ইসলামী শরিয়তে মাদক ও মদ ও হারাম
শায়েখ ড: ইউসূফ আল-কারযাভী
بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیۡمِ
الحمد لله و الصلاة و السلام على رسوله محمد و على أله و أمّته
اَللّٰهُمَّ صَلِّ عَليٰ مُحَمَّدٍ النبي الأمي عَدَدَ خَلْقِك وَ رِضَا نَفْسِك وَزِنَةَ عَرْشِك وَ مِدَادَ كَلِمَاتِك، صَلِّ عَليه صَلاَةً كَامِلَةً دَائِمَةً كَمَا يَنْبَغِي أَنْ يُصَلَّى عَلَيهِ وَ سَلِّمْ تَسلِيمَاً بِقَدرِ عَظَمَةِ ذَاتِكَ فِى كُلِّ وَقتٍ وَ حِين، صلاة تكون لك رضاء و له جزاء، صلاة لا غاية لها ولا منتهى ولا انقضاء باقية ببقائك الى يوم الدين ، و اعطه الوسيلة و الفضيلة و المقام المحمود الذي وعدته، و اجزه عنا ما هو اهله، و على اله وأصحابه و أزواجه و ذريته و أهل بيته و سلم تسليما مثل ذلك، اَللّٰهُمَّ اجمعني معه في الفردوس و جنة المأوى، اَللّٰهُمَّ صَلِّ عَليٰ مُحَمَّدٍ صَلوٰةً تُنَجِّيْنَا بِهَا مِنْ جَمِيْعِ الْأَهْوَالِ وَاْلآفَاتِ وَتَقْضِيْ لَنَا بِهَا مِنْ جَمِيْعِ الْحَاجَاتِ وَتُطَهِّرُنَا بِهَا مِنْ جَمِيْعِ السَّيِّاٰتِ وَتَرْفَعُنَا بِهَا عِنْدَكَ اَعْليٰ الدَّرَجَاتِ وَتُبَلِّغُنَا بِهَا اَقْصىٰ الْغَايَاتِ مِنْ جَمِيْعِ الْخَيْرَاتِ فِي الْحَيَاتِ وَبَعْدَ الْمَمَاتِ- اِنَّكَ عَليٰ كُلِّ شَيْئٍ قَدِيْرٍ بِرَحْمَتِكَ يَا اَرْحَمَ الرَّاحِمِيْنَ
[এই লিখাটি বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন ড. ইউসুফ আল-কারজাভী দা.বা. লিখিত “الحلال والحرام في الإسلام ” (আল-হালাল ওয়াল হারাম ফিল ইসলাম) বইয়ের মদ ও মাদক বিষয়ক অংশের অনুবাদ। উল্লেখ্য, এই প্রবন্ধে উল্লেখীত আয়াত ও হাদিস সমূহের অনুবাদ, এমনকি লেখকের আরবী পাঠের অনুবাদকে কোনো বিজ্ঞ মুহাক্কেক আলেমের পরামর্শ ব্যাতীত কারো কাছে বর্ণনা করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিচ্ছি, যাতে আমার অযোগ্যতার কারণে এখানে কোনো উল্লেখযোগ্য ভুল হয়ে থাকলে তা সংশোধন করে নেয়ার আগেই মানব সমাজে ছড়িয়ে না যায়। এগুলো পড়ুন ইলম অর্জনের জন্য এবং যোগ্য আলেম থেকে তা বুঝিয়ে নিন। আর কোনো যোগ্য চোখে উল্লেখযোগ্য ভুল ধরা পড়লে তা আমাকে অবগত করুন।]
মদ (الخمر /খামরুন) হল এমন এক অ্যালকোহলীক পদার্থ, যা (মন মস্তিষ্কে) নেশা ও মাদকতা উৎপন্ন করে।
আমাদের একথা খুলে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মাদক এমন একটি পদার্থ, যা একটি মানুষের বিবেক-বুদ্ধি ও দৈহিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি সাধন করে, ক্ষতি সাধন করে তার দ্বীন ও দুনিয়ার। একই ভাবে একথা বলারও অপেক্ষা রাখে না যে, মাদক পরিবার-পরিজন ও জ্ঞাতী-বংশকে এমন বিপদ-বিপর্যয়ের মাঝে ফেলে দেয়, যা থেকে উৎরে ওঠা, যা থেকে স্ত্রী- সন্তানদের জন্য মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানো সুকঠিন হয়ে পরে। মাদক সমাজ ও জাতি’র রুহানী, বৈষয়িক এবং চারিত্রিক অস্তিত্বের প্রশ্নে হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
এ পর্যায়ে এক গবেষক যা বলেছেন, তা সত্যই বৈকি। তিনি বলেছেন, মাদক মানব জাতিকে যতটা কঠিন আঘাত হেনেছে, ততটা কঠিন আঘাত আর অন্য কোনো কিছু হানতে পারে নি। যদি এ ব্যাপারে ব্যাপক পরিসংখ্যান চালানো যায় যে, বিশ্বের চিকিৎসালয় গুলোতে যে সমস্ত রোগাক্রান্ত মানুষ থাকে, তাদের মধ্যে কতজন মাদকের কারণে মস্তিষ্ক বিকৃত ও দূরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে যায়; কতজন মাদকের কারণে আত্বহত্যা করে, অন্যকে খুন করে; বিশ্বের কত জনের উপর এই মাদকের কারণে স্নায়ুবিক, পাকস্থলীক এবং নাড়িতন্ত্রিক রোগের অভিযোগ ওঠে; এই মাদকের কারণে কত জন মানুষ তার নিজের ধ্বন-সম্পদ উজার করে দিয়ে নিঃস্ব ও সর্বস্ব হয়ে যায়; কত জন মানুষ এই মাদকের কারণে তার মালিকানাকে বিক্রি করে দেয় কিংবা প্রতারণার জালে পড়ে তা হারিয়ে বসে; যদি এসব বিষয়ে কিংবা এর মাত্র কয়েকটি বিষয় নিয়ে পরিসংখ্যান চালানোা যায়, তাহলে এদের পরিমাণ এত ভয়ঙ্কর মাত্রায় গিয়ে ঠেঁকবে যে, আমরা দেখতে পাবো , এর সামনে যাবতীয় নসিহত যাবতীয় পরামর্শ বলতে গেলে বৃথা।
আরবরা জাহেলীয়াতের যুগে ছিল মদ পানের প্রতি গভীরভাবে আসক্ত । মদের সাথে ছিল তাদের গভীর বন্ধুত্ব ও অনুরক্ততা। তারা তাদের এ আসক্তি ও অনুরক্ততার কথা তাদের সাহিত্যের ভিতরেও প্রকাশ ঘটাতো। এমনকি মদের শ’খানেক নামও দিয়েছিলো তারা। এর বিভিন্ন গুণাগুণ তাদের কবিতাগুলোতে উচ্চারিত হত। বিভিন্ন আসরে আসরে বর্ণিত হত এর রকমারি চমক ও চানোক্য ।
যখন ইসলাম আবির্ভূত হল, সে তখন তাদেরকে একটি প্রজ্ঞাপূর্ন রাজপথে পরিচালিত করলো। ইসলাম তাদের ওপর মদকে হারাম করে দিল একটি ধারাবাহিকতা মেনে, একটি ক্রমধারা মেনে। তাদেরকে প্রথম ধাপে মদে-মত্তো অবস্থায় নামায পড়া থেকে নিষেধ করা হল। এরপর তাদেরকে বলে দেয়া হল যে, মদের মধ্যে যেসব উপকারিতা রয়েছে যেসব ফায়দা রয়েছে, তার তুলনায় এর গোনাহ ও অপরাধের দিকটিই অধিক মারাত্বক। এরপর আল্লাহ তাআলা সূরা মায়েদা’র নিম্নোক্ত ব্যপক তাৎপর্যবহ ও অকাট্য আয়াতে কারিমাটি নাজিল করলেন –
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِّنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ – إِنَّمَا يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَن يُوقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ فِي الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَن ذِكْرِ اللَّهِ وَعَنِ الصَّلَاةِ ۖ فَهَلْ أَنتُم مُّنتَهُونَ
“হে ইমানদারগণ! নিশ্চই খামরুন (মদ ও মাদক), মাইসীরুন (জুয়া), আনসাব্ (বলীদানের স্থান) এবং আযলাম (ভাগ্য গণনার শর)-শয়তানের অ-পবিত্রসব কাজ। বিধায় তোমরা তা পরিহার করে চলো। আশা করা যায়, তোমরা সফলতা লাভ করতে পারবে। নিশ্চই শয়তান চায় যে , মদ ও জুয়ার আবর্তে ফেলে সে তোমাদের পরষ্পরের মাঝে দুশমনি ও জিঘাংসা সৃষ্টি করে দিবে এবং তোমাদেরকে আল্লাহ’র স্মরণ ও নামায থেকে ফিরিয়ে রাখবে। সুতরাং, (এখন এসব থেকে) তোমরা বিরত হবে কি? [সূরা মায়েদাহ- ৯০, ৯১]
আল্লাহ তাআলা এ আয়াত দুটিতে মদ ও জুয়াকে একেবারে চুড়ান্ত ও কঠোর ভাষায় হারাম করে দিয়েছেন এবং এদেরকে الأنصاب (বলিদানের স্থান) এবং الأزلام (ভাগ্য গণনার শর) – এর সাথে একই সঙ্গে উল্লেখ করে এ কাজ দুটিকে رِجْسٌ (অপবিত্র/পঙ্কীলতাপূর্ণ) হিসেবে গণ্য করে নিয়েছেন। আর رِجْسٌ (রিযসুন) কথাটি যখন কুরআনে ব্যবহৃত, তখন সেটা শুধুমাত্র ফাহেশা, জঘন্য, বিভৎস ও পঙ্কীল জাতীয় কিছু বোঝাতেই মূলতঃ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তদুপরি এ কাজ দুটিকে আবার مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَان (শয়তানের কাজ) বলে অভিহিত করেছেন; আর শয়তানের কাজই হল ফাহেশা ও বদ্ কাজ করা। এখানে মদ্যপান ও জুয়াকে পরিহার করে চলার আহবান জানান হয়েছে; সাথে এই পরিহারকরণকে বানিয়ে দেওয়া হয়েছে সাফল্যের পানে ধাবিত হওয়ার পথ। আরও বলা হয়েছে, এ দু’কাজের বিভিন্ন সামাজিক ক্ষতির কথা। বলা হয়েছে, এসব কাজ নামাজ থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখে, সৃষ্টি করে একে-অপরের মাঝে দুশমনি ও জিঘাংসা। মাদক এবং জুয়ার আরও অন্যতম ক্ষতি এই যে, তা নামায এবং আল্লাহর স্বরণের ন্যায় দ্বীনের বিভিন্ন অপবিহার্য বিষয় -যা আত্মার রুহানী খোরাক- তা থেকে মানুষকে সরিয়ে রাখে। পরিশেষে মাদক ও জুয়া থেকে সম্পূর্ণ রূপে দূরে থাকার আহবান জানিয়ে সর্বশেষ বাক্যে বলা হয়েছে فَهَلْ أَنتُم مُّنتَهُونَ – ‘তাহলে (এখন এসব থেকে) তোমরা বিরত হবে কি’? এর জবাবে তখন একটি চুড়ান্ত কথাই উচ্চারীত হয়েছিল মুমিনদের পক্ষ থেকে। আর সেটি ছিল-
قد انتهينا يا رب – ‘হে আমাদের রব! আমরা পরিহার করলাম’।
قد انتهينا يا رب – ‘হে আমাদের রব! আমরা পরিহার করলাম’।
এ আয়াতখানি নাজিল হবার পর মু’মিন সমাজ এক বিষ্কয়কর দৃশ্যের অবতারনা করেছিলেন। তখন যার হাতে মদের পানপাত্র ছিল, এমনকি তা থেকে কিছুটা তিনি পানও করেছিলেন, কিছুটা অবশিষ্টও ছিল, এমতাবস্থায় তাঁর কাছে যখন এ আয়াতের কথা গিয়ে পৌঁছলো , তখন তিনি মদের সেই পানপাত্রটিকে তাঁর মুখ থেকে সরিয়ে নিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়েছিলেন।
বস্তুত: বহু রাষ্ট্র বহু সরকার আজ মাদকের ব্যক্তিক, পারিবারিক এবং জাতিগত নানান ক্ষয়-ক্ষতি ও অবক্ষয়ের কথা স্বীকার করে নিয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ -যেমন: আমেরিকা- রাষ্ট্রীয় আইন বলে মাদকদ্রব্য নিষিদ্ধ করে দেয়ার চেষ্টা চালিয়েছে, কিন্তু তাতে তারা ব্যর্থতারই মুখ দেখেছে। অপর দিকে শুধুমাত্র ইসলামই তার এ যুদ্ধে জয় লাভ করে মাদকের দফারফা করে দিয়েছিল। খৃষ্টান ধর্মে মাদকের অবস্থান সম্পর্কে গীর্জার কর্ণধারদের মাঝে মতদ্বন্দ্ব দেখা যায়। তারা ইঞ্জিলের বক্তব্যকে প্রামাণিক ভিত্তি বানিয়ে একথা বলছে যে- ‘সামান্য পরিমান মদ পাকস্থলীকে আরোগ্য দান করে’। তাদের এ কথাটিকে যদি সত্য বলে ধরেও নেয়া হয়, আর বাস্তবেও যদি সামান্য খানিক মদ পাকস্থলীর আরোগ্য সাধন করে থাকেও, তবুও ওই সামান্য পরিমাণ মাদক থেকেও তাদের নিবৃত থাকা অপরিহার্য কর্তব্য । কারণ সামান্য পরিমান মদ ও মাদক অধিক মত্তোতার দিকে চালিত করবে, গ্লাসের প্রথম চুমুক এক এক করে শেষ পর্যন্ত অভ্যস্থতার পর্যায়ে নিয়ে যাবে। এর বিপরীতে মাদক সম্পর্কে ইসলামের অবস্থান সুস্পষ্ট সুদৃঢ়। মাদক সেবন পর্যায়ে যত ধরনের সাহায্য সহযোগীতা হতে পারে, ইসলামে তার সবগুলিই নিষিদ্ধ।
প্রত্যেক নেশাকর জিনিসই خمر (খামরুন/মাদক/মদ)
নবী করিম ﷺ যখন সর্বপ্রথম মদ নিষিদ্ধ হওয়ার ঘোষনা দেন, তখন তিনি এদিকে মোটেও ভ্রুক্ষেপ করেননি যে , কোন্ কোন্ জিনিস থেকে মদ তৈরী করা হয়, বরং তার মূল দৃষ্টি ছিল -মদ (মানুষের মধ্যে) যে আছোর ও প্রতিক্রিয়া ঘটায় -সে দিকে; আর সেটা হল মাতালতা , নেশা ও মাদকতা। কাজেই যে জিনিসের মধ্যেই এই মাদকতা, নেশা ও মাতালতার শক্তি বিদ্যমান থাকবে, সেটিই خمر (খামরুন/মাদক/মদ) হিসেবে বিবেচিত হবে -চাই মানুষ সেটার যে নাম বা উপনামই দিক না কেনো -চাই তা যে জিনিস থেকেই প্রস্তুত করা হোক না কেনো। সুতরাং, ‘বিয়ার’ এবং এজাতীয় মাদকগুলোও হারাম।
নবী করিম ﷺ-এর কাছে ‘মধু’ থেকে প্রস্তুতকৃত, কিংবা ‘ভুট্ট’’ ও ‘যব’ ভিজিয়ে পরে তা ঘন করে যে মদ প্রস্তুত করা হয় -সে সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে, নবী করিম ﷺ যেমন ব্যপক অর্থবোধক বক্তব্য সহকারে প্রেরিত হয়েছিলেন, তেমনি এক্ষেত্রেও তিনি একটি ব্যপক অর্থবোধক জবাবই দান করেছিলেন, (বলেছিলেন)- كُلُّ مُسْكِرٍ خَمْرٌ , وَكُلُّ خَمْرٍ حَرَامٌ . رواه مسلم في الصحيح , كتاب الأشربة: باب بيان أن كل مسكر خمر: ٣/١٥٨٨ رقم ٢٠٠٣; و أبو داود في سننه : كتاب الأشربة , باب النهي عن المسكر: ٤/٨٥ رقم ٣٦٧٩ ; و النسائي في سننه ، كتاب الأشربة , باب تحريم كل شراب أسكر : ٨/٢٩٦ ; و الترمذي في سننه , كتاب الأشربة: باب ما جاء في شارب الخمر : ٤/٢٩٠ رقم ١٨٦١ ; و أحمد في مسنده : ٢/١٣٧ ; و غيرهم – “প্রত্যেক নেশাকর জিনিসই খামরুন (মাদক/মদ)। আর প্রত্যেক খমরুন’ই হারাম”। [সহিহ মুসলীম- ৩/১৫৮৮ হাদিস ২০০৩; মুসনাদে আহমদ- ২/১৩০; সুনানে আবু দাউদ- ৪/৮৫ হাদিস ৩৬৭৯; সুনানে নাসায়ী- ৮/২৯৭; সুনানে তিরমিযী -৪/২৯০ হাদিস ১৮৬১; সুনানে ইবনে মাজাহ- ২/১১২৩ হাদিস ৩৩৮৭; মুসনাদে আবু দাউদ তায়ালিসী, হাদিস ১৯১৬; শারহু মাআনিল আছার, ত্বাহাবী- ৪/২১৫; সুনানে দ্বারাকুতনী- ৪/২৪৮ হাদিস ১৬; আল-মুসান্নাফ, আব্দুর রাজ্জাক- ৯/২২১ হাদিস ১৭০০৪; আল-মু’জামুস সাগীর, তাবরাণী- ১/৫৪; মুসনাদে আবু ই’য়ালা– ১০/১৮৯ হাদিস ৫৮১৬]
রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর মিম্বরের উপর দাঁড়িয়ে হযরত ওমর ফারূক রা. লোকজনের সামনে এই ঘোষনা দিয়েছিলেন- الخَمرُ ما خامر العَقلَ – “খামরুন (মদ/মাদক) হল তা, যা মস্তিষ্কে মাদকতা আনয়ন করে”। [সহিহ বুখারী, হাদিস ৪৩৪৩; সহিহ মুসলীম, হাদিস ৩০৩২]
বস্তুতঃ এক্ষেত্রেও ইসলাম তার চুড়ান্ত পরিচয় দিয়েছে আরও একবার। মাদকের মধ্যে গণ্য হয় -এমন পানীয়ের পরিমাণ কম হোক কি বেশি -ইসলাম সেদিকে দেখতে যায় নি। বাস্, সে এমন ব্যবস্থা নিয়েছে, যাতে এই পিচ্ছিল পথে মানুষের কদম্ আছাড় খেয়ে খেয়ে এমন গভীরে চলে যেতে না পারে, যা থেকে আর ফেরত আসা সম্ভব নয়। এজন্য রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন- مَا أَسْكَرَ كَثِيرُهُ , فَقَلِيلُهُ حَرَامٌ – “যে জিনিসের অধিক পরিমান মাতালতা/নেশা/মাদকতা সৃষ্টি করে, তার সামান্য পরিমানও হারাম”। [সুনানে আবু দাউদ- ৪/৮৭ হাদিস ৩৬৮১; সুনানে ইবনে মাজাহ- ২/১১২৫ হাদিস ৩৩৯৩; মুসনাদে আহমদ- ৩/৩৪৩; সুনানে তিরমিযী- ৪/২৯২ হাদিস ১৮৬৫; সুনানুল কুবরা, বাইহাকী- ৮/২৯৬ হাদিস ১৭৩৯০; শারহু মাআনিল আছার, ত্বাহাবী- ৪/২১৭]
(রাসুলুল্লাহ ﷺ আরো বলেছেন): ما أسكر الفرق منه فملء الكف منه حرام – “যে জিনিসের এক ফরক্ব পরিমান মাতালতা/নেশা/মাদকতা সৃষ্টি করে, তার অঞ্জলী ভরা পরিমানও হারাম”। [মুসনাদে আহমদ- ২/৭১, ১৩১; সুনানে আবু দাউদ- ৩/৩২৯ হাদিস ৩৬৮৭; সুনানে তিরমিযী- ৪/২৫৯ হাদিস ১৮৬৬; সহিহ ইবনে হিব্বান– ৭/৩৭৯ হাদিস ৫৩৫৯]
فرق (ফারাক্ব) বলতে বোঝায় এমন পাত্রকে, যার মধ্যে ষাট রতল পরিমান জায়গা সংকুলান হয়।
মদ/মাদক ব্যবসা
মদ/মাদক -চাই কম হোক বা বেশি- নবী করিম ﷺ সেটাকে শুধু হারাম করে দিয়েই ক্ষ্যান্ত হন নি, বরং মাদক ব্যবসাকেও তিনি হারাম করে দিয়েছেন -চাই সেই ব্যবসাটি অমুসলীমদের সাথেই করা হোক না কেনো। সুতরাং কোনো মুসলমানের জন্যই এ কাজ জায়েয নয় যে, সে মাদক আমদানী-রপ্তানীর কাজ করবে, অথবা মাদক বিক্রির দোকান দিয়ে বসবে, কিংবা কোনো মদের দোকানে চাকুরী করবে।
এ পর্যায়ে নবী করিম ﷺ মাদকের সাথে সংশ্লিষ্ট দশ শ্রেণির ব্যক্তির উপরে লা’নত দিয়েছেন। তারা হল- عَاصِرَهَا وَ مُعْتَصِرَهَا -(أي طالب عصرها)- وَ شَارِبَهَا وَ حَامِلَهَا وَ الْمَحْمُولَةُ إِلَيْهِ وَ سَاقِيَهَا وَ بَائِعَهَا وَ آكِلَ ثَمَنِهَا وَ الْمُشْتَرِي لَهَا وَ الْمُشْتَرَاةُ لَهُ – “যে (দ্রব্য নিংরিয়ে/প্রক্রিয়াজাত করে) তা উৎপাদন করে, যে তা উৎপাদন করিয়ে নেয়, (অর্থাৎ যে মাদক উৎপাদন করতে বলে), যে তা সেবন করে, যে তা বহন করে, যার কাছে তা বহন করে নিয়ে যাওয়া হয়, যে তা পরিবেশন করে, যে তা বিক্রি করে, যে তার মূল্য খায়, যে তা ক্রয় করে, এবং যার জন্য তা ক্রয় করা হয়”। [সুনানে তিরমিযী- ১/২৪৩ হাদিস ১২৯৫; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস ৩৩৮১]
সূরা মায়েদার পূর্বোল্লখীত আয়াতে কারিমাটি যখন নাজিল হয়, তখন নবী করিম ﷺ বললেন- إن الله حرم الخمر فمن أدركته هذه الآية ، وعنده منها شيء، فلا يشرب ولا يبع” قال راوي الحديث: فاستقبل الناس بما كان عندهم منها طرق المدينة فسفكوها – “আল্লাহ (তাআলা কুরআনে) খামরুন (মদ/মাদক) হারাম করে দিয়েছেন। সুতরাং, যে ব্যক্তিই এই আয়াতের কথা জানতে পারবে, তার কাছে এর কোনো কিছু থেকে থাকলে সে আর (তা) সেবনও করতে পারবে না, (সেটা) বিক্রিও করতে পারবে না”। রাবী (হাদীসের বর্ণনাকারী) বলেন: লোকজন এ নির্দেশকে (ততক্ষনাৎ সাদরে) গ্রহন করে নিলেন। মদীনার রাস্তায় রাস্তায় তাদের যার কাছে এর যা কিছু ছিল, তারা তা বহিয়ে দিলেন”। [সহিহ মুসলীম, হাদিস ১৫৭৮; সুনানুল কুবরা, বাইহাকী- ৬/১৯ হাদিস ১১০৪১]
হারামের বিভিন্ন পথ ও মাধ্যমগুলোকে বন্ধ করে দেওয়ার উদ্দেশ্য ইসলাম এই নীতি অবলম্বন করেছে যে, সে প্রত্যেক মুসলমানের জন্য -এমন কোনো ব্যক্তির কাছে আঙ্গুর বিক্রি করাকেও হারাম করে দিয়েছে, যার সম্পর্কে জানা আছে যে, সে তা দিয়ে মদ উৎপাদন করবে। এক হাদিসে আছে- من حبس العنب أيام القطاف، حتى يبيعه من يهودي -أي: ليهودي- أو نصراني أو ممن يتخذه خمرا -أي: ولو كان مسلما- فقد تقحم النار على بصيرة – “যে ব্যক্তি ফলন তোলার দিনগুলিতে আঙ্গুর সংগ্রহ করে, পরিশেষে তা কোনো ইহূদী কিংবা কোনো খৃষ্টান অথবা এমন কোনো ব্যাক্তির কাছে -চাই সে মুসলমানই হোক না কেন- বিক্রি করে দেয়, যে তা থেকে মদ/মাদক উৎপাদন করবে, তাহলে সে মূলত: জেনে বুঝেই আগুনে ঝাপ দিলো। [আল-মু’জামুল আউসাত, ত্বাবরানী- ১/১৩৯; শুয়াবুল ইমান, বাইহাকী- ৫/১৭ হাদিস ৫৬১৮; বুলুগুল মারাম , ইবনে হাজার: ৬২ পৃষ্ঠা]
কোনো মুসলীম মদ/মাদক উপহার দিতে পারে না
একজন মুসলীমের জন্য যেমন মদ/মাদক বিক্রি করে তার মূল্য ভক্ষন ও ভোগ করা হারাম , তেমনি তা কাউকে বিনামূল্যে উপহার দেয়া –চাই তা কোনো ইহুদী বা খৃষ্টান অথবা অন্য কোনো অমুসলীমকেই দেয়া হোক না কেনো-তাও হারাম। কাজই কোনো মুসলমানের জন্যেই এটা উচিৎ হতে পারে না যে, সে কাউকে মদ/মাদক উপহার দিবে কিংবা সেটা উপহার স্বরূপ গ্রহন করবে। মুসলমান-তো একজন পবিত্র মানুষ; ভাল ও পবিত্র জিনিস ছাড়া সে যেমন উপহার দিতে পারে না , তেমনি সে তা গ্রহনও পারে না।
এক বর্ণনায় এসেছে, এক ব্যক্তি নবী করিম ﷺ কে মদ উপহার স্বরূপ দেয়ার ইচ্ছে করেছিল । তখন নবী করিম ﷺ তাকে জানালেন যে, আল্লাহ তাআলা মদ হারাম করে দিয়েছেন। তখন সে জিজ্ঞেস করলো: أفلا أبيعها – ‘(তাহলে) আমি কি সেটা বিক্রি করে দিতে পারবো না’? নবী করিম ﷺ বললেন: إن الذي حرم شربها حرم بيعها – ‘যিনি তা সেবন করাকে হারাম করেছেন, তিনি সেটা বিক্রি করাকেও হারাম করে দিয়েছেন’। লোকটি আবার জিজ্ঞেস করলো: أفلا أكارم بها اليهود – ‘আমি কি এটা কোনো ইহূদীকেও উপহার দিতে পারবো না’? নবী করিম ﷺ বললেন: إن الذي حرمها حرم أن يكارم بها اليهود – ‘যিনি একে হারাম করেছেন, তিনি তা কোনো ইহূদীকে উপহার হিসেবে দেয়াকেও হারাম করে দিয়েছেন’। লোকটি আবার জিজ্ঞেস করলো: فكيف أصنع بها – ‘তাহলে আমি সেটা দিয়ে কি করবো’? নবী করিম ﷺ বললেন: شنها على البطحاء – ‘এটা কোন উপত্যকায় ঢেলে দাও’। [মুসনাদে হুমাইদী- ২/৪৪৭ হাদিস ১০৩৪]
মাদকের আসর বা মজলিস থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা
শুধু তাই নয়, মুসলমানকে মদের আসর, সভা বা মজলিস এবং যারা এসব আসরে মাদক সেবন করে -তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। হযরত ওমর রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: من كان يؤمن بالله واليوم الآخر فلا يقعد على مائدة تدار عليها الخمر – “যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং আখেরাতের উপর ঈমান রাখে, সে যেন -যে টেবিল/দস্তরখানায় মদ পরিবেশন করা হয়, সেখানে না বসে। [মুসনাদে আহমদ, হাদিস ১২৬; মুসনাদে আবু ই’য়ালা, হাদিস ২৫১; সুনানে বাইহাকী, হাদিস ১৪৯৪১; সুনানে তিরমিযী, হাদিস ২৮০১; আল-মু’জামুল আউসাত, ত্বাবরানী- ৩/৬৯; তারিখে বাগদাদ, খতীব- ১/২৬০]
মুসলমান মাত্রই এ ব্যপারে আদিষ্ট যে, সে কোনো অন্যয়-অপরাধ ও পাপ কাজ দেখতে পেলে তাতে পরিবর্তন আনার পদক্ষেপ নিবে। সুতরাং, যদি তার পক্ষে (অন্যদেরকে) তা পরিহার করানো সম্ভবপর না হয়, তাহলে তার অবশ্য কর্তব্য হল, সে নিজেই তা থেকে দূরে থাকবে, তদুপরি ভদ্রতা বজায় রেখে ওই স্থান এবং সেখানে যারা রয়েছে, তাদেরকে পরিত্যাগ করবে।
খলীফায়ে রাশেদ হয়রত ওমর বিন আব্দুল আযীয রহ. থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি মদ্যপকে চাবুক মাড়তেন; এমনকি ওই ব্যক্তিকেও মাড়তেন, যে মদ্যপদের আসর বা মজলিসে উপস্থিত থাকতো -এমনকি সে তাদের সাথে মদ পান না করলেও। এও বর্ণিত আছে যে, একবার তার সামনে এমন কিছু লোককে ধরে নিয়ে আসা হল, যারা মদ পান করেছিল। তিনি তাদেরকে চাবুক মাড়ার নির্দেশ দিলেন। তখন তাঁকে বলা হল : ‘ওদের সাথে ওমুক ব্যক্তিও আছে, যে রোযা রেখেছিল’। তখন তিনি বললেন : ‘ওকে দিয়েই শুরু করো। তোমরা কি শোনো নি, আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন- وَقَدْ نَزَّلَ عَلَيْكُمْ فِي الْكِتَابِ أَنْ إِذَا سَمِعْتُمْ آيَاتِ اللَّهِ يُكْفَرُ بِهَا وَيُسْتَهْزَأُ بِهَا فَلَا تَقْعُدُوا مَعَهُمْ حَتَّىٰ يَخُوضُوا فِي حَدِيثٍ غَيْرِهِ ۚ إِنَّكُمْ إِذًا مِّثْلُهُمْ – “আর আল-কিতাবে তোমাদের উপর এই বিধান নাজিল করা হয়েছে যে, তোমরা যখন শুনতে পারবে যে, আল্লাহর আয়াতসমূহের সাথে কুফরী করা হচ্ছে, ঠাট্টা-মশকরা করা হচ্ছে, তখন তোমরা আর তাদের সাথে বসে থাকবে না -যাবৎ না তারা তা বাদ দিয়ে অন্য কথাবার্তায় লিপ্ত হয়ে যায়। অন্যথায় তোমরাও তাদের অনুরূপ গণ্য হবে”। [সূরা নিসা ১৪০]
মাদক খোদ্ রোগ; এটা কোনো ঔষধ নয়
ইসলাম এ সমস্ত সুস্পষ্ট দলিল-প্রমাণের মাধ্যমে মাদক বিরোধী যুদ্ধে সর্বদিক দিয়ে তার জোড়ালো ভূমিকা পালন করেছে এবং মুসলমান মাত্রকেই এ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছে; চেয়েছে তার এবং মাদকের মাঝে দূর্ভেদ্য প্রাচীর দাড়ঁ করিয়ে দিতে, যাতে সামান্যতম ছিদ্রপথও উন্মুক্ত থাকতে না পারে, যাতে মাদকের সাথে কোনো রকম যোগাযোগ বা সম্পর্ক থাকতে না পারে। কোনো মুসলমানের জন্যে সামান্যতম মাদক সেবনকেও বৈধ রাখা হয়নি। এমনিভাবে তার জন্য এও জায়েয নয় যে, সে মাদক ক্রয়-বিক্রয় করা, তা উপহার স্বরূপ দেয়া কিংবা উৎপাদনের সাথে কোনো রকম যোগ-সম্পর্ক বজায় রাখবে। তার জন্য এও জায়েজ নয় যে, সে মাদক এনে তার দোকানে অথবা বাড়িতে রেখে দিবে। তার জন্য এও জায়েয নয় যে, সে আনন্দঘন কোনো পার্টিতে অথবা নিরান্দমূলক কোনো সমাবেশে মাদক এনে হাজির করবে। তার জন্য এও জায়েয নয় যে, সে কোনো অমুসলীমের মেহমাদারী করার উদ্দেশ্যে মদ এগিয়ে দিবে। এমনিভাবে খাদ্য হোক, পানীয় হোক -কোন কিছুতেই মদ/মাদক মেশানো জায়েয নয় তার জন্য।
এখানে একটি প্রশ্ন থেকে যায়, যা কেউ কেউ জিজ্ঞেসও করে থাকে । আর সেটি হল, মাদকদ্রব্যকে ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে কিনা? বস্তুতঃ এর জবাব তা-ই, যা খোদ্ রাসুলুল্লাহ ﷺ দিয়েছিলেন। এক ব্যাক্তি রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে মদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলো যে, তা রোগের প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার করা যাবে কি-না ? রাসুলুল্লাহ ﷺ তাকে তা করতে নিষেধ করলেন। তখন লোকটি বললো: إِنَّمَا أَصْنَعُهَا لِلدَّوَاءِ – ‘আমি তো সেটা রোগ নিরাময়ের জন্য বানিয়েছি’। রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন- إِنَّهُ لَيْسَ بِدَوَاءٍ ، وَلَكِنَّهُ دَاءٌ – ‘ওটা কোনো ঔষধ নয়। বরং ওটাই একটা অসুখ’। [সহিহ মুসলীম- ৩/১৫৭৩ হাদিস ১৯৮৪; মুসনাদে আহমদ- ৪/৩৩১; সুনানে তিরমিযী, হাদিস ২০৪৬; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৩৮৭৩; সুনানে দারেমী- ২/১৫৩ হাদিস ২০৯৫]
রাসুলুল্লাহ ﷺ আরও বলেছেন: إن الله أنزل الداء والدواء، وجعل لكل داء دواء، فتداووا، ولا تتداووا بحرام – “নিশ্চই আল্লাহ রোগ-ব্যাধী ও ঔষধ (দুটোই) অবতীর্ণ করেছেন এবং তোমাদের সকল রোগ-ব্যাধীর জন্য প্রতিষেধকও বানিয়ে দিয়েছেন। কাজেই তোমরা চিকিৎসা করো। তবে হারাম কিছু দিয়ে চিকিৎসা করতে যেও না”। [সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৩৮৭০; সুনানে তিরমিযী, হাদিস ১৯৬১; সুনানুল কুবরা, বাইহাকী- ৫/১০]
আর অব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. মাদক সম্পর্কে বলেছেন:- إن الله لم يجعل شفاءكم فيما حرم عليكم – “নিশ্চই আল্লাহ তোমাদের জন্য যা হারাম করে দিয়েছেন, তিনি তার মধ্যে তোমাদের নিরাময় রাখেননি”। [সহীহ বুখারী, তা’লিকান: ৬/১০]
এতে বিষ্মীত হবার কিছু নেই যে, ইসলাম মদ/মাদক সহ অপরাপর হারাম জিনিসসমূহ দ্বারা চিকিৎসা করাকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম রহ. যেমন বলেছেন:- ‘কোনো কিছু হারাম হওয়াটা মূলত: তার পর থেকে সেটাকে সর্বোতভাবে পরিহার করে চলারই দাবী জানায়। মাদককে ঔষধ হিসেবে অবলম্বন করা হলে এতে ওই মাদকের মধ্যেই আষ্টেপিষ্টে থাকার প্রতি উস্কানীমূলক আগ্রহই জন্ম লাভ করবে। এতে-তো শরীয়তদাতার উদ্দেশ্যই ব্যহত হয়ে যাবে’।
তিনি আরও বলেছেন: ‘হারাম জিনিস দিয়ে চিকিৎসা করার অনুমতি দেয়া হলে তখন বিশেষভাবে ওই জিনিসের দিকেই নফ্সানী আগ্রহ ও চাহিদা বৃদ্ধি পাবে, যেটা পরিগ্রহ করে নিবে কুপ্রবৃত্তি ও নফ্সানীস্বাদ গ্রহনের পথে একটি মাধ্যম হিসেবে -বিশেষত: নফস যখন দেখতে পাবে যে, জিনিসটি (বাহ্যত:) তার জন্য ফায়দাকর, রোগ দূরিভূতকারী এবং আরোগ্য আকর্ষক একটি জিনিস! এতে করে তার মধ্যে যে ধারনাটি বৃদ্ধি পাবে, সেটা হল, বিভিন্ন ঔষধের মধ্যে সংশ্লিষ্ট হারাম ওষুধটিই তার জন্য প্রতিষেধক-নিরাময়ক’।
এ পর্যায়ে ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম রহ. একটি গুরুত্বপূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। তিনি বলেছেন:
‘কোনো ঔষধের মাধ্যমে সুস্থ্যতা লাভের একটি অন্যতম শর্ত হল, ঔষধটিকে স্বত:স্ফুর্তভাবে গ্রহন করা, ঔষধটি তার জন্য ফায়দারকর হওয়া এবং আল্লাহ তাআলা তার মধ্যে আরোগ্যের যে বরকত রেখে দিয়েছেন -সে ব্যপারে আস্থা রাখা। আর এটা জানা কথা যে, একজন মুসলমান যে জিনিসটিকে অকাট্যভাবে হারাম বলে বিশ্বাস করে, সেই জিনিসটি উপকারী ও ফলদায়ক হওয়ার বিষয়টি তার ও তার এই বিশ্বাসের মাঝে (সন্দেহ ও আস্থার দ্বন্দ্ব নিয়ে) ঘুরপাক খেতে থাকবে। ফলত: সে ওই হারাম জিনিসটিকে ভাল ধারণার সাথে স্বত:স্ফুর্ত ভাবে গ্রহণ করতে পারবেনা। বরং ইমানের প্রশ্নে যে বান্দা যতটা বলিয়ান হবে, সে ওই হারাম জিনিসটিকে ততটাই ঘৃনা করবে। ওই জিনিসের ব্যপারে তার বিশ্বাস হবে নিম্ন ও নিকৃষ্টমানের বলে। তার স্বভাব-প্রকৃতি সেটিকে একটুও পছন্দ করবে না। এমতাবস্থায় তার এই হারাম জিনিস গ্রহন কাজটি হবে খোদ্ একটি রোগ বা অসুস্থতা; কোনো ঔষধ নয়’। [যাদুল মাআদ, ইবনুল কাইয়্যেম- ৩/১১০-১১৬]
তবে এর সাথে সাথে শরীয়তের দৃষ্টিতে জরূরতের বিধানটিও বিবেচনাযোগ্য। কাজেই যদি মদ/মাদক মিশ্রীত কোনো দ্রব্য এমন কোনো রোগীর জন্য অতীব অপরিহার্য ঔষধ বা প্রতিষেধক বিবেচিত হয়, যার জীবন আশংকাজনক এবং ওই ঔষধ ছাড়া অন্য আর কোনো ঔষধ তার কাজে আসবেনা বলে যে ধারনা করা হচ্ছে -সেটাও বস্তুনিষ্ট; এবং যদি এমন কোনো বিশেষজ্ঞ মুসলীম ডাক্তার ওভাবে চিকিৎসা করার স্বপক্ষে ব্যবস্থাপত্র দেন, যিনি তার দ্বীনের ব্যপারে গায়রতমন্দ (তথা শ্রদ্ধাশীল এবং বস্তুনিষ্ঠভাবে বিশ্বাসী), তাহলে শরীয়তের নীতি যে সহজতার উপর স্থাপিত এবং যে শরীয়ত বক্রতা ও জটিলতাকে দূরীভূত করে দিয়েছে, সেই শরীয়ত এ কাজ করতে নিষেধ করে না। তবে এই অনুমতিটুকুকে যথাসম্ভব (শরীয়তের) নির্দিষ্ট ও সংকীরর্ণ সীমার মধ্যেই থাকতে হবে। إِنَّمَا حَرَّمَ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةَ وَالدَّمَ وَلَحْمَ الْخِنزِيرِ وَمَا أُهِلَّ بِهِ لِغَيْرِ اللَّهِ ۖ فَمَنِ اضْطُرَّ غَيْرَ بَاغٍ وَلَا عَادٍ فَلَا إِثْمَ عَلَيْهِ ۚ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ – “সুতরাং, যে ব্যক্তি নিরুপায় হয়ে পড়ে ; এবং তখন”। [সুরা বাকারাহ ১৭৩]
মাদক দ্রব্য
الخمر ما خامر العقل (খামরুন বা মদ/মাদক হল সেই পদার্থ, যা মস্তিষ্কে মাতালতা বা নেশা আনায়ন করে)। এই সুস্পষ্ট কথাটি বলেছিলেন হযরত ওমর বিন খাত্তাব রা. নবী করিম ﷺ এর মিম্বরে উপর আরোহনরত অবস্থায়। তিনি এ কথার দ্বারা খামরুন (মদ/মাদক)-এর অর্থ ও তাৎপর্যের একটি সীমানা এঁটে দিয়েছেন, যাতে করে প্রশ্নকারীদেরকে অধিক প্রশ্ন করতে না হয় এবং সংশয় পোষনকারীদের সংশয়ের কোনো অবকাশ না থাকে। সুতরাং, যে জিনিস মস্তিষ্কে নেশাচ্ছন্নতা ও মাতালভাব সৃষ্টি করে এবং বিচার-বিবেক ও পঞ্চেন্দ্রীয়ের স্বাভাবিক বৈশিষ্টকে হরন করে নেয়, সেটাই হচ্ছে খামরুন (মদ/মাদক); আল্লাহ ও তাঁর রাসুল ﷺ সেটাকেই কেয়ামত পর্যন্ত হারাম করে দিয়েছেন।
হাশীশ, কোকেন, আফিম এবং এ জাতীয় যে সমস্ত দ্রব্য ‘মাদক’ নামে পরিচিত -সেগুলোও এ পর্যায়েরই জিনিস। যারা এসব খেয়ে থাকে, তারা এগুলোর প্রভাব ও প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি জানে। এ সব জিনিস মস্তিষ্কের বিবেকবোধ ও বিচারশক্তির উপর অপরাপর সাধারণ জিনিসমূহ থেকে ভিন্নতর এমন সব নতুন নতুন প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে যে, সে দূরের জিনিস কে কাছে এবং কাছের জিনিসকে দূরে দেখতে পায়। সে বাস্তবতাকে ভুলে যায় এবং অবাস্তব বিষয়ের কল্পনায় বিভোর থাকে। সে সাতরে বেড়ায় স্বপ্ন আর জল্পনার সাগরে। যে ব্যক্তি মাদক ব্যবহার করে, তার সাথে এসবই ঘটতে থাকে। এসব ছাড়াও মাদক শারীরিক অবক্ষয়ের জন্ম দেয়, স্নায়ুবিক অস্থিরতা ও বিপর্যয় নিয়ে আসে, স্বাস্থ্যহানী ঘটায়। এর চেয়েও বড় কথা হল, মাদকদ্রব্য মনস্তাত্বিক দূর্বলতা, গাঠনিক শক্তিহীনতা, ইচ্ছাশক্তির অথর্বতা এবং অনুভূতিজ্ঞানের অবিশ্যম্ভাবী দূর্বলতার জন্ম দেয়। এর ফলে মাদকে অভ্যস্থ এসমস্ত মানুষ কল্যানের পরিবর্তে সমাজদেহে ব্যাপক ভাবে দংশনের ঝড় বইয়ে দিতে থাকে। এসব বির্পযয় ছাড়াও মাদকের পিছনে ব্যয় করতে গিয়ে তারা ধনসম্পদকে সর্বোতভাবে ধংস করে দেয়, পরিবারে ভাংগন ধরায়। এসবে প্রচুর ধ্বনসম্পদ খরচ হয়ে যায়। এতে করে মাদকে অভ্যস্থ ব্যক্তি তার সন্তান-সন্ততির (নির্ভর) শক্তিটুকুরও সর্বনাশ করে দেয়। কখনো কখনো অসৎ ও অসামাজিক পথে বিপথগামী হতেও সে কুন্ঠিত হয় না।
আমরা উল্লেখ করে এসেছি যে, التحريم يتبع الخبث والضرر অর্থাৎ ‘‘খবীছ ( অপবীত্র ও নিকৃষ্ট, বিভৎস ) এবং ক্ষতীকর জিনিস যেগুলো, ইসলাম সেগুলোকে হারাম ঘোষনা করে’’। এ থেকে আমাদের কাছে প্রতিভাত হয়ে ওঠে যে, মাদকের ন্যয় এ সমস্ত খবীছ, অপবীত্র ও নিকৃষ্ট জিনিস যে হারাম ও নিষিদ্ধ, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। কেননা, এসব জিনিসের শারীরিক, আত্বীক, ব্যক্তিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষয়-ক্ষতির বিষয়টি প্রমাণিত।
ইসলামের যেসকল ফুকাহায়ে কেরামের যুগে এ সমস্ত ‘খবীস’ জিনিসের প্রাদূর্ভাব ঘটেছিল, এসব নিষিদ্ধ ও নাজায়েয হবার ব্যপারে তাঁরা একমত। এ সকল ওলামায়ে কেরামের মধ্যে সর্বপ্রথম যার নাম আসে, তিনি হলেন শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রহ.। তিনি বলেছেন- هذه الحشيشة الصلبة حرام سواء سكر منها أو لم يسكر……. و إنما يتناولها الفجار ; لما فيها من النشوة و الطرب فهي تجامع الشراب المسكر في ذلك و الخمر توجب الحركة والخصومة و هذه توجب الفتور والذلة و فيها مع ذلك من فساد المزاج والعقل ; وفتح باب الشهوة ; و ما توجبه من الدياثة (فقدان الغيرة) : مما هي من شر الشراب المسكر وإنما حدثت في الناس بحدوث التتار . و على تناول القليل منها والكثير حد الشرب : ثمانون سوطا ; أو أربعون ……..ومن ظهر منه أكل الحشيشة فهو بمنزلة من ظهر منه شرب الخمر ; وشر منه من بعض الوجوه ; ويهجر ويعاقب على ذلك كما يعاقب هذا ….قال: وقاعدة الشريعة أن ما تشتهيه النفوس من المحرمات كالخمر والزنا ففيه الحد وما لا تشتهيه كالميتة ففيه التعزير . ” والحشيشة ” مما يشتهيها آكلوها ويمتنعون عن تركها ; ونصوص التحريم في الكتاب والسنة على من يتناولها كما يتناول غير ذلك… – “এই হাশীশ (এক প্রকার মাদক এবং তা) শক্ত হারাম একটি জিনিস -তাতে মাতালতা সৃষ্টি হোক, চাই না হোক।………মূলত: ফাজের (পাপী ও খারাপ লোক)-রাই এসব জিনিস সেবন করে থাকে। এতে রয়েছে বিহবল ও উত্তেজক পদার্থ। এর মধ্যে নেশা উৎপাদক মদের সদৃশ জিনিসই রয়েছে। মদ মানুষকে কলহ-বিবাদের দিকে চালিত করে। আর হাশীশের অবধারিত ক্রিয়া হল অবসাদবোধ এবং হীনমন্নতা। এর মধ্যে আরও এমন পদার্থও রয়েছে, যা জ্ঞানবোধ এবং মেজাজ-মর্জিকে বিশৃঙ্খল করে দেয়, উন্মুক্ত করে দেয় বদ প্রবৃত্তির দ্বার। তদুপরি এটি একজন মুসলীমের আত্বমর্যাদাবোধ এবং আত্বসম্ভ্রমবোধকে খুইয়ে ফেলে। এটা (কোনো কোনো দিক দিয়ে) ‘মাতালতা আনায়নকারী’ মদের চাইতেও ক্ষতিকর। বস্তুত: তাতার সম্প্রদায়ের উত্থানের মধ্য দিয়েই মানুষের মাঝে এর ব্যপক প্রচলন ঘটেছে। যে এটা সেবন করবে -পরিমান কম হোক, চাই বেশি হোক -তাকে মদ পানের শাস্তিই দেয়া বাঞ্চনীয়।…….. যার থেকে আত্বপ্রকাশ করবে যে, সে হাশীশ সেবন করেছে, মনে করতে হবে, তার থেকে মদ পান করার বিষয়টি আত্বপ্রকাশ করেছে। বস্তুত: কোনো কোনো দিক থেকে হাশীশ দ্রব্যটি মদ থেকেও খারাপ-নিকৃষ্ট। মদের ক্ষেত্রে যে শাস্তি দেওয়া হয়, সেই শাস্তি এ ক্ষেত্রেও দিতে হবে।…… (তিনি আরো) বলেছেন: ‘শরীয়তের নিয়ম এই যে, মদ এবং জেনা ব্যভিচারের মত যে সমস্ত হারাম কাজের প্রতি নফসের কামনা-বাসনা জাগ্রত হয়, সেগুলোর জন্য حد (হদ্দ)-এর ব্যবস্থা রয়েছে। অপর দিকে যেসব ব্যপারে কামনা-বাসনা জন্মায়না যেমন: মৃত ভক্ষণ করা, সে সমস্ত ক্ষেত্রে ব্যবস্থা রয়েছে তা’জিবের। বস্তুতঃ হাশীশ সেবনের পতি এতই আগ্রহ ও ললুপতা বিদ্যমান থাকে যে, তা থেকে বিরত থাকতে চাইলেও বিরত থাকা সম্ভব হয় না। বস্তুতঃ অন্যান্য মাদক সেবন হারাম হওয়া পর্যায়ে কুরআন-সুন্নাহ্’য় যেসমস্ত অকট্য দলিল-প্রমাণ রয়েছে, সেগুলো হাশীশ সেবনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য”। [ফাতাওয়ায়ে ইবনে তাইয়িব্যাহ– ৪/১৬২]
খাদ্য হোক বা পানীয় -ক্ষতিকর জিনিসমাত্রই হারাম
এক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়তে একটি সাধারণ মূলনীতি নির্ধারিত বয়েছে। মূলনীতিটি হল , ’কোনো মুসলমানের জন্যে এমন কোনো জিনিস খাওয়া বা পান করা হালাল নয়, যা তাকে দ্রুত কিংবা ধীরে ধীরে মৃত্যু মুখে পতিত করবে, (যেমন: বিষ বা এজাতীয় দ্রব্য সামগ্রী); অথবা তাকে (কোনো ভাবে) ক্ষতিগ্রস্থ করবে ও কষ্টে ফেলে দিবে’। এমনকি কোনো মুসলমানের জন্য এত অধিক পরিমান (হালাল খাদ্য) খাওয়া বা পান করাও জায়েয নয়, যা তাকে রোগী বানিয়ে দিবে। আসলে কোনো মুসলীম তার নিজের উপরও মালিকানাধীকার রাখে না। (মূলতঃ সব কিছুর মালিক হলেন একমাত্র আল্লাহ তাআলা । তাঁর নির্দেশ মতই এসব ব্যবহার করার গুরু দায়ীত্ব দেয়া হয়েছে মানুষকে; এগুলোতে কারও নিজের স্বেচ্ছাচারীতা জায়েয নয়) । একজন মুসলীম মূলত: তার দ্বীন, তার মিল্লাত, তার জীবন, তার স্বাস্থ্য এবং তার ধন সম্পদের উপর দায়ীত্বশীল। আল্লাহ তাআলা এর সব কিছুই তার কাছে আমানত স্বরূপ রেখেছেন; তাতে খেয়ানত করা তার জন্য হালাল নয়।। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন-
وَ لَا تَقْتُلُوا أَنفُسَكُمْ ۚ إِنَّ اللَّهَ كَانَ بِكُمْ رَحِيمًا
“আর তোমারা তোমাদের (নিজেদের)কে হত্যা করো না। নিশ্চই আল্লাহ তোমাদের ব্যপারে (একজন) করুনাকারী(র পরিচয় দিয়েছেন)”। [সূরা নিসা ২৯]
وَ لَا تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ
“আর তোমরা তোমাদের (নিজদের) হাতে (নিজেদেরকে) ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করো না”। [সূরা বাকারাহ ১৯৫]
রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন- لا ضرر ولا ضرار -‘নিজের ক্ষতি সাধন করা এবং অন্যের ক্ষতি সাধন করা কোনটিই জায়েয নয়’। [মুসনাদে আহমদ- ৫/৩২৬ হাদিস ২২৮৩০; সুনানে ইবনে মাজা, হাদিস ২৩৪০; সুনানে বাইহাকী- ৬/১৫৬ হাদিস ১২২২৪]
জরুরত (তথা শক্ত ঠেঁকা/প্রয়োজন) -নিষিদ্ধ জিনিসদিকে মুবাহ (অনুমোদিত) বানিয়ে দেয়
তবে ইসলাম মানুষের জীবনের বিভিন্ন জরুরত, শক্ত প্রয়োজন এবং মানবীক দূর্বলতার বিষয়টি থেকে গাফেল থাকেনি। তাই সে মানুষের চরম মাত্রার প্রয়োজন ও মানবীক দূর্বলতার প্রতি লক্ষ্য রেখে একজন মুসলীমকে এই অনুমতি দিয়েছে যে, সে যখন কোনো জরুরত পূরণে বাধ্য হয়ে যাবে, তখন সে ’হারাম’কে ততটুকু পরিমাণে গ্রহন করতে পারবে, ঠিক যতুটুকুতে তার জরুরত পূরণ হয়ে যায় এবং তাকে ধ্বংস ও ক্ষতি-ক্ষতি থেকে বাচায়; (তার বেশী নয়)।
আর একারণেই -মৃত প্রাণি, রক্ত এবং শূয়োরের গোশত খাওয়া হারাম হওয়ার কথা ঘোষণা দানের পর আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন-
فَمَنِ ٱضْطُرَّ غَيْرَ بَاغٍ وَلَا عَادٍ فَلَآ إِثْمَ عَلَيْهِ ۚ إِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
“তবে যে ব্যক্তি অনন্যোপায় হয়ে পড়ে (এমতাবস্থায় যে, সে আসলে এসব হারাম জিনিস ভক্ষনের ব্যপারে মোটেই আগ্রহী নয়। তদুপরি বাধ্যহয়ে ভক্ষন করতে গিয়ে ভক্ষনে জরুরতের তুলনায়) বাড়াবাড়িও করে না, সীমালঙ্ঘনও করে না, তাহলে তার উপর কোনো গোনাহ বর্তাবে না। নিশ্চই আল্লাহ ক্ষমাশীল দয়ালু”। [সূরা বাকারাহ ১৭৩]
এ মর্মের ঘোষনা কুরআন মজিদের চারটি সুরাতে বর্ণিত হয়েছে, যার প্রত্যেকটিতেই হারাম খাদ্যাদির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এসকল আয়াত এবং এরকম আরো কিছু আয়াত থেকে ইসলামের ফিকাহবীদগণ একটি গুরুত্বপূর্ন মূলনীতি নির্ধারন করেছেন-
إن الضرورات تبيح المحظورات
অর্থাৎ ‘‘জরুরত -নিষিদ্ধ জিনিষাদিকেও মুবাহ ( অনুমোদীত ) বানিয়ে দেয়’’।
তবে এখানে যে বিষয়টি প্রনিধানযোগ্য, তা এই যে, আয়াতগুলোতে ‘ঠেঁকে যাওয়া বা নিরুপায় হওয়া’ পর্যায়ের যেসকল লোকদের কথা বলা হয়েছে, তাদেরকে এই শর্ত দেয়া হয়েছে যে, তারা (হারাম জিনিসটির প্রতি মনের দিক থেকে) আকাঙ্খিতও হতে পারবে না, (তা গ্রহনে) স্বীমালঙ্ঘনও করতে পারবে ন। এ কথাটিকে এভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, সংশ্লিষ্ট জিনিসটির স্বাদ গ্রহন করা এবং তা পাওয়ার আকাঙ্খা -তার লক্ষ্য হতে পারবে না; দ্বিতীয়ত: পরিতৃপ্ত হতে গিয়ে সীমালঙ্খন করতে পারবে না, বরং ঠিক জরুরতের সীমা পর্যন্তই সেটাকে সীমাভুক্ত রাখতে হবে। এ শর্ত থেকে ফিকাহবীদগণ আরেকটি মূলনীতি নির্ধারন করেছেন। সেটি হল-
الضرورة تقدر بقدرها
অর্থাৎ ‘‘ জরুরতই নির্ধারন করবে (হারাম জিনিসটির) ব্যবহারের পরিমাণ’’।
একথা ঠিক যে, মানুষকে (তার) জরুরতের দাবীর কাছে (অনেক সময়) আত্বসমর্পণও করতে হয়। কিন্তু তাই বলে তার কাছে সম্পূর্ণরূপে সপে দেয়া এবং নিজের নফসের রশি’কে নফসের কাছে নিক্ষেপ করে দেয়া কাম্য হতে পারে না। বরং তার অপরিহার্য কর্তব্য হল, সে জোর করে মূল হালালের অনুসন্ধিৎসু হয়ে তা দিয়েই কাজ চালাবে; হারামের মধ্যেই অবিচল হয়ে থাকবে না কিংবা জরুরত পূরণ করতে গিয়ে হারামকে একটি সুযোগ হিসেবে নেবে না।
জরুরত সমূহের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ জিনিসগুলোর অনুমতি দিয়ে ইসলাম আসলে তার স্বাভাবিক ভাবধারা এবং সামগ্রীক নীতিমালারই প্রতিফলন ঘটিয়েছে। আর সেটা হচ্ছে তার সহজতা’র মূল স্বভাব-প্রকৃতি, যা কাঠিন্যতাকে তার সাথে মিশ্রীত হতে দেয় না, যা এই উম্মাহ’র উপর থেকে সেই ভারী বোঝাটিকে নামিয়ে দিয়েছে, যে বোঝাটি ছিল ইতিপূর্বেকার উম্মতদের উপর। আল্লাহ ত’আলা সত্যই বলেছেন-
مَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيَجْعَلَ عَلَيْكُم مِّنْ حَرَجٍ وَلَٰكِن يُرِيدُ لِيُطَهِّرَكُمْ وَلِيُتِمَّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ
‘‘আল্লাহ তাআলা তোমাদের উপরে জটিলতার কিছু চাপিয়ে দিতে চান না, বরং তিনি চান তোমাদেরকে পাক-পবিত্র করতে এবং তোমাদের উপর তাঁর নেয়ামতকে সুসম্পন্ন করতে। যাতে করে তোমরা শোকরগুজার হতে পারো”। [সূরা মায়েদা ৬]
يُرِيدُ ٱللَّهُ أَن يُخَفِّفَ عَنكُمْ ۚ وَخُلِقَ ٱلْإِنسَٰنُ ضَعِيفًا
“আল্লাহ তোমাদের থেকে বোঝা হালকা করে দিতে চান। আর মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে দূর্বলরূপে”। [সূরা নিসা ২৮]
কোনো কোনো ফিকাহবীদ ওলামায়ে কেরাম জরুরতের বিষয়টিকে বিবেচনায় নিয়েছেন এবং ঔষধের ব্যপারটিকে খাদ্য-খাবারের ন্যয়ই গনণ্য করেছেন। মূলতঃ জীবনের স্থায়ীত্ব ও কল্যান-ব্যবস্থার জন্য এ দুটো জিনিষই অত্যাবশ্যক। যেসকল ওলামায়ে কেরাম নিষিদ্ধ জিনিস দিয়ে চিকিৎসা করার অনুমতি দিয়েছেন, তাঁরা এর স্বপক্ষে এই হাদিস দ্বারা দলিল দিয়েছেন যে, নবী করিম ﷺ -আব্দুর রহমান বিন আওফ রা. এবং যুবায়ের বিন আওয়াম রা.-কে তাদেও খোঁচপাচড়া (চর্ম রোগ)-এর জন্য রেশমী পোশাক ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছিলেন -যদিও বা (সাধারন অবস্থায়) রেশমী পোশাক পরিধান করতে নিষেধ করা হয়েছে এবং রেশমী পোশাক পরিধানকারীর উপর সাবধানবাণী এসেছে।