো তারই অনুসরণ করবো”। [সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৪৬০৫; সুনানে ইবনে মাজা, হাদিস ২৬৬৩]

হযরত মিকদাম বিন মা’দীকারাব রা. থেকে বর্নিত, রাসুলুল্লাহ  এরশাদ করেছেন- أَلَا إِنِّي أُوتِيتُ القُرآنَ وَمِثلَهُ مَعَهُ ، أَلَا يُوشِكُ رَجُلٌ شَبعَان عَلَى أَرِيكَتِهِ يَقُولُ : عَلَيكُم بِهَذَا القُرآنِ ، فَمَا وَجَدتُم فِيهِ مِن حَلَالٍ فَأَحِلُّوهُ ، وَمَا وَجَدتُم فِيهِ مِن حَرَامٍ فَحَرِّمُوهُ ، أَلَا وَإِنَّ مَا حَرَّمَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيهِ وَسَلَّمَ كَمَا حَرَّمَ اللَّهُ . رواه الترمذي ٢٦٦٤ وقال : حسن غريب من هذا الوجه ، وحسنه الألباني في “السلسلة الصحيحة” ٢٨٧٠- “খুব ভাল করে শুনে রাখো, আমাকে (ওহী সূত্রে) কুরআন দেয়া হয়েছে এবং এর সাথে অনুরূপ (ওহী সূত্রেই হিকমত ও সুন্নাহ) দেয়া হয়েছে। খুব ভাল করে শুনে রাখো, অতি শিঘ্রই এমন হবে যে, উদরপূর্ণ লোক আরামকেদারায় ঠেস দিয়ে বলবে: তোমরা শুধু এই কুরআন’কেই গ্রহন করো; এর মধ্যে তোমরা যা হালাল পাবে তাই হালাল মনে করবে এবং তাতে যা হারাম পাবে তোমরা (শুধু) সেটাকেই হারাম মনে করবে। (কিন্তু) খুব ভাল করে শুনে রাখো, আল্লাহ’র রাসুল কর্তৃক হারামকৃত জিনিস আল্লাহ কর্তৃক (কোনো কিছু) হারাম করার মতোই, (কেননা আল্লাহ’র রাসুল কোনো শরয়ী কিছুই ওহীর ইঙ্গিত ছাড়া নিজ থেকে হারাম করেন না)”[জামে তিরমিযী, হাদিস ২৬৬৪; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৪৬০৪]

এই শেষ জামানায় এক পথভ্রষ্ঠ ফেরকাহ’র আবির্ভাব হয়েছে, যারা বলে তাদের জন্য শুধু কুরআনই যথেষ্ট, আর এদিকে মুসলীম উম্মাহ’র কাছে রাসুলুল্লাহ সা.-এর যেসকল হাদিসসমূহ নির্ভরযোগ্যসূত্রে সংরক্ষিত আছে তা আগাগোড়া অস্বীকার করে। তারা ‘আহলে কুরআন’ নামে পরিচিত, যাদেকে ‘মুনকেরুল হাদিস’ (হাদিস অস্বীকারকারী) বা ‘মুনকেরুস সুন্নাহ’ (সুন্নাহ অস্বীকারকারী)ও বলা হয়ে থাকে। এই ভবিষ্যৎ বাণী পূর্ণ হয়েছে।

হাদীস অস্বীকার করার এক সুবিধা হল কুরআনের ইচ্ছে মতো ব্যাখ্যা করে তার প্রকৃত অর্থ ও তাৎপর্যকে দুমড়ে-মুঁচড়ে রাখা যায় এবং ইসলামের বিরুদ্ধে বিভিন্নভাবে যুৎসই মতো ব্যবহার করে স্বেচ্ছাচারী জীবন কাটানোর পথ পাওয়া যায়। আজকালকার লিবারাল ঘরানার লোকেরা এই ফাঁদের বেশি শিকার হয়ে থাকে।  الله اعلم

 

(৩) ইজমা

ইজমা ( إِجمَاع ) ইসলামী শরীয়তের (আইনের) তৃতীয় উৎস ও মানদন্ড। إِجمَاع  শব্দটি جَمع  শব্দমূল থেকে উৎপন্ন, যার আভিধানিক অর্থ মিশ্রন, কিছুর মিশ্রিত বা একত্রিত বা সংগৃহিত রূপ, সমাবেশ, ঐক্যমত, দৃঢ সিদ্ধান্ত বা সংকল্প ইত্যাদি। আর ইসলামী পরিভাষায় ইজমা ( إِجمَاع ) বলা হয়- রাসুলুল্লাহ সা.-এর ইন্তেকালের পর সাহাবায়ে করোমের জামানা থেকে শুরু করে যেকোনো জামানায় কুরআন-সুন্নাহ’র ভিত্তিতে আহলে হক্ব মুস্তাহিদ আলেমগণের সকলে যে কোনো শরয়ী বিষয়ে ঐক্যমতে উপনীত হওয়াকে। কয়েকটি পয়েন্ট মাথায় রাখলে ইজমা কী -তা বোঝা অনেকটা সহজ হয়ে যাবে।
 
(১) অবশ্যই ইজমা’র ভিত্তি হতে হবে কুরআন ও সুন্নাহ। কুরআন ও সুন্নাহ’র সাথে সাংঘর্ষিক কোনো বিষয়ে ইজমা/ঐক্যমত বলে শরীয়তে কিছু নেই। 
 
(২) শুধুমাত্র মুসলমি উম্মাহ’র মধ্যেই ইজমা সংঘটিত হতে হবে। কোনো অমুসলীম কাফের মুরতাদরা সকলে মিলে শরীয়তের কোনো বিষয়ে ঐক্যমতে উপনীত হলেও তার সামান্য কোনো মূল্য ইসলামী শরীয়তে নেই।
 
(৩) রাসুলুল্লাহ সা.-এর ইন্তেকালের পর সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে সংঘটিত ইজমা থেকেই ইজমা ধর্তব্য। খোদ্ রাসুলুল্লাহ সা.-এর জামানায় ইজমা’র প্রশ্ন এজন্য আসে না যে, আল্লাহ তাআলা তাঁর সর্বশেষ রাসুল মুহাম্মাদ সা.-এর উপর শরীয়ত (আইন) হিসেবে যা কিছু নাজিল করেছেন তা-তো কোনো প্রশ্ন ছাড়াই স্বীকার করা সকল মুমিন-মুসলমানদের উপর ফরয, যার অস্বীকার বা প্রত্যাক্ষান যে কাউকে কাফের বানিয়ে দেয়। যেখানে খোদ্ কুরআনই নাজিল হচ্ছে এবং রাসুলুল্লাহ সা. স্বশরীরে উপস্থিত থেকে কুরআন ও হিকমাহ শিক্ষা দিচ্ছেন সেখানে পৃথক ইজমার জরুরতই বাকি থাকে না। সুতরাং বোঝা গেল, ইজমা হল রাসুলুল্লাহ সা.-এর ইন্তেকালের পর সাহাবায়ে কেরামের জামানা থেকে ধর্তব্য।
 
(৪) কোনো বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহ’য় পারদর্শি আহলে হক্ব মুসতাহীদ আলেমগণের শরয়ী ঐক্যমতই হল ইজমা। সুতরাং, কোনো বিষয়ে ইজমা কায়েম হওয়ার ক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কে মুর্খ-জাহেল সর্বসাধারণ মুসলমান কিংবা অপর্যাপ্ত ও অদক্ষ ইলমধারী আলেমদের মতের কোনোই মূল্য নেই, তাদের দ্বিমত পোষনে শরীয়তের কিছুই যায় আসে না। সুতরাং, কোনো বিষয়ে আহলে হক্ব মুসতাহীদ আলেমগণের ইজমাে/ঐক্যমত কায়েম হলে যদি গোটা বিশ্বের সকল মুর্খ-জাহেল মুসলমানরা কিংবা অদক্ষ ইলমধারীরাও ইজমার বিরোধীতা করে, তবুও আহলে হক্ব আলেমদের ইজমা স্বস্থানে স্বশক্তিতে দন্ডায়মান থাকবে, জাহেলদের দ্বিমত বা প্রতিবাদের তুফনে ইমজার কোনোই ক্ষতি হবে না। আহলে হক্ব মুসতাহীদ আলেমগণের শরয়ী ঐক্যমতকেই গোটা মুসলীম উম্মাহ’র ইজমা বলে ধরে নেয়া হয়।
 
(৪) আহলে হক্ব মুসতাহীদ আলেমগণের শরয়ী ইজমা ততদিন পর্যন্ত শরীয়তের অন্যতম উৎস ও মানদন্ড হিসেবে বিবেচিত হবে যতদিন কুরআন ও সুন্নাহর অনুগত্য অনুসরণ করা মুসলীম উম্মাহ’র উপর  অপরিহার্য হিসেবে বিবেচিত থাকবে। আর বলা বাহুল্য, মুহাম্মাদ সা. সর্বশেষ নবী ও রাসুল এবং মুসলীম উম্মাহ সর্বশেষ উম্মাহ।
 
এবারে আমরা ইজমা শরীয়তের হুজ্জত (দলিল) হওয়ার স্বপক্ষে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে সংক্ষেপে কিছু আলোচনা পেশ করছি।
 
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-
وَمِمَّنْ خَلَقْنَا أُمَّةٌ يَهْدُونَ بِالْحَقِّ وَبِهِ يَعْدِلُونَ
‘ আর তাদের মধ্য থেকে আমরা (একটি) উম্মত সৃষ্টি করেছি; তারা (নিজেরা) হক্ব-সত্য সহকারে হেদায়েতের (পথে চলে ও অন্যকেও সে অনুযায়ী) পথ দেখায় এবং তার মাধ্যমেই তারা ইনসাফ করে’। [সূরা আ’রাফ ১৮১]
 
ইমাম তাবারী (মৃ: ৩১০ হি:) রহ. এই আয়াতে বর্ণিত أمَّة (উম্মত) -এর ব্যাখ্যায় ইবনে জুরাইয রহ.-এর সূত্রে রাসুলুল্লাহ সা. থেকে বর্ণনা করেছেন- هذه أمتي – “এরা হচ্ছে আমার উম্মত”। আর হযরত ক্বাতাদাহ রহ.-এর সূত্রে রাসুলুল্লাহ সা. থেকে বর্ণনা করেছেন- بلغنا أن نبي الله صلى الله عليه وسلم كان يقول إذا قرأها: هذه لكم, وقد أعطي القوم بين أيديكم مثلَها: وَمِنْ قَوْمِ مُوسَى أُمَّةٌ يَهْدُونَ بِالْحَقِّ وَبِهِ يَعْدِلُونَ – আমাদেরকে কাছে রাসুলুল্লাহ সা.-এর এরশাদ পৌছেছে যে, তিনি এই আয়াতটি তেলাওয়াত করে বললেন- এরা হল তোমরা (যারা আমার সাহাবী তারা এবং যারা আমার ও তোমদের পথে চলে সেই মুসলীম জামাআত)। বস্তুতঃ তোমাদের আগেও একটি জাতিকে এরকম (নেয়ামত) দেয়া হয়েছিল। (এরপর তেলাওয়াত করলেন-) وَمِن قَوْمِ مُوسَىٰ أُمَّةٌ يَهْدُونَ بِالْحَقِّ وَبِهِ يَعْدِلُونَ – {আর (ইতিপূর্বে আমার নবী ও রাসুল) মুসার কওমের মধ্য থেকে একটি উম্মত (জামাআত/গোষ্ঠি) ছিল; তারা (নিজেরা) হক্ব-সত্য সহকারে হেদায়েতের (পথে চলতো ও অন্যকেও সে অনুযায়ী) পথ দেখাতো এবং তার মাধ্যমেই তারা ইনসাফ করতো। (সূরা আ’রাফ ১৭০)}।  ইমাম তাবারী রহ. নিজে এই আয়াতে বর্ণিত أمَّة (উম্মাহ) -এর অর্থ করেছেন جَمَاعَة (জামাআত/গোষ্ঠি)ইমাম বগভী রহ অর্থ করেছেন عصابة (দল/গোষ্ঠি)। [তাফসীরে তাবারী-১৩/২৮৬, আছার- ১৫৪৫৮, ১৫৪৫৯; তাফসীরে ইবনে কাসির- ৩/৫১৬; তাফসীরে বগভী- ৩/৩০৮] আর ইমাম মারুজী (মৃ: ২৯৭ হি:) রহ. উত্তম সনদে হযরত আলী বিন আবি তালেব রা. থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন- هي التي تنجو من هذه الأمة – “এঁরা হলেন এই উম্মতের মধ্যেই নাজাত পাওয়া (একটি বিশেষ জামাআত/গোষ্ঠি)”। [আস-সুন্নাহ, মারুজী, হাদিস ৬১; তাফসীরে ইবনু আবি হাতিম- ৫/১৫৮৭, হাদিস ৮৩৭০; আল-ই’তিসাম, শাতেবী- ৪/২৫৮; ফাতহুল কাদীর, শাওকানী- ১/২৫৬; জামেউল আহাদীস, ইমাম সুয়ূতী- ৩/২৮৭ , হাদিস ৫৭৮১]
 
আর ইমাম মারুজী (মৃ: ২৯৪ হি:) রহ. হাসান সনদে হযরত আলী বিন আবি তালেব রা. থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন- وَأَمَّا نَحْنُ ، فَيَقُولُ : وَمِمَّنْ خَلَقْنَا أُمَّةٌ يَهْدُونَ بِالْحَقِّ وَبِهِ يَعْدِلُونَ – وَهِيَ الَّتِي تَنْجُو مِنْ هَذِهِ الأُمَّةِ  – “আর আমাদের (মুসলমানদের) সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেছেন- وَمِمَّنْ خَلَقْنَا أُمَّةٌ يَهْدُونَ بِالْحَقِّ وَبِهِ يَعْدِلُونَ –{আর তাদের মধ্য থেকে আমরা (একটি) উম্মত সৃষ্টি করেছি; তারা (নিজেরা) হক্ব-সত্য সহকারে হেদায়েতের (পথে চলে ও অন্যকেও সে অনুযায়ী) পথ দেখায় এবং তার মাধ্যমেই তারা ইনসাফ করে} –এঁরা হলেন এই উম্মতের মধ্যেই নাজাত পাওয়া (একটি বিশেষ জামাআত/গোষ্ঠি)”। [আস-সুন্নাহ, মারুজী, হাদিস ৬২; তাফসীরে ইবনু আবি হাতিম- ৫/১৫৮৭, হাদিস ৮৩৭০; আল-ই’তিসাম, শাতেবী- ৪/২৫৮; ফাতহুল কাদীর, শাওকানী- ১/২৫৬; জামেউল আহাদীস, ইমাম সুয়ূতী- ৩/২৮৭ , হাদিস ৫৭৮১]
 
ইমাম সা’দী রহ. লিখেছেন- أي: ومن جملة من خلقنا أمة فاضلة كاملة في نفسها، مكملة لغيرها، يهدون أنفسهم وغيرهم بالحق، فيعلمون الحق ويعملون به، ويعلِّمونه، ويدعون إليه وإلى العمل به. وَبِهِ يَعْدِلُونَ بين الناس في أحكامهم إذا حكموا في الأموال والدماء والحقوق والمقالات، وغير ذلك، وهؤلاء هم أئمة الهدى، ومصابيح الدجى، وهم الذين أنعم اللّه عليهم بالإيمان والعمل الصالح، والتواصي بالحق والتواصي بالصبر، وهم الصديقون الذين مرتبتهم تلي مرتبة الرسالة، وهم في أنفسهم مراتب متفاوتة كل بحسب حاله وعلو منـزلته، فسبحان من يختص برحمته من يشاء، واللّه ذو الفضل العظيم – অর্থাৎ,   خَلَقْنَا أُمَّةٌ (আমারা একটি উম্মত সৃষ্টি করেছি) বাক্যটি নিজ থেকেই (এই উম্মতের) পূর্ণাঙ্গ ফজিলত ও মর্তবাকে প্রকাশ করে দিচ্ছে। (এই উম্মতের শান এই যে) সে অন্য (উম্মতদের) সকলকে ছাড়াও একাই পরিপূর্ণ। তাঁরা সত্য সহকারে যেমন নিজেদেরকে সঠিক পথে চালায়, তেমনি চালায় অন্যদেরকেও। তাঁরা হক্ব ও সত্যের ইলম হাসিল করে এবং তার উপর আমল করে। তাঁরা (মানুষকে) এই সত্যের দিকে ডাকে এবং ডাকে সে অনুযায়ী আমল করার দিকে। (আরো বলা হচ্ছে) وَبِهِ يَعْدِلُونَ ‘এবং তার মাধ্যমেই তারা ইনসাফ করে অর্থাৎ মানুষজনের মাঝে যখন তাদের ধনসম্পদ, রক্ত, হক্ব সহ বিভিন্ন ব্যাপারে (আল্লাহ তাআলার বিধান অনুসারে) ফয়সালা করতে হয় তখন তাঁরা সত্য সহকারে ইনসাফ করে। এঁরাই হলেন সঠিক পথের দিসারী, অাঁধারের বাতী। এরাই হলেন তাঁরা যাঁদেরকে আল্লাহ তাআলা তাঁদের ইমান, নেক আমল এবং এক অপরকে সত্য ও সবরের অসিয়ত করার (গুণ দানের) মাধ্যমে ধন্য করেছেন। এরাই হলেন সেই সত্যের ধারক-বাহক দল, যাঁদের মর্যাদা রাসুলগণের মর্যাদা নিম্নে (তবে সর্বসাধারণের মর্যাদার অনেক উপরে)। অবশ্য তাঁদের নিজেদের মধ্যে একেক জনের হাল-অবস্থা ও উন্নিত মানজিল অনুসারে মর্তবায় ভিন্নতা রয়েছে। বস্তুতঃ পবিত্র সত্ত্বা আল্লাহ তাআলা যাকে ইচ্ছা তাঁর বিশেষ রহমত দিয়ে ধন্য করেন। আর আল্লাহ তাআলা সুমহান করুনার অধিকারী [তাইসিরুল কারীম, ইমাম সা’দী– ১/৩১০]
 
খোলাসা হল,  আয়াতটিতে مِمَّنْ (তাদের মধ্য থেকে) কথাটিই এরই প্রমাণ বহন করে যে,  এখানে   أمَّة  (উম্মত) বলতে বিশ্বনবী মুহাম্মাদ সা.-এর মুসলীম উম্মাহ’র মধ্যে বিদ্যমান এমন একটি বিশেষ মর্যাদার  জামাআত/দল/গোষ্ঠি’কে বোঝানো হয়েছে, যাঁদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে দ্বীন ইসলামের হিফাজতের জন্য, যারা দ্বীনের সহিহ ইলম হাসিল করে, দ্বীন বোঝে, দ্বীনের উপর চলে, অন্যকে সহিহ পথ দেখায় এবং এরই দিকে মানুষকে আহবান করে। এই জামাআতকেই সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত বলা হয়েছে। كُنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ – ‘তোমরা সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত। তোমাদেরকে বের করা হয়েছে মানুষের (দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যানের) জন্য। তোমরা (এজন্য সর্বশ্রেষ্ঠ যে, তোমরা) নেকির কাজের নির্দেশ দাও  এবং গোনাহর কাজে বাধা দাও এবং আল্লাহ’র উপর ইমান রাখো’। [সূরা আল-ইমরান ১১০]
 
এই জামাআতের প্রথমে রয়েছে রাসুলুল্লাহ সা.-এর সম্মানীত সাহাবায়ে কেরাম রা., তারপর তাবেয়ীন, তারপর তাবে’ তাবেয়ীন। যেমন রাসুলুল্লাহ সা. এরশাদ করেন- خَيْرُ النَّاسِ قَرْنِي، ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ، ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ – “সর্বত্তম মানুষরা রয়েছে আমার যুগে (যাঁরা আমার সাহাবা), এরপর (উত্তম হল তাঁরা) যাঁরা তাঁদের সংলগ্ন (যুগে থাকবে এবং আমাকে ও আমার সাহাগণকে অনুসরণ করবে)। এরপর (উত্তম হল তাঁরা) যাঁরা তাঁদের সংলগ্ন (যুগে থাকবে এবং তাবেয়ীগণের মাধ্যমে আমাকে ও আমার সাহাগণকে অনুসরণ করবে)”। [সহীহ বুখারী- ৩/১৭১, হাদিস ২৬৫২] তবে মুসলীম উম্মাহ’র উপর আল্লাহ’র বিশেষ দয়া ও করুনা এই যে, উম্মতের মধ্যে এই বিশেষ জামাআতের ধারা কিয়ামতের আগ পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা যতদিন চাবেন অব্যাহত রাখবেন মর্মে বহু হাদিসে এসেছে। যেমন একটি সহীহ হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেন- لاَ يَزَالُ مِنْ أُمَّتِي أُمَّةٌ قَائِمَةٌ بِأَمْرِ اللَّهِ ، لاَ يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ ، وَلاَ مَنْ خَالَفَهُمْ ، حَتَّى يَأْتِيَهُمْ أَمْرُ اللَّهِ وَهُمْ عَلَى ذَلِكَ . رواه البخاري: رقم ٣٦٤١  –আমার উম্মতের মধ্যে একটি উম্মত (জামাআত/দল/গোষ্ঠি) সর্বদা আল্লাহ’র নির্দেশের উপরে কায়েম থাকবে। যারা তাঁদেরকে দমন করতে যাবে এবং যারা তাঁদের বিরোধীতায় লাগবে, তারা তাঁদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। এমনকি তাঁদের কাছে আল্লাহ’র হুকুম না এসে পৌছা পর্যন্ত তারা ওর উপরই কায়েম থাকবে’[সহিহ বুখারী, হাদিস ৩৬৪১] আর সওবান রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেন- لَا تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي ظَاهِرِينَ عَلَى الْحَقِّ لَا يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ حَتَّى يَأْتِيَ أَمْرُ اللَّهِ وَهُمْ كَذَلِكَ . أخرجه مسلم: رقم ١٩٢٠ – ‘আমার উম্মতের একটি গোষ্ঠি সর্বদা  সত্যের উপর জাহের (প্রকাশমান) হয়ে থাকবে। যারা তাঁদেরকে দমন করতে যাবে, তারা তাঁদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। এমন কি তাঁদের কাছে আল্লাহ’র হুকুম না এসে পৌছা পর্যন্ত তারা ওভাবেই (সত্যের উপর প্রকাশমান হয়ে) থাকবে’। [সহীহ মুসলীম- ২/১৪৩, হাদিস ১৯২০] 
 
ইমাম নববী রহ. লিখেছেন- وأما هذه الطائفة فقال البخاري : هم أهل العلم ، وقال أحمد بن حنبل : إن لم يكونوا أهل الحديث فلا أدري من هم ؟ قال القاضي عياض : إنما أراد أحمد أهل السنة والجماعة ، ومن يعتقد مذهب أهل الحديث ، قلت : ويحتمل أن هذه الطائفة مفرقة بين أنواع المؤمنين منهم شجعان مقاتلون ، ومنهم فقهاء ، ومنهم محدثون ، ومنهم زهاد وآمرون بالمعروف وناهون عن المنكر ، ومنهم أهل أنواع أخرى من الخير ، ولا يلزم أن يكونوا مجتمعين بل قد يكونون متفرقين في أقطار الأرض . وفي هذا الحديث معجزة ظاهرة ؛ فإن هذا الوصف ما زال بحمد الله تعالى من زمن النبي صلى الله عليه وسلم إلى الآن ، ولا يزال حتى يأتي أمر الله المذكور في الحديث . وفيه دليل لكون الإجماع حجة …, এই الطائفة (গোষ্ঠি/দল) সম্পর্কে ইমাম বুখারী রহ. বলেছেন- هم أهل العلمতাঁরা হলেন আহলে ইলম (ইলমের ধারক-বাহকগণ)। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহ. বলেছেন- إن لم يكونوا أهل الحديث فلا أدري من هم ؟ তাঁরা যদি আহলুল হাদিস (হাদিসের ধারক-বাহক) না হন তাহলে তাঁরা আর কারা – তা আমি জানি না। কাযি আইয়ায রহ. বলেছেন- (একথার দ্বারা) ইমাম আহমদ বিন হাম্বলের উদ্দেশ্য হল ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ’ এবং যাঁরা আহলুল হাদিস (হাদিসের ধারক-বাহক) হিসেবে বিবেচিত। (ইমাম নববী বলেন:) আমার মতে, এই الطائفة  (জামাআত/গোষ্ঠি/দল) দ্বারা এমন ব্যাক্তিবর্গ উদ্দেশ্য, যাঁরা (পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে বিদ্যমান) বিভিন্ন ধরনের মুমিনদের ভিতরে (ছড়িয়ে ছিটিয়ে) থাকা একটি (বিশেষ মর্যাদাবান) গোষ্ঠি, যাঁদের মধ্যে কেউ কেউ হলেন বীর মুজাহীদ, কেউ কেউ ফকিহ (ফিকাহশ্বাস্ত্রবিদ আলেম), কেউ কেউ মুহাদ্দেস, কেউ বা জাহেদ (দুনিয়ার মায়া ত্যাগী আবেদ), কেউ নেকির কাজে আদেশকারী ও অন্যায় কাজের নিষেধকারী, এভাবে তাঁদের মধ্যে (ইসলামের) কল্যানকারী অন্য আরো অনেক ধরনের ব্যাক্তিগণ থাকতে পারেন। (আর) এর জন্য এমনটা হওয়া আবশ্যক নয় যে, তাঁরা সবাই মিলে এক সাথে বসবাস করবেন। বরং তাঁরা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে পারেন। (তবে তাঁরা যেখানেই থাকুন না কেনো, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁরা ইজমাবদ্ধ/ঐক্যবদ্ধ থাকবেন)। আর (দেখুন) এই যে হাদিসভান্ডার, এটা-তো একটি সুস্পষ্ট মু’জিযা। বস্তুতঃ (মুহাদ্দেসগণের প্রচেষ্টায় সংরক্ষিত হাদিসের) এই বিস্তারিত ভান্ডার নবী সা.-এর জামানা থেকে আজ পর্যন্ত আল্লাহ’র মহিমার প্রতিফলন ঘটিয়ে আসছে। আর এ ধারা অব্যাহত থাকবে যাবৎ উপরোক্ত হাদিসে বণিত আল্লাহ’র নির্দেশ এসে না পৌছে। এটা একথারই দলিল যে, (আহলে হক্ব আলেমগণের ঐক্যমত বা) ইজমা হল (শরীয়তের) হুজ্জত/দলিল।....[শারহুল মুসলীম, ইমাম নববী- ১৩/৬৭]
 
যেমন উপরের হাদিসে যাঁদেরকে ইঙ্গিত করে  الطائفة (গোষ্ঠি/দল) বলা হয়েছে, তাঁদেরকেই অন্যান্য বহু হাদিসে الجماعة (জামাআত) বলে অবিহিত করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, যে কোনো জামানায় এই জামাআত’কে আঁকড়িয়ে ধরে থাকা গোমরাহী-পথভ্রষ্ঠতা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়। যেমন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বণিত হয়েছে, হযরত ওমর রা. একবার খুৎবায় বললেন যে, রাসুলুল্লাহ সা. এরশাদ করেছেন- عَلَيْكُمْ بِالجَمَاعَةِ وَإِيَّاكُمْ وَالفُرْقَةَ فَإِنَّ الشَّيْطَانَ مَعَ الوَاحِدِ وَهُوَ مِنَ الِاثْنَيْنِ أَبْعَدُ، مَنْ أَرَادَ بُحْبُوحَةَ الجَنَّةِ فَلْيَلْزَمُ الجَمَاعَةَ – خرجه الترمذي في الجامع ٢١٦٥، وأحمد فِي مسنده ١/١٨، وابن أبي عاصم فِي السنة ٨٨ ,٨٩٧، والحاكم في المستدرك ١/١١٤، والنسائي في الكبرى ٥/٣٨٨، والبزار في مسنده ١٦٦, طحاوي في مشكل الآثار٣١٥٦ , عبد الله بن المبارك في “مسنده” ٢٤١ – “তোমরা আল-জামাআত (-এর সাথে একাত্ব/ইজমাবদ্ধ/ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকা)কে তোমাদের উপর অপরিহার্য করে নাও এবং (ইজমা থেকে বের হয়ে আলাদা মতবাদ ও আদর্শের) ফেরকা (জন্ম দেয়া) থেকে বেঁচে চলো। কারণ, নিশ্চই শয়তান একাকী ব্যাক্তির সাথে থাকে; দু’ব্যাক্তি (কোথাও একত্রিত হলে সে তাদের জোট) থেকে অনেক দূরে থাকে। যে ব্যাক্তি জান্নাতের মধ্যভাগ (-এর জাকজমক ও আয়েশ লাভ) করতে চায়, সে যেন জামাআত (-এর সাথে একাত্ব/ইজমাবদ্ধ/ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকা)কে অপরিহার্য করে নেয়”। [জামে তিরমিযী, হাদিস ২১৬৫; মুসনাদে আহমাদ-১/১৮; আস-সুন্নাহ, ইবনু আবি আসেম, হাদিস ৮৮, ৮৯৭; মুসতাদরাকে হাকিম- ১/১১৪; সুনানুল কুবরা, নাসায়ী- ৫/৩৮৮; মুসনাদে বাযযার ১৬৬; শারহু মুশকিলিল আছার, তাহাবী, হাদিস ৩১৫৬; মুসনাদে ইবনে মুবারক ২৪১]
 
একটি সহীহ হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সা. এরশাদ করেন- مَنْ فَارَقَ الْجَمَاعَةَ شِبْرًا فَقَدْ خَلَعَ رِبْقَةَ الْإِسْلَامِ مِنْ عُنُقِهِ . رواه أبو داود ٤٧٥٨ ، وصححه الألباني في ” صحيح أبي داود – “যে ব্যাক্তি আল-জামাআত (-এর সাথে একাত্ব/ইজমাবদ্ধ/ঐক্যবদ্ধ না হয়ে বরং তা) থেকে এক বিঘত পরিমাণও আলাদা হল, সে মূলতঃ তার গর্দান থেকেই ইসলামের রশিকে খুলে ফেলে দিল”। [সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৪৭৫৮] আরেকটি হাদিসে আছে, রাসুলুল্লাহ সা. এরশাদ করেন- لَيْسَ أَحَدٌ يُفَارِقُ الجَمَاعَةَ شِبْرًا فَيَمُوتُ ، إِلَّا مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةً .رواه البخاري: ٧١٤٣ ، ومسلم ١٨٤٩ – “এমন কেউ নেই নেই, যে ইজমাবদ্ধতা/ঐক্যবদ্ধতা থেকে এক বিঘত পরিমাণও আলাদা হয়ে ইন্তেকাল করে অথচ সে জাহেলিয়াতের মড়া মড়ে না”। [সহীহ বুখারী, হাদিস ৭১৪৩; সহীহ মুসলীম, হাদিস ১৮৪৯]
 
এতে কোনোই সন্দেহ নেই যে, কুরআন-সুন্নাহ ‘র আলোকে শরীয়তের যে কোনো বিষয়ে মত/রায়/ফাতওয়া দেয়ার অধিকারী হলেন কুরআন-সুন্নাহ’য় পারদর্শি আহলে হক্ব মুসতাহীদ/মুহাক্কেক আলেমগণ। সুতরাং, শরীয়তের যে কোনো বিষয়ে তাঁদের ঐক্যমত’কেই বলা হবে শরয়ী ইজমা। কুরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কে যারা মুর্খ-জাহেল কিংবা অদক্ষ, তাদের জন্য শরয়ী মত/রায়/ফাতওয়া দেয়াই-তো নাজায়েয ও গোনাহ’র কাজ;  সেক্ষেত্রে তাদের মত বা ঐক্যমতের কী মূল্য থাকতে পারে, আর তাতে দ্বীন ইসলামের কী আসে যায়?! 
 
ইমাম তিরমিযী রহ. লিখেছেন- وَتَفْسِيرُ الْجَمَاعَةِ عِنْدَ أَهْلِ الْعِلْمِ : هُمْ أَهْلُ الْفِقْهِ وَالْعِلْمِ وَالْحَدِيثِ – “আলেমগণের মতে ‘আল-জামাআত’ দ্বারা উদ্দেশ্য হল আহলে হক্ব ফকীহ, আলেম ও মুহাদ্দেসগণ” [সুনানে তিরমিযী- ৪/৪৬৭]
 
ইমাম শাতেবী (মৃ: ৭৯০ হি: ) রহ. লিখেছেন-  ولا خلاف أنه لا اعتبار بإجماع العوام  – আর সর্বসাধারণ (জাহেল মুসলমান)দের ইজমা/ঐক্যমত যে ধর্তব্য নয় – সে সম্পর্কে কারোরও দ্বিমত নেই। [আল-ই’তেসাম, শাতেবী-১/৩৫৪] তিনি আরো লিখেছেন- الجميع اتفقوا على اعتبار أهل العلم والاجتهاد سواء ضموا إليهم العوام أم لا فإن لم يضموا إليهم فلا إشكال أن الاعتبار إنما هو بالسواد الأعظم من العلماء المعتبر اجتهادهم فمن شذ عنهم فمات فميتته جاهلية وإن ضموا إليهم العوام فبحكم التبع لأنهم غير عارفين بالشريعة فلا بد من رجوعهم في دينهم إلى العلماء ولا عبرة بمخالفتهم – “সকল (আহলে হক্ব ওলামায়ে কেরাম) এব্যাপারে একমত যে, ইলম ও ইসতেহাদের যোগ্যতাসম্পন্ন (আহলে হক্ব) আলেমগণ (-এর ইজমা/ঐক্যমতই) ধর্তব্য -চাই তাতে আমজনতা তাঁদের সাথ দিক চাই না দিক। যদি তারা আলেমগণের ইজমার সাথে সাথ না দেয় তাহলেও (আলেমগণের ইজমা) ধর্তব্য হওয়া নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠবে না। বস্তুতঃ সংশ্লিষ্ট ইজমাটি হয়েছে গ্রহনযোগ্য আলেমগণের একটি বিরাট মান্যবর জামায়াতের ইসতেহাদের আলোকে। তাই যে ব্যাক্তি তাঁদের ইজমা থেকে ভিন্ন পথ এখতিয়ার করবে, সে (ওই অবস্থায়) মড়লে জাহেলীয়াতের মড়া মড়বে। কিন্তু সাধারণ মুসলমানরা যদি আলেমগণের (ইজমা’র সাথে) সাথ দেয়, তাহলে তারা (আলেমগণের ইজমায়ী) বিধানের অনুগামী হয়ে চলবে, কারণ তারা শরীয়তের জ্ঞান রাখে না। বিধায় দ্বীনের প্রশ্নে তাদের মধ্যে কারা আলেমগণের ইজমার অনুগামী হল সেটা যেমন ধর্তব্য নয়, তেমনি তাদের বিরোধীতারও কোনো মূল্য নেই”। [আল-ই’তিসাম, শাতেবী- ১/৪৮২]
 
মোল্লা আলী কারী রহ. লিখেছেন- الحديث يدل على أن اجتماع المسلمين حق ، والمراد إجماع العلماء ، ولا عبرة بإجماع العوام ؛ لأنه لا يكون عن علم … انتهى – “হাদিসটি একথার দলিল যে, মুসলমানদের ইজমা -হক্ব (সঠিক)। আর এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল (আহলে হক্ব) আলেমগণের ইজমা (ঐক্যমত)। এক্ষেত্রে সর্বসাধারণ (মুসলমান) দের ঐক্যমতের কোনো মূল্য নেই। কারণ (তাদের শরীয়তের ইলম নেই, বা যা আছে তাতে শরীয়ত সম্পর্কে মুখ খোলার অধিকার সাব্যস্থ হবার নয়। আর) ইলম ছাড়া ইজমা হতে পারে না…..”[মিরকাতুল মাফাতিহ, আলী ক্বারী- ২/৬১]
 
ইমাম বদরুদ্দিন আইনী রহ. লিখেছেন- الجماعة التي أمر الشارع بلزومها هي جماعة العلماء لأن الله -عز وجل جعلهم حجة على خلقه وإليهم تفزع العامة في دينها وهم تبع لها وهم المعنيون بقوله: إن الله لن يجمع أمتي على ضلالة – “রাসুলুল্লাহ সা. যে জামাআতকে আঁকড়িয়ে ধরার নির্দেশ দিয়েছেন সেটি হল (আহলে হক্ব মুসতাহীদ/মুহাক্কেক) আলেমগণের জামাআত। এটা এজন্য যে, আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের উপর তাঁদেরকে হুজ্জত (দলিল) বানিয়েছেন। সর্বসাধারণ (মুসলমানরা দ্বীনের ইলম রাখে না বিধায়) দ্বীনের কোনো ব্যাপারে আশংকা হলে (তাঁর শরয়ী বিধান জানার জন্য) আলেমগণের কাছে ছুটে যেতে আদিষ্ট । (কারণ,) আলেমগণ হলেন (শরীয়তের) ব্যাখ্যাকার। (আলেমগণের দিকে ইঙ্গিত করেই) রাসুলুল্লাহ সা. এরশাদ করেন- إن الله لن يجمع أمتي على ضلالة – নিশ্চই আল্লাহ আমার উম্মত(-এর মুহাক্কিক আলেমগণ)কে পথভ্রষ্ঠতার উপর ঐকমত করবেন না” [উমদাতুল কারী, আইনী- ২৪/১৯৫]
 
ইমাম শাফেয়ী রহ. বলেছেন- إنما تكون الغفلة في الفرقة فأما الجماعة فلا يمكن فيها كافة غفلة عن معنة كتاب ولا سنة ولا قياس إن شاء الله  – “গাফলত (অবহেলাজনিত ভুল) শুধুমাত্র (একা ও) বিচ্ছিন্ন লোকের মধ্যেই হতে পারে। অপরদিকে الجماعة (জামাআত)-এর মধ্যে সকলের একই সাথে গাফলতী/ভুল হওয়া সম্ভব নয় – না কুরআনের অর্থ  ও মর্ম চয়নের ক্ষেত্রে, না সুন্নাহ’র ক্ষেত্রে, আর না কিয়াসের ক্ষেত্রে -ইনশাআল্লাহ”। [কিতাবুল উম্ম,ইমাম শাফেয়ী- ১/২২১]
 
এজন্য কোনো বিষয়ে আহলে হক্ব মুসতাহীদ/মুহাক্কেক আলেমগণের ইজমা কায়েম হলে যদি গোটা বিশ্বের সকল মুর্খ-জাহেল মুসলমানরা কিংবা অদক্ষ ইলমধারীরাও ইজমার বিরোধীতা করে, তবুও আহলে হক্ব আলেমদের ইজমা স্বস্থানে স্বশক্তিতে দন্ডায়মান থাকবে, জাহেলদের দ্বিমত বা প্রতিবাদের তুফনে ইমজার কোনোই ক্ষতি হবে না। 
 
ইমাম ত্বাবরানী (মৃ: ৩৬০ হি:) রহ. উত্তম সনদে হযরত আলী রা. থেকে একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন, হযরত আলী রা. বলেন-  قُلْتُ : يَا رَسُولَ اللَّهِ ، إِنْ نَزَلَ بِنَا أَمْرٌ لَيْسَ فِيهِ بَيَانٌ : أَمْرٌ وَلا نَهْيٌ ، فَمَا تَأْمُرُنَا ؟ قَالَ : ” تُشَاوِرُونَ الْفُقَهَاءَ وَالْعَابِدِينَ ، وَلا تُمْضُوا فِيهِ رَأْيَ خَاصَّةٍ – رواه الطبـراني فــي الأوســط: رقم الحديث ١٦٤٧, قال الهيثمي فـي مــجمـع الزوائد:١٠/١٧٨ رجاله موثقون من أهل الصحيح, الهندي في كنز العمال رقم ٤١٨٨، وقال عنه حسن صحيح, و خليفة بن خياط فـي مسنده, رقم الحديث ٤٦  – “আমি বললাম: ইয়া রাসুলাল্লাহ ! আমাদের কাছে যদি এমন কোনো ব্যাপার সামনে আসে, যে সম্পর্কে (কুরআন ও সুন্নাহ’র কোথায়ও পরিষ্কার করে কিছু) বলা নেই, আবার (সে সম্পর্কে) কোনো নিষেধাজ্ঞাও নেই, সেক্ষেত্রে আপনি আমাদেরকে কি করার নির্দেশ দেন? রাসুলুল্লাহ সা. এরশাদ করলেন:  تُشَاوِرُونَ الْفُقَهَاءَ وَالْعَابِدِينَ ، وَلا تُمْضُوا فِيهِ رَأْيَ خَاصَّةٍ –(তখন) তোমরা ফকিহ ও আবেদ (আলেম)গণের সাথে পরামর্শ করো এবং সে ব্যাপারে কোনো একক (ব্যাক্তির) মতামতকে গ্রহন করো না”। [আল-মু’জামুল আউসাত, ত্বাবরানী, হাদিস ১৬৪৭; মাজমাউয যাওয়ায়িদ, হাইছামী-১০/১৭৮; হাঞ্জুল উম্মাল, মুত্তাকী, হাদিস ৪১৮৮; মুসনাদে খালিফাহ, হাদিস ৪৬]
 
এই হাদিস থেকে বোঝা গেল, কোনো জামানায় যদি দেখা যায় যে, কোনো মুহাক্কেক আলেম (কুরআন-সুন্নাহ থেকে) ইসতেহাদ করে কোনো বিষয়ে এমন একক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, যার বিপরীতে পূর্বজামানার বা সেই জামানার আহলে হক্ব ফিকাহবীদ ও আবেদ আলেমগণ সর্বসম্মতভাবে অন্য মত পোষন করছেন, তাহলে সর্বসাধারণ মুসলমানদের উপর ওয়াজিব হল ওই একক মতের অনুসরণ না করে আলেমগণের ইজমা (ঐক্যমত)-কে অনুসরণ করা। এর কারণ হল, আল্লাহ তাআলা এই উম্মতের আহলে হক্ব ফিকাহবীদ ও আবেদ আলেমগণের জামাআত’কে পথভ্রষ্ঠতার উপর একমত হওয়া থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন।
 
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে সহিহ সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সা. এরশাদ করেন- لَا يَجْمَعُ اللَّهُ أُمَّتِي عَلَى ضَلَالَةٍ أَبَدًا وَيَدُ اللَّهِ عَلَى الْجَمَاعَةِ . رواه الحاكم في لمستدرك على الصحيحين , كتاب العلم : ١/١٩١ رقم ٣٩٩ , اسناده صحيح – “আল্লাহ আমার উম্মতকে কোনো দিন পথভ্রষ্ঠতার উপর ইজমাবদ্ধ/ঐক্যবদ্ধ করবেন না। আর জামাআতের উপরে রয়েছে আল্লাহ’র (রহমতের) রহমত”। [মুসতাদরাকে হাকিম– ১/১৯১ হাদিস ৩৯৯] 

আনাস বিন মালেক রা. , আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বহু সাহাবায়ে কেরাম রা. থেকে থেকে এই হাদিসের বহু শাহেদ হাদিস রয়েছে এবং তা বহু সূত্রে বর্ণিত হয়েছে এবং হাদিসের মাফহুম মুহাদ্দেস ওলামায়ে কেরামগণের কাছে মাকবুল ও সহিহ। আরো দেখুন: [আস-সুন্নাহ, ইমাম ইবনু আবি আসেম-৮৩, সুনানে তিরমিযী, হাদিস ২১৬৭; মুসতাদরাকে হাকিম- ১/১৯৯, ২০১, হাদিস ৩৯১-৩৯৯, ৮৬৬৪; আল-মু’জামুল কাবির, ত্বাবরানী-৩/২৯২, ১২/৪৪৭, হাদিস ২১৭১, ৩৪৪০, ১৩৬২৩; সুনানে আবু দাউদ-২/৫০০ , হাদিস ৪২৫৩; মুসনাদে আহমাদ-৫/১৪৫, হাদিস ২১৩৩১, ২৭২২৪; সুনানে ইবনে মাজাহ- ২/১৩০৩, হাদিস ৩৯৫০; মুসনাদে আব্দ বিন হুমায়েদ- ১/৩৬৭, হাদিস ১২২০; হিলইয়া, আবু নুআইম- ৩/৩৭; আল-মুসান্নাফ, ইবনে আবি শায়বা- ৭/৪৫৭, হাদিস ৩৭১৯২; সুনানে দারেমী, হাদিস ৫৫; আস-সুন্নাহ, ইবনু আবি আসেম, হাদিস ৮০, ৮২,  ৮৩, ৮৪, ৮৫, ৯২; আল-আসমাউ ওয়াস সিফাত, বাইহাকী, হাদিস ৭০১]

 
উম্মতের ইজমা যে যেকোনো প্রকার পথভ্রষ্ঠতা থেকে মুক্ত -তা যে বিশেষভাবে  শুধু রাসুলুল্লাহ সা.-এর হাদিসেই বর্ণিত হয়েছে -তা নয়, সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে অনেকেই মুসলমানদের সামনে (রাসুলুল্লাহর নাম উল্লেখ না করেও) একই ভঙ্গিতে  নসিহত বলতেন, যা থেকে প্রতিয়মান হয় যে, ইজমা’র এই মাফহুম (মর্ম ও অর্থ) একদম সহীহ এবং সে জামানায় এর ব্যাপক চর্চা ও আমল ছিল। যেমন, হযরত উসায়ের বিন আমর রহ. থেকে সহিহ সনদে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন:- شَيَّعْنَا ابْنَ مَسْعُودٍ حِينَ خَرَجَ , فَنَزَلَ فِي طَرِيقِ الْقَادِسِيَّةِ فَدَخَلَ بُسْتَانًا , فَقَضَى الْحَاجَةَ ثُمَّ تَوَضَّأَ وَمَسَحَ عَلَى جَوْرَبَيْهِ ثُمَّ خَرَجَ وَإِنَّ لِحْيَتَهُ لَيَقْطُرُ مِنْهَا الْمَاءُ , فَقُلْنَا لَهُ: اعْهَدْ إِلَيْنَا فَإِنَّ النَّاسَ قَدْ وَقَعُوا فِي الْفِتَنِ وَلَا نَدْرِي هَلْ نَلْقَاكَ أَمْ لَا , قَالَ: «اتَّقُوا اللَّهَ وَاصْبِرُوا حَتَّى يَسْتَرِيحَ بَرٌّ أَوْ يُسْتَرَاحَ مِنْ فَاجِرٍ , وَعَلَيْكُمْ بِالْجَمَاعَةِ فَإِنَّ اللَّهَ لَا يَجْمَعُ أُمَّةَ مُحَمَّدٍ عَلَى ضَلَالَةٍ . رواه ابن أبي شيبة في مصنفه , كتاب الفتن : ٢٢/٦٣ رقم ٣٩٣٤٦ ; قال ابن حجر في تلخيص الحبير, كتاب النكاح : ٣/٣٠١ : إسناده صحيح ومثله لا يقال من قبل الرأي – “(সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ) ইবনে মাসউদ রা. আমাদের সঙ্গ দিচ্ছিলেন, একসময় আলাদা হয়ে কাসেদিয়ার পথ ধরে চলতে চলতে বুস্তান এলাকায় প্রবেশ করলেন। এরপর হাজত সেরে ওযু করলেন এবং চামড়ার মুজার উপর মাসেহ করলেন। এরপর যখন বের হলেন, তখন তাঁর দাঁড়ি থেকে পানির ফোটা ঝড়ছিল। তখন আমরা তাঁকে বললাম: আমাদের দিকে একটু নজর দিন। কারণ লোকজন ফিতনায় লিপ্ত হয়ে পড়ছে। আর আমরা জানি না (প্রয়োজনে) আপনার সাক্ষাত পাবো কি না। তিনি বললেন: আল্লাহকে ভয় করে চলো এবং ধৈর্য ধারন করতে থাকো যাবৎ না সৎ কাজকে সচ্ছন্দে করতে পারো অথবা ফাজের (অসৎ-পাপী) লোকদের থেকে পরিত্রান লাভ করো। আর জামাআত (-এর সাথে একাত্ব/ইজমাবদ্ধ/ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকা)কে তোমাদের উপর  অপরিহার্য করে নাও। কারণ আল্লাহ তাআলা উম্মতে মুহাম্মাদীকে পথভ্রষ্ঠতার উপর ইজমাবদ্ধ/ঐক্যবদ্ধ করবেন না”। [আল-মুসান্নাফ, ইবনে আবি শায়বা- ২২/৬৩ হাদিস ৩৯৩৪৬; তালখিসুল হাবির, ইবনে হাজার- ৩/৩০১; তুহফতুল আহওয়াযী- ৬/৩২২]

 
এমনিভাবে হযরত উসায়ের বিন আমর থেকে উত্তম সনদে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন: سَمِعْتُ أَبَا مَسْعُودٍ يَقُولُ: «عَلَيْكُمْ بِالْجَمَاعَةِ فَإِنَّ اللَّهَ لا يَجْمَعُ أُمَّةَ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عليه وسلم على ضلالة – قال الألباني في ظلال الجنة: «إسناده جيد موقوف رجاله رجال الشيخين. والحديث رواه الطبراني أيضا من طريقين إحداهما رجالها ثقات كما في “المجمع” ٥/٢١٩ –  “আমি আবু মাসউদ রা.-কে বলতে শুনেছি: তোমরা জামাআত (-এর সাথে একাত্ব/ইজমাবদ্ধ/ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকা)কে তোমাদের উপর অপরিহার্য করে নাও। কারণ আল্লাহ তাআলা মুহাম্মাদ সা.-এর উম্মতকে পথভ্রষ্ঠতার উপর ইজমাবদ্ধ/ঐক্যবদ্ধ করবেন না”। [আস-সুন্নাহ, ইমাম ইবনু আবি আসেম-৮৫; আল-মু’জামুল কাবির, ত্বাবরানী- ৬/১১৭ হাদিস ১৪০৯২; মাজমাউয যাওয়ায়ীদ, হাইছামী- ৫/২১৮; তালখিসুল হাবির, ইবনে হাজার- ৩/৩০১]
 
وَكَذَٰلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا لِّتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ وَيَكُونَ الرَّسُولُ عَلَيْكُمْ شَهِيدًا
‘ আর এইভাবেই আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থি (ইনসাফগার) উম্মত বানিয়েছি, যাতে তোমরা মানুষের উপর সাক্ষ্যদাতা হতে পারো এবং (আমার) রাসুল (মুহাম্মাদও) তোমাদের উপর একজন সাক্ষ্যদাতা হতে পারেন ’। [সূরা বাকারাহ ১৪৩]

এই আয়াতে  أمة وسطاً – মধ্যপন্থি উম্মত -এর সারমর্ম হল এঁরা এমন এক মুসলীম জামাআত যাঁরা দুনিয়াতেও আল্লাহ’র হুকুম পালনের প্রশ্নে পরিমিত ও ন্যায়পরায়নতার পরিচয় দিবে এবং এই গুণী মর্যাদার কারণে আখেরাতে হাশরের ময়দানেও আগেকার বিভিন্ন যুগের উম্মতরা যারা তাদের কাছে আগত নবী ও রাসুলগণের আগমনকে অস্বীকার করবে তাদের মিথ্যা দাবী খন্ডনে এবং ওইসকল নবী ও রাসুলগণের  রেসালাতের সত্যতার উপর সাক্ষ্য দেয়ার মর্যাদা লাভ করবে, পরে রাসুলুল্লাহ সা. তাদের স্বাক্ষ্যের স্বপক্ষে স্বাক্ষ্য দিবেন। [সহীহ বুখারী ৪৪৮৭; মুসনাদে আহমাদ ১০৮৯১; সুনানে ইবনে মাজাহ ৪২৮৪, তাফসীরে তাবারী- ২/৮, তাফসীরে ইবনে কাসির- ১/১৮১] এই  আয়াত থেকে প্রমাণিত হয়, মুসলীম উম্মাহ’র সামষ্টিক স্বাক্ষ্য/মত আল্লাহ’র কাছে মকবুল (কবুলকৃত) এবং রাসুলুল্লাহ সা. কর্তৃক সমর্থিত। কারণ, যদি সকলের ঐক্যমতকে ভুল বলে ধরে নেয়া হয়, তাহলে- এই উম্মত  أمة وسطاً – মধ্যপন্থি/ইনসাফগার উম্মত -এই কথার কোনোই অর্থ থাকে না। তাই এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা এই উম্মতকে স্বাক্ষী/স্বাক্ষ্যদাতা উম্মত হিসেবে অবিহিত করার মাধ্যমে অপরাপর মানুষদেরকে তাদের ইজমায়ী/সামষ্টিক মত/স্বাক্ষ্যকে হুজ্জত (দলিল) হিসেবে নির্ণীত করেছেন। এ থেকেও একথা প্রমাণিত হয় যে, এই উম্মতের ইজমা/ঐক্যমত শরীয়তের হুজ্জত/দলিল। [ফিকহ মে ইজমা কা মাকাম, মুফতী রফী উসমানী- ১৫ পৃ:]

বিষয়টি এখানেই শেষ নয়। ইসলামী শরীয়তে উম্মাহ’র ইজমা এতই গুরুত্ব রাখে যে, রাসুলুল্লাহ সা.-এর বিরোধীতাকারী বা তাঁর বিপক্ষে অবস্থান গ্রহনকারীর জন্য যে শাস্তির কথা কুরআনে বলা হয়েছে, সেই শাস্তি ওই ব্যাক্তির জন্যেও রয়েছে মর্মে আমরা দেখতে পাই, যে ব্যাক্তি মুমিনগণের ইজমায়ী/ঐক্যবদ্ধ দ্বীনী পথকে পরিত্যাগ করে ভিন্ন পথ অবলম্বন করে নেয়।  যেমন, আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-
 
وَمَنْ يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّى وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيرًا
‘আর যে ব্যাক্তির কাছে আল-হুদা (সঠিক পথ) প্রতিভাত হয়ে যাওয়ার পরও রাসুলের বিপক্ষে অবস্থান নেয় এবং সে ইমানদারেগণের পথ ভিন্ন অন্য পথের অনুসরণ করে, সে যেদিকে মুখ ফিরিয়েছে আমরা তাকে সেদিকেই ফিরিয়ে দিবো এবং তাকে জাহান্নামে দগ্ধ করবো। আর (সেটা কতই-না) নিকৃষ্ট গন্তব্যস্থল। [সূরা নিসা ১১৫]
 
এখানে سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ (মুমিনদের পথ) বলতে জাহেল-মুর্খ মুসলমানদের পথ উদ্দেশ্য নয়, কারণ তারা-তো শরীয়তই বোঝে না, তাদের অনুসরণ করলে-তো মানুষ সব পথভ্রষ্ঠ হয়ে দোযখের পথ ধরবে। তাই বোঝা গেল, এখানে سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ (মুমিনদের পথ) বলতে আহলে হক্ব আলেমগণ উদ্দেশ্য, যাঁদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে দ্বীন ইসলামের হিফাজতের জন্য, যারা দ্বীনের সহিহ ইলম হাসিল করে, দ্বীন বোঝে, দ্বীনের উপর চলে, অন্যকে সহিহ পথ দেখায় এবং এরই দিকে মানুষকে আহবান করে, যাঁদের সামষ্টিকে ঐক্যমত ও একতাকে উপরে বর্ণিত হাদিসসমূহে   الجماعة   (জামাআত)   বা الطائفة (গোষ্ঠি/দল) বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে, যাঁরা কেয়ামতের আগ পর্যন্ত (আল্লাহ তাআলা যতদিন চাবেন) সর্বদা হক্বের উপর সিরাতে মুস্তাকিমের উপর কায়েম থাকবেন এবং কেউ এই জামাআতের পথকে লাইনচ্যুত করতে চাইলেও তাদেরকে লাইনচ্যুত করতে সমর্থ হবে না। যেমন হযরত মুয়াবিয়া রা.-এর সূত্রে বণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ এরশাদ করেন- مَنْ يُرِدِ اللَّهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِي الدِّينِ ، وَإِنَّمَا أَنَا قَاسِمٌ وَيُعْطِي اللَّهُ وَلَنْ يَزَالَ أَمْرُ هَذِهِ الْأُمَّةِ مُسْتَقِيمًا حَتَّى تَقُومَ السَّاعَةُ ، أَوْ حَتَّى يَأْتِيَ أَمْرُ اللَّهِ . رواه بخاري في الصحيح , كتاب العلم , باب من يرد الله به خيرا يفقهه في الدين : ١/٦١ رقم ٧١  – “আল্লাহ যার কল্যান করতে চান, তাকে দ্বীনের (ফকিহ বানান) গভীর জ্ঞান দান করেন। আর আমি (দ্বীনী ইলমের) নিছক একজন বন্টনকারী মাত্র, (বাস্তবে ইলম) আল্লাহ’ই দান করেন। আর এই উম্মতের (দ্বীনী) বিষয়াদি সব সময় (সিরাতে) মুস্তাকিম (সোজা পথের উপর স্থাপিত) থাকবে যাবৎ না কিয়ামত এসে যায় অথবা যাবৎ না আল্লাহ’র নির্দেশ আসে”। [সহিহ বুখারী- ১/১৬ হাদিস ৭১]
 
আর সর্বসাধারণ মুসলমানদের উপর ওয়াজিব হল এই الجماعة (জামাআত)-কে শক্তকরে আঁকড়িয়ে ধরে থাকা এবং তাদের মধ্যে যারা যারা এই জামাআতের পথকে শক্ত করে আঁকড়িয়ে ধরে থাকতে সমর্থ হবে, তারা তারা এই الجماعة (জামাআত)-এর কিস্তির মধ্যে আরোহীর মধ্যে শামীল হওয়া মুসলমান বলে বিবেচিত হবে। এজন্য যদিও-বা  আহলে হক্ব ওলামায়ে কেরামের দেখানো পথের অনুসারী সর্বসাধারণ মুসলমানরাও  الجماعة (জামাআত)-এর মধ্যে শামীল, কিন্তু  سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ (মুমিনদের পথ) বলতে আহলে হক্ব আলেমগণ উদ্দেশ্য, কারণ পথ দেখাবেন আহলে হক্ব আলেমগণই; জাহেলরা নয়। 
 
আয়াতটিতে يَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ (সে ইমানদারেগণের পথ ভিন্ন অন্য পথের অনুসরণ করে) বলতে الجماعة (জামাআত)-এর দেখানো পথ ভিন্ন সকল পথভ্রষ্ঠ পথ। وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ – ‘ আর (হে মুহাম্মাদ, তাদেরকে বলুন:) আমার এই পথ (একদম জান্নাত বরাবর) সোজা (পথ; সিরাতে মুস্তাকীম)। অতএব তোমরা (শুধুমাত্র) সেটাকেই অনুসরণ করে চলো। আর তোমরা (আমার এই পথ ভিন্ন অন্যদের দেখানো) পথসমূহের অনুসরণ করে চলো না। তাহলে (সে কাজ) তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে (সরিয়ে নিয়ে বহু মত ও পথে) বিভক্ত করে দিবে। [সূরা আনআম ১৫৩] 
 
কিন্তু কে শোনে কার কথা, মুসলীম উম্মাহ’র বেশিরভাগই الجماعة (জামাআত)-কে পরিত্যাগ করে অন্যদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অনুসরণ করার কারণে দ্বীন ইসলামকে টুকরো টুকরো করে ফেলবে মর্মে রাসুলুল্লাহ সা. ভবিষ্যৎবানী করে গেছেন। যেমন, হযরত মুয়াবিয়া রা. থেকে সহীহ সনদে বণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ সা. এরশাদ করেন- ألا إن من كان قبلكم من أهل الكتاب افترقوا على اثنتين وسبعين ملة وإن هذه الأمة ستفترق على ثلاث وسبعين اثنتان وسبعون في النار وواحدة في الجنة وهي الجماعة . أخرجه أبو داود: ٢/٦٠٨، برقم: ٤٥٩٧، وحسنه ابن حجر في ” تخريج الكشاف “: ص ٦٣ ، وصححه ابن تيمية في ” مجموع الفتاوى “: ٣/٣٤٥ ، والشاطبي في ” الاعتصام “: ١/٤٣٠ ، والعراقي في ” تخريج الإحياء “: ٣/١٩٩ , وأحمد في المسند: ٤/١٠٢ ، برقم: ١٦٩٧٩ ، والطبراني في المعجم الكبير: ١٩/٣٧٦، برقم: ٨٨٤ ، وقال الألباني: صحيح، أنظر مشكاة المصابيح: ١/٣٧، برقم:١٧٢ – ‘খুব ভাল করে শোন, তোমদের পূর্বে আহলে কিতাবদের মধ্যে যারা ছিল, তারা (ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শ ও আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে) বাহাত্তরটি মিল্লাতে (ফেরকায়) বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। আর নিশ্চই এই উম্মত তিহাত্তরটি (মিল্লাতে) বিভক্ত হয়ে যাবে, যার বাহাত্তরটিই যাবে দোযখে (ইসলাম বহির্ভূত ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শ ও আদর্শে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে) আর একটি যাবে জান্নাতে। আর সেই একটি (মিল্লাত) হল الجماعة (আল-জামাআত)। [সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৪৫৯৭; মুসনাদে আহমাদ- ৪/১০২, হাদিস ১৬৯৭৯; আল-মু’জামুল কাবির, ত্বাবরানী-১৯/৩৭৬, হাদিস ৮৮৪] মুসলীম নামধারী এই ৭২ টি ফেরকাহ কি উপরোক্ত এই আয়াতাংশের মধ্যে পরবে না-  وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيرًا – এবং তাকে জাহান্নামে দগ্ধ করবো। আর (সেটা কতই-না) নিকৃষ্ট গন্তব্যস্থল।
 
ইমাম জামাখশারী রহ. উপরোক্ত আয়াতের তাফসীরের একস্থানে লিখেছেন- وهو السبيل الذي هم عليه من الدين الحنيفي القيم، وهو دليل على أن الاجماع حجة لا تجوز مخالفتها كما لا تجوز مخالفة الكتاب والسنة لان الله عز وعلا جمع بين أتباع سبيل غير المؤمنين وبين مشاقة الرسول في الشرط وجعل جزاءه الوعيد الشديد فكان اتباعهم واجبا كموالاة الرسول عليه الصلاة  ‘এটা হল তাঁদের পথ যাঁরা দ্বীনে হানিফ (একমুখী দ্বীন/সিরাতে মুস্তাকীমের) উপর কায়েম থাকেন। আর এটা একথারই দলিল যে, (তাঁদের) ইজমা/ঐক্যমত (শরীয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ) হুজ্জত। এর বিরোধীতা করা তেমনিই নাজায়েয যেমনিভাবে কুরআন ও সুন্নাহ’র বিরোধীতা করা নাজায়েয। কারণ, আল্লাহ তাআলা  -মুমিনদের পথভিন্ন অন্য পথের অনুসরণ এবং রাসুলের বিরোধীতা করা -এই দুই কাজকে একই শর্তের মধ্যে শামীল করে নিয়েছেন এবং এর পরিণতি হিসেবে যে ধমক দিয়েছেন তা চরম মাত্রার। তাই তাঁদেরকে অনুসরণ করা তেমনিই অপরিহার্য যেমনিভাবে রাসুলুল্লাহ সা.-কে  অনুসরণ করা অপরিহার্য। [তাফসীরে কাশশাফ, ইমাম জামাখশারী- ১/৫৬৫; আল-বাহরুল মুহীত, ইমাম আবু হাইয়্যান- ৩/৩৬৬ ]
 
ইমাম ইবনে কাসির রহ. উপরোক্ত আয়াতের তাফসীরের একস্থানে লিখেছেন- أي : ومن سلك غير طريق الشريعة التي جاء بها الرسول صلى الله عليه وسلم ، فصار في شق والشرع في شق ، وذلك عن عمد منه بعد ما ظهر له الحق وتبين له واتضح له . وقوله : ( ويتبع غير سبيل المؤمنين ) هذا ملازم للصفة الأولى ، ولكن قد تكون المخالفة لنص الشارع ، وقد تكون لما أجمعت عليه الأمة المحمدية ، فيما علم اتفاقهم عليه تحقيقا ، فإنه قد ضمنت لهم العصمة في اجتماعهم من الخطأ ، تشريفا لهم وتعظيما لنبيهم [ صلى الله عليه وسلم ] . وقد وردت في ذلك أحاديث صحيحة كثيرة ، قد ذكرنا منها طرفا صالحا في كتاب ” أحاديث الأصول ” ، ومن العلماء من ادعى تواتر معناها ، والذي عول عليه الشافعي ، رحمه الله ، في الاحتجاج على كون الإجماع حجة تحرم مخالفته هذه الآية الكريمة ، بعد التروي والفكر الطويل . وهو من أحسن الاستنباطات وأقواها….. ‘অর্থাৎ, (এখানে এমন ব্যাক্তির কথা বলা হচ্ছে, যে ব্যাক্তি) রাসুলুল্লাহ সা. যে শরীয়ত নিয়ে এসেছেন, সে সেই শরীয়তের পথ ভিন্ন অন্য পথ এখতিয়ার করে নিয়েছে, অর্থাৎ তার পথ এক দিকে আর শরীয়তের পথ আরেক দিকে। আর তার (শরীয়তভিন্ন অন্যপথে চলার) এই মনকামনা প্রকাশ পেয়েছে তখন যখন তার সামনে (আল্লাহ’র নাজিলকৃত সত্য ও) হক্ব পথ প্রকাশিত হয়ে, পরিষ্ফুটিত হয়ে  সুস্পষ্টভাবে ধরা দিয়েছে -তার পর। এরপর আল্লাহ তাআলার (ওই ব্যাক্তি সম্পকে আরো) এরশাদ করেছেনوَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ – ‘এবং সে ইমানদারেগণের পথ ভিন্ন অন্য পথের অনুসরণ করে’এটা তার আগের বৈশিষ্টটির অনুগামী আরেকটি বৈশিষ্ট। তবে তার এই (বৈশিষ্টের বহিঃপ্রকাশ) ঘটতে পারে কখনো রাসুলুল্লাহ সা.-এর পরিষ্কার হুকুমের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে, আবার কখনো ঘটতে পারে -উম্মতে মুহাম্মাদী কোনো ব্যাপারে ইজমা/ঐক্যমতে উপনীত হয়েছে -আর তাদের সেই ঐক্যমতের কথা ভালকরে জানার পরও তার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে। (এই আয়াত থেকে বোঝা যায়) খোদ্ আল্লাহ তাআলাই মুমিনগণের ইজমা/ঐক্যমতকে ভুল হওয়া থেকে বাঁচিয়ে দেয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন – এক-তো তাদের অভিজাত মর্যাদার কারণে, দ্বিতীয়ত রাসুলুল্লাহ সা.-এর কারণে। এ সম্পর্কে বর্ণিত সহীহ হাদিসের সংখ্যা অনেক। আমি أحاديث الأصول কিতাবে এধরণের হাদিসগুলোকে সূত্র ও উসূল সহকারে যথার্থভাবে বর্ণনা করে দিয়েছি। অনেক ওলামায়ে কেরাম-তো এসকল হাদিসের মাফহুমকে তাওয়াতীর বলেও মত প্রকাশ করেছেন। (আহলে হক্ব আলেমগণের) ‘ইজমা’/ঐক্যমত যে শরীয়তের একটি  হুজ্জত (দলিল) এবং ইজমার বিপক্ষে অবস্থান নেয়া যে  হারাম  -ইমাম শাফেয়ী রহ. দীর্ঘ চিন্তাভাবনার পর নিশ্চিত হয়ে সেকথার স্বপক্ষে এই আয়াতে কারিমাকে দলিল হিসেবে পেশ করেছেন। বস্তুতঃ তাঁর এই দলিলটি এব্যাপারে সবচেয়ে সুন্দর ও শক্তিশালী একটি দলিল।…..[তাফসীরে ইবনে কাসির– ২/৪১৩]
 

(৪) কিয়াস

কিয়াস (القياس)-এর আভিধানিক অর্থ হল কোনো নমুনা সামনে রেখে অপর কোনো জিনিস ওই নমুনার সাথে সামঞ্জস্যতা রাখে কিনা তা নির্ণয় করা। আর শরীয়তের পরিভাষায় কিয়াস বলা হয় নতুন উদ্ভুত কোনো বিষয়/মাসআলাহকে ইসলামী শরীয়তের মূল ভিত্তি/উৎস কুরআন ও সুন্নাহ’য় বর্ণিত বিধানবিধিন বা উসূলের আলোকে নিরিক্ষন করে দেখা যে তা কুরআন বা সুন্নাহ’র কোনো বিধান বা উসূলের সাথে সামঞ্জস্যতা রাখে এবং সে অনুযায়ী ওই উদ্ভুত বিষয়ের শরয়ী হুকুম কী হবে তা স্থির করা। 
 
শরয়ী কিয়াস’কে অনেকে খোদ্ ইসতিহাদ (اجتهاد) বলেও অবিহিত করে থাকেন। অবশ্য কথাটি একটি উল্লেখযোগ্য পর্যায় পর্যন্ত  সম্পূর্ণ সঠিক। কারণ, ইসতিহাদ কথাটির  আভিধানিক অর্থ হল: কোনো কিছু হাসিল করার উদ্দেশ্যে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালানো। শরীয়তের পরিভাষায় ইজতিহাদ বলা হয় ইসলামী শরীয়তের মূল ভিত্তি/উৎস কুরআন ও সুন্নাহ’য় বর্ণিত বিধানবিধিন বা উসূলের আলোকে যে কোনো বিষয়ে শরীয়তের হুকুম কী – তা নির্ণয়ে   সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো।
 
বলা বাহুল্য, যে ব্যাপারে কুরআন-সুন্নাহ’য় সুস্পস্ট বিধান বিদ্যমান রয়েছে, সেখানে কিয়াস বা ইসতিহাদ -কোনটারই প্রয়োজন নেই; জায়েযও নেই। কিয়াস এবং ইসতিহাদ-তো করা হয় ওই ক্ষেত্রে, যখন কোনো নির্দিষ্ট ব্যাপারে কুরআন-সুন্নাহ’য় সুস্পস্ট বিধান বিদ্যমান পাওয়া যায় না, কিংবা পাওয়া গেলেও তার একাধিক শরয়ী অর্থ ও মর্ম বের করার অবকাশ থাকে, তখন কুরআন ও সুন্নাহ’য় বর্ণিত অনুষঙ্গিক বা অপরাপর বিধানবিধিন ও উসূলের আলোকে ইসতিহাদ/কিয়াস করে সেই বিষয়ে শরয়ী হুকুম কী -তা স্থির করা হয়।
 
কিয়াস ও ইসতিহাদ করার দলিল খোদ কুরআন কারিম, রাসুলুল্লাহ সা.-এর সুন্নাহ এবং সাহাবায়ে কেরামের আমল থেকে প্রমাণিত।
 
সহীহ হাদিসে আছে, রাসুলুল্লাহ সা. এরশাদ করেন– إني إنما أقضي بينكما برأي فيما لم ينزل علي فيه – ‘যে ব্যাপারে (সরাসরি কোনো ফয়সালা সহকারে) আমার উপর (কোনো ওহী) নাজিল হয় না, শুধু সেক্ষেত্রে আমি (আমার উপর বিগত নাজিল হওয়া ওহীর আলোকে ইসতেহাদ করি এবং একটি সিদ্ধান্তে উপণীত হই এবং) তোমাদের দুজনের মাঝে আমার সিদ্ধান্ত অনুসারে ফয়সালা করে দেই। [সহীহ বুখারী-৫/২১২; সহীহ মুসলীম-৩/১৩৩৭; সুনানে আবু দাউদ-৩৫৮৫; সুনানে নাসায়ী-৮/২৩৩; তাফসিরে ইবনে কাসির-৪/২৬০]
 
এই হাদিসে পরিষ্কার বলা হয়েছে, রাসুলুল্লাহ সা.-এর সামনে যখন এমন কোনো মাসআলাহ’র উদ্ভুত ঘটতো, যে ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা’র শরয়ী আইন কী -তা ব্যাক্ত করে কুরআনের কোনো আয়াত নাজিল হল না কিংবা হিকমাহ (সুন্নাহ) আকারেও কোনো ওহী পেলেন না, তখন তিনি বিগত নাজিল হওয়া কুরআনের বিধান ও হিকমাহ’র আলোকে ইসতিহাদ ও কিয়াস করে উদ্ভুত মাসআলাটির সমাধান জানিয়ে দিতেন। আল্লাহ তাআলা এভাবে রাসুলুল্লাহ সা.-এর মাধ্যমে উম্মতকে কুরআন অনুযায়ী বিচার-ফয়সালা ও ফাতওয়া দানের ‘হিকমাহ’ শিক্ষা দিয়েছেন। وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَ الْحِكْمَةَ  – ‘এবং (নবী মুহাম্মাদ সা.) তাদেরকে শিক্ষা দেন  আল-কিতাব (কুরআন) ও হিকমাহ্ (সুন্নাহ)[সূরা আল-ইমরান ১৬৪] কিয়াস ও ইসতেহাদ-যে একটি সুন্নাহ এবং ইসলামী শরীয়তের দলিল -এই হাদিসটি তার একটি প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
 
ইমাম ত্বাবরানী (মৃ: ৩৬০ হি:) রহ. উত্তম সনদে হযরত আলী রা. থেকে একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন, হযরত আলী রা. বলেন-  قُلْتُ : يَا رَسُولَ اللَّهِ ، إِنْ نَزَلَ بِنَا أَمْرٌ لَيْسَ فِيهِ بَيَانٌ : أَمْرٌ وَلا نَهْيٌ ، فَمَا تَأْمُرُنَا ؟ قَالَ : ” تُشَاوِرُونَ الْفُقَهَاءَ وَالْعَابِدِينَ ، وَلا تُمْضُوا فِيهِ رَأْيَ خَاصَّةٍ – رواه الطبـراني فــي الأوســط: رقم الحديث ١٦٤٧, قال الهيثمي فـي مــجمـع الزوائد:١٠/١٧٨ رجاله موثقون من أهل الصحيح, الهندي في كنز العمال رقم ٤١٨٨، وقال عنه حسن صحيح, و خليفة بن خياط فـي مسنده, رقم الحديث ٤٦  আমি বললাম: ইয়া রাসুলাল্লাহ ! আমাদের কাছে যদি এমন কোনো ব্যাপার সামনে আসে যে সম্পর্কে (কুরআন ও সুন্নাহ’র কোথায়ও পরিষ্কার করে কিছু) বলা নেই, আবার (সে সম্পর্কে) কোনো নিষেধাজ্ঞাও নেই, সেক্ষেত্রে আপনি আমাদেরকে কি করার নির্দেশ দেন? রাসুলুল্লাহ সা. এরশাদ করলেন:  تُشَاوِرُونَ الْفُقَهَاءَ وَالْعَابِدِينَ ، وَلا تُمْضُوا فِيهِ رَأْيَ خَاصَّةٍ –(তখন) তোমরা ফকিহ ও আবেদ (আলেম)গণের সাথে পরামর্শ করো এবং সে ব্যাপারে কোনো একক (ব্যাক্তির) মতামতকে গ্রহন করো না। [আল-মু’জামুল আউসাত, ত্বাবরানী, হাদিস ১৬৪৭; মাজমাউয যাওয়ায়িদ, হাইছামী-১০/১৭৮; হাঞ্জুল উম্মাল, মুত্তাকী, হাদিস ৪১৮৮; মুসনাদে খালিফাহ, হাদিস ৪৬]
 
এই হাদিস থেকে প্রমাণিত হয়, মুসতাহীদ/মুহাক্কেক আলেমগণ কুরআন ও সুন্নাহ’য় কোনো মাসআলাহ’র পরিষ্কার জবাব না পেলে তাঁরা কুরআন ও সুন্নাহ‘র আলোকে ইসতেহাদ করে কিয়াস করে শরয়ী জবাব/রায়/ফয়সালা/ফাতওয়া দিবেন। তবে সেক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ সা.-এর নির্দেশ হল কোনো মুহাক্কেক আলেমের একক মতকে প্রাধান্য না দিয়ে জমহুর আলেমগণের মতকে গ্রহন করা। এটা ‘কিয়াস’ নয়-তো কি?
 
আল্লাহ তাআলা সুরা আম্বিয়ায় বণী-ইসরাঈলের দুজন বিশিষ্ট নবীর আলোচনা এনেছেন -পিতা হযরত দাউদ আ. এবং তাঁর পুত্র হযরত সুলায়মান আ.। হযরত দাউদ আ. শুনু নবী ছিলেন না বরং একজন রাসুলও ছিলেন, কারণ আল্লাহ তাআলা তাঁকে একটি ভিন্ন শরীয়ত দিয়েছিলেন। তাঁর উপর ‘যাবুর’ কিতাব ও হিকমাহ/সুন্নাহ নাজিল হয়েছিল। একজন রাসুলের চাইতে তাঁর উপর নাজিল হওয়া শরীয়ত সম্পর্কে আর কার ইলম বেশি থাকতে পারে। পুত্র হযরত সুলায়মান আ. ছিলেন পিতা হযরত দাউদ আ.-এর শরীয়তের অনুগামী একজন নবী। নিঃসন্দেহে হযরত সুলায়মান আ. পিতার কাছ থেকে শরীয়তের ইলম হাসিল করেছিলেন, আবার নবী হিসেবেও তাঁর উপর বিভিন্ন বিষয়ে ওহী আসতো। মোট কথা, নবী হিসেবে তাঁরা উভয়ই শরীয়তের জ্ঞানে পারদর্শি ছিলেন -এটা বলাই বাহুল্য।
 
তাঁদের জামানায় একবার এক রাতে একটি কওমের গবাদীপশু অপর কারো ক্ষেতে ঢুকে পড়ে এবং ফসলের ক্ষতি করে ফেলে। ক্ষেতের মালিক এর বিচার চেয়ে মামলা দায়ের করে রাষ্ট্রের খলিফা হযরত দাউদ আ.-এর কাছে। ওই মামলার সঠিক ফয়সালা কী -সে ব্যাপারে কোনো বিধান নিয়ে সরাসরি কোনো ওহী নাজিল হল না। হযরত দাউদ আ. তাঁর উপর বিগত নাজিল হওয়া ওহীর আলোকে (কিয়াস/ইসতিহাদ করে) একটি ফয়সালা করে দিলেন। পুত্র হযরত সুলায়মান আ. আব্বাজির ফয়সালাটি শুনে তাঁকে বললেন যে, এ মামলায় এর চেয়েও সুন্দর একটি ফয়সালা হতে পারে, যা বাদী-বিবাদী উভয় পক্ষের জন্যই কল্যানকর হবে এবং তিনি ফয়সালাটি শুনিয়ে দিলেন। এ সম্পর্কেই আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-
 
وَدَاوُودَ وَسُلَيْمَانَ إِذْ يَحْكُمَانِ فِي الْحَرْثِ إِذْ نَفَشَتْ فِيهِ غَنَمُ الْقَوْمِ وَكُنَّا لِحُكْمِهِمْ شَاهِدِينَ – فَفَهَّمْنَاهَا سُلَيْمَانَ ۚ وَكُلًّا آتَيْنَا حُكْمًا وَعِلْمًا
‘(আর স্মরণ করো) দাউদ এবং সুলাইমান (-এর সেই ঘটনার কথা) যখন উভয়ে ক্ষেতের মামলার ব্যাপারে বিচার করে দিচ্ছিল। সেসময় (ঘটনাটি এই ঘটেছিল যে) রাতের বেলা তাতে একটি কওমের মেষ ছড়িয়ে পড়েছিল। আর আমি তাদের বিচারকার্য পর্যবেক্ষন করছিলাম (যে তাঁরা দুজনে কিভাবে বিচার করে)। তখন আমরা সুলায়মানকে তা (অর্থাৎ সঠিক ফয়সালা কী হওয়া উচিৎ তা) বুঝিয়ে দিলাম। আর (তাছাড়া) আমরা (তাঁদের দুজনের) প্রত্যেককেই দান করেছিলাম হিকমাহ ও ইলম [সূরা আম্বিয়া ৭৮, ৭৯]
 
এই আয়াতটি প্রমাণ করে, কিয়াসইসতিহাদ শুধু সর্বশেষ নবী ও রাসুল মুহাম্মাদ সা.-এর উপর নাজিলকৃত ইসলামী শরীয়তের সুন্নাহ নয়, এই সুন্নাহ পূর্ববর্তী নবী রাসুলদের শরীয়তেও বিদ্যমান ছিল। কিয়াস ইসতিহাদ এজন্য বলা হল, কারণ তখন যদি ওই মামলার রায় কি হওয়া উচিত -সে ব্যাপারে হযরত দাউদ আ.-এর উপর সরাসরি কোনো হুকুম আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে নাজিল হতই, তাহলে বলা হত না وَكُنَّا لِحُكْمِهِمْ شَاهِدِينَ আর আমি তাদের বিচারকার্য পর্যবেক্ষন করছিলাম (যে তাঁরা দুজনে কিভাবে বিচার করে)। কারণ, কোনো ব্যাপারে আল্লাহ বিধান সরাসরি নাজিল হওয়ার পর কোনো নবী কি সেই হুকুম ভিন্ন অন্য কোনো রায় দিতে পারেন?! কখনই নয়। বরং হযরত দাউদ আ.-এর জন্য ওই মামলাটি ছিল আল্লাহ’র একটি পরীক্ষা যে, তিনি কিভাবে এর কী শরয়ী ফয়সালা দেন -তা পর্যবেক্ষন করা। হযরত দাউদ আ. বিগত ওহীর উপর কিয়াস করে ইসতিহাদ করে একটি ফয়সালা দিলেন এবং ফয়সালাটি সম্পূর্ণ সঠিক হল নাকি সঠিকের কাছাকাছি হল নাকি আংশিক সঠিক হল -সে ব্যাপারে আয়াত নিশ্চুপ। তবে আয়াতের শেষে وَكُلًّا آتَيْنَا حُكْمًا وَعِلْمًا  –আর (তাছাড়া) আমরা (তাঁদের দুজনের) প্রত্যেককেই দান করেছিলাম হিকমাহ ও ইলম -থেকে বোঝা যায়, তাঁদের দুজন যে ফয়সালা দিয়েছিলেন তা আল্লাহ’র কাছে আপত্তির কিছু ছিল না; দুজনের রায়’ই শরীয়তসম্মত ছিল। তবে পুত্র সুলায়মান আ.-এর রায়টি অধিক উত্তম ছিল। এটা কিয়াস ও ইসতিহাদ নয়-তো কি ?! বিস্তারিত ঘটনার জন্য দেখুন [তাফসীরে ইবনে কাসীর-৫/২৫৫]
 
ইমাম হাসান বাসরী রহ. একবার উপরোক্ত আয়াতটি তিলাওয়াত করে বললেন:  فحَمَد سليمان، ولم يَلُم داود، ولولا ما ذكر الله من أمر هذين، لرأيت أنَّ القضاة هلكوا، فإنَّه أثنى على هذا بعلمه، وعذر هذا باجتهاده এখানে (উত্তম রায়ের জন্য) হযরত সুলায়মান আ.-এর প্রশংসা করা হয়েছে, কিন্তু হযরত দাউদ আ.-এর কোনো ক্রুটি ধরা হয়নি। আর আল্লাহ তাআলা যদি এই দুই নবীর উক্ত ঘটনা উল্লেখ না করতেন, তাহলে আমার মতে বিচারকরা নির্ঘাত ধ্বংস হয়ে যেত। বস্তুতঃ আল্লাহ তাআলা হযরত সুলায়মান আ.-এর রায়কে তার ইলমের কারণে প্রশংসা করেছেন, আর হযরত দাউদ আ.কে (ক্রুটি ধরা) থেকে মুক্তি দিয়েছেন তার ইসতিহাদের কারণে [সহিহ বুখারী- ৮/১১১; শারহুস সুন্নাহ, ইমাম বাগাভী- ১০/১১৬]
 
আল্লাহ’র সর্বশেষ শরীয়ত দ্বীন ইসলামেও আমরা দেখতে পাই যে, যে সকল আহলে হক্ব ওলামায়ে কেরাম ইসতেহাদ করার মত শরয়ী যোগ্যতার অধিকারী, তাঁরা কোনো ব্যাপারে তাঁদের চুড়ান্ত মেধা খাটিয়ে ইসতিহাদ/কিয়াস করে যদি শরীয়তের সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে সক্ষম হন, তাহলেও তারা দ্বিগুণ পুরুষ্কার পাবেন, আর যদি সিদ্ভান্তটি ভুল হয়ে যায়, তবুও তারা একটি সওয়াব পাবেন -মর্মে হাদিসে বর্ণিত রয়েছে। যেমন, হযরত আমর ইবনুল আস রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ সা. এরশাদ করেন– إذا حكم الحاكم فاجتهد ثم أصاب فله أجران وإذا حكم فاجتهد ثم أخطأ فله أجر – যখন কোনো হাকিম (বিচারক) ইসতিহাদ করে ফয়সালা দেন ও ফয়সালাটি সঠিক হয়, তখন তিনি (আমলনামায়) দুটি পুরষ্কার পান। আর তিনি যখন ইসতিহাদ করে ফয়সালা দেন কিন্তু ফয়সালাটা ভুল হয়ে যায়, তখন তিনি একটি পুরষ্কার পান। [সহীহ বুখার, হাদিস ৭৩৫২; সহীহ মুসলীম, হাদিস ১৭১৬; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৩৫৭৪; মুসনাদে আহমাদ-৪/১৯৮]
 
এই হাদিসটি ইসতিহাদ ও কিয়াসের পক্ষে একটি শক্তিশালী দলিল। কারণ কোনো ব্যাপারে কুরআন ও সুন্নাহ’য় সুস্পষ্ট ও দ্যার্থহীন বিধান বিদ্যমান থাকলে, সেক্ষেত্রে ইসতিহাদ ও কিয়াস করা-তো জায়েযই নেই। ইসতিহাদ ও কিয়াস-তো করা হয় ওই ক্ষেত্রে যেখানে -হয় সে ব্যাপারে কুরআন ও সুন্নাহ’য় সুস্পষ্ট ও দ্যার্থহীন কোনো বিধান বিদ্যমান নেই, অথবা বিদ্যমান থাকলেও তার একাধিক অর্থ, মর্ম সহ বিধান ইস্তেমবাত (চয়ন) করার অবকাশ থাকে। আর  বলাবাহুল্য, ইসলামী শরীয়ত সম্পর্কে জাহেল-মুর্খ বা অযোগ্য ব্যাক্তির ইসতিহাদ ও কিয়াস করে শরয়ী সিদ্ধান্ত দেয়ার সামান্যতম কোনো অধিকারই নেই, শরীয়তে তার মতের কোনো মূল্যও নেই, বরং তার জন্য এটা  কাজ নাজায়েয ও গুনাহ’র কাজ। 
 
ইমাম মহিউদ্দিন নববী রহ. এই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেছেন قال العلماء : أجمع المسلمون على أن هذا الحديث في حاكم عالم أهل للحكم ، فإن أصاب فله أجران : أجر باجتهاده ، وأجر بإصابته ، وإن أخطأ فله أجر باجتهاده…….قالوا : فأما من ليس بأهل للحكم فلا يحل له الحكم ، فإن حكم فلا أجر له بل هو آثم ، ولا ينفذ حكمه ، سواء وافق الحق أم لا ; لأن إصابته اتفاقية ليست صادرة عن أصل شرعي فهو عاص في جميع أحكامه ، سواء وافق الصواب أم لا ، وهي مردودة كلها ، ولا يعذر في شيء من ذلك – ‘ওলামায়ে কেরাম বলেন, মুসলীম উম্মাহ এব্যাপারে একমত যে, এই হাদিসে হাকিম (বিচারক) বলতে এমন আলেম উদ্দেশ্য যিনি (কুরআন-সুন্নাহ’য় পারদর্শী এবং শরীয়ত অনুযায়ী মানুষের) বিচার করার মত উপযুক্ত। এমন ব্যাক্তি যদি (ইসতেহাদ করে) সঠিক ফয়সালা দেন, তাহলে তার জন্য দুটি পুরষ্কার রয়েছে – একটি পুরষ্কার ইসতিহাদের, আর অপরটি সঠিক ফয়সালা দানের। আর তিনি যদি ভুল ফয়সালা দিয়ে বসেন, তাহলে তার জন্য থাকবে (শুধু) ইসতেহাদ করার পুরষ্কারটি।………..তাঁরা আরো বলেছেন, যে ব্যাক্তি (কুরআন-সুন্নাহ’র আলোকে) বিচার করার মতো উপযুক্ত নয়, তার জন্য বিচার করাই হালাল নয়। এরকম ব্যাক্তি যদি বিচার করে, তাহলে তার জন্য-তো কোনো পুরষ্কার-তো নেই-ই, বরং তার জন্য রয়েছে গোনাহ। সে বিচার করলেও তা কার্যকর হবে না – চাই তা (ঘটনাক্রমে) সঠিক বিচারই হোক বা ভুল।। [শারহু মুসলীম, ইমাম নববী- ১২/১৪ ]
 
শুরায়হ রহ. রা. থেকে সহিহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন- أَنَّ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ كَتَبَ إلَيْهِ : إذَا جَاءَكَ شَيْءٌ فِي كِتَابِ اللَّهِ فَاقْضِ بِهِ , وَلَا يَلْفِتَنَّكَ عَنْهُ الرِّجَالُ , فَإِنْ جَاءَكَ أَمْرٌ لَيْسَ فِي كِتَابِ اللَّهِ ، فَانْظُرْ سُنَّةَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَاقْضِ بِهَا , فَإِنْ جَاءَكَ مَا لَيْسَ فِي كِتَابِ اللَّهِ وَلَيْسَ فِيهِ سُنَّةٌ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، فَانْظُرْ مَا اجْتَمَعَ النَّاسُ عَلَيْهِ فَخُذْ بِهِ , فَإِنْ جَاءَكَ مَا لَيْسَ فِي كِتَابِ اللَّهِ وَلَمْ يَكُنْ فِيهِ سُنَّةٌ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَلَمْ يَتَكَلَّمْ فِيهِ أَحَدٌ قَبْلَكَ ، فَاخْتَرْ أَيَّ الْأَمْرَيْنِ شِئْتَ : إنْ شِئْتَ أَنْ تَجْتَهِدَ بِرَأْيِكَ وَتَقَدَّمَ فَتَقَدَّمْ , وَإِنْ شِئْتَ أَنْ تَتَأَخَّرَ فَتَأَخَّرْ , وَلَا أَرَى التَّأَخُّرَ إلَّا خَيْرًا لَكَ . اخرجه ابن أبي شيبة في المصنف, كِتَابُ الْبُيُوعِ وَالْأَقْضِيَةِ :١١/٢٠٢ رقم ٢٣٤٤٤ إسناده صحيح ; و الدارمي في سننه: رقم ١٦٩ إسناده جيد ; و ابن حزم في الاحكام: ٦/٧٦٩ ; و البيهقي في سنن الكبرى , باب موضع المشاورة قال الشافعي رحمه الله إذا نزل بالحاكم الأمر يحتمل : ١٠/١٩٦ رقم ٢٠٣٤٢ – ‘ওমর রা. তার কাছে (এই বলে) চিঠি লিখে পাঠালেন: ‘ যখন তুমি কোনো কিছুর সম্মুখীন হও যা(র সমাধান) আল্লাহ’র কিতাবে রয়েছে,  , তখন তা দিয়ে ফয়সালা করবে, এবং তুমি তা থেকে লোকজনের আকর্ষন সরাবে না। আবার তোমার কাছে যদি এমন কোনো বিষয় আসে যা(র সমাধান) আল্লাহ’র কিতাবে (পরিষ্কার করে বলা) নেই, তখন তুমি রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর সুন্নাহ’র প্রতি লক্ষ্য করবে, তারপর (তার সমাধান সেখানে পেলে) তুমি সেই অনুযায়ী ফয়সালা করবে। তবে তোমার কাছে যদি এমন কোনো বিষয় আসে যা(র সমাধান পরিষ্কার করে) আল্লাহ’র কিতাবেও (বলা) নেই এবং সে ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কোনো সুন্নাহ’ও (বিদ্যমান) নেই, তখন লোকেজন (তথা সাহাবাগণ)-এর প্রতি লক্ষ্য করবে যে তাঁরা কিসের উপরে ঐক্যমত রয়েছেন, (তা বুঝতে পারলে সংশ্লিষ্ট মাসআলাহ’র সমাধানকল্পে) তুমি সেটা গ্রহন করে নিবে। আর তোমার কাছে যদি এমন কোনো বিষয় আসে যা(র সমাধান) আল্লাহ’র কিতাবেও (পরিষ্কার বলা) নেই, এবং সে ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কোনো সুন্নাহ’ও (বিদ্যমান) নেই, আবার তোমার পূর্বে (সাহাবাদের) কেউ সেব্যাপারে কিছু বলেও যান নি, তখন তুমি দুটি বিষয়ের যেটি ইচ্ছে গ্রহন করতে পারো: তুমি (সংশ্লিষ্ট মাসআলাহ’র ব্যাপারে নিজেই) ইজতিহাদ করে তোমার মত দিয়ে (সাহাবাদের অবস্থান থেকে) অগ্রসর হতে চাইলে অগ্রসর হতে পারো, আর (নিজে কোনো ইজতিহাদ না করে) পিছুপা থাকতে চাইলে পিছুপা থাকতে পারো। আর তোমার জন্য শুধু পিছনে রয়ে যাওয়াতেই আমি অধিক কল্যান দেখতে পাচ্ছি’[অাল-মুসান্নাফ, ইমাম ইবনু আবি শায়বাহ- ১১/২০২ হাদিস ২৩৪৪৪; সুনানে দারেমী, হাদিস ১৬৯; সুনানুল কুবরা, ইমাম বাইহাকী- ১০/১৯৬ হাদিস ২০৩৪২; আল-ইহকাম, ইমাম ইবনে হাযাম- ৬/৭৬৯]
 
একটি সহীহ হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সা. এরশাদ করেন-  وأعلَمُهَا بالحلال وَالْحرَام معَاذ بن جبل ….. وأعلَمُهَا بالفرائض زيد – قال الألباني في السلسلة الصحيحة إنه صحيح – আর হালাল ও হারাম সম্পর্কে মুয়ায বিন যাবালের ইলম সবচাইতে বেশি……. এবং ‘ফারায়েয’ (পারিবারিক উত্তরাধিকার আইন) সম্পর্কে  যায়েদ বিন ছাবেতের ইলম সবচাইতে বেশি। [সুনানে তিরমিযী, হাদিস ৩৭৯০, ৩৭৯১; সুনানে ইবসে মাজা, হাদিস ১৫৪, ১৫৫; মুসতাদরাকে হাকিম-৩/৪২২; মুসনাদে আহমাদ-৩/১৮৪] হযরত মুয়ায বিন যাবাল রা-এর হালাল-হারাম বিষয়ে এবং হযরত যায়েদ বিন সাবেত রা.-এর ফারায়েয বিষয়ে অধিক ইলম থাকার অর্থ এছাড়া আর কি হতে পারে যে, তাঁরা এসকল বিষয়ে ইসতিহাদ/কিয়াস করে উদ্ভুত মাসআলাহ’র সমাধান নির্ণয়ে অধিক যোগ্যতা লাভ করেছিলেন। অন্যথায়, কুরআন ও সুন্নাহ’য় যে সকল বিধান সুস্পষ্টরূপে বর্ণিত রয়েছে, সেগুলো-তো তাঁরা ছাড়াও অপরাপর সাহাবীগণও জানতেন। 
 
রাসুলুল্লাহ সা. হযরত মুয়ায বিন যাবাল রা-কে ইয়ামেনের প্রশাসক বানিয়ে প্রেরণ করেছিলেন। হযরত মুয়ায বিন যাবাল রা. সেখানে প্রশাসকও ছিলেন, আবার কাযী (হাকেম/বিচারক)ও ছিলেন। এক রেওয়াতে এসেছে, হযরত মুয়ায বিন যাবাল রা.-এর কাছে একবার এমন একটি মুকাদ্দামা এলো, যেখানে পিতা কাফের অবস্থায় মাড়া গেছে কিন্তু তার জীবিত পুত্র হল মুসলমান, এমতাবস্থায় সে তার কাফের পিতার রেখে যাওয়া সম্পত্তির ওয়ারিছ (উত্তরাধিকারী) হবে কিনা? হযরত মুয়ায বিন যাবাল রা. বললেন, আমি রাসুলুল্লাহ সা.-কে এরশাদ করতে শুনেছি, তিনি বলেছেন– الاسلام يزيد و لا ينقص – ইসলাম বৃদ্ধি করে, হ্রাস করে না। [সুনানুল কুবরা, বাইহাকী-৬/৪১৬, হাদিস ১২৪৬৪; সুনানে আবু দাউদ-২/১৪০, হাদিস ২৯১২; মুসনাদে আহমাদ-৫/২৩০, হাদিস ২২০৫৮; ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার-১২/৪১]
 
এই রেওয়ায়েতটির ব্যাপারে কালাম রয়েছে, তবে এ থেকে বোঝা যায়, হযরত মুয়ায বিন যাবাল রা.-এর কাছে যে মুকাদ্দামাটি এসেছিল, সে সম্পর্কে কুরআন ও সুন্নাহ’র সরাসরি কোনো বিধান তাঁর ইলম-এ তখন ছিল না, ফলে তিনি রাসুলুল্লাহ সা.-এর অপর একটি হাদিসের সাথে কিয়াস করে ইসতিহাদী রায় দিয়েছিলেন, রাসুলুল্লাহ সা.-এর রায় জানা থাকলে তিনি এই মুকাদ্দমায় কিয়াস বা ইসতিহাদ করে নিজের রায় দিতেন না। রাসুলুল্লাহ সা. থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত আছে, তিনি এরশাদ করেন-  لا يرث المسلمُ الكافرَ، ولا الكافرُ المسلمَ – কোনো মুসলীম কোনো কাফেরের ওয়ারিস হয় না এবং কোনো কাফের কোনো মুসলীমের ওয়ারিস হয় না [সহীহ হাদিস, হাদিস ৬৩৮৩; সহীহ মুসলীম, হাদিস ১৬১৪]
 
উবাইদুল্লাহ বিন আবি ইয়াজিদ রহ. থেকে সহিহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন-  كَانَ ابْنُ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، «إِذَا سُئِلَ عَنِ الْأَمْرِ فَكَانَ فِي الْقُرْآنِ، أَخْبَرَ بِهِ، وَإِنْ لَمْ يَكُنْ فِي الْقُرْآنِ وَكَانَ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، أَخْبَرَ بِهِ، فَإِنْ لَمْ يَكُنْ، فَعَنْ أَبِي بَكْرٍ وَعُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا – فَإِنْ لَمْ يَكُنْ، قَالَ فِيهِ بِرَأْيِهِ . اخرجه الدارمي في سننه: رقم ١٦٨ إسناده صحيح – ‘(আব্দুল্লাহ) ইবনে আব্বাস রা. এমন ছিলেন যে, যখন তাকে কোনো ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হত, তখন (সেই বিষয়ের সমাধান) কুরআনে থাকলে তিনি তা জানিয়ে দিতেন। আর (তার সমাধান) যদি কুরআনে (পরিষ্কার করে বলা) না থাকতো, বরং (সমাধানটি যদি তিনি) রাসুলুল্লাহ ﷺ থেকে (শুনে থাকতেন বা কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্রে পেয়ে যেতেন, তাহলে) তিনি তা জানিয়ে দিতেন। আবার যদি (সুন্নাহ’তেও  পরিষ্কার কোনো ইশারা ইংগীত বিদ্যমান) না পেতেন, তখন (তিনি সেটির সমাধান নিতেন) আবু বকর রা. এবং ওমর রা. (-এর ফাতওয়া) থেকে। যদি (তাঁদের দুজনের ফাতওয়ার মধ্যেও সমাধান) না পেতেন, তখন তিনি সেব্যাপারে (কুরআন-সুন্নাহ’র আলোকে ইততিহাদ করে) নিজের মত দিতেন’। [সুনানে দারেমী, হাদিস ১৬৮]
 
 আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-
 
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنكُمْ ۖ فَإِن تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ۚ ذَٰلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا
‘হে মুমিনগণ! তোমরা অনুগত্য করো আল্লাহ’র এবং অনুগত্য করো রাসুলের, এবং তোমাদের (মুসলমানদের) মধ্যকার উলুল-আমর’-এর। এতে তোমরা যদি কোনো বিষয়ে বিবাদে লিপ্ত হয়ে পরো, তাহলে যদি আল্লাহ ও কেয়ামতের দিবসের প্রতি তোমাদের ইমান থেকে থাকে, তাহলে বিষয়টি আল্লাহ ও (তাঁর) রাসুলের (ফয়সালার) কাছে ছেড়ে দাও। এই (নির্দেশনাটি তোমাদের জন্য) কল্যানকর এবং (এটাই এবিষয়ক) সর্বোত্তম ব্যাখ্যা’।[সূরা নিসা ৫৯] 
 
কিয়াস সম্পর্কে উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রমাণিত হয়-
 
(১) কুরআন-সুন্নাহ’র বিধিবিধান ও উসূল সম্পর্কে পারদর্শী মুহাক্কেক আলেমগণের ইসতেহাদ ও কিয়াসই শুধু বৈধ এবং শরীয়তে ধর্তব্য। 
 
(২) কুরআন-সুন্নাহ’র বিধিবিধান ও উসূলকে সামনে রেখে যে কোনো বিষয়ে কিয়াস/ইসতিহাদ করার সময় উপযুক্ত ওলামায়ে কেরামের মধ্যে একাধিক মত প্রকাশ পেতে পারে এবং শরীয়তে তা অনুমোদিত (চাই সেটা আম পাবলিকের কাছে যত খারাপই লাগুক না কেনো)।
 
(৩) মুহাক্কেক আলেমের কিয়াস/ইসতিহাদকৃত মতটি শরীয়তের সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যতাপূর্ণ ও সঠিক হহতে পারে।
 
(৪)  মুহাক্কেক আলেমের কিয়াস/ইসতিহাদকৃত মতটি শরীয়তের অতীব নিকটতর মাত্রার সামঞ্জস্যতাপূর্ণ মত হতে পারে।
 
(৫)  মুহাক্কেক আলেমের কিয়াস/ইসতিহাদকৃত মতটি শরীয়তের সাথে সামঞ্জস্যতাপূর্ণ ও সঠিক নাও হতে পারে।
 
(৬)  কিয়াস/ইসতিহাদ করার অযোগ্য ব্যাক্তির ফাতওয়া (শরয়ী জাবাব) দান কিংবা হাকেম/কাজি (বিচারক) হিসেবে ফয়সালা দান নাজায়েয ও গোনাহ’র কাজ। কারণ সে শরীয়ত সম্পর্কে ইলম রাখে না। আর শরীয়তের ইলম ছাড়া কিয়াস/ইসতিহাদ হতেই পারেনা।  وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَ الَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ –  এবং যারা (এই শরীয়ত সম্পর্কে) জানে না তুমি তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না’।[সূরা জাসিয়া ১৮] সুতরাং, এরকম অযোগ্য ব্যাক্তির জন্য কোনো মুসতাহিদ আলেমের শরয়ী ফাতওয়া বা ফয়সালা’র উপর অভিযোগ উত্থাপন করা বা ভুল ধরার কোনোই হক্ব নেই।
 
সুযোগ্য আহলে হক্ব ওলামায়ে কেরামের কিয়াস-কে যে শরীয়তের মানদন্ডের মধ্যে শামিল করা হয়েছে, তা উপরের আলোচনা থেকে পুরষ্কার প্রমাণিত হয়। বস্তুতঃ কিয়াস -শরীয়তের দলিল হওয়ার ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরাম সহ পূর্বাপর সকল আহলে হক্ব মুফাসসিরীন, মুহাদ্দিসীন, মুসতাহিদীন ও ফুকাহা ওলামায়ে কেরামের ইজমা রয়েছে। এটাই উম্মাহ’র মুমিনগণের পথ।
 

কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াসইসতেহাদ -এই চারের সামষ্টিক রূপ হল ইসলামী শরীয়ত। যারা এর বাইরে রয়েছে, তারা ইসলামী শরীয়তের বাইরে রয়েছে এবং শরীয়তের ব্যাপারে তাদেরকে কথা মানা নাজায়েয।

ثُمَّ جَعَلْنَاكَ عَلَىٰ شَرِيعَةٍ مِنَ الْأَمْرِ فَاتَّبِعْهَا وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَ الَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ

‘অতঃপর (হে নবী মুহাম্মাদ!) আমি তোমাকে (আমার) নির্দেশিত একটি শরীয়তের উপর স্থাপন করেছি। অতএব তুমি তার অনুসরণ করে চলো এবং যারা (এই শরীয়ত সম্পর্কে) জানে না তুমি তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না’। [সূরা জাসিয়া ১৮]